-বিদ্যুৎ মিত্র
প্রথমেই আপনি শিখতে যাচ্ছেন কিভাবে ধ্যান করতে হয়। এটা যখন শেখা হয়ে যাবে, মনের এমন একটা লেভেলে পৌঁছুবেন আপনি, যেখানে পৌঁছে সমস্যা সমাধানের জন্যে মুক্ত করে দিতে পারবেন আপনার কল্পনাশক্তিকে। প্রথমে আপনি ধ্যান করা শিখবেন, সমস্যা সমাধান করতে শিখবেন পরে।
হোসে সিলভার চারদিনের ট্রেনিং কোর্সে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এসব শেখাবার জন্যে অভিজ্ঞ লেকচারার থাকেন, কিন্তু বই পড়ে শেখার সময় আপনি কোনো গাইড পাচ্ছেন। না।
তাই এই পদ্ধতিটা চারদিনের মধ্যে শিখতে পারবেন না, শিখবেন একটু দেরিতে। তবে সমস্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করা হবে, কাজেই শিখতে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না।
আপনি শুধু যদি ধ্যান করা শেখেন, এবং তারপর আর সামনে না বাড়েন, তাহলেও কিন্তু এক ধরনের সমস্যার সমাধান আপনা থেকেই হতে থাকবে। ধ্যানমগ্ন। অবস্থায় অদ্ভুত সুন্দর একটা ব্যাপার ঘটে, সেটাকে আমরা সুখপ্রদ প্রশান্তি বলতে পারি।
যতো বেশি ধ্যানমগ্ন হবেন, নিজের ভেতর যতো গভীরে ডুবে যাবেন, ততোই ওই সুখপ্রদ প্রশান্তি আর পরমানন্দের একটা অনুভূতি আপনার সমগ্র অস্তিত্বে এমন। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে জীবনের কোনো সংকটই সেটাকে নষ্ট করতে পারবে না।
আপনার শরীরও তাতে উপকৃত হবে। প্রথমে আপনি উপলব্ধি করবেন, ধ্যানমগ্ন অবস্থায় উদ্বেগ আর অপরাধবোধ একেবারেই থাকছে না। ধ্যান করে আলফা লেভেলে পৌঁছুবার ভালো দিকগুলোর একটা হলো, চেষ্টা করেও নিজের ভেতর আপনি রাগ বা অপরাধবোধ আনতে পারবেন না।
হঠাৎ কোনোভাবে এই সব বোধ যদি অনুপ্রবেশ করেও, সাথে সাথে আলফা থেকে বিটা লেভেলে অর্থাৎ ধ্যানমগ্ন অবস্থা থেকে জাগ্রত অবস্থায় উঠে আসবেন আপনি। তাতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। চর্চা করতে থাকুন, ধীরে ধীরে ধ্যানমগ্ন অবস্থার মেয়াদ বাড়তে থাকবে।
আলফাতে প্রথমবার পৌঁছে এক-একজনের এক-এক রকম অভিজ্ঞতা হয়। কারো মনে হয়, ‘আহ, কি আরাম!’ কেউ আবার এতো গভীর প্রশান্তি অনুভব করে যে তার মনে হয়, ‘আরে, কোনো অনুভূতিই নেই আমার!’ আবার কেউ কেউ জেগে থাকা অবস্থার সাথে এই অবস্থার তেমন কোনো পার্থক্যই অনুভব করতে পারে না।
প্রথমবার যতোক্ষণ ধ্যানমগ্ন থাকবেন, দ্বিতীয়বার তারচেয়ে একটু বেশিক্ষণ থাকবেন, এই ভাবে এক সময় রাগ বা অপরাধ বোধের হামলা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে, ফলে ধ্যানও আর আপনি না চাইলে ভাঙবে না।
এই বোধগুলো উপস্থিত না থাকার অর্থ হলো, মনের যেসব ক্ষতিকর আচরণ বা তৎপরতা শরীরকে অসুস্থ ও দুর্বল করে তোলে, ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সেগুলো নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। শরীরের ডিজাইন তৈরি করা হয়েছে ওটাকে সুস্থ রাখার জন্যে।
