ভবঘুরেকথা
জন্মন্তরবাদ চুরাশির ফেরে পুনজর্ন্ম

-স্বামী বিবেকানন্দ

পুনর্জন্ম

[মেমফিস্‌ শহরে ১৮৯৪ খ্রীঃ ১৯ জানুআরী প্রদত্ত; ২০ জানুআরীর ‘অ্যাপীল অ্যাভালাঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত।]

পীত-আলখল্লা ও পাগড়ি-পরিহিত সন্ন্যাসী স্বামী বিবে কানন্দ পুনরায় গতরাত্রে ‘লা স্যালেট একাডেমী’তে বেশ বড় এবং সমঝদার একটি সভায় বক্তৃতা দিয়াছেন। আলোচ্য বিষয় ছিল ‘আত্মার জন্মান্তরগ্রহণ’। বলিতে গেলে এই বিষয়টির আলোচনায় কানন্দের বোধ করি স্বপক্ষসর্মথনে যত সুবিধা হইয়াছিল, এমন আর অন্য কোন ক্ষেত্রে হয় নাই।

প্রাচ্য জাতি- সমূহের ব্যাপকভাবে স্বীকৃত বিশ্বাসগুলির মধ্যে পুনর্জন্মবাদ অন্যতম। স্বদেশে কিম্বা বিদেশে এই বিশ্বাসের পক্ষ-সমর্থন করিতে তাহারা সর্বদাই প্রস্তুত, কানন্দ যেমন তাঁহার বক্তৃতায় বলিলেনঃ

আপনারা অনেকেই জানেন না যে, পুনর্জন্মবাদ প্রাচীন ধর্মসমূহের একটি অতি পুরাতন বিশ্বাস। য়াহুদীজাতির অন্তর্গত ফ্যারিসীদের মধ্যে এবং খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের প্রথম প্রবর্তকগণের মধ্যে ইহা সুপরিচিত ছিল। আরবদিগের ইহা একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল। হিন্দু এবং বৌদ্ধদের মধ্যে ইহা এখনও টিকিয়া আছে। বিজ্ঞানের অভ্যুদয়কাল পর্যন্ত এই ধারা চলিয়া আসিয়াছিল। বিজ্ঞান তো বিভিন্ন জড়শক্তিকে বুঝিবার প্রয়াস মাত্র।

পাশ্চাত্য দেশের আপনারা মনে করেন, পুনর্জন্মবাদ নৈতিক আদর্শকে ব্যাহত করে। পুনর্জন্মবাদের বিচার-ধারা এবং যৌক্তিক ও তাত্ত্বিক দিকগুলির পুরাপুরি আলোচনার জন্য আমদিগকে গোড়া হইতে সবটা বিষয় পরীক্ষা করিতে হইবে। আমরা এই বিশ্বজগতের একজন ন্যায়বান্ ঈশ্বরে বিশ্বাসী, কিন্তু সংসারের দিকে তাকাইয়া দেখিলে ন্যায়ের পরিবর্তে অন্যায়ই বেশী দেখিতে পাওয়া যায়।

একজন মানুষ সর্বোৎকৃষ্ট পারিপার্শ্বিকের মধ্যে জন্মগ্রহণ করিল। তাহার সারা জীবনে অনুকূল অবস্থাগুলি যেন প্রস্তুত হইয়া তাহার হাতের মধ্যে আসিয়া পড়ে, সব কিছুই তাহার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এবং উন্নতির সহায়ক হয়। পক্ষান্তরে আর একজন হয়তো এমন পরিবেষ্টনীতে পৃথিবীতে আসে যে, জীবনের প্রতি ধাপে তাহাকে অপর সকলের প্রতিপক্ষতা করিতে হয়। নৈতিক অধঃপাতে গিয়া, সমাজচ্যুত হইয়া সে পৃথিবী হইতে বিদায় লয়। মানুষের ভিতর সুখ-শান্তির বিধানে এত তারতম্য কেন?

জন্মান্তরবাদ আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসসমূহের এই গরমিলগুলির সামঞ্জস্য সাধন করিতে পারে। এই মতবাদ আমাদিগকে দুর্নীতিপরায়ণ না করিয়া ন্যায়ের ধারণায় উদ্বুদ্ধ করে। পূর্বোক্ত প্রশ্নের উত্তরে তোমরা হয়তো বলিবে, উহা ভগবানের ইচ্ছা। কিন্তু ইহা আদৌ সদুত্তর নয়। ইহা অবৈজ্ঞানিক। প্রত্যেক ঘটনারই একটা কারণ থাকে। একমাত্র ঈশ্বরকেই সকল কার্য কারণের বিধাতা বলিলে তিনি এক ভীষণ দুর্নীতিশীল ব্যক্তি হইয়া দাঁড়ান।

