আদিম শ্রেণীহীন সমাজ : পর্ব এক
-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
আদিম শ্রেণীহীন সমাজ ছেড়ে মানুষ এল শ্রেণীসমাজের আওতায়। কী করে, কোন প্রার্থিব প্রভাবের ফলে অতীতের মানুষ ইতিহাসের এই পথটুকু অতিক্রম করল? হাতিয়ারের উন্নতি; এই উন্নতিই মানুষকে দেখাল।
প্রকৃতির কাছে মুক দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার পথ, আবার এই উন্নতির কৃপাতেই একদল মানুষ ক্রমে ক্রমে বাকি সকলকে দাসত্ব-শৃঙ্খলে বাধতে পারল। সমাজের এই পরিবর্তন কীভাবে সংস্কৃতির স্তরে প্রতিফলিত হয়েছে, তার কথা মনে রাখতে হবে। আদিম শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণীসমাজ। আর তারই প্রতিচ্ছবি : ইন্দ্রজাল থেকে ধর্ম।
ইন্দ্রজাল থেকে ধর্ম। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, ধর্ম ইন্দ্রজালের উন্নত আর সংস্কৃত সংস্করণমাত্র। বুর্জোয়া পণ্ডিত-মহলে এই ভ্রান্ত ধারণা ঘুরে ফিরে অনেকবার দেখা দিয়েছে। অনেকেই চেষ্টা করেছেন ইন্দ্রজালের মধ্যেই ধর্মের উৎস খুঁজতে, অনেকে চেয়েছেন ধর্মকে ইন্দ্রজালেরই সভ্য সংস্করণ বলে প্রচার করতে।
যেন আদিম মানুষের অন্বেষণ-বৃত্তি প্রথমটায় অতি স্থূল আর প্রাকৃত তত্ত্ববোধে আশ্রয় পেয়েছিল, তারই নাম ইন্দ্রজাল; ক্রমে সেই তত্ত্ববোধ উন্নত আর সংস্কৃত হতে হতে ধর্মের রূপ নিল। অর্থাৎ এই বিচার অনুসারে ইন্দ্রজাল আর ধর্ম-র মধ্যে গুণগত তফাত- জাতের তফাত- যেন নেই। তফাত যেটুকু, সেটুকু নেহাতই স্কুলের সঙ্গে সুন্মের তফাত।
অথচ, জাতের তফাতটাই দুয়ের মধ্যে আসল তফাত। ভুয়োদর্শনের সুস্থ প্রভাবের ফলে স্তর জেমস ফ্রেজারের বুর্জোয়া দৃষ্টিও এই বিষয়কে উপেক্ষা করতে পারেনি। তিনিও মানছেন যে, ইন্দ্রজালের সঙ্গে ধর্মের শুধু উদ্দেশ্য ভেদই নয়, উপায়-ভেদও বর্তমান। ইন্দ্রজালের উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতিকে বশ করা; প্রকৃতিকে জয় কৱা; ধর্মের উদ্দেশ্য হলো দেবতাকে সন্তুষ্ট করে তার কাছে কৃপা ভিক্ষা করা।
জয় করা আর ভিক্ষা চাওয়া- উদ্দেশ্যের দিক থেকে গুণগত প্রভেদ বই কী। তা ছাড়া, উপায়ের দিক থেকেও তফাতটা অত্যন্ত গভীর ও গুরুতর : প্রকৃতিকে বশ করতে গিয়ে ইন্দ্রজাল আবিষ্কার করতে চায় প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনকে- প্রকৃতির রাজ্যে কার্য-কারণ সম্বন্ধকে।
তাই, যত অস্পষ্ট আর যত অব্যক্ত ভাবেই হোক না কেন, ইন্দ্রজালের পেছনে নিশ্চয়ই এই বিশ্বাসই নিহিত যে, প্রকৃতির দাসত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো প্রকৃতির অমোঘ নিয়মকে চিনতে পারা। ইন্দ্রজালের যা প্রাপ্য, তার চেয়ে বেশি।
উজ্জ্বাস করবার প্রয়োজন নেই-প্রকৃতির দাসত্ব থেকে মুক্তির আসল পথ যে প্রকৃতির নিয়মকেই চিনতে শেখা, এই বোধ ইন্দ্রজালের পেছনে অব্যক্ত ও অচেতন। কল্পনার কুত্মটিকায় আবিল, তবু এই বোধের অস্তিত্বটুকুকে উড়িয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। অপর দিকে ধর্মের পেছনে উপায় হিসেবে কোন বোধের উপর নির্ভরতা?
