-আহমদ ছফা
৬.
পলাশীর যুদ্ধের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অনুসৃত নীতির ফলে যে উঁচু কোটির মুসলিম শাসক নেতৃশ্রেণীটি ছিল তার অবস্থা একেবারে শোচনীয় হয়ে পড়ে। ভাষাগত দিক দিয়ে তারা বাঙালি মুসলমান জনগণের সঙ্গে কোনোরকমে সম্পর্কিত ছিলেন না। এদেশে অনেকটা বিদেশীর মতোই অবস্থান করতেন। সরকারি চাকরিই ছিল তাদের এ দেশে অবস্থান করার মুখ্য অবলম্বন।
নবাবী আমলের অবসানের পর যখন ইংরেজ শাসন কায়েম হলো, তারা না পারলেন ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে, না পারলেন নিজেদের ধর্মীয় জনগণের নেতৃত্বদান করতে। রক্তগত, ভাষাগত, রুচি, সংস্কৃতি এবং আচরণগত ব্যবধানের দরুন আপদকালে সমাজে নেতৃশ্রেণীর পালনীয় যে ভূমিকা রয়েছে, বাংলাদেশে অবস্থানকারী অভিজাত মুসলিম। শ্রেণীটির তা পালন করার কথা একবারও মনে আসেনি।
কিন্তু উত্তর ভারতে হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। সেখানেও মুসলিম শাসক নেতৃশ্রেণীটি মোগল শাসনের আমলে সবদিক দিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। অত্যল্পকাল গত না হতেই স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে তারা নতুন ব্যবস্থাকে মেনে নেয়ার জন্য এবং নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্য মনন এবং মানসিকতার পরিবর্তনে লেগে যান। তার ফল আলীগড় কলেজ।
এই কলেজের সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য যে অবদান তাহলো মুসলিম নেতৃশ্রেণীকে পুঞ্জীভূত হতাশা থেকে উদ্ধার করে ব্রিটিশমুখী করা এবং ব্রিটিশ শাসকদেরও সিপাহী যুদ্ধের সংশয় সন্দেহের কুজ্ঝটিকা সরিয়ে মুসলিমমুখী করে তোলার ব্যাপারে, ব্যক্তিগতভাবে স্যার সৈয়দ আহমদ নিজে, তার বন্ধু এবং অনুরাগীবর্গ ও প্রতিষ্ঠিত আলীগড় কলেজ বিরাট ভূমিকা পালন করেছে।
তাই সেখানে মুসলমানেরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও লেখাপড়া, ব্যবসাবাণিজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের চাইতে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর ছিলেন। আসলে স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে সুযোগ নেয়ার পদ্ধতিটা ভালভাবে শিখিয়েছিলেন। তার চিন্তা সারা ভারতের শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে এত বেশি শেকড় বিস্তার করেছিল যে আলীগড়শিক্ষিত মুসলমানেরা কদাচিৎ সুযোগসন্ধানী নীতি পরিহার করতে পেরেছিলেন।
মওলানা আবুল কালাম আজাদকে এজন্য আলীগড়ে শিক্ষিত মুসলমানদের মানসিকতার পরিবর্তন আনার জন্যে প্রায় জেহাদ করতে হয়েছে। তথাপি তিনি সফল হয়েছেন। একথা বলা চলে না- যাক, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। উত্তর ভারতে শাসক নেতৃশ্রেণী একটা সামাজিক নেতৃত্ব নির্মাণ করতে পেরেছিলেন, কেননা জনগণ এবং অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, রুচি ও আচারগত শ্রেণীদূরত্ব ছাড়া অন্য কোনো দূরত্ব ছিল না।
কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত শ্রেণী একেবারে তলিয়ে গেল। কিন্তু তাদের আচার আচরণ সামাজিক আদর্শ অটুট থেকে গেল। হিন্দু সমাজের প্রতিযোগিতা এড়িয়ে ব্রিটিশ শাসকদের কপাকণা সম্বল করে যে সকল মুসলমান উপরের দিকে উঠে আসতেন, মৃত মুসলিম অভিজাতদের আদর্শকেই তাদের নিজেদের আদর্শ বলে বরণ করে নিতেন।
এরা আবার অনেক সময় আপন মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষার জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ যা করেছেন বাংলাদেশের মুসলমানের জন্য একই কাজ করা উচিত মনে করতেন।
