ভবঘুরেকথা
আত্মজ্ঞান আত্মদর্শন স্বরূপ ধ্যান চক্র

-স্বামী জয়ানন্দ মহারাজ

সমস্যাগুলো যেমন ধরুন-

১. তুহিনের সংসার হয়ে গেছে পনের বছর। স্বচ্ছল পরিবার ও দুটি মেয়ে আছে। বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে পরিবার মেয়ে দুটিকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে গিয়ে বাবার বাড়িতেই রয়েছে। এখন বলছে আর ফিরবে না। তুহিন মানসিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

২. অরিজিৎ তার সংসারে ছেলে মেয়ে ও পরিবারকে ফেলে চলে গিয়ে আবার নতুন করে সংসার পেতেছে। অরিজিতের পরিবারের মানসিক স্থিতি নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে।

৩. সুখের সাংসারে উপপত্নী বা উপপতির আগমনে সংসার তছনছ হয়ে যেতে বসেছে।

৪. গুণধর সন্তান তার বৃদ্ধ মা বাবা কে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে!

৫. সংসারে সদস্যদের মধ্যে মনোমালিন্য অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। তা সে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হতে পারে কিংবা সন্তান কথা শুনছে না, ভীষণ অবাধ্য এও হতে পারে!

৬. এছাড়া প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে বিচ্ছেদের ফলে মানসিক বিপর্যয় এখনকার দিনে প্রায়শই ঘটে চলেছে।

সম্পর্কের টানাপোড়েনের ফলে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি এবং সেখান থেকে নানান রকমের ঝামেলা ও অশান্তি দেখা দিতে শুরু করে। যার পরিণাম হিসেবে একদিকে যেমন সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে অপর দিকে অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে সমাজ উন্নীত হয়েছে।

আমাদের সমাজের এটি একটি বিষম ব্যাধি আকারে আত্মপ্রকাশ করেছে। মানুষের মধ্যে ধৈর্য এবং সহনশীলতা ভাব কমে গেছে। বর্হিমুখীনতা মানুষ কে তীব্র ভোগবাদের দিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে চলেছে। মানুষ আজ বাহ্যিক আড়ম্বর বাহারি আদব কায়দা আর সাজ পোশাকের ব্যপারে অধিক আগ্রহী।

অর্থকে সবকিছুর মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করে ফেলেছে। আর একে হাতিয়ার করে সামাজিক সম্মান স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে! মানুষের মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে আমিত্বের ভাব ও তীব্র অহমিকা আর অতিমাত্রায় অনুভূতি প্রবণ (sentimental) হবার দরুন সম্পর্কের মধ্যে যেমন অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে, তেমন তার থেকে বিরোধ তৈরি হয়ে পরিশেষে বিচ্ছেদে গিয়ে সে সম্পর্কে পরিসমাপ্তি ঘটছে। ভালোবাসার স্থান একরাশ ঘৃণা ও হিংসা অধিকার করে ফেলছে।

আমাদেরকে সমস্ত রকমের আসক্তি কামনা, লোভ এবং ক্রোধকে‌ পরিহার করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে সেই সঙ্গে মনের মধ্যে সুকোমল বৃত্তিগুলিকে- প্রেম, প্রীতি, পারস্পরিক ভালোবাসা, সততা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, বিশ্বাস, সাহায্য, সহানুভূতি এবং সহনশীলতা এই সমস্ত মহৎ গুণগুলিকে বেশি মাত্রায় জাগ্রত করতে হবে।

মানুষের মধ্য থেকে সংবেদনশীলতা চলে যাচ্ছে। কেবলমাত্র নিজেকে নিয়ে ভাবলে চলবে না, পরিবারের সকলের কথা ভাবতে হবে, সমাজের সকল মানুষের কথা ভাবতে হবে- আজ এই মানসিকতা আর বিশেষ দেখা যায় না বললেই চলে।

স্বার্থপর মানসিকতা আজ সমগ্র সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। মানুষের ভেতরের সুকোমল বৃত্তিগুলো- পারস্পরিক ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সাহায্য, সহানুভূতি এবং সহনশীলতা এই গুরুত্বপূর্ণ গুণগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

দেখেছি অনেক বড় বড় ডিগ্রী সমন্বিত ও বহু মেডেলে সুশোভিত বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়াঝাঁটি অশান্তি, তীব্র ইগোর লড়াই। গৃহে শান্তি বলে কিছু নেই। দুই জন দুই মেরুতে অবস্থান করছেন। অথচ সমাজের মানুষের চোখে বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তি- বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান! অথচ ঘরের দুটি মানুষকেও আনন্দ-শান্তিতে রাখার মতো যোগ্যতাটুকুও অর্জন করতে সক্ষম হননি!

