ভবঘুরেকথা
যে ফুল নিন্দে, সেই ফুল পিন্দে

-মূর্শেদূল মেরাজ

তারা জীবন দিয়ে সেই জীবন যাপন করে, যা তারা বিশ্বাস করে বা করতে চায়। তারা সেই অনুসন্ধানী প্রেমিক। যারা পরমের কাছাকাছি হতে পারে। ইশকে দিওয়ানা হতে পারে।

তাদের সকলেই যে প্রেমের চূড়ান্তে অবস্থান করছেন। তাদের সংস্পর্শে আসলেই লোহা সোনা হয়ে যাবে এমন কিছুই বলছি না। বলছি তাদের কথা, যারা সভ্যতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের মতো করে বাঁচে। আমাদের মতো মেনে নেয়ার দলে তারা নেই।

নেই সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে কোনো প্রত্যাশা। যেটুকু না হলেই নয়, সেটুকু হলেই তারা খুশি। মহাখুশি। আর প্রেম পেলে। প্রেমিক পেলে সবটুকু উজার করে দিতেও তাদের বাঁধে না। নিজেই হয়তো সারাদিন কিছু খেতে পারেনি।

কিন্তু গান শুনে মাতোয়ারা হয়ে নেচে গেয়ে সারাদিনের সমস্ত রোজগার তুলে দিতে দেখেছি তাদের অহরহ। তারা শিল্পীদের অর্থ দিয়ে নাম প্রচার করার জন্য বুক উচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না। সেই ছবি ফ্রেম বন্দি করে কাউকে দেখাতেও চায় না।

তারা খোঁজে প্রেম। যেখানে পায় সেখানে উজার করে দেয়। যেখানে পায় না সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না। এই জন্যই তাদের অনেকের স্বভাবের সাথে জালালী শব্দটি যুক্ত হয়ে যায়। বিজ্ঞ জনে তাদের অমর্যাদা করেন না।

অজ্ঞজনে তাদের নিয়ে বাতেলা করে। তাদের ধমকাধমকি করে আনন্দ পায়।

মঞ্চের সামনের এই সব মানুষদের মধ্যেও নানান পদ আছে। এক শ্রেণী আছেন, যারা আগাগোড়া স্বাভাবিক কঠিন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। স্বাভাবিক সময়ে তাদের সাথে কথা বলতে গেলেও দ্বিধা হয়। কি না কি মনে করেন। কথার উত্তর দেবেন কিনা।

বলেছিলেন, আমি কঠিন মানুষ। ছাত্ররা আমাকে যমের মতো ভয় পায়। কোনো দিন কারো গায়ে হাত তুলি নাই। কিন্তু আমাকে ক্লাসে দেখলে টু শব্দটি করার ক্ষমতা আমার ছাত্রদের নাই। যারা আমার কাছে একদিনও পড়েছে, আজন্ম আমাকে মনে রাখবে। আমি সেই লোক।

কিন্তু ঠিকঠাক মতো গানের সুর-শব্দ কানে গেলে তারা মাতোয়ারা হয়ে যায়। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যান। উত্তাল নৃত্যে নিজেকে উজার করে দেন। কে তাদের দেখে কি বললো। কি ভাবলো। তা নিয়ে ভাবনার সময় তাদের থাকে না।

বিক্রমপুরে এক বাউল গানের অনুষ্ঠানের মঞ্চে এমন এক ভদ্রলোকের সাথে কিঞ্চিৎ আলাপ করবার সুযোগ হয়েছিল। বন্ধুবর আয়োজন করেছিল অনুষ্ঠান। তাই অতীব নগন্য মানুষ হওয়া সত্বেও মঞ্চের কাছাকাছি থাকবার সুযোগ হয়েছিল।

সেই সূত্রে মঞ্চের সামনেই সেই মানুষগুলোকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল খুব কাছ থেকে। একসময় যখন চা-জল খেতে টং দোকানে বসেছি। তখন তাদের একজনকে দেখতে পেলাম পাশে। কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন স্থানীয় এক উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের গণিতের শিক্ষক তিনি।

বলেছিলেন, আমি কঠিন মানুষ। ছাত্ররা আমাকে যমের মতো ভয় পায়। কোনো দিন কারো গায়ে হাত তুলি নাই। কিন্তু আমাকে ক্লাসে দেখলে টু শব্দটি করার ক্ষমতা আমার ছাত্রদের নাই। যারা আমার কাছে একদিনও পড়েছে, আজন্ম আমাকে মনে রাখবে। আমি সেই লোক।

