ভবঘুরেকথা
শ্রীকৃষ্ণ গোপাল কালা

-স্বামী বিবেকানন্দ

একদিন শীতের অপরাহ্নে-পাঠশালায় যাবার জন্য প্রস্তুত হতে হতে গোপাল নামে একটি ব্রাহ্মণ-বালক তার মাকে ডেকে বলল, ‘মা, বনের পথ দিয়ে একা একা পাঠশালায় যেতে আমার বড় ভয় করে। অন্য সব ছেলেদের সঙ্গে হয় চাকর না-হয় আর কেউ আসে। পাঠশালায় পৌঁছে দেবার জন্যও আসে, আবার বাড়ী নিয়ে যেতেও আসে। আমায় কেন কেউ সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে আসে না, মা?’

একটি গ্রাম্য-পাঠশালার ছাত্র গোপাল। সকালে-বিকালে তার পাঠশালা বসত। বিকালের ছুটির পর, শীতের দিনে, বাড়ি আসতে আসতে পথেই সন্ধ্যা হয়ে যেত। তাছাড়া পাঠশালার পথটিও নিবিড় বনের মধ্য দিয়ে একেবেঁকে গিয়েছে। কাজেই অন্ধকারে একলাটি ঐ পথে আসতে গোপালের ভয় করত।

গোপালের মা বিধবা। শৈশবেই তার পিতার মৃত্যু হয়েছিল। নিষ্ঠাবান্‌ ব্রাহ্মণের মত অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, যজন-যাজন নিয়েই গোপালের বাবার দিন কাটত, সংসারের সুখ-সমৃদ্ধির দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল না। আবার তাঁর মৃত্যুর পর দুঃখিনী বিধবা তার মা যেন বিষয়-ব্যাপার থেকে আরও দূরে সরে গিয়েছিলেন, যদিও সে-সবের সঙ্গে যোগাযোগ কোনদিনই তাঁর বেশী ছিল না।

তখন ভগবানের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে, নিষ্ঠার সঙ্গে ধ্যান-উপাসনা, যম-নিয়ম প্রভৃতি পালন করে চরম-মুক্তিদাতা যে মৃত্যু, তারই জন্য ধৈর্য সহকারে তিনি অপেক্ষা করছিলেন। অন্তরে আশা ছিল-মৃত্যুর পরপারে, অন্তহীন জীবনের পথে, যিনি তাঁর ভাল-মন্দের সাথী, সুখ-দুঃখের অংশভাগী সেই দয়িতের সঙ্গে আবার মিলিত হবেন। …

নিজের একটি পর্ণকুটিরেই তিনি বাস করতেন। তাঁর স্বামী যখন বেঁচে ছিলেন, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত হিসাবে একখণ্ড ধানজমি কেউ তাঁকে দান করেছিল। সে-জমিতে যে ধান উৎপন্ন হতে-বিধবার প্রয়োজনের পক্ষে তাই ছিল যথেষ্ট। এ-ছাড়া, কুটিরটিকে ঘিরে আরও কিছু জমি ছিল। সেখানে বাঁশ-ঝাড় ছিল, কয়েকটি নারিকেল গাছ ছিল, আর ছিল দু-চারটি আম ও লিচুর চারা। গ্রামবাসীদের সাহায্যে সেগুলি থেকেও প্রচুর ফলমূল পাওয়া যেত। এরও উপর আর যা লাগত, তার জন্য প্রতিদিন অনেকটা সময় তিনি চরকায় সুতা কাটতেন। …

সে প্রার্থনার ফলে তাঁর অন্তরে এক বিচিত্র আনন্দানুভূতি জেগে উঠত। মনে হতে তিনি যেন নিজস্বামীর সহিত একত্র হয়ে ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হবার বাঞ্ছিত পথে আরও একটি দিন এগিয় গেলেন।

