ভবঘুরেকথা
ভাববাদ আধ্যাত্মবাদ

-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

ধর্ম আর ভাববাদ। ধর্মেরই মার্জিত আর সংস্কৃত সংস্করণ অধিবিদ্যা, ভাববাদের চুড়ান্ত অসম্ভব থেকে যার মুক্তি নেই। তাই, যে-অর্থে ইন্দ্রজাল ছেড়ে ধর্মের আওতায় এসে পড়া, সেই অর্থে ধর্ম ছেড়ে অধিবিদ্যা আর ভাববাদের আওতায় এসে পড়া কোনদিনই নয়।

বরং ইতিহাস-বিচারে চোখে পড়ে ধর্মের সঙ্গে অধিবিদ্যার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তাই! কেবল, ধর্মের বেলায় দরবারটা আবেগ আর কল্পনার কাছেই বেশি, অধিবিদ্যার বেলায় বিশুদ্ধ বুদ্ধির দাবিদাওয়ার কাছে। তবু মূলের কথাটা একই কথা।

সে-কথা মেহনতের কথা নয়, প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামের কথা নয়, প্রকৃতিকে চেনবার,-আর চেনবার ভিত্তিতে জয় করবার,-কথা নয়। প্রয়োগ-জীবন নয়। তার বদলে বিশুদ্ধ চেতনার দাবি। মেহনতের সঙ্গে লেশসম্পর্কহীন চেতনা। তারই বিকাশ ধর্মে, আবার ধর্মেরই বিশুদ্ধ সংস্করণ অধিবিদ্যায়।

আসলে, এই দুনিয়ায় বিপর্যয়ের যেন অন্ত নেই। বিরাট আর বিপুল প্রকৃতির যে শক্তি, তারই মুখোমুখি হয়েছে মানুষ। তাই, বিপর্যয়ের পর যেন বিপর্যয়ের ঢেউ। এই বিপর্যয়কে জয় করবার পথ রয়েছে দুটো। এক হলো প্রকৃতিকে জয় করা, আর এক হলো বিপর্বায়-বোধকে জয় করা। এক হলো বিজ্ঞান, যার স্থূল আর অচেতন অভিব্যক্তি ইন্দ্রজালের মধ্যে। আর এক হলো ধর্ম, যার সংস্কৃত আর মার্জিত অভিব্যক্তি অধিবিদ্যার মধ্যে।

অথচ, আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সামাজিক মেহনতের এই প্রেরণা নেই। কেননা আধুনিক সমাজ হলো শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, এ-সমাজের সদর মহলে মিসমার হয়ে গিয়েছে মেহনতের মর্বাদা। অবশ্য, মধ্যযুগের শৃঙ্খল ভেঙে যখন আধুনিক যুগের শুরু, জনগণ তখন এগিয়ে এসেছে সমাজের সদর মহলে, শোনা গিয়েছে মুক্তির বাণী; সমগ্র মানবতার মুক্তি।

প্রাকৃতিকে জয় করবার পথ, সংগ্রামের পথ-প্রয়োগের পথ। অব্যক্ত আর অচেতন ভাবে হলেও, স্থূল আর প্রায় সাহিজিক বৃত্তির বিকাশ হিসেবে হলেও, এই পথটাই ছিল ইন্দ্রজালের পথ। আবার এই পথটাই আধুনিক বিজ্ঞানের পথও। বিজ্ঞানের ঐশ্বর্য অনেক বেশি, ইন্দ্রজালের মতো বিজ্ঞান অচেতন আর অব্যক্ত নয়, নয়।

প্রায় সাহিজিক বৃত্তির বিকাশমাত্র। ইন্দ্রজালের মধ্যে অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে ইচ্ছাপূরণ; কল্পনা আর ভ্রান্তি। তাই আধুনিক বিজ্ঞান ইন্দ্রজালের পুনরুক্তিমাত্র নয়। বিজ্ঞানকে খাটো করবার, খেলো করবার, তুচ্ছ করবার তাগিদ ছাড়া আর কোনো তাগিদে নিশ্চয়ই বিজ্ঞানকে ইন্দ্রজালের পুনরুক্তি-মাত্র বলবার প্রশ্ন ওঠে না।

