ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

ভারতের রীতিনীতি

[১৮৯৪ খ্রীঃ ১৫ ফেব্রুআরী বৃহস্পতিবার ডেট্রয়েটে প্রদত্ত একটি বক্তৃতার বিবরণী-‘ডেট্রয়েট ফ্রী প্রেস’-এর সম্পাদকীয় বক্তব্য সহ।]

গত রাত্রে ইউনিটেরিয়ান চার্চে হল-ভরতি শ্রোতৃবৃন্দ খ্যাতনামা সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণ শ্রবণ করে, তিনি তাঁর দেশের রীতিনীতি ও প্রথা সম্পর্কে বলেন। তাঁর বাগ্মিতা ও মধুর ব্যবহারে শ্রোতারা আনন্দিত হয়; প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গভীর মনোযোগের সঙ্গে তারা তাঁর বক্তৃতা শোনে, মাঝে মাঝে উচ্চ করতালি-ধ্বনি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে। চিকাগো ধর্মমহাসভায় প্রদত্ত সুবিখ্যাত বক্তৃতার চেয়েও তাঁর এই বক্তৃতাটির বিষয়বস্তু ছিল অধিকতর জনপ্রিয়। ভাষণটি খুবই চিত্তাকর্ষক হয়েছিল; বিশেষতঃ সেই অংশগুলি, যেখানে বক্তা উপদেশমূলক প্রসঙ্গ ত্যাগ করে তাঁর স্বদেশবাসীদের কতকগুলি আধ্যাত্মিক অবস্থার সুনিপুণ বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ধর্মীয় ও দার্শনিক (এবং অবশ্যই আধ্যাত্মিক) প্রসঙ্গেই এই প্রাচ্যদেশীয় ভ্রাতা সর্বাপেক্ষা হৃদয়গ্রাহী এবং যখন তিনি প্রকৃতির মহৎ ও সহজ নৈতিক নিয়মের বিবেক-সম্মত কর্তব্যের কথা বলছিলেন, তখন তাঁর নিয়ন্ত্রিত কোমল কণ্ঠস্বর (যা তাঁর জাতির বৈশিষ্ট্য) এবং তাঁর রোমাঞ্চকর ভঙ্গি অনেকটা একজন প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তির মতই মনে হচ্ছিল। শ্রোতাদের নিকট কোন নৈতিক সত্য উপস্থাপনের সময় ছাড়া তাঁর বক্তৃতায় সুস্পষ্ট চিন্তাশীলতা প্রকাশ পায়, কিন্তু নৈতিক সত্য উপস্থাপনের সময় তাঁর বাগ্মিতায় চরমোৎকর্ষ দেখা যায়।

তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, ভারতে নৈতিকতার মান পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উঁচুতে। তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন বিশপ নিন্‌ডে (Bishop Ninde)। সানন্দচিত্তে বিবেকানন্দের পরিচয় প্রদান করে তিনি ভারতের আশ্চর্য বস্তু সম্বন্ধে ও সেখানকার শিক্ষিত শ্রেণীর বুদ্ধির উৎকর্ষের কথা উল্লেখ করেন। পাগড়ি-মাথায় উজ্জ্বল আলখাল্লা-পরা এবং বুদ্ধিদীপ্ত-চক্ষুবিশিষ্ট সেই শ্যামবর্ণ ভদ্রমহোদয় যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন সকলের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল এক মনোমুগ্ধকর মূর্তি। বিশপের সহৃদয় বাক্যের জন্য তিনি তাঁকে ধন্যবাদ জানালেন এবং তাঁর স্বদেশের জাতিভেদ, লোকের আচার-ব্যবহার ও ভাষার বিভিন্নতা সম্বন্ধে আলোচনা করতে প্রবৃত্ত হলেনঃ