অন্যান্য দেশে যে-সব গাছগাছড়া আর পশুপাখি আজ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, সেইসব গাছগাছড়া আর পশুপাখি আজও এখানে টিকে আছে, এবং সেই সঙ্গে টিকে আছে আদিম মানবসমাজের নিদর্শনও। আর সে সমাজে ধর্মের চিহ্ন নেই, আছে ইন্দ্রজালের। মোটামুটি বলা যায়, ফ্রেজার বলছেন, অষ্ট্রেলিয়ার সব আদিম অধিবাসীই ইন্দ্রজাল-বিদ বা মায়াবী, কিন্তু পুরোহিত একজনও নয়।
প্রার্থনা দিয়ে করুণার উদ্রেক, স্তবস্তুতির খোশামোদ দিয়ে মন গলানো, আহুতির ঘুষ দিয়ে হাত করা। মানুষের প্রথম ধর্ম চেতনা-সব দেশের বেলাতেই মোটামুটি একই রকম-প্রকৃতির অধিষ্ঠাতা আর অধিষ্ঠাত্রী দেবদেবীর সন্ধান করেছে।
প্রকৃতির রাজ্যে নিয়মের সন্ধান নয়, কেননা এইসব দেবদেবীর মধ্যে আর যাই থাক, নিয়মের শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। খেয়ালী বড়লোকদের মতো এই সব দেবদেবীর দল; অসীম তাদের শক্তি; তবু ভিক্ষে চাইলে তারা ভিক্ষে দিতেও পারে, খোেশামোদ শুনলে খুশি হয়, ঘুষ পেলে সিদ্ধি দেয়।
এবং ফ্রেজার ঠিকই বলেছেন যে, আসলে বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের যে বিরোধ, মােটামুটি সেই বিরোধই ইন্দ্রজালের সঙ্গে ধর্মের, কেননা আদিম ইন্দ্রিজাল আধুনিক বিজ্ঞানেরই আদিপুরুষ। শুধু তাই নয়,-নানান দেশে নানানভাবে ইন্দ্রজাল আর ধর্মের মেশামেশি।
সত্ত্বেও,-ফ্রেজার স্পষ্টই অনুভব করেছেন যে, ইন্দ্রজাল-কে ধর্মের চেয়ে প্রাচীন বলে স্বীকার করতেই হবে। “যদিও বহু যুগে বহু দেশে দেখতে পাওয়া যায়, ইন্দ্রজাল আর ধর্ম মিশে রয়েছে, তবুও কয়েকটি কারণের দরুন মনে করা উচিত যে, এই মেশামিশি আদিম নয়।”
কিন্তু এই সব কারণগুলির স্বরূপ কী? ফ্রেজারের মতে প্রধানত দুরকম। প্রথমত, ইন্দ্রজাল এবং ধর্মের মূল ধারণাকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ইন্দ্রজালের ভিত্তি হলো ধারণার অনুষঙ্গ (association of ideas), এবং ধর্মের ভিত্তি হলো প্রকৃতির অধিষ্ঠাতা-অধিষ্ঠাত্রী চৈতন্য-এবং-ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন দেবদেবীর কথা।
এ কথা তো স্পষ্টই যে, ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন শক্তির ধারণা নিছক ধারণার অনুষঙ্গের চেয়ে অনেক জটিল এবং অনেক উন্নত। দ্বিতীয়ত,- এবং এইটেই হলো ফ্রেজারের বৈজ্ঞানিক মহত্ত্ব যে, পদে পদে তিনি পরিদর্শনের উপর নির্ভর করতে চান- পৃথিবীর বুকে আজও যে সব জাতি সভ্যতার নিম্নতম স্তরে পড়ে আছে, তাদের মধ্যে ধর্ম দেখা দেয়নি, আছে শুধু ইন্দ্রজাল।