একটি সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলার মৃত্তিকার সাক্ষাৎ সন্তানদের এই সামাজিক অনুশাসন মেনে নিতে হয়েছিল। যেমন কল্পনা করা হয়, অত সহজে এই বাংলাদেশে আর্য প্রভাব বিস্তৃত হতে পারেনি। বাংলার আদিম কৌম সমাজের মানুষেরা সর্বপ্রকারে যে ওই বিদেশী উন্নত শক্তিকে বাধা দিয়েছিলেন- ছড়াতে, খেলার বোলে অজস্র প্রমাণ ছড়ানো রয়েছে।
প্রায়শ হালের একগুঁয়ে ইতিহাস ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তারা বলে থাকেন, ব্রিটিশ শাসনের আমলে বাংলার মুসলমান সমাজ অধঃপতনের গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এটা পুরো সত্য তো নয়ই, সিকি পরিমাণ সত্যও এর মধ্যে আছে কিনা সন্দেহ। সত্য বটে, মুসলিম শাসনের অবসানের পর শাসক নেতৃশ্রেণীটির দুর্দশার অন্ত ছিল না।
কিন্তু তাদের সঙ্গে সাধারণ বাঙালি মুসলমান জনগণের একমাত্র ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো যোগসূত্র ছিল কি? আর মুসলমান জনগণের অবস্থা ইংরেজ শাসনের পূর্বে অধিক ভাল ছিল কি? নবাবী আমলেও এ দেশীয় ফার্সী জানা যে সকল কর্মচারী নিয়োগ করা হতো, তাদের মধ্যে স্থানীয় হিন্দু কতজন ছিলেন এবং কতজন ছিলেন স্থানীয় মুসলমান, এ সকল বিষয় বিচার করে দেখেন না বলেই অতি সহজে অপবাদের বোঝাটি ইংরেজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা দায়িত্বমুক্ত মনে করেন।
উত্তর ভারতেও মুসলিম শাসক নেতৃশ্রেণী এইভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিলেন, অধিকন্তু তাদের অনেকেই সিপাহী বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার পরেও তারা কি করে এগিয়ে আসতে পারলেন এবং তাদের মধ্যে কেন সৃষ্টি হলো স্যার সৈয়দ আহমদের মতো একজন মানুষ। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে তেমন একজন মানুষ জন্মালেন না কেন? এই সকল বিষয়ে সদুত্তর সন্ধান করলেই বাঙালি মুসলমানের যে মৌলিক সমস্যা তার মূলে যাওয়া যাবে।
বাঙালি মুসলমান কারা? এক কথায় এর উত্তর বোধকরি এভাবে দেয়া যায়: যারা বাঙালি এবং একই সঙ্গে মুসলমান তারাই বাঙালি মুসলমান। এঁদের ছাড়াও সুদূর অতীত থেকেই এই বাংলাদেশের অধিবাসী অনেক মুসলমান ছিলেন যারা ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক এবং নৃতাত্ত্বিক ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যানুসারে ঠিক বাঙালি ছিলেন না।
আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধাগুলো তাদের হাতে ছিল না বলেই বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে কৃষ্টি সংস্কৃতিগত ভেদরেখাসমূহ অনেক দিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, এই প্রভুত্বশীল অংশের রুচি, জীবনদৃষ্টি, মনন এবং চিন্তন পদ্ধতি অনেকদিন পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানের দৃষ্টিকেও আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
বাঙালি মুসলমানের যে ক্ষুদ্র অংশ কোনো ফাঁক-ফোকর দিয়ে গলে যখন সামাজিক প্রভুত্ব এবং প্রতাপের অধিকারী হতেন, তখনই বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক চুকে যেত এবং উঁচু শ্রেণীর অভ্যাস, রুচি, জীবনদৃষ্টির এমনকি ভ্রমাত্মক প্রবণতাসমূহও কর্ষণে ঘর্ষণে নিজেদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অঙ্গীভূত করে নিতেন।
