ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-স্বামী বিবেকানন্দ

‘অ্যাপীল অ্যাভাল্যাঞ্চ’, ২১ জানুআরী, ১৮৯৪

হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবে কানন্দ গতকল্য বিকালে লা স্যালেট একাডেমীতে (মেমফিস্ শহরে) একটি বক্তৃতা দিয়াছেন। প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুন শ্রোতৃসংখ্যা খুব কম ছিল।

বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ভারতীয় আচার ব্যবহার’। বিবে কানন্দের ধর্মবিষয়ক চিন্তাধারা এই শহরের এবং আমেরিকার অন্যান্য নগরীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের চিত্তে সহজেই সমাদর লাভ করিতেছে।

তাঁহার মতবাদ খ্রীষ্টীয় ধর্মযাজকদের গোঁড়া বিশ্বাসের পক্ষে মারাত্মক। খ্রীষ্টান আমেরিকা এ-যাবৎ পৌত্তলিক ভারতবর্ষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনকে আলোকিত করিবার প্রভূত চেষ্টা করিয়া আসিয়াছে, কিন্তু এখন মনে হইতেছে যে, কানন্দের ধর্মের প্রাচ্য বিভব আমাদের পিতৃপিতামহের উপদিষ্ট প্রাচীন খ্রীষ্টধর্মের সৌন্দর্যকে ছাপাইয়া গিয়াছে এবং উহা আমেরিকার অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত মহলের অনেকের মনে একটি উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র খুঁজিয়া পাইবে।

বর্তমানকাল হইল ‘খেয়ালের’ যুগ। মনে হইতেছে যে, কানন্দ একটি ‘বহুকালের অনুভূত চাহিদা’ মিটাইতে পারিতেছেন। তিনি বোধ করি, তাঁহার দেশের একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত এবং আশ্চর্য পরিমাণে ব্যক্তিগত আকর্ষণ-শক্তিরও অধিকারী। তাঁহার বাগ্মিতায় শ্রোতৃমণ্ডলী মুগ্ধ হইয়া যায়।

যদিও তাঁহার মতবাদ খুব উদার, তবুও গোঁড়া খ্রীষ্টধর্মে প্রশংসা করিবার মত বস্তু সামান্যই তিনি দেখিতে পান। এ পর্যন্ত মেমফিস্‌ শহরে যত বক্তা বা ধর্মযাজক আসিয়াছেন, মনে হয় কানন্দ তাঁহাদের প্রত্যেকের অপেক্ষা বেশী সমাদর বিশেষভাবে লাভ করিয়াছেন।

এই হিন্দু সন্ন্যাসী এখানে যেরূপ সহৃদয় অভ্যর্থনা পাইতেছেন, ভারতে খ্রীষ্টান মিশনরীরা যদি সেরূপ পাইতেন, তাহা হইলে অ-খ্রীষ্টান দেশসমূহে খ্রীষ্টবাণী প্রচারের কাজ খুব সুগম হইত। বিবে কানন্দের গতকল্য বিকালের বক্তৃতা ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গীর দিক্ দিয়া চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল। তিনি তাঁহার স্বদেশের প্রাচীনকাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইতিহাস এবং রীতিনীতির সহিত সম্পূর্ণরূপে পরিচিত। ভারতের বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থান এবং বিষয়সমূহের বর্ণনা খুব সুষ্ঠু ও সহজভাবে দিতে পারেন।

বক্তৃতার সময় মহিলা শ্রোতারা তাঁহাকে ঘন ঘন প্রশ্ন করিতেছিলেন। তিনিও বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করিয়া সব প্রশ্নের উত্তর দিয়াছিলেন। কেবল জনৈক মহিলা যখন তাঁহাকে একটি অবান্তর ধর্মপ্রসঙ্গে টানিয়া আনিতে চাহিয়া একটি প্রশ্ন তুলিলেন, তখন কানন্দ আলোচ্য বিষয় ছাড়িয়া উহার উত্তর দিতে রাজী হন নাই। প্রশ্নকর্ত্রীকে বলিলেন, অন্য কোন সময়ে তিনি ‘আত্মার জন্মান্তর গ্রহণ’ প্রভৃতি বিষয় সম্বন্ধে তাঁহার মত বিবৃত করিবেন।

প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন যে, তাঁহার পিতামহের বিবাহ হইয়াছিল তিন বৎসর বয়সে; আর তাঁহার পিতার আঠার বৎসর বয়সে। বক্তা নিজে বিবাহ করেন নাই। সন্ন্যাসীর বিবাহ করিতে বাধা নাই, কিন্তু বিবাহ করিলে তাঁহার স্ত্রীকেও সন্ন্যাসিনী হইতে হয়। সন্ন্যাসিনী স্ত্রীর ক্ষমতা, সুবিধা এবং সামাজিক সম্মান তাঁহার স্বামীরই মত।৫

একটি প্রশ্নের উত্তরে বক্তা বলেন, ভারতে কোন কারণেই বিবাহ-বন্ধন ছেদের প্রচলন নাই, তবে বিবাহের ১৪ বৎসর পরেও সন্তান না হইলে স্ত্রীর অনুমতি লইয়া স্বামী আর একটি বিবাহ করিতে পারেন। স্ত্রী আপত্তি করিলে ইহা সম্ভব নয়। বক্তা ভারতের প্রাচীন মন্দির এবং সমাধিস্তম্ভসমূহের অতি চমৎকার বর্ণনা দেন। বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, প্রাচীনকালের ভাস্কর এবং শিল্পীদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বর্তমানকালের কারিগরদের অপেক্ষা অনেক বেশী উন্নত ছিল।

স্বামী বিবে কানন্দ আজ রাত্রে ওয়াই. এম. এইচ. হলে এই শহরে তাঁহার শেষ বক্তৃতা করিবেন। তিনি চিকাগোর ‘স্লেটন লাইসিআম ব্যুরো’-র সহিত এই দেশে তিন বৎসরের জন্য বক্তৃতাদানের একটি চুক্তি করিয়াছেন। কাল তিনি চিকাগো রওনা হইবেন। ২৫ তারিখ রাত্রিতে ওখানে তাঁহার একটি বক্তৃতা দিবার কথা।

ডেট্রয়েট ট্রিবিউন, ১৫ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

গত সন্ধ্যায় বেশ কিছু সংখ্যক শ্রোতা ব্রাহ্মসমাজের প্রসিদ্ধ হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবে কানন্দের দর্শন ও তাঁহার বক্তৃতা শ্রবণের সুযোগ পাইয়াছিলেন। ইউনিটি ক্লাবের উদ্যোগে ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এ এই বক্তৃতার আয়োজন হইয়াছিল। তিনি তাঁহার দেশীয় পোষাক পরিয়া আসিয়াছিলেন। তাঁহার কমনীয় মুখমণ্ডল এবং বলিষ্ঠ দেহ তাঁহার চেহারায় একটি সম্ভ্রান্ত ভাবের সৃষ্টি করিয়াছিল। বাগ্মিতায় তিনি শ্রোতৃমণ্ডলীর প্রখর মনোযোগ আকর্ষণ করেন। ঘন ঘন করতালি পড়িতেছিল।

বক্তার আলোচ্য বিষয় ছিল-‘ভারতের আচার-ব্যবহার’। উহা তিনি উৎকৃষ্ট ইংরেজীতে উপস্থাপিত করেন। তিনি বলেন, তাঁহাদের দেশের ‘ইণ্ডিয়া’ এবং দেশবাসীর ‘হিন্দু’ নাম ঠিক নয়। উহা বিদেশীদের উদ্ভাবিত। তাঁহাদের দেশের প্রকৃত নাম ‘ভারত’ এবং অধিবাসীরা ‘ব্রাহ্মণ’। প্রাচীনকালে তাঁহাদের কথ্য ভাষা ছিল সংস্কৃত। প্রত্যেকটি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত পরিষ্কার বোধগম্য অর্থ ছিল, কিন্তু এখন সে-সব চলিয়া গিয়াছে। জুপিটার শব্দের সংস্কৃত অর্থ ‘স্বর্গস্থ পিতা’।

বর্তমানকালে উত্তর ভারতের সব ভাষাই মোটামুটি একপ্রকার; কিন্তু উত্তর ভারতের লোক দক্ষিণ ভারতে গেলে তথাকার লোকের সহিত কথাবার্তা বলিতে পারিবে না। ফাদার মাদার, সিষ্টার ব্রাদার প্রভৃতি শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দগুলি শুনিতে অনেকটা একই রকম। বক্তা বলেন, এই কারণে এবং অন্যান্য তথ্যের প্রমাণ হইতেও তাঁহার মনে হয়, আমরা সকলেই একটি সাধারণ সূত্র-আর্যজাতি হইতে উদ্ভূত। এই আদিম আর্যজাতির প্রায় সব শাখাই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য হারাইয়া ফেলিয়াছে।

প্রাচীন ভারতের সমাজে চারটি শ্রেণীবিভাগ ছিল-পুরোহিত, রাজা ও সৈনিক, বণিক ও শিল্পী এবং শ্রমিক ও ভৃত্য। প্রথম তিন শ্রেণীর বালকগণকে যথাক্রমে দশ, এগার এবং ত্রয়োদশ বৎসর বয়সে শিক্ষার জন্য গুরুকুলে অধ্যাপকদের তত্ত্বাবধানে পাঠান হইত এবং তাহাদিগকে ত্রিশ, পঁচিশ ও কুড়ি বৎসর পর্যন্ত সেখানে থাকিতে হইত। প্রাচীনকালে বালক ও বালিকা উভয়ের জন্যই শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।

এখন বালকদেরই সুযোগ বেশী। অবশ্য দীর্ঘকালের এই ভুলটি শুধরাইবার চেষ্টা চলিতেছে। বৈদেশিক অধিকারের পূর্বে ভারতবর্ষের দর্শন এবং নীতি-নিয়মাদির অনেক অংশ প্রাচীনকালে নারীদের দ্বারা প্রণীত। হিন্দুসমাজে নারীর স্বকীয় অধিকার আছে। এই অধিকার তাঁহারা বজায় রাখেন। তাঁহাদের স্বপক্ষে আইনও রহিয়াছে।

গুরুকুল হইতে প্রত্যাবর্তনের পর ছাত্রেরা বিবাহ করিয়া সংসারী হইতে পারিত। সংসারের দায়িত্ব স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই এবং উভয়েরই নিজস্ব অধিকার ছিল। ক্ষত্রিয়দের ক্ষেত্রে কন্যা অনেক সময় নিজের পতি নিজেই মনোনয়ন করিত; কিন্তু অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই পিতামাতাই ঐ ব্যবস্থা করিতেন। বর্তমানকালে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য অনবরত চেষ্টা চলিতেছে।

হিন্দুদের বিবাহ-অনুষ্ঠানটি বড় সুন্দর। বর এবং কন্যা পরস্পর পরস্পরের হৃদয় স্পর্শ করিয়া ভগবান্ এবং সমবেত সকলকে সাক্ষী মানিয়া শপথ করে যে, একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকিবে। বিবাহ না করা পর্যন্ত কেহ পুরোহিত হইতে পারে না। প্রকাশ্য ধর্মানুষ্ঠানে যোগ দিবার সময় পুরুষের সহিত তাহার পত্নীও যায়। হিন্দুরা এই পাঁচটিকে কেন্দ্র করিয়া মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, যথা-দেবতা পিতৃপুরুষ দরিদ্র, ইতর প্রাণী এবং ঋষি বা শাস্ত্র।

হিন্দুগৃহস্থের বাড়ীতে যতক্ষণ সামান্য কিছুও থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত অতিথিকে ফিরিয়া যাইতে হয় না। অতিথির পরিতৃপ্তিপূর্বক ভোজন শেষ হইলে গৃহের শিশুরা খায়, তারপর তাহাদের পিতা এবং সর্বশেষে জননী। হিন্দুরা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দরিদ্র জাতি; কিন্তু দুর্ভিক্ষের সময় ছাড়া কখনও কেহ ক্ষুধায় মারা যায় না। সভ্যতা এক বিরাট কীর্তি। তুলনাস্বরূপ বলা হয় যে, ইংলণ্ডে যদি প্রতি চারিশত ব্যক্তির মধ্যে একজন মদ্যপায়ী থাকে তো ভারতে ঐ অনুপাতে প্রতি দশ লক্ষে একজন।