আসলে ইন্দ্রজালের মধ্যে যেটা সংকীর্ণতা,-যেটা ইচ্ছাপূরণ,-তার দায়ভাগ বিজ্ঞানের নয়, ধর্মেরই। তবু ইন্দ্রজালের অন্য দিকটার কথা ভুললেও চলবে না। সেটা হলো প্রয়োগজীবনের দিক : কল্পিত দেবতার পায়ে মাথা কোটা নয়, প্রার্থনা দিয়ে মন গলাবার চেষ্টা করা নয়, তার বদলে প্রকৃতিকে জয় করা।

আদিম মানুষের কাছে মেহনত আর জীবন প্রায় সমব্যাপ্ত : এত স্থূল আর এমন ভোঁতা। তার হাতিয়ার যে, সেই হাতিয়ারের নির্ভারে প্রত্যেকের পক্ষেই প্রাণপাত মেহনত না করলে বাঁচবার আর কোনো উপায়ই নেই। তাই, চেতনা যেটুকু, তা মেহনতেরই অপর পিঠ। চেতনায়-মোহনতে মিলে এক অখণ্ডতা।

মেহনত থেকেই ঠিকরে বেরিয়েছে চেতনার স্ফুলিঙ্গ, আবার চেতনার এই স্ফুলিঙ্গই প্রেরণা জুগিয়েছে মেহনন্তের। তবু হাতিয়ারটা নেহাতই স্থূল, নেহাতই অনুন্নত। তাই তার অনুরূপ মেহনতও নেহাতই নিচু স্তরের। ফলে তার উলটো পিঠেই যে চেতনা, সেই চেতনাও। তার মধ্যে চোদ্দ আনাই ইচ্ছাপূরণ, কল্পনা, ভ্রান্তি।

তবুও, ভ্রাস্তি দিয়ে ভরা হলেও, চোব্দ আনা ইচ্ছাপূরণ হলেও, মেহনতকে প্রেরণা জোগাতে পেরেছে। তার কারণ তখনকার সেই সাম্যজীবন;- যখন সবাই মিলে দল বেঁধে নাচছে, আর সবাইকার চোখের সামনে দুলছে কামনা সফল হবার ছবি, তখন সবকিছুই অনেকখানি অন্য রকম।

তখন দল বেঁধে শিকার করতে বেরিয়ে বাস্তবিকই শিকার সংগ্রহ করতে পারা অনেক বেশি সহজ, অনেক বেশি সম্ভব। জীবনের তাগিদ, মেহনতের তাগিদ,

প্রয়োগের তাগিদ-ইন্দ্রজালের মধ্যে এই যে তাগিদ-এরই উত্তরাধিকার আধুনিক বিজ্ঞানের। ইন্দ্রজালের ইচ্ছাপূরণটুকুর উত্তরাধিকার নয়; কেননা সেই দৈন্তের ভিত্তি নয়, স্থূল আর প্রায় অকর্মণ্য হাতিয়ারের ভিত্তি নয়। প্রয়োগের তাগিদ হলেও, একটা মস্ত তফাত রয়েছে।

আদিম মানুষের ইন্দ্রজালের পিছনে এই যে প্রয়োগের তাগিদ, এ-তাগিদ প্রায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে এসেছে তার সমাজের গড়নটা থেকে। সাম্যজীবন, দারিদ্র্যের তাগিদে হলেও সাম্যজীবন। তাই মেহনতের দায় সবাইকার উপরই, মেহনত আর জীবন প্রায় সমব্যাপ্ত।

অথচ, আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সামাজিক মেহনতের এই প্রেরণা নেই। কেননা আধুনিক সমাজ হলো শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, এ-সমাজের সদর মহলে মিসমার হয়ে গিয়েছে মেহনতের মর্বাদা। অবশ্য, মধ্যযুগের শৃঙ্খল ভেঙে যখন আধুনিক যুগের শুরু, জনগণ তখন এগিয়ে এসেছে সমাজের সদর মহলে, শোনা গিয়েছে মুক্তির বাণী; সমগ্র মানবতার মুক্তি।

