-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই, তবু বুদ্ধি আছে। কথাটা লেনিনের। আজগুবি শোনালেও উপায় নেই, কেননা সহজ কর্মজীবনের কাছে যা আজগুবি ভাববাদ তাকে ভয় করে না। এই মতবাদ অনুসারে বুদ্ধির অতিরিক্ত বাস্তব বস্তু কোথাও কিছু থাকতে পারে না, তাই মানুষের মাথাও নয়।
শুধু বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতা বা চিন্তা–যে নাম দিয়েই তার বর্ণনা করা যাক না কেন–সবচেয়ে চরম সত্য। ফলে মাথা নেই, তবু বুদ্ধি আছে। লেনিন বলছেন, এ-যেন এক মাথাহীন দর্শন।
অথচ, দর্শনের ইতিহাসে এমনই রহস্য যে, মাথা বলে কোনো পদার্থ এই মতবাদ অনুসারে বাস্তব না হলেও একে দেখতে লাগে শুম্ভ-নিশুম্ভের সেই পৌরাণিক সেনাপতির মতো-যার মাথা কেটে ফেললেই মরণ হয় না, কাটা মাথা থেকে ছিটকে-পড়া প্রত্যেক রক্তবিন্দু জন্ম দেয় এক একটি সমতুল্য দৈত্যের।
ভাববাদের এই অদ্ভূত লীলাখেলাকে বর্ণনা করতে বসলে দেশ-বিদেশের নানান পৌরাণিক উপাখ্যান মনে ভিড় করতে চায় ; মনে হয় ভাববাদ বুঝি মিশরের সেই পাখি, যুগে যুগে নিজের ভস্মাবশেষ থেকে যে লাভ করে নবজন্ম।
ভাববাদী মাথা না মানলেও এমনতর বেয়াদপির কথা শুনে নিশ্চয়ই মাথা গরম করে বলবেন- আসলে পেট বলে জিনিসটেও যে সত্যি নয়, আর পেট ভরানো বলে ব্যাপারটাও যে নেহাত স্থূল কথা, যাকে ধ্রুব সত্য বলা যায়, তা শুধু পেটের ধারণা আর পেট ভরানোর ধারণা!
মনে হয় মৃত দেবতার পুনরুজ্জীবন-কাহিনীতেও অবাক হবার কিছু নেই, কেননা দর্শনের পূত মন্দিরে আপাত তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মধ্যে যার উপাসনা প্রায় তৈলধারার মতো অবিচ্ছিন্ন, তারও মৃত্যুতে জীবনের পরিসমাপ্তি নয়, নবজীবনের সংকেত।
কেননা, ভাববাদকে বহুবার বহুভাবে খণ্ডন করা হয়েছে। তবুও মরণ হয়নি তার। বরং যাঁরা চণ্ডবিক্রমে একে খণ্ডন করতে এগিয়েছিলেন, তাঁরাই শেষ পর্যন্ত এর মহিমায় পঞ্চমুখ। শুনতে অবাক লাগে, কিন্তু আগেই বলেছি, আজগুবিকে ভিন্ন করলে, আর যাই হোক, ভাববাদকে বোঝবার জো থাকবে না।
ভাববাদের যেটা মোদ্দা কথা, সহজ বুদ্ধির সঙ্গে সত্যি যে তার মুখ-দেখাদেখি নেই, আর নেই বলে বর্কালির মতো ভাববাদীকে মাথা খুঁড়ে মরতে হয় ভাববাদের সঙ্গে সহজবুদ্ধির সংগতি প্রাণপণে প্রমাণ করতে। সহজবুদ্ধির সাধারণ মানুষ মনে করে স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে তার সংসার। কিন্তু ভাববাদী বলবেন, সংসার কোথায়?