প্রভাতের প্রথম স্বর্ণ-কিরণ তালগাছের চূড়ায় চূড়ায় প্রতিফলিত হবার বহুপূর্বে তিনি ঘুম থেকে উঠতেন। তখনও প্রভাতী পাখির কল-কাকলি শুরু হতে না। একটি সামান্য মাদুর আর তার উপর বিছানো একখানা কম্বল-এই ছিল তাঁর শয্যা। সেই দীন শয্যাটিতে বসে অতি প্রত্যূষ থেকে তিনি নামগান আরম্ভ করতেন। পুণ্যশ্লোকা নারীদের পূত চরিতকথা কীর্তন করতেন, ঋষিদের প্রণাম জানাতেন, আর জপ করতেন। জপ করতেন মানুষের পরমাশ্রয় নারায়ণের নাম, করুণাময় মহাদেবের নাম, আর জগত্তারিণী তারাদেবীর নাম।

সর্বোপরি অন্তরের সর্ব-আকৃতি নিবেদন করতেন প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তর দেবতা-শ্রীকৃষ্ণের কাছে, যিনি করুণায় বিগলিত হয়ে মানুষের শিক্ষার জন্য, ত্রাণের জন্য বাল-গোপালমূর্তিতে মর্ত্যধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সে প্রার্থনার ফলে তাঁর অন্তরে এক বিচিত্র আনন্দানুভূতি জেগে উঠত। মনে হতে তিনি যেন নিজস্বামীর সহিত একত্র হয়ে ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হবার বাঞ্ছিত পথে আরও একটি দিন এগিয় গেলেন।

কুটিরের অনতিদূরে ছিল একটি নদী। দিবারম্ভের পূর্বেই সেই নদীতে তাঁর স্নান হয়ে যেত। স্নানকালে তাঁর প্রার্থনা ছিল-‘হে দেবতা, নদীর নির্মলজলে স্নান করে দেহটি আমার যেমন পবিত্র হল-স্নিগ্ধ হল, তোমার করুণায় আমার অন্তরটিও যেন তেমনি পবিত্র-তেমনি স্নিগ্ধ হয়ে যায়।’

তারপর সদ্যোধৌত শুদ্ধ একটি শ্বেতবস্ত্র পরিধান করে তিনি পুষ্প-চয়ন করতেন, সুগন্ধ চন্দন প্রস্তুত করতেন বৃত্তাকৃতি চন্দন-পাটায়, এবং তুলসীপত্র আহরণ করে পূজার উদ্দেশ্যে ছোট ঠাকুরঘরটিতে প্রবেশ করতেন। সে ঘরে তাঁর বাল-গোপাল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত ছিল। একটি রেশমী চন্দ্রাতপের নীচে, সুদৃশ্য দারু-নির্মিত সিংহাসনে, ভেলভেটের কোমল গদির উপরে, প্রায় পুষ্পাবৃত অবস্থায় থাকত শ্রীকৃষ্ণের সে ধাতুনির্মিত বাল-গোপাল মূর্তিটি।

মায়ের প্রাণ শ্রীভগবানকে পুত্ররূপে কল্পনা করেই শুধু তৃপ্তিলাভ করত। তাঁর স্বামী জীবিতকালে কতদিন কতবার বেদোক্ত সেই নিরাকার, নিরবয়ব, নৈর্ব্যক্তিক দেবতার বর্ণনা তাঁকে শুনিয়েছেন। সর্ব-অন্তর দিয়ে সে-সব অনবদ্য কাহিনী তিনি শ্রবণ করতেন, অকুণ্ঠচিত্তে ধ্রুব সত্য বলে সেগুলি বিশ্বাস করতেন। কিন্তু হায়! শিক্ষাহীন ও শক্তিহীন এক নারীর পক্ষে সে বিরাটকে ধারণা করা কিরূপে সম্ভব? তাছাড়া শাস্ত্রে তো এ-কথাও লিপিবদ্ধ রয়েছে-যে যে-ভাবে আমাকে ভজনা করে, সে সে-ভাবেই আমাকে লাভ করে থাকে। মানুষ যুগে যুগে আমারই প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে থাকে।-