কিন্তু জড়বাদও পূর্বোক্ত মতবাদেরই মত অযৌক্তিক। আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার এলাকার সর্বত্রই কার্য-কারণ-ভাব ওতপ্রোত। অতএব এই দিক্‌ দিয়া আত্মার জন্মান্তরবাদ প্রয়োজনীয়। আমরা এই পৃথিবীতে আসিয়াছি। ইহা কি আমাদের প্রথম জন্ম? সৃষ্টি মানে কি শূন্য হইতে কোন কিছুর উৎপত্তি? ভাল করিয়া বিশ্লেষণ করিলে ইহা অসম্ভব মনে হয়। অতএব বলা উচিত, সৃষ্টি নয়—অভিব্যক্তি।

অবিদ্যমান কারণ হইতে কোন কার্যের উৎপত্তি হইতে পারে না। আমি যদি আগুনে আঙুল দিই, সঙ্গে সঙ্গে উহার ফল ফলিবে—আঙুল পুড়াইয়া যাইবে। আমি জানি আগুনের সহিত আঙুলের সংস্পর্শ-ক্রিয়াই হইল দাহের কারণ। এইরূপে বিশ্বপ্রকৃতি ছিল না—এমন কোন সময় থাকা অসম্ভব, কেননা প্রকৃতির কারণ সর্বদাই বর্তমান।

তর্কের খাতিরে যদি স্বীকার কর যে, এমন এক সময় ছিল, কোন প্রকার অস্তিত্ব ছিল না, তাহা হইলে প্রশ্ন ওঠে—এই-সব বিপুল জড়-সমষ্টি কোথায় ছিল? সম্পূর্ণ নূতন কিছু সৃষ্টি করিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রচণ্ড অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হইবে। হইা অসম্ভব। পুরাতন বস্তু নূতন করিয়া গড়া চলে, কি

ন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নূতন কিছু আমদানী করা চলে না।ইহা ঠিক যে, পুনর্জন্মবাদ গণিত দিয়া প্রমাণ করা চলে না। ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে অনুমান ও মতবাদের বলবত্তা প্রত্যক্ষের মত নাই সত্য, তবে আমার বক্তব্য এই যে, জীবনের ঘটনাসমূহকে ব্যাখ্যা করিবার জন্য মানুষের বুদ্ধি ইহা অপেক্ষা প্রশস্ততর অন্য কোন মতবাদ আর উপস্থাপিত করিতে পারে নাই।

মিনিয়াপলিস্‌ শহর হইতে ট্রেনে আসিবার সময় আমার একটি বিশেষ ঘটনার কথা মনে পড়িতেছে। গাড়ীতে জনৈক গো-পালক ছিল। লোকটি একটু রুক্ষপ্রকৃতি এবং ধর্ম বিশ্বাসে গোঁড়া প্রেসবিটেরিয়ান। সে আমার কাছে আগাইয়া আসিয়া জানিতে চাহিল, আমি কোথাকার লোক। আমি বলিলাম, ভারতবর্ষের। তখন সে আবার জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমার ধর্ম কি?’ আমি বলিলাম, হিন্দু। সে বলিল, ‘তাহা হইলে তুমি নিশ্চয়ই নরকে যাইবে।’

আমি তাহাকে পুনর্জন্মবাদের কথা বলিলাম। শুনিয়া সে বলিলঃ সে বরাবরই এই মতবাদে বিশ্বাসী, কেননা একদিন সে যখন কাঠ কাটিতেছিল, তখন তাহার ছোট বোনটি তাহার (গো-পালকের) পোষাক পরিয়া তাহাকে বলে যে, সে আগে পুরুষমানুষ ছিল। এই জন্যই সে আত্মার শরীরান্তর-প্রাপ্তিতে বিশ্বাস করে। এই মতবাদের মূল সূত্রটি এইঃ মানুষ যদি ভাল কাজ করে, তাহা হইলে তাহার উচ্চতর ঘরে জন্ম হইবে, আর মন্দ কাজ করিলে নিকৃষ্ট গতি।

এই মতবাদের আর একটি চমৎকার দিক্‌ আছে—ইহা শুভ প্রবৃত্তির প্ররোচক। একটি কাজ যখন করা হইয়া যায়, তখন তো আর উহাকে ফিরান যায় না। এই মত বলে, আহা যদি ঐ কাজটি আরও ভাল করিয়া করিতে পারিতে! যাহা হউক, আগুনে আর হাত দিও না। প্রত্যেক মুহূর্তে নূতন সুযোগ আসিতেছে। উহাকে কাজে লাগাও।

বিবে কানন্দ এইভাবে কিছুকাল বলিয়া চলেন। শ্রোতারা ঘন ঘন করতালি দিয়া প্রশংসাধ্বনি করেন।