মূলত বাঙালি মুসলমানেরা ইতিহাসের আদি থেকেই নির্যাতিত একটি মানবগোষ্ঠী। এই অঞ্চলে আর্য প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার পরে সেই যে বর্ণাশ্রম প্রথা প্রবর্তিত হলো, এদের হতে হয়েছিল তার অসহায় শিকার। যদিও তারা ছিলেন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, তথাপি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের প্রশ্নে তাদের কোনো মতামত বা বক্তব্য ছিল না।
একটি সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলার মৃত্তিকার সাক্ষাৎ সন্তানদের এই সামাজিক অনুশাসন মেনে নিতে হয়েছিল। যেমন কল্পনা করা হয়, অত সহজে এই বাংলাদেশে আর্য প্রভাব বিস্তৃত হতে পারেনি। বাংলার আদিম কৌম সমাজের মানুষেরা সর্বপ্রকারে যে ওই বিদেশী উন্নত শক্তিকে বাধা দিয়েছিলেন- ছড়াতে, খেলার বোলে অজস্র প্রমাণ ছড়ানো রয়েছে।
হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিমতম উৎস। কেউ কেউ অবশ্য বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকেই সাম্প্রদায়িকতার জনয়িতা মনে করেন। তারা ভারতীয় ইতিহাসের অতীতকে শুধু ব্রিটিশ শাসনের দুশ বছরের মধ্যে সীমিত রাখেন বলেই এই ভুলটা করে থাকেন।
এই অঞ্চলের মানুষদের বাগে আনতে অহংপুষ্ট আর্য শক্তিকেও যে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার তার বিশ্ববিশ্রুত ভারতের ধর্মসমূহ’ গ্রন্থে একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন। আর্য অথবা ব্রাহ্মণ্য শক্তি যে সকল জনগোষ্ঠীকে পদদলিত করে এদেশে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তাদেরকে একেবারে চিরতরে জন্ম-জন্মান্তরের দাস বলে চিহ্নিত করেছে।
আর যে সকল শক্তি ওই আর্য শক্তিকে পরাস্ত করে ভারতে শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন, তাদের সকলকেই মর্যাদার আসন দিতে কোনো প্রকারের দ্বিধা বা কুণ্ঠা বোধ করেনি। শক, হুন, মোগল, পাঠান, ইংরেজ যারাই এসেছে এদেশে তাদের সকলকেই একেকটি মর্যাদার আসন প্রদান করেছে। রাজ্যবিস্তারে প্রশাসনে তাদের সহায়তা করতে পিছপা হয়নি।
কিন্তু নিজেরা বাহুবলে যাদের পরাজিত করেছিল তারাও যে মানুষ একথা স্বীকার করার প্রয়োজনীয়তা খুব অল্পই অনুভব করেছেন। তবু ভারতবর্ষে এমনকি এই বাংলাদেশেও যে, কোনো কোনো নিচু শ্রেণীর লোক নানা বৃত্তি এবং পেশাকে অবলম্বন করে ধীরে ধীরে উপরের শ্রেণীতে উঠে আসতে পেরেছেন তা অন্যত্র আলোচনার বিষয়।
বাংলাদেশের এই পরাজিত জনগোষ্ঠী যাদেরকে রাজশক্তি পাশবিক শক্তির সাহায্যে অন্ত্যজ করে রাখা হয়েছিল, তাদেরই সকলে এক সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে সে প্রাথমিক পরাজয়ের কিঞ্চিত প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিলেন।
শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের ফলে প্রাচীন আর্য ধর্মের নব জীবন প্রাপ্তির পর বৌদ্ধদের এদেশে ধন প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকা যখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো, তার অব্যবহিত পরেই এদেশে মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা হয় এবং ভীত-সন্ত্রস্ত বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে।
হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিমতম উৎস। কেউ কেউ অবশ্য বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকেই সাম্প্রদায়িকতার জনয়িতা মনে করেন। তারা ভারতীয় ইতিহাসের অতীতকে শুধু ব্রিটিশ শাসনের দুশ বছরের মধ্যে সীমিত রাখেন বলেই এই ভুলটা করে থাকেন।
৭.
