-জহির আহমেদ
দুবাচাইল গ্রামের নিশিকান্ত মণ্ডলের ছেলে সুকুমার। পনের-ষোল বছরের কিশোর। বাবা খেয়া নৌকার মাঝি। নিশিকান্ত গরীব হলেও সৌখিন প্রকৃতির। অনেক বছর আগে থেকেই শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছে। তাই কাজকর্ম তেমন করতে পারে না। স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েসহ তার বড় সংসার।
খেয়ানৌকা চালিয়ে সংসারের ভরণপোষণ করা তার একার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুকুমারের লেখাপড়া চালাতে পারেন নি। একদিন ছেলেকে কাঠমিস্ত্রীর কাজে লাগিয়ে দিলেন। সুকুমার মিস্ত্রীর কাজ করে যা উপার্জন করে- তা সংসারে যোগান দেয়।
সাধারণত ঘর বাঁধার কাজ করে সে। কাজ পেলে দূরের কোন গ্রামেও চলে যায়। একটি ঘর বাঁধতে এক-দেড় মাস লেগে যায়। দূরের গ্রামে হলে প্রতিদিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি আসা সম্ভব হয় না। রাতে মালিকের বাড়িতেই থেকে যেতে হয়। কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলে হয়ত দু’তিন দিনের জন্য বাড়িতে এসে থেকে যায়।
সুকুমার মিশুক ও একটু খামখেয়ালী স্বভাবের ছেলে। যেখানে যায় সেখানেই হিন্দু-মুসলমান সবার সাথেই তার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।
দুবাচাইল ধর্মীয় সম্প্রীতিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার গ্রাম। সুকুমারদের বাড়ির এক জামাইয়ের নাম সুনীল। সুনীল তখন দেশের জনপ্রিয় একজন কীর্তনীয়া ও রামায়ণ শিল্পী। সে দুবাচাইল বেড়াতে আসলে শ্বশুর বাড়িতে রামায়ণ পালার আয়োজন করা হয়।
হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের অনেকে সারারাত ব্যাপী সুনীল ও তার দলের রামায়ণ-অভিনয় দেখে। তারা কখনো বীরত্বে উজ্জীবিত হয়, আবার কখনো করুণায় অঝোর নয়নে কাঁদে। অসাম্প্রদায়িক কথাবার্তা দিয়েই সুনীল তার রামায়ণ গানের সূচনা করে। ভূমিকায় তিনি বিশেষ করে মুসলমান দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন-
‘সব ধর্মের মূল বিষয়ে আসলে কোন পার্থক্য নেই। আপনারা বলেন পয়গম্বর- আমরা বলি অবতার, আপনাদের মা ফাতিমা- আমাদের মা লক্ষ্মী, আপনাদের আবে জমজম, হাউজে কাউসার- আমাদের গঙ্গাজল, আপনারা বলেন পুনরুত্থান- আমরা বলি পুনর্জন্ম। আপনাদের বেহেশত-দোজখ, আমাদের স্বর্গ-নরক। নামেই ভিন্ন, বস্তুত আসলে এক।’
সুনীলের এমন সব সুন্দর-সুন্দর অসাম্পদায়িক বাণী দুবাচাইলের হিন্দু-মুসলমানের সাথে সুকুমারও মুগ্ধ হয়ে শুনে। এভাবে সে ছোটবেলা থেকেই সুনীলের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত। শাতমোড়া গ্রামের মহর্ষি মনোমোহন দত্তের সর্বধর্ম আশ্রমেও সে যায়। এছাড়া ফকির দরবেশদের আস্তানায় গিয়েও সে আধ্যাত্মিক কথাবার্তা শোনে।
সম্ভবত নববই দশকের প্রথম দিকের ঘটনা। সুকুমার বাংগড়া গ্রামে একটি ঘর বাঁধার কাজ পেয়েছে। বাংগরা দুবাচাল থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার পূর্ব দিকে। সেখানে গিয়েও তার সমবয়সী কিছু মুসলমান বন্ধু জুটে গেল।
সুকুমারের মিশুক ও অসাম্প্রদায়িক স্বভাবের সুযোগ কাজে লাগায় বাংগড়া এলাকার কিছু গোঁড়া মুসলিম। তারা তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আরো কাছে টেনে নেয়। নিজেদের সওয়াবের পাল্লা আরো ভারি করার আশায় তারা উঠে পড়ে লাগে তার পিছনে।
দূরের গ্রাম থেকে আসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি কিশোর কোনভাবেই তাদেরকে এড়িয়ে চলতে পারে না। তাদের আচরণকে সে আন্তরিকতা ভেবেই গ্রহণ করে। একদিন বাজারের মসজিদের পাশ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ওদের একজন বলে, সুকুমার, চল মসজিদে যাই।
-অসুবিধা কী? চল যাই, আল্লাহর পবিত্র জায়গা।
-তুমি মুসলমান হইয়া যাও ভাই।
-মুসলমান মানে কী ভাই?
