ভবঘুরেকথা
সৎকার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া জন্মান্তর

অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি দুই

-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

কিন্তু তাই বলে সত্তার দিক থেকে চেতনার বা চিন্তার দাবিই চরম দাবি নয়; বস্তুসত্তা ন্যায়শাস্ত্রের মুখাপেক্ষী নয়, বরং ন্যায়শাস্ত্ৰই বস্তুসত্তার মুখাপেক্ষী। কিন্তু আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ চার্বাকপন্থীদের মধ্যে আশা করা মূঢ়তার পরিচয় হবে, তারা যে সমাজের দার্শনিক সেই সমাজের প্রতিচ্ছবিই তাঁদের দর্শনে।

এই কথা বিশেষ করে মনে রাখা দরকার চার্বাকপন্থীদের সুখসর্বস্ব নীতিবাদ সম্বন্ধেও। চার্বাকপন্থী বলেন, জড়াজগৎই যেহেতু একমাত্র সত্য সেইহেতু ইহজগতের ভোগমুখই মানুষের একমাত্র পুরুষার্থ। দেহ একবার ভস্মীভূত হলে পুনরাগমনের আর সম্ভাবনাই নেই, অতএব যতদিন বাঁচা যায়, সুখে করে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে সুনীতি সম্বন্ধে এই সুখসর্বস্ব মতবাদ।

কিন্তু বস্তুবাদের একমাত্র অনুসিদ্ধান্ত নয়। বস্তুত, আধুনিক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ এমনতর কথা মোটেই বলে না। তবু চার্বাকপন্থীর সমসাময়িক সমাজের ছবি মনে রাখলে এই সুখাবাদের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, এ মতবাদের প্রচলন হলো বৈদিক যুগের ঠিক পরেই, পুরোহিত শ্রেণী তখন অনেকাংশে দেশের শাসক-সম্প্রদায়, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই চার্বাক্যবাদের মূল প্রেরণা।

ফলে, পুরোহিত যদি বলেন; ধার করে হোক আর যেমন করেই হোক, পিতৃশ্রাদ্ধের দিন পুরোহিত ভোজন করাতে ভুললে চলবে না, তার উত্তরে, চার্বাকের পক্ষে বলে বসাই স্বাভাবিক : ধার করেই হোক আর যেমন করেই হোক, নিজের পেটটা আগে ঠাণ্ডা রাখাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ!

বিপক্ষদল তর্ক করতে পারেন : এ পৃথিবী শুধু দুঃখময়, তাই এখানে ভোগান্বেষণ করতে গেলে শেষ পর্যন্ত দুঃখের জালেই জড়িয়ে পড়তে হবে। চার্বাকপন্থী তার উত্তরে বলেন : মাছ খেতে গেলে গলায় কাঁটা বেঁধবার ভয় নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তাই বলে কি মাছ খাবার চেষ্টাই করবে না?

এ কথা ঠিক যে, শুধু এইটুকু বললেই চার্বাকদের মুখসর্বস্ব নীতিবাদের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের মতে মুখসর্বস্ব নীতিবাদ শুধু সেই শ্রেণীরই মুখপত্র হতে পারে, যে-শ্রেণী সমাজে মুখের অধিকার পেয়েছে। মার্কস-এর পত্রগুচ্ছ দ্রষ্টব্য।

যদি তাই হয়, তাহলে চার্বাকদর্শনের পেছনে সুখসম্ভোগের অধিকারী কোন শ্রেণীকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? চার্বাকদর্শনকে জনগণের দর্শন বলেছি। তাহলে এই নীতিবাদ এল কোথা থেকে? এই নীতিবাদ বস্তুবাদমাত্রেরই অনুসিদ্ধান্তু তো নয়।

বস্তুত, শ্রেণী সংগ্রামের দিক থেকে চার্বাকদর্শনের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে যাওয়া দুঃসাহসের কথা। তার কারণ এ নয় যে, চার্বাকদর্শনে শ্রেণী সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি অস্পষ্ট। তার আসল কারণ এই যে, প্রাচীন ভারতীয় সমাজে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাসটুকু অত্যন্ত অস্পষ্ট, কেননা আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এ এ বিষয়ে পর্বাপ্ত গবেষণা করেননি।

তাই দর্শনের ছাত্রকে এগুতে হয়। উলটো দিক থেকে; সামাজিক ইতিহাসের পাশাপাশি দর্শনের ইতিহাসকে বোঝাবার মতো মালমশলা নেই বলে দর্শনের ইতিহাসে শ্রেণীসংগ্রামের যে স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।

