আদিযোগী মহাদেব
-মেঘনা কুণ্ডু
‘শিব’ শব্দের বহুবিধ অর্থ রয়েছে, কোথাও বলা হয়, শিবের অর্থ ‘মঙ্গল’, কোথাও বলা হয় শিব অর্থ দয়া, প্রারম্ভ ইত্যাদি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, ‘শিব’ কথার অর্থ, ‘শূন্যতা’, যেখানে কিছুই নেই, সেখানেই শিবের অস্তিত্ব। তাঁর না আছে জন্ম, না আছে মৃত্যু। সমস্ত কিছুর অগ্রেও তিনি-অন্তিমেও তিনি। তিনি নিরাকার কিন্তু তাঁর বাস, এই পৃথিবীর বুকেই, তিনি সর্বত্র বিরাজমান!!
এই শিবের কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো, কিছু symbols বা চিহ্ন, যা আমরা সচরাচর দেখে থাকি, তাঁর কাল্পনিক ছবিতে!!
১.চন্দ্র
২. সর্প
৩. ত্রিশূল
৪. ত্রিনেত্র
৫. ডমরু
৬. ষাঁড়
৭. শিবলিঙ্গ
১. চন্দ্র:
মহাদেব কেনো চন্দ্রদেবকে তাঁর মস্তকে ধারণ করেছিলেন- এর দুটো ব্যাখ্যা আমরা পুরানে পাই, প্রথমটি হলো, সমুদ্রমন্থন থেকে উঠে আসা হলাহল শিব। পান করবার জন্য, তাঁর শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবার কারণে সকল দেবতাদের অনুরোধে তিনি চন্দ্রদেবকে তাঁর মস্তকে ধারণ করেছিলেন, কারণ চন্দ্র, শীতলতার প্রতীক এবং তিনি মহাদেবকে শীতলতা প্রদান করতে পারবেন। চন্দ্রের অপর নাম, ‘সোম’, তাই শিবকে আমরা ‘সোমনাথ’ নামেও জেনে থাকি।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি হলো, প্রজাপতি দক্ষের ২৭জন কন্যার সহিত চন্দ্রদেবের বিবাহ হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে রোহিণীদেবী অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। চন্দ্রদেব সুন্দরের পূজারি হবার কারণে রোহিনীদেবীকে তিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন।
এ দেখে বাকি ২৬ কন্যার দুঃখের সীমা ছিল না, তাই রাজা দক্ষ, চন্দ্রদেবকে দুরারোগ্যে রোগগ্রস্ত থাকার অভিশাপ দিয়েছিলেন। তারপর তিনি নারদদেবের পরামর্শে মহাদেবের সাধনা করে রোগমুক্ত হয়েছিলেন। তাই বলা হয়, কোনো রোগী যদি মহাদেবের আরাধনা করেন, তাহলে তিনি রোগমুক্ত হতে পারেন।
এ তো পুরানের ব্যাখ্যা। আসলে চাঁদ ‘জ্ঞান’-কে প্রতিনিধিত্ব করে। জ্ঞানের কোনো তল নেই। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানুষ জ্ঞান আহরণ করতেই থাকেন। তাই জ্ঞান সর্বদা এবং সর্বত্র অতিরঞ্জিত ভাবে প্রকাশ করা সঠিক নয়। মহাদেবের মস্তকে বিরাজমান অর্ধচন্দ্রের মতো, প্রয়োজন অনুযায়ী কিঞ্চিৎ ভাবে জ্ঞানকে রঞ্জিত করা উচিৎ!!
