ভবঘুরেকথা
সুভাষ চন্দ্র বসু

“মা যদি মরিয়া যান, তবে মার গল্প করিতে কত আনন্দ। আর এই আমাদিগের সর্ব্বসাধারণের মা জন্মভূমি বাঙ্গালাদেশ, ইঁহার গল্প করিতে কি আমাদিগের আনন্দ নাই? আইস, আমরা সকলে মিলিয়া বাঙ্গালার ইতিহাসের অনুসন্ধান করি। যাহার যত দূর সাধ্য, সে তত দূর করুক। ক্ষুদ্র কীট যোজনব্যাপী দ্বীপ নির্মাণ করে।”
বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (বঙ্কিম রচনাবলী ২য় খণ্ড পৃ ২৯১। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ ১৪২৩)

বঙ্কিমের এই বক্তব্যে যে তুলনাটা আছে, সেটা বাঙালির অতীতকে একটা জনগ্রাহ্য, সহজবোধ্য প্রতিকৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। যে অতীত বিগত, তার আলোচনা করে একটি জাতি সত্যিই আনন্দিত হয়, যেমন প্রয়াত মাতাকে নিয়ে আলোচনায় সন্তানদের চিত্তসুখ। অতীতকে একজন আইকনের মাধ্যমে আত্মস্থ করার প্রয়াস যে কোনও জাতির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এবং বাঙালির ক্ষেত্রে অতীতের সেই একজন আইকনের নাম সুভাষচন্দ্র বসু।

এক ফেসবুক গ্রুপে একবার পোলিং করে দেখা গেছিল যে সুভাষ বসু বিপুল ভোটে জনপ্রিয়তম বাঙালির শিরোপা পেয়েছিলেন (তাঁর জনপ্রিয়তা পরবর্তী তিনজন জনপ্রিয় আইকন বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথের এবং বিদ্যাসাগরের থেকেও অনেকটা বেশি)। এই তালিকার সীমাবদ্ধতা নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য।

প্রথম পাঁচজন আইকনের চারজনই গত দুশো বছরের মধ্যে জন্মেছেন, সবাই পুরুষ, দুজন কায়স্থ দুজন ব্রাহ্মণ, মধ্যযুগ থেকে একমাত্র চৈতন্যদেব এই তালিকায় পঞ্চমস্থান করে নিতে পেরেছেন, আদিযুগের কেউ প্রথম পাঁচজনের মধ্যে আসেন নি, প্রথম দশজনের মাত্র একজন আদিযুগের (অতীশ দীপঙ্কর)।

বস্তুত চৈতন্যদেব আর অতীশ না থাকলে খুবই নিরাপদভাবে বলে দেওয়া যেত যে আইকন বাছার সময় বাঙালি স্মরণে রাখতে ব্যর্থ হয় যে ইংরেজ আমল শুরু হওয়ার আগেও তার একটা ইতিহাস ছিল। কাজেই এই তালিকা আমাদের আইকনদের সম্পর্কে কোনও মূল্যায়ন নয়, বরং বর্তমানকালের বাঙালির চিন্তাভাবনা ও মানসিকতার একটি প্রতিফলন।

সেজন্যই এই তালিকায় সুভাষের প্রথম স্থান বাঙালির গত একশো বছরের ঐতিহাসিক ট্র্যাজেক্টরি থেকে নির্গত বর্তমান বাঙালির অবস্থা বুঝতে সাহায্য করে। এ জিনিস বাঙালির ইতিহাসবিস্মৃতির মধ্যেও অতীতস্মরণের প্রয়াস এবং বাম-বিশ্বমানবিক এস্টাব্লিশমেন্টের হাতে কোনঠাসা বাঙালির প্রতিরোধ-দুয়েরই দ্যোতক।

সুভাষ মারা গেছিলেন এমন সংবাদ বাঙালির কাছে এসেছিল, যদিও তিনি মারা যান নি ১৮ই আগস্ট ১৯৪৫-এ। প্রায় সমস্ত তথ্যপ্রমাণ সেদিকেই সাক্ষ্য দিচ্ছে বটে, যে ঐদিন সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয়নি, অন্তত প্লেন ক্র্যাশটা হয়নি, কিন্তু আমরা একটি বৃহত্তর অর্থে ধরছি, আমরা বলছি যে সুভাষের মৃত্যুহীন জীবনের সূচনা হয়েছিল সেইদিন, সেজন্য সুভাষের তথাকথিত মৃত্যুদিনটি তাঁর পুনরুত্থানের দিনও বটে।