বক্তা মৃত ব্যক্তির শবদাহ-অনুষ্ঠানের একটি বর্ণনা দেন। কোন কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্র ছাড়া এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোন প্রকাশ্য প্রচার করা হয় না। পনর দিন উপবাসের পর মৃতের আত্মীয়েরা পূর্বপুরুষদের নামে দরিদ্রদিগকে অর্থাদি দান করেন অথবা জনহিতকর কোন প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। নৈতিক আদর্শের দিক্‌ দিয়া হিন্দুরা অন্যান্য সকল জাতি অপেক্ষা প্রভূত উন্নততর।

হিন্দু দর্শন-

ডেট্রয়েট ফ্রী প্রেস, ১৬ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

মানরা যখন জেরুজালেম ধ্বংস করে, তখন বহু সহস্র য়াহুদী ভারতবর্ষে আসিয়া বসবাস করে। আরবগণ কর্তৃক স্বদেশ হইতে বিতাড়িত হইয়া বহু সহস্র পারসীকও ভারতে আশ্রয় পায়, কেহই নিপীড়িত হয় নাই। হিন্দুরা বিশ্বাস করে-সকল ধর্মই সত্য। তবে তাহাদের ধর্ম অপর ধর্মসমূহ অপেক্ষা প্রাচীনতর। ইংরেজ মিশনরীদের প্রথম দলটিকে ইংরেজ সরকার যখন জাহাজ হইতে ভারতে নামিতে বাধা দেন, তখন একজন হিন্দুই তাঁহাদের হইয়া দরবার করিয়া তাঁহাদিগকে নামিতে সাহায্য করেন।

যাহা সব কিছু মানিয়া লয়, তাহাই তো ধর্মবিশ্বাস। বক্তা অন্ধের হস্তী দর্শনের সহিত ধর্মমতের তুলনা করেন। এক একজন অন্ধ হাতীর দেহের এক একটি অংশ স্পর্শ দ্বারা অনুভব করিয়া হাতী কি রকম, তাহার সিদ্ধান্ত করিয়া বসিয়াছিল। নিজের অভিজ্ঞতার দিক্ দিয়া প্রত্যেকের উক্তিই সত্য হইলেও হাতীর সামগ্রিক বর্ণনা তো কোনটি হইতেই পাওয়া যায় নাই। হিন্দু দার্শনিকরা বলেন, ‘সত্য হইতে সত্যে, নিম্নতর সত্য হইতে উচ্চতর সত্যে।’

সব মানুষ কোন এক সময় একই রীতিতে চিন্তা করিবে, ইহা যাঁহারা আশা করেন তাঁহারা অলস স্বপ্ন দেখিতেছেন মাত্র। এরূপ অবস্থা উপস্থিত হইলে ধর্মের মৃত্যু ঘটিবে। প্রত্যেক ধর্মই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হইয়া পড়ে, আর প্রত্যেকটি দল দাবী করে যে, উহাই সত্য এবং অপরেরা ভ্রান্ত। বৌদ্ধধর্মে অপর মতাবলম্বীদের উপর নিপীড়ন অবিদিত।

বৌদ্ধধর্মই প্রথম নানা দেশে প্রচারক পাঠায় এবং বলিতে পারে যে, লক্ষ লক্ষ লোককে এক বিন্দু রক্তপাত না করিয়া স্বমতে আনিয়াছে। নানা দোষ এবং কুসংস্কার সত্ত্বেও হিন্দুরা কখনও অন্যের উপর অত্যাচার করে নাই। বক্তা জানিতে চান, নানা খ্রীষ্টান দেশের সর্বত্র যে-সর্ব অসাম্য রহিয়াছে, খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীরা ঐগুলি অনুমোদন করেন কিভাবে?

অলৌকিক ঘটনা-

ইভনিং নিউজ, ১৭ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

‘আমি আমার ধর্মের প্রমাণস্বরূপ কোন অলৌকিক ঘটনা দেখাইব-নিউজ-পত্রিকার এই অনুরোধ আমার পক্ষে রাখা সম্ভব নয়।’-এই কাগজের জনৈক প্রতিনিধি বিবে কানন্দকে ঐ-বিষয়ক সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি দেখাইলে তিনি উপরিউক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, প্রথমতঃ আমি অলৌকিক ঘটনা লইয়া কাজ করি না, আর দ্বিতীয়তঃ আমি যে হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত, উহা অলৌকিক ঘটনার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।

অলৌকিক ঘটনা বলিয়া কিছু আমরা মানি না। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের এলাকার বাহিরে আশ্চর্য অনেক কিছু ঘটিয়া থাকে সত্য, কিন্তু ঐগুলি কোন-না-কোন নিয়মের অধীন। আমাদের ধর্মের সহিত ঐগুলির কোন সম্পর্ক নাই। যে-সব আশ্চর্য ক্রিয়াকলাপ ভারতবর্ষে করা হয় বলিয়া বৈদেশিক সংবাদপত্রে ছাপা হয়, ঐগুলির অধিকাংশই হইল হাতের চাল বা সম্মোহন-বিদ্যার প্রভাবজনিত চোখের ভ্রম। যথার্থ জ্ঞানী পুরুষেরা কখনও ঐ-সব করেন না।

তাঁহারা কখনও পয়সার জন্য হাটে বাজারে এই-সব তুকতাক দেখাইয়া দেশময় ঘুরিয়া বেড়ান না। যাঁহারা যথার্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজিজ্ঞাসু এবং শুধু বালসুলভ কৌতূহলাক্রান্ত নয়, তাঁহারা ঐ-সকল জ্ঞানী-পুরুষের দেখা পান এবং তাঁহাদিগকে চিনিতে পারেন।

মানুষের দেবত্ব-

ডেট্রয়েট ফ্রী প্রেস, ১৮ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

হিন্দু দার্শনিক এবং পুরোহিত স্বামী বিবে কানন্দ গত রাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এ ‘মানুষের দেবত্ব’ সম্বন্ধে বলিয়া তাঁহার বক্তৃতা বা ধর্মব্যাখ্যান-মালার উপসংহার করিয়াছেন। আবহাওয়া খারাপ থাকা সত্ত্বেও প্রাচ্যদেশীয় এই ভ্রাতার (এই নামেই তাঁহাকে অভিহিত করা তিনি পছন্দ করেন) বক্তৃতামঞ্চে আসিবার আধ ঘণ্টা পূর্বেই সমগ্র গীর্জাটি দরজা পর্যন্ত শ্রোতৃমণ্ডলীর ভিড়ে ভরিয়া যায়।

তাঁহাদের মধ্যে সকল শ্রেণীর ও বৃত্তির লোকই ছিলেন-আইনজীবী, বিচারক, খ্রীষ্ট্রীয় ধর্মযাজক, ব্যবসায়ী, একজন য়াহুদী ধর্মযাজক এবং মহিলাদের তো কথাই নাই। মহিলারা বার বার উপস্থিত হইয়া এবং প্রখর মনোযোগ সহকারে তাঁহার ভাষণ শুনিয়া এই শ্যামবর্ণ আগন্তুককে তাঁহাদের ভূরি ভূরি প্রশংসাবাদ অর্পণ করিবার সুস্পষ্ট প্রবণতা প্রমাণ করিয়াছেন।

বক্তা ভদ্রলোকদিগের বসিবার ঘরে বসিয়া আলাপ আলোচনায় যেমন সকলকে আকর্ষণ করিতে পারেন, সাধারণ বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়াইয়াও সেইরূপ পারেন।

গতরাত্রের বক্তৃতা পূর্বেকারগুলি হইতে কম বর্ণনামূলক ছিল। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবৎ বিবে কানন্দ মানবীয় এবং ঐশ্বরিক ব্যাপার লইয়া তত্ত্ববিদ্যার একটি আস্তরণ বুনিয়া চলেন। তাঁহার কথাগুলি এত যুক্তিসঙ্গত যে, বিজ্ঞানকে তিনি সাধারণ বুদ্ধির মত সরল করিয়া তুলেন। ন্যায়গর্ভ ভাষণটি যেন প্রাচ্য গন্ধদ্রব্য দ্বারা সুবাসিত তাঁহার স্বদেশে হাতে-বোনা এবং অতি চমৎকার নানা রঙের একটি বস্ত্রের মতই সুন্দর, উজ্জ্বল, চিত্তাকর্ষক এবং আনন্দদায়ী।

শিল্পী যেমন তাঁহার চিত্রে নিপুণভাবে নানা রঙ ব্যবহার করেন, এই শ্যামবর্ণ ভদ্রলোকও তাঁহার ভাষণে সেইরূপ কাব্যময় উপমা প্রয়োগ করেন। যেখানে যেটি মানায় ঠিক সেখানে সেইটি তিনি বসাইয়া যান। উহার প্রতিক্রিয়া কিছু অদ্ভুত ঠেকিলেও উহার একটি আশ্চর্য আকর্ষণ আছে। চলচ্চিত্রের মত পর পর দ্রুত তাঁহার যুক্তিপ্রতিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলি উপস্থিত হইতেছিল, আর এই কুশলী বক্তার শ্রমও মাঝে মাঝে শ্রোতৃবৃন্দের উৎসাহপূর্ণ করতালি দ্বারা সার্থকতা লাভ করিতেছিল।

বক্তৃতার পূর্বে ঘোষণা হয় যে, বক্তার নিকট অনেকগুলি প্রশ্ন আনা হইয়াছে। ইহাদের কতকগুলির উত্তর তিনি ব্যক্তিগতভাবে আলাদা দেওয়াই ভাল মনে করেন। তবে তিনটি প্রশ্ন তিনি বাছিয়া রাখিয়াছেন, ঐগুলির প্রত্যুত্তর বক্তৃতামঞ্চ হইতেই দিবেন। প্রশ্নগুলি এইঃ

১. ভারতের লোকেরা কি তাহাদের শিশু-সন্তানদের কুমীরের মুখে নিক্ষেপ করে?
২. জগন্নাথের রথের চাকার নীচে পড়িয়া কি তাহারা মৃত্যুবরণ করে?
৩. মৃত স্বামীর সহিত কি তাহারা জীবিত বিধবাকেও জোর করিয়া দাহ করে?

