ভবঘুরেকথা
হোম যজ্ঞ পুরোহিত পূজা পরব

অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি এক

-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

“না আছে বুদ্ধি, না খেটে খাবার মত গতর; এমনতর অকর্মণ্য যে পুরোহিতশ্রেণী, তাদেরই একটা হিল্লে হিসেবে রচিত হয়েছে অগ্নিহোত্র যজ্ঞের কথা, তিন তিনটে বেদ, এবং এইরকম আরও অনেক কিছু। আসলে স্বর্গ, অপবর্গ বা পারলৌকিক আত্মা বলে সত্যি কিছু নেই।”

ভাবতে অবাক লাগে : অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে আমাদের দেশে এই রকম সাংঘাতিক কথা শুনতে পাওয়া গিয়েছিল। শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আক্রোশটা স্পষ্ট।

তবু শুধু আক্রোশ নয়, সহজ বুদ্ধির নির্মল খণ্ডনপদ্ধতিও। চার্বাকপন্থী যেমম বলেন। কর্মজীবনের কষ্টিপাথরে শাসক-শ্রেণীর দাবিগুলোকে ঘষে দেখো, দেখবে কী অসম্ভব রকমের মেকি।

“জ্যোতিষ্টম যজ্ঞে নিহত পশু যদি সোজা স্বর্গেই যায়, তাহলে যজমান কেন নিজের ব্যাপকে হাড়িকাঠে ফেলে না? শ্রাদ্ধাপিণ্ড যদি পরলোকগীত মানুষের পেট ভরাতে পারে, তাহলে কেউ বিদেশ যাবার সময় তার সঙ্গে চিড়েমুড়ি বেঁধে দেবার আর দরকার কী?

(ঘরে বসে তার উদ্দেশে পিণ্ডি দিলেই তো চলা উচিত; হাজার হোক পরলোকের চেয়ে ইহলোকেরই দেশান্তর অনেক কাছে-পিঠের ব্যাপার)। কিংবা, স্বর্গে বসে পৃথিবীতে দেওয়া পিণ্ডে যদি কারুর সাধ মেটে, তাহলে ছাদে বসে মাটিতে দেওয়া পিণ্ডে তার পেট ভরে না কেন?’

এ সব থেকে অন্তত একথা নিশ্চয়ই প্রমাণ হয় যে, এ দর্শন সম্বন্ধে কোনো কালে কোনো সম্পূর্ণ গ্রন্থ লেখা হোক আর নাই হোক এবং সে-সব পুঁথি দেশের বুক থেকে বিলুপ্ত করারার জন্যে বিপক্ষ দলের চেষ্টা থাকুক। আর নাই থাকুক,- মতবাদটা দেশের দার্শনিক সমাজে এককালে রীতিমত শোরগোল সৃষ্টি করেছিল।

এই যেন চার্বাকপন্থীর খাঁটি দার্শনিক পদ্ধতি। কূট তর্কের দিকে ঝোঁক কম, মৌলিক চার্বাক্যবাদে একান্তই তা ছিল কিনা ভেবে দেখবার কথা। কাজের ক্ষেত্রে, আটপৌরে দৈনন্দিন জীবনে যাচিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে কোন দর্শনের কতখানি দৌড়।

অবশ্য এমন খোলাখুলি এই পদ্ধতির কথা তাঁরা বলতেন কি না জানা নেই; খুব সম্ভব বলতেন না,-দর্শনের পদ্ধতি নিয়ে তখনকার দিনে আজকালকার মতো এত তর্কাতকি নিশ্চয়ই ছিল না।

তা ছাড়া চার্বাক-দর্শনের কোনো সম্পূর্ণ পুঁথি আমাদের কাছ পর্যন্ত তো এসে পৌঁছয়নি, যদিও যে-সব খণ্ড বিক্ষিপ্ত শ্লোক আজো টিকে রয়েছে তার থেকে অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, কোনো-না-কোনো সময়ে এ দর্শনের উপর সম্পূর্ণ গ্রন্থ নিশ্চয়ই রচিত হয়েছিল। সে পুঁথি বিলুপ্ত হয়েছে।

