ভবঘুরেকথা
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য

বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য : এক

-সুকুমারী ভট্টাচার্য

ভূমিকা

সংশয় ও নাস্তিক্যের মধ্যে প্রকৃতিগত, ব্যাপ্তিগত এবং মাত্রাগত পার্থক্য আছে। সব সংশয় নাস্তিক্য থেকে আসে না। আবার মূল নাস্তিক্যও সংশয়ের চেয়ে গভীর ও ব্যাপক। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আস্তিকেরও সংশয় থাকতে পারে। সংশয় পরিসরে ছোট, গভীরতাতেও তাঁই। নাস্তিকের সংজ্ঞা হল ঈশ্বরাপ্রামাণ্যবাদী’ অর্থাৎ যে ঈশ্বরকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে না, এবং ‘বেদাপ্রামাণ্যবাদী’ অর্থাৎ বেদকে প্রামাণ্য বলে মানে না।

এ ছাড়া উপনিষদে দেখি, যে পরলোকে বিশ্বাস করে না সে-ও নাস্তিক। পরলোক মানে শুধু স্বর্গনরক নয়, পরলোক থাকতে গেলেই মরণোত্তর আত্মা থাকতে হবে। তাই যে পরলোক নয়, শুধু ইহলোককেই স্বীকার করে সে-ও নাস্তিক। পরলোককে স্বীকার করলেও ঈশ্বরকে স্বীকার নাও করা যেতে পারে, এবং এ দুটি স্বীকার করেও বেদের প্রামাণ্যতা যে মানে না সে-ও নাস্তিক।

হেমচন্দ্রের অভিধান বলে, নাস্তিকের প্রতিশব্দ হল, বার্হস্পত্য, চার্বক ও লোকায়তিক। যে নাস্তি’ শব্দ থেকে নাস্তিক শব্দের বুৎপত্তি, তার তিনটি অর্থ হতে পারে: যে ঈশ্বর মানে না, যে পরলোক মানে না এবং যে বেদের প্রামাণ্য মানে না। দেখা যাচ্ছে ঈশ্বর, পরলোক ও বেদে বিশ্বাস পরস্পর-নিরপেক্ষ; তা হলে বোঝা যাচ্ছে যে, এ তিনটিই ছিল বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তিনটি মূল স্তম্ভ।

পরবর্তীকালে বুদ্ধের আগে যে সব বেদবিরোধী প্রস্থানের উদ্ভব হয়েছিল, তারা সকলেই বেদের প্রমাণ্যে অবিশ্বাসী, ঈশ্বরের অস্তিত্বেও আস্থাহীন। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই পরলোকে বিশ্বাসী; এর সঙ্গে বৌদ্ধ, জৈন ও আজীবিকরাও আছেন। অথচ এই পরলোক নিয়ে ব্রাহ্মণসাহিত্য, আরণ্যক ও উপনিষদে নানা সংশয়। শাস্ত্রমতে এ সংশয়ও নাস্তিক্য, তবে এ নাস্তিক্যের সংজ্ঞা শুরু হয় উপনিষদে।

ধ্রুপদী নাস্তিক

এই কালবিন্দুতে ধ্রুপদী নাস্তিক আবির্ভূত হন। তাঁদের সম্পর্কে সমাজের তীব্র তিক্ততাতেই বোঝা যায় কোনও একটি সুসংহত ছকে এঁরা আর পরস্পর-সাপেক্ষতায় সম্পূক্ত নন। এর প্রাথমিক সূত্রপাত কিন্তু পৃথিবীর ভোগ্যসামগ্রী নিয়ে পারস্পরিক নির্ভরতা থেকে। নাস্তিক্যের ইংরেজি ‘এথিইজম, এ শব্দটির বুৎপত্তি, a-theos থেকে অর্থাৎ অনীশ্বর’ বা ঈশ্বর না মানা’।

একেশ্বরবাদী খ্রিস্টধর্মে আত্মা ও পরলোক ঈশ্বর-সমর্থিত তত্ত্ব, অতএব ঈশ্বরকে না মানার সঙ্গেই এগুলো সম্পূক্ত ছিল। কিন্তু ভারতবর্ষে এই তিনটি তত্ত্ব: বেদ, ঈশ্বর ও পরলোক পৃথক ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ কেউ এর মধ্যে দুটিকে বিশ্বাস করে, কেউ একটিকে, কেউ-বা কোনওটিকেই বিশ্বাস করে না; যদিও এখানেও পরবর্তী যুগে এই তিনটি পরস্পর-সম্পূক্ত হয়ে যায়।

উপনিষদে স্বপ্ন ও জাগ্রৎ অবস্থার প্রসঙ্গে বারবার বলা হয়েছে স্বপ্নে মানুষ বহু অবাস্তব বিষয় দেখে। পরে জেগে উঠে জানতে পারে যে, সে-দেখাগুলো সম্পূর্ণ অলীক এবং যে-জগতে জেগে ওঠে সেটাই বাস্তব। তা হলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ বাস্তব জগতের আপেক্ষিক সত্যতাই স্বীকার করা হল।