বিদেশে একজন আমেরিকানকে নিউ ইয়র্ক শহরের রাস্তায় রেড-ইণ্ডিয়ানরা দৌড়াদৌড়ি করে কিনা-এই বিষয়ে, অথবা আমেরিকা সম্বন্ধে ইওরোপে এখনও পর্যন্ত প্রচলিত এই ধরনের আজগুবি খবর সম্বন্ধে যদি প্রশ্ন করা হয়, তাহা হইলে তিনি যেভাবে ঐ-সব প্রশ্নের উত্তর দিবেন, বক্তা বিবে কানন্দ প্রথম প্রশ্নটির জবাব সেই ভাবেই দিলেন। অর্থাৎ প্রশ্নটি এতই আজগুবী যে, উহার কোন গুরুত্বপূর্ণ উত্তর নিষ্প্রয়োজন।

কোন কোন সরল কিন্তু অজ্ঞ লোক তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, হিন্দুরা শুধু স্ত্রী-শিশুই কেন কুমীরদের মুখে দেয়?-ইহার উত্তরে বিবে কানন্দ ব্যঙ্গ করিয়া বলেন, উহার কারণ বোধ করি এই যে, স্ত্রী-শিশুদের মাংস বেশী নরম আর ঐ আজব দেশের নদীতে যে-সব হিংস্র জলজন্তু থাকে, তাহারা ঐরূপ মাংস সহজে হজম করিতে পারে। জগন্নাথ-সংক্রান্ত প্রশ্নটি সম্বন্ধে বক্তা ঐ তীর্থস্থানের দীর্ঘকাল প্রচলিত রথযাত্রা ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দেন এবং বলেন যে,

খুব সম্ভবতঃ কখনও কোন কোন অত্যুৎসাহী ভক্ত রথসংলগ্ন দড়িটি ধরিতে এবং টানিতে গিয়া পা পিছলাইয়া চাকার নীচে পড়িয়া মারা গিয়া থাকিবে। এইরূপ কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার অতিরঞ্জিত বর্ণনা হইতে পরে নানা বিকৃত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে এবং ঐ-সব শুনিয়া অন্য দেশের সহৃদয় লোক আতঙ্কে শিহরিয়া উঠেন।

হিন্দুরা জীবিত বিধবাদের অগ্নিসাৎ করে-বিবে কানন্দ ইহা অস্বীকার করেন। তবে ইহা সত্য যে, কখনও কখনও কোন বিধবা নিজে স্বেচ্ছায় অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়াছেন। এরূপ যখন ঘটিয়াছে, তখন পুরোহিত এবং সাধুসন্তেরা তাঁহাদিগকে ঐ কার্য হইতে বিরত থাকিতে পীড়াপীড়ি করিয়াছেন; কেননা ইঁহারা সকলেই আত্মহত্যার বিরোধী।

সকলের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও যদি পতিব্রতা বিধবা স্বামীর সহিত সহমৃতা হইবার জন্য জিদ করিতেন, তাহা হইলে তাঁহাকে একটি ‘অগ্নিপরীক্ষা’ দিতে হইত। তিনি অগ্নিশিখায় প্রথমে হাত ঢুকাইয়া দিতেন। যদি হাত পুড়িয়া যাইত, তাহা হইলে তাঁহার স্বামীর সহিত সহমরণের ইচ্ছায় আর বাধা দেওয়া হইত না। কিন্তু ভারতই তো একমাত্র দেশ নয়, যেখানে প্রেমিকা নারী প্রেমাস্পদের মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় তাঁহার সহিত অমৃতলোকে অনুগমন করিয়াছেন।

এই ধরনের মৃত্যুবরণ প্রত্যেক দেশেই হইয়াছে। যে-কোন দেশে ইহা এক প্রকার অস্বাভাবিক ধর্মোন্মত্ততা। অন্যত্র যেরূপ, ভারতেও উহা ঐরূপই অস্বাভাবিক। বক্তা পুনরায় বলেন, ‘না, ভারতবাসী নারীদের পুড়াইয়া মারে না। পাশ্চাত্যদেশের মত তাহারা কখনও ডাইনীদেরও দগ্ধ করে নাই।’

অতঃপর বক্তৃতার প্রকৃত বিষয়ে আসিয়া বিবে কানন্দ প্রথমে মানব-জীবনের শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করেন। শরীর বাহিরের খোসা মাত্র; মনও একটি ক্রিয়াশীল বস্তুবিশেষ, ইহার কাজ খুব ত্বরিত এবং রহস্যময়; একমাত্র আত্মাই সুস্পষ্ট ব্যক্তি-সত্তা। আত্মার অন্তরস্বরূপের জ্ঞান হইলে মুক্তিলাভ হয়। আমরা যাহাকে ‘পরিত্রাণ’ বলি হিন্দুরা উহাকে বলেন ‘মুক্তি’।

বেশ বলবান্ যুক্তিসহায়ে বক্তা প্রমাণ করেন যে, প্রত্যেক আত্মাই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন। আত্মা যদি কোন কিছুর অধীন হইত, তাহা হইলে উহা কখনও অমরত্ব লাভ করিতে পারিত না। কোন ব্যক্তি কিভাবে আত্মার স্বাধীনতা ও অমরত্বের প্রত্যাক্ষানুভূতি লাভ করিতে পারে, তাহার উদাহরণস্বরূপ বক্তা তাঁহার দেশের একটি উপকথা বর্ণনা করেন।

আসন্নপ্রসবা এক সিংহী একটি মেষের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িবার সময় বাচ্চা প্রসব করিয়া ফেলে এবং পরে মারা যায়। সিংহশাবকটিকে তখন এক মেষী স্তন্য পান করাইয়া বাঁচায়। শাবকটি মেষের দলে বাড়িতে থাকে। নিজেকে সে মেষ বলিয়া মনে করিত এবং আচরণও ঠিক মেষের ন্যায়ই করিত।

একদিন আর একটি সিংহ আসিয়া তাহাকে দেখিতে পায় এবং তাহাকে একটি জলাশয়ের নিকট লইয়া যায়। জলে সে নিজের প্রতিবিম্ব অপর সিংহের মত দেখিয়া বুঝিল-সে মেষ নয়, সিংহ। তখন সে সিংহের ন্যায় গর্জন করিয়া উঠিল। আমাদের অনেকেরই দশা ঐ ভ্রান্ত সিংহ-মেষের ন্যায়।

নিজদিগকে ‘পাপী’ মনে করিয়া আমরা কোণে লুকাইয়া থাকি এবং যত প্রকারে সম্ভব হীন আচরণ করিয়া চলি। নিজেদের আত্মার পূর্ণতা ও দেবত্ব আমরা দেখিতে পাই না। নরনারীর যে ‘আমি’, উহাই আত্মা। আত্মা যদি প্রকৃতপক্ষে মুক্ত, তাহা হইলে অনন্ত পূর্ণ স্বরূপ হইতে ব্যষ্টিগত বিচ্ছিন্নতা আসিল কিরূপে?

-হ্রদের জলে সূর্যের যেমন আলাদা আলাদা অসংখ্য প্রতিবিম্ব পড়ে, ঠিক সেই ভাবে। সূর্য এক, কিন্তু প্রতিবিম্ব-সূর্য বহু। মানবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ এক, কিন্তু নানা দেহে প্রতিবিম্ব-আত্মা বহু। বিম্ব-স্বরূপ পরমাত্মার অব্যাহত স্বাধীনতাকে উপলব্ধি করা যায়। আত্মার কোন লিঙ্গ নাই। স্ত্রী-পুরুষ-ভেদ দেহেই। এই প্রসঙ্গে বক্তা সুইডনবর্গের দর্শন ও ধর্মের মধ্যে গভীরভাবে প্রবেশ করেন।

হিন্দু বিশ্বাসসমূহের সহিত এই আধুনিক সাধু মহাপুরুষের আধ্যাত্মিক ভাবধারার সম্বন্ধ খুবই স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। মনে হইতেছিল সুইডনবর্গ যেন প্রাচীন এক হিন্দু ঋষির ইওরোপীয় উত্তরাধিকারী-যিনি এক সনাতন সত্যকে বর্তমান কালের পোষাক পরাইয়া উপস্থাপিত করিয়াছেন। শ্রেষ্ঠ ফরাসী দার্শনিক ও ঔপন্যাসিক (বালজাক?) তাঁহার ‘পূর্ণ আত্মা’র উদ্দীপনাময় প্রসঙ্গের মধ্যে এই ধরনের চিন্তাধারাকে অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন মনে করিয়াছেন।

প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই পরিপূর্ণতা বিদ্যমান। তাহার শারীরিক সত্তার অন্ধকার গুহাগুলির ভিতর উহা যেন শুইয়া আছে। যদি বল, ভগবান্‌ তাঁহার পূর্ণতার কিছু অংশ মানুষকে দেন বলিয়াই মানুষ সৎ হয়, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, পরম দেবতা ভগবানের পূর্ণতা হইতে পৃথিবীর মানুষকে প্রদত্ত ততটা অংশ বাদ গেল।

বিজ্ঞানের অব্যর্থ নিয়ম হইতে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক ব্যষ্টি আত্মার মধ্যে পূর্ণতা নিহিত, আর এই পূর্ণতাকে লাভ করার নামই মুক্তি-ব্যক্তিগত অনন্ততার উপলব্ধি। প্রকৃতি, ঈশ্বর, ধর্ম-তিনই তখন এক।

সব ধর্মই ভাল। এক গ্লাস জলের মধ্যে যে বাতাসের বুদ্বুদটি আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে, উহা চেষ্টা করে বাহিরের অনন্ত বায়ুর সহিত যুক্ত হইতে। বাতাসের বুদ্বুদটি যদি তেল, ভিনিগার বা এইরূপ অন্যান্য বিভিন্ন ঘনত্ব বিশিষ্ট তরল পদার্থে আটক পড়ে, তাহা হইলে উহার মুক্তির চেষ্টা তরল পদার্থটির ঘনত্ব অনুযায়ী কম বেশী ব্যাহত হয়। জীবাত্মাও সেইরূপ বিভিন্ন দেহের মধ্য দিয়া উহার স্বকীয় অনন্ততা লাভের জন্য প্রয়াস করিয়া চলিয়াছে।

আচার-ব্যবহার, পারিপার্শ্বিক ও বংশগত বৈশিষ্ট্য এবং জলবায়ুর প্রভাব-এই-সব দিক্ বিচার করিয়া কোন এক মানবগোষ্ঠীর পক্ষে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম হয়তো সর্বাপেক্ষা উপযোগী। অনুরূপ কারণে আর একটি ধর্ম অপর এক মানবগোষ্ঠীর পক্ষে প্রশস্ত। বক্তার সিদ্ধান্তগুলির চুম্বক বোধ করি এই যে, যাহা কিছু আছে, সবই উত্তম। কোন একটি জাতির ধর্মকে হঠাৎ পরিবর্তন করিতে যাওয়া যেন-আল্পস্ পর্বত হইতে প্রবহমানা

একটি নদীকে দেখিয়া কেন উহা তাহার বর্তমান পথটি লইয়াছে, সেই বিষয়ে সমালোচনা করা। আর এক ব্যক্তি হয়তো অভিমত প্রকাশ করিলেন যে, হিমালয় হইতে নিঃসৃতা একটি খরস্রোতা নদী হাজার হাজার বৎসর যে-পথে বহিয়া চলিয়াছে, ঐ পথ উহার পক্ষে স্বল্পতম এবং সুষ্ঠুতম পথ নয়।

খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী ঈশ্বরকে আমাদের পৃথিবীর ঊর্ধ্বে কোথাও উপবিষ্ট একজন ব্যক্তি বলিয়া কল্পনা করেন। কাজেই যে-স্বর্গে সোনার রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া মাঝে মাঝে নীচের মর্ত্যলোকের দিকে তাকাইয়া স্বর্গ-মর্ত্যের পার্থক্য বুঝা যায় না, এমন স্বর্গে তিনি স্বস্তিবোধ করিতে পারেন না।

যাহাকে খ্রীষ্টানরা আচরণের ‘স্বর্ণোজ্জ্বল নীতি’৬ বলিয়া থাকেন, উহার পরিবর্তে হিন্দুরা এই নীতিতে বিশ্বাস করেন যে, যাহা কিছু ‘অহং’শূন্য তাহাই ভাল; এবং ‘আমিত্ব’-মাত্রই খারাপ, আর এই বিশ্বাস দ্বারা যথাকালে মানুষ তাহার আত্মার অনন্ত স্বরূপ ও মুক্তি লাভ করিতে পারিবে। বিবে কানন্দ বলেন, তথাকথিত ‘সোনার নীতি’টি কী ভয়ানক অমার্জিত! সর্বদাই ‘আমি, আমি’।

অন্যের নিকট হইতে তুমি নিজে যেরূপ আচরণ চাও, তুমিও তাহার প্রতি সেইরূপ আচরণ কর! ইহা এক ভীষণ বর্বরোচিত ক্রূর নীতি, কিন্তু বক্তা খ্রীষ্টধর্মের এই মতবাদের নিন্দা করিতে চান না, কেননা যাহারা ইহাতে সন্তুষ্ট, তাহারা ইহার সহিত নিজদিগকে বেশ মানাইয়া লইয়াছে, বুঝিতে হইবে। যে বিপুল জলধারাটি বহিয়া চলিয়াছে, উহাকে বহিতে দেওয়াই কর্তব্য। যিনি উহার গতিকে পরিবর্তিত করিতে চাইবেন, তিনি নির্বোধ।