এ ঘটনাকে শুধুই শতাব্দীর শোভাযাত্রার ফল বলে বর্ণনা করা চলবে না, কেননা শতাব্দীর শোভাযাত্রা সত্ত্বেও তো প্রাচীনতর অন্যান্ত গ্রন্থ বিলুপ্ত হয়নি। বরং অনুমান করা স্বাভাবিক যে, বিজয়ী ব্রাহ্মণ্য শ্রেণী দেশের বুক থেকে এই সাংঘাতিক নাস্তিক্যবাদের সমস্ত কীর্তিকলাপ ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল।

এই প্রচেষ্টার বহুমুখী স্বাক্ষর আছে। তবু এই দর্শনের যে সমস্ত টুকরো বিক্ষিপ্ত চিহ্ন আজও বর্তমান, তা থেকে এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, চার্বাকদের ব্রাহ্মণ্যবিদ্বেষ নিছক বিদ্বেষ ছিল না, রীতিমত দার্শনিক ভিত্তির উপর তার প্রতিষ্ঠা ছিল এবং বিপক্ষের বহুমুখী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ মতবাদকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেওয়া কোনোদিন সম্ভব হয়নি।

একথার সপক্ষে বহু প্রমাণের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হলো মাধবাচার্যের “সর্বদর্শনসংগ্রহ”। প্রায় ছশো বছর আগে লেখা এই পুঁথি, দেশের দার্শনিক আলোচনার আসর তখনো রীতিমতো সরগরম। সংস্কৃতে লেখা ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসের মধ্যে এ গ্রন্থ অন্যতম।

তাই একে প্রামাণিক বলে না মেনে উপায় নেই। অন্যান্য আস্তিক লেখকদের মতো মাধবাচার্য ঈশ্বর-বন্দনা করে গ্রন্থ শুরু করতে চেয়েছেন। কিন্তু এভাবে শুরু করতে গিয়েই তাঁর হুঁশ হয়েছে চার্বাকদের কথা : তারা ঈশ্বর, আত্মা, পরলোক সবাই উড়িয়ে দিতে চায়।

তাই, চার্বাকবাদ খণ্ডন করে না নিলে ঈশ্বরস্তুতির ভিত মজবুত হয় না। এই সূত্রে মাধবাচার্য একটি পরিপূর্ণ দার্শনিক মতবাদের বর্ণনা করেছেন, এমন-কী কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন, যা নাকি খোদ চার্বাকপন্থীদের রচনা বলেই সাধারণত স্বীকৃত।

সাধারণত এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনাটুকুকেই চার্বাক দর্শনের প্রধান সম্বল বলা হয়। এ ছাড়া অবশ্যই চার্বাক-দর্শনের খুচরো কথাবার্তা বিভিন্ন দার্শনিকদের গ্রন্থে বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায়, কিন্তু সমস্তটাই পূর্বপক্ষ হিসেবে।

এ সব থেকে অন্তত একথা নিশ্চয়ই প্রমাণ হয় যে, এ দর্শন সম্বন্ধে কোনো কালে কোনো সম্পূর্ণ গ্রন্থ লেখা হোক আর নাই হোক এবং সে-সব পুঁথি দেশের বুক থেকে বিলুপ্ত করারার জন্যে বিপক্ষ দলের চেষ্টা থাকুক। আর নাই থাকুক,- মতবাদটা দেশের দার্শনিক সমাজে এককালে রীতিমত শোরগোল সৃষ্টি করেছিল।

নইলে একে খণ্ডন করবার জন্যে সমস্ত দার্শনিক দিকপালের এত মাথাব্যথাই বা হবে কেন? মাধবাচার্য তো সোজাসুজি মেনে নিয়েছেন : দুরুচ্ছেদং হি চার্বাকস্য চেষ্টতম্‌, চার্বাক মত উচ্ছেদ করা নেহাত চাট্টিখানি কথা নয়।

চর্বণ ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের কাছে অগৌরবের কিছু নয়, -আভিজাতিক সমাজের ক্ষীণাঙ্গির কাছে চর্বণ জিনিসটা যত হীন আর নীচ পশুবৃত্তির পরিচয়ই হোক না কেন। তাই, একথা যদি প্রমাণও হয় যে, চর্ব শব্দ থেকে তাদের দর্শনের নামকরণ হয়েছে, তাহলেও জনগণের পক্ষে কান লাল করবার কোনো কারণ নেই, সম্ভাবনাও নেই।

