এ কথা কহিবে সই এ কথা কহিবে
-দীনেশচন্দ্র সেন
আমি নিবিষ্ট হইয়া চণ্ডীদাসের পদাবলী পড়িতাম।- বটতলার পদকল্পতরু কিনিয়া লইলাম। ধীরে ধীরে এক গানটিতে আমার মনে একটা নূতন রাজ্যের দরজা খুলিয়া গেল-
“এ কথা কহিবে সই এ কথা কহিবে,
অবলা এমন তপঃ করিয়াছে কবে?
পুরুষ-পরশমণি নন্দের কুমার,
কি ধন লাগিয়া ধরে চরণে আমার।”
– তিনি স্পর্শ-মণি, যাহা ছুঁইয়া ফেলেন, তাহাই সোনা হইয়া যায়; এমন ধনী তিনি, কুবেরও তাঁহার কাছে ধন প্রার্থনা করেন, সেই কৃষ্ণ কি ধনের প্রত্যাশায় আমার পা ধরিয়া থাকেন, সখীগণ তোমরা বল, আমার মত তপস্যা কে করিয়াছে?- এরূপ অসাধনে সিদ্ধি আমি কি করিয়া লাভ করিলাম!
সাধকের চক্ষে বিশ্বের সকলই ভাগবত-মূর্ত্তি- তাঁহারই প্রকাশ। স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, যাঁহারা নিবিড় স্নেহ দ্বারা আমাকে বাঁধিতেছেন, তাঁহারা ভাগবত শক্তি, তাঁহারা কি নিত্যই চরণ ধরিয়া আমার সেবার জন্য, আমায় সাধিতেছেন না? এমন তপস্যা আমি কি করিয়াছি, তিনি সেবা দিয়া নিরন্তর আমাকে আকর্ষণ করিতেছেন!
যিনি বহুর মধ্যে কেবল এককে চিনিয়াছেন, এবং শত হন্তের সেবার মধ্যে সেই কর-কমল দুইটির পরশ পাইয়াছেন, তিনিই বলিতে পারেন-
পুরুষ-পরশমণি নন্দের কুমার,
কি ধন লাগিয়া ধরে চরণে আমার!”
এই পদের পরের পদগুলি এইরূপ-
“আমি যাই-যাই-যাই বলে’ তিন বোল।
কত না চুম্বন দেয়, কত দেহি কোল।
পদ আধ যায় পিয়া, চায় পালটিয়া,
বরান নিরথে কত কাতর হইয়া।” (চ)
কি অপার্থিব দৃশ্য! বিদায়কালে চিবুক ধরিয়া কৃষ্ণ “যাই” “যাই” বলিতেছেন; ‘যাই’ বলিলেই চলিয়া যাইতে পারেন না, রাধার মুখখানি তাঁহাকে ধরিয়া রাখে। পুনরায় ‘যাই’ বলিয়া বিদায় চান- প্রতিবারই ফিরিয়া আসিয়া সোগাগ করেন, আধ পা যাইয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চান এবং কাতর-দৃষ্টি মুখখানির প্রতি আবদ্ধ করিয়া থামিয়া দাঁড়ান,
সে মুখ যে কোন কেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা তাঁহাকে পুনঃ পুনঃ ফিরাইয়া আনে! এই অসাধনের ধন পাইয়া কি ফেলিয়া যাইতে ইচ্ছা হয়? কিন্তু যাইতে তো হইবেই; যদি সত্যই অঞ্চলের নিধি হারাইয়া যায়, যদি আবার না দেখিতে পান, তবে বাঁচিবেন কেমন করিয়া?
“করে কর ধরি পিয়া শপথি দেয় মোরে।
পুন দরশন লাগি কত চাটু বোলে।”
“রলয়োরভেদত্বাৎ”- ‘মোরে’ ও ‘বোলে’র গরমিল পাঠক ধরিবে না। এগুলি গান, কাব্যের নিয়ম এখানে সর্ব্বদা চলে না।
তিনি হাত ধরিয়া শপথ চাহিতেছেন, “আমার হাত ছুঁইয়া বল, আবার দেখা পাব”- যে দর্শন সমস্ত সাধনার শেষ সিদ্ধি, সহস্র কষ্টের উপশম, ভবরোগের শ্রেষ্ঠ ভেষজ- সেই দর্শনের জন্য ভিক্ষা।
সেই সনাতন ভিক্ষারী জীবকে এমনই করিয়া চান। হে মানব! তোমার দেবতা তোমাকে এমন করিয়া চান, মাতার উৎকণ্ঠার মধ্যে, স্বামীর সোহাগে, শিশুর ব্যাকুলতার মধ্যে সেই চিরন্তন ভিখারী এমনই করিয়া বারম্বার তোমার কাছে হাত পাতিয়া আছেন- তোমার চোখের মায়ার ঢাকনিটা খুলিয়া দেখিতে চাহিলে সেই প্রেম ভিক্ষুকের এই চিত্রই দেখিতে পাইবে। কবে তোমাকে পাইব- এইজন্য তিনি কাকুবাদ করিয়া শপথ চাহিতেছেন।
……………………
পদাবলী মাধুর্য্য -দীনেশচন্দ্র সেন।
…………………..
বঙ্গদেশের শিক্ষিতা মহিলাগণের মধ্যে যিনি কীর্ত্তন প্রচার করিয়া এদেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদের প্রতি পুনরায় তাঁহাদের আন্তরিক অনুরাগ ও শ্রদ্ধা জাগাইয়া তুলিয়াছেন, জাতীয় জীবনের সেই অগ্রগামিনী পথপ্রদর্শিকা সুর-ভারতী শ্রীমতী অপর্ণা দেবীর কর-কমলে স্নেহের সহিত এই পুস্তকখানি উৎসর্গ করিলাম।
এই পুস্তকের শেষ কয়েকটি ফর্ম্মা যখন ছাপা হয়, তখন আমি কলিকাতায় ছিলাম না। শেষের দিকটার পাণ্ডুলিপি আমি ভাল করিয়া দেখিয়া যাইতে পারি নাই। এজন্য সেই অংশে বহু ভুল-ভ্রান্তি দৃষ্ট হইবে। যদি এই পুস্তকের পুনরায় সংস্করণ করিতে হয়, তখন সেই সকল ভুল থাকিবে না, এই ভরসা দেওয়া ছাড়া এ সম্বন্ধে আর কিছু বলা এখন আমার পক্ষে সম্ভব নহে।
-শ্রীদীনেশ্চন্দ্র সেন
সাঙ্কেতিক শব্দ
চ- চণ্ডীদাস
শে- শেখর
ব- বলরাম দাস
রা- রাম বসু
কৃ- কৃষ্ণকমল গোস্বামী
রায়- রায় শেখর
বৃন্দা- বৃন্দাবন দাস
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………..
আরও পড়ুন-
কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম
বাঁশীর সুর
পদাবলী মাধুর্য্য
এ কথা কহিবে সই এ কথা কহিবে
দর্শন ও আনন্দ
অনুবাদ
গৌরদাস কীর্ত্তনীয়া
হারাই হারাই
সখী-সম্বোধনে
মাথুর
অভিসার
মান
পরিহাস রস
মান-মিলন
গৌর-চন্দ্রিকা
বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাস
বেদের শিক্ষা