ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

পত্রাবলী

১৯৫*
19 W. 38th St., নিউ ইয়র্ক
২২ জুন, ১৮৯৫

প্রিয় কিডি,
তোমাকে এক লাইন না লিখে একখানা গোটা চিঠি লিখছি।

তুমি দিন দিন উন্নতি করছ জেনে খুব সুখী হলাম। তুমি যে ভাবছ, আমি আর ভারতে ফিরব না, এটা তোমার ভুল ধারণা। আমি শীঘ্রই ভারতে ফিরব, তবে কোন বিষয়ে ব্যর্থ হয়ে ছেড়ে দেওয়া আমার স্বভাব নয়। এখানে আমি একটি বীজ পুঁতেছি, শীঘ্রই সেটি বৃক্ষে পরিণত হবে—হবেই হবে। তবে আমার আশঙ্কা, যদি আমি তাড়াহুড়ো করে যত্ন নেওয়া বন্ধ করি, গাছটির বাড়ের ক্ষতি হবে। তোমাদের কাগজটা বার করে ফেল। তোমাদের সঙ্গে আমার এখানকার লোকদের যোগাযোগ করে দিয়ে আমি ভারতে যাচ্ছি আর কি।

বৎস, কাজ করে যাও, রোম একদিনে নির্মিত হয়নি। আমি প্রভুর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। সুতরাং শেষে সব ভালই দাঁড়াবে। চিরদিনের জন্য আমার ভালবাসা জানবে।

তোমার
বিবেকানন্দ
…………………………….

১৯৬*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
২৬ জুন, ১৮৯৫

প্রিয় ভগিনী,
ভারতীয় পত্রগুলির (mail) জন্য ধন্যবাদ। এবার অনেক সু-খবর এল। অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের ‘আত্মার অমরত্ব’ শীর্ষক প্রবন্ধগুলি মাদার চার্চকে পাঠিয়েছি। আশা করি, এখন সেগুলি পড়ে তুমি আনন্দ পাচ্ছ। বেদান্তের কোন অংশই বৃদ্ধ উপেক্ষা করেননি। সাবাস তাঁর নির্ভীক কৃতিত্ব! ঔষধগুলি এসে পৌঁছেছে শুনে সমধিক সুখী হলাম। শুল্ক কিছু লাগল নাকি? যদি লেগে থাকে, আমি দিয়ে দেব; আপত্তি করো না। খেতড়িরাজের প্রেরিত শাল, কিংখাব আর ছোটখাট কয়েক রকম সুন্দর জিনিসের একটা বড় প্যাকেট আসছে। এগুলি বন্ধুদের উপহার দিতে চাই। তবে এসে পৌঁছতে এখনও অন্ততঃ মাস-কয়েক লাগবে

ভারতের চিঠিগুলোতে দেখবে, আমাকে দেশে ফিরে যাবার জন্য বারংবার অনুরোধ করছে। ওরা অস্থির হয়ে পড়েছে। ইওরোপে যদি যাই তো নিউ ইয়র্ক অঞ্চলের মিঃ ফ্রান্সিস লেগেটের অতিথি হয়ে যাব। তিনি ছয় সপ্তাহ ধরে জার্মানী, ফ্রান্স, ইংলণ্ড ও সুইজরলণ্ডের সর্বত্র ঘুরবেন। ওখান থেকে ভারতে ফিরব। চাই কি এখানেও ফিরতে পারি। এদেশে যে বীজ বপন করলাম, তার পরিণতি কামনা করি। এইবারের শীতে চমৎকার কাজ হয়েছে নিউ ইয়র্কে। সহসা ভারতে চলে গেলে সব পণ্ড হয়ে যেতে পারে। তাই যাওয়া সম্বন্ধে এখনও মন করিনি।

