শ্রীরামকৃষ্ণ যে আমার একান্ত নির্ভর ও গতি! তাঁর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে আমি চলেছি। শ্রীরামকৃষ্ণ সাধারণ বুদ্ধির জ্ঞানগোচর হবার নন, তিনি এতই মহান। তিনি স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে দিয়ে জগতে প্রকট হয়েছেন। স্বামীজীর শিক্ষার আলোক ব্যতীত শ্রীরামকৃষ্ণকে বুঝতে যাওয়া পাগলামি মাত্র।
শ্রীরামকৃষ্ণ-সন্তানগণের পবিত্রসঙ্গ একটা দুর্লভ সুযোগ। জন্মজন্মান্তরের সুকৃতির ফলে তাঁদের আশীর্বাদ লাভ হয়। যাঁরা আশীর্বাদ লাভ করেছেন, তাঁরা প্রকৃতই ভাগ্যবান।
ঠাকুরের ধ্যান কর। ধ্যান করলেই তাঁর ভাবগুলো ভেতরে ঢুকবে। ঠাকুরের আশ্রয়ে যখন এসে পড়েছ, তখন তাঁর কৃপা নিশ্চয় পেয়েছ জানবে। যতদিন এ শরীরটা আছে, কেবল তাঁর নাম করে যাও। সবচেয়ে সহজ সাধন-সর্বদা তাঁর স্মরণ-মনন।
জপধ্যান দ্বারাই কুণ্ডলিনীর জাগরণ হয় ইহাই সর্বাপেক্ষা সহজ উপায়। আবার গুরুর কৃপায় তো উহা হয়ই, এমন কি ব্রহ্মজ্ঞান পর্যন্ত হয়। গভীররাতে জপ করতে হয়, আর না হয় ব্রাহ্মমুহূর্তে ও সন্ধ্যায়। জপের সঙ্গে ইষ্টের ধ্যান করবে।
শীতকালই ধ্যানজপের সময়। ধ্যানে প্রথমে কল্পনার সাহায্য নিতে হয়, পরে উহা সত্যে পরিণত হয়। উহা হতে সত্য-উপলব্ধি হয়।
ধ্যানকালে ইষ্টমূর্তিকে জ্যোতির্ময় ভাবতে হয়— যেন তাঁর জ্যোতিতে সব আলোকিত। ধ্যান যতই জমবে, ততই ভেতরে আনন্দ। তাঁর দিকে মন যত বেশী যাবে, আনন্দ তত বেশী হবে। তার সংসারের দিকে, ভোগের দিকে মন যত বেশী যাবে, ততই দুঃখ-কষ্ট বেশী হবে। প্রথম প্রথম ধ্যান তো মনের সঙ্গে যুদ্ধ। মনের স্বভাবতই হচ্ছে এই যে ভগবৎভাব থেকে টেনে এনে বিষয়ে নাবিয়ে দেওয়া।
ব্রাহ্মমুহূর্তে সুষুম্না নাড়ীর ক্রিয়া আরম্ভ হয় বলে দুই নাকে নিশ্বাস বইতে থাকে, তাই মন স্থির হয়। সাধারণত হয় ইড়া, না হয় পিঙ্গলা দ্বারা শ্বাস বইতে থাকে, তাতে মন চঞ্চল হয়। অমাবস্যা, পূর্ণিমা, অষ্টমী তিথিতে এবং কালীপূজা, দুর্গাপূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজার দিনে বিশেষ করে জপধ্যান করতে হয়।
নামই এ যুগের সাধন। ভগবান ও তাঁর নাম অভিন্ন। যদি আকুল হয়ে একমনে শুধু তাঁর নামই জপ করা যায়, তবে তাতেই মুক্তিলাভ হয়। নামের অসীম শক্তি। নামের আগুন জ্বলে উঠলে ভেতরকার সমস্ত জঞ্জাল পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। জপের সময় না পেলেও স্মরণ-মনন ছাড়বে না। সারাদিনের মধ্যে দু’ঘণ্টা সময় অন্তত দেওয়া চাই।
নামের শক্তিতে ভোগবাসনা কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। যারা কাতর হয়ে ডাকে, ভগবান তাদের সংসারের ঝামেলা ক্রমেই কমিয়ে দিয়ে শেষকালে রেহাই দেন। সংসারে থেকেও জানবে, এ আমার ঠিক ঘর নয়, একটা বাসা মাত্র। শ্রীভগবানের পাদপদ্মই আমার আসল ঘর। যে কোন প্রকারেই হোক, সেখানে আমাকে যেতে হবে। মন্ত্র নামের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছুই নয়।
শিষ্যের জ্ঞানলাভ না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত গুরু যিনি তিনি শিষ্যকে পথ দেখাবার জন্যে, তার মুক্তির জন্যে অপেক্ষা করেন। প্রকৃত গুরু বস্তুতেই শিষ্যগণের ভার গ্রহণ করেন, অলৌকিক উপায়ে তিনি শিষ্যকে রক্ষা করেন। সদ্গুরু মন্ত্রদানকালে সেই মন্ত্রের সঙ্গে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক শক্তি শিষ্যে সঞ্চার করেন। তা দ্বারা অপেক্ষাকৃত অল্প চেষ্টায় ও অল্প সাধনায় শিষ্য কৃতকার্য হন।
গুরুতে আশ্রিত শিষ্যের কোন অমঙ্গল হতে পারে না। গুরুর কৃপায় তার চতুর্দিক লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা। কোন বিশেষ উন্নত মহাপুরুষের সঙ্গে বিশেষ আধ্যাত্মিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হলে, তাঁর জীবনে উপলব্ধ সত্যগুলি অনায়াসে নিজ জীবনে আয়ত্ত করার সুবিধা হয়।
‘কাম জয় করবো, ক্রোধ জয় করবো’ বলে চেষ্টা করলে রিপু জয় করা যায় না। ভগবানে মন দিলে ও-সব আপনা থেকেই কমে যায়।
……………………………………………
স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর কথা ‘অমিয়বাণী’ গ্রন্থ ‘ বর্তমান পত্রিকা ‘ থেকে….
স্বামীজীর শিক্ষার আলোকে শ্রীরামকৃষ্ণ
পুণঃপ্রচারে বিনীত –
প্রণয় সেন