পত্রাবলী
পত্রাবলী ১২৯
৫৪১,ডিয়ারর্বন এভিনিউ,চিকাগো*
নভেম্বর,১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী ,
আপনার পএ পাইয়া বিশেষ প্রীতিলাভ করিয়াছি । পরিহাস আমি ঠিকই বুঝিতে পারি , কিন্তু আমি ক্ষুদ্র শিশুটি নই যে উহাতেই নিরস্ত হইব ।…
সংগঠন – ও সংযোগশক্তিই পাশ্চাত্য জাতিগুলির সাফল্যের হেতু; আর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস , সহযোগিতা ও সহয়তা দ্বারাই ইহা সম্ভব হইয়া থাকে ।… জৈনধর্মাবলন্বী বীরচাঁদ গান্দীর কথাই ধরুন , তাঁহাকে আপনি বোম্বাইয়ে ষথেষ্ট জানিতেন । এই ভদ্রলোকটি এদেশের দুর্জয় শীতেও নিরামিষ ভিন্ন অন্য খাদ্য গ্রহণ করেন না এবং নিজের দেশ ও ধর্মকে প্রাণপণ সমর্থন করেন । এদেশের জনসাধারণ তাঁহাকে বিশেষ পছন্দ করে, কিন্ত যাহারা তাঁহা কে এদেশে পাঠাইয়াছিল, তাহারা আজ কি করিতেছে ?- তাহারা বীরচাঁদ জাতিচ্যুত করিতে সচেষ্ট।
হিংসারুপ পাপ দাসজাতির মধ্যৈই স্বভাবতঃ উদ্ভুত হইয়া থাকে এবং উহাই তাহাদিগকে হীনতার প নিমজ্জিত করিয়া রাখে। এদেশে ‘-‘ রা বক্তৃতা করিয়া অর্থসংগ্রহের চেষ্টা করিতেছিল এবং কিছু সাফল্য লাভ যে করে নাই এমন নহে কিন্তু তদপেক্ষা অধিকতর সাফল্য আমি লাভ করিআছিলাম ; আমি কোনপ্রকারে তাহাদের বিঘ্নস্বরুপ হই নাই। তবে কি কারণে আমার সাফল্য অধিক হইয়াছিল ? কারণ উহাই ভগবানের অভিপ্রায় ছিল ।
এদেশে কেহ যদি উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে থাকে তবে সকলের তাহার সহায়তা করিতে প্রস্তুত । আর ভারতবর্ষে কাল যদি কোন একটি পএিকায় আপনি আমার প্রশংসা করিয়া এক ছাত্র লেখেন,তবে পরদিন দেশসুদ্ধ সকলে আমার বিপক্ষে দাঁড়াইবে । ইহার হেতু কি ? হেতু-দাসসুলভ মনোবৃত্তি । নিজেদের মধ্যে কেহ সাথারণ স্তর হইতে একটু মাথা উঁচু কলরিয়া দাঁড়াইবে,ইহা তাহাদের পক্ষে অসহ্য । এদেশের মুক্তিকামী,স্বাবলম্বী ও ভ্রাতৃভাবে উদ্বুদ্ধ জনগণের সহিত আমাদের দেশের অপদার্থ লোকগুলির কি আপনি তুলনা করিতে চান ? আমাদের সহিত যাহাদের নিকটতম সাদৃশ্য আছে তাহারা এদেশের সদ্যোদাসত্বমুক্ত নিগ্রোগণ ।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাংশে প্রায় দুই কোটি নিগ্রো আর মুষ্ঠিমেয় কয়েকটি শ্বেত- আমেরিকান বাস করে ; অথচ এই শ্বেতকায় কয়েকজনই নিগ্রোদিগকে দাবাইয়া রাখিয়াছে ।
আইন অনুসারে সব ক্ষমতা থাকা সত্বেও এই দাসজাতির মুক্তির জন্য আমেরিকানরা ভাইয়ে ভাইয়ে এক নৃশংস যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছিল । সেই একই দোষ- হিংসা এখানেও রহিয়াছে । একজন নিগ্রো আর একজন প্রশংসা কিংবা উন্নতি সহ্য করিতে পারে না ; অবিলম্বে তাহাকে নিষ্পেষিত করিবার জন্য আমেরিকানদিগের সহিত যোগ দেয় । ভারত বর্ষের বাহিরেনা আসিলে এ বিষয়ে সম্যক ধারণা হওয়া সম্ভব নহে ।
যাহাদের প্রচুর অর্থ ও প্রতিপত্তি আছে , তাহাদের পক্ষে জগংকে এইভাবে চলিত দেওয়া ঠিক বটে ; কিন্তু যাহারা লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ও নিষ্পেষিত নরনারীর বুকের রক্তদ্বারা অর্জিত অর্থে শিক্ষিত হইয়া এবং বিলাসিতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকিয়াও উহাদের কথা একটিবার চিন্তা করিবার অবসর পায় না – তাহাদিগকে আমি ‘বিশ্বাসঘাতক ‘ বলিয়া অভিহিত করি ।
কোথায় ইতিহাসের কোন যুগে ধনী ও অভিজাত সম্প্রদিয় , পুরোহিত ও ধর্মধ্বজিগনণ দীন দুঃখীর জন্য চিন্তা করিয়াছে ? অথচ ইহাদের নিষ্পেষণ করাতেই তাহাদের ক্ষমতার প্রাণশক্তি ।
কিন্তু প্রভু মহান । শীঘ্রই হউক আর বিলম্বেই হউক, এ অন্যায়ের সমুচিত ফলও ফলিয়াছে । যাহারা দরিদ্রের রক্ত শোষণ করিয়াছে, উহাদের অর্জিত অর্থে নিজেরা শিক্ষা লাভ করিয়াছে , এমনকি , যাহাদের ক্ষমতা – প্রতিপত্তির সৌধ দরিদ্রের দুঃখদৈন্যের উপরই নির্মিত – কালচক্র আবর্তনে তাহাদেরই হাজার হাজার লোক দাসরুপে বিক্রিত হইয়াছে ; তাহাদের স্ত্রীকন্যার মর্যাদা নষ্ট হইয়াছে এবং বিষয়- সম্পত্তি সবই হইয়াছে । বিগত সহস্র বসর যাবৎ ইহাই চলিয়া আসিতেছে । আর ইহার পশ্চিতে কি কোন কারণ নাই বলিয়া আপনি মনে করেন ?
ভারতবর্ষে দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা এত বেশি কেন ? এ কথা বলা মুর্খতা যে তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তরগ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল ।….. বস্তুতঃ জমিদার ও পুরোহিতবর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল । আর সেইজন্য বাংলাদেশে যেখানে জমিদারর বিশেষ সংখ্যাধিক্য সেখানে কৃষকসম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানেরই সংখ্যা বেশী ।
এই নির্যাতিত ও অধঃপতিত লক্ষ লক্ষ নরনারীর উন্নতির কথা কে চিন্তা করে ? কয়েক হাজার ডিগ্রিধারী ব্যক্তিদ্বারা একটি জাতি গঠিত হয় না, অথবা মুষ্ঠিমেয় কয়েকটি ধনীও একটি জাতি নহে । আমাদের সুযোগ – সুবিধা খুব বেশী নাই এ কথা অবশ্য সত্য , কিন্তু যেটুকু আছে, তাহা এিশ কোটি নরনারীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পক্ষেও যথেষ্ট।
আমাদের দেশের শটকরা নব্বই জনই অশিক্ষিত,অথচ কে তাহাদের বিষয় চিন্তা করে ? এইসকল বাবুর দল কিংবা তথাকথিত দেশহিতৈষীর দল কি ?
এইসকল সত্বেও আমি বলি যে, ভগবান অবশ্যই একজন আছেন এবং এ কথা পরিহাসের বিষয় নহে। তিনিই আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত করিতেছেন ; এবং যদিও আমি জানি যে ,দাসজাতি তাহার স্বভাবদোষে যথার্থ হিতকারীকেই দংশন করিয়া থাকে , তথাপি ইহাদের জন্য আমি প্রার্থনা করি এবং আমার সহিত আপনিও প্রার্থনা করুন। যাহা কিছু সং, যাহা কিছু মহৎ , তাহার প্রতি আপনি যথার্থ সহানুভুতিসম্পন্ন । আপনাকে জানিয়া অন্ততঃ এমন একজনকে জানিয়াছি বলিয়া আমি মনে করি, য়াঁহার মধ্যে সারবস্ত আছে , য়াঁহার প্রকৃতি উদার এবং যিনি অন্তরে বাহিরে অকপট । তাই আমার সহিত ‘তমসো মা জ্যোতির্গময় ‘- এই প্রার্থনায় যোগ দিতে আমি আপনাকে আহ্বান করি।
লোকে কি বলিল – সেদিকে আমি ভ্রুক্ষেপ করি না । আমার ভগবানকে, আমার ধর্মকে, আমার দেশকে -সর্বোপরি দরিদ্র ভিক্ষুককে আমি ভালবাসি । নিপীড়িত, অশিক্ষিত ও দীনহীনকে আমি ভালবাসি তাহাদের বেদনা অন্তরে অনুভব করি, কত তীব্রভাবে অনুভব করি, তাহা প্রভুই জানেন । তিনিই আমাকে পথ দেখাইবেন । মানুশের স্ততি-নিন্দায় আমি দৃকপাতও করি না, তাহাদের অধিকাংশকেই অঞ্জ কলরবকারি শিশুর মতো মনে করি। সহানুভুতি ও নিঃস্বার্থ ভালবাসার ঠিক মর্মকথাটি ইহারা কখনও বুঝিতে পারে না। কিন্ত শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদে আমার সে অন্তদৃষ্টি আছে।
মুষ্ঠিমেয় সহকর্মীদের লইয়া এখন আমি কাজ করিতে চেষ্টা করিতেছি, আর উহাদের প্রত্যেকে আমারই মতো দরিদ্র ভিক্ষুক। তাহাদিগকে আপনি দেখিয়াছেন । প্রভুর কাজ চিরদিনই দীন -দরিদ্রগণই সম্পন্ন করিয়াছে। আশীর্বাদ করিবেন যেন ইশ্বরের প্রতি, গুরুর প্রতি এবং নিজের প্রতি আমার বিশ্বাস অটুট থাকে।
প্রেম এবং সহানুভুতিই একমাত্র পন্থা। ভালবাসাই একমাত্র উপাসনা।
প্রভু আপনাদের নিরন্তর সহায়তা করুন। আমার আশীর্বাদাদি জানিবেন।
ইতি–
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী-পরিশিষ্ট
…………………………..
২০৫ক*
[মিঃ ফ্রান্সিস লেগেটকে লিখিত]
সহস্রদ্বীপোদ্যান (যুক্তরাষ্ট্র)
অগষ্ট, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
আপনার চিঠি যথাসময়ে পেয়েছি।
আমার ইচ্ছামত আপনি আমায় লণ্ডনে যেতে বলেছেন—এ আপনার বিশেষ অনুগ্রহ ও মহত্ত্বের পরিচায়ক। সেজন্য অজস্র ধন্যবাদ। কিন্তু আমার লণ্ডনে যাবার কোন তাড়া নেই। তাছাড়া, আমি আপনাকে প্যারিসে বিবাহিত দেখতে চাই; তারপর আমি লণ্ডনে যাব।
আমি ঠিক সময়ে হাতের কাছে প্রস্তুত … থাকব, ভয় নেই।
ইতি
আপনার চিরবিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
…………………………..
২৬০ক*
[গিরিধারীদাস মঙ্গলদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
২২৮ ওয়েষ্ট ৩৯ ষ্ট্রীট
নিউ ইয়র্ক
২ মার্চ, ১৮৯৬
প্রিয় বন্ধু,
আপনার সুন্দর পত্রখানির উত্তর দিতে দেরী হওয়ার জন্য ক্ষমা করবেন।
আপনার পিতৃব্য মহাত্মা ছিলেন, তাঁর সমগ্র জীবন দেশের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত। আশা করি আপনারা সবাই তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন।
এই শীতে ভারতে ফিরছি—হরিদাস ভাইকে আর দেখতে পাব না ভেবে কী যে দুঃখ হচ্ছে, তা প্রকাশ করতে আমি অপারগ।
তিনি একজন দৃঢ়নিষ্ঠ উন্নতচরিত্র বন্ধু ছিলেন, তাঁকে হারিয়ে ভারতের খুবই ক্ষতি হল।
শিগ্গির ইংলণ্ডে যাচ্ছি—গ্রীষ্মকালটা সেখানে কাটাবার ইচ্ছা, আর পরের শীতকালে ভারতে যাব।
আপনার পিতৃব্য ও বন্ধুদের আমার কথা জানাবেন।
আপনার পরিবারবর্গের চির শুভানুধ্যায়ী
বিবেকানন্দ
পুনঃ—আমার ইংলণ্ডের ঠিকানাঃ কেয়ার অব ই.টি.স্টার্ডি এস্কোয়ার, হাই ভিউ, কেভার্শ্যাম, রীডিং, ইংলণ্ড।
…………………………..
৩২৪ক*
[‘লাইট অব দ্য-ইষ্ট’ পত্রিকার সম্পাদককে লিখিত]*
প্রিয় মহাশয়,
‘লাইট অব দ্য-ইষ্ট’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা অনুগ্রহ করে আমাকে পাঠানর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। পত্রিকাটির সম্পূর্ণ সাফল্য কামনা করি।
যেহেতু পত্রিকাটির উন্নতিকল্পে আপনি আমার পরামর্শ চেয়েছেন আমি খোলাখুলি বলি, একাজে আমার আজীবন অভিজ্ঞতায় আমি সব সময়ে দেখেছি যে অলৌকিকের চর্চা ক্ষতিকর, তা মানুষকে দুর্বল করে। আমাদের যা চাই তা হল শক্তি। অন্যান্য জাতির চেয়ে ভারতবাসী—আমাদের বেশী দরকার বলিষ্ঠ তেজস্বী চিন্তার। সর্ববিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মের অনুশীলন আমাদের যথেষ্ট হয়েছে। যুগ যুগ ধরে আমাদের ভেতরে রহস্যময় বস্তু ঠেসে পোরা হয়েছে। তার ফলে, আমাদের বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক পরিপাকশক্তি এমনভাবে নষ্ট হয়ে গেছে যা প্রায় চিকিৎসার অসাধ্য এবং জাতিটাকে অকর্মণ্য মানসিক জড়তার এমন এক নিম্নস্তরে টেনে নামান হয়েছে যার অভিজ্ঞতা এর আগে বা পরে অন্য কোন সভ্য সমাজকে লাভ করতে হয়নি। একটা বলশালী জাতি গড়ে তুলতে হলে তার পেছনে তরতাজা ও বলিষ্ঠ চিন্তা থাকা দরকার।[তা] আছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপনিষদের মধ্যে, যা সারা পৃথিবীকে শক্তিশালী করতে পারে। অদ্বৈতবাদ হচ্ছে শক্তির শাশ্বত আকর। কিন্তু তাকে কাজে লাগান দরকার। প্রথমে বেদান্তকে পণ্ডিতীর কঠিন আবরণ থেকে মুক্ত করতে হবে; তারপরে তার সমস্ত সরলতা সৌন্দর্য ও ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়েও তা প্রয়োগ করে দেশের সর্বত্র শিক্ষা দিতে হবে। ‘এটা একটা বিরাট কাজের ফরমাশ’, কিন্তু তাহলেও, যেন আগামী কালই একাজ নিষ্পন্ন হবে এভাবে এই উদ্দেশ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।’ একটা বিষয়ে আমি সুনিশ্চিতঃ যে কেউ অকপট ভালবাসা দিয়ে, নিঃস্বার্থপর হয়ে মানুষের সেবা করতে চায় সে অসাধ্য সাধন করতে পারবে।
ইতি
আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
…………………………..
৩৩০ক*
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
(দার্জিলিঙ থেকে লেখা)
আলমবাজার মঠ, কলকাতা
২৬ মার্চ, ১৮৯৭
প্রিয় মিসেস বুল,
আমাকে নিয়ে জাতীয় উল্লাস-উদ্দীপনা প্রদর্শন শেষ হয়েছে; অন্ততঃ আমাকে সে সব সংক্ষেপে সারতে হয়েছে, যেহেতু আমার স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়েছিল। পশ্চিমে একটানা খাটুনি ও ভারতে এক মাস প্রচণ্ড পরিশ্রমের পরিণাম বাঙালীর ধাতে—বহুমূত্র রোগ। এ একটি বংশগত শত্রু এবং বড়জোর কয়েক বছরের মধ্যে এই রোগে আমার দেহাবসান পূর্বনির্দিষ্ট। শুধু মাংস খাওয়া, জল একেবারে না খাওয়া এবং সর্বোপরি, মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ বিশ্রামই, বোধ হয়, জীবনের মেয়াদ বাড়াবার একমাত্র উপায়। মগজটাকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম আমি দিচ্ছি, দার্জিলিঙে যেখান থেকে এখন আপনাকে চিঠি লিখছি।
সারদানন্দের সাফল্যের খবর পেয়ে আমি খুব খুশী হয়েছি। তাকে আমার আন্তরিক ভালবাসা জানাবেন এবং তাকে অত্যধিক কাজ করতে দেবেন না। বাঙালীর শরীর মার্কিনদের মত নয়।
শ্রীযুক্ত চট্টোপাধ্যায় (মোহিনী) কলিকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এবং খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেন। আপনার প্রেরিত বার্তা তাঁকে দিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে কাজ করতে বেশ আগ্রহী। আর বেশী কিছু লেখবার নেই, আমি শুধু আমার মঠটি চালু করতে দৃঢ়সংকল্প এবং সে কাজ সারা হওয়া মাত্র আমি আবার আমেরিকায় আসব।
প্রসঙ্গতঃ গার্টুড অর্চাড (Gertrude Orchard) নামে ইংলণ্ডের এক মহিলাকে আপনার কাছে পাঠাব। তিনি গৃহশিক্ষিকার কাজ করেছেন, কিন্তু ললিতকলাদিতে তাঁর ব্যুৎপত্তি আছে এবং আমার ইচ্ছে, তিনি আমেরিকায় গিয়ে ভাগ্যপরীক্ষা করে দেখুন। আপনার ও মিসেস (ফ্লোরেন্স) এ্যাডাম্স-এর উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি তাঁকে দেব।
মিসেস এ্যাডাম্স, মিস থার্সবী, মিস ফার্মার (মহীয়সী ভগিনী) এবং অন্যান্য সুহৃদ্গণকে আমার ভালবাসা জানাবেন।
আপনি আমার অসীম প্রীতি ও চিরকৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
আপনার স্নেহের
বিবেকানন্দ
…………………………..
৩৩১ক*
[লালা বদ্রী শাহকে লিখিত]
দার্জিলিঙ
৭ এপ্রিল, ১৮৯৭
প্রিয় লালাজী,
এইমাত্র তারযোগে আপনার সহৃদয় আমন্ত্রণ পেলাম। বোধহয় আপনি ইতোমধ্যে শুনেছেন যে আমি মারাত্মক বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়েছি।
তাতে আমাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল এবং আমাকে ছুটতে হল দার্জিলিঙে—এ জায়গায় খুব ঠাণ্ডা এবং এই রোগের পক্ষে হিতকর বলে।
সেই থেকে আমি অনেক ভাল বোধ করছি এবং ডাক্তাররা চান না যে আমি ঘোরাফেরা করি, কেন না তাতে রোগ আবার বাড়বে। আমার স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা যদি মাস দুয়েক চলে তাহলে মনে হয় আমি সমতল ভূমিতে নেমে আসতে সমর্থ হব এবং আপনাদের সকলের সঙ্গে দেখা করতে আলমোড়ায় যেতে পারব। আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি বলে আমি বিশেষ দুঃখিত। কিন্তু আপনি বুঝছেন, এছাড়া গত্যন্তর ছিল না; শরীরটা আমার আয়ত্বে ছিল না।
আপনি ও আলমোড়ার অন্যান্য সব বন্ধুরা আমার ভালবাসা জানবেন।
ইতি
আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দঃ
…………………………..
৩৪৮ক*
[কলম্বোর মিঃ টি.শোকনাথনকে লিখিত]*
আলমোড়া
৩০ জুন, ১৮৯৭
প্রিয় বন্ধু,
সিংহলে (অধুনা শ্রীলঙ্কা) থাকার সময়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সে অনুসারে পত্রবাহক স্বামী শিবানন্দকে সেখানে পাঠান হল। যে কাজ তাঁর তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত হবে তিনি তার বিশেষ উপযুক্ত, অবশ্য আপনার সহৃদয় সহায়তা পেলে।
আশা করি আপনি তাঁকে সিংহলের অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেবেন। ইতি
সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ
…………………………..
১১৫*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
… আমি ক্রমাগত এক স্থান থেকে অপর স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সর্বদা কাজ করছি, বক্তৃতা দিচ্ছি, ক্লাস করছি এবং লোককে নানা রকমে বেদান্ত শিক্ষা দিচ্ছি।
আমি যে বই লেখবার সঙ্কল্প করেছিলাম, এখনও তার এক পঙ্ক্তি লিখতে পারিনি। সম্ভবতঃ পরে এ কাজ হাতে নিতে পারব। এখানে উদার মতাবলম্বীদের মধ্যে আমি কতকগুলি পরম বন্ধু পেয়েছি, গোঁড়া খ্রীষ্টানদের মধ্যেও কয়েক জনকে পেয়েছি, আশা করি, শীঘ্রই ভারতে ফিরব। এ দেশ তো যথেষ্ট ঘাঁটা হল, বিশেষতঃ অতিরিক্ত পরিশ্রম আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে। সাধারণের সমক্ষে বিস্তর বক্তৃতা করায় এবং একস্থানে স্থিরভাবে না থেকে ক্রমাগত তাড়াতাড়ি এখান থেকে সেখানে ঘোরার দরুন এই দুর্বলতা এসেছে। … সুতরাং বুঝছ আমি শীঘ্রই ফিরছি। কতকগুলি লোকের আমি খুব প্রিয় হয়ে উঠেছি, আর তাদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে; তারা অবশ্যই চাইবে, আমি বরাবর এখানে থেকে যাই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে—খবরের কাগজে নাম বেরনো এবং সর্বসাধারণের ভেতর কাজ করার দরুন ভুয়ো লোকমান্য তো যথেষ্ট হল—আর কেন? আমার ও-সবের একদম ইচ্ছা নেই।
… কোন দেশের অধিকাংশ লোকই কখনও কেবল সহানুভূতিবশে লোকের উপকার করে না। খ্রীষ্টানদের দেশে কতকগুলি লোক যে সৎকার্যে অর্থব্যয় করে, অনেক সময়ে তার ভেতর কোন মতলব থাকে, কিম্বা নরকের ভয়ে ঐরূপ করে থাকে। আমাদের বাঙলাদেশে যেমন চলিত কথায় বলে, ‘জুতো মেরে গরু দান।’ এখানে সেই রকম দানই বেশী! সর্বত্র তাই। আবার আমাদের জাতের তুলনায় পাশ্চাত্যেরা অধিকতর কৃপণ। আমি অন্তরের সহিত বিশ্বাস করি যে, এশিয়াবাসীরা জগতের সকল জাতের চেয়ে বেশী দানশীল জাত, তবে তারা যে বড় গরীব।
কয়েক মাস আমি নিউ ইয়র্কে বাস করবার জন্য যাচ্ছি। ঐ শহরটি সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রের যেন মাথা, হাত ও ধনভাণ্ডারস্বরূপ; অবশ্য বোষ্টনকে ‘ব্রাহ্মণের শহর’ (বিদ্যাচর্চাবহুল স্থান) বলে বটে। আমেরিকায় হাজার হাজার লোক রয়েছে, যারা আমার প্রতি সহানুভূতি করে থাকে। … নিউ ইয়র্কের লোকগুলির খুব খোলা মন। সেখানে আমার কতকগুলি বিশিষ্ট গণ্যমান্য বন্ধু আছেন। দেখি, সেখানে কি করতে পারা যায়। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, এই বক্তৃতা-ব্যবসায়ে আমি দিন দিন বিরক্ত হয়ে পড়ছি। পাশ্চাত্যদেশের লোকের পক্ষে ধর্মের উচ্চাদর্শ বুঝতে এখনও বহুদিন লাগবে। টাকাই হল এদের সর্বস্ব। যদি কোন ধর্মে টাকা হয়, রোগ সেরে যায়, রূপ হয়, দীর্ঘ জীবনলাভের আশা হয়, তবেই সকলে সেই ধর্মের দিকে ঝুঁকবে, নতুবা নয়। … বালাজী, জি. জি এবং আমাদের বন্ধুবর্গের সকলকে আমার আন্তরিক ভালবাসা জানাবে।
তোমাদের প্রতি চিরপ্রেমসম্পন্ন
বিবেকানন্দ
…………………………..
১১৬*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় কিডি,
তোমার এত শীঘ্র সংসারত্যাগের সংকল্প শুনে আমি বড়ই দুঃখিত হলাম। ফল পাকলে আপনি গাছ থেকে পড়ে যায়; অতএব সময়ের অপেক্ষা কর; তাড়াতাড়ি করো না। বিশেষ, কোন আহাম্মকি কাজ করে অপরকে কষ্ট দেবার অধিকার কারও নেই। সবুর কর, ধৈর্য ধরে থাক, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
বালাজী, জি. জি. ও আমাদের অপর সকল বন্ধুকে আমার বিশেষ ভালবাসা জানাবে। তুমিও অনন্তকালের জন্য আমার ভালবাসা জানবে।
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………..
১১৭*
[মঠের সকলকে লক্ষ্য করিয়া স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
২৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
কল্যাণবরেষু,
তোমাদের কয়েকখানা পত্র পাইলাম। শশী প্রভৃতি যে ধূমক্ষেত্র মাচাচ্চে, এতে আমি বড়ই খুশী। ধূমক্ষেত্র মাচাতে হবে, এর কম চলবে না। কুছ পরোয়া নেই। দুনিয়াময় ধূমক্ষেত্র মোচে যাবে, ‘বাহ গুরুকা ফতে!’ আরে দাদা ‘শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি’ (ভাল কাজে অনেক বিঘ্ন হয়), ঐ বিঘ্নের গুঁতোয় বড়লোক তৈরী হয়ে যায়। চারু কে, এখন বুঝতে পেরেছি; তাকে আমি ছেলেমানুষ দেখে এসেছি কিনা, তাই ঠাওরে উঠতে পারিনি। তাকে আমার অনেক আশীর্বাদ। বলি মোহন, মিশনরী-ফিশনরীর কর্ম কি এ ধাক্কা সামলায়? এখন মিশনরীর ঘরে বাঘ সেঁধিয়েছে। এখানকার দিগ্গজ দিগ্গজ পাদ্রীতে ঢের চেষ্টা-বেষ্টা করলে—এ গিরিগোবর্ধন টলাবার যো কি। মোগল পাঠান হদ্দ হল, এখন কি তাঁতীর কর্ম ফার্সি পড়া? ও সব চলবে না ভায়া, কিছু চিন্তা করো না। সকল কাজেই একদল বাহবা দেবে, আর একদল দুষমনাই করবে। আপনার কার্য করে চলে যাও—কারুর কথার জবাব দেবার আবশ্যক কি? ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতং, সত্যেনৈব পন্থা বিততো দেবযানঃ।’১গুরুপ্রসন্নবাবুকে এক পত্র লিখিতেছি। টাকার ভাবনা নাই, মোহন। সব হবে ধীরে ধীরে।
এ দেশে গরমীর দিনে সকলে দরিয়ার কিনারায় যায়—আমিও গিয়েছিলাম, অবশ্য পরের স্কন্ধে। এদের নৌকা আর জাহাজ চালাবার বড়ই বাতিক। ইয়াট বলে ছোট ছোট জাহাজ ছেলে-বুড়ো যার পয়সা আছে, তারই একটা আছে। তাইতে পাল তুলে দরিয়ায় যায় আর ঘরে আসে, খায় দায়—নাচে কোঁদে—গান বাজনা তো দিবারাত্র। পিয়ানোর জ্বালায় ঘরে তিষ্ঠাবার যো নাই।
ঐ যে G. W. Hale (হেল)-এর ঠিকানায় চিঠি দাও, তাদের কথা কিছু বলি। হেল আর তার স্ত্রী, বুড়ো-বুড়ী। আর দুই মেয়ে, দুই ভাইঝি, এক ছেলে। ছেলে রোজগার করতে দোসরা জায়গায় থাকে। মেয়েরা ঘরে থাকে। এদের দেশে মেয়ের সম্বন্ধেই সম্বন্ধ। ছেলে বে করে পর হয়ে যায়—মেয়ের স্বামী ঘন ঘন স্ত্রীর বাপের বাড়ী যায়। এরা বলে—
‘Son is son till he gets a wife
The daughter is daughter all her life.’২
চারজনেই যুবতী—বে থা করেনি। বে হওয়া এদেশে বড়ই হাঙ্গাম। প্রথম মনের মত বর চাই। দ্বিতীয় পয়সা চাই। ছোঁড়া বেটারা ইয়ারকি দিতে বড়ই মজবুত—ধরা দেবার বেলা পগার পার। ছুঁড়ীরা নেচে কুঁদে একটা স্বামী যোগাড় করে, ছোঁড়া বেটারা ফাঁদে পা দিতে বড়ই নারাজ। এই রকম করতে করতে একটা ‘লভ্’ হয়ে পড়ে—তখন সাদি হয়। এই হল সাধারণ—তবে হেলের মেয়েরা রূপসী, বড়মানষের ঝি, ইউনিভার্সিটি ‘গার্ল’ (বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী)—নাচতে গাইতে পিয়ানো বাজাতে অদ্বিতীয়া—অনেক ছোঁড়া ফেঁ ফেঁ করে—তাদের বড় পসন্দয় আসে না। তারা বোধ হয় বে থা করবে না—তার উপর আমার সংস্রবে ঘোর বৈরিগ্যি উপস্থিত। তারা এখন ব্রহ্মচিন্তায় ব্যস্ত।
মেরী আর হ্যারিয়েট হল মেয়ে, আর এক হ্যারিয়েট আর ইসাবেল হল ভাইঝি। মেয়ে দুইটির চুল সোনালী অর্থাৎ [তারা] ব্লণ্ড, আর ভাইঝি দুটি brunette [ব্রানেট] অর্থাৎ কালো চুল। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—এরা সব জানে। ভাইঝিদের তত পয়সা নেই—তারা একটা Kindergarten School (কিণ্ডারগার্টেন স্কুল) করে, মেয়েরা কিছু রোজগার করে না। এদের দেশের অনেক মেয়ে রোজগার করে। কেউ কারুর উপর নির্ভর করে না। ক্রোড়পতির ছেলেও রোজগার করে, তবে বে করে, আর আপনার বাড়ী ভাড়া করে থাকে। মেয়েরা আমাকে দাদা বলে, আমি তাদের মাকে মা বলি। আমার মালপত্র সব তাদের বাড়ীতে—আমি যেখানেই কেন যাই না। তারা সব ঠিকানা করে। এদেশের ছেলেরা ছোটবেলা থেকেই রোজগার করতে যায়, আর মেয়েরা ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শেখে—তাইতে করে একটা সভায় দেখবে যে 90 per cent. (শতকরা ৯০ জন) মেয়ে। ছোঁড়ারা তাদের কাছে কলকেও পায় না।
এদেশে ভূতুড়ে অনেক। মিডিয়ম (Medium) হল যে ভূত আনে। মিডিয়ম একটা পর্দার আড়ালে যায়, আর পর্দার ভেতর থেকে ভূত বেরুতে আরম্ভ করে—বড় ছোট, হর-রঙের। আমি গোটাকতক দেখলাম বটে, কিন্তু ঠকবাজি বলেই বোধ হল। আর গোটাকতক দেখে তবে ঠিক সিদ্ধান্ত করব। ভূতুড়েরা অনেকে আমাকে শ্রদ্ধাভক্তি করে।
দোসরা হচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ান সায়ান্স—এরাই হচ্চে আজকালকার বড় দল—সর্ব ঘটে। বড়ই ছড়াচ্ছে—গোঁড়া বেটাদের বুকে শেল বিঁধছে। এরা হচ্চে বেদান্তী অর্থাৎ গোটাকতক অদ্বৈতবাদের মত যোগাড় করে তাকে বাইবেলের মধ্যে ঢুকিয়েছে আর ‘সোঽহং সোঽহং’ বলে রোগ ভাল করে দেয়—মনের জোরে। এরা সকলেই আমাকে বড় খাতির করে।
আজকাল গোঁড়া বেটাদের ত্রাহি-ত্রাহি এদেশে। Devil worship৩ আর বড় একখানা চলছে না। আমাকে বেটারা যমের মত দেখে। বলে, কোথা থেকে এ বেটা এল, রাজ্যির মেয়ে-মদ্দ ওর পিছু পিছু ফেরে—গোঁড়ামির জড় মারবার যোগাড়ে আছে। আগুন ধরে গেছে বাবা! গুরুর কৃপায় যে আগুন ধরে গেছে, তা নিববার নয়। কালে গোঁড়াদের দম নিকলে যাবে। কি বাঘ ঘরে ঢুকিয়েছেন, তা বাছাধনেরা টের পাচ্ছেন। থিওসফিষ্টদের জোর বড় একটা নাই। তবে তারাও গোঁড়াদের খুব পিছু লেগে আছে।
এই ক্রিশ্চিয়ান সায়ান্স ঠিক আমাদের কর্তাভজা। বল ‘রোগ নেই’—বস্, ভাল হয়ে গেল, আর বল্ ‘সোঽহং’, বস্—ছুটি, চরে খাওগে। দেশ ঘোর materialist (জড়বাদী)। এই ক্রিশ্চিয়ান দেশের লোক—ব্যামো ভাল কর, আজগুবি কর; পয়সার রাস্তা হয়, তবে ধর্ম মানে—অন্য কিছু বড় বোঝে না। তবে কেউ কেউ বেশ আছে। যত বেটা দুষ্টু বজ্জাত, ঠক-জোচ্চোর মিশনরীরা তাদের ঘাড় ভাঙে আর তাদের পাপ মোচন করে। … এরা আমাতে এক নূতন ডৌলের মানুষ দেখেছে। গোঁড়া বেটাদের পর্যন্ত আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে, আর এখন সকলে বড়ই ভক্তি করছে—বাবা ব্রহ্মচর্যের চেয়ে কি আর বল আছে?
আমি এখন মান্দ্রাজীদের Address (অভিনন্দন), যা এখানকার সব কাগজে ছেপে ধূমক্ষেত্র মোচে গিয়েছিল, তারই জবাব লিখতে ব্যস্ত। যদি সস্তা হয় তো ছাপিয়ে পাঠাব, যদি মাগগি হয় তো type-writing (টাইপ) করে পাঠিয়ে দেব। তোমাদেরও এক কপি পাঠাব—‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ ছাপিয়ে দিও।
এদেশের অবিবাহিত মেয়েরা বড়ই ভাল, তারা ভয় ডর করে। … এরা হল বিরোচনের জাত। শরীর হল এদের ধর্ম, তাই মাজা, তাই ঘষা—তাই নিয়ে আছে। নখ কাটবার হাজার যন্ত্র, চুল কাটবার দশ হাজার, আর কাপড়-পোষাক গন্ধ-মসলার ঠিক-ঠিকানা কি! … এরা ভাল মানুষ, দয়াবান্ সত্যবাদী। সব ভাল, কিন্তু ঐ যে ‘ভোগ’, ঐ ওদের ভগবান্—টাকার নদী, রূপের তরঙ্গ, বিদ্যার ঢেউ, বিলাসের ছড়াছড়ি।
কাঙ্ক্ষন্তঃ কর্মণাং সিদ্ধিং যজন্ত ইহ দেবতাঃ।
ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধির্ভবতি কর্মজা॥—গীতা, ৪।১২
অদ্ভুত তেজ আর বলের বিকাশ—কি জোর, কি কার্যকুশলতা, কি ওজস্বিতা! হাতীর মত ঘোড়া—বড় বড় বাড়ীর মত গাড়ী টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এইখান থেকেই শুরু ঐ ডৌল সব। মহাশক্তির বিকাশ—এরা বামাচারী। তারই সিদ্ধি এখানে, আর কি! যাক—এদের মেয়ে দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম বাবা! আমাকে যেন বাচ্ছাটির মত ঘাটে-মাঠে দোকান-হাটে নিয়ে যায়। সব কাজ করে—আমি তার সিকিও করতে পারিনি। এরা রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী, আমি এদের পুষ্যিপুত্তুর, এরা সাক্ষাৎ জগদম্বা; বাবা! এদের পূজা করলে সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। আরে রাম বল, আমরা কি মানুষের মধ্যে? এই রকম মা জগদম্বা যদি ১০০০ আমাদের দেশে তৈরী করে মরতে পারি, তবে নিশ্চিত হয়ে মরব। তবে তোদের দেশের লোক মানুষের মধ্যে হবে। তোদের পুরুষগুলো এদের মেয়েদের কাছে ঘেঁষবার যুগ্যি নয়—তোদের মেয়েদের কথাই বা কি! হরে হরে, আরে বাবা, কি মহাপাপী! ১০ বৎসরের মেয়ের বর যুগিয়ে দেয়। হে প্রভু, হে প্রভু! কিমধিকমিতি—
আমি এদের এই আশ্চর্যি মেয়ে দেখি। একি মা জগদম্বার কৃপা! একি মেয়ে রে বাবা! মদ্দগুলোকে কোণে ঠেলে দেবার যোগাড় করেছে। মদ্দগুলো হাবুডুবু খেয়ে যাচ্ছে। মা তোরই কৃপা। গোলাপ-মা যা করেছে, তাতে আমি বড়ই খুশী। গোলাপ-মা বা গৌর-মা তাদের মন্ত্র দিয়ে দিক্ না কেন? মেয়ে-পুরুষের ভেদটার জড় মেরে তবে ছাড়ব। আত্মাতে কি লিঙ্গভেদ আছে নাকি? দূর কর মেয়ে আর মদ্দ, সব আত্মা। শরীরাভিমান ছেড়ে দাঁড়া। বলো ‘অস্তি অস্তি’; ‘নাস্তি নাস্তি’ করে দেশটা গেল! সোঽহং সোঽহং শিবোঽহং। কি উৎপাত! প্রত্যেক আত্মাতে অনন্ত শক্তি আছে; ওরে হতভাগাগুলো, নেই নেই বলে কি কুকুর বেড়াল হয়ে যাবি নাকি? কিসের নেই? কার নেই? শিবোঽহং শিবোঽহং। নেই নেই শুনলে আমার মাথায় যেন বজ্র মারে। রাম রাম, গরু তাড়াতে তাড়াতে জন্ম গেল! ঐ যে ছুঁচোগিরি, ‘দীনাহীনা’ ভাব—ও হল ব্যারাম। ও কি দীনতা? ও গুপ্ত অহঙ্কার! ন লিঙ্গং ধর্মকারণং, সমতা সর্বভূতেষু এতন্মুক্তস্য লক্ষণম্। অস্তি অস্তি অস্তি, সোঽহং, সোঽহং চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহং। ‘নির্গচ্ছতি জগজ্জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী’৪। ছুঁচোগিরি করবি তো চিরকাল পড়ে থাকতে হবে। ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’৫। শশী, তুই কিছু মনে করিস না—আমি সময়ে সময়ে nervous (দুর্বল) হয়ে পড়ি, দু-কথা বলে দিই। আমায় জানিস তো? তুই যে গোঁড়ামিতে নাই, তাতে আমি বড়ই খুশী। Avalanche৬ এর মত দুনিয়ার উপর পড়—দুনিয়া ফেটে যাক চড় চড় করে, হর হর মহাদেব। ‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানম্’ (আপনিই আপনাকে উদ্ধার করবে)।
রামদয়ালবাবু আমাকে এক পত্র লেখেন, আর তুলসীরামের এক পত্র পাইয়াছি। পলিটিক্যাল বিষয় তোমরা কেউ ছুঁয়ো না, এবং তুলসীরামবাবু যেন পলিটিক্যাল পত্র না লেখে। এখন পাবলিক ম্যান, অনর্থক শত্রু বাড়াবার দরকার নাই। তবে যদি পুলিশ-ফুলিশ পেছনে লাগে তোদের—‘দাঁড়িয়ে জান দে’। ওরে বাপ, এমন দিন কি হবে যে, পরোপকারায় জান যাবে? ওরে হতভাগারা, এ দুনিয়া ছেলেখেলা নয়—বড় লোক তাঁরা, যাঁরা আপনার বুকের রক্ত দিয়ে রাস্তা তৈরী করেন। এই হয়ে আসছে চিরকাল। একজন আপনার শরীর দিয়ে সেতু বানায়, আর হাজার লোক তার উপর দিয়ে নদী পার হয়। এবমস্তু, এবমস্তু, শিবোঽহং, শিবোঽহং (এইরূপই হউক, আমিই শিব)। রামদয়ালবাবুর কথামত ১০০ ফটোগ্রাফ পাঠিয়ে দেব। তিনি বেচতে চান। টাকা আমাকে পাঠাতে হবে না, মঠে দিতে বলো। আমার এখানে ঢের টাকা আছে, কোন অভাব নাই—ইওরোপ বেড়াবার আর পুঁথিপত্র ছাপাবার জন্য। এ চিঠি ফাঁস করিস না।
আশীর্বাদক
নরেন্দ্র
এইবার কাজ ঠিক চলবে, আমি দেখতে পাচ্ছি। Nothing succeeds as success (কৃতকার্যতা যে সাফল্য এনে দেয়, আর কিছু তা পারে না)। বলি শশী, তুমি ঘর জাগাও—এই তোমার কাজ। … কালী হোক business manager (বিষয়কার্যের পরিচালক)। মা-ঠাকুরাণীর জন্য একটা জায়গা খাড়া করতে পারলে তখন আমি অনেকটা নিশ্চিন্তি। বুঝতে পারিস? দুই তিন হাজার টাকার মত একটা জায়গা দেখ। জায়গাটা বড় চাই। আপাততঃ মেটে ঘর, কালে তার উপর অট্টালিকা খাড়া হয়ে যাবে। যত শীঘ্র পার জায়গা দেখ। আমাকে চিঠি লিখবে। কালীকৃষ্ণবাবুকে জিজ্ঞাসা করবে, কি রকম করে টাকা পাঠাতে হয়—Cook-এর দ্বারা কি প্রকারে। যত শীঘ্র পার ঐ কাজটা হওয়া চাই। ঐটি হলে বস্, আদ্দেক হাঁপ ছাড়ি। জায়গাটা বড় চাই, তারপর দেখা যাবে। আমাদের জন্য চিন্তা নাই, ধীরে ধীরে সব হবে। কলিকাতার যত কাছে হয় ততই ভাল। একবার জায়গা হলে মা-ঠাকুরাণীকে centre (কেন্দ্র) করে গৌর-মা, গোলাপ-মা একটা বেডোল হুজুক মাচিয়ে দিক্। মান্দ্রাজে হুজুক খুব মেচেছে, ভাল কথা বটে।
তোমাদের একটা কিনা কাগজ ছাপাবার কথা ছিল, তার কি খবর? সকলের সঙ্গে মিশতে হবে, কাউকে চটাতে হবে না। All the powers of good against all the powers of evil৭—এই হচ্ছে কথা। বিজয়বাবুকে খাতির-যত্ন যথোচিত করবে। Do not insist upon everybody’s believing in our Guru.৮
আমি গোলাপ-মাকে একটা আলাদা পত্র লিখছি, পৌঁছে দিও। এখন তলিয়ে বুঝ—শশী ঘর ছেড়ে যেতে পারবে না; কালী বিষয়কার্য দেখবে আর চিঠিপত্র লিখবে। হয় সারদা, নয় শরৎ, নয় কালী—এদের সকলে একেবারে বাইরে না যায়—একজন যেন মঠে থাকে। তারপর যারা বাইরে যাবে, তারা যে-সকল লোক আমাদের সঙ্গে sympathy (সহানুভূতি) করবে, তাদের সঙ্গে মঠের যেন যোগ করে দেয়। কালী তাদের সঙ্গে correspondence (পত্রব্যবহার) রাখবে। একটা খবরের কাগজ তোমাদের edit (সম্পাদন) করতে হবে, আদ্দেক বাঙলা, আদ্দেক হিন্দী—পার তো আর একটা ইংরেজীতে। পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছ—খবরের কাগজের subscriber (গ্রাহক) সংগ্রহ করতে ক-দিন লাগে? যারা বাহিরে আছে, subscriber (গ্রাহক) যোগাড় করুক। গুপ্ত৯—হিন্দী দিকটা লিখুক, বা অনেক হিন্দী লিখবার লোক পাওয়া যাবে। মিছে ঘুরে বেড়ালে চলবে না। যে যেখানে যাবে, সেইখানেই একটা permanent (স্থায়ী) টোল পাততে হবে। তবে লোক change (পরিবর্তিত) হতে থাকবে। আমি একটা পুঁথি লিখছি—এটা শেষ হলেই এক দৌড়ে ঘর আর কি! আর আমি বড় nervous (দুর্বল) হয়ে পড়েছি—কিছুদিন চুপ করে থাকার বড় দরকার। মান্দ্রাজীদের সঙ্গে সর্বদা correspondence (পত্রব্যবহার) রাখবে ও জায়গায় জায়গায় টোল খোলবার চেষ্টা করবে। বাকী বুদ্ধি তিনি দিবেন। সর্বদা মনে রেখো যে, পরমহংসদেব জগতের কল্যাণের জন্য এসেছিলেন—নামের বা মানের জন্য নয়। তিনি যা শেখাতে এসেছিলেন, তাই ছড়াও। তাঁর নামের দরকার নেই—তাঁর নাম আপনা হতে হবে। ‘আমার গুরুজীকে মানতেই হবে’ বললেই দল বাঁধবে, আর সব ফাঁস হয়ে যাবে—সাবধান! সকলকেই মিষ্টি বচন—চটলে সব কাজ পণ্ড হয়। যে যা বলে বলুক, আপনার গোঁয়ে চলে যাও—দুনিয়া তোমার পায়ের তলায় আসবে, ভাবনা নেই। বলে—একে বিশ্বাস কর, ওকে বিশ্বাস কর; বলি, প্রথমে আপনাকে বিশ্বাস কর দিকি। Have faith in yourself, all power is in you. Be conscious and bring it out১০—বল্, আমি সব করতে পারি। ‘নেই নেই বললে সাপের বিষ নেই হয়ে যায়।’ খবরদার, No ‘নেই নেই’ (নেই নেই নয়); বল্—‘হাঁ হাঁ,’ ‘সোঽহং সোঽহং’।
কিন্নাম রোদিষি সখে ত্বয়ি সর্বশক্তিঃ
আমন্ত্রয়স্ব ভগবন্ ভগদং স্বরূপম্।
ত্রৈলোক্যমেতদখিলং তব পাদমূলে
আত্মৈব হি প্রভবতে ন জড়ঃ কদাচিৎ॥১১
মহা হুঙ্কারের সহিত কার্য আরম্ভ করে দাও। ভয় কি? কার সাধ্য বাধা দেয়? কুর্মস্তারকচর্বণং ত্রিভুবনমুৎপাটয়ামো বলাৎ। কিং ভো ন বিজানাস্যম্মান্—রামকৃষ্ণদাসা বয়ম্।১২ ডর? কার ডর? কাদের ডর?
ক্ষীণাঃ স্ম দীনাঃ সকরুণা জল্পন্তি মূঢ়া জনাঃ
নাস্তিক্যস্ত্বিদন্তু অহহ দেহাত্মবাদাতুরাঃ।
প্রাপ্তাঃ স্ম বীরা গতভয়া অভয়ং প্রতিষ্ঠাং যদা
আস্তিক্যস্ত্বিদন্তু চিনুমঃ রামকৃষ্ণদাসা বয়ম্॥
পীত্বা পীত্বা পরমপীযূষং বীতসংসাররাগাঃ
হিত্বা হিত্বা সকলকলহপ্রাপিণীং স্বার্থসিদ্ধিম্।
ধ্যাত্বা ধ্যাত্বা শ্রীগুরুচরণং সর্বকল্যাণরূপং
নত্বা নত্বা সকলভবনং পাতুমামন্ত্রয়ামঃ॥
প্রাপ্তং যদ্বৈ ত্বনাদিনিধনং বেদোদধিং মথিত্বা
দত্তং যস্য প্রকরণে হরিহর ব্রহ্মাদিদেবৈর্বলম্।
পূর্ণং যত্তু প্রাণসারৈর্ভৌমনারায়ণানাং
রামকৃষ্ণস্তনুং ধত্তে তৎপূর্ণপাত্রমিদং ভোঃ॥১৩
ইংরেজী লেখাপড়া-জানা young men (যুবক)-দের ভিতর কার্য করতে হবে। ‘ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’ (ত্যাগের দ্বারাই অনেকে অমৃতত্ব লাভ করিয়াছেন)। ত্যাগ, ত্যাগ—এইটি খুব প্রচার করা চাই। ত্যাগী না হলে তেজ হবে না। কার্য আরম্ভ করে দাও। তোমরা যদি একবার গোঁ ভরে কার্য আরম্ভ করে দাও, তা হলে আমি বোধ হয় কিছুদিন বিরাম লাভ করতে পারি। তার জন্যই বোধ হয় কোথাও বসতে পারতুম না—এত হাঙ্গাম করতে হবে না কি? মান্দ্রাজ থেকে আজ অনেক খবর এল। মান্দ্রাজীরা তোলপাড়টা করছে ভাল। মান্দ্রাজের মিটিং-এর খবর সব ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ (Indian Mirror)-এ ছাপিয়ে দিও। আর কি অধিক লিখিব? সব খবর আমাকে খুঁটি-নাটি পাঠাবে। ইতি
বাবুরাম, যোগেন অত ভুগছে কেন?—‘দীনাহীনা’ ভাবের জ্বালায়। ব্যামো-ফ্যামো সব ঝেড়ে ফেলে দিতে বল—এক ঘণ্টার মধ্যে সব ব্যামো-ফ্যামো সেরে যাবে। আত্মাতে কি ব্যামো ধরে না কি? ছুট! ঘণ্টাভর বসে ভাবতে বল—‘আমি আত্মা—আমাতে আবার রোগ কি?’ সব চলে যাবে। তোমরা সকলে ভাব—‘আমরা অনন্ত বলশালী আত্মা’; দেখ দিকি কি বল বেরোয়। ‘দীনহীনা!’ কিসের ‘দীনহীনা’? আমি ব্রহ্মময়ীর বেটা! কিসের রোগ, কিসের ভয়, কিসের অভাব? ‘দীনহীনা’ ভাবকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় কর দিকি। সব মঙ্গল হবে। No negative, all positive, affirmative—I am, God is and everything is in me. I will manifest health, purity, knowledge, whatever I want.১৪আরে, এরা ম্লেচ্ছগুলো আমার কথা বুঝতে লাগল, আর তোমরা বসে বসে ‘দীনাহীনা’ ব্যামোয় ভোগো? কার ব্যামো—কিসের রোগ? ঝেড়ে ফেলে দে! বলে, ‘আমি কি তোমার মত বোকা?’ আত্মায় আত্মায় কি ভেদ আছে? গুলিখোর জল ছুঁতে বড় ভয় পায়। ‘দীনহীনা’ কি এইসি তেইসি—নেই মাঙ্গতা ‘দীনাক্ষীণা’! ‘বীর্যমসি বীর্যং, বলমসি বলম, ওজোঽসি ওজঃ, সহোঽসি সহো ময়ি ধেহি’।১৫ রোজ ঠাকুরপূজার সময় যে আসন প্রতিষ্ঠা—আত্মানম্ অচ্ছিদ্রং ভাবয়েৎ (আত্মাকে অচ্ছিদ্র ভাবনা করিবে)—ওর মানে কি? বল—আমার ভেতর সব আছে, ইচ্ছা হলে বেরুবে। তুমি নিজের মনে মনে বল, বাবুরাম যোগেন আত্মা—তারা পূর্ণ, তাদের আবার রোগ কি? বল ঘণ্টাখানেক দুচার দিন। সব রোগ বালাই দূর হয়ে যাবে। কিমধিকমিতি—
নরেন্দ্র
…………………………..
১১৮*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
হোটেল বেল ভিউ, ইওরোপীয়ান প্ল্যান
বীকন ষ্ট্রীট, বোষ্টন
২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪
প্রিয় মিসেস বুল,
আমি আপনার কৃপালিপি দুইখানিই পেয়েছি। আমাকে শনিবারে মেলরোজ ফিরে গিয়ে সোমবার পর্যন্ত সেখানে থাকতে হবে। মঙ্গলবার আপনার ওখানে যাব। কিন্তু ঠিক কোন্ জায়গাটায় আপনার বাড়ী আমি ভুলে গেছি; আপনি অনুগ্রহ করে যদি আমায় লেখেন। আমার প্রতি অনুগ্রহের জন্য আপনাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না—কারণ, আপনি যা দিতে চেয়েছেন, ঠিক সেই জিনিষটাই আমি খুঁজছিলাম—লেখবার জন্য একটা নির্জন জায়গা। অবশ্য আপনি দয়া করে যতটা জায়গা আমার জন্য দিতে চেয়েছেন, তার চেয়ে কম জায়গাতেই আমার চলে যাবে। আমি যেখানে হয় গুড়িসুড়ি মেরে পড়ে আরামে থাকতে পারব।
আপনার সদা বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
…………………………..
১১৯*
[ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
বোষ্টন
২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
ভারতের ডাক ও তোমার চিঠি এইমাত্র পেলাম। ভারত থেকে বেশ কিছু সংবাদপত্রের অংশ কেটে আমার কাছে পাঠান হয়েছে। তুমি সেগুলি পড়ে নিরাপদ স্থানে রেখে দেবে, তাই সেগুলি তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ভারতের চিঠি লেখার ব্যাপারে গত কয়েকদিন ধরে ব্যস্ত আছি। আরও দিন কয়েক বোষ্টনে থাকব। প্রীতি ও আশীর্বাদ।
সদা স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
…………………………..
১২০*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
… কলিকাতা থেকে আমার বক্তৃতা ও কথাবার্তা সম্বন্ধে যে-সব বই ছাপা হয়েছে, তাতে একটা জিনিষ আমি দেখতে পাচ্ছি। তাদের মধ্যে কতকগুলি এরূপভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যে, পড়লে বোধ হয় যেন আমি রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছি। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু আমি একজন রাজনীতিক নই, অথবা রাজনৈতিক আন্দোলনকারীও নই। আমার লক্ষ্য কেবল ভেতরের আত্মতত্ত্বের দিকে; সেইটি যদি ঠিক হয়ে যায়, তবে আর সবই ঠিক হয়ে যাবে—এই আমার মত। … অতএব তুমি কলিকাতার লোকদের অবশ্য অবশ্য সাবধান করে দেবে, যেন আমার কোন লেখা বা কথার ভেতর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মিথ্যা করে আরোপিত করা না হয়। কি আহাম্মকি! … শুনলাম, রেভারেণ্ড কালীচরণ বাঁড়ুয্যে নাকি খ্রীষ্টান মিশনরীদের সমক্ষে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, আমি একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধি। যদি সর্বসাধারণের সমক্ষে এ কথা বলা হয়ে থাকে, তবে আমার তরফ থেকে তাঁকে প্রকাশ্যে জিজ্ঞাসা করবে, তিনি কলিকাতার যে-কোন সংবাদপত্রে লিখে হয় তা প্রমাণ করুন, নতুবা তাঁর ঐ বাজে আহাম্মকি কথাটা প্রত্যাহার করুন। এটা অন্য ধর্মাবলম্বীকে অপদস্থ করবার খ্রীষ্টান মিশনরীদের একটা অপকৌশলমাত্র। আমি সাধারণভাবে খ্রীষ্টান-পরিচালিত শাসনতন্ত্রকে লক্ষ্য করে সরলভাবে সমালোচনার ছলে কয়েকটা কড়া কথা বলেছি। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, আমার রাজনৈতিক বা ঐ রকম কিছু চর্চার দিকে কিছু ঝোঁক আছে, অথবা রাজনীতি বা তৎসদৃশ কিছুর সঙ্গে আমার কোনরূপ সম্পর্ক আছে। যাঁরা ভাবেন, ঐ সব বক্তৃতা থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে ছাপান একটা খুব জমকাল ব্যাপার, আর যাঁরা প্রমাণ করতে চান যে আমি একজন রাজনৈতিক প্রচারক, তাঁদের আমি বলি, ‘হে ঈশ্বর, আমার বন্ধুদের হাত থেকে আমায় রক্ষা কর।’
… আমার বন্ধুগণকে বলবে, যাঁরা আমার নিন্দাবাদ করছেন, তাঁদের জন্য আমার একমাত্র উত্তর—একদম চুপ থাকা। আমি তাঁদের ঢিলটি খেয়ে যদি তাঁদের পাটকেল মারতে যাই, তবে তো আমি তাঁদের সঙ্গে এক দরের হয়ে পড়লুম। তাদের বলবে—সত্য নিজের প্রতিষ্ঠা নিজেই করবে, আমার জন্যে তাদের কারও সঙ্গে বিরোধ করতে হবে না। তাদের (আমার বন্ধুদের) এখনও ঢের শিখতে হবে, তারা তো এখনও শিশুতুল্য। তারা বালক—তারা এখনও আহাম্মকের মত সোনার স্বপন দেখছে!
… সাধারণের সহিত জড়িত এই বাজে জীবনে এবং খবরের কাগজের হুজুকে আমি একেবারে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। এখন প্রাণের ভেতর আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে—হিমালয়ের সেই শান্তিময় ক্রোড়ে ফিরে যাই।
তোমার প্রতি চিরস্নেহপূর্ণ
বিবেকানন্দ
…………………………..
১২১*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তুমি যে-সকল কাগজ পাঠাইয়াছিলে, তাহা যথাসময়ে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। আর এত দিনে তুমিও নিশ্চয় আমেরিকার কাগজে যে-সকল মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার কিছু কিছু পাইয়া থাকিবে। এখন সব ঠিক হইয়াছে। সর্বদা কলিকাতায় চিঠিপত্র লিখিবে। বৎস, এ পর্যন্ত তুমি সাহস দেখাইয়া আপনাকে গৌরবমণ্ডিত করিয়াছ। জি. জি-ও বড়ই অদ্ভুত ও সুন্দর কার্য করিয়াছে। হে আমার সাহসী নিঃস্বার্থ সন্তানগণ, তোমরা সকলেই বড় সুন্দর কার্য করিয়াছ। আমি তোমাদের কথা স্মরণ করিয়া বড়ই গৌরব অনুভব করিতেছি। ভারত তোমাদের লইয়া গৌরব অনুভব করিতেছে। তোমাদের যে খবরের কাগজ বাহির করিবার সঙ্কল্প ছিল, তাহা ছাড়িও না। খেতড়ির রাজা ও কাঠিয়াওয়াড়স্থ লিমডির ঠাকুর সাহেব—যাহাতে আমার কার্যের বিষয় সর্বদা সংবাদ পান, তাহা করিবে। আমি মান্দ্রাজ অভিনন্দনের একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর লিখিতেছি। যদি সস্তায় হয়, এখান হইতেই ছাপাইয়া পাঠাইয়া দিব, নতুবা টাইপ করিয়া পাঠাইয়া দিব। ভরসায় বুক বাঁধ—নিরাশ হইও না। এরূপ সুন্দরভাবে কার্য সম্পন্ন হওয়ার পর যদি আবার তোমার নৈরাশ্য আসে, তাহা হইলে তুমি মূর্খ। আমাদের কার্যের আরম্ভ যেরূপ সুন্দর হইয়াছে, আর কোন কার্যের আরম্ভ সেরূপ দেখা যায় না; আমাদের কার্য ভারতে ও তাহার বাহিরে যেরূপ দ্রুত বিস্তৃত হইয়াছে, এ পর্যন্ত ভারতে আর কোন আন্দোলন সেরূপ হয় নাই।
আমি ভারতের বাহিরে কোনরূপ প্রণালীবদ্ধ কার্য বা সভাসমিতি করিতে ইচ্ছা করি না। ঐরূপ করিবার কোন উপকারিতা বুঝি না। ভারতই আমাদের কার্যক্ষেত্র, আর বিদেশে আমাদের কার্য সমাদৃত হওয়ার এইটুকু মূল্য যে, উহাতে ভারত জাগিবে; এই পর্যন্ত। আমেরিকার ব্যাপারে ভারতে আমাদের কার্য করিবার অধিকার ও সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে। এখন ভাববিস্তারের জন্য আমাদের দৃঢ় ভিত্তির প্রয়োজন। মান্দ্রাজ ও কলিকাতা—এখন এই দুইটি কেন্দ্র হইয়াছে। অতি শীঘ্রই ভারতে আরও শত শত কেন্দ্র হইবে।
যদি পার তবে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র উভয়ই বাহির কর। আমার যে-সকল ভ্রাতা চারিদিকে ঘুরিতেছেন, তাঁহারা গ্রাহক সংগ্রহ করিবেন; আমিও অনেক গ্রাহক যোগাড় করিব এবং মধ্যে মধ্যে কিছু কিছু টাকা পাঠাইব। মুহূর্তের জন্যও বিচলিত হইও না, সব ঠিক হইয়া যাইবে।
আপনার গাঁটের ব্যথা এখন প্রায় সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়েছে জেনে খুব সুখী হলাম। দয়া করে আপনার ভাইকে আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জন্য মাপ করতে বলবেন। আমি এখানে কিছু সংস্কৃত বই পেয়েছি এবং অধ্যায়নের সাহায্যও জুটেছে। অন্যত্র এরূপ পাবার আশা নাই; সুতরাং শেষ করে যাবার আগ্রহ হয়েছে। কাল আপনার বন্ধু শ্রীযুক্ত মনঃসুখারামের সঙ্গে দেখা হল; তিনি তাঁর এক সন্ন্যাসী বন্ধুকে বাড়ীতে রেখেছেন। তিনি আমার প্রতি খুব সহৃদয়; তাঁর পুত্রও তাই।
ইচ্ছাশক্তিই জগৎকে পরিচালিত করিয়া থাকে। হে বৎস, যুবকগণ খ্রীষ্টান হইয়া যাইতেছে বলিয়া দুঃখিত হইও না। আমাদের নিজেদের দোষেই ইহা ঘটিতেছে।
এইমাত্র রাশীকৃত সংবাদপত্র ও পরমহংসদেবের জীবনী আসিল—আমি সমুদয় পড়িয়া তারপর আবার কলম ধরিতেছি। আমাদের সমাজে, বিশেষতঃ মান্দ্রাজে এখন যে প্রকার অযথা নিয়ম ও আচারবন্ধন রহিয়াছে, তাহাতে তাহারা ঐরূপ না হইয়াই বা করে কি? উন্নতির জন্য প্রথম চাই স্বাধীনতা। তোমাদের পূর্বপুরুষেরা আত্মার স্বাধীনতা দিয়াছিলেন, তাই (এদেশে) ধর্মের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও বিকাশ হইয়াছে। কিন্তু তাঁহারা দেহকে যতপ্রকার বন্ধনের মধ্যে ফেলিলেন, কাজে কাজেই সমাজের বিকাশ হইল না। পাশ্চাত্য দেশে ঠিক ইহার বিপরীত—সমাজে যথেষ্ট স্বাধীনতা, ধর্মে কিছুমাত্র নাই। ইহার ফলে তথায় ধর্ম নিতান্ত অপরিণত এবং সমাজ সুন্দর উন্নত হইয়া গড়িয়া উঠিয়াছে। এক্ষণে প্রাচ্যদেশীয় সমাজের চরণ হইতে বন্ধন-শৃঙ্খল ক্রমশঃ দূর হইতেছে, পাশ্চাত্যে ধর্মেরও ঠিক তাহাই হইতেছে। তোমাদিগকে অপেক্ষা করিতে হইবে এবং সহিষ্ণুতার সহিত কাজ করিয়া যাইতে হইবে।
প্রত্যেকের আদর্শ ভিন্ন ভিন্ন। ভারতের আদর্শ ধর্মমুখী বা অন্তর্মুখী, পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক বা বহির্মুখী। পাশ্চাত্য এতটুকু আধ্যাত্মিক উন্নতিও সমাজের উন্নতির ভিতর দিয়া করিতে চায়, আর প্রাচ্য এতটুকু সামাজিক শক্তিও আধ্যাত্মিকতার মধ্য দিয়া লাভ করিতে চায়।
এই জন্য আধুনিক সংস্কারকগণ প্রথমেই ভারতের ধর্মকে নষ্ট না করিয়া সংস্কারের আর কোন উপায় দেখিতে পান না। তাঁহারা উহার চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু বিফলমনোরথ হইয়াছেন। ইহার কারণ কি? কারণ—তাঁহাদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই তাঁহাদের নিজের ধর্ম উত্তমরূপে অধ্যয়ন ও আলোচনা করিয়াছেন; আর তাঁহাদের একজনও ‘সকল ধর্মের প্রসূতি’কে বুঝিবার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন, সেই সাধনার মধ্য দিয়া যান নাই! ঈশ্বরেচ্ছায় আমি এই সমস্যার মীমাংসা করিয়াছি বলিয়া দাবী করি। আমি দৃঢ়ভাবে বলিতেছি, হিন্দুসমাজের উন্নতির জন্য ধর্মকে নষ্ট করিবার কোন প্রয়োজন নাই এবং ধর্মের জন্যই যে সমাজের এই অবস্থা তাহা নহে, বরং ধর্মকে সামাজিক ব্যাপারে যেভাবে কাজে লাগান উচিত, তাহা হয় নাই বলিয়াই সমাজের এই অবস্থা। আমি আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রসমূহ হইতে ইহার প্রত্যেকটি কথা প্রমাণ করিতে প্রস্তুত। আমি ইহাই শিক্ষা দিতেছি, আর আমাদিগকে ইহা কার্যে পরিণত করিবার জন্য সারা জীবন চেষ্টা করিয়া যাইতে হইবে। কিন্তু ইহাতে সময় লাগিবে—অনেক সময় ও দীর্ঘকালব্যাপী আলোচনার প্রয়োজন। সহিষ্ণুতা অবলম্বন কর এবং কাজ করিয়া যাও। ‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানম্’।
আমি তোমাদের অভিনন্দনের উত্তর দিবার জন্য ব্যস্ত আছি। ইহা ছাপাইবার বিশেষ চেষ্টা করিবে। তা যদি সম্ভবপর না হয়, খানিকটা খানিকটা করিয়া ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ ও অন্যান্য কাগজে ছাপাইবে।
তোমাদেরই
বিবেকানন্দ
পুঃ—বর্তমান হিন্দুসমাজ কেবল আধ্যাত্মিকভাবাপন্ন মানুষের জন্য গঠিত এবং অন্য সকলকেই নির্দয়ভাবে পিষিয়া ফেলে। কেন? যাহারা সাংসারিক অসার বিষয়—যথা রূপরসাদি—একটু আধটু সম্ভোগ করিতে চায়, তাহারা কোথা যাইবে? তোমাদের ধর্ম যেমন উত্তম মধ্যম ও অধম—সকল প্রকার অধিকারীকেই গ্রহণ করিয়া থাকে, তোমাদের সমাজেরও তেমনি উচিত উচ্চ-নীচভাবাপন্ন সকলকে গ্রহণ করা। ইহার উপায়—প্রথমে তোমাদিগকে ধর্মের প্রকৃত তত্ত্ব বুঝিতে হইবে, পরে সামাজিক বিষয়ে উহা লাগাইতে হইবে। ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে এই কাজ করিতে হইবে। ইতি—
বি
…………………………..