প্রকৃতিই প্রয়োজনমত সকল সমস্যার সমাধান করিয়া দিবেন। বিবে কানন্দ বেশ জোর দিয়াই বলেন যে, প্রেততত্ত্ববাদী বা অদৃষ্টবাদী-ইঁহারা সকলেই ভাল এবং খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীগণকে ধর্মান্তরিত করিবার তাঁহার কোন ইচ্ছা নাই। যাঁহারা খ্রীষ্টধর্ম অনুসরণ করিয়া চলিতেছেন, তাঁহারা বেশ ভালই করিতেছেন। তিনি যে হিন্দু, ইহাও উত্তম। তাঁহার দেশে বিভিন্ন স্তরের মেধাবিশিষ্ট লোকের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের ধর্মমত প্রচলিত আছে।

সবটা মিলিয়া একটি ধারাবাহিক আধ্যাত্মিক ক্রমোন্নতি লক্ষিত হয়। হিন্দুধর্ম আমিত্বকে বড় করে না। ইহার আকাঙ্ক্ষাসমূহ কখনও মানুষের অহমিকাকে জড়াইয়া নয়, ইহা কখনও পুরস্কারের আশা বা শাস্তির ভয় তুলিয়া ধরে না। হিন্দুধর্ম বলে, ব্যক্তি-মানব তাহার ‘অহং’কে বর্জন করিয়া অনন্তত্ব লাভ করিতে পারে।

মানুষকে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের জন্য প্রলোভিত করিবার রীতি-ভগবান্ স্বয়ং পৃথিবীর একটি মানবগোষ্ঠীর নিকট প্রকট হইয়া ইহা প্রবর্তন করিয়াছেন বলা হইয়া থাকে-বস্তুতঃ অতি নিষ্ঠুর এবং ভয়াবহরূপে দুর্নীতিজনক। ধর্মান্ধগণ খ্রীষ্টীয় মতবাদ যদি আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করে, তাহা হইলে উহা তাহাদের নৈতিক স্বভাবের উপর একটি লজ্জাকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে আত্মার অনন্ততা উপলব্ধির সময় পিছাইয়া যায়।

ডেট্রয়েট ট্রিবিউন, ১৮ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

গতরাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চে বক্তৃতা-প্রসঙ্গে স্বামী বিবে কানন্দ বলেন যে, ভারতে ধর্ম বা সামাজিক নিয়মের বশে বিধবাদের কখনও জোর করিয়া জীবন্ত দাহ করা হয় নাই। এই ঘটনাগুলির সব ক্ষেত্রেই তাঁহারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করিয়াছেন। পূর্বে ভারতের একজন সম্রাট্ সতীদাহ প্রথা বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু ক্রমশঃ পরে উহা আবার প্রচলিত হয়। অবশেষে ইংরেজ সরকার উহা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন।

সকল ধর্মেই একশ্রেণীর লোক আছে, যাহারা ধর্মোন্মাদ। ইহা খ্রীষ্টধর্মে যেমন, হিন্দুধর্মেও তেমনি। ভারতে এমন সব ধর্মোন্মাদ দেখা যায়, যাহারা তপশ্চরণের নামে দিনের পর দিন সর্বক্ষণ মাথার উপরে হাত তুলিয়া রাখে। দীর্ঘকাল ঐরূপ করিবার ফলে হাতটি ক্রমে অসাড় হইয়া যায় এবং আজীবন ঐ অবস্থায় থাকে। কেহ কেহ ব্রত গ্রহণ করে-একভাবে নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিবার। ক্রমে ইহাদের শরীরের নীচের দিকে সম্পূর্ণ অবশ হইয়া যায় এবং উহারা আর হাঁটিতে পারে না।

সব ধর্মই সত্য। মানুষ নৈতিকতা অনুশীলন করে, কোন দৈবাদেশের জন্য নয়, উহা ভাল বলিয়াই করে। হিন্দুরা ধর্মান্তরিত-করণে বিশ্বাস করে না। বক্তা বলেন, উহা অপচেষ্টা। অধিকাংশ ধর্মের পিছনে কত ঐতিহ্য, শিক্ষাদীক্ষা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা রহিয়াছে। অতএব কোন এক ধর্মপ্রচারকের পক্ষে অন্য ধর্মাবলম্বী কাহারও ধর্মবিশ্বাসসমূহকে ভুল বলিয়া ঘোষণা করা কী নির্বুদ্ধিতা!

ইহা যেন কোন এশিয়াবাসীর আমেরিকায় আসিয়া মিসিসিপি নদীর গতিপথ দেখিবার পর ঐ নদীকে ডাকিয়া বলা, ‘তুমি সম্পূর্ণ ভুল পথে প্রবাহিত হইতেছ। তোমাকে উৎপত্তি-স্থানে ফিরিয়া নূতন করিয়া যাত্রা শুরু করিতে হইবে।’ আবার আমেরিকাবাসী কেহ যদি আল্পস্ পর্বতে গিয়া জার্মান সাগরে পড়িতেছে এমন কোন নদীকে বলে যে, তাহার গতিপথ অত্যন্ত আঁকাবাঁকা এবং ইহার একমাত্র প্রতিকার হইল নূতন নির্দেশ অনুসারে প্রবাহিত হওয়া-তাহা হইলে উহাও একই প্রকার নির্বুদ্ধিতা হইবে।

বক্তা বলেন যে, খ্রীষ্টানরা যাহাকে ‘সোনার নিয়ম’ বলেন, উহা মাতা বসুন্ধরার মতই পুরাতন। নৈতিকতার যাবতীয় বিধানেরই উৎপত্তি এই নিয়মটির মধ্যেই খুঁজিয়া পাওয়া যায়। মানুষ তো স্বার্থপরতার একটি পুঁটলি বিশেষ।

বক্তা বলেন যে, পাপীরা নরকাগ্নিতে অনন্তকাল শাস্তি ভোগ করিবে-এই মতবাদ সম্পূর্ণ অর্থহীন। দুঃখ রহিয়াছে, ইহা যখন জানা কথা, তখন পূর্ণ সুখ কি করিয়া সম্ভব? বক্তা কোন কোন তথাকথিত ধার্মিক ব্যক্তির প্রার্থনা করিবার রীতিকে বিদ্রূপ করেন। তিনি বলেন যে, হিন্দু চোখ বুজিয়া অন্তরাত্মার উপাসনা করে, কিন্তু কোন কোন খ্রীষ্টানকে প্রার্থনার সময় তিনি কোন একটি দিকে তাকাইয়া থাকিতে দেখিয়াছেন, যেন স্বর্গের সিংহাসনে উপবিষ্ট ভগবানকে তাঁহারা দেখিতে পাইতেছেন!

ধর্মের ব্যাপারে দুটি চরম হইল-ধর্মান্ধ এবং নাস্তিক। যে নাস্তিক, তাহার কিছু ভাল দিক্‌ আছে, কিন্তু ধর্মান্ধের বাঁচিয়া থাকা শুধু তাহার ক্ষুদ্র ‘আমি’টার জন্যই। জনৈক অজ্ঞাত ব্যক্তি বক্তাকে যীশুর হৃদয়ের একটি ছবি পাঠাইয়াছেন। এইজন্য তাঁহাকে তিনি ধন্যবাদ দিতেছেন, তবে তাঁহার মতে, ইহা গোঁড়ামির অভিব্যক্তি। ধর্মান্ধকে কোন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করা চলে না। তাহারা একটি অভিনব বস্তুবিশেষ।

ভগবৎপ্রেম-

ডেট্রয়েট ট্রিবিউন, ২১ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

গত রাত্রে বিবে কানন্দের বক্তৃতা শুনিবার জন্য প্রথম ইউনিটেরিয়ান চার্চে খুব ভিড় হইয়াছিল। শ্রোতৃমণ্ডলী আসিয়াছিলেন জেফারসন এভিনিউ এবং উডওয়ার্ড এভিনিউ-এর উত্তরাংশ হইতে। তাঁহাদের অধিকাংশই মহিলা। ইঁহারা বক্তৃতাটিতে খুব আকৃষ্ট হইয়াছিলেন, মনে হইল। ব্রাহ্মণ বক্তার অনেকগুলি মন্তব্য সোৎসাহে হর্ষধ্বনি দ্বারা এই মহিলারা সমর্থন করিতেছিলেন।

বক্তা যে-প্রেমের বিষয় আলোচনা করিলেন, উহা যৌন আকর্ষণের সহিত সংশ্লিষ্ট ভাবাবেগ নয়। ভারতে ভগবদ্ভক্ত ঈশ্বরের জন্য যে নিষ্কলুষ পবিত্র অনুরাগ বোধ করেন, উহা সেই ভালবাসা। বিবে কানন্দ তাঁহার ভাষণের প্রারম্ভে আলোচ্য বিষয়টি এই বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেনঃ ‘ভারতীয় তাহার ভগবানের জন্য যে প্রীতি অনুভব করে।’ কিন্তু বলিবার সময় তিনি এই ঘোষিত বিষয়ের সীমার মধ্যে থাকেন নাই।

বরং বক্তৃতার বেশীর ভাগ ছিল খ্রীষ্টধর্মের প্রতি আক্রমণ। ভারতীয়ের ধর্ম এবং ভগবৎপ্রেম সম্বন্ধে আলোচনা ছিল উহার গৌণ অংশ। বক্তৃতার অনেক বিষয় ভারতেতিহাসের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের কতকগুলি প্রাসঙ্গিক কাহিনীর সাহায্যে বিশদীকৃত হয়। এই কাহিনীগুলির পাত্র ভারতবর্ষের বিখ্যাত মোগল সম্রাটগণ, হিন্দুরাজগণ নয়।

বক্তা ধর্মাচার্যগণকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করেন-জ্ঞানমার্গের পথিক ও ভক্তিপথের অনুগামী। প্রথম শ্রেণীর জীবনের লক্ষ্য হইল প্রত্যক্ষ অনুভূতি, দ্বিতীয়ের ভগবৎপ্রেম। বক্তা বলেন, প্রেম হইল আত্মত্যাগ। প্রেম কিছু গ্রহণ করে না সর্বদাই দিয়া যায়। হিন্দু ভক্ত ভগবানের কাছে কোন কিছু চায় না, মুক্তি বা পারলৌকিক সুখের জন্য কখনও প্রার্থনা করে না। সে তাহার সকল চেতনা অনুরাগের গাঢ় উল্লাসে প্রেমাস্পদ ভগবানের প্রতি নিযুক্ত করে।

ঐ সুন্দর অবস্থা লাভ করা সম্ভবপর তখনই, যখন মানুষ ভগবানের জন্য গভীর অভাব বোধ করিতে থাকে। তখন ভগবান্ তাঁহার পরিপূর্ণ সত্তায় ভক্তের নিকট আবির্ভূত হন।

ঈশ্বরকে আমরা তিনভাবে ধারণা করিতে পারি। একটি হইল-তাঁহাকে এক বিরাট ক্ষমতাবান্ পুরুষ বলিয়া মনে করা এবং মাটিতে পড়িয়া তাঁহার মহিমার স্তুতি করা। দ্বিতীয়ঃ তাঁহাকে পিতৃদৃষ্টিতে ভক্তি করা। ভারতে পিতাই সব সময় সন্তানদের শাসন করেন। সেই জন্য পিতার উপর ভক্তিশ্রদ্ধায় খানিকটা ভয়ও মিশিয়া থাকে। আরও একটি ভাব হইল ভগবানকে ‘মা’ বলিয়া চিন্তা করা। ভারতে জননী সর্বদাই যথার্থ ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্রী। তাই ঈশ্বরের প্রতি মাতৃভাব ভারতে খুব স্বাভাবিক।

কানন্দ বলেন যে, যথার্থ ভক্ত ভগবদনুরাগে এত বিভোর থাকেন যে অপর ধর্মাবলম্বীদের নিকট গিয়া তাহারা ভুল পথে ঈশ্বর সাধনা করিতেছে, ইহা বলিবার এবং তাহাদিগকে স্বমতে আনিবার জন্য চেষ্টা করিবার সময় তাঁহার নাই।

