-স্বামী জয়ানন্দ মহারাজ
অনেক রকমের বিপর্যয়ের কথা আমরা জানি। এখন আমরা চোখের সামনে দুটি বিপর্যয়কে প্রত্যক্ষ করছি- একটি করোনা মহামারী এবং অপরটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় ‘আমপান’। এছাড়া ভূমিকম্প, খরা, বন্যা, সুনামী ও ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি মানুষকে নানান সময়ে হতে হয়।
প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়গুলি আসে- মানুষ তা ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠে। কিন্তু মানুষ যদি মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে তাহলে তার সেই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা অনেক সময় কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়!
সন্দেহ বাতিক মনোভাবই সমস্ত রকমের সুসম্পর্ককে ধ্বংস করে দেয়। ইংরেজ কবি বায়রনের কথা বলছি, যিনি বলেছিলেন- সমগ্র ইংল্যান্ডে মাত্র দুজন সতী নারী ছাড়া আর কোন সতী নারী নেই। এঁরা হলেন একজন রাণী ভিক্টোরিয়া আর অপরজন হলেন তাঁর নিজের গর্ভধারিনী মা।
রাণী ভিক্টোরিয়াকে তিনি সতী নারী বলেছেন, কারণ তা না বললে তাঁকে শান্তি পেতে হবে। আর নিজের মায়ের কথা বলেছেন, কারণ তা না বললে তিনি নিজেই জারজ সন্তান বলে প্রতিপন্ন হবেন! সব পুরুষ মানুষ ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের মতো হবে আর প্রতিটি স্ত্রীলোক দেবী সীতা মায়ের মতো হবে- এমনটি ভাবতে তো কোন ক্ষতি নেই। এখন দেখতে হবে- তা হয়ে উঠতে গেলে যে, ত্যাগ এবং তপস্যার প্রয়োজন সেটি আছে কিনা!
কেউ কেউ বলবেন- ‘আমি আমার প্রিয় মানুষটিকে অকারণে সন্দেহ করছি না! সন্দেহ এবং অবিশ্বাস করার পেছনে আমার কাছে যথেষ্ট কারণ এবং তথ্য সহ প্রমাণ রয়েছে!’ সেক্ষেত্রে তাদের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন- আপনি কি আপনার প্রিয় মানুষটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চান?
মাত্রা ছাড়া অবিশ্বাসের ফলে মানুষের মনের মধ্যে অবিশ্বাসের বিষ তৈরি হচ্ছে। আর সেই বিষ ছড়িয়ে গিয়ে সুসম্পর্ককে টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে ফেলছে। অহেতুক অকারণ সন্দেহ বাতিক মনোভাবই মানুষকে মানসিক অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, পারিবারিক জীবন তথা সামগ্রিক সমাজ জীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে। মন থেকে অবিশ্বাস এবং সন্দেহ বাতিক মনোভাবকে দূর করে দিয়ে তার জায়গায় সহজ বিশ্বাস প্রবণ মন গড়ে তুলতে হবে।
ধরুন আপনার সব থেকে প্রিয় কাছের মানুষটি আপনার থেকে দূরে থাকে। মনের স্বাভাবিক গতি অনুযায়ী আপনি সারাক্ষণ তারই কথা ভাবতে থাকেন- সকল কাজের মধ্যে, কাজের ফাঁকে ও অবসরে! আর কি করতে থাকেন? অকারণ আশঙ্কা করতে থাকেন!
আপনার মনের মধ্যে যদি সন্দেহ বাতিক মনোভাব থাকে, তাহলে তো আর কথাই নেই! যখন বাক্যালাপ করেন তখন আপনারা কোন পর্যায়ে উন্নীত হন তা একমাত্র আপনারাই জানেন- যারা নিত্য ভুক্তভোগী এবং পরিস্থিতির শিকার!
অযথা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি অশান্তি একেবারেই করবেন না। মন যদি সন্দেহগ্রস্থ হয় তাহলে- এক জায়গায় এক সাথে থাকলেও জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে। তখন অশান্তিই হবে নিত্য দিনের সঙ্গী। সব সম্পর্কের অবনতির শুরু হয় ঠিক এখান থেকেই। যার পরিণাম হয় বিচ্ছেদ দিয়ে। তাই আপনার মনে যদি সন্দেহ এবং অবিশ্বাস থেকে থাকে তাহলে তাকে এখনি বিদায় দিন!
কেউ কেউ বলবেন- ‘আমি আমার প্রিয় মানুষটিকে অকারণে সন্দেহ করছি না! সন্দেহ এবং অবিশ্বাস করার পেছনে আমার কাছে যথেষ্ট কারণ এবং তথ্য সহ প্রমাণ রয়েছে!’ সেক্ষেত্রে তাদের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন- আপনি কি আপনার প্রিয় মানুষটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চান?