তবু এ মত উচ্ছেদ করবার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। তাই এই দর্শনের যিনি প্রতিষ্ঠাতা বা প্রধান প্রচারক, তার নামটুকু পর্যন্ত ইতিহাস থেকে বেমালুম মুছে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো আধুনিক পণ্ডিত অবশ্য সোজাসুজি মনে করেন যে, চার্বাক বলেই এক ব্যক্তি এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, তার নাম অনুসারেই দর্শনটার নামকরণ।

কিন্তু দেশের প্রবাদ ও ঐতিহ্যে। এ মতের কোনো সমর্থন নেই। বরং প্রবাদ আছে যে, দেবতাদের গুরুদেব বৃহস্পতি এককালে কোনো এক কৃটি অভিপ্রায় চরিতার্থ করবার উদ্দেশ্যে এই মতবাদের প্রবর্তন ও প্রচার করেছিলেন।

মাধবাচার্যও চার্বাকদের সোজাসুজি “বৃহস্পতিমতানুসারী” বলেই বর্ণনা করেন। এই প্রবাদ, এবং এর মধ্যে ঐতিহাসিক সত্যের বিকৃত তথ্য আছে, তার আলোচনা পরে করব। আপাতত প্রশ্ন উঠবে; যদি তাই হয়, তাহলে “চার্বাক’ নাম এল কোথা থেকে?

আধুনিক পণ্ডিতেরা শব্দার্থের বিচারে এ প্রশ্নের জবাব খোঁজেন। হতে পারে, সাধারণ লোকের মন্নভোলানো কথা বলত বলে- চারু+বাক্‌-এদের নাম চার্বাক। হতে পারে চর্ব শব্দ থেকে এ নামের উৎপত্তি, অর্থাৎ চার্বাক হলো সেই দার্শনিকের নাম, খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে যে খুঁজত পরম পুরুষার্থ।

চার্বাকপন্থী যে সাধারণ মানুষের মনে ধরবার মত কথা বলুতেন, এ বিষয়ে অবশ্য সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা জনগণের সহজ কর্মবোধের কাছে এই লোকায়ত জগৎই একমাত্র সত্য। কৃষক জানে, তার পায়ের তলায় মাটি আর মাথার উপরে মেঘ-পৃথিবীর সমস্ত দার্শনিক তত্ত্বের চেয়ে ঢের বেশি সত্য।

এই মাটিতে লাঙল দিয়ে সে যে সোনার ফসল ফলায়, তা মায়া নয়, মনের খেয়ালী ধারণা নয়, আর এই সোনার ফসলের প্রায় সবটুকু যখন ওঠে জোতদারের গোলায়, তখন কৃষকের পেটে যে বাস্তব জ্বালা ধরে তার উপর অনেক রকম আধ্যাত্মিক প্রলেপ মাখিয়ে তবে ঠাণ্ডা রাখতে হয়।

পেটটা হলো মনের ধারণা, আর খালি পেটের যন্ত্রণাটা দীর্ঘ স্বপ্নের মতো প্রতিভাসিক-এমনতর। কথা শুধু তারই স্বার্থে রঞ্জিত, যে নিজে চাল উৎপাদন করতে নারাজ অথচ নৈবেদ্যর চাল দিয়ে সংসার চালাতে নিপুণ।

ধুলোমাটির গ্লানিমুক্ত এক চিন্ময় জগতের কথা জনগণের দর্শন হতে পারে না, জনগণের মনে ধরবার মতো কথাই চার্বাক দর্শনের কথা। আর জনগণের দর্শন বলেই খিদে পেলে পেট ভরে খাবার কথা বলতে এ দর্শনের চক্ষুলজা নেই।

চর্বণ ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের কাছে অগৌরবের কিছু নয়, -আভিজাতিক সমাজের ক্ষীণাঙ্গির কাছে চর্বণ জিনিসটা যত হীন আর নীচ পশুবৃত্তির পরিচয়ই হোক না কেন। তাই, একথা যদি প্রমাণও হয় যে, চর্ব শব্দ থেকে তাদের দর্শনের নামকরণ হয়েছে, তাহলেও জনগণের পক্ষে কান লাল করবার কোনো কারণ নেই, সম্ভাবনাও নেই।