স্বামী বিবে কানন্দ পুনরায় আজ বিকাল ৪টায় লা স্যালেট একাডেমীতে ‘ভারতীয় আচার-ব্যবহার’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিবেন।

তুলনাত্মক ধর্মতত্ত্ব-

[মেমফিস্‌ শহরে ১৮৯৪ খ্রীঃ ২১ জানুআরী প্রদত্ত; ‘অ্যাপীল অ্যাভালাঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত]

স্বামী বিবে কানন্দ গত রাত্রে ‘ইয়ং মেন‍্‍স্ হিব্রু এসোসিয়েশন হল’-এ ‘তুলনাত্মক ধর্মতত্ত্ব’ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দিয়াছেন। এখানে তিনি যতগুলি ভাষণ দিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে এইটি উৎকৃষ্ট। এই সুপণ্ডিত ভদ্রমহোদয়ের প্রতি এই শহরের অধিবাসীবৃন্দের শ্রদ্ধা এই বক্তৃতাটি দ্বারা নিঃসন্দেহে অনেক বাড়িয়াছে। এ পর্যন্ত বিবে কানন্দ কোন না কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের উপকারের জন্য বক্তৃতা করিয়াছেন।

ঐ-সকল প্রতিষ্ঠান যে তাঁহার নিকট আর্থিক সহায়তা পাইয়াছে তাহাও ঠিক। গত রাত্রের বক্তৃতার দর্শনী কিন্তু তাঁহার নিজের কাজের জন্য। এই বক্তৃতাটির পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থা করেন বিবে কানন্দের বিশিষ্ট বন্ধু ও ভক্ত মিঃ হিউ এল ব্রিঙ্কলী। এই প্রাচ্যদেশীয় মনীষীর শেষ বক্তৃতা শুনিতে গত রাত্রিতে প্রায় দুইশত শ্রোতার সমাগম হইয়াছিল।

বক্তা তাঁহার বক্তব্য বিষয় সম্বন্ধে প্রথমে এই প্রশ্নটি তুলেনঃ ধর্মের নানা মতবাদ সত্ত্বেও ধর্মে ধর্মে কি বাস্তবিকই খুব পার্থক্য আছে? বক্তার মতেঃ না, বর্তমান যুগে বিশেষ পার্থক্য আর নাই। তিনি সকল ধর্মের ক্রমবিকাশ আদিম কাল হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত অনুসরণ করিয়া দেখান যে, আদিম মানুষ অবশ্য ঈশ্বর সম্বন্ধে নানা প্রকারের ধারণা পোষণ করিত, কিন্তু মানুষের নৈতিক ও মানসিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর-ধারণার এই-সকল বিভিন্নতা ক্রমশঃ কমিয়া আসিতে থাকে এবং অবশেষে উহা একেবারেই মিলাইয়া যায়। বর্তমানে শুধু একটি মত সর্বত্র প্রবল—ঈশ্বরের নির্বিশেষ অস্তিত্ব।

বক্তা বলেনঃ এমন কোন বর্বর জাতি নাই, যাহারা কোন না কোন দেবতায় বিশ্বাস না করে। উহাদের মধ্যে প্রেমের ভাব খুব বলবান্ নয়, বরং উহারা জীবন যাপন করে ভয়ের পটভূমিতে। তাহাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন কল্পনায় একটি ঘোর বিদ্বেষপরায়ণ ‘দেবতা’ খাড়া হয়। এই ‘দেবতা’র ভয়ে তাহারা সর্বদাই কম্পমান। তাহার নিজের যাহা ভাল লাগে, ঐ দেবতারও তাহা ভাল লাগিবে, সে ধরিয়া লয়। সে নিজে যাহা পাইয়া সুখী হয়, সে ভাবে—উহা দেবতারও ক্রোধ শান্ত করিবে। স্বজাতীয়ের বিরুদ্ধতা করিয়াও সে এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য চেষ্টা করে।

বক্তা ঐতিহাসিক তথ্য দ্বারা প্রমাণ করেনঃ অসভ্য মানুষ পিতৃপুরুষের পূজা হইতে হাতীদের পূজায় পৌঁছায় এবং পরে বজ্র এবং ঝড়ের দেবতা প্রভৃতি নানা দেবতার উপাসনায়। এই অবস্থায় মানুষের ধর্ম ছিল বহুদেববাদ। বিবে কানন্দ বলেনঃ ‘সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য, সূর্যাস্তের চমৎকারিতা, নক্ষত্রখচিত আকাশের রহস্যময় দৃশ্য এবং বজ্র ও বিদ্যুতের অদ্ভুত অলৌকিকতা আদিম মানুষের মনে একটি গভীর আবেশ সৃষ্টি করিয়াছিল, যাহা সে ব্যাখ্যা করিতে পারে নাই।