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ॥

এবং ঐ ভাবটিতেই তাঁর অন্তর ভরে যেত, অতিরিক্ত আর কিছু প্রার্থনীয় ছিল না।

এইভাবেই কাটছিল তাঁর জীবন। হৃদয়ের সকল ভক্তি, বিশ্বাস ও প্রেম বাল-গোপাল শ্রীকৃষ্ণে তিনি সমর্পণ করেছিলেন এবং সে সমর্পণটি বিশেষভাবে তাঁর ক্ষুদ্র ধাতু-বিগ্রহটিকে ঘিরেই নিয়ত লুতাতন্তুর মত আবর্তিত হত। তাছাড়া ভগবানের এ-বাণীটিও তার শোনা ছিল-

‘রক্তমাংসের তৈরী মানুষকে তুমি যেমন সেবা কর, আমাকেও তেমনি প্রেম পবিত্রতা দিয়ে সেবা কর। আমি সেই সেবা গ্রহণ করব।’

সুতরাং সেবাই তিনি করতেন; যে-ভাবে নিজ প্রভুকে মানুষ সেবা করে, যে-ভাবে সেবা করে গুরুকে, সর্বোপরি তাঁর নয়নের নিধি পুত্রকে, একমাত্র সন্তানকে তিনি যেভাবে সেবা করতেন-শ্রীকৃষ্ণকেও তেমনিভাবেই সেবা করতেন। প্রতিদিন ধাতুমূর্তিটিকে তিনি স্নান করাতেন, সাজাতেন, ধূপধুনা দিতেন তাঁর সামনে। কিন্তু ভোগ বা নৈবেদ্য? হায়, দরিদ্র বিধবার সে সামর্থ্য কোথায়? দুঃখে তাঁর চোখে জল আসত, আর সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করতেন স্বামীর কাছে শোনা সেই শাস্ত্রবচন, ভগবানের সেই অভয়-উক্তি-পত্র, পুষ্প, ফল, জল,-ভক্তির সঙ্গে যে আমাকে যা-কিছু দান করে, আমি তাই গ্রহণ করে থাকি।-

পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্নামি প্রযতাত্মনঃ॥

সুতরাং তাঁর প্রার্থনা ছিল এই মন্ত্রেঃ হে দেবতা, এই বিপুলা পৃথিবীতে কত বিচিত্র কুসুম তোমারই প্রীতির জন্য নিয়ত ফুটে উঠেছে, তবু আমার তুচ্ছ বনফুল ক-টি গ্রহণ কর। তুমি বিশাল বিশ্বের অন্নদাতা, তথাপি আমার সামান্য ফলের নৈবেদ্য গ্রহণ কর। আমি শক্তিহীন, শিক্ষাহীন। তুমিই আমার দেবতা, আমার প্রাণের রাখাল, আমার পুত্র। তুমি কৃপা করে আমার পূজা-অর্চনা সার্থক কর, আমার প্রেম কামনাহীন কর। …

পূজার ফল বলে যদি কিছু থাকে, তবে সে ফলও তুমিই গ্রহণ কর। আমাকে দাও প্রেম, শুধু প্রেম-যে-প্রেম অন্য কোন প্রতিদানের প্রত্যাশা রাখে না, প্রেম ভিন্ন আর কিছু আকাঙ্ক্ষা করে না।

হয়তো আকস্মাৎ কোনদিন গ্রামের বাউল-বৈরাগী মায়ের ক্ষুদ্র আঙিনাটিতে এসে দাঁড়ায় এবং প্রভাতী সুরে গান ধরে-

শোনরে মানুষ ভাই,
প্রেমের কথা কয়ে যাই
(আমি) জ্ঞানের ডাকে ভয় করিনে-
প্রেমের ডাকে করি ভয়,
আমার আসন কাঁপে
প্রেমের ডাকে,
প্রেমাশ্রুতে হই উদয়।