আছে তো শুধু সংসারের ধারণা। এদিকে, ধারণার দৌলতে সত্যিই সংসার চলে না : পকেট-বোঝাই ধারণাকে উজাড় করে দিলেও মেছুনী এক টিকলি মাছ দেবে না, কিংবা ফাকা দু’নম্বর বাসের ধারণায় চেপে সাড়ে পাঁচটার সময় অফিস-ভাঙা ভিড় এড়িয়ে আরামে বাড়ি ফেরা, হায়, অসম্ভব।
উত্তরে ভাববাদী বিরক্ত হয়ে বলবেন, আসলে মাছটাও যে মাছ নয়, বাড়িটাও বাড়ি নয়, মাছের আর বাড়ির ধারণামাত্র। কিন্তু সহজ মানুষ একেবারো যেন নাচারী-মাছের ধারণা খেয়ে পেট নাকি কিছুতেই ভরে না!
ভাববাদী মাথা না মানলেও এমনতর বেয়াদপির কথা শুনে নিশ্চয়ই মাথা গরম করে বলবেন- আসলে পেট বলে জিনিসটেও যে সত্যি নয়, আর পেট ভরানো বলে ব্যাপারটাও যে নেহাত স্থূল কথা, যাকে ধ্রুব সত্য বলা যায়, তা শুধু পেটের ধারণা আর পেট ভরানোর ধারণা!
এহেন চরম জ্ঞানের কথা শুনেও মানুষের মাথা যদি শ্রদ্ধায় নুয়ে না পড়ে, তাহলে সন্দেহ করতে হবে যে, ভাববাদীর রকম-সকম দেখে মাথা বলে জিনিসটা সম্বন্ধেই সে শ্রদ্ধা হারিয়েছে।
এই বিজ্ঞানবাদকে খণ্ডন করতে বসে শঙ্কর, আর যাই হোক, তথাকথিত বৈদান্তিকসুলভ নিস্পৃহ সংযমের পরিচয় দেননি, এমন-কী তাঁর ভাষার সহজ প্রসাদগুণকে ছাপিয়ে উঠেছে প্রত্যক্ষ বিতৃষ্ণ। শঙ্কর বলেন, বিজ্ঞানবাদীর দল যে এমনতর আজগুবি কথা বলতে সাহস পায়, তার আসল কারণ তাদের মুখের মতো অঙ্কুশ নেই! অর্থাৎ অঙ্কুশের ভয় থাকলে অমন নির্লজ্জ মিথ্যে বলতে তারা সাহস পেত না।
তাই বলে সমস্ত যুগের সমস্ত দার্শনিকই যে ভাববাদীর এ-সব কথা মাথা পেতে মেনে নিয়েছেন, তাও মোটেই সত্যি কথা নয়। দর্শনের ইতিহাসে ভাববাদ সম্বন্ধে উৎসাহ যতখানি, ভাববাদকে খণ্ডন করবার উৎসাহ বুঝি তার চেয়ে কম নয়। অনেকবার অনেক দার্শনিক ভাববাদকে খণ্ডন করতে চেয়েছেন।
কিন্তু, যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য কথা, শেষ পর্যন্ত তাঁরা নিজেরাই ভাববাদের দীক্ষা নিলেন এবং বিধর্মে দীক্ষিত হবার পর যেন হয়ে দাড়ালেন এক একটি মূর্তিমান কালাপাহাড়, -ভাববাদেরই চরম নৃশংস প্রচারক। ভাববাদ তাই মরেও মরে না, যমালয় থেকে ফিরে আসে নতুন বর নিয়ে, নচিকেতার মতো।
একদিকে ভাববাদকে তীব্র, তীক্ষ্ণ আক্রমণ, অপরদিকে সেই ভাববাদের কাছেই করুণ আত্মসমৰ্পণ। এ-কথা যে-সব দার্শনিকের সম্বন্ধে সত্য, তাদের “দুর্বলচেতা” বলে উড়িয়ে দিতে যাওয়া নেহাত আত্মপ্রবঞ্চনা হবে। কেননা, দর্শনের ইতিহাসে তাঁরাই হলেন দিকপাল-বিশেষ।
স্বদেশে শঙ্কর, প্রাচীন গ্রীসে সক্রেটিস, আধুনিক যুরোপে কাণ্ট এবং সাম্প্রতিক যুগে অভিজ্ঞতাবিচারবাদীদের (Empirio-Critics) থেকে শুরু করে প্রয়োগবাদী (Pragmatists), বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী (Realist)) পর্যন্ত-যুগে যুগে এঁরাই তো যুগান্তকারী দার্শনিক বলে স্বীকৃত। অথচ এঁরা সকলেই প্রবল উৎসাহে ভাববাদকে খণ্ডন করার পর প্রবলতর উৎসাহেই ভাববাদের মাহাত্ম্যে মেতে উঠেছেন।