‘একটি শখ মাত্র।’-

ডেট্রয়েট জার্নাল, ২১ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

আধুনিক কালের ধর্ম সম্বন্ধে ইহাই বিবে কানন্দের অভিমত! ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী বিবে কানন্দ, যিনি এই ডেট্রয়েট শহরে কতকগুলি ধারাবাহিক বক্তৃতা দিতেছেন, যদি আরও এক সপ্তাহ এখানে থাকিতে রাজী হন, তাহা হইলে শহরের বৃহত্তম হলঘরটিতেও তাঁহার আগ্রহশীল শ্রোতৃমণ্ডলীর স্থান কুলাইবে না। তিনি এখানে দস্তুরমত একটি আকর্ষণ হইয়া পড়িয়াছেন। গতকল্য সন্ধ্যায় ইউনিটেরিয়ান চার্চের প্রত্যেকটি আসন ভরিয়া যায়; বহু লোককে বাধ্য হইয়া বক্তৃতার সারা সময় দাঁড়াইয়া থাকিতে হইয়াছিল।

বক্তার আলোচ্য বিষয় ছিল ‘ভগবৎপ্রেম’। প্রেমের সংজ্ঞা তিনি দিলেন-‘যাহা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ, যাহাকে ভালবাসি তাহার স্তুতি ও ভজনা ব্যতীত যাহার অপর কোন উদ্দেশ্য নাই।’ বক্তা বলেন, প্রেম এমন একটি গুণ, যাহা বিনীতভাবে পূজা করিয়া যায় এবং প্রতিদানে কিছুই চায় না। ভগবৎপ্রেম জাগতিক ভালবাসা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্‌। সাধারণতঃ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ছাড়া ভগবানকে আমরা চাই না।

বক্তা নানা গল্প ও উদাহরণ দ্বারা দেখান, আমাদের ভগবদর্চনার পিছনে স্বার্থবুদ্ধি কিভাবে নিহিত থাকে। বক্তা বলেন, খ্রীষ্টীয় বাইবেলের সর্বাপেক্ষা চমৎকার অংশ হইল ‘সলোমনের গীতি’; তবে তিনি শুনিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছেন যে, এই অংশকে বাইবেল হইতে বাদ দিবার সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে। বক্তা শেষের দিকে যেন এক প্রকার চূড়ান্ত যুক্তিস্বরূপ বলিলেন,

‘ইহা হইতে কতটা লাভ আদায় করিতে পারি’-এই নীতির উপরই আমাদের ঈশ্বর-প্রেম স্থাপিত দেখা যাইতেছে। ভগবানকে ভালবাসিবার সহিত খ্রীষ্টানদের এত স্বার্থবুদ্ধি জড়িত থাকে যে, তাহারা সর্বদাই তাঁহার নিকট কিছু না কিছু চাহিয়া থাকে। নানাপ্রকারের ভোগ-সামগ্রীও তাহার অন্তর্ভুক্ত। অতএব বর্তমানকালের ধর্ম একটা শখ ও ফ্যাশন মাত্র, আর মানুষ ভেড়ার পালের মত গীর্জায় ভিড় করে।

ভারতীয় নারী-

ডেট্রয়েট ফ্রী প্রেস, ২৫ মার্চ, ১৮৯৪

কানন্দ গতরাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চে-এ ‘ভারতীয় নারী’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন। তিনি প্রাচীন ভারতের নারীগণের প্রসঙ্গে বলেন যে, শাস্ত্রগ্রন্থসমূহে তাঁহাদিগকে গভীর শ্রদ্ধা দেখান হইয়াছে। অনেক নারী ঋষিত্ব লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের আধ্যাত্মিকতা তখন ছিল খুবই প্রশংসনীয়। প্রাচ্যের নারীগণকে প্রতীচ্যের আদর্শে বিচার করা ঠিক নয়। পাশ্চাত্যে নারী হইলেন পত্নী, প্রাচ্যে তিনি জননী।

হিন্দুরা মাতৃভাবের পূজারী। সন্ন্যাসীদের পর্যন্ত গর্ভধারিণী জননীর সম্মুখে ভূমিতে কপাল ঠেকাইয়া সম্মান দেখাইতে হয়। ভারতে পবিত্রতার স্থান খুব উঁচুতে। কানন্দ এখানে যে-সব ভাষণ দিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। সকলে উহা খুব পছন্দ করিয়াছেন।

ডেট্রয়েট ইভনিং নিউজ, ২৫ মার্চ, ১৮৯৪

গতরাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চে-এ স্বামী বিবে কানন্দের বক্তৃতার বিষয় ছিল-‘প্রাচীন, মধ্য ও বর্তমান যুগে ভারতীয় নারী’। তিনি বলেন, ভারতবর্ষে নারীকে ভগবানের সাক্ষাৎ প্রকাশ বলিয়া মনে করা হয়। নারীর সমগ্র জীবনে এই একটি চিন্তা তাঁহাকে তৎপর রাখে যে, তিনি মাতা; আদর্শ মাতা হইতে গেলে তাহাকে খুব পবিত্র থাকিতে হইবে। ভারতে কোন জননী কখনও তাহার সন্তানকে ত্যাগ করে নাই।

বক্তা বলেন, ইহার বিপরীত প্রমাণ করিবার জন্য তিনি সকলকে আহ্বান করিতেছেন। ভারতের মায়েরা যদি আমেরিকান তরুণীদের মত শরীরের অর্ধেক ভাগ যুবকদের কুদৃষ্টির সামনে খুলিয়া রাখিতে বাধ্য হইত, তাহা হইলে তাহারা মরিয়া যাইত। বক্তা ইচ্ছা করেন যে, ভারতকে তাহার নিজস্ব আদর্শে বিচার করা উচিত, এই দেশের আদর্শে নয়।

ট্রিবিউন, ১ এপ্রিল, ১৮৯৪

স্বামী বিবে কানন্দের ডেট্রয়েটে অবস্থান কালে নানা কথোপকথনে তিনি ভারতীয় নারীগণ সম্পর্কে কতকগুলি প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি যে-সব তথ্য উপস্থাপিত করেন, তাহাতে শ্রোতাদের কৌতূহল উদ্দীপিত হয় এবং ঐ বিষয়ে সর্বসাধারণের জন্য একটি বক্তৃতা দিবার অনুরোধ আসে। কিন্তু তিনি বক্তৃতার সময় কোন স্মারকলিপি না রাখায় ভারতীয় নারী সম্বন্ধে পূর্বে ব্যক্তিগত কথোপকথনের সময় যে-সব বিষয় বলিয়াছিলেন, তাহা ঐ বক্তৃতায় বাদ পড়িয়া গিয়াছিল।

ইহাতে তাঁহার বন্ধুবর্গ কিছুটা নিরাশ হন, কিন্তু তাঁহার মহিলা শ্রোতাদের মধ্যে জনৈক তাঁহার অপরাহ্নের কথোপকথনের কিছু প্রসঙ্গ সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। উহা এখন হইতে সর্বপ্রথম সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য দেওয়া হইতেছেঃ

আকাশচুম্বী হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতে আর্যগণ আসিয়া বসবাস করেন। এখনও পর্যন্ত ভারতে তাঁহাদের বংশধর খাঁটি ব্রাহ্মণ-জাতি বিদ্যমান। পাশ্চাত্য লোকের পক্ষে স্বপ্নেও এই উন্নত মানবগোষ্ঠীর ধারণা করা অসম্ভব। চিন্তায় কাজে এবং আচরণে ইঁহারা অতিশয় শুচি। ইঁহারা এত সাধুপ্রকৃতির যে, একথলি সোনা যদি প্রকাশ্যে পড়িয়া থাকে তো তাঁহাদের কেহ উহা লইবেন না।

কুড়ি বৎসর পরেও ঐ থলিটি একই জায়গায় পাওয়া যাইবে। এই ব্রাহ্মণদের শারীরিক গঠনও অতি চমৎকার। কানন্দের নিজের ভাষায়ঃ ‘ক্ষেতে কর্মনিরতা ইঁহাদের একটি কন্যাকে দেখিলে মন বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়, আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে হয়-ভগবান্ এমন অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতিমা কি করিয়া গড়িলেন!’

এই ব্রাহ্মণদের অবয়ব-সংস্থান সুসম্বদ্ধ, চোখ ও চুল কৃষ্ণবর্ণ এবং গায়ের রঙ-আঙুল ছুঁচবিদ্ধ করিলে উহা হইতে একটি রক্তবিন্দু যদি এক গ্লাস দুধে পড়ে, তাহা হইলে যে রঙ সৃষ্ট হয়, সেই রঙের। অবিমিশ্র বিশুদ্ধ হিন্দু ব্রাহ্মণদের ইহাই বর্ণনা।

হিন্দু নারীর উত্তরাধিকারের আইন-কানুন সম্বন্ধে বক্তা বলেন, বিবাহের সময় স্ত্রী যে যৌতুক পান, উহা সম্পূর্ণ তাঁহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি; উহাতে স্বামীর কখনও মালিকানা থাকে না। স্বামীর সম্মতি বিনা আইনতঃ তিনি উহা বিক্রয় বা দান করিতে পারেন। সেইরূপ অন্য সূত্রে, তথা স্বামীর নিকট হইতেও তিনি যে-সকল অর্থাদি পান, উহা তাঁহার নিজস্ব সম্পত্তি, তাঁহার ইচ্ছামত ব্যয় করিতে পারেন।

স্ত্রীলোক বাহিরে নির্ভয়ে বেড়াইয়া থাকেন। চারি পাশের লোকদের উপর তাঁহার পূর্ণ বিশ্বাস আছে বলিয়াই ইহা সম্ভব হয়। হিমালয়ে পর্দাপ্রথা নাই। ওখানে এমন অঞ্চল আছে যেখানে মিশনরীরা কখনও পৌঁছিতে পারেন না। এইসব গ্রাম খুবই দুর্গম। অনেক চড়াই করিয়া এবং পরিশ্রমে ঐ-সকল জায়গায় পৌঁছান যায়। এখানকার অধিবাসীরা কখনও মুসলমান-প্রভাবে আসে নাই। খ্রীষ্টধর্মও ইহাদের নিকট অজানা।

ভারতের প্রথম অধিবাসীরা-

ভারতের অরণ্যে এখনও কিছু কিছু বনবাসী অসভ্য লোক দেখা যায়। তাহারা অত্যন্ত বর্বর, এমন কি নরমাংসভোজী। ইহারাই দেশের আদিম অধিবাসী এবং কখনও আর্য বা হিন্দু হয় নাই। আর্যগণ ভারতে স্থায়ী বসবাস আরম্ভ করিলে এবং দেশের ভূভাগে ছড়াইয়া পড়িলে তাঁহাদের মধ্যে ক্রমশঃ নানাপ্রকার বিকৃতি প্রবেশ করে। সূর্যতাপও ছিল প্রচণ্ড। খর রৌদ্রে অনেকের গায়ের রঙ ক্রমশঃ কালো হইয়া যায়।

হিমালয়পর্বতবাসী শ্বেতকায় লোকের উজ্জ্বল বর্ণ সমতলভূমির হিন্দুদের তাম্রবর্ণে পরিবর্তিত হওয়া তো কেবলমাত্র পাঁচ পুরুষের ব্যাপার। কানন্দের একটি ভাই আছেন, তিনি খুব ফর্সা, আবার দ্বিতীয় আর একটি ভাই-এর রঙ কানন্দের চেয়ে ময়লা। তাঁহার পিতামাতা গৌরবর্ণ। মুসলমানদের অত্যাচার হইতে নারীদের রক্ষা করার জন্যই নিষ্ঠুর পর্দাপ্রথার উদ্ভব হইয়াছিল। গৃহে আবদ্ধ থাকিবার দরুন হিন্দু রমণীদের গায়ের রঙ পুরুষদের অপেক্ষা পরিষ্কার। কানন্দের বয়স একত্রিশ বৎসর।