নিত্যমুক্ত যেই ভগবান্
নিরবয়ব ব্রহ্ম যেই,
প্রেমের দায়ে নররূপে
তারি খেলা দেখতে পাই;
তারি লীলা জানতে পাই।

বৃন্দাবনের কুঞ্জছায়ে
জ্ঞানের কিবা প্রকাশ ছিল?
রাখাল-বালক গোপ-বালিকা
শাস্ত্র কবে পড়েছিল?
কিন্তু তারা প্রেমিক ছিল,
ছিল ভালবাসায় ভরা,
তাইতো তাদের প্রেমের পাশে
আমি চির রইনু ধরা।

এমনি করে তাঁর মাতৃহৃদয় যেন ভাগবত সত্তার মধ্যেই নিজের পুত্রটিকে লাভ করেছিল এবং দেব-গোপালের নামানুসারে পুত্রের নামও তিনি রেখেছিলেন-গোপাল। তাকে অবলম্বন করেই এ-জগতের বুকে নিজের মনটিকে ধরে রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। নতুবা পার্থিব-বন্ধনহীন তাঁর মন মুহুর্মুহুঃ জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধ্বে ধাবিত হত। এ মাটির পৃথিবীতে তাঁর যে প্রাত্যহিক জীবন, তা ছিল যেন অনেকটা কলের মত, নিষ্প্রাণ যন্ত্রের মত। বস্তুতঃ তাঁর চলাফেরা, তাঁর চিন্তা সুখ, এক কথায় তাঁর সমগ্র জীবনটুকু কি ঐ ক্ষুদ্র বালকটিকে ঘিরেই আবর্তিত ছিল না? হ্যাঁ, তাই ছিল।

বৎসরের পর বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে, আর তিনি তাঁর মাতৃহৃদয়ের সকল কোমলতা দিয়ে ঐ শিশুর জীবনের ক্রমবিকাশ লক্ষ্য করেছেন। আজ সে পাঠশালায় যাবার মত বড় হয়েছে, পাঠশালায় সে যাবে। তাই ছাত্রজীবনের প্রয়োজনীয় জিনিষগুলো সংগ্রহ করবার জন্য মার কত দীর্ঘদিনব্যাপী কঠোর পরিশ্রম!

প্রয়োজন অবশ্য খুব বেশী ছিল না। যে-দেশে মাটির প্রদীপে একছটাক তেল ঢেলে আর একটা কাপড়ের সলতে লাগিয়ে আলো জ্বেলে প্রফুল্ল চিত্তে মানুষ বিদ্যাচর্চায় দিন কাটায়, যেখানে ঘাসের তৈরী একটি মাদুর ভিন্ন আর কোন আসবাব-পত্রেরই প্রয়োজন হয় না, সে-দেশের ছাত্রজীবনের প্রয়োজন খুব বেশী হবার কথাও নয়। তবু সামান্য যে দু-চারটি জিনিষের প্রয়োজন ছিল, তা সংগ্রহ করতেই দরিদ্র বিধবাকে বহুদিন পরিশ্রম করতে হয়েছিল।

দিনের পর দিন চরকায় সূতা কেটে গোপালের জন্য একখানা পরবার কাপড় এবং একখানা গায়ে দেবার চাদর তাঁকে সংগ্রহ করতে হয়েছিল। সংগ্রহ করতে হয়েছিল মাদুর-জাতীয় ছোট একটি আসন, যার উপর দোয়াত, খাগের কলম প্রভৃতি রেখে গোপাল লিখবে এবং পরে যেটিকে গুটিয়ে বগলদাবা করে পাঠশালায় যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে যাবে, আর ফিরবার সময় সঙ্গে নিয়ে আসবে।

