নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : তিন
-সুকুমারী ভট্টাচার্য
তত্ত্ব অনুযায়ী তীর্থযাতপ্রা এবং ব্রতরক্ষার ফলেও কেবল এ জন্মের নয়। বহু পূর্ব জন্মের অজস্র পাপমোচন হয়। সুতরাং তত্ত্বগত ভাবে তারা ভাগ্যকে অস্বীকার করছে। কিন্তু স্বর্গ-নরকের ধারণা কখনওই সুস্পষ্ট রূপে ঘোষিত হয়নি, সুতরাং মৃত্যুর পরে মানুষের ভাগ্য বিষয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। প্রান্তি, কর্তব্যে অবহেলা এবং অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো অসংখ্য বিপদের সম্ভাবনা সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে।
আর একটি বিষয়ে এই সময়ে পুরোহিত এবং জাদু চিকিৎসক উভয় গোষ্ঠীই মন দিয়েছিলেন। এটা হল ভবিষ্যদ্বাণী, অমঙ্গলচিহ্ন, কুলক্ষণ, স্বপ্ন, ইত্যাদি, যা কিছুকে অশুভ ঘটনার পূর্ব সূচনা বলে মনে করা হয় এবং ওই সব অমঙ্গলকে এড়ানোর জন্য যার বিরুদ্ধে ধর্মানুষ্ঠানমূলক প্রতিষেধক গ্রহণ করা উচিত।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ (৩৩ অধ্যায়) এবং ভাগবত পুরাণ (৩:১৭)-এ আমরা দুলক্ষণ এবং অমঙ্গল চিহ্নের দীর্ঘ তালিকা পাই। ভাগবত-এ দৈত্য হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপুর জন্মের সময় বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। মহাভারত-এর মুখ্য চরিত্রগুলির জন্মকাল এবং যখন তারা যুদ্ধযাতপ্রা করছে- যে যুদ্ধে তারা ঘটনাক্রমে মৃত্যু অথবা বিজয়ের সম্মুখীন হবেসেই সময় বহু প্রকার দৈব লক্ষণের বর্ণনা রয়েছে।
ইলিয়ার্ড কাব্যে দেখা যায়। ভাল এবং মন্দ লক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু বিশ্লেষণে, এই প্রকার শব্দের ব্যবহার আরম্ভ হয়েছে। অমঙ্গল চিহ্ন ও দুর্লক্ষণ সম্পর্কে এই প্রকার মনোভাবের পিছনে এই অনুমান রয়েছে যে, চোখে যা দেখা যায় এবং এর থেকে যার পূর্বাভাস পাওয়া যায়–এই দুইয়ের মধ্যে কোনও অচিন্তিতপূর্ব যুক্তিসম্মত যোগাযোগ আছে; আমাদের চোখ এই আবরণ ভেদ করে দেখতে পায় না, যেহেতু আমরা সাধারণ মানুষ মাত্র।
এই যুক্তিকে দৃঢ় করার জন্য অনেক সময় সন্ন্যাসী, দেবতা ও মহাপুরুষরা লক্ষণ ও স্বপ্ন ব্যাখ্যা করে থাকেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, দুর্লক্ষণতত্ত্ব উপলব্ধি করার জন্য সংগুপ্ত জ্ঞান, যোগসিদ্ধ ক্ষমতা বা অতিলৌকিক ক্ষমতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
ভারতবর্ষে সেই অর্থে দৈব্রত্যাদেশের পীঠস্থান নেই, কারণ এখানে সন্ন্যাসী ও মহাপুরুষরাই দৈবপ্রত্যাদেশ দিয়ে থাকেন। মানুষ উদভ্রান্ত মানসিক অবস্থায় বা কোনও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে পূর্বাভাসের আত্যন্তিক প্রয়োজনে, অথবা তাদের কোনও প্রচেষ্টায় বাধা পেয়ে সাধু সন্তের কাছে যায়, যাঁরা তাদের জন্য আধ্যাত্মিক উপায় খুঁজে বার করেন।
আমাদের ডোডোনা (দেবী স্থান) অধিকাংশ ক্ষেতপ্রেই মন্দিরের পুরোহিতকূল, যাঁরা শরণার্থীদের প্রার্থনা কী ভাবে পূর্ণ হবে বা আন্দীে হবে কি না তা দেখাবার জন্য কোনও আনুষ্ঠানিক শুদ্ধি, ব্রত বা পুণ্য কাজের অনুষ্ঠান করতে বলেন। সম্ভাবনার সূত্র অনুযায়ী কয়েকটি ক্ষেতপ্রে তা সফলও হয় এবং বলার অপেক্ষা থাকে না যে, ব্যর্থতার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য প্রচুর ভুলভপ্রান্তির সুযোগও থাকে।