এবং বেদ বলতে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ-উপনিষদই বোঝাত না, তার সঙ্গে যজ্ঞও বোঝাত, যেটা বেদের প্রায়োগিক দিক। এই যজ্ঞ সম্বন্ধে সংশয় এবং অনীহাও নাস্তিক্যেরই একটি প্রকাশ বলে মনে করা হত। যজ্ঞের নানা প্রবক্তা ছিল, নানা গোষ্ঠী ও তার নানা রূপভেদ ও বিবর্তন ঘটেছিল; কিন্তু এ সবের বাইরে উত্তর ভারতে নানা বিকল্প বুপের মধ্যেও একটি বিমূর্ত যজ্ঞ’ ব্যাপার মানুষের চেতনায় ও আচরণে ছিল। নাস্তিকের ঔদাস্য ও অনাস্থ্য এই যজ্ঞ ব্যাপারটাকে অবলম্বন করেই।

‘যজ্ঞতত্ত্ব অপরিহার্যরূপে বেদের প্রতীকী, এমনকী বেদের বিবক্ষিতের সারবস্তু বলেই স্বীকৃত ছিল। তাই বেদোক্ত যজ্ঞক্রিয়াকে না মানাও নাস্তিক্য। তখন আস্তিক গার্হস্থ্য আশ্রমে থেকে নানা যজ্ঞক্রিয়া করবে, এইটেই ছিল সামাজিক অনুশাসন; তার বিরুদ্ধাচরণ সমাজ সম্পর্কে একটা প্রতিস্পর্ধা, এবং সে-সমাজ তো শাসিত হত এই বেদ দিয়েই। কাজেই এই বিরুদ্ধাচরণ নাস্তিক্য বলেই অভিহিত হত।

ক্রমে পরস্পর সংঘর্ষে উত্তীর্ণ হওয়া। যজ্ঞকারী ও নাস্তিক উভয়েই (যজ্ঞ) কর্ম অর্থে গোষ্ঠীগত আনুষ্ঠানিক আদানপ্রদান-নির্ভর কর্মকে পরিহার করে, উভয়ের পার্থক্য হল, বেদের ব্যক্তিগত কর্মের সত্য মিথ্যা বিষয়ে বেদের সার্বভৌম অনুজ্ঞা-যজ্ঞকারী (ও তার আস্তিক বংশধর) মানুষের লোক্যতীত স্তরে উত্তরণের জন্যে লোকাতীত অনুশাসনের কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতা সমর্পণ করে।

অপরপক্ষে, নাস্তিক্য লোকতীতকেই বিসর্জন দেয়–ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্যে।’[১] কর্মকাণ্ডের শেষ দিকে বৈদিক সাহিত্যে দেহাতীত আত্মা দেখা দেয়; যজ্ঞেও পৃথিবীর ভোগ্যসামগ্রীর অনেকটাই ভাগ হত পুরোহিত ও যজমানের মধ্যে। পরে যখন আত্মার কল্পনা উদিত হল। তখন যজ্ঞকারীরা যজ্ঞতত্ত্বের দ্বারা লোক্যতীত সত্তায়–আত্মায় উত্তরণ করলেন এবং এইখানে ঘটল নাস্তিকের সঙ্গে তার মৌলিক বিচ্ছেদ।

বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করতে গিয়ে সে তার ব্যক্তিসত্তার অর্থাৎ স্বাধীন চিন্তার অধিকার বিসর্জন দিল লোকাতীত তত্ত্বের কাছে। আর নাস্তিক সেই লোক্যতীতত্ত্বকে বিসর্জন দিল ব্যক্তিসত্তার নিজস্ব চিন্তার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার জন্যে। ব্যক্তিচিন্তার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার দুটি প্রধান অর্থ: বেদের প্রামাণ্য যেহেতু প্রত্যক্ষ নয়, অর্থাৎ দেবতা, যজ্ঞ, ধর্মাচরণ নিয়ে বেদ যত কথা বলছে তা যেহেতু প্রত্যক্ষ নয়।

তাই তা বিসর্জিত হল এবং পরে এরই সঙ্গে বিসজিত হল দেহব্যাতিরিক্ত আত্মা। বিনিময়ে তার চিন্তার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকল, অর্থাৎ যে-বিশ্বাসের স্বপক্ষে কোনও গ্রহণযোগ্য যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে অনায়াসে পরিহার করা হল।

উপনিষদে স্বপ্ন ও জাগ্রৎ অবস্থার প্রসঙ্গে বারবার বলা হয়েছে স্বপ্নে মানুষ বহু অবাস্তব বিষয় দেখে। পরে জেগে উঠে জানতে পারে যে, সে-দেখাগুলো সম্পূর্ণ অলীক এবং যে-জগতে জেগে ওঠে সেটাই বাস্তব। তা হলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ বাস্তব জগতের আপেক্ষিক সত্যতাই স্বীকার করা হল।

