লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দুই
-মূর্শেদূল মেরাজ
তাই আমাদের লক্ষ্য সকল সময় ঠিক থাকে না। মাঝে মাঝেই ঝাপসা যায়; সেটাও স্বাভাবিক। তারপরও লালনকে বুঝতে গেলে। অনেক কিছু জেনে-বুঝে-শুনে তবেই বুঝতে হবে। আবার সভ্যতা-আধুনিকতা-ধর্ম-দর্শনের চাপিয়ে লালনকে যেভাবে আজ উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে।
সেই আবরণও হটাতে হবে। যা সবচেয়ে কঠিন। কারণ যারা জীবন দিয়ে লালনকে আকড়ে ধরে আছে। তাদের অনেকে ফকির লালনকেও বেঁধে ফেলেছে সংকীর্ণতার গণ্ডিতে। তাই নিজ মূলে ফিরে যাওয়া আজ আর সহজ নয়। টেবিল চেয়ারে বসে গবেষণা করা। সাহিত্যের-ইতিহাসের বিচারে অনেক কিছু বলা যায় বটে।
কিন্তু অক্টোপাসের মতো সবদিক দিয়ে ঘিরে ফেলা এই প্রতিবন্ধকতার শৃঙ্খলে বসে লালনকে আবিষ্কার করা মোটেও সহজ নয়। তাই লালনকে আবিষ্কার করা থেকে ব্যবসার হাতিয়ার করা সব থেকে সহজ ও লাভজনক। যথা কারণে তাই ঘটছে।
এসব দেখে তারাপদ রায়ের কয়েকটা লাইন বারবার মনে পরছে। তারাপদ রায় লিখছেন-
আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেবেছিলাম
যার উদ্দেশ্যে ধ্রূপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ প্রশস্তি লিখেছিলাম
গতকাল বলাই বাবু বললেন, ‘ঐটি বাঁদরলাঠি গাছ’।
অ্যালসেশিয়ান ভেবে যে সারমেয় শাবকটিকে
আমরা তিন মাস বক্লস পরিয়ে মাংস খাওয়ালাম
ক্রমশ তার খেঁকিভাব প্রকট হয়ে উঠছে।
আমরা টের পাইনি
আমাদের ঝরণা কলম কবে ডট্ পেন হয়ে গেছে
আমাদের বড়বাবু কবে হেড অ্যসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছেন
আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন।
আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।
আমাদের বুঝতে হবে লালন ফকিরের গান বিনোদন নয় আরাধনা। আরাধনাতেও আনন্দ-বিনোদন থাকতেই পারে। সেটি বিতর্কের মূল বিষয় নয়। তবে তা ভক্তিতে-বিনয়ে-নম্রতায়-শ্রদ্ধায় সিক্ত হলে তবেই তাতে ডোবা যায়। তবেই ‘লালন’ ভাব থেকে ভাবনায় প্রকাশ পেতে শুরু করা সম্ভাবনা দেখা দেয়।
নইলে সে ভাবও খেলবে না। ভাবনাতেও আসবে না মূল ভাব। চেনা যাবে না লালনকে। ধরা যাবে না লালনকে। ধারণ করা যাবে না লালনকে। আমরা লালনকে কেবল গীতিকার বানিয়ে রাখতে চাইলে তাকে চিনতে পারা যাবে না। যাবে না শব্দের অর্থে খুঁজতে চাইলেও।
বা নির্দিষ্ট করে দেয়া অর্থের ভেতরে খুঁজলে কি পাবো তাকে? মার্কস-লেনিন-হেগের-ফুকো ইত্যাদি ইত্যাদি বিচার বিবেচনা করলেই কি পাওয়া যাবে তাকে?? বা কলোনীয়াল বিশ্লেষণের ভিত্তিতেও কি পাওয়া যাবে ফকির লালনকে???