-মুসলমান মানে হলো আত্মসমর্পণকারী।
-তাইলে সমস্যা নাই। আমিতো আমার মালিকের কাছে আত্মসমর্পণ করতেই চাই। কিন্তু তারে তো পাই না!
কথা শুনে তার মুসলমান বন্ধুদের জোশ আরো বেড়ে যায়। তারা মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে পরামর্শ করে তাকে মুসলমান বানানোর পরিকল্পনা করে। অশেষ নেকির আশায় তারা এ দিন সুকুমারকে মসজিদে নিয়ে যায়।
একজন বিধর্মীকে দ্বীনের পথে আনা অনেক সওয়াবের কাজ। এই পূণ্যদৃশ্য দেখার আশায় সেদিন আগে থেকেই কিছু লোক মসজিদে উপস্থিত ছিল। এসব পূর্ব পরিকল্পনার কথা সে আগে থেকে কিছুই জানত না।
নামাজ শেষ করে মুসল্লীরা মসজিদের ভেতরে বসে আছে। বন্ধুরা সুকুমারকে সাথে নিয়ে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসলো। ইমাম সাহেব কিছুক্ষণ ধরে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন গুণাবলী বিষয়ে বয়ান করলেন। মসজিদে উপবিষ্ট সবাই মনোযোগ দিয়ে ইমাম সাহেবের বয়ান শুনলো।
তারা একজন মুশরিকের মুসলমান হওয়ার দৃশ্য দেখার আশায় খুব এক্সাইটেড। অবশেষে ইমাম সাহেব বললেন, আমি কলেমা পড়তেছি, তুমি আমার সাথে পড়- বলে তিনি পড়তে শুরু করলেন, কলেমা-ই তাইয়েবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুল্লাহ (স)’।
ঘটনা এতদূর গড়াবে, সুকুমার সেটা ভাবতে পারেনি। আর এমন একটা পরিস্থিতির জন্য সে প্রস্তুতও ছিল না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে চুপ করে রইল। সুকুমার চুপ করে থাকায় ইমাম সাহেবের দেমাগে আঘাত লাগল। ক্ষুব্ধ চোখে সে সুকুমারের দিকে তাকাল।
ইমামের ভেতরে যেন তখন ইমানি তেজ। একটু ধমকের সুরেই ‘পড়’ বলে আবার কলেমা পড়তে শুরু করলেন। মুরুব্বিদের মধ্যে কেউ কেউ বললেন, পড়ো, পড়ো। কলমা পইড়া মুসলমান হও। মরলে বেহেশতে যাইতে পারবা। তার বন্ধুরাও ইশারা করে ও খোঁচা মেরে তাকে পড়তে বললো।
মারাত্মক বিব্রতকর এক অবস্থায় পড়ে গেলো সে। কিছুটা ভয় পেয়ে পাখির মতো উচ্চারণে ইমাম সাহেবের সাথে যেটুকু সম্ভব সে পড়লো। মুসল্লিদের সবাই তখন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ে নিল। সেদিনই সুকুমার মণ্ডলের নাম রাখা হলো মোঃ আলাউদ্দিন।
সবশেষে ইমাম সাহেব সবাইকে নিয়ে হাত তুলে দোয়া করে আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে আল্লাহ! আলাউদ্দিন নামের এই নওমুসলিমকে তুমি কবুল করে নাও।
