-স্বামী বিবেকানন্দ
‘ভক্তমাল’ নামক একখানা ভারতীয় গ্রন্থ হইতে এই কাহিনীটি গৃহীত। এক গ্রামে জনৈক ব্রাহ্মণ যুবক বাস করিত। অন্য গ্রামের এক দুশ্চরিত্রা নারীর প্রতি সে প্রণয়াসক্ত হয়। গ্রাম দুইটির মধ্যে একটি বড় নদী ছিল। প্রত্যহ খেয়া-নৌকায় নদী পার হইয়া যুবক তাহার নিকট যাইত। একদিন যুবককে পিতৃশ্রাদ্ধাদির কার্যে নিযুক্ত থাকিতে হয়; এজন্য ঐকান্তিক ব্যাকুলতা সত্ত্বেও সেদিন সে মেয়েটির কাছে যাইতে পারিল না।
হিন্দুসমাজের এই অবশ্য করণীয় অনুষ্ঠান তাহাকে সম্পন্ন করিতে হইয়াছিল। যুবক ছটফট করিতে থাকিলেও তাহার কোন উপায় ছিল না। অনুষ্ঠান শেষ করিতে রাত্রি হইয়া গেল।
তখন ভীষণ গর্জন করিয়া ঝড় উঠিয়াছে। বৃষ্টি নামিল, প্রচণ্ড তরঙ্গাঘাতে নদী বিক্ষুব্ধ হইল। নদী পার হওয়া বিপজ্জনক, তথাপি যুবক নদীতীরে উপস্থিত হইল। খেয়াঘাটে নৌকা নাই; এ দুর্যোগে মাঝিরা নদী পার হইতে ভয় পায়। যুবক কিন্তু যাইবার জন্য অস্থির; মেয়েটির প্রেমে সে পাগল; তাহাকে যাইতেই হইবে। একখণ্ড কাঠ ভাসিয়া আসিতেছিল, তাই ধরিয়া সে নদী পার হইল। অপর তীরে পৌঁছিয়া কাষ্ঠখণ্ডটি টানিয়া উপরে উঠাইল এবং প্রণয়িনীর গৃহদ্বারে উপস্থিত হইল।
গৃহদ্বার বন্ধ; যুবক দ্বারে করাঘাত করিলেও ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে কেহই তাহা শুনিতে পাইল না। সুতরাং সে গৃহপ্রাচীরের চতুর্দিক্ ঘুরিয়া ঘুরিয়া অবশেষে যাহা দেখিতে পাইল, সেটিকেই প্রাচীর-লম্বিত রজ্জু বলিয়া মনে করিল।
‘অহো! প্রিয়া আমার আরোহণের জন্য রজ্জু রাখিয়া দিয়াছে!’-মনে মনে এই বলিয়া যুবক সযত্নে সেটিকে ধরিল। সেই রজ্জুর সাহায্যে সে প্রাচীরে আরোহণ করিল এবং অপর দিকে পৌঁছিয়া পা ফসকাইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। একটা শব্দ শুনিয়া গৃহবাসিগণ জাগিয়া উঠিল। ঘরের বাহিরে আসিয়া মেয়েটি যুবককে মূর্ছিত অবস্থায় দেখিতে পাইল এবং তাহার চৈতন্য সম্পাদন করিল। যুবকের দেহ হইতে একটা উৎকট দুর্গন্ধ পাইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ব্যাপার কি?
