ভবঘুরেকথা

-স্বামী জয়ানন্দ মহারাজ

ব্যথা কিংবা দুঃখ পাওয়ার আকাঙ্খা আমরা নিশ্চয়ই কেউ করি না, কিন্তু কিভাবে যেন আমাদের পাওয়া হয়ে যায়! ব্যপারগুলো হঠাৎ করে কিভাবে যেন ঘটে যায়। আমরা কিন্তু ঐ অনভিপ্রেত অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকি না। ঘটনাগুলো যে সবসময় পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে সংঘটিত হয়, ঠিক তা নয়।

এই ব্যপারগুলো হয়তো খুবই সাধারণ বিষয় নিয়ে ঘটে এবং আমাদের নিত্যদিনের ওঠা বসায় মানুষগুলোর সাথে ঘটতে থাকে। তা বাড়ির বাইরের অথবা বাড়ির মধ্যেকার মানুষজনের সঙ্গেও হতে পারে। যখন ঘটে যায় তখন কিছুই করার থাকে না।

কিন্তু ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ার পর আমরা ব্যথিত হই। এ সবকিছুর পেছনে থাকে আমাদের আশা বা Expectation। অর্থাৎ আমরা যা চাই না সেটাই আমাদের সঙ্গে ঘটে।

ধরুন আপনি পরিবারের একজন দায়িত্বশীল সদস্য। আপনি আশা করছেন আপনার পরিবারের সদস্যরা আপনি যেমনটি চাইছেন তারা সেভাবে চলবে। কিন্তু বাস্তবে কি ঘটছে- প্রত্যেকে যে যার নিজের মতো করে চলছে। আপনি যখন কিছু বলতে যাচ্ছেন তখন অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।

আপনি ব্যথিত হচ্ছেন তাদের ব্যবহারে, তাদের কথায়। আপনার মনের মধ্যে অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু আপনার কিছুই করার থাকছে না। জীবন বিষময় হয়ে উঠছে। কি করবেন আপনি ভেবে উঠতে পারছেন না। আপনার মনের এই অবস্থা থেকে আপনাকে বেরিয়ে আসতে হবে।

কিন্তু আপনি কিভাবে ঐ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। কিংবা চলতে ফিরতে, যাতায়াত করতে পথে-ঘাটে, দোকানে-বাজারে এমনকি সোস্যাল মিডিয়ায় কখনও কখনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে আপনাকে পড়তে হচ্ছে।

আপনি অপমানিত বোধ করছেন। কিন্তু আপনি কি করবেন ভেবে উঠতে পারছেন না। এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে আপনি কি করবেন, তাহলে বলি শুনুন-

কেউ যদি নর্দমার নোংরা জল মুখে কুলকুচি করে আপনার গায়ে ছেটায় তাহলে আপনার জামা-কাপড় নোংরা হলো ঠিকই, কিন্তু মনে রাখবেন যিনি ছেটালেন আপনার গায়ে, তিনি কিন্তু নর্দমার নোংরা জলটা মুখে করেই তুললেন।

আপনি কিন্তু ভুল করেও নর্দমার ঐ নোংরা জল মুখে কুলকুচি করে তার গায়ে ছিটিয়ে প্রত্যাঘাত করতে যাবেন না। আপনি যদি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একই কাজ করেন তাহলে আপনিও ঐ একই গোত্রীয় হবেন এবং আপনিও একই দোষে দুষ্ট হবেন।

বরং আপনি তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিন। সহ্য করে নিন আর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকুন। সময়ই আপনাকে উত্তর দিয়ে দেবে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কালীয়নাগ বধ করার সময় তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন; তুমি এই সরবরে এত বিষ ঢেলেছ কেন? তোমার বিষে সরোবরের জল বিষময় হয়ে উঠেছে। কেউ এই সরবরের জল পান করতে পারে না! যেই পান করে সেই মারা যায়!

উত্তরে কালিয়নাগ বলেছিল, প্রভু! আপনি আমাকে যা দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, আমি তাই দিয়ে আপনার পূজো করেছি! আপনি তো আমাকে অমৃত দিয়ে পাঠাননি যে, আমি অমৃত দিয়ে আপনার পূজো করবো বা এই সরবরে অমৃত ঢালবো! আপনি আমাকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন আমি তাই ঢেলেছি এবং তাই দিয়ে আপনার পূজো করেছি!