তাকেই প্রধান সুত্র বলে মেনে নিয়ে সমাজের বিস্মৃত ইতিহাস থেকে শ্রেণী সংগ্রামের কথা খুড়ে বের করবার আশায়। নইলে যে দর্শনের ইতিহাস খামখেয়ালের দুৰ্বোধ্য পরম্পরা হয়েই থেকে যায়।

দর্শন জিনিসটে ব্যক্তিগত দার্শনিকদের খেয়ালী চিন্তা নয়, নৈর্ব্যক্তিক সত্যাম্বেষণাও নয়। সংস্কৃতির অন্যান্য অঙ্গের মতো দর্শনের ইতিহাসেও সামাজিক ইতিহাসেরই প্রতিচ্ছবি, এবং সমাজের ইতিহাস যেহেতু শ্রেণীসংগ্রামেরই ইতিহাস-সেইহেতু দার্শনিক মতবাদমাত্রই শ্রেণী:স্বার্থের রঙে রঞ্জিত।

এই অভিজ্ঞতার আলোয় দেশের দর্শনকে বুঝতে পারার আশা নিশ্চয় দুরাশা নয়। কারণ এ দেশ আমার দেশ হলেও এমন কিছু সৃষ্টিছাড়া আজব দেশ নয়। অথচ সুধীসমাজে। ভারতীয় দর্শনের যে আলোচনা আজও প্রচলিত, তা নেহাতই ভাবালুতার ভারে ভারাক্রান্ত, ভ্রান্ত স্বাদেশিকতার বিড়ম্বনায় বিকৃত।

প্রত্যেক সমাজেরই একদিকে শোষক-শাসক শ্রেণী এবং অপরদিকে শোষিত শ্রেণী। শোষক শ্রেণী সংখ্যায় স্বল্প বলেই শাসিত শ্রেণীকে মোটামুটি জনগণ বলে উল্লেখ করা যায়। লোকোত্তর দর্শন শাসক শ্রেণীর দর্শন, কেননা লোকোত্তরে শাসিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে লোকায়তের হাজার গ্লানি তুচ্ছ ও নশ্বর বলে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, জনগণকে নিরাপদ, নিরুপদ্রব করে রাখা যায়।

লোকায়তিক দর্শন জনগণের দর্শন, কারণ জনগণকে খেতে হয়। গতির খাটিয়ে-পরান্নে ভূরিভোজন তাদের কপালে নেই- এবং গতির খাটিয়ে খেতে হলে বাস্তব পৃথিবীর দুৰ্নিবার যাথার্থ্য নিয়ে তর্ক করবার উপায়ও থাকে না, মেজাজও না।

লোকায়তিক দর্শন জনগণের স্বার্থে উদ্দীপ্ত, শাসক শ্রেণীর শোষণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হলে মানতেই হয় শোষণের গ্লানিতে ভরা এই মাটির পৃথিবী স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মানসিক ধারণামাত্ৰও নয়। অবশ্য জনগণ আর তাদের দাবি কোনো বিশেষ সমাজের একচেটিয়া লক্ষণ নয়, তবুও লোকায়তিক দর্শন প্রত্যেক যুগে প্রসারলাভ করতে পারেনি।

কারণ একটি বিশেষ যুগের দর্শনে শুধু সেই শ্রেণীর কথাই প্রতিফলিত হয় যে-শ্রেণী সমাজব্যবস্থার মধ্যেও অগ্রণী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফরাসী বিপ্লবের সময় জনগণ এগিয়ে এসেছিল। উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর পাশাপাশি, সে যুগের ফরাসী দর্শনে তাই বস্তুবাদের অমন প্রতিপত্তি।

আজকের পৃথিবীর এক বিরাট দেশে জনগণ নতুন পৃথিবী গড়বার পণ করেছে, তাদের কাছে তাই বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদই একমাত্র দর্শন।

য়ুরোপীয় সভ্যতার আলোচনায় ওই তথ্য শুধু অভ্রান্ত নয়, দর্শনের ইতিহাসকে বোঝাবার একমাত্র উপায়। কেননা অন্য যে-কোনোভাবেই চেষ্টা করা যাক না কেন, দর্শনের ইতিহাস শেষ পর্যন্ত হয় ব্যক্তিগত মানুষের খেয়ালী চিন্তার অর্থহীন পরম্পরা, আর না-হয় হেগেলীয় ব্রহ্মের দুর্বোধ্যতম লীলাখেলার কাল্পনিক উপাখ্যান হয়ে থাকে।

এই অভিজ্ঞতার আলোয় দেশের দর্শনকে বুঝতে পারার আশা নিশ্চয় দুরাশা নয়। কারণ এ দেশ আমার দেশ হলেও এমন কিছু সৃষ্টিছাড়া আজব দেশ নয়। অথচ সুধীসমাজে। ভারতীয় দর্শনের যে আলোচনা আজও প্রচলিত, তা নেহাতই ভাবালুতার ভারে ভারাক্রান্ত, ভ্রান্ত স্বাদেশিকতার বিড়ম্বনায় বিকৃত।

