-অধ্যক্ষ কবিরাজ তপন কুমার বসু
সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনী জানেন না, এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে খুবই বিরল। সাবিত্রী ব্রত পালনের নিয়ম আজ পর্যন্ত হিন্দুসমাজে পতিব্রতা নারীদের মধ্যে স্বামীর সুস্বাস্থ্য কামনায় চলে আসছে। আমাদের দেশের পেশাদারী যাত্রাগোষ্ঠি কিছুদিন আগেও সাবিত্রী-সত্যবান যাত্রাটি মঞ্চে উপহার দিতেন।
তাছাড়া ৭০/৮০ এর দশকে আমরা মাঝেমধ্যে রেডিওতে সাবিত্রী-সত্যবান নাটক শুনতাম। এ থেকে সাবিত্রী সত্যবান কাহিনী সম্পর্কে আমাদের বাহ্যিক জ্ঞান লাভ হয়। এই জ্ঞানের অন্তরালে কিছু তত্ত্ব ও তথ্য লোকায়িত অবস্থায় থাকে। এ সম্পর্কে অনেকেই তেমন কোনো ধারণা পোষণ করি না।
আয়ুর্বেদে সাবিত্রী সূত্র বলে খ্যাত সাবিত্রী তত্ত্বটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক অমূল্য সম্পদ হিসাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে ডিএএমএস ও বিএএমএস-এর পাঠ্যতালিকায় প্রথমবর্ষের আয়ুর্বেদের ইতিহাসে সাবিত্রী সূত্রটি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।
সাবিত্রী-সত্যবানের ঘটনা যুধিষ্ঠিরের নিকট মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণনা করেন মহাভারতের বনপর্বে। প্রাচীন ভারতীয় মতানুসারে আজ থেকে প্রায় কয়েক হাজার বছর পূর্বে ভরদ্বাজকালে গার্গী, দেবযানী, সাবিত্রী প্রভৃতি মহিলা আয়ুর্বেদজ্ঞ পণ্ডিতের আবির্ভাব হয়।
গর্গ মুনির কন্যা এবং যাজ্ঞবাল্কা মুনির পত্নী ছিলেন গার্গী। গার্গী আয়ুর্বেদ বিদ্যা ছাড়াও আধ্যাত্ম বিদ্যা বা ব্রক্ষবিদ্যায় যশস্বিনী ছিলেন। দেবযানী ছিলেন দৈত্য গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা। দেবযানীর সম্পর্কে মহাভারতের আদি পর্বে উল্লেখ আছে।
সাবিত্রীর পিতার নাম অশ্বপতি এবং মাতার নাম রাণী মালতি। অশ্বপতি পাঞ্জাবের রাজা ছিলেন। বহুকাল সাবিত্রী দেবীর আরাধনা করে কন্যা সন্তান লাভ করেন বিধায় নিজ কন্যার নাম সাবিত্রী রাখেন। সাবিত্রী বাল্যকাল থেকেই স্বাধীনচেতা ছিলেন।
কন্যার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে রাজা অশ্বপতির কোনো হস্তক্ষেপ ছিলো না। ছোটোবেলা থেকেই সাবিত্রী তেজস্বী ও জ্ঞানী ছিলেন। মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতায় রাজার কোনো রূপ বাঁধা না থাকলেও রাণী মালতি তা সহ্য করতে চাইতেন না। শুধুমাত্র রাজাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে রাণী সাবিত্রীকে তেমন কিছু বলতেন না। সাবিত্রী যে শুধু আয়ুর্বেদেই সুপণ্ডিত ছিলেন তাই নয়। তিনি জ্যোতিষ ও সমাজবিদ্যা বা লোকবিদ্যায় ও সুপণ্ডিত ছিলেন।
পুরাকালে দ্যুমৎ সেন নামের এক রাজা জাতি বৈরিদের দ্বারা রাজ্য হারিয়ে বসবাস করতেন বনে। সত্যবান নামে রাজা দ্যুমৎ সেনের এক পুত্র ছিল। দ্যুমৎ সেন শাল্কদেশ বা মধ্য প্রদেশের রাজা ছিলেন। যৌবনে সাবিত্রী সত্যবানকে বিবাহ করার জন্যে তার পিতা অশ্বপতির নিকট প্রস্তাব দেন।
