ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-স্বামী বিবেকানন্দ

প্রথমে আপনাদের নিকট যে সাংখ্যদর্শনের আলোচনা করিতেছিলাম, এখন তাহার মোট কথাগুলি সংক্ষেপে বলিব। কারণ এই বক্তৃতায় আমরা ইহার ত্রুটি কোন‍্‍গুলি, তাহা বাহির করিতে এবং বেদান্ত আসিয়া কিরূপে ঐ অপূর্ণতা পূর্ণ করিয়া দেন, তাহা বুঝিতে চাই। আপনাদের অবশ্যই স্মরণ আছে যে সাংখ্যদর্শনের মতে প্রকৃতি হইতেই চিন্তা, বুদ্ধি, বিচার, রাগ, দ্বেষ, স্পর্শ, রস-এক কথায় সব-কিছুরই বিকাশ হইতেছে। এই প্রকৃতি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ নামক তিন প্রকার উপাদানে গঠিত।

এগুলি গুণ নয়,-জগতের উপাদান কারণ; এইগুলি হইতেই জগৎ উৎপন্ন হইতেছে, আর যুগ প্রারম্ভে এগুলি সামঞ্জস্যভাবে বা সাম্যাবস্থায় থাকে। সৃষ্টি আরম্ভ হইলেই এই সাম্যাবস্থা ভঙ্গ হয়। তখন এই দ্রব্যগুলি পরস্পর মিলিত হইয়া এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে। ইহাদের প্রথম বিকাশকে সাংখ্যেরা মহৎ (অর্থাৎ সর্বব্যাপী বুদ্ধি) বলেন। আর তাহা হইতে অহংজ্ঞানের উৎপত্তি হয়। অহংজ্ঞান হইতে মন অর্থাৎ সর্বব্যাপী মনস্তত্ত্বের উদ্ভব।

ঐ অহংজ্ঞান বা অহঙ্কার হইতেই জ্ঞান ও কর্মেন্দ্রিয় এবং তন্মাত্রা অর্থাৎ শব্দ, স্পর্শ, রস প্রভৃতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পরমাণুর উৎপত্তি হয়। এই অহঙ্কার হইতেই সমুদয় সূক্ষ্ম পরমাণুর উদ্ভব, আর ঐ সূক্ষ্ম পরমাণুসমূহ হইতেই স্থূল পরমাণুসমূহের উৎপত্তি হয়, যাহাকে আমরা জড় বলি। তন্মাত্রার (অর্থাৎ যে-সকল পরমাণু দেখা যায় না বা যাহাদের পরিমাণ করা যায় না) পর স্থূল পরমাণুসকলের উৎপত্তি-এগুলি আমরা অনুভব বা ইন্দ্রিয়গোচর করিতে পারি।

বুদ্ধি, অহঙ্কার ও মন-এই ত্রিবিধ কার্য-সমন্বিত চিত্ত প্রাণনামক শক্তিসমূহকে সৃষ্টি করিয়া উহাদিগকে পরিচালিত করিতেছে। এই প্রণের সহিত শ্বাসপ্রশ্বাসের কোন সম্বন্ধ নাই, আপনাদের ঐ ধারণা এখন ছাড়িয়া দেওয়া উচিত। শ্বাসপ্রশ্বাস এই প্রাণ বা সর্বব্যাপী শক্তির একটি কার্য মাত্র। কিন্তু এখানে ‘প্রাণসমূহ’ অর্থে সেই স্নায়বীয় শক্তিসমূহ বুঝায়, যেগুলি সমুদয় দেহটিকে চালাইতেছে এবং চিন্তা ও দেহের নানাবিধ ক্রিয়ারূপে প্রকাশ পাইতেছে।

শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি এই প্রাণসমূহের প্রধান ও প্রত্যক্ষতম প্রকাশ। যদি বায়ু দ্বারাই এই শ্বাসপ্রশ্বাস-কার্য হইত, তবে মৃত ব্যক্তিও শ্বাসপ্রশ্বাস-ক্রিয়া করিত। প্রাণই বায়ুর উপর কার্জ করিতেছে, বায়ু প্রাণের উপর করিতেছে না। এই প্রাণসমূহ জীবনশক্তিরূপে সমুদয় শরীরের উপর কার্য করিতেছে, উহারা আবার মন এবং ইন্দ্রিয়গণ (অর্থাৎ দুই প্রকার স্নায়ুকেন্দ্র) দ্বারা পরিচালিত হইতেছে। এ পর্যন্ত বেশ কথা।

মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ খুব স্পষ্ট ও পরিষ্কার, আর ভাবিয়া দেখুন, কত যুগ পূর্বে এই তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইয়াছে-ইহা জগতের মধ্যে প্রাচীনতম যুক্তিসিদ্ধ চিন্তাপ্রণালী। যেখানেই কোনরূপ দর্শন বা যুক্তিসিদ্ধ চিন্তাপ্রণালী দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা কপিলের নিকট কিছু না কিছু ঋণী। যেখানেই মনস্তত্ত্ব-বিজ্ঞানের কিছু না কিছু চেষ্টা হইয়াছে, সেখনেই দেখিতে পাওয়া যায়, ঐ চেষ্টা এই চিন্তা-প্রণালীর জনক কপিল নামক ব্যক্তির নিকট ঋণী।

অতএব সুখদুঃখ স্নায়ুকেন্দ্রসমূহের। মনে করুন, আমার দর্শনেন্দ্রিয় নষ্ট হইয়া গেল, তাহা হইলে আমার চক্ষুযন্ত্র থাকিলেও আমি রূপ হইতে কোন সুখ-দুঃখ অনুভব করিব না। অতএব ইহা স্পষ্ট দেখা যাইতেছে যে, সুখ-দুঃখ আত্মার নয়; উহারা মনের ও দেহের

এতদূর পর্যন্ত আমরা দেখিলাম যে, এই মনোবিজ্ঞান বড়ই অপূর্ব; কিন্তু আমরা যতই অগ্রসর হইব, ততই দেখিব, কোন কোন বিষয়ে ইহার সহিত আমাদিগকে ভিন্ন মত অবলম্বন করিতে হইবে। কপিলের প্রধান মত-পরিণাম। তিনি বলেন, এক বস্তু অপর বস্তুর পরিণাম বা বিকার; কারণ তাহার মতে কার্যকারণভাবের লক্ষণ এই যে কার্য অন্যরূপে পরিণত কারণমাত্র১ আর যেহেতু আমরা যতদূর দেখিতে পাইতেছি, তাহাতে সমগ্র জগৎই ক্রমাগত পরিণাম-প্রাপ্ত হইতেছে।

এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই নিশ্চয়ই কোন উপাদান হইতে অর্থাৎ প্রকৃতির পরিণামে উৎপন্ন হইয়াছে, সুতরাং প্রকৃতি উহার কারণ হইতে স্বরূপতঃ কখন ভিন্ন হইতে পারে না, কেবল যখন প্রকৃতি বিশিষ্ট আকার ধারণ করে, তখম সীমাবদ্ধ হয়। ঐ উপাদানটি স্বয়ং নিরাকার। কিন্তু কপিলের মতে অব্যক্ত প্রকৃতি হইতে বৈষম্যপ্রাপ্তির শেষ সোপান পর্যন্ত কোনটিই ‘পুরুষ’ অর্থাৎ ভোক্তা বা প্রকাশকের সহিত সমপর্যায়ে নয়। একটা কাদার তাল যেমন, সমষ্টিমনও তেমনি, সমগ্র জগৎও তেমনি।

স্বরূপতঃ উহাদের চৈতন্য নাই, কিন্তু উহাদের মধ্যে আমরা বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞান দেখিতে পাই, অতএব উহাদের পশ্চাতে-সমগ্র প্রকৃতির পশ্চাতে-নিশ্চয়ই এমন কোন সত্তা আছে, যাহার আলোক উহার উপর পড়িয়া মহৎ, অহংজ্ঞান ও এই-সব নানা বস্তুরূপে প্রতীত হইতেছে। আর এই সত্তাকেই কপিল ‘পুরুষ’ বা আত্মা বলেন, বেদান্তীরাও উহাকে আত্মা বলিয়া থাকেন। কপিলের মতে পুরুষ মিশ্রিত পদার্থ-উহা যৌগিক পদার্থ নয়। উহাই একমাত্র অজড় পদার্থ, আর সমুদয় প্রপঞ্চবিকারই জড়।

পুরুষই একমাত্র জ্ঞাতা। মনে করুন, আমি একটি বোর্ড দেখিতেছি। প্রথমে বাহিরের যন্ত্রগুলি মস্তিষ্ককেন্দ্রে (কপিলের মতে ইন্দ্রিয়ে) ঐ বিষয়টিকে লইয়া আসিবে; উহা আবার ঐ কেন্দ্র হইতে মনে যাইয়া তাহার উপর আঘাত করিবে, মন আবার উহাকে অহংজ্ঞানরূপে অপর একটি পদার্থে আবৃত করিয়া ‘মহৎ’ বা বুদ্ধির নিকট সমর্পণ করিবে। কিন্তু মহতের স্বয়ং কার্যের শক্তি নাই-উহার পশ্চাতে যে পুরুষ রহিয়াছেন, তিনিই প্রকৃতপক্ষে কর্তা।

এগুলি সবই ভৃত্যরূপে বিষয়ের আঘাত তাঁহার নিকট আনিয়া দেয়, তখন তিনি আদেশ দিলে ‘মহৎ’ প্রতিঘাত বা প্রতিক্রিয়া করে। পুরুষই ভোক্তা, বোদ্ধা, যথার্থ সত্তা, সিংহাসনোপবিষ্ট রাজা, মানবের আত্মা; তিনি কোন জড় বস্তু নন। যেহেতু তিনি জড় নন, সেহেতু তিনি অবশ্যই অনন্ত, তাহার কোনরূপ সীমা থাকিতে পারে না। সূতরাং ঐ পুরুষগণের প্রত্যেকেই সর্বব্যাপী, তবে কেবল সূক্ষ্ম ও স্থূল জড়পদার্থের মধ্য দিয়া কার্য করিতে পারেন।

মন, অহংজ্ঞান, মস্তিষ্ককেন্দ্রে বা ইন্দ্রিয়গণ এবং প্রাণ-এই কয়েকটি লইয়া সূক্ষ্মশরীর অথবা খ্রীষ্টীয় দর্শনে যাহাকে মানবের আধ্যাত্মিক দেহ বলে, তাহা গঠিত। এই দেহেরই পুরষ্কার বা দণ্ড হয়, ইহাই বিভিন্ন স্বর্গে যাইয়া থাকে, ইহার বারবার জন্ম হয়। কারণ আমরা প্রথম হইতেই দেখিয়া আসিতেছি, পুরুষ বা আত্মার পক্ষে আসা-যাওয়া অসম্ভব। ‘গতি’-অর্থে আসা যাওয়া, আর যাহা একস্থান হইতে অপর স্থানে গমন করে, তাহা কখনও সর্বব্যাপী হইতে পারে না।

এই লিঙ্গশরীর বা সূক্ষ্মশরীরই আসে যায়। এই পর্যন্ত আমরা কপিলের দর্শন হইতে দেখিলাম আত্মা অনন্ত এবং একমাত্র উহাই প্রকৃতির পরিণাম নয়। একমাত্র আত্মাই প্রকৃতির বাহিরে, কিন্তু উহা প্রকৃতিতে বদ্ধ হইয়া আছে বলিয়া প্রতীত হইতেছে। প্রকৃতি পুরুষকে বেড়িয়া আছে, সেইজন্য পুরুষ নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে মিশাইয়া ফেলিয়াছেন। পুরুষ ভাবিতেছেন, ‘আমি লিঙ্গশরীর, আমি স্থূলশরীর’, আর সেই জন্যই তিনি সুখদুঃখ ভোগ করিতেছেন।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সুখদুঃখ আত্মার নয়, উহারা লিঙ্গশরীরের এবং স্থূলশরীরের। যখনই কতকগুলি স্নায়ু আঘাতপ্রাপ্ত হয়, আমরা কষ্ট অনুভব করি, তখনই তৎক্ষণাৎ আমরা উহা উপলব্ধি করিয়া থাকি। যদি আমার অঙ্গুলির স্নায়ুগুলি নষ্ট হয়, তবে আমার অঙ্গুলি কাটিয়া ফেলিলেও কিছু বোধ করিব না। অতএব সুখদুঃখ স্নায়ুকেন্দ্রসমূহের। মনে করুন, আমার দর্শনেন্দ্রিয় নষ্ট হইয়া গেল, তাহা হইলে আমার চক্ষুযন্ত্র থাকিলেও আমি রূপ হইতে কোন সুখ-দুঃখ অনুভব করিব না। অতএব ইহা স্পষ্ট দেখা যাইতেছে যে, সুখ-দুঃখ আত্মার নয়; উহারা মনের ও দেহের।