তার নিজেরই রয়েছে নিরাময় ও উপশম ব্যবস্থা। মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মনই সে ব্যবস্থা বানচাল করে দেয়। তাই মনকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর মনকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রথম পদক্ষেপ হলো ধ্যান। একক ভাবে শুধু ধ্যানই তার নিজস্ব গতিপথ ধরে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে যায়, যাবার পথে শরীরের নিরাময় এবং উপশম ব্যবস্থাকে পুনর্বাসিত করে।
একদা উত্তেজনা আর উদ্বেগের কারণে যে শক্তি ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় ব্যবস্থাটি অচল হয়ে পড়েছিল, সেই শক্তি ফিরে পাওয়ায় আবার সেটা পুরোদমে। কাজ শুরু করে।
এবার জেনে নিন আলফা লেভেলে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পৌঁছুতে হলে কি করতে হবে।
সকালে আপনার ঘুম ভাঙলো। বাথরুমে যাবার তাগাদা থাকলে যান, তারপর আবার ফিরে আসুন বিছানায়। পনেরো মিনিট সময় বেঁধে নিন অ্যালার্ম ক্লকে, যাতে অনুশীলন করবার সময় ঘুম এসে পড়লেও সেটা সময়মতো ভেঙে যায়।
চোখ বন্ধ করে বন্ধ পাতার ভেতর দিয়ে ওপর দিকে তাকান, বিশ ডিগ্রি উঁচুতে। কারণটা এখনো পরিষ্কার জানা সম্ভব হয়নি, তবে দেখা গেছে, চোখের এই পজিশনই আলফা সৃষ্টির জন্যে সবচেয়ে বেশি উপযোগী।
এবার, ধীরে ধীরে, প্রতিবার দু’সেকেণ্ড করে বিরতি নিয়ে, একশো থেকে নিচের দিকে গুণতে থাকুন, এক পর্যন্ত। একশো, নিরানব্বই, আটানব্বই, সাতানব্বই:. এইভাবে। যখন গুণবেন, সম্পূর্ণ মনোযোগ এই কাজের ওপর স্থির রাখুন। আশা করা যায় প্রথমবার গোণা শেষ করলেই আপনি আলফা লেভেলে পৌঁছে যাবেন।
আলফাতে প্রথমবার পৌঁছে এক-একজনের এক-এক রকম অভিজ্ঞতা হয়। কারো মনে হয়, ‘আহ, কি আরাম!’ কেউ আবার এতো গভীর প্রশান্তি অনুভব করে যে তার মনে হয়, ‘আরে, কোনো অনুভূতিই নেই আমার!’ আবার কেউ কেউ জেগে থাকা অবস্থার সাথে এই অবস্থার তেমন কোনো পার্থক্যই অনুভব করতে পারে না।
পছন্দসই, প্রিয় একটা জায়গা বেছে নিন। শুয়ে পড়ুন বা আধশোয়া হোন, ভঙ্গিটি যেন অত্যন্ত আরামদায়ক হয়। জামা-কাপড় আঁটো না হয়ে ঢিলে-ঢালা হওয়া দরকার। নিরিবিলি, শান্ত, ঠাণ্ডা পরিবেশ হলে ভালো হয়। এবার আপনার শরীর সম্পূর্ণ ঢিল করে দিন, শিথিল করে ছেড়ে দিন নিজেকে।
এর কারণ হলো, আলফা লেভেল আমাদের জন্যে নতুন কোনো ব্যাপার নয়, এর সাথে আমরা সবাই পরিচিত–কেউ বেশি কেউ কম।
সকালে যখন আমাদের ঘুম ভাঙে, তখন প্রায়ই আমরা আলফা লেভেলে কিছুক্ষণের জন্যে থাকি। থিটা থেকে, অর্থাৎ ঘুমের লেভেল থেকে বিটায়, অর্থাৎ জেগে থাকা লেভেলে আসার সময় আলফা লেভেল আমাদেরকে পেরোতেই হয়। পেরোবার সময় ওই লেভেলে একটু দেরি করি আমরা, প্রায় প্রতিদিন সকালেই।