১২২*
[হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
চিকাগো
সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
অনেক দিন হইল আপনার অনুগ্রহ-পত্র পাইয়াছি, কিন্তু লিখিবার মত কিছুই ছিল না বলিয়া উত্তর দিতে দেরী করিলাম। মিঃ হেল-এর নিকট লিখিত আপনার চিঠি খুবই সন্তোষজনক হইয়াছে, কারণ উহাদের নিকট আমার ঐটুকুই দেনা ছিল। আমি এ সময়টা এদেশের সর্বত্র ঘুরিয়া বেড়াইতেছি এবং সব কিছু দেখিতেছি, এবং তাহার ফলে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে একটি মাত্র দেশ আছে, যেখানে মানুষ ধর্ম কি বস্তু তাহা বোঝে—সে দেশ হইল ভারতবর্ষ। হিন্দুদিগের সকল দোষত্রুটি সত্ত্বেও তাহারা নৈতিক চরিত্র ও আধ্যাত্মিকতায় অন্যান্য জাতি অপেক্ষা বহু ঊর্ধ্বে; আর তাহার নিঃস্বার্থ সন্তানগণের যথাযোগ্য যত্ন চেষ্টা ও উদ্যমের দ্বারা পাশ্চাত্যের কর্মৈষণা ও তেজস্বিতার কিছু উপাদান হিন্দুদের শান্ত গুণাবলীর সহিত মিলিত করিলে—এ যাবৎ পৃথিবীতে যত প্রকার মানুষ দেখা গিয়াছে, তদপেক্ষা অনেক উৎকৃষ্ট ধরনের মানুষ আবির্ভূত হইবে।
কবে ভারতবর্ষে ফিরিতে পারিব, বলিতে পারি না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এদেশের যথেষ্ট আমি দেখিয়াছি, সুতরাং শীঘ্রই ইওরোপ রওনা হইতেছি—তারপর ভারতবর্ষ।
আপনার ও আপনার ভ্রাতৃমণ্ডলীর প্রতি আমার ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করিতেছি। ইতি—
আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
…………………………..
১২৩*
[মঠের সকলকে লক্ষ্য করিয়া স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
বাল্টিমোর, আমেরিকা
২২ অক্টোবর, ১৮৯৪
প্রেমাস্পদেষু,
তোমার১৬ পত্রপাঠে সকল সমাচার অবগত হইলাম। শ্রীমান অক্ষয়কুমার ঘোষের এক পত্র লণ্ডন নগর হইতে অদ্য পাইলাম, তাহাতেও অনেক বিষয় জ্ঞাত হইলাম।
তোমাদের Address from the Town Hall meeting (টাউন হলের সভা হইতে অভিনন্দন) এস্থানের খবরের কাগজে বাহির হইয়া গিয়াছে। একেবারে Telegraph (টেলিগ্রাফ) করিবার আবশ্যক ছিল না। যাহা হউক, সকল কার্য কুশলে সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে—এই পরম মঙ্গল। এ-সকল মিটিং ও Address-এর (অভিনন্দনের) প্রধান উদ্দেশ্য এদেশের জন্য নহে, কিন্তু ভারতবর্ষের জন্য। এক্ষণে তোমরা নিজেদের শক্তির পরিচয় পাইলে—Strike the iron while it is hot.১৭ মহাশক্তিতে কার্যক্ষেত্রে অবতরণ কর। কুঁড়েমির কাজ নয়। ঈর্ষা অহমিকাভাব গঙ্গার জলে জন্মের মত বিসর্জন দাও ও মহাবলে কাজে লাগিয়া যাও। বাকী প্রভু সব পথ দেখাইয়া দিবেন। মহা বন্যায় সমস্ত পৃথিবী ভাসিয়া যাইবে। মাষ্টার মহাশয় ও G. C. Ghosh (গিরিশচন্দ্র ঘোষ) প্রভৃতির দুই বৃহৎ পত্র পাইলাম। তাঁহাদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। But work, work, work (কিন্তু কাজ কর, কাজ কর, কাজ কর)—এই মূলমন্ত্র। আমি আর কিছু দেখিতে পাইতেছি না। এদেশে কার্যের বিরাম নাই—সমস্ত দেশ দাবড়ে বেড়াচ্ছি। যেখানে তাঁর তেজের বীজ পড়িবে, সেইখানেই ফল ফলিবে—অদ্য বা শতাব্দান্তে বা। কারুর সঙ্গেই বিবাদে আবশ্যক নাই। সকলের সঙ্গে সহানুভূতি করিয়া কার্য করিতে হইবে। তবে আশু ফল হইবে।
মীরাটের যজ্ঞেশ্বর মুখোপাধ্যায় এক পত্র লিখিয়াছেন। তোমাদের দ্বারা যদি তাঁহার কোন সহায়তা হয়, করিবে। জগতের হিত করা আমাদের উদ্দেশ্য, আপনাদের নাম বাজান উদ্দেশ্য নহে। যোগেন ও বাবুরাম বোধ হয় এত দিনে বেশ সারিয়া গিয়াছে। নিরঞ্জন বোধ হয় Ceylon (সিংহল) হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে। সে Ceylon (সিংহল)-এ পালি ভাষা শিক্ষা কেন না করে এবং বৌদ্ধগ্রন্থ অধ্যয়ন কেন না করে, তাহা তো বুঝিতে পারি না। অনর্থক ভ্রমণে কি ফল? এবারকার উৎসব এমন করিবে যে, ভারতে পূর্বে আর হয় নাই। এখন হইতেই তাহার উদ্যোগ কর এবং উক্ত উৎসবের মধ্যে অনেকেই হয়তো কিছু কিছু সহায়তা করিলে আমাদের একটা স্থান হইয়া যাইবে। সকল বড়লোকের কাছে যাতায়াত করিবে। আমি যে-সকল চিঠিপত্র লিখি বা আমার সম্বন্ধে যাহা খবরের কাগজে পাও, তাহা সমস্ত না ছাপাইয়া যাহা বিবাদশূন্য এবং রাজনীতি সম্বন্ধে নহে, তন্মাত্র ছাপাইবে।
পূর্বের পত্রে লিখিয়াছি যে, তোমরা মা-ঠাকুরাণীর জন্য একটা জায়গা স্থির করিয়া আমাকে পত্র লিখিবে। যত শীঘ্র পার। Businessman (কাজের লোক) হওয়া চাই, অন্ততঃ এক জনের। গোপালের এবং সাণ্ডেলের দেনা এখনও আছে কিনা এবং কত দেনা লিখিবে।
তাঁহার যাহারা শরণাগত, তাহাদের ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ পদতলে, মাভৈঃ মাভৈঃ। সকল হইবে ধীরে ধীরে। তোমাদের নিকট এই চাই—হামবড়া বা দলাদলি বা ঈর্ষা একেবারে জন্মের মত বিদায় করিতে হইবে। পৃথিবীর ন্যায় সর্বংসহ হইতে হইবে; এইটি যদি পার, দুনিয়া তোমাদের পায়ের তলায় আসিবে।
এবারকার জন্মোৎসবে বোধ হয় আমি যোগদান করিতে পারিব। আমি পারি বা না পারি, এখন হইতে তার সূত্রপাত করিলে তবে মহা উৎসব হইতে পারিবে। অধিক লোক একত্র হইলে খিচুড়ি প্রভৃতি বসাইয়া খাওয়ান বড়ই অসম্ভব ও খাওয়া দাওয়া করিতেই দিন যায়। এজন্য যদি অধিক লোক হয়, তাহা হইলে দাঁড়া-প্রসাদ, অর্থাৎ একটা সরাতে লুচি প্রভৃতি হাতে হাতে দিলেই যথেষ্ট হইবে। মহোৎসবাদিতে পেটের খাওয়া কম করিয়া মস্তিষ্কের খাওয়া কিছু দিতে চেষ্টা করিবে। যদি ২০ হাজার লোকে চারি আনা করিয়া দেয় তো ৫ হাজার টাকা উঠিয়া যায়। পরমহংসদেবের জীবন এবং তাঁহার শিক্ষা এবং অন্যান্য শাস্ত্র হইতে উপদেশ করিবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাঙলার গ্রামে গ্রামে প্রায় হরিসভা আছে। ঐগুলিকে ধীরে ধীরে লইতে হইবে—বুঝিতে পার কিনা? সর্বদা আমাকে পত্র লিখিবে। অধিক newspaper cutting (খবরের কাগজের অংশ) পাঠাইবার আবশ্যক নাই—অনেক হইয়াছে। ইতি—
বিবেকানন্দ
…………………………..
১২৪*
ওয়াশিংটন
২৩ অক্টোবর, ১৮৯৪
প্রিয় বিহিমিয়া চাঁদ,
আমি এদেশে বেশ ভাল আছি। এতদিনে আমি ইহাদের নিজেদের ধর্মাচার্যগণের মধ্যে একজন হইয়া দাঁড়াইয়াছি। ইহারা সকলে আমাকে এবং আমার উপদেশ পছন্দ করে। সম্ভবতঃ আমি আগামী শীতে ভারতে ফিরিব। আপনি বোম্বাইয়ে মিঃ গান্ধীকে জানেন কি? তিনি এখনও চিকাগোতেই আছেন। ভারতে যেমন আমার অভ্যাস ছিল, এখানেও সেইরূপ আমি সমস্ত দেশের ভিতর ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেছি। প্রভেদ এইটুকু যে, এখানে উপদেশ দিয়া, প্রচার করিয়া বেড়াইতেছি। সহস্র সহস্র ব্যক্তি খুব আগ্রহ ও যত্নের সহিত আমার কথা শুনিয়াছে। এদেশে থাকা খুব ব্যয়সাধ্য, কিন্তু প্রভু সর্বত্রই যোগাড় করিয়া দিতেছেন।
ওখানে (লিমডি, রাজপুতানায়) আমার সমস্ত বন্ধুদের ও আপনাকে ভালবাসা জানাইতেছি। ইতি
বিবেকানন্দ
…………………………..
১২৫*
[মিসেস হেলকে লিখিত]
১১২৫ সেণ্ট পল ষ্ট্রীট
বাল্টিমোর
অক্টোবর, ১৮৯৪
মা,
দেখুন, আমি কোথায় এসে পড়েছি। ‘চিকাগো ট্রিবিউনে’ ভারতের একটি টেলিগ্রাফ লক্ষ্য করেছেন কি? এখান থেকে যাব ওয়াশিংটন; সেখান থেকে ফিলাডেলফিয়া। তারপর নিউ ইয়র্ক। ফিলাডেলফিয়ায় আমাকে মিস মেরীর ঠিকানা পাঠাবেন। নিউ ইয়র্ক যাবার পথে তার সঙ্গে দেখা করে যাব। আশা করি এতদিনে আপনি নিরুদ্বেগ হয়েছেন।
আপনার স্নেহের
বিবেকানন্দ
…………………………..
১২৬*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
১৭০৩ ফার্ষ্ট ষ্ট্রীট
ওয়াশিংটন
প্রিয় ভগিনী,
তুমি অনুগ্রহ করে যে পত্র দুখানি লিখেছিলে সেগুলি পেয়েছি। আজ এখানে, কাল বাল্টিমোরে আমার বক্তৃতা হবে; পুনরায় সোমবার বাল্টিমোরে ও মঙ্গলবার এখানে। তার দিন কয়েক পরে যাচ্ছি ফিলাডেলফিয়া। ওয়াশিংটন থেকে যাবার দিন তোমাকে পত্র দেব। অধ্যাপক রাইটের সঙ্গে দেখা করবার জন্যই ফিলাডেলফিয়ায় মাত্র দিনকয়েক থাকব। ওখান থেকে নিউ ইয়র্ক। বার কয়েক নিউ ইয়র্ক—বোষ্টন দৌড়াদৌড়ি করে ডেট্রয়েট হয়ে চিকাগোয় যাব। তারপর প্রবীণ (Senator) পামার যেমন বলেন—‘সাঁ করে ইংলণ্ডে।’
‘ধর্মে’র ইংরেজী প্রতিশব্দ ‘রিলিজন্’। কলিকাতাবাসিগণ পেট্রোর প্রতি রূঢ় ব্যবহার করায় আমি খুব দুঃখিত। আমি এখানে বেশ সদ্ব্যবহার পেয়েছি, কাজও চমৎকার হচ্ছে। ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। কেবল ভারত থেকে বোঝা বোঝা সংবাদপত্র আসায় বিরক্ত হয়েছিলাম। ‘মাদার চার্চ’ ও মিসেস গার্নসিকে সেগুলি গাড়ী বোঝাই করে পাঠিয়ে দিয়ে ভারতে ওদের নিষেধ করে দিলাম, আর যেন সংবাদপত্র না পাঠায়। ভারতে খুব হইচই পড়ে গিয়েছে। আলাসিঙ্গা লিখেছে, দেশ জুড়ে গ্রামে গ্রামে আমার নাম রটেছে। ফলে পূর্বেকার যে শান্তি আর রইল না; এর পর আর কোথাও বিশ্রাম বা অবসর পাওয়া কঠিন। ভারতের এই সংবাদপত্রগুলি আমাকে শেষ না করে ছাড়বে না দেখছি। কবে কি খেয়েছি, কখন হেঁচেছি—সব কিছু ছাপাবে। অবশ্য বোকামি আমারই। প্রকৃতপক্ষে এখানে এসেছিলাম নিঃশব্দে কিছু অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে; কিন্তু ফাঁদে পড়ে গেছি, আর এখন চুপচাপ থাকতে পাব না। সকলে আনন্দে থাক।
তোমাদের স্নেহের
বিবেকানন্দ
…………………………..
১২৭*
[ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
১৭০৮ ডব্লিউ, ১ ষ্ট্রীট, ওয়াশিংটন
২৬ (?) অক্টোবর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
আমার দীর্ঘ নীরবতার জন্য ক্ষমা করো। ‘মাদার চার্চ’কে কিন্তু আমি নিয়মিত চিঠি লিখে যাচ্ছি। তোমরা সকলে নিশ্চয়ই সুন্দর শীতল আবহাওয়া উপভোগ করছ। আমিও বাল্টিমোর ও ওয়াশিংটনকে খুব উপভোগ করছি। এখান থেকে ফিলাডেলফিয়া যাব। আমার ধারণা ছিল মিস মেরী ফিলাডেলফিয়ায় আছে; সুতরাং আমি তার ঠিকানা চেয়েছিলাম। কিন্তু সে ফিলাডেলফিয়ার কাছাকাছি অন্য কোন জায়গায় আছে। তাই মাদার চার্চের কথামত সে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার কষ্ট স্বীকার করুক, এ আমি চাই না।
যে মহিলাটির কাছে আমি আছি, তাঁর নাম মিস টটন, মিস হাউ-এর এক ভাইঝি। এখন এক সপ্তাহ তাঁর অতিথি হয়ে থাকব। সুতরাং তুমি তাঁর ঠিকানায় চিঠি লিখতে পার।
এই শীতে জানুআরী-ফেব্রুআরীর কোন এক সময়ে আমার ইংলণ্ডে যাবার ইচ্ছা। লণ্ডনের এক মহিলার কাছে আমার এক বন্ধু আছেন। মহিলাটি তাঁর আতিথ্যগ্রহণের জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ওদিকে ফিরে যাবার জন্য ভারত থেকে প্রতিদিন তাগিদ দিচ্ছে।
কার্টুনে পিটুকে কেমন লাগল? কাউকে কিন্তু দেখিও না। পিটুকে নিয়ে এইভাবে তামাশা করা কিন্তু আমাদের দেশের লোকের অন্যায়। তোমার কাছ থেকে চিঠি পেতে সব সময় আমার কত না আগ্রহ; দয়া করে যদি লেখাকে আর একটু স্পষ্ট করার পরিশ্রম করো। দোহাই, এই প্রস্তাবে চটে যেও না যেন।
তোমার সদা স্নেহময় ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………..
১২৮*
ওয়াশিংটন
২৭ অক্টোবর, ১৮৯৪
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনি অনুগ্রহ করে আমায় মিঃ ফ্রেডারিক ডগলাসের নামে যে পরিচয়পত্র দিয়েছেন, সেজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বাল্টিমোরে এক হোটেলওয়ালার নিকট আমি যে দুর্ব্যবহার পেয়েছি, সেজন্য আপনি দুঃখিত হবেন না। যেমন সর্বত্রই হয়েছে, এখানেও তেমনি—আমেরিকার নারীগণ আমাকে এই বিপদ হতে উদ্ধার করেছিলেন, তারপর আমি বেশ স্বচ্ছন্দে ছিলাম। এখানে মিসেস টটনের বাড়ীতে বাস করছি। ইনি আমার চিকাগোর জনৈক বন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্রী। সুতরাং সব দিকেই বেশ সুবিধা হচ্ছে। ইতি
বিবেকানন্দ
…………………………..
১২৯*
ওয়াশিংটন
২৭ অক্টোবর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমার শুভ আশীর্বাদ জানিবে। এতদিনে তুমি নিশ্চয়ই আমার অপর পত্রখানি পাইয়াছ। আমি কখনও কখনও তোমাদিগকে কড়া চিঠি লিখি, সেজন্য কিছু মনে করিও না। তোমাদিগের সকলকে আমি কতদূর ভালবাসি, তাহা তুমি ভালরূপই জান।
তুমি অনেকবার আমি কোথায় কোথায় ঘুরিতেছি, কি করিতেছি, তাহার সমুদয় বিবরণ ও আমার বক্তৃতাগুলির সংক্ষিপ্ত আভাস জানিতে চাহিয়াছ। মোটামুটি জানিয়া রাখ, ভারতেও যাহা করিতাম, এখানে ঠিক তাহাই করিতেছি। ভগবান্ যেখানে লইয়া যাইতেছেন, সেখানেই যাইতেছি—পূর্ব হইতে সঙ্কল্প করিয়া আমার কোন কার্য হয় না। আরও একটি বিষয় স্মরণ রাখিও, আমাকে অবিশ্রান্ত কার্য করিতে হয়, সুতরাং আমার চিন্তারাশি একত্র করিয়া পুস্তকাকারে গ্রথিত করিবার অবসর নাই। এত বেশী কাজ রাতদিন করিতে হইতেছে যে, আমার স্নায়ুগুলি দুর্বল হইয়া পড়িতেছে—আমি ইহা বেশ বুঝিতে পারিতেছি। ভারত হইতে যথেষ্ট কাগজপত্র আসিয়াছে, আর আবশ্যক নাই। তুমি এবং মান্দ্রাজের অন্যান্য বন্ধুগণ আমার জন্য যে নিঃস্বার্থভাবে কঠোর পরিশ্রম করিয়াছ, তাহার জন্য তোমাদের নিকট আমি যে কি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ, তাহা বলিতে পারি না। তবে ইহা জানিয়া রাখ, তোমরা যাহা করিয়াছ, তাহার উদ্দেশ্য আমার নাম বাজান নহে; তোমাদের শক্তি সম্বন্ধে তোমাদিগকে সজাগ করাই ইহার উদ্দেশ্য। সংগঠন-কার্যে আমি পটু নই; ধ্যানধারণা ও অধ্যয়নের উপরই আমার ঝোঁক। আমার মনে হয়, যথেষ্ট কাজ করিয়াছি—এখন একটু বিশ্রাম করিতে চাই। আমি এক্ষণে আমার গুরুদেবের নিকট হইতে যাহা পাইয়াছি, তাহাই লোককে একটু শিক্ষা দিব। তোমরা এখন জানিয়াছ, তোমরা কি করিতে পার। মান্দ্রাজের যুবকগণ, তোমরাই প্রকৃতপক্ষে সব করিয়াছ—আমি তো নামমাত্র নেতা! আমি সংসারত্যাগী (অনাসক্ত সন্ন্যাসী); আমি কেবল একটি জিনিষ চাই। যে ধর্ম বা যে ঈশ্বর বিধবার অশ্রুমোচন করিতে পারে না অথবা অনাথ শিশুর মুখে একমুঠো খাবার দিতে পারে না, আমি সে ধর্মে বা সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। যত উচ্চ মতবাদ হউক, যত সুবিন্যস্ত দার্শনিক তত্ত্বই উহাতে থাকুক, যতক্ষণ উহা মত বা পুস্তকেই আবদ্ধ, ততক্ষণ উহাকে আমি ‘ধর্ম’ নাম দিই না। চক্ষু আমাদের পৃষ্ঠের দিকে নয়, সামনের দিকে—অতএব সম্মুখে অগ্রসর হও, আর যে ধর্মকে তোমরা নিজের ধর্ম বলিয়া গৌরব কর, তাহার উপদেশগুলি কার্যে পরিণত কর—ঈশ্বর তোমাদিগের সাহায্য করুন।
আমার উপর নির্ভর করিও না, নিজেদের উপর নির্ভর করিতে শেখ। আমি যে সর্বসাধারণের ভিতর একটা উৎসাহ উদ্দীপিত করিবার উপলক্ষ হইয়াছি, ইহাতে আমি নিজেকে সুখী মনে করি। এই উৎসাহের সুযোগ লইয়া অগ্রসর হও—এই উৎসাহস্রোতে গা ঢালিয়া দাও, সব ঠিক হইয়া যাইবে।
হে বৎস, যথার্থ ভালবাসা কখনও বিফল হয় না। আজই হউক, কালই হউক, শত শত যুগ পরেই হউক, সত্যের জয় হইবেই, প্রেমের জয় হইবেই। তোমরা কি মানুষকে ভালবাস? ঈশ্বরের অন্বেষণে কোথায় যাইতেছ? দরিদ্র, দুঃখী, দুর্বল—সকলেই কি তোমার ঈশ্বর নহে? অগ্রে তাহাদের উপাসনা কর না কেন? গঙ্গাতীরে বাস করিয়া কূপ খনন করিতেছ কেন? প্রেমের সর্বশক্তিমত্তায় বিশ্বাস কর। নামযশের ফাঁকা চাকচিক্যে কি হইবে? খবরের কাগজে কি বলে না বলে, আমি সে দিকে লক্ষ্য করি না। তোমার হৃদয়ে প্রেম আছে তো? তবেই তুমি সর্বশক্তিমান্। তুমি সম্পূর্ণ নিষ্কাম তো? তাহাই যদি হও, তবে তোমার শক্তি কে রোধ করিতে পারে? চরিত্রবলে মানুষ সর্বত্রই জয়ী হয়। ঈশ্বরই তাঁহার সন্তানগণকে সমুদ্রগর্ভে রক্ষা করিয়া থাকেন! তোমাদের মাতৃভূমি বীর সন্তান চাহিতেছেন—তোমরা বীর হও। ঈশ্বর তোমাদিগকে আশীর্বাদ করুন। সকলেই আমাকে ভারতে আসিতে বলিতেছে। তাহারা মনে করে, আমি গেলে তাহারা বেশী কাজ করিতে পারিবে। বন্ধু, তাহারা ভুল বুঝিয়াছে। আজকাল যে উৎসাহ দেখা যাইতেছে, ইহা একটু স্বদেশহিতৈষণা মাত্র—ইহাতে কোন কাজ হইবে না। যদি উহা খাঁটি হয়, তবে দেখিবে অল্পকালের মধ্যেই শত শত বীর অগ্রসর হইয়া কার্যে লাগিয়া যাইবে। অতএব জানিয়া রাখ যে, তোমরাই সব করিয়াছ, ইহা জানিয়া আরও কার্য করিতে থাক, আমার দিকে তাকাইও না।
অক্ষয় এখন লণ্ডনে আছে—সে লণ্ডনে মিস মূলারের নিকট যাইবার জন্য আমাকে একখানি সুন্দর নিমন্ত্রণপত্র লিখিয়াছে। বোধ হয়, আগামী জানুআরী বা ফেব্রুআরীতে লণ্ডন যাইব। ভট্টাচার্য আমাকে ভারতে যাইতে লিখিতেছেন। এস্থান প্রচারের উপযুক্ত ক্ষেত্র। বিভিন্ন মতবাদ লইয়া কি করিব? আমি ভগবানের দাস। উচ্চ উচ্চ তত্ত্ব প্রচার করিবার উপযুক্ত ক্ষেত্র এদেশ অপেক্ষা আর কোথায় পাইব? এখানে যদি একজন আমার বিরুদ্ধে থাকে তো শত শত জন আমায় সাহায্য করিতে প্রস্তুত। এখানে মানুষ মানুষের জন্য ভাবে, নিজের ভ্রাতাদের জন্য কাঁদে, আর এখানকার মেয়েরা দেবীর মত। মূর্খদিগকেও যদি প্রশংসা করা যায়, তবে তাহারাও কার্যে অগ্রসর হয়। যদি সব দিকে সুবিধা হয়, তবে অতি কাপুরুষও বীরের ভাব ধারণ করে। কিন্তু প্রকৃত বীর নীরবে কার্য করিয়া চলিয়া যান। একজন বুদ্ধ জগতে প্রকাশিত হইবার পূর্বে কত শত বুদ্ধ নীরবে জীবন দিয়া গিয়াছেন!
প্রিয় বৎস আলাসিঙ্গা, আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি, মানুষকে বিশ্বাস করি; দুঃখী দরিদ্রকে সাহায্য করা, পরের সেবার জন্য নরকে যাইতে প্রস্তুত হওয়া—আমি খুব বড় কাজ বলিয়া বিশ্বাস করি। পাশ্চাত্যগণের কথা কি বলিব, তাহারা আমাকে খাইতে দিয়াছে, পরিতে দিয়াছে, আশ্রয় দিয়াছে, তাহারা আমার সহিত পরম বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করিয়াছে—খুব গোঁড়া খ্রীষ্টান পর্যন্ত। তাহাদের একজন পাদ্রী যদি ভারতে যায়, আমাদের দেশের লোক তাহার সহিত কিরূপ ব্যবহার করে? তোমরা তাহাদিগকে স্পর্শ পর্যন্ত কর না, তাহারা যে ম্লেচ্ছ!!! বৎস, কোন ব্যক্তি—কোন জাতিই অপরকে ঘৃণা করিলে জীবিত থাকিতে পারে না। যখনই ভারতবাসীরা ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দ আবিষ্কার করিল ও অপর জাতির সহিত সর্ববিধ সংস্রব পরিত্যাগ করিল, তখনই ভারতের অদৃষ্টে ঘোর সর্বনাশের সূত্রপাত হইল। তোমরা ভারতেতর দেশবাসীদের প্রতি উক্ত ভাবপোষণ সম্বন্ধে বিশেষ সাবধান হইও। বেদান্তের কথা ফস্ ফস্ মুখে আওড়ান খুব ভাল বটে, কিন্তু উহার একটি ক্ষুদ্র উপদেশও কার্যে পরিণত করা কি কঠিন!
আমি শীঘ্রই এখান হইতে চলিয়া যাইতেছি, সুতরাং এখানে আর খবরের কাগজ পাঠাইবার প্রয়োজন নাই। প্রভু তোমাকে চিরদিনের জন্য আশীর্বাদ করুন।
তোমাদের চিরকল্যাণাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
পুঃ—দুইটি জিনিষ হইতে বিশেষ সাবধান থাকিবে—ক্ষমতাপ্রিয়তা ও ঈর্ষা। সর্বদা আত্মবিশ্বাস অভ্যাস করিতে চেষ্টা কর। ইতি
বি
…………………………..
১৩০*
[শ্রীযুক্ত হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
চিকাগো
১৫ নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার অনুগ্রহ লিপি পাইয়াছি। আপনি যে এখানেও আমাকে স্মরণ করিয়াছেন, তাহা আপনার সৌজন্যের নিদর্শন। আপনার বন্ধু নারায়ণ হেমচন্দ্রের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় নাই। তিনি বর্তমানে আমেরিকায় নাই বলিয়াই আমার বিশ্বাস। আমি এখানে বহু চমকপ্রদ এবং অপূর্ব দৃশ্যাদি দেখিয়াছি।
আপনার ইওরোপে আসিবার বিশেষ সম্ভাবনা আছে জানিয়া সুখী হইলাম। যে প্রকারেই হউক এ সুযোগ অবশ্য গ্রহণ করিবেন। জগতের অন্যান্য জাতি হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকাই আমাদের অধঃপতনের হেতু এবং পুনর্বার সকলের সহিত একযোগে জগতের জীবনধারায় ফিরিয়া যাইতে পারিলেই সে অবস্থার প্রতিকার হইবে। গতিই তো জীবন। আমেরিকা একটি অদ্ভুত দেশ। দরিদ্র ও স্ত্রীজাতির পক্ষে এদেশ যেন স্বর্গের মত। এদেশে দরিদ্র একরূপ নাই বলিলেই চলে এবং অন্য কোথাও মেয়েরা এদেশের মেয়েদের মত স্বাধীন শিক্ষিত ও উন্নত নহে। সমাজে উহারাই সব।
ইহা এক অপূর্ব শিক্ষা। সন্ন্যাসজীবনের কোন ধর্ম—এমন কি দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি জিনিষগুলি পর্যন্ত আমাকে পরিবর্তিত করিতে হয় নাই, অথচ এই অতিথিবৎসল দেশে প্রত্যেকটি গৃহদ্বারই আমার জন্য উন্মুক্ত। যে প্রভু ভারতবর্ষে আমাকে পরিচালিত করিয়াছেন, তিনি কি আর এখানে আমাকে পরিচালিত করিবেন না? তিনি তো করিতেছেনই! একজন সন্ন্যাসীর এদেশে আসিবার কী প্রয়োজন ছিল, আপনি হয়তো তাহা বুঝিতে পারেন না, কিন্তু ইহার প্রয়োজন ছিল। জগতের নিকট আপনাদের পরিচয়ের একমাত্র দাবী—ধর্ম, এবং সেই ধর্মের পতাকাবাহী যথার্থ খাঁটি লোক ভারতের বাহিরে প্রেরণ করিতে হইবে, আর তাহা হইলেই ভারতবর্ষ যে আজও বাঁচিয়া আছে, এ কথা জগতের অন্যান্য জাতি বুঝিতে পারিবে।
বস্তুতঃ যথার্থ প্রতিনিধিস্থানীয় কিছু লোকের এখন ভারতের বাহিরে জগতের অন্যান্য দেশে যাইয়া ইহা প্রতিষ্ঠা করা উচিত যে, ভারতবাসীরা বর্বর কিম্বা অসভ্য নহে। ঘরে বসিয়া হয়তো আপনারা ইহার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করিতে পারিবেন না, কিন্তু আপনাদের জাতীয় জীবনের জন্য ইহার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে—আমার এ-কথা বিশ্বাস করুন।
যে সন্ন্যাসীর অন্তরে অপরের কল্যাণ-সাধন-স্পৃহা বর্তমান নাই, সে সন্ন্যাসীই নহে—সে তো পশুমাত্র!
আমি অলস পর্যটক নহি, কিম্বা দৃশ্য দেখিয়া বেড়ানও আমার পেশা নহে। যদি বাঁচিয়া থাকেন, তবে আমার কার্যকলাপ দেখিতে পাইবেন এবং আজীবন আমাকে আশীর্বাদ করিবেন।
দ্বিবেদী মহাশয়ের প্রবন্ধ ধর্মমহাসভার পক্ষে অত্যন্ত দীর্ঘ হওয়ায় উহাকে কাটিয়া ছাঁটিয়া ছোট করিতে হইয়াছিল। ধর্মমহাসভায় আমি কিছু বলিয়াছিলাম এবং তাহা কতটা ফলপ্রসূ হইয়াছিল তাহার নিদর্শনস্বরূপ আমার হাতের কাছে যে দু-চারিটি দৈনিক ও মাসিক পত্রিকা পড়িয়া আছে, তাহা হইতেই কিছু কিছু কাটিয়া পাঠাইতেছি। নিজের ঢাক নিজে পিটান আমার উদ্দেশ্য নহে, কিন্তু আপনি আমাকে স্নেহ করেন, সেই সূত্রে আপনার নিকট বিশ্বাস করিয়া আমি এ-কথা অবশ্য বলিব যে, ইতোপূর্বে কোন হিন্দু এদেশে এরূপ প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই এবং আমার আমেরিকা আগমনে যদি অন্য কোন কাজ নাও হইয়া থাকে, আমেরিকাবাসিগণ অন্ততঃ এটুকু উপলব্ধি করিয়াছে যে, আজও ভারতবর্ষে এমন মানুষের আবির্ভাব হইয়া থাকে, যাঁহাদের পাদমূলে বসিয়া জগতের সর্বাপেক্ষা সভ্য জাতিও ধর্ম এবং নীতি শিক্ষা লাভ করিতে পারে। আর হিন্দুজাতি যে একজন সন্ন্যাসীকে প্রতিনিধিরূপে এদেশে প্রেরণ করিয়াছিল, তাহার সার্থকতা উহাতেই যথেষ্টরূপে সাধিত হইয়াছে বলিয়া কি আপনার মনে হয় না? বিস্তারিত বিবরণ বীরচাঁদ গান্ধীর নিকট অবগত হইবেন।
কয়েকটি পত্রিকা হইতে অংশবিশেষ আমি নিয়ে উদ্ধৃত করিতেছিঃ
‘সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার অনেকগুলিই বিশেষ বাগ্মিতাপূর্ণ হইয়াছিল সত্য, কিন্তু হিন্দু সন্ন্যাসী ধর্মমহাসভার মূল নীতি ও উহার সীমাবদ্ধতা যেরূপ সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন, অন্য কেহই তাহা করিতে পারে নাই। তাঁহার বক্তৃতার সবটুকু আমি উদ্ধৃত করিতেছি এবং শ্রোতৃবৃন্দের উপর উহার প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বলিতে পারি যে, দৈবশক্তিসম্পন্ন বক্তা তিনি এবং তাঁহার অকপট উক্তিসমূহ যে মধুর ভাষার মধ্য দিয়া তিনি প্রকাশ করেন, তাহা তদীয় গৈরিক বসন এবং বুদ্ধিদীপ্ত দৃঢ় মুখমণ্ডল অপেক্ষা কম আকর্ষণীয় নয়।’— (নিউ ইয়র্ক ক্রিটিক)
ঐ পৃষ্ঠাতেই পুনর্বার লিখিত আছেঃ
‘তাঁহার শিক্ষা, বাগ্মিতা এবং মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব আমাদের সম্মুখে হিন্দু সভ্যতার এক নূতন ধারা উন্মুক্ত করিয়াছে। তাঁহার প্রতিভাদীপ্ত মুখমণ্ডল, গম্ভীর ও সুললিত কণ্ঠস্বর স্বতই মানুষকে তাঁহার দিকে আকৃষ্ট করে এবং ঐ বিধিদত্ত সম্পদসহায়ে এদেশের বহু ক্লাব ও গীর্জায় প্রচারের ফলে আজ আমরা তাঁর মতবাদের সহিত পরিচিত হইয়াছি। কোন প্রকার নোট প্রস্তুত করিয়া তিনি বক্তৃতা করেন না। কিন্তু নিজ বক্তব্য বিষয়গুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করিয়া অপূর্ব কৌশল ও ঐকান্তিকতা সহকারে তিনি মীমাংসায় উপনীত হন এবং অন্তরের গভীর প্রেরণা তাঁহার বাগ্মিতাকে অপূর্বভাবে সার্থক করিয়া তোলে।’
‘ধর্মমহাসভায় বিবেকানন্দই অবিসংবাদিরূপে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁহার বক্তৃতা শুনিয়া আমরা বুঝিতেছি যে, এই শিক্ষিত জাতির মধ্যে ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করা কত নির্বুদ্ধিতার কাজ।’—(হের্যাল্ড, এখানকার শ্রেষ্ঠ কাগজ)
আর অধিক উদ্ধৃত করিলাম না, পাছে আমায় দাম্ভিক বলিয়া মনে করেন। কিন্তু আপনাদের বর্তমান অবস্থা প্রায় কূপমণ্ডূকের মত হইয়াছে বলিয়া এবং বহির্জগতে কোথায় কি ঘটিতেছে, তাহার দিকে দৃষ্টি দিবার মত অবস্থা আপনাদের নাই দেখিয়া এটুকু লেখা প্রয়োজন বোধ করিয়াছি। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে আপনার কথা বলিতেছি না—আপনাকে মহাপ্রাণ বলিয়া জানি, কিন্তু জাতির সর্বসাধারণের পক্ষে আমার উক্তি প্রযোজ্য।
আমি ভারতবর্ষে যেমন ছিলাম এখানেও ঠিক তেমনি আছি, কেবল এই বিশেষ উন্নত ও মার্জিত দেশে যথেষ্ট সমাদর ও সহানুভূতি লাভ করিতেছি—যাহা আমাদের দেশের নির্বোধগণ স্বপ্নেও চিন্তা করিতে পারে না। আমাদের দেশে সাধুকে এক টুকরা রুটি দিতেও সবাই কুণ্ঠিত হয় আর এখানে একটি বক্তৃতার জন্য এক হাজার টাকা দিতেও সকলে প্রস্তুত; এবং যে উপদেশ ইহারা লাভ করিল, তাহার জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ থাকে।
এই অপরিচিত দেশের নরনারী আমাকে যতটুকু বুঝিতে পারিতেছে, ভারতবর্ষে কেহ কখনও ততটুকু বোঝে নাই। আমি ইচ্ছা করিলে এখন এখানে পরম আরামের মধ্যে জীবন কাটাতেই পারি, কিন্তু আমি সন্ন্যাসী এবং সমস্ত দোষত্রুটি সত্ত্বেও ভারতবর্ষকে ভালবাসি। অতএব দু-চারি মাস পরেই দেশে ফিরিতেছি এবং যাহারা কৃতজ্ঞতার ধারও ধারে না, তাহাদের মধ্যে পূর্বের মত নগরে নগরে ধর্ম ও উন্নতির বীজ বপন করিতে থাকিব।
আমেরিকার জনসাধারণ ভিন্নধর্মাবলম্বী হইয়াও আমার প্রতি যে সহায়তা সহানুভূতি শ্রদ্ধা ও আনুকূল্য দেখাইয়াছে, তাহার সহিত আমার নিজ দেশের স্বার্থপরতা অকৃতজ্ঞতা ও ভিক্ষুক-মনোবৃত্তির তুলনা করিয়া আমি লজ্জা অনুভব করি এবং সেই জন্যই আপনাকে বলি যে, দেশের বাহিরে আসিয়া অন্যান্য দেশ দেখুন এবং নিজ অবস্থার সহিত তুলনা করুন।
এখন, এই-সকল উদ্ধৃত অংশ পাঠ করিবার পর, ভারতবর্ষ হইতে একজন সন্ন্যাসী এদেশে প্রেরণ করা সমীচীন হইয়াছে বলিয়া আপনার মনে হয় কি?
অনুগ্রহপূর্বক এই চিঠি প্রকাশ করিবেন না। ভারতবর্ষে থাকিতেও যেমন, এখানেও ঠিক তেমনি—অপকৌশল দ্বারা নাম করাকে আমি ঘৃণা করি।
আমি প্রভুর কার্য করিয়া যাইতেছি এবং তিনি যেথায় লইয়া যাইবেন সেখানেই যাইব। ‘মূকং করোতি বাচালং’ ইত্যাদি—যাঁহার কৃপা মূককে বাচাল করে, পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করায়, তিনিই আমাকে সাহায্য করিবেন। আমি মানুষের সাহায্যের অপেক্ষা রাখি না। যদি প্রভুর ইচ্ছা হয়, তবে ভারতবর্ষে কিম্বা আমেরিকায় কিম্বা উত্তর মেরুতে সর্বত্র তিনিই আমাকে সাহায্য করিবেন। আর যদি তিনি সাহায্য না করেন, তবে অন্য কেহই করিতে পারিবে না। চিরকাল প্রভুর জয় হউক। ইতি
আশীর্বাদক
আপনাদের বিবেকানন্দ
…………………………..
১৩১*
৫৪১, ডিয়ারর্বন এভিনিউ, চিকাগো
নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী,
আপনার পত্র পাইয়া বিশেষ প্রীতিলাভ করিয়াছি। পরিহাস আমি ঠিকই বুঝিতে পারি, কিন্তু আমি ক্ষুদ্র শিশুটি নই যে, উহাতেই নিরস্ত হইব।
সংগঠন ও সংযোগশক্তিই পাশ্চাত্য জাতিগুলির সাফল্যের হেতু; আর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, সহযোগিতা ও সহায়তা দ্বারাই ইহা সম্ভব হইয়া থাকে। … জৈনধর্মাবলন্বী বীরচাঁদ গান্ধীর কথাই ধরুন, তাঁহাকে আপনি বোম্বাইয়ে যথেষ্ট জানিতেন। এই ভদ্রলোকটি এদেশের দুর্জয় শীতেও নিরামিষ ভিন্ন অন্য খাদ্য গ্রহণ করেন না এবং নিজের দেশ ও ধর্মকে প্রাণপণ সমর্থন করেন। এদেশের জনসাধারণ তাঁহাকে বিশেষ পছন্দ করে, কিন্তু যাহারা তাঁহাকে এদেশে পাঠাইয়াছিল, তাহারা আজ কি করিতেছে?—তাহারা বীরচাঁদকে জাতিচ্যুত করিতে সচেষ্ট।
হিংসারূপ পাপ দাসজাতির মধ্যেই স্বভাবতঃ উদ্ভূত হইয়া থাকে এবং উহাই তাহাদিগকে হীনতার পঙ্কে নিমজ্জিত করিয়া রাখে। এদেশে ‘—’রা বক্তৃতা করিয়া অর্থসংগ্রহের চেষ্টা করিতেছিল এবং কিছু সাফল্য লাভ যে করে নাই—এমন নহে, কিন্তু তদপেক্ষা অধিকতর সাফল্য আমি লাভ করিয়াছিলাম; আমি কোনপ্রকারে তাহাদের বিঘ্নস্বরূপ হই নাই। তবে কি কারণে আমার সাফল্য অধিক হইয়াছিল? কারণ উহাই ছিল ভগবানের অভিপ্রায়।
এদেশে কেহ যদি উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে থাকে, তবে সকলেই তাহাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত। আর ভারতবর্ষে কাল যদি কোন একটি পএিকায় আপনি আমার প্রশংসা করিয়া এক ছত্র লেখেন, তবে পরদিন দেশসুদ্ধ সকলে আমার বিপক্ষে দাঁড়াইবে। ইহার হেতু কি? হেতু—দাসসুলভ মনোবৃত্তি। নিজেদের মধ্যে কেহ সাধারণ স্তর হইতে একটু মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইবে, ইহা তাহাদের পক্ষে অসহ্য। এদেশের মুক্তিকামী, স্বাবলম্বী ও ভ্রাতৃভাবে উদ্বুদ্ধ জনগণের সহিত আমাদের দেশের অপদার্থ লোকগুলির কি আপনি তুলনা করিতে চান? আমাদের সহিত যাহাদের নিকটতম সাদৃশ্য আছে, তাহারা এদেশের সদ্যোদাসত্বমুক্ত নিগ্রোগণ।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাংশে প্রায় দুই কোটি নিগ্রো আর মুষ্টিমেয় কয়েকটি শ্বেত আমেরিকান বাস করে; অথচ এই শ্বেতকায় কয়েকজনই নিগ্রোদিগকে দাবাইয়া রাখিয়াছে।
আইন অনুসারে সব ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এই দাসজাতির মুক্তির জন্য আমেরিকানরা ভাইয়ে ভাইয়ে এক নৃশংস যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছিল। সেই একই দোষ—হিংসা এখানেও রহিয়াছে। একজন নিগ্রো আর একজনের প্রশংসা কিম্বা উন্নতি সহ্য করিতে পারে না; অবিলম্বে তাহাকে নিষ্পেষিত করিবার জন্য আমেরিকানদিগের সহিত যোগ দেয়। ভারত- বর্ষের বাহিরে না আসিলে এ বিষয়ে সম্যক ধারণা হওয়া সম্ভব নহে।
যাহাদের প্রচুর অর্থ ও প্রতিপত্তি আছে, তাহাদের পক্ষে জগৎকে এইভাবে চলিতে দেওয়া ঠিক বটে; কিন্তু যাহারা লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ও নিষ্পেষিত নরনারীর বুকের রক্তদ্বারা অর্জিত অর্থে শিক্ষিত হইয়া এবং বিলাসিতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকিয়াও উহাদের কথা একটিবার চিন্তা করিবার অবসর পায় না—তাহাদিগকে আমি ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলিয়া অভিহিত করি।
কোথায় ইতিহাসের কোন্ যুগে ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়, পুরোহিত ও ধর্মধ্বজিগণ দীনদুঃখীর জন্য চিন্তা করিয়াছে?—তাহাদের ক্ষমতার জীবনীশক্তি ইহাদের নিষ্পেষণ হইতেই উদ্ভূত!
কিন্তু প্রভু মহান্। শীঘ্রই হউক আর বিলম্বেই হউক, এ অন্যায়ের সমুচিত ফলও ফলিয়াছে। যাহারা দরিদ্রের রক্ত শোষণ করিয়াছে, উহাদের অর্জিত অর্থে নিজেরা শিক্ষা লাভ করিয়াছে, এমন কি, যাহাদের ক্ষমতা-প্রতিপত্তির সৌধ দরিদ্রের দুঃখদৈন্যের উপরই নির্মিত—কালচক্রের আবর্তনে তাহাদেরই হাজার হাজার লোক দাসরূপে বিক্রীত হইয়াছে; তাহাদের স্ত্রী-কন্যার মর্যাদা নষ্ট হইয়াছে এবং বিষয়-সম্পত্তি সবই লুণ্ঠিত হইয়াছে। বিগত সহস্র বৎসর যাবৎ ইহাই চলিয়া আসিতেছে। আর ইহার পশ্চাতে কি কোন কারণ নাই বলিয়া আপনি মনে করেন?
ভারতবর্ষে দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা এত বেশী কেন? এ-কথা বলা মূর্খতা যে, তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তরগ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল। … বস্তুতঃ জমিদার ও পুরোহিতবর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল। আর সেইজন্য বাঙলাদেশে, যেখানে জমিদারের বিশেষ সংখ্যাধিক্য, সেখানে কৃষকসম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানেরই সংখ্যা বেশী।
এই নির্যাতিত ও অধঃপতিত লক্ষ লক্ষ নরনারীর উন্নতির কথা কে চিন্তা করে? কয়েক হাজার ডিগ্রীধারী ব্যক্তিদ্বারা একটি জাতি গঠিত হয় না, অথবা মুষ্টিমেয় কয়েকটি ধনীও একটি জাতি নহে। আমাদের সুযোগ-সুবিধা খুব বেশী নাই—এ-কথা অবশ্য সত্য, কিন্তু যেটুকু আছে, তাহা এিশ কোটি নরনারীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পক্ষেও যথেষ্ট।
আমাদের দেশের শতকরা নব্বই জনই অশিক্ষিত, অথচ কে তাহাদের বিষয় চিন্তা করে?—এ-সকল বাবুর দল কিম্বা তথাকথিত দেশহিতৈষীর দল কি?
এ-সকল সত্ত্বেও আমি বলি যে, ভগবান্ অবশ্যই একজন আছেন এবং এ-কথা পরিহাসের বিষয় নহে। তিনিই আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত করিতেছেন; এবং যদিও আমি জানি যে, দাসজাতি তাহার স্বভাবদোষে যথার্থ হিতকারীকেই দংশন করিয়া থাকে, তথাপি ইহাদেরই জন্য আমি প্রার্থনা করি এবং আমার সহিত আপনিও প্রার্থনা করুন। যাহা কিছু সৎ, যাহা কিছু মহৎ, তাহার প্রতি আপনি যথার্থ সহানুভূতিসম্পন্ন। আপনাকে জানিয়া অন্ততঃ এমন একজনকে জানিয়াছি বলিয়া আমি মনে করি, যাঁহার মধ্যে সারবস্তু আছে, যাঁহার প্রকৃতি উদার এবং যিনি অন্তরে বাহিরে অকপট। তাই আমার সহিত ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’—এই প্রার্থনায় যোগ দিতে আমি আপনাকে আহ্বান করি।
লোকে কি বলিল—সেদিকে আমি ভ্রূক্ষেপ করি না। আমার ভগবানকে, আমার ধর্মকে, আমার দেশকে—সর্বোপরি দরিদ্র ভিক্ষুককে আমি ভালবাসি। নিপীড়িত, অশিক্ষিত ও দীনহীনকে আমি ভালবাসি; তাহাদের বেদনা অন্তরে অনুভব করি, কত তীব্রভাবে অনুভব করি, তাহা প্রভুই জানেন। তিনিই আমাকে পথ দেখাইবেন। মানুষের স্তুতি-নিন্দায় আমি দৃকপাতও করি না, তাহাদের অধিকাংশকেই অজ্ঞ কলরবকারী শিশুর মত মনে করি। সহানুভূতি ও নিঃস্বার্থ ভালবাসার ঠিক মর্মকথাটি ইহারা কখনও বুঝিতে পারে না। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদে আমার সে অন্তর্দৃষ্টি আছে।
মুষ্টিমেয় সহকর্মীদের লইয়া এখন আমি কাজ করিতে চেষ্টা করিতেছি, আর উহাদের প্রত্যেকে আমারই মত দরিদ্র ভিক্ষুক। তাহাদিগকে আপনি দেখিয়াছেন। প্রভুর কাজ চিরদিন দীন-দরিদ্রগণই সম্পন্ন করিয়াছে। আশীর্বাদ করিবেন যেন ঈশ্বরের প্রতি, গুরুর প্রতি এবং নিজের প্রতি আমার বিশ্বাস অটুট থাকে।
প্রেম এবং সহানুভূতিই একমাত্র পন্থা। ভালবাসাই একমাত্র উপাসনা।
প্রভু আপনাদের নিরন্তর সহায়তা করুন। আমার আশীর্বাদাদি জানিবেন।
…………………………..
১৩২*
[রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়কে লিখিত]১৮
নিউ ইয়র্ক
১৮ নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় মহাশয়,
সম্প্রতি কলিকাতা টাউন হলের সভায় যে প্রস্তাবগুলি গৃহীত হইয়াছে এবং আমার সহ-নাগরিকগণ আমাকে উদ্দেশ করিয়া যে সহৃদয়তাপূর্ণ কথাগুলি পাঠাইয়াছেন, তাহা আমি পাইয়াছি।
মহাশয়, আমার ক্ষুদ্র কার্যও যে আপনারা সাদরে অনুমোদন করিয়াছেন, তজ্জন্য আমার হৃদয়ের গভীরতম কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
আমার দৃঢ় ধারণা—কোন ব্যক্তি বা জাতি অপর জাতি হইতে নিজেকে সম্পূর্ণ পৃথক্ রাখিয়া বাঁচিতে পারে না। আর যেখানেই শ্রেষ্ঠত্ব, পবিত্রতা বা নীতি (policy)-সম্বন্ধীয় ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হইয়া এইরূপ চেষ্টা করা হইয়াছে, যেখানেই কোন জাতি আপনাকে পৃথক্ রাখিয়াছে, সেখানেই তাহার পক্ষে ফল অতিশয় শোচনীয় হইয়াছে।
আমার মনে হয়, ভারতের পতন ও অবনতির এক প্রধান কারণ—জাতির চারিদিকে এইরূপ আচারের বেড়া দেওয়া। প্রাচীনকালে এই আচারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল—হিন্দুরা যেন চতুষ্পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধদের সংস্পর্শে না আসে । ইহার ভিত্তি—অপরের প্রতি ঘৃণা।
প্রাচীন বা আধুনিক তার্কিকগণ মিথ্যা যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া যতই ইহা ঢাকিবার চেষ্টা করুন না কেন, অপরকে ঘৃণা করিতে থাকিলে কেহই নিজে অবনত না হইয়া থাকিতে পারে না। ধর্মনীতির এই অব্যর্থ নিয়মের জাজ্বল্যমান প্রমাণস্বরূপ—ইহার অনিবার্য ফল এই হইল যে, যাহারা একদিন প্রাচীন জাতিসমূহের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিল, তাহারাই এক্ষণে সমুদয় জাতির উপহাস ও ঘৃণার পাত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আমাদেরই পূর্বপুরুষগণ যে নিয়ম প্রথম আবিষ্কার করিয়াছিলেন, আমরাই সেই নিয়ম লঙ্ঘন করিবার দৃষ্টান্তস্থল হইয়া রহিয়াছি।
আদান-প্রদানই প্রকৃতির নিয়ম; ভারতকে যদি আবার উঠিতে হয়, তবে তাহাকে নিজ ঐশ্বর্য-ভাণ্ডার উন্মুক্ত করিয়া পৃথিবীর সমুদয় জাতির ভিতর ছড়াইয়া দিতে হইবে এবং পরিবর্তে অপরে যাহা কিছু দেয়, তাহাই গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। সম্প্রসারণই জীবন—সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু; প্রেমই জীবন—দ্বেষই মৃত্যু। আমরা যেদিন হইতে অপর জাতিসকলকে ঘৃণা করিতে আরম্ত করিলাম, সেইদিন হইতে আমাদের ধ্বংস আরম্ভ হইল; আর যতদিন না আমরা আবার সম্প্রসারণশীল হইতেছি, ততদিন কিছুই আমাদের বিনাশ আটকাইয়া রাখিতে পারিবে না। অতএব আমাদিগকে পৃথিবীর সকল জাতির সহিত মিশিতে হইবে। আর শত শত কুসংস্কারাবিষ্ট ও স্বার্থপর ব্যক্তি (প্রবাদবাক্যের কুকুর যেমন গরুর জাবপাত্রে শুইয়া থাকিয়া, নিজেও তাহা খায় না অথচ গরুরও খাইবার ব্যাঘাত উৎপাদন করে, ইহারাও সেইরূপ) অপেক্ষা প্রত্যেক হিন্দু, যিনি বিদেশে ভ্রমণ করিতে যান, তিনি স্বদেশের অধিকতর কল্যাণসাধন করেন। পাশ্চাত্য জাতিগণ জাতীয় জীবনের যে অপূর্ব সৌধ নির্মাণ করিয়াছেন, সেগুলি চরিত্ররূপ স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। যতদিন না আমরা এইরূপ শত শত উৎকৃষ্ট চরিত্র সৃষ্টি করিতে পারিতেছি, ততদিন এ-জাতি বা ও-জাতির বিরুদ্ধে বিরক্তিপ্রকাশ ও চীৎকার করা বৃথা।
যে অপরকে স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত নয়, সে কি স্বয়ং স্বাধীনতা পাইবার যোগ্য? আসুন, আমরা বৃথা চীৎকারে শক্তিক্ষয় না করিয়া ধীরতার সহিত মনুষ্যোচিতভাবে কার্যে লাগিয়া যাই। আর আমি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি যে, কেহ কিছু পাইবার ঠিক ঠিক উপযুক্ত হইলে জগতের কোন শক্তিই তাহাকে তাহার প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত করিতে পারে না। আমাদের জাতীয় জীবন অতীতকালে মহৎ ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু আমি অকপটভাবে বিশ্বাস করি যে, আমাদের ভবিষ্যৎ আরও গৌরবান্বিত। শঙ্কর আমাদিগকে পবিত্রতা, ধৈর্য ও অধ্যবসায়ে অবিচলিত রাখুন।
ভবদীয় বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৩৩*
[মান্দ্রাজী ভক্তগণের উদ্দেশে শ্রীআলাসিঙ্গা পেরুমলকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
১৯ নভেম্বর, ১৮৯৪
হে বীরহৃদয় যুবকবৃন্দ,
তোমাদের গত ১১ অক্টোবর তারিখের পত্র কাল পাইয়া অতিশয় আনন্দিত হইলাম। এ পর্যন্ত কোন বিঘ্ন না হইয়া বরং আমাদের কার্যে উন্নতিই হইয়াছে, ইহাতে আমি পরম আনন্দিত। যে-কোনরূপেই হউক, সঙ্ঘের যাহাতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠা ও উন্নতি হইতে পারে, তাহা করিতেই হইবে; আর আমরা ইহাতে নিশ্চয়ই কৃতকার্য হইব—নিশ্চয়ই। ‘না’ বলিলে চলিবে না। আর কিছুরই আবশ্যক নাই, আবশ্যক কেবল প্রেম সরলতা ও সহিষ্ণুতা। জীবনের অর্থ বিস্তার; বিস্তার ও প্রেম একই কথা। সুতরাং প্রেমই জীবন—উহাই জীবনের একমাত্র গতিনিয়ামক; স্বার্থপরতাই মৃত্যু, জীবন থাকিতেও ইহা মৃত্যু, আর দেহাবসানেও এই স্বার্থপরতাই প্রকৃত মৃত্যুস্বরূপ। দেহাবসানে কিছুই থাকে না, এ-কথাও যদি কেহ বলে, তথাপি তাহাকে স্বীকার করিতে হইবে যে, এই স্বার্থপরতাই যথার্থ মৃত্যু।
পরোপকারই জীবন, পরহিতচেষ্টার অভাবই মৃত্যু। শতকরা নব্বই জন নরপশুই মৃত, প্রেততুল্য, কারণ হে যুবকবৃন্দ, যাহার হৃদয়ে প্রেম নাই, সে মৃত ছাড়া আর কি? হে যুবকবৃন্দ, দরিদ্র অজ্ঞ ও নিপীড়িত জনগণের ব্যথা তোমরা প্রাণে প্রাণে অনুভব কর, সেই অনুভবের বেদনায় তোমাদের হৃদয় রুদ্ধ হউক, মস্তিষ্ক ঘুরিতে থাকুক, তোমাদের পাগল হইয়া যাইবার উপক্রম হউক। তখন গিয়া ভগবানের পাদপদ্মে তোমাদের অন্তরের বেদনা জানাও। তবেই তাঁহার নিকট হইতে শক্তি ও সাহায্য আসিবে—অদম্য উৎসাহ, অনন্ত শক্তি আসিবে। গত দশ বৎসর ধরিয়া আমার মূলমন্ত্র ছিল—এগিয়ে যাও, এখনও বলিতেছি, এগিয়ে যাও। যখন চতুর্দিকে অন্ধকার বৈ আর কিছুই দেখিতে পাই নাই, তখনও বলিয়াছি—এগিয়ে যাও। এখন একটু একটু আলো দেখা যাইতেছে, এখনও বলিতেছি—এগিয়ে যাও। বৎস, ভয় পাইও না। উপরে তারকাখচিত অনন্ত আকাশমণ্ডলের দিকে সভয় দৃষ্টিতে চাহিয়া মনে করিও না, উহা তোমাকে পিষিয়া ফেলিবে। অপেক্ষা কর, দেখিবে—অল্পক্ষণের মধ্যে দেখিবে, সবই তোমার পদতলে। টাকায় কিছুই হয় না, নামেও হয় না, যশেও হয় না, বিদ্যায়ও কিছু হয় না, ভালবাসায় সব হয়—চরিত্রই বাধাবিঘ্নরূপ বজ্রদৃঢ় প্রাচীরের মধ্য দিয়া পথ করিয়া লইতে পারে।
এক্ষণে আমাদের সম্মুখে সমস্যা এই—স্বাধীনতা ব্যতীত কোনরূপ উন্নতিই সম্ভব নহে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ধর্মচিন্তায় স্বাধীনতা দিয়াছিলেন, ফলে আমরা এই অপূর্ব ধর্ম পাইয়াছি। কিন্তু তাঁহারা সমাজের পায়ে অতি কঠিন শৃঙ্খল পরাইলেন। এক কথায় বলিতে গেলে আমাদের সমাজ ভয়াবহ, পৈশাচিক। পাশ্চাত্যদেশে সমাজ চিরকাল স্বাধীনতা সম্ভোগ করিয়াছে—তাহাদের সমাজের দিকে লক্ষ্য করিয়া দেখ। আবার অপরদিকে তাহাদের ধর্ম কিরূপ, সেদিকেও দৃষ্টিপাত করিও।
স্বাধীনতাই উন্নতির প্রথম শর্ত। যেমন মানুষের চিন্তা করিবার ও কথা বলিবার স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক, তেমনি তাহার আহার পোষাক বিবাহ ও অন্যান্য সকল বিষয়েই স্বাধীনতা প্রয়োজন—তবে এই স্বাধীনতা যেন অপর কাহারও অনিষ্ট না করে।
আমরা নির্বোধের মত জড় সভ্যতার বিরুদ্ধে চীৎকার করিতেছি। না করিবই বা কেন? হাত বাড়াইয়া না পাইলে ‘আঙুর টক’ বলিব না তো কি! ভারতের আধ্যাত্মিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিলেও ভারতে এক লক্ষ নরনারীর অধিক যথার্থ ধার্মিক লোক নাই, ইহা মানিতেই হইবে। এই মুষ্টিমেয় লোকের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য ভারতের ত্রিশ কোটি লোককে অসভ্য অবস্থায় থাকিতে হইবে এবং না খাইয়া মরিতে হইবে? একজন লোকও কেন না খাইয়া মরিবে? মুসলমানগণ হিন্দুদিগকে জয় করিল—এ ঘটনা সম্ভব হইল কেন? বাহ্য সভ্যতা সম্বন্ধে হিন্দুর অজ্ঞতাই ইহার কারণ। বাহ্য সভ্যতা আবশ্যক শুধু তাহাই নহে; প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তুর ব্যবহারও আবশ্যক, যাহাতে গরীব লোকের জন্য নূতন নূতন কাজের সৃষ্টি হয়।
অন্ন! অন্ন! যে ভগবান্ এখানে আমাকে অন্ন দিতে পারেন না, তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখিবেন—ইহা আমি বিশ্বাস করি না। ভারতকে উঠাইতে হইবে, গরীবদের খাওয়াইতে হইবে, শিক্ষার বিস্তার করিতে হইবে, আর পৌরোহিত্যরূপ পাপ দূরীভূত করিতে হইবে। আরও খাদ্য, আরও সুযোগ প্রয়োজন। আমাদের নির্বোধ যুবকগণ ইংরেজগণের নিকট হইতে অধিক ক্ষমতা লাভের জন্য সভাসমিতি করিয়া থাকে—ইহাতে ইংরেজরা হাসে। যে অপরকে স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত নয়, সে কোনমতেই স্বাধীনতা পাইবার যোগ্য নহে। দাসেরা শক্তি চায় অপরকে দাস করিয়া রাখিবার জন্য। তাই বলি, এই অবস্থা ধীরে ধীরে আনিতে হইবে—লোককে অধিক ধর্মনিষ্ঠ হইতে শিক্ষা দিয়া ও সমাজকে স্বাধীনতা দিয়া। প্রাচীন ধর্ম হইতে এই পৌরোহিত্যের অত্যাচার ও অনাচারের মূলোচ্ছেদ করিয়া ফেল, দেখিবে এই ধর্মই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম।
আমার কথা কি বুঝিতেছ? ভারতের ধর্ম লইয়া ইওরোপের সমাজের মত একটি সমাজ গড়িতে পার? আমার বিশ্বাস ইহা কার্যে পরিণত করা খুব সম্ভব, আর এরূপ হইবেই হইবে। ইহা কার্যে পরিণত করিবার প্রধান উপায়—মধ্যভারতে একটি উপনিবেশ স্থাপন। যাহারা তোমাদের ভাব মানিয়া চলিবে, কেবল তাহাদের সেখানে রাখা হইবে। তারপর এই অল্পসংখ্যক লোকের মধ্যে সেই ভাব বিস্তার কর। অবশ্য ইহাতে টাকার দরকার, কিন্ত এ টাকা আসিবে। ইতোমধ্যে একটি কেন্দ্রীয় সমিতি করিয়া সমগ্র ভারতে তাহার শাখা স্থাপন করিয়া যাও। এখন কেবল ধর্মভিত্তিতে এই সমিতি স্থাপন কর; কোনরূপ সামাজিক সংস্কারের কথা এখন প্রচার করিও না। কেবলমাত্র এইটুকু দেখিলেই হইবে যে, অজ্ঞ লোকদিগের কুসংস্কার যেন প্রশ্রয় না পায়। শঙ্করাচার্য, রামানুজ, চৈতন্য প্রভৃতি প্রাচীন নামের মধ্য দিয়া এ-সকল সত্য প্রচারিত হইলে লোকে সহজে গ্রহণ করিয়া থাকে। ঐ সঙ্গে নগরসঙ্কীর্তন প্রভৃতিরও বন্দোবস্ত কর।
মনে কর, প্রথম সমিতি খুলিবার সময় একটি মহোৎসব করিলে। নিশান প্রভৃতি লইয়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া নগরসঙ্কীর্তন হইল, বক্তৃতাদি হইল। তারপর প্রতি সপ্তাহে এক বা ততোধিক বার সমিতির অধিবেশন হউক। নিজের ভিতর উৎসাহাগ্নি প্রজ্বলিত কর, আর চারিদিকে বিস্তার করিতে থাক। উঠিয়া পড়িয়া কাজে লাগ। নেতৃত্ব করিবার সময় সেবকভাবাপন্ন হও, নিঃস্বার্থপর হও; আর একজন গোপনে অপরের নিন্দা করিতেছে, তাহা শুনিও না। অনন্ত ধৈর্য ধরিয়া থাক, সিদ্ধি তোমার করতলে। ভারতের কোন কাগজ আর পাঠাইবার আবশ্যকতা নাই। আমার নিকট বিস্তর আসিয়াছে, আর না। এইটুকু বুঝ যে, যেখানে যেখানে তোমরা কোন সাধারণ সভা আহ্বান করিতে পারিয়াছ, সেইখানেই কাজ করিবার একটু সুবিধা পাইয়াছ। সেই সুবিধার সহায়তা লইয়া কাজ কর। কাজ কর, কাজ কর; পরের হিতের জন্য কাজ করাই জীবনের লক্ষণ। আমি আয়ারকে পৃথক্ কোন পত্র লিখি নাই, কিন্তু অভিনন্দন-পত্রের যে উত্তর পাঠাইয়াছি, তাহাই বোধ হয় পর্যাপ্ত হইবে। তাঁহাকে ও অপরাপর বন্ধুগণকে আমার হৃদয়ের ভালবাসা, সহানুভূতি ও কৃতজ্ঞতা জানাইবে। তাঁহারা সকলেই মহাশয় ব্যক্তি। একটি বিষয়ে বিশেষ সাবধান হইবেঃ আমি তোমার নিকটেই আমার সমুদয় পত্র পাঠাই বলিয়া—অন্যান্য বন্ধুগণের নিকট—তুমি নিজে যেন একটা মস্ত লোক, এটা দেখাইতে যাইও না। আমি জানি, তুমি এত নির্বোধ হইতেই পার না। তথাপি তোমাকে এ বিষয়ে সাবধান করিয়া দেওয়া আমার কর্তব্য বলিয়া মনে করি। ইহাতেই সম্প্রদায় ভাঙিয়া যায়। আমি চাই, যেন আমাদের মধ্যে কোনরূপ কপটতা, কোনরূপ লুকোচুরি ভাব, কোনরূপ দুষ্টামি না থাকে। আমি বরাবরই প্রভুর উপর নির্ভর করিয়াছি, দিবালোকের ন্যায় উজ্জ্বল সত্যের উপর নির্ভর করিয়াছি। আমার বিবেকের উপর এই কলঙ্ক লইয়া যেন মরিতে না হয় যে, আমি নামের জন্য, এমন কি, পরের উপকার করিবার জন্য লুকোচুরি খেলিয়াছি। একবিন্দু দুর্নীতি, বদ মতলবের একবিন্দু দাগ পর্যন্ত যেন না থাকে।
গুপ্ত বদমাশি, লুকোন জুয়াচুরি যেন কিছু আমাদের মধ্যে না থাকে; কিছুই লুকাইয়া করা হইবে না। কেহ যেন নিজেকে গুরুর বিশেষ প্রিয়পাত্র মনে করিয়া অভিমানে স্ফীত না হন। এমন কি, আমাদের মধ্যে গুরুও কেহ থাকিবে না; গুরুগিরি চলিবে না। হে বীরহৃদয় বালকগণ, কার্যে অগ্রসর হও। টাকা থাক বা না থাক, মানুষের সহায়তা পাও আর নাই পাও, তোমার তো প্রেম আছে? ভগবান্ তো তোমার সহায় আছেন? অগ্রসর হও, তোমার গতি কেহ রোধ করিতে পারিবে না।
ভারত হইতে প্রকাশিত থিওসফিষ্টদের একখানি কাগজে লিখিতেছে, তাঁহারা আমার সাফল্যের পথ প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন! বটেই তো!!! নিছক বাজে কথা—থিওসফিষ্টরা আমার পথ প্রস্তুত করিয়া দিয়াছে!