এ হেন সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের পরিণাম সহজেই অনুমেয়। সম্মান, মর্যাদা ও সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়ার লোভ তো আছেই। তার ওপর মানুষের ভোগবাদী মানসিকতা মানুষকে আরো বেশি করে বিষয়ের প্রতি আসক্ত করে তোলে। বেশি বিষয়চিন্তা থেকে মন হয়ে ওঠে বিষয়াসক্ত তার থেকে আসে আসক্তি।

আসক্তি থেকে আসে কামনা যা প্রাপ্তির সংকল্পকে তীব্র করে তোলে। কামনা প্রতিহত হলেই ক্রোধের উৎপত্তি হয়। ক্রোধ থেকে হয় মোহ যা মানুষকে অবিবেক করে তোলে। মোহগ্রস্ত থেকে হয় স্মৃতিবিভ্রম। স্মৃতিবিভ্রম থেকে মানুষের বুদ্ধিনাশ ঘটে।

বুদ্ধিনাশ হলে মানুষ তখন প্রাণাশ হয়ে যায় অর্থাৎ মানুষ একেবারে পশু হয়ে যায়। সব ধরনের আসক্তি থেকে কামনা, লোভ, ক্রোধ সৃষ্টি হয় আর সেটাই মানুষের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখন এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় কি?

আমাদেরকে সমস্ত রকমের আসক্তি কামনা, লোভ এবং ক্রোধকে‌ পরিহার করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে সেই সঙ্গে মনের মধ্যে সুকোমল বৃত্তিগুলিকে- প্রেম, প্রীতি, পারস্পরিক ভালোবাসা, সততা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, বিশ্বাস, সাহায্য, সহানুভূতি এবং সহনশীলতা এই সমস্ত মহৎ গুণগুলিকে বেশি মাত্রায় জাগ্রত করতে হবে।

এরপরও সংসারে যদি কারুর মানসিক বিপর্যয় ঘটে সেক্ষেত্রে দুধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন! একটি হচ্ছে নেতিবাচক চিকিৎসা পদ্ধতি অপরটি হলো ইতিবাচক চিকিৎসা পদ্ধতি। প্রথমে নেতিবাচক চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বলছি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন-

কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং
বিষমে সমুপস্থিতম্।
অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যম-
কীর্তিকরমর্জুন।।

অর্থাৎ এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে তুমি এইরকম যুক্তি তুলে ধরেছে ও এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছ যখন দুই সৈন্যদলের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হয় হয়; এমন সময়ে তুমি বলছ, না আমি যুদ্ধ করতে পারব না, চললাম। আমি হৃষীকেশ যাচ্ছি। এ কাজ অনার্য সুলভ। কোন মহৎচিত্ত ব্যক্তি কখনই এমন দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে পারেন না।

এখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মানসিক আঘাত দিয়ে তিরস্কার করে চিকিৎসা করছেন। অনার্যজুষ্টম্, তুমি যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছ তা আর্যেরা নেয় না। যারা নিকৃষ্টচিত্ত, যারা আর্য নয়, তারাই কেবল তোমার দৃষ্টিভঙ্গি নেয়। অস্বর্গ্যম্, এতে স্বর্গে বা মর্তে কোথাও তোমার গৌরব বৃদ্ধি হবে না।

দেখুন, যে কোনো ধরনের সম্পর্কের স্মৃতি সবসময়ই বেদনারই হয়। আর তা যদি ভালোবাসার সম্পর্কের স্মৃতি হয় তাহলে তো কথাই নেই! সেথায় ভালোবাসার পূজা মন্দিরে নিত্য দেবতার পূজা হয়ে চলে। যদিওবা দেবালয়ে কিংবা মন্দিরে দেবতার প্রতিমার বদল হয়, পূজারীও বদলায়- কিন্তু হৃদয় মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবতার কখনো বদল হয় না, সেখানে পূজারী এবং পূজা কোনো কিছুই বদলায় না।