সামাজিক মেহনতের প্রেরণায় দীপ্ত হয়ে উঠেছে বিজ্ঞান, ধর্মমোহের সঙ্গে দুর্বার তার সংগ্রাম। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যেই একটা প্রকাণ্ড ফাকি লুকোনো ছিল। সমগ্র মানবতার স্বার্থ নিয়ে অত কথার পিছনে প্রচ্ছন্ন ছিল শুধু একটি বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থ। সে-শ্রেণীর নাম দেওয়া হয় বুর্জোয়া শ্রেণী।

আর সেই প্রয়োগ-বিছুরিত যে বস্তুবাদ, সে-বস্তুবাদও সুপ্ত, অব্যক্ত, অচেতন। যেন বস্তুবাদের স্বপ্ন, তবুও বস্তুবাদেরই স্বপ্ন-ভাববাদ নয়, অধ্যাত্মবাদ নয়, অলীক ইচ্ছাপূরণের যতখানি মিশেলাই থাকুক না কেন! সোভিয়েট দেশে সেই হারিয়ে-যাওয়া সাম্যজীবনকে নতুন করে খুঁজে পাবার আয়োজন; কিন্তু অভাবের ভিত্তিতে নয়, দারিদ্র্যের ভিত্তিতে নয়, ভোঁতা।

এই শ্রেণীর স্বার্থ যতই প্রকট হয়ে পড়তে লাগল, ততই দেখা গেল, সমাজের সদরমহলে জনগণের ঠাই আর হচ্ছে না। বিজ্ঞানের পিছন থেকে বাদ পড়তে লাগল সামাজিক মেহনন্তের প্রেরণা ৷ অথচ, প্রয়োগকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞানের পক্ষে বাঁচাই সম্ভব নয়, বিজ্ঞান একান্তভাবেই প্রয়োগনির্ভর।

সামাজিক মেহনত থেকে বিচ্যুত হয়ে তাই বিজ্ঞান ক্রমশই নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগল। গবেষণাগারের সংকীর্ণ গণ্ডিটুকুর মধ্যে যে খণ্ড বিচ্ছিন্ন প্রয়োগ, তারই উপর নির্ভর করবার আশায়। এই প্রয়োগটুকুরও নির্ভর যদি না জুটত, তাহলে বিজ্ঞানের পক্ষে বিজ্ঞান হয়ে থাকা আর সম্ভবই হতো না।

তবু এপ্রয়োগ নেহাতই খণ্ড প্রয়োগ; সাধারণ কর্মজীবনের সঙ্গে, সামাজিক মেহনতের সঙ্গে তার মুখ-দেখাদেখি কম। কোনো এক অসামান্য বৈজ্ঞানিক হয়তো গবেষণাগারের মধ্যে আবিষ্কার করলেন পরমাণুর ভিতর লুকানোশপ্রায় অবিশ্বাস্ত দৈত্যশক্তিকে।

কিন্তু সামাজিকভাবে এই দৈত্যশক্তিকে নিয়ে কী করা হবে, তা তার জানা নেই; এই দৈত্যশক্তিকে নিয়োগ করে পাহাড় গুড়ো করে মরুভূমির বুকে নদীর স্রোত টেনে আনা যায়, যায় মরা ধুলোর রাজ্যে সুজলাসুফলা-শস্যশ্যামলা পৃথিবী গড়া। সোভিয়েট দেশে যেমনটা আজ আয়োজন।

আবার এই দৈত্যশক্তিকে নিয়োগ করে এক মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ স্ত্রী-পুরুষ আর শিশুকে নির্বিচারে নিঃশেষ করা যায়। মার্কিন মুলুকে যেমনটা আজ আয়োজন। কোন পথে নিযুক্ত হবে ওই দৈত্যশক্তি? নিছক গবেষণাগারের সংকীর্ণ গণ্ডিটুকুর মধ্যে বসে এ-প্রশ্নের কোনো জবাব বৈজ্ঞানিক খুঁজে পান। না।

সামাজিক মেহনত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে বিজ্ঞান। বৈজ্ঞানিকের সামনে তাই অনিশ্চয়তার বিরাট খাদ্য। এই খাদ পূরণ করবার আশায় বৈজ্ঞানিককে হরেক রকম অলীক কল্পনার দ্বারস্থ হতে হয়, বস্তুবাদের সঙ্গে মিশেল হয় অধ্যাত্মবাদের। সুস্থ প্রয়োপের যতটুকু ভিত্তি ততটুকুই সুস্থ বস্তুবাদ, কাজের মানুষ অনিবার্যভাবেই বাস্তব পৃথিবীর মুখোমুখি।