সাবধান! আমাদের মধ্যে যাহাতে কিছুমাত্র অসত্য প্রবেশ না করে। সত্যকে ধরিয়া থাক, আমরা নিশ্চয়ই কৃতকার্য হইব। হইতে পারে বিলম্বে, কিন্তু নিশ্চিত কৃতকার্য হইব, এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। কাজ করিয়া যাও। মনে কর, আমি জীবিত নাই। এই মনে করিয়া কাজে লাগ, যেন তোমাদের প্রত্যেকের উপর সমুদয় কাজের ভার। ভাবী পঞ্চাশ শতাব্দী তোমাদের দিকে চাহিয়া আছে। ভারতের ভবিষ্যৎ তোমাদের উপর নির্ভর করিতেছে। কাজ করিয়া যাও।
ইংলণ্ড হইতে অক্ষয়ের একখানি সুন্দর পত্র পাইয়াছি। জানি না, কবে ভারতে যাইতে পারিব। এখানে প্রচারের যেমন সুবিধা, সাহায্যপ্রাপ্তিরও সেইরূপ আশা। ভারতে লোকেরা বড় জোর আমার প্রশংসা করিতে পারে, কিন্তু কেহ একটি পয়সা দিতে রাজী নয়। পাইবেই বা কোথায়? নিজেরা যে ভিক্ষুক! তারপর ভারতবাসীরা বিগত দুই সহস্র বা ততোধিক বর্ষ ধরিয়া লোকহিতকর কার্য করিবার শক্তি হারাইয়া ফেলিয়াছে। জাতি (Nation), সর্বসাধারণ (Public) প্রভৃতি তত্ত্ব সম্বন্ধে তাহারা এই নূতন ভাব পাইতেছে। সুতরাং তাহাদিগের উপর আমার দোষারোপ করিবার কোন প্রয়োজন নাই। পরে আরও বিস্তারিত লিখিতেছি। তোমাদিগকে অনন্তকালের জন্য আশীর্বাদ । ইতি—
বিবেকানন্দ
পুনঃ—ফোনগ্রাফ সম্বন্ধে তোমাদের আর খবর লইবার প্রয়োজন নাই। আমি এইমাত্র খেতড়ি হইতে খবর পাইলাম যে, উহা নিরাপদে তথায় পৌঁছিয়াছে। ইতি
বি
…………………………..
১৩৪*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
৩০ নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
ফোনগ্রাফ ও পত্রখানি তোমার কাছে নিরাপদে পৌঁছেছে জেনে আনন্দিত হইলাম। আমাকে খবরের কাগজের অংশ কেটে আর পাঠাবার দরকার নেই, কাগজের বন্যা আমায় ভাসিয়ে দিয়েছে—এখন যথেষ্ট হয়েছে, আর আবশ্যক নেই। এখন সঙ্ঘের জন্য খাট। আমি ইতোমধ্যেই নিউ ইয়র্কে একটা সমিতি স্থাপন করেছি, তার সহকারী সভাপতি শীঘ্রই তোমাকে পত্র লিখবেন—তুমিও যত শীঘ্র পার তাঁদের সঙ্গে পত্রালাপ করতে আরম্ভ কর। আশা করি, আমি আরও কয়েক জায়গায় সমিতি স্থাপন করতে সমর্থ হব।
আমাদিগকে আমাদের সব শক্তি সংহত করতে হবে—একটা সম্প্রদায় গড়বার জন্যও নয়, আধ্যাত্মিক ব্যাপারের জন্যও নয়, কিন্তু বৈষয়িক দিকটার জন্য। জোরের সহিত প্রচারকার্য চালাতে হবে। তোমাদের সব মাথাগুলো একত্র কর ও সঙ্ঘবদ্ধ হও।
রামকৃষ্ণের অলৌকিক ক্রিয়া সম্বন্ধে কি পাগলামি হচ্ছে? আমার অদৃষ্টে সারা জীবন দেখছি—গরু-তাড়ানো ঘুচল না। মস্তিষ্কহীন আহাম্মকগুলো কেন যে এই বাজে আজগুবিগুলো লেখে তা জানিও না, বুঝিও না। মদকে ‘ডি. গুপ্তের ঔষধে’ পরিণত করা ছাড়া কি রামকৃষ্ণের জগতে আর কোন কাজ ছিল না? প্রভু আমাকে এই কলিকাতার লোকদের হাত থেকে রক্ষা করুন! কি সব লোক নিয়ে কাজ করতে হবে! যদি এরা শ্রীরামকৃষ্ণের একখানা যথার্থ জীবনচরিত লিখতে পারে—তিনি কি জন্য এসেছিলেন, কি শিক্ষা দিতে এসেছিলেন, সেই দিক্ লক্ষ্য রেখে লিখতে পারে, তবে লিখুক। নতুবা এইসব আবোল-তাবোল লিখে তাঁর জীবনী ও উপদেশকে যেন বিকৃত করা না হয়। এ-সব লোক ভগবানকে জানতে চায়—এদিকে রামকৃষ্ণের ভেতর বুজরুকি ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না! খাজা আহাম্মকি! এ-রকম আহাম্মকি দেখলে আমার রক্ত টগবগ ফুটতে থাকে।
কিডি তাঁর ভক্তি, জ্ঞান ও ধর্মসমন্বয়ের কথা এবং অন্যান্য উপদেশ তর্জমা করুন না? এই লিখতে হবে যে, তাঁর জীবনটা একটা অসাধারণ আলোকবর্তিকা, যার তীব্র রশ্মিসম্পাতে লোকে হিন্দুধর্মের সমগ্র দিক্ বা রূপ সত্যসত্যই বুঝতে সমর্থ হবে। শাস্ত্রে যে-সব জ্ঞান মতবাদরূপে রয়েছে, তিনি তার মূর্ত দৃষ্টান্ত। ঋষি ও অবতারেরা যা বাস্তবিক শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন, তিনি নিজের জীবন দ্বারা তা দেখিয়া গেছেন। শাস্ত্রগুলি মতবাদ মাত্র—তিনি ছিলেন তার প্রত্যক্ষ অনুভূতি। এই ব্যক্তি তাঁর একান্ন-বর্ষব্যাপী একটা জীবনে পাঁচ হাজার বছরের জাতীয় আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করে গেছেন এবং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষাপ্রদ আদর্শরূপে আপনাকে গড়ে তুলেছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন মত এক একটা অবস্থা বা ক্রম মাত্র, পরধর্ম বা পরমতের প্রতি শুধু দ্বেষভাবশূন্য হলেই চলবে না, আমাদিগকে ঐ ধর্ম বা মতকে আলিঙ্গনও করতে হবে; সত্যই সকল ধর্মের ভিত্তি—তাঁর এই মতবাদ দ্বারা বেদের ব্যাখ্যা ও শাস্ত্রসমূহের সমন্বয় হতে পারে। এসব ভাব নিয়ে তাঁর একখানি সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী জীবনচরিত লেখা যেতে পারে। সময়ে সবই ঠিক হবে। কুরুচিপূর্ণ অসংলগ্ন ভাষা পরিহার করবে। … অন্যান্য জাতিরা এগুলিকে চূড়ান্ত অশ্লীলতা মনে করে। তাঁর ইংরেজী জীবনচরিত সমগ্র জগৎ পড়বে, সুতরাং সাবধান, ঐপ্রকার শব্দ ও ভাব যেন ওর ভিতর প্রবেশ না করে। আমার নিকট প্রেরিত একখানা জীবনচরিত পড়লাম, তাতে এইরূপ বহু শব্দের প্রয়োগ আছে। … সুতরাং খুব সাবধান—খুব সাবধান হয়ে এরূপ ভাষা বা ভাব বাদ দেবে।
কলিকাতায় বন্ধুদের এদিকে একবিন্দু ক্ষমতা নেই, অথচ হামবড়াইটা খুব আছে—তারা নিজেদের এত বড় মনে করে যে, অপরের পরামর্শ শুনতে একদম নারাজ। এই অদ্ভুত ভদ্রলোকদের নিয়ে যে কি করব তা বুঝি না—তাদের কাছ থেকে বেশী কিছু আশা করি না। তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তারা যে বাঙলা বইখানি পাঠিয়েছে, তার জন্য লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হচ্ছে। লেখক হয়তো ভেবেছেন যে, তিনি খোলাখুলিভাবে সত্য লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছেন, পরমহংসদেবের ভাষা পর্যন্ত বজায় রাখছেন; কিন্তু তিনি এটা ভাবেননি যে, শ্রীরামকৃষ্ণ মেয়েদের সামনে কখনও এ-রকম ভাষা ব্যবহার করতেন না। এই লেখক আশা করেন, তাঁর বই স্ত্রীপুরুষ সমভাবে পড়বে। প্রভু আহাম্মকদের হাত থেকে আমায় রক্ষা করুন! তারা আবার নিজের খেয়ালে চলে মনে করে, তারা সকলেই তাঁকে সাক্ষাৎ দেখেছে! দূর ছাই এরূপ মস্তিষ্কহীনদের ভেতর দিয়ে যা কিছু বেরোয়, তা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। নিজেরা ভিখারী—রাজার মত চালচলন দেখাতে চায়। নিজেরা আহাম্মক, মনে করে—আমরা মস্ত জ্ঞানী! নগণ্য দাস সব, মনে করছে—আমরা প্রভু! এই তো তাদের অবস্থা! কি যে করব, কিছু বুঝতে পারি না। প্রভু আমায় রক্ষা করুন! আমার সব আশা-ভরসা তোমাদের উপর। কাজ করে যাও, কলিকাতার লোকদের মতানুসারে চলো না, কেবল তাদের না চটিয়ে খুশী রেখে যাও এই আশায় যে, তাদের মধ্যে কেউ না কেউ ভাল দাঁড়াতে পারে। কিন্তু স্বাধীনভাবে তোমাদের কাজে অগ্রসর হও। ভাত রান্না হলে অনেকেই পাত পেতে বসে যায়। সাবধান—কাজ করে যাও। সতত আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৩৫*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
৩০ নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় কিডি,
তোমার পত্র পেলাম। তোমার মন যে এদিক ওদিক করছে, তা সব পড়লাম। সুখী হলাম যে, তুমি রামকৃষ্ণকে ত্যাগ করনি। আমি তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি—তাঁর সম্বন্ধে যে-সব অদ্ভুত গল্প প্রকাশিত হয়েছে সেগুলি থেকে আর যে-সব অহাম্মক ওগুলি লিখছে তাদের থেকে তুমি তফাত থাকবে। সেগুলি সত্য বটে, কিন্তু আমি নিশ্চিত বুঝছি, আহাম্মকেরা সব তালগোল পাকিয়ে খিচুড়ি করে ফেলবে। তাঁর কত ভাল ভাল জ্ঞানরাশি শিক্ষা দেবার ছিল! তবে সিদ্ধাইরূপ বাজে জিনিষগুলোর ওপর অত ঝোঁক দাও কেন? অলৌকিক ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করতে পারলেই তো আর ধর্মের সত্যতা প্রমাণিত হয় না—জড়ের দ্বারা তো আর চৈতন্যের প্রমাণ হয় না। ঈশ্বর বা আত্মার অস্তিত্ব বা অমরত্বের সঙ্গে অলৌকিক ক্রিয়ার কি সম্বন্ধ? তুমি ঐ-সব নিয়ে মাথা ঘামিও না, তুমি তোমার ভক্তি নিয়ে থাক আর এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাক যে, আমি তোমার সব দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। এটা ওটা নিয়ে মনকে চঞ্চল করো না। রামকৃষ্ণকে প্রচার কর। যে পানীয় পান করে তোমার তৃষ্ণা মিটেছে, তা অপরকে পান করতে দাও। তোমার প্রতি আমার আশীর্বাদ—সিদ্ধি তোমার করতলগত হোক। বাজে দার্শনিক চিন্তা নিয়ে মাথা ঘামিও না, অথবা তোমার গোঁড়ামি দ্বারা অপরকেও বিরক্ত করো না। একটা কাজই তোমার পক্ষে যথেষ্ট—রামকৃষ্ণকে প্রচার করা, ভক্তি প্রচার করা। এই কাজের জন্য তোমায় আশীর্বাদ করছি—কাজ করে যাও। এখন প্রভুর নাম প্রচার করগে।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৩৬*
[ডাঃ নাঞ্জুণ্ড রাওকে লিখিত]
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
৩০ নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রেমাস্পদেষু,
তোমার মনোরম পত্রখানি এইমাত্র পেলাম। তুমি যে শ্রীরামকৃষ্ণের মহিমা বুঝতে পেরেছ, তা জেনে আমার বড়ই আনন্দ হল। আরও আনন্দ হল তোমার তীব্র বৈরাগ্যের পরিচয় পেয়ে। এই বৈরাগ্যই তো হল ভগবানলাভের অন্যতম প্রথম সাধন। আমি মান্দ্রাজবাসীর উপর চিরকাল অনেক আশা পোষণ করে এসেছি। এখনও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মান্দ্রাজ থেকেই আধ্যাত্মিক তরঙ্গ উঠে সমগ্র ভারতকে বন্যায় ভাসিয়ে দেবে। আমি কেবল এই প্রার্থনা করতে পারি যে, তোমার শুভ সঙ্কল্প শীঘ্র সিদ্ধ হোক। তবে বৎস, তোমার উদ্দেশ্যসিদ্ধির পথে বিঘ্নগুলির কথাও আমার বলা উচিত। প্রথমতঃ এটি দেখতে হবে যে, হঠাৎ কিছু করে ফেলা কারও পক্ষে উচিত নয়। দ্বিতীয়তঃ তোমার মা এবং স্ত্রীর জন্যও একটু ভাবা উচিত। অবশ্য তুমি বলতে পার, শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যেরা সংসার ত্যাগ করবার সময় তাঁদের মা-বাপের মতামতে কি সব সময় চলেছিলেন? আমি জানি, নিশ্চিত জানি যে, বড় বড় কাজ খুব স্বার্থত্যাগ ব্যতীত হতে পারে না। আমি নিশ্চিত জানি, ভারতমাতা তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানগণের জীবন বলি চান, আর আমার অকপট আশা এই যে, তুমিও তাঁর কৃপায় তাঁদেরই অন্যতম হবার সৌভাগ্য লাভ করবে।
সমগ্র জগতের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখতে পাবে, মহাপুরুষগণ চিরকাল বড় বড় স্বার্থত্যাগ করেছেন, আর সাধারণ লোক তার সুফল ভোগ করেছে। তুমি যদি তোমার নিজের মুক্তির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ কর, সে আর কি ত্যাগ হল? তুমি কি জগতের কল্যাণের জন্য তোমার নিজের মুক্তিকামনা পর্যন্ত ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছ? তুমি স্বয়ং ব্রহ্মস্বরূপ এ কথাটা ভেবে দেখ। আমি তোমাকে উপস্থিত এই পরামর্শ দিই যে, তুমি কিছুদিন ব্রহ্মচারীর জীবন যাপন কর অর্থাৎ কিছুদিনের জন্য স্ত্রীর সংস্রব একেবারে ছেড়ে দিয়ে তোমার পিতার গৃহেই বাস কর—ইহাই ‘কুটীচক’ অবস্থা। জগতের কল্যাণের জন্য তুমি যে মহা স্বার্থত্যাগ করতে যাচ্ছ, তাতে তোমার স্ত্রীকেও সম্মত করবার চেষ্টা কর। আর তোমার যদি জ্বলন্ত বিশ্বাস, সর্বজয়ী প্রেম ও সর্বশক্তির চিত্তশুদ্ধি থাকে, তবে তুমি যে তোমার উদ্দেশ্যসাধনে শীঘ্রই সফলতা লাভ করবে, সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সন্দেহ নেই। দেহ মন প্রাণ অর্পণ করে তুমি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উপদেশ-প্রচারকার্যে লেগে যাও দেখি—কারণ, সাধনার প্রথম সোপান হচ্ছে কর্ম। খুব মনোযোগ দিয়ে সংস্কৃত অধ্যয়ন আর খুব সাধনভজনের অভ্যাস কর। তোমাকে মানব-জাতির একজন শ্রেষ্ঠ আচার্য হতে হবে, আর আমার গুরু মহারাজ বলতেন, ‘নিজেকে মারতে হলে একটি নরুন দিয়ে হয়, কিন্তু অপরকে মারতে গেলে ঢাল তরবারের দরকার।’ তেমনি লোকশিক্ষা দিতে হলে অনেক শাস্ত্র পড়তে হয় ও অনেক তর্ক-যুক্তি করে বোঝাতে হয়, কিন্তু নিজের ধর্মলাভ কেবল একটি কথায় বিশ্বাস করলেই হয়। আর যখন ঠিক সময় হবে, তখন তুমি সমগ্র জগতে গিয়ে তাঁর নাম প্রচার করবার অধিকারী হবে। তোমার সঙ্কল্প অতি শুভ ও পবিত্র, সন্দেহ নাই—ভগবান্ শীঘ্র তোমার সঙ্কল্পসিদ্ধির সহায় হোন, কিন্তু হঠাৎ একটা কিছু করে ফেল না। প্রথমে কর্ম ও সাধন-ভজনের দ্বারা নিজেকে পবিত্র কর।
ভারত দীর্ঘকাল ধরে যন্ত্রণা সয়েছে, সনাতন ধর্মের ওপর বহুকাল ধরে অত্যাচার হয়েছে। কিন্তু প্রভু দয়াময়, তিনি আবার তাঁর সন্তানগণের পরিত্রাণের জন্য এসেছেন। পতিত ভারতকে আবার জাগরিত হবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পদতলে বসে শিক্ষা গ্রহণ করলেই কেবল ভারত উঠতে পারবে। তাঁর জীবন, তাঁর উপদেশ চারিদিকে প্রচার করতে হবে, যেন হিন্দুসমাজের সর্বাংশে—প্রতি অণুতে পরমাণুতে এই উপদেশ ওতপ্রোতভাবে ব্যাপ্ত হয়ে যায়। কে এ কাজ করবে? শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পতাকা বহন করে কে সমগ্র জগতের উদ্ধারের জন্য যাত্রা করবে? কে নাম, যশ, ঐশ্বর্যভোগ—এমন কি ইহলোক-পরলোকের সব আশা ত্যাগ করে অবনতির স্রোত রোধ করতে এগোবে? কয়েকটি যুবক দুর্গপ্রাচীরের ভগ্নপ্রদেশে লাফিয়ে পড়েছে—তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে। তারা খুব অল্পসংখ্যক; এইরূপ কয়েক সহস্র যুবকের প্রয়োজন। তারা নিশ্চয়ই আসবে।আমি আনন্দিত যে, আমাদের প্রভু তোমার মনে তাঁদের অন্যতম হবার ইচ্ছা জাগিয়ে দিয়েছেন। প্রভু যাকে মনোনীত করবেন, সে-ই ধন্য—সে-ই মহাগৌরবের অধিকারী। তমোহ্রদে মজ্জমান লক্ষ লক্ষ নরনারীকে প্রভুর জ্যোতির্ময় রাজ্যে আনবার জন্য তোমার সঙ্কল্প উত্তম, আশা উচ্চ এবং লক্ষ্য অতি মহৎ।
কিন্তু হে বৎস, এতে অন্তরায় আছে। হঠাৎ কিছু করে ফেলা উচিত নয়। পবিত্রতা, সহিষ্ণুতা ও অধ্যবসায়—এই তিনটি, সর্বোপরি প্রেম সিদ্ধিলাভের জন্য একান্ত আবশ্যক। তোমার সামনে তো অনন্ত সময় পড়ে আছে, অতএব তাড়াতাড়ি হুড়োহুড়ির কোন প্রয়োজন নেই। তুমি যদি পবিত্র ও অকপট হও, সবই ঠিক হয়ে যাবে। তোমার মত শত শত যুবক চাই, যারা সমাজের উপর গিয়ে মহাবেগে পড়বে এবং যেখানে যাবে সেখানেই নবজীবন ও আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চার করবে। ভগবান্ শীঘ্র তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করুন। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৩৭**
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
১৬৮, ব্র্যাট্ল্ ষ্ট্রীট, কেম্ব্রিজ
৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
এখানে তিন দিন আছি। লেডী হেনরী সমারসেটের একটি সুন্দর বক্তৃতা হল। এখানে রোজ সকালে বেদান্ত বা অপরাপর বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকি। তোমাকে পাঠিয়ে দেবার জন্য একখানি ‘বেদান্তধর্ম’ (Vedantism) ‘মাদার টেম্পলের’ নিকট দিয়েছিলাম। সে-খানি বোধ করি পেয়েছ। আর একদিন স্প্যাল্ডিংদের ওখানে খেতে গিয়েছিলাম। আমার আপত্তি সত্ত্বেও সেদিন তারা ধরে বসল মার্কিনদের সমালোচনা করতে হবে। আলোচনা তাদের অপ্রিয় হয়ে থাকবে; হওয়া স্বাভাবিক বটে—সর্বদা, সর্বত্র। চিকাগোয় ‘মাদার চার্চ’ ও পরিবারস্থ সকলের খবর কি? অনেকদিন হল তাঁদের কোন পত্র পাইনি। সময় পেলে এর পূর্বেই চট করে শহরে গিয়ে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে আসতাম। সারাদিনই বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়। তারপর ভয়, গিয়েও যদি দেখা না হয়।
তোমার যদি অবসর থাকে লিখো; আমি সুযোগ পাওয়া মাত্রই তোমার সঙ্গে দেখা করে আসব। অপরাহ্ণের দিকে আমার অবকাশ। সকাল থেকে বেলা ১২টা ১টা পর্যন্ত খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। এইভাবে চলবে—যে পর্যন্ত এখানে আছি অর্থাৎ এই মাসের ২৭ বা ২৮ তারিখ পর্যন্ত। সকলে আমার প্রীতি জানবে। ইতি
তোমার চিরস্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৩৮*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
কেম্ব্রিজ
ডিসেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
এইমাত্র তোমার পত্র পেলাম। তোমাদের সামাজিক প্রথায় যদি না বাধে তা হলে মিসেস ওলি বুল, মিস ফার্মার, এবং মিসেস এডামস্ নামক চিকাগো হতে আগত ব্যায়ামবিশারদের সঙ্গে একবার দেখা করে যাও না কেন?
যে-কোন দিন তাদের সেখানে পাবে।
তোমাদের চিরস্নেহশীল
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৩৯*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
কেম্ব্রিজ
২১ ডিসেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
এর পর তোমার আর কোন পত্র পাইনি। আগামী মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কে চলে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে তুমি মিসেস বুলের পত্র অবশ্য পেয়ে থাকবে। আমি যে-কোন দিন সানন্দে তোমার কাছে যাব; বক্তৃতা শেষ হওয়ায় আমার এখন অবকাশ আছে—আগামী রবিবার ছাড়া।
চিরস্নেহশীল
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৪০*
[আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লিখিত]
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২৬ ডিসেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয়বরেষু,
শুভাশীর্বাদ। তোমার পত্র এই মাত্র পেলাম। নরসিংহ ভারতে পৌঁছেছে শুনে সুখী হলাম। ডাঃ ব্যারোজের ধর্মমহাসভা সম্বন্ধে বিবরণ-পুস্তকখানি তোমায় পাঠাতে পারিনি, সেইজন্য আমি দুঃখিত। পাঠাতে চেষ্টা করব। কথাটা হচ্ছে এই যে, ধর্মমহাসভা সম্বন্ধে সব ব্যাপার এদেশে পুরানো হয়ে গেছে। তিনি সম্প্রতি কোন বই লিখেছেন কিনা জানি না, আর তুমি যে কাগজখানির কথা উল্লেখ করেছ, তার সম্বন্ধেও কখনও কিছু জানিনি। এখন ডাঃ ব্যারোজ, ধর্মমহাসভা, তৎসংক্রান্ত এই পত্র ও অন্য যা কিছু সব প্রাচীন ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, সুতরাং তোমরাও ঐগুলিকে ইতিহাসের সামিল ভাবতে পার।
এখন আমার সম্বন্ধে প্রায়ই শুনে থাকি, কোন না কোন মিশনরী কাগজে আমাকে আক্রমণ করে লিখে থাকে। তার কোনটা আমার দেখবার ইচ্ছাও হয় না। যদি ভারতের ঐ-রকম মিশনরীদের আক্রমণ-সম্বলিত কোন কাগজ আমাকে পাঠাও, তা হলে তা জঞ্জালের সঙ্গে ফেলে দেব। আমাদের কাজের জন্য একটু হুজ্জতের দরকার হয়েছিল—এখন যথেষ্ট হয়েছে। এখন আর লোকে এখানে বা সেখানে আমার পক্ষে বা বিপক্ষে ভালমন্দ কি বলছে, সেদিকে আর লক্ষ্য করো না। তুমি তোমার কাজ করে যাও, আর মনে রেখো—‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিত দুর্গতিং তাত গচ্ছতি।’
এখানে দিন দিন লোকে আমার ভাব নিচ্ছে, আর তোমাকে আলাদা বলছি, তুমি যতটা ভাবছ তার চেয়ে এখানে আমার যথেষ্ট প্রতিপত্তি হয়েছে। সব জিনিষই ধীরে ধীরে অগ্রসর হবে।
বাল্টিমোরের ঘটনা সম্বন্ধে বক্তব্য এই, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ভাগে লোকে নিগ্রোদের সঙ্গে অন্য কৃষ্ণকায় জাতির প্রভেদ জানে না। যখন জানতে পারবে, তখন দেখবে—তারা খুব অতিথিবৎসল। ‘টমাস আ কেম্পিসে’র কথা নিয়ে ব্যাপারটা আমার নিকটও নূতন সংবাদ বটে! আমি তোমায় পূর্বেও লিখেছি, এখনও লিখছি, আমি খবরের কাগজের সুখ্যাতি বা নিন্দায় মোটেই কান দিই না, ঐরূপ কিছু আমার কাছে এলে আমি আগুনে পুড়িয়ে ফেলি, তোমরাও তাই করো। খবরের কাগজের আহাম্মকি বা কোন প্রকার সমালোচনার দিকে মন দিও না। মন মুখ এক করে নিজের কর্তব্য করে যাও—সব ঠিক হয়ে যাবে। সত্যের জয় হবেই হবে! দোহাই, আমাকে খবরের কাগজ, সাময়িক কোন পত্র বা কোন বই পাঠিও না। আমি সর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছি, সুতরাং ঐ সব জিনিষের বোঝা বইতে গেলে আমার কি কষ্ট, তা বুঝতেই পারছ।
মিশনরীদের মিথ্যা উক্তিগুলি গ্রাহ্যের মধ্যেই এনো না—এখানে কোন ভদ্রলোকই তাদের আমল দেয় না। ভারতে তারা হাত-পা চাপড়াক, ডাঃ ব্যারোজও যে এখানে খুব বড় লোক, তা নয়। সম্পূর্ণ নীরবতাই হচ্ছে তাদের উক্তিগুলির প্রতিবাদ, আমার ইচ্ছা—তোমরা তাই কর। সর্বোপরি, আমাকে ভারতীয় খবরের কাগজের বন্যায় ভাসিয়ে দিও না, ওর থেকে আমার যা দরকার ছিল তা হয়ে গেছে, আর না। এখন কাজে মন দাও। সুব্রহ্মণ্য আয়ারকে তোমাদের সভার সভাপতি করো। আমি তাঁর মত অকপট ও মহানুভব লোক আর দেখিনি। তাঁর ভেতর হৃদয় ও বুদ্ধিবৃত্তির খুব সুন্দর সামঞ্জস্য আছে। তাঁকে সভাপতি করে কাজে অগ্রসর হও। আমার ওপর বেশী নির্ভর করো না—নিজেদের ওপর নির্ভর করে যাও। এখনও আমি অকপটভাবে বিশ্বাস করি, মান্দ্রাজ থেকেই শক্তিতরঙ্গ উঠবে। আমার সম্বন্ধে কথা এই, কবে আমি ফিরে যাচ্ছি—জানি না। আমি এখানে এবং ভারতে দু-জায়গাতেই কাজ করছি। মাঝে মাঝে কিছু কিছু টাকা পাঠাতে পারব, এই পর্যন্ত সাহায্য করতে পারি। তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানবে।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৪১*
[লালা গোবিন্দ সহায়কে লিখিত]
C/o. জি. ডবলিউ. হেল, এস্কোয়ার
চিকাগো
১৮৯৪
প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
আমার কলিকাতার গুরুভ্রাতাগণের সহিত তোমার পত্রব্যবহার আছে কি? তুমি চরিত্রে, আধ্যাত্মিকতায় এবং সাংসারিক ব্যাপারে বেশ উন্নতি করিতেছ তো? হয়তো শুনিয়া থাকিবে—কিভাবে প্রায় বৎসরাধিক কাল আমি আমেরিকায় হিন্দুধর্ম প্রচার করিতেছি। এখানে বেশ ভালই আছি। যত শীঘ্র পার এবং যতবার ইচ্ছা আমাকে চিঠি লিখিও।
সস্নেহ
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৪২*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
১৮৯৪
প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
… সাধুতাই শ্রেষ্ঠ নীতি, এবং পরিণামে ধার্মিক লোকের জয় হইবেই। … বৎস, সর্বদা মনে রাখিও আমি যতই ব্যস্ত, যতই দূরে অথবা যত উচ্চপদস্থ লোকের সঙ্গেই থাকি না কেন, আমি সর্বদাই আমার বন্ধুবর্গের প্রত্যেকের, সর্বাপেক্ষা সামান্যপদস্থ ব্যক্তির জন্যও প্রার্থনা করিতেছি এবং তাহাকে স্মরণ রাখিতেছি। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৪৩
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
১৮৯৪
কল্যাণবরেষু,
তোমাদের পত্র পাইয়া অতিশয় আনন্দিত হইলাম। মজুমদারের লীলা শুনিয়া বড়ই দুঃখিত। গুরুমারা বিদ্যে করতে গেলে ঐ-রকম হয়। আমার অপরাধ বড় নাই। মজুমদার দশ বংসর আগে এখানে এসেছিল—বড় খাতির ও সম্মান; এবার আমার পোয়াবারো। গুরুদেবের ইচ্ছা, আমি কি করিব? এতে চটে যাওয়া মজুমদারের ছেলেমানষি। যাক, উপেক্ষিতব্যং তদ্বচনং ভবৎসদৃশানাং মহাত্মনাম্। অপি কীটদংশনভীরুকাঃ বয়ং রামকৃষ্ণতনয়াঃ তদ্ধৃদয়রুধিরপোষিতাঃ? ‘অলোকসামান্যমচিন্ত্যহেতুকং নিন্দন্তি মন্দাশ্চরিতং মহাত্মনাং’ ইত্যাদয়ঃ সংস্মৃত্য ক্ষন্তব্যোঽয়ং জাল্মঃ মজুমদারাখ্যঃ।১৯ প্রভুর ইচ্ছা—এ দেশের লোকের মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি প্রবোধিত হয়। মজুমদার-ফজুমদারের কর্ম তাঁর গতি রোধ করে? আমার নামের আবশ্যক নাই—I want to be a voice without a form.২০ হরমোহন প্রভৃতি কাহারও আমাকে সমর্থন করিবার আবশ্যক নাই—কোঽহং তৎপাদপ্রসরং প্রতিরোদ্ধুং সমর্থয়িতুং বা, কে বান্যে হরমোহনাদয়ঃ? তথাপি মম হৃদয়কৃতজ্ঞতা তান্ প্রতি। ‘যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে’—নৈষ প্রান্তবান্ তৎপদবীমিতি মত্বা করুণাদৃষ্ট্যা দ্রষ্টব্যোঽয়মিতি।২১প্রভুর ইচ্ছায় এখনও নামযশের ইচ্ছা হৃদয়ে আসে নাই; বোধ হয় আসিবেও না। আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। তিনি এই যন্ত্রদ্বারা সহস্র সহস্র হৃদয়ে এই দূরদেশে ধর্মভাব উদ্দীপিত করিতেছেন। সহস্র সহস্র নরনারী এদেশে আমাকে অতিশয় স্নেহ প্রীতি ও ভক্তি করে, আর শত শত পাদ্রী ও গোঁড়া ক্রিশ্চান শয়তানের সহোদর মনে করে। মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্,২২ আমি তাঁহার কৃপায় আশ্চর্য! যে শহরে যাই, তোলপাড় হয়। এরা আমার নাম দিয়েছে—Cyclonic Hindu.২৩তাঁর ইচ্ছা মনে রাখিও— I am a voice without a form (আমি অমূর্ত বাণী)।
ইংলণ্ডে যাব কি যমল্যাণ্ডে, প্রভু জানেন। তিনি সব যোগাড় করে দেবেন। এদেশে একটা চুরুটের দাম এক টাকা, একবার ঠিকাগাড়ী চড়লে ৩৲ টাকা, একটা জামার দাম ১০০৲ টাকা। ৯৲ টাকা রোজ হোটেল—প্রভু সব যুগিয়ে দেন। এদেশের সব বড় বড় লোকের বাড়ীতে যত্ন করে নিয়ে যাচ্ছে। উত্তম খাওয়া-পরা সব আসছে—জয় প্রভু, আমি কিছু জানি না। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতং সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।’২৪ ‘বিগতভীঃ’ হওয়া চাই। কাপুরুষে ভয় করে, আত্মসমর্থন করে। কেহ যেন আমাকে সমর্থন করিতে অগ্রসর না হয়। মান্দ্রাজের খবর সব আমি মধ্যে মধ্যে পাই ও রাজপুতানার। ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে দিয়ে আমাকে অনেক ঠাট্টা করেছে—কার কথা কার মুখে দিয়ে! সব খবর পাচ্ছি। আর দাদা—এমন চক্ষু আছে, যা ৭০০০ ক্রোশ দূরে দেখে—এ কথা সত্য বটে। চুপে যেও, কালে কালে সব বেরুবে—যতটুকু তাঁর ইচ্ছা। তাঁর একটা কথাও মিথ্যে হয় না। দাদা, কুকুর-বেড়ালের ঝগড়া দেখে মানুষে কি দুঃখু করে? তেমনি সাধারণ মানুষের ঈর্ষা হিংসা গুঁতাগুঁতি দেখে তোমাদের মনে কোন ভাব হওয়া উচিত নয়। দাদা, আজ ছমাস থেকে বলছি যে, পর্দা হঠছে, সূর্যোদয় হচ্ছে। পর্দা উঠছে—উঠছে ধীরে ধীরে, slow but sure (ধীরে কিন্তু নিশ্চিত), কালে প্রকাশ। তিনি জানেন—‘মনের কথা কইব কি সই, কইতে মানা।’ দাদা, এ সব লিখিবার নহে, বলিবার নহে। আমার পত্র অন্য কেউ যেন না পড়ে, তোমরা ছাড়া। হাল ছেড় না, টিপে ধরে থেক—পাকড় ঠিক বটে, তাতে আর ভুল নাই—তবে পারে যাওয়া আজ আর কাল—এই মাত্র। দাদা, leader (নেতা) কি বানাতে পারা যায়? Leader জন্মায়। বুঝতে পারলে কিনা? লিডারি করা আবার বড় শক্ত—দাসস্য দাসঃ, হাজারো লোকের মন যোগান। Jealousy, selfishness (ঈর্ষা, স্বার্থপরতা) আদপে থাকবে না—তবে leader. প্রথম by birth (জন্মগত), দ্বিতীয় unselfish (নিঃস্বার্থ), তবে leader. সব ঠিক হচ্ছে, সব ঠিক আসবে, তিনি ঠিক জাল ফেলছেন, ঠিক জাল গুটাচ্ছেন—বয়মনুসরামঃ, বয়মনুসরামঃ, প্রীতিঃ পরমসাধনম্২৫ বুঝলে কিনা? Love conquers in the long run,২৬ দিক্ হলে চলবে না—wait, wait (অপেক্ষা কর, অপেক্ষা কর); সবুরে মেওয়া ফলবেই ফলবে। যোগেনের কথা কিছুই লেখ নাই। রাখাল-রাজা ঘুরে ফিরে পুনর্বৃন্দাবনং গচ্ছেদিতি। …
তোমায় বলি ভায়া, যেমন চলছে চলতে দাও; তবে দেখো কোন form (বাহ্য অনুষ্ঠানপদ্ধতি) যেন necessary (একান্ত আবশ্যক) না হয়, unity in variety (বহুত্বে একত্ব)—সর্বজনীন ভাবের যেন কোনমতে ব্যাঘাত না হয়। Everything must be sacrificed, if necessary, for that one sentiment universality.২৭ আমি মরি আর বাঁচি, আর দেশে যাই বা না যাই, তোমরা বিশেষ করে মনে রাখবে যে, সর্বজনীনতা—perfect acceptance, not tolerance only, we preach and perform. Take care how you trample on the least rights of others.২৮ ঐ দিয়ে বড় বড় জাহাজডুবি হয়ে যায়। পূর্ণ ভক্তি গোঁড়ামি ছাড়া—এইটি দেখাতে হবে, মনে রেখো। তাঁর কৃপায় সব ঠিক চলবে। মঠ কেমন চলছে, উৎসব কেমন হল, গোপাল—বুড়ো ও হুটকো কোথায় কেমন, গুপ্ত কোথায় কেমন—সব লিখবে। মাষ্টার কি বলে? ঘোষজা কি বলে? রামদাদা ঠাণ্ডা ভাব পেয়েছে কি না? দাদা, সকলের ইচ্ছা যে leader (নেতা) হয়, কিন্তু সে যে জন্মায়—ঐটি বুঝতে না পারাতেই এত অনিষ্ট হয়। প্রভুর কৃপায় রামদাদা শীঘ্রই ঠাণ্ডা হবে ও বুঝতে পারবে। তাঁর কৃপা কাউকে ছাড়বে না। জি. সি. ঘোষ কি করছে?
আমাদের মাতৃকাগণ বেঁচে বর্তে আছে তো? গৌর-মা কোথা? এক হাজার গৌর-মার দরকার—ঐ noble stirring spirit (মহান্ ও উদ্দীপনাময় ভাব)। যোগেন-মা প্রভৃতি সকলে ভাল আছে বোধ হয়। ভায়া, আমার পেটটা এমন ফুলছে যে, কালে বোধ হয় দরজা টরজা কাটতে হবে। মহিম চক্রবর্তী কি করছে? তার ওখানে যাওয়া-আসা করিবে। লোকটা ভাল। আমরা সকলকে চাই—It is not at all necessary that all should have the same faith in our Lord as we have, but we want to unite all the powers of goodness against all the powers of evil.২৯মহেন্দ্র মাষ্টারকে request from me (আমার তরফ থেকে অনুরোধ কর)। He can do it (তিনি এটা করতে পারবেন)। আমাদের একটা বড় দোষ—সন্ন্যাসের গরিমা। ওটা প্রথম প্রথম দরকার ছিল, এখন আমরা পেকে গেছি, ওটার আবশ্যক একেবারেই নাই। বুঝতে পেরেছ? সন্ন্যাসী আর গৃহস্থে কোন ভেদ থাকবে না, তবে যথার্থ সন্ন্যাসী। সকলকে ডেকে বুঝিয়ে দেবে—মাষ্টার, জি. সি. ঘোষ, রামদা, অতুল আর আর সকলকে নিমন্ত্রণ করে যে, ৫|৭টা ছোঁড়াতে মিলে, যাদের এক পয়সাও নাই, একটা কার্য আরম্ভ করলে—যা এখন এমন accelerated (ক্রমবর্ধমান) গতিতে বাড়তে চলল—এ হুজ্জুক, কি প্রভুর ইচ্ছা? যদি প্রভুর ইচ্ছা, তবে তোমরা দলাদলি jealousy (ঈর্ষা) পরিত্যাগ করে united action (সমবেতভাবে কার্য) কর। Shameful (লজ্জার কথা), আমরা universal religion (সর্বজনীন ধর্ম) করছি দলাদলি করে। যদি গিরিশ ঘোষ, মাষ্টার আর রামবাবু ঐটি করতে পারে, তবে বলি বাহাদুর আর বিশ্বাসী, নইলে মিছে nonsense (বাজে)।
সকলে যদি একদিন এক মিনিট বোঝে যে, আমি বড় হব বললেই বড় হওয়া যায় না, যাকে তিনি তোলেন সে উঠে, যাকে তিনি নীচে ফেলেন সে পড়ে যায়, তাহলে সকল ন্যাটা চুকে যায়। কিন্ত ঐ যে ‘অহং’—ফাঁকা ‘অহং’—তার আবার আঙ্গুল নাড়াবার শক্তি নাই, কিন্ত কাউকে উঠতে দেব না—বললে কি চলে? ঐ jealousy (ঈর্ষা), ঐ absence of conjoined action (সঙ্ঘবদ্ধভাবে কার্য করিবার শক্তির অভাব) গোলামের জাতের nature (স্বভাব); কিন্তু আমাদের ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করা উচিত। ঐ terrible jealousy characteristic (ভয়ানক চারিত্রিক বিশেষত্ব ঈর্ষা), আমাদের, বিশেষ বাঙ্গালীর। কারণ, we are the most worthless and superstitious and the most cowardly and lustful of all Hindus.৩০ পাঁচটা দেশ দেখলে ঐটি বেশ করে বুঝতে পারবে। আমাদের সমাত্মা এই গুণে এদের স্বাধীনতাপ্রাপ্ত কাফ্রীরা—যদি তাদের মধ্যে একজনও বড় হয়, অমনি সবগুলোয় পড়ে তার পিছু লাগে—white (শ্বেতাঙ্গ)-দের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাকে পেড়ে ফেলবার চেষ্টা করে। আমরাও ঠিক ঐ রকম। গোলাম কীটগুলো, এক পা নড়বার ক্ষমতা নাই—স্ত্রীর আঁচল ধরে তাস খেলে গুড়ুক ফুঁকে জীবনযাপন করে, আর যদি কেউ ঐগুলোর মধ্যে এক পা এগোয়, সবগুলো কেঁউ কেঁউ করে তার পিছু লাগে—হরে হরে ।
At any cost, any price, any sacrifice (ওর জন্য যতই ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করতে হোক) ঐটি আমাদের ভিতরে না ঢোকে—আমরা দশ-জন হই, দুজন হই do not care (কুছ পরোয়া নেই), কিন্তু ঐ কয়টা perfect characters (সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ চরিত্র) হওয়া চাই। আমাদের ভিতর যিনি পরস্পরের গুজুগুজু নিন্দা করবেন বা শুনবেন, তাকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। ঐ গুজুগুজু সকল নষ্টের গোড়া—বুঝতে পারছ কি? হাত ব্যথা হয়ে এল … আর লিখতে পারি না। ‘মাঙ্গনা ভালা না বাপ্সে যব্ রঘুবীর রাখে টেক্’। রঘুবীর টেক্ রাখবেন দাদা—সে বিষয় তোমরা নিশ্চিন্ত থেকো। বাঙলাদেশে তাঁর নাম প্রচার হল বা না হল, তাতে আমার অণুমাত্র চেষ্টা নাই—ওগুলো কি মানুষ! রাজপুতানা, পাঞ্জাব, N.W. (উত্তর-পশ্চিম) প্রদেশ,৩১ মান্দ্রাজ—ঐ সকল দেশে তাঁকে ছড়াতে হবে। রাজপুতানায় যেখানে ‘রঘুকুলরীতি সদা চলি আঈ। প্রাণ জাঈ বরু বচন ন জাঈ॥’—এখনও বাস করে।
পাখী উড়তে উড়তে এক জায়গায় পৌছায়, যেখান থেকে অত্যন্ত শান্তভাবে নীচের দিকে দেখে। সে জায়গায় পৌঁছেছে কি? যিনি সেখানে পৌঁছান নাই, তাঁর অপরকে শিক্ষা দিবার অধিকার নাই। হাত পা ছেড়ে দিয়ে ভেসে যাও—ঠিক পৌঁছে যাবে।
ঠাণ্ডার পো ধীরে ধীরে পালাচ্ছেন—শীতকাল কাটিয়ে দেওয়া গেল। শীতকালে এদেশে সর্বাঙ্গে electricity (তড়িৎ) ভরে যায়। Shake-hand (করমর্দন) করতে গেলে shock (ধাক্কা) লাগে আর আওয়াজ হয়—আঙুল দিয়ে গ্যাস জ্বালান যায়। আর শীতের কথা তো লিখেছি। সারা দেশটা দাবড়ে বেড়াচ্ছি, কিন্ত চিকাগো আমার ‘মঠ’—ঘুরে ফিরে আবার চিকাগোয় আসি। এখন পূর্বদিকে যাচ্ছি, কোথায় যে বেড়া পায়ে লাগবে, তিনি জানেন। মা-ঠাকরুন দেশে গেছেন; তাঁর শরীর বোধ হয় সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যলাভ করেছে।
তোমাদের কি করে চলছে, কে চালাচ্ছে? রামকৃষ্ণ,৩২ তার মা, তুলসীরাম প্রভৃতি বোধ হয় উড়িষ্যায়?
দমদম মাষ্টার কেমন আছে? দাশুর তোমাদের উপর সেই প্রীতি আছে কিনা? সে ঘন ঘন আসে কিনা? ভবনাথ কেমন আছে, কি করছে? তোমরা তার কাছে যাও কিনা—তোমরা তাকে শ্রদ্ধা ভক্তি কর কিনা? হাঁ হে বাপু, সন্ন্যাসী-ফন্ন্যাসী মিছে কথা—মূকং করোতি, ইত্যাদি। বাবা, কার ভেতর কি আছে, বুঝা যায় না। তিনি ওকে বড় করেছেন—ও আমাদের পূজ্য। এত দেখে শুনেও যদি তোমাদের বিশ্বাস না হয়, ধিক তোমাদের! ভবনাথ তোমাদের ভালবাসে কিনা? তাকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা প্রীতি ও ভালবাসা দিও। কালীকৃষ্ণবাবুকে আমার ভালবাসা দিও—তিনি অতি উন্নতচিত্ত ব্যক্তি। রামলাল কেমন আছে? তার একটু বিশ্বাস ভক্তি হয়েছে কিনা? তাকে আমার প্রীতিসম্ভাষণ দিও। সাণ্ডেল ঘানিতে ঠিক ঘুরছে বোধ হয়; ধৈর্য ধরিতে কহিবে—ঘানি ঠিক যাবে। সকলকে আমার হৃদয়ের প্রীতি।
অনুরাগৈকহৃদয়ঃ
নরেন্দ্র
পুঃ—মা-ঠাকুরাণীকে তাঁহার জন্মজন্মান্তরের দাসের পুনঃপুনঃ ধূল্যবলুণ্ঠিত সাষ্টাঙ্গ দিবে—তাঁহার আশীর্বাদ আমার সর্বতোমঙ্গল। ইতি
…………………………..
১৪৪
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
(মার্চ বা এপ্রিল), ১৮৯৪
কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্র পাইয়া সাতিশয় আহ্লাদিত হইলাম। তুমি খেতড়িতে থাকিয়া অনেক পরিমাণে স্বাস্থ্যলাভ করিয়াছ, ইহা বড়ই আনন্দের বিষয়।
তারক দাদা মান্দ্রাজে অনেক কার্য করিয়াছেন—বড়ই আনন্দের কথা! তাঁহার সুখ্যাতি অনেক শুনিলাম মান্দ্রাজবাসীদের নিকট। রাখাল ও হরি লক্ষ্ণৌ হইতে এক পত্র লিখিয়াছে, তাহাদের শারীরিক কুশল। মঠের সকল সংবাদ অবগত হইলাম শশীর পত্রে।
রাজপুতানার স্থানে স্থানে ঠাকুরদের ভিতর ধর্মভাব ও পরহিতৈষণা বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করিবে। কার্য করিতে হইবে। বসিয়া বসিয়া কার্য হয় না! মালসিসর আলসিসর আর যত ‘সর’ ওখানে আছে, মধ্যে মধ্যে পরিভ্রমণ করিতে থাক; আর সংস্কৃত, ইংরেজী সযত্নে অভ্যাস করিবে। গুণনিধি পাঞ্জাবে আছে বোধ হয়, তাহাকে আমার বিশেষ ভালবাসা জানাইয়া খেতড়িতে আনিবে ও তাহার সাহায্যে সংস্কৃত শিখিবে ও তাহাকে ইংরেজী শিখাইবে। যে প্রকারে পার, তাহার ঠিকানা আমায় দিবে। গুণনিধি অচ্যুতানন্দ সরস্বতী।
খেতড়ি শহরের গরীব নীচ জাতিদের ঘরে ঘরে গিয়া ধর্ম উপদেশ করিবে আর তাদের অন্যান্য বিষয়, ভূগোল ইত্যাদি মৌখিক উপদেশ করিবে। বসে বসে রাজভোগ খাওয়ায়, আর ‘হে প্রভু রামকৃষ্ণ’ বলায় কোন ফল নাই, যদি কিছু গরীবদের উপকার করিতে না পার। মধ্যে মধ্যে অন্য অন্য গ্রামে যাও, উপদেশ কর, বিদ্যা শিক্ষা দাও। কর্ম, উপাসনা, জ্ঞান—এই কর্ম কর, তবে চিত্তশুদ্ধি হইবে, নতুবা সব ভস্মে ঘৃত ঢালার ন্যায় নিষ্ফল হইবে। গুণনিধি আসিলে দুইজনে মিলিয়া রাজপুতানার গ্রামে গ্রামে গরীব দরিদ্রদের ঘরে ঘরে ফের। যদি মাংস খাইলে লোকে বিরক্ত হয়, তদ্দণ্ডেই ত্যাগ করিবে, পরোপকারার্থে ঘাস খাইয়া জীবন ধারণ করা ভাল। গেরুয়া কাপড় ভোগের জন্য নহে, মহাকার্যের নিশান—কায়মনোবাক্য ‘জগদ্ধিতায়’ দিতে হইবে। পড়েছ, ‘মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব’; আমি বলি, ‘দরিদ্রদেবো ভব, মূর্খদেবো ভব’। দরিদ্র, মূর্খ, অজ্ঞানী, কাতর—ইহারাই তোমার দেবতা হউক, ইহাদের সেবাই পরমধর্ম জানিবে। কিমধিকমিতি—
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৪৫
[অনাগারিক ধর্মপালকে লিখিত]
আমেরিকা
১৮৯৪
প্রিয় ধর্মপাল,
আমি তোমার কলিকাতার ঠিকানা ভুলে গিয়েছি, তাই মঠের ঠিকানায় এই পত্র পাঠালাম। আমি তোমার কলিকাতার বক্তৃতার কথা এবং উহা দ্বারা কিরূপ আশ্চর্য ফল হয়েছিল—সে সব শুনেছি।
… এখানকার জনৈক অবসরপ্রাপ্ত মিশনরী আমাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে একখানি পত্র লেখেন, তারপর তাড়াতাড়ি আমার সংক্ষিপ্ত উত্তরটি ছাপিয়ে একটা হুজুগ করবার চেষ্টা করেন। তবে তুমি অবশ্য জান, এখানকার লোকে এরূপ ভদ্রলোকদের কিরূপ ভেবে থাকে। আবার সেই মিশনরীটিই গোপনে আমার কতকগুলি বন্ধুর কাছে গিয়ে তাঁরা যাতে আমার কোন সহায়তা না করেন, সেই চেষ্টা করেন। অবশ্য তিনি তাঁদের কাছ থেকে নিছক ঘৃণাই পেয়েছেন। আমি এই লোকটার ব্যবহারে একেবারে অবাক হয়ে গেছি। একজন ধর্মপ্রচারকের এরূপ কপট ব্যবহার! দুঃখের বিষয়—প্রত্যেক দেশে, প্রত্যেক ধর্মেই এরূপ ভাব!