…………………………………
১ কারণভাবাচ্চ । -সাংখ্যসূত্র, ১।১১৮

আত্মার সুখ দুঃখ কিছুই নাই; আত্মা সকল বিষয়ের সাক্ষিস্বরূপ, যাহা কিছু হইতেছে, তাহারই নিত্য সাক্ষিস্বরূপ, কিন্তু আত্মা কোন কর্মের ফল গ্রহণ করে না। ‘সূর্য যেমন সকল লোকের চক্ষুর দৃষ্টির কারণ হইলেও স্বয়ং কোন চক্ষুর দোষে লিপ্ত হয় না, পুরুষও তেমনি।’ ১

‘যেমন একখণ্ড স্ফটিকের সম্মুখে লাল ফুল রাখিলে উহা লাল দেখায়, এইরূপ পুরুষকেও প্রকৃতির প্রতিবিম্ব দ্বারা সুখদুঃখে লিপ্ত বোধ হয়, কিন্তু উহা সদাই অপরিণামী।’ ২

উহার অবস্থা যতটা সম্ভব কাছাকাছি বর্ণনা করিতে গেলে বলিতে হয়, ধ্যানকালে আমরা যে-ভাব অনুভব করি, উহা প্রায় সেইরূপ। এই ধ্যানাবস্থাতেই আপনারা পুরুষের খুব সন্নিহিত হইয়া থাকেন। অতএব আমরা দেখিতেছি, যোগীরা এই ধ্যানাবস্থাকে কেন সর্বোচ্চ অবস্থা বলিয়া থাকেন; কারণ পুরুষের সহিত আপনারা এই একত্ববোধ-জড়াবস্থা বা ক্রিয়াশীল অবস্থা নয়। উহা ধ্যানাবস্থা। ইহাই সাংখ্যদর্শন।

তারপর সাংখ্যেরা আরও বলেন যে, প্রকৃতির এই-সকল বিকার আত্মার জন্য, উহার বিভিন্ন উপাদানে সম্মিলনাদি সমস্তই উহা হইতে স্বতন্ত্র অপর কাহারও জন্য। সুতরাং এই যে নানাবিধ মিশ্রণকে আমরা প্রকৃতি বা

…………………………………
১ কঠোপনিষদ্, ২।২।২২
২ কুসুমবোচ্চ মণিঃ।-সাংখ্যসূত্র, ২।৩৫

জগৎপ্রপঞ্চ বলি-এই যে আমাদের ভিতরে এবং চতুর্দিকে ক্রমাগত পরিবর্তন-পরম্পরা হইতেছে, তাহা আত্মার ভোগ ও অপবর্গ বা মুক্তির জন্য। আত্মা সর্বনিম্ন অবস্থা হইতে সর্বোচ্চ অবস্থা পর্যন্ত ভোগ করিয়া তাহা হইতে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিতে পারেন, আবার আত্মা যখন অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, তিনি কোন কালেই প্রকৃতিতে বদ্ধ ছিলেন না, তিনি সর্বদাই উহা হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিলেন।

তখন তিনি আরও দেখিতে পান যে, তিনি অবিনাশী, তাঁহার আসা যাওয়া কিছুই নাই; স্বর্গে যাওয়া, আবার এখানে আসিয়া জন্মানো-সবই প্রকৃতির, তাহার নিজের নয়; তখনই আত্মা মুক্ত হইয়া যান। এইরূপে সমুদয় প্রকৃতি আত্মার ভোগ বা অভিজ্ঞতা-সঞ্চয়ের জন্য কার্য করিয়া যাইতেছে, আর আত্মা সেই চরম লক্ষে যাইবার জন্য এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিতেছেন। মুক্তিই সেই চরম লক্ষ। সাংখ্য দর্শনের মতে এরূপ আত্মার সংখ্যা বহু। অনন্ত সংখ্য আত্মা রহিয়াছেন।

সাংখ্যের আর একটি সিদ্ধান্ত এই যে ঈশ্বর নাই-জগতের সৃষ্টিকর্তা কেহ নাই। সাংখ্যেরা বলেন, প্রকৃতিই যখন এই সকল বিভিন্ন রূপ সৃষ্টি করিতে সমর্থ, তখন আর ঈশ্বর স্বীকার করিবার প্রয়োজন নাই।

এখন আমাদিগকে সাংখ্যদের এই তিনটি মত খণ্ডন করিতে হইবে। প্রথমটি এই যে, জ্ঞান বা ঐরূপ যাহা কিছু তাহা আত্মার নয়, উহা সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির অধিকারে, আত্মা নির্গুণ ও অরূপ। সাংখ্যের যে দ্বিতীয় মত আমরা খণ্ডন করিব, তাহা এই যে, ঈশ্বর নাই; বেদান্ত দেখাইবেন, ঈশ্বর স্বীকার না করিলে জগতের কোনপ্রকার ব্যাখ্যা হইতে পারে না। তৃতীয়তঃ আমাদিগকে দেখাইতে হইবে যে, বহু আত্মা থাকিতে পারে না, আত্মা অনন্তসংখ্যক হইতে পারে না, জগদ‍্‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍ব্রহ্মাণ্ডে মাত্র এক আত্মা আছেন, এবং সেই একই বহুরূপে প্রতীত হইতেছেন।

আপনি সেই অজ্ঞাত সত্তা ‘ক’-স্বরূপ; আপনি আমার মনের উপর কার্য করিতেছেন, এবং যেদিক হইতে ঐ কার্য হইয়াছিল, তাহার মন একটি তরঙ্গ নিক্ষেপ করে, আর সেই তরঙ্গকেই আমরা ‘অমুক নর’ বা ‘ অমুক নারী’ বলিয়া থাকি।

প্রথমে আমরা সাংখ্যের প্রথম সিদ্ধান্তটি লইয়া আলোচনা করিব যে, বুদ্ধি ও যুক্তি সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির অধিকারে, আত্মাতে ওগুলি নাই। বেদান্ত বলেন, আত্মার স্বরূপ সসীম অর্থাৎ তিনি পূর্ণ সত্তা, জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ। তবর আমাদের সাংখ্যের সহিত এই বিষয়ে একমত যে, তাঁহারা যাহাকে বুদ্ধিজাত জ্ঞান বলেন, তাহা একটি যৌগিক পদার্থমাত্র। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমাদের বিষয়ানুভূতি কিরূপে হয়, সেই ব্যাপারটি আলোচনা করা যাক।