যাক… কোথায় খুঁজলে লালনকে পাওয়া যাবে সেটা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরঞ্চ এই লেখার উদ্দেশ্য কোন পথে চলছে লালন চর্চা। দেখা যাক সে সম্পর্কে কিছু তুলে ধরা যায় কিনা।
এ বিষয়ে প্রবেশের আগে আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা বর্তমানকাল পর্যন্ত যে ধারায় লালনচর্চা দেশে চলছে। সে বিষয়ে গুটিকয়েক কথা তুলে ধরছি। এবং প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছি এ কোনো জরিপ নয়। এ কেবলই চোখে দেখা ঘটনার বিশ্লেষণ মাত্র।
তাই সাধুগুরুপাগলভক্তগোসাই সকলের তরে ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে নিচ্ছি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা প্রার্থী। আসলে আমরা সকলেই সেই মহান সাধককেই বুঝতে চাইছি। সেই বুঝবার ক্ষেত্রটা হয়তো আমাদের ভিন্ন ভিন্ন। তারপরও উদ্দেশ্যে তো একই।
এই বুঝতে যাওয়ার যাত্রায় আদৌও কোনো ভুল কি হচ্ছে? আদৌ কি আমরা শুদ্ধতা ধরে রাখতে পারছি?? আমরা কি যথাযথ ভাবে লালনকে বুঝতে চাইছি? লালনকে কি আমরা কেবলই ব্যবসার স্বার্থে ব্যবহার করছি?? আসলে আমরা যে যে অবস্থানে আছি।
এই উভয় সংকটের মধ্যে থেকেও যারা কাজ করে যাচ্ছেন তাদের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা। তার উপর সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক নানান প্রতিবন্ধকতা তো রয়েছেই। এসবকে অনেকে মেনে নিয়ে নিরব হয়ে যায়। আবার এসবকে অনেকে মেনে নিয়ে নিজের কাজটা ঠিকঠিকই করে যায়।
সেই সেই অবস্থান থেকে লালনকে কি রুপে দেখছি। কি কি কাজ করছি। কিভাবে করছি। কেনো করছি বা কেনো করছি না?? সে সব একটু বুঝে নিতে গেলে আমরা নিজেরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা আগে চিহ্নিত করা জরুরী। আর যা কিছু ভুলচুক হয়ে গেছে।
তা মেনে নিয়েই দায়িত্ব নিয়ে বাকি কাজটা এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। মহান সাধকরা অবশ্য কারো জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকেন না। যখন নিজেরা ছড়িয়ে আরো ব্যপ্তি নিয়ে আলোকিত করতে চান। তখন নিজেদের কাজ নিজেরাই করিয়ে নেন।
সেই মহান দায়িত্ব কার উপর অর্পিত হবে তা কে বলতে পারে। একজন কট্টরপন্থীও হয়ে উঠতে পারে একজন উদারপন্থী সাধকের গোলাম। তার জন্য বাজি রাখতে পারে জীবন-যৌবন। আবার একজন উদারপন্থীরাও গিয়ে ভীড়তে পারে কট্টরপন্থীর ছায়াতলে।
আসলে কাকে দিয়ে কি করিয়ে নেয়া হবে। তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি কই? তাই মহতদের মতি বোঝা সহজ নয়। তাদের নিয়ে কাজ করতে যাওয়া অনেক সময় যেমন ধৃষ্ঠতা। আবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিস্ক্রিয় থাকাটাও কোনো যুক্তির মধ্যে পরে না।
এই উভয় সংকটের মধ্যে থেকেও যারা কাজ করে যাচ্ছেন তাদের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা। তার উপর সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক নানান প্রতিবন্ধকতা তো রয়েছেই। এসবকে অনেকে মেনে নিয়ে নিরব হয়ে যায়। আবার এসবকে অনেকে মেনে নিয়ে নিজের কাজটা ঠিকঠিকই করে যায়।
এই সব হতাশা-আশা সকল কিছু নিয়ে একটু দেখা যাক আমরা লালনচর্চা কিরূপে করছি। তার একটা খসড়া চিত্র। কারা কারা লালনকে নিয়ে কাজ করছেন মোটা দাগে তাদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করে। এই অবসরে ভুল-ত্রুটি ক্ষমা চেয়ে তাদের সম্পর্কে। তাদের কাজের ধারা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জানা যাক-
- লালন সাধক (খিলকাধারী সাধুগুরু)।
- লালন ভক্ত (দীক্ষাধারী)।
- অনুরাগী।
- লেখক।
- গবেষক।
- শিল্পী।
- সংগীতের আয়োজক।
- সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।
- সাধুসঙ্গ।
- সঙ্গীতানুষ্ঠান।
- লাইভ/অনলাইন।
- ইউটিউব।
- সাক্ষাৎকার।
লালন চর্চায় সাধুগুরু (খিলকাধারী)
