-হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
বাঙালী ব্রাহ্মণ, শুধু বাংলার নয়, সমস্ত ভারতেরই গৌরবের স্থল। বিদ্যা, বুদ্ধি, শাস্ত্রজ্ঞানে তাঁহার কোন-জাতীয় ব্রাহ্মণ হইতেই ন্যূন নহেন, বরং তত্ত্ব বুদ্ধি ও বিচারশক্তিতে তাঁহাদের স্থান সর্বাপেক্ষা উচ্চ। কিন্তু আমরা এখন সে সকল গৌরবের কথা এখানে বলিব না। তাঁহাদিগকে বাংলার গৌরব বলিয়াছি, বাংলায় তাহারা কি করিয়াছেন তাহাই দেখাইব এবং সেই জন্য তাঁহাদের গৌরব করিব।
এই যে এত বড় একটা অনার্য দেশ, এখানে বৌদ্ধ, জৈন এবং অন্যান্য অব্রাহ্মণ ধর্মের এত প্রাদুর্ভাব ছিল, অথচ এখন এ দেশে জৈন বৌদ্ধ দেখিতেও পাওয়া যায় না, তাহাদের কীর্তিকলাপ পর্যন্ত লোকে একেবারে ভুলিয়া গিয়াছে,–চারিদিকের লোকে জানে বাংলা হিন্দুধর্মের দেশ–এটা কে করিল ? কাহার যন্ত্রে, কাহার দূরদর্শিতায়, কাহার নীতিজ্ঞানে এই দেশটা আর্য আচারে, আর্য বিদ্যায়, আর্য ধর্মে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে ?
এ প্রশ্নের ত এক উত্তর। বাঙালী ব্রাহ্মণরাই এই কাজটি করিয়াছেন। বাংলায় রাজশক্তি ত তাঁহাদের অনুকূল ছিল না, বরং অনেক স্থানে অনেক সময় ঘোর প্রতিকূলই ছিল। এই রাজশক্তির বিরুদ্ধে অনবরত সংগ্রাম করিয়া দেশটাকে হিন্দু করিয়া তুলা একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার, বঙ্গের ব্রাহ্মণের তাহা সুসিদ্ধ করিয়াছেন, আর এমনি ভাবে সুসিদ্ধ করিয়াছেন যে, মুসলমান ঐতিহাসিকেরা জানেন না যে, তাঁহাদের আগমনের সময়েই এদেশে হিন্দু ছাড়া আরও একটা প্রবল ধর্ম ছিল।
এইরূপ করায় তাহাদের দুই কাজই হইয়াছিল। লোকের দৃষ্টি বৌদ্ধের দিক হইতে হিন্দুর দিকে পড়িয়াছিল এবং মুসলমানদের হাত হইতে উদ্ধার হইবার একটা বেশ যন্ত্র হইয়াছিল। রাজনীতিজ্ঞ মুসলমানেরাও একথা বেশ অনুভব করিয়াছিলেন, তাই তাহারা ঘরের পয়সা দিয়া বাংলা লেখার সাহায্য করিতেন। বাস্তবিকই স্মৃতি ও দর্শন অপেক্ষা এই সকল বাংলা তর্জমায় হিন্দু সমাজের বন্ধন বেশ শক্ত হইয়া উঠিয়াছিল।
মুসলমানের প্রাচীন সমাজ, বিশেষতঃ প্রাচীন বৌদ্ধসমাজ, একেবারে ধ্বংস করিয়া দিলে, তাহার পর কিরূপে ব্রাহ্মণের আবার ধীরে ধীরে সেই সমাজ আবার গড়িয়া তুলিলেন, তাহা পূর্বেই অনেকটা দেখাইয়াছি। স্মৃতি, দর্শন, বৈষ্ণব ধর্ম, শাক্ত ধৰ্ম, তাহাদের বিশেষ সাহায্য করিয়াছিল, কিন্তু তাহাতেই ব্রাহ্মণের নিশ্চিন্ত ছিলেন না।
তাঁহারা দেখিয়াছিলেন, দেশীয় ভাষায় ছড়া লিখিয়া, দেশীয় ভাষায় গান গাইয়া, বৌদ্ধের কেমন দেশটাকে মাতাইয়া তুলিত। সুতরাং দেশ মাতাইতে হইলে যে, মাতৃভাষা ভিন্ন হয় না, এ তাহদের বেশ জ্ঞান হইয়াছিল। তাই তাহারা প্রথম হইতেই রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি বাংলা করা আরম্ভ করিয়া দেন।
এইরূপ করায় তাহাদের দুই কাজই হইয়াছিল। লোকের দৃষ্টি বৌদ্ধের দিক হইতে হিন্দুর দিকে পড়িয়াছিল এবং মুসলমানদের হাত হইতে উদ্ধার হইবার একটা বেশ যন্ত্র হইয়াছিল। রাজনীতিজ্ঞ মুসলমানেরাও একথা বেশ অনুভব করিয়াছিলেন, তাই তাহারা ঘরের পয়সা দিয়া বাংলা লেখার সাহায্য করিতেন। বাস্তবিকই স্মৃতি ও দর্শন অপেক্ষা এই সকল বাংলা তর্জমায় হিন্দু সমাজের বন্ধন বেশ শক্ত হইয়া উঠিয়াছিল।
কিন্তু এ তর্জমার মূলে ব্রাহ্মণ। এ কথাটা প্রথম তাঁহাদেরই মাথায় আসিয়াছিল এবং তাঁহারাই আগ্রহসহকারে এই কার্য করিয়া বাঙালীর গৌরব যথেষ্ট বৃদ্ধি করিয়া গিয়াছেন।
………………….
আরও পড়ুন-
নানা ধর্মমত
বৌদ্ধ শীলভদ্র
বৌদ্ধ লেখক শান্তিদেব
নাথপন্থ
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
জগদ্দল মহাবিহার ও বিভূতিচন্দ্র
বৃহস্পতি, শ্রীকর, শ্রীনাথ ও রঘুনন্দন
ন্যায়শাস্ত্র
চৈতন্য ও তাঁহার পরিকর
তান্ত্রিকগণ
বাঙালী ব্রাহ্মণ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….