গত শীতকালে আমি এদেশে খুব বেড়িয়েছি—যদিও শীত অতিরিক্ত ছিল, আমার তত শীত বোধ হয়নি। মনে করেছিলাম—ভয়ানক শীত ভোগ করতে হবে, কিন্তু ভালয় ভালয় কেটে গেছে। ‘ফ্রি রিলিজিয়স সোসাইটি’র (Free Religious Society) সভাপতি কর্ণেল নেগিনসনকে তোমার অবশ্য স্মরণ আছে—তিনি খুব যত্নের সহিত তোমার খবরাখবর সব নিয়ে থাকেন। সেদিন অক্সফোর্ডের ডাঃ কার্পেণ্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। তিনি প্লীমাথে (plymouth) বৌদ্ধধর্মের নীতিতত্ত্ব সম্বন্ধে বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতাটি বৌদ্ধধর্মের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ। তিনি তোমার এবং তোমার কাগজের সম্বন্ধে খোঁজ করলেন। আশা করি, তোমার মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। যিনি ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ এসেছিলেন, তুমি তাঁর উপযুক্ত দাস।
অবসরমত দয়া করে আমার সম্বন্ধে সব কথা লিখবে। তোমার কাগজে আমি সময়ে সময়ে ক্ষণিকের জন্য তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে থাকি। ‘ইণ্ডিয়ান মিররের’ মহানুভব সম্পাদক মহাশয় আমার প্রতি সমানভাবে অনুগ্রহ করে আসছেন—সেজন্য তাঁকে অনুগ্রহপূর্বক আমার পরম ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাবে।
কবে আমি এদেশ ছাড়ব জানি না। তোমাদের থিওসফিক্যাল সোসাইটির মিঃ জজ (Mr. Judge) ও অন্যান্য অনেক সভ্যের সহিত আমার পরিচয় হয়েছে। তাঁরা সকলেই খুব ভদ্র ও সরল, আর অধিকাংশই বেশ শিক্ষিত।
মিঃ জজ খুব কঠোর পরিশ্রমী—তিনি থিওসফি প্রচারের জন্য সম্পূর্ণরূপে জীবন সমর্পণ করেছেন। এদেশে তাঁদের ভাব লোকের ভিতর খুব প্রবেশ করেছে, কিন্তু গোঁড়া ক্রিশ্চানরা তাঁদের পছন্দ করে না। সে তো তাদেরই ভুল। ছয় কোটি ত্রিশ লক্ষ লোকের মধ্যে এক কোটি নব্বই লক্ষ লোক কেবল খ্রীষ্টধর্মের কোন না কোন শাখার অন্তর্ভুক্ত। ক্রিশ্চানগণ বাকী লোকদের কোনরকম ধর্মই দিতে পারেন না। যাদের আদতে কোন ধর্ম নেই, থিওসফিষ্টরা যদি তাদের কোন না কোন আকারে ধর্ম দিতে কৃতকার্য হন, তাতে গোঁড়াদেরই বা আপত্তির কারণ কি, তা তো বুঝতে পারি না। কিন্তু খাঁটি গোঁড়া খ্রীষ্টধর্ম এদেশ হতে দ্রুতগতিতে উঠে যাচ্ছে। এখানে খ্রীষ্টধর্মের যে রূপ দেখতে পাওয়া যায়, তা ভারতের খ্রীষ্টধর্ম হতে এত তফাত যে, বলবার নয়। ধর্মপাল, তুমি শুনে আশ্চর্য হবে যে, এদেশে এপিস্কোপ্যাল ৩৩ এমন কি, প্রেসবিটেরিয়ান৩৪চার্চের ধর্মাচার্যদের মধ্যে আমার অনেক বন্ধু আছেন। তাঁরা তোমারই মত উদার, আবার তাঁদের নিজের ধর্ম অকপটভাবে বিশ্বাস করেন। প্রকৃত ধার্মিক লোক সর্বত্রই উদার হয়ে থাকেন। অন্তরের প্রেমই তাঁকে উদার হতে বাধ্য করে। কেবল যাদের কাছে ধর্ম একটা ব্যবসামাত্র, তারাই ধর্মের ভিতর সংসারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিবাদ ও স্বার্থপরতা এনে ব্যবসার খাতিরে এরূপ সঙ্কীর্ণ ও অনিষ্টকারী হতে বাধ্য হয়।
তোমার চিরভ্রাতৃপ্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৪৬*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
একটা পুরানো গল্প শোন। একটা লোক রাস্তা চলতে চলতে একটা বুড়োকে তার দরজার গোড়ায় বসে থাকতে দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলে—‘ভাই, অমুক গ্রামটা এখান থেকে কতদূর?’ বুড়োটা কোন জবাব দিলে না। তখন পথিক বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কিন্তু বুড়ো তবু চুপ করে রইল। পথিক তখন বিরক্ত হয়ে আবার রাস্তায় গিয়ে চলবার উদ্যোগ করলে। তখন বুড়ো দাঁড়িয়ে উঠে পথিককে সম্বোধন করে বললে, ‘আপনি অমুক গ্রামটার কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন—সেটা এই মাইল-খানেক হবে।’ তখন পথিক তাকে বললে, ‘তোমাকে এই একটু আগে কতবার ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, তখন তো তুমি একটা কথাও কইলে না—এখন যে বলছ, ব্যাপারখানা কি?’ তখন বুড়ো বললে, ‘ঠিক কথা। কিন্তু প্রথম যখন জিজ্ঞাসা করছিলেন, তখন চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন, আপনার যে যাবার ইচ্ছে আছে, ভাব দেখে তা বোধ হচ্ছিল না—এখন হাঁটতে আরম্ভ করেছেন, তাই আপনাকে বললাম।’
হে বৎস, এই গল্পটা মনে রেখো। কাজ আরম্ভ করে দাও, বাকী সব আপনা-আপনি হয়ে যাবে। গীতায় ভগবান্ বলেছেন—
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্॥ (গীতা, ৯।২২)
অর্থাৎ যারা আর কারও ওপর নির্ভর না করে কেবল আমার ওপর নির্ভর করে থাকে, তাদের যা কিছু দরকার, সব আমি যুগিয়ে দিই।
ভগবানের এ কথাটা তো আর স্বপ্ন বা কবিকল্পনা নয়।
প্রথম কথা হচ্ছে, আমি সময়ে সময়ে তোমায় অল্প স্বল্প করে টাকা পাঠাব। কারণ, প্রথম কলিকাতাতেও আমাকে ঐরকম কিছু কিছু টাকা—বরং মান্দ্রাজের চেয়ে কিছু বেশীই—পাঠাতে হবে। সেখানে আন্দোলন আমার ওপর নির্ভর করে শুধু যে শুরু হয়েছে তা নয়, উদ্দাম বেগে চলেছে। তাদের আগে দেখতে হবে। দ্বিতীয়তঃ কলিকাতা অপেক্ষা মান্দ্রাজে সাহায্য পাবার আশা বেশী আছে। আমার ইচ্ছা—এই দুটো কেন্দ্রই একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করুক। এখন কিছু পূজা পাঠ প্রচার—এই ভাবেই কাজ আরম্ভ করে দিতে হবে। সকলের মেলবার একটা জায়গা কর, সেখানে প্রতিসপ্তাহে কোনরকম একটু পূজা-আর্চা করে সভাষ্য উপনিষদ্ পাঠ হোক—এইরূপে আস্তে আস্তে কাজ আরম্ভ করে দাও। একবার চাকায় হাত লাগাও দেখি—চাকাটি ঠিক ঘুরে যাবে।
‘মিররে’ অভিনন্দনটা ছাপা হয়েছে, দেখলাম—ওরা যে এটা ভালভাবে নিয়েছে, তা ভালই। যার শেষ ভাল, তার সব ভাল।
এখন কাজে লাগ দেখি। জি. জি-র প্রকৃতিটা ভাবপ্রবণ, তোমার মাথা ঠাণ্ডা—দুজনে এক সঙ্গে মিলে কাজ কর। ঝাঁপ দাও—এই তো সবে আরম্ভ। আমেরিকার টাকায় হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের আশা অসম্ভব—প্রত্যেক জাতকে নিজেকে নিজে উদ্ধার করতে হবে। মহীশূরের মহারাজা, রামনাদের রাজা ও আর আর কয়েকজনকে এই কাজের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন করবার চেষ্টা কর। ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ আরম্ভ করে দাও। মান্দ্রাজে একটা জায়গা নেবার চেষ্টা কর—একটা কেন্দ্র যদি করতে পারা যায়, সেইটে একটা মস্ত জিনিষ হল, তারপর সেখান থেকে ছড়াতে থাক। ধীরে ধীরে কাজ আরম্ভ কর—প্রথমটা কয়েকজন গৃহস্থ প্রচারক নিয়ে কাজ আরম্ভ কর, ক্রমশঃ এমন লোক পাবে, যারা এই কাজের জন্য সারা জীবন দেবে। কারও ওপর হুকুম চালাবার চেষ্টা করো না—যে অপরের সেবা করতে পারে, সেই যথার্থ সর্দার হতে পারে। যত দিন না শরীর যাচ্ছে, অকপটভাবে কাজে লেগে থাক। আমার কাজ চাই—নামযশ টাকাকড়ি কিছু চাই না। কাজের আরম্ভটা যখন এমন সুন্দর হয়েছে, তখন তোমরা যদি কিছু না করতে পার, তবে তোমাদের ওপর আমার আর কিছু মাত্র বিশ্বাস থাকবে না। আমাদের আরম্ভটা বেশ সুন্দর হয়েছে। ভরসায় বুক বাঁধ। জি.জি-কে তো তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য কিছু করতে হয় না—সে কেন মান্দ্রাজে একটা জায়গার জন্য যাতে কিছু টাকার যোগাড় হয়, সেই উদ্দেশ্যে লোককে একটু তাতায় না? মান্দ্রাজে একটা কেন্দ্র হয়ে গেলে তারপর চারিদিকে কার্যক্ষেত্র বিস্তার করতে থাক। এখন সপ্তাহে একত্র হওয়া; একটু স্তব হল, কিছু শাস্ত্রপাঠ হল—তাহলেই যথেষ্ট। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হও—তাহলেই সিদ্ধি নিশ্চিত।
নিজেদের কাজে স্বাধীনতা না হারিয়ে কলিকাতার ভ্রাতৃবর্গের ওপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাভক্তি দেখাবে—কারণ, তারা যে সন্ন্যাসী।
কার্যসিদ্ধির জন্য আমার ছেলেদের আগুনে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এখন কেবল কাজ, কাজ, কাজ—বছর কতক বাদে স্থির হয়ে কে কতদূর করলে মিলিয়ে তুলনা করে দেখা যাবে। ধৈর্য, অধ্যবসায় ও পবিত্রতা চাই।
… এখন আমি হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কোন বই লিখছি না—এখন কেবল নিজের ভাবগুলো টুকে যাচ্ছি মাত্র—জানি না কবে সেগুলো পুস্তকাকারে নিবদ্ধ করে প্রকাশ করব।
বইএ আছে কি? জগৎ তো ইতোমধ্যেই নানা বাজে বইরূপ আবর্জনাস্তূপে ভরে গেছে। কাগজটা বার করবার চেষ্টা করো, তাতে কারও সমালোচনার দরকার নেই। তোমার যদি কিছু ভাব দেবার থাকে তা শিক্ষা দাও, তার ওপর আর এগিও না। তোমার যা ভাব দেবার থাকে দিয়ে যাও, বাকী প্রভু জানেন। মিশনরীদের এখানে কে গ্রাহ্য করে? তারা বিস্তর চেঁচিয়ে এখন থেমেছে। আমি তাদের নিন্দাবাদ লক্ষ্যই করি না, আর তাতে আমার ওপর সাধারণের ধারণা ভালই হয়েছে। আমাকে আর খবরের কাগজ পাঠিও না—যথেষ্ট এসেছে। কাজটা যাতে চলে, তার জন্য একটু চাউর হওয়ার দরকার হয়েছিল—খুব হয়ে গেছে। দেখ না অন্যান্য দলেরা কেমন এক রকম বিনা ভিত্তিতেই গড়ে তুলেছে। আর তোমাদের এমন সুন্দর আরম্ভ হয়েও তোমরা যদি কিছু করতে না পার, তবে আমি বড়ই নিরাশ হব। তোমরা যদি আমার সন্তান হও, তবে তোমরা কিছুই ভয় করবে না, কিছুতেই তোমাদের গতিরোধ করতে পারবে না। তোমরা সিংহতুল্য হবে। ভারতকে—সমগ্র জগৎকে জাগাতে হবে। এ না করলে চলবে না, কাপুরুষতা চলবে না—বুঝলে? মৃত্যু পর্যন্ত অবিচলিতভাবে লেগে পড়ে থেকে আমি যেমন দেখাচ্ছি, করে যেতে হবে—তবে তোমার সিদ্ধি নিশ্চিত। আসল কথা হচ্ছে গুরুভক্তি, মৃত্যু পর্যন্ত গুরুর ওপর বিশ্বাস। তা কি তোমার আছে? যদি থাকে, আর আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি আছে—তাহলে তুমি জেনে রাখ যে, তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। অতএব কাজে লেগে যাও—তোমার সিদ্ধি নিশ্চিত। প্রতি পদক্ষেপেই আমার শুভ ইচ্ছা এবং আশীর্বাদ তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। মিলেমিশে কাজ কর, সকলের সঙ্গে ব্যবহারে অত্যন্ত সহিষ্ণু হও। সকলকে আমার ভালবাসা জানাবে; আমি সর্বদা তোমাদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখছি। এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও। এই তো সবে আরম্ভ। এখানে একটু হইচই হলে ভারতে তার প্রবল প্রতিধ্বনি হয়। বুঝলে? সুতরাং তাড়াহুড়ো করে এখান থেকে চলে যাবার আমার দরকার নেই। আমাকে এখানে স্থায়ী একটা কিছু করে যেতে হবে—সেইটে আমি এখন ধীরে ধীরে করছি। দিন দিন আমার প্রতি এখানকার লোকের বিশ্বাস বাড়ছে। তোমাদের বুকের ছাতিটা খুব বেড়ে যাক। সংস্কৃত ভাষা বিশেষতঃ বেদান্তের তিনটে ভাষ্য অধ্যয়ন কর। প্রস্তুত হয়ে থাক। আমার অনেক রকম কাজ করবার মতলব আছে। উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা যাতে করতে পার, তার চেষ্টা কর। যদি তোমার বিশ্বাস থাকে, তবে তোমার সব শক্তি আসবে। কিডিকে এবং ওখানে আমার সকল সন্তানকে এই কথা বলো। তারা সকলেই বড় বড় কাজ করবে—দুনিয়া তা দেখে তাক লেগে যাবে। বুকে ভরসা বেঁধে কাজে লেগে যাও। তোমরা কিছু করে আমায় দেখাও; একটা মন্দির, একটা ছাপাখানা, একখানা কাগজ, থাকবার জন্য একখানা বাড়ী করে আমায় দেখাও। যদি মান্দ্রাজে আমার জন্য একখানা বাড়ী করতে না পার তো কোথায় গিয়ে থাকব? লোকের ভেতর বিদ্যুৎবেগে শক্তি সঞ্চার কর। টাকা ও প্রচারক যোগাড় কর। তোমাদের যা জীবনের ব্রত করেছ, তাতে দৃঢ়ভাবে লেগে থাক। এ পর্যন্ত যা করেছ, খুব ভালই হয়েছে। আরও ভাল কর, তার চেয়ে ভাল কর—এইরূপে এগিয়ে চল, এগিয়ে চল। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, এই পত্রের উত্তরে তুমি লিখবে যে, তোমরা কিছু করেছ। কারও সঙ্গে বিবাদ করো না, কারও বিরুদ্ধে লেগো না। রামা শ্যামা খ্রীষ্টান হয়ে যাচ্ছে, এতে আমার কি এসে যায়? তারা যা খুশী তাই হোক না। কেন বিবাদ-বিসংবাদের ভেতর মিশবে? যার যা ভাবই হোক না কেন, সকলের সকল কথা ধীরভাবে সহ্য কর। ধৈর্য, পবিত্রতা ও অধ্যবসায়ের জয় হবে। ইতি—
তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৪৭*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]
আমেরিকা
১৮৯৪
… জনৈক সংস্কৃত কবি বলিয়াছেন, ‘ন গৃহং গৃহমিত্যাহুর্গৃহিণী গৃহমুচ্যতে’—গৃহকে গৃহ বলে না, গৃহিণীকেই গৃহ বলা হয়, ইহা কত সত্য! যে গৃহছাদ তোমায় শীত গ্রীষ্ম বর্ষা হইতে রক্ষা করিয়া থাকে, তাহার দোষগুণ বিচার করিতে হইলে উহা যে স্তম্ভগুলির উপর দাঁড়াইয়া আছে, তাহা দেখিলে চলিবে না—হউক না সেগুলি অতি মনোহর কারুকার্যময় ‘করিন্থিয়ান’ স্তম্ভ। উহার বিচার করিতে হইবে গৃহের কেন্দ্রস্থানীয় সেই চৈতন্যময় প্রকৃত স্তম্ভের দ্বারা, যাহা গৃহস্থালীর প্রকৃত অবলন্বন—আমি নারীগণের কথা বলিতেছি। সেই আদর্শের দ্বারা বিচার করিলে আমেরিকার পারিবারিক জীবন জগতের যে-কোন স্থানের পারিবারিক জীবনের সহিত তুলনায় হীনপ্রভ হইবে না।
আমি আমেরিকার পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে অনেক বাজে গল্প শুনিয়াছি—শুনিয়াছি সেখানে নাকি নারীগণের চালচলন নারীর মত নহে, তাহারা নাকি স্বাধীনতা-তাণ্ডবে উন্মত্ত হইয়া পারিবারিক জীবনের সকল সুখশান্তি পদদলিত করিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ করে, এবং আরও ঐ প্রকারের নানা আজগুবি কথা শুনিয়াছি। কিন্তু একবৎসর কাল আমেরিকার পরিবার ও আমেরিকার নরনারীগণের সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া দেখিতেছি, ঐপ্রকার মতামত কি ভয়ঙ্কর অমূলক ও ভ্রান্ত! আমেরিকার নারীগণ! তোমাদের ঋণ আমি শত জন্মেও পরিশোধ করিতে পারিব না। তোমাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করিয়া উঠিতে পারি না। প্রাচ্য অতিশয়োক্তিই প্রাচ্য মানবের সুগভীর কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপনের একমাত্র উপযুক্ত ভাষা—
‘অসিতগিরিসমং স্যাৎ কজ্জলং সিন্ধুপাত্রে
সুরতুরুবরশাখা লেখনী পত্রমুর্বী।
লির্খতি যদি গৃহীত্বা সারদা সর্বকালং—’৩৫
‘যদি সাগর মস্যাধার, হিমালয় পর্বত মসী, পারিজাতশাখা লেখনী, পৃথিবী পত্র হয়, এবং স্বয়ং সরস্বতী লেখিকা হইয়া অনন্তকাল লিখিতে থাকেন,’ তথাপি তোমাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা-প্রকাশে অসমর্থ হইবে।
গত বৎসর গ্রীষ্মকালে আমি এক বহু দূরদেশ হইতে আগত, নাম-যশ-ধন-বিদ্যাহীন, বন্ধুহীন, সহায়হীন, প্রায় কপর্দকশূন্য পরিব্রাজক প্রচারকরূপে এদেশে আসি। সেই সময় আমেরিকার নারীগণ আমাকে সাহায্য করেন, আহার ও আশ্রয় দেন, তাঁহাদের গৃহে লইয়া যান, এবং আমাকে তাহাদের পুত্ররূপে, সহোদররূপে যত্ন করেন। যখন তাঁহাদের নিজেদের যাজককুল এই ‘বিপজ্জনক বিধর্মী’কে৩৬ ত্যাগ করিবার জন্য তাঁহাদিগকে প্ররোচিত করিতেছিলেন, যখন তাঁহাদের সর্বাপেক্ষা অন্তরঙ্গ বন্ধুগণ এই ‘অজ্ঞাতকুলশীল বিদেশীর, হয়তো বা সাংঘাতিক চরিত্রের লোকটির’ সঙ্গ ত্যাগ করিতে উপদেশ দিতেছিলেন, তখনও তাঁহারা আমার বন্ধুরূপে বর্তমান ছিলেন। এই মহামনা নিঃস্বার্থ পবিত্র নারীগণই—চরিত্র ও অন্তঃকরণ সম্বন্ধে বিচার করিতে অধিকতর নিপুণা, কারণ নির্মল দর্পণেই প্রতিবিম্ব পড়িয়া থাকে ।
কত শত সুন্দর পারিবারিক জীবন আমি দেখিয়াছি; কত শত জননী দেখিয়াছি, যাঁহাদের নির্মল চরিত্রের, যাঁহাদের নিঃস্বার্থ অপত্যস্নেহের বর্ণনা করিবার ভাষা আমার নেই। কত শত কন্যা ও কুমারী দেখিয়াছি, যাহারা ‘ডায়না দেবীর ললাটস্থ তুষারকণিকার ন্যায় নির্মল’—আবার বিলক্ষণ শিক্ষিতা এবং সর্বাধিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতিসম্পন্না। তবে কি আমেরিকার নারীগণ সকলেই দেবীস্বরূপা? তাহা নহে, ভাল মন্দ সকল স্থানেই আছে। কিন্তু যাদের আমরা অসৎ নামে অভিহিত করি, জাতির সেই দুর্বল মানুষগুলির দ্বারা সে সম্বন্ধে ধারণা করিলে চলিবে না; কারণ উহারা তো আগাছার মত পড়িয়াই থাকে। যাহা সৎ উদার ও পবিত্র, তাহা দ্বারাই জাতীয় জীবনের নির্মল ও সতেজ প্রবাহ নিরূপিত হয়।
একটি আপেল গাছ ও তাহার ফলের গুণাগুণ বিচার করিতে হইলে কি যে-সকল অপক্ব অপরিণত কীটদষ্ট ফল মাটিতে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়িয়া থাকে, তাহাদের সাহায্য লও যদিও কখনও কখনও তাহারাই সংখ্যায় অধিক? যদি একটি সুপক্ব ও পরিপুষ্ট ফল পাওয়া যায়, তবে সেই একটির দ্বারাই ঐ আপেল গাছের শক্তি সম্ভাবনা ও উদ্দেশ্য অনুমিত হয়, যে শত শত ফল অপরিণত রহিয়া গিয়াছে, তাহাদের দ্বারা নহে।
তারপর, আমি আমেরিকার আধুনিক রমণীগণের উদার মনের প্রশংসা করি। আমি এদেশে অনেক উদারমনা পুরুষও দেখিয়াছি, তাঁহাদের মধ্যে কেহ আবার অত্যন্ত সঙ্কীর্ণভাবাপন্য সম্প্রদায়ের। তবে একটি প্রভেদ আছে—পুরুষগণের পক্ষে একটি বিপদাশঙ্কা এই যে, তাঁহারা উদার হইতে গিয়া নিজেদের ধর্ম খোয়াইয়া বসিতে পারেন, কিন্তু নারীগণ যেখানে যাহা কিছু ভাল আছে, তাহার প্রতি সহানুভূতিহেতু উদারতা লাভ করিয়া থাকেন, অথচ নিজেদের ধর্ম হইতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না। তাঁহারা প্রাণে প্রাণে স্বতই অনুভব করেন যে, ধর্ম একটি ইতিবাচক (positive) ব্যাপার, নেতিবাচক (negative) নহে; যোগের ব্যাপার, বিয়োগের নহে। তাঁহারা প্রতিদিন এই সত্যটি হুদয়ঙ্গম করিতেছেন যে, প্রত্যেক জিনিষের হাঁ-এর দিকটাই, ইতিবাচক দিকটাই সঞ্চিত থাকে এবং প্রকৃতির এই অস্তিবাচক—এবং এই হেতু গঠনমূলক শক্তিসমূহের একীকরণ দ্বারাই পৃথিবীর নাস্তিবাচক ভাবগুলি বিনষ্ট হইয়া থাকে।
চিকাগোর এই বিশ্ব-মহামেলা কী অদ্ভুত ব্যাপার! আর সেই ধর্মমহামেলা, যাহাতে পৃথিবীর সকল দেশ হইতে লোক আসিয়া নিজ নিজ ধর্মমত ব্যক্ত করিয়াছিল, তাহাও কী অদ্ভুত! ডাক্তার ব্যারোজ ও মিঃ বনির অনুগ্রহে আমিও আমার ভাবগুলি সর্বসমক্ষে উপস্থাপিত করিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম। মিঃ বনি কী অদ্ভুত লোক! একবার ভাবিয়া দেখ দেখি, তিনি কিরূপ দৃঢ়চেতা ব্যক্তি, যিনি মানসনেত্রে এই বিরাট অনুষ্ঠানটির কল্পনা করিয়াছিলেন এবং উহাকে কার্যে পরিণত করিতেও প্রভূত সফলতা লাভ করিয়াছিলেন। তিনি আবার যাজক ছিলেন না; তিনি নিজে একজন উকিল হইয়াও যাবতীয় ধর্মসম্প্রদায়ের পরিচালকগণের নেতা ছিলেন। তিনি মধুরস্বভাব, বিদ্বান ও সহিষ্ণু ছিলেন—তাঁহার হৃদয়ের গভীর মর্মস্পর্শী ভাবসমূহ তাঁহার উজ্জ্বল নয়নদ্বয়ে ব্যক্ত হইত। … ইতি
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৪৮
[স্বামী অভেদানন্দকে লিখিত]
আমেরিকা
(নভেম্বর), ১৮৯৪
প্রিয় কালী,
তোমার পত্রে সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। ‘ট্রিবিউন’ পত্রে উক্ত টেলিগ্রাফ বাহির হওয়ার কোন সংবাদ পাই নাই। চিকাগো নগর ছয়মাস যাবৎ ত্যাগ করিয়াছি, এখনও যাইবার সাবকাশ নাই; এজন্য বিশেষ খবর লইতে পারি নাই। তোমার পরিশ্রম অত্যন্ত হইয়াছে, তার জন্য তোমায় কি ধন্যবাদই বা দিই? অদ্ভুত কার্যক্ষমতা তোমরা দেখাইয়াছ। ঠাকুরের কথা কি মিথ্যা হয়? তোমাদের সকলের মধ্যে অদ্ভুত তেজ আছে। শশী সাণ্ডেলের বিষয় পূর্বেই লিখিয়াছি। ঠাকুরের কৃপায় কিছু চাপা থাকে না। তবে তিনি সম্প্রদায়স্থাপনাদি করুন, হানি কি? ‘শিবা বঃ সন্তু পন্থানঃ’৩৭। দ্বিতীয়তঃ তোমার পত্রের মর্ম বুঝিলাম না।আমি অর্থসংগ্রহ করিয়া আপনাদের মঠ স্থাপন করিব, ইহাতে যদি লোকে নিন্দা করে তো আমার কোন ক্ষতিবৃদ্ধি দেখি না। কূটস্থ বুদ্ধি তোমাদের আছে, কোন হানি হইবে না। তোমাদের পরস্পরের উপর নিরতিশয় প্রেম থাকুক, ইতর-সাধারণের উপর উপেক্ষাবুদ্ধি ধারণ করিলেই যথেষ্ট। কালীকৃষ্ণবাবু অনুরাগী ও মহৎ ব্যক্তি। তাঁহাকে আমার বিশেষ প্রণয় কহিও। যতদিন তোমরা পরস্পরের উপর ভেদবুদ্ধি না করিবে, ততদিন প্রভুর কৃপায় ‘রণে বনে পর্বতমস্তকে বা’ তোমাদের কোন ভয় নাই। ‘শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি’,৩৮ ইহা তো হইবেই। অতি গম্ভীর বুদ্ধি ধারণ কর। বালবুদ্ধি জীবে কে বা কি বলিতেছে, তাহার খবরমাত্রও লইবে না। উপেক্ষা, উপেক্ষা, উপেক্ষা ইতি।
শশীকে পূর্বে লিখিয়াছি সবিশেষ। খবরের কাগজ, পুস্তকাদি পাঠাইও না। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে—দেশেও ঘুরে মরা, এদেশেও তাই, বাড়ার ভাগ বোঝা বওয়া। এদেশে আমি কেমন করে লোকের পুস্তকের খদ্দের জোটাই বল? আমি একটা সাধারণ মানুষ বৈ নয়। এদেশের খবরের কাগজ প্রভৃতিতে যাহা কিছু আমার বিষয় লেখে, আমি তাহা অগ্নিদেবকে সমর্পণ করি। তোমরাও তাহাই কর। তাহাই ব্যবস্থা।
ঠাকুরের কাজের জন্য একটু হাঙ্গামের দরকার ছিল, তা হয়ে গেছে, বেশ কথা; এক্ষণে ইতরগুলো কি বকে না বকে, তাতে কোন রকমে তোমরা কর্ণপাত করিবে না। আমি টাকা রোজগার করি বা যা করি, হেঁজিপেঁজি লোকের কথায় কি তাঁর কাজ আটকাবে? ভায়া, তুমি এখন ছেলেমানুষ। আমার চুলে পাক ধরেছে। হেঁজিপেঁজি লোকদের কথায় আর মতামতের উপর আমার শ্রদ্ধা আঁচে বুঝে লও। তোমরা যতদিন কোমর বেঁধে এককাট্টা হয়ে আমার পিছে দাঁড়াবে, ততদিন পৃথিবী একত্র হলেও কোন ভয় নাই। ফলে এই পর্যন্ত বুঝিলাম যে, আমাকে অতি উচ্চ আসন গ্রহণ করিতে হইবে। তোমাদের ছাড়া আর কাহাকেও পত্র লিখিব না। ইতি।
বলি, গুণনিধি কোথায় আছে, খোঁজ করে তাকে মঠে যত্ন করে আনবার চেষ্টা করিবে। সে লোকটা অতি sincere (অকপট) ও বড়ই পণ্ডিত। তোমরা দুটো জায়গার ঠিকানা করবেই করবে, যে যা বলে, বলে যাক। খবরের কাগজে আমার স্বপক্ষে অথবা বিপক্ষে কে কি লেখে, লিখুক; গ্রাহ্যমধ্যেই আনবে না। আর দাদা, বার বার ব্যাগত্তা করি,৩৯ আর ঝুড়ি ঝুড়ি খবরের কাগজাদি পাঠাইও না। বিশ্রাম এখন কোথায়? আমরা যখন শরীর ছেড়ে দিব, তখন কিছুদিন বিশ্রাম করিব। ভায়া, ঐ তেজে একবার মহোৎসব কর দিকি। রৈ রৈ হয়ে যাক। ওয়া বাহাদুর! সাবাস! নিধে পেলার দল প্রেমের তরঙ্গে ভেসে চলে যাবে।তোমরা হলে হাতী, পিঁপড়ের কামড়ে কি তোমাদের ভয়?
তোমার প্রেরিত Address (অভিনন্দন) অনেক দিন হল এসেছে এবং তার জবাবও চলে গেছে প্যারীবাবুর নিকট।
এই কথা মনে রেখো—দুটো চোখ, দুটো কান, কিন্তু একটা মুখ। উপেক্ষা, উপেক্ষা, উপেক্ষা। ‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি।’৪০ ভয় কার? কাদের ভয় রে ভাই? এখানে মিশনরী-ফিশনরী চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ক্ষান্ত হয়ে গেছে—অমনি সকল জগৎ হবে।
‘নিন্দন্তু নীতিনিপুণাঃ যদি বা স্তুবন্তু
লক্ষ্মীঃ সমাবিশতু গচ্ছতু বা যথেষ্টম্।
অদ্যৈব বা মরণমস্তু শতান্তরে বা
ন্যায্যাৎ পথঃ প্রবিচলন্তি পদং ন ধীরাঃ॥’৪১
কিমধিকমিতি। হেঁজিপেঁজিদের সঙ্গে মেশবারও আবশ্যক নাই। ওদের কাছে ভিক্ষেও করতে হবে না। ঠাকুর সব জোটাচ্ছেন এবং জোটাবেন। ভয় কি রে ভাই? সকল বড় কাজ মহা বিঘ্নের মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে। হে বীর ‘স্মর পৌরুষমাত্মনঃ উপেক্ষিতব্যাঃ জনাঃ সুকৃপণাঃ কামকাঞ্চনবশগাঃ।’৪২ এক্ষণে আমি এদেশে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ। অতএব আমার সহায়তার আবশ্যক নাই। কিন্তু আমার সহায়তা করিতে যাইয়া ভ্রাতৃস্নেহাৎ তোমাদের মধ্যে যে পৌরুষের আবির্ভাব হইয়াছে, তাহা প্রভুর কার্যে নিযুক্ত কর, এই তোমাদের নিকট আমার প্রার্থনা। মনের ভাব বিশেষ উপকার বোধ না হইলে প্রকাশ করিবে না। প্রিয় হিতবচন মহাশত্রুরও প্রতি প্রয়োগ করিবে।
হে ভাই, নামযশের ধনের ভোগের ইচ্ছা জীবের স্বতই আছে। তাহাতে যদি দুদিক চলে তো সকলেই আগ্রহ করিতে থাকে। ‘পরগুণ-পরমাণুং পর্বতীকৃত্য’ অপিচ, ত্রিভুবনের উপকারমাত্র ইচ্ছা মহাপুরুষেরই হয়। অতএব বিমূঢ়মতি অনাত্মদর্শী তমসাচ্ছন্নবুদ্ধি জীবকে বালচেষ্টা করিতে দাও। গরম ঠেকলেই আপনি পালিয়ে যাবে! চাঁদে থুথু ফেলবার চেষ্টা করুক; ‘শুভং ভবতু তেষাম্’ (তাদের মঙ্গল হউক)। যদি তাদের মধ্যে মাল থাকে, সিদ্ধি কে বারণ করতে পারে? যদি ঈর্ষাপরবশ হয়ে আস্ফালন মাত্র করে তো সব বৃথা হবে।
হরমোহন মালা পাঠিয়েছেন। বেশ কথা। বলি, এদেশে আমাদের দেশের মত ধর্ম চলে না। তবে এদের দেশের মত করে দিতে হয়। এদের হিন্দু হতে বললে এরা সকলে পালিয়ে যাবে ও ঘৃণা করবে, যেমন আমরা খ্রীষ্ট-মিশনরীদের ঘৃণা করি। তবে হিঁদুশাস্ত্রের কতক ভাব এরা ভালবাসে, এই পর্যন্ত। অধিক কিছুই নয় জানিবে। পুরুষেরা অধিকাংশই ধর্ম-টর্ম নিয়ে মাথা বকায় না, মেয়েদের মধ্যে কিছু কিছু, এইমাত্র—বাড়াবাড়ি কিছুই নাই। ২/৪ হাজার লোক অদ্বৈতমতের উপর শ্রদ্ধাবান। তবে পুঁথি, জাতি, মেয়েমানুষ নষ্টের গোড়া—ইত্যাদি বললে দূরে পালিয়ে যাবে। ধীরে ধীরে সব হয়। Patience, purity, perseverance (ধৈর্য, পবিত্রতা, অধ্যবসায়)। ইতি—
নরেন্দ্র
…………………………..
১৪৯
[স্বামী শিবানন্দকে লিখিত]৪৩
আমেরিকা
১৮৯৪
প্রিয় শিবানন্দ,
এইমাত্র তোমার পত্র পেলাম। সম্ভবতঃ ইতোমধ্যে তুমি আমার অন্য চিঠিগুলি পেয়েছ এবং জেনেছ যে, আর আমেরিকায় কিছু পাঠাবার দরকার নাই। কোন কিছুরই বাড়াবাড়ি ভাল নয়। এই যে খবরের কাগজগুলো আমায় বাড়িয়ে তুলছে, তাতে আমার খ্যাতি হয়েছে সন্দেহ নাই, কিন্তু এর ফল এখানকার চেয়ে ভারতে বেশী। এখানে বরং রাতদিন খবরের কাগজে নাম বাজতে থাকলে উচ্চশ্রেণীর লোকদের মনে বিরক্তি জন্মায়; অতএব যথেষ্ট হয়েছে। এখন এই সকল সভার অনুসরণে ভারতে সঙ্ঘবদ্ধ হতে চেষ্টা কর। আর এদেশে কিছু পাঠাবার দরকার নাই। প্রথমে মাতাঠাকুরাণীর জন্য একটি জায়গা করবার দৃঢ়সঙ্কল্প করেছি, কারণ মেয়েদের জায়গাই প্রথম দারকার। … যদি মায়ের বাড়ীটি প্রথমে ঠিক হয়ে যায়, তাহলে আর আমি কোন কিছুর জন্য ভাবি না। … আমি ইতিপূর্বেই ভারতবর্ষে চলে যেতাম, কিন্তু ভারতবর্ষে টাকা নাই। হাজার হাজার লোক রামকৃষ্ণ পরমহংসকে মানে, কিন্তু কেউ একটি পয়সা দেবে না—এই হচ্ছে ভারতবর্ষ। এখানে লোকের টাকা আছে, আর তারা দেয়। আসছে শীতে আমি ভারতবর্ষে যাচ্ছি। ততদিন তোমরা মিলেমিশে থাক।
জগৎ উচ্চ উচ্চ নীতির (principles) জন্য আদৌ ব্যস্ত নয়; তারা চায় ব্যক্তি (person)। তারা যাকে পছন্দ করে, তার কথা ধৈর্যের সহিত শুনবে, তা যতই অসার হোক না কেন—কিন্তু যাকে তারা পছন্দ করে না, তার কথা শুনবেই না। এইটি মনে রেখো এবং লোকের সহিত সেইমত ব্যবহার করো। সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি শাসন করতে চাও, সকলের গোলাম হয়ে যাও। এই হল আসল রহস্য। কথাগুলি রুক্ষ হলেও ভালবাসায় ফল হবেই। যে-কোন ভাষার আবরণেই থাকুক না কেন, ভালবাসা মানুষ আপনা হতেই বুঝতে পারে।
ভায়া, রামকৃষ্ণ পরমহংস যে ভগবানের বাবা, তাতে আমার সন্দেহমাত্র নাই; তবে তিনি কি বলতেন, লোককে দেখতে দাও; তুমি জোর করে কি দেখাতে পার?—এইমাত্র আমার objection (আপত্তি)।
লোকে বলুক, আমরা কি বলব? দাদা, বেদ-বেদান্ত পুরাণ-ভাগবতে যে কি আছে, তা রামকৃষ্ণ পরমহংসকে না পড়লে কিছুতেই বুঝা যাবে না। His life is a searchlight of infinite power thrown upon the whole mass of Indian religious thought. He was the living commentary to the Vedas and to their aim. He had lived in one life the whole cycle of the national religious existence in India.৪৪
ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ জন্মেছিলেন কিনা, বুদ্ধ চৈতন্য প্রভৃতি একঘেয়ে, রামকৃষ্ণ পরমহংস the latest and the most perfect (সবচেয়ে আধুনিক এবং সবচেয়ে পূর্ণবিকশিত চরিত্র)—জ্ঞান, প্রেম, বৈরাগ্য, লোকহিতচিকীর্ষা, উদারতার জমাট; কারুর সঙ্গে কি তাঁহার তুলনা হয়? তাঁকে যে বুঝতে পারে না, তাঁর জন্ম বৃথা। আমি তাঁর জন্মজন্মান্তরের দাস, এই আমার পরম ভাগ্য, তাঁর একটা কথা বেদবেদান্ত অপেক্ষা অনেক বড়। তস্য দাস দাস-দাসোঽহং। তবে একঘেয়ে গোঁড়ামি দ্বারা তাঁর ভাবের ব্যাঘাত হয়—এইজন্য চটি। তাঁর নাম বরং ডুবে যাক—তাঁর উপদেশ (শিক্ষা) ফলবতী হোক। তিনি কি নামের দাস?
ভায়া, যীশুখ্রীষ্টকে জেলে-মালায় ভগবান্ বলেছিল, পণ্ডিতেরা মেরে ফেললে; বুদ্ধকে বেনে-রাখালে তাঁর জীবদ্দশায় মেনেছিল। রামকৃষ্ণকে জীবদ্দশায়—নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরির (ঊনবিংশ শতাব্দীর) শেষভাগে ইউনিভার্সিটির ভূত ব্রহ্মদত্যিরা ঈশ্বর বলে পূজা করেছে। … হাজার হাজার বৎসর পূর্বে তাঁদের (কৃষ্ণ, বুদ্ধ, খ্রীষ্ট প্রভৃতির) দু-দশটি কথা পুঁথিতে আছে মাত্র। ‘যার সঙ্গে ঘর করিনি, সেই বড় ঘরনী’—এ যে আজন্ম দিনরাত্রি সঙ্গ করেও তাঁদের চেয়ে ঢের বড় বলে বোধ হয়, এই ব্যাপারটা কি বুঝতে পার ভায়া?
মা-ঠাকরুন কি বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেহই পার না, ক্রমে পারবে। ভায়া, শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না। আমাদের দেশ সকলের অধম কেন, শক্তিহীন কেন?—শক্তির অবমাননা সেখানে বলে। মা-ঠাকুরাণী ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে। দেখছ কি ভায়া, ক্রমে সব বুঝবে। এইজন্য তাঁর মঠ প্রথমে চাই। রামকৃষ্ণ পরমহংস বরং যান, আমি ভীত নই। মা-ঠাকরাণী গেলে সর্বনাশ! শক্তির কৃপা না হলে কি ঘোড়ার ডিম হবে! আমেরিকা ইওরোপে কি দেখছি?—শক্তির পূজা, শক্তির পূজা। তবু এরা অজান্তে পূজা করে, কামের দ্বারা করে। আর যারা বিশুদ্ধভাবে, সাত্ত্বিকভাবে মাতৃভাবে পূজা করবে, তাদের কী কল্যাণ না হবে! আমার চোখ খুলে যাচ্ছে, দিন দিন সব বুঝতে পারছি। সেইজন্য আগে মায়ের জন্য মঠ করতে হবে। আগে মা আর মায়ের মেয়েরা, তারপর বাবা আর বাপের ছেলেরা, এই কথা বুঝতে পার কি?
সকলে ভাল, সকলকে আশীর্বাদ কর। দাদা, দুনিয়াময় তাঁর ঘর ছাড়া আর সকল জায়গাতেই যে ভাবের ঘরে চুরি! দাদা, রাগ করো না, তোমরা এখনও কেউ মাকে বোঝনি। মায়ের কৃপা আমার উপর বাপের কৃপার চেয়ে লক্ষ গুণ বড়। … ঐ মায়ের দিকে আমিও একটু গোঁড়া। মার হুকুম হলেই বীরভদ্র ভূতপ্রেত সব করতে পারে। তারক ভায়া, আমেরিকা আসবার আগে মাকে আশীর্বাদ করতে চিঠি লিখেছিলুম, তিনি এক আশীর্বাদ দিলেন, অমনি হুপ্ করে পগার পার, এই বুঝ। দাদা, এই দারুণ শীতে গাঁয়ে গাঁয়ে লেকচার করে লড়াই করে টাকার যোগাড় করছি—মায়ের মঠ হবে।
বাবুরামের মার বুড়োবয়সে বুদ্ধির হানি হয়েছে। জ্যান্ত দুর্গা ছেড়ে মাটির দুর্গা পূজা করতে বসেছে। দাদা, বিশ্বাস বড় ধন; দাদা, জ্যান্ত দুর্গার পূজা দেখাব, তবে আমার নাম। তুমি জমি কিনে জ্যান্ত দুর্গা মাকে যে দিন বসিয়া দেবে, সেই দিন আমি একবার হাঁফ ছাড়ব। তার আগে আমি দেশে যাচ্ছি না। যত শীঘ্র পারবে—। টাকা পাঠাতে পারলে আমি হাঁফ ছাড়ে বাঁচি; তোমরা যোগাড় করে এই আমার দুর্গোৎসবটি করে দাও দেখি। গিরিশ ঘোষ মায়ের পূজা খুব করছে, ধন্য সে, তার কুল ধন্য। দাদা, মায়ের কথা মনে পড়লে সময় সময় বলি, ‘কো রামঃ?’ দাদা, ও ঐ যে বলছি, ওইখানটায় আমার গোঁড়ামি।
রামকৃষ্ণ পরমহংস ঈশ্বর ছিলেন কি মানুষ ছিলেন, যা হয় বলো দাদা, কিন্তু যার মায়ের উপর ভক্তি নাই, তাকে ধিক্কার দিও।
নিরঞ্জন লাঠিবাজি করে, কিন্তু তার মায়ের উপর বড় ভক্তি। তার লাঠি হজম হয়ে যায়। নিরঞ্জন এমন কার্য করছে যে, তোমরা শুনলে অবাক হয়ে যাবে। আমি খবর রাখছি। তুমিও যে মান্দ্রাজীদের সঙ্গে যোগদান করে কার্য করছ, সে বড়ই ভাল। দাদা, তোমার উপর আমার ঢের ভরসা, সকলকে মিলেমিশে চালাও ভায়া। মায়ের জমিটা যেমন করেছ, অমনি আমি হুপ্ করে আসছি আর কি। জমিটা বড় চাই, building (বাড়ী) আপাততঃ মাটির ঘর ভাল, ক্রমে ভাল building (পাকা) তুলব, চিন্তা নাই।
ম্যালেরিয়ার প্রধান কারণ জল। দুটো তিনটে ফিলটার তৈয়ার কর না কেন? জল সিদ্ধ করে ফিলটার করলে কোন ভয় থাকে না।
হরিশের কথা তো কিছুই শুনতে পাই না। আর দক্ষরাজা কেমন আছে? সকলের বিশেষ খবর চাই। আমাদের মঠের চিন্তা নাই, আমি দেশে গিয়ে সব ঠিকঠাক করব।
দুটো বড় Pasteur’s bacteria-proof (পাস্তুরের জীবাণু-প্রতিষেধক) ফিলটার কিনবে; সেই জলে রান্না, সেই জলে খাওয়া—ম্যালেরিয়ার বাপ পালিয়ে যাবে। … On and on; work, work, work; this is only the beginning. (এগিয়ে চল; কাজ, কাজ, কাজ; এই তো সবে আরম্ভ)।
কিমধিকমিতি—
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৫০
[মঠে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
১৮৯৪
হে ভ্রাতৃবৃন্দ, ইতঃপূর্বে তোমাদের এক পত্র লিখি, সময়াভাবে তাহা অসম্পূর্ণ। রাখাল ও হরি লক্ষ্ণৌ হইতে এক পত্র লেখেন। তাঁহারা—হিন্দু খবরের কাগজরা আমার সুখ্যাতি করিতেছে, এই কথা লেখেন ও তাঁহারা বড় আনন্দিত যে, ২০ হাজার লোক খিচুড়ি খেয়েছে। যদি কলিকাতা অথবা মান্দ্রাজের হিন্দুরা সভা করে রিজলিউশন পাস করিত যে, ইনি আমাদের প্রতিনিধি এবং আমেরিকার লোকেদের অভিনন্দন করিত—আমাকে যত্ন করিয়াছে বলিয়া, তাহলে অনেক কাজ এগিয়ে যেত। কিন্তু এক বৎসর হয়ে গেল, কই কিছুই হল না! অবশ্য বাঙালীদের উপর আমার কিছুই ভরসা ছিল না; তবে মান্দ্রাজবাসীরাও কিছু করতে পারলে না। …
আমাদের জাতের কোন ভরসা নাই। কোন একটা স্বাধীন চিন্তা কাহারও মাথায় আসে না—সেই ছেঁড়া কাঁথা, সকলে পড়ে টানাটানি—রামকৃষ্ণ পরমহংস এমন ছিলেন, তেমন ছিলেন; আর আষাঢ়ে গপ্পি—গপ্পির আর সীমা-সীমান্ত নাই। হরে হরে, বলি একটা কিছু করে দেখাও যে তোমরা কিছু অসাধারণ—খালি পাগলামি! আজ ঘণ্টা হল, কাল তার উপর ভেঁপু হল, পরশু তার ওপর চামর হল, আজ খাট হল, কাল খাটের ঠ্যাঙে রূপো বাঁধান হল—আর লোকে খিচুড়ি খেলে আর লোকের কাছে আষাঢ়ে গল্প ২০০০ মারা হল—চক্রগদা- পদ্মশঙ্খ—আর শঙ্খগদাপদ্মচক্র—ইত্যাদি, একেই ইংরেজীতে imbecility (শারীরিক ও মানসিক বলহীনতা) বলে—যাদের মাথায় ঐ রকম বেল্কোমো ছাড়া আর কিছু আসে না, তাদের নাম imbecile (ক্লীব)—ঘণ্টা ডাইনে বাজবে বা বাঁয়ে, চন্দনের টিপ মাথায় কি কোথায় পরা যায়—পিদ্দিম দুবার ঘুরবে বা চারবার—ঐ নিয়ে যাদের মাথা দিন রাত ঘামতে চায়, তাহাদেরই নাম হতভাগা; আর ঐ বুদ্ধিতেই আমরা লক্ষ্মীছাড়া জুতোখেকো, আর এরা ত্রিভুবন বিজয়ী। কুঁড়েমিতে আর বৈরাগ্যে আকাশ-পাতাল তফাত।
যদি ভাল চাও তো ঘণ্টাফণ্টাগুলোকে গঙ্গার জলে সঁপে দিয়ে সাক্ষাৎ ভগবান্ নর-নারায়ণের—মানবদেহধারী হরেক মানুষের পূজো করগে—বিরাট আর স্বরাট। বিরাট রূপ এই জগৎ, তার পূজো মানে তার সেবা—এর নাম কর্ম; ঘণ্টার উপর চামর চড়ান নয়, আর ভাতের থালা সামনে ধরে দশ মিনিট বসব কি আধ ঘণ্টা বসব—এ বিচারের নাম ‘কর্ম’ নয়, ওর নাম পাগলা-গারদ। ক্রোর টাকা খরচ করে কাশী বৃন্দাবনের ঠাকুরঘরের দরজা খুলছে আর পড়ছে। এই ঠাকুর কাপড় ছাড়ছেন, তো এই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন, তো এই ঠাকুর আঁটকুড়ির বেটাদের গুষ্টির পিণ্ডি করছেন; এদিকে জ্যান্ত ঠাকুর অন্ন বিনা, বিদ্যা বিনা মরে যাচ্ছে। বোম্বায়ের বেনেগুলো ছারপোকার হাসপাতাল বানাচ্ছে—মানুষগুলো মরে যাক। তোদের বুদ্ধি নাই যে, এ-কথা বুঝিস—আমাদের দেশের মহা ব্যারাম—পাগলা-গারদ দেশময়।
যাক, তোমাদের মধ্যে যারা একটু মাথাওয়ালা আছে, তাঁদের চরণে আমার দণ্ডবৎ ও তাঁদের কাছে আমার এই প্রার্থনা যে, তাঁরা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ুন—এই বিরাটের উপাসনা প্রচার করুন, যা আমাদের দেশে কখনও হয় নাই। লোকের সঙ্গে ঝগড়া করা নয়, সকলের সঙ্গে মিশতে হবে। Idea (ভাব) ছড়া গাঁয়ে গাঁয়ে, ঘরে ঘরে যা—তবে যথার্থ কর্ম হবে। নইলে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা আর মধ্যে মধ্যে ঘণ্টা নাড়া, কেবল রোগ বিশেষ। … Independent (স্বাধীন) হ, স্বাধীন বুদ্ধি খরচ করতে শেখ্ … অমুক তন্ত্রের অমুক পটলে ঘণ্টার বাঁটের যে দৈর্ঘ্য দিয়েছে, তাতে আমার কি? প্রভুর ইচ্ছায় ক্রোর তন্ত্র, বেদ, পুরাণ তোদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবে। … যদি কাজ করে দেখাতে পারিস, যদি এক বৎসরের মধ্যে দু-চার লাখ চেলা ভারতে জায়গায় জায়গায় করতে পারিস, তবে বুঝি। তবেই তোদের উপর আমার ভরসা হবে, নইলে ইতি।
সেই যে বোম্বাই থেকে এক ছোকরা মাথা মুড়িয়ে তারকদার সঙ্গে রামেশ্বরে যায়, সে বলে, আমি রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য। রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য! না দেখা, না শোনা—একি চ্যাংড়াম নাকি? গুরুপরম্পরা ভিন্ন কোন কাজ হয় না—ছেলেখেলা নাকি? সে ছোঁড়াটা যদি দস্তুরমত পথে না চলে, দূর করে দেবে। গুরুপরম্পরা অর্থাৎ সেই শক্তি যা গুরু হতে শিষ্যে আসে, আবার তাঁর শিষ্যে যায়, তা ভিন্ন কিছুই হবার নয়। উড়ধা—আমি রামকৃষ্ণের শিষ্য, একি ছেলেখেলা নাকি? আমাকে জগমোহন বলেছিল যে, একজন বলে তোমার গুরুভাই, আমি এখন ঠাউরে ধরেছি, সেই ছোকরা। গুরুভাই কি রে? হাঁ, চেলা বলতে লজ্জা করে! একদম গুরু বন্বে! দূর করে দিও যদি দস্তুরমত পথে না চলে।
ঐ যে তুলসী ও খোকার মনের অশান্তি, তার মানে কোন কাজ নাই। ঐ যে নিরঞ্জনেরও—তার মানে কোন কাজ নাই। গাঁয়ে গাঁয়ে যা, ঘরে ঘরে যা; লোকহিত, জগতের কল্যাণ কর—নিজে নরকে যাও, পরের মুক্তি হোক—আমার মুক্তির বাপ নির্বংশ। নিজের ভাবনা যখনই ভাববে তুলসী, তখনি মনে অশান্তি। তোমার শান্তির দরকার কি বাবাজী? সব ত্যাগ করেছ, এখন শান্তির ইচ্ছা, মুক্তির ইচ্ছাটাকেও ত্যাগ করে দাও তো বাবা। কোন চিন্তা রেখো না; নরক স্বর্গ ভক্তি বা মুক্তি সব don’t care (গ্রাহ্য করো না), আর ঘরে ঘরে নাম বিলোও দিকি বাবাজী। আপনার ভাল কেবল পরের ভালয় হয়, আপনার মুক্তি এবং ভক্তিও পরের মুক্তি ও ভক্তিতে হয়—তাইতে লেগে যাও, মেতে যাও, উন্মাদ হয়ে যাও। ঠাকুর যেমন তোমাদের ভালবাসতেন, আমি যেমন তোমাদের ভালবাসি, তোমরা তেমনি জগৎকে ভালবাস দেখি।
সকলকে একত্র কর। গুণনিধি কোথায়? তাকে তোমাদের কাছে আনবে। তাকে আমার অনন্ত ভালবাসা। গুপ্ত কোথা? সে আসতে চায় আসুক। আমার নাম করে তাকে ডেকে আনো। এই ক-টি কথা মনে রেখো—
১ | আমরা সন্ন্যাসী, ভক্তি ভুক্তি মুক্তি—সব ত্যাগ।
২ | জগতের কল্যাণ করা, আচণ্ডালের কল্যাণ করা—এই আমাদের ব্রত, তাতে মুক্তি আসে বা নরক আসে।
৩| রামকৃষ্ণ পরমহংস জগতের কল্যাণের জন্য এসেছিলেন। তাঁকে মানুষ বল বা ঈশ্বর বল বা অবতার বল, আপনার আপনার ভাবে নাও।
৪| যে তাঁকে নমস্কার করবে, সে সেই মুহূর্তে সোনা হয়ে যাবে। এই বার্তা নিয়ে ঘরে ঘরে যাও দিকি বাবাজী—অশান্তি দূর হয়ে যাবে। ভয় করো না—ভয়ের জায়গা কোথা? তোমরা তো কিছু চাও না—এতদিন তাঁর নাম, তোমাদের চরিত্র চারিদিকে ছড়িয়েছ, বেশ করেছ; এখন organised (সঙ্ঘবদ্ধ) হয়ে ছড়াও—প্রভু তোমাদের সঙ্গে, ভয় নাই।
আমি মরি আর বাঁচি, দেশে যাই বা না যাই, তোমরা ছড়াও, প্রেম ছড়াও। গুপ্তকেও এই কাজে লাগাও। কিন্তু মনে রেখো, পরকে মারতে ঢাল খাঁড়ার দরকার। ‘সন্নিমিত্তে বরং ত্যাগো বিনাশে নিয়তে সতি’—যখন মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, তখন সৎ বিষয়ের জন্য দেহত্যাগই শ্রেয়। ইতি
পুঃ—পূর্বের চিঠি মনে রেখো—মেয়ে-মদ্দ দু-ই চাই, আত্মাতে মেয়েপুরুষের ভেদ নাই। তাঁকে অবতার বললেই হয় না—শক্তির বিকাশ চাই। হাজার হাজার পুরুষ চাই, স্ত্রী চাই—যারা আগুনের মত হিমাচল থেকে কন্যাকুমারী—উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু, দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়বে। ছেলেখেলার কাজ নেই—ছেলেখেলার সময় নেই—যারা ছেলেখেলা করতে চায়, তফাত হও এই বেলা; নইলে মহা আপদ তাদের। Organisation (সঙ্ঘ) চাই—কুঁড়েমি দূর করে দাও, ছড়াও, ছড়াও; আগুনের মত যাও সব জায়গায়। আমার উপর ভরসা রেখো না, আমি মরি বাঁচি, তোমরা ছড়াও, ছড়াও। ইতি
নরেন্দ্র
…………………………..
১৫১
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
১৮৯৪
প্রাণাধিকেষু,
তারকদাদা ও হরির আগের লিখিত এক পত্র শেষে পাই। তাহাতে অবগত হইলাম যে, তাঁহারা কলিকাতায় আসিতেছেন। পূর্বের পত্রে সমস্ত জানিয়াছ। রামদয়ালবাবুর পত্র পাই। তথামত ছবি পাঠান হইবে। মা-ঠাকুরাণীর জন্য জমি খরিদ করিতে হইবে, তাহা ঠিক করিবে—অর্থাৎ বিল্ডিং আপাতত মাটির হউক, পরে দেখা যাইবে। কিন্তু জমিটা প্রশস্ত চাই। কি প্রকারে কাহাকে টাকা পাঠাইব, সমস্ত সন্ধান করিয়া লিখিবে। তোমাদের মধ্যে একজন বৈষয়িক কার্যের ভার লইবে।
সাণ্ডেলকে সমস্ত বৈষয়িক ব্যাপার সন্ধান করিয়া এক পত্র লিখিতে বলিবে। সাণ্ডেল চাকরি-বাকরি করিতেছে কেমন? যদি প্রভুর ইচ্ছা হয়, শীঘ্রই অনেক কাজ করিতে পারিব। হরমোহন কেদারবাবুর টাকার কথা কি লিখিয়াছে। আমি টাকা পত্রপাঠ পাঠাইব; কিন্তু কাহার নামে ও কাহাকে পাঠাইব, জানি না। একজন সেখানে এজেণ্ট না হইলে কোন কাজ চলিতে পারে না।
বিমলা—কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের জামাতা—এক সুদীর্ঘ পত্র লিখিয়াছেন যে, তাঁহার হিন্দুধর্মে এখন যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি। আমাকে প্রতিষ্ঠা হইতে সাবধান হইবার জন্য অনেক সুন্দর উপদেশ দিয়াছেন। এবং তাঁহার গুরু শশীবাবুর সাংসারিক দারিদ্র্যের কথা লিখিতেছেন। শিব, শিব! যাঁহার বড় মানুষ শ্বশুর তিনি কিছুই পারেন না, আর আমার তিন কালে শ্বশুর মোটেই নাই!! শশীবাবুর প্রণীত এক পুস্তক পাঠাইয়াছেন। উক্ত পুস্তকে সূক্ষ্মতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। বিমলার ইচ্ছা যে, এতদ্দেশ হইতে উক্ত পুস্তক ছাপাইবার সাহায্য হয়; তাহার তো কোন উপায় দেখি না, কারণ ইহারা বাঙলা ভাষা তো মোটেই জানে না। তাহার উপর হিন্দুধর্মের সহায়তা ক্রিশ্চানরা কেন করিবে? বিমলা এক্ষণে সহজ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিয়াছেন—পৃথিবীর মধ্যে হিন্দু শ্রেষ্ঠ, তন্মধ্যে ব্রাহ্মণ! ব্রাহ্মণমধ্যে শশী ও বিমলা—এই দুইজন ছাড়া পৃথিবীতে আর কাহারও ধর্ম হইতে পারেই না; কারণ তাহাদের ‘ঊধ্বস্রোতস্বিনীবৃত্তি’ নীচের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে এবং উক্ত দুইজনের কেবল উচ্চদিকে … । এই প্রকারে বিমলা এক্ষণে সনাতন ধর্মের যাহা আসল সার, তাহা খিঁচিয়া লইয়াছেন!
ধর্ম কি আর ভারতে আছে দাদা! জ্ঞানমার্গ, ভক্তিমার্গ, যোগমার্গ সব পলায়ন। এখন আছেন কেবল ছুঁৎমার্গ—আমায় ছুঁয়োনা, আমায় ছুঁয়োনা। দুনিয়া অপবিত্র, আমি পবিত্র। সহজ ব্রহ্মজ্ঞান! ভালা মোর বাপ!! হে ভগবান্! এখন ব্রহ্ম হৃদয়কন্দরেও নাই, গোলোকেও নাই, সর্বভূতেও নাই—এখন ভাতের হাঁড়িতে …। পূর্বে মহতের লক্ষণ ছিল ‘ত্রিভুবনমুপকারশ্রেণীভিঃ প্রীয়মাণঃ’,৪৫ এখন হচ্ছে, আমি পবিত্র আর দুনিয়া অপবিত্র—লাও রূপেয়া, ধরো হামারা পায়েরকা নীচে।
হরমোহন মধ্যে এক দিগ্গজ পত্র লেখেন। তাতে প্রধান খবর প্রায়ই এই রকম, যথা—‘অমুক ময়রার দোকানে অমুক ছেলে আপনার নিন্দা করিল; তাহাতে অসহ্য হওয়ায় আমি লড়াই করি’ ইত্যাদি। কে তাকে লড়াই করিতে বলে, প্রভু জানেন। ….যাক, তাহার ভালবাসাকে বলিহারি যাই এবং তাহার perseverance (অধ্যবসায়)-কে। মধ্যে যদি পার immediately (অবিলম্বে) হাওলাত করে কেদারবাবুর টাকা সুদসমেত দিও, আমি পত্রপাঠ পাঠাইয়া দিব। কাকে টাকা পাঠাই, কোথায় পাঠাই। তোমাদের যে হরিঘোষের গোয়াল। আমার টাকার কিছুই অভাব নাই, … কেদারবাবুর টাকা twice over দিব (দ্বিগুণ পরিশোধ করিব), তাহাকে ক্ষুণ্ণ হইতে মানা করিবে। আমি জানিতাম, উপেন তাহা পরিশোধ করিয়াছে এতদিনে। যাক, উপেনকে কিছুই বলিবার আবশ্যক নাই। আমি পত্রপাঠ পাঠিয়ে দিব।
যে মহাপুরুষ—হুজুক সাঙ্গ করে দেশে ফিরে যেতে লিখছেন, তাঁকে বলো কুকুরের মত কারুর পা চাটা আমার স্বভাব নহে। যদি সে মরদ হয় তো একটা মঠ বানিয়ে আমায় ডাকতে বলো। নইলে কার ঘরে ফিরে যাব? এ দেশে আমার more (অধিক) ঘর—হিন্দুস্থানে কি আছে? কে ধর্মের আদর করে? কে বিদ্যের আদর করে? ঘরে ফিরে এস!!! ঘর কোথা?
এবারকার মহোৎসব এমনি করবে যে, আর কখনও তেমন হয় নাই। আমি একটা ‘পরমহংস মহাশয়ের জীবনচরিত’ লিখে পাঠাব। সেটা ছাপিয়ে ও তর্জমা করে বিক্রী করবে। বিতরণ করলে লোকে পড়ে না, কিছু দাম লইবে। হুজুকের শেষ !!! … এই তো কলির সন্ধ্যে। আমি মুক্তি চাই না, ভক্তি চাই না; আমি লাখ নরকে যাব, ‘বসন্তবল্লোকহিতং চরন্তঃ’ (বসন্তের ন্যায় লোকের কল্যাণ আচরণ করে)—এই আমার ধর্ম। আমি কুঁড়ে, নিষ্ঠুর, নির্দয়, স্বার্থপর ব্যক্তিদের সহিত কোন সংস্রব রাখিতে চাই না। যাহার ভাগ্যে থাকে, সে এই মহাকার্যে সহায়তা করিতে পারে। … সাবধান, সাবধান! এ-সকল কি ছেলেখেলা, স্বপন-দেখা নাকি? মধো, সাবধান! সুরেশ দত্তর ‘রামকৃষ্ণচরিত’ পড়িলাম, মন্দ হয় নাই। শশী সাণ্ডেলের কোন উপকার যদি তোমাদের দ্বারা হয়, করিবে। বেচারা ভক্ত মানুষ, বড়ই কষ্ট পাচ্ছে। আমি তো দাদা এখানে বসে কোন উপায় দেখি না। কিমধিকমিতি।
দাদা, একবার গর্জে গর্জে মধুপানে লেগে যাও দিকি—মাষ্টার, জি. সি. ঘোষ, অতুল, রামদা, নৃত্যগোপাল, শাঁকচুন্নি! বলি, শাঁকচুন্নির কোন কথাই তো তোমরা লেখ না! সে গেল কোথা? মাকে ভক্তি করছে তেমনি কিনা? নৃত্যগোপাল-দাদার শরীর বেশ ভাল হয়েছে কি না, বাবুরাম যোগেন সেরেছে কিনা—ইত্যাদি আমি সকলের বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে চাই। শরৎকে কি সাণ্ডেলকে একটি বিশেষ পত্রে সব খুলে লিখতে বলবে। কালীকৃষ্ণ, ভবনাথ, দাশু, সাতু, হরি চাটুয্যে সকলকে তোমরা ভালবাস কিনা—সব লিখবে। … তোরা এক একটা মানুষ হ দিকি রে বাবা! গঙ্গাধর খেতড়ি থেকে তো পালায় নাই?