গুরু-শিষ্য পরম্পরায় যথাযথ সময় গুরু উপযুক্ত শিষ্যকে খিলকা/খিড়কা বা খেলাফত দিয়ে নব্য গুরু রূপে স্বীকার করে নেন। নতুন গুরু তখন আনুষ্ঠানিকভাবে অধিকার পায় নিজ শিষ্য করার। তিনিও ফকিরকুলের শিরোমণি লালন সাঁইজির মত-পথ শিক্ষা দেন নিজ নিজ শিষ্যদের।
সহজ কথায়, খিলকা হচ্ছে জীবিত অবস্থায় মৃত্যুকে মেনে নিয়ে মৃতের পোশাক পরিধান করা। অর্থাৎ খিলকা পরিধান করা মানে মৃতের মতো জীবন যাপন করা। যাকে লালন ফকির বলেছেন ‘জিন্দা মরা’। অর্থাৎ যিনি নিজ ইন্দ্রিয় ও ষড়রিপুকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। বাহ্যিক সুখ-দু:খ, কামনা-বাসনা যাকে সাধারণের মতো তাড়িত করে না।
গুরু-শিষ্য পরম্পরাতে এই মতাদর্শ চলমান। তাই প্রথাগত মতে, সাঁইজির মতাদর্শকে সংরক্ষণ-প্রচার-প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন লালন ঘরের গুরু। তারা গুরু-শিষ্য পরম্পরায় সেই যাত্রা অব্যাহত রাখেন। এটাই তাদের কর্ম।
ফকির লালন যে কেবল একজন গীতিকার নন একজন মহান সাধক। মতাদর্শের প্রণেতা। এই বার্তাটা যারা বহন করে চলেছেন যাপিত জীবনের মধ্য দিয়ে। তারা হলেন লালন ঘরের সাধুগুরু। নইলে শিক্ষিত-প্রাতিষ্ঠানিক মহল তো লালন ফকিরকে শুধুই একজন গীতিকার হিসেবে চিহ্নিত করে ছেড়েছিল।
দিন দিন এই কোণঠাসা হতে হতে তারা নিজেদের অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলেন। যা চলেছে দীর্ঘদিন। তবে গত এক বা দুই দশক ধরে নতুন প্রজন্মের মাঝে সাঁইজিকে নিয়ে যে জিজ্ঞাসা শুরু হয়েছে। তাতে অনেকেই এই মতের সাধুগুরুদের সন্ধানে বের হয়েছেন।
যদিও সমাজের অনেক মহলের কাছে এখনও ফকির লালন একজন গীতিকারই। লালনগীতি এক ধরণের লোকগান ভিন্ন আর কিছু নয় তাদের কাছে। কিন্তু সাধুগুরুরা সমাজের নানাবিধ চাপ সহ্য করেও সাঁইজির দেহত্যাগের সোয়া’শ বছরের বেশি সময় পরও তার জীবনধারাকে নিজ জীবনে ধারণ করে চলছেন।
মৌলবাদী, কট্টরবাদীসহ বিভিন্ন জাত-পাত-ধর্ম-গোত্র-রাষ্ট্রের অত্যাচার-অবিচার-নিপিড়নেও তারা তাদের বিশ্বাসকে টিকিয়ে রেখেছেন। সাঁইজির প্রতি তাদের ভক্তি-প্রেমকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই জন্য তাদের চরণে শত-সহস্র-লক্ষ-কোটি ভক্তি।
কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হলো ক্রমাগত কোণঠাসা হতে হতে সাধুগুরুদের অনেকেই তাদের ব্যাপ্তি সংকীর্ণ করে নিয়েছেন। নিজ ভক্তদের মাঝেই ক্ষুদ্র পরিসরে নিজ নিজ করণকারণ পালনের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন।
দিন দিন এই কোণঠাসা হতে হতে তারা নিজেদের অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলেন। যা চলেছে দীর্ঘদিন। তবে গত এক বা দুই দশক ধরে নতুন প্রজন্মের মাঝে সাঁইজিকে নিয়ে যে জিজ্ঞাসা শুরু হয়েছে। তাতে অনেকেই এই মতের সাধুগুরুদের সন্ধানে বের হয়েছেন।
(চলবে…)
<<লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এক ।। লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তিন>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………………
আরো পড়ুন-
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এক
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দুই
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তিন
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব চার
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব পাঁচ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব ছয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব সাত
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব আট
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব নয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দশ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এগারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব বারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তেরো