লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এক
-মূর্শেদূল মেরাজ
কথায় বলে ‘আদার ব্যাপারী, আবার জাহাজের খবর নেয়’। অর্থাৎ আদার ব্যাপারীর মতো নগণ্য ব্যবসায়ী হয়ে জাহাজের মতো বিশাল মাপের ব্যবসার খবরাখবর নেয়ার মতো আস্পর্ধা কেনো করো হে! তুমি কে হে বাপু? আরো পরিষ্কার করতে বলতে গেলে বলতে হয়, তুমি তুচ্ছ মানুষ; তুমি কেনো বিশালত্বের খবরাখবর নিবে?
কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো তৃতীয় বিশ্বের নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুসিকতার আদার ব্যাপারীরাই বরাবর জাহাজের খবর রাখতে ভালোবাসে। আমাদের সকলের হাতেই অপচয় করার মতো এমন অনেক অনেক সময় বর্তমান।
নিজের চড়কায় তেল দেয়ার সময় না পেলেও। অন্যের চড়কায় তেল দেয়া আমাদের অভ্যাস। এতে আমাদের আত্মতৃপ্তি হয়। বরঞ্চ এ কাজ করতে না পারলে অস্বস্তিতে রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত আসতে চায় না। পেটের খাবার হজম হয় না।
এই অভ্যাস ‘বদ’ না ‘ভালো’; ‘সু’ না ‘কু’ সেটা নিয়ে কথা বলতে গেলে আরেক প্রবাদে গিয়ে পড়তে হয়। সেটি হলো- ‘উপর দিকে থুথু দিলে নিজের গায়ে থুথু পড়ে’। তাই আর বাড়াবাড়ি না করে মূল আলোচনায় ঢুকে পরি। সেটাই সর্বদিক দিয়ে মঙ্গল।
যাক জাতিগত অভ্যাসবশত: একটু জাহাজের খবর নিতে এই লেখা ভূমিষ্ঠ হতে চলেছে। লিখতে চাইছি ফকিরকুলের শিরোমণি ফকির লালন সাঁইজিকে-সাঁইজির ভাবনাকে-সাঁইজির মতাদর্শকে আমরা কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আদৌ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি? নাকি কেবল আমাদের ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য ব্যবহার করছি।
শুধু লালন গান নয়। ‘লালন’-এর বাজার দরই এখন বেশ রমরমা। যে লালন ফকিরকে আমরা ব্রাত্য করে রাখবার প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছি যুগের পর যুগ। সেই লালন ফাঁকতাল গলে যখন ‘লোকো’ তকমা খসিয়ে ক্রমশ তার নিজ অবস্থানে অসীন হতে চলেছেন।
ভারতবর্ষে বহু দেশ-ভাষা-জাতি-ধর্ম-গোত্র-সম্প্রদায়ের শাসক এসেছে। আমাদের শাসন করেছে। তবে আমাদের সর্বনাশ যারা করেছে, সেই তালিকা করলে তার শীর্ষে অবস্থান করবে ব্রিটিশরা। তারা এই অঞ্চলে কেবল শাসন আর লুণ্ঠন করতেই এসেছিল।
তখনই আমরা বুঝে ফেলেছি, এইখানে ব্যবসা ভালো হবে। আর ‘লাভের গুড়’ খাওয়ার জন্য দলে দলে পিঁপড়েরা এসে উপস্থিত। তবে এখানেও নতুন এক সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমরা কি আদৌ পিঁপড়েও হতে পেরেছি? তাদের মতো দলবদ্ধ হয়ে কোনো কাজ কি আদৌ আমাদের পক্ষে সম্ভব???