আস্তিক, নাস্তিক, সংশয়ী

প্রত্যক্ষ মানে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, তাকে স্বীকার করতে গেলে বেদের অতিলৌকিক অনুজ্ঞা স্বীকার করা যায় না। বহু প্রস্থানই বেদের প্রামাণ্যতা মানতে পারেনি। এগুলির মধ্যে প্রধান হল বৌদ্ধমত। আত্মা ও পরলোক মানলেও বৌদ্ধধর্ম বেদকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেনি, যজ্ঞকেও অস্বীকার করেছে। যখন ঐতিহ্যের অভ্যস্তরীণ প্রস্থানিক বস্তু বিপর্যস্ত হচ্ছে তখনই বাইরের (বাহ্য) ও বিরুদ্ধ (নাস্তিক) বৌদ্ধমতের প্রতিস্পর্ধার বিরুদ্ধে বেদকে উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে।…

ঐতিহ্যগত (আস্তিক) ও ঐতিহ্যবহির্ভূত (নাস্তিক) মতের পার্থক্য হল ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে সবচেয়ে মৌলিক ও পরিচিত লক্ষণ। ঐতিহ্যবাহিত ভারতীয় স্তোত্রসাহিত্যে যেমন, তেমনই অধুনাতন ভারতীয় দর্শনের সমীক্ষাতেও স্পষ্ট ’।[২]

সে বলে, কিছু আছে কি না বা কেউ আছে কি না। আমি জানি না, জানা যায়ও না। তার জ্ঞানে দোলাচলতা নেই, থাকা-না-থাকা সম্বন্ধে তার না জানাটা খুবই দ্ব্যর্থহীন: সে নিশ্চিত জানে যে, সে নিশ্চিত ভাবে কিছুই জানে না। থাকা ও না-থাকার উভয়মুখী সম্ভাবনাকে সে স্বীকার করে মাত্র; এবং প্রচ্ছন্ন ভাবে সে নিশ্চিত ভাবে জানে না, কিছু আছে কি না, থাকলেও জানা সম্ভব কি না।

‘প্রাচীন গ্রিক ভাষাতেও নাস্তিকতার সংজ্ঞা আদিতে শুধু ঈশ্বরে (অর্থাৎ দেবদেবীতে) অবিশ্বাসীকেই বোঝাত না, ঈশ্বরে বিশ্বাস করুক বা না করুক, রাষ্ট্রের সর্বস্বীকৃত দেবতাদের (অস্তিত্বে) অবিশ্বাসীকেও বোঝাত।[৩] রোম সাম্রাজ্যে (নাস্তিক) খ্রিস্টান অজ্ঞেয়বাদীদের বোঝাত।’ দর্শনের কোশগ্রন্থ বলে: ‘সংশয়বাদ একটি সমালোচনা শ্রয়ী দার্শনিক মনোভাব হিসেবে জ্ঞানের নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে দার্শনিকদের ও অন্যদের যে দাবি, তাকে প্রশ্ন করে।[৪]

গ্রিক ‘স্কেপটিকস’ শব্দটি অনুসন্ধিৎসু এই অর্থ বহন করে; সংশয় শব্দটির অর্থ অনুসন্ধান। কোনও নিশ্চিত বিশ্বাসের অভাবই সুচিত করে ‘সংশয়’। ইংরেজি doubt শব্দটি বুৎপত্তির দিক থেকে double শব্দটির সঙ্গে অন্বিত, অর্থাৎ এর মুখ্য অর্থ দ্বিত্ব, ‘এটাও হয়, হয়তো। ওটা-ও হয়’–এই মনোভাব। লাতিন dubits প্রাচীন লাতিন dubo, জার্মান zweifel-এ সবের অর্থ দ্বিত্বতা, অর্থাৎ স্থির সিদ্ধাস্তের অভাব, দোলাচলতা।

তা হলে প্রাচীন গ্রিক, লাতিন, জার্মান সংশয়ের বুৎপত্তিগত অর্থ হল, দ্বিধা, অর্থাৎ নিশ্চয়তার অভাব। এর এক প্রান্তে আছে বিশ্বাস, যার মধ্যে অন্তর্নিহিত দৃঢ়তা, স্থিরতা, অসংশয়িত প্রত্যয়। অপর প্রান্তে আছে ঠিক তার বিপরীত মনোভাব: অবিশ্বাস ও নাস্তিক্য; এর মধ্যেও আছে দৃঢ়তা ও অসংশয়। আস্তিকের যেমন দ্বিধা নেই যে, ঈশ্বর, পরলোক, আত্মা, বেদ সবই আছে এবং সবই প্রামাণ্যক, অসংশয়িত, ঠিক তেমনই নাস্তিকের চিন্তাতেও কোনও যথার্থ দ্বিধা নেই।