শ্রেণী-সংগ্রামের আলোচনায় এসে পড়তে হয়। একদিকে জনগণ আর তাদের লোকায়ত দর্শন, অপরদিকে পুরোহিত শ্রেণী, যাগযজ্ঞ। আর পারলৌকিক আত্মার কথা। একদিকে নিদেন পেট ভরে খাবার কথা, (যদিও ধার-করে ঘি খাওয়ার উৎসাহটা নিশ্চয়ই অপপ্রচারের দরুন)।

চার্বাকপন্থীও বিপক্ষের শ্রেণীস্বার্থটুকু প্রকাশ করে দিয়ে ক্ষান্ত হননি, বিপক্ষকে নিরস্ত্র করতে কোমর বেঁধে লেগেছেন। বিশুদ্ধ তর্বাপদ্ধতি বলে, ব্যাপারটায় গোড়াতেই গলদ, তর্কের কোন দার্শনিক প্রতিষ্ঠা নেই। চার্বাকপন্থী বলেন, তর্ক-পদ্ধতির সবচেয়ে মামুলি উদাহরণটা নিলেই এ কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাবে।

অপর দিকে ইহজীবনে উপবাসী থেকে পুরোহিত ভোজন করিয়ে পরলোকে পরমান্ন পাবার স্বচ্ছ যুক্তি। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনেও শ্রেণী সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি! একে অত্যাধুনিক ছাত্রের উদ্ধত কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মাধবাচার্যের বইতে খোদ চার্বাকপন্থীর যে শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে, তার মধ্যেও শ্রেণী-সংগ্রামের ইঙ্গিতটুকু স্পষ্ট-

“মৃতের উদ্দেশে প্রেতকার্য প্রভৃতি ব্রাহ্মণদের জীবনোপায় ছাড়া আর কিছু নয়। যারা তিন তিনটে বেদ রচনা করেছে তারা বেবাক ভণ্ড-ধূর্ত-নিশাচরের দল।”

“ভণ্ড-ধূর্ত-নিশাচরাঃ” : শুনতে যে রুচিতে বাধে, মনে হয়। কাঁচা খিস্তি। দর্শনের ‘নৈর্ব্যক্তিক’ আলোচনায় এ রকম শালীনতার অভাব কেন? কিন্তু মুশকিল এই যে, “ছোটলোকের” দল শাসকের বিরুদ্ধে যখন রুখে দাঁড়ায়, তখন তাদের কাছে সুরুচি, শালীনতা প্রভৃতি তথাকথিত ‘মনুষ্যধর্মগুলো লোকঠকানে সাধুবাক্যেরই অঙ্গবিশেষ মনে হতে পারে বই কী!

বিপক্ষের সাধুপুরুষমাত্রই জানেন যে, বিপ্লবের সময় রক্তাক্ত বীভৎসতা করতে পর্যন্ত ‘ছোটলোক’দের রুচিতে বাধে না, খিস্তি খেউড় তো নেহাত ছোট ব্যাপার। তবু সমাজে শ্রেণীসংগ্রাম এক জিনিস-এবং দার্শনিক দ্বন্দ্ব তার প্রতিবিম্ব হলেও হাজার হোক স্বতন্ত্র স্তরের ব্যাপার।

বাষ্প জল ছাড়া কিছুই নয়, তবু শুধু জলও নয়-শুধু জলে এঞ্জিন চলে না, বাম্পে চলে; তাই বাম্পের আইনকানুনও আলাদা। মানুষের দার্শনিক চেতনা জিনিসটিরও সেই অবস্থা। বাস্তব সমাজের ঘাতপ্রতিঘাতেই তার জন্ম, তবু নিছক এই ঘাতপ্রতিঘাত দিয়ে তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হয় না।

তার আইনকানুন আলাদা। তাই কোনো দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু শ্রেণী:স্বার্থের উল্লেখ করলেই চলবে না। মাটির পৃথিবীতে মজবুত খুটি ছিল বলেই আমাদের দেশের চার্বাকপন্থীরাও সুস্থ জড়বাদের এই প্রাথমিক সত্যকে যেন অস্পষ্টভাবে অনুভব করতেঁ পেরেছিলেন।

বিপক্ষদলের শ্রেণীস্বার্থের দিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেই চলবে না। কেননা, বিপক্ষের হাতে আছে দার্শনিক পদ্ধতির এক অপূর্ব সুদর্শনচক্র, সে অস্ত্ৰ দিয়ে সমস্ত জড়বাদ তারা অবলীলায় খণ্ড খণ্ড করে ফেলতে পারে।