যে কোন জিনিসের প্রাপ্তির সাথে সাথেই বিয়োগটিও তার সাথে থাকে কিন্তু আমরা সেটিকে দেখতে পাই না। ফলে যেকোনো প্রাপ্তিতে আমরা মনের মধ্যে যে আনন্দ অনুভব করি, তার বিয়োগ ঘটলে আমরা ঠিক ততোধিক দুঃখ পাই। মাথায় রাখতে হবে- জগতের এসবই দুদিনের জন্য, কোন কিছুই চিরদিনের জন্য নয়, কোন কিছুই অনন্ত নয়, এক মাত্র ঈশ্বর ছাড়া।

ভগবান যাকে যা দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সে তাই দিয়ে ভগবানের পূজো করছেন এবং সেটাই এই জগতের মাঝে ঢালছে! আপনি একটু অন্যরকম ব্যবহার চাইলে পাবেন কেন? সবই তো ভগবানের সৃষ্টি, ভগবানের দান!

সেখানে আমার আপনার কারুর কোন হাত নেই! আপনি চাইলেও কাউকে পরিবর্তন করতে পারবেন না। অপরকে পরিবর্তন করতে যাওয়া কেবলমাত্র বৃথাই নয়, বোকামিও বটে।

তা বলে বিষধরের সঙ্গে তো আর ঘর করাও চলে না আর ভাব করাও চলে না! তাই বিষধর সাপ দেখলে সাবধান হয়ে যেতে হয়। আর আপনি যদি সাবধান না হোন তাহলে আপনাকে যে কোনো সময় ছোবল খাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

মূল কথা, ঘরেই হোক কিংবা বাইরে, আপনাকে সাবধানে পা ফেলতে হবে। অসাবধান হলেই ছোবল খেয়ে বিষের জ্বালায় জ্বলতে হবে। বুদ্ধিমান লোকেরা এক-আধবার ছোবল খেয়ে শিক্ষা পেয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে, ফলে তাদের বার বার ছোবল খেতে হয় না। আর বোকাদের বার বার ছোবল খেয়েও শিক্ষা হয় না। ফলে ছোবল খেতে খেতে শেষে তাদের প্রাণটাই চলে যায়!

এসবের সঙ্গে মনে মনে আপনি ভাবতে থাকুন- ‘সবাই তো দু’দিনের জন্য’! আর নিজের অহং পরিত্যাগ করুন। নিজেকে পরিবারের কর্তা না ভেবে পরিবারের সেবক ভাবতে চেষ্টা করুন। পরিবারের সদস্যদের ভগবানের সন্তান ভাবতে চেষ্টা করুন। তাদের ভাবনা ভগবানের ওপরে ছেড়ে দিয়ে নিজেকে চিন্তা মুক্ত রাখতে চেষ্টা করুন।

আপনার যদি সম্পদ, ঐশ্বর্য, বিদ্যা ও পাণ্ডিত্য থাকে তাহলে তা নিয়ে আপনি কখোনোই অহংকার করবেন না। আপনার থেকে আরো বড়ো, অনেক বড়ো ঐশ্বর্যবান, বিদ্বান, পণ্ডিত ব্যক্তি আছেন। আপনার চেয়ে অপরের আরও বেশি বেশি আছে।

আপনার চেয়ে আরও বেশি প্রতিভাবান, বুদ্ধিমান, রূপবান রয়েছে। তবে কিসের এত অহংকার? কাজেই অহংকার করার কিছুই নেই। ধন-সম্পদ, ঐশ্বর্য, বুদ্ধি, বিদ্যা, পাণ্ডিত্য, প্রতিভা, রূপ এসব ভগবান কৃপা করে আপনাকে দিয়েছেন, -এটি ভাবতে শিখুন।

যে কোন জিনিসের প্রাপ্তির সাথে সাথেই বিয়োগটিও তার সাথে থাকে কিন্তু আমরা সেটিকে দেখতে পাই না। ফলে যেকোনো প্রাপ্তিতে আমরা মনের মধ্যে যে আনন্দ অনুভব করি, তার বিয়োগ ঘটলে আমরা ঠিক ততোধিক দুঃখ পাই। মাথায় রাখতে হবে- জগতের এসবই দুদিনের জন্য, কোন কিছুই চিরদিনের জন্য নয়, কোন কিছুই অনন্ত নয়, এক মাত্র ঈশ্বর ছাড়া।

একজন লোক খুব গরীব। দু’বেলা দু’মুঠো আহার ঠিক মতো জুটতো না। এদিকে বাড়িতে স্ত্রী অসুস্থ। অভাবের তাড়নায় চিকিৎসাও করাতে পারছে না। লোকটির এত কষ্ট যে, সে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আত্মহত্যা করতে গেল।

বিশ্বাস করুন আপনি যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছেন, আপনিও তা কিছুদিনের মধ্যেই কাটিয়ে উঠবেন। তাই অযথা দুঃখ কষ্টের কথা সর্বদা চিন্তা করে বা ভেবে ভেবে মনের ব্যাথা আরও বেশি করে বাড়িয়ে তুলবেন না।

পথে এক সাধুর সাথে তার দেখা হলো। লোকটি ভাবলো, ভালোই হলো! মরবার আগে সাধুর দর্শন হলো! সাধুকে প্রণাম করতেই সাধু বললেন- বেটা! তুম্ ইতনা দুঃখী কিঁউ হো?