২. সর্প:
পুরানের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, হলাহলকে মহাদেবের কণ্ঠ অবধি রোধ করবার জন্য মাতা পার্বতী তাঁর কণ্ঠে ‘বাসুকী’ নামক এক সর্প পেঁচিয়ে দিয়েছিলেন। এই সর্প তিন প্যাঁচে অবস্থান করছে মহাদেবের কণ্ঠে। এই তিনটি প্যাঁচ তিনটি কালকে (বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যত) নির্দেশ করে।
এছাড়া এটি কুণ্ডলীনি চক্রের জাগৃতির কথা নির্দেশ করে। তাই মহাদেবকে কালেরও কাল ‘মহাকাল’ বলা হয়। আসলে সর্প, ‘সতর্কতা’-কে প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা শিবের কণ্ঠে সর্প দেখে শিখতে পারি, কীভাবে ভয়কে জয় করা যায়, শুধু চাই আত্মবিশ্বাসী মনোভাব।
৩. ত্রিশূল:
ত্রিশূলের তিনটি ফলা। তিনটি গুণ-সত্য, তমঃ এবং রজঃ কে এবং তিনটি লোক-স্বর্গলোক, মর্ত্যলোক এবং পাতাললোক কে নির্দেশ করে। তাই মহাদেবের আরেক নাম ত্রৈলোক্যনাথ।
৪. ত্রিনেত্র:
ত্রিনেত্র, ‘সতর্কতা’, ‘বিদ্যা’ এবং ‘জ্ঞান’ কে নির্দেশ করে।
৫. ডমরু:
পুরান থেকে জানা যায় যে, ‘ডমরু’-এর আওয়াজ থেকে ধ্বনির উৎপত্তি। যদি আমরা ভালো করে লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারবো, ডমরু দুটো ওম্ চিহ্নের মিলনে সৃষ্ট। এটি সৃষ্টি এবং ধ্বংসের বারংবার আবর্তনকে নির্দেশ করে।
৬. ষাঁড়:
মহাদেবের ষাঁড় ‘ধর্ম’-কে নির্দেশ করে। যদি আমরা সৎভাবে ধর্মপথে নিজেদের চালিত করতে পারি তাহলে আমরা স্বয়ং শিব-শম্ভুর সান্নিধ্য পেয়ে যাবো।
৭. শিবলিঙ্গ:
পুরাতন ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষার প্রচলনের আধিক্য দেখা যায়। কিন্তু বিদেশী জাতির আগমনের কারণে, দিনে দিনে ভাষার অপভ্রংশতা ঘটেছে। তাই ‘লিঙ্গ’ কথাটির যে অর্থ আমরা আজ জানি, তা প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়।
‘লিঙ্গ’ কথাটির অর্থ হলো ‘প্রতীক’। মহাদেবের প্রতীককে ‘শিবলিঙ্গ’ বলা হয়। আদতে আমরা যে শিবলিঙ্গকে দর্শন করে এসেছি তা কোনোদিনই এমন ছিল না। সময়ের বিবর্তনের ফলে শিবলিঙ্গের এমন আকৃতি হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এর আকার ছিল অণ্ডাকৃতি। এছাড়া শিবের মস্তকে ভস্মদ্বারা অঙ্কিত, তিনটি রেখা নির্দেশ করে, শিব ত্রিনেত্রী, ত্রিলোকী এবং ত্রিকালদর্শী। তিনিই আদি এবং তিনিই অনন্ত।।
ভোলানাথ আপনাদের ওপর সর্বদা কৃপা বর্ষণ করুন, এই কামনা করি।
ওম্ নমঃ শিবায়!!!
……………………….
আরো পড়ুন :
মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম শিব
নির্বাণ শতকাম
আদিযোগী মহাদেব
সে বাঁশি আজও বাজে
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………….
পুণঃপ্রচারে বিনীত-মেঘনা কুণ্ডু
…………………………………………
ব্যবহৃত ছবি প্রসঙ্গ
অবতার, দেব-দেবতাদের সে অর্থে কোনো ছবি যে নেই সেটা তো সকলের কাছেই স্বীকৃত। তবে ভক্তকুল তার রূপ দেখার জন্য আকুল। সাধককুল তার ছবি দেখবার চেষ্টা করে আত্মপোলব্ধির ভেতরে অনুভবের মাধ্যমে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো আর থেমে থাকে না। তারা শাস্ত্রে উল্লেখিত ইশারা, বৈশিষ্ট্য ও কাল্পনিকতাকে ঘিরে গড়ে তোলে বিভিন্ন দেব-দেবতা-অবতারের অবয়ব। এ ছবি শিল্পীর কল্পনা মাত্র।