মহাভারতের অন্ত দর্শন
-আবুতালেব পলাশ আল্লী
পুঁথিপত্র থেকে জানা যায়, হস্তিনাপুরের করুক্ষেত্র যুক্ত এতোটাই বিদ্ধংসী ছিল যে তৎকালীন জনসংখ্যার আশি ভাগ পুরুষই এই যুদ্ধে প্রাণ হারায়। মহাভারতের ১৮দিনের এই যুদ্ধ শেষে সঞ্জয় কুরুক্ষেত্রের সেই জায়গায় গমন করেন যেখানে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল।
কুরুক্ষেত্রের জমিতে দাঁড়িয়ে সঞ্জয় ভাবতে থাকেন, সত্যিই কি এই সেই জায়গার মাটি যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে? যে মাটি মহাপ্রতাপশালী পাণ্ডব এবং কৌরবদের রক্তে শুষে নিয়েছে? এই চিন্তা যখন তার মস্তিষ্কে বিরাজ করছে, তক্ষুণি এক বৃদ্ধের কম্পিত-কোমল ধ্বনি তাঁর কানে বেজে ওঠলো।
তিনি শুনতে পেলেন সেই কণ্ঠটি বলে উঠলো, ‘তুমি কখনোই সত্য জানতে পারবে না বৎস!’
ঘুরে দাঁড়াতে সঞ্জয় গেরুয়া বস্ত্রধারী এক বৃদ্ধকে ধুলোর স্তম্ভ থেকে উঠে আসতে দেখতে পেলেন।
বৃদ্ধ মৃদু হেসে বৃদ্ধ বললেন- ‘আমি জানি বৎস! তুমি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিষয় জানতে চাও কিন্তু ততক্ষণ তা তোমার বোধগম্য হইবে না, যতক্ষণ না তুমি বাস্তবে যুদ্ধটা কি বস্তু, সেটা বুঝিবে।’
-‘তার মানে?’
-‘মহাভারত একটি দৃষ্টান্ত, একটি মহাকাব্য, হয়তো বাস্তব, হয়তো বা দর্শন।’ মৃদু-মন্দ হেসে বৃদ্ধ সঞ্জয়ের দিকে তাকান। তাঁর মনে আরও প্রশ্ন উদ্রেক করাই বোধহয় তাঁর লক্ষ।
সঞ্জয় অনুরোধ করেন- ‘আপনি দয়া করে যদি বলেন ওই দর্শন বস্তুটি কি?’
নিশ্চয়! এই বলিয়া বৃদ্ধ আরম্ভ করেন- ‘পঞ্চপাণ্ডব আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় বই কিছু না। দৃষ্টি, ঘ্রাণ, স্বাদ, স্পর্শ ও ধ্বনি। আর কৌরবরা কি, তা কি জান তুমি?’ দৃষ্টি সরু করে বৃদ্ধ শুধান।
-‘কৌরব আমাদের একশত দোষ। যারা নিত্য, প্রতিমুহূর্ত আমাদের ওই পাঁচ ইন্দ্রিয়কে আক্রমণ করছে। জানো কখন?’
সঞ্জয় আবারো না সূচক মাথা নাড়েন।
-‘শ্রীকৃষ্ণ যখন তোমার রথের সারথি হন, তখন!’
বৃদ্ধ ঝকঝকে হাসি হাসেন এবং সঞ্জয় এই অন্তর্নিহিত জ্ঞান প্রাপ্তিযোগে অবাক চোখে বৃদ্ধকে দেখেন।
-‘শ্রীকৃষ্ণ তোমার অন্তর ধ্বনি, তোমার আত্মা, তোমার পথ প্রদর্শনকারী আলোকস্তম্ভ এবং তুমি যদি তাঁর হাতে নিজেকে সমর্পিত করে দাও, তুমি চিন্তা মুক্ত থাকবে জীবনে।
সঞ্জয় নিঃশব্দে মাথা নাড়ান। এক দৃষ্টিতে তিনি কুরুভূমির দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে তাঁর লক্ষ-কোটি চিন্তা তোলপাড় করে। প্রতিটি কথা গুছিয়ে তিনি সামঞ্জস্য তৈরি করার চেষ্টা করেন। খানিক বাদে যখন তিনি মাথা তোলেন, বৃদ্ধ তখন সেখান থেকে প্রস্থান করেছেন। ধুলোর স্তম্ভে আবার মিলিয়ে গেছেন।
সঞ্জয় বোকার মত বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু শীঘ্রই আবার সামলে নিয়ে পরের প্রশ্ন করেন- ‘তাহলে দ্রোণাচার্য, ভীষ্ম পিতামহ কেন কৌরবের হয়ে লড়াই করলেন, যদি কৌরবরা দোষী হয়?’