ফ্রেজার বলছেন, অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের কথা। আশ্চর্য দেশ এই অষ্ট্রেলিয়া,- এর আকার অপেক্ষাকৃত ছোট, এর মধ্যে জলের অভাব এবং মরুদেশের প্রাচুর্য, এবং অন্যান্য মহাদেশের সঙ্গে এর যোগাযোগ না থাকার দরুণ আজও এই দেশ যেন “অতীত জিনিসের জাদুঘর” হয়ে রয়েছে।
অন্যান্য দেশে যে-সব গাছগাছড়া আর পশুপাখি আজ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, সেইসব গাছগাছড়া আর পশুপাখি আজও এখানে টিকে আছে, এবং সেই সঙ্গে টিকে আছে আদিম মানবসমাজের নিদর্শনও। আর সে সমাজে ধর্মের চিহ্ন নেই, আছে ইন্দ্রজালের। মোটামুটি বলা যায়, ফ্রেজার বলছেন, অষ্ট্রেলিয়ার সব আদিম অধিবাসীই ইন্দ্রজাল-বিদ বা মায়াবী, কিন্তু পুরোহিত একজনও নয়।
সভ্যতার এই নিম্নতম নিদর্শনে যদি দেখা যায় শুধু ইন্দ্রজাল, অপেক্ষাকৃত উন্নততর স্তরে ইন্দ্রজালের সঙ্গে ধর্মের মেশা মিশি-প্রাচীন ভারত, মিশর প্রভৃতি থেকে শুরু করে আধুনিক য়ুরোপের অপেক্ষাকৃত পিছনে-পড়ে-থাকা সমাজ পর্যন্ত-এবং সভ্যতার উচ্চতর স্তরে যদি দেখা যায় শুধু ধর্ম, তাহলে বুঝতে হবে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ইন্দ্রজালকে পেছনে ফেলে ক্রমশ এগিয়েছে ধর্মের দিকে।
তাই সমগ্র সমাজের কল্যাণ ছাড়া ব্যক্তিবিশেষের মাথায় কল্যাণ সম্বন্ধে আর কোনো কল্পনা আসা কঠিন। মুক্তির রূপ ব্যক্তি-বিশেষের কোনোরকম স্বার্থসিদ্ধি নয়। সমাজের শাসন তখন শ্রেণী-বিশেষের স্বার্থে অনুপ্রাণিত হয়নি, তাই মানুষের কাছে সমাজখৃঙ্খলা শৃঙ্খল-এর রূপ নেয়নি। শৃঙ্খলাকে ভেঙে ফেলবার কথা তাই ওঠেই না।
ফ্রেজারের বৈজ্ঞানিক নিষ্ঠা অসামান্য, এবং এক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্তও- ধর্ম এবং ইন্দ্রজালে জাতের তফাত, এবং এই দুয়ের মধ্যে ইন্দ্রজাল প্রাচীনতরঅবশ্যই স্বীকার্য। এবং ইন্দ্রজালের প্রাচীনতার পক্ষে উপরোক্ত যে দুটি প্রমাণ তিনি দিয়েছেন, তার মধ্যে দ্বিতীয় প্রমাণের গুরুত্ব নিশ্চয়ই মানতে হবে। কিন্তু তার দুর্বলতা ও দৃষ্টির সংকীর্ণতা ধরা পড়ে উপরোক্ত প্রথম প্রমাণের মধ্যে।
ইন্দ্রজাল প্রকৃতির অন্তর্নিহিত অমোঘ আইনকানুনকে আবিষ্কার করে প্রকৃতিকে জয় করতে চায়, ইন্দ্রজাল আধুনিক বিজ্ঞানেরই আদি পুরুষ-তবুও ইন্দ্রজালের তুলনায় ফ্রেজার ধর্মকে মহত্তর ও উন্নততর মানব-সংস্কৃতি মনে করতে বাধ্য হয়েছেন। এক এই উন্নত লক্ষণ থেকেই প্রমাণ, ফ্রেজার মনে করেছেন, যে, ধর্ম উন্নততর মানব-সমাজের সংস্কৃতি। এখানেই ফ্রেজারের বুর্জোয়া দৃষ্টি তাঁর বৈজ্ঞানিক চেতনাকে আচ্ছন্ন করেছে।