আস্তিকের মতোই নাস্তিকেরও কোনও সংশয় নেই; সে সংশয়ী নয়, বরং নিশ্চিতই জানে বেদ, আত্মা, পরলোক, ঈশ্বর বা দেবতারা কেউই, কিছুই বাস্তবিক পক্ষে নেই বা প্রমাণসিদ্ধ নয়। এ কল্পনাগুলি তার জীবনচর্যায় অকিঞ্চিৎকার, নিরর্থক এবং বাস্তবে নিম্প্রয়োজন। অর্থাৎ আস্তিক ও নাস্তিক দুজনেরই তত্ত্বগত অবস্থান ইতিবাচক, এবং স্পষ্ট; শুধু সংশয়ীর অবস্থান ইতি-নেতিবাচক, অতএব অস্পষ্ট। অজ্ঞেয়বাদীর অবস্থানও ইতি-নৌতির মধ্যবতী, কিন্তু স্পষ্ট।

সে বলে, কিছু আছে কি না বা কেউ আছে কি না। আমি জানি না, জানা যায়ও না। তার জ্ঞানে দোলাচলতা নেই, থাকা-না-থাকা সম্বন্ধে তার না জানাটা খুবই দ্ব্যর্থহীন: সে নিশ্চিত জানে যে, সে নিশ্চিত ভাবে কিছুই জানে না। থাকা ও না-থাকার উভয়মুখী সম্ভাবনাকে সে স্বীকার করে মাত্র; এবং প্রচ্ছন্ন ভাবে সে নিশ্চিত ভাবে জানে না, কিছু আছে কি না, থাকলেও জানা সম্ভব কি না।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের গ্রিসে তার্কিক সম্প্রদায়ের বক্তব্য, ‘যে পৃথিবীটা সকলের পক্ষেই একই রকমের সেটি কোনও দেবতা বা মানুষ সৃষ্টি করেনি; সেটি বরাবরই ছিল, এখনও আছে এবং চিরকালই থাকবে।’[৬] এমন কথা মনে করলে সৃষ্টিকর্ম ও সৃষ্টিকতাঁর প্রশ্নটা চলে যায়, থাকে শুধু সৃষ্টিটাই, এবং সেটা প্রত্যক্ষ অতএব সংশয়াতীত।

ঠিক এই অবস্থান প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে কোথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। কিন্তু মাঝে মাঝে ‘কে জানে’। এ ধরনের বাক্যাংশ থেকে অজ্ঞেয়বাদের আভাস পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে স্পষ্ট আস্তিক্য, স্পষ্ট নাস্তিক্য এবং স্পষ্ট সংশয়ের প্রকাশই বেশি পাওয়া যায়।

গ্রিসের মতো প্রাচীন ভারতবর্ষেও যজ্ঞক্রিয়াই ধর্মাচরণ ছিল বলে যজ্ঞে ও তৎসংশ্লিষ্ট দেবদেবীতে অবিশ্বাসই ছিল নাস্তিক্য। নাস্তিক্য খুব ব্যাপক শব্দ, এক দিকে কোনও একজনের মনে বিশ্বাসের জগতের সমগ্র ব্যাপারটা নিয়ে আমূল অবিশ্বাস জন্মায় কদাচিৎই। কিন্তু খণ্ড খণ্ড বিক্ষিপ্ত ব্যাপারে, যজ্ঞপ্রিক্রিয়ায়, বিশেষ বিশেষ দেবতা সম্বন্ধে, তাদের উৎপত্তি, অস্তিত্ব, কার্যক্ষমতা,

যজ্ঞক্রিয়ার যথার্থ সম্বন্ধে অবিশ্বাস বহু মানুষের মনেই জগতে পারে। এ ধরনের সংশয় সংহিতা ব্রাহ্মাণে, অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের সাহিত্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে বহুবার ব্যক্তি হয়েছে; এগুলি সংশয়, যদিও এর মধ্যে কিছু কিছু নাস্তিক্যের ধারঘেষা। নেম ভার্গব যখন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ দেবতা ইন্দ্র সম্বন্ধে অসংশয়িত উচ্চারণ করেন, ইন্দ্রকে কে জন্মাতে দেখেছে?

বলছেন, ইন্দ্র বলে কেউ নেই- তখন সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এটা খণ্ড সংশয় থেকে অখণ্ড নাস্তিক্যে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। কারণ তখন ধর্ম হল যজ্ঞ এবং যজ্ঞের মুখ্য দেবতাই ইন্দ্র, কাজেই ইন্দ্র নেই’ বলা সংশয়কে ছাড়িয়ে নাস্তিক্যের পর্যায়ে চলে যায়।

এ দেশে বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব থেকেই সাহিত্যে বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি নানা অংশ নিয়ে সংশয়ের প্রকাশ দেখা গেছে। বেদে যা আছে তার বাইরেও অন্যান্য সংশয়ের প্রকাশ গণমানসে নিশ্চয়ই ছিল, কারণ বেদে সমগ্র গোষ্ঠীর বিশ্বাস বা সংশয়ের সমস্ত অনুপুঙ্খ নিশ্চয়ই বিধৃত নেই, মোটের ওপর বেদ জনসাধারণের ধর্মাচরণ ও তার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পটভূমিকার একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সাহিত্য।

