আত্মজ্ঞান সাধনায় চারটি ধাপ বা স্তর
-মোতওয়াল্লী চিলু ভূঁইয়া জালালী
: জালালী দর্শন বা উপাসনা :
আত্মজ্ঞান চর্চায় যে চারটি স্তর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য উহারা যথাক্রমে- স্থুল, পর্বত, সাধক এবং সিদ্ধি। সাধন ভূমিতে প্রবেশের জন্য সাধককে এই চারটি স্তরকে নির্ভুলভাবে বুঝতে সমর্থ হওয়া আবশ্যক। সাধনায় নানাবিধ পন্থা রহিয়াছে।
নানা মুনির নানা মত তো আছেই। ইহার পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় ভাষায় আত্মজ্ঞান বিষয়ে পুস্তকের ভাষা বিদেশি হওয়াতে। সাধারণ ভক্তদের ইহার মধ্য হইতে সঠিক ভাবার্থ বের করে আনা অনেক কঠিনতম কার্য।
বিশেষ করে সাধককে বুঝতে সক্ষম হওয়া খুবই জরুরি যে, ‘ধর্ম’ ও ‘সাধনা’ এক বিষয় নয়। ধর্ম হইল সামাজ কর্তৃক স্বীকৃত। যাহা বিভিন্ন মত,বিশ্বাস ও দর্শনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে আদিকাল হইতে বর্তমান পর্যন্ত।
সাধনা হইতেছে সকল ধর্মের মধ্যে যে মূল বিষয়গুলো রয়েছে। সেইগুলো প্রত্যক্ষ অনুভূতির দ্বারা বর্তমানে লাভ করার নিদৃষ্ট কৌশল বা পন্থাকে বুঝায়।
ধর্ম অনুমান আর সাধনা বর্তমান।
ভারত উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় আত্মজ্ঞান বিষয়ক চর্চা কয়েক হাজার বৎসর ব্যাপিয়া অনুসৃত হয়ে আসছে। যীশুর, মুহম্মদ (স) ও অন্যান্য ধর্মদর্শন প্রচারকগণ জন্মের সময়কাল হইতেই বাংলা ভাষায় আধ্যাত্মিক বা আত্মজ্ঞানের চর্চা চলছে।
নেপালে আবিষ্কৃত ধর্মীয় সাহিত্যে চর্যাপদের আবিস্কারই ইহার প্রমাণ। আরবি, সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে তুলনায় বাংলা ভাষা অনেক প্রসিদ্ধ। কবিতা, গান, বাউল গান, গল্প, নাটক, ছড়া, ধর্ম দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য নাগরিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে উপর লিখিত বিপুলসংখ্যক কর্ম বিদ্যমান।
কেননা সাধকদের অলৌকিক দৃষ্টান্ত যুগে যুগে এক মহাশক্তির প্রমাণ কেবলমাত্র সাধকদের দ্বারাই স্থাপিত হইতেছে। বাংলা ভাষায় আধ্যাত্মিক চর্চা যত নিখুঁতভাবে বুঝা যাবে, বিদেশী ভাষায় কি ইহা সহজবোধ্য হবে কি?
আমাদের বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃত হয়ে আছে। এবং বাউল পালাগানকে বিশ্ব ঐতিহ্য সংস্থা ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে। মাতৃভাষায় আত্মজ্ঞান বিষয়ক চর্চার উদ্যোগ জালালী দর্শনে উপস্থিতি বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে ইহা উপযোগী হবে বলে মনে করি।
আমাদের মূল সমস্যা হলো নিজ মাতৃভাষায় আধ্যাত্মিক বা আত্মজ্ঞানের চর্চা না করে, বিদেশী ভাষায় ইহার চর্চা করা হয়। বাংলা ভাষায় আত্মজ্ঞানের চর্চাকে মুসলমান বাঙালিদের প্রায় সকলেই বৈদিক বা হিন্দুদের ধর্ম হইতে আসিয়াছে বলে মনে করেন।
বাস্তব সত্যটি হলো সাধকদের সাধনালব্ধ জ্ঞান হইতেই ধর্মের প্রচলন। সামাজিকভাবে আরও ব্যাপক আকারে ধর্মের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ভক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কেননা সাধকদের অলৌকিক দৃষ্টান্ত যুগে যুগে এক মহাশক্তির প্রমাণ কেবলমাত্র সাধকদের দ্বারাই স্থাপিত হইতেছে। বাংলা ভাষায় আধ্যাত্মিক চর্চা যত নিখুঁতভাবে বুঝা যাবে, বিদেশী ভাষায় কি ইহা সহজবোধ্য হবে কি?