আমাদের স্মরণ আছে যে, চিত্তই বাহিরের বিভিন্ন বস্তুকে লইতেছে, উহারই উপর বহির্বিষয়ের আঘাত আসিয়াছে এবং উহা হইতে প্রতিক্রিয়া হইতেছে। মনে করুন বাহিরে কোন বস্তু রহিয়াছে; আমি একটি বোর্ড দেখিতেছি। উহার জ্ঞান কিরূপে হইতেছে? বোর্ডটির স্বরূপ অজ্ঞাত, আমরা কখনই উহা জানিতে পারি না। জার্মান দার্শনিকেরা উহাকে ‘বস্তুর স্বরূপ’ (Thing of itself) বলিয়া থাকেন।

সেই বোর্ড স্বরূপতঃ যাহা, সেই অজ্ঞেয় সত্তা ‘ক’ আমার চিত্তের উপর কার্য করিতেছে, আর চিত্ত প্রতিক্রিয়া করিতেছে। চিত্ত একটি হ্রদের মতো। যদি হ্রদের উপর আপনি একটি প্রস্তর নিক্ষেপ করেন, যখনই প্রস্তর ঐ হ্রদরে উপর আঘাত করে, তখনই প্রস্তরের দিকে হ্রদের প্রতি-ক্রিয়া-রূপ একটি তরঙ্গ আসিবে। আপনারা বিষয়ানুভূতি-কালে বাস্তবিক এই তরঙ্গটি দেখিয়া থাকেন। আর ঐ তরঙ্গটি মোটেই সেই প্রস্তরটির মতো নয়-উহা একটি তরঙ্গ।

অতএব সেই যথার্থ বোর্ড ‘ক’-ই প্রস্তররূপে মনের উপর আঘাত করিতেছে, আর মন সেই আঘাতকারী পদার্থের দিকে একটি তরঙ্গ নিক্ষেপ করিতেছে। উহার দিকে এই যে তরঙ্গ নিক্ষিপ্ত হইতেছে, তাহাকেই আমরা বোর্ড নামে অভিহিত করিয়া থাকি। আমি আপনাকে দেখিতেছি। আপনি স্বরূপতঃ যাহা, তাহা অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়।

আপনি সেই অজ্ঞাত সত্তা ‘ক’-স্বরূপ; আপনি আমার মনের উপর কার্য করিতেছেন, এবং যেদিক হইতে ঐ কার্য হইয়াছিল, তাহার মন একটি তরঙ্গ নিক্ষেপ করে, আর সেই তরঙ্গকেই আমরা ‘অমুক নর’ বা ‘ অমুক নারী’ বলিয়া থাকি।

এই জ্ঞানক্রিয়ার দুইটি উপাদান-একটি ভিতর হইতে ও অপরটি বাহির হইতে আসিতেছে, আর এই দুইটির মিশ্রণ (ক+মন) আমাদের বাহ্য জগৎ। সমুদয় জ্ঞান প্রতিক্রিয়ার ফল। তিমি মৎস্য সম্বন্ধে গণনা দ্বারা স্থির করা হইয়াছে যে, উহার লেজে আঘাত করিবার কতকক্ষণ পরে উহার মন ঐ লেজের উপর প্রতিক্রিয়া করে এবং ঐ লেজে কষ্ট অনুভব হয়।

শুক্তির কথা ধরুন, একটি বালুকাকণা১ ঐ শুক্তির খোলার ভিতর প্রবেশ করিয়া উহাকে উত্তেজিত করিতে থাকে-তখন ঐ শুক্তি বালুকাকণার চতুর্দিকে নিজ রস প্রক্ষেপ করে-তাহাতেই মুক্তা উৎপন্ন হয়। দুইটি জিনিসে মুক্তা প্রস্তুত হইতেছে। প্রথমতঃ শুক্তির শরীর নিসৃঃত রস, আর দ্বিতীয়তঃ বর্হিদেশ হইতে প্রাপ্ত আঘাত। আমার এই টেবিলটির জ্ঞানও সেইরূপ- ‘ক’+মন। ঐ বস্তুকে জানিবার চেষ্টাটা তো মনই করিবে, আর যখনই আমরা উহা জানিলাম।

তখনই উহা হইয়া দাঁড়াইল একটি যৌগিক পদার্থ ‘ক’+মন। আভ্যন্তরিক অনুভূতি সম্বন্ধে অর্থাৎ যখন আমরা নিজেকে জানিতে ইচ্ছা করি, তখন ঐরূপ ব্যাপার ঘটিয়া থাকে। যথার্থ আত্মা বা আমি, যাহা আমাদের ভিতরে রহিয়াছে, তাহাও আজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। উহাকে ‘খ’ বলা যাক। যখন আমি আমাকে শ্রীঅমুক বলিয়া জানিতে চাই, তখন ঐ ‘খ’ ‘খ+মন’ এইরূপে প্রতীত হয়। যখন আমি আমাকে জানিতে চাই, তখন ঐ ‘খ’ মনের উপর একটি আঘাত করে।

মনও আবার ঐ ‘খ’-এর উপর আঘাত করিয়া থাকে। অতএব আমাদের সমগ্র জগতে জ্ঞানকে ‘ক+মন’(বাহ্যজগৎ) এবং ‘খ+মন’ (অন্তর্জগৎ) রূপে নির্দেশ করা যাইতে পারে। আমরা পরে দেখিব, অদ্বৈতবাদীদের সিদ্ধান্ত কিরূপে গণিতের ন্যায় প্রমাণ করা যাইতে পারে।

‘ক ও খ’ কেবল বীজগণিতের অজ্ঞাত সংখ্যামাত্র। আমরা দেখিয়াছি, সকল জ্ঞানই যৌগিক-বাহ্যজগৎ বা ব্রহ্মান্ডের জ্ঞানও যৌগিক, এবং বুদ্ধি বা অহংজ্ঞানও সেরূপ একটি যৌগিক ব্যাপার। যদি উহা ভিতরের জ্ঞান বা মানসিক অনুভূতি হয়, তবে উহা ‘খ+মন’, আর যদি উহা বাহিরের জ্ঞান বা বিষয়ানুভূতি হয়, তবে উহা ‘ক+মন’। সমুদয় ভিতরের জ্ঞান ‘খ’ এর সহিত মনের সংযোগলব্ধ এবং বাহিরের জড় পদার্থের সমুদয় জ্ঞান ‘ক’ এর সহিত মনের সংযোগের ফল।

প্রথমে ভিতরের ব্যাপারটি গ্রহণ করিলাম। আমরা প্রকৃতিতে যে জ্ঞান দেখিতে পাই, তাহা সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক হইতে পারে না, কারণ জ্ঞান ‘খ’ ও মনের সংযোগলব্ধ, আর ঐ ‘খ’ আত্মা হইতে আসিতেছে। অতএব আমরা যে জ্ঞানের সহিত পরিচিত, তাহা আত্মচৈতন্যের শক্তির সহিত প্রকৃতির সংযোগের ফল। এইরূপে আমরা বাহিরের সত্তা যাহা জানিতেছি, তাহাও অবশ্য মনের সহিত ‘ক’-এর সংযোগে উৎপন্ন। অতএব আমরা দেখিতেছি যে, আমি আছি।