বুর্জেয়া দৃষ্টিকোণের সংকীর্ণতা। সেই সংকীর্ণতা সাম্য-জীবনের স্বরূপএবং তারই প্রতিচ্ছবি যে সংস্কৃতিতে, সেই সংস্কৃতির স্বরূপকেও-বোঝাবার পথে পরিপন্থী। তাই, ইন্দ্রজাল থেকে ধর্ম, সংস্কৃতির ইতিহাসে এই পথটুকুকে বুঝতে হলে সামাজিক পরিপ্রেক্ষাকে মনে রাখা একান্তভাবে দরকার, মনে রাখা দরকার মানুষের পক্ষে আদিম শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে এসে পড়বার কথা।
আদিম অবিভক্ত সমাজের পটভূমি ছাড়া ইন্দ্রজালকে বোঝবার উপায় নেই। কেননা, যত অস্পষ্টভাবেই হোক, যত অচেতনভাবেই হোক, ইন্দ্রজালের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানেরই পূর্বাভাস। প্রকৃত বিজ্ঞানের দুটো প্রধান দিক। এক হলো প্রয়োগের উপর ঝোক – উৎসাহটা প্রকৃতিকে জয় করবার, প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করবার।
আর দ্বিতীয় দিক হলো প্রকৃতিকে জয় করবার জন্যে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মকে আবিষ্কার করবার চেষ্টা। অর্থাৎ প্রকৃত বিজ্ঞানের মূলে এ চেতনা বর্তমান যে, প্রকৃতির নিয়মকে চিনতে শেখার মধ্যেই মানুষের প্রকৃত মুক্তি। এই প্রয়োগনির্ভরতা এবং মুক্তির স্বরূপস্বীকারকে বিজ্ঞানের দুটো প্রধান দিক বলে মানতেই হবে, কেননা এর থেকে বিচুত হলে বিজ্ঞানকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে দেখা যায়।
যেমনটা হয়েছে আজকের যুগে : সামাজিক অর্থে প্রয়োগভ্রষ্ট ও মুক্তি সম্বন্ধে ভ্রান্তবিশ্বাস-বিলাসী তথাকথিত বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের যে সংকট গত কয়েক বছর থেকে অত্যন্ত প্রকট হয়ে পড়েছে, তাকে ধামাচাপা দেবার উপায়ও আজ যেন নিঃশেষ।
মানুষের সেই আদিম সমাজে, সভ্যতার ওই সুদূর ও নিম্নতর স্তরে, মানুষের সংস্কৃতি কেমন করে এই সুস্থ চেতনার ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিল? সমস্যা সন্দেহ নেই। এবং বুর্জোয়ার চুলচেরা বিচারেও এ সমস্যা সমাধানের কোনো মূলসূত্র পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, বুর্জোয়ার দৃষ্টিভঙ্গিই সংকীর্ণ, যে সংকীর্ণতা এই সমস্যা সমাধানের পরিপন্থী। বুর্জোয়ার দৃষ্টি ব্যক্তির ও ব্যষ্টির দৃষ্টি।