তারপর যে-শুভদিনটিতে গোপালের বিদ্যারম্ভ হল, সে প্রথম অ, আ, লিখতে চেষ্টা করল-সে-দিনটি দুঃখিনী মায়ের কাছে যে কী আনন্দের দিন ছিল, তা মা ভিন্ন অন্যের পক্ষে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আজ? আজ তাঁর মনে একটি গভীর বিষাদের ছায়া পড়েছে। বনপথ দিয়ে একা যেতে-আসতে গোপাল ভয় পাচ্ছে, কে তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে? এর আগে কোনদিন নিজের বৈধব্যের নিঃসঙ্গতা ও দারিদ্র্য এমন করে তিনি ভাবেননি, অনুভব করেননি। মুহূর্তের জন্য চতুর্দিক্‌ যেন অন্ধকারে ঢেকে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে পড়ল ভগবানের সেই চিরন্তন আশ্বাসবাণী-

অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্॥

একান্তভাবে-অনন্যচিন্ত হয়ে যে ব্যক্তি আমার উপর নির্ভর করে, আমি তার সকল ভার স্বয়ং বহন করে থাকি।

আর তাঁর বিশ্বাসী মন ঐ আশ্বাস-বাণীতেই একটি আশ্রয় খুঁজে পেল। …

তারপর চোখের জল মুছে ছেলেকে বললেন, ‘ভয় কি বাবা! ঐ বনে আমার আর একটি ছেলে থাকে, তারও নাম গোপাল। সে তোমার বড় ভাই। বনভূমির অন্ধকার পথে যখন তুমি ভয় পাবে, তখন তোমার দাদাকে ডেক।’

বিশ্বাসী মায়ের পুত্র গোপাল। সেও তাই সকল অন্তর দিয়েই মার কথা বিশ্বাস করল। …

তারপর সেদিন অপরাহ্ণে-পাঠশালা থেকে ফেরার পথে অরণ্যভূমির নিবিড়তায় ভয় পেয়েই মায়ের নির্দেশ অনুসারে বালক তার বনের ভাইটিকে ডাক দিল-‘গোপাল-দাদা, তুমি কি এখানে আছ? মা বলেছেন, তুমি এই বনে থাক; বলেছেন, তোমাকে ডাকতে। একলাটি আমার বড় ভয় করছে, ভাই!’

তখন দূর বনান্তরাল থেকে শব্দ ভেসে এল-‘ভয় নেই ভাই, এই তো আমি রয়েছি। ভয় কিসের, তুমি বাড়ি যাও।’

সেদিন থেকে, এমনি করে দিনের পর দিন গোপাল তার বনের দাদাকে ডাকে, আর একই স্বর শুনতে পায়। বাড়ি এসে মাকে সে-সব কথা সে বলে, আর মা বিস্ময়ে প্রেমে মুগ্ধ হয়ে শোনেন সে কাহিনী। তারপর একদিন মা তাকে বললেন-‘বাবা, এরপর যখন তোমার রাখাল দাদার সঙ্গে দেখা হবে, তখন তাকে বল সে যেন তোমাকে দেখা দেয়।’ …

পরদিন যথাকালে বনপথে যাবার সময় গোপাল তার ভাইকে ডাক দিল এবং পূর্বের মত উত্তরও এল বন থেকে। কিন্তু এবার মার কথামত গোপাল তার দাদাকে দেখা দেবার জন্য একান্ত অনুরোধ করল। বলল, ‘গোপাল দাদা, তোমাকে তো কোনদিন আমি দেখিনি। আজ আমাকে দেখা দাও।’

তখন উত্তর শোনা গেল, ‘ভাই, এখন বড় ব্যস্ত আছি। আজ আমি আসতে পারব না।’ কিন্তু গোপাল ছাড়বে না, সে বার বার কাতরভাবে অনুরোধ করতে লাগল। তখন অকস্মাৎ বনের ছায়াচ্ছন্ন প্রদেশ থেকে বেরিয়ে এল বনের রাখাল। পরনে গোপালকের বেশ, মাথায় ছোট্ট মুকুট-তাতে বসানো শিখিপুচ্ছ, হাতে বাঁশের বাঁশী।