প্রথমবার অনুশীলনের সময় আপনি যদি কিছুই অনুভব না করেন, বুঝতে হবে এর আগে আলফা লেভেলে অনেকবার গেছেন আপনি, কিন্তু টের পাননি। মনটাকে শান্ত করুন, ঘাবড়াবেন না। অনুশীলন চালিয়ে যান।
একাগ্র মনোযোগের সাথে চেষ্টা করলে যদিও আপনি প্রথমবারই আলফা লেভেলে পৌঁছে যাবেন, তবু আলফা লেভেলের নিচের দিকে এবং তারপর থিটা লেভেলে নামতে হলে আরো পঁচিশদিন আপনাকে চর্চা করতে হবে পদ্ধতিটি।
একশো থেকে এক, এই কাউন্ট ডাউন পর পর পাঁচ দিন চালান। তারপর পঞ্চাশ থেকে এক, আরো পাঁচ দিন। তারপর পঁচিশ থেকে এক, আরো পাঁচ দিন। তারপর দশ থেকে এক, পাঁচ দিন। সবশেষে পাঁচ থেকে এক, পাঁচ দিন।
প্রথমবার বা প্রথম কয়েকবার একাগ্র মনোযোগের সাথে চেষ্টা করার পরও যাঁরা আলফা লেভেলে পৌঁছুতে পারছেন না বলে মনে করছেন, এবার তাঁদের জন্যে কিছু নিয়ম। এই নিয়ম অন্যান্য সবাইও ইচ্ছে করলে ব্যবহার করতে পারেন, কোনো ক্ষতি তো নেই-ই, লাভের পরিমাণ ষোলো আনা। এই নিয়মকে আমরা তিন–এক (৩-১) পদ্ধতি নামে অভিহিত করতে পারি।
শরীর শিথিল করে দিয়ে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নেয়ার নিয়ম এটা। আপনারা যারা এখনো আলফা লেভেলে পৌঁছুতে পারছেন না বলে মনে করছেন, এই নিয়ম তাঁরা সকালেই চর্চা করবেন, বাকিরা সকাল, দুপুর, রাত বা যে কোনো সময় চর্চা করতে পারেন।
পছন্দসই, প্রিয় একটা জায়গা বেছে নিন। শুয়ে পড়ুন বা আধশোয়া হোন, ভঙ্গিটি যেন অত্যন্ত আরামদায়ক হয়। জামা-কাপড় আঁটো না হয়ে ঢিলে-ঢালা হওয়া দরকার। নিরিবিলি, শান্ত, ঠাণ্ডা পরিবেশ হলে ভালো হয়। এবার আপনার শরীর সম্পূর্ণ ঢিল করে দিন, শিথিল করে ছেড়ে দিন নিজেকে।
চোখ বন্ধ করুন। তারপর গভীর ভাবে, বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ করুন। নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় মনে মনে ৩ সংখ্যাটি তিনবার উচ্চারণ করুন, সেই সাথে মনের চোখ দিয়ে ৩ সংখ্যাটির ছবি চাক্ষুষ করুন, এ-ও তিনবার।
মোট পঁচিশ দিন সকালে চর্চা করার জন্যে অনুশীলন দেয়া হয়েছে আপনাকে। কিন্তু এই পঁচিশ দিন পেরোবার আগেই, মাত্র দশ দিন অনুশীলনগুলো চর্চা করার পর, নতুন আরেকটা কাজ ধরবেন আপনি। এবার দিনের যে-কোনো সময়, দুপুরে বা রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে আলফা লেভেলে পৌঁছুতে হবে আপনাকে।
আরেকটা গভীর শ্বাস নিন, এবং নিঃশ্বাস ফেলার সময় মনে মনে ২ সংখ্যাটি তিনবার উচ্চারণ এবং মনের চোখে সংখ্যাটি তিনবার চাক্ষুষ করুন।
আরেকটা গভীর শ্বাস নিন, নিঃশ্বাস ফেলার সময় মনে মনে ১ সংখ্যাটি তিনবার উচ্চারণ করুন, মনের চোখে সংখ্যাটি তিনবার চাক্ষুষ করুন।
এই নিয়ম চর্চা করার পর আপনি যেখানে পৌঁছুলেন সেটাকে আমরা বেসিক লেভেল বলতে পারি, এই বেসিক লেভেল থেকে অন্যান্য যে-কোনো লেভেলে নেমে যাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ।
