ভবঘুরেকথা
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ধর্ম বৌদ্ধ নাথ তান্ত্রিক

-হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

রাইট সাহেব নেপাল হইতে কতকগুলি পুঁথি কুড়াইয়া লইয়া গিয়া কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিকে দেন। তাহার মধ্যে শান্তিদেবের শিক্ষাসমুচ্চয় নামে একখানি পুঁথি থাকে। পুঁথিখানি কাগজের হাতের লেখা, অধিকাংশই বাংলা। বেলডল সাহেব যখন এই পুঁথিগুলির ক্যাটালগ করেন তখন তিনি বলেন যে, এ পুঁথিখানি খ্রীস্টের জন্মের চৌদ্ধ শ বা পনেরো শ বছর পরে লেখা।

তাহার পর তিনি যখন উহা ছাপান, তখন তিনি ভূমিকায় লিখেন, “না, আর এক শ বছর আগাইয়া যাইতে পারে, কাগজ কি এর চেয়েও পুরানো হবে?” বেন্‌ডল সাহেব একজন বড় লোক। তাঁহার সহিত আমার সদ্ভাব ছিল। তিনি ও আমি দুই জনে একবার নেপাল গিয়াছিলাম। তথাপি এ জায়গায়ু আমি তাঁহার সহিত একমত হইতে পারি না। আমি নেপালে এর চেয়েও পুরানো কাগজের পুঁথি দেখিয়াছি এবং দুই-একখানি আনাইয়াছি।

সুতরাং কাগজ বলিয়া যদি পুঁথিখানি নূতন হয়, তাহ হইলে আমি তাহাতে রাজী নই। ডা: হার্নলি সম্প্রতি দেখাইছেন যে, অনেক পূর্বে নেপালে ‘কায়গদ’ ছিল। ‘কায়গদ’ শব্দটি চীনের। আমরা কাগজ পরে পাইয়াছি, কেননা আমরা উহা সরাসরি চীন হইতে পাই নাই, মূসলমানদের হাত হইতে পাইয়াছি, মুসলমানেরা চীন হইতেই পাইয়াছিল। মুসলমানেরা কায়গদ শব্দটিকে কাগজ করিয়া তুলিয়াছে।

যাহা হউক, উহা একটি প্রকাণ্ড বিহার ছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। রামপালই যে ঐ বিহার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, এমন বোধ হয় না। এই বিহারে অনেক বড় বড় ভিক্ষু থাকিতেন, তাঁহাদের মধ্যে বিভূতিচন্দ্ৰই প্রধান। বিভূতিচন্দ্র অনেকগুলি সংস্কৃত বৌদ্ধ গ্রন্থের টীকা-টিপ্পণী লিখিয়াছিলেন। যখন তিব্বত দেশে এই সকল বৌদ্ধগ্রন্থ তর্জম হইতেছে, তখন তিনি অনেক পুস্তকের তর্জমায় সাহায্য করিয়াছেন।

পুথিখানির শেষে লেখা আছে–দেয় ধর্মোয়ং প্রবরমহাযানযায়িনো জাগদ্দলপণ্ডিত বিভূতিচন্দ্রস্য ইত্যাদি।

বেন্‌ডল সাহেব বলিয়াছেন, “মহাযানপন্থী জগদ্দল পণ্ডিত বিভূতিচন্দ্র কে আমি জানি না।”

১৯০৭ সালে আমি আবার নেপালে গিয়া কয়েকখানি পুথিতে জগদ্দল-মহাবিহারের নাম পাই ; কিন্তু আমিও তথন সে মহাবিহার কোথায়, কি বৃত্তান্ত, জানিতাম না। সেই বারে আমি বিভূতিচন্দ্রের নাম পাই। তিনি ‘অমৃতকর্ণিকা’ নামে ‘নামসংগীতি’র একখানি টীকা করেন, ঐ টীকা কালচক্রযানের মতে লিখিত হয়।

তাহার পর রামচরিত কাব্য ছাপাইবার সময় জানিতে পারি, রামপাল রামাবতী নামে যে নগর বসান ‘জগদ্দল মহাবিহার’ তাহারই কাছে ছিল। উহা গঙ্গা ও করতোয়ার সংগমের উপরেই ছিল। এখন করতোয় গঙ্গায় পড়ে না, পড়ে যমুনায় ; গঙ্গাও এক সময় বুড়িগঙ্গা দিয়া যাইত। তাই ভাবিয়ছিলাম, রামপাল নামে মুন্সীগঞ্জে যে এক পুরানোগ্রাম আছে, হয়ত সেই রামাবতী ও জগদ্দল উহারই নিকটে কোথাও হইবে।

আমি এ কথা প্রকাশ করার পর, অনেকেই জগদ্দল খুঁজিতেছেন, কেহ মালদহে, কেহ বগুড়ায় ; কিন্তু খোঁজ এখনও পাওয়া যায় নাই, পাওয়া কিন্তু নিতান্ত দরকার। কারণ, মগধে যেমন নালন্দা, পেশোয়ারে যেমন কনিষ্ক-বিহার, কলম্বোতে যেমন দীপদত্তম বিহার, সেইরূপ বাংলার মহাবিহার জগদ্দল। তাঞ্জুরে কোথাও লেখে উন্থ বরেন্দ্র ছিল, কোন কোন জায়গায় লেখে বাংলা, কোন কোন জায়গায় লেখে পূর্ব-ভারতে।

যাহা হউক, উহা একটি প্রকাণ্ড বিহার ছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। রামপালই যে ঐ বিহার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, এমন বোধ হয় না। এই বিহারে অনেক বড় বড় ভিক্ষু থাকিতেন, তাঁহাদের মধ্যে বিভূতিচন্দ্ৰই প্রধান। বিভূতিচন্দ্র অনেকগুলি সংস্কৃত বৌদ্ধ গ্রন্থের টীকা-টিপ্পণী লিখিয়াছিলেন। যখন তিব্বত দেশে এই সকল বৌদ্ধগ্রন্থ তর্জম হইতেছে, তখন তিনি অনেক পুস্তকের তর্জমায় সাহায্য করিয়াছেন।

………………….
আরও পড়ুন-
নানা ধর্মমত
বৌদ্ধ শীলভদ্র
বৌদ্ধ লেখক শান্তিদেব
নাথপন্থ
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
জগদ্দল মহাবিহার ও বিভূতিচন্দ্র
বৃহস্পতি, শ্রীকর, শ্রীনাথ ও রঘুনন্দন
ন্যায়শাস্ত্র
চৈতন্য ও তাঁহার পরিকর
তান্ত্রিকগণ
বাঙালী ব্রাহ্মণ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!