যেমন- ইসলাম হইতে সৃজিত সাধনায় সুফিবাদের মধ্যে যে চারটি ধাপ রয়েছে। শরিয়ত, তরিকত, হাকীকত ও মারেফাত। আবার ইহাদের মধ্যে সাধনায় ধাপগুলোর চতুর্মাত্রিক ধারাবাহিক ফানা হতে বলা হয়।
বাংলা ভাষায় ও সংস্কৃত ভাষার অনুসৃত আত্মজ্ঞানের সাধনায় সুফিবাদীদের মধ্যে পার্থক্যটা বেশি দেখা যায় না। এখানে পঞ্চভূত যথা- মাটি, পানি, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ বা ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ও ব্যোম এর সঙ্গে সুফিবাদের আলমে খালকের বা দৃশ্যমান জগতের সাথে প্রায় মিল।
যেমন- ফানাফিশ শাইখ, ফানা ফির রাসূল, ফানা ফিল্লাহ ও বাকা বিল্লাহ। বাংলা ভাষায় সাধনায় যে চারটি সোপান এইগুলো সুফিধারার সঙ্গে তেমন অমিল নেই। উভয়টিই সাধককে ধাপে ধাপে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়।
আরবি ভাষায় অনুসৃত ইসলামি তরিকাগুলো মানুষের দেহে দশটি লতিফা আছে কলব, রুহ, ছের, খফি, আখফা, নফছ, আব (পানি), আতশ (অগ্নি), খাক (মৃত্তিকা) ও বাদ (বাতাস)।
প্রথম ছয়টি আলমে আমরের (সূক্ষ্ম বা অদৃশ্য জগতের) লতিফা। শেষের চারটি আলমে খালকের (স্থুল বা দৃশ্য জগতের) লতিফা। এই সকল আরবি পরিভাষা ইসলামিক ধর্মের সুফিবাদি তরিকা হইতে আনয়ন করা হয়েছে।
বাংলা ভাষায় ও সংস্কৃত ভাষার অনুসৃত আত্মজ্ঞানের সাধনায় সুফিবাদীদের মধ্যে পার্থক্যটা বেশি দেখা যায় না। এখানে পঞ্চভূত যথা- মাটি, পানি, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ বা ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ও ব্যোম এর সঙ্গে সুফিবাদের আলমে খালকের বা দৃশ্যমান জগতের সাথে প্রায় মিল।
এবং সুফিদের ছয় লতিফার সঙ্গে তুলনীয় সূক্ষ শরীরে ছয়চক্র বা সাতচক্র। যথা- মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা ও সহস্রার বিশেষ অমিল নাই। কিন্তু ধর্মীয় একশ্রেণী গোষ্ঠী আধ্যাত্মিক বা আত্মজ্ঞানের শুদ্ধ চর্চায় ধর্মীয়করণ করে প্রায় সব আত্মজ্ঞান চর্চাকে একত্র করতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলছে।
নিম্নে উদাহরণ দেওয়া হলো-
১. কলব লতিফা- হজরত আদম (আ) – রঙ জরদ বা সরিষা ফুলের ন্যায়।
২. রুহ লতিফা- হজরত নূহ (আ) ও হজরত ইব্রাহিম (আ) – রঙ স্বর্ণ বা টর্চলাইটের আলোর ন্যায় দেখতে।
৩. ছের লতিফা- হজরত মূসা (আ) – রঙ সাদা বর্ণ।
৪. খফি লতিফা- হজরত ঈসা (আ) – রঙ কাল বর্ণ।
৫. আখ্ফা লতিফা- হজরত মুহাম্মদ (স) – রঙ সবুজ বর্ণ।
৬. নফস লতিফা- কোন নবীর জেরে কদম নহে। এই নফস ‘খোদ খাহাম খোদী’। এই লতিফার রঙ সাদা।