এই দৃষ্টিতে আদিম সমাজকে বুঝতে পারাই সম্ভব নয়, কেননা সে সমাজ শ্রেণীহীন সমাজ, যেখানে জীবন সমবায়ের জীবন। সে সমাজের অন্তনিহিত স্বজনী উৎসকে বুর্জোয়ার দৃষ্টি আবিষ্কার করবে। কেমন করে? আদিম শ্রেণীহীন সমাজ : একের সঙ্গে দশের সম্পর্ক সংখ্যাগণিতের সম্পর্ক নয়, অঙ্গর সঙ্গে অঙ্গীয় সম্পর্ক।
তাই সমগ্র সমাজের কল্যাণ ছাড়া ব্যক্তিবিশেষের মাথায় কল্যাণ সম্বন্ধে আর কোনো কল্পনা আসা কঠিন। মুক্তির রূপ ব্যক্তি-বিশেষের কোনোরকম স্বার্থসিদ্ধি নয়। সমাজের শাসন তখন শ্রেণী-বিশেষের স্বার্থে অনুপ্রাণিত হয়নি, তাই মানুষের কাছে সমাজখৃঙ্খলা শৃঙ্খল-এর রূপ নেয়নি। শৃঙ্খলাকে ভেঙে ফেলবার কথা তাই ওঠেই না।
আর, এই কথা সমাজের মধ্যে যতই প্রকট হতে লাগল, ততই ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো বিজ্ঞানের সংকট। হাজার রকম কলাকৌশলের উন্নতি সত্ত্বেও, লক্ষ রকম চোখ-ধাধানো আবিষ্কারের কান-ফাটানো খবর রটিয়েও, আজ বিজ্ঞানের এই সংকট সম্বন্ধে খবরটুকুকে চাপা দেবার কোনো উপায় পাওয়া যাচ্ছে না।
বরং এই শৃঙ্খলাকে স্বীকার করা, একে মেনে নেওয়া-তার মধ্যেই মানুষের মুক্তির একমাত্র সম্ভাবনা। একের স্বার্থ আর দশের স্বাৰ্থ পৃথক নয়, দশের সিদ্ধির সঙ্গে একের সিদ্ধির ঘনিষ্ঠ মেশামিশি। সমাজ-শৃঙ্খলা যখন শ্রেণীস্বার্থে রক্ষিত হয়ে শৃঙ্খলের রূপ নেয়, শুধু তখনই মানুষের পক্ষে এই শৃঙ্খলাকে ভাঙবার অন্ধ তাগিদ ওঠে।
আদিম প্রাগবিভক্ত সমাজে এই তাগিদ ওঠবার কথা নয়। ওঠেওনি। তাই, তার সংস্কৃতির পিছনেও মুক্তি বলতে শৃঙ্খলাকে চিনতে শেখাই বুঝিয়েছে, যদিও অস্পষ্ট, যদিও অচেতনভাবেই।
আদিম প্রাগবিভক্ত সমাজের সংস্কৃতিতে প্রয়োগের তাগিদই বা অগ্রণী কেন? এর উত্তর জাদুঘরে গিয়ে সে-যুগের ভোঁতা হাতিয়ারগুলোর উপর চোখ বোলালেই বোঝা যায়। ওইরকম স্থূল হাতিয়ার হাতে সবাই মিলে পৃথিবীর সঙ্গে প্রাণপণ-সংগ্রাম করলে পরই কোনোমতে সবাইকার পক্ষে বাঁচতে পারা সম্ভব। তাই সংগ্রাম যতটুকু, ততটুকু প্রকৃতির সঙ্গেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম নয়।
মানুষের উৎপাদন-শক্তি তখনো উদ্ধৃত্ত বলে কিছু সৃষ্টি করতে শেখেনি। বলেই একজনের শ্রমের উপর নির্ভর করে আর একজনের পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়। মেহনতের দায় প্রত্যেকের উপরই, মেহনত ছাড়া জীবনের অর্থ নেই। প্রকৃতিকে জয় করবার তাগিদটাই আদিম মানুষের কাছে আদি ও অকৃত্রিম তাগিদ; নাচ আর ইন্দ্রজালের মধ্যে এই তাগিদের প্রকাশ।