তবু তার মধ্যেও অবিশ্বাসের নানা চিহ্ন আছে–দেবতাদের স্বরূপ, আচরণ, অভিপ্রায়, ক্ষমতা এবং যজ্ঞকর্মের যথাযথ্য সম্পর্কে সন্দেহে। সংহিতা থেকে উপনিষদে পৌছোনোর পথ-পরিক্রমায় সংশয়গুলি বাড়ছিল–সংখ্যায়, প্রকারে, গভীরতায় এবং ব্যাপকতায়।

যদিও বিশ্বাস ও তত্ত্বের বিবর্তনের, নিজস্ব ক্রম থাকে, তবু মোটের ওপরে জীবন ও জীবিকার ভিত্তিউৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার সঙ্গে তার একটি অঙ্গাঙ্গি যোগ থাকে, কারণ উৎপাদন অর্থাৎ সমাজের অবগঠন বহুলাংশে সমাজের মানসিক অধিগঠনকে নিবৃপণ করে।

মানুষের অবচেতনে প্রত্যাশা থাকে যে, ‘তাঁর জীবনের ভিত্তিগত গঠনে পুরো অথবা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশগুলি তার বোধগম্য হবে এবং তার কর্মপ্রচেষ্টার নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে।’[৫] এই প্রত্যাশাকে চুর্ণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা। মানুষ আবিষ্কার করে যে, তার জীবনের অবগঠনের অনেকটাই তার বোধের এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তখনই দেখা দেয় সংশয়–তার জানা জগতের অংশবিশেষ সম্বন্ধে এবং সৃষ্টি সম্বন্ধে; সে সংশয় সমগ্র জগৎ সম্পর্কে।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের গ্রিসে তার্কিক সম্প্রদায়ের বক্তব্য, ‘যে পৃথিবীটা সকলের পক্ষেই একই রকমের সেটি কোনও দেবতা বা মানুষ সৃষ্টি করেনি; সেটি বরাবরই ছিল, এখনও আছে এবং চিরকালই থাকবে।’[৬] এমন কথা মনে করলে সৃষ্টিকর্ম ও সৃষ্টিকতাঁর প্রশ্নটা চলে যায়, থাকে শুধু সৃষ্টিটাই, এবং সেটা প্রত্যক্ষ অতএব সংশয়াতীত।

বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সংশয়

উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত ছাড়া আর কোনও দর্শনপ্রস্থানই প্রত্যক্ষকে অস্বীকার করেনি। এরাও স্বপ্নকে অলীক ও অবাস্তব এবং জাগ্রৎ অভিজ্ঞতাকে বাস্তব বলে স্বীকার করে প্রত্যক্ষকে অন্তত একটা আপেক্ষিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ভূতাবাদী (যারা প্রত্যক্ষ জীবন ও জীবিতকেই স্বীকার করে, আত্মাকে নয়), পরমাণুবাদী (বৈশেষিক, যারা পরমাণুকে সৃষ্টির সূক্ষ্মতম উপাদান বলে), লোকায়ত, সাংখ্য ও ন্যায়-প্রস্থান সকলেই প্রত্যক্ষকে অবিসংবাদিত সত্তা বলে স্বীকার করে।

বেদের যুগে দৃশ্য বা দৃষ্ট বস্তু নিয়ে কারও কোনও সংশয় ছিল না। যা অতীতে ঘটেছে বলে মনে করা হত, অর্থাৎ প্রত্যক্ষের অগোচরে, সেই সব ব্যাপার নিয়ে সংশয় ছিল, যেমন বিশ্বসৃষ্টি বা দেবতাদের উৎপত্তি।

এ ছাড়া সংশয় ছিল যজ্ঞ নিয়ে; কোন যজ্ঞে কী ফল পাওয়ার কথা তা বলাই ছিল। যজ্ঞ করেও প্রত্যাশিত ফল না পেলে স্বভাবতই সংশয় জাগে যজ্ঞের প্রক্রিয়া, দেবতাদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা, দেবতাদের যজ্ঞফল দেওয়ার ক্ষমতা, ইচ্ছা এবং শেষত, তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও। অবশ্যই, কাকতালীয় হিসেবে কিছু কিছু যজ্ঞের ফল পাওয়া যেত। কাজেই এ নিয়ে সংশয় ব্যাপক, গভীর বা সার্বত্রিক হতে পারত না।

কিন্তু যে-মানুষ জীবনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে গভীর ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত এবং এ দ্বিধায় যার মমর্যন্ত্রণা আছে তার পক্ষে ঔদাস্য তো সম্ভব নয়, তার পক্ষে এ-সিদ্ধান্ত জীবনমরণের সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। তবে সংশয়, অজ্ঞেয়বাদ ও নাস্তিক্য এ তিনটির ভিত্তিভূমি। শুধু জ্ঞান নয়, বিশ্বাসও, যেটি উপলব্ধির স্তরে অনুভূতির প্রাস্তবতীর্ণ। এবং জ্ঞান ও বিশ্বাসের দুইয়েরই সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পূক্ত।

