ভবঘুরেকথা

গৌর-চন্দ্রিকা

-দীনেশচন্দ্র সেন

এই পদাবলী পড়িয়া পাছে কেহ ইহাতে সাধারণ নায়ক-নায়িকার ভাব আরোপ করিয়া বৈষ্ণবের স্বর্গকে বাস্তবের মাটীতে পরিণত করেন, এই আশঙ্কায় কীর্ত্তনের আসরে গৌর-চন্দ্রিকার সৃষ্টি। গৌরচন্দ্রিকা দিকদর্শনী স্বরূপ, বিশাল পদ-সমুদ্রে নাবিককে ঠিক্-পথ দেখাইয়া লইয়া যায়- দিক্‌ভ্রান্ত হইতে দেয় না।

একঘণ্টা বাল মুলগায়েন ও দোহারগণ খোল পিটিয়া ও মন্দিরা-করতাল বাজাইয়া- শ্রোতারা আসরে কি প্রত্যাশা করেন- তাহারই একটা মুখবন্ধ প্রস্তুত করেন।

পূর্ব্বরাগের পালা আরম্ব করিবার আগে গৌরবিষয়ক এরূপ কোন গান উচ্চকণ্ঠে গাহিতে থাকেন-
‘‘আজ হাম কি পেশিলু নবদ্বীপচন্দ্র,

‘‘আজ হাম কি পেশিলু নবদ্বীপচন্দ্র,
করতলে করই বদন অবলম্ব।
পুনঃ পুনঃ গতায়ত করু ঘরপন্থ,
ক্ষণে ক্ষণে ফুলবনে চলই একান্ত।
ছল ছল নয়নে কমল সুবিলাস,
নব নব ভাব করত বিকাশ।
পুলক মুকুল বর ভরু সব দেহ,
এ রাধামোহন কছু ন পায়ল খেহ।”

চিত্রকর যেরূপ তুলির রং ঘষিয়া ঘষিয়া রূপরেখায় একটী স্থায়ী বর্ণ তৈয়ারী করেন, সেইরূপ পুনঃ পুনঃ এই গানটি গাহিতে গাহিতে শ্রোতার মনে ভাবমুগ্ধ গৌরাঙ্গের মূর্ত্তি স্থায়ীরূপে পরিকল্পিত হয়। গোরা আজ বড়চঞ্চল চিত্ত, একবার ঘরে একবার বাহিরে যাতায়াত করিতেছেন, তারপরে কি ভাবিয়া পুনরায় ফুলবনের দিকে একান্তে চলিয়া যাইতেছেন।

তাঁহার সজল চক্ষুদুটিতে পদ্মের মত দুষ্টি নূতন নূতন ভাবে খেলিয়া যাইতেছে। ক্ষণে ক্ষণে মনে আনন্দ উছিলিয়া উঠিতেছে এবং সর্ব্বশরীর রোমাঞ্চিত হইতেছে। এই ভাব কি- তাহা পদকর্ত্তা রাধামোহন ঠিক্ করিতে পারিতেছেন না। এই চিত্র নব অনুরাগের ইহার ভাবে শ্রোতাদিগকে মুগ্ধ করিয়া গায়েন মূলপালা অবতারণা করিবেন।

অথ শ্রীরাধার পূর্ব্বরাগ (চণ্ডীদাসের পদ)
-দীনেশচন্দ্র সেন

‘‘ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার, তিল তিল আসে-যায়,
মন উচাটন নিশাস-সঘন কদম্বকাননে চায়।
রাই এমন কেন বা হ’ল। সদাই চঞ্চল বসন-অঞ্চল সম্বরণ নাহি করে।
বসি থাকি থাকি উঠই চমকি ভূষণ খসিয়া পড়ে।’’

সুতরাং দেখা যাইতেছে চণ্ডীদাসের কবিতায় রাধিকার যে অবস্থা বর্ণিত হইয়াছে, গৌর-চন্দ্রিকায় গৌরাঙ্গের সেই ভাবই সূচিত হইয়াছে। গৌরাঙ্গ করতলে বদন স্থাপনপূর্ব্বক মৌনাবলম্বন করিয়াছেন, রাধিকাও চণ্ডীদাসের পদে ‘বসিয়া বিয়লে থাকয়ে একলে না শোনে কাহারো কথা’।

গৌরাঙ্গ ‘পুনঃ পুনঃ যাতায়াত করু ঘরপস্থ’ রাধিকাও ঘরের বাহিরের দণ্ডে শতবার ‘তিল তিল আসে যায়’। গৌরাঙ্গ ক্ষণে ক্ষণে ‘চলই পূলবসন্ত কান্ত’ এবং রাধিকাও ‘মন উচাটন নিশাস-যঘন কদম্বকাননে চায়।’ ইহা একই চিত্রের এপিঠ ওপিঠ।

গৌর-চন্দ্রিকার দ্বারা আসরের আবহাওয়া একেবারে নির্ম্মল হইয়া যায়, তারপর রাধকৃষ্ণ লীলার অধ্যাত্মিক অর্থ ও ভাব পরিগ্রহ করিতে শ্রোতার কোনরূপই অসুবিধা হয় না। এই জন্যেই গৌরচন্দ্রিকা না গাহিয়া গায়েন কখনই রাধাকৃষ্ণ লীলা আরম্ব করেন না- পাছে লোকে লালসার কথা দিয়া এই লীলার ভাষ্য প্রস্তুত করে।

মান, মাখুর, খণ্ডিতা, গোষ্ঠ প্রভৃতি প্রত্যেক পালা গাহিবার পূর্ব্বে গৌর চন্দ্রিকাটি এইরূপ-