বলি, আর খবরের কাগজ পাঠাবার আবশ্যক নাই। তার ঢের মেরে গেছে। তোদের কারও organising power (সংগঠন-শক্তি) নাই দেখিতেছি; বড়ই দুঃখের বিষয়। সকলকে আমার ভালবাসা দিবে, সকলের help (সাহায্য) আমি চাই; কারুর সঙ্গে বিবাদবিসংবাদ খবরদার যাতে না হয়। Neither money pays, nor name, nor fame, nor learning; it is character that can cleave through adamantine walls of difficulties,৪৬ —মনে রেখো। লোকের সঙ্গে যাওয়া-আসা, বিশেষ করিয়া মতামত pooh pooh (দুঃ ছাই) করিবে না, তাতে লোক বড়ই চটে। জায়গায় জায়গায় এক একটা সেণ্টার করিতে হইবে—এ তো বড় সহজ! যেমন তোমরা জায়গায় জায়গায় ফের, অমনি একটি সেণ্টার করবে সেখানে। এই রকম করে কার্য হবে। যেখানে পাঁচজন লোক তাঁকে মানে, সেখানেই এক ডেরা—এমনি করে চল এবং সর্বদা সকল জায়গার সঙ্গে communication (যোগাযোগ) রাখিতে হইবে। ইতি
চিরস্নেহাস্পদ
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৫২*
ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক ষ্টেশন
২৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় মিসেস বুল,
আমি নিরাপদে নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছি; ল্যাণ্ডস্বার্গ ডিপোয় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে—আমি তখনই ব্রুকলিনের দিকে রওনা হলাম ও সময়মত সেখানে পৌঁছলাম।
সন্ধ্যাকালটা পরমানন্দে কেটে গেল—এথিক্যাল কালচার সোসাইটির (Ethical Culture Society) কতকগুলি ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
আসছে রবিবার একটা বক্তৃতা হবে। ডাঃ জেন্স্ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ খুব সহৃদয় ও অমায়িক ব্যবহার করলেন, আর মিঃ হিগিন্সকে পূর্বেরই মত দেখলাম—খুব কাজের লোক। বলতে পারি না কেন, অন্যান্য শহরের চেয়ে এই নিউ ইয়র্ক শহরেই দেখছি—মেয়েদের চেয়ে পুরুষদের ধর্মালোচনায় আগ্রহ বেশী।
আমার ক্ষুরখানা ১৬১ নং বাড়ীতে ফেলে এসেছি, অনুগ্রহপূর্বক সেটা ল্যাণ্ডস্বার্গের নামে পাঠিয়ে দেবেন।
এই সঙ্গে মিঃ হিগিন্স আমার সম্বন্ধে যে পুস্তিকাটি ছাপিয়েছেন, তার এক কপি পাঠালাম—আশা করি, ভবিষ্যতে আরও পাঠাতে পারব।
মিস ফার্মারকে এবং তাঁদের পবিত্র পরিবারের সকলকে আমার ভালবাসা জানাবেন।
সদা বশংবদ
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৫৩*
C/o G. W. Hale
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এইমাত্র তোমার পত্র পেলাম। ভট্টাচার্যের মাতার দেহত্যাগ-সংবাদে বিশেষ দুঃখিত হলাম। তিনি একজন অসাধারণ মহিলা ছিলেন। প্রভু তাঁর কল্যাণ করুন।
আমি যে খবরের কাগজের অংশগুলি তোমায় পাঠিয়েছিলাম, সেগুলি প্রকাশ করতে বলে আমি ভুল করেছি। এ আমার একটা ভয়ানক অন্যায় হয়ে গেছে। মুহূর্তের জন্য দুর্বলতা আমার হৃদয়কে অধিকার করেছিল, এতে তাই প্রকাশ হচ্ছে।
এ দেশে দু-তিন বছর ধরে বক্তৃতা দিলে টাকা তোলা যেতে পারে। আমি কতকটা চেষ্টা করেছি, আর যদিও সাধারণে খুব আদরের সহিত আমার কথা নিচ্ছে, কিন্তু আমার প্রকৃতিতে এটা একেবারে খাপ খাচ্ছে না, বরং ওতে আমার মনটাকে বেজায় নামিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং আমি এই গ্রীষ্মকালেই ইওরোপ হয়ে ভারতে ফিরে যাব—স্থির করেছি; এতে যা খরচ হবে, তার জন্য যথেষ্ট টাকা আছে। তাঁর ইচ্ছে পূর্ণ হোক।
ভারতের খবরের কাগজ ও তাদের সমালোচনা সম্বন্ধে যা লিখেছ, তা পড়লাম। তারা যে এ-রকম লিখবে, এ তাদের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। প্রত্যেক দাসজাতির মূল পাপ হচ্ছে ঈর্ষা। আবার এই ঈর্ষাদ্বেষ ও সহযোগিতার অভাবই এই দাসত্বকে চিরস্থায়ী করে রাখে। ভারতের বাইরে না এলে আমার এ মন্তব্যের মর্ম বুঝবে না। পাশ্চাত্য জাতিদের কার্যসিদ্ধির রহস্য হচ্ছে—এই সহযোগিতা। এদের শক্তি অদ্ভুত, আর এর ভিত্তি হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর পরস্পরের কার্যের গুণগ্রাহিতা। আর জাতটা যত দুর্বল ও কাপুরুষ হবে, ততই তার ভেতর এই [কাপুরুষতা] পাপটা স্পষ্ট দেখা যাবে। যতই কষ্টকল্পিত হোক, মূলে কতকটা সত্য না থাকলে কোন অপবাদই উঠতে পারে না, আর এখানে আসবার পর মেকলে ও আর আর অনেকে বাঙালী জাতকে যে ভয়ানক গালাগাল দিয়েছেন, তার কারণ কিছু কিছু বুঝতে পারছি। এরা সর্বপেক্ষা কাপুরুষ আর সেই কারণেই এতদূর ঈর্ষাপরায়ণ ও পরনিন্দাপ্রবণ। হে ভ্রাতঃ, এই দাসভাবাপন্ন জাতের নিকট কিছু আশা করা উচিত নয়। ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে দেখলে কোন আশার কারণ থাকে না বটে, তথাপি তোমাদের সকলের সামনে খুলেই বলছি—তোমরা কি এই মৃত জড়পিণ্ডটার ভেতর, যাদের ভেতর ভাল হবার আকাঙ্ক্ষাটা পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে, যাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য একদম চেষ্টা নেই, যারা তাদের হিতৈষীদের ওপরই আক্রমণ করতে সদা প্রস্তুত, এরূপ মড়ার ভেতর প্রাণসঞ্চার করতে পার? তোমরা কি এমন চিকিৎসকের আসন গ্রহণ করতে পার, যিনি একটা ছেলের গলায় ঔষধ ঢেলে দেবার চেষ্টা করছেন, এদিকে ছেলেটা ক্রমাগত পা ছুঁড়ে লাথি মারছে এবং ঔষধ খাব না বলে চেঁচিয়ে অস্থির করে তুলছে?
‘—’ সম্পাদক সম্বন্ধে বক্তব্য এই, আমার স্বর্গীয় গুরুদেবের কাছে উত্তম-মধ্যম তাড়া খেয়ে অবধি সে আমাদের ছায়া পর্যন্ত মাড়ায় না। একজন মার্কিন বা ইওরোপীয়ান তার বিদেশস্থ স্বদেশবাসীর পক্ষ সর্বদাই নিয়ে থাকে, কিন্তু হিন্দু—বিশেষ বাঙালী স্বদেশবাসীকে অপমানিত দেখলে খুশী হয়। যাই হোক, ওসব নিন্দা-কুৎসার দিকে একদম খেয়াল করো না। ফের তোমায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি—‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।’—কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়। পাহাড়ের মত অটল হয়ে থাক। সত্যের জয় চিরকালই হয়ে থাকে। রামকৃষ্ণের সন্তানগণের যেন ভাবের ঘরে চুরি না থাকে, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা বেঁচে থাকতে এর কোন ফল দেখে যেতে না পারি; কিন্তু আমরা বেঁচে রয়েছি, এ বিষয়ে যেমন কোন সন্দেহ নেই, সেইরূপ নিঃসন্দেহে শীঘ্র বা বিলম্বে এর ফল হবেই হবে। ভারতের পক্ষে প্রয়োজন—তার জাতীয় ধমনীর ভিতর নূতন বিদ্যুদগ্নি-সঞ্চার। এরূপ কাজ চিরকালই ধীরে ধীরে হয়ে এসেছে, চিরকালই ধীরে হবে; এখন ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে শুধু কাজ করেই খুশী থাক; সর্বোপরি, পবিত্র ও দৃঢ়চিত্ত হও এবং মনে প্রাণে অকপট হও—ভাবের ঘরে যেন এতটুকু চুরি না থাকে, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি তোমরা রামকৃষ্ণের শিষ্যদের কারও ভেতর কোন জিনিষ লক্ষ্য করে থাক, সেটি এই—তারা একেবারে সম্পূর্ণ অকপট। আমি যদি ভারতে এই রকম এক-শ জন লোক রেখে যেতে পারি, তাহলে সন্তুষ্ট চিত্তে মরতে পারব—আমি বুঝব, আমার কর্তব্য শেষ হয়ে গেছে। অজ্ঞ লোকে যা তা বকুক না কেন, তিনিই জানেন—সেই প্রভুই, জানেন কি হবে। আমার লোকের সাহায্য খুঁজে বেড়াই না, অথবা সাহায্য এসে পড়লে ছেড়েও দিই না—আমরা সেই পরমপুরুষের দাস। এই সব ক্ষুদ্র লোকের ক্ষুদ্র চেষ্টা আমরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনি না। এগিয়ে যাও। শত শত যুগের কঠোর চেষ্টার ফলে একটা চরিত্র গঠিত হয়। দুঃখিত হয়ো না; সত্যে প্রতিষ্ঠিত একটি কথা পর্যন্ত নষ্ট হবে না—হয়তো শত শত যুগ ধরে আবর্জনাস্তূপে চাপা পড়ে লোকলোচনের অগোচরে থাকতে পারে, কিন্তু শীঘ্র হোক, বিলম্বে হোক—তা আত্মপ্রকাশ করবেই করবে। সত্য অবিনশ্বর, ধর্ম অবিনশ্বর, পবিত্রতা অবিনশ্বর। আমাকে একটা খাঁটি লোক দাও দেখি, আমি রাশি রাশি বাজে চেলা চাই না। বৎস, দৃঢ়ভাবে ধরে থাক—কোন লোক তোমাকে এসে সাহায্য করবে, এ ভরসা রেখো না—সকল মানুষের সাহায্যের চেয়ে প্রভু কি অনন্ত গুণে শক্তিমান্ নন? পবিত্র হও, প্রভুর ওপর বিশ্বাস রাখ, সর্বদাই তাঁর ওপর নির্ভর কর, তাহলেই তোমার সব ঠিক হয়ে যাবে, কেউ তোমার বিরুদ্ধে লেগে কিছু করতে পারবে না। আগামী পত্রে আরও বিস্তারিত খবর দেব।
এদেশে যাদের গরীব বলা হয়, তাদের দেখছি; আমাদের দেশের গরীবদের তুলনায় এদের অবস্থা অনেক ভাল হলেও কত লোকের হৃদয় এদের জন্য কাঁদছে! কিন্তু ভারতের চিরপতিত বিশ কোটি নরনারীর জন্য কার হৃদয় কাঁদছে? তাদের উদ্ধারের উপায় কি? তাদের জন্য কার হৃদয় কাঁদে বল? তারা অন্ধকার থেকে আলোয় আসতে পারছে না, তারা শিক্ষা পাচ্ছে না। কে তাদের কাছে আলো নিয়ে যাবে? কে দ্বারে দ্বারে ঘুরে তাদের কাছে আলো নিয়ে যাবে? এরাই তোমাদের ঈশ্বর, এরাই তোমাদের দেবতা হোক, এরাই তোমাদের ইষ্ট হোক। তাদের জন্য ভাব, তাদের জন্য কাজ কর, তাদের জন্য সদাসর্বদা প্রার্থনা কর—প্রভুই তোমাদের পথ দেখিয়ে দেবেন। তাঁদেরই আমি মহাত্মা বলি, যাঁদের হৃদয় থেকে গরীবদের জন্য রক্তমোক্ষণ হয়, তা না হলে সে দুরাত্মা। তাদের কল্যাণের জন্য আমাদের সমবেত ইচ্ছাশক্তি, সমবেত প্রার্থনা প্রযুক্ত হোক—আমরা কাজে কিছু করে উঠতে না পেরে লোকের অজ্ঞাতসারে মরতে পারি—কেউ হয়তো আমাদের প্রতি এতটুকু সহানুভূতি দেখালে না, কেউ হয়তো আমাদের জন্য এক ফোঁটা চোখের জল ফেললে না, কিন্তু আমাদের একটা চিন্তাও কখনও নষ্ট হবে না। এর ফল শীঘ্র বা বিলম্বে ফলবেই ফলবে। আমার প্রাণের ভেতর এত ভাব আসছে, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না—তোমরা আমার হৃদয়ের ভাব মনে মনে কল্পনা করে বুঝে নাও। যতদিন ভারতের কোটি কোটি লোক দারিদ্র্য ও অজ্ঞানান্ধকারে ডুবে রয়েছে, ততদিন তাদের পয়সায় শিক্ষিত অথচ যারা তাদের দিকে চেয়েও দেখছে না, এরূপ প্রত্যেক ব্যক্তিকে আমি দেশদ্রোহী বলে মনে করি। যতদিন ভারতের বিশ কোটি লোক ক্ষুধার্ত পশুর মত থাকবে, ততদিন যে সব বড়লোক তাদের পিষে টাকা রোজগার করে জাঁকজমক করে বেড়াচ্চে অথচ তাদের জন্য কিচ্ছু করছে না, আমি তাদের হতভাগা পামর বলি। হে ভ্রাতৃগণ! আমরা গরীব, আমরা নগণ্য, কিন্তু আমাদের মত গরীবরাই চিরকাল সেই পরমপুরুষের যন্ত্রস্বরূপ হয়ে কাজ করেছে। প্রভু তোমাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন। সকলে আমার বিশেষ ভালবাসা জানবে। ইতি
পুঃ—যদি তোমরা কিছু ছাপিয়ে না থাক তো ছাপা বন্ধ কর—নাম হুজুকের আর দরকার নেই। ইতি—
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৫৪*
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
৩ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
গত রবিবার ব্রুকলিনে বক্তৃতা দিয়েছি। সন্ধ্যায় পৌঁছলে মিসেস হিগিন্স আমায় একটু সম্বর্ধনা করেন, এবং ডক্টর জেন্স্ (Janes) প্রভৃতি এথিক্যাল সোসাইটি (Ethical Society)-র কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কয়েকজন মনে করেন যে, এরূপ প্রাচ্যদেশীয় ধর্মপ্রসঙ্গ ব্রুকলিনের জনসাধারণের উপভোগ্য হবে না।
কিন্তু প্রভুর কৃপায় বক্তৃতা খুব সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। ব্রুকলিনের প্রায় আটশত গণ্যমান্য ব্যক্তি যোগদান করেন! যাঁরা মনে করেছিলেন বক্তৃতা সফল হবে না, তাঁরাই ব্রুকলিনে কয়েকটি ধারাবাহিক বক্তৃতার আয়োজন করেছেন। আমার নিউ ইয়র্কের বক্তৃতামালা প্রায় প্রস্তুত, কিন্তু মিস থার্সবি নিউ ইর্য়কে না আসা পর্যন্ত তারিখ ঠিক করতে চাই না। এভাবে মিস ফিলিপ্স্—যিনি মিস থার্সবির বন্ধু, এবং যিনি আমার নিউ ইর্য়কের বক্তৃতামালার আয়োজন করছেন—মিস থার্সবির সহযোগিতায় প্রয়োজনবোধে সেখানে কিছু বন্দোবস্ত করতে চান।
হেল পরিবারের কাছে আমি বিশেষরূপে ঋণী এবং নববর্ষের প্রথম দিনে তাদের কাছে হঠাৎ এসে হাজির হব, ভেবেছিলাম। এখানে একটি নতুন পাগড়ি যোগাড় করবার চেষ্টাতে আছি। পুরানো পাগড়িটি এখানে আছে। কিন্তু বারবার কাচার ফলে সেটা এত ঢিলে হয়ে গিয়েছে যে, সেটা পরে লোকের কাছে যাওয়া যায় না। চিকাগোর ঠিক তেমনি একটা পাগড়ি পাব বলে মনে হয়।
আশা করি আপনার পিতা ইতোমধ্যে ভাল হয়েছেন। মিস ফার্মার, মিঃ ও মিসেস গিবন্স এবং ধার্মিক পরিবারটির সকলকে আমার প্রীতি জানাবেন।
সতত স্নেহের
বিবেকানন্দ
পুনঃ—ব্রুকলিনে মিস কুরিং-এর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি বরাবরই সদয়। তাঁকে শীঘ্র চিঠি লিখলে আমার প্রীতি জানাবেন।
…………………………..
১৫৫*
[স্যার এস. সুব্রহ্মণ্য আয়ারকে লিখিত]
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
৩ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় মহাশয়,
প্রেম, কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসপূর্ণ হৃদয়ে অদ্য আপনাকে পত্র লিখিতে প্রবৃত্ত হইলাম। প্রথমেই বলিয়া রাখি—আমার জীবনে এমন অল্প কয়েকজনের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে, যাঁহাদের হৃদয় ভাব ও জ্ঞানের অপূর্ব সমম্বয়ে পূর্ণ, সর্বোপরি যাঁহারা মনের ভাবসমূহ কার্যে পরিণত করিবার শক্তি রাখেন, আপনি তাঁহাদের মধ্যে একজন। বিশেষতঃ আপনি অকপট, তাই আমি আপনার নিকট আমার কয়েকটি মনের ভাব বিশ্বাস করিয়া প্রকাশ করিতেছি।
ভারতের কার্য বেশ আরম্ভ হইয়াছে, আর উহা শুধু যে কোনক্রমে বজায় রাখিতে হইবে, তাহা নহে, মহা উদ্যমের সহিত উহার উন্নতি ও বিস্তারসাধন করিতে হইবে। এই সময়। এখন আলস্য করিলে পরে আর কার্যের সুযোগ থাকিবে না। কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে নানাবিধ চিন্তা করিয়া নিম্নলিখিত প্রণালীতে উহা সীমাবদ্ধ করিয়াছিঃ প্রথমে মান্দ্রাজে ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দিবার জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে, ক্রমশঃ উহাতে অন্যান্য অবয়ব সংযোজন করিতে হইবে; আমাদের যুবকগণ যাহাতে বেদসমূহ, বিভিন্ন দর্শন ও ভাষ্যসকল সম্পূর্ণরূপে শিক্ষা পায়, তাহা করিতে হইবে; উহার সহিত অন্যান্য ধর্মসমূহের তত্ত্বও তাহাদিগকে শিখাইতে হইবে। সঙ্গে সঙ্গে ঐ বিদ্যালয়ের মুখপত্রস্বরূপ একখানি ইংরেজী ও একখানি দেশীয় ভাষার কাগজ থাকিবে।
প্রথমেই এটি করিতে হইবে; আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপার হইতেই বড় বড় বিষয় দাঁড়াইয়া থাকে। কয়েকটি কারণে মান্দ্রাজই এক্ষণে এই কার্যের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ক্ষেত্র। বোম্বাইয়ে সেই চিরদিনের জড়ত্ব; বাঙলায় ভয়—এখন যেমন পাশ্চাত্য ভাবের মোহ, তেমনি পাছে তাহার বিপরীত ঘোর প্রতিক্রিয়া হয়। মান্দ্রাজই এক্ষণে এই প্রাচীন ও আধুনিক উভয় জীবন-প্রণালীর যথার্থ গুণ গ্রহণ করিয়া মধ্যপথ অনুসরণ করিতেছে।
সমাজের যে সম্পূর্ণ সংস্কার আবশ্যক—এ বিষয়ে ভারতীয় শিক্ষিত সমাজের সহিত আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু ইহা করিবার উপায় কি? সংস্কারকগণ সমাজকে ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া যেরূপে সমাজসংস্কারের প্রণালী দেখাইলেন, তাহাতে তাঁহারা কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। আমার প্রণালী এইঃ আমি এখনও এটা মনে করি না যে, আমার জাতি এতদিন ধরিয়া কেবল অন্যায় করিয়া আসিতেছে; কখনই নহে। আমাদের সমাজ যে মন্দ, তাহা নহে—আমাদের সমাজ ভাল। আমি কেবল চাই—আরও ভাল হোক। সমাজকে মিথ্যা হইতে উচ্চতর সত্যে যাইতে হইবে, মন্দ হইতে ভালয় নয়; সত্য হইতে উচ্চতর সত্যে, ভাল হইতে আরও ভালয়—আরও ভালয় যাইতে হইবে। আমি আমার স্বদেশবাসীকে বলি—এতদিন তোমরা যাহা করিয়াছ, তাহা বেশ হইয়াছে; এখন আরও ভাল করিবার সময় আসিয়াছে। এই জাতিবিভাগের কথাই ধরুন—সংস্কৃতে ‘জাতি’ শব্দের অর্থ শ্রেণীবিশেষ। এখন সৃষ্টির মূলেই ইহা বিদ্যমান। বিচিত্রতা অর্থাৎ জাতির অর্থই সৃষ্টি। ‘একোঽহং বহু স্যাম্’ (আমি এক—বহু হইব)—বিভিন্ন বেদে এইরূপ কথা দেখা যায়। সৃষ্টির পূর্বে এক থাকে—বহুত্ব বা বিচিত্রতাই সৃষ্টি। যদি এই বিচিত্রতাই না থাকে, তবে সৃষ্টিই লোপ পাইবে।
যতদিন কোন শ্রেণীবিশেষ সক্রিয় ও সতেজ থাকে, ততদিন তাহা নানা বিচিত্রতা প্রসব করিয়া থাকে। যখনই উহা বিচিত্রতা উৎপাদনে বিরত হয়, অথবা যখন উহার বিচিত্রতা বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়, তখনই উহা মরিয়া যায়। মূলে ‘জাতির’ অর্থ ছিল প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ প্রকৃতি, নিজ বিশেষত্ব প্রকাশ করিবার স্বাধীনতা। সহস্র সহস্র বর্ষ ধরিয়া এই অর্থই প্রচলিত ছিল—এমন কি, খুব আধুনিক শাস্ত্রগ্রন্থসমূহেও বিভিন্ন জাতির একত্র ভোজন নিষিদ্ধ হয় নাই; আর প্রাচীনতর গ্রন্থসমূহের কোথাও বিভিন্ন জাতিতে বিবাহ নিষিদ্ধ হয় নাই। তবে ভারতের পতনের কারণ কি? জাতি সম্বন্ধে এই ভাব পরিহার। যেমন গীতা বলিতেছেন, জাতি বিনষ্ট হইলে জগৎও বিনষ্ট হইবে। ইহা কি সত্য বলিয়া বোধ হয় যে, এই বিচিত্রতা বন্ধ করিয়া দিলে জগৎও নষ্ট হইয়া যাইবে? বর্তমান বর্ণবিভাগ (caste) প্রকৃত ‘জাতি’ নহে, বরং উহা জাতির উন্নতির প্রতিবন্ধক। উহা যথার্থই জাতির অর্থাৎ বিচিত্রতার স্বাধীন গতি রোধ করিয়াছে। কোন বদ্ধমূল প্রথা বা জাতিবিশেষের জন্য বিশেষ সুবিধা বা কোন আকারের বংশানুক্রমিক শ্রেণীবিভাগ প্রকৃত ‘জাতি’কে অব্যাহত গতিতে অগ্রসর হইতে দেয় না, যখনই কোন জাতি আর এইরূপ নানা বিচিত্রতা প্রসব করে না, তখনই উহা অবশ্যই বিনষ্ট হইবে। অতএব আমি আমার স্বদেশবাসিগণকে ইহাই বলিতে চাই যে, ‘জাতি’ উঠাইয়া দেওয়াতেই ভারতের পতন হইয়াছে। প্রাণহীন অভিজাত অথবা সুবিধাভোগী শ্রেণীমাত্রই ‘জাতি’র প্রতিবন্ধক—উহা জাতি নহে। জাতি নিজ প্রভাব বিস্তার করুক, জাতির পথে যাহা কিছু বিঘ্ন আছে, সব ভাঙিয়া ফেলা হউক—তাহা হইলেই আমরা উঠিব। এক্ষণে ইওরোপের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। যখনই উহা জাতিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে সমর্থ হইল—প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ ‘জাতি’ গঠন করিতে যে-সকল বাধা আছে, সেই সকল বাধার অধিকাংশই দূর করিয়া দিল—তখনই ইওরোপ উঠিল। আমেরিকায় প্রকৃত ‘জাতি’র বিকাশের সর্বাপেক্ষা অধিক সুবিধা—সেইজন্য তাহারা বড়। প্রত্যেক হিন্দুই জানে যে, জ্যোতিষীরা বালকবালিকার জন্মমাত্র জাতি নির্বাচন করিতে চেষ্টা করিয়া থাকেন। উহাই প্রকৃত ‘জাতি’—প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব; আর জ্যোতিষ ইহা মানিয়া লইয়াছে। ইহা যদি পুনরায় পুরাপুরিভাবে চালু হয়, তবেই আমরা উঠিতে পারিব। এই বৈচিত্র্যের অর্থ বৈষম্য বা কোন বিশেষ অধিকার নয়।
আমার কার্যপ্রণালীঃ হিন্দুদের দেখান যে, তাহাদিগকে কিছুই ছাড়িতে হইবে না, কেবল ঋষি-প্রদর্শিত পথে চলিতে হইবে ও শত শত শতাব্দীব্যাপী দাসত্বের ফলস্বরূপ এই ‘জড়ত্ব’ দূর করিতে হইবে। অবশ্য মুসলমানগণের অত্যাচারের সময় আমাদের উন্নতি বন্ধ হইয়াছিল; তাহার কারণ তখন ছিল জীবনমরণের সমস্যা, উন্নতির সময় ছিল না। এখন আর সেই অত্যাচারের ভয় নাই; এখন আমাদিগকে সম্মুখে অগ্রসর হইতেই হইবে—স্বধর্মত্যাগী ও মিশনরীগণের উপদিষ্ট ধ্বংসের পথে নয়—আমাদের নিজেদের ভাবে, নিজেদের পথে। প্রাসাদের গঠন অসম্পূর্ণ বলিয়াই উহা বীভৎস দেখাইতেছে। বহু শত শতাব্দীর অত্যাচারে প্রাসাদ-নির্মাণ বন্ধ রাখিতে হইয়াছিল। এখন নির্মাণ-কার্য শেষ করা হউক, তাহা হইলে সবই যথাস্থানে সুন্দর দেখাইবে। ইহাই আমার কার্যপ্রণালী। এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।
প্রত্যেক জাতির জীবনে একটি করিয়া মূল প্রবাহ থাকে। ধর্মই ভারতের মূল স্রোত; উহাকে শক্তিশালী করা হউক, তবেই পার্শ্ববর্তী অন্যান্য স্রোতগুলিও উহার সঙ্গে সঙ্গে চলিবে। ইহা আমার ভাবধারার একটা দিক্। আশা করি, যথাসময়ে আমার সমুদয় চিন্তারাশি প্রকাশ করিতে পারিব। কিন্তু বর্তমানে দেখিতেছি, এই দেশেও আমার বিশেষ কাজ রহিয়াছে। অধিকন্তু কেবল এখান হইতেই সাহায্যের প্রত্যাশা করি। কিন্তু এ পর্যন্ত কেবল আমার ভাবপ্রচার ব্যতীত আর কিছু করিতে পারি নাই। এখন আমার ইচ্ছা—ভারতেও একটা চেষ্টা করা হউক। মান্দ্রাজেই সফলতার সম্ভাবনা আছে। আ—ও অন্যান্য যুবকগণ খুব খাটিতে পারে, কিন্তু তাহা হইলেও তাহারা ‘উৎসাহী যুবক’ মাত্র। এই কারণে আমি তাহাদিগকে আপনার নিকট সমর্পণ করিতেছি। যদি আপনি তাহাদের পরিচালক হন, আমার নিশ্চিত ধারণা—উহারা কৃতকার্য হইবে। জানি না—কবে ভারতে যাইব। তিনি যেমন চালাইতেছেন, আমি সেইরূপ চলিতেছি; আমি তাঁহার হাতে।
‘এই জগতে ধনের সন্ধান করিতে গিয়া তোমাকেই শ্রেষ্ঠ রত্নরূপে পাইয়াছি; হে প্রভো, তোমারই নিকট আমি নিজেকে বলি দিলাম।’
‘ভালবাসার পাত্র খুঁজিতে গিয়া একমাত্র তোমাকেই ভালবাসার পাত্র পাইয়াছি। তোমারই নিকট আমি নিজেকে বলি দিলাম।’৪৭
প্রভু আপনাকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন।
ভবদীয় চিরকৃতজ্ঞ
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৫৬
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
১৮৯৫
প্রিয়তমেষু,
তোমার পত্রে টাকা-পঁহুছান ইত্যাদি সংবাদ পাইয়া অতিশয় আনন্দিত হইলাম। … দেশে আসিবার কথা যে লিখিয়াছ, তাহা ঠিক বটে; কিন্তু এদেশে একটি বীজ বপন করা হইয়াছে, সহসা চলিয়া গেলে উহা অঙ্কুরে নষ্ট হইবার সম্ভাবনা, এজন্য কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইবে। খেতড়ির রাজা, জুনাগড়ের দেওয়ান প্রভৃতি সকলেই দেশে আসিতে লেখেন। সত্য বটে; কিন্তু ভায়া, পরের ভরসা করা বুদ্ধিমানের কার্য নহে। আপনার পায়ের জোর বেঁধে চলাই বুদ্ধিমানের কার্য। সকলই হইবে ধীরে ধীরে; আপাততঃ একটা জায়গা দেখার কথাটা বিস্মৃত হইও না। একটা বিরাট জায়গা চাই—১০ হাজার থেকে ২০ হাজার [টাকা] পর্যন্ত—একদম গঙ্গার উপর হওয়া চাই। যদিও হাতে পুঁজি অল্প, তথাপি ছাতি বড় বেজায়, জায়গার উপর নজরটা রাখবে। একটা নিউ ইয়র্কে, একটা কলিকাতায় এবং একটা মান্দ্রাজে; এখন এই তিনটা আড্ডা চালাতে হবে, তারপর ধীরে ধীরে যেমন প্রভু যোগান।
যে যা করে, করতে দিও (উৎপাত ছাড়া)। টাকাখরচ বিলকুল তোমার হাতে রেখো। … অধিক কি বলিব? তুমি ইদিক ওদিক যাওয়াটা বড় একটা ত্যাগ কর। ঘর জাগিয়ে বসে থাক। … স্বাস্থ্যটার উপর বেজায় নজর রাখা চাই—পরে অন্য কথা। তারকদাদা দেশপর্যটনে উৎসুক—বেশ কথা, তবে এ সব দেশে বড়ই মাগগি, ১০০০ টাকার কমে মাসে চলে না (ধর্মপ্রচারকের)। … এদের দেশের বাঘভাল্লুকে পাদ্রী-পণ্ডিতদের মুখ হতে রুটি ছিনিয়ে নিয়ে খেতে হবে—এই বুঝ। অর্থাৎ বিদ্যের জোরে এদের দাবিয়ে দিতে হবে, নইলে ফু করে উড়িয়ে দেবে। এরা না বোঝে সাধু, না বোঝে সন্ন্যাসী, না বোঝে ত্যাগ-বৈরাগ্য; বোঝে বিদ্যের তোড়, বক্তৃতার ধুম আর মহা উদ্যোগ। আমার মতে কিন্তু যদি তারকদাদা পাঞ্জাব বা মান্দ্রাজে কতকগুলি সভা ইত্যাদি স্থাপন করে বেড়ান ও তোমরা একত্রিত হয়ে organised (সঙ্ঘবদ্ধ) হও তো বড়ই ভাল হয়। নূতন পথ আবিষ্কার করা বড় কাজ বটে, কিন্তু উক্ত পথ পরিষ্কার করা ও প্রশস্ত সুন্দর করাও কঠিন কাজ। আমি যেখানে যেখানে প্রভুর বীজ বপন করে এসেছি; তোমরা যদি সেই সেই স্থানে কিয়ৎকাল বাস করে উক্ত বীজকে বৃক্ষে পরিণত করতে পার, তাহা হইলেও আমার অপেক্ষা অনেক অধিক কাজ তোমরা করবে। উপস্থিত যারা রক্ষা করতে পারে না, তারা অনুপস্থিতে কি করিবে? তৈয়ারী রান্নায় একটু নুন-তেল যদি দিতে না পার, তাহলে কেমন করে বিশ্বাস হয় যে, সকল যোগাড় করবে? না হয় তারকদাদা আলমোড়ায় একটা হিমালয়ান মঠ স্থাপন করুন, এবং সেথায় একটা লাইব্রেরী করুন; আমরা দু-দণ্ড ঠাণ্ডা জায়গায় বাস করি এবং সাধনভজন করি। যা হোক, প্রভু যাকে যেমন বুদ্ধি দেন, আমার তাতে আপত্তি কি? অপিচ Godspeed—শিবা বঃ সন্তু পন্থানঃ। তারকদাদার হৃদয়ে মহা উৎসাহ আছে; এজন্য তাঁহা হতে আমি অনেক আশা করি। তারকদাদার সহিত এক থিওসফিষ্টের মূলাকাত হয়। সে লণ্ডন হতে আমাকে এক চিঠি লেখে। তারপর আর তো তার খবরাখবর নাই। সে ব্যক্তি ধনী বটে, সে তারকদাদার উপর শ্রদ্ধাবানও বটে। তার নামটা ভুলে গেছি। সে তাঁকে লণ্ডনাদি ভ্রমণ করাইতে পারে; এবং আমি যে কার্য করিতে চাই, তাহা সমাধানের জন্য তোমাদের কয়েকজনকে ইওরোপ ও আমেরিকা দেখাইয়া লওয়া অবশ্য কর্তব্য। একচক্র ভ্রমণের পর হৃদয় উদার হবে, তখন আমার idea (ভাব) বুঝতে পারবে ও কাজ করতে পারবে। তবে আমার হাতে টাকা নাই, কি করি? শীঘ্রই প্রভু রাস্তা খুলে দেবেন—এমন ভরসা আছে। এ সকল খবর ও আমার হৃদয়ের ভালবাসা তারকদাদাকে দিও, ও আলমোড়ায় একটা কিছু আড্ডা স্থাপনে বিশেষ যোগাড় দেখতে বলবে।
রাখাল, ঠাকুরের দেহত্যাগের পর মনে আছে, সকলে আমাদের ত্যাগ করে দিলে—হাবাতে গরীব ছোঁড়াগুলো মনে করে; কেবল বলরাম, সুরেশ, মাষ্টার ও চুনীবাবু এরা সকলে বিপদে আমাদের বন্ধু। অতএব এদের ঋণ আমরা কখনও পরিশোধ করতে পারব না। মাভৈঃ! খুব আনন্দ করতে বল—তাঁর আশ্রিতের কি নাশ আছে রে, বোকারাম?
ইতি সদৈকহৃদয়ঃ
নরেন
…………………………..
১৫৭*
চিকাগো
১১ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় জি. জি.,
তোমার ৩রা ডিসেম্বরের পত্র এইমাত্র পেলাম। ঐ সঙ্গেই আলাসিঙ্গার ও মহীশূরের মহারাজার পত্র পেলাম। নরসিংহ যে আমেরিকা এসেছিল, সে ভারতে ফিরে সেখান থেকে মিসেস হেগকে একখানা পত্র লিখেছে—তাতে হিন্দুদের বর্বর আখ্যা দিয়েছে, আর আমার সম্বন্ধে একটা কথাও লেখেনি। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তার মাথার কিছু গোলমাল হয়েছে। যাতে সে আরোগ্যলাভ করে, তার চেষ্টা কর। চিরদিনের জন্য কিছুই নষ্ট হয় না।
ডঃ ব্যারোজ তোমার পত্রের জবাব কেন দিলেন না, জানি না; কলিকাতার লোকদের যা উত্তর দিয়েছেন, তাও দেখিনি।
এখানকার ধর্মমহাসভার উদ্দেশ্য ছিল সব ধর্মের মধ্যে খ্রীষ্টান ধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করা, কিন্তু তা সত্ত্বেও দার্শনিক হিন্দুধর্ম আপন মর্যাদা রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল। ডঃ ব্যারোজ ও ঐ ধাঁজের লোকেরা বেজায় গোঁড়া—তাদের সাহায্য আমি চাই না, প্রভুই আমার সহায়। প্রভু এদেশে আমায় যথেষ্ট বন্ধু দিচ্ছেন, আর তাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যারা আমার অনিষ্ট করবার জন্য চেষ্টা করেছে, তারা এখন হয়রান হয়ে ছেড়ে দিয়েছে। প্রভু ওদের মঙ্গল করুন।
ডঃ ব্যারোজ ও ঐ ধরনের অন্যান্য লোকদের সম্বন্ধে এই পর্যন্ত জেনে রাখ, ওদের সঙ্গে আমার কোনপ্রকার সংস্রব নাই। বাল্টিমোরের ঘটনা নিয়ে যে বাজে গুজব রটেছিল, সে সম্বন্ধে বক্তব্য এই, সেখানে এখন আমার অনেক ভাল ভাল বন্ধু রয়েছেন, এবং বরাবরই সেখানে আরও অধিকসংখ্যক বন্ধু পাব। আমি এক মুহূর্তও অলসভাবে কাটাচ্ছি না, এদেশের দুটি প্রধান কেন্দ্র—বন ও নিউ ইয়র্কের মধ্যে দৌড়ে বেড়াচ্ছি। এর মধ্যে বোষ্টনকে ‘মস্তিষ্ক’ ও নিউ ইয়র্ককে ‘টাকার থলি’ বলা যেতে পারে। এই উভয় স্থানেই আমার কাজ আশাতীতভাবে সফল হয়েছে। যদি সংবাদপ্রেরকগণ তোমাদের নিকট ও-সম্বন্ধে কিছু না পাঠিয়ে থাকে, তাতে আমার কিছু দোষ নেই। যা হোক, বৎসগণ, আমি এই খবরের কাগজের হুজুগে বিরক্ত হয়ে গেছি, আর যে আমি তোমাদের নিকট ওগুলো পাঠাব, সে আশা করো না। কাজ আরম্ভ করবার জন্য একটু হুজুগ দরকার ছিল, এখন যথেষ্ট হয়ে গেছে।
মণি আয়ারকে চিঠি লিখেছি এবং তোমাকে আমার নির্দেশ পূর্বেই জানিয়েছি। এখন আমাকে দেখাও, তোমরা কি করতে পার। আহাম্মকের মত বাজে বকলে চলবে না, এখন আসল কাজ আরম্ভ করতে হবে। কিভাবে কাজ আরম্ভ করতে হবে, তা তোমাদের আগেই জানিয়েছি; আয়ারকেও পত্র লিখেছি। হিন্দুরা যে বড় বড় কথা বলে, তার সঙ্গে আসল কাজ দেখাতে হবে। তা যদি না পারে, তবে তারা কিছুই পাবার যোগ্য নয়। ব্যস্, এই কথা।তোমাদের নানাবিধ খেয়ালের জন্য আমেরিকা টাকা দিতে চাচ্ছে না। কেনই বা দেবে? আমার সম্বন্ধে বক্তব্য এই, আমি যথার্থ সত্য শিক্ষা দিতে চাই; তা এখানেই হোক আর অন্যত্রই হোক—আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না।
আমার বা তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে কে কি বলে, সে দিকে আর কান দিও না। সিংহবিক্রমে কাজ করে যাও, প্রভু তোমাদের আশীর্বাদ করুন। যতদিন না আমার দেহত্যাগ হচ্ছে, অবিশ্রান্ত ভাবে কাজ করে যাব; আর মৃত্যুর পরও জগতের কল্যাণের জন্য কাজ করতে থাকব। অসত্যের চেয়ে সত্যের প্রভাব অনন্তগুণে বেশী; সাধুতারও তাই। তোমাদের যদি ঐ গুণগুলি থাকে, তবে ওরা নিজেদের শক্তিতেই পথ করে নেবে।
থিওসফিষ্টের সঙ্গে আমার কোন সংস্রব নেই। বলছ তারা আমায় সাহায্য করবে। দূর! তোমরা যেমন আহাম্মক! তোমরা কি মনে কর, এখানে লোকে তাদের সঙ্গে আমাকে একদরের মনে করে? এখানে কেউ তাদের গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না, আর হাজার হাজার ভাল লোক আমার প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন। এইটি জেনে রাখ, এবং প্রভুর প্রতি বিশ্বাসসম্পন্ন হও।
খবরের কাগজে হুজুগ আমাকে যতটা না বাড়াতে পেরেছে, তার চেয়ে এদেশে আমি লোকের ওপর ধীরে ধীরে অনেক বেশী প্রভাব বিস্তার করছি। গোঁড়ারা এটা প্রাণে প্রাণে বুঝেছে, তারা কোনমতে এটা ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না; তাই যাতে আমার প্রভাবটা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়, তার জন্য চেষ্টার কিছুমাত্র ত্রুটি করছে না। কিন্তু তারা তা পেরে উঠবে না—প্রভু এ-কথা বলছেন।
এটা হচ্ছে চরিত্রের ও পবিত্রতার প্রভাব, ও ব্যক্তিত্বের শক্তি। যতদিন এগুলি আমার থাকবে, ততদিন নিশ্চিন্ত থেকো, কেউ আমার মাথার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। প্রভু বলেছেন, যদি কেউ চেষ্টা করে, সে ব্যর্থ হবে।
বইপত্র—বাজে জঞ্জাল লিখে কি হবে? লোকের অন্তর স্পর্শ করতে হলে জীবন চাই, সেইটিই হচ্ছে একমাত্র উপায়; ব্যক্তির ভেতর দিয়ে ভাবের আকর্ষণ অপরের প্রাণে সঞ্চারিত হয়ে যায়। তোমরা তো এখনও ছেলেমানুষ। প্রভু আমাকে প্রতিদিনই গভীর হতে গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি দিচ্ছেন। কাজ কর, কাজ কর, কাজ কর।
ওসব বাজে বুকনি ছেড়ে দাও, প্রভুর কথা কও। ভণ্ড ও মাথাপাগলা লোকদের কথা নিয়ে আলোচনা করবার সময় আমাদের নেই—জীবন যে ক্ষণস্থায়ী।
সদাসর্বদা তোমাদের এটি মনে রাখা বিশেষ দরকার যে, প্রত্যেক জাতকে এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ চেষ্টায় নিজের উদ্ধারসাধন করতে হবে। সুতরাং অপরের কাছে সাহায্যের প্রত্যাশা করো না। আমি খুব কঠোর পরিশ্রম করে মাঝে মাঝে কিছু কিছু টাকা পাঠাতে পারি—এই পর্যন্ত। যদি তার ওপর ভরসা করে তোমাদের থাকতে হয়, তবে বরং কাজকর্ম বন্ধ করে দাও। আরও জেনে রাখ যে, আমার ভাব বিস্তার করবার এটি বিশেষ উপযুক্ত জায়গা; আমি যাদের শিক্ষা দেব, তারা হিন্দুই হোক, মুসলমানই হোক, আর খ্রীষ্টানই হোক, আমি তা গ্রাহ্য করি না। যারা প্রভুকে ভালবাসে, তাদেরই সেবা করতে আমি সর্বদাই প্রস্তুত, জানবে।
আমাকে বাজে খবরের কাগজ আর পাঠিও না, ও দেখলেই আমার গা আঁতকে ওঠে। আমাকে নীরবে ধীরভাবে কাজ করতে দাও—প্রভু আমার সঙ্গে সর্বদা রয়েছেন। যদি ইচ্ছা হয় তো সম্পূর্ণ অকপট, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ, সর্বোপরি সম্পূর্ণ পবিত্র হয়ে আমার অনুসরণ কর। আমার আশীর্বাদ তোমাদের ওপর রয়েছে। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে পরস্পর প্রশংসা-বিনিময় করবার সময় আমাদের নেই। যখন এই জীবনযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, তখন প্রাণভরে কে কতদূর কি করলাম, তুলনা করব ও পরস্পরের সুখ্যাতি করব। এখন কথা বন্ধ কর; কেবল কাজ—কাজ—কাজ। ভারতে তোমরা স্থায়ী কিছু করেছ, তা তো দেখতে পাচ্ছি না। তোমরা কোন কেন্দ্র স্থাপন করেছ, তাও দেখতে পাচ্ছি না। তোমরা কোন মন্দির বা হল প্রতিষ্ঠা করেছ—তাও তো দেখছি না। অপর কেউ তোমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে, তাও কিছু দেখছি না। কেবল কথা কথা কথা—‘আমরা খুব বড়, আমরা খুব বড়’—পাগল! আমরা ক্লীব—তা ছাড়া আমরা আর কি?
এই জঘন্য নাম-যশ ও অন্যান্য বাজে ব্যাপার—ওগুলিতে আমার কি হবে? ওগুলি কি আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি? আমি দেখতে চাই—শত শত ব্যক্তি এসে প্রভুর আশ্রয় নেবে। কোথায় তারা? আমি তাদের চাই—তাদের দেখতে চাই। তোমরা তো এরূপ লোক আমার কাছে এনে দিতে পারনি—তোমরা আমায় কেবল নাম-যশ দিয়েছ। নাম-যশ চুলোয় যাক। কাজে লাগ, সাহসী যুবকবৃন্দ, কাজে লাগ। আমার ভেতরে যে কি আগুন জ্বলছে, তার সংস্পর্শে এখনও তোমাদের হৃদয় অগ্নিময় হয়ে ওঠেনি। তোমরা এখন পর্যন্ত আমায় বুঝতে পারনি। তোমরা এখনও আলস্য ও ভোগের পুরাতন রাস্তাতেই চলেছ। দূর করে দাও যত আলস্য, দূর করে দাও ইহলোক ও পরলোকে ভোগের বাসনা। আগুনে গিয়ে ঝাঁপ দাও এবং লোককে ভগবানের দিকে নিয়ে এস।
ভগবৎসমীপে প্রার্থনা করি, আমার ভেতরে যে আগুন জ্বলছে, তা তোমাদের ভেতর জ্বলে উঠুক, তোমাদের মন মুখ এক হোক—ভাবের ঘরে চুরি যেন একদম না থাকে। তোমরা যেন জগতের যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মত মরতে পার—ইহাই সর্বদা বিবেকানন্দের প্রার্থনা।
পুঃ—আলাসিঙ্গা, কিডি, ডাক্তার বালাজী এবং আর আর সকলকে আমার ভালবাসা জানাবে এবং বলবে—রাম শ্যাম যদু আমাদের পক্ষে বা বিপক্ষে কি বলছে, এই নিয়ে তারা যেন দিনরাত মাথা না ঘামায়, তারা যেন তাদের সমস্ত শক্তি একত্র করে কাজে লাগায়। জগতে যত রাম শ্যাম আছে, সকলকে আশীর্বাদ কর, তারা তো শিশু মাত্র, আর তোমরা কাজে লেগে যাও। ইতি—
বি
পুঃ—সংবাদপত্রের রিপোর্ট সম্বন্ধে বক্তব্য এই, খুব সাবধানে তাদের কথা গ্রহণ করতে হবে। কারণ যদি কোন রিপোর্টারকে দেখা সাক্ষাৎ করতে না দেওয়া হয়, তবে সে গিয়ে যা তা কতকগুলি স্বকপোলকল্পিত বাজে গল্প লিখে ছাপিয়ে দেয়। সেইজন্যই তো তোমরা বাল্টিমোর-সংক্রান্ত বাজে খবরগুলো পেয়েছ। লোকগুলি কি করে ঐসব লেখবার উপাদান পেলে, আমি তো নিজেই তা জানি না। আমেরিকার কাগজগুলো কোন ব্যক্তির সম্বন্ধে যা খুশী তাই লেখে। বক্তৃতার রিপোর্টগুলোও বার আনা বাজে কথায় ভরা। রিপোর্টারেরা নিজেদের কল্পনা থেকে অনেক জিনিষ পূরণ করে দেয়। আমেরিকার কাগজ থেকে কিছু তুলে ছাপবার সময় খুব সাবধান। ইতি—
বি
…………………………..
১৫৮*
আমেরিকা
১২ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি গতকল্য জি. জি-কে পত্র লিখেছি, কিন্তু আরও কতকগুলি কথা বলা দরকার হচ্ছে—তাই তোমায় লিখছিঃ
প্রথমতঃ আমি পূর্বে কয়েকখানি পত্রে তোমাদের লিখেছি যে, বই-টই বা খবরের কাগজ প্রভৃতি আর আমায় পাঠিও না, কিন্তু তবু তোমরা পাঠাচ্ছ—এতে আমি বিশেষ দুঃখিত। কারণ আমার ঐগুলি পড়বার এবং ঐগুলি সম্বন্ধে খেয়াল করবার মোটেই সময় নেই। অনুগ্রহ করে ওগুলি আর পাঠিও না। আমি মিশনরী থিওসফিষ্ট বা ঐ ধরনের লোকদের মোটেই আমল দিই না—তারা সবাই যা পারে তা করুক। তাদের কথা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই তাদের দর বাড়ান হবে। মান্দ্রাজ-অভিনন্দনের উত্তরটা মিসেস—কে পাঠিয়ে ঠিক করনি। তিনি একজন গোঁড়া খ্রীষ্টান, সুতরাং গোঁড়াদের সম্বন্ধে ওতে আমি যে সমালোচনা করেছি, তা তাঁর ভাল লাগবে না। যাই হোক, সব ভাল যার শেষ ভাল।
এখন তোমরা চিরদিনের জন্য জেনে রাখ যে, আমি নাম-যশ বা ঐরূপ বাজে জিনিষ একদম গ্রাহ্য করি না। আমি জগতের কল্যাণের জন্য আমার ভাবগুলি প্রচার করতে চাই। তোমরা খুব বড় কাজ করেছ বটে, কিন্তু কাজ যতদূর হয়েছে, তাতে শুধু আমার নাম-যশই হয়েছে। কেবল জগতের বাহবা নেবার জন্যই জীবন ব্যয় করা অপেক্ষা আমার কাছে আমার জীবনের আরও বেশী মূল্য আছে বলে মনে হয়। ঐসব আহাম্মকির জন্য আমার মোটেই সময় নেই, জানবে। তোমরা ভারতের ভাবগুলি প্রচারের জন্য ও সঙ্ঘবদ্ধ হবার উদ্দেশ্যে কি কাজ করেছ?—কই, কিছুই না।
একটি সঙ্ঘের বিশেষ প্রয়োজন—যা হিন্দুদের পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করতে ও ভাল ভাবগুলি আদর করতে শেখাবে। আমাকে ধন্যবাদ দেবার জন্য কলিকাতার সভায় ৫০০০ লোক জড়ো হয়েছিল—অন্যান্য স্থানেও শত শত লোক সভায় মিলিত হয়েছে—বেশ কথা, কিন্তু তাদের প্রত্যেককে চারটি করে পয়সা সাহায্য করতে বল দেখি—অমনি তারা সরে পড়বে। বালসুলভ নির্ভরতাই আমাদের জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। যদি কেউ তাদের মুখের কাছে খাবার এনে দেয়, তবে তারা খেতে খুব প্রস্তুত; কারও কারও আবার সেই খাবার গিলিয়ে দিতে পারলে আরও ভাল হয়। আমেরিকা তোমাদের কিছু টাকা-কড়ি পাঠাতে পারবে না—কেনই বা পারবে? যদি তোমরা নিজেরা নিজেদের সাহায্য করতে না পার, তবে তো তোমরা বাঁচবারই উপযুক্ত নও। তুমি যে জানতে চেয়েছ—আমেরিকার কাছ থেকে বছরে কয়েক হাজার টাকা পাবার নিশ্চিন্ত ভরসা করা যেতে পারে কিনা, তাই পড়ে আমি একেবারে হতাশ হয়ে গেছি। এক পয়সাও পাবে না। সব টাকা কড়ি নিজেদেরই যোগাড় করে নিতে হবে—কেমন, পারবে?
জনসাধারণের শিক্ষা সম্বন্ধে আমার যে পরিকল্পনা ছিল, আমি উপস্থিত তা ছেড়ে দিয়েছি; ও ধীরে ধীরে হবে। এখন আমি চাই—একদল অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত প্রচারক। বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা, সংস্কৃত ও কয়েকটি পাশ্চাত্য ভাষা এবং বেদান্তের বিভিন্ন মতবাদ শিক্ষা দেবার জন্য মান্দ্রাজে একটি কলেজ করতেই হবে। ওর মুখপত্রস্বরূপ ইংরেজী ও দেশীয় ভাষায় পত্রিকা হবে, সঙ্গে সঙ্গে ছাপাখানাও থাকবে। এর মধ্যে একটা কিছু কর—তাহলে জানব, তোমরা কিছু করেছ—কেবল আমাকে আকাশে তুলে দিয়ে প্রশংসা করলে কিছু হবে না।
তোমাদের জাতটা দেখাক যে তারা কিছু করতে প্রস্তুত। তোমরা ভারতে যদি এরূপ কিছু করতে না পার, তবে আমাকে একলা কাজ করতে দাও। জগৎকে দেবার জন্য আমার কাছে একটা বাণী আছে, যারা তা আদরপূর্বক নেবে ও কাজে পরিণত করবে, তাদের কাছে সেটি দিয়ে যেতে চাই। কে বা কারা সেটি নেয়, আমি গ্রাহ্য করি না। ‘যারা আমার পিতার কার্য করবে’,৪৮ তারাই আমার আপনার জন।
যাই হোক, আবার বলছি, এইজন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করো—একেবারে ছেড়ে দিও না। আমার নাম খুব বড় করতে হবে না। আমি দেখতে চাই আমার ভাবগুলি যেন কাজে পরিণত হয়। সকল মহাপুরুষের চেলারাই চিরকাল উপদেশগুলির সঙ্গে গুরুকে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ফেলে, এবং অবশেষে ব্যক্তির জন্য তাঁর ভাবগুলি নষ্ট হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যগণ যেন এই প্রকার না করেন। এ বিষয়ে তাঁদের সর্বদাই সাবধান থাকতে হবে। তোমরা ভাবগুলির জন্য কাজ কর, ব্যক্তির জন্য নয়। প্রভু তোমাদের আশীর্বাদ করুন।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৫৯
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
১৮৯৫
প্রাণাধিকেষু,
এক্ষণে বহুত খবরের কাগজ এককাট্টা হইয়া গেল। আর পাঠাইবার আবশ্যক নাই। হুজুগ এক্ষণে ভারতের মধ্যেই চলুক। বোধ করি, তোমরা এতদিনে কলিকাতায় আসিয়া থাকিবে। তারকদার পত্র শেষ, তারপর আর কোন সংবাদ নাই।
কালী কলিকাতায় থাকিয়া কাগজপত্র ছাপাইতেছে—সে বড় ভাল কথা, কিন্তু এখানে আর পাঠাইবার আবশ্যক নাই। … কিন্তু এই যে দেশময় একটা হুজুগ উঠিয়াছে, ইহার আশ্রয়ে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়। অর্থাৎ স্থানে স্থানে branch (শাখা) স্থাপন করিবার প্রযত্ন কর। ফাঁকা আওয়াজ না হয়। মান্দ্রাজবাসীদের সহিত যোগদান করিয়া স্থানে স্থানে সভা প্রভৃতি স্থাপন করিতে হইবে। যে খবরের কাগজ বাহির হইবার কথা হইতেছিল, তাহার কি হইল? খবরের কাগজ চালাইবার তোমার ভাবনা কি আমরা জানি না; এখন লোক যে অল্প। চিঠি লিখে, ইত্যাদি করে সকলের ঘাড়ে গতিয়ে দাও; তারপর গড় গড় করে চলে যাবে। বাহাদুরি দেখাও দেখি। দাদা, মুক্তি নাই বা হল, দু-চার বার নরককুণ্ডে গেলেই বা। এ-কথা কি মিথ্যে?—
মনসি বচসি কায়ে পুণ্যপীযূষপূর্ণঃ
ত্রিভুবনমুপকারশ্রেণীভিঃ প্রীয়মাণঃ।
পরগুণপরমাণুং পর্বতীকৃত্য কেচিৎ
নিজহৃদি বিকসন্তঃ সন্তি সন্তঃ কিয়ন্তঃ॥৪৯
নাই বা হল তোমাদের মুক্তি। কি ছেলেমানষি কথা! রাম রাম! আবার ‘নেই নেই’ বললে সাপের বিষ ক্ষয় হয়ে যায় কিনা? ও কোন্ দিশী বিনয়—‘আমি কিছু জানি না, আমি কিছুই নই’—ও কোন্ দিশী বৈরাগ্যি আর বিনয় হে বাপ! ও রকম ‘দীনাহীনা’ ভাবকে দূর করে দিতে হবে! আমি জানিনি তো কোন্ শালা জানে? তুমি জান না তো এতকাল করলে কি? ও-সব নাস্তিকের কথা, লক্ষ্মীছাড়ার বিনয়। আমরা সব করতে পারি, সব করব; যার ভাগ্যে আছে, সে আমাদের সঙ্গে হুহুঙ্কারে চলে আসবে, আর লক্ষ্মীছাড়াগুলো বেড়ালের মত কোণে বসে মেউ মেউ করবে।
এক মহাপুরুষ লিখছেন, ‘আর কেন? হুজুগ খুব হল, ঘরে ফিরে এস।’ বেকুব; তোকে মরদ বলতুম, যদি একটা ঘর করে আমায় ডাকতে পারতিস। ও-সব আমি দশ বৎসর দেখে দেখে পাকা হয়ে গেছি। কথায় আর চিঁড়ে ভেজে না। যার মনে সাহস, হৃদয়ে ভালবাসা আছে, সে আমার সঙ্গে আসুক; বাকী কাউকে আমি চাই না, মার কৃপায় আমি এক লাখ আছি—বিশ লাখ হব। আমার একটি কাজ হয়ে গেলেই আমি নিশ্চিন্ত। রাখাল ভায়া, তুমি উদ্যোগ করে সেইটি করে দেবে—মা-ঠাকুরাণীর জন্য একটা জায়গা। আমার টাকাকড়ি সব মজুত; খালি তুমি উঠে পড়ে লেগে একটা জমি দেখে শুনে কেনো। জমির জন্য ৩।৪ অথবা ৫ হাজার পর্যন্ত লাগে তো ক্ষতি নাই। ঘর-দ্বার এক্ষণে মাটির ভাল। একতলা কোঠার চেয়ে মাটির ঘর ঢের ভাল। ক্রমে ঘর-দ্বার ধীরে ধীরে উঠবে। যে নামে বা রকমে জমি কিনলে অনেক দিন চলবে, তাই উকিলদের পরামর্শে করিবে। আমার দেশে যাওয়া অনিশ্চিত। সেখানেও ঘোরা, এখানেও ঘোরা; তবে এখানে পণ্ডিতের সঙ্গ, সেখানে মূর্খের সঙ্গ—এই স্বর্গ-নরকের ভেদ। এদেশের লোকে এককাট্টা হয়ে কাজ করে, আর আমাদের সকল কাজ বৈরিগ্যি (অর্থাৎ কুঁড়েমি), হিংসা প্রভৃতির মধ্যে পড়ে চুরমার।
হরমোহন, মধ্যে মধ্যে এক দিগ্গজ পত্র লেখেন—তা আমি অর্ধেক পড়তে পারি না, ইহা আমার পক্ষে পরম মঙ্গল। কারণ অধিকাংশ খবরই এই ডৌলের যথা—‘অমুক ময়রার দোকানে বসে অমুক ছেলেরা আপনার বিরুদ্ধে এই-সকল কথা বলিতেছিল, আর তাহাতে আমি অসহ্য বোধে তাহাদের সহিত কলহ করিলাম ইতি।’ আমার পক্ষসমর্থনের জন্য তাহাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু জেলে-মালা আমার সম্বন্ধে কে কি বলিতেছে, ইহা সবিশেষ শুনিবার বিশেষ বাধা এই যে—‘স্বল্পশ্চ কালো বহবশ্চ বিঘ্নাঃ’ (সময় অল্প, বিঘ্ন অনেক)।
একটা Organized Society (সঙ্ঘবদ্ধ সমিতি) চাই। শশী ঘরকন্না দেখুক, সান্যাল টাকাকড়ি বাজারপত্রের ভার নিক, শরৎ সেক্রেটারী হোক অর্থাৎ চিঠিপত্র সব লেখা ইত্যাদি। একটা ঠিকানা কর, মিছে হাঙ্গাম কি করছ—বুঝতে পারলে কিনা? খবরের কাগজে ঢের হয়ে গেছে, এক্ষণে আর দরকার নাই। এক্ষণে তোমরা কিছু কর দিকি দেখি। যদি একটা মঠ বানাতে পার, তবে বলি বাহাদুর, নইলে ঘোড়ার ডিম। মান্দ্রাজের লোকদের সঙ্গে যুক্তি করে কাজ করবে। তাদের কাজ করবার অনেক শক্তি আছে। এবারকার মহোৎসব এমনি হুজুগ করে করবে যে, এমন আর কখনও হয় নাই। খাওয়াদাওয়ার হুজুগ যত কম হয়, ততই ভাল। দাঁড়া-প্রসাদ, মালসা ভোগ যথেষ্ট। সুরেশ দত্ত-র ‘শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনী’ পাঠ করলাম। খুব ভাল; তবে … প্রভৃতি উদাহরণগুলি ছাপিয়েছেন কেন? কি মহাপাপ, ছি ছি!
আমি একটা ইংরেজীতে শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবন very short (অতি সংক্ষিপ্ত) লিখিয়া পাঠাইতেছি। সেটা ছাপাইয়া ও বঙ্গানুবাদ করিয়া মহোৎসবে বিক্রী করিবে, বিতরণ করিলে লোকে পড়ে না। কিঞ্চিৎ দাম চাই। খুব ধূমধামের সঙ্গে মহোৎসব করিবে। কিছু collection (চাঁদা) নেবে। তাতে দু এক হাজার টাকা হতে পারবে। তাহলে মা-ঠাকুরাণীর জমির উপর দস্তুরমত ঘর-দ্বার হয়ে যাবে। ইতি
চৌরস বুদ্ধি চাই, তবে কাজ হয়। যে গ্রামে বা শহরে যাও, যেখানে দশজন লোক পরমহংসদেবকে শ্রদ্ধাভক্তি করে, সেইখানেই একটা সভা স্থাপন করিবে। এত গ্রামে গ্রামে কি ভেরেণ্ডা ভাজলে নাকি? হরিসভা প্রভৃতিগুলোকে ধীরে ধীরে ‘স্বাহা’ করতে হবে। কি বলব তোদের? আর একটা ভূত যদি আমার মত পেতুম! ঠাকুর কালে সব জুটিয়ে দেবেন। … শক্তি থাকলেই বিকাশ দেখাতে হবে। … মুক্তি-ভক্তির ভাব দূর করে দে। এই একমাত্র রাস্তা আছে দুনিয়ায়—পরোপকারায় হি সতাং জীবিতং পরার্থং প্রাজ্ঞ উৎসৃজেৎ (পরোপকারের জন্যই সাধুদিগের জীবন, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি পরের জন্যই তা উৎসর্গ করবেন)। তোমার ভাল করলেই আমার ভাল হয়, দোসরা আর উপায় নেই, একেবারেই নেই। ‘হে ভগবান্, হে ভগবান্!’ আরে ভগবান্ হেন করবেন, তেন করবেন—আর তুমি বসে বসে কি করবে? … তুই ভগবান্, আমি ভগবান্, মানুষ ভগবান্ দুনিয়াতে সব করছে; আবার ভগবান্ কি গাছের উপর বসে আছেন? এই তো বুদ্ধির দৌড়, তারপর— … যদি কল্যাণ চাস, ওসব হিংসে ঝগড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে লেগে যা। যারা তা করতে পারবে না, তাদের বিদায় করে দে।
বিমলা … শশী সাণ্ডেলের লিখিত এক পুস্তক পাঠিয়েছেন এবং লিখেছেন যে, শশীবাবুর সাংসারিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ—তাই জন্য তাঁর পুস্তকের যদি এ দেশে কেহ কেহ সহায়তা করে। দাদা, সে পুঁথি হল বাঙলা ভাষায়—এদেশের লোক কি সাহায্য করবে?—পুঁথি পড়ে বিমলা অবগত হয়েছেন যে, এ দুনিয়াতে যত লোক আছে, তারা সকলে অপবিত্র এবং তাদের প্রকৃতিতে আসলে ধর্ম হবার যো-টি নাই, কেবল ভারতবর্ষের একমুষ্টি ব্রাহ্মণ যাঁরা আছেন, তাঁদের ধর্ম হতে পারবে। আবার তাঁদের মধ্যে শশী (সাণ্ডেল) আর বিমলাচরণ—এঁরা হচ্ছেন চন্দ্রসূর্যস্বরূপ। সাবাস, কি ধর্মের জোর রে বাপ! বিশেষ বাঙলাদেশে ঐ ধর্মটা বড়ই সহজ। অমন সোজা রাস্তা তো আর নাই। তপ-জপের সার সিদ্ধান্ত এই যে, আমি পবিত্র আর সব অপবিত্র! পৈশাচিক ধর্ম, রাক্ষসী ধর্ম, নারকী ধর্ম! যদি আমেরিকার লোকের ধর্ম হতে পারে না, যদি এদেশে ধর্ম প্রচার করা ঠিক নয়, তবে তাহাদের সাহায্য-গ্রহণে আবশ্যক কি? এদিকে অযাচিত বৃত্তির ধুম, আবার পুঁথিময় আক্ষেপ, আমায় কেউ কিছু দেয় না। বিমলা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, যখন ভারতসুদ্ধ লোক শশী (সাণ্ডেল) আর বিমলার পদপ্রান্তে ধনরাশি ঢেলে দেয় না, তখন ভারতের সর্বনাশ উপস্থিত। কারণ, শশীবাবু সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা অবগত আছেন এবং বিমলা তৎপাঠে নিশ্চিত অবগত হয়েছেন যে, তিনি ছাড়া এ পৃথিবীতে আর কেহই পবিত্র নাই। এ রোগের ঔষধ কি? বলি, শশী- বাবুকে মালাবারে যেতে বলো। সেখানকার রাজা সমস্ত প্রজার জমি ছিনিয়ে নিয়ে ব্রাহ্মণগণের চরণার্পণ করেছেন, গ্রামে গ্রামে বড় বড় মঠ, চর্ব্য চূষ্য খানা, আবার নগদ। … ভোগের সময় ব্রাহ্মণেতর জাতের স্পর্শে দোষ নাই—ভোগ সাঙ্গ হলেই স্নান; কেন না ব্রাহ্মণেতর জাতি অপবিত্র—অন্য সময় তাদের স্পর্শ করাও নাই। এক শ্রেণীর সাধু সন্ন্যাসী আর ব্রাহ্মণ বদমাশ দেশটা উৎসন্ন দিয়েছে। ‘দেহি দেহি’ চুরি-বদমাশি—এরা আবার ধর্মের প্রচারক! পয়সা নেবে, সর্বনাশ করবে, আবার বলে ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না’—আর কাজ তো ভারি—‘আলুতে বেগুনেতে যদি ঠেকাঠেকি হয়, তাহলে কতক্ষণে ব্রহ্মাণ্ড রসাতলে যাবে?’ ‘১৪ বার হাতে-মাটি না করিলে ১৪ পুরুষ নরকে যায়, কি ২৪ পুরুষ?’—এই-সকল দুরূহ প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছেন আজ দু হাজার বৎসর ধরে। এদিকে 1/4 of the people are starving (সিকি ভাগ লোক না খেতে পেয়ে মরছে)। ৮ বৎসরের মেয়ের সঙ্গে ৩০ বৎসরের পুরুষের বে দিয়ে মেয়ের মা-বাপ আহ্লাদে আটখানা। … আবার ও কাজে মানা করলে বলেন, আমাদের ধর্ম যায়! ৮ বৎসরের মেয়ের গর্ভাধানের যাঁরা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেন, তাঁদের কোন দেশী ধর্ম? আবার অনেকে এই প্রথার জন্য মুসলমানদের ঘাড়ে দোষ দেন। মুসলমানদের দোষ বটে!! সব গৃহ্যসূত্রগুলো পড়ে দেখ দেখি, ‘হস্তাৎ যোনিং ন গূহতি’ যতদিন, ততদিন কন্যা, এর পূর্বেই তার বে দিতে হবে। সমস্ত গৃহ্যসূত্রেরই এই আদেশ।
বৈদিক অশ্বমেধ যজ্ঞের ব্যাপার স্মরণ কর—‘তদনন্তরং মহিষীং অশ্ব-সন্নিধৌ পাতয়েৎ’ ইত্যাদি! আর হোতা পোতা ব্রহ্মা উদ্গাতা প্রভৃতিরা বেডোল মাতাল হয়ে কেলেঙ্কারী করত। বাবা, জানকী বনে গিয়েছিলেন, রাম একা অশ্বমেধ করলেন—শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেম বাবা!