দুইটি বালকই তখন মহাখুশী। একসঙ্গে তারা খেলা করল, গাছে উঠল, ফল কুড়াল, ফুল কুড়াল-বনের গোপাল আর দুঃখিনী মায়ের গোপাল-দু-টি ভাই। খেলতে খেলতে পাঠশালার সময় প্রায় উত্তীর্ণ হয়ে এল এবং গোপাল একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও পাঠশালার পথে চলে গেল।

সেদিন তার পাঠ প্রায় ভুল হয়ে গেছে। সমগ্র অন্তর উৎসুক হয়ে রয়েছে কেবল বনে ফিরে রাখাল দাদার সঙ্গে আবার খেলা করবার প্রবল আকাঙ্ক্ষায়। …

এইভাবে কয়েকমাস সময় কেটে গেল। দিনের পর দিন সন্তানের বিচিত্র কাহিনী শুনতেন মা, আর ভগবানের অপার করুণার কথা চিন্তা করে নিজের দৈন্য বৈধব্য প্রভৃতি সব কিছু ভুলে যেতেন। দুঃখকে মনে মনে গ্রহণ করতেন ভগবানের অনন্ত আশীর্বাদ বলে।

এরপর পাঠশালার গুরুমশায়ের গৃহে একটি শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠানের দিন এল। সে-কালে গ্রাম্য-পাঠশালার পণ্ডিতগণ একাই অনেকগুলি ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতেন। নির্ধারিত বেতন হিসাবেও তাঁরা বিশেষ কিছু গ্রহণ করতেন না। কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকর্ম উপস্থিত হলে ছাত্রেরা নানা উপঢৌকন দিত শিক্ষককে এবং সে-সবের উপর তাঁরা অনেকাংশে নির্ভরও করতেন।

কাজেই গোপালের গুরুমশায়ও ছাত্রদের কাছে অনুষ্ঠান উপলক্ষে উপঢৌকনের জন্য অনুরোধ জানালেন এবং প্রত্যেক ছাত্র সাধ্যমত সে অনুরোধ রক্ষাও করল। কেউ দিল অর্থ, কেউ দিল অন্য কোন দ্রব্য-সামগ্রী। কিন্তু দুঃখিনী বিধবার পুত্র গোপাল! হায়, উপঢৌকনের সামগ্রী সে কোথায় পাবে? তাই অন্য পড়ুয়ারা একটু বিদ্রূপের হাসি হেসে-কে কি দেবে, তার বিবরণ গোপালকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে বেড়াতে লাগল।

সে রাত্রে মনে গভীর দুঃখ নিয়ে গোপাল মাকে সব কথা বলল। বলল-‘গুরুমশায়ের জন্য কিছু দিতেই হবে।’ কিন্তু মায়ের তো কোন সম্বলই নেই, কি দেবেন তিনি?

অবশেষে তিনি স্থির করলেন, যা চিরদিন করে এসেছেন জীবনের সর্বাবস্থায়, আজও তাই করবেন, রাখালরূপী শ্রীকৃষ্ণের উপর নির্ভর করবেন। তাঁর কাছেই চাইবেন, যদি কিছু প্রয়োজন হয়। সুতরাং ছেলেকে বললেন, সে যেন তার বনের রাখাল-দাদার কাছে গুরুমশায়ের জন্য কিছু চেয়ে নেয়।

পরদিন বনের পথে রাখাল-দাদার সঙ্গে যথানিয়মে গোপালের দেখা হল, দুজনে কিছুক্ষণ খেলাধুলাও করল। তারপর বিদায় নেবার কালে গোপাল তার দুঃখের কথা জানাল রাখাল-দাদাকে, অনুরোধ করল গুরুমশায়কে দেবার মত কিছু উপহার সে যেন তাকে দেয়।

রাখাল বলল, ‘ভাই গোপাল, আমি সামান্য বনের রাখাল। মাঠে মাঠে গোরু চরাই। আমার তো টাকা-পয়সা নেই, ভাই। তবে তোমার রাখাল-দাদার উপহারস্বরূপ এই ছোট ক্ষীরের বাটিটি তুমি নাও, এইটি তোমার গুরুমশাকে উপহার দিও।’

কিন্তু একি! মুহূর্তে সে শূন্যপাত্র আবার ক্ষীরে পূর্ণ হয়ে গেল! আবার ঢাললেন, আবারও পূর্ণ হল! এমনি যতবার তিনি ঢালেন, ততবারই পাত্রটি মুহূর্তে ভরে ওঠে!