অকীর্তিকরম্, এতে তোমার বদনামও হবে অপযশ হবে। অর্জুন এক মহান যোদ্ধা, তিনি দৌর্বল্যের শিকার হলে তাঁর সুনামে ভাঁটা পড়বে। অনার্যজুষ্টম্, অস্বর্গ্যম্, অকীর্তিকরম্, এই তিনটি কথা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের ওপরে হঠাৎ মানসিক অভিঘাত রূপ চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে কাজ করল। এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নেতিবাচক কথার মধ্য দিয়ে মানসিক আঘাত দিয়ে চিকিৎসা করলেন।

আমরাও নেতিবাচক পথে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করে মানসিক বিপর্যয়ের চিকিৎসা করতে পারি। আমরা বলবো- তুমি সত্য এবং সংকল্প ভঙ্গ করলে তোমার গৌরব বৃদ্ধি হবে না। এতে তোমার বদনাম ও অপযশ হবে। তোমার সুনামে ভাঁটা পড়বে। তোমার মহৎচিত্ত সামান্য হয়ে যাবে, ছোট হয়ে যাবে। এই ভাবে তাকে মানসিক আঘাতের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে সুফল পাওয়ার জন্য।

ইতিবাচক পথে চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ করে মানসিক বিপর্যয়েরও চিকিৎসা করা যেতে পারে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরবর্তী শ্লোকে অর্জুনকে বলছেন-

ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ
নৈতৎ ত্বয্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং
ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।

ভীরুতা অর্থাৎ দুর্বলতা, সম্পূর্ণ শক্তিহীনতা; যাতে কোন পৌরুষ নেই। হে অর্জুন, এই হীনমন্যতার, ভীরুতার শিকার হয়ো না। কেন? নৈতৎত্বয্যুপপদ্যতে, এ তোমার শোভা পায় না। তুমি এত বড় বীর, তুমি এত মহান, এত বিরাট- এ রকম ব্যবহার তোমার উপযুক্ত নয়।

আমরাও ইতিবাচক পথে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করে মানসিক বিপর্যয়ের চিকিৎসা করতে পারি। আমরা বলবো- এটি তোমার মানায় না, তুমি এত ভালো, তুমি এত উঁচু মনের, তুমি এত মহান, সত্য এবং সংকল্প ভঙ্গ করা তোমার মানায় না এবং তুমি যেমন ব্যবহার করছো তাও তোমায় মানায় না। এটা তোমার প্রকৃত রূপ নয়।

আপনারা ইতিবাচক পথে এভাবেও মানসিক অভিঘাতের মধ্য দিয়ে মানসিক বিপর্যয়ের চিকিৎসা করতে পারেন। সবটাই শান্তভাবে মিষ্টি করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করবেন। আশাকরি এই পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে আপনারা আপনাদের সুন্দর সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হবেন।

দেখুন, যে কোনো ধরনের সম্পর্কের স্মৃতি সবসময়ই বেদনারই হয়। আর তা যদি ভালোবাসার সম্পর্কের স্মৃতি হয় তাহলে তো কথাই নেই! সেথায় ভালোবাসার পূজা মন্দিরে নিত্য দেবতার পূজা হয়ে চলে। যদিওবা দেবালয়ে কিংবা মন্দিরে দেবতার প্রতিমার বদল হয়, পূজারীও বদলায়- কিন্তু হৃদয় মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবতার কখনো বদল হয় না, সেখানে পূজারী এবং পূজা কোনো কিছুই বদলায় না।

পূজাপদ্ধতিও ভুলে যাবার কোনো অবকাশ নেই। কেবল ভক্তিবনতঃ হয়ে নিত্য নিজেকে নিবেদন করে যেতে হয় দেবতার শ্রীচরণে। সেখানে ‘কেন’- এর কোনো উত্তর নেই। সর্বাগ্রে হৃদয় মন্দিরে দেবতাকে প্রতিষ্ঠিত করে ভক্তি, শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও অনুরাগ সহযোগে অঞ্জলী প্রদান করে ভার বহনের শক্তি টুকু প্রার্থনা করুন। আর বলুন- ‘আমার ভার লইব করি, নাই বা দিলে সান্ত্বনা। বহিতে পারি এমনি যেন হয়।’

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………………
স্বামী জয়ানন্দজীর অন্যান্য লেখা পড়ুন:
আপন স্বরূপ
মানসিক বিপর্যয়ে মুক্তির পথ
সম্পর্ক বিপর্যয়ে মুক্তির পথ

এতো চিন্তা কিসের?

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!