মধ্য যুগের অন্ধকার বিদীর্ণ করে যখন আধুনিক যুগের দিকে এগিয়ে আসা, তখন সামাজিক মেহনতের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল বলেই বিজ্ঞান রূপ নিতে পেরেছিল দুর্বিজয় বস্তুবাদের। তারপর বিজ্ঞান সামাজিক মেহনত থেকে যতই বিচ্ছিন্ন হয়েছে ততই তার সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদী ভিত্তিতে ফাটল দেখা গিয়েছে, দেখা গিয়েছে রকমারি অধ্যাত্মবাদ দিয়ে ফাটলগুলো পূর্ণ করবার চেষ্টা।

আবার, কর্মজীবনের সুস্থ তাগিদ ছিল বলেই আদিম ইন্দ্রজালের ভিত্তিতেও বাস্তবাদের স্বাক্ষর পাওয়া যায়। প্রকৃতির নিয়মকানুনকে চেনবার চেষ্টা। অবশ্যই ভুল করে চেনা। কেননা, তখনকার কর্মজীবন হলো দীন-দরিদ্র হাতিয়ারের কর্মজীবন। প্রয়োগ, কিন্তু নেহাতই নীচু স্তরের প্রয়োগ।

আর সেই প্রয়োগ-বিছুরিত যে বস্তুবাদ, সে-বস্তুবাদও সুপ্ত, অব্যক্ত, অচেতন। যেন বস্তুবাদের স্বপ্ন, তবুও বস্তুবাদেরই স্বপ্ন-ভাববাদ নয়, অধ্যাত্মবাদ নয়, অলীক ইচ্ছাপূরণের যতখানি মিশেলাই থাকুক না কেন! সোভিয়েট দেশে সেই হারিয়ে-যাওয়া সাম্যজীবনকে নতুন করে খুঁজে পাবার আয়োজন; কিন্তু অভাবের ভিত্তিতে নয়, দারিদ্র্যের ভিত্তিতে নয়, ভোঁতা।

আর স্থূল হাতিয়ারের ভিত্তিতে নয়। তাই সামাজিক মেহনতকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করতে পারা, কিন্তু এবার অনেক উচু স্তরে। তুলনাই হয় না, এমন উচু স্তর। আর তাই বলিষ্ঠ, সচেতন বস্তুবাদ। এই বস্তুবাদের আভাস পাওয়া গিয়েছিল আধুনিক যুগের শুরুতে। কিন্তু ওই আভাস হিসেবেই শেষ হলো তার ইতিহাস।

কর্মজীবনের সঙ্গে এদের যোগাযোগটুকু স্পষ্ট, আর তাই বস্তুবাদের বেশ। এম্পিডোক্লিস স্পষ্টই স্বীকার করেন যে, তার দার্শনিক ধারণাগুলিকে তিনি সংগ্রহ করেছেন রঙমেশানো বা রুটি তৈরি করার কাজ চোখে দেখতে দেখতে। তা ছাড়াও গ্রীক যুগের অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সঙ্গে তার নাম সংযুক্ত হয়ে রয়েছে, যে-রকম থ্যালিসের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আছে এঞ্জিনিয়ারিং বুৎপত্তির কথা।

সামাজিক মেহনতের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের পিছনে প্রকাণ্ড ফাকি ছিলো, তাই। তাই দর্শনের আঙিনায় আসন পাবার জন্য সে-বস্তুবাদ যখন বড় বেশি দুবিনীত হই-হল্লা করেছিল, তখন শ্রেণীসমাজের সদর মহলের সংস্কৃতি নেহাতই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার জন্যে, খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।

কিন্তু সামাজিক মেহনতের সঙ্গে সম্পর্ক যত ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগল ততই তাকে সংস্কৃত করবার নামে সর্বস্বাস্ত করে। নেবার আয়োজন, আর না-হয় তো সাক্ষাৎ-সমরে তাকে পরাভূত করে তারই শবদেহের উপর অধ্যাত্মবাদের প্রেত-সাধনা। ভারতীয় সংস্কৃতিতে বস্তুবাদের কথা নিয়ে পরে স্বতন্ত্র আলোচনা তুলব।