বাঙালি মুসলমানরা শুরু থেকেই তাদের আর্থিক সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দুর্দশার হাত থেকে আত্মরক্ষার তাগিদেই ক্রমাগত ধর্ম পরিবর্তন করে আসছিলেন। কিন্তু ধর্ম পরিবর্তনের কারণে তাদের মধ্যে একটা সামজিক প্রভুত্ব অর্জনের উন্মেষ হলেও জাগতিক দুর্দশার অবসান ঘটেনি।
বাংলাদেশে নতুন নতুন রাজশক্তি প্রতিষ্ঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা আশাতীত হারে বৃদ্ধিলাভ করেছে। যেহেতু মৌলিক উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যে কোনো পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটেনি, তাই রাজশক্তিকেও পুরনো সমাজ সংগঠনকে মেনে নিতে হয়েছে।
পুঁথিসাহিত্যের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই, বাঙালি আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের মনটি রাজশক্তির আনুকূল্য অনুভব করে হুংকার দিয়ে ফণা মেলে জেগে উঠেছে। কিন্তু ঐ জেগে ওঠাই সার, সে মন কোনো পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারেনি। প্রতিবন্ধকতাসমূহ সামাজিক সংগঠনের মধ্যেই বিরাজমান ছিল।
সে জন্যেই মুসলিম শাসনামলেও বাঙালি মুসলমানেরা রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নিগৃহীত ছিলেন। ইংরেজ আমলে উঁচু শ্রেণীর মুসলমানরা সম্পূর্ণভাবে সামাজিক নেতৃত্বের আসন থেকে বিতাড়িত হলে উঁচু বর্ণের হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবেই সে আসন পূরণ করে।
বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশই বাংলার আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের লোক। তাদের মানসিকতার মধ্যেও আদিম সমাজের চিন্তন পদ্ধতির লক্ষণসমূহ সুপ্রকট। বার বার ধর্ম পরিবর্তন করার পরেও বাইরের দিক ছাড়া তাদের বিশ্বাস এবং মানসিকতার মৌলবস্তুর মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
দিনের পর দিন গিয়েছে, নতুন ভাবাদর্শ এদেশে তরঙ্গ তুলেছে, নতুন রাজশক্তি এদেশে নতুন শাসনপদ্ধতি চালু করেছেন, কিন্তু তারা মনের দিক দিয়ে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের মতোই বার বার বিচ্ছিন্ন থেকে গিয়েছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই ছিলেন বাঙালি মুসলমান এবং মুসলমান রাজত্বের সময়ে তাদের মানসে যে একটি বলবন্ত সামজিক আকাক্ষা জাগ্রত হয়েছিল তাদেরই রচিত পুঁথিসাহিত্যসমূহের মধ্যে তার প্রমাণ মেলে।
কাব্য সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার অনুসারে হয়তো এসকল পুঁথির বিশেষ মূল্য নেই, কিন্তু বাঙালি মুসলমান সমাজের নৃতাত্ত্বিক এবং সমাজতাত্ত্বিক গবেষণায় এসবের মূল্য যে অপরিসীম সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইতালীয় দার্শনিক বেনেদিত্তো ক্রোচের মতে প্রতিটি জাতির এমন কতিপয় সামাজিক আবেগ আছে যার মধ্যে জাতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্যাসের আকারে পুরোমাত্রায় বিরাজমান থাকে, রাজনৈতিক পরাধীনতার সময়ে সে আবেগ সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকে এবং কোনো রাজনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হলে সে আবেগই ফণা মেলে হুংকার দিয়ে ওঠে।
সাহিত্যেই এই প্রথমে জাতিগত আকাক্ষার রূপায়ণ ঘটতে থাকে। জাতিগত আকাক্ষার সঙ্গে যুক্ত হতে না পারলে কোনো মহৎ সাহিত্য যে সৃষ্টি হতে পারে না, একথা বলাই বাহুল্য।