কিন্তু বিপদ এই যে, ঐতিহাসিক তথ্যের সম্বল অতি স্বল্প, এবং সেইটুকুর উপর নির্ভর করে শ্রেণী-সংগ্রামের দিক থেকে ভারতীয় দর্শনের ব্যাখ্যা দিতে যাওয়া দুঃসাহস। ভরসার কথা শুধু এইটুকুই যে, এ-আলোচনার ভুলভ্রান্তি যোগ্যতার ব্যক্তিকে যোগ্যতম আলোচনায় উদ্দীপ্ত করতে পারে এবং তিনি ভারতীয় দর্শন নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনার পথ খুলে দিতে পারেন।

প্রথম কথা হলো চার্বাকদর্শনের কাল নিৰ্ণয়। এ দর্শনের উপর কোনো যুগে কোনো সম্পূর্ণ গ্রন্থ রচিত হোক আর নাই হোক, বিশেষ কোনো ব্যক্তি এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বা প্রধান প্রচারক হোন বা না-হোন, এ কথায় কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই দর্শন এককালে আমাদের দেশে রীতিমত শোরগোল শুরু করেছিল এবং কালক্রমে এ দর্শনকে দেশের বুক থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলবার চেষ্টাও নিশ্চয়ই হয়েছিল।

কোন যুগে প্রচারিত হয়েছিল। এই দর্শন? নানান প্রাচীন গ্রন্থে লোকায়তিক দর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীনতম বৌদ্ধ গ্রন্থে, এমন-কী মহাভারতে ও উত্তর উপনিষদে, এ মতবাদের কথা আছে! এই সাক্ষ্যগুলির উপর নির্ভর করে আধুনিক পণ্ডিতেরা (রাধাকৃষ্ণন, গার্বে ইত্যাদি) প্রমাণ করেন যে, বৈদিক যুগের ঠিক পরে-আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে-দেশে এই দর্শনের প্রচলন হয়েছিল।

ভারতীয় সভ্যতার এই সময়টা ছিল যুগসন্ধির যুগ। রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোড়নের যেন শেষ নেই-সেই আলোড়নের ঢেউ যে দর্শনের মতো তথাকথিত নৈর্ব্যক্তিক রাজত্বেও এসে লাগবে, তাতে বিস্ময়ের অবকাশ নেই। এমন-কী শ্রীযুক্ত রাধাকৃষ্ণনের মতো ভারতীয় দর্শনের আধ্যাত্মিক ঐতিহাসিক এ কথা অস্বীকার করতে চান না।

ভাষার ঝঙ্কার দিয়ে, অলংকারের চোখ-ধাধানো কারিগরি করে এই মূল প্রশ্নকে ঢেকে রাখা যেতে পারে, কিন্তু এর কোনো মীমাংসা দেওয়া যায় না। বস্তুত ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ছাড়া যুগে যুগে সভ্যতার পরিবর্তনগুলো নেহাতই হেঁয়ালি হয়ে থাকে। হাজার রকম আধ্যাত্মিক গোঁজামিল দিয়েও এগুলির ব্যাখ্যা হয় না।

কিন্তু যে করে হোক একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা তিনি দেবেনই দেবেন। ফলে সমস্ত ব্যাপারটাই অর্থহীনতায় অদ্ভুত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“লোকাচার আর তন্ত্রমূলক পুৱানো ধর্মবিশ্বাসকে খণ্ডন করবার ব্যাপারে এই বস্তুবাদের অবদান অনেকখানিই ছিল। চার্বাক্যমতের মতো বিস্ফোরক শক্তির সাহায্যে বহু শতাব্দীর অন্ধবিশ্বাসকে যদি ঝাকুনি দেওয়া না হতো, তাহলে দীর্ঘ যুগের সমর্থন-লব্ধ তখনকার আচার-বিচারকে উদার-পন্থা অনুসারে সংস্কার করবার চেষ্টা বিফল হতে বাধ্য হতো।

বস্তুবাদ ঘোষণা করে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক মুক্তি, উচ্ছেদ করে আপ্তবাক্যমূলক ব্যবস্থার; বুদ্ধির দাবির কাছে যার সাক্ষি টেকে না, ব্যক্তি তাকে স্বীকার করবে না। বস্তুবাদ হলো মানবাত্মার পক্ষে নিজেকে ফিরে পাওয়া, যা-কিছু বাইরের জিনিস আর বিদেশী তাকেই পরিত্যাগ করা।