এ-কথা সমস্ত ব্রাহ্মণেই আছে—সমস্ত টীকাকার স্বীকার করেছেন। না করবার যো-টি কি!
এ সকল কথা বলবার মানে এই—প্রাচীনকালে ঢের ভাল জিনিষ ছিল, খারাপ জিনিষও ছিল। ভালগুলি রাখতে হবে, কিন্তু আসছে যে ভারত—Future India—Ancient India-র (ভবিষ্যৎ ভারত প্রাচীন ভারতের) অপেক্ষা অনেক বড় হবে। যেদিন রামকৃষ্ণ জন্মেছেন, সেইদিন থেকেই Modern India (বর্তমান ভারত)—সত্যযুগের আবির্ভাব! আর তোমরা এই সত্যযুগের উদ্বোধন কর—এই বিশ্বাসে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হও।
তাইতেই যখন তোমরা বলো, রামকৃষ্ণ অবতার, আবার তারপরই বল, আমরা কিছুই জানি না, তখনই আমি বলি, liar (মিথ্যাবাদী), চোর, ঝুঠ বিলকুল। যদি রামকৃষ্ণ পরমহংস সত্য হন, তোমরাও সত্য। কিন্তু দেখাতে হবে। … তোমাদের সকলের ভেতর মহাশক্তি আছে, নাস্তিকের ভেতর ঘোড়ার ডিম আছে। যারা আস্তিক, তারা বীর; তাদের মহাশক্তি বিকাশ হবে। দুনিয়া ভেসে যাবে—‘দয়া দীন উপকার’—মানুষ ভগবান্, নারায়ণ—আত্মায় স্ত্রী পুং নপুং ব্রহ্মক্ষত্রাদি ভেদ নাই—ব্রহ্মাদিস্তম্ব পর্যন্ত নারায়ণ। কীট less manifested (অল্প অভিব্যক্ত), ব্রহ্ম more manifested (অধিক অভিব্যক্ত)। Every action that helps a being manifest its divine nature more and more is good; every action that retards it, is evil.
The only way of getting our divine nature manifested is by helping others do the same.
If there is inequality in nature, still there must be equal chance for all—or if greater for some and for some less—the weaker should be given more chance than the stronger.৫০
অর্থাৎ চণ্ডালের বিদ্যাশিক্ষার যত আবশ্যক, ব্রাহ্মণের তত নহে। যদি ব্রাহ্মণের ছেলের একজন শিক্ষকের আবশ্যক, চণ্ডালের ছেলের দশ জনের আবশ্যক। কারণ যাহাকে প্রকৃতি স্বাভাবিক প্রখর করেন নাই তাহাকে অধিক সাহায্য করিতে হইবে। তেলা মাথায় তেল দেওয়া পাগলের কর্ম। The poor, the down-trodden, the ignorant, let these be your God.৫১
মহা দঁক সামনে—সাবধান! ঐ দঁকে সকলে পড়ে মারা যায়—ঐ দঁক হচ্ছে যে—হিঁদুর (এখনকার) ধর্ম বেদে নাই, পুরাণে নাই, ভক্তিতে নাই, মুক্তিতে নাই—ধর্ম ঢুকেছেন ভাতের হাঁড়িতে। [এখনকার] হিঁদুর ধর্ম বিচারমার্গেও নয়, জ্ঞানমার্গেও নয়—ছুঁৎমার্গে; আমায় ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না, ব্যস্। এই ঘোর বামাচার ছুঁৎমার্গে পড়ে প্রাণ খুইও না। ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু’, কি কেবল পুঁথিতে থাকিবে না কি? যারা এক টুকরা রুটি গরীবের মুখে দিতে পারে না, তারা আবার মুক্তি কি দিবে! যারা অপরের নিঃশ্বাসে অপবিত্র হয়ে যায়, তারা আবার অপরকে কি পবিত্র করিবে? ছুঁৎমার্গ is a form of mental disease (একপ্রকার মানসিক ব্যাধি), সাবধান! All expansion is life, all contraction is death. All love is expansion, all selfishness is contraction. Love is therefore the only law of life. He who loves lives, he who is selfish is dying. Therefore love for love’s sake, because it is only law of life, just you breathe to live.৫২ This is the secret of নিষ্কাম প্রেম, কর্ম, &c. (ইহাই নিষ্কাম প্রেম, কর্ম প্রভৃতির রহস্য)।
শশীর (সাণ্ডেল) যদি কিছু উপকার করিতে পার চেষ্টা করিবে। সে অতি উদার ব্যক্তি ও নিষ্ঠাবান, তবে সঙ্কীর্ণপ্রাণ। পরদুঃখকাতরতা সকলের ভাগ্যে হয় না। রামকৃষ্ণাবতারে জ্ঞান ভক্তি ও প্রেম। অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত প্রেম, অনন্ত কর্ম, অনন্ত জীবে দয়া। তোরা এখনও বুঝতে পারিসনি। শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ (কেহ কেহ আত্মার বিষয় শুনিয়াও ইঁহাকে জানিতে পারে না)। What the whole Hindu race has thought in ages, he lived in one life. His life is the living commentary to the Vedas of all the nations.৫৩ ক্রমশঃ লোকে বুঝবে—আমার পুরানো বোল—struggle, struggle up to light. Onward, (প্রাণপণ সংগ্রাম করে আলোর দিকে অগ্রসর হও)। অলমিতি—দাস
নরেন্দ্র
…………………………..
১৬০*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
ব্রুকলিন
২০ জানুআরী, ১৮৯৫
… আপনার পিতা যে তাঁর জীর্ণ শরীর ত্যাগ করবেন, আমি পূর্বেই তার কতকটা আভাস পেয়েছিলাম, কিন্তু যখন এরূপ সঙ্গতিহীন মায়ার তরঙ্গ কাউকে আঘাত করবার উপক্রম করে, তখন তাকে সে বিষয় লেখাটা আমার অভ্যাস নয়। তবে এই সময়গুলি জীবনের এক একটা অধ্যায় পাল্টানোর মত—আর আমি জানি, আপনি এতে সম্পূর্ণ অবিচলিত আছেন। সমুদ্রের উপরিভাগটা পর্যায়ক্রমে উঠে নামে বটে, কিন্তু যে আত্মা ধীরভাবে তা পর্যবেক্ষণ করছেন, সেই জ্যোতির তনয়ের নিকট প্রত্যেক পতন ওর ভেতর দিকটা এবং নিম্নদেশস্থ মুক্তার স্তর ও প্রবালসমূহকে বেশী বেশী করে প্রকাশিত করে। আসা যাওয়া সম্পূর্ণ ভ্রমমাত্র। আত্মা কখনও আসেনও না, যানও না। যখন সমুদয় দেশ আত্মার মধ্যেই রয়েছে, তখন সে স্থানই বা কোথায়, আত্মা যেখানে যাবেন? যখন সমুদয় কাল আত্মাতেই রয়েছে, তখন ওর দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করবার ও ছাড়বার সময়ই বা কোথায়?
পৃথিবী ঘুরছে, ঐ ঘোরাতেই এই ভ্রম উৎপন্ন হচ্ছে যে সূর্য ঘুরছে; কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে সূর্য ঘুরছে না। সেইরূপ প্রকৃতি বা মায়া বা স্বভাব ঘুরছে, পরিণাম প্রাপ্ত হচ্ছে, আবরণের পর আবরণ উন্মোচন করছে, এই মহান্ গ্রন্থের পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছে—এদিকে সাক্ষিস্বরূপ আত্মা অবিচলিত ও অপরিণামী জ্ঞানসুধাপানে বিভোর আছেন। যত জীবাত্মা পূর্বে ছিল বা বর্তমানে আছে বা ভবিষ্যতে থাকবে, সকলেই বর্তমান কালে রয়েছে, আর জড় জগতের একটি উপমা ব্যবহার করে বলা যায় যে, তারা সকলেই এক জ্যামিতিক বিন্দুতে রয়েছে। যেহেতু আত্মাতে দেশের ভাব থাকতে পারে না, সেইহেতু যাঁরা সকলে আমাদের ছিলেন, আমাদের রয়েছেন এবং আমাদের হবেন, তাঁরা সকলেই আমাদের সঙ্গে সর্বদাই রয়েছেন, সর্বদাই ছিলেন এবং সর্বদাই থাকবেন। আমরা তাঁদের মধ্যে রয়েছি এবং তাঁরাও আমাদের মধ্যে রয়েছেন।
এই কোষগুলির কথা ধরুন। যদিও এরা প্রত্যেকটি পৃথক্, তথাপি সকলেই ক ও খ (দেহ ও প্রাণ)—এই দুই বিন্দুতে সম্মিলিত রয়েছে। সেখানে তারা এক। প্রত্যেকেরই এক একটা আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্ব রয়েছে, কিন্তু সকলেই ঐ ক-খ নামক অক্ষে (axis) সম্মিলিত। কোনটাই সেই অক্ষকে ছেড়ে থাকতে পারে না, আর ঐসকল কোষের পরিধি যতই ভগ্ন বা ছিন্নভিন্ন হোক না কেন, ঐ অক্ষে দাঁড়িয়ে আমরা এর মধ্যে যে-কোন ঘরে ঢুকতে পারি। এই অক্ষটিই ঈশ্বর (ব্রহ্ম ও শক্তি)। এইখানেই আমরা তাঁর সঙ্গে এক; এতেই সকলের সঙ্গে সকলের যোগ, আর সকলেই সেই ভগবানে সম্মিলিত।
একখানা মেঘ চাঁদের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, তাতে এই ভ্রমের উৎপত্তি হচ্ছে যে, চাঁদটাই চলেছে। তেমনি প্রকৃতি, দেহ, জড়বস্তু—এইগুলি সচল, গতিশীল; এদের গতিতেই এই ভ্রম উৎপন্ন হচ্ছে যে, আত্মা গতিশীল। সুতরাং অবশেষে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সহজাত জ্ঞান (অথবা প্রেরণা?) দ্বারা সর্বজাতির উচ্চনীচ সব রকমের লোক, মৃতব্যক্তিদের অস্তিত্ব নিজেদের কাছেই অনুভব করে এসেছে, যুক্তির দৃষ্টিতেও তা সত্য।
প্রত্যেক জীবাত্মাই এক একটা নক্ষত্রস্বরূপ, আর ঈশ্বররূপ সেই অনন্ত নির্মল নীল আকাশে এই নক্ষত্ররাজি বিন্যস্ত রয়েছে। সেই ঈশ্বরই প্রত্যেক জীবাত্মার মূলস্বরূপ, তিনি প্রত্যেকের যথার্থ স্বরূপ, প্রত্যেকের প্রকৃত ব্যক্তিত্ব তিনিই। কতকগুলি জীবাত্মারূপ তারকা—যাঁরা আমাদের দিগন্তের বাইরে চলে গেছেন, তাঁদের সন্ধানেই ধর্ম জিনিষটার আরম্ভ; আর এই অনুসন্ধান সমাপ্ত হল—যখন তাঁদের সকলকেই ভগবানের মধ্যে পাওয়া গেল এবং আমরা আমাদের নিজেদেরও যখন তাঁর মধ্যে পেলাম। সুতরাং ভিতরের কথা হচ্ছে এই যে, আপনার পিতা যে জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করেছিলেন, তা ত্যাগ করেছেন এবং অনন্তকাল যেখানে ছিলেন, সেখানেই অবস্থিত রয়েছেন। তিনি কি এ জগতে বা অন্য কোন জগতে আর একটি ঐরূপ বস্ত্র প্রস্তুত করে পরিধান করবেন? আমি ভগবৎসমীপে হৃদয়ের সহিত প্রার্থনা করছি, যে পর্যন্ত না পূর্ণ জ্ঞানের সহিত তিনি তা না করতে পারছেন, তাঁকে যেন আর তা না করতে হয়। প্রার্থনা করি, কাউকে যেন তার নিজকৃত পূর্ব কর্মের অদৃশ্য শক্তিতে পরিচালিত হয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও না যেতে হয়। প্রার্থনা করি, সকলেই যেন মুক্ত হতে পারে অর্থাৎ জানতে পারে যে, আমরা মুক্ত। আর যদি বা আবার স্বপ্ন দেখতে হয়, তবে তাদের সে স্বপ্ন যেন শান্তি ও আনন্দপূর্ণ হয়। ইতি
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৬১*
নিউ ইয়র্ক
২৪ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
মনে হয়—এ বৎসর আমার অতিরিক্ত পরিশ্রম হচ্ছে, কারণ অবসাদ অনুভব করছি। এক দফা বিশ্রামের খুব বেশী দরকার। সুতরাং মার্চ মাসের শেষভাগে বোষ্টনের কাজে হাত দেওয়ার সম্বন্ধে আপনার প্রস্তাবটি সমীচীন বটে। এপ্রিলের শেষাশেষি আমি ইংলণ্ড যাত্রা করব।
ক্যাট্স্কিল অঞ্চলে অতি অল্পমূল্যে বিস্তীর্ণ ভূমিখণ্ড পাওয়া যেতে পারে। একশত-এক একর পরিমাণ একটি জমি আছে; মূল্য মাত্র দু-শ ডলার। অর্থ মজুত রয়েছে। কিন্তু জমি আমার নামে তো আর কিনতে পারি না। এ দেশে আপনিই আমার একমাত্র সম্পূর্ণ বিশ্বাসভাজন বন্ধু। আপনি সম্মত হলে ঐ জমিটি আপনার নামে ক্রয় করি। গ্রীষ্মকালে শিক্ষার্থীরা ওখানে গিয়ে ইচ্ছামত কুটীর নির্মাণ বা শিবির রচনা করে ধ্যানাভ্যাস করতে পারবে। পরে অর্থসংগ্রহে সক্ষম হলে তারা সেখানে পাকা ঘর নির্মাণ করতে পারবে।
কাল এ-মাসের শেষ রবিবাসরীয় বক্তৃতা। আগামী মাসের প্রথম রবিবারে বক্তৃতা হবে ব্রুকলিন শহরে, অবশিষ্ট তিনটি নিউ ইয়র্কে। এ-বৎসরের মত নিউ ইয়র্ক-বক্তৃতাবলী এখানেই শেষ করব।
প্রাণ ঢেলে খেটেছি। আমার কাজের মধ্যে সত্যের বীজ যদি কিছু থাকে, কালে তা অঙ্কুরিত হবেই। অতএব আমি নিশ্চিন্ত—সকল বিষয়েই। বক্তৃতা এবং অধ্যাপনায় আমার বিতৃষ্ণা এসে যাচ্ছে। ইংলণ্ডে কয়েক মাস কাজ করার পর ভারতবর্ষে ফিরে গিয়ে বৎসর-কয়েকের জন্য অথবা চিরতরে গা-ঢাকা দেব। আমি যে ‘নিষ্কর্মা সাধু’ হয়ে থাকিনি, সে বিষয়ে অন্তর থেকে আমি নিঃসন্দেহ। একটি লেখবার খাতা আমার আছে। এটি আমার সঙ্গে পৃথিবীময় ঘুরছে। দেখছি সাত বৎসর পূর্বে এতে লেখা রয়েছেঃ এবার একটি একান্ত স্থান খুঁজে নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় পড়ে থাকতে হবে। কিন্তু তাহলে কি হয়, এই সব কর্মভোগ বাকী ছিল! আমার বিশ্বাস, এবার কর্মক্ষয় হয়েছে, এবং ভগবান্ আমাকে প্রচারকার্য তথা শুভকর্মের বন্ধন থেকেও অব্যাহতি দেবেন।
আত্মাই এক এবং অখণ্ড সত্তাস্বরূপ আর সব অসৎ—এই জ্ঞান হয়ে গেলে কি আর কোন ব্যক্তি বা বাসনা মানসিক উদ্বেগের হেতু হতে পারে? মায়ার প্রভাবেই পরোপকার ইত্যাদি খেয়ালগুলো আমার মাথায় ঢুকেছিল, এখন আবার সরে যাচ্ছে। চিত্তশুদ্ধি অর্থাৎ চিত্তকে জ্ঞানলাভের উপযোগী করা ছাড়া কর্মের যে আর কোন সার্থকতা নেই—এ বিষয়ে আমার বিশ্বাস ক্রমশঃ দৃঢ় হচ্ছে।
দুনিয়া তার ভাল মন্দ নিয়ে নানা রূপে চলতে থাকবে। ভাল মন্দ শুধু নূতন নামে ও নূতন স্থানে দেখা দেবে। নিরবচ্ছিন্ন প্রশান্তি ও বিশ্রামের জন্য আমার হৃদয় তৃষিত। ‘একাকী বিচরণ কর! একাকী বিচরণ কর! যিনি একাকী অবস্থান করেন, কাহারও সহিত কদাচ তাঁহার বিরোধ হইতে পারে না। তিনি অপরের উদ্বেগের হেতু হন না, অপরেও তাঁহার উদ্বেগের হেতু হন না।’ সেই ছিন্ন বস্ত্র (কৌপীন), মুণ্ডিত মস্তক, তরুতলে শয়ন ও ভিক্ষান্ন-ভোজন—হায়! এগুলিই এখন আমার তীব্র আকাঙ্ক্ষার বিষয়! শত অপূর্ণতা সত্ত্বেও সেই ভারতভূমিই একমাত্র স্থান, যেখানে আত্মা তার মুক্তির সন্ধান পায়—ভগবানের সন্ধান পায়। পাশ্চাত্যের এ-সব আড়ম্বর সর্বথা অন্তঃসারশূন্য ও আত্মার বন্ধন। জীবনে আর কখনও এর চেয়ে তীব্রভাবে জগতের অসারতা অনুভব করিনি। ভগবান্ সকলের বন্ধন ছিন্ন করে দিন—সকলেই মায়া-মুক্ত হোক, ইহাই বিবেকানন্দের চিরন্তন প্রার্থনা।
…………………………..
১৬২*
[মিস ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
528, 5th Avenue, নিউ ইয়র্ক
২৪ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় মিস বেল,
আশা করি ভাল আছ …
আমার শেষ বক্তৃতাটা পুরুষদের দ্বারা খুব বেশী সমাদৃত হয়নি, কিন্তু দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে মেয়েদের দ্বারা। তুমি জান যে, ব্রুকলিন জায়গাটা নারী-অধিকার আন্দোলনের বিরোধিতা কেন্দ্র, তাই যখন আমি বললাম, মেয়েরা সর্ববিষয়ে অধিকার পাবার যোগ্য এবং তাদের তা পাওয়া উচিত, তখন বলাই বাহুল্য, পুরুষেরা সেটা পছন্দ করল না। তার জন্যে কোন চিন্তা নাই, মেয়েরা খুশীতে আত্মহারা।
আমার আবার একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। আমি গার্নসিদের কাছে যাচ্ছি। শহরতলীতেও একটা ঘর পেয়েছি; সেখানে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে কয়েক ঘণ্টা কাটাব। মাদার চার্চ নিশ্চয়ই এতদিনে সম্পূর্ণ ভাল হয়েছেন এবং তোমরা সকলে আজকালকার সুন্দর আবহাওয়া উপভোগ করছ। মিসেস এডামস্কে আমার পর্বতপ্রমাণ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা দিও, যখন তাঁর সঙ্গে তোমার দেখা হবে। আমার চিঠিগুলি যথারীতি গার্নসিদের কাছে পাঠিয়ে দিও।
সকলের জন্য আমার ভালবাসা।
তোমাদের সদা স্নেহবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৬৩*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
54W. 33rd Street, N.Y
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
১ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫
স্নেহের ভগিনী,
এইমাত্র তোমার সুন্দর পত্রখানি পাইলাম। মাদার চার্চ কনসার্টে যাইতে পারেন নাই শুনিয়া অতীব দুঃখিত হইলাম। নিষ্কামভাবে কাজ করিতে বাধ্য হওয়াও সময়ে সময়ে উত্তম সাধন—যদিও তাহাতে নিজকৃত কর্মের ফলভোগ হইতে বঞ্চিত হইতে হয়।
ভগিনী জোসেফাইন লক্ও একখানি সুন্দর চিঠি লিখিয়াছেন। তোমার সমালোচনাগুলি পড়িয়া আমি মোটেই দুঃখিত হই নাই, বরং বিশেষ আনন্দিত হইয়াছি। সেদিন মিস থার্সবির বাড়ীতে এক প্রেসবিটেরিয়ান ভদ্রলোকের সহিত আমার তুমুল তর্ক হইয়াছিল। যেমন হইয়া থাকে, ভদ্রলোকটি অত্যন্ত উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া গালাগালি আরম্ভ করিলেন। যাহা হউক, মিসেস বুল আমাকে এজন্য পরে খুব ভর্ৎসনা করিয়াছেন, কারণ এগুলি আমার কাজের পক্ষে ক্ষতিকর। তোমারও মত ঐ প্রকার বলিয়া বোধ হইতেছে।
তুমি যে এ সম্বন্ধে ঠিক এই সময়েই লিখিয়াছ, ইহা আনন্দের বিষয়, কারণ আমি ঐ বিষয়ে যথেষ্ট ভাবিতেছি। প্রথমতঃ আমি এই সকল ব্যাপারের জন্য আদৌ দুঃখিত নই; হয়তো তুমি ইহাতে বিরক্ত হইবে—হইবার কথা বটে। সাংসারিক উন্নতির জন্য মধুরভাষী হওয়া যে কত ভাল, তাহা আমি বিলক্ষণ জানি। আমি মিষ্টভাষী হইতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি, কিন্তু যখন অন্তরস্থ সত্যের সহিত একটা ভয়ঙ্কর আপস করিতে হয়, তখনই আমি থামিয়া যাই। আমি বিনম্র দীনতায় বিশ্বাসী নহি—সমদর্শিত্বের ভক্ত!
সাধারণ মানবের কর্তব্য—তাহার ‘ঈশ্বর’—সমাজের সকল আদেশ পালন করা; কিন্তু জ্যোতির তনয়গণ কখনও সেরূপ করেন না। ইহা একটি চিরন্তন নিয়ম। একজন নিজেকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সামাজিক মতামতের সহিত খাপ খাওয়াইয়া সর্বকল্যাণপ্রদ সমাজের নিকট হইতে সর্ববিধ সুখসম্পদ পায়; অপর ব্যক্তি একাকী থাকিয়া সমাজকে তাঁহার দিকে টানিয়া লন।
সমাজের সঙ্গে যে নিজেকে খাপ খাওয়াইয়া চলে, তাহার পথ কুসুমাস্তীর্ণ, আর যে তাহা করে না, তাহার পথ কণ্টকাকীর্ণ। কিন্তু লোকমতের উপাসকেরা পলকেই বিনাশপ্রাপ্ত হয়; আর সত্যের তনয়গণ চিরজীবী।
আমি সত্যকে একটা অনন্তশক্তিসম্পন্ন জারক (corrosive) পদার্থের সহিত তুলনা করি; উহা যেখানে পড়ে, সেখানেই ক্ষয় করিতে করিতে নিজের পথ করিয়া লয়—নরম জিনিষে শীঘ্র, শক্ত গ্র্যানাইট পাথরে বিলম্বে; কিন্তু পথ করিয়া লইবেই। যল্লিখিতং তল্লিখিতম্। ভগিনী, আমি যে প্রত্যেকটি ঘোর মিথ্যার সহিত মিষ্টবাক্যে আপস করিতে পারি না, সেজন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু আমি তাহা পারি না। সারাজীবন এজন্য ভুগিয়াছি, তবু তাহা করিতে পারি না। আমি বারবার চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু পারি নাই। ঈশ্বর মহিমময়, তিনি আমাকে মিথ্যাচারী হইতে দিবেন না। অবশেষে উহা ছাড়িয়া দিয়াছি। এক্ষণে যাহা ভিতরে আছে, তাহাই ফুটিয়া উঠুক। আমি এমন কোন পথ পাই নাই, যাহা সকলকে খুশী করিবে; সুতরাং আমি স্বরূপতঃ যাহা, তাহাই আমাকে থাকিতে হইবে—আমায় নিজ অন্তরাত্মার নিকট খাঁটি থাকিতে হইবে। ‘যৌবন ও সৌন্দর্য নশ্বর, জীবন ও ধনসম্পত্তি নশ্বর, নাম-যশও নশ্বর, এমন কি পর্বতও চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া ধূলিকণায় পরিণত হয়; বন্ধুত্ব ও প্রেম ক্ষণস্থায়ী, একমাত্র সত্যই চিরস্থায়ী।’ হে সত্যরূপী ঈশ্বর, তুমিই আমার একমাত্র পথপ্রদর্শক হও। আমার যথেষ্ট বয়স হইয়াছে, এখন আর মিষ্ট মধু হওয়া চলে না। আমি যেমন আছি, যেন তেমনই থাকি। ‘হে সন্ন্যাসী, তুমি নির্ভয়ে দোকানদারি ত্যাগ করিয়া, শত্রু-মিত্র কাহাকেও গ্রাহ্য না করিয়া সত্যে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ থাক।’ এই মুহূর্ত হইতে আমি ইহামুত্রফলভোগবিরাগী হইলাম—‘ইহলোক এবং পরলোকের যাবতীয় অসার ভোগনিচয়কে পরিত্যাগ কর।’ হে সত্য, একমাত্র তুমিই আমার পথপ্রদর্শক হও। আমার ধনের কামনা নাই, নাম-যশের কামনা নাই, ভোগের কামনা নাই। ভগিনী, এ সকল আমার নিকট অতি তুচ্ছ। আমি আমার ভ্রাতৃগণকে সাহায্য করিতে চাহিয়াছিলাম। কিরূপে সহজে অর্থোপার্জন হয়, সে কৌশল আমার জানা নাই—ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমার হৃদয়স্থিত সত্যের বাণী না শুনিয়া আমি কেন বাহিরের লোকদের খেয়াল অনুসারে চলিতে যাইব? ভগিনী, আমার মন এখনও দুর্বল, বাহ্য জগতের সাহায্য আসিলে সময়ে সময়ে অভ্যাসবশতঃ উহা আঁকড়াইয়া ধরি। কিন্তু আমি ভীত নহি। ভয়ই সর্বাপেক্ষা গুরুতর পাপ—ইহাই আমার ধর্মের শিক্ষা।
প্রেসবিটেরিয়ান যাজকমহাশয়ের সহিত আমার যে শেষ বাগ্যুদ্ধ এবং তৎপরে মিসেস বুলের সহিত যে দীর্ঘ তর্ক হয়, তাহা হইতে আমি স্পষ্ট বুঝিয়াছি, মনু কেন সন্ন্যাসিগণকে উপদেশ দিয়াছেনঃ একাকী থাকিবে, একাকী বিচরণ করিবে। বন্ধুত্ব বা ভালবাসামাত্রই সীমাবদ্ধতা; বন্ধুত্বে—বিশেষতঃ মেয়েদের বন্ধুত্বে চিরকালই ‘দেহি দেহি’ ভাব। হে মহাপুরুষগণ, তোমরাই ঠিক বলিয়াছ। যাহাকে কোন ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করিতে হয়, সে সত্য-স্বরূপ ঈশ্বরের সেবা করিতে পারে না। হৃদয়, শান্ত হও, নিঃসঙ্গ হও, তাহা হইলেই অনুভব করিবে—প্রভু তোমার সঙ্গে সঙ্গে আছেন। জীবন কিছুই নহে, মৃত্যুও ভ্রমমাত্র! এইসব কিছুই নয়, একমাত্র ঈশ্বরই আছেন। হৃদয়, ভয় পাইও না, নিঃসঙ্গ হও। ভগিনী, পথ দীর্ঘ, সময় অল্প, সন্ধ্যাও ঘনাইয়া আসিতেছে। আমাকে শীঘ্র ঘরে ফিরিতে হইবে। আদবকায়দার শিক্ষা সম্পূর্ণ করিবার সময় আমার নাই। আমি যে বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছি, তাহাই বলিয়া উঠিতে পারিতেছি না। তুমি সৎস্বভাবা, পরম দয়াবতী। আমি তোমার জন্য সব করিব; কিন্তু রাগ করিও না, আমি তোমাদের সকলকে শিশুর মত দেখি।
আর স্বপ্ন দেখিও না। হৃদয়, আর স্বপ্ন দেখিও না। এক কথায় জগৎকে আমার নূতন কিছু দিবার আছে। মানুষের মন যোগানর সময় আমার নাই, উহা করিতে গেলেই আমি ভণ্ড হইয়া পড়িব। বরং সহস্রবার মৃত্যু বরণ করিব, তবুও [মেরুদণ্ডহীন] জেলি মাছের মত জীপনযাপন করিয়া নির্বোধ মানুষের চাহিদা মিটাইতে পারিব না—তা আমার স্বদেশেই হোক অথবা বিদেশেই হউক। তুমিও যদি মিসেস বুলের মত ভাবিয়া থাক, আমার কোন বিশেষ কার্য আছে, তাহা হইলে ভুল বুঝিয়াছ, সম্পূর্ণ ভুল বুঝিয়াছ। এ জগতে বা অন্য কোন জগতে আমার কোনই কার্য নাই। আমার কিছু বলিবার আছে, উহা আমি নিজের ভাবে বলিব, হিন্দুভাবেও নয়, খ্রীষ্টানভাবেও নয়, বা অন্য কোনভাবেও নয়; আমি উহাদিগকে শুধু নিজের ভাবে রূপ দিব—এইমাত্র। মুক্তিই আমার একমাত্র ধর্ম, আর যাহা কিছু উহাকে বাধা দিতে চাহে, তাহা আমি পরিহার করিয়া চলিব—তাহার সহিত সংগ্রাম করিয়াই হউক বা তাহা হইতে পলায়ন করিয়াই হউক। কী! আমি যাজককুলের মনস্তুষ্টি করিতে চেষ্টা করিব!! ভগিনী, আমার এ-কথা ভুল বুঝিয়া তুমি ক্ষুণ্ণ হইও না। তোমরা শিশুমাত্র, আর শিশুদের অপরের অধীনে থাকিয়া শিক্ষা করাই কর্তব্য। তোমরা এখনও সেই উৎসবের আস্বাদ পাও নাই, যাহা ‘যুক্তিকে অযুক্তিতে পরিণত করে, মর্ত্যকে অমর করে, এই জগৎকে শূন্যে পর্যবসিত করে এবং মানুষকে দেবতা করিয়া তোলে।’ শক্তি থাকে তো লোকে যাহাকে ‘এই জগৎ’ নামে অভিহিত করে, সেই মূর্খতার জাল হইতে বাহির হইয়া আইস। তখন আমি তোমায় প্রকৃত সাহসী ও মুক্ত বলিব। যাহারা এই আভিজাত্যরূপ মিথ্যা ঈশ্বরকে চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া তাহার চরম কপটতাকে পদদলিত করিতে সাহস করে, তাহাদিগকে যদি তুমি উৎসাহ দিতে না পার, তবে চুপ করিয়া থাক; কিন্তু আপস ও মনস্তুষ্টিকরারূপ মিথ্যা মূর্খতা দ্বারা তাহাদিগকে পুনরায় পঙ্কে টানিয়া আনিবার চেষ্টা করিও না।
আমি এই জগৎকে ঘৃণা করি—এই স্বপ্নকে, এই উৎকট দুঃস্বপ্নকে, তাহার গীর্জা ও প্রবঞ্চনাসমূহকে, তাহার শাস্ত্র ও বদমাশিগুলিকে, তাহার সুন্দর মুখ ও কপট হৃদয়কে, তাহার ধর্মধ্বজিতার আস্ফালন ও অন্তঃসারশূন্যতাকে—সর্বোপরি ধর্মের নামে তাহার দোকানদারিকে আমি ঘৃণা করি। কী! সংসারের ক্রীতদাসেরা কি বলিতেছে, তাহা দ্বারা আমার হৃদয়ের বিচার করিবে! ছিঃ! ভগিনী, তুমি সন্ন্যাসীকে চেনো না। বেদ বলেন, সন্ন্যাসী বেদশীর্ষ, কারণ তিনি গীর্জা, ধর্মমত, ঋষি (prophet), শাস্ত্র প্রভৃতি ব্যাপারের ধার ধারেন না। মিশনরীই হউক বা আপর কেহই হউক, তাহারা যথাসাধ্য চীৎকার ও আক্রমণ করুক, আমি তাহাদিগকে গ্রাহ্য করি না। ভর্তৃহরির ভাষায়ঃ৫৪ ইনি কি চণ্ডাল, অথবা ব্রাহ্মণ, অথবা শূদ্র, অথবা তপস্বী, অথবা তত্ত্ববিচারে পণ্ডিত কোন যোগীশ্বর?—এইরূপে নানা জনে নানা আলোচনা করিতে থাকিলেও যোগিগণ রুষ্টও হন না, তুষ্টও হন না; তাঁহারা আপন মনে চলিয়া যান। তুলসীদাসও বলিয়াছেনঃ
হাতী চলে বাজারমে কুত্তা ভোঁকে হাজার
সাধুওঁকা দুর্ভাব নহী জব্ নিন্দে সংসার।
যখন হাতী বাজারের মধ্য দিয়া চলিয়া যায়, তখন হাজার কুকুর পিছু পিছু চীৎকার করিতে আরম্ভ করে, কিন্তু হাতী ফিরিয়াও চাহে না। সেরূপ যখন সংসারী লোকেরা নিন্দা করিতে থাকে, তখন সাধুগণ তাহাতে বিচলিত হন না।
আমি ল্যাণ্ডসবার্গের (Landsberg) বাটীতে অবস্থান করিতেছি। ইনি সাহসী ও মহৎ ব্যক্তি। প্রভু তাঁহাকে আশীর্বাদ করুন। কখনও কখনও আমি গার্নসিদের (Guernseys) ওখানে শয়ন করিতে যাই। ঈশ্বর তোমাদের সকলকে চিরকালের জন্য কৃপা করুন। তিনি তোমাদিগকে শীঘ্র এই জগৎ নামক বিরাট ধাপ্পাবাজি হইতে উদ্ধার করুন। তোমরা যেন কদাপি এই জগৎরূপ জরাজীর্ণ ডাইনীর কুহকে না পড়! শঙ্কর তোমাদিগের সহায় হউন! উমা তোমাদিগের সমক্ষে সত্যের দ্বার উদ্ঘাটিত করিয়া দিন এবং তোমাদের সকল মোহ অপসারিত করুন! স্নেহাশীর্বাদসহ
তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৬৪
[শ্রীযুক্ত বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালকে লিখিত]
54W. 33rd St., নিউ ইয়র্ক
৯ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় সান্যাল,
তোমার এক পত্র পাইলাম, তাহাতে টাকা পৌঁছিবার সংবাদ লিখিয়াছ; কিন্তু বোষ্টন হইতে কয়েকটি বন্ধু যে টাকা পাঠান, তাহার সংবাদ এখনও পাই নাই—বোধ হয় দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে পাইব। গোপালদাদা কাশী হইতে এক পত্র লেখে। জমির বিষয় যাহা লিখিয়াছ, তাহা কিছুই নহে। পরঞ্চ রাখাল এক পত্রে জমির বিষয় লিখিতেছেন, তাহাও কিছু বিশেষ নহে। দুটো ঘরওয়ালা যে জমির বিষয় লিখিয়াছ, তাহাতে আমার আপত্তি আছে—অর্থাৎ ঘরের জন্য জমিটার কমি না হয়। জমিটা যাহাতে বড় হয়, তাহার চেষ্টা করিবে। তোমাদের ঐ যে গোঁড়ামি, তাহাতে তোমাদের নিয়ে যে কিছু করা—তা আমার দ্বারা হবে না। পরমহংসদেব আমার গুরু ছিলেন; আমি তাঁকে যাই ভাবি, দুনিয়া তা ভাববে কেন? গুরুপূজার ভাব বাঙলাদেশ ছাড়া অন্যত্র আর নাই—তথাপি অন্য লোকে সে ভাব লইবার জন্য প্রস্তুত নহে। তোমাদের ভেতর একটা মস্ত মূর্খতা আছে যে, তোমরা একটা কি! বলি কলিকাতার দশ ক্রোশ তফাতে—না তোমাদের কেউ জানে, না তোমাদের গুরুকে কেউ জানে। আর তোমরা সেই ‘পরমহংসদেব অবতার’ নিয়ে ছেঁড়াছিঁড়ি। ফল—আমি শশী প্রভৃতিকে কিঞ্চিৎ বোঝাবার চেষ্টা করে দেখলাম যে, সে চেষ্টা নিষ্ফল। অতএব তাদের দিল্লীর লাড়ু দিয়ে সরে পড়াই ভাল।
মা-ঠাকুরাণীর জন্য জমি কিনে দিলে আমি আপনাকে ঋণমুক্ত মনে করব। তারপর আমি আর কিছু বুঝিসুঝি না। তোমরা তো আমার নামটি টেনে নেবার বেলা খুব তৈয়ার—যে আমি তোমাদেরই একজন। কিন্তু আমি একটা কাজ করতে বললে অমনি পেছিয়ে পড়, ‘মতলবকী গরজী জগ্ সারো’—এ জগৎ মতলবের গরজী।
আমি বাঙলাদেশ জানি, ইণ্ডিয়া জানি—লম্বা কথা কইবার একজন, কাজের বেলায়—০ (শূন্য)।
আমি এখানে জমিদারীও কিনি নাই, বা ব্যাঙ্কে লাখ টাকাও জমা নাই। এই ঘোর শীতে পর্বত-পাহাড়ে বরফ ঠেলে—এই ঘোর শীতে রাত্তির দুটো-একটা পর্যন্ত রাস্তা ঠেলে লেকচার করে দু-চার হাজার টাকা করেছি—মা-ঠাকুরাণীর জন্য জায়গা কিনলেই আমি নিশ্চিন্ত। গুঁতোগুঁতির আড্ডা করে দেবার শক্তি আমার নাই। অবতারের বাচ্চারা কোথায়—ছোট ছোট অবতারেরা—ওহে অবতারের পিলেগণ?
অলমিতি। তোমাদের হতে আমার কোন আশা নাই। তোমরাও আমার কোন আশা করো না। যে যার আপনার পথে চলে যাও। শুভমস্তু। এ দুনিয়া এই রকম মতলব-ভরা!
চিঠিপত্র উপরোক্ত ঠিকানায় লিখবে এখন হতে। এই ঠিকানা এখন হতে—আমার নিজের আড্ডা। যদি পার একখানা ‘যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ’—English translation (ইংরেজী অনুবাদ) পাঠাবে। মহিনকে দাম দিতে বলবে। ইতি
পূর্বে যে বইয়ের কথা লিখেছি অর্থাৎ সংস্কৃত নারদ-ও শাণ্ডিল্য-সূত্র, তাহা ভুলো না। ইতি
‘আশা হি পরমং দুঃখং নৈরাশ্যং পরমং সুখম্।’ ইতি
নরেন্দ্র
…………………………..
১৬৫*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
228W. 39th st., নিউ ইয়র্ক
১০ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
এখনও আমার পত্র পাওনি জেনে বিস্মিত হলাম। তোমার পত্র পাবার ঠিক পরেই আমি তোমাকে লিখি এবং নিউ ইয়র্কে দেওয়া আমার তিনটি বক্তৃতা-সংক্রান্ত কয়েকখানি পুস্তিকা পাঠাই। রবিবাসরীয় ও সাধারণে প্রদত্ত এই ভাষণগুলি সঙ্কেতলিপিতে লিখিত হয়ে পরে মুদ্রিত হয়েছে। এইরূপ তিনটি বক্তৃতা দুখানি পুস্তিকায় মুদ্রিত হয়, তারই কয়েকখানি তোমাকে পাঠাই। নিউ ইয়র্কে আরও দুই সপ্তাহ আছি। অতঃপর ডেট্রয়েট। তারপরে বোষ্টনে সপ্তাহখানেক বা সপ্তাহ দুই।
এ বৎসর অবিরাম কাজের ফলে আমি ভগ্নস্বাস্থ্য। স্নায়ুই বিশেষভাবে আক্রান্ত। সারা শীতে এক রাত্রিও সুনিদ্রা হয়নি। দেখছি—অতিরিক্ত খাটুনি হয়ে যাচ্ছে। আবার সামনে ইংলণ্ডে মস্ত কাজ।
কাজগুলো করতে হবে। তারপর ভারতে ফিরে গিয়ে বাকী জীবন বিশ্রাম! ভগবানের উদ্দেশে কর্মের ফল সমর্পণ করে আমি জগতের কল্যাণের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। এখন বিশ্রামই আমার অভীপ্সিত। আশা করি কিছু অবসর পাব ও ভারতীয়গণ আমাকে নিষ্কৃতি দেবে।
হায়! যদি কয় বছরের জন্য আমি নির্বাক হতে পারতাম এবং আমাকে মোটেই কথা বলতে না হত! বস্তুতঃ এ-সব পার্থিব দ্বন্দ্বের জন্য আমি জন্মাইনি। আমি স্বভাবতই কল্পনাপ্রবণ ও কর্মবিমুখ। আদর্শবাদী হয়েই আমি জন্মেছি এবং স্বপ্নরাজ্যেই আমি বাস করতে পারি। জাগতিক বিষয়সমূহ আমাকে উত্ত্যক্ত করে তোলে এবং আমার দুঃখের কারণ হয়ে থাকে। কিন্তু প্রভুর ইচ্ছাই পূর্ণ হবে।
তোমরা ভগিনী চারজন আমাকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছ। এ দেশে আমার যা কিছু, তার মূলে তোমরা। তোমরা চিরসুখী ও সৌভাগ্যশালিনী হও। যেখানেই থাকি, গভীর কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ভালবাসা সহ সর্বদাই তোমাদের মনে রাখব। সারা জীবন স্বপ্নের ধারার মত। স্বপ্নের মধ্যে দ্রষ্টার মত থাকাই আমার আকাঙ্ক্ষা। ব্যস্। সকলের প্রতি—ভগিনী জোসেফাইনের প্রতি আমার শুভেচ্ছা। ইতি
তোমার চিরস্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৬৬*
54 W 33rd St., নিউ ইয়র্ক
১৪ ফেব্রুআরী,১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
… জননীর ন্যায় আপনার সৎপরামর্শের জন্য আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। আশা করি জীবনে তদনুযায়ী কাজ করতে পারব।
আমি যে বইগুলির কথা আপনাকে লিখেছিলাম, সেগুলি আপনার বিভিন্ন ধর্মের পুস্তক-সম্বলিত গ্রন্থাগারের জন্য। আর আপনারই যখন কোথায় থাকা হবে-না-হবে ঠিক নেই, তখন ওগুলির আর এখন প্রয়োজন নেই। আমার গুরুভাইদেরও প্রয়োজন নেই, কারণ তাঁরা ভারতে ওগুলি পেতে পারেন; আর আমাকেও যখন সর্বদা ঘুরতে হচ্ছে, তখন আমার পক্ষেও সেগুলি সর্বত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনার এই দানের প্রস্তাবের জন্য আপনাকে বহু ধন্যবাদ।
আপনি আমার ও আমার কাজের জন্য ইতোমধ্যেই যা করেছেন, সেজন্য আপনাকে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ যে কি করে করব, তা বলতে পারি না। এই বৎসরও কিছু সাহায্যের প্রস্তাবের জন্য আমার অসংখ্য ধন্যবাদ জানবেন।
তবে আমার অকপট বিশ্বাস এই যে, এ বৎসর আপনার সমুদয় সাহায্য মিস ফার্মারের গ্রীনএকারের কার্যে দেওয়া উচিত। ভারত এখন অপেক্ষা করে বসে থাকতে পারে—শত শতাব্দী ধরে তো অপেক্ষা করছেই। আর হাতের কাছে করবার যে কাজটা রয়েছে, সেটার দিকে সর্বদাই আগে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
আর এক কথা, মনুর মতে—সন্ন্যাসীর পক্ষে একটা সৎকার্যের জন্যও অর্থ সংগ্রহ করা ভাল নয়। আমি এখন বেশ প্রাণে প্রাণে বুঝেছি যে, প্রাচীন ঋষিরা যা বলে গেছেন, তা অতি ঠিক কথাঃ ‘আশা হি পরমং দুঃখং নৈরাশ্যং পরমং সুখম্’—আশাই পরম দুঃখ এবং ত্যাগ করাতেই পরম সুখ। এই যে আমার ‘এ করব, ও করব’, এ রকম ছেলেমানুষি ভাব ছিল, এখন সেগুলিকে সম্পূর্ণ ভ্রম বলে বোধ হচ্ছে। আমার এখন ঐ-সকল বাসনা ত্যাগ হয়ে আসছে। ‘সব বাসনা ত্যাগ করে সুখী হও। কেউ যেন তোমার শত্রু বা মিত্র না থাকে, তুমি একাকী বাস কর। এইরূপে ভগবানের নাম প্রচার করতে করতে শত্রুমিত্রে সমদৃষ্টি হয়ে, সুখদুঃখের অতীত হয়ে, বাসনা ঈর্ষা ত্যাগ করে কোন প্রাণীকে হিংসা না করে, কোন প্রাণীর কোন প্রকার অনিষ্ট বা উদ্বেগের কারণ না হয়ে, আমরা পাহাড়ে পাহাড়ে গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ করে বেড়াব।’
‘ধনী দরিদ্র, উচ্চ নীচ, কারও কাছ থেকে কিছু সাহায্য চেও না—কিছুরই আকাঙ্ক্ষা করো না। এই যে সব দৃশ্য একের পর এক দৃষ্টির সামনে থেকে অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে, সেগুলিকে সাক্ষিরূপে দেখ—সেগুলি সব চলে যাক।’
হয়তো এই দেশে আমাকে টেনে নিয়ে আসবার জন্য ঐসব ভাবোন্মত্ত বাসনার প্রয়োজন ছিল। এই অভিজ্ঞতা লাভ করবার জন্য প্রভুকে ধন্যবাদ দিচ্ছি।
এখন বেশ সুখে আছি। আমি আর মিঃ ল্যাণ্ডসবার্গ মিলে কিছু চাল ডাল বা যব রাঁধি—চুপচাপ খাই, তারপর হয়তো কিছু লিখলাম বা পড়লাম, উপদেশপ্রার্থী গরীব লোকদের কেউ দেখা করতে এলে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। আর এইভাবে থেকে বোধ হচ্ছে, আমি যেন বেশ সন্ন্যাসীর মত জীবনযাপন করছি—আমেরিকায় এসে অবধি এতদিন এ রকম অনুভব করিনি।
‘ধন থাকলে দারিদ্র্যের ভয়, জ্ঞানে অজ্ঞানের ভয়, রূপে বার্ধক্যের ভয়, যশে নিন্দুকের ভয়, অভ্যুদয়ে ঈর্ষার ভয়, এমন কি দেহে মৃত্যুর ভয় আছে। এই জগতের সমুদয়ই ভয়যুক্ত। তিনিই কেবল নির্ভীক, যিনি সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন।’৫৫
আমি সেদিন মিস কর্বিনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম—মিস ফার্মার ও মিস থার্সবিও তথায় ছিলেন। আধঘণ্টা ধরে আমাদের বেশ আনন্দে কাটল। মিস কর্বিনের ইচ্ছা—আগামী রবিবার থেকে তাঁর বাড়ীতে কোন রকম ক্লাস খুলি। আমি আর এখন এ-সবের জন্য ব্যস্ত নই। আপনা-আপনি যদি এসে পড়ে, তবে তাতে প্রভুরই জয়জয়কার। আর যদি না আসে, তাহলে প্রভুর আরও জয়জয়কার।
পুনরায় আমার চিরকৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
আপনার অনুগত সন্তান
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৬৭*
[ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
54 West 33rd St., নিউ ইয়র্ক
২৫ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
তোমার অসুখ হয়েছিল জেনে আমি দুঃখিত। তোমাকে একটি চিকিৎসা৬৫ বলে দিচ্ছি, যদিও তোমার স্বীকৃতি আমার মনের অর্ধেক বল হরণ করে নিয়েছে। তুমি যে এর থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছ, তা ভালই হয়েছে। যার শেষ ভাল, তার সব ভাল।
বইগুলি বেশ ভাল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে এবং সেগুলির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
তোমার সদা স্নেহবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৬৮*
19 W. 38 St., নিউ ইয়র্ক
১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
… তথাকথিত সমাজসংস্কার নিয়ে মাথা ঘামিও না, কারণ গোড়ায় আধ্যাত্মিক সংস্কার না হলে কোনপ্রকার সংস্কারই হতে পারে না। … তাঁর কথা প্রচার করে যাও, সামাজিক কুসংস্কার এবং গলদ সম্বন্ধে ভালমন্দ কিছু বলো না। হতাশ হয়ো না, গুরুর উপর বিশ্বাস হারিও না, ভগবানের উপর বিশ্বাস হারিও না—হে বৎস, যতক্ষণ তোমার এই তিনটি জিনিষ আছে, কিছুই তোমার অনিষ্ট করতে পারবে না। আমি দিন দিন সবল হয়ে উঠছি। হে সাহসী বালকগণ, কাজ করে যাও।
সাশীর্বাদ
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৬৯*
আমেরিকা
৬ মার্চ, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি দীর্ঘকাল নীরব থাকার দরুন তুমি হয়তো কত কি ভাবছ। কিন্তু হে বৎস! আমার বিশেষ কিছু লেখবার ছিল না; খবরের মধ্যে সেই পুরাতন কথা—কেবল কাজ, কাজ, কাজ।
তুমি ল্যাণ্ডসবার্গ ও ডাঃ ডের নিকট যে পত্র লিখেছ, তার দুখানাই আমি দেখেছি—সুন্দর লেখা হয়েছে। আমি যে কোনরূপে এখনি ভারতে ফিরে যেতে পারব, তা তো বোধ হয় না। এক মুহূর্তের জন্যও ভেবো না যে, ইয়াঙ্কিরা ধর্মকে কাজে পরিণত করবার এতটুকু মাত্র চেষ্টা করে। এ বিষয়ে কেবল হিন্দুরই—কথা ও আচরণের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে। ইয়াঙ্কিরা টাকা রোজগারে খুব কৃতকর্মা। আমি এখান থেকে চলে গেলেই যা কিছু একটু ধর্মভাব জেগেছে, সবটাই উড়ে যাবে। সুতরাং চলে যাবার আগে কাজের ভিত্তিটা পাকা করে যেতে চাই। সব কাজই আধাআধি না করে সম্পূর্ণ করা উচিত।
‘—’ আয়ারকে একখানা পত্র লিখেছিলাম; তাতে যা লিখেছি, তোমরা সেইসব বিষয়ে কি করছ?
রামকৃষ্ণের নাম প্রচার করবার জন্য জেদ করো না। আগে তাঁর ভাব প্রচার কর—যদিও আমি জানি, জগৎ চিরকালই আগে মানুষটিকে মানে, তারপর তার ভাবটি নেয়। কিডি ছেড়ে দিয়েছে; বেশ তো, সে একবার সবদিক চেখে চেখে দেখুক, যা খুশী তাই প্রচার করুক না, কেবল গোঁড়ামি করে যেন অপরের ভাবের ওপর আক্রমণ না করে। তুমি ওখানে তোমার নিজের ক্ষুদ্র শক্তিতে যতটা পার, করবার চেষ্টা কর, আমিও এখানে একটু আধটু সামান্য কাজ করবার চেষ্টা করছি। কিসে ভাল হবে, তা প্রভুই জানেন। আমি তোমাকে যে বইগুলির কথা লিখেছিলাম, সেগুলি পাঠিয়ে দিতে পার? গোড়াতেই একেবারে বড় বড় পরিকল্পনা খাড়া করো না, ধীরে ধীরে আরম্ভ কর। যে মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছ, সেটা কত শক্ত, তা বুঝে অগ্রসর হও, ক্রমে ওপরে ওঠবার চেষ্টা কর।
হে সাহসী বালকগণ! কাজ করে যাও—একদিন না একদিন আমরা আলো দেখতে পাবই পাব।
জি.জি., কিডি, ডাক্তার এবং আর আর বীরহৃদয় মান্দ্রাজী যুবকদের আমার বিশেষ ভালবাসা জানাবে।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
পুঃ—যদি সুবিধা হয়, কতকগুলি কুশাসন পাঠাবে।
পুঃ—যদি লোকে পছন্দ না করে, তবে সমিতির ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ নামটা বদলে আর যা খুশী করে দাও না কেন?
সকলের সঙ্গে মিলেমিশে শান্তিতে থাকতে হবে—ল্যাণ্ডসবার্গের সঙ্গে চিঠিপত্র আদান-প্রদান কর। এইরূপে কাজটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকুক। রোমনগর একদিনে নির্মিত হয়নি। মহীশূরের মহারাজার দেহত্যাগ হল; তিনি আমাদের বিশেষ আশার স্থল ছিলেন। যাই হোক, প্রভুই মহান্—তিনিই অপরাপর ব্যক্তিকে আমাদের মহৎ কার্যে সাহায্য করবার জন্য পাঠাবেন।
ইতি—
বি
…………………………..
১৭০*
54 W. 33rd St., নিউ ইয়র্ক
২১ মার্চ, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
আমি যথাসময়ে আপনার কৃপালিপি পেলাম এবং তাতে আপনার এবং মিস থার্সবি ও মিসেস এডামস্ সম্বন্ধে খবরাখবর পেয়ে বিশেষ সুখী হলাম।
আপনার সঙ্গে মিসেস ও মিস হেলের দেখা হয়েছে শুনে খুব সুখী হলাম, চিকাগোয় আমার যে কয়জন বিশিষ্ট বন্ধু আছেন, তন্মধ্যে তাঁরা অন্যতম।
রমাবাঈ-এর দল আমার বিরুদ্ধে যে-সকল নিন্দা প্রচার করছে, তা শুনে আমি আশ্চর্য হলাম। মিসেস বুল! আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না যে, মানুষ যেরূপই চলুক না কেন, এমন কতকগুলি লোক চিরকালই থাকবে যারা তার সম্বন্ধে ঘোরতর মিথ্যা রচনা করে প্রচার করবেই। চিকাগোতে তো আমার বিরুদ্ধে এরূপ কিছু না কিছু লেগে থাকত।
আমাদের বাড়ীটার নীচ তলায় অর্থের বিনিময়ে কয়েকটি বক্তৃতা দেবার সঙ্কল্প করছি। ঐ ঘরে প্রায় ১০০ লোকের জায়গা হবে, এতেই খরচা উঠে যাবে। ভারতবর্ষে টাকা পাঠাবার জন্য বিশেষ ব্যস্ত নই, সেজন্য অপেক্ষা করব।
মিস ফার্মার কি আপনার সঙ্গে আছেন? মিসেস পিক কি চিকাগোয় আছেন? আপনার সঙ্গে কি জোসেফাইন লকের দেখা হয়েছে?
মিস হ্যামলিন আমার প্রতি খুব দয়া প্রকাশ করছেন, আমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করছেন।
আমার গুরুদেব বলতেন, হিন্দু খ্রীষ্টান প্রভৃতি বিভিন্ন নাম—মানুষে মানুষে পরস্পর ভ্রাতৃভাবের বিশেষ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। আগে আমাদিগকে ঐগুলি ভেঙে ফেলবার চেষ্টা করতে হবে। এগুলি পরের মঙ্গল করবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, এখন কেবল অশুভ প্রভাব বিস্তার করছে। এগুলির কুৎসিত কুহকে পড়ে আমাদের মধ্যে যাঁরা সেরা, তাঁরাও অসুরবৎ ব্যবহার করে থাকেন। এখন আমাদিগকে ঐগুলি ভাঙবার জন্য কঠোর চেষ্টা করতে হবে এবং আমরা এ বিষয়ে নিশ্চয়ই কৃতকার্য হব।
তাই তো একটা কেন্দ্র স্থাপন করবার জন্য আমার এতটা আগ্রহ। সঙ্ঘের অনেক দোষ আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তা ছাড়া কিছু হবারও যো নেই। এখানেই ভয়, আপনার সঙ্গে আমার মতভেদ হবে। সেই বিষয়টি এই যে, কেউ সমাজকেও সন্তুষ্ট করবে, অথচ বড় বড় কাজ করবে—তা হতে পারে না।
ভিতর থেকে যেরূপ প্রেরণা আসে, সেভাবে কাজ করা উচিত, আর যদি সেই কাজটা ঠিক ঠিক এবং ভাল হয়, তবে হয়তো মরে যাবার শত শত শতাব্দী পরে সমাজকে নিশ্চয়ই তাঁর দিকে ঘুরে আসতেই হবে। দেহ-মন-প্রাণ দিয়ে সর্বান্তঃকরণে আমাদের কাজে লেগে যেতে হবে। একটা ভাবের জন্য যতদিন পর্যন্ত না আমরা আর যা কিছু সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত হচ্ছি, ততদিন আমরা কোন কালে আলো দেখতে পাব না।
যাঁরা মানবজাতির কোনপ্রকার সাহায্য করতে চান, তাঁদের এ-সকল সুখ-দুঃখ, নাম- যশ, আর যত প্রকার স্বার্থ আছে, সেগুলি একটা পোঁটলা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দিতে হবে এবং ভগবানের কাছে আসতে হবে। সকল আচার্যই এই কথা বলে গেছেন ও করে গেছেন।
আমি গত শনিবার মিস কর্বিনের কাছে গিয়েছিলাম, আর তাঁকে বলে এসেছি যে, আর ওখানে ক্লাস করতে যেতে পারব না। জগতের ইতিহাসে কি কখনও এরূপ দেখা গেছে যে, ধনীদের দ্বারা কোন বড় কাজ হয়েছে? হৃদয় ও মস্তিষ্ক দ্বারাই চিরকাল যা কিছু বড় কাজ হয়েছে—টাকার দ্বারা নয়। আমার ভাব ও জীবন সবই উৎসর্গ করেছি; ভগবান্ আমার সহায়, আর কারও সাহায্য চাই না। ইহাই সিদ্ধির একমাত্র রহস্য—এ বিষয়ে নিশ্চয়ই আপনি আমার সঙ্গে একমত।
আপনারই চিরকৃতজ্ঞ ও স্নেহের সন্তান
বিবেকানন্দ
পুঃ—মিস ফার্মার ও মিসেস এডামস্কে আমার ভালবাসা জানাবেন।
বি
…………………………..