আপাতত ঘুরোপীয় সংস্কৃতির দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখা যাক। আদিম ইন্দ্রজালের মধ্যে বস্তুবাদ দেখা দিয়েছিল, যদিও তা স্বপ্নের মতো অক্ষুট। ভিত্তিতে হাতিয়ারের দৈন্য, তাই অক্ষুট, তাই স্বপ্নের মতো। আধুনিক যুগের শুরুতে দেখা দিয়েছিল সুস্থ আর সচেতন বস্তুবাদের আভাস, কিন্তু সমাজ-ব্যবস্থার মূলে যে-ফাকি লুকোনো ছিল তারই চাপে এই বস্তুবাদের ইতিহাস উপক্ৰমণিকাতেই পরিসমাপ্ত হলো।

সোভিয়েট সমাজে সামাজিক মেহনতের বলিষ্ঠ ভিত্তি, তাই বিজ্ঞানের ঐশ্বর্ষে দীপ্ত বস্তুবাদ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দুর্জয় হয়ে উঠেছে। বাকি থাকে গ্রীক যুগের কথা। দর্শনের ইতিহাসের সঙ্গে সমাজ-ইতিহাসকে মিলিয়ে দেখলেই দেখতে পাওয়া যায়, গ্রীক যুগে যখনই বস্তুবাদ দুর্জয় হয়ে উঠেছে তখনই তার সঙ্গে কর্মজীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক-

প্রাচীন আয়োনীয়া শহরে তখন বণিক শ্রেণীর শাসন, পৃথিবীর সঙ্গে সংগ্রামের হাতিয়ারকে উন্নত করার উপরই তাদের সম্পদের নির্ভর, তাই এই উন্নতি-কল্পে তাদের অমন উৎসাহ, আর তাই এই শহরের আবহাওয়ায় জন্ম হলো যে-দর্শনের, সে-দর্শন বস্তুবাদী দর্শন।। থ্যালিস, এ্যানেক্সিমেণ্ডার, এ্যানেক্সিমেনিস।

এদের বস্তুবাদ অবশ্যই স্থূল ধরনের বস্তুবাদ। না-হয়ে উপায়ও ছিল না। মানব-ইতিহাসে তখন সবেমাত্র বিজ্ঞানের সুচনা। তাছাড়া ও-শহরে তখন কর্মজীবনের যে-আবহাওয়া, সে-আবহাওয়ার মধ্যে চোদ্দ আনাই ফাকি, কেননা তার ভিত্তিতে শ্রেণী-স্বার্থ আর শোষণই।

আর তাই-সমাজের ভিত্তিতে শ্রেণীর স্বার্থের এই উর্বর জমি ছিল বলেই,- আয়োনীয় বস্তুবাদকে অমন সহজে ফেলে গ্রীক যুগে পাইথাগোরাস আর পারমানাইডিসের দল পারল ভাববাদী আর অধ্যাত্মবাদী দর্শনের বীজ বুনতে, সে বীজ ফলফুলে শোভিত হয়ে দেখা দিল প্লেটোর দর্শনে।

প্লেটো যে কী পরিমাণে এদের কাছে ঋণী, তা নিয়ে গ্রীক দর্শনের ঐতিহাসিকেরা অনেক আলোচনা করেছেন। মাঝখানে বস্তুবাদ মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছিল এম্পিডোক্লিস্ আর বিশেষ করে ডিমোক্রিটাস-লিউসিপাসের দর্শনে। মনে রাখতে হবে, পাইথাগোরাস, পারমানাইডিস বা প্লেটোর মতো এই বস্তুবাদীরা কেউই কর্মজীবন-বিচ্যুতি রহস্যবাদের বা বিশুদ্ধ চেতনার উপাসক নন।

কর্মজীবনের সঙ্গে এদের যোগাযোগটুকু স্পষ্ট, আর তাই বস্তুবাদের বেশ। এম্পিডোক্লিস স্পষ্টই স্বীকার করেন যে, তার দার্শনিক ধারণাগুলিকে তিনি সংগ্রহ করেছেন রঙমেশানো বা রুটি তৈরি করার কাজ চোখে দেখতে দেখতে। তা ছাড়াও গ্রীক যুগের অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সঙ্গে তার নাম সংযুক্ত হয়ে রয়েছে, যে-রকম থ্যালিসের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আছে এঞ্জিনিয়ারিং বুৎপত্তির কথা।

