ভবঘুরেকথা
ভাববাদ আধ্যাত্মবাদ

আদিম শ্রেণীহীন সমাজ : পর্ব দুই

-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

সোভিয়েট বিপ্লবের মধ্যে শোনা গেল শোষণের পালা শেষ করবার ডাক। কিন্তু এ ডাক একজাতীয় শোষণ শেষ করে নতুন জাতের শোষণ পেশ করবার অভিসন্ধি নয়। সামাজিক মেহনতের হারানো পটভূমি ফিরে পাওয়া গেল বিজ্ঞানে, ঘোষিত হলো নিঃসংকোচ বস্তুবাদের জয়।

তার ভিত্তিতে প্রয়োগ, সমষ্টির চেতনা আর মুক্তির স্বরূপ উপলব্ধি। আর তারই প্রেরণায় দিকে দিকে আজ মিলিত মহামানবের অগ্রগতি আগামী নিঃশ্রেণীক সমাজের দিকে-এই সমাজে বিজ্ঞান হবে সংকটমুক্ত, সমবেত মানবজীবনের উৎস থেকে প্রেরণা সঞ্চয় করে বিজ্ঞান আবার প্রতিষ্ঠিত হবে সুস্থ বস্তুবাদী ভিত্তির উপর।

তবু, আগামী কালের বিজ্ঞান অতীতের ইন্দ্রজালের স্তরে নিশ্চয়ই ফিরে যাওয়া নয়। তার সহজ কারণ, আগামী কালের নিঃশ্রেণীক সমাজ অতীতের অবিভক্ত শ্রেণীহীন সমাজের পুনরুক্তিমাত্র নয়। সমবায়ের দিক থেকে, মিলেমিশে একসঙ্গে থাকার দিক থেকে, মিল থাকলেও এ দুইয়ের ঐশ্বর্যে একেবারে আকাশপাতাল তফাত।

অতীতের অবিভক্ত সমাজের কাহিনী নিতান্তই দারিদ্র্যের কাহিনী; মানুষ তখন স্থূল হাতিয়ার হাতে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে প্রবৃত্ত, তার বাস্তব সাফল্য নেহাতই সংকীর্ণ- তাই দৈন্যের আর অভাবের অন্ত নেই। ওই অক্তাবের প্রতিষেধক হিসেবে মানুষ খুঁজেছে ইচ্ছাপুরাণ-বাস্তব বিজয়ের ফাকিটুকু কল্পনার বিজয় দিয়ে ভরাট করবার চেষ্টা।

বজের ডাক-কে আয়ত্ত করে বজের শক্তিকে আয়ত্ত করার কথা। ইন্দ্রজালের এইটেই হলো আসল দৈন্য- এই ইচ্ছাপূরণ। দীন সমাজের প্রতিচ্ছবিইন্দ্রজালের মধ্যেও অনেকখানি দৈন্য না থেকে উপায় কী? এই দৈন্তের দরুনই, এই ইচ্ছাপূরণের চাপেই, ইন্দ্রজালের বস্তুবাদী ভিত্তিটুকু নেহাত অস্পষ্ট এবং অচেতন।

আগামী নিঃশ্রেণীক সমাজের বাণী হলো প্রাচুর্যের বাণী-তাই দৈন্তের চাপ নেই তার তত্ত্বজিজ্ঞাসায়, আগামী কালের বিজ্ঞানে। সে বিজ্ঞান সুস্থ আর সংস্কারমুক্ত। তার বস্তুবাদী ভিত্তি স্পষ্ট ও সচেতন।

ইন্দ্রজাল থেকে ধর্ম। কেমনভাবে, ঠিক কোন প্রভাবের ফলে মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাসে এই পরিবর্তন এল? এই পরিবর্তনকে বোঝবার কোনো উপায় নেই। বুর্জোয়ার দৃষ্টি দিয়ে। কেননা বুর্জোয়ার দৃষ্টিকোণ অনিবার্যভাবেই ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টিকোণ, অথচ সংস্কৃতির স্তরে এই পরিবর্তন সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবিমাত্র; তাই সামাজিক পরিবর্তনটুকুই ঐখানে একমাত্র মূলসূত্র।

সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতি। ইন্দ্রজালের মৃত্যু এবং ধর্মের জন্ম-এই দুয়ের মূলসূত্রই পাওয়া যাবে এই সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতির মধ্যে। একের সঙ্গে দশের সম্বন্ধ আর অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ নয়, একের আর দশের জীবন-সমস্যা নয় অদ্বৈত। একের অনুপ্রেরণা আর দশের অনুপ্রেরণা হলো বিভিন্ন, বিচ্ছিন্ন হলো একের সিদ্ধি আর দশের সিদ্ধি।

তবু প্রকৃতির অধিষ্ঠাতা আর অধিষ্ঠাত্রী হিসাবে কল্পিত হলো কেন? কেননা অপেক্ষাকৃত উন্নত হাতিয়ারের কৃপাতে মানুষের উৎপাদনশক্তি অপেক্ষাকৃত বেশি। হলেও তখনও মূল সমস্যা প্রকৃতিকে নিয়েই-প্রাকৃতিক শক্তির সামনে মানুষ প্রায় তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎ হয়েই রয়েছে।

আদিম সাম্যাবস্থাই ছিল অতীত ইন্দ্রজালের মূল উৎস। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম নয়, মানুষের সঙ্গে সংগ্রাম শুধু প্রকৃতির। এক অখণ্ড সমগ্রতার মধ্যে মানুষের জীবন, তার সংস্কৃতিটুকুও এই জীবন থেকে বিচ্যুত নয়। তাই সংস্কৃতিটুকুও সংগ্রামেরই অঙ্গ। ইন্দ্রজাল তাই প্রয়োগপ্রধান।

আবার, সমাজ-জীবনে অখণ্ড সমগ্রতা বলেই মুক্তির যে অচেতন আদর্শ ইন্দ্রজালের অন্তরালে, তা শৃঙ্খলাকে ভাঙবার আদর্শ নয়,-শৃঙ্খলাকে স্বীকার করার মধ্যেই মুক্তি। তাই সংস্কৃতি হিসেবে ইন্দ্রজালের যে-দুটো প্রধান বৈশিষ্ট্য, তার মূলে রয়েছে সামাজিক অখণ্ডতার চেতনা। এই আদিম সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতির মধ্যেই ইন্দ্রজালের মৃত্যুরহস্য।

শুধু ইন্দ্রজালের মৃত্যুরহস্যই নয়, ধর্মের জন্মরহস্যও। আদিম সাম্যাবস্থাবিচ্যুতির বিভিন্ন দিকগুলির স্বতন্ত্র উল্লেখ করা যাক, দেখা যাবে প্রত্যেকটি দিকই কীভাবে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ধর্মের জন্মকে সম্ভব করেছে। প্রথমত, প্রয়োগের প্রাধান্য আর টিকল না।

প্রকৃতির সঙ্গে সমবেত মানুষের সংগ্রামের বদলে দেখা দিল মানুষের সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম। একদল মানুষের ঘাড়ে পড়ল উৎপাদনের সমস্ত দায়। কিন্তু তারা সমাজের সদরমহলে নয়, অন্দরমহলে। তাই সমাজের সদরমহল থেকে বাদ পড়ল মেহনতের কথা। শ্রমের কথা বাদ দিয়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যা খোঁজবার চেষ্টা।

প্রকৃতির নানান বিভাগের অধিষ্ঠাতা-অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে দেখা দিল হরেক রকম দেবদেবীর কল্পনা। সভ্যতার সদর মহলে মানুষের মন ঝুঁকল ধর্মের দিকে। কিন্তু কোন মানুষের? মানুষ তো আর আগেকার মতো শুধু এক রকমের নয়, দু-রকমের। শাসক আর শাসিত, শোষক আর শোষিত।

শুধু শাসকের, শুধু শোষকের মাথা খাটাবার ঢালাও অবসর। মাথা খাটিয়ে পাওয়া দেবদেবীর উপাখ্যান। আর তাই, শাসক-শ্রেণীর চেতনায় জন্ম বলেই, এই সব প্রথম দেব-দেবীগুলি শাসকশ্রেণীর প্রতিকৃতিমাত্ৰ।

