ভবঘুরেকথা
সাধুসঙ্গ সাধুগুরু পরম্পরা ফকির

-দ্বীনো দাস

কোনো গুরু ভক্তদের নিজ নিজ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর দাঁড়াতে দিচ্ছে না। সবাই বলছে এটা কর, এটা মানো, ওটা মানো, যেহেতু আমি গুরু বলছি! ভক্তের নিজের বিচারবুদ্ধিকে, স্বাধীন অনুধাবনার ক্ষমতাকে কেউ জাগ্রত করছে না, সবাই বলছেন আমাকে মানো। আমার ধ্যান কর, পূজা কর, স্মরণ, মনন কর।

কারো কারো গুরু গৌরব এতো বেশী অতিক্রম করে যাচ্ছে, যা বক্তব্য নয়, তাই তারা বলছে। যা কর্তব্য নয়, তাই তারা করছে। যা ভাবা উচিত নয়, তাই তারা ভাবছে। যা ভাবানো উচিত নয় তাই তারা ভাবাচ্ছে। এই শ্রেণীর গুরুরা মানুষ্যত্বের কলঙ্ক বা অপচায়ক।

আমার মতে, তিনিই সদ বা প্রকৃত গুরু, যিনি সৎ সাহসে বুক ঠুকে বলতে পারবে। আমার মধ্যে যদি অসৎ কিছু দেখো তবে সত্যের জন্য আমাকে অগ্রাহ্য কর বা পরিত্যাগ কর। এমন কি আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কর। কেনো না এ জগতে সত্যই সর্বাপেক্ষা গুরু তার তুলনায় জগতে আর সব কিছুই লঘু।

সদগুরু বলবে, যদি প্রত্যক্ষ সত্য আমার কাছে কিছু পাও তবেই আমাকে মেনো। নইলে ছেড়া কাঁথার মত আমাকে বর্জন করো। উচ্ছিষ্ট খাদ্যের মত আমাকে বর্জন করো। অনুমানে আমাকে মানতে যেও না। মানতে হয় তো প্রত্যক্ষ নির্ভর করে মানো।

আমার কথায়, চিন্তায়, কার্য্যে যদি অসত্য দেখতে পাও তবে ওটা আমার একটা লীলা ভেবে মনকে ফাঁকি দিও না। অসত্যের প্রতিবাদ করতে নির্ভীক চিত্তে দণ্ডায়মান হও, মিথ্যা অমান্য করো।

বর্তমানে অসৎ গুরুরা ভক্তকে বলে- কৈ আমার সালামি? দক্ষিণা, নাজরানা উপঢৌকন কৈ? ভক্ত অমনি কাড়ি কাড়ি ব্যাগ ভর্তি টাকা গরু, ছাগল ও অনান্য বস্তু যার যেমন সামার্থ হলো সে তেমন দিলো। যে ভক্ত অধিক কিছু দেয় সেই গুরুর অতি প্রিয় পাত্র হয় বা বড় ভক্ত হয়ে যায়।

কানে একটা মন্ত্র বা কলেমা দিলেই মুর্শিদ বা গুরু হওয়া যায় না। গুরু হওয়া বড় শক্ত কথা। আজকাল এই যে কত সহজে একজন আর একজনের গুরু হচ্ছে। তার ফল কি হচ্ছে? যত্ন করে কষ্ট করে গুরু পদবি লাভ করতে হলো না বলে গুরু তার মনুষ্যত্বে খাটো হয়ে যায়।

আর মনুষ্যত্বে খাটো হন বলেই বিদ্রোহী। ভক্তকে ক্ষমা করতে পারে না। আশীর্বাদ করে বলতে পারে না- সত্যের জন্য আমাকে বর্জন কর। আমার প্রতি মোহকৃষ্ট হয়ে সত্যকে অবমাননা করো না। গুরুর নিজের জীবনের জ্বলন্ত মনুষ্যত্ব দেখিয়েই বর্তমানের ভক্তের মনুষ্যত্ব প্রয়াসী চিত্তকে আকৃষ্ট করতে হবে।

তাতে গুরুরও লাভ ভক্তেরও লাভ। সদগুরুর কথা- যেদিন দেখবা আমি তোমাদের কল্যাণে বিঘ্ন হচ্ছি। ধর্মলাভের অন্তরায় বা বাঁধা হচ্ছি। স্রষ্ঠাকে পাবার বাঁধা হচ্ছি। সেদিন আমাকে ত্যাগ করবা। আর একটা কথা তিনি বলবেন- সত্যই গুরু, সত্যকে যে ত্যাগ করে, সে-ই গুরু ত্যাগী।

বর্তমানে অসৎ গুরুরা ভক্তকে বলে- কৈ আমার সালামি? দক্ষিণা, নাজরানা উপঢৌকন কৈ? ভক্ত অমনি কাড়ি কাড়ি ব্যাগ ভর্তি টাকা গরু, ছাগল ও অনান্য বস্তু যার যেমন সামার্থ হলো সে তেমন দিলো। যে ভক্ত অধিক কিছু দেয় সেই গুরুর অতি প্রিয় পাত্র হয় বা বড় ভক্ত হয়ে যায়।

সৃষ্টিকর্তার জন্য প্রাণ আকুল হলো না। তার জন্য চিত্ত অধীর হলো না। তারপরও একটা লোক দেখানো বায়াত/দীক্ষা নিতেই হবে। আর লোক দেখানো সাধুগিরি ফলিয়ে বেড়াতে হবে। আমি অমুক আউলিয়া, অমুক নাম করা পীর, অমুক বড় সাধু, অমুক ত্যাগি সন্ন্যাসী, অমুক পরমহংসদেবের শিষ্য।