‘‘আজি না গৌরাঙ্গচাঁদের কি ভাব হইল,
ধবলী শ্যমলী বলি ডাকিতে ‍লাগিল।
বেণু বিনা বাঁশী করিয়া সিঙ্গাধ্বনি,
হৈ হৈ রবেতে গোরা ঘোরায় পাঁচনি।’’

এইখানে অদ্ভূত ব্যাপার এই, গোরা কেন ধবলী, শ্যামলী, প্রভৃতি নাম ধরিয়া গাভীগুলিকে ডাকিতে যাইবেন? তিনিও ব্রজের রাখাল নহেন। তিনি কেন পাচন বাড়ি ঘুরাইয়তে যাইবেন নন্দের ধেনুপাল চরাইবার জন্য তিনি ত নিযুক্ত নহেন! গায়েন ছোট ছোট গানের মধ্য দিয়া এই প্রশ্নের সমাধান করেন।

কলির জীব বহির্ম্মূখ, তাহারা ইন্দ্রিয়াধীন পশু। তিনি আসিয়াছিলেন হরিনাম দিয়া মানুষের পশুপ্রকৃতি ফিরাইতে। তাঁহার মুখের অবিরল হরি হরি ধ্বনি, বেণুবর, এবং তিনি যে হাতখানি উচ্চদিকে হেলাইয়া মানুষের প্রকৃত গম্যস্থান নির্দ্দেশ করিতেন- তাহাই পাচন-বাড়ির সঙ্কেত।

একটু কষ্ট কল্পনা করিয়া নদীয়ার তরুণ ব্রাহ্মণটিকে ব্রজের রাখালে পরিণত করিতে হয় বটে, তথাপি অবিরত হরি হরি রবে- গায়েনের ভক্তিগদগদ কণ্ঠের ধ্বনিতে করতাল, মন্দিরা ও মৃদঙ্গের শব্দে এবং গৌরহরির নাম পুনঃ পুনঃ কীর্ত্তন দ্বারা আসরের বিশুদ্ধি সাধিত হয় এবং কৃষ্ণের গোচারণ-পর্ব্বের আধ্যাত্মিকতা উপলব্ধি করিবার জন্য শ্রোতৃবর্গের মনে তৎকালোচিত একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

কিন্তু মাথুর সম্ভোগমিলন ও রূপাভিসার প্রভৃতি পালায় চৈতন্য ভাবের সঙ্গে রাধা ভাবের এতটা স্বাভাবিক ঐক্য আছে যে, সেই সেই পালা গৌরচন্দ্রিকার সহিত একবারে মিলাইয়া যায়। গৌর-চন্দ্রিকায় “গৌর কেন এমন হৈল? স্বরূপ দে’খে যা রে- গৌর বুঝি প্রাণে মৈল!” এবং মাথুরের “রাই কেন এমন হৈল?

ও বিশাখা, তোরা দেখে যা, রাই বুঝি প্রাণে মৈল” উভয়ের একবারে পার্থক্যহীন মিলনের ছন্দ রেখায় রেখায় মিল পড়িয়া যায়। সেখানে আর ওস্তাদ গায়নের উভয়কে মিলাইবার জন্য কোন রিপুকর্ম্ম করিতে হয় না।

বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাস>>

……………………
পদাবলী মাধুর্য্য -দীনেশচন্দ্র সেন।

…………………..
বঙ্গদেশের শিক্ষিতা মহিলাগণের মধ্যে যিনি কীর্ত্তন প্রচার করিয়া এদেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদের প্রতি পুনরায় তাঁহাদের আন্তরিক অনুরাগ ও শ্রদ্ধা জাগাইয়া তুলিয়াছেন, জাতীয় জীবনের সেই অগ্রগামিনী পথপ্রদর্শিকা সুর-ভারতী শ্রীমতী অপর্ণা দেবীর কর-কমলে স্নেহের সহিত এই পুস্তকখানি উৎসর্গ করিলাম।

এই পুস্তকের শেষ কয়েকটি ফর্ম্মা যখন ছাপা হয়, তখন আমি কলিকাতায় ছিলাম না। শেষের দিকটার পাণ্ডুলিপি আমি ভাল করিয়া দেখিয়া যাইতে পারি নাই। এজন্য সেই অংশে বহু ভুল-ভ্রান্তি দৃষ্ট হইবে। যদি এই পুস্তকের পুনরায় সংস্করণ করিতে হয়, তখন সেই সকল ভুল থাকিবে না, এই ভরসা দেওয়া ছাড়া এ সম্বন্ধে আর কিছু বলা এখন আমার পক্ষে সম্ভব নহে।
-শ্রীদীনেশ্চন্দ্র সেন

সাঙ্কেতিক শব্দ

চ- চণ্ডীদাস
শে- শেখর
ব- বলরাম দাস
রা- রাম বসু
কৃ- কৃষ্ণকমল গোস্বামী
রায়- রায় শেখর
বৃন্দা- বৃন্দাবন দাস

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………..
আরও পড়ুন-
কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম
বাঁশীর সুর
পদাবলী-মাধুর্য্য : ভূমিকা
এ কথা কহিবে সই এ কথা কহিবে
দর্শন ও আনন্দ
অনুবাদ
গৌরদাস কীর্ত্তনীয়া
হারাই হারাই
সখী-সম্বোধনে
মাথুর
অভিসার
মান
পরিহাস রস
মান-মিলন
গৌর-চন্দ্রিকা
বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাস
বেদের শিক্ষা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!