রসের কথা অরসিকে বলো না
রসের কথা অরসিকে বলো না,
কারে বলো না, কেউ ত লবে না।
যেমন কয়লাকে দুগ্ধে ডুবালে দুগ্ধের বরণ ধরে না।।
এক মহারাজ বাঞ্ছা করলে,
তিত মিঠা করব ব’লে,
করলে শতভার চিনি দিয়ে নিম্ববৃক্ষ রোপনা।
তাহে তিনগুণ তিত বৃদ্ধি হ’লো
মিঠাগুণ তার হ’লো না।।
যেমন কাক-তোতা এক খাঁচাতে
যত্ন করো পোষমানাতে,
বুলি ধরাইব বলে খেতে দেও মাখন-ছানা।
তোতা বুলি ধ’রে নিবে, কাকের বুলি হবে না।।
এক দরিদ্র জংলা হ’তে
দাঁড়ায় বাদশা’র দ্বারেতে;
বাদশা’ তারে দয়া ক’রে দিল ডাব-চিনিপানা।
ডাক কামড়ে খেতে দন্ত ভাঙে, ছুলে খেতে জানে না।।
রসনগরে বিষম নদী,
ডুবলি নে মন জন্মাবধি,
হীরুচাঁদের বাক্য ভুলে হ’লি টোপা-পানা।
অধীন পাঞ্জ বলে, ডুব, মন, পাবি মতি-দানা।।
…………….
অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’ গ্রন্থ থেকে এই পদটি সংগৃহিত। পদকর্তা আমাদের কাছে পাঞ্জু শাহ্ নামে পরিচিত হলেও অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’ গ্রন্থে পাঞ্জ শাহ্ বলে উল্লেখ করা আছে। ১৩৬৪ বঙ্গাব্দে প্রথম প্রকাশিত এই গ্রন্থের বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। লেখকের এই অস্বাধারণ সংগ্রহের জন্য তার প্রতি ভবঘুরেকথা.কম-এর অশেষ কৃতজ্ঞতা।
এই পদটি সংগ্রহ সম্পর্কে অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় লিখেছেন- বাংলার বাউল-ফকির বা নেড়ার ফকিরদের মধ্যে লালনের স্থান যে সর্বোচ্চ, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু লালনের মৃত্যুর পরে যিনি সারা বাংলার ফকির-মহলে লালনেরই মতো উচ্চ স্থান লাভ করিয়াছিলেন, তিনি ফকির পাঞ্জু শাহ্।
লালনের মৃত্যুর অব্যবহিত পর হইতে প্রায় পঁচিশ বৎসর যাবৎ পাঞ্জু শাহ্ অনেকটা লালনের শূন্যস্থান পূরণ করিয়া রাখিয়াছিলেন। লালনের মতো তাঁহার রচিত গান বাংলার সর্বত্রই পাওয়া যায় এবং ফকির-মহলে বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে গীত হয়।
পাঞ্জু শাহের সুযোগ্য পুত্র জনাব রফিউদ্দীন খোন্দকার তাঁহার পিতার পুরাতন খাতা-পত্র হইতে নকল করিয়া প্রায় দুইশত গান আমাকে পাঠাইয়াছেন। ঐ সঙ্গে তিনি তাঁহার পিতার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখিয়া দিয়াছেন এবং একখানি ফটোও পাঠাইয়াছেন। এই সহৃদয়তার জন্য তাঁহাকে অজস্র ধন্যবাদ জানাইতেছি।
খোন্দকার সাহেবের লিখিত জীবনী তাঁহার ভাষাতেই উদ্ধৃত করা গেল-
১২৫৮ সালের শ্রাবণ মাসে ফকির পাঞ্জু শাহ যশোহর জিলার শৈলকুপা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান বংশে জন্মগ্রহণ করেন। ইহার পিতা খাদেমালী খোন্দকার সাহেবের ইনি প্রথম পুত্র।
ইঁহার পিতা একজন সঙ্গতিসম্পন্ন লোক ছিলেন। কুচক্রীর ষড়যন্ত্রে উত্যক্ত হইয়া বিষয়-বিভব তুচ্ছ-বোধে ইনি স্বীয় স্ত্রী ও বালক পুত্রসহ যশোহর জিলার হরিণাকুণ্ড থাকার অধীন হরিশপুর গ্রামের বিশিষ্ট সম্ভ্রান্ত, অবস্থাপন্ন বিশ্বাস-পরিবারের মাননীয় ফকির মহম্মদ বিশ্বাস দিগরের সাহায্য ও আন্তরিক সহানুভূতি পাইয়া উক্ত হরিশপুর গ্রামেই দরিদ্রভাবে বসবাস আরম্ভ করেন।
তাঁহার আত্মসম্মান-জ্ঞান ও ভদ্রতায় তিনি গ্রামস্থ লোকের শ্রদ্ধাভাজন হন। ফকির পাঞ্জু শাহের পিতা একজন গোঁড়া মুসলমান ছিলেন। শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানে (Formalities) নিষ্ঠাবান হইয়া ইনি বাংলা ভাষা-শিক্ষারই বিরোধী হন এবং স্বীয় পুত্রকে আরবী, ফার্সি ও উর্দ্দু-শিক্ষাদানে প্রবৃত্ত হন।
১৫/১৬ বৎসর বয়সে ফকির পাঞ্জু শাহ্ গোঁড়া পিতার ভয়ে বিশ্বাস-পরিবারের মহরালী বিশ্বাসের নিকট স্বত:প্রবৃত্ত হইয়া গোপনে বাংলা ভাষা-শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন।
