মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ নাম-কীর্ত্তনের দ্বারা জীবের মুক্তি বিধান করিতে চাহিয়াছেন, ইহা সত্য। তিনি নিজেই ত্রিসত্য করিয়া বলিয়া গিয়াছেন-
হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্,
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা।
কিন্তু নামই একমাত্র গতি বলিলে ইহা বুঝা যায় না যে, নামজপ বর্জ্জনীয় এবং উচ্চরব করিয়া নামকীর্ত্তনই একমাত্র করণীয়। যদি উচ্চকীর্ত্তনেই সব হইত, তবে বৈষ্ণবধর্ম্ম প্রচারকারী কীর্ত্তণীয়া বাবাজী মহাশয়েরা আবার পৃথক নামজপে বসেন কেন, মৃদঙ্গ ও করতাল অক্ষত থাকিতে মালা-ঝোলার বোঝাই বা বহন করেন কেন?
ইহা হইতেই বুঝিতে পারিবে, কোন্ সাধন শ্রীগৌরাঙ্গদেবের অধিকতর অভিপ্রেত ছিল। বস্তুত, নাম-কীর্ত্তন বস্তুটা ধর্ম্মপ্রচারের অঙ্গ-স্বরূপ। কীর্ত্তন বস্তুটা সাধনের সহায়ক, সাধনের রুচিবর্দ্ধক এবং অসাধককে হরিনামের প্রতি আকৃষ্ট করিবার অব্যর্থ ঔষধ। কিন্তু জপই সাধনের মূল অঙ্গ। মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মহাশয়ের ন্যায় মহাপুরুষরা কীর্ত্তনকে প্রচারের অঙ্গস্বরূপই গ্রহণ করিয়াছিলেন।
পরহিত তরে কর নাম-সঙ্কীর্ত্তন,
আত্মহিত তরে জপ অন্তরঙ্গ ধন।
উচ্চকীর্ত্তন ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মহাশয় নাম-সাধনকেই জীবের উদ্ধারের একমাত্র উপায় বলিয়া গিয়াছেন। কিন্তু বাবা ‘শ্রীশ্রীসদ্গুরু-সঙ্গ’ গ্রন্থ পড়িলেই দেখিতে পাইবে, শ্বাসে-প্রশ্বাসে নামজপ কথাটার উপরেই তাঁর সমস্ত জোর।
চীৎকার করিয়া শ্বাস-প্রশ্বাসে জপ চলে না! নামে আস্থাহীন অজ্ঞান জীবকে ভগবানের পানে টানিয়া আনিবার জন্য তিনি দোর্দ্দণ্ড বিক্রমে কীর্ত্তন করিয়াছেন, কখনো ভক্তরাজ হনুমানের ন্যায়, কখনো মহারুদ্র শিবের ন্যায়, কখনো ত্রিভঙ্গ-বঙ্কিম মুরারির ন্যায় মৃদঙ্গের তালে তালে নৃত্য করিয়া হরি-নামের পাপহারী হুঙ্কারে মেদিনী কাঁপাইয়াছেন, কিন্তু আর্ত্ত জীব যখন তাঁর শরণাগত হইয়া পায়ে পরিয়া কাঁদিয়াছে, তখন দিয়াছেন উপদেশ নীরব সাধনার, গোপন জপের।
কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীকে বারংবার তিনি বাক্য-কথন কমাইতে উপদেশ দিয়াছেন, নিজে এক বৎসরকালের জন্য একেবারে মৌনী হইয়া নিরন্তর নাম জপিয়াছেন, একবার কোনও কারণে মৌনচ্যুত হইয়া পরিলে খড়মের আঘাতে করিয়া নিজের কপাল নিজে ফাটাইয়া রক্তপাত করিয়াছেন এবং শিষ্যমাত্রকেই শ্বাস-প্রশ্বাসে নামজপ করিতে বারংবার মিনতি করিয়াছেন। অসম্যগ্দর্শী সমালোচকের বৃথা বাচালতায় আসল কথা ভুলিও না বাপধন!