ঘটনা শেষ হওয়ার কয়েকদিন পরেই সুকুমারের ঘর বাঁধার কাজ শেষ হয়ে গেল। কাজের ফাঁকে একবার বাড়ি গিয়ে সে দু’দিন থেকে এসেছিল। ঘরে সে অভাব দেখে এসেছে। চাল-ডাল তেমন কিছুই ছিল না। ছোট ভাই-বোনেরা প্রায় সময়ই উপোষ করে। রাতে নিশিকান্ত চাল নিয়ে আসলে তারপর রান্না হয়।
কাজে ফিরার সময়ও মা-বাবা-ভাই-বোনদের অভাবী ও শুকনো মুখগুলো দেখে এসেছে সে। আজ তাদের কথা স্মরণ করে সুকুমারের চোখ ছলছল করে উঠলো। বাড়ি যেতে তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। টাকা পেলে সে আজই চলে যেত। মালিক আজ রাতে টাকা দিলে ভোর রাতেই সে রওয়ানা দিবে।
বিশ্বকর্মা কাঠমিস্ত্রীর কর্মের বিনিময়ে সুকুমার ও তার পরিবারের খাদ্য-বস্ত্রের যোগান দিচ্ছেন। ঘরের সবাই সুকুমারের অপেক্ষায় দিন গুনছে। টাকা নিয়ে বাড়িতে গেলে অনাহারী-অর্ধাহারী মানুষগুলোর মুখে কিছুদিন দু’বেলা খাবার জুটবে।
সে বুঝতে পারলো, কর্মহীন ধর্ম দিয়ে সে কিছুই পাবে না। না ভালোবাসা, না মায়া-মমতা, না টাকা-পয়সা, ভাত-কাপড়, না পরমেশ্বরের করুণা- কিছুই না। রাতেই টাকা হাতে পেয়ে খুব ভোরেই সে রওয়ানা দিল। পুরো পথ পায়ে হেঁটে সকালের মধ্যেই সে পৌঁছে গেলো তার প্রিয় জন্মভূমি দুবাচাইলে।
যেখানে হিন্দু-মুসলমান ভাইভাই হয়ে বাস করে। চিতাশালের কাছে গিয়ে বট গাছটিতে পাখির কিচির-মিচির শুনে তার মন খুশিতে ভরে গেল। তার মনের উপর থেকে একটা চাপ সরে গেলো। বাড়ি পৌঁছে মার কাছে গিয়ে বসলো, মাকে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদে ফেললো।
দুপুরের রোদে তিতাসের ঠাণ্ডা পানিতে সে অনেকগুলো ডুব দিয়ে তার মনটা প্রশান্ত হলো। সে ভাবল, জন্মভূমির মতো এত শান্তি আর কোথায় আছে! মা যখন কাপড়ের আঁচল দিয়ে তার মাথা ও মলিন মুখটি মুছে দিলো, সুকুমারের এতদিনের সব ক্লান্তি নিমেষেই উধাও হয়ে গেল! তার মনে পড়লো ছোটবেলায় উষারঞ্জন স্যারের কাছে পড়া সেই লাইনটি- ‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরিয়ষী।’
দুই
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এছাড়া গ্রামের একটি যুব সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মাকে দেখতে ও সংগঠনের প্রয়োজনেও বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলেই গ্রামে চলে আসি। সংস্কারমুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক মন নিয়েই বেড়ে উঠছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও তরুণ বয়স। এছাড়া বড় বংশ ও যুব সংঘের সভাপতি, সাহস একটু বেশিই ছিল। সেবার এক ছুটিতে বাড়ি এসে শুনলাম চমকপ্রদ সে কথা। ঝড়ের মতো গ্রামের বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছিল কথাটি।