তোমার গায়ে এমন দুর্গন্ধ কেন? কি করে আঙিনার ভেতরে এলে?’ যুবক উত্তর করিল, ‘কেন, আমার প্রেমিকা কি প্রাচীরে একটা দড়ি ঝুলিয়ে রাখেনি?’ স্ত্রীলোকটি হাসিয়া বলিল, ‘প্রেমিকা আবার কে? অর্থোপার্জনই আমাদের উদ্দেশ্য। তুমি কি মনে কর, তোমার জন্য আমি দড়ি ঝুলিয়ে রেখেছিলাম? কি উপায়ে তুমি নদী পার হলে? ‘কেন, একটি কাষ্ঠখণ্ড ধরেছিলাম।’ মেয়েটি বলিল, ‘চল, একবার দেখে আসি।’
যে রজ্জুর কথা বলা হইয়াছে, উহা ছিল একটা বিষধর গোখুরা সাপ, তাহার সামান্য স্পর্শেই মৃত্যু নিশ্চিত। সাপটার মাথা ছিল একটা গর্তের মধ্যে। সাপের গর্তে প্রবেশ করার সময় যুবক দড়ি মনে করিয়া তাহার লেজটা ধরিয়াছিল। প্রেমে পাগল হইয়াই সে এই কাজ করিয়াছিল। সাপের মুখ গর্তের মধ্যে এবং দেহ বাহিরে থাকিলে যদি কেহ তাহার লেজ ধরে, তবে সাপ তাহার মুখ গর্তের বাহিরে আনে না। এইজন্যই যুবক লেজ ধরিয়া প্রাচীর আরোহণ করিতে পারিয়াছিল। কিন্তু যুবক খুব জোরের সহিত লেজ টানিতে থাকায় সাপটির মৃত্যু ঘটিয়াছিল।
স্ত্রীলোকটি জিজ্ঞাসা করিল, ‘কাষ্ঠখণ্ডটি কোথায় পেলে?’ উত্তর হইল, ‘কেন, নদীতে ভেসে আসছিল।’ বস্তুতঃ উহা ছিল একটি গলিত শব; নদীস্রোতে ভাসিয়া যাইবার সময় কাষ্ঠখণ্ড মনে করিয়া যুবক উহা ধরিয়াছিল। এখন বুঝা গেল, তাহার দেহে কেন ঐ দুর্গন্ধ। মেয়েটি যুবকের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘প্রেমে আমার কখনও বিশ্বাস ছিল না; আমরা কখনও প্রেমে বিশ্বাস করি না। কিন্তু এ যদি প্রেম না হয়, তবে-ভগবান্ রক্ষা করুন!
প্রেম কি তা আমরা জানি না; কিন্তু বন্ধু! আমার মত একজন নারীকে তুমি হৃদয় দান করিলে কেন? কেন তোমার হৃদয় ভগবানকে উৎসর্গ করলে না? এরূপ করলে তুমি সিদ্ধিলাভ করবে।’-এই কথায় যুবকের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল! ক্ষণিকের জন্য তাহার অন্তর্দৃষ্টি খুলিয়া গেল। ‘ভগবান্ কি আছেন?’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বন্ধু, আছেন বৈ কি!’
যুবক সেই স্থান ত্যাগ করিল, এবং চলিতে চলিতে এক অরণ্যে প্রবেশ করিয়া সেখানে সাশ্রুনয়নে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিল, ‘প্রভু, আমি তোমাকে চাই। আমার এ প্রেম-প্রবাহ ক্ষুদ্র মানব-হৃদয়ে ধরে না। আমি সেই প্রেমের সাগরকে ভালবাসিতে চাই, যেখানে আমার প্রেমের এই প্রবল প্রবাহিণী গিয়া মিশিতে পারে; আমার প্রেমের এই বেগবতী নদী তো আর ক্ষুদ্র জলাশয়ে প্রবেশ করিতে পারে না, ইহা চায় অনন্ত সাগর। প্রভু, তুমি যেখানেই থাক, আমার কাছে এস।’
সন্নাসী সেই কাঁটা দুটি নিজের দুই চোখে সজোরে বিঁধিয়া দিয়া বলিলেন, ‘দূর হ, দুর্বৃত্ত নয়ন-যুগল। এখন থেকে তোরা আর সম্ভোগ করতে পারবি না। যদি দেখতেই চাস, তবে অন্তশ্চক্ষু দিয়ে দেখ্-সে ব্রজের রাখালকে। এখন অন্তশ্চক্ষুই তোর সর্বস্ব।’