তবু যত দিন যাচ্ছিল তত নিৰ্ম্মফল যজ্ঞের সংখ্যা বাড়ছিল এবং সংশয়ও বাড়ছিল। যজ্ঞে ফল দেওয়ার প্রতিশ্রুতির দায়িত্ব দেবতাদেরই, সেই ভরসাতেই অত স্তোত্র হব্য দিয়ে তাদের আরাধনা। ‘ফল না হলে জন্মায় একটা আততি (tension); (সৃষ্ট হয়) দিব্য অঙ্গীকার এবং এর প্রকাশ্য ব্যর্থতা, অন্য আততিটি হল ঈশ্বরের ইচ্ছা, তার দিব্য পথনির্দেশ ও মানবিক স্বাধীনতা।

মানুষের বিরুদ্ধাচরণ করবার ক্ষমতা… পরিনির্দিষ্ট ছক ও বিশৃঙ্খলা, দিব্য নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা–এ দুটি দ্বান্দ্বিকতা।’[৭] দৈব শৃঙ্খলা, দেবতাদের নিয়ন্ত্রণ এ সব মানতে হলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় এ সবের ব্যত্যয়, অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা, নানা ধরনের বিপর্যয় এ সবের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না; ফলে মানুষ সুপরিনির্দিষ্ট দিব্য আকল্পের পৃথিবীতে দেবতাদের প্রতিশ্রুত যজ্ঞফল না পেলে ধাক্কা খায়, তার জানার জগতে এর ব্যাখ্যা মেলে না, তখনই জাগে সংশয়।

শুধু প্রত্যাশিত যজ্ঞফল না পাওয়া নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতায় নানা বিরুদ্ধ, ক্ষতিকর অভিজ্ঞতাও তো আছে: খরা-বন্যা-পঙ্গপাল, ব্যাধি-জরা-মৃত্যু, প্রিয়বিচ্ছেদ, ইষ্টলাভে বঞ্চনা, ইত্যাদি বিভিন্ন অগ্রীতিকর তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে মানুষ বুঝে যায় যে, বিশ্ববিধান তার পক্ষে সততই মঙ্গলময় নয়, প্রায়ই দুঃখজনক। দেবতা-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বপ্রকৃতির ওপরে ভরসা রাখা চলে না।

‘প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ যদি সর্বব্যাপী হয়, তা হলে যা কিছু ক্ষতি ও যন্ত্রণ ঘটায় তাকে (এ ভাবে) ব্যাখ্যা করতে হবে যে, সব কিছু জানা থাকলে সেটিকে মানুষের পক্ষে হিতকর বিধাতৃগোষ্ঠী অথবা সর্বমঙ্গলময় বিশ্ববিধান কোনওটাই নিজের উপলব্ধিতে বা বুদ্ধিতে মানুষ পায় না; তাই জাগে সংশয়, যার একটি পরিণতি নাস্তিক্য। সংশয়মাত্রই নাস্তিক্যের জন্ম দেয় না।

কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে বহু মানুষের চেতন ও অবচেতন মনে বহু যজ্ঞের নিষ্ফলতা, বহু সামাজিক বঞ্চনা, দারিদ্র্য, অত্যাচারের পুঞ্জিত স্মৃতি কোনও কোনও চিন্তাশীল মানুষের মনে সৃষ্টি করত। সমস্ত বিশ্ববিধান সম্বন্ধে গভীর অবজ্ঞা; বিধাতা বা যজ্ঞে-আরাধ্য দেবদেবীদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে এই ব্যাপক সর্বাত্মক সংশয়ের একটি পরিণতি নাস্তিক্য।

সংশয় ও নাস্তিক্যের অন্তর্বতী একটি অবস্থার নাম অজ্ঞেয়বাদী (agnosticism), অর্থাৎ বিধাতা বা দেবদেবীরা আছেন কি না সে-বিষয়ে নিজের জ্ঞানের ও বিশ্বাসের অভাব, এবং জ্ঞানের এই অভাবের প্রকাশ্য স্বীকৃতি: ‘কেউ কোথাও আছেন কি না জানি না, অর্থাৎ থাকতেও পারে, না থাকতেও পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই।’ এ অবস্থা সংশয়ের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে, কিন্তু পূর্ণ নাস্তিক্য এটা নয়।

গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাসের ভাষায়: ‘দেবতাদের বিষয়ে আমি জানতে পারি না, তারা আছেন কী নেই, কিংবা কেমন তাদের আকৃতি; কারণ জ্ঞানকে প্রতিহত করে অনেকগুলি বিষয়: জ্ঞেয় বিষয়টির দুর্বোধ্যতা এবং মনুষ্যজীবনের স্বল্পায়ুতা।’[৯] অজ্ঞেয়বাদের ভিত্তি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।