প্রথমত, এইসব দেব-দেবীগুলি সকলেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জীব। এই ব্যক্তিত্ব-চেতনা আদিম সাম্যাবস্থায় ছিল না, থাকবার কথা নয়। কেননা একের চেতনা তখন দশের চেতনার সঙ্গে মিশে এক অখণ্ড সমগ্রতার রূপে বিরাজ করছে। কিন্তু, শ্রেণীবিভাগের পর, শাসকের ব্যক্তিত্ব বাকি সকলোয় উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তাই এই ব্যক্তিত্ব প্রতিফলিত হয়েছে তার কল্পনা দিয়ে গড়া দেব-দেবীগুলির মধ্যেও।

দ্বিতীয়ত, শাসক-শ্রেণীর মানুষের খামখেয়ালী বৃত্তি এই সব দেব-দেবীগুলির মধ্যে অল্পবিস্তর প্রতিফলিত। শাসকের মতোই অসীম শক্তি এই দেবতাদের; তবু তাদের কাছে ভিক্ষে চাইলে ভিক্ষে মিলতে পারে, স্তবস্তুতির খোশামোদে তাদের মন গলাবার সম্ভাবনা, নৈবেদ্যর ঘুষ পেলে তারা সিদ্ধি দিতেও পারে। খোশামোদ-প্রিয় আর লোভী। এই সব প্রথম দেব-দেবীর দল-এর মধ্যেই পাওয়া ষাবে পৃথিবীর প্রথম শাসক-শ্রেণীর প্রতিচ্ছবি।

তবু প্রকৃতির অধিষ্ঠাতা আর অধিষ্ঠাত্রী হিসাবে কল্পিত হলো কেন? কেননা অপেক্ষাকৃত উন্নত হাতিয়ারের কৃপাতে মানুষের উৎপাদনশক্তি অপেক্ষাকৃত বেশি। হলেও তখনও মূল সমস্যা প্রকৃতিকে নিয়েই-প্রাকৃতিক শক্তির সামনে মানুষ প্রায় তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎ হয়েই রয়েছে।

প্রকৃতিকে নিয়ে যে সমস্যা, আদিম সাম্যাবস্থায় মানুষ তার সমাধান করতে চেয়েছিল প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে, এই শক্তিগুলিকে জয় করে। কিন্তু সংগ্রামের কথা আর শ্রেণীসমাজে প্রাধান্য পেল না, কেননা তখন কর্ম হয়েছে অপ্রধান, প্রাধান্য পেয়েছে জ্ঞান।

অনেক জায়গায় জনগণ অনেকভাবে এই ধর্ম-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছিল, বিদ্রোহ ঘোষণা করছিল। তার কিছু কিছু স্বাক্ষর আজও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি। তবু, মোটের উপর এ কথায় কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই ধর্ম-বিশ্বাসকে জনগণ শেষ পর্যন্ত স্বীকারই করে নিয়েছে। কেমন করে তা সম্ভব হলো?

তাই প্রাকৃতিক শক্তি নিয়ে যে সমস্যা, শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের সভ্য মানুষ সে সমস্যার সমাধান করতে চাইল অন্যভাবে। এই শক্তিগুলিকে বাস্তবিক জয় করার চেষ্টা না করে নিজের মনকে, চেতনাকে এমনভাবে বদল করা, যাতে প্রাকৃতিক শক্তিগুলি আর শক্রদ্ধাপে দেখা না দেয়।

অর্থাৎ, নিজের কল্পনাকে আর আবেগকে এমনভাবে পরিবর্তন করে নেওয়া, যাতে অন্তত এইটুকু সাত্মনা জুটবে যে, প্রাকৃতিক শক্তিগুলির সঙ্গে মানবমনেরই আত্মীয়তা-এইভাবে বিরোধী শক্তিগুলিকে মিত্র কল্পনা করে মানুষ বুঝি এদের হাত থেকে নিস্তার পাবে।

তাই, এই সব আদিম দেব-দেবীর দল-মূলে প্রাকৃতিক শক্তি সম্বন্ধে কল্পনা হলেও-শোষক শ্রেণীর চেতনারই ছাচে ঢালা তাদের রূপ। এর মধ্যে প্রাকৃতিক শক্তির কাল্পনিক প্রতিবিম্ব তো আছেই; কিন্তু শুধু সেইটুকুই নয়, শোষক শ্রেণীর নিজেদের রূপ অনুসারে রূপান্তরিত।