আমি জানিতেছি ও আমি সুখী অর্থাৎ সময়ে সময়ে আমাদের ভাব আসে যে, আমার কোন অভাব নাই-এই তিনটি তত্ত্বে আমাদের জীবনের কেন্দ্রগত ভাব, আমাদের জীবনের মহান্ ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, আর ঐ কেন্দ্র বা ভিত্তি সীমাবিশিষ্ট হইয়া অপর বস্তুসংযোগে যৌগিক ভাব ধারণ করিলে আমরা উহাকে সুখ বা দুঃখ নামে অভিহিত করিয়া থাকি। এই তিনটি তত্ত্বই ব্যাবহারিক সত্তা, ব্যাবহারিক জ্ঞান, ব্যাবহারিক আনন্দ বা প্রেমরুপে প্রকাশিত হইতেছে।

প্রত্যেক ব্যক্তিরই অস্তিত্ব আছে, প্রত্যেককেই জানিতে হইবে প্রত্যেক ব্যক্তিই আনন্দের জন্য হইয়াছে। ইহা অতিক্রম করিবার সাধ্য তাহার নাই। সমগ্র জগতেই এইরূপ। পশুগণ, উদ্ভিদগণ ও নিম্নতম হইতে উচ্চতম সত্তা পর্যন্ত সকলকেই ভালবাসিয়া থকি। আপনারা উহাকে ভালবাসা না বলিতে পারেন, কিন্তু অবশ্যই তাহারা সকলেই জগতে থাকিবে, তাহারা সকলকেই জানিবে এবং সকলকেই ভালবাসিবে।

অতএব এই যে সত্তা আমরা জানিতেছি, তাহা পূর্বোক্ত ‘ক’ ও মনের সংযোগফল, আর আমাদের জ্ঞানও সেই ভিতরের ‘খ’ ও মনের সংযোগফল, আর প্রেমও ঐ ‘খ’ ও মনের সংযোগফল। অতএব এই যে তিনটি বস্তু বা তত্ত্ব ভিতর হইতে আসিয়া বাহিরের বস্তুর সহিত মিশ্রিত হইয়া ব্যাবহারিক সত্তা, ব্যাবহারিক জ্ঞান ও ব্যাবহারিক প্রেমের সৃষ্টি করিতেছে, তাহাদিগকেই বৈদান্তিকেরা নিরপেক্ষ বা পারমার্থিক সত্তা(সৎ), পারমার্থিক জ্ঞান(চিৎ) ও পারমার্থিক আনন্দ বলিয়া থাকেন।

আর ঐ তিনটি একই জিনিস, আমরা এক বস্তুকে তিন বিভিন্ন ভাবে দেখিযা থাকি মাত্র। উহারা সমুদয় সাধারণ জ্ঞানের অতীত, আর তাহাদের প্রতিবিম্বে প্রকৃতিকে চৈতন্যময় বলিয়া বোধ হয়।

সেই পারমার্থিক সত্তা, যাহা অসীম অমিশ্র অযৌগিক, যাহার কোন পরিণাম নাই, তাহাই সেই মুক্ত আত্মা, আর তখন সেই প্রকৃত সত্তা প্রাকৃতিক বস্তুর সহিত মিলিত হইয়া যেন মলিন হইয়া যায়, তাহাকেই আমরা মানব নামে অভিহিত করি। উহা সীমাবদ্ধ হইয়া উদ্ভিদ‍্‍জীবন, পশুজীবন, বা মানবজীবনরূপে প্রকাশিত হয়। যেমন অনন্ত দেশ এই গৃহের দেওয়াল বা অন্য কোনরূপ বেষ্টনের দ্বারা আপাততঃ সীমাবদ্ধ বোধ হয়। সেই পারমার্থিক জ্ঞান বলিতে যে জ্ঞানের বিষয় আমরা জানি, তাহাকে বুঝায় না-বুদ্ধি বা বিচারশক্তি বা সহজাত জ্ঞান কিছুই বুঝায় না, উহা সেই বস্তুকে বুঝায়, যাহা বিভিন্ন আকারে প্রকাশিত হইলে আমরা এই সকল বিভিন্ন নামে অভিহিত করিয়া থাকি। যখন সেই নিরপেক্ষ বা পূর্ণজ্ঞান সীমাবদ্ধ হয়, তখন আমরা উহাকে দিব্য বা প্রতিভ জ্ঞান বলি, যখন আরও অধিক সীমাবদ্ধ হয়, তখন উহাকে যুক্তিবিচার, সহজাত জ্ঞান ইত্যাদি নাম দিয়া থাকি। সেই নিরপেক্ষ জ্ঞানকে বিজ্ঞান বলে। উহাকে ‘সর্বজ্ঞতা’ বলিলে উহার ভাব অনেকটা প্রকাশ হইতে পারে। উহা কোন প্রকার যৌগিক পদার্থ নয়। উহা আত্মার স্বভাব। যখন সেই নিরপেক্ষ আনন্দ সীমাবদ্ধ ভাব ধারণ করে, তখনই উহাকে আমরা ‘প্রেম’ বলি-যাহা স্থূল শরীর, সূক্ষ্মশরীর বা ভাবসমূহের প্রতি আকর্ষণ স্বরূপ। এইগুলি সেই আনন্দের বিকৃত প্রকাশমাত্র আর ঐ আনন্দে আত্মার গুণবিশেষ নয়, উহা আত্মার স্বরূপ-উহার আভ্যন্তরিক প্রকৃতি। নিরপেক্ষ সত্তা, নিরপেক্ষ জ্ঞান, নিরপেক্ষ আনন্দ আত্মার গুণ নয়, উহারা আত্মার স্বরূপ, উহাদের সহিত আত্মার কোন প্রভেদ নাই। আর ঐ তিনটি একই জিনিস, আমরা এক বস্তুকে তিন বিভিন্ন ভাবে দেখিযা থাকি মাত্র। উহারা সমুদয় সাধারণ জ্ঞানের অতীত, আর তাহাদের প্রতিবিম্বে প্রকৃতিকে চৈতন্যময় বলিয়া বোধ হয়।