আমাদের গ্রামের একটি হিন্দু ছেলে মুসলমান হয়ে গেছে। নাম তার সুকুমার। কিন্তু সে এখনো তার হিন্দু পরিবারেই চলা-ফেরা করছে। নাম শুনে তাকে চিনতে পারলাম না। আজ রাতে বীরপাড়ার মসজিদের সামনের মাঠে সুকুমারের বিষয়ে সালিশ-বিচার বসবে।
বাংগড়ার সেই মসজিদের ইমাম সাহেব আরেকজন ইমামকে সাথে নিয়ে দুবাচাইল চলে এসেছে সুকুমারের খোঁজে। বাংগড়া থেকে চলে আসার পর সুকুমারের কোন খোঁজ পাচ্ছে না, তবে তারা কোন ভাবে খবর সংগ্রহ করেছে যে, এখন সে তার মা-বাবার সাথে হিন্দু সমাজেই বাস করছে। শুধুমাত্র দ্বীনের সম্মানে আসল তথ্য জানার জন্য কষ্ট করে তারা এত দূর থেকে ছুটে এসেছে।
দুজন ইমাম দুবাচাইল এসেই আমাদের বীরপাড়ার মসজিদের ইমামের কাছে ঘটনা খুলে বলেন। আমাদের মসজিদের ইমাম বিষয়টি অবগত করলেন মসজিদ কমিটিকে। কমিটির লোকজন দুবাচাইল ও বাজেবিশাড়া গ্রামের সর্দারদের নিয়ে আজ সন্ধ্যার পরে মসজিদের মাঠে পঞ্চায়েতের মিটিং বসেছে।
মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল লতিফ সাহেব সালিশ-বিচার অনুষ্ঠানের সভাপতি। এদিকে ঝানু বিচারক হিসেবে সালিশ পরিচালনা করছেন বাজেবিশাড়ার ফালু মেম্বার সাহেব। বিচার দেখার জন্য সেদিন বহু মানুষ জমায়েত হয়েছিল। তার মধ্যে সুকুমারের আত্মীয়স্বজনসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও ছিল।
সভার শুরুতে প্রথমে বাংগড়ার ইমাম সাহেবের জবানবন্দী শোনা হলো। তিনি সুকুমারের মুসলমান হওয়ার বিষয়টি উপস্থিত সবার সামনে তুলে ধরলেন। ইমাম সাহেবের কথা শেষ হলে, ফালু মেম্বার সুকুমারকে জেরা শুরু করলেন। জেরাগুলো ছিল এমন-
-ইমাম সাহেব যা বলছেন, এই ব্যাপারে তোর কোন কথা আছে?
সুকুমার নিশ্চুপ।
-কথা বলসছ না কেন? ইমাম সাহেব যা বলছেন, তা কি ঠিক?
-ঠিকই আছে।
-সত্যই কি তুই মুসলমান হইছিলি?
এই প্রশ্নেও সুকুমার চুপ করে রইলো।
-তুই এখনো হিন্দু সমাজে চলস কেন?
-আমি বুঝতে পারি নাই।
-কী বুঝতে পারছ নাই?
এই প্রশ্নের উত্তরে সুকুমার আবারো চুপ করে রইলো।
-তুই এখন কী চাস? হিন্দু না মুসলমান, কোন সমাজে থাকবি?