আচার্য শঙ্করের ‘বিজ্ঞানবাদ খণ্ডন’ ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে সুপ্রসিদ্ধ! (প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের পরিভাষায় ‘বিজ্ঞান’ শব্দটার অর্থ হলো মনের ধারণা, Science নয় ; তাই বিজ্ঞানবাদ আসলে আমরা যাকে ভাববাদ বা Idealism বলে উল্লেখ করছি তাইই। বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে একটি সম্প্রদায় ছিল, যার নাম বিজ্ঞানবাদী এবং যার মতবাদ-ও এমন-কী যুক্তি-প্রায় হুবহু য়ুরোপীয় দার্শনিক বার্কলির মতোই)।
এই বিজ্ঞানবাদকে খণ্ডন করতে বসে শঙ্কর, আর যাই হোক, তথাকথিত বৈদান্তিকসুলভ নিস্পৃহ সংযমের পরিচয় দেননি, এমন-কী তাঁর ভাষার সহজ প্রসাদগুণকে ছাপিয়ে উঠেছে প্রত্যক্ষ বিতৃষ্ণ। শঙ্কর বলেন, বিজ্ঞানবাদীর দল যে এমনতর আজগুবি কথা বলতে সাহস পায়, তার আসল কারণ তাদের মুখের মতো অঙ্কুশ নেই! অর্থাৎ অঙ্কুশের ভয় থাকলে অমন নির্লজ্জ মিথ্যে বলতে তারা সাহস পেত না।
এই তো শঙ্করের ভাববাদ খণ্ডন। কিন্তু তারপর? তাঁর নিজের মতবাদ? ব্ৰহ্ম সত্য, এবং ব্ৰহ্ম মানে বিশুদ্ধ চৈতন্য। এর চেয়ে চরম ভাববাদ-চেতনকারণবাদ-পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো দেখা দেয়নি। যে বহির্বস্তুর অবিসংবাদিত সত্তা নিয়ে এত তর্ক, তার হলো কী?
শঙ্কর বলছেন, বহির্জগৎকে উড়িয়ে দেবে কেমন করে? তার অনুভূতি যে অবিসংবাদিত! দিব্বি এক পেট খেয়ে এবং রীতিমতো পরিতৃপ্ত হয়ে যদি কেউ বলে, ‘কিছুই তো খাইনি, কই পরিতৃপ্তও তো হইনি,’ -তাহলে তার কথা যে-রকম মিথ্যে হবে, সেইরকমই মিথ্যে বিজ্ঞানবাদীর কথা।
ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বহির্বস্তুর সন্নিকর্ষ হবার পর, এবং স্বয়ং অব্যবধানে বহির্বস্তুকে অনুভব করার পর, বিজ্ঞানবাদীও বলে ‘বহির্বস্তু যে কী, কই তা তো জানি নে, কখনো তা দেখিনি– মনের বাইরে সত্যি কিছু নেই।’
বিজ্ঞানবাদীর দল নিজেদের কথাটা হয়তো আর একটু শুধরে নিয়ে বলবে, বিষয়ের অনুভূতিকে আমরা অস্বীকার করতে যাব কেন, আমরা শুধু অস্বীকার করি তার বাহ্যত্বরূপ-বিজ্ঞেয় পদার্থরাশি অন্তর্বর্তী ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। উত্তরে শঙ্কর বলছেন, এ হলো গায়ের জোরের কথা।
অনুভূতির সময় আমরা তো এই বলেই অনুভব করি।– এটা হলো স্তম্ভ, ওটা হলো কুড্য। কই এমন তো কখনো অনুভব করিনে যে, এটা হলো স্তম্ভের মানস রূপ, ওটা হলো কুড্যর মানস-রূপ! তাছাড়া, বহির্বস্তু বলে কোনো জিনিস।
যদি কোথাও কোনোকালে না থাকে, তাহলে অন্তর্বর্তী ধারণাকেই বা কেমন করে “বহির্বৎ” হিসাবে অনুভব করা সম্ভব? আসলে, ‘বহির্বৎ’ বলে ধারণাটা এল কোথা থেকে? এমন কথা তো মুখ-ফুটে কেউ বলতে পারে না যে, বিষ্ণুমিত্রের চেহারাটা ঠিক বন্ধ্যাপুত্রের মতো!