ফলে চোখের সম্মুখে উপস্থিত প্রকৃতির এইসব বিশাল ঘটনার নিয়ামক একজন উচ্চতর এবং মহাশক্তিমান্ কেহ আছেন—এই ধারণাই তাহার হৃদয়ে সঞ্চারিত হইয়াছিল।’

ইহার পর আসিল আর একটি পর্যায়—একেশ্বরবাদের কাল। বিভিন্ন দেবতারা অদৃশ্য হইয়া একটি মাত্র সত্তায় মিশিয়া গেলেন—দেবতার দেবতা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বরে। ইহার পর বক্তা আর্যজাতিকে এই পর্যায় পর্যন্ত অনুসরণ করিলেন। এই পর্যায়ে তত্ত্বজিজ্ঞাসুর কথা হইল—‘আমরা ঈশ্বরের সত্তায় বাঁচিয়া আছি, তাঁহারই মধ্যে চলিতেছি ফিরিতেছি। তিনিই গতিস্বরূপ।’

ইহার পর আর একটি কাল আসিল, দর্শনশাস্ত্রে যাহাকে সর্বেশ্বরবাদের কাল বলা হয়। আর্যজাতি বহুদেবতাবাদ, একেশ্বরবাদ এবং বিশ্বজগৎই ঈশ্বর—সর্বেশ্বরবাদের এই মতও প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেন, ‘আমার অন্তরাত্মাই একমাত্র সত্য। আমার প্রকৃতি হইল সত্তাস্বরূপ, যত কিছু বিস্তৃতি, তাহা আমাতেই।’

বিবে কানন্দ অতঃপর বৌদ্ধধর্মের প্রসঙ্গে আসেন। তিনি বলেন যে, বৌদ্ধেরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নাই, অস্বীকারও করে নাই। উপদেশ প্রার্থনা করিলে বুদ্ধ শুধু বলিতেন, ‘দুঃখ তো দেখিতে পাইতেছ; বরং উহা হ্রাস করিবার চেষ্টা কর।’ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর কাছে দুঃখ সর্বদাই বিদ্যমান।

বক্তা বলেন, মুসলমানরা হিব্রুদের ‘প্রাচীন সমাচার’ এবং খ্রীষ্টানদের ‘নূতন সমাচার’ বিশ্বাস করেন, তবে তাঁহারা খ্রীষ্টানদের পছন্দ করেন না, কেননা তাঁহাদের ধারণা যে, খ্রীষ্টানরা প্রাচীন ধর্মমতের বিরোধিতা করেন এবং মানুষ-পূজা শিক্ষা দেন। মহম্মদ তাঁহার মতানুবর্তীদের তাঁহার নিজের কোন ছবি রাখিতে নিষেধ করিয়াছিলেন।

বক্তা বলেনঃ এখন এই প্রশ্ন উঠে যে, এই-সকল বিভিন্ন ধর্মের সবগুলিই কি সত্য, না কতকগুলি খাঁটি, আর বাকীগুলি ভুয়া? সব ধর্মই একটি সিদ্ধান্তে আসিয়া পৌঁছিয়াছে—একটি চরম অনন্ত সত্তার অস্তিত্ব। ধর্মের লক্ষ্য হইল একত্ব। আমরা যে চারি পাশে ঘটনারাশির বৈচিত্র্য দেখি, উহারা একত্বেরই অনন্ত অভিব্যক্তি। ধর্মসমূহকে যদি তলাইয়া বিশ্লেষণ করা যায়, তাহা হইলে দেখিতে পাওয়া যাইবে, মানুষের অভিযান—মিথ্যা হইতে সত্যে নয়, নিম্নতর সত্য হইতে উচ্চতর সত্যে।

ধরুন জনৈক ব্যক্তি একটি মাত্র মাপের জামা লইয়া অনেকগুলি লোকের কাছে বিক্রয় করিতে আসিয়াছে। কেহ কেহ বলিল, ঐ জামা তাহাদের গায়ে লাগিবে না। তখন লোকটি উত্তর করিল, তাহা হইলে তোমরা বিদায় হও,

জামা পরিয়া কাজ নাই। কোন পাদ্রীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, যে-সব (খ্রীষ্টান) সম্প্রদায় তাঁহার মতবাদ ও বিশ্বাসগুলি মানে না, তাহাদের কি ব্যবস্থা হইবে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘ওঃ, উহারা খ্রীষ্টানই নয়।’ কিন্তু ইহা অপেক্ষা ভাল উপদেশও সম্ভব। আমাদের নিজেদের প্রকৃতি, পরস্পরের প্রতি প্রেম এবং বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ—এইগুলি হইতে আমরা প্রশস্ততর শিক্ষা পাই।