-আমি আমার মা-বাপের সাথে হিন্দু সমাজেই থাকতে চাই।
জেরার সময়ে দর্শকদের মধ্য থেকে মাঝে-মধ্যে কিছুটা শোরগোল ও ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছিল। এবার ক্ষোভের পরিমান বেড়ে গিয়ে হৈ-চৈ শুরু হলো। বিচারকরা ধমক দিয়ে সাধারণ দর্শক-শ্রোতাদের থামালেন।
বিচারের জেরা-জবানবন্দী শেষ। এবার রায়ের পালা। গ্রাম্য সালিশেও সাধারণত রায়ের জন্য জুরিবোর্ড বসে। কিন্তু আজ আসামী কিংবা তার পক্ষের কারো কোন আর্জি নেই। তাই বিচার একতরফা, জুরিরও কোন প্রয়োজনই বোধ করলো না কেউ। বিচারকদের সবাই রায়ের ব্যাপারেও ফালু মেম্বারের উপরই নির্ভর করলো।
ফালু মেম্বার হয়তো ভাবলেন, সুকুমারকে এখন আর জোর করে মুসলমান বানানোর উপায় নেই। তাই তার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে হিন্দু সমাজে থাকতে দেয়াই উচিত হবে। ওদিকে আবার ক্ষুব্ধ দর্শক-শ্রোতাদেরও সন্তুষ্ট করতে হবে।
সুকুমারের বাবা নিশিকান্ত সালিশে উপস্থিত নেই। অসুস্থ হয়ে সে ঘরে শয্যাশায়ী। সালিশে আছে সুকুমারের চাচা হরিপদ মণ্ডল। ফালু মেম্বার হরিপদ মণ্ডলকে বললেন, হরিপদ! যা হইছে সবাই শুনলো। তুমি শুনছোতো সব কথা?
-জ্বি, শুনছি।
-এখন কী করবা, বল।
-আপনেরা যে সিদ্ধান্ত দেন, এর উপর আমার কোন কথা নাই।
ফালু মেম্বার কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবলেন। তার পাশে বসা সর্দারদের সাথে কিছুটা পরামর্শ করলেন। তারপর ডাকলেন, হরিপদ!
-জি বলেন।
-শোন। যা হওয়ার হইয়া গেছে। এখন হাউজরে খুশি কইরা তোমার ভাতিজারে লইয়া যাও।
হরিপদ মণ্ডল আমাদের গ্রামের হিন্দু সমাজের একজন বিশিষ্টি লোক। সারাজীবন ফালু মেম্বারের সাথেই সে চলেছ। ফালু মেম্বারের সাথে অনেক নাটকেও সে অভিনয় করেছে। ‘সাগরভাসা’ নাটকে ফালু মেম্বার রঞ্জিত বাদশার অভিনয় করতো, আর হরিপদ সাজতো তার সেনাপতি।
কিন্তু আজকে বীরপাড়ার মসজিদের সামনে যে নাটক অভিনীত হলো, তা সামাজিক ও বাস্তবভিত্তিক। আজকের নাটকেও সেনাপতি হরিপদ মণ্ডল রাজা ফালু মেম্বারের ভাষা ঠিকই বুঝে নিল। সাথে সাথেই হরিপদ এক পাটি চটিজুতা হাতে নিয়ে ভাতিজাকে বেধড়ক পেটাতে লাগলো।
এখানে কোন প্রকার মমতার সুযোগ নেই। কারণ অপরাধ গুরুতর! ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত! এ বড় মারাত্মক অপরাধ! এমন অপরাধীকে কেমন ভাবে শায়েস্তা করা উচিত, তা ভেবে হরিপদের মাথা গরম হয়ে গেছে। তার উপর হাউজকে খুশি করাও সহজ কাজ নয়! সুকুমার ‘মাগো-মাগো’ বলে চিৎকার করছে, আর হরিপদ পিটিয়েই চলছে। হাউজ নিরব হয়ে উপভোগ করছে সে দৃশ্য।
সেদিন কয়েক শ লোকের সমাগম হয়েছিল। পাশের বাড়িগুলোর ভেতর থেকে মহিলারাও দৃশ্য দেখছিল। যুবকদের অনেকের সাথে আমিও মিটিংয়ের মাঝে ঘাসের উপর বসেছিলাম। আমাদের বয়েসী কারো কোন কথা বলার সুযোগ সাধারণত গ্রাম্য মিটিংয়ে থাকে না। এতক্ষণ কিছু বলারও প্রয়োজন বোধ না করলেও এবার আর মেনে নিতে পারলাম না। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলাম।
আমাকে দেখে হরিপদ তার চলমান কর্ম স্থগিত রেখে দাঁড়িয়ে রইল। সভায় পিনপতন নিরবতা। সকলের দৃষ্টি এবার আমার দিকে। আমি বললাম, সভাপতির অনুমতিক্রমে আমি একটি কথা বলতে চাই। আসলে ধর্ম হলো শান্তির জন্য। ইসলাম ধর্মেই একটি কথা আছে, ‘লা ইকরাহা ফিদ্দিন।’
ধর্মে কোন বারাবারি বা জোর-জবরদস্তি নেই। কিন্তু এখানে যা করা হচ্ছে, তাতে ইসলাম ধর্মকেই ছোট করা হচ্ছে। আমি কথা বলছিলাম, সবাই শুনছিলেন। সভাপতি সম্পর্কে আমার দাদা। তিনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, তুই চুপ কর।
মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি আরেক প্রভাবশালী ব্যক্তি সম্পর্কে আমার চাচা আব্দুল কাদির (মাখন মিয়া) আমাকে শাসানোর কড়া সুরে বললেন, বড় কথা কস, তুই কয়দিন মসজিদে আসছ?
