-স্বামী বিবেকানন্দ
এইবার ইষ্টনিষ্ঠা সম্বন্ধে আমাদিগকে আলোচনা করিতে হইবে। যে ভক্ত হইতে চায়, তাহার জানা উচিত, ‘যত মত তত পথ’-তাহার জানা উচিত, বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় সেই একই ভগবানের মহিমার বিভিন্ন বিকাশমাত্র।
‘হে ভগবান্, লোকে তোমাকে কত বিভিন্ন নামে ডাকিয়া থাকে-লোকে তোমাকে বিভিন্ন নামে যেন ভাগ করিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু প্রত্যেকটি নামেই তোমার পূর্ণশক্তি বর্তমান। যে উপাসক যে নামে উপাসনা করিতে ভালবাসে, তাহার নিকট তুমি সেই নামের ভিতর দিয়াই প্রকাশিত হও। তোমার প্রতি অন্তরাত্মার ঐকান্তিক অনুরাগ থাকিলে তোমাকে ডাকিবার কোন নির্দিষ্ট কাল নাই। তোমার নিকট এত সহজে যাওয়া যায়, কিন্তু আমার দুর্দৈব-তোমার প্রতি অনুরাগ জন্মিল না।’৩৭
শুধু তাই নয়, ভক্ত যেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা জ্যোতির তনয়গণকে ঘৃণা না করেন; এমন কি তাঁহাদের সমালোচনা-বিষয়েও যেন বিশেষ সতর্ক থাকেন; তাঁহাদের নিন্দা শোনাও তাঁহার উচিত নয়। অবশ্য এমন লোক অতি অল্পই আছেন, যাঁহারা উদার, সহানুভূতিসম্পন্ন, অপরের গুণগ্রহণে সমর্থ, আবার গভীর ভগবৎ-প্রেমসম্পন্ন। সচরাচর দেখা যায়, উদারভাবাপন্ন সম্প্রদায়গুলি আধ্যাত্মিক গভীরতা হারাইয়া ফেলে।
নূতন নূতন বিষয় শোনা তাহাদের যেন একরূপ ব্যারাম-একরূপ নেশার ঝোঁকের মত। তাহারা খানিকটা সাময়িক স্নায়বীয় উত্তেজনা চায়, সেটি চলিয়া গেলেই তাহারা আর একটির জন্য প্রস্তুত হয়। ধর্ম তাহাদের নিকট যেন আফিমের নেশার মত হইয়া দাঁড়ায়, আর ঐ পর্যন্তই তাহাদের দৌড়। ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেনঃ আর এক প্রকার মানুষ আছে, তাহারা মুক্তা-ঝিনুকের মত।
ধর্ম তাহাদের নিকট একপ্রকার রাজনীতিক-সামাজিক-ভাবাপন্ন সমিতির কার্যে পরিণত হয়। আবার খুব সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিগণের নিজ আদর্শের প্রতি খুব ভালবাসা আছে বটে, কিন্তু তাহাদের এই ভালবাসার প্রতিটি বিন্দু অপর সকল সম্প্রদায়ের-যেগুলির মতের সহিত তাহাদের এতটুকুও পার্থক্য আছে-সেগুলির উপর ঘৃণা হইতে সংগৃহীত হইয়াছে।
ঈশ্বরেচ্ছায় জগৎ যদি পরম উদার অথচ গভীরপ্রেমসম্পন্ন জনগণে পূর্ণ হইয়া যাইত, বড় ভাল হইত! কিন্তু এইরূপ মহাত্মার সংখ্যা অতি বিরল। তথাপি আমরা জানি, জগতের অনেককে এই আদর্শে শিক্ষিত করা সম্ভব; আর ইহার উপায় এই ‘ইষ্টনিষ্ঠা’।
প্রত্যেক ধর্মের প্রতিটি সম্প্রদায় মানুষকে শুধু নিজের আদর্শটি দেখাইয়া দেয়, কিন্তু সনাতন বৈদান্তিক ধর্ম ভগবানের সেই মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিবার অনন্ত দ্বার খুলিয়া দেন, এবং মানবের সমক্ষে প্রায় অসংখ্য আদর্শ স্থাপন করেন। সেই আদর্শগুলির প্রত্যেকটিই সেই অনন্তস্বরূপের এক-একটি বিকাশ মাত্র। অতীত ও বর্তমানের মহামহিমময় ঈশ্বরতনয় বা ঈশ্বরের অবতারগণ মনুষ্যজীবনের বাস্তব ঘটনাবলীর কঠিন পর্বত কাটিয়া যে-সকল বিভিন্ন পথ বাহির করিয়াছেনG
পরমকরুণাপরবশ হইয়া বেদান্ত উহা মুমুক্ষু নরনারীগণকে দেখাইয়া দেন, আর বাহু প্রসারিত করিয়া সকলকে-এমন কি ভবিষ্যৎ মানবকেও সেই সত্য ও আনন্দের ধামে আহ্বান করেন, যেখানে মানবাত্মা মায়াজাল হইতে মুক্ত হইয়া পূর্ণ স্বাধীনতা ও অনন্ত আনন্দের অবস্থায় উন্নীত হয়।