এই তো শঙ্করের ভাববাদ খণ্ডন। কিন্তু তারপর? তাঁর নিজের মতবাদ? ব্ৰহ্ম সত্য, এবং ব্ৰহ্ম মানে বিশুদ্ধ চৈতন্য। এর চেয়ে চরম ভাববাদ-চেতনকারণবাদ-পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো দেখা দেয়নি। যে বহির্বস্তুর অবিসংবাদিত সত্তা নিয়ে এত তর্ক, তার হলো কী?
সমগ্র জগৎ–যে জগতে ভাববাদীর মুখের মতো চাবুক নেই বলে শঙ্করের এত অনুশোচনা–রজ্জুতে সৰ্প-প্রতিভাসের মতো মিথ্যে হয়ে গেল। (মিথ্যা হিসাবে রজ্জু-সৰ্প আরও এক কাঠি সরেস, কিন্তু তাই বলে ব্যবহারিক পৃথিবী তার চেয়ে এক চুলও বেশি নয়। অদ্বৈত মতে মিথ্যার তারতম্যকে সত্যের তারতম্য বলে ভুল করলে চলবে না)।
সহজবুদ্ধির সঙ্গে সামান্যতম। আপসটুকুও নেই : ভাববাদ-খণ্ডন পরিণতি পেল চূড়ান্ত ভাববাদে।
দর্শনের এই আজব গোলক-ধাঁধায় ঘোরা–ভাববাদের হাত থেকে মুক্তি, পেতে গিয়ে ভাববাদের জালেই জড়িয়ে পড়া–একে শুধু দিশি দার্শনিকের খামখেয়াল বলে উড়িয়ে দেওয়াও চলে না। প্রাচীন গ্রীসে মহৎ দার্শনিকের মধ্যেও একই ঘটনার পুনরুক্তি। সক্রেটিসের কথা ধরা যাক।
দর্শনের সেই পুরোনো গোলক-ধাঁধাই! তবু নেহাত একে প্রাচীনদের সেকেলে ভ্রান্তিবিলাস ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়াও সম্ভব নয়। য়ুরোপের ইতিহাসে বিজ্ঞানের দিগ্বিজয় শুরু হবার পরও যে দিগ্বিজয়ী দার্শনিকের জন্ম হলো, এবং যার বৈজ্ঞানিক বুৎপত্তি অতি-বড় বিপক্ষও অস্বীকার করতে পারেন না, তিনিই বা এই অদ্ভুত আবর্তকে এড়াতে পারলে কই?