আত্মার সেই নিত্য নিরপেক্ষ জ্ঞানই মানব মনের মধ্য দিয়া আসিয়া আমাদের বিচার বুদ্ধি হইয়াছে। যে উপাধি বা মাধ্যমের ভিতর দিয়া উহা প্রকাশ পায় তাহার বিভিন্নতা অনুসারে উহার বিভিন্নতা হয়। আত্মা হিসাবে আমাতে এবং অতি ক্ষুদ্রতম প্রাণীতে কোন প্রভেদ নাই, কেবল তাহার মস্তিষ্ক জ্ঞানপ্রকাশের অপেক্ষাকৃত অনুপযোগী যন্ত্র, এজন্য তাহার জ্ঞানকে আমরা সহজাত জ্ঞান বলিয়া থাকি।

মানবের মস্তিষ্ক অতি সূক্ষ্মতর ও জ্ঞানপ্রকাশে উপযোগী, সেজন্য তাহার নিকট জ্ঞানের প্রকাশ স্পষ্টতর, আর উচ্চতম মানবে উহা একখণ্ড কাঁচের ন্যয় সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হইয়া গিয়াছে। অস্তিত্ব বা সত্তা সম্বন্ধেও এইরূপ; আমরা যে অস্তিত্বকে জানি, এই সীমাবদ্ধ ক্ষুদ্র অস্তিত্ব সেই নিরপেক্ষ সত্তার প্রতিবিম্বমাত্র, এই নিরপেক্ষ সত্তাই আত্মার স্বরূপ।

আনন্দ সম্বন্ধেও এইরূপ; যাহাকে আমরা প্রেম বা আকর্ষণ বলি, তাহা সেই আত্মার নিত্য আনন্দের প্রতিবিম্বস্বরূপ, কারণ যেমন ব্যক্তভাব বা প্রকাশ হইতে থাকে, অতি সসীমতা আসিয়া থাকে, কিন্তু আত্মার সেই অব্যক্ত স্বাভাবিক স্বরূপগত সত্তা অসীম ও অনন্ত, সেই আনন্দের সীমা নাই। কিন্তু মানবীয় প্রেমে সীমা আছে। আমি আজ আপনাকে ভালবাসিলাম তারপরদিনই আমি আপনাকে আর ভালবাসিতে নাও পারি।

একদিন আমার ভালবাসা বাড়িয়া উঠিল, তারপরদিন আবার কমিয়া গেল, কারণ উহা একটি সীমাবদ্ধ প্রকাশমাত্র। অতএব কপিলের মতের বিরুদ্ধে এই প্রথম কথা পাইলাম, তিনি আত্মাকে নির্গুণ, অরূপ, নিষ্ক্রিয় পদার্থ বলিয়া কল্পনা করিয়াছেন।

কিন্তু বেদান্ত উপদেশ দিতেছেন-উহা সমুদয় সত্তা, জ্ঞান ও আনন্দের সারস্বরূপ, আমরা যতপ্রকার জ্ঞানের বিষয় জানি, তিনি তাহা হইতে অনন্তগুণে মহত্তর, আমরা মানবীয় প্রেম বা আনন্দের যতদূর পর্যন্ত কল্পনা করিতে পারি, তিনি তাহা হইতে অনন্তগুণে অধিক আনন্দময়, আর তিনি অত্যন্ত সত্তাবান্। আত্মার কখনও মৃত্যু হয় না। আত্মার সম্বন্ধে জন্ম মরণের কথা ভাবিতে পারা যায় না, কারণ তিনি অনন্ত সত্তাস্বরূপ।

কপিলের সহিত আমাদের দ্বিতীয় বিষয়ে মতভেদ-তাহার ঈশ্বর-বিষয়ক ধারণা লইয়া। যেমন ব্যষ্টিবুদ্ধি হইতে আরম্ভ করিয়া ব্যষ্টিশরীর পর্যন্ত এই প্রাকৃতিক সান্ত প্রকাশ-শ্রেণীর পশ্চাতে উহাদের নিয়ন্তা ও স্বরূপ আত্মাকে স্বীকার করা পয়োজন, সমষ্টিতেও-বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডেও সমষ্টি বুদ্ধি, সমষ্টি মন, সমষ্টি সূক্ষ্ম ও স্থূল জড়ের পশ্চাতে তাহাদের নিয়ন্তা ও শাস্তারূপে কে আছেন, আমরা তাঁহাকে এই কথা জিজ্ঞাস করিব।

এই সমষ্টিবুদ্ধ্যাদি শ্রেণীর পশ্চাতে উহাদের নিয়স্তা ও শাস্তাস্বরূপ এক সর্বব্যাপী আত্মা স্বীকার না করিলে ঐ শ্রেণী সম্পূর্ণ হইবে কিরূপে? যদি আমরা অস্বীকার করি, সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডের একজন শাস্তা আছেন-তাহা হইলে ঐ ক্ষুদ্রতর শ্রেণীর পশ্চাতেও একজন আত্মা আছেন, ইহাও অস্বীকার করিতে হইবে; কারণ সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড একই নির্মাণপ্রণালীর পৌনঃপুনিকতা মাত্র।

আমরা একতাল মাটিকে জানিতে পারিলে সকল মৃত্তিকার কথা জানিতে পারিব। যদি আমরা একটি মানবকে বিশ্লেষণ করিতে পারি, তবে সমগ্র জগতকে বিশ্লেষণ করা হইল; কারণ সবই একই নিয়মে নির্মিত অতএব ইহা যদি ইহা সত্য হয় যে, এই ব্যষ্টিশ্রেণীর পশ্চাতে এমন একজন অছেন, যিনি সমুদয় প্রকৃতির অতীত, যিনি পরূষ, যিনি কোন উপাদানে নির্মিত নন, তাহা হইলে ঐ একই যুক্তি সমষ্টি ব্রহ্মাণ্ডের উপরও খাটিবে এবং উহার পশ্চাতেও একটি চৈতন্যকে স্বীকার প্রয়োজন হইবে। যে সর্বব্যাপী চৈতন্য প্রকৃতির সমুদয় বিকারের পশাতে রহিয়াছে, বেদান্ত তাহাকে সকলের নিয়ন্তা ‘ঈশ্বর’ বলেন।

এখন পূর্বোক্ত দুইটি বিষয় অপেক্ষা গুরুতর বিষয় লইয়া সাংখ্যের সহিত আমাদিগকে বিবাদ করিতে হইবে। বেদান্তের মত এই যে, আত্মা একটি মাত্র থাকিতে পারেন। যেহেতু আত্মা কোন প্রকার বস্তু দ্বারা গঠিত নয়, সেই হেতু প্রত্যেক আত্মা অবশ্যই সর্বব্যাপী হইবে-সাংখ্যের এই মত প্রমাণ করিয়া বিবাদের প্রারম্ভেই আমরা উহা দিগকে বেশ ধাক্কা দিতে পারি। যে কোন বস্তু সীমাবদ্ধ, তাহা অপর কিছু দ্বারা সীমিত।

