ভবঘুরেকথা

-হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

অভিধর্মকোষ-ব্যাখ্যার মঙ্গলাচরণে লেখা আছে যে, গ্রন্থকার বসুবন্ধু দ্বিতীয় বুদ্ধের ন্যায় বিরাজ করিতেন। এ কথা দি ভারতবর্ষের পক্ষে সত্য হয় তাহা হইলে সমস্ত এশিয়ার পক্ষে হিউয়ান্‌ চুয়াং যে দ্বিতীয় বুদ্ধের ন্যায় বিরাজ করিতেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। চীনে যত বৌদ্ধ পণ্ডিত জন্মিয়া ছিলেন, হিউয়ান চুয়াং তাঁহাদের মধ্যে সকলের চেয়ে বড়।

তাঁহারই শিষ্য-প্রশিষ্য এক সময় জাপান, কোরিয়া, মঙ্গলিয়া ছাইয়া ফেলিয়াছিল। হিউয়ান চুয়াং বৌদ্ধ ধর্ম ও যোগ শিখিবার জন্য ভারতবর্ষে আসিয়া ছিলেন। তিনি যাহা শিখিবার জন্য আসিয়ছিলেন, তাহার চেয়ে অনেক বেশী শিখিয়া যান। যাঁহার পদতলে বসিয়া তিনি এত শাস্ত্র শিখিয়াছিলেন, তিনি একজন বাঙালী। ইহা বাঙালীর পক্ষে কম গৌরবের কথা নয়।

ইহার নাম শীলভদ্র, সমতটের এক রাজার ছেলে। হিউমান চুয়াং যখন ভারতবর্ষে আসেন তখন তিনি নালন্দা বিহারের অধ্যক্ষ ; বড় বড় রাজা এমন কি সম্রাট হর্ষবর্ধন পর্যন্ত তাঁহার নামে তটস্থ হইতেন, কিন্তু সে পদের গৌরব, মানুষের নহে। শীলভদ্রের পদের গৌরব অপেক্ষ বিদ্যার গৌরব অনেক বেশী ছিল। হিউয়ান্‌ চুয়াং একজন বিচক্ষণ বহুদর্শী লোক ছিলেন।

তিনি গুরুকে দেবতার মত ভক্তি করিতেন। তিনি বলিয়া গিয়াছেন যে, নানা দেশে নানা গুরুর নিকট বৌদ্ধশাস্ত্রের ও বৌদ্ধযোগের গ্রন্থ সকল অধ্যয়ন করিয়া, তাঁহার যে সকল সন্দেহ কিছুতেই মিটে নাই, শীলভদ্রের উপদেশে সেই সকল সন্দেহ মিটিয়া গিয়াছে। কাশ্মীরের প্রধান প্রধান বৌদ্ধ পণ্ডিত তাঁহার সে সমস্ত সংশয় দূর করিতে পারেন নাই, শীলভদ্র তাহা এক-এক কথায় দূর করিয়া দিয়াছিলেন।

তাঁহার বাল্যকালের কথাও কিছু এখানে বলা আবশ্যক। পূর্বেই বলিয়াছি যে, তিনি সমতটের রাজার ছেলে, তিনি নাকি ব্রাহ্মণ ছিলেন। বাল্যকাল হইতে তাঁহার বিদ্যায় অনুরাগ ছিল এবং খ্যাতিপ্রতিপত্তিও খুব হইয়াছিল। তিনি বিদ্যার উন্নতির জন্য সমস্ত ভারতবর্ষ ভ্রমণ করিয়া ত্রিশ বৎসর বয়সে নালন্দায় আসিয়া উপস্থিত হন। সেখানে বোধিসত্ত্ব ধৰ্মপাল তখন সর্বময় কর্তা।

শীলভদ্র মহাযান বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু বৌদ্ধদিগের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সমস্ত গ্রন্থই তাঁহার পড়া ছিল। এ ত অনেক বৌদ্ধেরই থাকিতে পারে, বিশেষ যাঁহারা বড় বড় মহাযান বিহারের কর্তা ছিলেন, তাঁহাদের থাকাই ত উচিত, কিন্তু শীলভদ্রের ইহা অপেক্ষা অনেক বেশী ছিল–তিনি ব্রাহ্মণদের সমস্ত শাস্ত্র আয়ত্ত করিয়াছিলেন। পাণিনি তাঁহার বেশ অভ্যাস ছিল এবং সেই সময় উহার যে সকল টীকাটিপ্পনী হইয়াছিল, তাহাও তিনি পড়াইতেন।

ব্রাহ্মণের আদি গ্রন্থ যে বেদ, তাহাও তিনি হিউয়ান চুয়াংকে পড়াইয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার মত সর্বশাস্ত্রবিশারদ পণ্ডিত ভারতবর্ষেও আর দেখিতে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। তাঁহার যেমন পাণ্ডিত্য ছিল, তেমনি মনের উদারতা ছিল। হিউয়ান্‌ চুয়াং-এর পাণ্ডিত্য ও উৎসাহ দেখিয়া নালন্দার সমস্ত পণ্ডিতবর্গ তাঁহাকে দেশে যাইতে দিবেন না স্থির করিলেন, তখন শীলভদ্র বলিয়া উঠিলেন,

“চীন একটি মহাদেশ, হিউয়ান্‌ চুয়াং ঐখানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করিবেন, ইহাতে তোমাদের বাধ দেওয়া উচিত নয়। সেখানে গেলে ইঁহার দ্বারা সদধর্মের অনেক উন্নতি হইবে, এখানে বসিয়া থাকিলে কিছুই হইবে না।”