আমেরিকান পুরুষদের প্রতি কটাক্ষ-

কানন্দ চোখের কোণে ঈষৎ কৌতুক মিশাইয়া বলেন যে, আমেরিকান পুরুষদের দেখিয়া তিনি আমোদ অনুভব করেন। তাঁহারা প্রচার করিয়া বেড়ান যে, স্ত্রীজাতি তাঁহাদের পূজার পাত্র, কিন্তু তাঁহার মতে আমেরিকানরা পূজা করেন রূপ ও যৌবনকে। তাঁহাদিগকে কখনও তো বলিরেখা বা পক্ক কেশের সহিত প্রেমে পড়িতে দেখা যায় না! বক্তা বলেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁহার দৃঢ় ধারণা এই যে, এক সময়ে বৃদ্ধা নারীদের পোড়াইয়া মারিবার জন্য মার্কিন পুরুষদের পুরুষানুক্রমে পাওয়া একটি কৌশল ছিল।

বর্তমান ইতিহাস ইহার নাম দিয়াছে-ডাইনী-দহন। পুরুষরাই ডাইনীদের অভিযুক্ত করিত, আর সাধারণতঃ অভিযুক্তার জরাই ছিল তাহার প্রাণদণ্ডের কারণ। অতএব দেখা যাইতেছে, জীবন্ত নারীকে দগ্ধ করা শুধু যে একটি হিন্দুরীতি, তাহা নয়। বক্তার মতে খ্রীষ্টীয় গীর্জার তরফ হইতে এক সময়ে বৃদ্ধা স্ত্রীলোকদের অগ্নিদগ্ধ করা হইত, ইহা স্মরণ রাখিলে হিন্দু বিধবাদের সহমরণ-প্রথার কথা শুনিয়া পাশ্চাত্য সমালোচকদের আতঙ্ক কম হইবে।

উভয় দাহের তুলনা-

হিন্দু বিধবা যখন মৃত পতির সহিত স্বেচ্ছায় অগ্নিতে প্রবেশ করিয়া মৃত্যু বরণ করিতেন, তখন ভুরিভোজন এবং সঙ্গীতাদিসহ একটি উৎসবের পরিবেশ সৃষ্ট হইত। মহিলা নিজে তাঁহার সর্বাপেক্ষা দামী বস্ত্র পরিতেন। তিনি বিশ্বাস করিতেন, স্বামীর সহিত সহমরণে তাঁহার নিজের এবং পরিবারবর্গের স্বর্গলোকে গতি হইবে। আত্মবলিদাত্রীরূপে তাঁহাকে সকলে পূজা করিত এবং তাঁহার নাম পরিবারের বিবরণীতে গৌরবান্বিত হইয়া থাকিত।

সহমরণ-প্রথা আমাদের নিকট যত নৃশংসই মনে হউক, খ্রীষ্টীয় সমাজের ডাইনী-দহনের তুলনায় ইহার একটা উজ্জ্বল দিক্‌ রহিয়াছে। যে-স্ত্রীলোককে ডাইনী বলিয়া ঘোষণা করা হইত, গোড়া হইতেই তাহাকে পাপী সাব্যস্ত করা হইত। তারপর একটি বদ্ধ কারাকক্ষে তাহাকে আবদ্ধ করিয়া পাপ স্বীকারের জন্য চলিত নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং ঘৃণিত বিচার-প্রহসন।

অবশেষে শাস্তিদাতাদের হর্ষধ্বনির মধ্যে বেচারীকে টানিয়া বধ্যস্থানে লইয়া যাওয়া হইত। বলপূর্বক অগ্নিদাহের যন্ত্রণার মধ্যে তাহার সান্ত্বনা থাকিত শুধু দর্শকবৃন্দের আশ্বাস যে, মৃত্যুর পর অনন্ত নরকাগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হইয়া তাহার আত্মার ভাগ্যে ভবিষ্যতের যে ভীষণতর কষ্ট লেখা আছে, বর্তমান কষ্ট শুধু তাহার সামান্য একটি নিদর্শন।

জননীগণ আরাধ্যা-

কানন্দ বলেন যে, হিন্দুরা মাতৃ-ভাবটির পূজা করিতে শিক্ষা পায়। মায়ের স্থান পত্নীর ঊর্ধ্বে। মা হলেন আরাধনার পাত্রী। হিন্দুদের মনে ঈশ্বরের পিতৃভাব অপেক্ষা মাতৃভাবটিই বেশী স্থান পায়।

ভারতে কোন জাতির স্ত্রীলোককেই অপরাধের জন্য কঠিন শারীরিক শাস্তি দেওয়ার বিধান নাই। হত্যা-অপরাধ করিলেও নারী প্রাণদণ্ড হইতে অব্যাহতি পায়। বরং অপরাধিনীকে গাধার পিঠে লেজের দিকে মুখ করিয়া বসাইয়া রাস্তায় ঘুরান হয়। একজন ঢোল পিটাইয়া তাহার অপরাধ উচ্চৈঃস্বরে জানাইয়া যায়; পরে তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। তাহার এই অবমাননাকেই যথেষ্ট শাস্তি এবং ভবিষ্যতে অপরাধের পুনরাবৃত্তির প্রতিষেধক বলিয়া মনে করা হয়।

অপরাধিনী প্রায়শ্চিত্ত করিতে চাহিলে নানা ধর্মপ্রতিষ্ঠানে গিয়া অনুষ্ঠান করিবার সুযোগ পায় এবং এইভাবে সে পুনরায় শুচি হইতে পারে। অথবা সে স্বেচ্ছায় সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস-আশ্রমে প্রবেশপূর্বক যথার্থ নিষ্পাপ জীবন লাভ করিতে পারে।

মিঃ কানন্দকে প্রশ্ন করা হয় যে, এইভাবে অপরাধিনী নারী সন্ন্যাসী-আশ্রমে প্রবেশ করিবার অনুমতি পাইলে এবং সমাজ-শাসন এড়াইয়া গেলে পবিত্র ঋষিদের প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে ভণ্ডামির স্থান দেওয়া হয় কিনা। কানন্দ উহা স্বীকার করিলেন, তবে ব্যাখ্যা করিয়া ইহাও বুঝাইয়া দিলেন যে, জনসাধারণ ও সন্ন্যাসীর মধ্যে অপর কেহ অন্তর্বর্তী নাই। সন্ন্যাসী সকল জাতির গণ্ডী ভাঙিয়া দিয়াছেন।

একজন ব্রাহ্মণ নিম্নবর্ণের কোন হিন্দুকে হয়তো স্পর্শ করিবেন না, কিন্তু ঐ ব্যক্তি যদি সন্ন্যাস গ্রহণ করে, তাহা হইলে অত্যন্ত অভিজাত ব্রাহ্মণও তাহার পায়ে লুটাইয়া পড়িতে সঙ্কুচিত হইবেন না।

গৃহস্থেরা সন্ন্যাসীর ভরণ-পোষণের ভার গ্রহণ করে, তবে যতক্ষণ পর্যন্ত তাহার সাধুতা সম্বন্ধে তাহাদের বিশ্বাস আছে। সন্ন্যাসীর ভণ্ডামি ধরা পড়িলে তাহাকে সকলে মিথ্যাচারী বলিয়া মনে করে। তাহার জীবন তখন অধম ভিক্ষুকের জীবন মাত্র। কেহ তাহাকে আর শ্রদ্ধা করে না।

অন্যান্য চিন্তাধারা-

নারী রাজা অপেক্ষাও অধিক সম্মান ও সুবিধা ভোগ করেন। যখন গ্রীক পণ্ডিতেরা হিন্দুজাতির সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করিতে হিন্দুস্থানে আসিয়াছিলেন, তখন সকল গৃহের দ্বারই তাঁহাদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু মুসলমানরা যখন তাহাদের তরবারি এবং ইংরেজগণ তাহাদের গুলিগোলা লইয়া দেখা দিল, তখন সব দরজাই বন্ধ করা হইল। এই ধরনের অতিথিকে কেহ স্বাগত জানায় নাই। কানন্দ যেমন মিষ্ট করিয়া বলেন, ‘যখন বাঘ আসে, তখন আমরা আমাদের দরজা জানালা বন্ধ রাখি, যতক্ষণ না বাঘ চলিয়া যায়।’

কানন্দ বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা তাঁহাকে বহুতর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার জন্য উদ্দীপনা দিয়াছে, তবে আমাদের তথা জগতের নিয়তি আজিকার আইন-প্রণেতার উপর অপেক্ষা করিতেছে না, উহা অপেক্ষা করিতেছে নারীজাতির উপর। কানন্দের উক্তিঃ ‘তোমাদের দেশের মুক্তি দেশের নারীগণের উপরই নির্ভর করে।’

ধর্মে দোকানদারি-

[মিনিয়াপলিস্ শহরে ১৮৯৩ খ্রীঃ, ২৬ নভেম্বর প্রদত্ত বক্তৃতার ‘মিনিয়াপলিস্ জার্নাল’ পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণ]

চিকাগো ধর্ম-মহাসভার খ্যাতিমান্ ব্রাহ্মণ পুরোহিত স্বামী বিবেকানন্দের প্রাচ্যদেশীয় ধর্ম-ব্যাখ্যান হইতে কিছু শিখিতে উদ‍্গ্রীব শ্রোতৃমণ্ডলী গতকল্য সকালে ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এ ভিড় করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই বিশিষ্ট প্রতিনিধিকে এই শহরে আমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন ‘পেরিপ্যাটেটিক ক্লাব’। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ঐ প্রতিষ্ঠানে তাঁহার বক্তৃতা হয়। গতকল্যকার বক্তৃতার জন্য তাঁহাকে এই সপ্তাহ পর্যন্ত এখানে থাকিতে অনুরোধ করা হইয়াছিল।

প্রারম্ভিক প্রার্থনার পর ধর্মযাজক ডক্টর এইচ. এম. সিমন‍্স‍্-‘বিশ্বাস, আশা এবং দান’ সম্বন্ধে সেণ্ট পলের উক্তি পাঠ করেন। সেণ্ট পল যে বলিয়াছেন, ‘ইহাদের ভিতর দানই হইল সর্বোত্তম’-ইহার সমর্থনে ডক্টর সিমন‍্স‍্ ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্রের একটি শিক্ষা, মোসলেম ধর্মমতের একটি বচন এবং হিন্দু সাহিত্য হইতে কয়েকটি কবিতা পাঠ করেন। এই উক্তির সহিত সেণ্ট পলের কথার সামঞ্জস্য রহিয়াছে।

দ্বিতীয় প্রার্থনা সঙ্গীতের পর স্বামী বিবেকান্দিকে শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট পরিচিত করিয়া দেওয়া হয়। তিনি বক্তৃতামঞ্চের ধারে আসিয়া দাঁড়ান এবং গোড়াতেই একটি হিন্দু উপাখ্যান বলিয়া সকলের চিত্ত আকৃষ্ট করেন। উৎকৃষ্ট ইংরেজীতে তিনি বলেনঃ

তোমাদিগকে আমি পাঁচটি অন্ধের একটি গল্প বলিব। ভারতের কোন গ্রামে একটি শোভাযাত্রা চলিতেছে। উহা দেখিবার জন্য অনেক লোকের ভিড় হইয়াছে। বহু আড়ম্বরে সুসজ্জিত একটি হাতী ছিল সকলের বিশেষ আকর্ষণ। সকলেই খুব খুশী।

পাঁচজন অন্ধও দর্শকের সারির মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহারা তো চোখে দেখিতে পায় না, তাই ঠিক করিল হাতীকে স্পর্শ করিয়া বুঝিয়া লইবে জানোয়ারটি কেমন। ঐ সুযোগ তাহাদিগকে দেওয়া হইল। শোভাযাত্রা চলিয়া গেলে সকলের সহিত তাহারা বাড়ী ফিরিয়া আসিয়াছে। তখন হাতীর সম্বন্ধে কথাবার্তা শুরু হইল।

একজন বলিল, ‘হাতী হইতেছে ঠিক দেওয়ালের মত।’ দ্বিতীয় বলিল, ‘না, তা তো নয়, উহা হইল দড়ির মত।’ তৃতীয় অন্ধ কহিল, ‘দূর, তোমার ভুল হইয়াছে, আমি যে নিজে হাত দিয়া দেখিয়াছি, উহা ঠিক সাপের মত।’ আলোচনায় উত্তেজনা বাড়িয়া চলিল, তখন চতুর্থ অন্ধ বলিল যে, হাতী হইল ঠিক যেন একটি বালিশ। ক্রুদ্ধ বাদপ্রতিবাদে অবশেষে পঞ্চম অন্ধ মারামারি শুরু করিল।