অবশ্যই ধর্মের ইতিহাস আছে। বহুর উপাসনা থেকে এক পরমব্রহ্মের ধ্যান পর্যন্ত। তবু, এই ইতিহাসের মধ্যে তৈলধারার মতো অবিচ্ছিন্ন যে কথা, সে কথা হলো চেতনাকে বদল করে বিপর্বায়-বোধের হাত থেকে নিষ্কৃতি খোঁজবার কথা। প্রকৃতিকে বদলে বিপর্বায়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি খোঁজবার ঠিক উলটো। প্রয়োগের ঠিক উলটো। বিজ্ঞানের ঠিক উলটো।

আর ডিমোক্রিটাস-লিউসিপাস-এর প্রধানতই ছিলেন। বৈজ্ঞানিক, বৈজ্ঞানিক বলেই প্রয়োগপরায়ণ আর তাই বস্তুবাদী। কেবল মনে রাখতে হবে, গ্রীক যুগের এইসব বস্তুবাদ মানব-সংস্কৃতির যত মূল্যবান ঐতিহাই হোক না কেন, এগুলি সবই দ্বিধাভিরা বস্তুবাদের নমুনা। কেননা এর মূলে যে প্রয়োগ, যে কর্মজীবনের প্রেরণা, তার শক্তি নেহাতই ক্ষীণ।

সামাজিক মেহনতের পূর্ণ প্রেরণা এইসব বস্তুবাদের মূলে জোটেনি। জোটবার কথাও নয়। গ্রীক সমাজ ক্রীতদাসের মেহনতের উপর নির্ভর করেছিল, সমাজের সদর মহলে মেহনতের পূর্ণ মর্যাদা জুটবে কেমন করে? তবুও, এই সামাজিক কাঠামোর মধ্যেও, মেহনতের সঙ্গে, কর্মজীবনের সঙ্গে যখনই সংস্কৃতির যোগাযোগ, তখনই মাথা তুলে দাড়াতে চেয়েছে বস্তুবাদ। এই কথাটাই বিশেষ করে লক্ষ করবার মতো কথা।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি মানুষ। বিপর্যয়-মুক্তির দুটো পথ তার সামনে। একটা পথ হলো বিপর্যয়কে জয় করবার পথ, প্রয়োগের পথ। এই পথে এগুতে গেলে তার চেতনা বস্তুবাদী না হয়ে পারে না। যদিও এ পর্যন্ত-অর্থাৎ সোভিয়েট দেশে সচেতন ঐশ্বর্যের ভিত্তিতে মানুষের মেহনতাকে প্রতিষ্ঠা করবার যে-আয়োজন তার আগে পর্যন্ত-প্রকৃতিকে জয় করবার যে-পথ, সেপথে নানান দ্বিধা, নানান দ্বন্দ্ব। তাই সোভিয়েট দেশে বস্তুবাদের প্রতিষ্ঠাই প্রথম সর্বাঙ্গীণ আর বলিষ্ঠ প্রতিষ্ঠা।

আর একটা পথ হলো এই বিপর্বায়-বোধকেই জয় করবার পথ। এই দ্বিতীয় পথটারই নাম ধর্ম, যার সংস্কৃত সংস্করণ অধিবিদ্যা আর ভাববাদ। বিপর্যয়বোধকে জয় করা। তার মানে, মানুষের যে-চেতনায় এই বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি, সেই চেতনার উপরেই এমন প্রলেপ দেওয়া, এমনভাবে সেই চেতনাকে বদল করে নেওয়া, যাতে বিপর্যয় থাকলেও বিপর্যয়-সংক্রান্ত হুশিটুকু না থাকে।