আমি কিছু না বলে দাঁড়িয়েই রইলাম। ভাবলাম, একটি সঠিক সিদ্ধান্ত আসার আগে আমি বসবো না। বিচারকদের মধ্য থেকে যখন সিদ্ধান্ত আসলো, মারামারির দরকার নাই, তখন হরিপদ বসে পড়ল। অবশেষে সালিশের সমাপ্তি হলে সুকুমার তার সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে বাড়ি চলে গেল।
তিন
আমি ঢাকা চলে আসার পর সুকুমারের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তার চেহারাও আমার মনে ছিল না। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে গ্রামে চলে গিয়ে এলাকার একটি কলেজে শিক্ষকতা করছি।
সুকুমারের ঘটনার প্রায় এক যুগ পেড়িয়ে গেছে। একদিন রাজনৈতিক বা সামাজিক কোন প্রয়োজনে কয়েকজন মিলে সুকুমারদের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে আসছিলাম। জানতে ইচ্ছে হলো, সে এখন কেমন আছে? কী করছে? সাথের লোকদের তার কথা জিজ্ঞেস করলাম। হঠাৎ সে আমাদের সামনে এসে হাজির।
দেখে আমি চিনতে পারিনি। একজন আমাকে চিনিয়ে দিলো। হাসিমুখে বললাম, সুকুমার, তুমি কি আমারেচিনতে পারছো?
সুকুমার হেসেই উত্তর দিল, আপনারে চিনবো না স্যার? আপনে আমার জীবন বাঁচাইছিলেন।
শেষ কথা
ইদানীং প্রায়ই অসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী দুবাচাইলের বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক সাধক মোখলেছ শাহর দরবারে সুকুমারকে দেখা যায়। তাঁর দরবারে আল্লা-রাসুল-পীর-মুর্শিদের পাশাপাশি সনাতন ধর্মের অবতার ও সাধুগুরু বৈষ্ণবদের নামেও ভক্তিমূলক গান গাওয়া হয়।
মোখলেছ শাহর দরবারের প্রায় প্রত্যেক ওরশে সুকুমার সারারাত ব্যাপী গভীর দরদ নিয়ে গান শোনে, আর বিরহে কাঁদে। কেঁদে-কেটে একেবারে ফানাফিল্লাহ হয়ে যায়। হয়ত তার পরমেশ্বরই তার আল্লাহ- তার প্রেমাস্পদ। তাঁর বিচ্ছেদ-বেদনাই তাকে এমন আকুল করে কাঁদায়। ভাবের বশে শত শত টাকা সে শিল্পীদের বকশিসও দিয়ে দেয়। সুকুমার আজো তার মা-বাবার সাথেই বাস করেছে। তবে ওরশে তার পরিচয় দেয়া হয় ‘গণি শাহর ভক্ত’ হিসেবে।
তবে কি গণি শাহর প্রেমের ফায়েজ পেয়ে সুকুমার এত দিনে সত্যিকারের ধর্ম বা শান্তির পথ খুঁজে পেয়েছে?