আবার কোনও অতিপ্রাকৃত কার্যকলাপে–যেখানে মধ্যবতী হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা (অবশ্যই রহস্যময় ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে) রয়েছে–সেই সব কার্যে বিশ্বাস জন্ম নেয়; যেহেতু এই সব ক্রিয়াকলাপ, শক্তি এবং ভবিষ্যদ্বাণীর পদ্ধতি সব কিছুই অস্পষ্ট, সে জন্য মনে করা হয়। এগুলি ভাগ্যেরই বহুবিচিত্র প্রকাশ।
কিন্তু গ্রিক ট্র্যাজিক নায়করা যুদ্ধ করেছে দেবতা দ্বারা রক্ষিত সব শত্রুর বিরুদ্ধে, এখানে ধর্মীয় ও সামাজিক শর্ত অনুযায়ী যুদ্ধ সমর্থিত হয়েছে, কারণ তার উদ্দেশ্য কাউকে সাহায্য করা এবং অন্যদের প্রতিরোধ করা তাই এমনকী পরাজিত নায়করাও ভাগ্যের বঞ্চনা অনুভব করে না। কিন্তু ভারতবর্ষে ভাগ্য মানুষের কাছে এক অন্ধ চালিকা শক্তি রূপে উপস্থিত হয়, কেননা, মানুষ নিজেই এই শক্তির উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্ধ।
কালিদাসের রঘুবংশ কাব্যে নিঃসন্তান রাজা দিলীপ কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের কাছে গিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী ও সমাধান প্রার্থনা করেন; তিনি ঋষির উপদেশ মতো আচরণ করেন ও একটি পুত্র লাভ করেন। মহাভারত-এ নারদ মুনি সত্যবানের আয়ু সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন (৩:২৯);
অধিকাংশ পুরাণেই এই ভাবে মহাপুরুষেরা মানুষের দুর্দশার কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের উপায় বলেছেন। এর কারণ এই যে তাদের পবিত্র তপোবল মহাবিশ্বের অধ্যাত্মশক্তির সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মিক যোগ স্থাপন করেছে, ফলে তাঁরা জানতে পারেন, এবং যেহেতু তারা পরিণতি বুঝতে পারেন। তাই তারা কার্যের যথার্থ প্রতিষেধকও নির্ণয় করেন।
পুরাণসম্মত সর্বপ্রকার কুসংস্কার পোষণ করার পক্ষে মানসিক পরিবেশ ছিল একেবারে যথাযথ। জাদু এবং রহস্যময়তার প্রতি বিশ্বাসের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৬ কিন্তু অনির্ণেয় এবং সর্বশক্তিমান নিয়তি সর্বব্যাপী জাল বিস্তার করেছিল। সাধারণ মানুষকে পদানত করে, তাকে পুরোহিত ও শাস্তপ্রের নির্দেশ মানতে বাধ্য করেছিল। এর প্রধান অস্ত্র ছিল আতঙ্ক এবং নিয়তির অনির্ণেয়তাই তাকে আরও ভীতিকর করে তুলেছিল।
নিয়তিবাদের তত্ত্ব যখন ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠছে তখন সেই সব শতাব্দীর পর শতাব্দীতেই যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। এই সব শৈব ও বৈষ্ণব আন্দোলনেও প্রায়ই পরোক্ষ ভাবে নিয়তি তত্ত্বকে ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষ করে গোষ্ঠীগত ধর্মতত্ত্বকে মানুষের মনে দৃঢ়মূল করার জন্য যে সব আখ্যান মূলত রচিত হয়েছিল সেগুলির ক্ষেতপ্রে।
এর মধ্যে মুসলিম ধর্মও প্রবর্তিত হয়েছে এবং কিছু মানুষ ধর্মান্তরিতও হয়েছে। কিন্তু জীবনের প্রতি যে গভীর নিয়তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল–যার ফলে মানুষ যে কোনও ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতার আস্ফালন বিনা প্রতিবাদে মেনে নিত তার কোনও পরিবর্তনই হল না।
কেউ যদি দরিদ্র, মৃত, বঞ্চিত বা দুৰ্ভাগ্যজনক অবস্থায় থাকে। তবে এ-ই। তার নিয়তি। বারংবার আমরা এই প্রবচন শুনতে পাই-‘নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে’–ভাগ্যকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। দীর্ঘতর কাব্যে নাটকে বা ধর্মসাহিত্যে আমরা সহস্ৰাধিক শ্লোকে এই একই কথা শুনি–নিয়তির সর্বোচ্চ ক্ষমতার কাছে এই নির্বিবাদ আত্মসমর্পণ।