যদি আপনার উত্তর হয়- ‘না’, তাহলে আপনাকে বলবো- আপনার ঐসব সব তথ্য ও প্রমাণগুলোকে আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিয়ে ভগবদ্ গীতার এই শ্লোকটি পড়ুন-
অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ
প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ।
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয়
জায়তে বর্ণসঙ্করঃ।। ৪১।।
‘অধর্মের প্রাদুর্ভাবে, যখন সামাজিক মূল্যবোধ চলে যায়, কুলস্ত্রীগণ সেসময় কঠিন অবস্থায় পড়ে ভ্রষ্টা হয়ে যায়। আমাদের কুলস্ত্রীগণের কিছু অসুবিধা হলে, সমগ্র সমাজের ক্ষতি হয়। সমাজে বর্ণসঙ্করাদি বহু ভ্রষ্টাচার চলতে থাকে।’
অতএব কি করবেন? আপনি যদি বুঝে থাকেন, আপনার প্রিয় মানুষটি আপনাকেই ভালোবাসে- তাহলে তার ভুল ত্রুটিগুলোকে বাদ দিয়ে তার ভালোগুলোকে গ্রহণ করুন। ভালোবাসতে শিখুন সেই সঙ্গে ত্রুটি বিচ্যুতিকে ক্ষমা করতে শিখুন ও সহ্য করতে শিখুন।
তাই ভগবান আপনাকে যেমনটি দিয়েছেন এবং আপনিও আপনার নিজের বিচারবোধ দিয়ে যাকে নির্বাচন করেছেন, তাকে নিয়েই আপনাকে চলতে হবে এবং সন্তুষ্ট থাকতে হবে- এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই! তাই নিজেরা নিজেদের মধ্যে অযথা ঝগড়াঝাঁটি না করে, অশান্তি না বাঁধিয়ে, শান্তিতে এবং আনন্দে থাকুন, ভালো থাকুন।
মিষ্টি ব্যবহার করুন। মেজাজ শান্ত রাখুন। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। রূঢ় করে নয়, মিষ্টি করে কথা বলুন। প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই সেবা করুন। এই কয়েকটি বিষয় পালন করে চলুন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে এবং সবকিছুই ঠিকঠাক ভাবে চলছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না! দায়বদ্ধতা বজায় রাখুন। দায়িত্বশীল এবং যত্নশীল হয়ে উঠুন। দেখবেন যে যে সমস্যাগুলো দেখাদিয়েছিল- সেগুলো আর নেই।
তখন দেখবেন- ছোট্ট বাচ্চাটিকে ফেলে কেউ আর বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে না, বা কেউ সঙ্গে নিয়েও বাড়ি থেকে বেড়িয়েও যাচ্ছে না। কোনো শিশুই তখন আর মা হারা বা পিতৃ হারা হচ্ছে না! প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা স্বামী-স্ত্রী কেউ আর পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না। সংকল্প রক্ষা করে চলুন।
সততা এবং বিশ্বাস দুটোকেই পুরোপুরি বজায় রাখুন এবং ধরে চলুন। সততা এবং বিশ্বাস যত গভীর হবে সম্পর্ক তত দৃঢ় এবং মজবুত হবে। যারা এই ধরনের সমস্যায় জর্জরিত তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- মাত্র যে কয়েকটি সূত্রের সন্ধান দিলাম সেই ক’টি নিজেরা পালন করতে শুরু করে দিন এবং সমস্যার থেকে মুক্তি নিন।
আর তা না করতে পারলে পরিণাম হবে খুবই শোচনীয়। এখন আপনি ভাবুন কি করবেন! এক’কে ধরে জীবনটা কাটিয়ে দেবেন নাকি রেলের একটা লাইন ছেড়ে আবার একটা লাইন ধরে ছুটবেন নাকি লাইন পাল্টে পাল্টে সারাজীবন ছুটতে থাকবেন- সে সিদ্ধান্ত আপনার!
সবকিছুকে সহ্য করে নিতে হয়। সবকিছুকে মনে না লাগিয়ে মানিয়ে নিতে হয়। খারাপ বিষয়গুলোকে মন থেকে বার করে দিয়ে ভালোগুলোকে মনে রাখতে হয়। আর আপনাকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে, আপনার সবচেয়ে প্রিয় এবং কাছের মানুষটি অপরিবর্তনীয় (not replaceable)।
তাই ভগবান আপনাকে যেমনটি দিয়েছেন এবং আপনিও আপনার নিজের বিচারবোধ দিয়ে যাকে নির্বাচন করেছেন, তাকে নিয়েই আপনাকে চলতে হবে এবং সন্তুষ্ট থাকতে হবে- এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই! তাই নিজেরা নিজেদের মধ্যে অযথা ঝগড়াঝাঁটি না করে, অশান্তি না বাঁধিয়ে, শান্তিতে এবং আনন্দে থাকুন, ভালো থাকুন।
চোখের সামনেই তো নিত্য দেখে চলেছেন মৃত্যুর হাতছানি! এরই মধ্যে যেভাবে বললাম সেভাবেই চেষ্টা করুন নিজেদের মনের শান্তি, প্রেম ও আনন্দকে খুঁজে নিতে।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………………
স্বামী জয়ানন্দজীর অন্যান্য লেখা পড়ুন:
আপন স্বরূপ
মানসিক বিপর্যয়ে মুক্তির পথ
সম্পর্ক বিপর্যয়ে মুক্তির পথ
এতো চিন্তা কিসের?
……………………
আরো পড়ুন:
এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: এক
এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: দুই
এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: তিন
এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: চার
এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: পাঁচ
এই ক্রান্তিকালে নিজেকে জানি: ছয়