এই টেবিল রহিয়াছে-ইহার অস্তিত্ব অনেক বস্তুর দ্বারা সীমাবদ্ধ, আর সীমাবদ্ধ বস্তু বলিলেই পূর্ব হইতে এমন একটি বস্তুর কল্পনা করিতে হয় যাহা উহাকে সীমাবদ্ধ করিয়াছে। যদি আমরা ‘দেশ’ সম্বন্ধে চিন্তা করিতে যাই, তবে উহাকে একটি ক্ষুদ্র বৃত্তের মত চিন্তা করিতে হয়, কিন্তু তাহারও বাহিরে আরও দেশ রহিয়াছে। আমরা অন্য কোন উপায়ে সীমাবদ্ধ দেশের বিষয় কল্পনা করিতে পারি না। উহাকে কেবল অনন্তের মধ্য দিয়াই বুঝা ও অনুভব করা যাইতে পারে।

সসীমকে অনুভব করিতে হইলে সর্বস্থলেই আমাদিগকে অসীমের উপলব্ধি করিতে হয়। হয় দুইটিই স্বীকার করিতে হয়, নতুবা কোনটিই স্বীকার করা চলে না। যখন আপনারা কাল সম্বন্ধে চিন্তা করেন, তখন আপনাদিগকে নির্দিষ্ট একটি ‘কালের অতীত কাল’ সম্বন্ধেও চিন্তা করিতে হয়। উহাদের একটি সীমাবদ্ধ কাল, আর বৃহত্তরটি অসীম কাল। যখনই আপনারা সসীমকে অনুভব করিবার চেষ্টা করিবেন, তখনই দেখিবেন-উহাকে অসীম হইতে পৃথক করা অসম্ভব।

যদি তাই হয়, তবে আমরা তাহা হইতে প্রমাণ করিব যে, এই আত্মা অসীম ও সর্বব্যাপী। এখন একটি গভীর সমস্যা আসিতেছে। সর্বব্যাপী ও অনন্ত পদার্থ কি দুইটি হইতে পারে? মনে করুন অসীম পদার্থ দুইটি হইল-তাহা হইলে উহাদের মধ্যে একটি অপরটিকে সীমাবদ্ধ করিবে। মনে করুন, ‘ক’ ও ‘খ’ দুইটি অনন্ত বস্তু রহিয়াছে। তাহা হইলে অনন্ত ‘ক’ অনন্ত ‘খ’ কে সীমাবদ্ধ করিবে।

কারণ আপনি ইহা বলিতে পারেন যে অনন্ত ‘ক’ অনন্ত ‘খ’ নয়, আবার অনন্ত ‘খ’ এর সম্বন্ধেও বলা যাইতে পারে যে উহা অনন্ত ‘ক’ নয়। অতএব অনন্ত একটিই থাকিতে পারে। দ্বিতীয়তঃ অনন্তের ভাগ হইতে পারে না। অনন্তকে যত ভাবে ভাগ করা যাক না কেন, তথাপি উহা অনন্ত হইবে, কারণ উহাকে স্বরূপ হইতে পৃথক করা যাইতে পারে না।

মনে করুন, একটি অনন্ত সমুদ্র রহিয়াছে, উহা হইতে আপনি কি এক ফোঁটা জলও লইতে পারেন? যদি পারিতেন, তাহা হইলে সমুদ্র আর অনন্ত থাকিত না, ঐ এক ফোঁটা জলই উহাকে সীমাবদ্ধ করিত। অনন্তকে কোন উপায়ে ভাগ করা যাইতে পারে না।

…………………………………
১ বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতদের মতে বালুকাকণা হইতে মুক্তার উৎপত্তি-এই লোক-প্রচলিত বিশ্বাসটির কোন ভিত্তি নাই। সম্ভবতঃ ক্ষুদ্রকীটাণুবিশেষ (Parasite) হইতে মুক্তার উৎপত্তি।

কিন্তু আত্মা যে এক, ইহা অপেক্ষাও তাহার প্রবলতর প্রমাণ আছে। শুধু তাই নয়, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড যে এক অখণ্ড সত্তা-ইহাও প্রমাণ করা যাইতে পারে। আর একবার আমরা পূর্বকথিত ‘ক’ ও ‘খ’ নামক অজ্ঞাতবস্তুসূচক চিহ্নের সাহায্য গ্রহণ করিব। আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, যাহাকে আমরা বর্হিজগৎ বলি, তাহা ‘ক+মন’, এবং অন্তর্জগৎ ‘খ+মন’। ‘ক’ ও ‘খ’ এই দুইটিই অজ্ঞাত পরিমাণ বস্তু-দুইটি অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়।

এখন দেখা যাক্, মন কি? দেশ, কাল, নিমিত্ত ছাড়া মন আর কিছুই নয়-উহারাই মনের স্বরূপ। আপনারা কাল ব্যতীত কখন চিন্তা করিতে পারেন না, দেশ ব্যতীত কোন বস্তুর ধারণা করিতে পারেন না এবং নিমিত্ত বা কার্য-কারণ-সম্বন্ধ ছাড়িয়া কোন বস্তুর কল্পনা করিতে পারেন না। পূর্বোক্ত ‘ক’ও‘খ’ এই তিনটি ছাঁচে পড়িয়া মন দ্বারা সীমাবদ্ধ হইতেছে। ঐগুলি ব্যতীত মনের স্বরূপ আর কিছুই নয়।

এখন ঐ তিনটি ছাঁচ, যাহাদের নিজস্ব কোন অস্তিত্ব নাই, সেগুলি তুলিয়া লউন। কি অবশিষ্ট থাকে? তখন সবই এক হইয়া যায়। ‘ক’ও‘খ’ এক বলিয়া বোধ হয়। কেবল এই ম–এই ছাঁচই উহাদিগকে আপাতদৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ করিয়াছিল। ‘ক’ও‘খ’ উভয়ই অজ্ঞাত বা অজ্ঞেয়। আমরা উহাদিগের উপর কোন গুণের আরোপ করিতে পারি না। সুতরাং গুণ-বা বিশেষণ-রহিত বলিয়া উভয়ই এক।

যাহা গুণরহিত ও নিরপেক্ষ ও পূর্ণ, তাহা অবশ্যই এক হইবে। নিরপেক্ষ পূর্ণ বস্তু দুইটি হিতে পারে না। সেখানে কোন গুণ নাই, সেখানেই কেবল এক বস্তু থাকিতে পারে। ‘ক’ও‘খ’ উভয়ই নির্গুণ, কারণ উহারা মন হইতেই গুণ পাইতেছে। অতএব এই ‘ক’ও‘খ’ এক।

সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড এক অখণ্ড সত্তামাত্র। জগতে কেবল এক আত্মা, এক সত্তা আছে; আর এক সত্তা যখন দেশ কাল নিমিত্তের ছাঁচের মধ্যে পড়ে, তখনই তাহাকে বুদ্ধি, অহংজ্ঞান, সূক্ষ্ম-ভূত, স্থূল-ভূত প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়। সমুদয় ভৌতিক ও মানসিক আকার বা রূপ, যাহা কিছু এই জগদ‍্‍ব্রহ্মাণ্ডে আছে, তাহা সেই এক বস্তু-কেবল বিভিন্নরূপে প্রতিভাত হইতেছে মাত্র।

যখন উহার একটি অংশ এই দেশ-কাল-নিমিত্তের জালে পড়ে, তখন উহা আকার গ্রহণ করে বলিয়া বোধ হয়; ঐ জাল সরাইয়া দেখুন-সবই এক। এই সমগ্র জগৎ এক অখণ্ডস্বরূপ. আর উহাকেই অদ্বৈত-বেদান্তদর্শনে ‘ব্রহ্ম’ বলে। ব্রহ্ম যখন ব্রহ্মাণ্ডের পশ্চাতে আছেন বলিয়া প্রতীত হয়, তখন তাহাকে ঈশ্বর বলে, আর যখন তিনি এই ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডের পশ্চাতে বিদ্যমান বলিয়া প্রতীত হন, তখন তাঁহাকে ‘আত্মা’ বলে। অতএব এই আত্মাই মানুষের অভ্যন্তরস্থ ঈশ্বর।

একটি মাত্র পুরুষ আছেন-তাহাকে ঈশ্বর বলে, আর যখন ঈশ্বর ও মানবের স্বরূপ বিশ্লেষণ করা হয়, তখন বুঝা যায়-উভয়ই এক। এই ব্রহ্মাণ্ড আপনি স্বয়ং, অবিভক্ত আপনি। আপনি এই সমগ্র জগতের মধ্যে রহিয়াছেন। ‘সকল হস্তে আপনি কাজ করিতেছেন, সকল মুখে আপনি খাইতেছেন, সকল নাসিকায় আপনি শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলিতেছেন, সকল মনে আপনি চিন্তা করিতেছেন।’১

সমগ্র জগৎই আপনি। এই ব্রহ্মাণ্ড আপনার শরীর। আপনি ব্যক্ত ও অব্যক্ত উভয় জগৎ; আপনি জগতের আত্মা, আবার আপনিই উহার শরীর বটে। আপনিই ঈশ্বর, আপনিই দেবতা, আপনিই মানুষ, আপনিই পশু, আপনিই উদ্ভিদ, আপনিই খনিজ, আপনিই সব-সমুদয় ব্যক্ত জগৎ আপনিই। যাহা কিছু আছে সবই ‘আপনি’; যথার্থ ‘আপনি’ যাহা-সেই এক অবিভক্ত আত্মা; যে ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ ব্যক্তি বিশেষকে আপনি আমি বলিয়া মনে করেন, তাহা নয়।

এখন এই প্রশ্ন উঠিতেছে, আপনি অনন্ত পুরুষ হইয়া কিবাবে এইরূপ খণ্ড খণ্ড হইলেন?-কিভাবে শ্রী অমুক, পশুপক্ষী বা অন্যান্য বস্তু হইলেন? ইহার উত্তরঃ এই সমুদয় বিভাগই আপাতপ্রতীয়মান। আমরা জানি অনন্তের কখন বিভাগ হইতে পারে না। অতএব আপনি একটা অংশমাত্র-এ কথা মিথ্যা, উহা কখনই সত্য হইতে পারে না। আর আপনি যে শ্রী অমুক-এ-কথাও কোনকালে সত্য নয়, উহা কেবল সপ্নমাত্র। এটি জানিয়া মুক্ত হউন। ইহাই অদ্বৈতবাদীর সিদ্ধান্ত।

‘আমি মনও নই, দেহও নই, ইন্দ্রিয়ও নই-আমি অখণ্ড সচ্চিদানন্দস্বরূপ। আমি সেই, আমিই সেই।’২

যদি আপনি নিজেকে বদ্ধ বলিয়া ভাবেন তো বদ্ধই থাকিবেন, আপনি নিজেই নিজের বন্ধনের কারণ হইবেন। আর যদি আপনি উপলব্ধি করেন যে আপনি মুক্ত, তবে এই মুহূর্তেই আপনি মুক্ত। ইহাই জ্ঞান-মুক্তির জ্ঞান, এবং মুক্তিই সমুদয় প্রকৃতির চরম লক্ষ্য

ইহাই জ্ঞান এবং ইহা ব্যতীত আর যাহা কিছু সবই অজ্ঞান। যাহা কিছু আছে, সবই অজ্ঞান-অজ্ঞানের ফলস্বরূপ। আমি আবার কি জ্ঞান লাভ করিব? আমি স্বয়ং জ্ঞানস্বরূপ। আমি আবার জীবন লাভ করিব কি? আমি স্বয়ং প্রাণস্বরূপ। জীবন আমার স্বরূপের গৌণ বিকাশমাত্র। আমি নিশ্চয়ই জানি যে, আমি জীবিত, তাহার কারণ আমিই জীবনস্বরূপ সেই এক পুরুষ। এমন কোন বস্তু নাই, যাহা আমার মধ্য দিয়া প্রকাশিত নয়, যাহা আমাতে নাই এবং যাহা আমার স্বরূপে অবস্থিত নয়।

আমিই পঞ্চভূত-রূপে প্রকাশিত; কিন্তু আমি এক ও মুক্তস্বরূপ। কে মুক্তি চায়? কেহই মুক্তি চায় না। যদি আপনি নিজেকে বদ্ধ বলিয়া ভাবেন তো বদ্ধই থাকিবেন, আপনি নিজেই নিজের বন্ধনের কারণ হইবেন। আর যদি আপনি উপলব্ধি করেন যে আপনি মুক্ত, তবে এই মুহূর্তেই আপনি মুক্ত। ইহাই জ্ঞান-মুক্তির জ্ঞান, এবং মুক্তিই সমুদয় প্রকৃতির চরম লক্ষ্য।

…………………………………
১ গীতা, ১৩।১৩ ২ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে। ন চ ব্যোমভূমি র্ন বায়ু শ্চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্ ।।
-নির্বাণষটকম্, শংকরাচার্য

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!