এ কথা সত্য যে, আমরা এমন বিবরণও পেয়েছি যেখানে মানুষ তার ক্ষমতার প্রমাণ করার জন্য ভাগ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু সেই যুদ্ধের পরিণতিও হয় পরাজয়। মহাভারতে কর্ণ বলেন, দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম মদায়িত্তং তু পৌরুষম–নীচ বংশে জন্ম ছিল ভাগ্যের অধীন। কিন্তু আমার পৌরুষ আমার অধীন।’
কিন্তু মহাকাব্যের সব পাঠকই জানেন নিষ্কারুণ ভাগ্যের বিরুদ্ধে কর্ণের এই যুদ্ধ অনেকাংশে গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কদের মতো; যারা অতুলনীয় বলশালী সব শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, শুধু হেরে যাওয়া যুদ্ধই করে গেছে কেবলমাত্র তাদের মনুষ্যত্বের গৌরব রক্ষা করতে।
কিন্তু গ্রিক ট্র্যাজিক নায়করা যুদ্ধ করেছে দেবতা দ্বারা রক্ষিত সব শত্রুর বিরুদ্ধে, এখানে ধর্মীয় ও সামাজিক শর্ত অনুযায়ী যুদ্ধ সমর্থিত হয়েছে, কারণ তার উদ্দেশ্য কাউকে সাহায্য করা এবং অন্যদের প্রতিরোধ করা তাই এমনকী পরাজিত নায়করাও ভাগ্যের বঞ্চনা অনুভব করে না। কিন্তু ভারতবর্ষে ভাগ্য মানুষের কাছে এক অন্ধ চালিকা শক্তি রূপে উপস্থিত হয়, কেননা, মানুষ নিজেই এই শক্তির উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্ধ।
সুতরাং কোনও মানুষের এ কথা জানার উপায় নেই যে, পবিত্র জীবনযাপন করা সত্ত্বেও তার কেন বিনাশ হল। মাঝে মাঝে মহাকাব্য ও পুরাণের অতিকথাগুলি ভাগ্যের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে হতভাগ্য মানুষকে জ্ঞান দেয়। এই ভাবে ভাগ্যের বোধ বহির্ভূত প্রকৃতি নির্দিষ্ট করে দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেহেতু সামগ্রিক ভাবে অধিকাংশ মানুষের কাছে এই সব ব্যাখ্যা খুবই প্রক্ষিপ্ত ভাবে গ্রহণযোগ্য এবং কোনও কোনও সময়ে এর অস্তিত্বই নেই, তাই কেন তারা এই ভাবে কষ্ট পায় এ বিষয়ে মানুষ সম্পূর্ণ অন্ধকারেই থেকে যায়।
যে সব শক্তি মানুষের ভাগ্যবিধি নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলিকে চেনা অসম্ভব; এই বোধের মারাত্মক চাপ মানুষকে নিস্ক্রিয় করে দেয়। ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় প্রকার নেতৃত্বের কাছেই এই মতবাদ অত্যন্ত সুবিধাজনক। কারণ, এর সাহায্যে সাধারণ মানুষকে নিবীর্য করে আত্মিক এবং বস্তুগত উভয় বন্ধনেই বেঁধে রাখা সম্ভব ছিল।
এই সুদীর্ঘ সময়ে অধিকাংশ মানুষের কাছে জীবন ছিল প্রায় অসহনীয়। কৃষক এবং কারিগর এরা অত্যন্ত্র শ্রমমূল্য পেত। স্বল্পসংখ্যক ধনীর হাতেই সম্পদ রাশি কৃত হত। রাজসভায় রচিত কাব্য ও নাটকের পাতা এদের উপভোগের বিবরণেই আকীর্ণ। সমাজের সর্বোচ্চ স্তর আর সর্বনিম্ন স্তরের জীবনযাতপ্রার মানে এতই পার্থক্য যে, এর জন্য কিছুটা ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
কর্মফল্যবাদ ও জন্মান্তরবাদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত দক্ষতার সঙ্গেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছিল। যেখানে সাধারণ ক্ষেতপ্রে মানুষ অভাব, রোগ, দুর্দশা এবং শোষণের বিরুদ্ধে সরবে। প্রতিবাদ করবে। সেখানে এই সব দুষ্ট মতবাদ সহজেই প্রতিবাদী কণ্ঠকে রুদ্ধ করেছিল। কারণ পূর্বজন্মের কার্যকলাপ অজ্ঞাত, অজ্ঞেয়ই রয়ে যায়, তার তথাকথিত যে ফল মানুষ ইহজন্মে ভোগ করে তাই হল অ-দৃষ্ট।