পুঁথিসাহিত্যের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই, বাঙালি আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের মনটি রাজশক্তির আনুকূল্য অনুভব করে হুংকার দিয়ে ফণা মেলে জেগে উঠেছে। কিন্তু ঐ জেগে ওঠাই সার, সে মন কোনো পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারেনি। প্রতিবন্ধকতাসমূহ সামাজিক সংগঠনের মধ্যেই বিরাজমান ছিল।
সমাজ সংগঠন ভেঙে ফেলে নব রূপায়ণ তারা ঘটাতে পারেননি। কারণ মুসলিম শাসকেরাও স্থানীয় জনগণের মধ্য থেকে যে নেতৃশ্রেণী সংগ্রহ করেছিলেন, তাদের মধ্যে বাঙালি মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব একেবারে ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, রুচি এবং আচারগত দূরত্বের দরুন শাসকশ্রেণীর অভ্যাস, মনন রপ্ত করতে গিয়ে বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বাঙালি মুসলমান।
কিন্তু স্যার সৈয়দের আলীগড় আন্দোলন একান্তভাবে উত্তর প্রদেশের মুসলমানদের সংখ্যলঘিষ্ঠ মুসলমান সামন্ত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল। আবার এই সামন্তশ্রেণীর সঙ্গে জনগণের শ্রেণীগত তফাত ছাড়া ভাষা সংস্কৃতিগত পার্থক্য যে ছিল না একথা বিংশ শতাব্দীতেও ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানেরা খুব কমই উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
ইংরেজ শাসন কায়েম হওয়ার পরে এই দেশে হিন্দুসমাজের ভেতর থেকে যে একটি মধ্যবিত্ত নেতৃশ্রেণী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তার মধ্যে মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিত্ব প্রায় না থাকার কারণ হিসেবে শুধু ব্রিটিশের ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল পলিসি’ কিংবা মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি ইংরেজের অন্ধবিদ্বেষকে ধরে নিলে মুসলিম সমাজের তুলনামূলকভাবে পেছনে পড়ে থাকার কারণসমূহের সঠিক ব্যাখ্যা করা হবে না।
৮.
ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দু মধ্যবিত্তের উত্থান যুগে ইউরোপীয় ভাবধারা, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং নানা আধুনিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক চিন্তারাশি বঙ্গীয় হিন্দু সমাজের একাংশের মধ্যে যে তরঙ্গ তুলেছিল, তা মুসলমান সমাজকে স্পর্শও করতে পারেনি। আধুনিক যুগের দাবির সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে যে সকল ধর্মীয় এবং সামাজিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক মূল্যচেতনার নেতৃত্ব হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী দান করেছিলেন, মুসলমান সমাজে তা একেবারে প্রসার লাভ করেনি।
জগৎ এবং জীবনের যে সকল অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্ন নবযুগের আলোকে তারা ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন, মুসলমান সমাজ তার কিছুই গ্রহণ করেনি। সে সময়ে স্যার সৈয়দ আহমদ, সৈয়দ আমির আলী, নওয়াব আবদুল লতিফ প্রমুখ যে সকল মুসলিম চিন্তানায়ক মুসলমানদের হয়ে কথা বলছিলেন এবং চিন্তা করছিলেন, মুসলমান সমাজের প্রকৃত দাবি কী হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে চিন্তা করার কোনো অবকাশই পাননি। শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং সংস্কার বলতে তাদের মনে প্রভুত্ব হারানো উঁচু কোটির মুসলমানদের কথাই জাগরুক ছিল।
স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে যে অধিকারচেতনা অপেক্ষাকৃত পরে জাগ্রত হয়, আসলে তা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তের আন্দোলন এবং অগ্রগতির সম্প্রসারণ মাত্র। তাদেরকে তা করতে গিয়ে দু-ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