অতীতের বোঝা এই যুগের শ্বাসরোধ করেছিল। চার্বাকদর্শন তার হাত থেকে মুক্তি দেবার জন্য পাগলের মতো চেষ্টা। বিশুদ্ধ চিন্তার গঠনমূলক চেষ্টাকে ঠাই করে দেবার জন্যে দরকার ছিল গোঁড়ামি দূর করা, এ দর্শন তা করতে সক্ষম হয়েছিল।”

সোজাসুজি বলা যায়। এগুলি নেহাতই স্থূল অসত্য, কেননা চার্বাকবাদ আধ্যাত্মিকতার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ, এর প্রধান উৎসাহ নিছক বুদ্ধির দাবিকে অস্বীকার করবার, এ মতবাদ আত্মার কোনো অস্তিত্বই মানে না।

তাই আধ্যাত্মিক আত্মোপলব্ধির কোনোরকম পথ প্রদর্শন করায় চার্বাকপন্থীর মধ্যে আগ্রহ-কল্পনা নেহাতই বাড়াবাড়ি, এবং বুদ্ধির কাল্পনিক পটকাবাজির জন্তে চার্বাকদের মাথাব্যথার কথাটুকু প্রায় হাস্যকর। আশা করি, শ্রীযুক্ত রাধাকৃষ্ণনের মতো বিদগ্ধ পণ্ডিত এই স্থূল অসত্যগুলিকে নেহাত অলংকারের খাতিরেই উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু তবুও, অলংকারের খাতিরে এসব কথা মেনে নিলেও, তার প্রধান বক্তব্যটুকু সহজবুদ্ধির কাছে অর্থহীনতায় দুর্যোধ্যই থেকে যায়! আসল কথা হলো : বৈদিক যুগের ক্রিয়াকাণ্ড থেকে মানুষের মনকে সরিয়ে নেবার জন্যে এত মাথাব্যথা ঠিক কার?

কার মাথাব্যথা উন্মুক্ত বুদ্ধির নির্মল দর্শনের জন্যে পথ পরিষ্কার করে দেবার? ইতিহাসের? নবযুগের? না, ইতিহাসের ক্রমবিকাশের মধ্যে দিয়ে লীলাখেলায় প্রমত্ত কোনো হেগেলীয় পরব্রহ্মের?

ভাষার ঝঙ্কার দিয়ে, অলংকারের চোখ-ধাধানো কারিগরি করে এই মূল প্রশ্নকে ঢেকে রাখা যেতে পারে, কিন্তু এর কোনো মীমাংসা দেওয়া যায় না। বস্তুত ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ছাড়া যুগে যুগে সভ্যতার পরিবর্তনগুলো নেহাতই হেঁয়ালি হয়ে থাকে। হাজার রকম আধ্যাত্মিক গোঁজামিল দিয়েও এগুলির ব্যাখ্যা হয় না।

অবশ্যই, শাসক সম্প্রদায় হিসেবে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয়ের মধ্যে একতা থাকলেও, স্বার্থ বিভাগের দিক থেকে দুই শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব নিশ্চয়ই ছিল-পরশুরাম ও কর্তবীর্বার্জন প্রভৃতির উপাখ্যানে তার প্রতিচ্ছবি। এই সমস্ত দিক থেকে প্রাচীন ভারতে শ্রেণী সংগ্রামের ছবি অত্যন্ত জটিল, সন্দেহ নেই।

অথচ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের অর্থ প্রাঞ্জল। সমাজের কাঠামো নির্ভর করে ধন উৎপাদন ও বণ্টনের ব্যবস্থার উপর। ফলে, এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন এলে সমাজের চেহারাও বদলে যায়; পুরোনো শাসক শ্রেণীর পরিবর্তে দেখা দেয় নতুন শাসক শ্রেণী। এবং সংস্কৃতি জিনিসটে যেহেতু শাসক শ্রেণীরই মুখপত্র, সেইহেতুই নতুন সমাজে সংস্কৃতির রূপান্তর চোখে পড়ে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে চার্বাক-দর্শনকে বোঝবার মতো খণ্ড ও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু মালমশলা জোগাড় করা যাক। তবু সেটুকুর সাহায্যে প্রাচীন ভারতে এই দর্শনের আবির্ভাবের উপর যেটুকু আলোকপাত করা যায়, তার মূল্যও সামান্য নয়।

শ্রীযুক্ত ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় দেখাতে চাইছেন, প্রাচীন বৈদিক যুগে ভারতীয় সমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দিয়েছিল, তবু শ্রেণী সংগ্রাম প্রকট হয়ে পড়েনি। তার কারণ প্রাচীন বৈদিক সমাজের অর্থনীতিতে আদিম সাম্যতন্ত্র ছেড়ে আদিম সামন্ত প্রথার দিকে অগ্রসর হবার লক্ষণ।

সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি কৃষিসভ্যতার দিকে যত অগ্রসর হয়েছে, শ্রেণীসংগ্রামও ততই স্পষ্ট ও ব্যক্ত হয়ে পড়েছে। তাই পদানত জনগণ বা শূদ্র সম্বন্ধে ঋগ বেদে উল্লেখ শুধু এক জায়গায়। পুরুষসুক্তে, এবং এই পুরুষসূক্ত অনেক পণ্ডিতের মতেই আসলে উত্তর কালে রচিত হয়েছে এবং পিগ বেদের মুধ্যে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।

পুরুষসুক্তে। শ্রেণীবিভাগের প্রথম প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। বৈদিক ঋষি বলেছেন : “সেই বিরাট পুরুষের মুখ থেকে জন্ম হয়েছে ব্রাহ্মণের, তার হাত থেকে রাজন্যের, তার উরু থেকে জন্মেছে বৈশ্য এবং তার পা থেকে জন্মেছে। শূদ্র।”

আবার, “ইন্দ্র আর অগ্নি জন্মেছে তার মুখ থেকে- তার পা থেকে পৃথিবী বা মৃত্তিকা।” অর্থাৎ, জনগণ বা শূদ্রের সঙ্গে মাটির সম্পর্ক যেন নাড়ির সম্পর্ক। এই বর্ণনার মধ্যে ঐতিহাসিক তথ্যের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। আদিম সাম্যাবস্থায় সমস্ত মানুষেরই সামাজিক অবস্থা সমজাতিক ও সদৃশ ছিল, যেন এক অভিন্ন বিরাট পুরুষ।

কালক্রমে ভারতীয় সমাজ চারটি বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথমত, যুদ্ধের দায়িত্ব ও কৃষি উৎপাদনের দায়িত্ব পৃথক হয়ে যায়, উৎপাদনের দিক থেকে উন্নত সমাজের রক্ষাকার্যের জন্যে এ বিভাগ প্রয়োজন ছিল। যোদ্ধার দল নিশ্চয়ই বাহুবলে নিজেদের শাসকশ্রেণী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছিল।

কিন্তু বাহুবলে প্রতিষ্ঠাকে আরও মজবুত করবার জন্যে প্রয়োজন হয় ধর্মবল ও যুক্তিবলের প্রতিষ্ঠা। তাই, ক্রমশ এই রাজন্য শ্রেণীর মধ্যে থেকে ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত শ্রেণীর উদয় হলো-বিশ্বামিত্র প্রভৃতির উপাখ্যানে এই ঐতিহাসিক সত্যের প্রতিচ্ছবি।

অবশ্যই, শাসক সম্প্রদায় হিসেবে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয়ের মধ্যে একতা থাকলেও, স্বার্থ বিভাগের দিক থেকে দুই শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব নিশ্চয়ই ছিল-পরশুরাম ও কর্তবীর্বার্জন প্রভৃতির উপাখ্যানে তার প্রতিচ্ছবি। এই সমস্ত দিক থেকে প্রাচীন ভারতে শ্রেণী সংগ্রামের ছবি অত্যন্ত জটিল, সন্দেহ নেই।

এই বিপ্লবকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করা ছাড়াও শাসকশ্রেণী এ বিপ্লবের সমস্ত চিহ্ন ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে। তবু প্রাচীন ইতিহাসে এ বিপ্লবের অস্পষ্ট স্বাক্ষর; ছন্দ্যোগ্য উপনিষদে জনশ্রুতি নামে শূদ্র রাজার বিবরণ, শতপথ ব্রাহ্মণে শূদ্র মন্ত্রীদের কথা, মৈত্রেয়ানী সংহিতায় শূদ্র ধনী ব্যক্তির উল্লেখ।

তবু পুরুষস্যক্তে এই যে বহিঃরেখা পাওয়া যায়, তার তাৎপর্য স্পষ্ট। একদিকে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয়ের শাসক শ্রেণী, ব্রহ্ম-তেজ ও ইন্দ্রবিক্রমে তারা শাসন-কাজ চালাত; পরের উৎপাদনে চলত তাদের সংসার, তাই মাটির সঙ্গে সম্পর্ক বড় একটা ছিল না।

অপরদিকে, শূদ্র বা জনগণ; উৎপাদনের সমস্ত দায়িত্ব তাদের ঘাড়ে, তাই মাটির সঙ্গে তাদের যেন নাড়ির যোগ। সেই বিরাট পুরুষের-সেই আদিম সমজাতিক মনুন্য সমাজের-পায়ের থেকে জন্মেছে। শূদ্র, আর জন্মেছে মাটি, -শূদ্রের অন্তরঙ্গ আত্মীয়।