নাহ্! এখানেও হতাশার চূড়ান্ত। আমরা কোথাও কোনো বিষয়েই আর একমত হতে পারছি না। কেবলমাত্র নির্মমতা-নির্যাতন-আক্রোশ-আক্রমণ-শোষণে আমরা দলবদ্ধ হই। অন্যত্র ঠনঠনে। কোনো শুদ্ধচর্চায় আমরা একতা দেখাতে পারিনি বাংলা নামের দেশ জন্ম হওয়ার পর থেকে আর।
আমরা একতা বা একত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বারবার নিজেদের মধ্যেই বিভেদ তৈরি করে ফেলেছি। কোনোক্ষেত্রেই শেষ রক্ষা হয় নি। সফল-টফল হয়েছি বলে বলে নিজেদের মান রক্ষা করতে গিয়ে তর্ক আমরা করি প্রায়শই। তবে সকলেই নিজের কাছে নিজের মতো করে জানি। সেসবই গালগল্প।
আমরা সকলেই নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠান ভাবি। আর এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের কাছে কি আর যায়? নাক উঁচু স্বভাবের ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত হয়েও ইংরেজিটা আমরা ব্রিটিশ কায়দায় শিখতে পারিনি বটে। তবে তাদের নাক উঁচু স্বভাবটা ঠিকই রপ্ত করেছি বেশ।
তাই সকলেই নাক উঁচু করে সামনের দিকে এগিয়ে চলছি বলে ভাবছি। কিন্তু আদৌ এগুচ্ছি নাকি পিছুচ্ছি সেটা আমরা এখনো নির্ণয়ই করতে পারিনি। বা করতে চাই নি। তা করতে গেলে হয়তো আমাদের ফাঁকিগুলো দৃশ্যমান হয়ে যাবে।
খসে যাবে আমাদের এতো দিনের সাজানো সজ্জা। দৃশ্যমান হবে নগ্নতা। স্বপ্ন ভঙ্গ হবে আমাদেরকে ঘিড়ে স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোর।
ভারতবর্ষে বহু দেশ-ভাষা-জাতি-ধর্ম-গোত্র-সম্প্রদায়ের শাসক এসেছে। আমাদের শাসন করেছে। তবে আমাদের সর্বনাশ যারা করেছে, সেই তালিকা করলে তার শীর্ষে অবস্থান করবে ব্রিটিশরা। তারা এই অঞ্চলে কেবল শাসন আর লুণ্ঠন করতেই এসেছিল।
বাকি যারা এসেছিল তাদের অনেকে কেবল শাসন করতে আসলেও। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বেশিভাগ এখানেই স্থায়ী হয়েছিল। তাই তারা এই ভূমিকে একপর্যায়ে নিজেদের বলেই মেনেছিল। সেকারণেই হয়তো তারা আমাদের মনোজাগতিক শাসনের দিকে সেভাবে বিশেষ দৃষ্টিপাত করেনি।
কিন্তু ব্রিটিশরা এসেছিল এবং শাসন করেছিল বেশ পরিকল্পিত ভাবেই। তারা আমাদের কেবল শাসনই করেন নি। মনস্তাত্ত্বিকভাবেও তারা আমাদের মাঝে এমন সব বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে, এতো বছর পরও আমরা সেই বিষ নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছি। যা ক্রমশ বিষে বিষময় হয়েই চলেছে।
ইতিহাসে ভারতবর্ষে অনেক নির্মম শাসকের আগমন ঘটেছে সত্য। কিন্তু ব্রিটিশদের মতো এমন ছকে ফেলে আমাদের নিজস্বতাকে ধ্বংস বা নিজস্বতার প্রতি অনুসন্ধানের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন আর কেউ এতো পরিকল্পিতভাবে আর কেউ করেনি।
তাই আমাদের নিজেদের হাজার হাজার বছরের যে অর্জন ছিল। সেই বিষয়গুলো বুঝতে বেশ কষ্ট হয় আজ। বিষয়গুলো মেনে নিতেও কষ্ট হয়। নিজেদের নিজেরাই চিনতে পারছি না। তাই সূচনাতেই এতো এতো কথা বলা।
কলোনীয়াল যে চক্রে আমরা আবর্ত হয়ে গেছি সেই থেকে। তার থেকে আমরা আর মুক্তি পাইনি। মুক্তি যে পাওয়া প্রয়োজন সেই ভাবনাও আজ পর্যন্ত জাগ্রতই হয়নি। আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি-ধর্ম-দর্শন-শিল্প সকল কিছুই দেখতে শুরু করেছি তাদের পড়ানো চশমা দিয়ে।
তাই আমরা আমাদের নিজেদের বিষয়গুলোকে ভাবতে পেরেছি ‘লোকো’ বলে। এই বিষয়টা আমাদের কাছে কখনো অপমান মনে হয়নি। এখনো হয় না। আমরা গর্ব করে বলি আমাদের লোকো ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ। আসলেই কি সেসব ‘লোকো’? নাকি সেটাই আমাদের মূল সংস্কৃতি??
আবার আমরা ঘুড়িয়ে বলছি লোকো বিষয়টা আমাদের শিকড়। আদি মূল। আবার বলছি লোকো। বিষয়টা এক মুখে দুই কথা হয়ে গেলো না?