তাঁর দর্শন, এমন-কী তাঁর জীবনকেও বোঝবার একমাত্র সূত্র হলো সফিস্টদের ভাববাদকে খণ্ডন করবার উৎসাহ। সফিস্টরা তর্কে ধুরন্ধর ; তারা প্রমাণ করতে চায় যে, ব্যক্তিগত মানুষের মনের ওপরেই পরমসত্তার একান্ত নির্ভর। মানুষের ভালোলাগা-না-লাগাই সত্যবিচারের অভ্রান্ত কষ্টিপাথর।
ভাববাদের এই মূল দাবিকে নিছক জ্ঞানের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখে সফিস্টদের সন্তোষ নেই, নৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনেও তারা এর জের টানতে চায়–সুনীতি আর দুর্নীতির মধ্যে আসলে কোনো তফাত নেই, আপনার যা রোচে, সেটাই আপনার কাছে সুনীতি ; প্রেয় আর শ্রেয়, একেবারে নিছক এক।
রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনের বেলাতেও ওই এক কথা-এ-সব আইন-কানুন মানতে যদি মন্দ না লাগে, তাহলে মন্দ কী? কিন্তু মানতে যে হবেই, এমন কোনো কথা নেই। সক্রেটিস দেখলেন, ভাববাদের এই দাবি সমাজজীবনের পক্ষে একেবারে দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ভাববাদকে খণ্ডন করবার জন্যে তিনি প্রায় মরিয়া হয়ে উঠলেন।
তার খণ্ডন-পদ্ধতি আপাত বিনয়ের পরাকাষ্ঠা, কিন্তু তার পেছনে যে তীব্র বিদ্রুপ আর তীক্ষ্ণ বিদ্বেষ লুকানো, সে-কথা তার ভক্তদের লেখা ভালো করে পড়ে দেখলেই বুঝতে পারা যায়। হাটবাজার থেকে শুরু করে বড়লোকের খানাপিনার আসর পর্যন্ত সর্বত্রই তার দুর্ধর্ষ দ্বন্দ্ব-আহবান,–অমনটাই ছিল তখনকার দিনের ব্যাপার।
কিন্তু তারপর? তাঁর নিজের মতবাদ? তিনি নিজে অবশ্য কোনো দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেননি। তাঁর দর্শনের যেটুকু পরিচয় পাওয়া যায়, তা শুধু তার ভক্তবৃন্দের–প্রধানত প্লেটাে ও জেনোফেন-এর–গ্রন্থাবলী থেকে। এবং টীকাকারদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক তর্ক আছে যে, প্লেটো নিজের গ্রন্থে সক্রেটিসের মুখে যে দার্শনিক মতবাদ বসিয়েছেন, তা তাঁর গুরুদেবেরই মতবাদ, না নিজের মতবাদ ভক্তিভরে গুরুদেবের নামে প্রচারিত মাত্র!
কিন্তু এ-কথা নিয়ে তর্ক যতই থাকুক না কেন, এবং গুরুশিষ্যের মধ্যে মতের প্রভেদ ঠিক কী এবং কতটুকু, এ-বিষয়ে টীকাকাররা নিঃসন্দেহ হতে পারুন আর নাই পারুন,- অন্তত এক বিষয়ে মতভেদের কোনো প্রশ্নই ওঠে না! প্লেটোর দর্শনে সক্রেটিক বিশ্বালোচনের পূর্ণ বিকাশ। এবং গ্রীক যুগে প্লেটোর পৌরোহিত্যেই এই ভাববাদের সবচেয়ে জমকালো অভিষেক। ভাববাদ-খণ্ডন এইভাবে ভাববাদেই পরিণতি পেল।
দর্শনের সেই পুরোনো গোলক-ধাঁধাই! তবু নেহাত একে প্রাচীনদের সেকেলে ভ্রান্তিবিলাস ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়াও সম্ভব নয়। য়ুরোপের ইতিহাসে বিজ্ঞানের দিগ্বিজয় শুরু হবার পরও যে দিগ্বিজয়ী দার্শনিকের জন্ম হলো, এবং যার বৈজ্ঞানিক বুৎপত্তি অতি-বড় বিপক্ষও অস্বীকার করতে পারেন না, তিনিই বা এই অদ্ভুত আবর্তকে এড়াতে পারলে কই?
কিন্তু স্থির ও নিত্যর কোন হদিশ মানস-জগতে মেলে না। তাই বহির্জগতে তার সত্তা না মেনে উপায়ই নেই। আর এই কথা প্রমাণ করার পর কাণ্টে প্রায় উল্লাস করে বললেন : ভাববাদীর মরণ-মন্ত্র ভাববাদের বিরুদ্ধেই চেলে দেওয়া গেল, কেননা ভাববাদ অনুসারে একমাত্র অন্তর্বস্তুর যাথার্থই অধিসাংবাদিত, অথচ প্রমাণ করে দেওয়া গেল যে, অন্তর্বস্তুর অনুভূতি একান্তভাবে বহির্বস্তুর মুখাপেক্ষী!
