-দীপঙ্কর মজুমদার
নমো ভগবতে তুভ্যং নমো বিদ্যা-প্রদায়িনে।
ওঁ সচ্চিদানন্দরূপায় বাণেশ্বর নমোহস্তুতে…।।
এ-এক অমোঘ সত্য… ভগবান কিম্বা তাঁর প্রতিরূপী অবতার অধর্মের পরিত্রাতা হয়ে বারবারই জন্ম নিয়েছেন এই ধরাধামে। সেখানে শ্রীরামচন্দ্র, বলরাম (শ্রীকৃষ্ণ) বা ভগবান বুদ্ধ এর ব্যতিক্রম নন। তাই তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর শাশ্বত বাণী ঘোষণা করেছিলেন-
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্ম্ম-সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
এই জীবজগৎ যা থেকে সৃষ্ট হয়ে বিশ্ব-লীলাক্ষেত্রে অভিব্যক্ত, সে-তো তুমিই। তোমাকে আশ্রয় করেই তো এই ত্রিভুবন আনন্দ দোলায় নিত্য লীলায়িত, আবার মহাপ্রলয়ে এই বিশ্ব সৃষ্টি তোমারই দেহে লীন হয়ে যাবে। তবু হে অন্তর্যামী, বিশ্ববিভূতি তোমাকে এই সীমাবদ্ধ দেহ-মনন-বুদ্ধি দিয়ে কতটুকুই বা বুঝতে পেরেছি, সেখানে আজও আমরা পরাজিত- হে নাথ।
তুমি আপনা হইতে হও আপনার
যার কেহ নাই তুমি আছ তার।।
পিতামাতা, ভ্রাতা-ভগিনী, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা প্রমুখের সঙ্গে জীবের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ হলেও তা ক্ষণস্থায়ী। আর ভগবান সেখানে অনন্তকালের আত্মীয়। আসলে আমাদের আত্মাই পরিশেষে পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়ে যায়। কাজেই শ্রীভগবানকে একনিষ্ঠভাবে পাবার জন্য হৃদয়ের পবিত্র ভালোবাসা, দেহের সমস্ত প্রেম, অন্তরের তীব্র অনুরাগ আর চিত্তের ব্যাকুলতা প্রয়োজন।
ভক্ত যখন পার্থিব জগতে বসে পাগলের মতো প্রার্থনা করতে থাকেন, তখন স্বয়ং ভগবান নিজের অনন্ত ঐশ্বর্য্যকে গোপন রেখে ধরাধামে আর্বিভূত হন। সেক্ষণে ভক্তবৃন্দ তখন ভগবানের সঙ্গে আপনার প্রেম-সম্বন্ধ স্থাপন করে আত্মতৃপ্ত ও কৃতার্থ হয়ে ওঠেন।
কে এই ভগবান? সমগ্র ঐশ্বর্য, সমগ্র বীর্য, সমগ্র যশ, সমগ্র সৌন্দর্য, সমগ্র জ্ঞান ও সমগ্র বৈরাগ্য -এই ছয়টি অচিন্ত্য শক্তি যাঁর মধ্যে বিরাজমান তিনিই হলেন ভগবান।
ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশস: শ্রিয়:।
জ্ঞান-বৈরাগ্যয়োশ্চৈব যন্নাং ভগ ইতীঙ্গনা।।
কালোর্ত্তীনের সঙ্গে সঙ্গে যুগোপযোগী অনেক মহান পুরুষ তথা মহামানব জন্ম নিয়েছেন এই বসুন্ধরায় তাঁদেরই উত্তরসূরী এক মহাজীবনের কাহিনী উপস্থাপন করাই এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য।
সূচনার শুরু যাকে দিয়ে সেই ‘রামনাথ কৃষ্ণমূর্তি’ যখন মাতৃগর্ভে, তখন এক পাঞ্জাবি সাধু তার মাকে ভবিষ্যদ্বাণীর দ্বারা বলেন, ‘এ মাইজী তেরি গর্ভমে এক মহাপুরুষ আরাহা হ্যায়, তু ধৈর্য্য ধর্। উসকো নাম হোগা রাম অউর উসকো জনম্ দিনমে তু ভুখা রেহেগী; ইয়ে মেরা বচন হ্যায়।’
এই কথা বলে সাধুজী চলে গেলেন। সাধুর কথা শুনে রামের পিতামাতা কঠিন চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন। কারণ অগ্রজ দুই কন্যা-সন্তানের পর পুত্র জন্মলাভ করবে আর সে যদি সত্যিই সন্ন্যাসী হয় এই ভেবে।
জেলা বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বরের নিকট সবুজ বনানীতে ঘেরা অতি মনোরম জোয়ালভাঙা গ্রামে মাতুলালয়ে এগারো মাস পনেরো দিনে ‘রাম’ ভূমিষ্ঠ হয়। মাতৃগর্ভে থাকাকালীন রামের মা একদিন স্বপ্নে দেখলেন, একটা শ্বেতহাতির সারা গায়ে কড়ি দিয়ে সাজানো।
ইংরেজি ১৯৭০ সালে (বাংলা: ১৩৭৭, ১৫ই ভাদ্র)। মুসলধারে বৃষ্টি, ভোর ৫টা ১৮ মিনিট, শুক্লপক্ষের পুণ্যলগ্নে উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্রে মায়ের কোল আলোচিত করে ভূমিষ্ঠ হল রাম। প্রত্যেকেই সেদিন এক অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করলেন, নবজাতক কোনো কান্নাকাটির পরিবর্তে গভীর ধ্যানে মগ্ন রয়েছে।