আর অসহায় গরীব ভক্তগুলো অধিক কিছু দিতে না পরাতে পীর সাহেব বা গুরুর প্রিয় পাত্র হতে পারে না। এমন কি ঐ গুরু গরীব ভক্তের সাথে হাসি মুখে কথাও বলে না। তখন গরীব ভক্তদের হৃদয়ে কষ্ট হয়। যা ঐ অসৎ গুরু অনুভব করতে পারে না।

এই শ্রেণীর গুরুরা পরমাত্মার সাক্ষাৎ পাইনি বা ব্রক্ষের উপলব্ধি করে নি। কিন্তু অজ্ঞ মূর্খ অশিক্ষিত সহজ সরল ভক্তদের কাছে বারবার শুধু একই কথা বলে- আমি ব্রহ্ম, আমি পরাতপর পরমাত্মা, আমি উপাস্যের উপাস্য, আমি মুর্শিদ, আমি রাসুল আমিই সব তোমাদের। তোমরা কখনো গুরুকে মানুষ জ্ঞান করবা না। -এই সব হলো অসৎ গুরুদের কথা।

আর সদ প্রকৃত গুরুর কথা- গুরুদক্ষিণা প্রকৃতই অদেয়। অর্থাৎ সর্বস্ব দিলেও যোগ্য ভাবে দেওয়া হয় না বা হয়ে উঠে না। এজন্য গুরুকে না দিতে পারলেও দিতে হয় জগতকে। জগৎ সেবাই গুরু সেবা।

গুরুর কাছ হইতে যে উৎসাহ, যে উদ্দীপনা ও যে প্রেরণা ভক্ত পায় তাহা বিশ্বজগতে ছড়াইয়া দেওয়ার নামই গুরু দক্ষিণা। গুরু যত স্বার্থত্যাগ করে ভক্তের জন্য, জগতের জন্য ভক্তকে ততখানি স্বার্থত্যাগ করতে হয়। গুরু ভক্তকে যতখানি ভালবাসে, ভক্তকে ততখানি জগতকে ভালবাসতে হয়।

যতখানি তিনি ভক্তের জন্য কেঁদে আকুল হয়। ততখানি জগতের জন্য ভক্তকে কাঁদতে হয়। তবেই গুরু দক্ষিণা দেওয়া হবে। গুরু দক্ষিণা দেওয়া সহজ কথা নয়, গুরু-ঋণ অর্থ দিয়ে পরিশোধ হয় না।

আজকাল বায়াত বা দীক্ষা নেওয়াটা একটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভজন সাধন কিছুই করা না। শুধু মুখে বলে বেড়ানো- আমি অমুক দরবারের অমুক পীর বা অমুক আকড়া/আশ্রমের অমুক গুরুর শিষ্য ভক্ত। আজকাল এই জন্যই বায়াত বা দীক্ষার সম্মান মূল্য হ্রাস পেয়েছে।

সৃষ্টিকর্তার জন্য প্রাণ আকুল হলো না। তার জন্য চিত্ত অধীর হলো না। তারপরও একটা লোক দেখানো বায়াত/দীক্ষা নিতেই হবে। আর লোক দেখানো সাধুগিরি ফলিয়ে বেড়াতে হবে। আমি অমুক আউলিয়া, অমুক নাম করা পীর, অমুক বড় সাধু, অমুক ত্যাগি সন্ন্যাসী, অমুক পরমহংসদেবের শিষ্য।

নিজের মধ্যে আত্মশুদ্ধি হচ্ছে কিনা তা আমরা দেখি না। শুধু মহত মানুষের দোহাই দিয়ে বেড়াই। এই এতেই হচ্ছে গুরুবাদের সর্বনাশ।

বায়াত বা দীক্ষার ফলে অনেকের ও প্রাণে সৃষ্টিকর্তার জন্য আকুলতা জন্মে; একথাও ঠিক। কিন্তু আত্মগঠন আগে প্রয়োজন বায়াত বা দীক্ষার জন্য। বিশুদ্ধ শ্রদ্ধা ব্যতীত কেউ বায়াত বা দীক্ষা লাভের যোগ্য হয় না। একজন অলি বা সাধু দেখলাম, আর অমনি বললাম দীক্ষা দাও, আমাকে বায়াত করেন, এর মত বোকামি আর নেই।

(চলবে…)

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………
আরো পড়ুন:
গুরুদক্ষিণা প্রসঙ্গে: পর্ব ১
গুরুদক্ষিণা প্রসঙ্গে: পর্ব ২

গুরুদক্ষিণা প্রসঙ্গে: পর্ব ৩

…………………………
বি.দ্র.
আমার এই লেখা কিছু সংগৃহীত, কিছু সৎসঙ্গ করে সাধুগুরুদের কাছ থেকে নেওয়া ও আমার মুর্শিদ কেবলা ফকির দুর্লভ সাঁইজি হতে জ্ঞান প্রাপ্ত। কিছু নিজের ছোট ছোট ভাব থেকে লেখা। লেখায় অনেক ভুল ত্রুটি থাকতে পারে। তাই নিজগুণে ক্ষমা করবেন।

জয়হোক সত্যের জয়হোক মানবতার।। আলেক সাঁই।।

……………………………….
আরো পড়ুন:
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: এক
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: দুই
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: তিন
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: চার
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: পাঁচ
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: ছয়

গুরুপূর্ণিমা
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!