কিন্তু গানের অনুষ্ঠানে আসলে যে কি হয় নিজেও জানি না। কত চেষ্টা করি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু পারি না বেশিভাগ সময়ই। এই জন্য আগে আশপাশে কোথাও গান শুনতে যেতাম না। দূরে দূরে যেতাম। যেখানে আমাকে কেউ চেনে না। আমার পরিচয় জানে না।

তিনি আমার উপর খুবই বিরক্ত নিয়ে বললেন, ভাই আপনি যে কি পান আমি বুঝি না। আরে ওরা তো সব খোঁজা মাল। সব কয়টা ধাপ্পাবাজ। ফটকাবাজ। আপনি আসল লোকের সন্ধান পান নাই। তাই আগাড়ে-পাগাড়ে ঘোড়েন। তাই এই সব ধান্দাবাজরে বড় করে দেখেন।

কিন্তু এসব কি আর গোপন থাকে। ঠিকই কেউ না কেউ দেখে ফেলে। আমার সামনে এসে বলবার সাহস রাখে না সত্য। কিন্তু আড়ালে আবডালে ঠিকই বলে বেড়ায়। তাই এখন আর ভাবি না। ভাব আসলে ভাব ছড়িয়ে দেই। পরে নিজেই লজ্জা পাই।

আমি যে নাচতে পারি সেটা আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না। পেটে বোমা মারলেও এক ফোটা নাচ আসবে না। কিন্তু গানে ডুবে গেলে কই থেকে যে এইসব আসে কে জানে। আমি কিছুই জানি না। যেই মালিক আমাকে দুনিয়ায় পাঠাইছে তিনিই ভালো বলতে পারবেন।

আবার অনেকে মঞ্চের সামনে আসেন সেবা ভাব নিয়ে। তারা নাচের তালে তালে বাতাস করেন। এটা সেটা খাবার জিনিস দিয়ে যান। ধুপধোয়া দেন। কোনো কিছুর বিনিময় আশা না করেই তারা এসব করেই চলেন। করেই চলেন। এতেই তাদের আনন্দ। কেউ কিছু দিলে নেন। না দিলে নাই।

আরেক শ্রেণী আছেন, যারা বিভিন্ন বেশ ধরে, ভাব নিয়ে মঞ্চের সামনে ঘুরে বেড়ায়। অল্পবিস্তর নাচলেও তাদের মূল লক্ষ্য থাকে সবাই তাকে দেখুক। বিচিত্র কিছু আচার-বিচার তারা করেন। তাদের কেউ কেউ নিছক মজার জন্য বা লোক দেখানোর জন্য করলেও।

তাই যার সাথে মনে মিলে। যার মাঝে প্রেম দেখি। তাকেই লালমোহন বাবুর ভাষায় ‘কালটিভেট’ করতে চাই। এর বেশি কিছু নয়। তাই হয়তো পাগল-মস্তানরা আমার পছন্দের তালিকায় অনেক উপরে থাকে। তাই বলে তাদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেই।

এদের মাঝেও আছে খাঁটি মানুষ। যারা প্রেমের দরিয়ায় ভেসে বেড়ায় আজন্ম। আসলে ভাবের মানুষই এমন। তাদের দেখে হুটহাট করে মন্তব্য করলে পরে পস্তাতে হয়। তাদের চেনা সহজ নয়। এক ভদ্রলোকের সাথে কিছুদিন পূর্বে পরিচয় হয়েছে।

তিনি আমার উপর খুবই বিরক্ত নিয়ে বললেন, ভাই আপনি যে কি পান আমি বুঝি না। আরে ওরা তো সব খোঁজা মাল। সব কয়টা ধাপ্পাবাজ। ফটকাবাজ। আপনি আসল লোকের সন্ধান পান নাই। তাই আগাড়ে-পাগাড়ে ঘোড়েন। তাই এই সব ধান্দাবাজরে বড় করে দেখেন।

তাকে সেদিন কোনো উত্তর দেই নাই। দেয়ার ইচ্ছাও হয় নাই। আসলে এর উত্তরও হয় না। হয়তো সভ্যতার নিরিখে তার কথাই সত্য। সেটাই যথাযথ। তাই তার সাথে তর্কে জড়ানোর কিছু নাই। তাকেও আমার ভক্তি। কিন্তু আমি মানুষের মাঝে সেই প্রেমটাকেই ধরতে চাই যে প্রেমকে আমি শুদ্ধ মনে করি।

আসলে আমার কাউকে কিছু প্রমাণের দায় নেই। কারো কাছে কিছু চাইবার নেই। সিদ্ধপুরুষ খুঁজে খুঁজে, তাদের পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে তারা যথাযথ কিনা তার বিচারের কোনো আগ্রহও নেই। নেই তাদের কাছেও কিছু চাওয়া পাওয়া। প্রশ্ন করে করে জ্ঞান অর্জন করা।

