ভবঘুরেকথা

-বার্ট্রান্ড রাসেল

ভাববাদ শব্দটিকে বিভিন্ন মতাবলম্বী দার্শনিকরা কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। আমরা এর দ্বারা সেই মতবাদ বুঝবো যা বলে যা অস্তিত্বশীল বা যা কম-বেশি অস্তিত্বশীল বলে জ্ঞাত হওয়া যায়, তা কোন না কোন অর্থে নিশ্চিত মানসিক।

দার্শনিকদের মধ্যে বহুল প্রচারিত এই মতবাদ বিভিন্ন রূপে বর্তমান এবং এটি বিভিন্ন কারণে মানা হয়। এই মতবাদ এত ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং স্বভাবতই এত চিত্তাকর্ষক যে দর্শনের খুব সংক্ষিপ্ত ইতিহাসেও এর কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়।

যারা দার্শনিক আলোচনায় অনভ্যস্ত তারা এই ধরনের মতবাদকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেন। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে সাধারণ বোধ টেবিল, চেয়ার, সূর্য, চন্দ্র বা বাহ্য বস্তুকে মন এবং মনের বিষয়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলে মনে করে এবং মন না থাকলেও এদের অস্তিত্ব চলতেই থাকবে একথা মানে।

আমরা মনে করি জড়ের অস্তিত্ব মনের বহু পূর্ব থেকেই আছে এবং এটিকে মনের চিন্তার ফল বলে মনে করা খুবই কষ্টকর। কিন্তু সত্য বা মিথ্যা যা-ই হোক না কেন, ভাববাদকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আমরা দেখেছি যে বাহ্য বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্ব থাকলেও তারা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত থেকে অবশ্যই আলাদা এবং বাহ্যবস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের মিল রয়েছে ঠিক সেভাবে যেভাবে একটি ক্যাটালগের সঙ্গে তাতে লিপিবদ্ধ বিষয়ের সাদৃশ্য থাকে।

এরপর তিনি সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করেছেন, যেমন একটি গাছ। তিনি দেখিয়েছেন যে যখন আমরা গাছটি দেখি তখন আমরা যা তাৎক্ষণিকভাবে জ্ঞাত হই তা হল কতকগুলো ধারণা। তিনি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে এরকম মনে করার সামান্যতমও ভিত্তি নেই যে দেখা যাওয়া ছাড়া গাছটির আর কোন সত্যতা আছে, তিনি বলেন এর অস্তিত্ব দেখার উপর নির্ভরশীল, লাতিন ভাষায় এর অস্তিত্বশীলতা হল দেখা।

এই কারণে সাধারণ বোধ বাহ্য বস্তুর অন্তর্নিহিত স্বভাব সম্বন্ধে আমাদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখে এবং যদি এদের মানসিক বলে মনে করার উপযুক্ত কারণ থাকে, তাহলে আমরা কখনই যুক্তিযুক্তভাবে এদেরকে অসম্ভব বলে বাদ দিতে পারি না শুধুমাত্র এই কারণে যে এই মতবাদ অদ্ভুত লাগছে।

বাহ্য বস্তু সম্বন্ধে সত্যতা অবশ্যই অদ্ভুত। এতে পৌঁছানো নাও যেতে পারে, কিন্তু যদি কোন দার্শনিক মনে করেন যে তিনি এতে পৌঁছাতে পেরেছেন, তাহলে তিনি যাকে সত্য বলে চিহ্নিত করছেন তা অদ্ভুত হলেও সেটি তাঁর মতের বিরুদ্ধে আপত্তির কোন কারণ হতে পারে না।

সাধারণত জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাববাদ প্রচার করা হয়, অর্থাৎ সেই শর্তগুলো আলোচনার মাধ্যমে যা আমাদের বিষয়গুলো জানার জন্য প্রয়োজন। বিশপ বার্কলে এই ভিত্তিতে ভাববাদ প্রচার করার প্রথম প্রচেষ্টা করেন। তিনিই প্রথম যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করেছিলেন- যা বহুলাংশে সঠিক-যে মন নিরপেক্ষভাবে ইন্দ্রিয়-উপাত্তগুলোর অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

এগুলো অবশ্যই আংশিকভাবে মনের মধ্যে থাকবে এই অর্থে যে, যদি কোন দেখা, শোনা, স্পর্শ করা, গন্ধ নেয়া বা স্বাদ গ্রহণ করা না থাকে তা হলে এদের অস্তিত্ব থাকবে না। তার এই মত বহুলাংশেই সঠিক, যদিও কিছু যুক্তি সঠিক নয়।