নদীর বুকে যে জলস্রোতের আবর্ত, ঐগুলি যেমন নদীর প্রাণের পরিচায়ক, ঐগুলি না থাকিলে নদী যেমন মরিয়া যায়, সেইরূপ ধর্মকে বেড়িয়া নানা বিশ্বাস ও মত ধর্মের অন্তর্নিহিত শক্তিরই ইঙ্গিত। এই মতবৈচিত্র্য যদি ঘুচিয়া যায়, তাহা হইলে ধর্মচিন্তারও মরণ ঘটিবে। গতি আবশ্যক। চিন্তা হইল মনের গতি, এই গতি থামিয়া যাওয়া মৃত্যুর সূচনা।

একটি বুদ্বুদকে যদি এক গ্লাস জলের তলদেশে আটকাইয়া রাখ, উহা তৎক্ষণাৎ উপরের অনন্ত বায়ুমণ্ডলে যোগ দিবার জন্য আন্দোলন শুরু করিবে। জীবাত্মা সম্বন্ধে এই একই কথা। উহা ভৌতিক দেহ থেকে মুক্তি লাভ করিতে এবং নিজের শুদ্ধ স্বভাব ফিরিয়া পাইতে অনবরত চেষ্টা করিতেছে। উহার আকাঙ্ক্ষা হইল স্বকীয় বাধাহীন অনন্ত বিস্তার পুনরায় লাভ করা। আত্মার এই প্রচেষ্টা সর্বত্রই সমান।

খ্রীষ্টান বল, বৌদ্ধ বল, মুসলমান বল, অথবা সংশয়বাদী কিম্বা ধর্মযাজকই বল, প্রত্যেকের মধ্যে জীবাত্মা এই মুক্তির প্রয়াসে তৎপর। মনে কর, একটি নদী হাজার মাইল আঁকাবাঁকা পার্বত্য পথ কত কষ্টে অতিক্রম করিয়া অবশেষে সমুদ্রে পড়িয়াছে, আর একজন মানুষ ঐ সঙ্গমস্থলে দাঁড়াইয়া নদীকে আদেশ করিতেছেঃ হে নদী, তোমার উৎপত্তি স্থলে ফিরিয়া যাও এবং নূতন একটি সিধা রাস্তা ধরিয়া সাগরে এস।

এই মানুষটি কি নির্বোধ নয়? য়াহুদী তুমি, তুমি হইলে জাইঅন (Zion) শৈল হইতে নিঃসৃত একটি নদী। কিন্তু আমি, আমি নামিয়া আসিতেছি উত্তুঙ্গ হিমালয় শৃঙ্গ হইতে। আমি তোমাকে বলিতে পারি না—যাও, তুমি ফিরিয়া যাও, তুমি ভুল পথ ধরিয়াছ। আমার পথে পুনরায় বহিয়া এস। এইরূপ উক্তি বোকামী ছাড়া বিষম ভুলও। নিজের বিশ্বাস আঁকড়াইয়া থাক। সত্য কখনও বিলুপ্ত হয় না।

পুঁথিপত্র নষ্ট হইতে পারে, জাতিসমূহও সংঘর্ষে নিশ্চিহ্ন হইতে পারে, কিন্তু সত্য বাঁচিয়া থাকে। পরে কোন মানুষ আসিয়া উহাকে আবিষ্কার করে এবং উহা সমাজে পুনঃ প্রবর্তিত হয়। ইহা হইতে প্রমাণিত হয়, ভগবান কী চমৎকার রীতিতে তাঁহার অতীন্দ্রিয় জ্ঞান অনবরত মানুষের কাছে অভিব্যক্ত করিতেছেন!

‘এশিয়ার আলোক’—বুদ্ধদেবের ধর্ম

[ডেট্রয়েট শহরে ১৮৯৪ খ্রীঃ ১৯ মার্চ প্রদত্ত; ‘ডেট্রয়েট ট্রিবিউন’ পত্রিকায় প্রকাশিত।]

গতরাত্রে অডিটোরিয়ামে বিবে কানন্দ ১৫০ জন শ্রোতার নিকট ‘এশিয়ার আলোক’—বুদ্ধদেবের ধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দেন। মাননীয় ডন এম. ডিকিনসন সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট বক্তার পরিচয়-প্রসঙ্গে বলেন—কে বলিতে পারে যে, এই ধর্মমতটি ঈশ্বরাদিষ্ট, আর অন্যটি নিকৃষ্ট? অতীন্দ্রিয়তার বিভাগ-রেখা কে টানিতে পারে?