তৎকালে হরিশপুর গ্রাম বিশেষ সমৃদ্ধ ছিল। সকল শ্রেণীর হিন্দু-মুসলমান পরস্পর মিলিতভাবে বসবাস করিতেন। সুফী ফকিরদের মধ্যে জহরদ্দীন শাহ্, পিজিরদ্দীন শাহ্, ফকির লালন শাহের শিষ্য দুদমল্লিক শাহ্ ইত্যাদি সুফীতত্ত্ববিদ্ সাধু ও হিন্দুদের মধ্যে মদন দাস গোস্বামী, যদুনাথ সরকার, হারানচন্দ্র কর্মকার প্রভৃতি সমবেতভাবে বৈষ্ণব ধর্ম বেদান্তের সূক্ষ্ম তত্ত্ব, ইসলামের সুউচ্চ তত্ত্ব ও তাছাওফের গভীর বিষয় এবং চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের বিষয়সমূহ আলোচনা করিতেন। প্রায়ই সুফী ফকির ও বৈষ্ণবগণ একত্র হইয়া সুফী মতবাদ-সম্বন্ধীয় ও বৈষ্ণব তত্ত্ব-সম্বন্ধীয় গান ও সিদ্ধান্ত-আলোচনায় শান্তি অনুভব করিতেন।
এই সমস্ত বিষয় ফকির পাঞ্জু শাহের পিতা পছন্দ করিতেন না। ঐ সংস্রবে যাতায়াত বা বসা-ওঠা করিতে নিষেধ করা সত্ত্বেও পাঞ্জু শাহ্ গোপনে যাতায়াত করিতেন এবং কখনও তাহা প্রকাশ পাইলে ইঁহার লাঞ্ছনার সীমা থাকিত না। এইভাবে পিতা বর্তমান থাকা পর্যন্ত তাহার মন:কষ্টের ভয়ে ইনি সঙ্গোপনে গভীর আগ্রহ সহকার সুযোগমত সাধুসঙ্গে সময় কাটাইতেন।
২৪/২৫ বৎসর বয়সে ইঁহার বিবাহ হয়। …১২৮৫ সালের ২০ ভাদ্র ইহার পিতা পরলোক গমন করেন।…
পিতার মৃত্যুর কিছুদিন পর ইনি কেলাফত (বৈরাগ্যবস্ত্র) ধারণ করেন। …এই সময় হইতেই তাঁহার ধর্মজীবন আরম্ভ হয়।…
হরিশপুর গ্রামের দক্ষিণপ্রান্তে হেরাজতুল্ল্যা খোন্দকার নামে একজন সুফীতত্ত্ববিদ্ পরম সাধুর নিকট ইনি দীক্ষিত হন। ইনি গুরুনিষ্ঠা ও গুরুর সেবাযত্নে একান্ত আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রায় ৩৩/৩৪ বৎসর বয়স হইতেই ইঁহার ধর্মানুরাগ ও জ্ঞানগরিমায় মুগ্ধ হইয়া ২/৪জন করিয়া ইঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিতে থাকে। এই সময় ইনি ‘ইস্কি ছাদেকী গহর’ নামে ১খানা কেতাব রচনা ও প্রকাশ করেন এবং সুফী মতবাদ-সম্বন্ধীয় গান রচনা করিতে আরম্ভ করেন।
ক্রমেই দেশ-দেশান্তরে শিষ্যসংখ্যা বর্ধিত হইতে থাকে। নিজ জেলা ছাড়া ফরিদপুর, নদীয়া, রাজসাহী, দিনাজপুর, রংপুর, ঢাকা, মংমনসিংহ, বরিশাল, খুলনা ও সুদূর আসাম বিভাগেও অনেকে ইঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আজিও বাংলার বহু জায়গায় ইঁহার রচিত পদাবলী আগ্রহ সহকারে গীত হইয়া থাকে। জীবনে অক্ষর কীর্তি রাখিয়া ১৩২১ সালে ২৮শে শ্রাবণ ৬৩ বৎসর বয়সে ইনি পরলোক গমন করেন।…
Islamic Theology-তে ইঁহার যথেষ্ট অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়, অথচ শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানে সাধারণ গোঁড়া মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে একমত হইতে পারেন নাই বলিয়া কাঠমোল্লাদের কাছে ইনি ’নাড়ার ফকির’ বলিয়া উপেক্ষিত হন। ইহাতে ইনি কোনদিন বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ করেন নাই।…
১৫/১৬ বৎসর হইতেই ফকির পাঞ্জু শাহ সাধুসঙ্গে আনন্দ বোধ করিতেন এবং তখন হইতেই মাংস, ডিম প্রভৃতি খাইতেন না।… ইনি পশুপাখী হথ্যা করেন নাই বা অনুমোদনও করেন নাই। আহারে ও পরিচ্ছন্নতায় ইনি বিশেষ সতর্ক ছিলেন।
প্রথম জীবনে তামাক খাইয়াছেন, কিন্তু অপরের ব্যবহৃত হুঁকা কখনও ব্যবহার করেন নাই। শেষ বয়সে তামাক বর্জন করেন। সাধারণ মুসলমান তাঁহাকে হিন্দু-আচারধারী বৈরাগী বলিয়া জল্পনা-কল্পনা করিত। তাহাতে ইনি ভ্রূক্ষেপও করেন নাই। আত্মীয়-স্বজন, সাধু-সজ্জন ও জনসাধারণের সেবায় ইনি অতুলনীয় ছিলেন।… ১৩৬০, ২রা চৈত্র।
লিং হতভাগ্য
খোন্দকার রফিউদ্দীন
সাং হরিশপুর
পো: সাধুগঞ্জ। জি: যশোহর।
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন-
voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….