কিন্তু তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে আমাদের প্রত্যক্ষ একমাত্র ইন্দ্রিয়-উপাত্তের অস্তিত্বকে নিশ্চিত করতে পারে এবং জ্ঞাত হওয়া মানেই মনের মধ্যে থাকা এবং তা মননযোগ্য। এভাবে তিনি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে মন ছাড়া কোন কিছু জানা যায় না এবং আমার মনে জ্ঞাত না হয়ে যা জানা যায় তা অবশ্যই অন্য কারোর মনে থাকবে।

তার যুক্তি বুঝার জন্য তার ধারণা শব্দের ব্যবহার বুঝা প্রয়োজন। যা কিছু তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায় তাকেই তিনি ধারণা নাম দিয়েছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ইন্দ্রিয়-উপাত্তগুলোকে জানা যায়। এভাবে আমাদের দেখা একটি বিশেষ রঙ হল একটি ধারণা। একইভাবে যে শব্দ আমরা শুনি বা অন্যান্য বিষয়গুলোও।

কিন্তু এই পদটি সম্পূর্ণভাবে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। এরকম অনেক বিষয় রয়েছে যাকে মনে করা বা কল্পনা করা যায়। মনে করা বা কল্পনা করার ক্ষেত্রে বিষয়ের সঙ্গে আমাদের তাৎক্ষণিক পরিচিত থাকে। এ সমস্ত তাৎক্ষণিক উপাত্তগুলোকেই তিনি ধারণা বলেছেন।

এরপর তিনি সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করেছেন, যেমন একটি গাছ। তিনি দেখিয়েছেন যে যখন আমরা গাছটি দেখি তখন আমরা যা তাৎক্ষণিকভাবে জ্ঞাত হই তা হল কতকগুলো ধারণা। তিনি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে এরকম মনে করার সামান্যতমও ভিত্তি নেই যে দেখা যাওয়া ছাড়া গাছটির আর কোন সত্যতা আছে, তিনি বলেন এর অস্তিত্ব দেখার উপর নির্ভরশীল, লাতিন ভাষায় এর অস্তিত্বশীলতা হল দেখা।

এভাবে, যখন বার্কলে বলেন যদি আমরা গাছটিকে জানতে পারি তাহলে গাছটি অবশ্যই আমাদের মনে থাকবে, তখন আসলে তার যা বলার অধিকার আছে তা হল গাছটির চিন্তা অবশ্যই আমাদের মনে রয়েছে। গাছটি স্বয়ং অবশ্যই আমাদের মনে রেখেছি সে স্বয়ং আমাদের মনের মধ্যে রয়েছে।

তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করেন যে যখন আমরা চোখ বন্ধ করব বা যখন কোন ব্যক্তি এর কাছে থাকবে না, তখনও গাছটির অস্তিত্ব থাকবে। কিন্তু তিনি বলেন যে এর ধারাবাহিক অস্তিত্বের কারণ হল ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ। আসল গাছ যার সঙ্গে বাহ্য বিষয়ের অনুরূপতা রয়েছ, তা ঈশ্বরের মনে ধারণা আকারে রয়েছে।

কিন্তু যখন আমরা গাছটি দেখি কথন আমাদের কাছে যা ধারণা আকারে প্রতিভাত হয়, সেগুলো ঈশ্বরের মনে স্থায়ী হিসেবে থাকে যতক্ষণ অবধি গাছটির অস্তিত্বশীলতা রয়েছে। তাঁর মতে আমাদের সমস্ত প্রত্যক্ষ ঈশ্বরের প্রত্যক্ষে আংশিকভাবে অংশগ্রহণ করে, এই অংশগ্রহণের জন্যই বিভিন্ন ব্যক্তি একই গাছ প্রত্যক্ষ করে।

এভাবে জগতে মন ও তার ধারণা ছাড়া আর কিছুই নেই এবং এটা সম্ভবও নয় যে কোনকিছু জ্ঞাত হতে পারবে, যেহেতু যা জ্ঞাত হয় তা হল অবশ্যই ধারণা।

এই ধরনের যুক্তিতে নানা দোষ আছে যা দর্শণের ইতিহাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং যেগুলোকে সর্বসমক্ষে আনা উচিত।