লেখাপড়া, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থস্বার্থের দিকে অনেকদূর অগ্রসর হিন্দু সমাজের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো এবং অন্যদিকে উঁচুতলার মুসলমানদের মূল্যচেতনা এবং জীবনদৃষ্টিকে স্বীকার করে নেয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না। এই দু-মুখী প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করতে হলে যে শক্ত সামাজিক ভিত্তিভূমির প্রয়োজন ছিল,তাদের পেছনে ছিল না।
তাই বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে থেকেও ইংরেজি শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ নিয়ে যারা উপরে উঠে আসতেন, উঁচুতলার মুসলমানদের জীবনদৃষ্টির সঙ্গে তারা নিজেদের সংযুক্ত করতেন। স্যার সৈয়দ আহমদের আলীগড় আন্দোলন থেকে শুরু করে জামালুদ্দিন আফগানীর ‘প্যান ইসলামিজম’ পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে আসা সমস্ত আন্দোলন প্রবর্তনার সঙ্গে নিজেদের অংশীদার করে নিতেন।
কিন্তু স্যার সৈয়দের আলীগড় আন্দোলন একান্তভাবে উত্তর প্রদেশের মুসলমানদের সংখ্যলঘিষ্ঠ মুসলমান সামন্ত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল। আবার এই সামন্তশ্রেণীর সঙ্গে জনগণের শ্রেণীগত তফাত ছাড়া ভাষা সংস্কৃতিগত পার্থক্য যে ছিল না একথা বিংশ শতাব্দীতেও ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানেরা খুব কমই উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
কোনো বিষয়েই তারা উল্লেখ্য কোনো মৌলিক অবদান রাখতে পারেননি। সত্য বটে, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন প্রমুখ কবি কাব্যের ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। একটু তলিয়ে দেখলেই ধরা পড়বে, উভয়েরই রচনায় চিন্তার চাইতে আবেগের অংশ অধিক। তাছাড়া এই দুই কবির প্রথম পৃষ্ঠপোষক ও গুণগ্রাহী ছিল হিন্দু সমাজ, মুসলমান সমাজ নয়।
তারা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে অনুরূপ সমাজচেতনা এবং মূল্যবোধ সঞ্চারের চেষ্টা করতেন। কিন্তু বাঙালি জনগণের সঙ্গে এতটা সম্পর্ক বিরহিত ছিল যে ভাবাদর্শিক কোনো জাগরণ আনতেই পারেনি। ধর্মীয় বদ্ধমত এবং সংস্কারকে আঘাত করে এমন কোনো সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন মুসলমান সমাজের ভেতর থেকে জেগে উঠতে পারেনি। মুসলমানদের দ্বারা সংগঠিত প্রায় সমস্ত সামজিক কর্মকাণ্ড এই ধর্মীয় পুনর্জাগরণভিত্তিক।
হিন্দু সমাজে যে ধর্মীয় পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলন হয়নি একথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু তাদের একাংশের মধ্যে অন্তত কিছুসংখ্যক মানুষ মৌলিক চিন্তা করেছিলেন এবং সামাজিক অনেকগুলো বদ্ধমতকে শাণিত আক্রমণ করেছিলেন, বাস্তবে না হলেও তত্ত্বগত দিক দিয়ে বেশ কিছুদূর যুক্তিবাদিতার চর্চা তাদের মধ্যে হয়েছে।
তাদের কৃত আন্দোলনসমূহ যে সমুদ্র তরঙ্গের শীর্ষে ফসফরাসের মতো জ্বলেছে, সমাজের গভীরে প্রবিষ্ট হতে পারেনি, তার নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। কিন্তু মুসলমান সমাজে যুক্তিবাদিতার চাষ একেবারে হয়নি। নতুন যুগের আলোক জগৎ এবং জীবনকে ব্যাখ্যা করে সমাজের সামনে তুলে ধরছেন এমন মানুষ সত্যিই বিরল। মুসলমান সমাজে যে কোনো মনীষী জন্মাতে পারেননি কারণ সামাজিক লক্ষ্যের দ্বি কিংবা ত্রি-মুখীনতা। সামাজিক এবং ধর্মীয় সংগঠনসমূহের মধ্যেই বিভিন্নমুখী লক্ষ্যের কারণসমূহ সংগুপ্ত ছিল।
৯.