ইন্দ্রজাল ছেড়ে ধর্ম। এই ধর্ম শোষকের চিন্তা আর কল্পনা দিয়ে গড়া। তাই এর সঙ্গে শোষক-শ্রেণীর স্বার্থের কথাটাও জড়িত রয়েছে। ধর্মের দরুন শোষক-শ্রেণীর স্বাৰ্থসিদ্ধিটা কী রকম? শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শোষিত জনগণকে শাসনে রাখার জন্যে আধ্যাত্মিক অন্ত্রের উপযোগিতা অসামান্য।

স্বর্গ-নরক, পাপ-পুণ্য, ইহলোকের অন্নের বদলে পরলোকে পরমামের আশ্বাস, এমনি কতই কী। ধর্ম শিখিয়েছে, সংগ্রামের বদলে প্রার্থনার উপযোগিতা; শাসকের কাছ থেকে যদি কিছু পেতেই হয়, তা নেহাতই ভিক্ষার দান, চাটুকারিতার বখশিশ, ঘুষের ফল।

ধর্মকে তাই জনগণকে আয়ত্তে রাখবার আফিম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ আফিমের ঘোর জনগণের মনকে নেহাতই নিরাপদ, নেহাতই নিরুপদ্রব করে রাখবে।

শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। ইন্দ্রজাল ছেড়ে ধর্ম। শাসক-শ্রেণীর একটি অস্ত্ৰ এই ধর্ম। প্রাকৃতিক শক্তির কাল্পনিক প্রতিচ্ছবি-শাসক-শ্রেণীর ছাচে ঢালা প্রতিচ্ছবি-এই ধর্মের প্রাণবস্তু হলেও বাস্তব হাতিয়ার হিসেবে শাসক-শ্রেণীর কাছে এর মূল্য বড় কম নয়।

অবশ্য শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের যে রকম ইতিহাস আছে, সেইরকমই ইতিহাস আছে ধর্মেরও। শ্রেণীসমাজের কাঠামোর মধ্যে যুগে যুগে উৎপাদনশক্তির রূপ বদলে যাবার ফলে এতদিন পর্যন্ত শোষণের রূপ, সমাজ-ব্যবস্থার রূপ নানানভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। তাই পরিবর্তিত হয়েছে শোষণের জন্যে অনিবার্যভাবে উপযোগী এই আফিমের রূপও।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আফিমকে জনগণ আমনভাবে মেনেই বা নিল কেন? শাসক-শ্রেণীর স্বার্থে প্রণোদিত, শাসক-শ্রেণীর কল্পনাপ্রসুত এই ধর্মকে শোষিত জনগণ স্বীকার করতে গেল কেন? ইতিহাসের সেই সুদূর অতীতকে খুঁড়তে পারলে হয়তো দেখা যাবে যে, যতটা সহজে ধর্মকে মেনে নেবার ব্যাপারটা সাধারণত প্রচার করা হয়, আসলে ঘটনাটি অত সহজ সত্যিই ছিল না।

অনেক জায়গায় জনগণ অনেকভাবে এই ধর্ম-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছিল, বিদ্রোহ ঘোষণা করছিল। তার কিছু কিছু স্বাক্ষর আজও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি। তবু, মোটের উপর এ কথায় কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই ধর্ম-বিশ্বাসকে জনগণ শেষ পর্যন্ত স্বীকারই করে নিয়েছে। কেমন করে তা সম্ভব হলো?

বৃষ্টি না হলে ফসল ফলবে না, মানুষের পেট ভরবে না; দল বেঁধে বৃষ্টির নাচ নেচে, কল্পনায় বৃষ্টি পেয়ে দল বেঁধে দ্বিগুণ উৎসাহে ফসলের সন্ধান করা-এই হচ্ছে ইন্দ্রজাল। কিন্তু বৃষ্টি পড়ল, ফসল ফলল, তবু মানুষের পেট ভরল না-এ হলো এক নতুন ধরনের অনিশ্চয়তা।

উত্তরে মনে রাখতে হবে আদিম সাম্যাবস্থাবিচ্যুতির পটভূমি। এই বিচ্যুতির ফলে আদিম সমবেত জীবনে যে নিশ্চয়তা, তারও বিচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী। একের ভাগ্য যখন দশের ভাগ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধে যুক্ত, তখন সুনিশ্চিত সাহসে মানুষ বুক বাঁধতে পারে; অনিশ্চয়তার কথা তেমন ওঠে না।

