ভবঘুরেকথা
কৃষ্ণ রাধা ব্রজলীলা প্রেম কালা বৃন্দাবন

‘রাধা ও রাধা… বলি ও রাধু… রাধে রে… ডাকতে ডাকতে গলা যে শুকিয়ে গেল, সারা দিচ্ছিস না কেন? কী হল তোর? বলতে বলতে সখি ললিতা এসে দাঁড়ায় রাধার সামনে। চমকে তাকায় রাধা। হাতের ধাক্কা লেগে ননীর ভাণ্ড থেকে কিছুটা ননী গড়িয়ে মাটিতে পড়ে। ব্যস্ত হয়ে ওঠে রাধা।

কাল ফাল্গুনী পূর্ণিমা, ভার ভার দুধ, দই, ঘি, ননী, মিঠাই যাবে মথুরার রাজবাড়িতে। রাজবাড়িতে কাল ফাল্গুনী পূর্ণিমার উৎসব তাই ব্রজভূমের গোপ-গোপিনীরা নাওয়া-খাওয়া প্রায় বন্ধ করে রাত জেগে দই, ননী, ঘি ও বিভিন্ন মিষ্টি তৈরিতে ব্যস্ত।

শাশুড়ি জটিলা, ননদ কুটিলাও নৌকাতে দুধ দইয়ের ভাণ্ড তুলে স্নান করে আগে আগে চলেছে বাড়ির পথে। এই অবস্থায় রাধা কী করে? দু’চোখ ভরে জল আসে। দু-দু’বার রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পরে যায় রাধা। ওড়না ছিঁড়ে যায়, হাত-পা কেটে রক্ত ঝরছে তবুও বাঁশি বেজেই চলেছে। বাঁশির সুর ডাকছে যেন রাধা রাধা বলে।

এদিকে রাধার যে কী হয়েছে, এত ব্যস্ততার মধ্যেও থেকে থেকে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ছে। দিন-রাত কোকিলগুলো কুহুকুহু করে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। চারদিক থেকে কত যে ফুলের সৌরভ দখিনা বাতাসে ভেসে এসে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে, ময়ূর-ময়ূরীরা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসবই রাধাকে আনমনা করে দিচ্ছে, কিন্তু সবচেয়ে যন্ত্রণার ব্যাপারে শ্যামের বাঁশি।

রাত নেই, দিন নেই, যখন-তখন কানাই তাঁর বাঁশি বাজায় আর রাধার বুকের ভেতর তোলপাড় করে ওঠে। কিন্তু রাধা যে আয়ান ঘোষের স্ত্রী। তার স্বামী-শাশুড়ি-ননদ নিয়ে সংসার। কুলবধূ রাধা কীভাবে সবার নজর এড়িয়ে যাবে তার প্রেমিক কৃষ্ণের কাছে।

‘না বাজাও বাঁশরি কানাহা’ রাধা মিনিত করেছে কৃষ্ণের কাছে। অনেক করে বুঝিয়েছে, কিন্তু নটখট কেশব বড় অবুঝ, বড় দুষ্টু। ‘কিরে রাধা যাবি না? যমুনার ঘাটে যে নৌকা অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি চল, না হলে সামান না নিয়ে নৌকা ছেড়ে দেবে।’

ললিতার কথায় রাধা তাড়াতাড়ি তার দুধ, ননী, ছানা, দই, মিষ্টির হাঁড়িগুলো মাথায় একের পর এক সাজিয়ে দইয়ের ভাণ্ড নিয়ে সখি ললিতার সঙ্গে পথে বেড়িয়ে পরে।

রাস্তায় বেড়িয়ে রাধা দেখে চারপাশে কতরকমের ফুলের পাপড়ি, সুগন্ধি গাছের পাতা, শুকিয়ে আবির বানানো হচ্ছে বাড়ির দাওয়ায়। রাধা বলে, ‘ললিতা চারপাশে এত রঙের ফুল এত সুগন্ধ আমাকে কেমন করে দিচ্ছে। কী হয়েছে আমার বলত?’