এ স্তব হলো বিশুদ্ধ বিচার-বুদ্ধি, অভ্রান্ত তর্কপদ্ধতি। পরমসত্তা বিশুদ্ধ তর্কপ্রণালীর দাবি মানতে বাধ্য, বিপক্ষের কাছে। এ কথা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ এবং বুদ্ধির দাবি জড়বাদ কোনোমতেই মেটাতে পারে না। কিন্তু জড়বাদের প্রথম কথা হলো; বাস্তবজগৎ বুদ্ধির দাবি মানতে বাধ্য নয়, বরং বুদ্ধিই বাস্তব জগতের দাবি মানতে বাধ্য।

চার্বাকপন্থীও বিপক্ষের শ্রেণীস্বার্থটুকু প্রকাশ করে দিয়ে ক্ষান্ত হননি, বিপক্ষকে নিরস্ত্র করতে কোমর বেঁধে লেগেছেন। বিশুদ্ধ তর্বাপদ্ধতি বলে, ব্যাপারটায় গোড়াতেই গলদ, তর্কের কোন দার্শনিক প্রতিষ্ঠা নেই। চার্বাকপন্থী বলেন, তর্ক-পদ্ধতির সবচেয়ে মামুলি উদাহরণটা নিলেই এ কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাবে।

পর্বতঃ বহ্নিমান ধূমাৎ। ধূম দেখে পর্বতে বহি অনুমান করা সম্ভব। তার কারণ আমাদের স্থির বিশ্বাস-যাত্র যাত্র ধূমঃ তন্ত্র অত্র বহ্নি, যেখানে যেখনে ধুয়ো সেখানে সেখানেই আগুন। কিন্তু কথা হলো, এ রকম বিশ্বাস পোষণ করবার অধিকার কোথা থেকে পাওয়া সম্ভব?

তাহলে মাধবাচার্য ব্যাপ্তি-খণ্ডনের এই নিখুঁত বর্ণনা দিতে গেলেন কেন? তার কারণ হয়তো মৌলিক চার্বাকদর্শনে যদিও সমস্ত অনুমানকেই উড়িয়ে দেবার উৎসাহ ছিল না, তবুও নিশ্চয়ই সুস্থ বস্তুবাদীর বিশুদ্ধ-বুদ্ধি-বিদ্বেষটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

নিজেদের অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কোনো অজুহাত থাকতেই পারে না, অথচ নিছক অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে “সমস্ত’ ধূম সম্বন্ধে কথা বলা নিশ্চয়ই দুঃসাহস। আমাদের অভিজ্ঞতা অতি স্বল্প-ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের সমস্ত ধূম এ অভিজ্ঞতার আওতায় আসতে পারেই না।

চার্বাকদের কথাটা আমাদের দেশের দার্শনিক পরিভাষায় প্রকাশ করতে গেলে বলতে হবে : অনুমান নির্ভর করে ব্যাপ্তির উপর, ব্যাপ্তি হলো হেতু বা লিঙ্গ (middle term : আলোচ্য উদাহরণে ধূম) এবং পক্ষ (major term : আলোচ্য উদাহরণে ‘বহ্নি’), এদের মধ্যে সামান্য-সম্বন্ধ (universal relation : আলোচ্য উদাহরণে “যত্র যত্র ধূমঃ তন্ত্র তত্র বহ্নি)।

চার্বাকপন্থী বলেন, এই ব্যাপ্তি জিনিসটে কোনোদিন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। মানুষ বড় জোর বলতে পায়ে-যে-যে জায়গায় আমি ধুয়ো দেখেছি সেই সেই জায়গাতেই দেখেছি আগুন। কিন্তু আমি আপনি ক-জায়গায় ধুয়োই বা দেখেছি?

অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সমস্ত ধুয়ো কেউ কখনো দেখেনি, দেখতে পারে না। কারুর পক্ষে তাই জোর গলায় বলবার অধিকার নেই; সমস্ত ধুয়োর সঙ্গে আগুনের যোগাযোগ থাকতে বাধ্য।

দৈনিক জীবনে সবচেয়ে সরল অনুমানের বেলাতেই যদি দেখি তর্কপদ্ধতির গোড়ায় গলদ রয়েছে, তাহলে দার্শনিকদের কুটতর্ককে সত্য অন্বেষণের অভ্রান্ত উপায় বলে মানবার কোনো মানেই হয় না।

এবং অনুমানই যদি আচল বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে প্রত্যক্ষ ছাড়া জ্ঞানের অন্যান্য তথাকথিত উৎসগুলোর উপর নির্ভর করতে যাওয়া নেহাতই মূঢ়তা, কেননা এগুলি সবই অনুমান-নির্ভর অর্থাৎ উপমান, আপ্তবাক্য প্রভৃতি জানের তথাকথিত উৎসগুলো শেষ পর্যন্ত দেউলে, কেননা এদের আসল সম্পত্তি বলতে অনুমান এবং অনুমান নেহাতই অচল।

তাই চার্বাকপন্থী বলেন, নিছক প্রত্যক্ষ দিয়ে যতটুকু জানা যায় ততটুকুকে সত্যি বলে মানব। অবশ্য এ কথা ঠিক, চার্বাকদের এই অনুমান-খণ্ডন বিচার-সহও নয়, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষে অনিবার্যও নয়। বরং এর থেকে চরম ভাববাদ এবং সন্দেহবাদ এসে পড়াই স্বাভাবিক-যেমন এসেছিল ইংরেজ দার্শনিক হিউমের বেলায়।

তবে এখানে একটা প্রশ্ন তোলা যায়; যদিও মাধবাচার্য চার্বােকদের এই ব্যাপ্তি-খণ্ডন পদ্ধতির নিখুঁত বৰ্ণনা করেছেন, তবুও চার্বাকদর্শনে এমন খুঁটিয়ে অনুমান-পদ্ধতিকে খণ্ডন করবার চেষ্টা সত্যি কি ছিল? আমার বিশ্বাস তা ছিল না, থাকার কথা নয়।

কেননা, মৌলিক চার্বাকদর্শনের প্রচলন ও প্রভাব হয় অন্তত খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। সে যুগে জ্ঞানের উৎস নিয়ে দেশে এমন কূটতর্কের রেওয়াজই থাকা সম্ভব নয়। তাই সে-যুগে এমন খুঁটিয়ে ব্যাপ্তি জিনিসটে কেউ যে খণ্ডন করতে চেয়েছিলেন, তা নেহাতই অসম্ভব বলে মনে হয়।

তাহলে মাধবাচার্য ব্যাপ্তি-খণ্ডনের এই নিখুঁত বর্ণনা দিতে গেলেন কেন? তার কারণ হয়তো মৌলিক চার্বাকদর্শনে যদিও সমস্ত অনুমানকেই উড়িয়ে দেবার উৎসাহ ছিল না, তবুও নিশ্চয়ই সুস্থ বস্তুবাদীর বিশুদ্ধ-বুদ্ধি-বিদ্বেষটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

এই পৃথিবীর চরম সুখই আসল স্বর্গসুখ, এই পৃথিবীর চরম যন্ত্রণাই আসল নিরকযন্ত্রণা। মোক্ষ জিনিসটে দেহচ্ছেদেরই নামান্তর। বলাই বাহুল্য, চার্বাকপন্থী দেহের অতীত আত্মা বলে কোনো জিনিস মানেন না। ওরফে তাদের নাম তাই দেহাত্মবাদী।

অর্থাৎ মৌলিক চার্বাকবাদ নিশ্চয়ই বলতে চেয়েছিল যে, বিশুদ্ধ বুদ্ধি দিয়ে দর্শন গড়া চলবে না, পরমসত্তা বুদ্ধির মুখাপেক্ষী নয়, শুদ্ধ-বুদ্ধির দাবি মানতে বাধ্য নয়। আগেই বলেছি, প্রেতকার্যের অন্তঃসারশূন্যতা দেখাতে গিয়ে চার্বাকপন্থী সূক্ষ্ম দার্শনিক যুক্তির অবতারণা করতে চাননি; বরং দৈনন্দিন কর্মজীবনের কষ্টিপাথরে ঘষে দেখাতে চেয়েছেন, এসব ব্যাপার স্রেফ লোকঠকানে ধাপ্লাবাজি।

মৌলিক চার্বাকদর্শনের এই শুদ্ধবুদ্ধিবিদ্বেষ হয়তো কালক্রমে, ফলাও হয়ে, ব্যাপ্তিখণ্ডনে -অনুমান মাত্রকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টায় – পরিণত হয়েছিল। মাধবাচার্যের গ্রন্থে হয়তো তারই বর্ণনা। তাহলে মানতেই হবে, ভারতবর্ষেবস্তুবাদ এমন পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিল যো-পথে এগুলো বস্তুবাদের ঠিক বিপরীতে, অর্থাৎ চরম ভাববাদে, গিয়ে পড়বার সম্ভাবনা।