কিন্তু মানুষ যখন একা, প্রকৃতির বিরাট শক্তির সামনে সে তুচ্ছ আর অকিঞ্চিৎ। এখানে বাস্তব তুচ্ছতা অকিঞ্চন তার কথা বলছি না, তুচ্ছতা-বোধ আর অকিঞ্চনাত-বোধের কথা বলছি। আদিম সাম্যাবস্থায় মানুষের উৎপাদনশক্তি অনেক অনুন্নত ছিল; তাই বাস্তবভাবে দেখতে গেলে প্রকৃতির বিরাট শক্তির সামনে মানুষ অনেক বেশি তুচ্ছ, অনেক বেশি অসহায়।

তবু, অসহায়বোধ তখন তেমন প্রকট হয়ে পড়েনি, যে-রকম প্রকট হয়ে পড়ল অপেক্ষাকৃত উন্নত উৎপাদন-প্রণালীর সমাজে-শ্রেণী-সমাজে। কেননা, শ্রেণী-সমাজের আগে, এই সাম্যাবস্থায়, একের জীবন যখন দশের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধে যুক্ত, তখন দশের প্রেরণা একের প্রেরণার মধ্যে সঞ্জীবিত।

আর সমবায় জীবন থেকে সঞ্জাত এই প্রেরণা বাস্তব অসহায়তা সত্ত্বেও মানুষের মনকে পঙ্গু হতে দেয়নি, মানুষের অসহায়-বোধ প্রকট হতে পারেনি। দশের প্রেরণা একের প্রেরণাকে সঞ্জীবিত করেছে, আর তাই মানুষ দশের সঙ্গে মিলে কোমর বেঁধে লেগেছে অসাধ্য সাধনের কাজে, প্রকৃতিকে জয় করবার কাজে।

প্রকৃতির বিরাট শক্তির সামনে ভীত মানুষ হাটু গেড়ে করুণ প্রার্থনার ভঙ্গি গ্রহণ করেনি-মিনতি জানাতে চায়নি। সেই শক্তির কাছে, চায়নি তার করুণার উদ্রেক করতে। দল বেঁধে এক সঙ্গে এই শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করছে মানুষ, এমন-কী বাস্তব বিজয়ের প্রকাণ্ড অসম্পূর্ণতাটা কাল্পনিক বিজয় দিয়ে পূরণ করে নিতে চেয়েছে।

কিন্তু কেঁদে পড়েনি, ভিক্ষে চায়নি। কেঁদে পড়া, ভিক্ষা চাওয়া, অসহায়ের মতো করুণা প্রার্থনা করা-সমবেত জীবনের পরিপূর্ণতার মধ্যে এসবের স্থান নেই।

শ্রেণী-সমাজের আওতায় জনগণের মধ্যে এই যে অসহায়-বোধ, একে যেন ইন্ধন জোগাল নতুন এক ধরনের দুর্যোগ, নতুন এক ধরনের অনিশ্চয়তা। আগে ছিল শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শ্রেণী-সমাজে তার উপর জুটল সামাজিক দুর্যোগও।

বৃষ্টি না হলে ফসল ফলবে না, মানুষের পেট ভরবে না; দল বেঁধে বৃষ্টির নাচ নেচে, কল্পনায় বৃষ্টি পেয়ে দল বেঁধে দ্বিগুণ উৎসাহে ফসলের সন্ধান করা-এই হচ্ছে ইন্দ্রজাল। কিন্তু বৃষ্টি পড়ল, ফসল ফলল, তবু মানুষের পেট ভরল না-এ হলো এক নতুন ধরনের অনিশ্চয়তা।

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে; সহস্র বছর ইন্দ্রজাল অভ্যাসের পর হঠাৎ এক সময়ে স্তর ফ্রেজারের ‘আদিম দার্শনিকটর’ মনে এই অসহায় ভাবে জাগল কেন, হঠাৎ বা কেন সে “প্রকৃতির উপর আধিপত্য” “ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিত্যাগ” করল? অর্থাৎ, ইন্দ্রজাল ছেড়ে মানুষ কেন এল ধর্মের আওতায়? এ প্রশ্নকে ফ্রেজার অগ্রাহ করেননি।