সহস্রদ্বীপোদ্যানে লক্ষ্য করার মত তেমন কিছু ঘটেনি। দৃশ্য রমণীয় বটে। কয়েকজন বন্ধু রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে ঈশ্বর ও আত্মা সম্বন্ধে ইচ্ছামত প্রসঙ্গ হয়। ফল দুধ প্রভৃতি আহার করি, আর বেদান্তবিষয়ক প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সংস্কৃত গ্রন্থ পড়ি, এগুলি ওরা ভারত থেকে অনুগ্রহ করে পাঠিয়েছে।

চিকাগোয় যদি ফিরি তো ছয় সপ্তাহের পূর্বে নয়, চাই কি আরও দেরী হতে পারে। বেবী যেন আমার জন্য তার ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন না করে। ফিরে যাবার আগে যে-কোন উপায়ে তোমাদের সকলের সঙ্গে দেখা করব—নিশ্চয় জেনো।

মান্দ্রাজ-অভিনন্দনের উত্তর পড়ে তুমি খুবই বিচলিত হয়েছিলে; সেখানে কিন্তু তার খুব ফল হয়েছে। সেদিন মান্দ্রাজ ‘খ্রীষ্টান কলেজে’র অধ্যক্ষ (President) মিঃ মিলার তাঁর এক ভাষণে আমার চিন্তাগুলি অনেকাংশে সন্নিবিষ্ট করে বলেছেন যে, ঈশ্বর ও মানুষ সম্বন্ধে ভারতের তত্ত্বগুলি প্রতীচ্যের খুব উপযোগী, আর যুবকদের সেখানে (পাশ্চাত্যে) গিয়ে প্রচারকার্যে ব্রতী হতে আহ্বান করেছেন। এতে ধর্মযাজক মহলে বেশ ক্রোধের সঞ্চার হয়েছে। ‘এরেনা’ পত্রে প্রকাশিত যে প্রবন্ধের কথা তুমি লিখেছ, আমি তার কিছুই দেখিনি। নিউ ইয়র্কের মহিলারা আমার সম্পর্কে কোনরূপ হইচই করেননি। তোমার বন্ধুটির বিবরণ কল্পনাপ্রসূত। প্রভুত্ব করা তাদের স্বভাব নয়। আশা করি, ফাদার পোপ ও মাদার চার্চ ইওরোপে যাচ্ছেন। দেশভ্রমণ জীবনে খুবই আনন্দদায়ক। আমাকে এক জায়গায় বেশী দিন আটকে রাখলে সম্ভবতঃ মারা পড়ব। পরিব্রাজক-জীবনের তুলনা হয় না।

চতুর্দিকে অন্ধকার যতই ঘনিয়ে আসে, উদ্দেশ্য ততই নিকটবর্তী হয়, ততই জীবনের প্রকৃত অর্থ—জীবন যে স্বপ্ন, তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে; কেন যে মানুষ এটা বুঝতে পারে না তাও বোঝা যায়। সে যে একান্ত অর্থহীনের মধ্যে অর্থসঙ্গতি খুঁজতে চেষ্টা করেছিল! স্বপ্নের মধ্যে বাস্তবের সন্ধান শিশুসুলভ উদ্যম বৈ আর কি! ‘সবই ক্ষণিক, সবই পরিবর্তনশীল’—এইটুকু নিশ্চয় জেনে জ্ঞানী ব্যক্তি সুখদুঃখ ত্যাগ করে জগদ‍্‍‍বৈচিত্র্যের সাক্ষিমাত্ররূপে অবস্থান করেন, কোন কিছুতে আসক্ত হন না।

‘যাঁদের চিত্ত সাম্যে প্রতিষ্ঠিত, তাঁরা ইহজীবনেই জন্মমৃত্যুর বন্ধন অতিক্রম করেছেন। ভগবান্ নির্দোষ ও সমদর্শী এবং সকলের প্রতি সমবুদ্ধি; সুতরাং তাঁরা ভগবানেই অবস্থিত।’৭৪ বাসনা, অজ্ঞান ও ভেদদৃষ্টি—এই তিনটিই বন্ধন। জীবনে অনাসক্তি, জ্ঞান ও সমদর্শিতা—এই তিনটি মুক্তি। মুক্তিই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের লক্ষ্য।

না আসক্তি, না বিদ্বেষ; না সুখ, না দুঃখ; না মৃত্যু, না জীবন; না ধর্ম, না অধর্ম; নেতি, নেতি নেতি।

চিরতরে তোমার
বিবেকানন্দ
…………………………….