বস্তুত, কডাওয়েল দেখিয়েছেন, শ্রেণীসমাজের দর্শনের পক্ষে এই মারাত্মক সম্ভাবনা থেকে যায়; অধ্যাত্মবাদ শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে যান্ত্রিক বস্তুবাদে, বস্তুবাদ ভাববাদে। কড্‌ওয়েল এই কথার উদাহরণ দেখিয়েছেন সাম্প্রতিক য়ুরোপীয় দার্শনিক পরিস্থিতি থেকে; একদিকে হেগেলের অধ্যাত্মবাদ পরিণত হতে চেয়েছে যান্ত্রিক বস্তুবাদে এবং অপরদিকে বৈজ্ঞানিকদের যান্ত্রিক বস্তুবাদ পরিণত হতে চেয়েছে চরম অধ্যাত্মবাদে।

এই বিপরীত-পরিণতির আসল কারণ, কডাওয়েল দেখিয়েছেন, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব। প্রাচীন ভারতের শ্রেণীবিভক্ত সমাজেও যে এই ঘটনার পুনরুক্তি থাকবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এবং ঘটেছিলও ভাই। একদিকে চার্বাকদের বস্তুবাদ এমন পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিল যেপথের চরম পরিণতি ভাববাদ ও সন্দেহবাদ-এ!

অপর পক্ষে, ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ যে যুগে যুগে কেমনভাবে চরম ভোগবাদ ও জড়বাদে পরিণত হয়েছে, তার বহুল দৃষ্টান্ত দেশের ইতিহাসে। এখানে দুটি দৃষ্টাস্তের উল্লেখ করা যায়। প্রাচীনকালে বৈদিক অধ্যাত্মবাদের অপর পিঠে ছিল ক্রিয়াকাণ্ডের চরম পার্থিবতা, মধ্যযুগে বাংলাদেশে বৌদ্ধ অধ্যাত্মবাদ তন্ত্র, সহজিয়া প্রভৃতি চূড়ান্ত পাথিবিতায় পর্যবসিত হয়েছে!

চার্বাকদের কথায় ফেরা যাক। বিশুদ্ধ তর্ক অপ্রতিষ্ঠ। অতএব, এই জড় জগতের দুৰ্নিবার যাথার্থ্যকে তর্কবলে উড়িয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। অপরপক্ষে, স্বর্গ নরক বা পারলৌকিক আত্মার কথা হাজার তর্কবলেও প্রমাণ করা অসম্ভব।

মানতে হবে এই পৃথিবীই একমাত্র সত্য, মাটি-জল-আগুন-বাতাস দিয়ে তৈরি এই পৃথিবী। চার্বাকপন্থী পঞ্চভূতের পঞ্চম ভূতকে-আকাশ বা ব্যোমকে-সত্য বলে মানেন না, কেননা আকাশ ইন্দ্রিয়গ্রাহস্থ নয় এবং ইন্দ্রিয়বেদনা বা অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস।

এই পৃথিবীর চরম সুখই আসল স্বর্গসুখ, এই পৃথিবীর চরম যন্ত্রণাই আসল নিরকযন্ত্রণা। মোক্ষ জিনিসটে দেহচ্ছেদেরই নামান্তর। বলাই বাহুল্য, চার্বাকপন্থী দেহের অতীত আত্মা বলে কোনো জিনিস মানেন না। ওরফে তাদের নাম তাই দেহাত্মবাদী।

আধুনিক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী অবশ্য আলোচনা এখানেই শেষ করবেন না। তিনি দেখাতে চেষ্টা করবেন যে, যদিও জড় থেকেই চেতনার উৎপত্তি, জড়ের উপরই তার স্থিতি এবং শেষ পর্যন্ত জড়ের মধ্যেই তা বিলীন হয়ে যায়, তবুও জড়ের উপর তার যে প্রভাব, সে প্রভাবকেও অগ্রাহ করবার কোন উপায় নেই।