অনাবৃষ্টির অনিশ্চয়তার উপর আর এক রকমের অনিশ্চয়তা যোগ করে দেওয়া। মানুষের মনের অসহায়বোধকে দ্বিগুণ করে তোলা। সমবেত জীবন থেকে কোনো প্রেরণারই সঞ্চয় নেই। ভিক্ষাপাত্রই বুঝি একমাত্র সম্বল, শাসকের কৃপা জাগাতে পারা ছাড়া কোনো পথই চোখে পড়ে না। মানুষের মন ধর্মের দিকে ঝুঁকবে বই-কী।

তারপর, সেই প্রথম সভ্য সমাজের পর থেকে আজ পর্যন্ত শ্রেণী:সমাজ। উৎপাদন-প্রণালীর হাজার উন্নতি সত্ত্বেও এই সামাজিক অনিশ্চয়তার হাত থেকে মানুষ মুক্তি পায়নি। তাই ধর্মের হাত থেকেও নয়। অসহায় মানুষ জীবনে বিধ্বস্ত হয়ে করুণা ভিক্ষা করেছে উচ্চতর শক্তির কাছে। সমবেত জীবন ফিরে না।

আসা পর্যন্ত এই অসহায়তা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। তাই, ধর্মের হাত থেকেও নয়। সমাজের গভীরে ধর্মের এই বীজ লুপ্ত থাকার দরুন। এতদিনকার খাপছাড়া সব রকম নাস্তিক্যবাদ বিফলে গিয়েছে। সমবেত জীবন ফিরে পাবার আগে পর্যন্ত ধর্মের হাত থেকে মানুষের প্রকৃত মুক্তি নেই; অর্থাৎ এক কথায় গণ-বিপ্লব।

এই বিপ্লব সোভিয়েট দেশে সাম্য-জীবনের আগমনী শুনিয়েছে। তাই, ধর্মের হাত থেকেও নিষ্কৃতির পথ দেখিয়েছে মানুষকে। তবু অতীত ইন্দ্রজালের স্তরে ফিরে যাওয়া নয়। অনেক অনেক উন্নত উৎপাদন-প্রণালী এসেছে মানুষের কবলে।

তাই প্রকৃতিকে আসল জয় করবার অভাবটা কল্পনায় জয় করা দিয়ে পূরণ করে নেবার চেষ্টা নয়-ইন্দ্রজাল নয়। বিজ্ঞান। সংস্কারমুক্ত সুস্থ বিজ্ঞান। ইন্দ্রজালের মূল ভঙ্গি যেন অনেক অনেক উঁচু স্তরে উন্নীত।

ইন্দ্রজাল থেকে ধর্ম। শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণীসমাজ। এই পটভূমিকে মনে রাখতেই হবে। বুর্জোয়া বৈজ্ঞানিক-কলাকৌশলের দিক থেকে যত আশ্চর্য প্রতিভার অধিকারীই তিনি হোন না কেন-এই পটভূমির কথা মনে রাখেন না। তাই ইন্দ্রজাল ছেড়ে ধর্মে পৌঁছোনোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কয়েকটি কাল্পনিক কথার উপর তাকে নির্ভর করতে হয়।

স্যার জেমস্‌ ফ্রেজারের কথাই আবার উল্লেখ করছি। ধর্মের জন্মের মূলে মানুষের মনে যে এক অভূতপূর্ব অসহায় ভাব জেগেছিল, সে-কথা তিনি অনুভব করতে পারেন- “আমাদের সেই আদিম দার্শনিকট তার প্রাচীন বিশ্বাসের লিঙ্গর থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর, সংশয় এবং অনিশ্চয়তার দুর্যোগময় সমুদ্রে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে তার নিজের উপর আর নিজের শক্তির উপর পুরোনো সুখের আস্থা নির্মমভাবে ঝাকুনি খাবার পর, নিশ্চয়ই করুণভাবে হতভম্ব ও বিচলিত হয়ে পড়েছিল।