তবুও মানুষ অবদমন আর শোষণকে প্রতিহত করেছে। কারণ, যে কোনও তত্ত্ব যত দৃঢ় এবং আপাতদৃষ্টিতে যত নিয়ন্ত্রক হোক না কেন তা কখনওই মানুষের জীবনতৃষ্ণাকে সম্পূর্ণ বিনাশ করতে পারে না।
মহাকাব্য ও পুরাণগুলিতে নিয়তি আর স্বাধীন ইচ্ছ–উভয়ের আপেক্ষিক কার্যকারিতা বিষয়ে দীর্ঘ বিতর্ক দেখা যায়। যদি পরিণামবাদকে সম্পূর্ণ ভাবে মেনে নেওয়া হয়, তবে তা জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করে, সুতরাং এ বিষয়ক বিভিন্ন শাস্ত্র গ্রন্থগুলি স্পষ্টতই পরস্পরবিরোধী। প্রথম তাৎপর্যময় শ্লোকটি দেখা যায় মহাভারত-এ, যেখানে আমরা শুনি, চেষ্টা ব্যতীত ভাগ্যনির্ম্মফল; ভাগ্য কোনও ন্যায়বান পুরুষকে কী করতে পারে?
অহংকারী, ক্ষমতাবান পুরুষ ভাগ্যের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন না। এর পর উদাহরণের একটি তালিকা আছে: ‘যেমন করে নিঃশেষিত তৈলপ্রদীপে তেল দিলেও’ প্রদীপ নিভে যেতে থাকে তেমনই যখন কর্ম বিনষ্ট হয় তখন ভাগ্যও দুর্বল হতে থাকে। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে (১১৬-১১৯ পরিচ্ছেদ এবং ১৪৪, ১৪৫ পরিচ্ছেদ) জীবনের নীতিনিষ্ঠ পথ এবং কর্ম থেকে মােক্ষাপ্রাপ্তি ও তার ফলকেই জীবনের সারমর্ম বলে দৃঢ় ভাবে ব্যাখ্যা করে। সমগ্র উনবিংশ পরিচ্ছেদটি হল কর্ম এবং তার প্রভাব সম্পর্কে পর্যালোচনা।
এর প্রথমেই রয়েছে–সৎ বা অসৎ কোনও কর্মই নিঃশেষে অবলুপ্ত হয়ে যায় না, তারা পরিণত হয়। অর্থাৎ যথোপযুক্ত ক্ষেতপ্রে ফলদান করে। এর পরিবর্তে মানুষের নৈতিক দায়িত্ব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়েছে: বহু আখ্যানেই আপাত-অলঙ্ঘ্য প্রতিকূলতার সম্মুখে মানব প্রচেষ্টাকে প্রশংসা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে প্রতিদ্বন্দিতার যোগ্য।
কিন্তু এক প্রকার বিপরীত অর্থাৎ নিয়তিবাদী মনোভাব, যার অন্তলীন ইঙ্গিত হল সচেতন ভাবে এমনকী স্বেচ্ছায় এক অপ্রতিরোধ্য অনির্ণেয় শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করা, সেই বোধ অজস্র আখ্যানে ফুটে উঠেছে এবং এই মনোভাবই সাফল্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে এমন এক জগৎ গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া সবই পুর্বনির্দিষ্ট, ফলে কাঁটায় পদাঘাত করলে তা ব্যর্থ হয়েই ফিরে আসে।
এই ভাবে, এই নৈতিক ভাবে দুর্বলকারী মতবাদ বিস্তার লাভ করায় অনেক প্রতিরোধের সম্ভাবনা নিশ্চয়ই বিনষ্ট হয়েছিল। কারণ এই মতবাদ একটি সহজবোধ্য স্তরে মানুষকে বোঝায় যে তার ভাগ্য বা ভবিষ্যৎ অবশ্যই বোধসীমার বহি ভুর্ত, কারণ নিয়তিই সব কিছুর চরম নিয়ন্তা।
যে সব শক্তি মানুষের ভাগ্যবিধি নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলিকে চেনা অসম্ভব; এই বোধের মারাত্মক চাপ মানুষকে নিস্ক্রিয় করে দেয়। ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় প্রকার নেতৃত্বের কাছেই এই মতবাদ অত্যন্ত সুবিধাজনক। কারণ, এর সাহায্যে সাধারণ মানুষকে নিবীর্য করে আত্মিক এবং বস্তুগত উভয় বন্ধনেই বেঁধে রাখা সম্ভব ছিল। এই সব সমাজপতিদের হাতে বহু শতাব্দী ধরে নিয়তিবাদ ছিল এক মারাত্মক বলবান অস্ত্র।