মূলত উত্তর-ভারতে চারটি ভাষা এবং দক্ষিণ-ভারতে চারটি, কিন্তু ধর্ম উভয়ত্র এক। ত্রিশ কোটি লোকের মধ্যে পাঁচ ভাগের চার ভাগই হিন্দু এবং এই হিন্দু জাতিটি কিছুটা অদ্ভুত। ধর্মীয় রীতি অনুসারে হিন্দু সব কাজ করে; ধর্মনিষ্ঠার সঙ্গে সে আহার করে, প্রত্যূষে শয্যা ত্যাগ করে, ধর্মের নির্দেশ অনুসারে সে সৎকর্ম করে এবং অসৎ কাজও করে ধর্মভাবে।

এই সময়ে বক্তা তাঁর ভাষণের শ্রেষ্ঠ নৈতিক সার কথাটি উল্লেখ করেন। তিনি বলেনঃ তাঁর স্বদেশবাসীদের বিশ্বাস-সকল স্বার্থশূন্য কাজই সৎ এবং সকল স্বার্থপরতাই অসৎ। অতএব হিন্দুর মতে নিজের জন্য গৃহনির্মাণ স্বার্থপরতা; হিন্দু গৃহনির্মাণ করে ঈশ্বরোপাসনা এবং অতিথিসেবার জন্য। নিজের জন্য আহার্য-রন্ধন স্বার্থপরতা; তাই সে রন্ধন করে দরিদ্রসেবার জন্য; যদি কোন ক্ষুধার্ত আগন্তুক প্রার্থী আসে, তবে আগে তার সেবা করে অবশেষে সে নিজে আহার্য গ্রহণ করে-এই ভাবটি দেশের সর্বত্র বিরাজ করছে। যে কেউ খাদ্য ও আশ্রয়ের প্রার্থী হোক না কেন, সব দরজাই তার জন্য খোলা থাকবে।

জাতিভেদ-প্রথার সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। লোকের বৃত্তি বংশগত-একজন ছুতোর-মিস্ত্রীর ছেলে ছুতোর হয়েই জন্মায়; স্বর্ণকারের ছেলে স্বর্ণকার, কারিগরের ছেলে কারিগর এবং পুরোহিতের ছেলে পুরোহিত। তবে এই সামাজিক দোষত্রুটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের, এ প্রায় এক হাজার বছর ধরে চলে আসছে মাত্র; কালের এই পরিণাম ভারতে খুব দীর্ঘ বলে বিবেচিত হয় না, যেমন মনে করা হয় এদেশে বা অন্য সকল দেশে।

দু-রকমের দান বিশেষভাবে সমাদৃত-শিক্ষাদান এবং প্রাণদান। কিন্তু শিক্ষাদানই অগ্রাধিকার লাভ করে। একজন মানুষের জীবন রক্ষা করা খুব ভাল; তাকে শিক্ষাদান করা তার চেয়েও ভাল। অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দেওয়া গর্হিত কাজ এবং যে-ব্যক্তি ব্যবসার সামগ্রীর মত শিক্ষার বিনিময়ে কাঞ্চন গ্রহণ করে, তার উপর ধিক্কার বর্ষিত হয়। সরকার মাঝে মাঝে শিক্ষকদের সাহায্য করে থাকেন। তার ফলে তথাকথিত সভ্যদেশগুলিতে যে- পরিবেশ বজায় আছে, এখানে নৈতিক ফলাফল তার চেয়ে শুভকর হয়েছে।


এই অবস্থায় অন্য যে-কোন জাতির চেয়ে এখানে অধিকতর আধ্যাত্মিক শক্তি ও জ্ঞানের উন্মেষ ঘটেছে। এই দেশ ও জাতির ভেতর থেকে একটি অফুরন্ত স্রোতের ধারা বয়ে চলেছে, যা দেশ-বিদেশের বহু চিন্তাশীল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এরা সহজেই ঘাড় থেকে পার্থিব বোঝা ছুঁড়ে ফেলে দেয়