ধীরে মাথা সঞ্চালন করে বৃদ্ধ বলেন- ‘ইহার মানে, যখন তুমি বড় হও, তোমার ধারণা বয়স্ক মানুষদের প্রতি বদল হতে থাকে। ছেলেবেলায় যে বয়জ্যেষ্টদের মনে হত তারা সঠিক, বড় হয়ে বুঝতে পার, ততটা ঠিক নন তারা। তাদেরও দোষ আছে।
এবং একটা দিন আসে যখন তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাদের সঙ্গ তোমার জন্যে ভাল কি মন্দ। তারপর এটাও হয়ত তুমি উপলব্ধি কর একটা সময়, তাদের সাথে লড়াই করাই তোমার জন্যে মঙ্গলের। বেড়ে ওঠার ইহাই সবচাইতে কঠিন পক্ষ এবং সেইজন্যেই গীতার সারমর্ম জানা দরকার।’
বাকরূদ্ধ হইয়া সঞ্জয় মাটির ওপর হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়েন। ইহার কারণ এই নয় যে এই বাণী ক্লান্তিজনিত তাঁর কাছে বরং এই দর্শনের মাত্রাধিকতায় তিনি অভিভূত হইয়া পড়েন।‘তাহলে কর্ণকে কি বলবেন?’
– ‘আহ্! তুমি সর্বোত্তম প্রশ্ন সবার শেষে করেছ। কর্ণ তোমার ইন্দ্রিয়দের ভ্রাতা। সে বাসনা। সে তোমারই এক অংশ কিন্তু সে সঙ্গ দেয় দোষের। যদিও সে দোষীর সঙ্গ দিয়ে মনে মনে পীড়া অনুভব করে কিন্তু নিজেকে ঠিক সাব্যস্ত করার জন্যে নানান যুক্তি দেয়।
ঠিক যেমন তোমার বাসনা সর্বক্ষণ তোমায় যুক্তি যুগিয়ে চলে। তোমার বাসনা তোমায় মিথ্যে যুক্তি দিয়ে মন ভোলানোর চেষ্টা করে না কি সর্বদা?’
সঞ্জয় নিঃশব্দে মাথা নাড়ান। এক দৃষ্টিতে তিনি কুরুভূমির দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে তাঁর লক্ষ-কোটি চিন্তা তোলপাড় করে। প্রতিটি কথা গুছিয়ে তিনি সামঞ্জস্য তৈরি করার চেষ্টা করেন। খানিক বাদে যখন তিনি মাথা তোলেন, বৃদ্ধ তখন সেখান থেকে প্রস্থান করেছেন। ধুলোর স্তম্ভে আবার মিলিয়ে গেছেন।
পেছনে ফেলে রেখে, এক চিলতে জীবনদর্শন!
……………………………
পুনপ্রচারে বিনীত: আবুতালেব পলাশ আল্লী
মা শাহে সেতারার রওজা বা দরবার শরিফ
খুলনা, বাংলাদেশ।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………….
আরও পড়ুন-
দর্শনের ইতিহাস বিচার
আইয়োনীয় দর্শন
টোটেম বিশ্বাস
নির্ধারণবাদ
বিতণ্ডাবাদী
অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদ
জনগণের দর্শন ও বস্তুবাদী দর্শন
লোকায়ত ও সাংখ্য
লোকায়ত, বৈষ্ণব, সহজিয়া
প্রকৃতিবাদী দার্শনিকবৃন্দ