উচ্চকীর্ত্তন ও প্রভু জগদ্বন্ধু
আধুনিক বাংলায় ফরিদপুরের শ্রীশ্রীজগদ্বন্ধু-সুন্দরের আবির্ভাব একটা নিতান্ত নগণ্য ঘটনা নহে। প্রভু জগদ্বন্ধুর অনুবর্ত্তীদিগের সংখ্যাল্পতা দ্বারা তাঁহারা জীবনের মহিমার পরিমাপ করা ভ্রম হইবে। কোন অলৌকিক অনুভূতি ব্যতীতও সাধারণ দৃষ্টিতে জগদ্বন্ধু-সুন্দরের দিকে যে কেহ তাকাইয়াছে, সেই মুগ্ধ হইয়াছে এবং তাঁহার চরণতলে মাথা নত করিয়াছে।
কীর্ত্তন ইঁহার ব্রহ্মাস্ত্র ছিল
অপরাহ্ণে বহু প্রবীণ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা শ্রীশ্রীবাবামণির শ্রীপাদপদ্মদর্শনে শুভাগমন করিয়াছেন। একজন প্রশ্ন করিলে শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন, নিজেকে অনাসক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে নিজেকে অবিরাম পরমাত্মার পায়ে সমর্পণ কর্ব্বার চেষ্টা করা।
যে কাজই কর, তাঁর জন্য কর, তাঁর আদেশে কর, তাঁকে সেবা দিতে গিয়ে কর। তাঁর জন্য যে কাজ, তাতে ভালমন্দ নেই, শুভাশুভ নেই, নিন্দা বা প্রশংসার কিছু নেই, তাঁর কাজ সব বিচার-বিবেচনার ঊর্দ্ধদেশে অবস্থিত। তাঁর আদেশ জেনে যে গুলি চালায়, সে হিংসক নয়, তাঁর আদেশ জেনে যে ইন্দ্রিয়-সেবা করে, সে লম্পট নয়, তাঁর আদেশকেই প্রধান করে আর সব-কিছুকে অপ্রধান জেনে চলাই হচ্ছে অনাসক্ত হবার শ্রেষ্ঠ উপায়।
গৃহীকে এইভাবেই পুত্রোত্পাদন কত্তে হবে, সৈনিককে এইভাবেই দেশরক্ষার জন্য লড়াই কত্তে হবে, বিচারককে এইভাবেই অপরাধীর প্রতি দণ্ডবিধান কত্তে হবে, শিক্ষককে এইভাবেই ছাত্র-শাসন কত্তে হবে। অস্ত্রচিকিত্সক যখন রোগীর শরীরে ছুরি চালায়, তখন আঘাত করাটায় তার লক্ষ্য থাকে না, লক্ষ্য থাকে রোগ-নিরাময়ে, সুতরাং প্রয়োজনের অতিরিক্ত আঘাত সে করে না, প্রয়োজনের চেয়ে কম করেও ক্ষান্ত হয় না।
তেমনি ভালমন্দ প্রত্যেক কাজে ঈশ্বরের সেবাকেই প্রধান জেনে, তাঁর জন্য যে অবস্থার লোকের পক্ষে যেরূপ কার্য্য কর্ত্তব্য হবে, সে তা অকুণ্ঠিত চিত্তে করে যাবে, এই হচ্ছে অনাসক্ত হবার প্রধান উপায়। গৃহীর পক্ষে পুত্রোত্পাদন অধিকাংশ স্থলে কর্ত্তব্য, অথচ পুত্রোত্পাদনে ইন্দ্রিয়চর্চ্চা অবশ্যম্ভাবী-এমত অবস্থায় ভগবত্প্রীতিকে প্রধান করে ইন্দ্রিয়ের চর্চ্চাকে গৌণ ব্যাপার করে, ভগবত্-প্রীতির জন্য যা করা দরকার, স্বচ্ছন্দে সে করবে, অননুতপ্ত হ’য়ে করবে।
সৈনিকের পক্ষে দেশরক্ষা করাই প্রধান কর্ত্তব্য, অথচ দেশরক্ষার ব্যাপারে আততায়ি-দলন বা শত্রুহত্যা একান্তই অবশ্যম্ভাবী, এমত অবস্থায় ভগবত্-প্রীতিকে প্রধান করে যুদ্ধবিদ্যাকে গৌণ করে ভগবানের প্রীতির জন্য যা’ করা আবশ্যক, সে তা নির্ভয়ে নিঃসঙ্কোচে কর্বে।
জগত্কে অলীক ব’লে যতক্ষণ না সত্যি অনুভূতি হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজ নিজ আশ্রমোচিত কর্ত্তব্যও লোককে কত্তে হবে, আবার তার মাঝে ঈশ্বর-সমর্পণের ভিতর দিয়ে অনাসক্তভাবও বজায় রাখতে হবে। অন্নবস্ত্রের যতদিন প্রয়োজন থাকবে ততদিন কৃষিবিদ্যার চর্চ্চার প্রয়োজনীয়তা থাকবেই, যে বিদ্যার চর্চ্চা আছে বলেই জগতে ভূমির সীমানা নিয়ে আবার লড়াইও চল্তে বাধ্য।
পুত্রলাভের প্রয়োজন যতকাল থাকবে, ততকাল পুত্রলাভানুকূল ইন্দ্রিয়চর্চ্চা থাকবেই, যে চর্চ্চা একটু করলে মানুষের মন চিরকালই আরও একটু কত্তে লিপ্সু হতে চাইবেই; রাষ্ট্রের যতকাল প্রয়োজন থাকবে, ততকাল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সৈনিক থাকবেই, যাদের যুদ্ধ-বিদ্যার চর্চ্চা আত্মরক্ষার মৌলিক প্রয়োজনকে বারংবার লঙ্ঘন করে পররাষ্ট্রলোলুপতায় পরিণত হতে চেষ্টা কর্ব্বে। আকার থাকলে তার বিকার আছে।
এই অবস্থায় এ সব বিকারের প্রধান ঔষধ হচ্ছে, অনাসক্ত হয়ে কাজ করা, কর্ত্তব্যবোধে মাত্র কাজ করা, কাজের সঙ্গে সঙ্গে নিজের চিত্তপ্রবৃত্তিকে উচ্ছৃঙ্খল হতে না দেওয়া, চিত্তবৃত্তিগুলিকে হাতের মুঠোর ভিতরে পুরে দেখে দরকারমত মাত্র তাদের ব্যবহার করা, বুলডগ্কে যেমন শিকারীরা দরকার মত ব্যবহার করে, অপর সময়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখে। এই যে অনাসক্ত কর্ত্তব্যপালন, তার উৎস হচ্ছে ভগবানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়ার ধ্যান জমান।
……………………………………..
স্বরূপানন্দ পরমহংস দেবের উপদেশ-বাণী অখণ্ড সংহিতা থেকে
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে- ভারতের সাধক সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত – প্রণয় সেন