যেহেতু সুভাষকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ বাঙালি সেদিনই সেই যে হারিয়েছিল সে সুযোগ আর আসেনি, কেবল প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এসেছে ইতিউতি তাঁর প্রত্যাবর্তনের, নয়নের সম্মুখ থেকে সরে গিয়েছেন বলে আরও বেশি করে নয়নের মণি হয়ে উঠেছেন সুভাষ।

সুভাষ আর ঘরে ফেরেন নি, তাই আমাদের ঘর সুভাষময় হয়ে উঠেছে। সুভাষের অনুপস্থিতি এবং বাঙালির সুভাষপ্রীতি– এই দুই প্রবণতা জাক্সটাপোজড হয়ে যেন একটা শূন্য-করুণা, পুরুষ-প্রকৃতি ডায়াড তৈরি করেছে। এরপরে ট্রান্সফার অভ পাওয়ারের ভারতে ক্রমাগত কোনঠাসা হতে থাকা বাঙালি ১৯৪৫-এ নিরুদ্দিষ্ট সুভাষকে গ্রহণ করবে তার হারিয়ে যাওয়া মিথিক্যাল স্বর্ণযুগের প্রতীক হিসেবে, এবং সেই স্বর্ণযুগের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় থাকবে বাঙালি।

বাঙালি জাতি বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্রের সময় থেকেই আদর্শ পুরুষের জন্য প্রতীক্ষারত। শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথ যেমন সাহিত্যের অমরাবতীর চরিত্র বা সব্যসাচী যেরকম আদর্শ অগ্নিযুগের চরিত্র, সুভাষও সেরকম পুরুষোত্তম, ubermensch হয়ে উঠেছেন। সারা ভারতের জন্যই বটে।

‘ঘোষ-ধরের কনানড্রাম বইয়ে’র একটি চ্যাপ্টারের নামই Der Ubermensch. তবে সুভাষের শূন্যস্থান বাঙালির জন্য লাকানিয়ান রিয়েলের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ, ঈশ্বরের মত, ধরাছোঁয়ার মধ্যে পাওয়া অসম্ভব। অথবা মার্ক্স যেমন বলেছিলেন ধর্ম সম্পর্কে, সুভাষ বাঙালির জন্য তাই হয়ে উঠেছেনঃ হার্ট অভ দ্য হার্টলেস কন্ডিশন, সৌল অভ দ্য সৌললেস ওয়ার্ল্ড – আত্মাহীন জগতের আত্মা, হৃদয়হীন পরিবেশের হৃদয়।

সুভাষ এভাবে নির্যাতিত বাঙালি জাতির ধর্মে পরিণত হয়েছেন। সর্বোপরি, সুভাষ বাঙালির বিদ্রোহের প্রতীক, বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠেছেন, যে বিপ্লব আর আসে নি, তবুও বাঙালি সে বিপ্লবের প্রতীক্ষায় থেকেছে।

এভাবে তার প্রিয় আইকন সুভাষকে বাঙালি অনবরত খুঁজে গেছে, অপেক্ষায় থেকেছে সুভাষের ফিরে আসার মুহূর্তের। সুভাষ এভাবে মৃত্যুঞ্জয় হয়েছেন, কারণ বিস্মৃতিই মৃত্যু, আর সুভাষের অনুপস্থিতিতে বাঙালি তাঁকে নিরন্তর খুঁজেছে, এক মুহূর্তের জন্যও বাঙালি তার প্রিয় আইকনকে বিস্মৃত হয়নি।

সেজন্য সুভাষ ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে মরেন নি। আমরা বলতে চাই সুভাষের মৃত্যুহীন জীবনের সূচনা হয়েছিল তাঁর অন্তর্ধানের ফলে। সেই মৃত্যুহীন জীবনের একটি অতি সংক্ষিপ্ত প্রয়াস আমরা এই লেখায় পাব। ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং-এর ইউটিলিটারিয়ান উদ্দেশ্য নিয়ে এ প্রবন্ধ রচিত নয়, অর্থাৎ তথ্যানুসন্ধানের উপযোগিতা স্বীকার করে নিয়েও এ লেখায় সুভাষের প্রত্যাবর্তনের ফেনোমেনন, যা ভারতে ও বাংলায় একটি প্রতিস্পর্ধা, তার সমস্যাগুলি বোঝার প্রয়াসটাই মুখ্য হয়ে উঠবে। বাঙালির ইতিহাসের রাজনৈতিক-দার্শনিক-সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক গতি বোঝার জন্য আমরা ১৯৪৫ পরবর্তী পুনরুজ্জীবন-পুনরুত্থানের কাহিনীর বিবেচনা-বিশ্লেষণ করব।