১৭১*
[ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
54 W. 33 St. N.Y.
২৭ মার্চ, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
তোমার চিঠিখানা পেয়ে এত আনন্দ হয়েছে যে, তা প্রকাশ করা যায় না। আমিও অনায়াসে চিঠিখানা আগাগোড়া পড়তে পেরেছি। অবশেষে কমলারঙ ঠাওরিয়ে সেই রঙের একটা জামা পেয়েছি, কিন্তু গরমের দিনে ব্যবহারের উপযোগী কোন জামা এ-পর্যন্ত পাইনি। যদি পাও, আমাকে অনুগ্রহ করে জানিও। এখানে নিউ ইয়র্কে তৈরী করে নেব। তোমার সেই অদ্ভুত ডিয়ারবর্ণ এভিনিউ-এর অযোগ্য দর্জি সাধু-সন্ন্যাসীর জামাও প্রস্তুত করতে জানে না।
ভগিনী লক্ এক লম্বা চিঠি লিখেছে এবং হয়তো উত্তরের দেরী দেখে আশ্চর্য হয়েছে। উৎসাহে সে অভিভূত হয়ে যায়; তাই আমি অপেক্ষা করছি এবং কি লিখব, জানি না। অনুগ্রহ করে তাকে বলবে—এই মুহূর্তে কোন স্থান নির্ধারণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মিসেস পীক সদাশয়া মহীয়সী ও অত্যন্ত ধর্মশীলা হলেও বৈষয়িক ব্যাপারে আমার মতই বুদ্ধিমান, তবে আমি দিনদিন বুদ্ধিমান হচ্ছি। ওয়াশিংটনে মিসেস পীকের জানা কে একজন তাকে গ্রীষ্মাবাসের জন্য একটি জায়গা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন।
কে জানে, সে প্রতারিত হবে কিনা? প্রতারণার এ এক অদ্ভুত দেশ; অন্যের ওপর সুবিধা নেওয়ার কোন-না-কোন গুপ্ত অভিসন্ধি আছে শতকরা নিরানব্বই জনের। যদি কেউ মুহূর্তের জন্য কেবল একটু চোখ বন্ধ করে, তবেই তার সর্বনাশ! ভগিনী জোসেফাইন অগ্নিশর্মা। মিসেস পীক সাদাসিধে ভাল মহিলা। এখানকার লোকেরা আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছে যে, কিছু করবার আগে কয়েক ঘণ্টা আমাকে চারিদিকে তাকাতে হয়। সবই ঠিক হয়ে যাবে। ভগিনী জোসেফাইনকে একটু ধৈর্য ধরতে বলো। একজন বৃদ্ধার সংসার চালানর চেয়ে প্রতিদিন কিণ্ডারগার্টেন তোমার নিশ্চই আরও ভাল লাগছে। মিসেস বুলকে দেখেছ; তাঁকে এত নিরীহ ও শান্ত দেখে তুমি নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়েছ। মিসেস এডামসের সঙ্গে মাঝে মাঝে তোমার দেখা হয় কি? তার উপদেশে মিসেস বুল খুব উপকৃত হয়েছে। আমিও কিছু উপদেশ গ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু কোন কাজে লাগল না; মিসেস এডামস্ যেমন চাইছে, তাতে সামনের ক্রমবর্ধমান বোঝা নোয়ান যায় না। হাঁটবার সময় যদি সামনে ঝুঁকবার চেষ্টা করি, তাহলে ভারকেন্দ্র পাকস্থলীর উপরিভাগে আসে; কাজেই পুরোভাগে ডিগবাজি খেয়ে চলি।
ক্রোরপতি কেউ আসছে না, ‘কয়েক-সহস্র’পতিও নয়! দুঃখিত, খুব দুঃখিত!!! কি করতে পারি—যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। আমার ক্লাসগুলি যে মহিলাতেই ভর্তি। … বেশ, ধৈর্য ধর। আমি চোখ মেলে রাখব, কখনও সুযোগ হারাব না। তুমি যদি কাকেও না পাও, অন্ততঃ আমার কুঁড়েমির জন্য তা নয়, জেনো।
সেই পুরাতন পথেই জীবন চলেছে। ক্রমাগত বক্তৃতা ও ধর্মপ্রসঙ্গ করে অনেক সময় বিরক্তি আসে, দিনের পর দিন চুপ করে থাকতে ইচ্ছা হয়।
তোমার স্বপ্ন শুভ হোক, কারণ সুখী হবার এটাই একমাত্র পথ।
সতত তোমার স্নেহের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৭২*
আমেরিকা
৪ এপ্রিল, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এইমাত্র তোমার পত্র পেলাম। কোন ব্যক্তি আমার অনিষ্ট করবার চেষ্টা করলে তুমি তাতে ভয় পেও না। যতদিন প্রভু আমাকে রক্ষা করবেন, ততদিন আমি অপরাজেয়। আমেরিকা সম্বন্ধে তোমার ধারণা বড় অস্পষ্ট। মিসেস হেল ছাড়া গোঁড়া খ্রীষ্টানদের সঙ্গে আমার কোন সম্বন্ধ নেই। তবে এখানে উদারভাব এবং চিন্তাও যথেষ্ট আছে। মিঃ লাণ্ড বা ঐ ধাঁজের গোঁড়ারা পালপার্বণে নিজের খরচায় এসে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নেচে কুঁদে ফিরে যায়। এ একটা প্রকাণ্ড দেশ, অধিকাংশ লোকই ধর্মের ধার ধারে না। শতকরা ৯৯.৯ জন লোক ঐ ধরনের। এদেশে খ্রীষ্টধর্ম দাঁড়িয়ে আছে শুধু একটা জাতীয়তাবোধকে অবলম্বন করে, তা ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রিয় বৎস! সাহস হারিও না। আমি আয়ারকে একখানি পত্র লিখেছিলাম, তোমাদের পত্রে তার কোন উল্লেখ না দেখে মনে হয়, তোমরা তার সম্বন্ধে কিছুই জান না; আর আমি তোমাদের নিকট যে কতকগুলি বই চেয়েছিলাম, সে সম্বন্ধেও তুমি কিছু লেখনি। যদি সব সম্প্রদায়ের ভাষ্যসহ বেদান্তসূত্র আমায় পাঠাতে পার তো ভাল হয়। সম্ভবতঃ সামান্না তোমায় এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারে। আমার জন্য একটুও ভয় পেও না। তিনি আমার হাত ধরে রয়েছেন। ভারতে ফিরে গিয়ে কি হবে? ভারত তো আমার ভাবরাশি-বিস্তারের সাহায্য করতে পারবে না। এই দেশ আমার ভাবে খুব আকৃষ্ট হচ্ছে। আমি যখন আদেশ পাব, তখন ফিরে যাব। ইতোমধ্যে তোমরা সকলে ধৈর্যের সঙ্গে ধীরে ধীরে কাজ করে যাও। যদি কেউ আমায় আক্রমণ করে কথা বলে, তাহলে তার অস্তিত্ব পর্যন্ত ভুলে যাও। যদি কেউ ভালমন্দ বলে, পার তো তাকে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ দিও, আর কাজ করে যাও। আমার ভাব হচ্ছে, তোমরা এমন একটা শিক্ষালয় স্থাপন কর, যেখানে ছাত্রগণকে ভাষ্যসমেত বেদবেদান্ত সব পড়ান যেতে পারে। উপস্থিত এইভাবে কাজ করে যাও। তাহলেই বোধ হয়, এক্ষণে মান্দ্রাজীদের কাছে খুব বেশী সহানুভূতি পাবে। এইটি জেনে রেখো যে, যখনই তুমি সাহস হারাও, তখনই তুমি শুধু নিজের অনিষ্ট করছ তা নয়, কাজেরও ক্ষতি করছ। অসীম বিশ্বাস ও ধৈর্যই সফলতালাভের একমাত্র উপায়।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
পুঃ—জি. জি., ডাক্তার, কিডি, বালাজী এবং আর সবাইকে আনন্দ করতে বলো—তারা যেন কারও বাজে কথা শুনে মনকে চঞ্চল না করে। তোমরা সকলে নিজেদের আদর্শ ধরে থাক, আর অন্য কিছুর প্রতি খেয়াল করো না—সত্যের জয় হবেই হবে। সর্বোপরি, তুমি যেন অপরকে চালাতে বা তাদের শাসন করতে, অথবা ইয়াঙ্কিরা যেমন বলে অপরের উপর ‘boss’ (মাতব্বরি) করতে যেও না; সকলের দাস হও।
—বি
…………………………..
১৭৩*
[মিঃ ফ্রান্সিস লেগেটকে লিখিত]
১০ এপ্রিল, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
আজ প্রাতে তোমার শেষ চিঠিখানা এবং রামানুজাচার্যের ভাষ্যের প্রথম ভাগ পেলাম। কয়েকদিন আগে তোমার আর একখানা পত্র পেয়েছিলাম। মণি আয়ারের কাছ থেকেও একখানা পত্র পেয়েছি।
আপনার (রিজলি) পল্লীগৃহে সহৃদয় আমন্ত্রণের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা অসম্ভব। আমি এখন একটু ভুলের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি এবং দেখছি আগামীকাল আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। আগামীকাল (40 W. 9th Street-এ) মিস এণ্ড্রুজ-এর গৃহে আমার একটা ক্লাস আছে। মিস ম্যাকলাউড আমাকে বলেছিলেন যে, ঐ ক্লাসটা স্থগিত রাখা সম্ভব, সেজন্য আমি কাল সানন্দে আপনাদের সঙ্গে যোগ দেবার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি যে, মিস ম্যাকলাউড ভুল করেছেন। মিস এণ্ড্রুজ আমাকে বলে গিয়েছেন যে, কোন উপায়ে কাল তিনি ক্লাস বন্ধ করতে পারেন না বা প্রায় ৫০/৬০ জন সভ্যকে বিজ্ঞপ্তিও দিতে পারেন না।
এই অবস্থায় আমি আমার অক্ষমতার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত এবং আশা করি মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস স্টার্জিস (Mrs. Sturgis) বুঝবেন যে, আমার অনিচ্ছা নয়, এই অনিবার্য পরিস্থিতিই আপনার সহৃদয় আমন্ত্রণ গ্রহণ না করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগামী পরশু অথবা এ সপ্তাহে আপনার সুবিধামত যে-কোন দিন যেতে পারলে খুব আনন্দিত হব।
আপনার চিরবিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৭৪
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
১১ এপ্রিল, ১৮৯৫
কল্যাণবরেষু,
… তুমি লিখিয়াছ যে তোমার অসুখ আরোগ্য হইয়াছে, কিন্তু তোমাকে এখন হইতে অতি সাবধান হইতে হইবে। পিত্তি পড়া বা অস্বাস্থ্যকর আহার বা পুতিগন্ধময় স্থানে বাস করিলে পুনশ্চ রোগে ভুগিবার সম্ভাবনা এবং ম্যালেরিয়ার হাত হইতে বাঁচা দুষ্কর। প্রথমতঃ একটা ছোটখাট বাগান বা বাটী ভাড়া লওয়া উচিত, ৩০।৪০ টাকার মধ্যে হইতে পারিবে। দ্বিতীয়তঃ খাবার এবং রান্নার জল যেন ফিল্টার করা হয়। বাঁশের ফিল্টার বড় রকম হইলেই যথেষ্ট। জলেতেই যত রোগ—পরিষ্কার অপরিষ্কার নহে, রোগবীজপূর্ণ, তাই রোগের কারণ। জল উত্তপ্ত করে ফিল্টার করা হউক। সকলকে স্বাস্থ্যের দিকে প্রথম নজর দিতে হইবে। একজন রাঁধুনী, একটা চাকর, পরিষ্কার বিছানা, সময়ে খাওয়া—এ-সকল অত্যাবশ্যক। যে প্রকার বলছি সমস্তই যেন করা হয়, ইহাতে অন্যথা না হয়। … টাকাকড়ি খরচের সমস্ত ভার রাখাল যেন লয়, অন্য কেহ তাহাতে উচ্চবাচ্য না করে। নিরঞ্জন, ঘরদ্বার, বিছানা, ফিল্টার যাতে দস্তুরমত ঠিক সাফ থাকে, তাহার ভার লইবে। … সমস্ত কার্যের সফলতা তোমাদের পরস্পরের ভালবাসার উপর নির্ভর করিতেছে। দ্বেষ, ঈর্ষা, অহমিকাবুদ্ধি যতদিন থাকিবে, ততদিন কোন কল্যাণ নাই। … কালীর Pamphlet (পুস্তিকা) খুব উত্তম হয়েছে, তাতে কোন অতিপ্রসঙ্গ নাই।
ঐ যে কানে কানে গুজোগুজি করা—তাহা মহাপাপ বলে জানবে; ঐটা ভায়া, একেবারে ত্যাগ দিও [করিও]। মনে অনেক জিনিষ আসে, তা ফুটে বলতে গেলেই ক্রমে তিল থেকে তাল হয়ে দাঁড়ায়। গিলে ফেললেই ফুরিয়ে যায়।
মহোৎসব খুব ধুমধামের সহিত হয়ে গেছে, ভাল কথা। আসছে বারে এক লাখ লোক যাতে হয়, তারই চেষ্টা করতে হবে বৈকি। মাষ্টার মহাশয় প্রভৃতি ও তোমরা এককাট্টা হয়ে একটা কাগজ যাতে বার করতে পার, তার চেষ্টা দেখ দিকি। … অনন্ত ধৈর্য, অনন্ত উদ্যোগ যাহার সহায়, সে-ই কার্যে সিদ্ধি হবে। পড়াশুনাটা বিশেষ করা চাই, বুঝলে শশী? মেলা মুখ্যু-ফুখ্যু জড়ো করিসনি বাপু। দুটো চারটে মানুষের মত—এককাট্টা কর দেখি। একটা মিউও যে শুনতে পাইনি। তোমরা মহোৎসবে তো লুচিসন্দেশ বাঁটলে, আর কতকগুলো নিষ্কর্মার দল গান করলে, … তোমরা কী spiritual food (আধ্যাত্মিক খোরাক) দিলে, তা তো শুনলাম না? তোদের যে পুরানো ভাব nil admirari—কেউ কিছুই জানে না ভাব— যতদিন না দূর হবে, ততদিন তোরা কিছুই করতে পারবিনি, ততদিন তোদের সাহস হবে না। Bullies are always cowards. (যারা লোককে তর্জন করে বেড়ায়, তারা চিরকাল কাপুরুষ)।
সকলকে sympathy-র (সহানুভূতির) সহিত গ্রহণ করিবে, রামকৃষ্ণ পরমহংস মানুক বা নাই মানুক। বৃথা তর্ক করতে এলে ভদ্রতার সহিত নিজে নিরস্ত হবে। মাষ্টার মহাশয় কতদিন মুখে বোজলা দিয়ে থাকবেন? বোজলাতেই যে জন্ম গেল দেখছি! সকল মতের লোকের সহিত সহানুভূতি প্রকাশ করিবে। এই সকল মহৎ গুণ যখন তোমাদের মধ্যে আসবে, তখন তোমরা মহাতেজে কাজ করতে পারবে, অন্যথা ‘জয় গুরু-ফুরু’ কিছুই চলবে না। যাহা হউক, এবারকার মহোৎসব অতি উত্তমই হইয়াছে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই এবং তার জন্য তোমরা বিশেষ প্রশংসার উপযুক্ত। কিন্তু you must push forward. Do you see? (তোমাদের এগিয়ে পড়তে হবে, বুঝলে কিনা?) শরৎ কি করছে? ‘আমি কি জানি!আমি কি জানি!’—ওরকম বুদ্ধিতে তিন কালেও কিছু জানতে পারবে না। ঠাকুরদাদার কথা—শাঁকচুন্নীর নাকি সুর ভাল বটে, কিন্তু কিছু উঁচুদরের চাই, that will appeal to the intellect of the learned (যা লেখাপড়াজানা লোকেরা পড়ে আনন্দ পাবে)। খালি খোলবাজান হাঙ্গামার কী কাজ? Not only this মহোৎসব will be his memorial, but the central union of an intense propaganda of his doctrines.৫৭ তোকে কি বলব? তোরা এখনও বালক। সব ধীরে ধীরে হবে। তবে সময়ে সময়ে I fret and stamp like a leashed hound.৫৮ Onward and forward (এগিয়ে পড়, এগিয়ে যাও)—আমার পুরানো বুলি। এখন এই পর্যন্ত। আমি আছি ভাল। দেশে তাড়াতাড়ি যেয়ে ফল নাই। তোরা উঠে পড়ে লেগে যা দিকি—সাবাস বাহাদুর! ইতি
নরেন্দ্র
…………………………..
১৭৫*
54 W. 33rd St., নিউ ইয়র্ক
১১ এপ্রিল, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার পত্র পেলাম—ঐ সঙ্গে মনিঅর্ডার ও ‘ট্রান্সক্রিপ্ট’৫৯ কাগজটাও পেলাম। আজ ব্যাঙ্কে যাব—ডলারগুলি ভাঙিয়ে পাউণ্ড করে আনতে। কাল মিঃ লেগেটের কাছে চলে যাচ্ছি কয়েকদিন পল্লীতে বাস করবার জন্য। আশা করি, একটু বিশুদ্ধ বায়ুসেবনে ভালই হবে।
এ বাড়ী এখনই ছেড়ে দেবার কল্পনা ত্যাগ করেছি, কারণ তাতে অত্যন্ত বেশী খরচা পড়বে। অধিকন্তু এখনই বদলান যুক্তিযুক্ত নহে; আমি ধীরে ধীরে সেটি করবার চেষ্টা করছি।
মিস হ্যামলিন আমায় যথেষ্ট সাহায্য করছেন—আমি সেজন্য তাঁর নিকট বিশেষ কৃতজ্ঞ। তিনি আমার প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করছেন—আশা করি, তাঁর ভাবের ঘরেও চুরি নাই। তিনি আমাকে ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চান—আমার ভয় হয়, পূর্বে যেমন একবার শেখান হয়েছিল, ‘নিজেকে সামলে রেখো, যার তার সঙ্গে মিশো না’—এ ব্যাপার তারই দ্বিতীয় সংস্করণ। প্রভু যাঁদের পাঠান, তাঁরাই খাঁটি লোক; আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় এই কথাই তো আমি বুঝেছি। তাঁরাই যথার্থ সাহায্য করতে পারেন, আর তাঁরাই আমাকে সাহায্য করবেন। আর অবশিষ্ট লোকদের সম্বন্ধে বক্তব্য এই, প্রভু তাদের সকলেরই কল্যাণ করুন, আর তাদের হাত থেকে আমায় রক্ষা করুন।
আমার বন্ধুরা সবাই ভেবেছিলেন, একলা একলা দরিদ্রপল্লীতে এভাবে থাকলে এবং প্রচার করলে কিছুই হবে না, আর কোন ভদ্রমহিলা কখনই সেখানে আসবেন না। বিশেষতঃ মিস হ্যামলিন মনে করেছিলেন, তিনি কিম্বা তাঁর মতে যারা ‘ঠিক ঠিক লোক’, তারা যে দরিদ্রোচিত কুটীরে নির্জনবাসী একজন লোকের কাছে এসে তার উপদেশ শুনবে, তা হতেই পারে না। কিন্তু তিনি যাই মনে করুন, যথার্থ ‘ঠিক ঠিক লোক’ ঐ স্থানে দিনরাত আসতে লাগল, তিনিও আসতে লাগলেন। হে প্রভো, মানুষের পক্ষে তোমার ও তোমার দয়ার উপর বিশ্বাস-স্থাপন—কি কঠিন ব্যাপার!! শিব, শিব! মা, তোমায় জিজ্ঞাসা করি, ঠিক ঠিক লোকই বা কোথায়, আর বেঠিক বা মন্দ লোকই বা কোথায়? সবই যে তিনি!! হিংস্র ব্যাঘ্রের মধ্যেও তিনি, মৃগশিশুর ভেতরও তিনি; পাপীর ভেতরও তিনি, পুণ্যাত্মার ভেতরও তিনি—সবই যে তিনি!! সর্বপ্রকারে আমি তাঁর শরণাগত, সারা জীবন তাঁর কোলে আশ্রয় দিয়ে এখন কি তিনি আমায় পরিত্যাগ করবেন? ভগবানের কৃপাদৃষ্টি যদি না থাকে, তবে সমুদ্রে এক ফোঁটা জলও থাকে না, গভীর জঙ্গলে একটা ছোট ডালও পাওয়া যায় না, আর কুবেরের ভাণ্ডারে একমুঠো অন্ন মেলে না; আর তাঁর ইচ্ছা হলে মরুভূমিতে ঝরণা বয়ে যায়, এবং ভিক্ষুকেরও সকল অভাব ঘুচে যায়। একটি চড়ুই পাখী কোথায় উড়ে পড়ছে—তাও তিনি দেখতে পান।৬০ মা, এগুলি কি কেবল কথার কথা—না অক্ষরে অক্ষরে সত্য ঘটনা?
এই ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ কথা এখন থাক। হে আমার শিব, তুমিই আমার ভাল, তুমিই আমার মন্দ। প্রভো, বাল্যকাল থেকেই আমি তোমার চরণে শরণ নিয়েছি। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বা হিমানীমণ্ডিত মেরুপ্রদেশে, পর্বতচূড়ায় বা মহাসমুদ্রের অতল তলে—যেখানেই যাই, তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। তুমিই আমার গতি, আমার নিয়ন্তা, আমার শরণ, আমার সখা, আমার গুরু, আমার ঈশ্বর, তুমিই আমার স্বরূপ। তুমি কখনই আমায় ত্যাগ করবে না—কখনই না, এ আমি ঠিক জানি। হে আমার ঈশ্বর, আমি কখনও কখনও একলা প্রবল বাধাবিঘ্নের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়ি, তখন মানুষের সাহায্যের কথা ভাবি। চিরদিনের জন্য ওসব দুর্বলতা থেকে আমায় রক্ষা কর, যেন আমি তোমা ছাড়া আর কারও কাছে কখনও সাহায্য প্রার্থনা না করি। যদি কেউ কোন ভাল লোকের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, সে কখনও তাকে ত্যাগ করে না বা তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে না। প্রভু, তুমি সকল ভালর সৃষ্টিকর্তা—তুমি কি আমায় ত্যাগ করবে? তুমি তো জান, সারা জীবন আমি তোমার—কেবল তোমারই দাস। তুমি কি আমায় ত্যাগ করবে—যাতে অপরে আমায় ঠকিয়ে যাবে বা আমি মন্দের দিকে ঢলে পড়ব?
মা, তিনি কখনই আমায় ত্যাগ করবেন না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
আপনার চির আজ্ঞাবহ সন্তান
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৭৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
54 W 33rd St., নিউ ইয়র্ক
২৪ এপ্রিল, ১৮৯৫
… জননীর ন্যায় আপনার সৎপরামর্শের জন্য আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। আশা করি জীবনে তদনুযায়ী কাজ করতে পারব।… যে রহস্যময় চিন্তারাশি সম্প্রতি পাশ্চাত্য জগতে অকস্মাৎ আবির্ভূত হইয়াছে, তাহার মূলে যদিও কিছু সত্য আছে, তথাপি আমি সম্যক অবগত আছি, ইহাদের অধিকাংশই বাজে ও কাণ্ডজ্ঞানহীন মতলবে পরিপূর্ণ। আর এইজন্যই ভারতে কিম্বা অন্য কোথাও ধর্মের এই দিকটার সঙ্গে আমি কোন সম্বন্ধ রাখি নাই এবং রহস্যবাদী সম্প্রদায়গুলিও আমার প্রতি বিশেষ অনুকূল নহে।
প্রাচ্যে কিম্বা পাশ্চাত্যে—সর্বত্র একমাত্র অদ্বৈতদর্শনই যে মানবজাতিকে ‘ভূতপূজা’ এবং ঐ জাতীয় কুসংস্কার হইতে মুক্ত করিতে পারে এবং কেবল উহাই যে মানবকে তাহার স্ব স্ব ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়া শক্তিমান্ করিয়া তুলিতে সমর্থ, সে বিষয়ে আমি আপনার সহিত সম্পূর্ণ একমত। পাশ্চাত্য দেশেরই ন্যায় বা তদপেক্ষা অধিক ভারতের নিজেরও এই অদ্বৈতবাদের প্রয়োজন আছে। অথচ কাজটি অত্যন্ত দুরূহ; কারণ প্রথমতঃ আমাদিগকে সকলের মনে রুচি সৃষ্টি করিতে হইবে, তারপর চাই শিক্ষা; সর্বশেষে সমগ্র সৌধটি নির্মাণ করিবার জন্য অগ্রসর হইতে হইবে।
চাই পূর্ণ সরলতা, পবিত্রতা, বিরাট বুদ্ধি এবং সর্বজয়ী ইচ্ছাশক্তি। এই সকল গুণসম্পন্ন মুষ্টিমেয় লোক যদি কাজে লাগে, তবে দুনিয়া ওলটপালট হইয়া যায়। গত বৎসর এদেশে আমি যথেষ্ট বক্তৃতা দিয়াছিলাম, বাহবাও অনেক পাইয়াছিলাম; কিন্তু পরে দেখিলাম, সে-সব কাজ যেন আমি নিছক নিজের জন্যই করিয়াছি। চরিত্রগঠনের জন্য ধীর ও অবিচলিত যত্ন, এবং সত্যোপলব্ধির জন্য তীব্র প্রচেষ্টাই কেবল মানবজাতির ভবিষ্যৎ জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। তাই এ বৎসর আমি সেই ভাবেই আমার কার্যপ্রণালী নিয়মিত করিব, স্থির করিয়াছি। কয়েকজন বাছা বাছা স্ত্রী-পুরুষকে অদ্বৈত- বেদান্তের উপলব্ধি সম্বন্ধে হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিব—কতদূর সফল হইব, জানি না। কেহ যদি শুধু নিজের সম্প্রদায় বা দেশের জন্য না খাটিয়া সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে ব্রতী হইতে চায়, তবে পাশ্চাত্য দেশই তাহার উপযুক্ত ক্ষেত্র।
পত্রিকা বাহির করা বিষয়ে আমি আপনার সহিত সম্পূর্ণ একমত, কিন্তু এ-সব করিবার মত ব্যবসাবুদ্ধি আমার একেবারে নাই; আমি শিক্ষাদান ও ধর্মপ্রচার করিতে পারি, মধ্যে মধ্যে কিছু লিখিতে পারি। সত্যের উপর আমার গভীর বিশ্বাস। প্রভুই আমাকে সাহায্য করিবেন এবং তিনিই প্রয়োজনমত কর্মীও পাঠাইবেন, আমি যেন কায়মনোবাক্যে পবিত্র, নিঃস্বার্থ এবং অকপট হইতে পারি।
‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্। সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ॥’ বৃহত্তর জগতের কল্যাণার্থ নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ যে বিসর্জন দিতে পারে, সমগ্র জগৎ তাহার আপনার হইয়া যায়। … আমার ইংলণ্ডে যাওয়া এখনও অনিশ্চিত। সেখানে আমার পরিচিত কেহই নাই; অথচ এখানে কিছু কিছু কাজ হইতেছে। প্রভুই যথাসময়ে আমাকে পথ দেখাইবেন।
…………………………..
১৭৭*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
19 W. 38th Street, নিউ ইয়র্ক
প্রিয় বন্ধু,
আপনার শেষ পত্র আমি যথাসময়ে পাইয়াছি। এই অগষ্ট মাসের শেষভাগে ইওরোপে যাইবার একটা ব্যবস্থা পূর্বেই হইয়াছিল বলিয়া আপনার আমন্ত্রণ ভগবানের আহ্বান বলিয়া মনে করি।
‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্।’ মিথ্যার কিঞ্চিৎ প্রলেপ থাকিলে সত্যপ্রচার সহজ হয় বলিয়া যাঁহারা মনে করেন, তাঁহারা ভ্রান্ত। কালে তাঁহারা বুঝিতে পারেন যে, বিষ—এক ফোঁটা মিশ্রিত হইলেও সমস্ত খাদ্য দূষিত করিয়া ফেলে। যে পবিত্র ও সাহসী, সে-ই জগতে সব কাজ করিতে পারে।
প্রভু আপনাকে সর্বদা মায়ামোহ হইতে রক্ষা করুন। আমি আপনার সহিত কাজ করিতে সর্বদাই প্রস্তুত আছি। যদি আমরা নিজেরা খাঁটি থাকি, তবে প্রভুও আমাদিগকে শত শত বন্ধু প্রেরণ করিবেন। ‘আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুঃ …।’
চিরকালই ইওরোপ হইতে সামাজিক এবং এশিয়া হইতে আধ্যাত্মিক শক্তির উদ্ভব হইয়াছে এবং এই দুই শক্তির বিভিন্ন প্রকার সংমিশ্রণেই জগতের ইতিহাস গড়িয়া উঠিয়াছে। মানবজাতির ইতিহাসের একটি নূতন পৃষ্ঠা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হইতেছে এবং সর্বত্র তাহারই চিহ্ন দেখা যাইতেছে। শত শত নূতন পরিকল্পনার উদ্ভব ও বিলয় হইবে, কিন্তু একমাত্র যোগ্যতমেরই প্রতিষ্ঠা সুনিশ্চিত—সত্য ও শিব অপেক্ষা যোগ্যতম আর কি হইতে পারে?
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৭৮*
54 W. 33rd Street, নিউ ইয়র্ক
২৫ এপ্রিল, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
গত পরশু মিস ফার্মারের একখানি হৃদ্যতাপূর্ণ পত্র পেলাম—তার সঙ্গে বার্বার হাউসে প্রদত্ত বক্তৃতাগুলির জন্য একশত ডলারের একখানি চেকও এল। আগামী শনিবার তিনি নিউ ইয়র্কে আসছেন। অবশ্য আমি মিস ফার্মারকে তাঁর বক্তৃতার বিজ্ঞাপনে আমার নাম দিতে মানা করব। বর্তমানে গ্রীনএকারে যেতে পারছি না, সহস্রদ্বীপোদ্যানে (Thousand Island Park) যাবার বন্দোবস্ত করেছি—ঐ স্থান যেখানেই হোক। সেখানে আমার জনৈকা ছাত্রী মিস ডাচারের এক কুটীর আছে। আমরা কয়েকজন সেখানে নির্জন বাস করে বিশ্রাম ও শান্তিতে কাটাব, মনে করেছি। আমার ক্লাসে যাঁরা আসেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে ‘যোগী’ করতে চাই। গ্রীনএকারের মত কর্মচঞ্চল হাট এ কাজের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। অপর জায়গাটি আবার লোকালয় থেকে সম্পূর্ণ দূরে বলে যারা শুধু মজা চায়, তারা কেউ সেখানে যেতে সাহস করবে না।
জ্ঞানযোগের ক্লাসে যাঁরা আসতেন, তাঁদের ১৩০ জনের নাম মিস হ্যামলিন টুকে রেখেছিলেন—এতে আমি খুব খুশী আছি। আরও ৫০ জন বুধবারে যোগ-ক্লাসে আসতেন—আর সোমবারের ক্লাসে আরও ৫০ জন। মিঃ ল্যাণ্ডসবার্গ সব নামগুলি লিখে রেখেছিলেন—আর নাম লেখা থাক বা নাই থাক, এঁরা সকলেই আসবেন। মিঃ ল্যাণ্ডসবার্গ আমার সংস্রব ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু নামগুলি সব এখানে আমার কাছে ফেলে গেছেন। তারা সকলেই আসবে—আর তারা যদি না আসে তো অপরে আসবে। এইরূপেই চলবে— প্রভু, তোমারই মহিমা!!!
নাম টুকে রাখা এবং বিজ্ঞাপন দেওয়া একটা মস্ত কাজ সন্দেহ নেই; আমার জন্য এই কাজ করেছেন বলে তাঁদের উভয়ের কাছে আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পেরেছি যে, অপরের ওপর নির্ভর করা আমার নিজেরই আলস্য, সুতরাং উহা অধর্ম—আর আলস্য থেকে সর্বদা অনিষ্টই হয়ে থাকে। সুতরাং এখন থেকে ঐ-সব কাজ আমিই করছি এবং পরেও নিজেই সব করব। তাতে আর ভবিষ্যতে কারও কোন উদ্বেগের কারণ থাকবে না।
যাই হোক, আমি মিস হ্যামলিনের ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ মধ্যে যাকে হোক নিতে পারলে ভারি সুখী হব; কিন্তু আমার দুরদৃষ্টক্রমে তেমন একজনও তো এখনও এল না। আচার্যের চিরন্তন কর্তব্য হচ্ছে অত্যন্ত ‘বেঠিক’ লোকদের ভিতর থেকে ‘ঠিক ঠিক লোক’ তৈরী করে নেওয়া।
মোদ্দা কথাটা এই, মিস হ্যামলিন নামে সম্ভ্রান্ত মহিলাটি আমাকে নিউ ইয়র্কের ‘ঠিক ঠিক লোকগুলির’ সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার আশা ও উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং কার্যতঃ তিনি আমায় যেরূপ সাহায্য করেছিলেন, তার জন্য যদিও আমি তাঁর কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ, তবু মনে করছি আমার যা অল্পস্বল্প কাজ আছে, তা আমার নিজের হাতে করাই ভাল। এখনও অন্যের সাহায্য নেবার সময় হয়নি—কাজ অতি অল্প। আপনার যে উক্ত মিস হ্যামলিন সম্বন্ধে অতি উচ্চ ধারণা, তাতে আমি খুব খুশী। আপনি যে তাঁকে সাহায্য করবেন, এ জেনে অন্যে যা হোক, আমি তো বিশেষ খুশী; কারণ তাঁর সাহায্য প্রয়োজন। কিন্তু মা, রামকৃষ্ণের কৃপায় কোন মানুষের মুখ দেখলেই আমি যেন স্বভাবসিদ্ধ সংস্কারবলে তার ভিতর কি আছে, তা প্রায় অভ্রান্তভাবে জানতে পারি; আর এর ফলে এই দাঁড়িয়েছে যে, আপনি আমার সব ব্যাপার নিয়ে যা খুশী করতে পারেন, আমি তাতে এতটুকু অসন্তোষ পর্যন্ত প্রকাশ করব না। আমি মিস ফার্মারের পরামর্শও খুব আনন্দের সঙ্গেই নেব—তিনি যতই ভূত-প্রেতের কথা বলুন না কেন। এ-সব ভূত-প্রেতের অন্তরালে আমি একটি অগাধপ্রেমপূর্ণ হৃদয় দেখতে পাচ্ছি, কেবল এর ওপর একটা প্রশংসনীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার সূক্ষ্ম আবরণ রয়েছে—তাও কয়েক বৎসরে নিশ্চয় অন্তর্হিত হবে। এমন কি—ল্যাণ্ডস্বার্গও মাঝে মাঝে আমার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে তাতে কোন আপত্তি করব না। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এঁদের ছাড়া অন্য কোন লোক আমায় সাহায্য করতে এলে আমি বেজায় ভয় পাই—এই পর্যন্ত আমি বলতে পারি। আপনি আমাকে যে সাহায্য করেছেন, শুধু তার দরুন নয়—আমার স্বাভাবিক সংস্কারবশতই (অথবা যাকে আমি আমার গুরুমহারাজের প্রেরণা বলে থাকি) আপনাকে আমি আমার মায়ের মত দেখে থাকি। সুতরাং আপনি আমাকে যে-কোন উপদেশ দেবেন, তা আমি সর্বদাই মেনে চলব—কিন্তু ঐ পরামর্শ বা আদেশ সাক্ষাৎ আপনার কাছ থেকে আসা চাই। আপনি যদি আর কাকেও মাঝখানে খাড়া করেন, তাহলে আমি নিজে বেছে নেওয়ার দাবী প্রার্থনা করি। এই কথা আর কি!
আপনার চিরানুগত সন্তান
বিবেকানন্দ
পুঃ—মিস হ্যামলিন এখনও এসে পৌঁছননি। তিনি এলে আমি সংস্কৃত বইগুলি পাঠাব। তিনি কি আপনার কাছে মিঃ নওরোজী-কৃত ভারত সম্বন্ধে একখানি বই পাঠিয়েছেন? আপনি যদি আপনার ভাইকে বইখানি একবার আগাগোড়া দেখতে বলেন, তবে আমি খুব খুশী হব। গান্ধী এখন কোথায়?
বি
…………………………..
১৭৯*
54 W. 33rd St. New York
মে, ১৮৯৫
প্রিয়,
তোমাকে চিঠি লেখবার পর আমার ছাত্রেরা আবার এসেছে আমায় সাহায্য করবার জন্য; ক্লাসগুলি এখন খুবই সুন্দরভাবে চলবে, সন্দেহ নেই।
এতে আমি খুব খুশী হয়েছি, কারণ শেখান ব্যাপারটা আমার জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্য ও বিশ্রাম যেমন প্রয়োজন, আমার জীবনে এও তেমনি প্রয়োজন।
তোমার
বিবেকানন্দ
পুনঃ—আমি ইংরেজী পত্রিকা ‘The Borderland’-এ—এর বিষয়ে অনেক কিছু পড়েছি— ভারতে খুব ভাল কাজ করছে এবং হিন্দুরা যাতে তাদের ধর্ম বুঝতে পারে, সে বিষয়ে চেষ্টা করছে। আমি —র লেখায় কোনপ্রকার পাণ্ডিত্য দেখতে পাইনি, … অথবা কোন আধ্যাত্মিকতাও নয়। যাই হোক, যে জগতের ভাল করতে চায়, তার উদ্দেশ্য সফল হোক।
কত সহজেই এ সংসার ধাপ্পাবাজিতে ভুলে যায়! এবং সভ্যতার সূচনা থেকেই কত যে জুয়াচুরি বেচারা মানুষের মাথার ওপর জমছে!
…………………………..
১৮০*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]৬১
U. S. A.
মে (?), ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
‘যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি ধর্মের গৌরব পুনঃস্থাপনের জন্য আবির্ভূত হই’—হে মহারাজ, ইহা পবিত্র গীতামুখে উচ্চারিত সেই সনাতন ভগবানের বাক্য, এই কথাগুলি জগতে আধ্যাত্মিক শক্তি-তরঙ্গের উত্থান-পতনের মূল সুর।
ধর্মজগতে এই পরিবর্তন বারংবার তাহার নূতন নূতন বিশিষ্ট ছন্দে প্রকাশিত হইতেছে; যদিও অন্যান্য বিরাট পরিবর্তনের ন্যায় নিজস্ব এলাকার মধ্যগত প্রত্যেকটি বস্তুর উপর এই পরিবর্তনগুলিও প্রভাব বিস্তার করে, তথাপি শক্তি-ধারণে সমর্থ বস্তুর উপরেই তাহাদের কার্যকারিতা সমধিক প্রকাশ পায়।
বিশ্বগতভাবে যেমন জগতের আদিম অবস্থা ত্রিগুণের সাম্যভাব, এই সাম্যভাবের চ্যুতি ও তাহা পুনঃপ্রাপ্তির জন্য সমুদয় চেষ্টা লইয়াই এই প্রকৃতির বিকাশ বা বিশ্বজগৎ; যতদিন না এই সাম্যাবস্থা পুনরায় ফিরিয়া আসে, ততদিন এইভাবেই চলিতে থাকে। সীমাবদ্ধভাবে তেমনি আমাদের এই পৃথিবীতে যতদিন মনুষ্যজাতি এইভাবেই থাকিবে, ততদিন এই বৈষম্য ও তাহার অপরিহার্য পরিপূরক এই সাম্যলাভের চেষ্টা—দুই-ই পাশাপাশি বিরাজ করিবে। তাহাতে পৃথিবীর সর্বত্র ভিন্ন ভিন্ন জাতির ভিতর, উপজাতিগুলির ভিতর, এমন কি প্রত্যেকটি ব্যক্তিতে সুস্পষ্ট বিশেষত্ব থাকিবে।
অতএব নিরপেক্ষভাবে এবং সাম্য রক্ষা করিয়া সকলকে শক্তি প্রদত্ত হইলেও প্রত্যেক জাতিই যেন একটি বিশেষ প্রকার শক্তিসংগ্রহ ও বিতরণের উপযোগী এক-একটি অদ্ভুত যন্ত্র- স্বরূপ; ঐ জাতির অন্যান্য অনেক শক্তি থাকিলেও সেই শক্তিটিই তাহার বিশেষ লক্ষণরূপে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়। মনুষ্যপ্রকৃতিতে একটি ভাবের তরঙ্গ উঠিলে, তাহার প্রভাব অল্প-বিস্তর সকলেই অনুভব করিলেও ঐ ভাব যে-জাতির বিশেষ লক্ষণ এবং সাধারণতঃ যে-জাতিকে কেন্দ্র করিয়া ঐ ভাবের আরম্ভ, সেই জাতির অন্তস্তল পর্যন্ত উহা দ্বারা আলোড়িত হয়। এই কারণেই ধর্মজগতে কোন আলোড়ন উপস্থিত হইলে তাহার ফলে ভারতে অবশ্যই নানাপ্রকার গুরুতর পরিবর্তন হইতে থাকিবে, ভারতকে কেন্দ্র করিয়াই বহুবিস্তৃত ধর্মতরঙ্গসমূহ বারংবার উত্থিত হইয়াছে, কারণ সর্বোপরি ভারত ধর্মের দেশ।
যাহা দ্বারা আদর্শলাভের সহায়তা হয়, মানুষ কেবল সেটিকেই বাস্তব বলে। সাংসারিক মানুষের নিকট যাহা কিছুর বিনিময়ে টাকা পাওয়া যায়, তাহাই বাস্তব; যাহার বিনিময়ে টাকা হয় না, তাহা অবাস্তব। প্রভুত্ব যাহার আকাঙ্ক্ষা, তাহার নিকট যাহাদ্বারা সকলের উপর প্রভুত্ব করিবার বাসনা চরিতার্থ হয়, তাহাই বাস্তব, বাকী সব কিছুই নয়। যাহা জীবনে বিশেষ প্রীতির প্রতিধ্বনি করে না, তাহার মধ্যে মানুষ কিছুই দেখিতে পায়
যাহাদের একমাত্র লক্ষ্য জীবনের সমুদয় শক্তির বিনিময়ে কাঞ্চন, নাম বা অপর কোনরূপ ভোগসুখ অর্জন করা, যাহাদের নিকট সমরসজ্জায় সজ্জিত সৈন্যদলের যুদ্ধযাত্রাই শক্তি-বিকাশের একমাত্র লক্ষণ, যাহাদের নিকট ইন্দ্রিয়সুখই জীবনের একমাত্র সুখ, তাহাদের নিকট ভারত সর্বদাই একটা বিশাল মরুভূমির মত প্রতীয়মান হইবে; তাহাদের কাছে জীবনের বিকাশ বলিয়া যাহা পরিচিত, তাহার পক্ষে ঐ মরুভূমির প্রতিটি দমকা বাতাস মারাত্মক।
কিন্তু যাঁহাদের জীবনতৃষ্ণা ইন্দ্রিয়জগতের অতি দূরে অবস্থিত অমৃতনদীর সলিলপানে একেবারে মিটিয়া গিয়াছে, যাঁহাদের আত্মা সর্পের জীর্ণত্বকমোচনের ন্যায় কাম, কাঞ্চন ও যশঃস্পৃহারূপ ত্রিবিধ বন্ধনকে দূরে ফেলিয়া দিয়াছে, যাঁহারা চিত্তস্থৈর্যের উন্নত শিখরে আরোহণ করিয়া তথা হইতে—ইন্দ্রিয়-বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তিগণের ‘ভোগ’ বলিয়া কথিত আপাতমনোহর বস্তুর জন্য নীচজনোচিত কলহ, বিবাদ, দ্বেষহিংসার প্রতি প্রীতি ও প্রসন্নতার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, সঞ্চিত সৎকর্মের ফলে চক্ষু হইতে অজ্ঞানের আবরণ খসিয়া পড়ায় যাঁহারা অসার নামরূপের পারে প্রকৃত সত্যদর্শনে সমর্থ হইয়াছেন, তাঁহারা যেখানেই থাকুন না কেন, আধ্যাত্মিকতার জন্মভূমি ও অফুরন্ত খনি ভারতবর্ষ তাঁহাদের দৃষ্টিতে ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয়; শূন্যে বিলীয়মান ছায়ার মত এই জগতে যিনি একমাত্র প্রকৃত সত্তা, তাঁহার সন্ধানরত প্রত্যেকটি সাধকের নিকট ভারত আশার আলোকরূপে প্রতীত হয়।
অধিকাংশ মানব তখনই শক্তিকে শক্তি বলিয়া বুঝিতে পারে, যখন অনুভবের উপযোগী করিয়া স্থূল আকারে উহা তাহাদের সম্মুখে ধরা হয়, তাহাদের নিকট যুদ্ধের উত্তেজনা শক্তির প্রত্যক্ষ বিকাশ বলিয়া প্রতীত হয়; আর যাহা কিছু ঝড়ের মত আসিয়া সম্মুখের সব কিছু উড়াইয়া লইয়া যায় না, উহা তাহাদের দৃষ্টিতে মৃত্যুস্বরূপ। সুতরাং শত শত শতাব্দীব্যাপী যে ভারতবর্ষ কোনরূপ বাধাদানে নিশ্চেষ্ট হইয়া বিদেশী বিজেতৃগণের পদতলে পতিত, জনতা সেখানে একতাহীন, স্বদেশপ্রেমের ভাবও যেখানে এতটুকু নাই—সেই ভারত তাহাদের নিকট বিকৃত অস্থিপূর্ণ দেশ, প্রাণহীন পচনশীল পদার্থের স্তূপ বলিয়া প্রতীত হইবে।
বলা হয়, যোগ্যতমই কেবল জীবনসংগ্রামে জয়ী হইয়া থাকে। তবে সাধারণ ধারণানুসারে যে-জাতি সর্বাপেক্ষা অযোগ্য, সে-জাতি দারুণ দুর্ভাগ্য সহ্য করিয়াও কেন বিনাশের কিছুমাত্র চিহ্ন প্রদর্শন করিতেছে না? তথাকথিত বীর্যবান্ ও কর্মপরায়ণ জাতিসমূহের শক্তি দিন দিন কমিয়া আসিতেছে, আর এদিকে ‘দুর্নীতিপরায়ণ (?)’ হিন্দুর শক্তি সর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পাইতেছে, ইহা কিরূপে হইতেছে? এক মুহূর্তের মধ্যে যাহারা জগৎকে শোণিতসাগরে প্লাবিত করিয়া দিতে পারে, তাহারা খুব প্রশংসা পাইবার যোগ্য। যাহারা জগতের কয়েক লক্ষ লোককে সুখে-স্বচ্ছন্দে রাখিবার জন্য পৃথিবীর অর্ধেক লোককে অনাহারে রাখিতে পারে, তাহারাও মহৎ গৌরবের অধিকারী! কিন্তু যাহারা অপর কাহারও মুখ হইতে অন্ন কাড়িয়া না লইয়া লক্ষ লক্ষ মানুষকে সুখে রাখিতে পারে, তাহারা কি কোনরূপ সম্মান পাইবার যোগ্য নয়? শত শত শতাব্দী ধরিয়া অপরের উপর বিন্দুমাত্র অত্যাচার না করিয়া লক্ষ লক্ষ লোকের ভাগ্য পরিচালনা করাতে কি কোনরূপ শক্তি প্রদর্শিত হয় না?
সকল প্রাচীন জাতির পুরাণেই দেখা যায়, বীরপুরুষদের প্রাণ তাঁহাদের শরীরের কোন বিশেষ ক্ষুদ্র অংশে ঘনীভূত ছিল। যতদিন সেখানে হাত পড়িত না, ততদিন তাঁহারা দুর্ভেদ্য থাকিতেন। বোধ হয় যেন প্রত্যেক জাতিরও এইরূপ একটি বিশেষ কেন্দ্রে জীবনীশক্তি সঞ্চিত আছে; তাহাতে হাত না পড়া পর্যন্ত কোন দুঃখবিপদই সেই জাতিকে বিনষ্ট করিতে পারে না।
ধর্মেই ভারতের এই জীবনীশক্তি। যতদিন হিন্দুরা তাহাদের পূর্বপুরুষগণের নিকট উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান বিস্মিত না হইতেছে, ততদিন জগতে কোন শক্তি তাহাদের ধ্বংস করিতে পারিবে না।
যে ব্যক্তি সর্বদাই স্বজাতির অতীতের দিকে ফিরিয়া তাকায়, আজকাল সকলেই তাহাকে নিন্দা করিয়া থাকে। অনেকে বলেন, এইরূপ ক্রমাগত অতীতের আলোচনাই হিন্দুজাতির নানারূপ দুঃখের কারণ। কিন্তু আমার বোধ হয়, ইহার বিপরীতটিই সত্য; যতদিন হিন্দুরা তাহাদের অতীত ভুলিয়া ছিল, ততদিন তাহারা হতবুদ্ধি হইয়া অসাড় অবস্থায় পড়িয়াছিল। যতই তাহারা অতীতের আলোচনা করিতেছে, ততই চারিদিকে নূতন জীবনের লক্ষণ দেখা যাইতেছে। অতীতের ছাঁচেই ভবিষ্যৎকে গড়িতে হইবে, এই অতীতই ভবিষ্যৎ হইবে।
অতএব হিন্দুগণ যতই তাঁহাদের অতীত আলোচনা করিবেন, তাঁহাদের ভবিষ্যৎ ততই গৌরবময় হইবে; আর যে-কেহ এই অতীতকে প্রত্যেকের কাছে তুলিয়া ধরিতে চেষ্টা করিতেছেন, তিনিই স্বজাতির পরম হিতকারী। আমাদের পূর্বপুরুষগণের রীতিনীতিগুলি মন্দ ছিল বলিয়া যে ভারতের অবনতি হইয়াছে, তাহা নহে; এই অবনতির কারণ, ঐ রীতিনীতিগুলির যে ন্যায়সঙ্গত পরিণতি হওয়া উচিত ছিল, তাহা হইতে দেওয়া হয় নাই।
প্রত্যেক বিচারশীল পাঠকই জানেন, ভারতের সামাজিক বিধানগুলি যুগে যুগে পরিবর্তিত হইয়াছে। প্রথম হইতেই এই নিয়মগুলি এক বিরাট পরিকল্পনার প্রতিফলনের চেষ্টাস্বরূপ ছিল, কালক্রমে ধীরে ধীরে এগুলি বিকশিত হইবার কথা। প্রাচীন ভারতের ঋষিগণ এত দূরদর্শী ছিলেন যে, তাঁহাদের জ্ঞানের মহত্ত্ব বুঝিতে জগৎকে এখনও অনেক শতাব্দী অপেক্ষা করিতে হইবে। আর তাঁহাদের বংশধরগণের এই মহান্ উদ্দেশ্যের পূর্ণভাব ধারণা করিবার অক্ষমতাই ভারতের একমাত্র কারণ।
শত শত শতাব্দী ধরিয়া প্রাচীন ভারত তাহার প্রধান দুই জাতির—ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের উচ্চাভিলাষপূর্ণ অভিসন্ধি-সাধনের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল।
একদিকে পুরোহিতগণ সাধারণ প্রজাদের উপর রাজাদের অবৈধ সামাজিক অত্যাচার নিবারণে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এই প্রজাগণকে ক্ষত্রিয়গণ আপনাদের ‘ন্যায়সঙ্গতভক্ষ্য’রূপে ঘোষণা করিতেন। অপর দিকে ক্ষত্রিয়গণই ভারতে একমাত্র শক্তিসম্পন্ন জাতি ছিলেন, যাঁহারা পুরোহিতগণের আধ্যাত্মিক অত্যাচার ও সাধারণ মানুষকে বন্ধন করিবার জন্য তাঁহারা যে ক্রমবর্ধমান নূতন নূতন ক্রিয়াকাণ্ড প্রবর্তন করিতেছিলেন, তাহার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া কিছু পরিমাণে কৃতকার্য হইয়াছিলেন।
অতি প্রাচীনকাল হইতেই উভয় জাতির এই সংঘর্ষ আরম্ভ হইয়াছিল। সমগ্র শ্রুতির ভিতরেই ইহা অতি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। সাময়িকভাবে এই বিরোধ মন্দীভূত হইল, যখন ক্ষত্রিয়দের এবং জ্ঞানকাণ্ডের নেতা শ্রীকৃষ্ণ সামঞ্জস্যের পথ দেখাইয়া দিলেন। তাহার ফল গীতার শিক্ষা, যাহা ধর্ম দর্শন ও উদারতার সারস্বরূপ। কিন্তু বিরোধের কারণ তখনও বর্তমান ছিল, সুতরাং তার ফলও অবশ্যম্ভাবী।
সাধারণ দরিদ্র মূর্খ প্রজার উপর প্রভুত্ব করিবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্বোক্ত দুই জাতির মধ্যেই বর্তমান ছিল, সুতরাং বিরোধ আবার প্রবলভাবে জাগিয়া উঠিল। আমরা সেই সময়কার যে সামান্য সাহিত্য পাই, তাহা সেই প্রাচীনকালের প্রবল বিরোধের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র, কিন্তু অবশেষে ক্ষত্রিয়ের জয় হইল, জ্ঞানের জয় হইল, স্বাধীনতার জয় হইল আর কর্মকাণ্ডের প্রাধান্য রইল না, ইহার অধিকাংশই চিরকালের জন্য চলিয়া গেল।
এই উত্থানের নাম বৌদ্ধ সংস্কার। ধর্মের দিকে উহা কর্মকাণ্ড হইতে মুক্তি সূচনা করিতেছে, আর রাজনীতির দিকে ক্ষত্রিয় দ্বারা পুরোহিত-প্রাধান্যের বিনাশ সূচিত হইতেছে।
বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, প্রাচীন ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ যে দুই মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা উভয়েই—কৃষ্ণ ও বুদ্ধ—ক্ষত্রিয় ছিলেন। ইহা আরও বেশী লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, এই দুই দেবমানবই স্ত্রী-পুরষ জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের জন্যই জ্ঞানের দ্বার খুলিয়া দিয়াছিলেন।
অদ্ভুত নৈতিক বল সত্ত্বেও বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন মত ধ্বংস করিতে অত্যধিক সমুৎসুক ছিল। উহার অধিকাংশ শক্তিই নেতিমূলক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হওয়াতে বৌদ্ধধর্মকে উহার জন্মভূমি হইতে প্রায় বিলুপ্ত হইতে হইল; আর যেটুকু অবশিষ্ট রহিল, তাহাও বৌদ্ধধর্ম যে-সকল কুসংস্কার ও ক্রিয়াকাণ্ড নিবারণে নিয়োজিত হইয়াছিল, তদপেক্ষা শতগুণ ভয়ানক কুসংস্কার ও ক্রিয়াকাণ্ডে পূর্ণ হইয়া উঠিল। যদিও উহা আংশিকভাবে বৈদিক পশুবলি নিবারণে কৃতকার্য হইয়াছিল, কিন্তু উহা সমুদয় দেশ, মন্দির, প্রতিমা, প্রতীক, যন্ত্র ও সাধুসন্তের অস্থিতে ভরিয়া ফেলিল।
সর্বোপরি বৌদ্ধধর্মের জন্য আর্য মঙ্গোলীয় ও আদিম প্রভৃতি ভিন্ন প্রকৃতির জাতির যে মিশ্রণ হইল, তাহাতে অজ্ঞাতসারে কতকগুলি বীভৎস বামাচারের সৃষ্টি হইল। প্রধানতঃ এই কারণেই সেই মহান্ আচার্যের উপদেশাবলীর এই বিকৃত পরিণতিকে শ্রীশঙ্কর ও তাঁহার সন্ন্যাসি-সম্প্রদায় ভারত হইতে বিতাড়িত করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
এইরূপে মনুষ্যদেহধারিগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভগবান্ বুদ্ধ কর্তৃক প্রবর্তিত জীবন-প্রবাহও পূতিগন্ধময় বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হইল; ভারতকে কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করিতে হইল, যতদিন না ভগবান্ শঙ্করের আবির্ভাব এবং কিছু পরে-পরেই রামানুজ ও মধ্বাচার্যের অভ্যুদয় হইল।
ইতোমধ্যে ভারতেতিহাসের এক সম্পূর্ণ নূতন অধ্যায় আরম্ভ হইয়াছে। প্রাচীন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় জাতি অন্তর্হিত হইয়াছে। হিমালয় ও বিন্ধ্যের মধ্যবর্তী আর্যভূমি, যেখানে কৃষ্ণ ও বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, যাহা মহামান্য রাজর্ষি ও ব্রহ্মর্ষিগণের শৈশবের লীলাভূমি ছিল, তাহা এখন নীরব; আর ভারত উপদ্বীপের সর্বশেষ প্রান্ত হইতে, ভাষায় ও আকারে সম্পূর্ণ বিভিন্ন এক জাতি হইতে, প্রাচীন ব্রাহ্মণগণের বংশধর বলিয়া গৌরবকারী বংশসমূহ হইতে বিকৃত বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল।
আর্যাবর্তের সেই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ কোথায় গেলেন? তাঁহারা একেবারে বিলুপ্ত, কেবল এখানে ওখানে ব্রাহ্মণত্ব বা ক্ষত্রিয়ত্ব-অভিমানী কতকগুলি মিশ্র জাতি বাস করিতেছে। আর তাঁহাদের ‘এতদ্দেশপ্রসূতস্য সকাশদগ্রজন্মনঃ’ পৃথিবীর সকল মানুষ আপন আপন চরিত্র শিক্ষা করিবে,৬২ এইরূপ অহঙ্কৃত, আত্মশ্লাঘাময় উক্তি সত্ত্বেও তাঁহাদিগকে অতি বিনয়ের সহিত দীনবেশে দাক্ষিণাত্যবাসীদের পদতলে বসিয়া শিক্ষা করিতে হইয়াছিল। ইহার ফলে ভারতে পুনরায় বেদের অভ্যুদয় হইল—বেদান্তের পুনরুত্থান হইল; এইরূপ বেদান্তের চর্চা আর কখনও হয় নাই, গৃহস্থেরা পর্যন্ত আরণ্যকপাঠে নিযুক্ত হইলেন।
বৌদ্ধধর্ম-প্রচারে ক্ষত্রিয়েরাই প্রকৃত নেতা ছিলেন এবং দলে দলে তাঁহারাই বৌদ্ধ হইয়াছিলেন। সংস্কার ও ধর্মান্তরকরণের উৎসাহে সংস্কৃত ভাষা উপেক্ষিত হইয়া লোকপ্রচলিত ভাষাসমূহের চর্চা প্রবল হইয়াছিল। আর অধিকাংশ ক্ষত্রিয়ই বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃত শিক্ষার বহির্ভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন। সুতরাং দাক্ষিণাত্য হইতে যে এই সংস্কার-তরঙ্গ আসিল, তাহাতে কিয়ৎপরিমাণে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণগণেরই উপকার হইল। কিন্তু উহা ভারতের অবশিষ্ট লক্ষ লক্ষ লোকের পক্ষে অধিকতর ও নূতনতর বন্ধনের কারণ হইয়াছিল।
ক্ষত্রিয়গণ চিরকালই ভারতের মেরুদণ্ডস্বরূপ, সুতরাং তাঁহারাই বিজ্ঞান ও স্বাধীনতার পরিপোষক। দেশ হইতে কুসংস্কার দূরীভূত করিবার জন্য বারংবার তাঁহাদের বজ্রকণ্ঠ ধ্বনিত হইয়াছে, আর ভারতেতিহাসে প্রথম হইতে তাঁহারাই পুরোহিতকুলের অত্যাচার হইতে সাধারণকে রক্ষা করিবার অভেদ্য প্রাচীররূপে দণ্ডায়মান।
যখন তাঁহাদের অধিকাংশ ঘোর অজ্ঞানে নিমগ্ন হইলেন, এবং অপরাংশ মধ্য এশিয়ার বর্বর জাতিগুলির সহিত শোণিতসম্বন্ধ স্থাপন করিয়া ভারতে পুরোহিতগণের প্রাধান্য-স্থাপনে তরবারি নিয়োজিত করিল, তখনই ভারতে পাপের মাত্রা পূর্ণ হইয়া আসিল, আর ভারতভূমি একেবারে ডুবিয়া গেল। যতদিন না ক্ষত্রিয়-শক্তি জাগরিত হইয়া নিজেকে মুক্ত করে এবং অবশিষ্ট জাতির চরণ-শৃঙ্খল মোচন করিয়া দেয়, ততদিন আর ভারত উঠিবে না। পৌরোহিত্যই ভারতের সর্বনাশের মূল। নিজ ভ্রাতাকে অবনমিত করিয়া মানুষ স্বয়ং কি অবনত না হইয়া থাকিতে পারে?
জানিবেন, রাজাজী, আপনার পূর্বপুরুষগণের দ্বারা আবিষ্কৃত সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যঃ বিশ্বজগতের একত্ব। কোন ব্যক্তি নিজের কিছুমাত্র অনিষ্ট না করিয়া কি অপরের অনিষ্ট করিতে পারে? এই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণের অত্যাচার-সমষ্টি চক্রবৃদ্ধিহারে তাঁহাদেরই উপর ফিরিয়া আসিয়াছে, এই সহস্রবর্ষব্যাপী দাসত্ব ও অপমানে তাহারা অনিবার্য কর্মফলই ভোগ করিতেছে।
আপনাদেরই একজন পূর্বপুরুষ বলিয়াছিলেন, ‘ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।’৬৩—যাঁহাদের মন সাম্যে অবস্থিত, তাঁহারা জীবদ্দশাতেই সংসার জয় করিয়াছেন। তাঁহাকে লোকে ভগবানের অবতার বলিয়া বিশ্বাস করিয়া থাকে, আমরা সকলেই ইহা বিশ্বাস করি। তবে তাঁহার এই বাক্য কি অর্থহীন প্রলাপমাত্র? যদি তাহা না হয়, আর আমরা জানি তাঁহার বাক্য প্রলাপ নয়, তবে জাতি লিঙ্গ—এমন কি গুণ পর্যন্ত বিচার না করিয়া সমুদয় সৃষ্ট জগতের এই পূর্ণ সাম্যের বিরুদ্ধে যে-কোন চেষ্টা ভয়ানক ভ্রমাত্মক; আর যতদিন না এই সাম্যভাব আয়ত্ত হইতেছে, ততদিন কেহ কখনই মুক্ত হইতে পারে না।
অতএব হে রাজন, আপনি বেদান্তের উপদেশাবলী পালন করুন—অমুক ভাষ্যকারের বা টীকাকারের ব্যাখ্যানুসারে নহে, আপনার অন্তর্যামী আপনাকে যেরূপ বুঝাইয়াছেন, সেইভাবে। সর্বোপরি এই সর্বভূতে সর্ববস্তুতে সমজ্ঞানরূপ মহান্ উপদেশ পালন করুন—সর্বভূতে সেই এক ভগবানকে দর্শন করুন।
ইহাই মুক্তির পথ; বৈষম্যই বন্ধনের পথ। কোন ব্যক্তি বা কোন জাতি বাহিরের একত্ব-জ্ঞান ব্যতীত বাহিরের স্বাধীনতা লাভ করিতে পারে না, আর সকলের মানসিক একত্ব-জ্ঞান ব্যতীত মানসিক স্বাধীনতাও লাভ করিতে পারে না।
অজ্ঞান অসাম্য ও বাসনা—এই তিনটি মানবজাতির দুঃখের কারণ, আর উহাদের মধ্যে একটির সহিত অপরটির অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। একজন মানুষ নিজেকে অপর কোন মানুষ হইতে, এমন কি পশু হইতেও শ্রেষ্ঠ ভাবিবে কেন? বাস্তবিক সর্বত্রই তো এক বস্তু বিরাজিত। ‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী’৬৪ —তুমি স্ত্রী, তুমি পুরুষ, তুমি কুমার আবার তুমিই কুমারী।
অনেকে বলিবেন, ‘এরূপ ভাবা সন্ন্যাসীর পক্ষে ঠিক বটে, কিন্তু আমরা যে গৃহস্থ!’ অবশ্য গৃহস্থকে অন্যান্য অনেক কর্তব্য করিতে হয় বলিয়া সে পূর্ণভাবে এই সাম্য-অবস্থা লাভ করিতে পারে না, কিন্তু ইহা তাহাদেরও আদর্শ হওয়া উচিত। এই সমত্বভাব লাভ করাই সমগ্র সমাজের, সমুদয় জীবের ও সমগ্র প্রকৃতির আদর্শ। কিন্তু হায়, লোকে মনে করেঃ বৈষম্যই এই সমজ্ঞান-লাভের উপায়; অন্যায় কাজ করিয়া তাহারা যেন ন্যায়ের লক্ষ্যে—সত্যে পৌঁছিতে পারে!