ললিতা হেসে ওঠে, ‘ও রাধা! তোর মনে প্রেম জন্মেছে রে লো সখি। তোর ভালোবাসার পাত্রই তোকে শান্তি দিতে পারে।’

বলতে বলতে যমুনা নদীর তীরে এসে দাঁড়ায় রাধারা। নৌকা ভর্তি করে দুধ, দই প্রভৃতির ভাণ্ড তুলে দিয়ে যমুনাতে স্নান করে পথে নামতেই বেজে ওঠে কানহার বাঁশি। না না, দুহাতে কান চাপা দেয় রাধা। এই দিনের আলোয় সে কিছুতেই কৃষ্ণের কাছে যেতে পারবে না।

শাশুড়ি জটিলা, ননদ কুটিলাও নৌকাতে দুধ দইয়ের ভাণ্ড তুলে স্নান করে আগে আগে চলেছে বাড়ির পথে। এই অবস্থায় রাধা কী করে? দু’চোখ ভরে জল আসে। দু-দু’বার রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পরে যায় রাধা। ওড়না ছিঁড়ে যায়, হাত-পা কেটে রক্ত ঝরছে তবুও বাঁশি বেজেই চলেছে। বাঁশির সুর ডাকছে যেন রাধা রাধা বলে।

সারা দোলনা ঢেকে দেয় ফুলে ফুলে। নানা রঙের আবির এনে জায়গায় জায়গায় হাঁড়ি ভর্তি করে ঢাকনা দিয়ে রাখে। পরদিন ভোরবেলা এসে নানা ফুল ছড়িয়ে মাটিতে ফুলের গালিচা বিছিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করে থাকে কানহার বাঁশির ডাকের জন্য।

কিছুটা মূহ্যমানের মতো ধীরে ধীরে পলাশ-কৃষ্ণচূড়ার বনে ঢুকে পরে রাধা। ওই তো নাটের গুরু কৃষ্ণ। রাধাকে দেখে বাঁশি থামিয়ে হাসতে হাসতে দু-হাত প্রসারিত করে কৃষ্ণ। বিব্রত রাধা নিজেকে কৃষ্ণের বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মিনতি করে বলে-

‘যখন-তখন আর বাঁশি বাজিও না কানহা, তোমার বাঁশির সুর আমাকে ঘরে থাকতে দেয় না। দিন নেই, রাত নেই, তোমার বাঁশি শুনলেই আমি পথে বেরিয়ে পড়ি। এর জন্য আমাকে যে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয় তা তো তুমি বোঝো না?’

কৃষ্ণ এতক্ষণ মুচকি-মুচকি হাসছিলেন। এবার বললেন, ‘ঠিক আছে কাল তাহলে তুমি আমার কাছে এসো না। কাল ফাল্গুনী পূর্ণিমা ব্রজের গোপিনীরা কাল আমার সঙ্গে হোলি খেলবে। তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবে না। দেখছ তো আবির-গুলালের সুগন্ধে ব্রজের বাতাস আমোদিত।

কাল সারাদিন দোল খেলা আর সারারাত চাঁদের আলোয় ফুলের দোলনায় দুলে পূর্ণ চন্দ্রিমার শোভ উপভোগ। তা যা হোক, রাধা তুমি যদি না আস তাহলে আর কী হবে? রাধার কৃষ্ণ তখন রাধাকে ছাড়াই অন্য গোপিনীদের সঙ্গে আনন্দ করবে।’

রাধা ছটফট করে ওঠে কৃষ্ণের কথা শুনে। না, সে কিছুতেই তার প্রাণপ্রিয় কৃষ্ণকে অন্যান্য গোপনারীদের মাঝে ছাড়তে পারবে না। যত বাধা আসুক শ্বশুরবাড়ি থেকে রাধা যাবে। রাধাকে যেতেই হবে কাল কৃষ্ণের সঙ্গে দোল খেলতে।

অশ্রূভেজা চোখ তুলে রাধা মিনতি করে বলে, ‘কানহা আজ রাতে দয়া করে বাঁশি বাজিও না। বরং কাল ভোরে বাঁশি বাজিও, আমি সেই সুর শুনে তোমার কাছে আসব। আমাকে ছাড়া দোল খেলা শুরু করবে না কথা দাও।’ কৃষ্ণও কথা দিলেন রাধা এলে তবেই শুরু হবে দোল খেলা।

কৃষ্ণের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাধা সোজা চলে যায় সখি ললিতা, বিশাখার গৃহে। তিন সখি মিলে অনেক আলোচনা করে। তারপর ঘরে ফিরে আসে রাধা। সন্ধেবাতি দেওয়ার পর খেয়ে-দেয়ে শাশুড়ি-ননদ ঘুমিয়ে পরলে রাধা পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে বাড়ি থেকে বার হয়ে ললিতা-বিশাখাকে নিয়ে বৃন্দাবনে গাছের ডালে বড় করে দোলনা টাঙায়।

সারা দোলনা ঢেকে দেয় ফুলে ফুলে। নানা রঙের আবির এনে জায়গায় জায়গায় হাঁড়ি ভর্তি করে ঢাকনা দিয়ে রাখে। পরদিন ভোরবেলা এসে নানা ফুল ছড়িয়ে মাটিতে ফুলের গালিচা বিছিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করে থাকে কানহার বাঁশির ডাকের জন্য।