বক্তা দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করে বেড়িয়েছিলেন, সভ্যতার সংজ্ঞা কি? প্রশ্নটি তিনি আরও বহু দেশে জিজ্ঞাসা করেছেন। কখনও উত্তর পেয়েছেন, ‘আমরাই হলাম সভ্যতার মাপকাঠি।’ তিনি সবিনয়ে জানান-শব্দটির সংজ্ঞা সম্বন্ধে তাঁর মত অন্য রকম। কোন জাতি হয়তো প্রাকৃতিক শক্তিকে বশীভূত করতে পারে, জনহিতকর প্রয়োজনীয় সমস্যাগুলির প্রায় সমাধান করে ফেলতে পারে, তথাপি এ কথা তাদের বোধগম্য নাও হতে পারে যে, যে-ব্যক্তি নিজেকে জয় করার শিক্ষা লাভ করেছে, সেই ব্যক্তিবিশেষের মধ্যেই সর্বোৎকৃষ্ট সভ্যতা পরিস্ফুট। পৃথিবীর যে-কোন দেশের চেয়ে এই পরিবেশটি ভারতে অধিক বর্তমান, কারণ সেখানে বস্তুগত পরিবেশ আধ্যাত্মিক পরিবেশের অধীন এবং প্রত্যেকেই সকল প্রাণীর মধ্যে আত্মার প্রকাশ দেখতে সচেষ্ট এবং প্রকৃতিকেও একই ভাবে দেখে। এখানেই দেখা যায়-ভাগ্যের নির্দয় পরিহাসকে অবিচল ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করার মত ধীর মনোভাব; এই অবস্থায় অন্য যে-কোন জাতির চেয়ে এখানে অধিকতর আধ্যাত্মিক শক্তি ও জ্ঞানের উন্মেষ ঘটেছে। এই দেশ ও জাতির ভেতর থেকে একটি অফুরন্ত স্রোতের ধারা বয়ে চলেছে, যা দেশ-বিদেশের বহু চিন্তাশীল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এরা সহজেই ঘাড় থেকে পার্থিব বোঝা ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

খ্রীষ্টপূর্ব ২৬০ অব্দে যে প্রাচীন রাজা আদেশ করেছিলেন, ‘আর কোন রক্তপাত বা কোন যুদ্ধ করা চলবে না’ এবং যিনি সৈনিকের বদলে পাঠিয়েছিলেন একদল শিক্ষক, তিনি জ্ঞানীর মত কাজই করেছিলেন, যদিও বাস্তবতার দিক্‌ থেকে দেশ তার ফলে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বল-প্রয়োগকারী বর্বর জাতিগুলির অধীনতা স্বীকার করলেও ভারতবাসীর আধ্যাত্মিকতা চিরকাল বেঁচে আছে; কারও সাধ্য নেই, সেটি তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। নিষ্ঠুর ভাগ্যের আঘাত সহ্য করার মত খ্রীষ্টসুলভ নম্রতা ভারতের মানুষের আছে, এবং সেই সঙ্গে তাদের আত্মা উজ্জ্বলতর লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। এরূপ দেশে ‘ভাবপ্রচার’-এর জন্য কোন খ্রীষ্টান মিশনারীর প্রয়োজন নেই, কারণ ভারতের ধর্ম মানুষকে ধীর, মধুর, বিবেচক এবং মনুষ্য-পশু-নির্বিশেষে ভগবানের সৃষ্ট সকল প্রাণীর প্রতি প্রীতিসম্পন্ন করে তোলে। নৈতিকতার দিক্‌ থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পৃথিবীর যে-কোন দেশ অপেক্ষা ভারত উচ্চে। মিশনারীরা যদি কেবল সেখানকার পবিত্র বারি পান করতে বা সেই মহান্‌ জাতির উপর বহু পবিত্র জীবনের কী অপূর্ব প্রভাব পড়েছে-তা দেখতে যান, তবেই ভাল করবেন।

তারপর বক্তা বিবাহের রীতিনীতি ও প্রাচীনকালে যখন সহশিক্ষা-প্রথার প্রচলন ছিল, তখন নারীদের যে-সকল সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হত, তার বর্ণনা করেন। ভারতের ঋষিদের লেখায় প্রত্যাদিষ্ট নারীর অপূর্ব চিত্র পাওয়া যায়। খ্রীষ্টধর্মে প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তিরা সকলেই পুরুষ, কিন্তু ভারতের পূতচরিত্র নারীগণ ধর্মগ্রন্থসমূহর উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছেন। গৃহস্থদের উপাসনার অঙ্গ পাঁচটি, তার মধ্যে একটি অধ্যয়ন-অধ্যাপনা; আর একটি হল মূক প্রাণীর সেবা, এই উপাসনাটি আমেরিকানদের পক্ষে বোঝা শক্ত। ইওরোপীয়দের পক্ষেও এই ভাবটি উপলব্ধি করা সহজ নয়। অন্যান্য জাতি পাইকারী হারে প্রাণী হত্যা করে এবং নিজেরাও পরস্পর হানাহানি করে মরে, রক্তের সমুদ্রে তারা বাস করে।