সুভাষ কী সন্ন্যাসী হতে পারেন? হ্যাঁ, তাঁর মধ্যে স্পষ্ট আধ্যাত্মিক প্রবণতা ছিল। হ্যাঁ, অগ্নিযুগের একাধিকশ্রেষ্ঠ সন্তানই সন্ন্যাসী হয়ে গেছিলেন। ‘কনান্ড্রাম’ লেখকদ্বয় উল্লেখ করেন ১৯২৮ সালে গান্ধী এবং অরবিন্দের আধ্যাত্মিকতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন (৬৬৮-৯)। কাজেই সুভাষের সন্ন্যাসগ্রহণ একটা আমূল পরিবর্তন, বা মেটামরফোসিস হিসেবে গণ্য করতে হবে, ঘোষ-ধরের এই যুক্তির সঙ্গে একমত হওয়া যায়।

মুখার্জি কমিশনে ফরওয়ার্ড ব্লকের আইনজীবী কেশব ভট্টাচার্য পর্যন্ত তাঁর বই চক্রব্যূহে নেতাজি লেখবার সময় জ্ঞানগঞ্জ এবং তার অলৌকিকত্ব নিয়ে লিখেছেন “পরমসিদ্ধ যোগীদের মহাতীর্থ, সাধনক্ষেত্র দেবতাত্মা হিমালয়ের অত্যন্ত গোপন জায়গা জ্ঞানগঞ্জে রয়েছেন অসংখ্য মহাপুরুষ, দিব্যজ্ঞানী সাধক। সেইসব যোগসিদ্ধ মহাপুরুষগণের কারও বয়স একশ বৎসর, কারও বয়স তারও অনেক অনেক বেশি, জ্ঞানগঞ্জে ঈশ্বর সাধনাতে মগ্ন রয়েছেন” (৬০১-২)।

প্রসঙ্গত ঘোষ-ধরের বই সামান্য উল্লেখ করেছে, প্রথমে গোপীনাথ কবিরাজের জ্ঞানগঞ্জ পুস্তকের, এবং তারপরে গুমনামি বাবার দাবির উল্লেখ যে তিনি জ্ঞানগঞ্জে অতিপ্রাচীন অলৌকিক সাধুদের দেখেছেন (৪৯৩), তবে এই উল্লেখ দুতিন লাইনে সারা হয়েছে, দীর্ঘায়িত করা হয়নি (অনুজ ধরের নিজের বইতে একটি ছোট অধ্যায় ছিল জ্ঞানগঞ্জের ওপরে, শিরোনাম ছিল “সুভাষ বোস অ্যালাইভ অ্যাট ১১৫?” তাতে বলা হয়েছিল যে সুভাষ এই জ্ঞানগঞ্জে গিয়ে আজও বেঁচে আছেন)।

‘ওই মহামানব আসে’ গ্রন্থে যে বক্তব্যগুলো রেখেছেন গুমনামি অর্থাৎ মহাকাল অর্থাৎ ভগবন্‌জি, তার বিশ্লেষণ এবার না করলেই নয়। এই নামটির বঙ্গীকৃত রূপ ভগবানজি প্রথমবার ওই মহামানব আসে সঙ্কলনে দেখা যাচ্ছে জয়শ্রী পত্রিকায় ২০০৪ সালে প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয়তে।

ওই মহামানব আসে গ্রন্থে তার আগের কোনও তারিখের লেখায় আমার চোখে ভগবানজি শব্দটি পড়ল না। তার আগে তিনি মহাকাল, মৃত ভূত, পথিক ফকির ইত্যাদি নামেই অভিহিত।

সম্ভবত একুশ শতকের শুরুতে মুখার্জি কমিশনের প্রতিবেদন এবং অনুজ ধরের লেখালেখিতে এই অবাঙালিদের দেওয়া ভগবন্‌জি নামটি জনপ্রিয় হয় গুমনামি ভক্তদের মধ্যে। অবাঙালিরাই পঞ্চাশের দশকে এই নাম ধরে প্রথম ডাকতে শুরু করেছিল (কনান্ড্রাম ৫৪৯)।