ত্রিকালজ্ঞ ঋষি ও কূটবুদ্ধিসম্পন্ন দেবদূত হিসাবে আমরা যাকে চিনি, তিনি হলেন ‘নারদ’। সাবিত্রী যাতে সত্যবানকে বিবাহ না করে তার জন্যে নারদ মুনি সাবিত্রীর নিকট গেলেন এবং তিনি তার সমস্ত কথা শ্রবণ করে বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘সাবিত্রী! তুমি যে নরকে স্বামী হিসাবে বরণ করতে যাচ্ছ তার আয়ু মাত্র আর এক বছর আছে।’ উত্তরে সাবিত্রী নারদ মুনিকে যা বলেছিলেন তাই ই আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ‘সাবিত্রী সূত্র’- নামে পরিচিত।
সূত্রটি এই রূপ-
‘মানুষের আয়ু নিয়ত হয়, অনিয়ত হয়, আয়ু একটি সংযোগ দ্রব্য। দেহ ও মনের বিকারে আয়ু অনিয়মিত হয়, মনোবিকার, শান্তি, বিবেক ও ধৈর্য্যের দ্বারা উপশমিত হয়। দেহবিকার চিকিৎসার আয়ত্ত্বে থাকে। ঋষি পুরুষের জানা নেই, শোনিতেই আয়ুর গতি ও স্থিতিশীলতা, অনিয়ত আয়ুর উপলক্ষণ হয়। সেক্ষেত্রে সহচার্যের প্রজ্ঞা বলেই আয়ুকে সৎ নিয়ত করে।’
নারদ মুনি এই অমূল্য তত্ত্ব শ্রবণের পরে সাবিত্রীর সাথে সত্যবানকে বিবাহ করার অনুমতি দেন। ফলে রাজা অশ্বপতি কন্যার বিবাহের আয়োজন করেন। পরবর্তীকালে সাবিত্রী তার স্বামীকে শোনিতাচ্ছাস জনিত মূর্চ্ছা অর্থাৎ হাইপার টেনশন স্ট্রোক থেকে বাঁচাইয়া তোলেন। এইভাবে তার স্বামীর আয়ুকে বৃদ্ধি করেন।
আয়ু কিভাবে বৃদ্ধি হয় প্রকৃতপক্ষে এই সূত্রে তারই অবতারণা ঘটানো হয়েছে। আয়ু চারপ্রকার-
১. হিতায়ু।
২. অহিতায়ু।
৩. সুখ আয়ু।
৪. দুঃখ আয়ু।
এখানে হিত আয়ুর কথা বলা হয়েছে। ভাবমিশ্রের মতে, আয়ু একটি সংযোগ দ্রব্য। সাবিত্রী সূত্র অধ্যয়নকালে আমরা লক্ষ্য করি যে, আয়ুকে একটি সংযোগ দ্রব্য হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। সংযোগ বলতে আমরা বুঝি একের সাথে আর এক বা একাধিক বস্তুর যোগ। তাহলে এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, কিসের সাথে কি যোগ হয়? তারপর আরেকটা প্রশ্ন আসে কেমন করে যোগ হয়?
আমার মনে হয় শুধুমাত্র পরিমিত কায়িক পরিশ্রম, প্রয়োজন মতো বিশ্রাম, প্রয়োজনীয় উপবাস, স্নেহ বর্জিত আহার, স্বল্পাহার প্রভৃতির বিধানই আয়ু বৃদ্ধির সব নয়। এরমধ্যে কোনো অন্তর্নিহিত তত্ত্ব বিরাজ করে। অর্থাৎ দেহতত্ত্বের চিরায়ত পথে সাধক যেমন ধীরে ধীরে নিজস্ব ধারায় সাধন মার্গে অগ্রসর হন, ঠিক তেমনিভাবে কোনো গুহ্য সাধন তত্ত্ব এই সাবিত্রী সূত্রের মধ্যে লুকায়িত আছে।
বাহ্য ঘটনার চাইতে অন্তরঙ্গ একান্ত সাধনার গভীরতার মূল্য অনেক বেশি দিতে হবে। তাই গুহ্য সাধনার তাৎপর্য উপলব্ধি করার দিকে জোর না দিয়ে আমরা অযথা ইতিহাস নিয়ে ঘাটবো না।
…………………………
অধ্যক্ষ কবিরাজ তপন কুমার বসু।
এমএ (ইংরেজি); ডিএএমএস(ঢাকা); কাব্য, ব্যাকরণ, আয়ুর্বেদ ও পুরাণ তীর্থ (ঢাকা)।
প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, প্রফুল্ল সিংহ আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ, মাগুরা।
প্রাক্তন পরীক্ষক – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক বোর্ড ( ঢাকা)।