এ কথা ঠিক যে, শ্রেণী সংগ্রামের এই রূপ ভারতীয় সমাজে হঠাৎ একদিন ফুটে ওঠেনি এবং সে রূপ। এত সরলও নয়।

তবু এ কথাতেও সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বৈদিক যুগের শেষেরদিক থেকে ভারতীয় সমাজে শ্রেণীসংগ্রাম প্রকট থেকে প্রকটতর হতে শুরু করেছে, কেননা এই সময়টায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল, ভারতবর্ষে “এশিয়াটিক সামন্তসমাজে’র ভিত পাকাপাকিভাবে গড়ে উঠেছিল।

যুগসন্ধির এই সময়ে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সংগ্রাম কঠোর ও তীক্ষ্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সব সংগ্রামের মধ্যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের শাসক-ভাগ্য ভাগাভাগি করা নিয়ে যে মারামারি, তারই ঐতিহাসিক প্রতিচ্ছবি সবচেয়ে বেশি করে পাওয়া যায়।

রামায়ণে এই সংগ্রামের ব্রাহ্মণ-সংস্করণ, বৌদ্ধ ও জৈন পুঁথিতে তার ক্ষত্ৰিয়সংস্করণ। এই দুটি সংস্করণই যে ভালোভাবে টিকে গিয়েছে, তার কারণ শাসক শ্রেণীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত স্বার্থের যেন খানিকটা ভাগাভাগি হয়ে গেল।

কিন্তু এই শ্রেণী-সংগ্রামের মধ্যে শূদ্রদল বা জনগণ বিপক্ষের জয় বা নিজেদের পরাজয় যে নেহাত অসহায়ভাবে মেনে নিয়েছিল, এমন কথা মনে করবার কোন কারণ নেই।

বস্তুত এই সংগ্রামের কোনো স্পষ্ট শূদ্র-সংস্করণ ইতিহাসে টিকে না থাকলেও খণ্ডবিক্ষিপ্ত কয়েকটি তথ্য থেকে এটুকু স্পষ্টই বোঝা যায় যে, শূদ্র-শ্রেণীও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠবার চেষ্টা মাঝে মাঝে করেছিল, করেছিল বিপ্লব-ঘোষণা।

এই বিপ্লবকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করা ছাড়াও শাসকশ্রেণী এ বিপ্লবের সমস্ত চিহ্ন ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে। তবু প্রাচীন ইতিহাসে এ বিপ্লবের অস্পষ্ট স্বাক্ষর; ছন্দ্যোগ্য উপনিষদে জনশ্রুতি নামে শূদ্র রাজার বিবরণ, শতপথ ব্রাহ্মণে শূদ্র মন্ত্রীদের কথা, মৈত্রেয়ানী সংহিতায় শূদ্র ধনী ব্যক্তির উল্লেখ।

গৌতম, আপস্তম্ভ, মনু প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রকাররা যে-শূদ্র সম্বন্ধে কিছুদিনের মধ্যে কঠোরতম বিধিনিষেধের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই শূদ্রকে নিশ্চয়ই আদর আপ্যায়িত করে রাজা-উজির বানানো হয়নি। তারা যদি রাজা-উজির হয়ে থাকে, তা হলে তা নিছক নিজেদের জোরেই হতে পেরেছিল।

তাই এগুলিকে শূদ্রবিপ্লবের খণ্ড বিক্ষিপ্ত স্বাক্ষর বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। সংস্কৃতির স্তরে এই বিপ্লবের প্রতিচ্ছবিই চার্বাক-দর্শনে। এবং চার্বাক-দর্শন তাই প্রাচীন ভারতীয় শ্রেণীসংগ্রামের একমাত্র শূদ্র-সংস্করণ। আরও একটা কথা এই স্বত্রে বুঝতে পারা সম্ভব।

আগেই বলেছি, সুখসর্বস্ব নীতিবাদ বস্তুবাদের একমাত্র অনুসিদ্ধান্ত হতে বাধ্য নয়; মার্কস-মতে এ নীতিবাদ শুধু তারই মনের কথা হতে পারে, সমাজে যে মুখসম্ভোগের অধিকার পেয়েছে।

খোদ দেবতাদের গুরুদেবের ফন্দিফিকির নিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তোলা সামান্য মানুষের পক্ষে নিশ্চয়ই শোভা পায় না। পুরোহিত শ্রেণী হয়তো তাই নিশ্চিন্ত ছিল, এ প্রশ্ন কোনোদিন উঠবে না। তা ছাড়া, লোকায়তে বিশ্বাস করলে লড়াইতে হার মানবার ভয় যে কেন, সে যুক্তিও সহজবুদ্ধির কাছে অস্পষ্ট।