প্রথমত, ধারণা শব্দটি ব্যবহারের মধ্যেই গোলমাল রয়েছে। আমরা সাধারণ ধারণা বলতে কারোর মনের মধ্যে কোন কিছুকে ভাবি এবং যখন আমাদের বলা হয় যে গাছটি ধরণা দিয়ে গঠিত তখন এটি মনে করা খুবই স্বাভাবিক যে যদি তাই হয় তাহলে গাছটি অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে মনের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু মনের মধ্যে থাকা এই ধারণাটি অত্যন্ত জটিল।

আমরা কোন ব্যক্তিকে মনে ধরে রাখার কথা বলি। কিন্তু এর দ্বারা বুঝাই না যে ব্যক্তিটি আমাদের মনে রয়েছে, বরং ব্যক্তিটির চিন্তা আমাদের মনে রয়েছে। যখন কোন ব্যক্তি বলে যে তাকে করতে বলা হয়েছিল এমন কোন বিষয় তার মনের মধ্যে থেকে সম্পূর্ণভাবে চলে গিয়েছে, তখন সে এটা বুঝায় না যে বিষয়টি নিজে কখনও তার মনের মধ্যে ছিল, বরং বিষয়টির চিন্তা পূর্বে তার মনে ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে মনের মধ্যে থেকে চলে গিয়েছে।

এভাবে, যখন বার্কলে বলেন যদি আমরা গাছটিকে জানতে পারি তাহলে গাছটি অবশ্যই আমাদের মনে থাকবে, তখন আসলে তার যা বলার অধিকার আছে তা হল গাছটির চিন্তা অবশ্যই আমাদের মনে রয়েছে। গাছটি স্বয়ং অবশ্যই আমাদের মনে রেখেছি সে স্বয়ং আমাদের মনের মধ্যে রয়েছে।

এই বিভ্রান্তি কোন পারদর্শী দার্শিনিক সত্যিই সৃষ্টি করেছেন বলাটা খুবই মোটা দাগের ব্যাপার, কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা এটিকে সম্ভব করেছে। কিভাবে এটা সম্ভব হয়েছে তা দেখার জন্য আমাদের অবশ্যই ধারণার প্রকৃতি সম্পর্কে প্রশ্নের আরও গভীরে যাওয়া প্রয়োজন।

বার্কলের মত অর্থাৎ রঙটি অবশ্যই মনের মধ্যে থাকবে– এই মতটির সম্ভাব্যতা নির্ভর করছে বিষয়টিকে উপলব্ধির ক্রিয়ার সঙ্গে উপলব্ধি করার বস্তুটিকে গুলিয়ে ফেলার ওপর। এদের মধ্যে যে কোনটিকেই ধারণা বলা যেতে পারে, হয়তো বার্কলে এদের যে কোনটিকেই ধারণা বলতেন।

ধারণার প্রকৃতি সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্ন তোলার আগে আমরা অবশ্যই ইন্দ্রিয় উপাত্ত ও বাহ্য বিষয় সম্পর্কিত এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রশ্নকে আলাদা করব।

বিভিন্ন কারণের জন্য আমরা দেখেছি যে বার্কলে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের ব্যাপারে সঠিক ছিলেন যা আমদের গাছের প্রত্যক্ষকে কম বা বেশি ব্যক্তিগত করে তোলে– ব্যক্তিগত এই অর্থে যে এরা গাছের উপর নির্ভর করে এবং গাছটি প্রত্যক্ষ না হলে এরা থাকবে না।

কিন্তু এটি তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন যুক্তি, যার দ্বারা বার্কলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায় তা অবশ্যইমনের মধ্যে থাকবে। এই উদ্দেশ্যে আমাদের ইন্দিয়-উপাত্তের উপর নির্ভরতা সম্পর্কে বিস্তারিত যুক্তি দেয়া অপ্রয়োজনীয়।

সাধারণত এটি প্রমাণ করা প্রয়োজনীয় যে কোন কিছু জানা মানেই বিষয়গুলো মানসিক হয়ে ওঠে। বার্কলে বিশ্বাস করতেন যে তিনিই এটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। পূর্ববর্তী প্রশ্ন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়-উপাত্তও বাহ্য বিষয়ের পার্থক্য নিয়ে নয়, বরং এই প্রশ্নটি নিয়েই এখন আমরা আলোচনা করব।

বার্কলের অর্থে ধারণা কে গ্রহণ করলে, মনের সামনে কোন ধারণা এলেই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়কে আমাদের বিবেচনা করতে হবে। একদিকে সেই বিষয়টি যার সম্পর্কে আমরা সচেতন–ধরাযাক আমার টেবিলের রঙ এবং অন্যদিকে প্রকৃত সচেতনতা, বিষয়টিকে উপলব্ধি করার মানসিক ক্রিয়া।