বেসিক লেভেল থেকে আরো নিচের লেভেলে যেতে হলে বা বেসিক লেভেলেরই আরো গভীর তলদেশে যেতে হলে একশো থেকে এক, এই নিয়মে কাউন্ট ডাউন করবেন।
এবার অটোসাজেশন প্রসঙ্গ। এই আটোসাজেশন সবার জন্যে। প্রতিদিন অনুশীলন শেষে যে লেভেলেই পৌঁছান আপনি, সাজেশনগুলো দিতে পারবেন নিজেকে। যতো গভীর লেভেলে সাজেশন দেবেন ততোই বেশি উপকার পাবেন।
১। আমার মনের এই নতুন শক্তি মানব কল্যাণের সহায়ক হবে।
২। প্রতিদিন প্রতি কাজে আমি ভালো করছি, ভালো করছি, ভালো করছি। বা, প্রতিদিন সব দিক থেকে উন্নতি করছি।
৩। হ্যাঁ-সূচক ভাবনায় আমার মনের আশা পূরণ এবং উপকার হবে।
৪। মনের এই লেভেলে বা অন্য লেভেলে এবং জেগে থাকা অবস্থায় আমার মনের ওপর, আমার সমস্ত অনুভূতি এবং ইন্দ্রিয়ের ওপর, সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব আছে আমার, এবং থাকবে।
প্রথমবার আলফা লেভেলে পৌঁছে প্রথমবারই এই লেভেল থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে নিজেকে অটোসাজেশন দেবেন আপনি। এই সাজেশন যতোবার ধ্যানমগ্ন হবেন। ততোবার নিজেকে দিতে হবে। সব সময় একই সাজেশন ব্যবহার করা ভালো।
মনে মনে এই কথাগুলো বলুন-
আমি এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুণতে যাচ্ছি; পাঁচ সংখ্যাটি উচ্চারণ করার সাথে সাথে আমি আমার চোখ খুলবো, সেই সাথে সম্পূর্ণ সজাগ অবস্থায় জেগে উঠবো, অনুভব করবো সম্পূর্ণ সুস্থতা, শরীর-মন আগের চেয়ে ভালো লাগবে।
এরপর আপনি গুণতে শুরু করুন। ১-২, ধ্যানমগ্ন অবস্থা থেকে উঠে আসতে শুরু করেছেন। ৩-এবার আবার নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন যে পাঁচ পর্যন্ত গুণে আপনি আপনার চোখ খুলবেন, সম্পূর্ণ সজাগ অবস্থায় জেগে উঠবেন, শরীর-মন তাজা।
আর ঝরঝরে লাগবে, কোনো রকম অসুস্থ বোধ করবেন না, বরং আগের চেয়ে সুস্থ বোধ করবেন। ৪–৫। পাঁচ পর্যন্ত গুণে, চোখ খুলুন। তারপর বলুন–সম্পূর্ণ জেগেছি। আমি, সুস্থ বোধ করছি।
মোট পঁচিশ দিন সকালে চর্চা করার জন্যে অনুশীলন দেয়া হয়েছে আপনাকে। কিন্তু এই পঁচিশ দিন পেরোবার আগেই, মাত্র দশ দিন অনুশীলনগুলো চর্চা করার পর, নতুন আরেকটা কাজ ধরবেন আপনি। এবার দিনের যে-কোনো সময়, দুপুরে বা রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে আলফা লেভেলে পৌঁছুতে হবে আপনাকে।
এর জন্যে দশ থেকে পনেরো মিনিট অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হবে। কারণ, আলফার হালকা লেভেল থেকে নয়, এবার আপনি বিটা থেকে গভীর আলফা লেভেলে নামতে চাইছেন, তাই সামান্য একটু অতিরিক্ত ট্রেনিং দরকার।
………………..
অশেষ কৃতজ্ঞতা- আত্ম-উন্নয়ন : বিদ্যুৎ মিত্র
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………
আরও পড়ুন-
ধ্যান কি করে করতে হয় : প্রথম কিস্তি
ধ্যান কি করে করতে হয় : দ্বিতীয় কিস্তি
ধ্যান কি করে করতে হয় : তৃতীয় কিস্তি
মন নিয়ন্ত্রণ
ধ্যান বিজ্ঞানাদি