এইভাবে বহু বৎসর বনে কাটাইয়া তাহার মনে হইল, সে সিদ্ধিলাভ করিয়াছে। সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া সে শহরে আসিল। একদিন সে নদীতীরে একটি স্নানের ঘাটে বসিয়াছিল, এমন সময় ঐ শহরের এক বণিকের সুন্দরী যুবতী পত্নী পরিচারিকা-সহ সেই স্থান দিয়া চলিয়া গেল। বৃদ্ধের সেই পুরাতন ভাবটি আবার জাগিয়া উঠিল, সুন্দরীর সুন্দর মুখখানি তাহাকে আবার আকর্ষণ করিল। যোগী নির্নিমেষ নয়নে তাহার দিকে চাহিয়া দাঁড়াইল এবং যুবতীকে তাহার গৃহ পর্যন্ত অনুসরণ করিল।
মুহূর্তমধ্যে যুবতীর স্বামী আসিয়া উপস্থিত হইল এবং গৈরিকধারী সন্ন্যাসীকে দেখিয়া বলিল, ‘মহারাজ, ভেতরে আসুন। আমি আপনার জন্য কি করিতে পারি?’ যোগী উত্তর করিলেন, ‘আমি আপনার নিকট একটি ভয়ানক বস্তুর প্রার্থী?’ ‘মহারাজ, যে-কোন বস্তু চাইতে পারেন, আমি গৃহস্থ; যে যা চায়, আমি তাকে তাই দিতে প্রস্তুত।’ সন্ন্যাসী বলিলেন, ‘আমি আপনার পত্নীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।’ গৃহস্থ বলিল, ‘হা ভগবান্ এ কি! আমি তো পবিত্র, আমার স্ত্রীও পবিত্র; প্রভু সকলের রক্ষক।
মহারাজ, স্বাগতম্, ভেতরে আসুন।’ সন্ন্যাসী ভিতরে আসিতেই গৃহস্বামী স্ত্রীর নিকট তাঁহার পরিচয় দিল। স্ত্রী জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?’ সন্ন্যাসী তাহার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘মা, আপনার চুল থেকে দুটো কাঁটা আমাকে দেবেন কি?’ ‘এই নিন্।’ সন্নাসী সেই কাঁটা দুটি নিজের দুই চোখে সজোরে বিঁধিয়া দিয়া বলিলেন, ‘দূর হ, দুর্বৃত্ত নয়ন-যুগল। এখন থেকে তোরা আর সম্ভোগ করতে পারবি না। যদি দেখতেই চাস, তবে অন্তশ্চক্ষু দিয়ে দেখ্-সে ব্রজের রাখালকে। এখন অন্তশ্চক্ষুই তোর সর্বস্ব।’
তিনি প্রেমবিষয়ক কয়েকটি মনোরম কবিতা লিখিয়াছেন। সকল সংস্কৃত গ্রন্থেই লেখকেরা প্রথমে গুরুবন্দনা করেন। তাই বিল্বমঙ্গল সেই নারীকেই তাঁহার প্রথম গুরু বলিয়া বন্দনা করিয়াছেন।
এইভাবে সন্ন্যাসী পুনরায় বনে ফিরিয়া গেলেন এবং আবার দিনের পর দিন ভগবানের কাছে কাঁদিতে লাগিলেন। তাঁহার মধ্যে প্রেমের যে উদ্দাম প্রবাহ বহিতেছিল, তাহাই সত্যলাভের জন্য সংগ্রাম করিতে লাগিল; পরিশেষে তিনি সিদ্ধি- লাভ করিলেন। তাঁহার হৃদয়রূপ প্রেম-প্রবাহিণীর গতি ঠিক পথে পরিচালিত হইয়া তাঁহাকে রাখালরাজের নিকট পৌঁছাইয়া দিল।
কাহিনীতে এইরূপ বর্ণিত আছে, কৃষ্ণরূপে ভগবান্ তাঁহাকে দর্শন দিয়াছিলেন। পরে একবার মাত্র তাঁহার অনুতাপ আসিয়াছিল যে, তিনি চক্ষু হারাইয়া-কেবল অন্তর্দৃষ্টিই লাভ করিতে পারিয়াছিলেন। তিনি প্রেমবিষয়ক কয়েকটি মনোরম কবিতা লিখিয়াছেন। সকল সংস্কৃত গ্রন্থেই লেখকেরা প্রথমে গুরুবন্দনা করেন। তাই বিল্বমঙ্গল সেই নারীকেই তাঁহার প্রথম গুরু বলিয়া বন্দনা করিয়াছেন।