এতে দু-ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে; প্রথমত, নিশ্চিত বিশ্বাসের অভাবে মমর্যন্ত্রণা এক ধরনের আত্মিক নিরালম্বতা; দ্বিতীয়ত, সমস্ত ব্যাপারটা সম্পর্কেই অনীহা ঔদাসীন্য। অর্থাৎ আমি যখন খেয়েপরে ভাল ভাবেই বেঁচে আছি তখন ভগবান থাকুন বা না থাকুন আমার কিছু এসে যায় না। এ ঔদাসীন্য সংশয়ের অন্তরালেও প্রচ্ছন্ন থাকতে পারে, নাস্তিক্যেও থাকতে পারে।

কিন্তু যে-মানুষ জীবনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে গভীর ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত এবং এ দ্বিধায় যার মমর্যন্ত্রণা আছে তার পক্ষে ঔদাস্য তো সম্ভব নয়, তার পক্ষে এ-সিদ্ধান্ত জীবনমরণের সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। তবে সংশয়, অজ্ঞেয়বাদ ও নাস্তিক্য এ তিনটির ভিত্তিভূমি। শুধু জ্ঞান নয়, বিশ্বাসও, যেটি উপলব্ধির স্তরে অনুভূতির প্রাস্তবতীর্ণ। এবং জ্ঞান ও বিশ্বাসের দুইয়েরই সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পূক্ত।

তার অর্থ, এর পরে যে সব যজ্ঞের অনুষ্ঠান হচ্ছিল সাধারণ মানুষ তার সঙ্গে সুপরিচিত ছিল। এর ফলে মানুষ একটু দূর থেকে মিলিয়ে দেখতে লাগল যজ্ঞ থেকে যে-ফল পাওয়ার কথা তা পাওয়া যায় কি না। যখন হিসেব মিলিছিল না। তখন নানা ভাবে নানা সংশয় মানুষের মনে উদ্রিক্ত হচ্ছিল এবং তৎকালীন ও তার পরবর্তী শাস্ত্রে–সংহিতা ব্রাহ্মণ ও উপনিষদে- উচ্চারিত হয়ে স্থায়ী ভাবে বিধৃত রইল।

এবং ঠিক এই কারণেই এই পুরো ব্যাপারটাই জীবনের গভীরতম অংশ থেকে উদ্ভূত, এবং মর্মের স্পর্শকাতর তত্ত্বগুলিতে প্রবল যন্ত্রণার স্পন্দন তোলে। বেঁচে থাকার মানে কী, এ নিয়ে সেই প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর সর্বদেশে সর্বকালে মানুষ তীব্র ভাবে অনুসন্ধিৎসু। এ সন্ধান শুধু বুদ্ধিগত হলে তা এমন মর্মস্তুদ হত না, শুধু আবেগনির্ভর হলেও হত না, কিন্তু যেহেতু আবেগ এবং মনন এতে সমান ভাবে সম্পূক্ত, তাই এ ব্যাপারটা সম্পর্কে মানুষের প্রতিক্রিয়া এত জরুরি।

আবেগ (emotion), মনন (intellection) এ দুটিই তো ইচ্ছাশক্তি (volition)-কে প্রণোদিত করে, অর্থাৎ মানুষ তার সত্তার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। যে-গভীর স্তর থেকে সেখানে সে হয় বিশ্বাসী, নয়। অজ্ঞেয়বাদী, নয় নাস্তিক। এবং এ তিনটি বিকল্পই নিরূপণ করে তার বেঁচে থাকার অর্থের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মপন্থা কী। যজ্ঞের যুগে তার জীবনের সমস্ত সংঘাতের, অভাবের, অভিযোগের প্রতিকার চাইবার জায়গা ছিল দেবতাদের অনুগ্রহ এবং সেখানে পৌঁছোবার পথ ছিল যজ্ঞ।

শাস্ত্রে সংশয়

যজ্ঞের যুগের শাস্ত্র রচনার শেষ পর্যায়ে আর্যাবর্তে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে। শাস্ত্রগুলি রচিত হচ্ছিল আর্যাবর্তে, গঙ্গার উত্তরে হস্তিনাপুরে। সেখানে কৌরব রাজা নিচক্ষুর আমলে একটি প্রকাণ্ড প্লাবনে আর্যাবর্তের অনেক অংশই বিধ্বস্ত হয়ে যায় খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে। সেই সময়ে যজ্ঞ-সম্পর্কিত শাস্ত্র অর্থাৎ ব্রাহ্মণ এবং সংহিতার শেষাংশ রচিত হচ্ছিল। ওই সময়ে রাজধানী হস্তিনাপুর থেকে যমুনার পারে কৌশাম্বীতে সরিয়ে আনা হয়।