সাধুর এই কথা শুনে লোকটি কান্নায় ভেংগে পড়লো এবং সাধুকে তার দুঃখের সব কথা খুলে বললো। সাধু তার সব কথা শুনে তাকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলল এবং আত্মহত্যা করতে নিষেধ করল আর ভগবানের নাম নিতে বলে বললেন- ‘বেটা! অ্যায়সা দিন নহী রহেগা।’

মানে- ‘এমন দিন থাকবে না’। লোকটি তখন ভাবলো, তবে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি, দিন বদলাবে। সাধুর নির্দেশের কথা স্মরণ করে লোকটি আর আত্মহত্যা করলোনা, বাড়িতে ফিরে গেল।

এদিকে ধীরে ধীরে তার অবস্থার পরিবর্তন হতে লাগলো। চারিদিক থেকে সে সাহায্য পেতে শুরু করলো। তার স্ত্রী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে তার প্রভূত ধনসম্পদ হতে থাকলো। লোকটির অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল।

ছেলে-পুলে নিয়ে বেশ সুখেই আছে সে। একসময় ছেলের বিবাহ দিল। আনন্দ ও সুখের মধ্য দিয়ে তার দিনগুলো কাটতে থাকলো। কয়েক বছর পর নাতির জন্ম হয়েছে। এর কয়েক মাস পর তার অন্নপ্রাশনের আয়োজন করেছে লোকটি। বিশাল আয়োজন। প্রচুর পরিমাণ লোক আমন্ত্রিত।

যেন আনন্দের বন্যা বইছে চারিদিক থেকে। এমনি আনন্দের দিনে লোকটির সেই সাধুর কথা মনে পড়লো। সাধু বলেছিলেন- ‘বেটা! অ্যায়সা দিন নহী রহেগা।’ মানে- ‘এমন দিন থাকবে না’। তার জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল, -এই যে ধন-দৌলত, ঐশ্বর্য এসব তো কিছুই চিরদিন থাকবে না! লোকটি সংসার ত্যাগ করে চলে গেল নিত্যের খোঁজে।

তাই সব সময় মাথায় রাখুন; -‘অ্যায়সা দিন নহী রহেগা।’ মানে- ‘এমন দিন থাকবে না’, তা সুখ কিংবা দুঃখ যাই হোক না কেন,- সবই দুদিনের জন্য। তাই সহ্য করে চলুন আর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। সময়ই অবস্থার পরিবর্তন নিয়ে আসবে এবং তা অবসম্ভবাভী, আর কেউ তা রোধ করতে পারবে না।

বিশ্বাস করুন আপনি যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছেন, আপনিও তা কিছুদিনের মধ্যেই কাটিয়ে উঠবেন। তাই অযথা দুঃখ কষ্টের কথা সর্বদা চিন্তা করে বা ভেবে ভেবে মনের ব্যাথা আরও বেশি করে বাড়িয়ে তুলবেন না।

রাত ও দিনের পরিবর্তনের মতোই আপনার অবস্থার পরিবর্তনও আসবেই,-এবং তা আসতে বাধ্য, তাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষা।

জেনে রাখুন; একই রকম অবস্থা চিরদিন কারুর যায় না। কঠিন অবস্থায় সহ্য করে চলতে হয়, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। আর বিশ্বাস করুন; সবই তো দুদিনের জন্য, কোন কিছুই তো আর চিরদিনের নয়।

অতএব ভাবনা কিসের? দুঃখ কিসের? আর মাথায় রাখুন- ‘অ্যায়সা দিন নহী রহেগা।’ মানে- ‘এমন দিন থাকবে না’। কিছু বুঝলেন কি? এখনও দুঃখ করবেন?

নাকি আগামীর কথা ভেবে আনন্দে থাকবেন? আশাকরি আপনার দুঃখের মাঝেও এই লেখাটি কিছুটা হলেও আপনাকে স্বস্তি দেবে।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………………
স্বামী জয়ানন্দজীর অন্যান্য লেখা পড়ুন:
আপন স্বরূপ
মানসিক বিপর্যয়ে মুক্তির পথ
সম্পর্ক বিপর্যয়ে মুক্তির পথ

এতো চিন্তা কিসের?

……………………
আরো পড়ুন:
এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: এক
এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: দুই
এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: তিন
এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: চার

এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: পাঁচ
এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: ছয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!