আকাশে থালার মতো গোল পূর্ণিমার চাঁদ গলানো রূপোর মতো জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে। শীতল মলয় বাতাস বইছে। দোলনায় নাম না জানা কত পাখির গানে, ফুলের সুগন্ধে ফুলদোলের স্থানে যেন স্বর্গভূমি নেমে আসে ব্রজভূমে। রাধা-কৃষ্ণ এইভাবে অনাবিল ভালোবাসা, আনন্দ ও স্বর্গীয় সুখে ভাসতে ভাসতে সারা পূর্ণিমা রাত ফুলদোলে মেতে থাকে। দোল হয়ে ওঠে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের এক মূর্ত প্রকাশ।

একটু পরে বেজে ওঠে কৃষ্ণের বাঁশি। সময় হয়ে গিয়েছে হোলি খেলার। রাধা ভোরবেলা থেকে নতুন ঘাঘরা, কাঁচুলি ও চেলি পরে সুন্দর করে সেজে লম্বা চুলে বেনি করে সেজেছে। অপরূপা লাগছে রাধাকে সেই সাজে। বাড়ি থেকে বের হয়ে বাঁশির সুর লক্ষ্য করে তার মতো শতশত ব্রজ নারী চলেছে সুন্দর সেজেগুজে।

তবে রাধার দিকে যার চোখ পড়ছে সেই যে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে রাধা তা ভালোই বুঝতে পারছে। কৃষ্ণের বাঁশি হঠাৎ থেমে যায়, রাধাও দাড়িয়ে পরে। খুঁজতে থাকে, কোথায় আবার লুকালো দুষ্টু কানহা? রাধা যখন পাগলের মতো কৃষ্ণকে খুঁজছে ঠিক সেই সময় হঠাৎ করেই কৃষ্ণ এসে আবিরে আবিরে রাধাকে রাঙিয়ে দেয়।

রাধাও কম যায় না, সেও কৃষ্ণকে আবিরে আবিরে ভরিয়ে দেয়। সখিরা নানা হোলির গান গাইতে গাইতে হোলি খেলতে থাকে রাধা-কৃষ্ণের সঙ্গে। দেখতে দেখতে গোলারং পিচকারিতে ভরে কৃষ্ণ রাধাকে রাঙিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে রাধা ও অন্যান্য ব্রজবাসীরাও পিচকারির সঙ্গে অপরকে ভিজিয়ে দেয় নানা সুগন্ধি ভেষজ রঙে।

দেখতে দেখতে ব্রজভূমির মাটি রঙিন হয়ে যায়। এদিকে কৃষ্ণের পিচকারির রঙে সারাদিন ভিজে কাঁপতে কাঁপতে রাধা মিনতি করে আর পিচকিরির রঙে তাকে না রাঙাতে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। কৃষ্ণ আজ দোলের নেশায় মেতেছে। এই রঙে রঙিন করে তুলতেই হবে তার প্রেমিকা রাধার অন্তর।

সারাদিন রং খেলার পর রাধা-কৃষ্ণসহ ব্রজ নারী ও নর যমুনায় স্নান করে গোলাপের পাপড়ি দেওয়া ছানা-দইয়ের শবরত খেয়ে যে যায় বাড়ির পথ ধরে।

বাড়ি ফিরেও রাধার শান্তি নেই। রাতে যে ফুলদোল খেলতে হবে কৃষ্ণের সঙ্গে। রাত প্রথম প্রহর শেষ হয়ে ব্রজবাসী যখন নিজে নিজ ঘরে ঘুমিয়ে পরেছে সেই সময় রাধা তার সখিরা মিলে ফুলের দোলনার কাছে আসে। রাধা-কৃষ্ণকে ফুলের সাজে সাজিয়ে সখিরা দোলনায় বসিয়ে দোল দিতে দিতে পুষ্পবৃষ্টি করে। কেউ কেউ প্রেমের গানও গায়। শুরু হয় রাধাকৃষ্ণের নিশীথ ফুলদোল।

আকাশে থালার মতো গোল পূর্ণিমার চাঁদ গলানো রূপোর মতো জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে। শীতল মলয় বাতাস বইছে। দোলনায় নাম না জানা কত পাখির গানে, ফুলের সুগন্ধে ফুলদোলের স্থানে যেন স্বর্গভূমি নেমে আসে ব্রজভূমে। রাধা-কৃষ্ণ এইভাবে অনাবিল ভালোবাসা, আনন্দ ও স্বর্গীয় সুখে ভাসতে ভাসতে সারা পূর্ণিমা রাত ফুলদোলে মেতে থাকে। দোল হয়ে ওঠে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের এক মূর্ত প্রকাশ।

……………………………
বর্তমান পত্রিকা থেকে সংকলিত
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে: ভারতের সাধক-সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!