বিবে কানন্দ ভারতবর্ষের প্রাচীন ধর্মগুলির বিশদ পর্যালোচনা করেন। তিনি যজ্ঞ- বেদীতে বহুল প্রাণিবধের কথা বলিয়া বুদ্ধের জন্ম এবং জীবন-কাহিনী বর্ণনা করেন। সৃষ্টির কারণ এবং জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বুদ্ধের মনে যে দুরূহ সমস্যাগুলি উঠিয়াছিল, ঐগুলির সমাধানের জন্য তিনি যে তীব্র সাধনা করিয়াছিলেন এবং পরিশেষে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলেন, এ-সকল বিষয় বক্তা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন যে, বুদ্ধ অপর সকল মানুষের উপরে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যাঁহার সম্বন্ধে কি মিত্র, কি শত্রু—কেহ কখনও বলিতে পারে না যে, তিনি সকলের হিতের জন্য ছাড়া একটিও নিঃশ্বাস লইয়াছেন বা এক টুকরা রুটি খাইয়াছেন।

কানন্দ বলেন, আত্মার জন্মান্তরগ্রহণ বুদ্ধ কখনও প্রচার করেন নাই। তবে তিনি বিশ্বাস করিতেন যে, সমুদ্রে যেমন একটি ঢেউ উঠিয়া মিলাইয়া যাইবার সময় পরবর্তী ঢেউটিতে তাহার শক্তি সংক্রামিত করিয়া যায়, সেইরূপ একটি জীব তাহার উত্তরকালীনে নিজের শক্তি রাখিয়া যায়। বুদ্ধ ঈশ্বরের অস্তিত্ব কখনও প্রচার করেন নাই; আবার ঈশ্বর যে নাই, তাহাও বলেন নাই।

তাঁহার শিষ্যেরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ‘আমরা সৎ হইব কেন?’ বুদ্ধ উত্তর দিলেন, ‘কারণ তোমরা উত্তরাধিকারসূত্রে সদ‍্‍ভাব পাইয়াছ। তোমাদেরও উচিত পরবর্তীদের জন্য কিছু সদ‍্‍ভাব রাখিয়া যাওয়া।’ সংসার সমষ্টিকৃত সাধুতার সম্প্রসারের জন্যই আমাদের প্রত্যেকের সাধু আচরণ বিধেয়।

বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অবতার। তিনি কাহারও নিন্দা করেন নাই, নিজের জন্য কিছু দাবী করেন নাই। নিজেদের চেষ্টাতেই আমাদিগকে মুক্তিলাভ করিতে হইবে, ইহাই ছিল তাঁহার বিশ্বাস। মৃত্যুশয্যায় তিনি বলিয়াছিলেন, ‘আমি বা অপর কেহই তোমাদিগকে সাহায্য করিতে পারে না। কাহারও উপর নির্ভর করিও না। নিজের মুক্তি নিজেই সম্পাদন কর।’

মানুষে মানুষে এবং মানুষে ও ইতরপ্রাণীতে অসাম্যের বিরুদ্ধে বুদ্ধ প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, সকল প্রাণীই সমান। তিনিই প্রথম মদ্যপান বন্ধ করার নীতি উপস্থাপিত করেন। তাঁহার শিক্ষাঃ সৎ হও, সৎ কাজ কর। যদি ঈশ্বর থাকেন, সাধুতার দ্বারা তাঁহাকে লাভ কর। যদি ঈশ্বর নাও থাকেন, তবুও সাধুতাই শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য। মানুষের যাবতীয় দুঃখের জন্য সে নিজেই দায়ী। তাহার সমুদয় সদাচরণের জন্য প্রশংসাও তাহারই প্রাপ্য।

বুদ্ধই প্রথম ধর্মপ্রচারক দলের উদ্ভাবক। ভারতের লক্ষ লক্ষ পদদলিতদিগের পরিত্রাতারূপে তাঁহার আবির্ভাব। উহারা তাঁহার দার্শনিক মত বুঝিতে পারিত না, কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া এবং তাঁহার উপদেশ শুনিয়া তাঁহাকে অনুসরণ করিত।

উপসংহারে কানন্দ বলেন যে, বৌদ্ধধর্ম খ্রীষ্টধর্মের ভিত্তি। ক্যাথলিক সম্প্রদায় বৌদ্ধধর্ম হইতেই উদ্ভূত।

মানুষের দেবত্ব-

‘এডা রেকর্ড’, ২৮ ফেব্রুআরী, ১৮৯৪

গত শুক্রবার (২২ ফেব্রুআরী) অপেরা হাউস-এ হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের ‘মানুষের দেবত্ব’ সম্বন্ধে বক্তৃতা শুনিয়া ঘর-ভর্তি শ্রোতার সমাগম হইয়াছিল। বক্তা বলেন, সকল ধর্মের মূল ভিত্তি হইল মানুষের প্রকৃত স্বরূপ আত্মাতে বিশ্বাস—যে আত্মা জড়পদার্থ ও মন দুয়েরই অতিরিক্ত কিছু। জড়বস্তুর অস্তিত্ব অপর কোন বস্তুর উপর নির্ভর করে। মনও পরিবর্তনশীল বলিয়া অনিত্য। মৃত্যু তো একটি পরিবর্তন মাত্র।