নিজেকে ক্ষুদ্র প্রমাণ করে অন্যকে বড় করার প্রথাটা বেশ উত্তম। কিন্তু নিজেকে-নিজের সংস্কৃতি-নিজের সত্ত্বাকে ঘৃণা করে-তুচ্ছ ভেবে-কুসংস্কার ভেবে অন্যদেরটা মহান ভববার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। থাকতে পারে না। কথায় বলে, ‘বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে’।
তবে এখানে বলা হয়নি তুমি নিজেকে-নিজের চিন্তাকে-নিজের চেতনা তুচ্ছজ্ঞান করো। এখানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে। তুমি বিনীত হও। নম্র হও। নত হও। সমর্পিত হও। যাতে তোমার আচার-বিচার দেখে তোমাকে যারা দেখছে তাদের মধ্যেও সেই ভাবের উদয় হয়।
আসলে কলোনীয়াল শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে এমনভাবে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে যে, আমরা কিছুতেই আমাদের চিন্তা-চেতনাকে তার থেকে পুরোপুরি বের করে আনতে পারি না। ঝামেলাটা হলো, আমরা ভাবতেও শিখেছি সেই কলোনীয়াল শিক্ষার আলোকে।
তাই আমাদের নিজেদের হাজার হাজার বছরের যে অর্জন ছিল। সেই বিষয়গুলো বুঝতে বেশ কষ্ট হয় আজ। বিষয়গুলো মেনে নিতেও কষ্ট হয়। নিজেদের নিজেরাই চিনতে পারছি না। তাই সূচনাতেই এতো এতো কথা বলা।
এতোসব কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য। তা হলো, যে মতাদর্শকে আমরা বুঝতে চাইছি-প্রচার করতে চাইছি সেটা যে আমাদের। সেটা কি আমরা সত্যিই মানতে পারছি?
আবার একটা সংস্কৃতির সকল কিছুই যে মহান বিষয়টা তেমনও নয়। ঐতিহ্য বলতেই তা সত্যতার চূড়ামণি তাও নয়। তবে তাকে বুঝতে গেলে। তার ধারাকে ধরতে গেলে তার মাঝে বাস করা জরুরী। তার স্বাদ নিতে শেখা জরুরী।
নাকি সেটা শো-কেসে সাজিয়ে রাখবার জন্য কিংবা বুকসেল্ফে সংখ্যা বাড়ানোর জন্য লিখছি। আমরা যা বলছি-করছি-ভাবছি-জানছি তা কি নিজে বিশ্বাস করে করছি? নিজে জেনে করছি?? নিজে তা মানছি??? বিষয়টি আগে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।
একটা মতাদর্শকে ধারণ করতে না পারলে সে সম্পর্কে গবেষণা করা বেশ কঠিন। আবার ধারণের মাত্রা বেশি হয়ে গেলেও তার মাহাত্ম্য নিয়ে এতোটাই বিমোহিত হয়ে পরতে হয় যে তার গুণগান গেয়েই শেষ করতে হয়। মূলে পৌঁছানো যায় না।
এ কথা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, মূলে পৌঁছাতে যে দৃঢ়তা প্রয়োজন। যে স্থিরতা প্রয়োজন, যে স্থিতিতে থাকা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে তা একজন গবেষক বা লেখকের পক্ষে অর্জন করা মোটেও সহজ নয়।
বর্তমান সময়ের যে অস্থিরতা, বাড়তে থাকা চাহিদার বোঝা। তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে যে সামাজিক মর্যাদা-প্রতিপত্তি কাঙ্খি প্রায় প্রতিটি মানুষকেই অংশ নিতে হচ্ছে ইঁদুর দৌড়ে। সেই দৌড়ের প্রতিযোগীতায় থেকে তলানীতে গিয়ে ভাবা সহজ কার্য নয়।
এর মাঝে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে লোভ, মোহ, মায়ার ফাঁদের জ্বাল। সামাজিক মান-মর্যাদার প্রত্যাশা থাকলে সেগুলোকে পাশ কাটানো আসলেই বড্ড কঠিন।
আবার একটা সংস্কৃতির সকল কিছুই যে মহান বিষয়টা তেমনও নয়। ঐতিহ্য বলতেই তা সত্যতার চূড়ামণি তাও নয়। তবে তাকে বুঝতে গেলে। তার ধারাকে ধরতে গেলে তার মাঝে বাস করা জরুরী। তার স্বাদ নিতে শেখা জরুরী।
সভ্যতার দৃষ্টিতে তাকে বিচার করলে সর্বক্ষেত্রে চলে না। তাতে জল ঢুকে যায়। তাকে বিচার করবার জন্য বিচার শক্তি-বিবেক-বিবেচনা শক্তিকে নিক্তির কোন পাশে রাখতে হবে তা জেনে নিতে হয় নিজ দায়িত্বে।
এই রকম অনেক কথা বলা যেতে পারে। ভাবা যেতে পারে। কিন্তু পালন করা মুশকিল। কারণ আমরা যারা অন্তত দুই-এক পাতা পড়ে ফেলেছি। আমরা আর সহজভাবে ভাবতে পারি না। আমাদের ঘাড়ের উপর কলোনীয়াল খড়গ টান টান হয়ে নিশানা করে থাকে সকল সময়।
(চলবে…)
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দুই>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………………
আরো পড়ুন-
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এক
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দুই
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তিন
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব চার
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব পাঁচ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব ছয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব সাত
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব আট
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব নয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দশ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এগারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব বারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তেরো