বাঙালি মুসলমান বলতে যাদের বোঝায়, তারা মাত্র দুটি আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিলেন এবং অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার একটি তীতুমীরের অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত ওহাবী আন্দোলন। অন্যটি হাজী দুদুমিয়ার ফারায়েজী আন্দোলন। এই দুটি আন্দোলনেই বাঙালি মুসলমানেরা মনেপ্রাণে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু উঁচু শ্রেণীর মুসলমানেরা এই আন্দোলন সমর্থন করেছেন তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
আসলেও কৃষক জনগণই ছিলেন এই আন্দোলন দুটির হোতা। আধুনিক কোনো রাষ্ট্র কিংবা সমাজদর্শন এই আন্দোলন দুটিকে চালনা করেনি। ধর্মই ছিল একমাত্র চালিকাশক্তি। সে সময়ে বাংলাদেশে আধুনিক রাষ্ট্র এবং সমাজ সম্পর্কিত বোধের উন্মেষ ঘটেনি বললেই চলে। সমাজের নিচুতলার কৃষক জনগণকে সংগঠিত করার জন্য ধর্মই ছিল একমাত্র কার্যকর শক্তি। রাজনৈতিক দিক দিয়ে এই আন্দোলন দুটির ভূমিকা প্রগতিশীল ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু সামাজিক দিক দিয়ে পশ্চাগামী ছিল, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।
এই আন্দোলন দুটি ছাড়া অন্য প্রায় সমস্ত আন্দোলন হয়তো উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, নয়তো হিন্দু সমাজের উদ্যোগ এবং কর্মপ্রয়াসের সম্প্রসারণ হিসেবে মুসলমান সমাজে ব্যাপ্তিলাভ করেছে। সমাজের মৌল ধারাটিকে কোনো কিছুই প্রভাবিত করেনি। তার ফলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের মনটিতে একটু রং-টং লাগলেও কোনো রূপান্তর বা পরিবর্তন হয়নি।
আমরা দেখেছি শহীদে কারবালার ব্রাহ্মণ আজর উনবিংশ শতাব্দীর মীর মশাররফ হোসেনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিষাদ সিন্ধু’তেও একই স্থানে, একই পোশাকে, একই চেহারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মধ্যিখানে কয়েকটি শতাব্দীর পরিবর্তন কোনো ভাবান্তর আনতে পারেনি। বিংশ শতাব্দীতেও এই মনের বিশেষ হেরফের ঘটেনি। বাঙালি মুসলমানের রচিত কাব্য-সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান পর্যালোচনা করলেই এ সত্যটি ধরা পড়বে।
কোনো বিষয়েই তারা উল্লেখ্য কোনো মৌলিক অবদান রাখতে পারেননি। সত্য বটে, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন প্রমুখ কবি কাব্যের ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। একটু তলিয়ে দেখলেই ধরা পড়বে, উভয়েরই রচনায় চিন্তার চাইতে আবেগের অংশ অধিক। তাছাড়া এই দুই কবির প্রথম পৃষ্ঠপোষক ও গুণগ্রাহী ছিল হিন্দু সমাজ, মুসলমান সমাজ নয়।
বাঙালি মুসলমানদের মন যে এখনো আদিম অবস্থায়, তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুন তার মনের উপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত রয়েছে, সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়।
মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো হয়তো চর্বিতচর্বণ নয়তো ধর্মীয় পুনর্জাগরণ। এর বাইরে চিন্তা, যুক্তি এবং মনীষার সাহায্যে সামজিক ডগমা বা বদ্ধমতসমূহের অসারতা প্রমাণ করেছেন, তেমন লেখক কবি মুসলমান সমাজে আসেননি। বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে।