তার চেয়েও আকস্মিক ঘটনাকে বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করার মানসিকতাই নিয়তিবাদ। ভারতবর্ষে এবং অন্যান্য দেশেও বুদ্ধিনির্ভর জীবনযাতপ্রার এক মূর্ত প্রতিবাদ হল নিয়তিবাদ। বিশেষ করে যেখানে যুক্তিনির্ভরতা আর বুদ্ধি দিয়ে কোনও কোনও সমস্যার সমাধান হয় না।
এক ধর্মীয় বাতাবরণ যার মধ্যে আছে অনেকাংশে জাদু, শুভাশুভ লক্ষণ বিচার, দেবত্ব-আরোপ, দৈববাণী, জ্যোতিষ, অভিশাপ আর্শিবাদ এবং সর্বোপরি যে বাতাবরণকে ক্রমশ এক শক্তিশালী পুরোহিত তন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করেছিল- তা সাধারণ মানুষকে এক ভাবে বন্দি করে রেখেছিল। এই কারণেই প্রায় পনেরো শতাব্দী কাল ধরে এই দুষ্ট শক্তি সম্পন্ন মতবাদ সক্রিয় থাকার ক্ষমতা সংগ্রহ করেছিল।
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে নিয়তিবাদ কোনও দার্শনিক তত্ত্ব নয়; এর কোনও ধারাবাহিক বৈজ্ঞানিক জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। কোনও মহাজাগতিক তত্ত্ব, সত্ততত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, কারণতত্ত্ব বা স্বর্গ-নরক বিচার–কিছুই এখানে. নেই। কিন্তু যে সমাজে এই নিয়তিবাদ সৃষ্টি হয়। সে সমাজে এই সব ধর্মীয় ও দার্শনিক মতবাদের উপরই নিয়তিবাদের প্রভাব পড়ে।
অবশ্যই এই মতবাদ আবশ্যিক ভাবে আদিম নয়, কারণ প্রায়ই দেখা. যায় সমাজের যথেষ্ট শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান স্তরেও এর বিস্তার। তবে সাধারণ ভাবে বলা যায়, এর অন্যতম শর্ত হল বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া। যখন প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ে, যখন বস্তুগত সমৃদ্ধির ফলে কারিগরি উন্নতির ফল জনগণের কাছে সহজলভ্য হয়, তখন নিয়তিবাদের ভিত্তি শিথিল হয়ে পড়ে। অধিকাংশ সমাজেই সামগ্রিক ভাবে বস্তুগত সমৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিদ্যার বিস্তার আর নিয়তিবাদের মধ্যে এক প্রকার বিপরীত অনুপাত রয়েছে।
অবশ্য কোনও মানুষের পক্ষে প্রকৃতিবিষয়ে সামান্য অতিকথা–বিরোধী বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার জ্ঞান–নিয়তিবাদের বিরোধিতা করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। কারণ প্রায়ই এই জ্ঞানকে কার্যক্ষেতপ্রে প্রয়োগ করার মতো সহায় তার থাকে না (যেমন ঘটে কৃষক ও কৃষি সারের ক্ষেত্রে)।
কখনও বা অন্তর্নিহিত বাধাই তাকে বৈজ্ঞানিক সাহায্য আসার পরেও নিস্ক্রিয় করে রাখে, বিশেষ করে যখন তার সমগ্র জীবনের চিন্তাধারার সঙ্গে কোনও বিজ্ঞান শিক্ষার একটি স্বতন্ত্র অংশকে সংযুক্ত করার পক্ষে তার নিজস্ব শিক্ষাদীক্ষার স্তরটি প্রয়োজন মতো উন্নত না থাকে (যেমন টিকাকরণ ও পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে)। যতদিন জীবনচর্যার এক বৃহদংশ।
মানুষের সক্রিয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, ততদিন নিয়তিবাদ পল্লবিত হতে থাকে। তার প্রধান কারণ এই যে, জীবন সম্পর্কে এক পুরাণকথানুগ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একে যুক্ত করা সহজ। অন্যান্য বহু দেশের মতো ভারতবর্ষেও এই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রাধান্য দেখা যায়।
নিয়তিবাদের সারমর্ম হল যৌক্তিকতার উপরে আকস্মিকতার, প্রত্যাশিত নিয়ন্ত্রণাধীনের উপর অপ্রত্যাশিতের অচিন্তনীয়ের প্রাধান্য। এর ভিত্তি হল জীবনে আকস্মিক অনায়ত্ত পরিস্থিতি উপস্থিত হওয়ার অতিবাস্তব সম্ভাবনা; এবং জীবনে যে সব ঘটনা যুক্তিসঙ্গত ভাবে প্রত্যাশা করা যায়।