আমি মানুষের মাঝে বেড়াই কেবল প্রেমের সন্ধানে। সেই প্রেম দেখে যদি আমার পাষান মনে প্রেমের ভাব জাগ্রত হয়। যদি ভক্তিভাব জাগে। যদি এতটুকু প্রেমময় হতে পারি। তাতেই আমার জন্মজন্মান্তরের সার্থকতা। এরবেশি কিছু না।

নইলে তা যোজন যোজন দূরে চল যায়। সত্য আর শুদ্ধ জ্ঞান প্রেম ভিন্ন অন্য পথে ধারণ করা সহজ নয়। অহং-এর গণ্ডি মানুষকে প্রেমময় হতে দেয় না। সেই গণ্ডি টপকাতে হলে প্রেমের মানুষকে চিনে নিতে হয়। আর এই চিনে নেয়ার যাত্রায় আমার তালিকায় সেই সব মানুষ অনেক বড় জায়গা করে নিয়েছে।

তাই যার সাথে মনে মিলে। যার মাঝে প্রেম দেখি। তাকেই লালমোহন বাবুর ভাষায় ‘কালটিভেট’ করতে চাই। এর বেশি কিছু নয়। তাই হয়তো পাগল-মস্তানরা আমার পছন্দের তালিকায় অনেক উপরে থাকে। তাই বলে তাদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেই।

জড়াজড়ি করে শুনে থাকি। এক থালায় খাই। তা নয়। সেই পর্যন্ত এখনো যেতেই পারি না। আপসোস এখনো সংস্কারের বেড়া ভাঙ্গতে পারি নাই। তাদের দেখে দেখে সেই প্রেমের সন্ধানে রত হই। যদি সেই সংস্কারের বেড়া ভেঙ্গে পরে, তবেই না গগনের চাঁদ পাতালে নামবে।

একদা যাদের দেখে বিরক্ত হইতাম। এখন তাদের দেখলেই মন ভরে উঠে। অনেকেই হয়তো আমার মতো প্রেমশূন্য নন। তারা হয়তো সকল সময়ই প্রেমময়। প্রেমময় হয়েই জন্মায়। আমার মতো জীবন দিয়ে বুঝে নিতে হয় না। তাদের চরণে ভক্তি।

কিন্তু আমার মতো অভাগা যারা আছেন, তাদের জন্যই এই সব বলা। আর নবীন অভাগাদের এই বলে অভয় দেয়া যে, চূড়ান্ত সিন্ধান্ত নিয়ে নিজেকে আটকে ফেলার মানে নেই। এই রহস্যময় ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যকে ভালোবাসলেই আপন হয়ে উঠে সব কিছু।

নইলে তা যোজন যোজন দূরে চল যায়। সত্য আর শুদ্ধ জ্ঞান প্রেম ভিন্ন অন্য পথে ধারণ করা সহজ নয়। অহং-এর গণ্ডি মানুষকে প্রেমময় হতে দেয় না। সেই গণ্ডি টপকাতে হলে প্রেমের মানুষকে চিনে নিতে হয়। আর এই চিনে নেয়ার যাত্রায় আমার তালিকায় সেই সব মানুষ অনেক বড় জায়গা করে নিয়েছে।

যারা ভাব গানের মঞ্চের সামনে সবকিছু ভুলে মাতোয়ারা হয়ে যেতে পারে। তা সে বদ্ধ উম্মাদই হোক বা ভাবের পাগলই হোক। সে জালালী পাগলই হোক। বা শিক্ষিত সমাজের প্রতিষ্ঠিত কেউ হোক। যে শুদ্ধ জ্ঞানে। কোনো কিছু প্রত্যাশা না করে পাগলামি করতে পারে ভাবে ডুবে তাকে নিয়ে তো ভাবতেই হয়। শেষে পাগলের গান-

খাজার নামে পাগল হইয়া
ঘুরি আমি আজমির গিয়া,
এত করে ডাকলাম তারে
তবু দেখা পাইলাম না

পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না।।

তুই পাগল, তোর মনও পাগল
পাগল-পাগল করিস না।।

পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না।।

মুর্শিদ আছে দেশে দেশে
এই জগতে কত বেশে,
ধরতে পারলে পাবি রে তুই
বেহেশতেরই নজরানা।।

পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না।।

(সমাপ্ত)

…………………….
আরো পড়ুন-
যে ফুল নিন্দে, সেই ফুল পিন্দে: পর্ব এক
যে ফুল নিন্দে, সেই ফুল পিন্দে: পর্ব দুই

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!