গোপালের তখন আনন্দ আর ধরে না। একে তো গুরুমশায়ের জন্য কিছু উপহার হাতে পেয়েই সে খুশী, তার উপর সে-উপহার এসেছে রাখাল-দাদার কাছ থেকে। অতি দ্রুত সে পাঠশালায় চলে গেল। পাঠশালার অন্যান্য ছাত্রেরা তখন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে এক এক করে গুরুমশায়ের হাতে তাহাদের উপহার তুলে দিচ্ছে। গোপালও কম্পিতবক্ষে সবার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। ভিন্ন ভিন্ন ছাত্রের হাতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ভাল ভাল উপহার ছিল, সুতরাং পিতৃহীন দরিদ্র বালকের তুচ্ছ উপহারের দিকে কেউ তাকিয়েও দেখল না।

সে-তাচ্ছিল্যে গোপাল যেন দমে গেল, দুঃখে তার চোখে জল এল। অবশেষে হঠাৎ গুরুমশায়ের চোখ পড়ল তার দিকে। তিনি তখন তার হাত থেকে ক্ষীরের পাত্রটি নিয়ে অন্য একটি বৃহৎ পাত্রে ঢেলে দিলেন। কিন্তু একি! মুহূর্তে সে শূন্যপাত্র আবার ক্ষীরে পূর্ণ হয়ে গেল! আবার ঢাললেন, আবারও পূর্ণ হল! এমনি যতবার তিনি ঢালেন, ততবারই পাত্রটি মুহূর্তে ভরে ওঠে!

উপস্থিত সকলে তো একেবারে স্তম্ভিত। গুরুমশায় তখন দু-হাতে গোপালকে কোলে তুলে নিলেন। বললেন, ‘এ-পাত্র তুই কোথায় পেলি, বাবা?’

গোপাল তখন পণ্ডিতমশায়ের কাছে তার বনের রাখাল-দাদার কাহিনী আনুপূর্বিক বর্ণনা করল। কেমন করে সে তাঁকে প্রতিদিন ডাকে এবং সাড়া পায়; কেমন করে প্রতিদিন দু-জনে তারা খেলা করে এবং কেমন করে ঐ ক্ষীরের ছোট পাত্রটিও রাখাল-দাদার হাত থেকেই সে পেয়েছে।

সব কথা শুনে গুরুমশায় তখনই তার সঙ্গে বনে গিয়ে সেই অদ্ভুত রাখাল-বালককে দেখতে চাইলেন এবং গোপালও মহানন্দে তাঁকে নিয়ে চলল। বনস্থলীতে গিয়ে অন্যদিনের মত আজও সে তার দাদাকে ডাকল, কিন্তু সেদিন কোন উত্তর শোনা গেল না। গোপাল বার বার ডাকতে লাগল, তবু কোন জবাব এল না। তখন অতি করুণ স্বরে গোপাল বলল, ‘রাখাল-দাদা, আজ তুমি আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছ না? তুমি উত্তর না দিলে এঁরা যে মনে করবেন, আমি মিথ্যা কথা বলছি।’

তখন অতিদূরে বন-প্রদেশ থেকে একটি স্বর ভেসে এল-এক অশরীরী শব্দ, কে যেন বলছে, ‘ভাই, তোমার আর তোমার মায়ের ভক্তি-বিশ্বাসের টানেই আমি তোমার কাছে যাই। কিন্তু তোমার গুরুমশায়ের এখনও অনেক দেরী, তাঁকে বল সে-কথা।’

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!