ইম্যানুয়েল কাণ্ট–কোএন্স্বের্গের সেই ঋষি ইম্যানুয়েল কাণ্ট,-যাঁর কথা বলতে গিয়ে কোলরিজের কবিকণ্ঠও আবেগে গদগদ হয়ে পড়ে। পাছে তাঁর দার্শনিক মতবাদকে টীকাকারেরা ভুল করে ভাববাদ বলেই চালিয়ে দেন, এই ভয়ে কান্ট তাঁর প্রধান গ্রন্থ ‘শুদ্ধবুদ্ধির বিচার’-এর দ্বিতীয় সংস্করণে একটি নূতন অংশ জুড়ে দিলেন, আর সেই অংশের নাম দিলেন ‘ভাববাদ-খণ্ডন’।
তাঁর মতো পারিপাট্য-প্রিয় দার্শনিক ভাববাদকে খণ্ডন করার সময় এলোমেলোভাবে অগ্রসর হবেন, এমন কথা নিশ্চয়ই ভাবা যায় না ; কাণ্ট এলোমেলোভাবে এগোননি। প্রথমে তিনি প্রচলিত ভাববাদের শ্রেণীবিভাগ করে নিয়েছেন : একদিকে বার্কলির গোড়া ভাববাদ এবং অপরদিকে দেকার্ত-এর সংশয়াত্মক ভাববাদ।
বার্কলি সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য সামান্যই-দেশ এবং কালের বাহ্যসত্তা অপ্রমাণ করে, এ দুটিকে মানব অনুভূতির মূল কাঠামো বলে প্রমাণ করে, কাণ্ট নাকি আগেই এই গোড়া ভাববাদের মূল উচ্ছেদ করেছেন (কীভাবে যে তা সম্ভব হয়, তাই নিয়ে অবশ্য টীকাকারদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে)।
আপাতত কাণ্টের প্রধান উদ্দেশ্য হলো দেকার্ত-এর সংশয়াত্মক ভাববাদ খণ্ডন করা। দেকার্ত-মতে একমাত্র আত্মার সত্তাই অবিসংবাদিত সত্য, তাকে সংশয় করতে গেলেও স্বীকার করতে হয়। অপরপক্ষে, বহির্বস্তুর সত্তা ভগবানের দোহাই না দিয়ে মানবার জো নেই।
এ কথা খণ্ডন করতে গিয়ে কাণ্ট দেখালেন যে, তথাকথিত অবিসংবাদিত আত্মাকে মানতে গেলে বহির্বস্তুর সন্তা না মেনে উপায় নেই। কেননা, আত্মা সম্বন্ধে আমাদের যেটুকু উপলব্ধি, তা নিছক চেতনা-প্রবাহের উপলব্ধি, এবং প্রবাহকে প্রবাহ হিসেবে বুঝতে গেলে স্থির ও নিত্যর সাহায্য নিতেই হবে।
কিন্তু স্থির ও নিত্যর কোন হদিশ মানস-জগতে মেলে না। তাই বহির্জগতে তার সত্তা না মেনে উপায়ই নেই। আর এই কথা প্রমাণ করার পর কাণ্টে প্রায় উল্লাস করে বললেন- ভাববাদীর মরণ-মন্ত্র ভাববাদের বিরুদ্ধেই চেলে দেওয়া গেল, কেননা ভাববাদ অনুসারে একমাত্র অন্তর্বস্তুর যাথার্থই অধিসাংবাদিত, অথচ প্রমাণ করে দেওয়া গেল যে, অন্তর্বস্তুর অনুভূতি একান্তভাবে বহির্বস্তুর মুখাপেক্ষী!
(চলবে…)
…………………….
ভাববাদ খণ্ডন – মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………….
আরও পড়ুন-
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই : এক
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই : দুই
বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না : প্রথম পর্ব
বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না : দ্বিতীয় পর্ব
ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি : পর্ব এক
ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি : পর্ব দুই