তারা বলেন, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ প্রতি পদেই দেহাত্মবাদে স্বতঃপ্রবৃত্ত আস্থা দেখিয়ে থাকে। মানুষ বলে; “আমি স্থূল”, “আমি কৃশ”, “আমি কৃষ্ণ”। অর্থাৎ, “আমি” জিনিসটা স্থূল, কৃশ, কৃষ্ণ প্রভৃতি দৈহিক লক্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। “আমার দেহ”, এ শুধু কথার কথা, যেন “দেহ” আর “আমি” দুটো আলাদা জিনিস।

এ-রকম কথার কথা, যেন “দেহ” আর “আমি” দুটো আলাদা জিনিস। এ-রকম কথা তো আমরা কতই বলে থাকি; যেমন ধরুন- “রাহুর মাথা”। আসলে মাথাই তো রাহুর সর্ব্বস্ব-মাথা বাদ দিলে রাহু বলে আর কী বাকি থাকবে? ঠিক সেই রকমই; “আমার দেহ”। দেহই আমি এবং আমিই দেহ।

প্রশ্ন ওঠে : তাহলে চেতনা বলে জিনিসটা আসলে কী? চার্বাকপন্থী বলেন, চেতনা জিনিসটে কোনোরকম পারলৌকিক আত্মার বিকাশ মোটেই নয়। তাই বলে চেতনা জিনিসটাকে উড়িয়ে দেবার দরকারও নেই; জড়ের উপর তার আবির্ভাব, জড়ের দরুন তার আবির্ভাব, তবু আবির্ভাব হিসেবে অপূর্ব।

তাই তার মধ্যে নতুন গুণের লক্ষণ, সে গুণ জড়মাত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না। আশ্চর্য সরল উদাহরণ দিয়ে তঁরা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে চান : কিশ্বাদিভ্যঃ সমেতেভ্যো দ্রব্যোভ্যো মদীশচক্তিবৎ! কিথ (সুরাবীজ) ইত্যাদি। কয়েকটি দ্রব্য একত্র মেশানোর ফলে যেরকম মদশক্তির আবির্ভাব হয়, ঠিক সেই রকমই।

কিংবা, আর একটি এইরকম সরল উদাহরণ চার্বাকপন্থীদের নামে প্রচলিত আছে : পান, চুন, খয়ের, সুপুরি -এগুলোর কোনোটার মধ্যেই টুকটুকে লাল রঙ নেই, অথচ এগুলি দিয়ে পান। সেজে মুখে দিলে পর ঠোঁটদুটি টুকটুকে লাল হয়ে যায়।

লাল রঙ এল কোথা থেকে? এ রঙ পান-চুন-খয়ের-সুপুরি ছাড়া কিছুই নয়, অথচ পান-চুন-খয়েরসুপুরির উপর এক অপূর্ব আবিভােব বই কী। ঠিক তেমনি, ক্ষিতি-আপ-তেজমরুত ছাড়া মানুষ আর কিছুই নয়, তবু এই চতুভূতের এক বিশেষ সমাবেশের ফলেই মানুষের মধ্যে চেতনা বলে ওই অপূর্ব গুণের আবির্ভাব।

আধুনিক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী অবশ্য আলোচনা এখানেই শেষ করবেন না। তিনি দেখাতে চেষ্টা করবেন যে, যদিও জড় থেকেই চেতনার উৎপত্তি, জড়ের উপরই তার স্থিতি এবং শেষ পর্যন্ত জড়ের মধ্যেই তা বিলীন হয়ে যায়, তবুও জড়ের উপর তার যে প্রভাব, সে প্রভাবকেও অগ্রাহ করবার কোন উপায় নেই।

(চলবে…)

অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি দুই>>

…………………….
ভাববাদ খণ্ডন – মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………
আরও পড়ুন-
অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি এক
অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি দুই
তন্ত্রের অর্থ, প্রাচীনত্ব ও সম্প্রদায়-ভেদ
তন্ত্রের দেহতত্ব
লোকায়ত, তন্ত্র, সাংখ্য : অসুর-মত

……………….
আরও পড়ুন-
মানুষ কী কারণে অসুখী হয়?
বায়রনীয় অ-সুখ
বিরক্তি এবং উত্তেজনা
অবসাদ
ঈর্ষা
পাপের চেতনা
সুখলাভ কি তবু সম্ভব?
উদ্দীপনা
স্নেহ-ভালবাসা
সুখী মানুষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!