তখন একজন চক্ষুষ্মান্ ব্যক্তি ঘটনাস্থলে আসিয়া উপস্থিত। সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘বন্ধুগণ ব্যাপার কি?’ ঝগড়ার কারণ বলা হইলে আগন্তুক কহিল, ‘মহাশয়রা, আপনাদের সকলের কথাই ঠিক। মুশকিল এই যে, আপনারা হাতীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্পর্শ করিয়াছেন। হাতীর পাশ হইল দেওয়ালের মত।

লেজকে তো দড়ি মনে হইবেই। উহার শুঁড় সাপের মত বলা চলে, আর যিনি পায়ের পাতা ছুঁইয়া দেখিয়াছেন, তিনি ঠিকই বলিয়াছেন যে, হাতী বালিশের মত। এখন আপনারা ঝগড়া থামান। বিভিন্ন দিক্‌ দিয়া হাতীর সম্বন্ধে আপনারা সকলেই সত্য কথা বলিয়াছেন।’

বক্তা বলেনঃ ধর্মেও এই ধরনের মতদ্বৈধ দেখা দিয়াছে। পাশ্চাত্যের লোক মনে করে, তাহারাই একমাত্র ঈশ্বরের খাঁটি ধর্মের অধিকারী; আবার প্রাচ্যদেশের লোকেরও নিজেদের ধর্ম সম্বন্ধে অনুরূপ গোঁড়ামি বিদ্যমান। উভয়েরই ধারণা ভুল। বস্তুতঃ ঈশ্বর প্রত্যেক ধর্মেই রহিয়াছেন।

প্রতীচীর চিন্তাধারা সম্বন্ধে বক্তা অনেক স্পষ্ট সমালোচনা করেন। তাঁহার মতে খ্রীষ্টানদের মধ্যে ‘দোকানদারী’ ধর্মের লক্ষণ দেখা যাইতেছে। তাঁহাদের প্রার্থনাঃ হে ঈশ্বর আমাকে ইহা দাও, উহা দাও; হে প্রভু তুমি আমার জন্য ইহা কর, উহা করা। হিন্দু ইহা বুঝিতে পারে না। তাহার বিবেচনায় ঈশ্বরের কাছে কিছু চাওয়া ভুল। কিছু না চাহিয়া ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির বরং উচিত দেওয়া।

ঈশ্বরের নিকট কোন কিছুর জন্য প্রার্থনা না করিয়া তাঁহাকে এবং মানুষকে যথাসাধ্য দান করা-ইহাতেই হিন্দুর অধিকতর বিশ্বাস। বক্তা বলেন, তিনি লক্ষ্য করিয়াছেন যে, পাশ্চাত্যে অনেকেই যখন সময় ভাল চলিতেছে, তখন ঈশ্বর সম্বন্ধে বেশ সচেতন, কিন্তু দুর্দিন আসিলে তাঁহাকে আর মনে থাকে না। পক্ষান্তরে হিন্দু ঈশ্বরকে দেখেন ভালবাসার পাত্ররূপে। হিন্দুধর্মে ভগবানের পিতৃভাবের ন্যায় মাতৃত্বের স্বীকৃতি আছে, কারণ ভালবাসার সুষ্ঠুতর পরিণতি ঘটে মাতাপুত্রের সম্বন্ধের মাধ্যমে।

পাশ্চাত্যের খ্রীষ্টান সারা সপ্তাহ টাকা রোজগারের জন্য খাটিয়া চলে, ইহাতে সফল হইলে সে ভগবানকে স্মরণ করিয়া বলে, ‘হে প্রভু, তুমি যে এই টাকা দিয়াছ, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।’ তারপর যাহা কিছু সে রোজগার করিয়াছে, সবটাই নিজের পকেটে ফেলে। হিন্দু কি করে? সে টাকা উপার্জন করিলে দরিদ্র এবং দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্য করিয়া ঈশ্বরের সেবা করে।

বক্তা এইভাবে প্রাচী এবং প্রতীচীর ভাবধারার তুলনামূলক আলোচনা করেন। ঈশ্বরের প্রসঙ্গে বিবেকানন্দীর উক্তির নিষ্কর্ষঃ তোমরা পাশ্চাত্যের অধিবাসীরা মনে কর ঈশ্বরকে কবলিত করিয়াছ। ইহার অর্থ কি? ভগবানকে যদি তোমরা পাইয়াই থাকিবে, তাহা হইলে তোমাদের মধ্যে এত অপরাধ-প্রবণতা কেন? দশজনের মধ্যে নয়জন এত কপট কেন? ভগবান্ যেখানে, সেখানে কপটাচার থাকিতে পারে না।

ভগবানের উপাসনার জন্য তোমাদের প্রাসাদোপম অট্টালিকাসমূহ রহিয়াছে, সপ্তাহে একদিন ওখানে কিছু সময় তোমরা কাটাইয়াও আস, কিন্তু কয়জন তোমরা বাস্তবিকই ভগবানকে পূজা করিতে যাও? পাশ্চাত্যে গীর্জায় যাওয়া একটা ফ্যাশন-বিশেষ এবং তোমাদের অনেকেরই গীর্জায় যাওয়ার পিছনে অপর কোন উদ্দেশ্য নাই। এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যবাসী তোমাদের ভগবানের উপর বিশেষ অধিকারের কোন দাবী থাকিতে পারে কি?

এই সময় বক্তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সাধুবাদ দ্বারা অভিনন্দিত করা হয়। বক্তা বলিতে থাকেনঃ আমরা হিন্দুধর্মাবলম্বীরা প্রেমের জন্য ভগবানকে ডাকায় বিশ্বাস করি। তিনি আমাদিগকে কি দিলেন সেজন্য নয়, তিনি প্রেমস্বরূপ বলিয়াই তাঁহাকে ভালবাসি। কোন জাতি বা সমাজ বা ধর্ম যতক্ষণ প্রেমের জন্য ভগবানকে আরাধনা করিতে ব্যগ্র না হইতেছে, ততক্ষণ উহারা ঈশ্বরকে পাইবে না। প্রতীচ্যে তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং বড় বড় আবিষ্ক্রিয়ায় খুব করিতকর্মা, প্রাচ্যে আমরা ক্রিয়াপটু ধর্মে।

তোমাদের দক্ষতা বাণিজ্যে, আমাদের ধর্মে। তোমরা যদি ভারতে গিয়া ক্ষেতে মজুরদের সহিত আলাপ কর, দেখিবে রাজনীতিতে তাহাদের কোন মতামত নাই। ঐ সম্বন্ধে তাহারা একেবারেই অজ্ঞ। কিন্তু ধর্ম সম্বন্ধে কথা কও, দেখিবে উহাদের মধ্যে যে দীনতম, সেও একেশ্বরবাদ দ্বৈতবাদ প্রভৃতি ধর্মের সব মতের বিষয় জানে। যদি তাহাকে জিজ্ঞাসা কর, ‘তোমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা কি রকম?’

সে বলিবে, ‘অতশত বুঝি না, আমি খাজনা দিই এই পর্যন্ত, আর কিছু জানি না।’ আমি তোমাদের শ্রমিক এবং কৃষকদের সহিত কথা কহিয়া দেখিয়াছি, তাহারা রাজনীতিতে বেশ দুরস্ত। তাহারা হয় ডেমোক্রাট, নয় রিপাবলিকান এবং রৌপ্যমান বা স্বর্ণমান কোন‍্‍টি তাহারা পছন্দ করে, তাহাও বলিতে পারে। কিন্তু ধর্ম সম্বন্ধে যদি জিজ্ঞাসা কর, তাহারা ভারতীয় কৃষকদের মতই বলিবে-‘জানি না’।

একটি নির্দিষ্ট গীর্জায় তাহারা যায়, কিন্তু ঐ গীর্জার মতবাদ কি, তাহা তাহাদের মাথায় ঢুকে না। গীর্জায় নিজেদের সংরক্ষিত আসনের জন্য তাহারা ভাড়া দেয়-এই পর্যন্তই তাহারা জানে।

ভারতবর্ষে যে নানা প্রকারের কুসংস্কার আছে, বক্তা তাহা স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলেন, ‘কোন্ জাতি কুসংস্কার হইতে মুক্ত?’ উপসংহারে বক্তা বলেনঃ প্রত্যেক জাতি ভগবানকে তাহাদের একচেটিয়া সম্পত্তি বলিয়া মনে করে। বস্তুতঃ প্রত্যেক জাতিরই ঈশ্বরের উপর দাবী আাছে। সৎপ্রবৃত্তি মাত্রই ঈশ্বরের প্রকাশ। কি প্রাচ্যে কি প্রতীচ্যে মানুষকে শিখিতে হইবে ‘ভগবানকে চাওয়া’।

এই চাওয়াকে বক্তা, জলমগ্ন ব্যক্তি যে প্রাণপণ চেষ্টায় বাতাস চায়, তাহার সহিত তুলনা করেন। বাতাস তাহার চাই-ই, কারণ বাতাস ছাড়া সে বাঁচিতে পারিবে না। পাশ্চাত্যবাসী যখন এইভাবে ভগবানকে চাহিতে পারিবে, তখনই তাহারা ভারতে স্বাগত হইবে, কেননা প্রচারকেরা তখন আসিবেন যথার্থ ভগবদ্ভাব লইয়া, ভারত ঈশ্বরবিমুখ-এই ধারণা লইয়া নয়। তাঁহারা আসিবেন যথার্থ প্রেমের ভাব বহন করিয়া, কতকগুলি মতবাদের বোঝা লইয়া নয়।

মানুষের নিয়তি-

[মেমফিস্‌ শহরে ১৮৯৪ খ্রীঃ ১৭ জানুআরী প্রদত্ত ভাষণের চুম্বক। ১৮ জানুআরী ‘অ্যাপীল অ্যাভালাঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত]

শ্রোতৃসমাগম মোটের উপর ভালই হইয়াছিল। শহরের সেরা সাহিত্যরসিক ও সঙ্গীতামোদীরা, তথা আইন এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। বক্তা কোন কোন আমেরিকান বাগ্মী হইতে একটি বিষয়ে স্বতন্ত্র। গণিতের অধ্যাপক যেমন ছাত্রদের কাছে বীজগণিতের একটি প্রতিপাদ্য বিষয় ধাপে ধাপে বুঝাইয়া দেন, ইনিও তেমনি তাঁহার বিষয়বস্তু সুবিবেচনার সহিত ধীরে ধীরে উপস্থাপিত করেন।

কানন্দ৭ নিজের ক্ষমতা এবং যাবতীয় প্রতিকূল যুক্তির বিরুদ্ধে স্বীয় প্রতিপাদ্য বিষয়কে সফলভাবে সমর্থন করিবার সামর্থ্যের উপর পূর্ণবিশ্বাস রাখিয়া কথা বলেন। এমন কোন ভাবধারা তিনি জানেন না বা এমন কোন কিছু ঘোষণা করেন না, যাহাকে শেষ পর্যন্ত তিনি ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্তে লইয়া যাইতে পারিবেন না। তাঁহার বক্তৃতার অনেক স্থলে ইঙ্গারসোলের৮ দর্শনের সহিত কিছু সাদৃশ্য আছে।

আবার ওখানকার অন্য একটি কাগজের মতে দণ্ড অপেক্ষা ক্ষমাই সুসঙ্গত। একটি কাগজের সম্পাদক পরিসংখ্যান দ্বারা প্রমাণ করিয়াছেন, যে-সব কয়েদীকে কঠোর সাজা দেওয়া হয়, তাহাদিগের শতকরা মাত্র পঞ্চাশ জন সৎপথে ফিরিয়া আসে; পক্ষান্তরে যাহারা মৃদুভাবে দণ্ডিত, তাহাদের ভিতর শতকরা নব্বই জন কারামুক্তির পর সদ‍্‍বৃত্তি অবলম্বন করে।

তিনি মৃত্যুর পরে নরকে শাস্তিভোগে বিশ্বাস করেন না। খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীরা যেভাবে ঈশ্বরকে মানেন, সেইরূপ ঈশ্বরেও তাঁহার আস্থা নাই। মানুষের মনকে তিনি অমর বলেন না, কারণ উহা পরতন্ত্র। সকল প্রকার আবেষ্টন হইতে যাহা মুক্ত নয়, তাহা কখনও অমর হইতে পারে না।

কানন্দ বলেনঃ ভগবান্ একজন রাজা নন, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন এক কোণে বসিয়া মর্ত্যবাসী মানুষের কর্ম অনুযায়ী দণ্ড বা পুরস্কার বিধান করিতেছেন। এমন এক সময় আসিবে, যখন মানুষ সত্যকে উপলব্ধি করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিবে এবং বলিবে-আমি ঈশ্বর, আমি তাঁর প্রাণের প্রাণ। আমাদের প্রকৃত স্বরূপ, নিজেদের মৃত্যুহীন সত্তাই যখন ভগবান্, তখন তিনি অতি দূরে, এই শিক্ষা দিবার সার্থকতা কি?