ভক্তিযোগ এইরূপে ভগবৎপ্রাপ্তির বিভিন্ন পথগুলির একটিকেও ঘৃণা বা অস্বীকার করিতে নিষেধ করেন। তথাপি গাছ যতদিন ছোট থাকে, ততদিন বেড়া দিয়া রাখিতে হয়। অপরিণত অবস্থায় নানাপ্রকার ভাব ও আদর্শ সম্মুখে রাখিলে ধর্মরূপ কোমল লতিকা মরিয়া যাইবে। অনেক লোক উদার ধর্মভাবের নামে অনবরত ভাবাদর্শ পরিবর্তন করিয়া নিজেদের বৃথা কৌতূহল মাত্র চরিতার্থ করে।
নূতন নূতন বিষয় শোনা তাহাদের যেন একরূপ ব্যারাম-একরূপ নেশার ঝোঁকের মত। তাহারা খানিকটা সাময়িক স্নায়বীয় উত্তেজনা চায়, সেটি চলিয়া গেলেই তাহারা আর একটির জন্য প্রস্তুত হয়। ধর্ম তাহাদের নিকট যেন আফিমের নেশার মত হইয়া দাঁড়ায়, আর ঐ পর্যন্তই তাহাদের দৌড়। ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেনঃ আর এক প্রকার মানুষ আছে, তাহারা মুক্তা-ঝিনুকের মত।
মুক্তা-ঝিনুক সমুদ্রতল ছাড়িয়া স্বাতীনক্ষত্রে পতিত বৃষ্টি-জলের জন্য উপরে আসে। যতদিন না ঐ জলের একটি বিন্দু পায়, ততদিন সে মুখ খুলিয়া উপরে ভাসিতে থাকে, তারপর গভীর সমুদ্রতলে ডুব দেয় এবং যে পর্যন্ত না বৃষ্টিবিন্দুটি মুক্তায় পরিণত হয়, সে পর্যন্ত সেইখানেই বিশ্রাম করে।
তবে গুরুদত্ত ঐ বীজমন্ত্র হইতেই আধ্যাত্মিক ভাবের সুবৃহৎ বটবৃক্ষ উৎপন্ন হইয়া শাখার পর শাখা ও মূলের পর মূল বিস্তার করিয়া ধর্মজীবনের সমগ্র ক্ষেত্র ছাইয়া ফেলিবে। পরিশেষে প্রকৃত ভক্ত দেখিবেন-যিনি সারা জীবন তাঁহার নিজের ইষ্টদেবতা, তিনিই বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন রূপে উপাসিত।
এই উদাহরণে ইষ্টনিষ্ঠা-ভাবটি যেরূপ হৃদয়স্পর্শী কবিত্বের ভাষায় ফুটিয়া উঠিয়াছে আর কোথাও সেরূপ হয় নাই। ভক্তিপথে প্রবর্তকের এই একনিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন। হনুমানের ন্যায় তাঁহার বলা উচিত, ‘যদিও লক্ষ্মীপতি ও সীতাপতি পরমাত্মস্বরূপে অভেদ, তথাপি কমললোচন রামই আমার সর্বস্ব।’৩৮ অথবা সাধু তুলসীদাস যেমন বলিতেন, ‘সকলের সঙ্গে বসো, সকলের সঙ্গে আনন্দ কর, সকলের নাম গ্রহণ কর; যে যাহাই বলুক না কেন সকলকেই হাঁ হাঁ বলোG
কিন্তু নিজের ভাব দৃঢ় রাখিও’৩৯, ভক্তিযোগীরও সেই প্রকার আচার অবলম্বন করা উচিত। ভক্তসাধক যদি অকপট হন, তবে গুরুদত্ত ঐ বীজমন্ত্র হইতেই আধ্যাত্মিক ভাবের সুবৃহৎ বটবৃক্ষ উৎপন্ন হইয়া শাখার পর শাখা ও মূলের পর মূল বিস্তার করিয়া ধর্মজীবনের সমগ্র ক্ষেত্র ছাইয়া ফেলিবে। পরিশেষে প্রকৃত ভক্ত দেখিবেন-যিনি সারা জীবন তাঁহার নিজের ইষ্টদেবতা, তিনিই বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন রূপে উপাসিত।
………………………………
৩৭ নাম্নামকারি বহুধা নিজসর্বশক্তি- স্তত্রর্পিতা নিয়মিতঃ স্মরণে ন কালঃ। এতাদৃশী তব কৃপা ভগবন্ মমাপি দুর্দৈবমীদৃশামিহাজনি নানুরাগঃ।। -শিক্ষাষ্টকম্, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য
৩৮ শ্রীনাথে জানকীনাথে অভেদঃ পরমাত্মনি। তথাপি মম সর্বস্বঃ রামঃ কমললোচনঃ।। ৩৯ সব্সে বসিয়া সব্সে রসিয়ে সব্কা লীজিয়ে নাম। হাঁ জী হাঁ জী কর্তে রহিয়ে বৈঠিয়ে আপনা ঠাম।।-দোঁহা, তুলসীদাস
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….