শেষ পর্যন্ত সে শান্তি পেল ঝোড়ো সমুদ্রে পাড়ি শেষ করে এক শান্ত স্বৰ্গে পৌছে, বিশ্বাস আর কর্মের এক নতুন শৃঙ্খলা খুঁজে পেয়ে, যে শৃঙ্খলা অমন ঝঙ্কাটময় সংশয়ের একটা সমাধান তাকে দিতে পারুল, দিতে পারল প্রকৃতির উপর যে আধিপত্যকে সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ত্যাগ করেছে, তারই একটা বিনিময়, বিনিময়টা যতই ঠুনকো হোক না কেন।”

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে; সহস্র বছর ইন্দ্রজাল অভ্যাসের পর হঠাৎ এক সময়ে স্তর ফ্রেজারের ‘আদিম দার্শনিকটর’ মনে এই অসহায় ভাবে জাগল কেন, হঠাৎ বা কেন সে “প্রকৃতির উপর আধিপত্য” “ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিত্যাগ” করল? অর্থাৎ, ইন্দ্রজাল ছেড়ে মানুষ কেন এল ধর্মের আওতায়? এ প্রশ্নকে ফ্রেজার অগ্রাহ করেননি।

নাচতে নাচতে সমগ্র গোষ্ঠীর সামনে দুলে উঠল বৃষ্টির ছবি-চোখের সামনে সেই ছবির প্রেরণা। ফসল জুটছে, ফসল জুটবেই, জুটবেই, জুটবেই-এই প্রেরণায় সঞ্জীবিত হয়ে পুরো দল যখন ফসলের সন্ধানে বেরুল, তখন তার বাস্তব সাফল্য অনেক বেশি সম্ভবপর।

কিন্তু তার দৃষ্টি বুর্জোয়ার দৃষ্টি, সংস্কৃতির সমস্ত ইতিকথাই সে-দৃষ্টিতে ব্যক্তি-বিশেষের অবদান। তাই তিনি উক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলছেন, প্রাচীনকালের “ধূর্ততর বুদ্ধিমানেরা” হঠাৎ যেন আবিষ্কার করল ইন্দ্রজালের বন্ধ্যাত্বি; বৃষ্টির নাচ নাচলে সত্যিই বৃষ্টি হবার কথা নয়।

আর তাই এত অশান্তি, শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রজাল ছেড়ে ধর্মের দিকে অগ্রগতি? সংস্কৃতিকে শুধু ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি বলে ধরে নিলে এই রকম অর্থহীন। “হঠাৎ” দিয়ে বিজ্ঞানের অনেক ফাঁক পূরণ করতে হয়!

তবু প্রশ্ন ওঠে, সহস্র বছর ধরে এমন-কী একজনও বেরুল না, যে ধরতে পারল ইন্দ্রজালের বন্ধ্যাত্বি? অতি বছর ধরে, অমন একটানাভাবে ইন্দ্রজাল টিকল কেমন করে? এ প্রশ্ন ফ্রেজার নিজেই তুলেছেন আর জবাবে বলেছেন : অনেক সময় ইন্দ্রজাল অনুষ্ঠানের পর বাস্তবিকই হয়তে হঠাৎ বাঞ্ছিত ফল ফলত।

বৃষ্টি তো এমনিতেই মাঝে মাঝে হয়; হঠাৎ হয়তো ইন্দ্রজাল অনুষ্ঠানের পর- কিন্তু ইন্দ্রজাল অনুষ্ঠানের দরুন নয়, প্রাকৃতিক নিয়মেরই দারুন- আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরল। আর তাই মানুষের মনে বদ্ধমূল হলো ইন্দ্রজালে বিশ্বাস।

সমাজের পটভূমি তুচ্ছ করে শুধু খাপছাড়া আপতনের উপর নির্ভর করতে যাওয়া। অথচ, স্পষ্টই দেখা যায়, শুধু এই ক্ষীণ আর আপতিক অনুষঙ্গের সূত্র দিয়ে সহস্র বছর ধরে মানুষের পক্ষে ইন্দ্রজালে বিশ্বাসের সঙ্গে বাধা থাকবার প্রসঙ্গ প্রায় হাস্যকর।