উল্লেখিত ছয় লতিফা ব্যতীত আরও চারটি লতিফা আছে-
ক. আব’ অর্থ পানি এই লতিফার রঙ নীল বর্ণের।
খ. আতশ’ অর্থ অগ্নি এই লতিফার রঙ কালো বর্ণের।
গ. খাক’ অর্থ মাটি এই লতিফার রঙ ধানী বর্ণের।
ঘ. বাদ’ অর্থ বায়ু এই লতিফার রঙ সাদা বর্ণের।
তেমনি ভাবে সনাতন ধর্মের একটা শ্রেণী গোষ্ঠিও আত্মজ্ঞান চর্চা সীমাবদ্ধ ধর্মীয়করুণ করে ফেলেছেন। যেমন- দেহের ধাম আঠারো মোকাম যাহা আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাহা আছে এই দেহ ভাণ্ডে। ভগবান আমাদের দেহ মাঝে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবকিছু দিয়ে দিয়েছেন। তাই ভজন সাধনের জন্য আর কোথাও যেতে হবে না। এ দেহে সব মিলে।
দেহের আঠারো মোকাম-
মন দিয়া শুন ধাম-তত্ত্বের বিচার।
দেহ মধ্যে বৃন্দাবন সর্বসিদ্ধি সার।।
বাহ্যেতে চুরাশী ক্রোশ বৃন্দাবন হয়।
দেহ মধ্যে সেই সব করিব নির্ণয়।।
ব্রহ্মাণ্ডেতে যাহা আছে ভাণ্ডে তাহা পাই।
শ্রীগুরুর কৃপা হলে জানিবে সবাই।।
অতএব কহি শুন ধাম বিবরণ।
নিত্যানন্দময় স্থান ধাম বৃন্দাবন।।
বক্ষেতে মথুরা ধাম করিয়াছে স্থিতি।
মুখ দ্বারে শ্রীরাধিকা করেছে বসতি।।
ব্রহ্মরন্ধ্রে মস্তকেতে শ্রীগোলোক ধাম।
কর্ণদ্বয় হয় বটে শ্রীগোকুল নাম।।
রাধাকুন্ড শ্যামকুণ্ড হয় নেত্রদ্বয়।
কালিন্দী যমুনা দুই নাসিকাতে রয়।।
জিহ্বার ভিতরে গোবর্ধনের কুঠুরী।
কহিলাম ধাম-তত্ত্ব শুন কর্ণ ভরি।।
অতঃপর কহি সবে শুন দিয়া মন।
আঠার মোকাম তত্ত্ব করহ শ্রবণ।।
চূড়া মধ্যে চূড়ামণি ব্রহ্মপাশে স্থিতি।
পাট মধ্যে মহাবিষ্ণু করেন বসতি।।
চক্ষু মধ্যে কালাচাঁদ করিতেছে ধ্যান।
নাসিকাতে নিত্যানন্দ মধু করে পান।।
কর্ণেতে চৈতন্য গোঁসাই হয়ে সাবধান।
মুখেতে ভদ্রাক্ষ বসি বত্রিশ যোগান।।
জিহ্বাতে নারদ মুনি বাজায় কোন্দল।
জিহ্বা নিচে বসে নদী কায়া গঙ্গাজল।।
আল্জিহ্বায় সরস্বতী বামেতে শ্রীদাম।
কণ্ঠদেশে শ্রীকানাই বাহুতে বলরাম।।
হস্ত মধ্যে শ্রীগোবিন্দ দান-অধিপতি।
সপ্তদ্বীপে জগন্নাথ করেন বসতি।।
নাভিমূলে ব্রহ্মা সদা করিতেছে লীলা।
লিঙ্গে মহাদেব বসে ল’য়ে চন্দ্রকলা।।
গুহ্যদ্বারে বসিয়াছে নাড়ুয়া গোপাল।
কামিনীর সঙ্গে কেলি বড়ই রসাল।।
দেখা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক ধর্ম গোষ্ঠীই যার যার সীমাবদ্ধ দলগতভাবে সাধনার রূপরেখা কল্পনা করে বলছে।
(চলবে…)
………………………………….……………..
জালালী দর্শন সম্পর্কে জানতে আরো পড়ুন-
মৃত্যু ও পরকাল
সৃষ্টিতত্ত্ব
পুনর্জন্ম
স্বর্গ
নরক
দ্বৈত-অদ্বৈত-বিশিষ্ট অদ্বৈত
আত্মজ্ঞান সাধনায় চারটি ধাপ বা স্তর
স্থূল
স্থূল-২