আবার যখন কুমাররাজ ভাষ্করবর্মা হিউয়ান্‌ চুয়াংকে কামরূপ যাইবার জন্য বার বার অনুরোধ করিতে লাগিলেন এবং যাইতে রাজী হইলেন না, তখনও শীলভদ্র বলিলেন, “কামরূপে বৌদ্ধ ধর্ম এখনও প্রবেশলাভ করিতে পারে নাই, সেখানে গেলে যদি বৌদ্ধ ধর্মের কিছুমাত্র বিস্তার হয়, তাহার পরম লাভ।” এই সমস্ত ঘটনায় শীলভদ্রের ধর্মানুরাগ, দূরদর্শিতা ও নীতিকৌশলের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।

তাঁহার বাল্যকালের কথাও কিছু এখানে বলা আবশ্যক। পূর্বেই বলিয়াছি যে, তিনি সমতটের রাজার ছেলে, তিনি নাকি ব্রাহ্মণ ছিলেন। বাল্যকাল হইতে তাঁহার বিদ্যায় অনুরাগ ছিল এবং খ্যাতিপ্রতিপত্তিও খুব হইয়াছিল। তিনি বিদ্যার উন্নতির জন্য সমস্ত ভারতবর্ষ ভ্রমণ করিয়া ত্রিশ বৎসর বয়সে নালন্দায় আসিয়া উপস্থিত হন। সেখানে বোধিসত্ত্ব ধৰ্মপাল তখন সর্বময় কর্তা।

“আমি যখন কাষায় গ্রহণ করিয়াছি, তখন অর্থ লইয়া কি করিব?” রাজা বললেন, “বুদ্ধদেবের জ্ঞানজ্যোতি ত বহুদিন নির্বাণ হুইয়া গিয়াছে, এখন যদি আমরা গুণের পূজা না করি, তবে ধর্ম কিরূপে রক্ষা হইবে? আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার প্রার্থনা গ্রাহ্য করিবেন না।”

তিনি ধর্মপালের ব্যাখ্যা শুনিয়া উাহার শিষ্য হইলেন এবং অল্প দিনের মধ্যেই ধর্মপালের সমস্ত মত আয়ত্ব করিয়া লইলেন। এই সময় দক্ষিণ হইতে একজন দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত মগধের রাজার নিকট ধর্মপালের সহিত বিচার প্রার্থনা করেন। রাজা ধর্মপালকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। ধর্মপাল যাইবার জন্য উদ্যোগ করিলেন। শীলভদ্র বলিলেন, “আপনি কেন যাইবেন ?”

তিনি বলিলেন, “বৌদ্ধ ধর্মের আদিত্য অস্তমিত হইয়াছে। বিধর্মীর চারিদিকে মেঘের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। উহাদিগকে দূর করিতে না পরিলে সদ্‌ধর্মের উন্নতি নাই।” শীলভদ্র বলিলেন, “আপনি থাকুন, আমি যাইতেছি।” শীলভদ্রকে দেখিয়া দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত হাসিয়া উঠলেন, “এই বালক আমার সহিত বিচার করিবে?” কিন্তু শীলভদ্র অতি অল্পেই তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করিয়া দিলেন।

সে শীলভদ্রের না যুক্তি খণ্ডন করিতে পারিল, না বচনের উত্তর দিতে পারিল, লজ্জায় অধোবন হইয়া সে সভা ত্যাগ করিয়া গেল। শীলভদ্রের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হইয়া রাজা তাহাকে একটি নগর দান করিলেন। শীলভদ্র বলিলেন,

“আমি যখন কাষায় গ্রহণ করিয়াছি, তখন অর্থ লইয়া কি করিব?” রাজা বললেন, “বুদ্ধদেবের জ্ঞানজ্যোতি ত বহুদিন নির্বাণ হুইয়া গিয়াছে, এখন যদি আমরা গুণের পূজা না করি, তবে ধর্ম কিরূপে রক্ষা হইবে? আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার প্রার্থনা গ্রাহ্য করিবেন না।”

তখন শীলভদ্র তাঁহার কথায় রাজী হইয়া নগরটি গ্রহণ করিলেন এবং তাহার রাজস্ব হইতে একটি প্রকাণ্ড সংঘারাম নির্মাণ করিয়া দিলেন।

হিউয়ান চুয়াং এক জায়গায় বলিতেছেন যে, শীলভদ্ৰ বিদ্যা বুদ্ধি ধর্মানুরাগ নিষ্ঠা প্রভৃতিতে প্রাচীন বৌদ্ধগণকে ছাড়াইয়া উয়িছিলেন। তিনি দশ-কুড়িখানি পুস্তক লিখিছিলেন। তিনি যে সকল টীকা-টিপ্পনী লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা অতি পরিষ্কার ও তাহার ভাষা অতি সরল।

………………….
আরও পড়ুন-
নানা ধর্মমত
বৌদ্ধ শীলভদ্র
বৌদ্ধ লেখক শান্তিদেব
নাথপন্থ
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
জগদ্দল মহাবিহার ও বিভূতিচন্দ্র
বৃহস্পতি, শ্রীকর, শ্রীনাথ ও রঘুনন্দন
ন্যায়শাস্ত্র
চৈতন্য ও তাঁহার পরিকর
তান্ত্রিকগণ
বাঙালী ব্রাহ্মণ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!