এ ঘটনার পরে ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রের সৃষ্টিশীল পর্যায়ের যেন অবসান ঘটে; (এর পরেও) আচার্য পরম্পরার নাম পাওয়া যায় এবং নিশ্চয়ই কিছু কিছু বৈদিক শাস্ত্রাংশের পুনরানুশীলন চলছিল… কিছু স্বতন্ত্র রচনা যেন নিবন্ধ রইল গৌণ শাস্ত্রচর্চায়, যজ্ঞকর্ম, অর্থশাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব, জ্যোতিষ ও জ্যামিতিতে।’ এর অর্থ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের মধ্যেই যজ্ঞতত্ত্ব পরিনিষ্ঠিত হয়ে যায়, খুব বড় রকমের কোনও পরিবর্তন আর ঘটেনি।

ছোট ছোট যজ্ঞের আঙ্গে সামান্য আঞ্চলিক পরিবর্তন ঘটে থাকতে পারে। কিছু কিছু ছোট যজ্ঞ উদ্ভাবিতও হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সমস্ত গোষ্ঠীর পক্ষে অনুষ্ঠিত যে সব বৃহৎ শ্রেণীতযাগ, রাজসূয়, বাজপেয়, অশ্বমেধ, অগ্নিচয়ন, সত্র–এগুলি এর আগেই তাদের চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিক রূপ ও হোতার আবৃত্তি, উদগীতার গান এবং অধ্বন্ধুর উপাংশু (মৃদু স্তরে) আবৃত্তির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল।

তার অর্থ, এর পরে যে সব যজ্ঞের অনুষ্ঠান হচ্ছিল সাধারণ মানুষ তার সঙ্গে সুপরিচিত ছিল। এর ফলে মানুষ একটু দূর থেকে মিলিয়ে দেখতে লাগল যজ্ঞ থেকে যে-ফল পাওয়ার কথা তা পাওয়া যায় কি না। যখন হিসেব মিলিছিল না। তখন নানা ভাবে নানা সংশয় মানুষের মনে উদ্রিক্ত হচ্ছিল এবং তৎকালীন ও তার পরবর্তী শাস্ত্রে–সংহিতা ব্রাহ্মণ ও উপনিষদে- উচ্চারিত হয়ে স্থায়ী ভাবে বিধৃত রইল।

বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য : দুই>>

……………….
[১] ‘it is no longer a question of denying a particular person’s (or group’s) sacrifice, but of

denying the abstract Institution of sacrifice he doctrine of sacrifice is either true or false It is at this point that the classical nastika makes his appearance The utter acerbity of their relations signifies the fact that they are no longer bound together in a complementary pattern.

The initial point is, however, the breakthrough out of mutual dependence in the contest for the goods of life Both ritualist and nastika reject karman in the sense of the (sacrificial) ‘work of agonistic exchange between two parties. What divides them is the truth or falsehood of the doctrine of individual karman regulated by transcendent Veda injunction… .

The ritualist (and his astika progeny) in order to safeguard man’s transcendence subjects his freedom to transcendent injunction The nastika, on the other hand, surrenders his transcendence in favour of man’s freedom.-J. C. Heesterman, p. 84

[২] ‘it (Veda) is invoked against the Internal sectarian disintegration of the tradition, as well as against the ‘external’ (bahya) and heterodox (nastika) challenges of Buddhism The distinction between ‘orthodox’ (astika) and ‘heterodox’ (nastika) systems is among the most basic and familiar traditional Indian doxographies as it is in modern surveys of indian philosophy.’–Halbfass: p 6 and p. 237

(৩] (Greek (ABEOS) atheos originally used in Greece of all those who whether they believed in god or not, disbelieved in the official gods of the state. In Roman empire (the word) was used by pagans to denote Christian agnosticism.’–The Oxford Dictionary of the Christian Church, p. 100)

[৪] Macmilian Encyclopaedia af Philosophy Skepticism, Vol Vil, p 499

[৫] The assumption that all or the most significant features of these structures are knowable

and controllable by human effort,… –Guy E Swanson, p 188

[৬] The World which is the same for all, has not been made by any god or man: it has ever been, is now, and ever shall be… ‘Orphic Fragments, 334 EBc30, quoted in George Thomson. Vol. II, p. 227

[৭) ‘(the tension) between the divine promise and its ostensible failure to be fulfilled; the other is a tension between God’s will, His providential guidance and human freedom, the refractory nature of man… the double dialectic between design and disorder, providence and freedom.’–Robert Alter, p 141

[৮) If Nature’s providence is all inclusive, then any event which causes injury or suffering has to be integrated as something which, if all the facts were known, would be recognized as beneficial by man, ‘–A.A Long, p 70

[৯) ‘About the gods, I am not able to know whether they exist or do not exist, nor what they like in form, for the factors preventing knowledge are many: the obscurity of the object, at the shortness of human life.’–Protagonus for 4 The Sophist

…………………
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………
আরও পড়ুন-
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য : এক
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য : দুই
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য : তিন

.……………….
আরও পড়ুন-
বেদ রচনার গোড়ার দিক : এক
বেদ রচনার গোড়ার দিক : দুই

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!