আত্মা মনকে যন্ত্রস্বরূপ করিয়া শরীরকে চালিত করে। মানবাত্মা যাহাতে শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হয়, এই চেষ্টা করা কর্তব্য। মানুষের স্বরূপ হইল নির্মল ও পবিত্র, কিন্তু অজ্ঞান আসিয়া মেঘের মত উহাকে যেন আছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। ভারতীয় ধর্মের দৃষ্টিতে প্রত্যেক আত্মাই তাহার প্রকৃত শুদ্ধ স্বরূপ ফিরিয়া পাইতে চেষ্টা করিতেছে। অধিকাংশ ভারতবাসী আত্মার স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী। আমাদের ধর্মই একমাত্র সত্য, ইহা আমাদের প্রচার করা নিষিদ্ধ।

বক্তা বলেন, “আমি হইলাম চৈতন্যস্বরূপ, জড় নই। প্রতীচ্যের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ মৃত্যুর পরও আবার স্থূল শরীরে বাস করিবার আশা পোষণ করে। আমাদের ধর্ম শিক্ষা দেয় যে, এইরূপ কোন অবস্থা থাকিতে পারে না। আমরা ‘পরিত্রাণে’র বদলে ‘আত্মার মুক্তি’র কথা বলি।”

মূল বক্তৃতাটিতে মাত্র ৩০ মিনিট লাগিয়াছিল, তবে বক্তৃতার ব্যবস্থাপক সমিতির অধ্যক্ষ ঘোষণা করেন, বক্তৃতার শেষে কেহ প্রশ্ন করিলে বক্তা উহার উত্তর দিতে প্রস্তুত আছেন। এই সুযোগ অনেকেই গ্রহণ করিয়াছিলেন। যাঁহারা প্রশ্ন করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে যেমন ছিলেন ধর্মযাজক, অধ্যাপক, ডাক্তার ও দার্শনিক, তেমনি ছিলেন সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, সৎলোক আবার দুষ্ট লোক। অনেকে লিখিয়া তাঁহাদের প্রশ্ন উপস্থাপিত করেন।

অনেকে আবার তাঁহাদের আসন হইতে উঠিয়া বক্তাকে সোজাসুজি প্রশ্ন করেন। বক্তা সকলকেই সৌজন্যের সহিত উত্তর দেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তাকে খুব হাসাইয়া তুলেন। এক ঘণ্টা এইরূপ চলিবার পর বক্তা আলোচনা সমাপ্তির অনুরোধ জানান। তখনও বহু লিখিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বাকী। বক্তা অনেকগুলির জবাব কৌশলে এড়াইয়া যান। যাহা হউক তাঁহার আলোচনা হইতে হিন্দুধর্মের বিশ্বাস ও শিক্ষাসমূহ সম্বন্ধে নিম্নোক্ত আরও কয়েকটি কথা আমরা লিপিবদ্ধ করিলামঃ

হিন্দুরা মানুষের পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। তাহদের ভগবান্ কৃষ্ণ উত্তর ভারতে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে এক শুদ্ধভাবা নারীর৯ গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। কৃষ্ণের কাহিনী বাইবেলে কথিত খ্রীষ্টের জীবনেতিহাসের অনুরূপ, তবে কৃষ্ণ নিহত হন একটি আকস্মিক দুর্ঘটনায়। হিন্দুরা মানবাত্মার প্রগতি এবং দেহান্তর-প্রাপ্তি স্বীকার করেন। আমাদের আত্মা পূর্বে পাখী, মাছ বা অপর কোন ইতরপ্রাণীর দেহে আশ্রিত ছিল, মরণের পরে আবার অন্য কোন প্রাণী হইয়া জন্মাইবে।

একজন জিজ্ঞাসা করেন, এই পৃথিবীতে আসিবার আগে এই সব আত্মা কোথায় ছিল। বক্তা বলেন অন্যান্য লোকে। আত্মা সকল অস্তিত্বের অপরিবর্তনীয় আধার। এমন কোন কাল নাই, যখন ঈশ্বর ছিলেন না এবং সেইজন্য এমন কোন কাল নাই যখন সৃষ্টি ছিল না। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা ব্যক্তি-ভগবান্ স্বীকার করেন না। বক্তা বলেন, তিনি বৌদ্ধ নন। খ্রীষ্টকে যেভাবে পূজা করা হয়, মহম্মদকে সেইভাবে করা হয় না। মহম্মদ খ্রীষ্টকে মানিতেন, তবে খ্রীষ্ট যে ঈশ্বর—ইহা অস্বীকার করিতেন।

পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ক্রমবিকাশের ফলে ঘটিয়াছে, বিশেষ নির্বাচন (নূতন সৃষ্টি) দ্বারা নয়। ঈশ্বর হইলেন স্রষ্টা, বিশ্বপ্রকৃতি তাঁহার সৃষ্টি। হিন্দুধর্মে ‘প্রার্থনা’র রীতি নাই—এক শিশুদের জন্য ছাড়া এবং তাহাও শুধু মনের উন্নতির উদ্দেশ্যে। পাপের সাজা অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি ঘটিয়া থাকে। আমরা যে-সব কাজ করি, তাহা আত্মার নয়, অতএব কাজের ভিতর মলিনতা ঢুকিতে পারে। আত্মা পূর্ণস্বরূপ, শুদ্ধস্বরূপ। উহার কোন বিশ্রাম-স্থানের প্রয়োজন হয় না।

জড়পদার্থের কোন ধর্ম আত্মাতে নাই। মানুষ যখন নিজেকে চৈতন্যস্বরূপ বলিয়া জানিতে পারে, তখনই সে পূর্ণাবস্থা লাভ করে। ধর্ম হইল আত্মস্বরূপের অভিব্যক্তি। যে যত আত্মস্বরূপ সম্বন্ধে অবহিত, সে তত সাধু। ভগবানের শুদ্ধসত্তার অনুভবের নামই উপাসনা। হিন্দুধর্ম বহিঃপ্রচারে বিশ্বাস করে না।

উহার শিক্ষা এই যে—মানুষ যেন ভগবানকে ভালবাসার জন্যই ভালবাসে এবং প্রতিবেশীর প্রতি সদয় আচরণের সময় নিজেকে যেন সম্পূর্ণ ভুলিয়া যায়। পাশ্চাত্যের লোক অতিরিক্ত কর্মপ্রবণ। বিশ্রামও সভ্যতার একটি অঙ্গ। হিন্দুরা নিজেদের দুর্বলতাগুলি ঈশ্বরের উপর চাপায় না। সকল ধর্মের পারস্পরিক মিলনের একটি প্রবণতা এখন দেখা যাইতেছে।

হিন্দু সন্ন্যাসী-

‘বে সিটি টাইমস্‌’, ২১ মার্চ ১৮৯৪

গতকল্য সন্ধ্যায় অপেরা হাউস-এ স্বামী বিবে কানন্দ যে চিত্তাকর্ষক ভাষণটি দিয়াছেন, ঐরূপ বক্তৃতা শুনিবার সুযোগ এই শহরের (বে সিটি) লোক কদাচিৎ পাইয়া থাকে। বক্তা ভদ্রলোক, ভারতবর্ষের অধিবাসী। প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে তিনি কলিকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ডক্টর সি. টি নিউকার্ক যখন শ্রোতৃবৃন্দের নিকট বক্তার পরিচয় প্রদান করিতেছেন, তখন অপেরা হাউসের নীচের তলার প্রায় অর্ধেকটা ভরিয়া গিয়াছে।

কথাপ্রসঙ্গে বক্তা এই দেশের লোককে সর্বশক্তিমান্ ডলারের ভজনা করিবার জন্য সমালোচনা করেন। ভারতে জাতিভেদ আছে সত্য, কিন্তু খুনী লোক কখনও সমাজের শীর্ষস্থানে যাইতে পারে না। কিন্তু এদেশে যদি সে দশলক্ষ ডলারের মালিক হয়, তাহা হইলে সে অপর যে-কোন ব্যক্তিরও সমান। ভারতে একবার যদি কেহ গুরুতর অপরাধ করিয়া বসে, তাহা হইলে বারবার সে হীন থাকিয়া যায়।

হিন্দুধর্মের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হইল—অন্যান্য ধর্ম ও বিশ্বাসসমূহের প্রতি সহিষ্ণুতা। অন্যান্য প্রাচ্য দেশের ধর্ম অপেক্ষা ভারতবর্ষের ধর্মের উপরই মিশনরীদের আক্রোশ বেশী, কেননা হিন্দুরা তাঁহাদিগকে এইরূপ করিতে বাধা দেয় না। এখানে হিন্দুরা তাহাদের ধর্মের যাহা একটি প্রধান শিক্ষা—সহিষ্ণুতা, উহাই প্রতিপালন করিতেছে, বলিতে পারা যায়। কানন্দ একজন উচ্চশিক্ষিত এবং মার্জিতরুচি ভদ্রলোক।

আমরা শুনিয়াছি ডেট্রয়েট-এ কানন্দকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিলঃ হিন্দুরা নদীতে তাহাদের শিশুসন্তান নিক্ষেপ করে কিনা? কানন্দ উত্তর দেনঃ না তাহারা ঐরূপ করে না, পাশ্চাত্যদেশের মত ডাইনী সন্দেহ করিয়া স্ত্রীলোকেদেরও তাহারা দাহ করে না। বক্তা আজ রাত্রে স্যাগিন শহরে বক্তৃতা করিবেন।

 

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!