এই পথই হলো ধর্মের পথ। কেননা, ধর্ম চেয়েছে মানুষের ভাব-আবেগকে এমনভাবে বদল করতে, যাতে প্রকৃতি আর বিরুদ্ধ-শক্তি হিসেবে প্রতীত না হয়। মানুষের প্রথম ধর্ম-চেতনায় তাই দেখতে পাওয়া যায় প্রাকৃতিক শক্তির অধিষ্ঠাতাঅধিষ্ঠাত্রী দেবদেবীর কল্পনা : ইন্দ্র, বরুণ, মাতিরিশ্বন, অগ্নি, আদিত্য, সোম, এই রকম সব দেশেই।

এই সব প্রাচীন দেবদেবীর মধ্যে কিন্তু মানুষের প্রতিবিম্ব; তোয়াজ করলে এরা তুষ্ট হয়, তোয়াজ না করলেই সর্বনাশ। তবু সর্বনাশ-সম্ভাবনার বোধ থেকে অন্তত একরকমের মুক্তি তো জুটল; নৈবেদ্য সাজিয়ে উপাসনা করতে পারলে আর সর্বনাশের ভয় নেই। অবশ্যই এ-পথ সত্যিকারের বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাবার বাস্তব পথ হতে পারে না। সে পথ একমাত্র বিজ্ঞানের পথ।

ধর্মের পথ হলো নিজের মনকে বদল করবার পথ, নিজের চেতনাকে বদল করবার পথ, যাতে সর্বনাশ-বোধ থেকে আত্মরক্ষণ করা যায়। সমাজে শ্রেণী-বিভাগ দেখা দেবার আগে পর্যন্ত এইভাবে চেতনাকে, শুধু চেতনাকে বদল করবার সম্ভাবনা মানুষের সামনে দেখা দেয়নি। দেখা দিল শ্রেণীবিভাগ ফুটে ওঠবার পর থেকে, কেননা তখন থেকেই সমাজের সদর মহলে চেতনা, অন্দরমহলে মেহনত ৷ যে-হাত দিয়ে মেহনত সেই হাত পড়ল চোখের আড়ালে।

অবশ্যই ধর্মের ইতিহাস আছে। বহুর উপাসনা থেকে এক পরমব্রহ্মের ধ্যান পর্যন্ত। তবু, এই ইতিহাসের মধ্যে তৈলধারার মতো অবিচ্ছিন্ন যে কথা, সে কথা হলো চেতনাকে বদল করে বিপর্বায়-বোধের হাত থেকে নিষ্কৃতি খোঁজবার কথা। প্রকৃতিকে বদলে বিপর্বায়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি খোঁজবার ঠিক উলটো। প্রয়োগের ঠিক উলটো। বিজ্ঞানের ঠিক উলটো।

প্রাচীন গ্রীসে যখন কিনা দর্শনের প্রথম জন্ম, তখন তার সঙ্গে প্রয়োগজীবনের কতখানি সম্পর্ক। তাই সে দর্শন কী-রকম অভ্রান্তভাবেই বস্তুবাদী, আর ওই বস্তুবাদের একটা চেষ্টাই হলো ধর্মবিশ্বাসকে, পৌরাণিক বিশ্বাসকে ঠেলে সরিয়ে বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ওই প্রয়োগজীবনের সঙ্গে দার্শনিক চেতনার সম্পর্ক যখনই যত ক্ষীণ হয়েছে, ততই সে চেতনা সরে গিয়েছে বস্তুবাদের দিক থেকে ভাববাদের দিকে। এই হলো একটা দেশের কথা।

ধর্মের মার্জিত আর সংস্কৃত সংস্করণ হলো অধিবিদ্যা, যার মূল কথা চেতনকারণবাদ, ভাববাদ। তাই ধর্মের সঙ্গে অধিবিদ্যার মেশা মিশি। আমাদের দেশে এক চার্বাক-দর্শন আর প্রাচীন সাংখ্য দর্শনের কথা বাদ দিলে এ-কথা একেবারে প্রকট ও স্পষ্ট। তাও সাংখ্য দর্শনের নিরীশ্বর প্রধান কারণবাদকে শুধরে নিয়ে তার মধ্যে ঈশ্বরের জন্যে, ধর্মের জন্যে জায়গা করে নেওয়া এবং পাছে বস্তুবাদের মোহো পড়ে চরিত্র বিগড়ে যায়।