তোমাদের ধর্মে যে আদিম পাপের কথা আছে উহা শুনিয়া বিভ্রান্ত হইও না, কেননা তোমাদের ধর্ম আদিম নিষ্পাপ অবস্থার কথাও বলে। আদমের যখন অধঃপতন ঘটিল, তখন উহা তো তাঁহার পূর্বেকার নির্মল স্বভাব হইতেই। (শ্রোতৃবৃন্দের হর্ষধ্বনি) পবিত্রতাই আমাদের প্রকৃত স্বরূপ, আর সকল ধর্মাচরণের লক্ষ্য হইল উহা ফিরিয়া পাওয়া। প্রত্যেক মানুষ শুদ্ধস্বরূপ, প্রত্যেক মানুষ সৎ।

আপত্তি উঠিতে পারে, কোন কোন মানুষ পশুতুল্য কেন? উত্তরে বলি, যাহাকে তুমি পশুতুল্য বলিতেছ, সে ধূলামাটিমাখা হীরকখণ্ডের মত। ধূলা ঝাড়িয়া ফেল, যে হীরা সেই হীরা দেখিতে পাইবে-যেন কখনও ধূলিলিপ্ত হয় নাই, এমন স্বচ্ছ। আমাদের স্বীকার করিতেই হইবে যে, প্রত্যেক আত্মা একটি বৃহৎ হীরকখণ্ড।

আমাদের মানুষ-ভ্রাতাকে পাপী বলার চেয়ে নীচতা আর নাই। একবার একটি সিংহী একটি ভেড়ার পালে পড়িয়া একটি মেষকে নিহত করে। সিংহীটি ছিল আসন্নপ্রসবা। লাফ দিবার ফলে তাহার শাবকটি ভূমিষ্ঠ হইল, কিন্তু লম্ফন-জনিত ক্লান্তিতে সিংহী মারা গেল। সিংহশিশুকে দেখিয়া একটি মেষমাতা উহাকে স্তন্য পান করাইতে থাকে। সিংহশাবক মেষের দলে ঘাস খাইয়া বাড়িতে লাগিল।

একদিন একটি বৃদ্ধ সিংহ ঐ সিংহ-মেষকে দেখিতে পাইয়া ভেড়ার দল হইতে উহাকে সরাইয়া আনিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সিংহ-মেষ ছুটিয়া পলাইয়া গেল। বৃদ্ধ সিংহ অপেক্ষা করিতে লাগিল এবং পরে উহাকে ধরিয়া ফেলিল। তখন সে উহাকে একটি স্বচ্ছ জলাশয়ের ধারে লইয়া গিয়া বলিল, ‘তুমি ভেড়া নও, সিংহ-এই জলের মধ্যে নিজের আকৃতি দেখ।’

সিংহ-মেষও জলে প্রতিবিম্বিত নিজের চেহারা দেখিয়া বলিয়া উঠিল, ‘আমি সিংহ, ভেড়া নই।’ আসুন, আমরা নিজেদের মেষ না ভাবিয়া সিংহ ভাবি। আসুন, আমরা মেষের মত ‘ব্যা ব্যা’ করা এবং ঘাস খাওয়া পরিত্যাগ করি।

আমেরিকায় আমার চার মাস কাটিল। ম্যাসাচুসেট‍্স্ রাজ্যে আমি একটি চরিত্র-সংশোধক জেল দেখিতে গিয়াছিলাম। জেলের অধ্যক্ষকে জানিতে দেওয়া হয় না-কোন্ কয়েদীর কি অপরাধ। কয়েদীদের প্রত্যেকের উপর যেন সহৃদয়তার একটি আচ্ছাদনী ফেলিয়া দেওয়া হয়। আর একটি শহরের কথা জানি, যেখানে বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা সম্পাদিত তিনটি সংবাদপত্রে প্রমাণ করিবার চেষ্টা হইতেছে যে, অপরাধীদের কঠিন সাজা হওয়া প্রয়োজন।

আবার ওখানকার অন্য একটি কাগজের মতে দণ্ড অপেক্ষা ক্ষমাই সুসঙ্গত। একটি কাগজের সম্পাদক পরিসংখ্যান দ্বারা প্রমাণ করিয়াছেন, যে-সব কয়েদীকে কঠোর সাজা দেওয়া হয়, তাহাদিগের শতকরা মাত্র পঞ্চাশ জন সৎপথে ফিরিয়া আসে; পক্ষান্তরে যাহারা মৃদুভাবে দণ্ডিত, তাহাদের ভিতর শতকরা নব্বই জন কারামুক্তির পর সদ‍্‍বৃত্তি অবলম্বন করে।

যদি জিজ্ঞাসা কর ধর্মে ধর্মে এত পার্থক্য কেন, তো তাহার উত্তর এই-ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তটিনী হাজার মাইল পর্বতগাত্র বাহিয়া অবশেষে বিশাল সমুদ্রে গিয়া পড়ে। সেইরূপ নানা ধর্মও তাহাদের অনুগামিগণকে শেষ পর্যন্ত ভগবানের কাছেই লইয়া যায়। ১৯০০ বৎসর ধরিয়া তোমরা য়াহুদীগণকে দলিত করিবার চেষ্টা করিতেছ। চেষ্টা সফল হইয়াছে কি? প্রতিধ্বনি উত্তর দেয়-অজ্ঞানতা এবং ধর্মান্ধতা কখনও সত্যকে বিনষ্ট করিতে পারে না।

ধর্মের উৎপত্তি মানুষের প্রকৃতিগত দুর্বলতার ফলে নয়। কোন এক অত্যাচারীকে আমরা ভয় করি বলিয়া যে ধর্মের জন্ম, তাহাও নয়। ধর্ম হইল প্রেম-যে-প্রেম বিকশিত হইয়া, বিস্তারিত হইয়া, পুষ্টিলাভ করিয়া চলে। একটি ঘড়ির কথা ধর। ছোট একটি আধারের মধ্যে কল-কব্জা রহিয়াছে, আর রহিয়াছে একটি স্প্রিং। দম দেওয়া হইলে স্প্রিংটি উহার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসিতে চায়।

মানুষ হইল ঘড়ির স্প্রিং-এর মত। সব ঘড়ির যে একই রকমের স্প্রিং থাকিবে তাহা নয়, সেইরূপ সকল মানুষের ধর্মমত এক হইবার প্রয়োজন নাই। আর আমরা ঝগড়াই বা করিব কেন? আমাদের সকলের চিন্তাধারা যদি একই প্রকারের হইত, তাহা হইলে আমাদের মৃত্যু ঘটিত। বাহিরের গতির নাম কর্ম, ভিতরের গতি হইল মানুষের চিন্তা। ঢিলটি মাটিতে পড়িল; আমরা বলি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি উহার কারণ।

ঘোড়া গাড়ী টানিয়া লইয়া যাইতেছে, কিন্তু ঘোড়াকে চালাইতেছেন ঈশ্বর। ইহাই গতির নিয়ম। ঘূর্ণিপাক জলস্রোতের প্রবলতা নির্ণয় করে। স্রোত যদি বন্ধ হয়, তাহা হইলে নদীও মরিয়া যায়। গতিই জীবন। আমাদের একত্ব এবং বৈচিত্র্য দুই-ই চাই। গোলাপকে অন্য এক নামেও ডাকিলেও উহার মিষ্ট গন্ধ আগেকার মতই থাকিবে। অতএব তোমার ধর্ম যাহাই হউক, তাহাতে কিছু আসে যায় না।

একটি গ্রামে ছয়জন অন্ধ বাস করিত। তাহারা হাতী দেখিতে গিয়াছে। চোখে তো দেখিতে পায় না, হাত দিয়া অনুভব করিল হাতী কি রকম। একজন হাতীর লেজে হাত দিয়া দেখিল, একজন হাতীর পার্শ্বদেশে। একজন শুঁড়ে এবং চতুর্থ জন কানে। তখন তাহারা হাতীর বর্ণনা শুরু করিল। প্রথম অন্ধ বলিল, হাতী হইল দড়ির মত। দ্বিতীয় জন বলিল, না, হাতী হইতেছে বিরাট দেওয়ালের মত।

তৃতীয় অন্ধের মতে হাতী একটি অজগর সাপের মত; আর চতুর্থ জন-যে হাতীর কানে হাত দিয়াছিল-বলিল, হাতী একটি কুলার মত। মতভেদের জন্য অবশেষে তাহারা ঝগড়া এবং ঘুষাঘুষি আরম্ভ করিল। এমন সময়ে ঘটনাস্থলে একব্যক্তি আসিয়া পড়িল এবং তাহাদিগকে কলহের কারণ জিজ্ঞাসা করিল।

অন্ধেরা বলিল যে, তাহারা হাতীটিকে দেখিয়াছে, কিন্তু হাতী সম্বন্ধে প্রত্যেকেরই মত আলাদা এবং প্রত্যেকেই অপরকে মিথ্যাবাদী বলিতেছে। তখন আগন্তুক তাহাদিগকে বলিল, ‘তোমাদের কাহারও কথা পুরা সত্য নয়, তোমরা অন্ধ। হাতী বাস্তবিক কি রকম, তাহা তোমরা কেহই জান না।’

আমাদের ধর্মের ব্যাপারেও এইরূপ ঘটিতেছে। আমাদের ধর্মের জ্ঞান অন্ধের হস্তীদর্শনের তুল্য। (শ্রোতৃমণ্ডলীর হর্ষধ্বনি)

ভারতে জনৈক সন্ন্যাসী বলিয়াছিলেন, মরুভুমির বালি পিষিয়া কেহ যদি তেল বাহির করিতে পারে অথবা কুমীরের কামড় না খাইয়া তাহার দাঁত কেহ উপড়াইয়া আনিতে পারে-এ কথা বরং বিশ্বাস করিব, কিন্তু ধর্মান্ধ ব্যক্তির গোঁড়ামির পরিবর্তন হইয়াছে, তাহা কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারি না।

যদি জিজ্ঞাসা কর ধর্মে ধর্মে এত পার্থক্য কেন, তো তাহার উত্তর এই-ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তটিনী হাজার মাইল পর্বতগাত্র বাহিয়া অবশেষে বিশাল সমুদ্রে গিয়া পড়ে। সেইরূপ নানা ধর্মও তাহাদের অনুগামিগণকে শেষ পর্যন্ত ভগবানের কাছেই লইয়া যায়। ১৯০০ বৎসর ধরিয়া তোমরা য়াহুদীগণকে দলিত করিবার চেষ্টা করিতেছ। চেষ্টা সফল হইয়াছে কি? প্রতিধ্বনি উত্তর দেয়-অজ্ঞানতা এবং ধর্মান্ধতা কখনও সত্যকে বিনষ্ট করিতে পারে না।

বক্তা এই ধরনের যুক্তি-পুরঃসর প্রায় দুই ঘণ্টা বলিয়া চলেন। বক্তৃতার উপসংহারে তিনি বলেন, ‘আসুন, আমরা কাহারও ধ্বংসের চেষ্টা না করিয়া একে অপরকে সাহায্য করি।’

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!