কিছুক্ষণ পর ধ্যান ভাঙতেই শিশুটি চিৎকার ও ক্রন্দনে নিজের অস্তিত্বের জানান দিল। জন্মের সময় রামের উন্নত ওষ্ঠযুগল পরিলক্ষণ করে মাতুল বলে উঠলেন, ‘এই শিশু তো সাধারণ নয়… এ যে গৌতম বুদ্ধ।’
অতীতে মাতুলালয় ছিল তৎকালীন জমিদার বংশীয়। বাড়ির একমাত্র পুত্রসন্তান যাতে সন্ন্যাসী না হয়, তারজন্য গৃহজ্যোতিষীর কথা মতো কবচ, ধাতু, রত্ন ধারণ করানো হল ছোট্ট বালককে। তাছাড়া ওই পাঞ্জাবী সাধুর ভবিষ্যৎ বাণীকে স্মরণ করে বালকের নাম ‘রাম’ রাখার চিন্তা একদম উপেক্ষা করা হল।
ধীরে ধীরে বালক বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত ঠাকুর ভক্ত হয়ে উঠল। আবার গৃহদ্বারে কোনো গৈরিক ভিখারি এলে তার সঙ্গে পাঁচঘর ঘুরে বেড়াত। কিম্বা কোনো সাধুকে দেখলেই উদাসী ভাবে বিভোর হয়ে যেত।
এই ভাবের নিদর্শন স্বরূপ যেমন, সঙ্গীতের প্রতি ছিল তীব্র আকর্ষণ, অপরদিকে গ্রামের পাঁচজনকে নিয়ে ঠাকুরের গান গাওয়া, অভিনয় করা কিম্বা মাটি দিয়ে বিভিন্ন দেবদেবী গড়ে তার পুজো পাঠ করা ইত্যাদি।
এভাবে চলতে চলতে বালক পঞ্চবর্ষে যখন উত্তীর্ণ হল, তখন বাড়ির এক পরিচারীকার হাত ধরে আলুর ক্ষেতে গিয়ে আলু কীভাবে সংগ্রহ করা হয় তা দেখতে থাকে। আর সেখানে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে, বালক রাম এই ঝাড়খণ্ড সীমান্তের হস্তিকাঁন্দা গ্রামের (শোনা যায় সেখানে একদা গভীর জঙ্গলে নাকি হাতি কাঁদত, তাই গ্রামটির এরূপ নামকরণ) পিতৃভূমির মাটিতে যখন খেলতে শুরু করল এবং নিজে হাতে আলু তুলতে গিয়ে তুলে নিল স্বয়ং দেবাদি দেবকে।
বালক তৎক্ষণাৎ আনন্দে আপ্লুত হয়ে সুচিৎকারে বলে উঠল, ‘এই দ্যাখো গো আমি শিবঠাকুর পেয়েছি।’
কথা শেষ করেই এক ছুটে বাড়ি গিয়ে মাকে জড়িয়ে বলল, ‘মাগো মা এই দ্যাখো আমি ক্ষেত থেকে শিবঠাকুর পেয়েছি।’
মা বললেন, ‘হ্যাঁ সবই তো তোমার আছে শিব, যাও তুলসী তলায় রেখে এসো।’ বাধ্য বালক মায়ের কথা মতো তাই করল।
একদিন মলুটি গ্রাম থেকে আসা গৃহপূজারি তুলসী তলায় ফুল-জল দিতে গিয়ে চমকে উঠল। হঠাৎ তার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল, ‘এই শিলা কোথায় পেলেন?’ মা বললেন, ‘আমার ছেলে ওটা ক্ষেতের জমিতে পেয়েছে। ও বলে ওটা নাকি শিব।’
পূজারি বিস্ময়ে তাকালেন। তারপর মাকে বললেন, ‘হ্যাঁ শিবই তো। তবে যে সে শিব নয় মা। এ যে বাণলিঙ্গ মানে বাণেশ্বর শিব আর এই শিলা অতীব দুর্লভ। যদি এর পুজোপাঠ দিতে আপনাদের কোনো অসুবিধা হয়, তবে মা আমায় দিয়ে দিন আমি একে আমার গৃহে নিয়ে যাই নিত্যপুজোর জন্য।’
মা বললেন, ‘না না তা কি করে হয়, আমার ছেলে ওটা দেখতে না পেলে ভীষণ ক্ষেপে যাবে গো গোঁসাই ঠাকুর। ও আমার শিব, আমার শিব বলে সারাদিন ওকে নিয়ে খেলে বেড়ায়। ওটা ওখানই থাক, আমরাই আজ থেকে ওর পুজো করব।’
পূজারি ব্রাহ্মণের কথায়, যার কাছে ইনি এসেছেন তারাই তো দেবতা। সেই কথা মতো সেদিন থেকে বাণলিঙ্গের নিত্যপুজো শুরু হল। রামও এই বাণলিঙ্গ শিবকে ‘রামনাথ’ বলে পুজো করে।
লক্ষণীয়, রাম অবতার জন্মজন্মান্তরে যখনই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন তার ইষ্ট দেবতা ভগবান শিব এভাবেই ব্রহ্ম শিলারূপে তার কাছে এসেছেন। আসলে ভগবান শিবই পাঞ্জাবী সাধুর রূপ ধরে রামের মায়ের নিকট এসেছিলেন।
(চলবে…)
…………………………
আরো পড়ুন:
রাম নাথ কৃষ্ণমূর্তি: এক
রাম নাথ কৃষ্ণমূর্তি: দুই
রাম নাথ কৃষ্ণমূর্তি: তিন