তার চেয়েও আকস্মিক ঘটনাকে বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করার মানসিকতাই নিয়তিবাদ। ভারতবর্ষে এবং অন্যান্য দেশেও বুদ্ধিনির্ভর জীবনযাতপ্রার এক মূর্ত প্রতিবাদ হল নিয়তিবাদ। বিশেষ করে যেখানে যুক্তিনির্ভরতা আর বুদ্ধি দিয়ে কোনও কোনও সমস্যার সমাধান হয় না।
আর একটি শ্লোকে বলা হয়েছে ধর্ম, কাল এবং মৃত্যু সর্বদা একতপ্রে বিচরণ করে। মৃত্যুর বারো দিন পরে একজন মানুষকে যমপুরীতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে মৃত্যু কাল ও অন্তকের মাঝে সে যমকে দেখতে পায়।কালই সর্ব প্রাণীর সৃষ্টি ও ধ্বংসকর্তা, সকলেই কালের অধীন। কিন্তু কাল কারও অধীন নয়।
কালের ক্রম বিচার করলে নিয়তিবাদের উদ্ভব হয় উপনিষদের সমকালে। অন্য ভাবে বলা যায়, মননশীল স্তরের প্রধান অংশ তখন জ্ঞান এবং অধ্যাত্ম-রহস্যকেই জীবন ও বাস্তব সম্পর্কিত একমাত্র সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি রূপে, মোক্ষাপ্রাপ্তির অদ্বিতীয় কার্যকরী ধর্মীয় উপায় রূপে ঘোষণা করেছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিপরীত তত্ত্ব সেই সময় দেখা গেল। অবশ্যই ঔপনিষদিক জ্ঞানের উদ্দেশ্য আর আংকাবাদী অ-দৃষ্ট উভয়ের অস্তিত্ব ভিন্ন মেরুতে।
কিন্তু জ্ঞানের সর্বশপ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করে, নিয়তিবাদ নিয়ে এল জ্ঞানের এক তাত্ত্বিক শূন্যতা। জ্ঞানকে নিক্ষেপ করল অন্ধগলি পথে যেখানে মানুষের ভবিষ্যৎ বাস্তবে অজানা, অজ্ঞেয় থেকে যায়। জীবনে প্রত্যেকটি বিষয়ের যে পূর্বাভাস পাওয়া যায় না, সব কিছু পরিকল্পনা মতো হয় না, আয়ত্তে থাকে না। এই সত্যকে নিশ্চিত করে নিয়তিবাদ।
ক্রমবর্ধমান যুক্তিবাদনিয়ন্ত্রিত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেতপ্রের চেয়েও আকস্মিকতার ভূমিকাকেই সে অনেক বড় করে দেখায়। এই মনোভাব নিস্ক্রিয়তার এবং উদ্যোগহীনতার জনক এবং কিছু দূর পর্যন্ত এই মনোভাব নির্দিষ্ট শক্তির স্বার্থ রক্ষণ করে থাকে।
নিয়তিবাদ যে কোনও সংহত ধর্ম ব্যাখ্যার বিরোধী। যদি দেবতারা মানুষকে সত্য, শিব, সুন্দর ও পূর্ণতার পথের মঙ্গলজনক দিশা দেখান, তারই প্রতিনিধি হয়ে থাকেন তবে ভাগ্য যেখানে ক্রিয়াশীল হবে সেই শূন্যস্থান সৃষ্টি হয় না। মঙ্গলময় দেবতারা যখন মানুষের জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করেন তখন তার পরিণতি হওয়া উচিত। শুধু আনন্দময়।
কিন্তু অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, জীবনের প্রতি এই আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক রুক্ষ বাস্তবের মোচড় আছে। সুতরাং, গ্রীণ যেমন বলেছেন, ‘বস্তু জগতের মর্মে পুরাকাহিনির দেবতাদের মঙ্গলময়তা সম্পর্কে এমনকী নৈতিকতার কোনও মূল্য সম্পর্কে একটি গভীর সংশয়বোধ এমনকী নৈরাশ্যবাদ শুধুমাত্র পুরাণোক্ত দেবতাদের সম্বন্ধে নয়, কিন্তু নৈতিকতার মূল ভিত্তি সম্বন্ধেও অন্তর্নিহিত আছে।
যদি সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহই শুভ শক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে, তবে নিয়তিবাদকে কোথাও স্থান দেওয়া যায় না, বিশেষ করে যেহেতু নিয়তিবাদ স্বাধীন বিচারশক্তি ও পুরুষকারের ভূমিকা অস্বীকার করে। পূর্বনির্ধারণ এবং স্বাধীনবিচারের মতো, ক্যালডিনের পূর্বনির্ণয়বাদের মতো বিতর্কই ভারতীয় মহাকাব্য ও পুরাণ সাহিত্যের দার্শনিক তত্ত্বালোচনায় প্রধান হয়ে উঠেছে।