তাই যে সব শূদ্র রাজা বা শূত্র ধনী ব্যক্তির উল্লেখ ইতিহাসে পাওয়া যায়, তাদের মুখে সুখসর্বস্ব নীতিবাদ কল্পনা করা অসঙ্গত নয়, সমাজে সুখের অধিকারী তারা নিশ্চয়ই হয়েছিল, এবং যেহেতু মূলত তারা শূদ্রই, সেইহেতু শূদ্র-শ্রেণীর সাধারণ দর্শনের সঙ্গে তাদের ভোগবিলাসী নীতিবাদ মিশে যাবার প্রচুর সম্ভাবনা।

অবশ্যই একদিক থেকে এ সমস্ত কথাই নিছক অনুমান মাত্র, কেননা নিশ্চিত ও পর্বাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্য আপাতত যেটকু সংগ্রহ করা সম্ভব, তা দিয়ে প্রত্যেকটি কথা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বৈদিক যুগের পরে ব্রাহ্মণরা যে একের পর এক ধর্মশাস্ত্র রচনা করে শূদ্রদের নির্মমভাবে দাবিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছিল, সে কথাটকু নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক সত্য।

গৌতম, আপস্তম্ভ, মনু থেকে রঘুনন্দন পর্যন্ত এই প্রচেষ্টার ইতিহাস প্রসিদ্ধ ও দীর্ঘ। আপাতত তার উল্লেখ না করলেও চলবে। কেবল এই কঠোর থেকে কঠোরতার বিধানপরম্পরা সম্বন্ধে একটা প্রশ্ন না তুললেই নয়; শূদ্র-বিপ্লবের পুনরুক্তি সম্বন্ধে ভয় না থাকলে শাসক শ্রেণী এমন বিচলিত মনোবৃত্তির পরিচয় দেবে কেন?

চার্বাক-দর্শনের উৎপত্তি সম্বন্ধে দেশে যে প্রবাদ প্রচলিত হয়েছে, তার মধ্যেও এই বিচলিত মনোভাবেরই পরিচয়। শূন্ত্রদের সমাজে দমন করেও, শূদ্রদর্শনের পুঁথি নিশ্চিহ্ন করেও পুরোহিত শ্রেণীর মনে শান্তি ছিল না। কেননা, জনগণ যেন মরেও মরতে চায় না, তাদের লোকায়ন্তিক দর্শন বারবার খণ্ডন করা হলেও এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া কঠিন।

দুরুচ্ছেদং হি চার্বাকস্য চেষ্টতম। এই দশনকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করবার আশাতে পুরোহিত-শ্রেণী তাই রটিয়ে দিল- সত্যি বলতে কী, ওই ভ্রান্ত দর্শন এককালে আমরাই রচনা করেছিলুম। আসলে দেবতাদের সঙ্গে তখন অসুরদের জোর লড়াই চলেছিল, অম্বরের এমন লড়াই লড়ছিল যে দেবতাদের অবস্থা প্রায় টলোমলে।

তখন দেবতাদের গুরুদেব বৃহস্পতি এক ফন্দি আঁটলেন। এক ভ্রান্ত ও হেয় দর্শন রচনা করে অসুরদের মধ্যে গিয়ে সেই দর্শন প্রচার করে দিলেন -এই ভ্রান্ত দশনের মোহে পড়ে তারা ভোগ-বিলাসী হয়ে পড়ল, তার চরিত্র হারাল এবং শেষ পর্যন্ত দেবতাদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো।

খোদ দেবতাদের গুরুদেবের ফন্দিফিকির নিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তোলা সামান্য মানুষের পক্ষে নিশ্চয়ই শোভা পায় না। পুরোহিত শ্রেণী হয়তো তাই নিশ্চিন্ত ছিল, এ প্রশ্ন কোনোদিন উঠবে না। তা ছাড়া, লোকায়তে বিশ্বাস করলে লড়াইতে হার মানবার ভয় যে কেন, সে যুক্তিও সহজবুদ্ধির কাছে অস্পষ্ট।

তাই চতুর্মুখ ব্রহ্মার চারমুখ ভরা বেদ থাকলেও গলায় পৈতে নেই; কিন্তু গাঁজাখোর শিব ভূতপ্রেতের দলে নাচলেও তার গলায় পৈতে! হিন্দুসভ্যতার ইতিহাসে এমনতর দৃষ্টান্তর অভাব একটুও নেই।