মানসিক ক্রিয়া নিঃসন্দেহেই মানকি, কিন্তু মনে করার এরকম কোন কারণ আছে কি যে, যে বিষয়টি জানা হচ্ছে তা কোন অর্থে মানসিক? রঙ সম্পর্কীয় আমাদের পূর্ববর্তী যুক্তিগুলো এটিকে মানসিক বলে প্রমাণ করে না। এগুলো শুধুমাত্র এটাই প্রমাণ করে যে এদের অস্তিত্ব আমাদের ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বাহ্য বস্তুর সম্বন্ধের উপর নির্ভর করে এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে টেবিলের উপর।

অর্থাৎ এর প্রমাণ করে যে, কোন বিশেষ বিন্দুতে একটি চোখ স্থাপিত হলে, একটি নির্দিষ্ট আলোয় একটি নির্দিষ্ট বর্ণ বিদ্যমান থাকবে। এই যুক্তিগুলো প্রমাণ করে না যে রঙটি দর্শনকারীর মনের মধ্যে রয়েছে।

বার্কলের মত অর্থাৎ রঙটি অবশ্যই মনের মধ্যে থাকবে– এই মতটির সম্ভাব্যতা নির্ভর করছে বিষয়টিকে উপলব্ধির ক্রিয়ার সঙ্গে উপলব্ধি করার বস্তুটিকে গুলিয়ে ফেলার ওপর। এদের মধ্যে যে কোনটিকেই ধারণা বলা যেতে পারে, হয়তো বার্কলে এদের যে কোনটিকেই ধারণা বলতেন।

এভাবে যখন আমরা জ্ঞানের প্রকৃতি অনুধাবন করি, তখন বার্কলের যুক্তি রূপ ও অন্তর্বস্তু উভয়ই ভুল বলে পরিগণিত হয় এবং ধারণাগুলো অর্থাৎ বিষয়কে অনুধাবন করা অবশ্যই মানসিকতার তাঁর এই ভাবনার ভিত্তিগুলোর কোন কার্যকারিতা থাকে না।

কাজটি নিঃসন্দেহে মনের মধ্যে রয়েছে : এই কারণে যখন আমরা কাজটি সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন আমরা সহজেই ধরে নিই যে ধারণাগুলি অবশ্যই মনের মধ্যে রয়েছে।

এ-কথাটা শুধুমাত্র তখনই সত্য যখন ধারনাগুলোকে জানার কাজ হিসেবে নেয়া হয়, তা ভুলে গিয়ে আমরা ধারণাগুলো মনের মধ্যে আছে এই বচনটিকে ধারনার অন্য অর্থে স্থানান্তরিত করি অর্থাৎ বিষয়গুলোকে জানার থেকে আমাদের জানার কাজে।

এভাবে মনের অজান্তেই বাকচাতুরীর মাধ্যমে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে যা আমরা জানতে পারি তা অবশ্যই আমাদের মনের মধ্যে থাকে। বার্কলের যুক্তির এটি মনে হয় সঠিক বিশ্লেষণ এবং আসল দোষ যার উপর এটি দাঁড়িয়ে আছে।

বিষয়কে জানার ক্ষেত্রে কাজ ও বিষয়ের মধ্যে পার্থক্যের এই প্রশ্নটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু আমাদের জ্ঞান অর্জনের সম্পূর্ণ ক্ষমতাই এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। নিজের বাইরের বিষয়বস্তুর সাথে পরিচিত হওয়ার ক্ষমতাই মনের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা মন ও তার থেকে আলাদা কোন কিছুর সম্বন্ধের উপরনির্ভর করে। এটিই বিভিন্ন বিষয়বস্তুকে জানার ব্যাপারে মনের শক্তি তৈরি করে। যদি আমরা বলি যে জানা বিষয়বস্তুগুলো অবশ্যই মনের মধ্যে থাকে, তাহলে হয় আমরা অন্যান্যভাবে মনের জানার শক্তিকে সীমাবদ্ধ করি, নয়তো নিছক পুনরুক্তি করি।

যদি আমরা মনে করি মনের মধ্যে আর মনের সামনে একই বিষয়, তাহলে আমরা পুনরুক্তি করি, অর্থাৎ যদি আমরা শুধুমাত্র মনের দ্বার জানাকে বুঝাই। কিন্তু যদি আমরা এটা মনে করি তাহলে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, এই অর্থে যা মনের মধ্যে রয়েছে তা মানসিক না-ও হতে পারে।