হাজার বছর ধরে মাত্র কয়েকটি আচমকা ঘটনায় মোহিত হয়ে এবং লক্ষ লক্ষ বিরুদ্ধ দৃষ্টান্তকে অগ্রাহ করে মানুষের মনে টিকে রইল ইন্দ্রজালে বিশ্বাস! অথচ, সামাজিক পটভূমিটুকু মনে রাখলে এখানে কোনোরকম রহস্য থাকে না।

হাজার বছর ধরে মানুষের মন ইন্দ্রজালে আস্থাবান ছিল, কেননা হাজার বছর ধরে ইন্দ্রজাল সত্যিই প্রকৃতিকে জয় করবার পথে তাকে সাহায্য করেছে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের মানুষ, শ্রেণীসমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে ইন্দ্রজালের এই বাস্তব অর্থক্রিয়াকারিত্ব বুঝবে কেমন করে?

ইন্দ্রজালকে আজ শুধু বন্ধ্যা ভ্রাস্তির ভূপ বলে মনে হয়, কেননা ইন্দ্রজালকে আমরা আমাদের সমাজের পরিপ্রেক্ষায় দেখতে চাই। আজকের দিনে কেউ যদি শিকার-নৃত্য করে, তাহলে তার শিকার সমাধা হবার বাস্তব সম্ভাবনা বাড়বে না। কিন্তু আদিম মানুষের বেলায় তো তা নয়।

কেননা, তার জীবন সমবায়ের জীবন-একের সঙ্গে দশের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। ইন্দ্রজালের অনুষ্ঠান কোন মানুষের একার অনুষ্ঠান নয়, সমগ্র সমাজের অনুষ্ঠান। তাই এই অনুষ্ঠান থেকে ষে প্রেরণা উদ্দীপ্ত, তা সমগ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সঞ্চারিত। বৃষ্টির নাচ।

নাচতে নাচতে সমগ্র গোষ্ঠীর সামনে দুলে উঠল বৃষ্টির ছবি-চোখের সামনে সেই ছবির প্রেরণা। ফসল জুটছে, ফসল জুটবেই, জুটবেই, জুটবেই-এই প্রেরণায় সঞ্জীবিত হয়ে পুরো দল যখন ফসলের সন্ধানে বেরুল, তখন তার বাস্তব সাফল্য অনেক বেশি সম্ভবপর।

তাই যতদিন আদিম অবিভক্ত সমাজ, ততদিন পর্যন্ত ইন্দ্রজাল বন্ধ্যা নয়, মিথ্যা নয়, মূখীতা নয়। তার বাস্তব মূল্যও অনেকখানি, অনেকখানি তার অবদান বাস্তব সাফল্যের পথে। তারপর সেই আদিম সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতিএই বিচ্যুতির মধ্যেই ইন্দ্রজালের মৃত্যু-

অবিভক্ত সমাজে ইন্দ্রজাল যে বাস্তব সাফল্যের সহায় ছিল, বিভক্ত সমাজে আর তা রইল না। মানুষের জীবনে দেখা দিল অনিশ্চিত আর অসহায় ভাব। তাকে অবলম্বন করেই জন্ম হল ধর্মের।

ইন্দ্রজাল থেকে ধর্ম : কোনো কল্পিত আদিম দার্শনিকের আকস্মিক আবিষ্কার নয়, সামাজিক পরিবর্তনেরই প্রতিচ্ছবি।

(সমাপ্ত)

<<আদিম শ্রেণীহীন সমাজ : পর্ব এক

…………………….
ভাববাদ খণ্ডন – মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………
আরও পড়ুন-
আদিম শ্রেণীহীন সমাজ : পর্ব এক
আদিম শ্রেণীহীন সমাজ : পর্ব দুই

……………
আরও পড়ুন-
অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি এক
অকর্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী : কিস্তি দুই
তন্ত্রের অর্থ, প্রাচীনত্ব ও সম্প্রদায়-ভেদ
তন্ত্রের দেহতত্ব
লোকায়ত, তন্ত্র, সাংখ্য : অসুর-মত

……………….
আরও পড়ুন-
মানুষ কী কারণে অসুখী হয়?
বায়রনীয় অ-সুখ
বিরক্তি এবং উত্তেজনা
অবসাদ
ঈর্ষা
পাপের চেতনা
সুখলাভ কি তবু সম্ভব?
উদ্দীপনা
স্নেহ-ভালবাসা
সুখী মানুষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!