কিন্তু আসল কথা হলো, এই প্রবাদটির মধ্যে ব্রাহ্মণ-শ্রেণীর একটি আদশ পদ্ধতির পুনরুল্লেখ পাওয়া যায়। সংস্কৃতির স্তরে ব্রাহ্মণ শ্রেণী বিপক্ষকে শুধু খণ্ডন করেই ক্ষান্ত হয় না, কোনো মতে নিজের শ্রেণীর মধ্যে বিপক্ষকে শুষে নেবার চেষ্টা করে।

তাই ভগবান বুদ্ধ দশ অবতারের এক অবতার হয়ে গেলেন। শুধু দর্শনের বেলাতে নয়, ব্রতের বেলাতেও একই পদ্ধতি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিয়েছেন, কেমনভাবে দেশের ঘোষিত প্রচলিত বা মেয়েলি ব্রতগুলিকে শাস্ত্রীয় ব্রতের মধ্যে শুষে নেবার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই রকম অজস্র উদাহরণ সাহিত্যে শিল্পে দেবদেবীর কল্পনায়-সংস্কৃতির প্রায় সমন্ত ক্ষেত্রেই। অতুলচন্দ্র গুপ্তর সেই ছোট্ট প্রবন্ধটির কথা মনে পড়ল : “গণেশ”। “সর্ববিঘ্নহর ও সর্বসিদ্ধিদাতা বলে যে দেবতাটি হিন্দুর পূজা-পার্বণে সর্বাগ্রে পূজা পান, তার ‘গণেশ” নামেই পরিচয় যে তিনি ‘গণ’ অর্থাৎ জনসংঘের দেবতা।

এ থেকে যেন কেউ অনুমান না করেন যে, প্রাচীন হিন্দুসমাজের যারা মাথা, তার জনসংঘের উপর অশেষ ভক্তি ও প্রীতিমান ছিলেন। যেমন আর সব সমাজের মাথা, তেমনি তারাও সংঘবদ্ধ জন-শক্তিকে ভক্তি করতেন না, ভয় করতেন!…

আদিতে গণেশ ছিলেন কর্মসিদ্ধির দেবতা নয়, কর্মবিঘ্নের দেবতা। যাজ্ঞবল্ক স্মৃতির মতে এঁর দৃষ্টি পড়লে রাজার ছেলে রাজ্য পায় না, কুমারীর বিয়ে হয় না…বণিক ব্যবসায়ে লাভ করতে পারে না…।

এইজন্যই গণেশের অনেক প্রাচীন পাথরের মূতিতে দেখা যায় যে শিল্পী তাকে অতি ভয়ানক চেহারা দিয়ে গড়েছে; গণশক্তির উপর প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার কর্তাদের মনোভাব কী ছিল, তা গণেশের নর-শরীরের উপর জানোয়ারের মাথার কল্পনাতেই প্রকাশ।”

কিংবা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে-রকম দেখাবার চেষ্টা করেছেন, আদিদেব মহাদেবের কল্পনাটা ব্রাহ্মণদের পক্ষে আদিবুদ্ধর কথা আত্মসাৎ করবার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়-

‘খৃষ্টান পাদ্রীরা যেমন দীক্ষিত ব্যক্তির মাথায় জল ছিটাইয়া দিয়া দলে টানিয়া লন সেইরূপ ব্রাহ্মণের আদিবুদ্ধের গলায় যজ্ঞোপবীতের ফাঁস নিক্ষেপ করিয়া তাঁহাকে আপনাদের দলে টানিয়া লইলেন।”

তাই চতুর্মুখ ব্রহ্মার চারমুখ ভরা বেদ থাকলেও গলায় পৈতে নেই; কিন্তু গাঁজাখোর শিব ভূতপ্রেতের দলে নাচলেও তার গলায় পৈতে! হিন্দুসভ্যতার ইতিহাসে এমনতর দৃষ্টান্তর অভাব একটুও নেই।

(সমাপ্ত)

<<অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি এক

…………………….
ভাববাদ খণ্ডন – মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………
আরও পড়ুন-
অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি এক
অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি দুই
তন্ত্রের অর্থ, প্রাচীনত্ব ও সম্প্রদায়-ভেদ
তন্ত্রের দেহতত্ব
লোকায়ত, তন্ত্র, সাংখ্য : অসুর-মত

……………….
আরও পড়ুন-
মানুষ কী কারণে অসুখী হয়?
বায়রনীয় অ-সুখ
বিরক্তি এবং উত্তেজনা
অবসাদ
ঈর্ষা
পাপের চেতনা
সুখলাভ কি তবু সম্ভব?
উদ্দীপনা
স্নেহ-ভালবাসা
সুখী মানুষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!