একজন ইওরোপীয় বলেছিল, ভারতবাসীরা যে প্রাণী হত্যা করে না, তার কারণ তারা মনে করে, প্রাণীদের মধ্যে তাদের পূর্বপুরুষের আত্মা আছে। পশুর স্তর থেকে যারা বেশী দূর অগ্রসর হয়নি, তাদের পক্ষেই এ-ধরনের যুক্তি সাজে। আসলে এটা ভারতের এক শ্রেণীর নাস্তিকের উক্তি-এ ভাবে তারা বেদের ‘অহিংসা ও পুনর্জন্মবাদ’-এর দোষ দর্শন করে থাকে। এ রকম ধর্মীয় মতবাদ কোনকালে ছিল না। এটা জড়বাদী বিশ্বাস। মূক প্রাণীর উপাসনার একটি উজ্জ্বল চিত্র বক্তা তুলে ধরেন।

ভারতের অপূর্ব বিধি অতিথিপরায়ণতা একটি গল্পের মাধ্যমে তিনি চিত্রিত করেন। একদা দুর্ভিক্ষের দরুন এক ব্রাহ্মণকে-তাঁর স্ত্রী, পুত্র এবং পুত্রবধূসহ কিছুকাল অনাহারে কাটাতে হয়। গৃহস্বামী খাদ্যের অন্বেষণে বাইরে গিয়ে সামান্য পরিমাণ ছাতু সংগ্রহ করে আনেন; বাড়িতে এসে তিনি তা চার ভাগে ভাগ করেন এবং যখন সেই ছোট্ট পরিবারটি আহার করতে যাচ্ছে, এমন সময় দরজায় করাঘাত শোনা গেল। আগন্তুক একজন ক্ষুধার্ত অতিথি। ভাগগুলি তখন অতিথির সামনে দেওয়া হল এবং সে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে চলে গেল, আর এদিকে অতিথি-সেবাপরায়ণ সেই চারজন মৃত্যু বরণ করল। আতিথেয়তার পবিত্র নামে ভারতে যা আশা করা যায়, এই গল্পটি তারই আদর্শ-রূপে বলা হয়ে থাকে।


তাঁর অপরিমিত আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ শ্রোতাগণ অনুভব করেন, কারণ তা চেতন ও অচেতন সকল বস্তুর প্রতি ভালবাসা-রূপে এবং সমন্বয়ের ঐশী বিধান ও কল্যাণকর অভিপ্রায়ের বিচিত্র কার্যরীতির গভীরে প্রবেশ করবার প্রখর অন্তর্দৃষ্টি-রূপে স্বতঃপ্রকাশিত।

সুনিপুণ বাগ্মিতার সঙ্গে বক্তা তাঁর ভাষণ শেষ করেন। তাঁর বক্তব্য আগাগোড়া সহজ সরল; কিন্তু যখনই তিনি কোন চিত্র বর্ণনায় রত হন, তখন তা অপূর্ব কাব্যের মত শোনায়, তা থেকে প্রমাণিত হয়, পূর্বদেশীয় ভ্রাতা প্রকৃতির সৌন্দর্য কত গভীর ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁর অপরিমিত আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ শ্রোতাগণ অনুভব করেন, কারণ তা চেতন ও অচেতন সকল বস্তুর প্রতি ভালবাসা-রূপে এবং সমন্বয়ের ঐশী বিধান ও কল্যাণকর অভিপ্রায়ের বিচিত্র কার্যরীতির গভীরে প্রবেশ করবার প্রখর অন্তর্দৃষ্টি-রূপে স্বতঃপ্রকাশিত।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!