এই ভয়ে যোগদর্শনের সঙ্গে তাকে একসূত্রে বেঁধে দেওয়া; যে-কারণে শেষ পর্যন্ত সাংখ্য আর শুধু সাংখ্য -রইল না, দেখা দিল সাংখ্য নামের এক দর্শন, যার মধ্যে ধর্মে-অধিবিদ্যায় সুনিশ্চিত মেশামিশি। চার্বাকদের কথা পরে আলাদা করে আলোচনা করব। আপাতত বাকি দার্শনিক মতবাদগুলির দিকে দেখা যাক।

এমন কী বৌদ্ধ আর জৈন দর্শন-যেগুলির নাম হলো নাস্তিক দর্শন-সেগুলির মধ্যেও চোদে আনা প্রেরণা নিছক ধর্মের প্রেরণাই। বৌদ্ধ ধর্ম আর জৈন ধর্ম। ধর্মবিরোধী বলে এগুলির নাম নাস্তিক নয়, বেদ মানে না বলে নামটা নাস্তিক। বাকি থাকে আস্তিক দর্শনগুলির কথা। অপৌরুষেয় বৈদিক বিশ্বাসের মুকুট পরে সেগুলি স্পষ্টতমভাবেই ধর্মের সঙ্গে নিজেদের সৌহার্দ ঘোষণা করছে।

ন্যায়-বৈশেষিকও মাথা খুঁড়েছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করবার আশায়, রামানুজ আর শঙ্কর তর্ক তুলছেন যো-জানের দরুন মুক্তি বা ব্ৰহ্মলাভ সেই জ্ঞান উপাসনাজন্য না বাক্য-জন্য। এইভাবে ধর্ম আর অধিবিদ্যার মেশামিশি সমস্ত ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

কিন্তু শুধু ভারতীয় দর্শনের কথাই নয়। য়ুরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে নেহাত প্রয়োগপ্রণোদিত বস্তুবাদের গণ্ডিটুকুর বাইরে সর্বত্র এই কথা। পাইথাগোরাস, পারমানাইডিস, প্লেটো থেকে শুরু করে ব্রাডলির ব্রহ্মবিদ্যা পর্যন্ত। কেবল, খুব হালে ব্যাপারটার কিছুটা ভোল বদলেছে।

সোজাসুজি ভগবানের কথায় সহজে আর মানুষের মন ভোলানো যায় না দেখে ধর্মবিশ্বাসের কথাটা খিড়কি দোর দিয়ে নিয়ে আসবার চেষ্টা : সামনে বহুরূপী, বিজ্ঞানর্ম্মান্য প্রবঞ্চনার তোরণ। তাই ধর্মের সঙ্গে অধিবিদ্যার বিরোধ নয়, বরং ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়তাই। বিরোধ বস্তুবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের। দর্শনের ইতিহাসে কয়েকটি প্রাচীন পরিচ্ছেদের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

প্রাচীন গ্রীসে যখন কিনা দর্শনের প্রথম জন্ম, তখন তার সঙ্গে প্রয়োগজীবনের কতখানি সম্পর্ক। তাই সে দর্শন কী-রকম অভ্রান্তভাবেই বস্তুবাদী, আর ওই বস্তুবাদের একটা চেষ্টাই হলো ধর্মবিশ্বাসকে, পৌরাণিক বিশ্বাসকে ঠেলে সরিয়ে বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ওই প্রয়োগজীবনের সঙ্গে দার্শনিক চেতনার সম্পর্ক যখনই যত ক্ষীণ হয়েছে, ততই সে চেতনা সরে গিয়েছে বস্তুবাদের দিক থেকে ভাববাদের দিকে। এই হলো একটা দেশের কথা।

আরো একটা দেশের কথা তুলব। আমাদের দেশের কথা। আমাদের দেশের প্রাচীন বস্তুবাদী দর্শনটার কথা, যার নাম হলো কিনা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন।

প্রথমে গ্রীক দর্শনের আদি যুগটার কথা; বস্তুবাদ ছেড়ে ভাববাদের দিকে ঝোকার ইতিহাসটা।

…………………….
ভাববাদ খণ্ডন – মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই : এক
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই : দুই
বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না : প্রথম পর্ব
বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না : দ্বিতীয় পর্ব
ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি : পর্ব এক
ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি : পর্ব দুই
ধর্ম আর ভাববাদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!