এভাবে যখন আমরা জ্ঞানের প্রকৃতি অনুধাবন করি, তখন বার্কলের যুক্তি রূপ ও অন্তর্বস্তু উভয়ই ভুল বলে পরিগণিত হয় এবং ধারণাগুলো অর্থাৎ বিষয়কে অনুধাবন করা অবশ্যই মানসিকতার তাঁর এই ভাবনার ভিত্তিগুলোর কোন কার্যকারিতা থাকে না।

আমরা স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ প্রকাশ করতে পারি যে হয়তো এটির অস্তিত্ব রয়েছে এবং এটি সত্যিই আছে কিনা তা ভেবে অবাক হই। এভাবে এটি আমাদের জ্ঞানলাভের ইচ্ছার সঙ্গে সংযুক্ত এবং হয় এই ইচ্ছা চারিতার্থ করার অথবা তা বিফল করার মতো গুরুত্ব এর আছে।

সুতরাং ভাববাদের সপক্ষে তার যুক্তি বাতিল করা যেতে পারে। অন্য আর কোন ভিত্তি আছে কিনা তা এখন দেখা প্রয়োজন।

প্রায়শই বলা হয় এবং যেন এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য এমনভাবেই বলা হয় যে যা আমরা জানি না তার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা কিছু জানতেও পারি না। বলা হয় যা কিছু আমাদের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক তা অবশ্যই আমাদের দ্বারা জ্ঞাত হবে।

এর থেকে এই ধারণা আসে যে বস্তু যদি এমন কিছু হয় যার সম্পর্কে আমরা জানতে পারি না, তাহলে বস্তু হল এমন কিছু যার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত হতে পারি না এবং আমাদের কাছে এই বিষয়ের কোন গুরুত্বও থাকে না।

কিছু দুর্বোধ্য কারণে সাধারণভাবে ধরেই নেয়া হয় যে যা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় তা সত্য হতে পারে না; অতএব বস্তু, যদি এটি মন বা মানসিক ধারণার দ্বারা গঠিত না হয়, তাহলে তা নিতান্তই অসম্ভব ও নিছক কল্পনা মাত্র।

আমাদের বর্তমান অবস্থায় এ ধরনের যুক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা অসম্ভব, কেননা এটি এমন কতকগুলো দিকের প্রশ্ন তোলে যার প্রাথমিক আলোচনা প্রয়োজন। তবে এই যুক্তিকে নাকচ করার কতকগুলো কারণ এ মুহূর্তেই বিবেচনা করা যেতে পারে।

শেষ থেকে শুরু করা যাক; যার ব্যবহারিক কোন গুরুত্ব আমাদের কাছে নেই তা কেন সত্য হতে পারবে না, তার কোন কারণ নেই। এটি সত্যি যে তত্ত্বগত প্রয়োজনীয়তাকে হিসেবের মধ্যে নিলে গ্রহণ করা হয় যা-কিছু সত্য তার কিছু গুরুত্ব আমাদের কাছে থাকবেই, যেহেতুে জগতের সত্যতা সম্পর্কে জ্ঞানলাভে ইচ্ছুক ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোন বিষয় সম্পর্কেই আমাদের কিছু আগ্রহ থাকে।

কিন্তু এই ধরনের আগ্রহকে বিচারের অন্তর্ভূক্ত করা হলে, ব্যাপারটা এমন হবে না যে বস্তুর কোন গুরুত্বই আমাদের কাছে নেই, শর্তসাপেক্ষে যে এটির অস্তিত্ব রয়েছে, এমনকি যদি আমরা এর অস্তিত্বের কথা জানতে সক্ষম না হই তাহলেও।

আমরা স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ প্রকাশ করতে পারি যে হয়তো এটির অস্তিত্ব রয়েছে এবং এটি সত্যিই আছে কিনা তা ভেবে অবাক হই। এভাবে এটি আমাদের জ্ঞানলাভের ইচ্ছার সঙ্গে সংযুক্ত এবং হয় এই ইচ্ছা চারিতার্থ করার অথবা তা বিফল করার মতো গুরুত্ব এর আছে।

অন্যদিকে, এটি কোনভাবেই সত্য নয়, বরং বলতে গেলে মিথ্যাই, যে যা আমরা জানি না তার অস্তিত্ব নেই। জানা এই শব্দটি এখানে দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে :

১. প্রথম অর্থে এটি সেই ধরনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যা ভ্রান্তির বিপরীত, যে-অর্থে আমরা যা জানি তা সত্য, যে অর্থটি আমাদের বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অর্থাৎ যাকে বিধান (Judgement) বলা হয়। শব্দটির এই অর্থে আমরা জানি যে কোন কিছু ঘটেছে। এই ধরনের জ্ঞানকে সত্যের জ্ঞান হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে।

২. উপরোক্ত জানা শব্দটির দ্বিতীয় অর্থে, শব্দটি আমাদের বিষয়বস্তুর জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, যাকে আমরা পরিচিতি বলতে পারি। এই অর্থেই আমরা ইন্দ্রিয়-উপাত্তকে জানি।

এভাবে যে বিবৃতিটিকে সত্য বলে মনে হচ্ছিল তা পুনর্বর্ণিত হলে এ রকম দাঁড়ায়-আমরা কখনই সঠিকভাবে বিচার করতে পারি না যে যা কিছুর সঙ্গে আমরা পরিচিত নই তা অস্তিত্বশীল নয়। এই বক্তব্য কোনভাবেই সত্য নয়, বরং স্পষ্টতই মিথ্যা।

এই বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে হলে সর্বপ্রথমে পরিচিতির দ্বারা জ্ঞান ও বর্ণনার দ্বারা আমাদের পার্থক্য করা প্রয়োজন, তারপর বিচার করা দরকার সাধারণ নীতির (যদি কিছু থাকে) কোন্ ধরনের জ্ঞানের মধ্যে সেই নিশ্চয়তা থাকে, যেরকম নিশ্চয়তা থাকে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার অস্তিত্ব সংক্রান্ত জ্ঞানের। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।

চীনের সম্রাটের সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কিন্তু আমি সঠিকভাবেই জানি যে তিনি আছেন। অবশ্য বলা যেতে পারে যে আমি এটা জানি কেননা অন্যান্য ব্যক্তি তাকে জানে। তবে এটি একটি অপ্রাসঙ্গিক উক্তি হবে, কারণ, নীতিটি সত্য হলে, আমি জানতেই পারি না যে অন্য কারোর তাঁর সঙ্গে পরিচিতি আছে।

তাছাড়া এর সপক্ষেও কোন কারণ নেই যে যার সঙ্গে কোন ব্যক্তির পরিচিতি নেই তার অস্তিত্ব সম্পর্কে কেন আমি জানতে পারব না। এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি বিস্তৃত ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে।

যদি আমি কোন অস্তিত্বশীল বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত থাকি, তাহলে আমার সেই পরিচিতিই বিষয়টির অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাকে নিশ্চিত করে। কিন্তু বিপরীতে এটা সত্য নয় যে যখনই আমি জানতে পারি কোন একটি বিষয়ের অস্তিত্ব আছে, তখন আমাকে বা অন্য কাউকে বিষয়টি সম্পর্কে অবশ্যই পরিচিত থাকতে হবে।

যেসব ক্ষেত্রে পরিচিতি ছাড়াই আমি যথার্থ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, সেসব ক্ষেত্রে যা ঘটে তা হল-বিষয়টি আমি বর্ণনার মাধ্যমে জানি এবং কোন সাধারণ নীতির ভিত্তিতে এই বর্ণনার সঙ্গে মেলে এমন বিষয়ের অনুমান যে বিষয়ের অস্তিত্ব আমি জেনেছি তার থেকে করা হয়।

এই বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে হলে সর্বপ্রথমে পরিচিতির দ্বারা জ্ঞান ও বর্ণনার দ্বারা আমাদের পার্থক্য করা প্রয়োজন, তারপর বিচার করা দরকার সাধারণ নীতির (যদি কিছু থাকে) কোন্ ধরনের জ্ঞানের মধ্যে সেই নিশ্চয়তা থাকে, যেরকম নিশ্চয়তা থাকে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার অস্তিত্ব সংক্রান্ত জ্ঞানের। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।

…………………….
অশেষ কৃতজ্ঞতা-
দর্শনের সমস্যাবলি : বার্ট্রান্ড রাসেল
অনুবাদ – আতা-ই-রাব্বি

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………………
আরও পড়ুন-
আধ্যাত্মিক উপলব্ধি
পরমসত্তানুসন্ধানে আত্মোপলব্ধির গুরুত্ব
অলৌকিক ঘটনার নিয়ম
ভাববাদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!