পুনরায় এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হল গুরুত্বের আপেক্ষিকতা। একটি শ্লোকে বলা হচ্ছে দৈব, পুরুষকার এবং কাল এই তিন শক্তি যুগপৎ মানুষের ভাগ্য নিযন্ত্রণ করে। আর এক জায়গায় পরিষ্কার বলা হয়েছে সমস্ত দুৰ্ভাগ্য এবং দুর্ঘটনা কালের নিয়ন্ত্রণাধীন; কাল যদি বিরুদ্ধে থাকে, ক্রুদ্ধ হয় তবে কী করে আমরা পরিতপ্রাণ পাব? এটা ব্রহ্মারই বিধি যে, সব কিছু প্রাণীকুলের ত্রিভুবনের সমস্ত শক্তি, কালের অধীন।
আর একটি শ্লোকে বলা হয়েছে ধর্ম, কাল এবং মৃত্যু সর্বদা একত্রে বিচরণ করে। মৃত্যুর বারো দিন পরে একজন মানুষকে যমপুরীতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে মৃত্যুকাল ও অন্তকের মাঝে সে যমকে দেখতে পায়। কালই সর্ব প্রাণীর সৃষ্টি ও ধ্বংসকর্তা, সকলেই কালের অধীন। কিন্তু কাল কারও অধীন নয়।
বিভিন্ন স্তরে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিস্তার এবং আর্থিক অবস্থার উন্নতিএ দুইয়ের মিলিত অবদানে যখন কুসংস্কারমুক্ত, নিয়তির প্রভাব মুক্ত জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি কেবল বাস্তবায়িতই হবে না–অত্যাবশ্যক, অপরিহার্য হয়ে উঠবে, তখনই নিয়তিবাদের শিকড়গুলি সমাজের অভ্যন্তরীণ গঠন থেকে উচ্ছেদ হবে।
এই কালের প্রয়োজন নিয়তিবাদের ধারণার বিকাশকে পোষণ করার জন্য। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যে সময় তা হল ভবিষ্যৎ এবং মহাকালের রূপকল্পনা–অসীমের মূর্ত বিগ্রহ; সে হল ভবিষ্যতের প্রায় নির্ভুল রূপমূর্তি। পৌরাণিক অতিকথাগুলিতে শিব, যিনি যুগাস্তের ভয়ংকর বিধাতা, তাকে বলা হয়েছে মহাকাল’–মৃত্যুর দেবতা। এই দেবতা ভূত-প্রেতের সঙ্গে বিচরণ করেন এবং তিনি যমেরই এক পরিবর্তিত রূপ।
তাই যে সব পুরাকথাতে কাল, অন্তক, যম, ধর্মরাজ, ইত্যাদির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে তারা শিবকেও এঁদের সঙ্গে যুক্ত করে। শিবের মধ্যে এবং শিবের দ্বারা কাল ও সময় মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে। লৌকিক ‘ধর্মপূজার’ ক্ষেতপ্রে যে শিবকে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয় তা কোনও আকস্মিক সমাপতন নয়।
এই ভাবে পুরাকথার উপযোগী ভাষায় ও ইঙ্গিতে এই বক্তব্যই প্রকাশিত হয়। যে, কাল একজন ন্যায্য বিচারক, ধর্ম (ন্যায়), কাল (সময়) ও যম (মৃত্যু) একতপ্রে নৈতিকতা সম্মত কার্য বিধান করেন। মানুষকে তার ভাগ্যের সঙ্গে যুক্ত করার এটি একটি প্রচেষ্টাতাকে আশ্বাস দেওয়া যে, কোনও কিছুই নিয়মবহির্ভূত নয়, কারণ দেবতারাই মানবজীবনে কর্তৃত্ব করছেন।
কাজেই শেষ পর্যন্ত কোনও কিছুই ভুল হবে না, হতে পারে না। কিন্তু ধর্মতত্ত্বে বা অতিকথায় এ কথা কখনও স্পষ্ট ভাবে স্বীকার করা হয়নি, ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ভাগ্য অজ্ঞেয় ও অন্ধকারাচ্ছন্নই রয়ে গেছে।