শ্রীমতী হ্যারিসন দেখাচ্ছেন, আদিম মানুষের সমাজে মানুষের বয়েস বাড়ার আর এক নাম হলো নাচের সংখ্যা বাড়া, নাচে যোগ দিতে না পারাটা চরম লজ্জার লক্ষণ, বার্ধক্যের দরুন নাচে যোগ দিতে না পারলে মানুষ আপন কপালে করাঘাত করে; জীবনধারণের আর কোনো অর্থ খুঁজে পায় না।
প্রকৃত বিজ্ঞানের এই মূল ভিত্তিতে- প্রয়োগ-প্রাধান্য আর মুক্তির স্বরূপবোধে- সুদূর অতীতের অসভ্য মানুষ অচেতনভাবে আশ্রয় পেয়েছিল তার সমাজ-সংগঠনের দরুন। তারপর শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ইতিহাসে মানুষ যখন ডাক শুনেছে শোষণের পালা শেষ করে দেবার, তখন আবার বিকশিত হয়েছে বিজ্ঞান।
বিজ্ঞানের সঙ্গে বস্তুবাদের উপর ঝোঁকও। যেমনটা দেখতে পাওয়া যায় য়ুরোপে, মধ্যযুগ শেষ হয়ে নতুন যুগ শুরু হবার সময়। ইংলেণ্ডে বেকন-হবস, ফরাসী দেশের বস্তুবাদীর দল। কিন্তু ইতিহাসের অগ্রগতির মধ্যে দিয়ে দেখা গেল অতি মারাত্মক ধাঙ্গাবাজি লুকোনো ছিল সে-ডাকের পিছনে; এ-ডাক শোষণের পালা শেষ করবার আহবান নয়, একজাতীয় শোষণের বদলে আর একজাতীয় শোষণকে কায়েম করবার ডাক।
আর, এই কথা সমাজের মধ্যে যতই প্রকট হতে লাগল, ততই ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো বিজ্ঞানের সংকট। হাজার রকম কলাকৌশলের উন্নতি সত্ত্বেও, লক্ষ রকম চোখ-ধাধানো আবিষ্কারের কান-ফাটানো খবর রটিয়েও, আজ বিজ্ঞানের এই সংকট সম্বন্ধে খবরটুকুকে চাপা দেবার কোনো উপায় পাওয়া যাচ্ছে না।
বিজ্ঞানের মধ্যে জায়গা জুড়ে বসতে চাইছে ভাববাদ। নিছক গবেষণারোয় সংকীর্ণ গণ্ডিটুকুর মধ্যে যতটুকু প্রয়োগ, তার উপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে চাইল বিজ্ঞান, সামাজিক মেহনতের বিরাট পটভূমি আর বিজ্ঞানের পটভূমি হয়ে থাকতে পারল না।
(চলবে…)
আদিম শ্রেণীহীন সমাজ : পর্ব দুই>>
…………………….
ভাববাদ খণ্ডন – মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………
আরও পড়ুন-
আদিম শ্রেণীহীন সমাজ : পর্ব এক
আদিম শ্রেণীহীন সমাজ : পর্ব দুই
……………
আরও পড়ুন-
অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি এক
অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি দুই
তন্ত্রের অর্থ, প্রাচীনত্ব ও সম্প্রদায়-ভেদ
তন্ত্রের দেহতত্ব
লোকায়ত, তন্ত্র, সাংখ্য : অসুর-মত
……………….
আরও পড়ুন-
মানুষ কী কারণে অসুখী হয়?
বায়রনীয় অ-সুখ
বিরক্তি এবং উত্তেজনা
অবসাদ
ঈর্ষা
পাপের চেতনা
সুখলাভ কি তবু সম্ভব?
উদ্দীপনা
স্নেহ-ভালবাসা
সুখী মানুষ