ভাসা ভাসাভাবে, অনেক কিছুই জানার ভান করে, আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সংকুচিত। বাঙালি মুসলমানের মন’ এখনো একেবারে অপরিণত, সবচেয়ে মজার কথা এ-কথাটা ভুলে থাকার জন্যই সে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না। যেহেতু আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান এবং প্রসারমান যান্ত্রিক কৃৎকৌশল স্বাভাবিকভাবে বিকাশলাভ করছে এবং তার একাংশ সুফলগুলোও ভোগ করছে, ফলে তার অবস্থা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এঁচড়েপাকা শিশুর মতো।
অনেক কিছুরই সে সংবাদ জানে, কিন্তু কোনো কিছুকে চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মনীষা দিয়ে আপনার করতে জানে না। যখনই কোনো ব্যবস্থার মধ্যে কোনোরকম অসঙ্গতি দেখা দেয়, গোঁজামিল দিয়েই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় এবং এই গোজামিল দিতে পারাটাকে রীতিমতো প্রতিভাবানের কর্ম বলে মনে করে।
শিশুর মতো যা কিছু হাতের কাছে, চোখের সামনে আসে, তাই নিয়েই সে সন্তুষ্ট, দূরদর্শিতা তার একেবারেই নেই। কেননা একমাত্র চিন্তাশীল মনই আগামীকাল কি ঘটবে সে বিষয়ে চিন্তা করতে জানে। বাঙালি মুসলমান বিমূর্তভাবে চিন্তা করতেই জানে না এবং জানে না এই কথাটি ঢেকে রাখার যাবতীয় প্রয়াসকে তার কৃষ্টি কালচার বলে পরিচিত করতে কুণ্ঠিত হয় না।
বাঙালি মুসলমানের সামাজিক সৃষ্টি, সাংস্কৃতিক সৃষ্টি, দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিসমূহের প্রতি চোখ বুলোলেই তা প্রতিভাত হয়ে উঠবে। সাবালক মন থেকেই উন্নত স্তরের সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের উদ্ভব এবং বিকাশ সম্ভব। এই সকল ক্ষেত্রে তার মনের সাবালকত্বের কোনো পরিচয় রাখতে পারেনি। যে জাতি উন্নত বিজ্ঞান, দর্শন এবং সংস্কৃতির স্রষ্টা হতে পারে না, অথবা সেগুলোকে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না, তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টিও সম্ভব নয়।
যে নিজের বিষয় নিজে চিন্তা করতে জানে না, নিজের ভালমন্দ নিরূপণ করতে অক্ষম, অপরের পরামর্শ এবং শোনা কথায় যার সমস্ত কাজকারবার চলে, তাকে খোলা থেকে আগুনে, কিংবা আগুন থেকে খোলায়, এইভাবে পর্যায়ক্রমে লাফ দিতেই হয়। সুবিধার কথা হলো নিজের পঙ্গুত্বের জন্য সব সময়েই দায়ী-করবার মতো কাউকে না কাউকে পেয়ে যায়। কিন্তু নিজের দুর্বলতার উৎসটির দিকে একবারও দৃষ্টিপাত করে না।
বাঙালি মুসলমানদের মন যে এখনো আদিম অবস্থায়, তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুন তার মনের উপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত রয়েছে, সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়।
মানসিক ভীতিই এই সমাজকে চালিয়ে থাকে। দু-বছরে কিংবা চার বছরে হয়তো এ অবস্থার অবসান ঘটানো যাবে না, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের মনের ধরন-ধারণ এবং প্রবণতাগুলো নির্মোহভাবে জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়তো পাওয়াও যেতে পারে।
(সমাপ্ত)
<<বাঙালি মুসলমানের মন : দ্বিতীয় কিস্তি ।। বাঙালি মুসলমানের মন : প্রথম কিস্তি>>
…………………….
বাঙালি মুসলমানের মন (প্রবন্ধ) : আহমদ ছফা।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………
আরও পড়ুন-
বাঙালি মুসলমানের মন : প্রথম কিস্তি
বাঙালি মুসলমানের মন : দ্বিতীয় কিস্তি
বাঙালি মুসলমানের মন : তৃতীয় কিস্তি