১৯৬৯ সালের একটি লেখায় ‘চারণিক’ আক্ষেপ করছেনঃ “পথ বেয়ে চলেছি, দৃষ্টি বাধা পায়, ‘বাঙ্গালী গর্জে ওঠো’, ‘জাগো বাঙ্গালী’।”

কিন্তু হায় কোথায় ঘুম-ভাঙ্গা বাঙ্গালীর দল। কোথায় জাগ্রত বীর বাঙ্গালী” (৪২)। এরপরেই নাটকীয়ভাবে মহাকালের বেশে “সুভাষ” আশ্বস্ত করছেনঃ “যে মাতৃসাধনা চরিতার্থ করতে সূক্ষ্ম দেহে শয়তান ইংরেজের পাপচক্রের ব্যূহ ভেদ করে অদৃশ্য হয়েছিল, সে সাধনা পূর্ণ হতে বাকী নেই।

…এবার রুদ্রের ভূমিকায় আমার এই জীর্ণমৃত শরীর তোমাদের কষাঘাত হানবে। আমার দেশ, আমার জননী জন্মভূমি এবার স্ব-ভূমিকায় অধিষ্ঠান করবেই” (৪২-৩)।

বাঙালির বিংশ শতক একটি বিস্তৃত শ্মশান, সেখানে সে অনবরত পুড়েছে, তার মেধা তার সংস্কৃতি নিয়ে সে পুড়েছে, তার সর্বাঙ্গ পুড়ে গেছে, সেই তাইহোকুর (কল্প)কাহিনীতে যেমন সুভাষের সর্বাঙ্গ পুড়েছিল, বাস্তবে বাঙালি সেভাবে পুড়েছে, কিন্তু তার মধ্যেও সে তার ঘরের ছেলেকে ভোলেনি একদিনের জন্যও।

বাঙালি মনে করে রেখেছে, এ যন্ত্রণা অনবরত সে লালন করে গেছে, যে সুভাষ আজও ঘরে ফেরে নি। এবং মা কালী চাইলে একদিন বাঙালি তার ঘরের ছোট্ট ছেলের ওপরে হওয়া সমস্ত অন্যায়ের শোধ অবশ্যই নেবে।

বাঙালি আজও সুভাষকে তার অন্য সব আইকনের থেকে বেশি ভালোবাসে, এবং সুভাষের অনুগামীদের এ কথা বিস্মৃত হওয়া অন্যায়, কারণ সুভাষ যে সম্মান পেয়েছেন, আমরা রত্নপ্রসবিনী বঙ্গমাতার সন্তানরা সে সম্মান আর কাউকে দিইনি, সুভাষের জন্য বাংলামায়ের আসন পাতা আছে আজও।

চৈতন্যর আগে, বঙ্কিমের আগে, ধর্মপাল দেবপালের আগে, অতীশের আগে, বিদ্যাসাগরের আগে, রবীন্দ্রনাথের আগে – সবার আগে সুভাষের আসন আমরা রেখেছি, আমাদের ঘরের সবথেকে ছোট যে ছেলেটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আজও ফেরেনি, আমরা বাঙালিরা তার জন্য আসন পেতে আজও তার প্রতীক্ষায় আছি। এই সম্মান হিমালয়ের থেকেও বেশি ভারি।

……………………………………………
* “আমি আমার theory বলবো, তার স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণও খাড়া করবো, আপনার যুক্তিগ্রাহ্য মনে না হলে আপনি মানবেন না…”

………………………..
ঋণস্বীকার-
২) কেশব ভট্টাচার্য। চক্রব্যূহে নেতাজি। কলকাতাঃ নেতাজি রিসার্চ ফোরাম, ২০১২।
৩) শ্যামল বসু। সুভাষ ঘরে ফেরে নাই (৩ খণ্ড একত্রে)। কলকাতাঃ রিফ্লেক্ট, ২০০৮।
৪) চন্দ্রচূড় ঘোষ ও অনুজ ধর। কনানড্রামঃ সুভাষ বোসে’জ লাইফ আফটার ডেথ। নিউ দিল্লিঃ বিতস্তা, ২০১৯।
৫) চারণিক। ওই মহামানব আসে (পরিবর্ধিত অখণ্ড সংস্করণ)। কলকাতাঃ জয়শ্রী প্রকাশন, ২০১০।
৬) নারায়ণ সান্যাল। নেতাজি রহস্য সন্ধানে।কলকাতাঃ দে’জ পাবলিশিং, ২০০৩।

পুণঃপ্রচারে বিনীত -প্রণয় সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!