ইহাই মনুষ্যপ্রকৃতিতে বিষবৎ কার্য করে; মনুষ্যজাতির উপর অভিশাপস্বরূপ, সকল দুঃখের মূল কারণ—এই বৈষম্য। ইহাই শরীরিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক সর্ববিধ বন্ধনের মূল।
‘সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্বিতমীশ্বরম্।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্॥’৬৫
ঈশ্বরকে সর্বত্র সমভাবে অবস্থিত দেখিয়া তিনি আত্মা দ্বারা আত্মাকে হিংসা করেন না, সুতরাং পরম গতি লাভ করেন। এই একটি শ্লোকে অল্প কথার মধ্যে সকলের উপযোগী মুক্তির উপায় বলা হইয়াছে।
রাজপুত আপনারা প্রাচীন ভারতের গৌরবস্বরূপ। আপনাদের অবনতি হইতেই জাতীয় অবনতি আরম্ভ হইল। লুণ্ঠিত ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা ভাগ করিয়া লইবার জন্য নহে, জ্ঞানহীনগণকে জ্ঞানদানের জন্য ও পূর্বপুরুষদের পবিত্র বাসভূমির প্রনষ্ট গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য যদি ক্ষত্রিয়দের বংশধরগণ ব্রাহ্মণের বংশধরগণের সহিত সমবেত চেষ্টায় বদ্ধপরিকর হন, তবেই ভারতের উন্নতি সম্ভব।
আর কে বলিতে পারে, ইহা শুভ মুহূর্ত নহে? কালচক্র আবার ঘুরিয়া আসিতেছে, পুনর্বার ভারত হইতে সেই শক্তিপ্রবাহ বাহির হইয়াছে, যাহা অনতিদূরকালমধ্যে নিশ্চয়ই জগতের দূরতম প্রান্তে পৌঁছিবে। এক মহাবাণী উচ্চারিত হইয়াছে, যাহার প্রতিধ্বনি প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, প্রতিদিনই যাহা অধিক হইতে অধিকতর শক্তিসংগ্রহ করিতেছে, আর এই বাণী পূর্ববর্তী সকল বাণী হইতেই অধিকতর শক্তিশালী, কারণ ইহা পূর্ববর্তী বাণীগুলির সমষ্টিস্বরূপ। যে বাণী একদিন সরস্বতীতীরে ঋষিগণের নিকট প্রকাশিত হইয়াছিল, যাহার প্রতিধ্বনি নগরাজ হিমালয়ের চূড়ায় চূড়ায় প্রতিধ্বনিত হইতে হইতে কৃষ্ণ বুদ্ধ ও চৈতন্যের ভিতর দিয়া সমতল প্রদেশে নামিয়া সমগ্র দেশ প্লাবিত করিয়াছিল, তাহাই আবার উচ্চারিত হইয়াছে। আবার দ্বার উদ্ঘাটিত হইয়াছে!
আর হে প্রিয় মহারাজ, আপনি সেই (ক্ষত্রিয়) জাতির বংশধর, যাঁহারা সনাতন ধর্মের জীবন্ত স্তম্ভস্বরূপ, অঙ্গীকারবদ্ধ রক্ষক ও সাহায্যকারী; আপনি রাম ও কৃষ্ণের বংশধর। আপনি কি এই কর্তব্য পালন না করিয়া দূরে থাকিবেন? আমি জানি, তাহা কখনই হইতে পারে না। আমার নিশ্চয় ধারণা, পুনরায় ধর্মের সাহায্যে আপনারই হস্ত প্রথমে প্রসারিত হইবে। হে রাজা অজিত সিং, যখনই আমি আপনার কথা ভাবি—যাঁহার মধ্যে আপনাদের বংশের সর্বজনবিদিত বৈজ্ঞানিক শিক্ষার সহিত এমন পবিত্র চরিত্র (যাহা থাকিলে একজন সাধুও গৌরবান্বিত হইতে পারেন) এবং সকল মানবের জন্য অসীম প্রেম যুক্ত হইয়াছে—যখন এইরূপ ব্যক্তিগণ সনাতন ধর্মের পুনর্গঠনে ইচ্ছুক, তখন আমি ইহার মহাগৌরবময় পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাসী না হইয়া থাকিতে পারি না।
চিরকালের জন্য আপনার উপর ও আপনার স্বজনগণের উপর শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ বর্ষিত হউক, আর আপনি পরের হিতের জন্য ও সত্যপ্রচারের জন্য দীর্ঘকাল জীবিত থাকুন, ইহাই সর্বদা বিবেকানন্দের প্রার্থনা।
…………………………..
১৮১*
[কলিকাতার জনৈক ব্যক্তিকে লিখিত]
আমেরিকা
২ মে, ১৮৯৫
প্রিয়,
তোমার সহৃদয় সুন্দর পত্রখানি পাইয়া বড়ই আনন্দিত হইলাম। তুমি যে আমাদের কার্য সাদরে অনুমোদন করিয়াছ, সেজন্য তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ। নাগমহাশয় একজন মহাপুরুষ। এরূপ মহাত্মার দয়া যখন তুমি পাইয়াছ, তখন তুমি অতি সৌভাগ্যবান। এই জগতে মহাপুরুষের কৃপালাভই জীবের সর্বোচ্চ সৌভাগ্য। তুমি এই সৌভাগ্যের অধিকারী হইয়াছ। ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’,৬৬ তুমি যখন তাঁহার৬৭ একজন শিষ্যকে তোমার জীবনের পথপ্রদর্শকরূপে পাইয়াছ, তখন তুমি তাঁহাকেই পাইয়াছ জানিবে।
প্রেমে মানুষে মানুষে, আর্যে ম্লেচ্ছে, ব্রাহ্মণে চণ্ডালে, এমন কি—পুরুষে নারীতে পর্যন্ত ভেদ করে না। প্রেম সমগ্র বিশ্বকে আপনার গৃহসদৃশ করিয়া লয়। যথার্থ উন্নতি ধীরে ধীরে হয়, কিন্তু নিশ্চিতভাবে। যে-সকল যুবক ভারতের নিম্নশ্রেণীর উন্নয়নরূপ একমাত্র কর্তব্যে মনপ্রাণ নিয়োগ করিতে পারে, তাহাদের মধ্যে কাজ কর, তাহাদিগকে জাগাও—সঙ্ঘবদ্ধ কর এবং এই ত্যাগ-মন্ত্রে দীক্ষিত কর। এ-কাজ ভারতের যুবকগণের উপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করিতেছে।
সকল বিষয়ে আজ্ঞাবহতা শিক্ষা কর; নিজ ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করিও না, গুরুজনের অধীন হইয়া চলা ব্যতীত কখনই শক্তির কেন্দ্রীকরণ হইতে পারে না, আর এইরূপ বিচ্ছিন্ন শক্তিগুলিকে কেন্দ্রীভূত না করিলে কোন বড় কাজ হইতে পারে না। কলিকাতার মঠটি প্রধান কেন্দ্র। অন্যান্য সকল শাখার সভ্যদের উচিত এই কেন্দ্রের সহিত একযোগে ও নিয়মানুসারে কার্য করা।
ঈর্ষা ও অহংভাব তাড়াইয়া দাও—সঙ্ঘবদ্ধভাবে অপরের জন্য কাজ করিতে শিখ। আমাদের দেশে এইটির বিশেষ অভাব।
শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
পুঃ—নাগমহাশয়কে আমার অসংখ্য সাষ্টাঙ্গ জানাইবে।
বি
…………………………..
১৮২
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
৫ মে, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
যা ভেবেছিলাম, তাই হয়েছে। যদিও অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার তাঁর হিন্দুধর্মবিষয়ক রচনাসমূহের শেষভাগে ক্ষতিকর একটি মন্তব্য না দিয়ে ক্ষান্ত হন না, আমার তবু সর্বদাই মনে হত, কালে সমগ্র তত্ত্বই তিনি বুঝতে পারবেন। যত শীঘ্র পার, ‘বেদান্তবাদ’ (Vedantism) নামে তাঁর শেষ বইখানা সংগ্রহ কর। বইখানিতে দেখবে তিনি সবই সাগ্রহে গ্রহণ করেছেন—মায় জন্মান্তরবাদ।
আমি তোমাদের এ যাবৎ যা বলেছি, তারই কিছু অংশ এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ; বইখানি তোমার মোটেই দুরূহ বলে মনে হবে না।
অনেক বিষয়ে দেখবে চিকাগোয় আমি যা সব বলেছি, তারই আভাস।
বৃদ্ধ যে সত্য বস্তু ধরতে পেরেছেন—এতে আমি এখন আনন্দিত। কারণ আধুনিক গবেষণা ও বিজ্ঞানের বিরোধিতার মুখে ধর্ম অনুভব করবার এই হল একমাত্র পথ।
আশা করি, টড্-এর ‘রাজস্থান’ ভাল লাগছে। আন্তরিক ভালবাসা জেনো। ইতি
তোমাদের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পুঃ—মেরী কবে বোষ্টনে আসছে?
—বি
…………………………..
১৮৩*
[মিঃ ফ্রান্সিস লেগেটকে লিখিত]
আমেরিকা
৬ মে, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আজ প্রাতে তোমার শেষ চিঠিখানা এবং রামানুজাচার্যের ভাষ্যের প্রথম ভাগ পেলাম। কয়েকদিন আগে তোমার আর একখানা পত্র পেয়েছিলাম। মণি আয়ারের কাছ থেকেও একখানা পত্র পেয়েছি।
আমি ভাল আছি—কাজকর্ম আগের মতই চলছে। তুমি লাণ্ড বলে একজনের বক্তৃতার কথা লিখেছ; তিনি কে এবং কোথায় থাকেন, তার কিছুই জানি না। হতে পারে তিনি কোন গীর্জার বক্তা। কারণ তিনি যদি বড় বড় সভায় বক্তৃতা দিতেন, তাহলে আমরা নিশ্চয় তাঁর কথা শুনতে পেতাম। হতে পারে তিনি কোন কোন খবরের কাগজে তাঁর বক্তৃতার রিপোর্ট বার করে ভারতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, আর মিশনরীরা তাঁর সাহায্যে নিজেদের ব্যবসা জমাবার চেষ্টা করছে। তোমার চিঠি থেকে তো আমি এই পর্যন্ত অনুমান করছি। এখানে এই ব্যাপারটা নিয়ে সাধারণের ভেতর এমন কিছু সাড়া পড়েনি, যাতে আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে। কারণ তাহলে এখানে প্রত্যহ আমাকে শত শত লোকের সঙ্গে লড়াই করতে হয়।
এখন এখানে ভারতের খুব সুনাম, এবং ডাঃ ব্যারোজ ও অন্যান্য গোঁড়ারা সবাই মিলে এই আগুন নেভাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয়তঃ ভারতের বিরুদ্ধে গোঁড়াদের এই বক্তৃতাগুলিতে আমার প্রতি রাশি রাশি গালিগালাজ থাকা চাই-ই। … সন্ন্যাসী হয়ে আমাকে কি সেগুলির বিরুদ্ধে ক্রমাগত আত্মসমর্থন করে যেতে হবে? এখানে আমার কয়েকজন প্রভাবশালী বন্ধু আছেন, তাঁরাই মাঝে মাঝে জবাব দিয়ে এঁদের চুপ করিয়ে দেন। আর হিন্দুরা সবাই যদি নিশ্চিন্তে ঘুমায়, তবে হিন্দুধর্ম সমর্থন করবার জন্য আমার এত শক্তি অপচয় করার দরকার কি বল? এখন এখানে ভারতের খুব সুনাম, এবং ডাঃ ব্যারোজ ও অন্যান্য গোঁড়ারা সবাই মিলে এই আগুন নেভাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয়তঃ ভারতের বিরুদ্ধে গোঁড়াদের এই বক্তৃতাগুলিতে আমার প্রতি রাশি রাশি গালিগালাজ থাকা চাই-ই। … সন্ন্যাসী হয়ে আমাকে কি সেগুলির বিরুদ্ধে ক্রমাগত আত্মসমর্থন করে যেতে হবে? এখানে আমার কয়েকজন প্রভাবশালী বন্ধু আছেন, তাঁরাই মাঝে মাঝে জবাব দিয়ে এঁদের চুপ করিয়ে দেন। আর হিন্দুরা সবাই যদি নিশ্চিন্তে ঘুমায়, তবে হিন্দুধর্ম সমর্থন করবার জন্য আমার এত শক্তি অপচয় করার দরকার কি বল?
তোমরা ত্রিশ কোটি মানুষ—বিশেষ যারা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধির অহঙ্কারে এত গর্বিত, তারা—কি করছ বল দেখি? লড়াই করবার ভারটা তোমরা নিয়ে আমাকে কেবল প্রচার ও শিক্ষার জন্য ছেড়ে দাও না কেন? এখানে আমি দিনরাত অচেনা বিদেশীদের ভেতরে থেকে প্রাণপণ সংগ্রাম করছি, প্রথমতঃ নিজের অন্নের জন্য, দ্বিতীয়তঃ—যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করে আমার ভারতীয় বন্ধুদের সাহায্য করবার জন্য। ভারত কি সাহায্য পাঠাচ্ছে বল? ভারতবাসীর মত দেশপ্রেমহীন আর কোন জাতি পৃথিবীতে আছে কি? যদি তোমরা বার জন সুশিক্ষিত দৃঢ়চেতা ব্যক্তিকে ইওরোপ-আমেরিকায় প্রচারের জন্য পাঠাতে এবং কয়েক বৎসর তাদের এখানে থাকবার খরচ যোগাতে পারতে, তাহলে তোমরা ভারতের নৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় প্রকার প্রভূত উপকার করতে পারতে। ভারতের প্রতি নৈতিক সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি রাজনৈতিক বিষয়েও ভারতের বন্ধু হয়ে দাঁড়ায়।
পাশ্চাত্যের অনেকে তোমাদিগকে অর্ধনগ্ন বর্বর জাতি মনে করে, সুতরাং ভাবে—খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের সভ্য করে তুলতে হবে। তোমরা এর বিপরীতটা প্রমাণ কর না কেন? তোমরা কুকুর-বিড়ালের মত কেবল বংশবৃদ্ধি করতে পার। … যদি তোমরা ত্রিশ কোটি লোক ভয়ে ভীত হয়ে বসে থাক, একটি কথা বলবারও সাহস না পাও, তবে এই সুদূর দেশে একটা মানুষ আর কত করবে বল? আমি তোমাদের জন্য যতটুকু করেছি, তোমরা ততটুকুরও উপযুক্ত নও। তোমরা আমেরিকার কাগজে হিন্দুধর্ম সমর্থন করে প্রবন্ধ লিখে পাঠাও না কেন? কে তোমাদের বেঁধে রেখেছে? দৈহিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক সব বিষয়ে কাপুরুষের জাত—তোমরা যেমন পশুতুল্য, তেমন ব্যবহার পাচ্ছ। কেবল দুটো জিনিষ তোমাদের লক্ষ্য—কাম ও কাঞ্চন। তোমরা একজন সন্ন্যাসীকে খুঁচিয়ে তুলে দিনরাত লড়াতে চাও, আর তোমরা নিজেরা—সাহেবদের, এমন কি মিশনরীদের ভয়ে ভীত! তোমরা আবার বড় বড় কাজ করবে—ফুঃ! কেন তোমরা কয়েকজন মিলে বেশ উত্তমরূপে হিন্দুধর্ম সমর্থন করে বোষ্টনের এরেনা পাবলিশিং কোম্পানীর কাছে লেখা পাঠাও না? ‘এরেনা’ (Arena) একখানি সাময়িক পত্র—ওরা খুব আনন্দের সঙ্গে তা ছাপাবে, আবার হয়তো পারিশ্রমিকস্বরূপ তোমাদের যথেষ্ট টাকাও দেবে। তাহলেই তো চুকে গেল।
এইটি মনে রেখো যে, এ পর্যন্ত যে-সব হতভাগা হিন্দু এই পাশ্চাত্য দেশে এসেছে, তারা অর্থ বা সম্মানের জন্য নিজের দেশ ও ধর্মের কেবল বিরুদ্ধ সমালোচনাই করেছে। তোমরা জান, আমি এখানে নাম-যশের জন্য আসিনি—আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও এসব এসে পড়েছে। ভারতে গিয়ে আমি কি করব? কে আমায় সাহায্য করবে? ভারতের কি দাসসুলভ স্বভাব বদলেছে? তোমরা ছেলেমানুষ—ছেলেমানুষের মত কথা বলছ—কিসে কি হয়, তোমরা তা জান না। মান্দ্রাজে তেমন লোক কোথায়, যারা ধর্মপ্রচারের জন্য সংসার ত্যাগ করবে? দিবারাত্র বংশবৃদ্ধি ও ঈশ্বরানুভূতি—একদিনও একসঙ্গে চলতে পারে না। আমিই একা সাহস করে নিজের দেশকে সমর্থন করছি; হিন্দুদের কাছ থেকে এরা যা আশাই করেনি, তাই আমি এদের দিয়েছি … । অনেকেই আমার বিরুদ্ধে, কিন্তু আমি কখনও তোমাদের মত কাপুরুষ হব না। আমি কাজ করতে করতেই মরব—পালাব না। কিন্তু এই দেশে হাজার হাজার লোক রয়েছে, যারা আমার বন্ধু এবং শত শত ব্যক্তি রয়েছে, যারা মৃত্যু পর্যন্ত আমার অনুসরণ করবে; প্রতি বৎসরই এদের সংখ্যা বাড়বে। আর যদি এখানে আমি তাদের সঙ্গে থেকে কাজ করি, তবে আমার ধর্মের আদর্শ—জীবনের আদর্শ সফল হবে, বুঝলে?
আমেরিকায় যে সর্বজনীন মন্দির (Temple Universal) স্থাপিত হবার কথা উঠেছিল, সে সম্বন্ধে আর বড় উচ্চবাচ্য শুনতে পাই না। তবে মার্কিন জীবনের কেন্দ্রস্বরূপ নিউ ইয়র্কে আমার প্রতিষ্ঠা দৃঢ় হয়েছে, এখানে আমার কাজ চলতে থাকবে। আমি আমার শিষ্যদের যোগ, ভক্তি ও জ্ঞান শিক্ষার সমাপ্তির জন্য একটি গ্রীষ্মাবাসে নির্জন স্থানে নিয়ে যাচ্ছি—যাতে তারা কাজ চালিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে।
যা হোক, বৎস, আমি তোমাদের যথেষ্ট তিরস্কার করেছি। তোমাদের তিরস্কার করা দরকার ছিল। এখন কাজে লাগ—কাগজখানার জন্য এখন উঠে পড়ে লাগ। আমি কলিকাতায় কিছু টাকা পাঠিয়েছি; মাসখানেকের ভেতর কাগজটার জন্য তোমাদের কাছেও কিছু টাকা পাঠাতে পারব। এখন অবশ্য অল্পই পাঠাব, পরে নিয়মিতরূপে কিছু কিছু পাঠাতে পারব। এখন কাজে লাগ। হিন্দু ভিখারীদের কাছে আর ভিক্ষা করতে যেও না। আমি নিজের মস্তিষ্ক এবং সবল দক্ষিণ বাহুর সাহায্যে নিজেই সব করব। এখানে বা ভারতে আমি কারও সাহায্য চাই না। কলিকাতা ও মান্দ্রাজ দু-জায়গায় কাজের জন্য যা টাকা দরকার, তা আমি নিজেই রোজগার করব। … রামকৃষ্ণকে অবতার বলে মানবার জন্য লোককে বেশী পীড়াপীড়ি করো না।
এখন তোমাদের কাছে আমার নূতন আবিষ্কারের কথা বলছি। ধর্মের যা কিছু সব বেদান্তের মধ্যেই আছে, অর্থাৎ বেদান্তদর্শনের দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও অদ্বৈত—এই তিনটি স্তরে আছে, একটির পর একটি এসে থাকে। এই তিনটি মানবের আধ্যাত্মিক উন্নতির তিনটি ভূমিকা। এদের প্রত্যেকটিরই প্রয়োজন আছে। এই হল ধর্মের সারকথা। ভারতের বিভিন্ন জাতির আচার-ব্যবহার মত ও বিশ্বাসে প্রয়োগের ফলে বেদান্ত যে রূপ নিয়েছে, সেইটি হচ্ছে হিন্দুধর্ম; এর প্রথম স্তর অর্থাৎ দ্বৈতবাদ—ইওরোপীয় জাতিগুলির ভাবের ভেতর দিয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে খ্রীষ্টধর্ম, আর সেমেটিক জাতিদের ভেতর হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলমান ধর্ম; অদ্বৈতবাদ উহার যোগানুভূতির আকারে হয়ে দাঁড়িয়েছে বৌদ্ধধর্ম প্রভৃতি। এখন ‘ধর্ম’ বলতে বুঝায় বেদান্ত। বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন প্রয়োজন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং অন্যান্য অবস্থা অনুসারে তার প্রয়োগ অবশ্যই বিভিন্ন হবে।
তোমরা দেখতে পাবে যে, মূল দার্শনিক তত্ত্ব যদিও এক, তবু শাক্ত শৈব প্রভৃতি প্রত্যেকেই নিজ নিজ বিশেষ ধর্মমত ও অনুষ্ঠান-পদ্ধতির ভেতর তাকে রূপায়িত করে নিয়েছে। এখন তোমাদের কাগজে এই তিন ‘বাদ’ সম্বন্ধে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ লিখে ওদের মধ্যে একটি অপরটির পর আসে, এইভাবে সামঞ্জস্য দেখাও—আর আনুষ্ঠানিক ভাবটা একেবারে বাদ দাও। অর্থাৎ দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক দিকটাই প্রচার কর; লোকে সেগুলি তাদের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকলাপাদিতে লাগিয়ে নিক। আমি এ বিষয়ে একখানি বই লিখতে চাই—সেজন্য সব ভাষ্যগুলি চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার কাছে এ পর্যন্ত কেবল রামানুজ-ভাষ্যের একখণ্ড মাত্র এসেছে।
আমেরিকান থিওসফিষ্টরা অন্য থিওসফিষ্টদের দল ছেড়ে দিয়েছে …। ইংলণ্ডের স্টার্ডি সাহেব সম্প্রতি ভারতে গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে আমার গুরুভ্রাতা শিবানন্দের সাক্ষাৎ হয়েছিল; তিনি আমাকে এক পত্র লিখে জানতে চেয়েছেন, কবে আমি ইংলণ্ডে যাচ্ছি। তাঁকে একখানি সুন্দর পত্র লিখেছি। বাবু অক্ষয়কুমার ঘোষের খবর কি? আমি তাঁর কাছ থেকে আর কোন খবর পাইনি। মিশনরীগণকে ও অপরাপর সকলকে তাদের যা প্রাপ্য, দিয়ে দাও। আমাদের দেশের কতকগুলি বেশ দৃঢ়চেতা লোককে ধর—ভারতে বর্তমানে ধর্মের নবজাগরণ সম্বন্ধে বেশ সুন্দর ওজস্বী অথচ সুরুচিসঙ্গত একটা প্রবন্ধ লেখ আর সেটি আমেরিকার কোন সাময়িক পত্রে পাঠিয়ে দাও। আমার ঐরকম দু-একখানা কাগজের সঙ্গে জানাশোনা আছে। তোমরা তো জান, আমি বিশেষ লিখিয়ে নই; আর লোকের দোরে দোরে ঘুরে বেড়ানর অভ্যাসও আমার নেই। আমি চুপচাপ বসে থাকি, আর যা কিছু আসবার আমার কাছে আসে—তার জন্য আমি বিশেষ চেষ্টা করি না। নিউ ইয়র্ক থেকে Metaphysical Magazine বলে একখানা নূতন দার্শনিক পত্রিকা বের হয়েছে—ওখানা বেশ ভাল কাগজ। পল কেরসের কাগজটা মন্দ নয়, তবে ওর গ্রাহকসংখ্যা বড় কম। বৎসগণ! আমি যদি কপট বিষয়ী হতাম, তবে এখানকার কাজ সংগঠিত করে খুব সাফল্য অর্জন করতে পারতাম। হায়, এখানে ধর্ম বলতে তার বেশী কিছু বুঝায় না। টাকার সঙ্গে নাম- যশ—এই হল ধর্মযাজক; আর টাকার সঙ্গে কাম যোগ দিলে হল সাধারণ গৃহস্থ।
আমাকে এখানে একদল নূতন মানুষ সৃষ্টি করতে হবে, যারা ঈশ্বরে অকপট বিশ্বাসী হবে এবং সংসারকে একেবারে গ্রাহ্য করবে না। অবশ্য এটি হবে ধীরে—অতি ধীরে। ইতোমধ্যে তোমরা কাজ করে চল, আর যদি তোমাদের ইচ্ছা থাকে এবং সাহস থাকে, তবে মিশনরীরা যা পাবার উপযুক্ত, তাদের তাই দাও। যদি আমি তাদের সঙ্গে লড়াই করতে যাই, [এখানে] আমার শিষ্যেরা চমকে যাবে। মিশনরীরা তো আর তর্ক করে না, তারা কেবল গালাগাল করে; সুতরাং ওদের সঙ্গে বিবাদ করলে আমার চলবে না। সেদিন রমাবাঈ নামক খ্রীষ্টান মহিলাটি আমার একজন বিশেষ বন্ধু অধ্যাপক জেমসের কাছ থেকে খুব জোর ধাক্কা খেয়েছেন—কাগজের সেই অংশটা তোমাকে পাঠালাম। সুতরাং তোমরা দেখছ, তারা আমার এখানকার বন্ধুবর্গের কাছ থেকে মাঝে মাঝে এইরূপ ধাক্কা খাবে, আর তোমরাও ভারতে মধ্যে মধ্যে তাদের ঐরূপ দু-চার ঘা দিতে থাক—ঐ দুটোর মধ্যে আমি আমার নৌকো সিধে চালিয়ে নিয়ে যাই।
এখন কাগজখানা কোনরূপে বার করবার খুব ঝোঁক হয়েছে আমার। এই পত্রিকায় গুরুগম্ভীর বিষয় যেন লঘুভাবে আলোচিত না হয়, এর সুর—ধীর গম্ভীর উচ্চ গ্রামে বাঁধা চাই। আমি তোমাদের টাকা পাঠাব … কাজ আরম্ভ করে দাও। আমি এখানে অনেক গ্রাহক যোগাড় করে দেব, আমি নিজে ওর জন্য প্রবন্ধ লিখব এবং সময়ে সময়ে আমেরিকান লেখকদের দিয়ে প্রবন্ধ লিখিয়ে পাঠাব। তোমরাও একদল পাকা নিয়মিত লেখক ধর। তোমার ভগিনীপতি তো একজন খুব ভাল লেখক। তারপর আমি তোমাকে জুনাগড়ের দেওয়ান হরিদাসভাই, খেতড়ির রাজা, লিমডির ঠাকুরসাহেব প্রভৃতির নামে পত্র দেব, তাঁরা কাগজটার গ্রাহক হবেন—তাহলেই ওটা খুব চলে যাবে। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ও দৃঢ়চিত্ত হও এবং কাজ করে যাও। আমরা বড় বড় কাজ করব—ভয় পেও না। এই একটি নিয়ম কর যে, কাগজের প্রত্যেক সংখ্যায় পূর্বোক্ত তিনটি ভাষ্যের মধ্যে কোন না কোন একটির খানিকটা অনুবাদ থাকবে। আর এক কথা—তুমি সকলের সেবক হও, অপরের উপর এতটুকু প্রভুত্ব করতেও চেষ্টা করো না। তাতে ঈর্ষার উদ্রেক হবে ও সব মাটি করে দেবে। কাগজের প্রথম সংখ্যাটার বাইরের চাকচিক্য যেন ভাল হয়। আমি ওর জন্য একটা প্রবন্ধ লিখব। আর ভারতে ভাল ভাল লেখকদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের বেশ ভাল ভাল প্রবন্ধ সংগ্রহ কর। তার মধ্যে একটা যেন দ্বৈত-ভাষ্যের অংশবিশেষের অনুবাদ হয়। পত্রিকার প্রচ্ছদপটে প্রবন্ধ ও লেখকদের নাম থাকবে, আর চারধারে খুব ভাল প্রবন্ধগুলির ও ওদের লেখকদের নাম থাকবে। আগামী মাসের মধ্যেই আমি প্রবন্ধ ও টাকা পাঠাচ্ছি। কাজ করে চল। তুমি এ যাবৎ চমৎকার কাজ করেছ। আমরা সাহায্যের জন্য বসে থাকব না। হে বৎস! আমরাই এটা কাজে পরিণত করব—আত্মনির্ভরশীল ও বিশ্বাসী হও, ধৈর্য ধরে থাক। আশা করি, সামান্না তোমায় কিছু সাহায্য করতে পারে। আমার অপর বন্ধুদের বিরোধিতা করো না—সকলের সঙ্গে মিলেমিশে চল। সকলকে আমার অনন্ত ভালবাসা জানিও।
সদা আশীর্বাদক
তোমাদের বিবেকানন্দ
পুঃ—‘—’ আয়ার এবং অন্যান্য ভদ্রমহোদয়গণের সহিত সকল বিষয়ে পরামর্শ করে চলবে। যদি তুমি নিজেকে নেতারূপে সামনে দাঁড় করাও, তাহলে কেউ তোমায় সাহায্য করতে আসবে না, বোধ হয় এই হচ্ছে তোমার বিফলতার কারণ।—আয়ারের নামটাই যথেষ্ট; তাঁকে যদি না পাও, অন্য কোন বড়লোককে তোমাদের নেতা কর। যদি কৃতকার্য হতে চাও, অহংটাকে আগে নাশ করে ফেল। ইতি
—বি
…………………………..
১৮৪*
54 W. 33rd Street, নিউ ইয়র্ক
৭ মে, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
মিস ফার্মারের সঙ্গে ঐ ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তি করে ফেলবার দরুন আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ। ভারতবর্ষ থেকে একখানা খবরের কাগজ পেলাম, তাতে ভারত থেকে ডাঃ ব্যারোজকে ধন্যবাদ পাঠান হয়েছিল, তার সংক্ষিপ্ত উত্তর বেরিয়েছে। মিস থার্সবি আপনাকে সেটা পাঠিয়ে দেবেন।
গতকাল মান্দ্রাজ অভিনন্দন-সভার সভাপতির কাছ থেকে আর একখানা পত্র পেলাম—তাতে তিনি মার্কিনদের ধন্যবাদ দিয়েছেন, আমাকেও একটা অভিনন্দন পাঠিয়েছেন। আমি তাঁকে আমার মান্দ্রাজী বন্ধুদের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে বলেছিলাম। এই ভদ্রলোকটি মান্দ্রাজ শহরের অধিবাসিগণের মধ্যে সর্বপ্রধান, মান্দ্রাজের প্রধান ধর্মাধিকরণের (High Court) একজন বিচারপতি—ভারতে এ একটি অতি উচ্চপদ।
আমি নিউ ইয়র্কে জনসভায় আর দুটি বক্তৃতা দেব; ‘মট্ স্মৃতি-মন্দিরের’ ওপর- তলায় এই দুটি বক্তৃতা হবে। প্রথমটি আগামী সোমবার, বিষয়—‘ধর্মবিজ্ঞান’; দ্বিতীয়টির বিষয়—‘যোগের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা’।
মিস থার্সবি প্রায় ক্লাসে আসেন। মিঃ ফ্লন এক্ষণে আমার কার্যের ওপর বিশেষ অনুরাগ দেখাচ্ছেন ও প্রসারের জন্য যত্ন নিচ্ছেন। ল্যাণ্ডস্বার্গ আসে না। আমার আশঙ্কা হয়, সে আমার ওপর খুব বিরক্ত হয়েছে। মিস হ্যামলিন কি ভারতের আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে বইখানি আপনাকে পাঠিয়েছে? আমার ইচ্ছা, আপনার ভাই বইখানি পড়ে দেখেন এবং নিজে নিজে বোঝেন—ভারতে ইংরেজ শাসন বলতে কি বুঝায়।
আপনার চিরকৃতজ্ঞ সন্তান
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৮৫*
নিউ ইয়র্ক
১৪ মে, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
বইগুলি সব নিরাপদে পৌঁছেছে। সেজন্য বহু ধন্যবাদ। শীঘ্রই তোমায় কিছু টাকা পাঠাতে পারব—খুব বেশী অবশ্য নয়, এখন কয়েক শতমাত্র; তবে যদি বেঁচে থাকি সময়ে সময়ে কিছু পাঠাব।
এখন নিউ ইয়র্কের ওপর আমার একটা প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে; আশা করছি, একদল স্থায়ী কর্মী পাব, আমি এদেশ ছেড়ে চলে গেলে তারা কাজ চালাবে। বৎস, দেখছ এইসব খবরের কাগজের হুজুগ কিছুই নয়। যখন আমি চলে যাব, তখন এখানে আমার কাজের একটা স্থায়ী দাগ রেখে যাওয়া উচিত; আর প্রভুর আশীর্বাদে তা শীঘ্রই হবে। অবশ্য টাকাকড়ির দিক দিয়ে ধরলে সফলতা হয়নি, বলতে হবে। কিন্তু জগতে সমুদয় ধনরাশির চেয়ে ‘মানুষ’ হচ্ছে বেশী মূল্যবান।
মিস হ্যামলিন আমায় যথেষ্ট সাহায্য করছেন—আমি সেজন্য তাঁর নিকট বিশেষ কৃতজ্ঞ। তিনি আমার প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করছেন—আশা করি, তাঁর ভাবের ঘরেও চুরি নাই। তিনি আমাকে ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চান—আমার ভয় হয়, পূর্বে যেমন একবার শেখান হয়েছিল, ‘নিজেকে সামলে রেখো, যার তার সঙ্গে মিশো না’—এ ব্যাপার তারই দ্বিতীয় সংস্করণ। প্রভু যাঁদের পাঠান, তাঁরাই খাঁটি লোক; আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় এই কথাই তো আমি বুঝেছি। তাঁরাই যথার্থ সাহায্য করতে পারেন, আর তাঁরাই আমাকে সাহায্য করবেন। আর অবশিষ্ট লোকদের সম্বন্ধে বক্তব্য এই, প্রভু তাদের সকলেরই কল্যাণ করুন, আর তাদের হাত থেকে আমায় রক্ষা করুন।
তুমি আমার জন্য ভেবো না—প্রভু আমায় রক্ষা করছেন। আমার এদেশে আসা, আর এত পরিশ্রম ব্যর্থ হতে দেওয়া হবে না। প্রভু দয়াময়—যদিও এমন লোক অনেক আছে, যারা—যে-কোনরূপে হোক—আমার অনিষ্ট করবার চেষ্টা করেছে; আবার এমন লোকও অনেক আছে, যারা শেষ পর্যন্ত আমার সহায়তা করবে। অনন্ত ধৈর্য, অনন্ত পবিত্রতা, অনন্ত অধ্যবসায়—এই তিনটি জিনিষ থাকলে যে-কোন সৎ আন্দোলনে অবশ্যই সফল হতে পারা যায়; এই হল সিদ্ধিলাভের রহস্য।
এই ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ কথা এখন থাক। হে আমার শিব, তুমিই আমার ভাল, তুমিই আমার মন্দ। প্রভো, বাল্যকাল থেকেই আমি তোমার চরণে শরণ নিয়েছি। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বা হিমানীমণ্ডিত মেরুপ্রদেশে, পর্বতচূড়ায় বা মহাসমুদ্রের অতল তলে—যেখানেই যাই, তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। তুমিই আমার গতি, আমার নিয়ন্তা, আমার শরণ, আমার সখা, আমার গুরু, আমার ঈশ্বর, তুমিই আমার স্বরূপ। তুমি কখনই আমায় ত্যাগ করবে না—কখনই না, এ আমি ঠিক জানি। হে আমার ঈশ্বর, আমি কখনও কখনও একলা প্রবল বাধাবিঘ্নের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়ি, তখন মানুষের সাহায্যের কথা ভাবি। চিরদিনের জন্য ওসব দুর্বলতা থেকে আমায় রক্ষা কর, যেন আমি তোমা ছাড়া আর কারও কাছে কখনও সাহায্য প্রার্থনা না করি। যদি কেউ কোন ভাল লোকের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, সে কখনও তাকে ত্যাগ করে না বা তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে না। প্রভু, তুমি সকল ভালর সৃষ্টিকর্তা—তুমি কি আমায় ত্যাগ করবে? তুমি তো জান, সারা জীবন আমি তোমার—কেবল তোমারই দাস। তুমি কি আমায় ত্যাগ করবে—যাতে অপরে আমায় ঠকিয়ে যাবে বা আমি মন্দের দিকে ঢলে পড়ব?
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৮৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
C/o Miss Mary Philips
19 W. 38th St., নিউ ইয়র্ক
২৮ মে, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এই সঙ্গে আমি একশ’ ডলার অথবা ইংরেজী মুদ্রা হিসাবে ২০ পাউণ্ড ৮ শিলিং ৭ পেন্স পাঠালাম। আশা করি, এতে তোমাদের কাগজটা বার করবার কিঞ্চিৎ সাহায্য হবে, পরে ধীরে ধীরে আরও সাহায্য করতে পারব।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
পুঃ—পত্রপাঠ নিউ ইয়র্কে উপরের ঠিকানায় প্রাপ্তিস্বীকার করবে। এখন থেকে নিউ ইয়র্ক আমার প্রধান আস্তানা। অবশেষে আমি এদেশে কিছু করে যেতে সমর্থ হলাম।
—বি
…………………………..
১৮৭*
54 W. 33rd St, নিউ ইয়র্ক
মে, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
আমি গতকাল মিস থার্সবিকে ২৫ পাউণ্ড দিয়েছি। ক্লাসগুলি চলছে বটে, কিন্তু দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি—যদিও ক্লাসে বহু ছাত্রের সমাগম হয়, তারা যা দেয়, তাতে ঘরভাড়াটাও ওঠে না। এই সপ্তাহটা চেষ্টা করে দেখব, তারপর ছেড়ে দেব।
আমি সহস্রদ্বীপোদ্যানে (Thousand Island Park) আমার ক্লাসের জনৈকা ছাত্রী মিস ডাচারের কাছে যাচ্ছি। ভারতবর্ষ থেকে বেদান্তের বিভিন্ন ভাষ্য আমার নিকট শীঘ্র পাঠান হচ্ছে। এই গ্রীষ্মে ওখানে থাকাকালে আমি ‘বেদান্তদর্শনের তিনটি বিভিন্ন সোপান’ সম্বন্ধে ইংরেজীতে একখানি বই লিখব মনে করছি; তারপর গ্রীনএকারে যেতে পারি।
মিস ফার্মার আমার কাছে জানতে চান, এই গ্রীষ্মে গ্রীনএকারে কোন্ কোন্ বিষয়ে বক্তৃতা করব, আর কোন্ সময়েই বা সেখানে যাব। আমি এর উত্তরে কি লিখব বুঝতে পাচ্ছি না। আশা করি, আপনি কৌশলে ঐ অনুরোধ কাটিয়ে দেবেন—এ বিষয়ে আপনার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করলাম।
আমি বেশ ভাল আছি—মুদ্রাকর সমিতির (Press Association) জন্য ‘অমরত্ব’ (Immortality) বিষয়ে আমার প্রতিশ্রুত একটি প্রবন্ধ লিখতে বিশেষ ব্যস্ত আছি।
আপনার অনুগত
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৮৮*
21 W. 34th St, নিউ ইয়র্ক
জুন, ১৮৯৫
প্রিয় জো,৬৮
নানা ঝড়-ঝাপটা তোমার উপর দিয়ে যাচ্ছে, দেখছি। ফলে নিশ্চয়ই আরও বহু আবরণ অপসৃত হবে।
মিঃ লেগেট তোমার ফনোগ্রাফের কথা বলছিলেন। তাঁকে কয়েকটি চোঙ (cylinders) সংগ্রহ করতে বলেছি। ‘কারও একটি ফনোগ্রাফে ঐগুলি দিয়ে কথা বলি, পরে ঐগুলি জো-কে পাঠিয়ে দি’—আমার এই কথা শুনে তিনি বললেন, ‘আমি তো একটি ফনোগ্রাফ কিনে দিতে পারি। জো যা বলে আমি তাই করি।’ তাঁর অন্তরে একটা কবিত্ব প্রচ্ছন্ন আছে দেখে সুখী হলাম।
আজ গার্নসিদের ওখানে থাকতে যাচ্ছি। ডাক্তার নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে আমাকে রোগমুক্ত করতে চান। অন্য সব পরীক্ষার পর ডাঃ গার্নসি আমার নাড়ী দেখছিলেন; এমন সময় সহসা ল্যাণ্ডস্বার্গ এসে হাজির, আমাকে দেখামাত্র সরে পড়ল। ডাক্তার গার্নসি খুব হেসে উঠে বললেন যে, ঠিক ঐ সময়ে আসার জন্য তিনি লোকটিকে পুরস্কৃত করতে ইচ্ছুক, কারণ সে আসাতে রোগটা ঠিক ঠিক নির্ণয় করা গেল। তার আসবার পূর্ব পর্যন্ত নাড়ীর স্পন্দন ঠিক ছিল, কিন্তু তাকে দেখামাত্র মানসিক উত্তেজনার ফলে স্পন্দন প্রায় থেমে গেল। নিশ্চয় হল—রোগটি স্নায়ুসংক্রান্ত। তিনিও আমাকে ডাক্তার হেল্মারের চিকিৎসাই চালাতে বললেন—জোর করে। তাঁর বিশ্বাস হেল্মার আমাকে রোগমুক্ত করবেন। লোকটি বেশ উদার।
আজই শহরে ‘পবিত্র গাভী’ (the sacred cow) দেখতে যাবার ইচ্ছা। নিউ ইয়র্কে আর দিন-কয়েক আছি। হেল্মার বলেছেন, সপ্তাহে তিনবার করে চার সপ্তাহ, তার পর দু-বার করে আর চার সপ্তাহ চিকিৎসা করালেই সম্পূর্ণ সুস্থ হব। যদি ইতোমধ্যে বোষ্টনে যাই, তিনি ওখানকার এক ওস্তাদ চিকিৎসককে আবশ্যকমত নির্দেশ দেবেন।
ল্যাণ্ডস্বার্গের সঙ্গে সামান্য মিষ্টালাপের পর বেচারীকে অব্যাহতি দেবার জন্য— উপরতলায় মাদার গার্নসির নিকট চলে গেলাম। ইতি
সতত প্রভুপদে তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৮৯
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
১৮৯৫
কল্যাণবরেষু,
তোমাদের এক পত্রে অনেক সমাচার জ্ঞাত হইলাম। তবে সকলের বিশেষ সমাচার লিখ নাই। নিরঞ্জনের এক পত্র মধ্যে পাই—সে সিলোন যাইতেছে সংবাদ পাই। সারদা যাহা করিতেছে, তাহাই আমার অভিমত; তবে ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস অবতার’ ইত্যাদি প্রচার করিবার আবশ্যক নাই। তিনি পরোপকার করিতে আসিয়াছিলেন, নিজের নাম ঘোষণা করিতে নহে। চেলারা গুরুর নাম করে; গুরু যা শেখাতে এসেছিলেন, তাতে জলাঞ্জলি দেয়, আর দলাদলি ইত্যাদি তার ফল।
আলাসিঙ্গা লিখেছে চারুবাবুর বিষয়। আমি তাঁহাকে স্মরণ করিতেছি না। চারুবাবুর বিষয় সবিশেষ লিখিবে ও তাঁহাকে আমার ধন্যবাদ দিবে। সকলের বিষয় বিশেষ করিয়া লিখিবে—বৃথা বার্তা করিবার সময় কুলায় না। আমার জীবনে বোধ হয় কারুর সহিত ঠাট্টা-বটকেরা করার অপেক্ষা অনেক কার্য আছে।
কর্মকাণ্ড ত্যাগ করিবার চেষ্টা করিবে; ঘণ্টা নাড়া সন্ন্যাসীর নহে এবং যাবৎ জ্ঞান না হয়, তাবৎ কর্ম। আমিই ঐ অনর্থের মূল। এক্ষণে দেখিতেছি যে, ঐ ঘণ্টা-পত্র লইয়া রামকৃষ্ণ-অবতারের দল বাঁধিবে এবং তাঁহার শিক্ষায় ধূলি নিক্ষেপ হইবে। তোমরা ঘণ্টা ত্যাগ করিতে পার ভালই, নচেৎ আমি তোমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারিব না। দলাদলি, দলবাঁধা, কূপমণ্ডুকের মধ্যে আমি নাই, আর যেথায় আমি থাকি। ইতি
‘—’ থিওসফিষ্ট হইয়াছেন, ভালই, রুচীনাং বৈচিত্র্যং! মঙ্গলমস্তু তেষাং, কিমহংব্রবীমি (রুচির বৈচিত্র্য! তাদের মঙ্গল হউক, আমি আর কি বলিব)? Universal brotherhood (সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব), বেশ কথা—শিবাঃ বঃ সন্তু পন্থানঃ। তার চেয়ে সুখের বিষয় কি আছে? … রামকৃষ্ণ পরমহংসের উদারভাব প্রচার করে আবার দলবাঁধা কেমন করে হয়? দলের বীজ হচ্ছে ঐ ঘণ্টা-পত্র। আমি হাজারবার ঠুকেছি, এবারও ঠুকলাম—ফলে কিছু হয় না। আমার নামে যদি তোমাদের দলবাঁধার সহায়তা হয়, তাহলেই আমি লীডার (নেতা) বটি, নইলে আমি কেউ নই! এই সত্য বটে! আমি ওতে নাই। আমি যে রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য এবং তোমরাও যে তাই, এইটি বই লিখে ছাপাতে যত্ন তো যথেষ্ট হয়েছে; কিন্তু আমি যে আজ ৬ বৎসর ঘণ্টা-পত্র ত্যাগ করার জন্য বলছি, তাতে কারুর কান পাতা নাই। … আমি একমাত্র কর্ম বুঝি—পরোপকার, বাকী সমস্ত কুকর্ম। তাই শ্রীবুদ্ধদেবের পদানত হই। বুঝতে পারছ? … ফল কথা—আমি বৈদান্তিক; সচ্চিদানন্দ আমার নিজের আত্মার মহান্ রূপ ছাড়া অন্য ঈশ্বর বড় একটা দেখতে পাচ্ছি না। অবতার মানে—যাঁহারা সেই ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন, অর্থাৎ জীবন্মুক্ত। অবতারবিশেষত্ব আমি দেখিতে পাইতেছি না। ব্রহ্মাদিস্তম্ব পর্যন্ত সমস্ত প্রাণী কালে জীবন্মুক্তি প্রাপ্ত হবে এবং আমাদের উচিত সকলের সেই অবস্থা পেতে সহায় হওয়া। এই সহায়তার নাম ধর্ম, বাকী অধর্ম। এই সহায়তার নাম কর্ম, বাকী কুকর্ম; আর আমি কিছুই দেখছি না। অন্যবিধ তান্ত্রিক বা বৈদিক কর্মে ফল থাকিতে পারে, কিন্তু তদবলন্বন কেবল বৃথা জীবনক্ষয়—কারণ কর্মের ফল যে পবিত্রতা, তাহা কেবল পরোপকার মাত্রে ঘটে। যজ্ঞাদি কর্মের ভোগাদি সম্ভব, আত্মার পবিত্রতা অসম্ভব। অতএব সন্ন্যাস অবলম্বন করে, জীবকে উচ্চগতি শিক্ষা না দিয়ে পুনঃ- পুনঃ অনর্থকর কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করা আমার মতে দূষণীয়। মূর্খ গৃহস্থ কর্মপর হউক, তাতে ক্ষতি নাই; কিন্তু ত্যাগী!! … সমস্তই প্রত্যেকের আত্মার বর্তমান। যে বলে আমি মুক্ত, সেই মুক্ত হবে। যে বলে আমি বদ্ধ, সে বদ্ধ হবে। দীন হীন ভাব আমার মতে পাপ এবং অজ্ঞতা। ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’।৬৯ ‘অস্তি ব্রহ্ম বদসি চেদস্তি ভবিষ্যসি, নাস্তি ব্রহ্ম বদসি চেৎ নাস্ত্যেব ভবিষ্যসি’।৭০ যে সদা আপনাকে দুর্বল ভাবে, সে কোন কালে বলবান্ হইবে না; যে আপনাকে সিংহ জানে, সে ‘নির্গচ্ছতি জগজ্জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী’।৭১ দ্বিতীয়তঃ রামকৃষ্ণ পরমহংস কোন নূতন তত্ত্ব প্রচার করিতে আইসেন নাই—প্রকাশ করিতে আসিয়াছিলেন বটে, অর্থাৎ He was the embodiment of all past religious thoughts of India. His life alone made me understand what the Shastras really meant, and the whole plan and scope of the old Shastras.৭২
মিশনরী-ফিশনরী এদেশে বড় চলল না। এরা ঈশ্বরেচ্ছায় আমায় খুব ভালবাসে, কারুর কথায় ভোলবার নয়। এরা আমার ideas (ভাব) যেমন বোঝে, আমার দেশের লোক তেমন পারে না, এবং এরা বড় স্বার্থপর নয়। অর্থাৎ ঐ jealousy (ঈর্ষা) আর হামবড়া ভাবগুলো এরা কাজের বেলা দূর করে দেয়, তখন সকলে মিলে একজন কাজের লোকের কথামত চলে। তাতেই এরা এত বড়। তবে এরা হচ্ছে টাকা-দেবতার জাত, সকল কথায় পয়সা; আমাদের দেশের লোক টাকার বিষয়ে বড় উদার, এরা তত নয়। কৃপণ ঘরে ঘরে। ওটি ধর্মের মধ্যে। তবে দুষ্কর্ম করলে পর পাদ্রীদের হাতে পড়ে। তখন টাকা দিয়ে স্বর্গে যায়! এগুলো সব দেশেই সমান—priestcraft (পুরোহিতদের তুকতাক)।
আমি কবে দেশে যাব, কি না যাব, কিছুই বলতে পারি না। এখানে ঘুরে বেড়ান, সেখানেও তাই। তবে এখানে হাজারো লোক আমার কথা শোনে, বোঝে—হাজারো লোকের উপকার হয়; সেখানে কি?
রামকৃষ্ণ পরমহংসের বিষয় মজুমদার যা লিখেছিল, আমি খালি তাই চাহিয়াছিলাম। তা না হয়ে কতকগুলো জার্মান ছেঁড়া পুঁথি পাঠিয়ে দিয়েছ, আর তার মধ্যে দুখানা আমার লেকচার; কি আপদ!!
সারদা যা করছে, তা আমার সম্পূর্ণ অভিমত। তাকে আমার শত শত ধন্যবাদ। বলি, তোমরা যা কিছু করছ, আমি বুঝতে পারি না। … যা হোক, মান্দ্রাজ ও বোম্বেতে আমার মনের মত লোক আছে। তারা বিদ্বান্ এবং সকল কথা বোঝে এবং তারা দয়াল; অতএব পরহিতচিকীর্ষা বুঝিতে পারে। কিমধিকমিতি।
মা-ঠাকুরাণীকে আমার শত শত দণ্ডবৎ দিবে এবং সকলকে আমার যথাযোগ্য সম্ভাষণ দিবে। আমি বই-টই কিছু ছাপাই নাই। এখানে লেকচার করে বেড়াই মাত্র। গুপ্ত, তুলসী প্রভৃতির বিষয় কিছুই লেখ নাই কেন? কালী কি করছে? শরৎ, যোগেন সেরে গেছে কিনা? আমার জীবনের প্রতি দেখে [তাকালে] আমার আপসোস হয় না। দেশে দেশে কিছু না কিছু লোকশিক্ষা দিয়ে বেড়িয়েছি, তার বদলে রুটির টুকরো খেয়েছি। যদি দেখতুম যে, কোন কাজ করিনি, কেবল লোক ঠকিয়ে খেয়েছি, তাহলে আজ গলায় দড়ি দিয়ে মরতুম।
সারদাকে আমায় একটা চিঠি লিখতে বলবে। তার সঙ্গে আমার মত মিলবে বোধ হয়। … আমি রামকৃষ্ণ পরমহংসের চেলা নই, আমি কারুর চেলাপত্র নই ইতি; আমি সারদার চেলা। যারা আমার মনের মত কার্য করবে, আমি তাদের চেলা। যারা তা না করবে, তাদের কোন খবর আমি চাই না, আমার কোন খবর তাদের জন্য নাই। ইতি
নরেন্দ্র
…………………………..
১৯০*
পার্সি, নিউ হ্যাম্পসায়ার
৭ জুন, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
অবশেষে আমি এখানে মিঃ লেগেটের কাছে এসে পৌঁছেছি। আমি জীবনে যে-সকল সুন্দরতম স্থান দেখেছি, এটি তাদের অন্যতম। কল্পনা করুন, চতুর্দিকে প্রকাণ্ড বনের দ্বারা আচ্ছাদিত পর্বতশ্রেণী ও তার মধ্যে একটি হ্রদ—আর সেখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। কি মনোরম, কি নিস্তব্ধ, কি শান্তিপূর্ণ! শহরের কোলাহলের পর, আমি যে এখানে কি আনন্দ পাচ্ছি, তা আপনি সহজেই অনুমান করতে পারেন।
এখানে এসে আমি যেন নবজীবন লাভ করেছি। আমি একলা বনের মধ্যে যাই, আমার গীতাখানি পাঠ করি এবং বেশ সুখেই আছি। দিন দশেকের মধ্যে এ স্থান ত্যাগ করে সহস্রদ্বীপোদ্যানে (Thousand Island Park) যাব। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন ভগবানের ধ্যান করব এবং একলা নির্জনে থাকব। এই কল্পনাটাই মনকে উঁচু করে দেয়।
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৯১*
[ভূর্জপত্রে মিস মেরী হেলকে লিখিত]
পার্সি, N.H.
১৭ জুন, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
আগামীকাল৭৩ যাচ্ছি সহস্রদ্বীপোদ্যানে। ঠিকানা—C/o Miss Dutcher, Thousand Island Park, N.Y. তুমি এখন কোথায় আছ? গ্রীষ্মের সময় তোমরা সব কোথায় থাকবে? অগষ্ট মাসে আমার ইওরোপে যাবার সম্ভাবনা আছে। যাবার আগে তোমাদের সঙ্গে দেখা করব। সুতরাং পত্র দিও। তাছাড়া ভারত হতে কতকগুলি বই ও চিঠি আসবার কথা। অনুগ্রহ করে সেগুলো মিস ফিলিপসের ঠিকানায়—নিউ ইয়র্কে পাঠিয়ে দিও। ভারতবর্ষে যাবতীয় পবিত্র লিপি এই ভূর্জপত্রে লেখা হয়। আমিও সংস্কৃতে লিখলামঃ উমাপতি (শিব) সর্বদা তোমাকে রক্ষা করুন।
তোমরা সকলে অনন্তকাল সুখে থাক।
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৯২*
[মিঃ লেগেটকে লিখিত]
Thousand Island Park, N.Y.
C/o Miss Dutcher ১৮ জুন, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
রওনা হবার পূর্বদিন মিসেস স্টার্জিস্-এর এক চিঠি পেয়েছি, ৫০ ডলারের একখানা চেকও সঙ্গে আছে। পরদিনই তাঁর কাছে প্রাপ্তিস্বীকার পৌঁছিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তোমাকে অনুরোধ করছি, তুমি এর পর যখন তাঁকে চিঠি লিখবে, তখন আমার ধন্যবাদ ও প্রাপ্তিস্বীকারটা তাঁকে জানিয়ে দিও।
প্রাচীন হিন্দু প্রবচন ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’-ছাড়া এখানে বেশ সময় কাটছে। একই কথা, আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। অগষ্টের প্রথম ভাগে চিকাগো যাচ্ছি। তুমি কখন রওনা হচ্ছ?
এখানকার বন্ধুরা সকলেই তোমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। তোমার সর্বাঙ্গীণ সুখ শান্তি ও স্বাস্থ্য কামনা করি।
তোমার স্নেহের
বিবেকানন্দ
…………………………..
১৯৩*
54 W. 33rd St., নিউ ইয়র্ক
জুন, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
আমি এইমাত্র এখানে পৌঁছলাম। এই অল্প ভ্রমণে আমার উপকার হয়েছে। সেখানকার পল্লী ও পাহাড়গুলি—বিশেষতঃ মিঃ লেগেটের নিউ ইয়র্ক প্রদেশের পল্লীভবনটি আমার খুব ভাল লেগেছিল।
ল্যাণ্ডস্বার্গ বেচারী এই থেকে চলে গিয়েছে। সে তার ঠিকানা পর্যন্ত আমাকে জানিয়ে যায়নি। সে যেখানেই যাক, ভগবান্ তার মঙ্গল করুন। আমি জীবনে যে দু-চারজন অকপট লোক দেখবার সৌভাগ্য লাভ করেছি, সে তাদেরই মধ্যে একজন।
যা কিছু ঘটে, সবই ভালর জন্য। সকল প্রকার মিলনের পরেই বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। আশা করি, আমি একাই সুন্দর কাজ করতে পারব। মানুষের কাছ থেকে যত কম সাহায্য নেওয়া যাবে, ভগবানের কাছ থেকে তত বেশী সাহায্য পাওয়া যাবে। এইমাত্র আমি লণ্ডনস্থ জনৈক ইংরেজের একখানি পত্র পেলাম—তিনি আমার দুইজন গুরুভাইয়ের সঙ্গে কিছুদিন ভারতবর্ষের হিমালয় প্রদেশে বাস করেছিলেন। তিনি আমায় লণ্ডনে যেতে বলছেন। আপনাকে চিঠি লেখার পর, আমার ছাত্রেরা খুব সাহায্য করছে এবং এখন যে ক্লাসগুলি খুব ভালভাবে চলবে, তাতে সন্দেহ নাই। আমি এতে খুব আনন্দিত হয়েছি, কারণ খাওয়া-দাওয়ার বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মত শিক্ষাদান করাটা আমার জীবনে একটা অত্যাবশ্যক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুঃ—‘—’ সম্বন্ধে ‘বর্ডারল্যাণ্ড’ নামক ইংরেজী সংবাদপত্রে অনেক বিষয় পড়লাম। তিনি হিন্দুদিগকে তাদের নিজ ধর্মের গুণগুলি গ্রহণ করতে শিখিয়ে ভারতবর্ষে যথার্থই সৎকার্য করেছেন। … উক্ত মহিলার লেখা পড়ে তার মধ্যে কোনরূপ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেলাম না, … কিম্বা কোনরূপ আধ্যাত্মিক ভাবও পেলাম না। যা হোক, যে-কেউ জগতের উপকার করতে চায়, ভগবান্ তারই সহায় হউন।
এই জগৎ কত সহজেই না বুজরুকদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে থাকে! আর সভ্যতার প্রথম উন্মেষের সময় থেকে বেচারা মানুষকে নিরীহ পেয়ে তার উপর কত প্রবঞ্চনাই না চলেছে!
আপনার স্নেহের
তোমাদের বিবেকানন্দ
…………………………..
১৯৪*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
54 W. 33rd Street, নিউ ইয়র্ক
২২ [?] জুন, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
ভারত থেকে প্রেরিত পত্রগুলি ও বই-এর পার্সেল নির্বিঘ্নে পৌঁছেছে। মিঃ স্যামের আগমন-সংবাদে আমি খুবই আনন্দিত। একদিন রাস্তায় মিঃ স্যামের এক বন্ধুর সহিত দেখা হয়। ভদ্রলোক ইংরেজ; বেশ লোক। বললেন, ওহিওর কোন স্থানে মিঃ স্যামের সঙ্গে এক বাড়ীতে আছেন।
আমার দিনগুলো আগের মতই প্রায় একভাবে চলেছে। অবসরমত হয় অনর্গল বকছি, নয়তো একদম চুপচাপ। এ গ্রীষ্মে গ্রীনএকার যাওয়া হয়ে উঠবে কিনা জানি না। সেদিন মিস ফার্মারের সহিত দেখা করি; তখন তিনি স্থানান্তরে যেতে খুব ব্যস্ত, সুতরাং বাক্যালাপ অতি অল্পই হয়। তিনি একজন মহীয়সী নারী।
ক্রিশ্চান সায়ান্সের চর্চা কেমন চলছে? আশা করি তুমি গ্রীনএকার যাচ্ছ। সেখানে ওই দলের ও ভূতুড়েদের (spiritualists) অনেককে দেখবে, তাছাড়া দেখবে হস্তরেখাবিচারক, জ্যোতিষী, আরও কত কি! মিস ফার্মারের নেতৃত্বে সেখানে মিলবে রোগের যাবতীয় প্রতিকার ও ধর্মবিষয়ক যাবতীয় মতবাদ।
ল্যাণ্ডস্বার্গ অন্যত্র চলে গেছে। আমি একাই আছি। আজকাল দুধ, ফল, বাদাম—এইসব আমার আহার। ভাল লাগে, আছিও বেশ। এই গ্রীষ্মের মধ্যেই মনে হয় শরীরের ওজন ৩০/৪০ পাউণ্ড কমবে। শরীরের আকার অনুসারে ওজন ঠিকই হবে। ঐ যাঃ! বেড়ান বিষয়ে মিসেস এডাম্সের উপদেশের কথা একেবারে ভুলে গেছি। তাঁর নিউ ইয়র্কে এসে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে আবার সেগুলি অভ্যাস করতে হবে।
গান্ধী সম্ভবতঃ বোষ্টন হতে ভারত রওনা হয়েছিলেন। পথে ইংলণ্ড হয়ে যাবেন। তাঁর অভিভাবিকা মিসেস হাওয়ার্ড শোকগ্রস্ত হয়ে কেমন আছেন? কম্বলগুলো যে আটলাণ্টিকগর্ভে মগ্ন হয়নি, সত্যসত্যই এসে পৌঁছেছে—এটা সুখবর বলতে হবে।
বক্তৃতা না দিলেও এ বৎসর মাথা তোলবার সময় পাইনি। ভারত থেকে বেদান্তের উপর দ্বৈত, অদ্বৈত ও বিশিষ্টাদ্বৈত—এই তিন প্রধান সম্প্রদায়ের ভাষ্য পাঠিয়েছে। আশা করি নির্বিঘ্নে এসে পৌঁছবে। চর্চা করে খুব আনন্দ হবে। এই গ্রীষ্মে বেদান্তদর্শন-বিষয়ক এক পুস্তক রচনার সঙ্কল্প। ভালমন্দ, সুখদুঃখের সংমিশ্রণই জগৎ। চক্র চিরকালই উঠবে ও নামবে; ভাঙা গড়া বিধির অলঙ্ঘ্য বিধান। যাঁরা এ সবের পারে যাবার চেষ্টা করছেন, তাঁরাই ধন্য।
মেয়েরা সব ভাল আছে জেনে সুখী হলাম। পরিতাপের বিষয়, এবারকার শীতেও কেউ ধরা পড়ল না। এদিকে শীতের পর শীত চলে যাচ্ছে। আশাও ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। এখানে আমার বাসার কাছে অবস্থিত ওয়ালডর্ফ হোটেল। আমেরিকান ধনী-কন্যারা ক্রয় করবেন বলে বহু খেতাবধারী কিন্তু কপর্দকহীন ইওরোপীয় পুরুষের প্রদর্শনী ও আড্ডা এটি। আমদানী এত প্রচুর ও বিবিধ যে, ইচ্ছানুরূপ নির্বাচন বাস্তবিকই সুলভ। কেউ আছেন একেবারেই ইংরেজী বলতে পারেন না, আবার আছেন জনকয়েক যাঁরা আধ আধ ইংরেজী বলেন, যা অন্যের বোধগম্য নয়। ভাল ইংরেজী বলতে পারেন, এমন সব লোকও আছেন। কিন্তু নির্বাকদের তুলনায় তাঁদের আশা বড় কম। কারণ যাঁরা ইংরেজী ভাল বলতে পারেন, মেয়েরা তাঁদের ঠিক ‘বিদেশী’ বলে মনে করে না।
এক মজার বইয়ে পড়লাম, সমুদ্রে এক আমেরিকান জাহাজ ডুবু ডুবু। লোকেরা হতাশ হয়ে অন্তিম সান্ত্বনার জন্য কোনরূপ ধর্মানুষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভব করল। প্রেসবিটেরিয়ান চার্চের এক বিশিষ্ট ধর্মযাজক জাহাজে ছিলেন—জস্ খুড়ো। সকলে তাঁকেই ধরে বসল, ‘আর তো মরতে বসেছি, এখন কিছু ধর্মানুষ্ঠান করুন, দোহাই জস্ খুড়ো।’ খুড়ো মাথার টুপি হাতে উল্টে ধরে তখনই দান সংগ্রহ করতে শুরু করলেন।
ধর্ম বলতে তিনি এর বেশী বুঝতেন না। এই জাতীয় লোকের অধিকাংশেরই এই অবস্থা। এদের বুদ্ধিতে ধর্মের তাৎপর্য দানসংগ্রহ। ভগবান্ এদের মঙ্গল করুন। এখনকার মত আসি। কিছু খেতে যাচ্ছি। বড় খিদে পেয়েছে। ইতি—
তোমাদের স্নেহের
বিবেকানন্দ