ন্যায্য এবং নিরপেক্ষ শেষ বিচারের আপাত বাহ্যরূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে চিত্রগুপ্তের পৌরাণিক চরিত্রটিকে সৃষ্টি করে। এই চিত্রগুপ্ত মানুষের ন্যায়–অন্যায় কাজগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখেন, যাতে পরজন্মে সেই অনুযায়ী মানুষ শাস্তি বা পুরস্কার পায়। এক অর্থে, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আর নিয়তিবাদ পরস্পরের বিপরীতগামী: যদি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সফল তাৎপর্য থাকে, তবে একজনের কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত বিকল্পে অন্য একজন করতে পারে এবং কর্মের প্রকৃত অনুষ্ঠাতার উপর থেকে নৈতিক দায়িত্ব হস্তান্তরিত হয়।
অভিশাপ এবং আর্শিবাদ, যা মানুষের জীবনধারাকে প্রভাবিত করে, সেগুলি প্রায়ই আবেগতাড়িত বলে মনে হয় এবং কোনও প্রতীতিমূলক অধিবিদ্যাসংকপ্রান্ত তত্ত্বের সঙ্গে এগুলিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যায় না। অনুরূপ ভাবে যদি আত্মা ও প্রেত কোনও মানুষের জীবনকে সত্যই প্রভাবিত করতে পারে তবে তার কৃত ভাল ও মন্দ কাজের গুরুত্ব হপ্রাস পায় এবং অকার্যকর হয়ে দাঁড়ায়।
যদি অনুমান করা যায় যে অভিশাপ ও আশীর্বাদ, আত্মা ও প্রেত, শ্রাদ্ধ ও প্রায়শ্চিত্ত, এমনকী পুরস্কার ভাগ করে নেওয়া (পুরাণগুলি মধ্যে মধ্যেই আখ্যানের সাহায্যে এর উদাহরণ দেয়)–এই সব কিছুই পূর্বনির্দিষ্টতার পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ে তখনই কর্ম তার গুরুত্ব হারিয়ে গৌণ হয়ে পড়ে। আর যদি এই নিয়তি অথবা পূর্বনির্দিষ্টতার তত্ত্ব নিজেই কর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে ওই সব অসংখ্য গৌণ মাধ্যমের কল্পনা অপ্রয়োজনীয়, এমনকী পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়ে। সুতরাং নিয়তিবাদ বিষয়ে যুক্তিসংগত প্রতিতি উদ্ভাবনের চেষ্টা কখনও করা হয়নি।
তবুও এই নিয়তিবাদের সর্বব্যাপী অস্পষ্টতা হাজার হাজার বছর ধরে ধর্মীয় পরিবেশকে গপ্রাস করে রেখেছে। পুরোহিতদের স্বার্থেই নিয়তিবাদকে তার অসংখ্য প্রকার বহিঃপ্রকাশ আর বিভিন্ন মাধ্যমসহ মেনে নেওয়া হয়েছিল। বৃহত্তর জনসাধারণের আর্থিক অনুন্নত অবস্থা আর বিত্ত জগতেও তার বিভিন্ন কার্যকলাপ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাবই নিয়তিবাদের অধিপত্যের কারণ।
বিভিন্ন স্তরে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিস্তার এবং আর্থিক অবস্থার উন্নতিএ দুইয়ের মিলিত অবদানে যখন কুসংস্কারমুক্ত, নিয়তির প্রভাব মুক্ত জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি কেবল বাস্তবায়িতই হবে না–অত্যাবশ্যক, অপরিহার্য হয়ে উঠবে, তখনই নিয়তিবাদের শিকড়গুলি সমাজের অভ্যন্তরীণ গঠন থেকে উচ্ছেদ হবে।
কিছু দিন বাহ্যিক স্তরে এর প্রভাব অবশিষ্ট থাকতেও পারে কিন্তু ভয় আর বিস্ময়ের জাল বিস্তার করে লৌকিক চেতনাকে অধিকার করার ক্ষমতা তখন নিয়তিবাদ হারিয়ে ফেলবে। আর্থসামাজিক অগ্রগতি এর মূলকে ধ্বংস করে হয়ে উঠবে সহজসাধ্য, নূতনতর বিকাশের সহায়ক।
(সমাপ্ত)
<<নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : দুই ।। নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : এক>>
………………..
প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ : সুকুমারী ভট্টাচার্য।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………..
আরও পড়ুন-
নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : এক
নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : দুই
নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব : তিন