১৯৭*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.

প্রিয় ভগিনী,
ভারতীয় পত্রাদির জন্য বহু ধন্যবাদ। ভাষার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে অক্ষম। মাদার চার্চকে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার-লিখিত ‘অমরত্ব’ নামক যে প্রবন্ধটি পাঠাই, সেটি পড়ে দেখে থাকবে—তাঁর মতে, ইহজীবনে যারা আমাদের প্রীতিভাজন, অতীত জন্মেও তারা নিশ্চয় তেমনি ছিল। তাই মনে হয়, কোন পূর্বজন্মে আমি এই ভক্ত পরিবারেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। ভারত থেকে কয়েকখানি বই আসবার কথা, হয়তো এসে গেছে। যদি এসে থাকে, তবে অনুগ্রহ করে এখানে পাঠিয়ে দিও। ডাকমাশুল বাবদ যদি কিছু দেয় থাকে, সংবাদ পাবামাত্র পাঠাব, জানবে। কম্বলগুলির জন্য শুল্কের কথা তুমি তো কিছু লেখনি। খেতড়ি থেকে আর একটি বড় প্যাকেট আসবে—কার্পেট, শাল, কিংখাব ও অন্যান্য ছোট ছোট জিনিষের। বোম্বাইয়ে আমেরিকান কনসালের মারফৎ শুল্ক ওখানেই দিয়ে দেওয়া সম্ভব হলে ওখানেই দিয়ে দিতে লিখেছি। নয়তো আমাকেই এখানে দিতে হবে। মনে হয় মাসকয়েকের পূর্বে আসছে না। বইগুলির জন্য উদ‍্‍‍গ্রীব রইলাম। এলেই অনুগ্রহ করে পাঠিয়ে দিও।

মাকে, ফাদার পোপ ও ভগিনীদের সকলকে আমার ভালবাসা। এ স্থানটি বড় ভাল লাগছে। আহার যৎসামান্য, অধ্যয়ন আলোচনা ধ্যানাদি কিন্তু খুব চলছে। অপূর্ব এক শান্তির আবেগে প্রাণ ভরে উঠছে। প্রতিদিনই মনে হচ্ছে—আমার করণীয় কিছু নেই। আমি সর্বদাই পরম শান্তিতে আছি। কাজ তিনিই করছেন। আমরা যন্ত্রমাত্র। তাঁর নাম ধন্য! কাম, কাঞ্চন ও প্রতিষ্ঠারূপ ত্রিবিধ বন্ধন যেন আমা থেকে সাময়িক ভাবে খসে পড়েছে। ভারতে মধ্যে মধ্যে আমার যেমন উপলব্ধি হত, এখানেও আবার তেমনি হচ্ছে—‘আমার ভেদবুদ্ধি, ভালমন্দ বোধ, ভ্রম ও অজ্ঞান বিলুপ্ত হয়েছে, আমি গুণাতীত রাজ্যে বিচরণ করছি। কোন্ বিধিবিশেষ মানব? কোন‍্‍‍‍‍‍‍‍‍টাই বা লঙ্ঘন করব?’ সে উচ্চ ভাবভূমি থেকে মনে হয়, সারা বিশ্ব যেন একটা ডোবা। হরিঃ ওঁ তৎ সৎ; একমাত্র তিনিই আছেন আর কিছু নাই। আমি তোমাতে, তুমি আমাতে। হে প্রভো! তুমি আমার চির আশ্রয় হও। শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। সতত প্রীতিশুভেচ্ছাযুক্ত—

তোমাদের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………….

১৯৮*
আমেরিকা
১ জুলাই, ১৮৯৫

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তোমাদের প্রেরিত মিশনরীদের বইখানা ও রামনাদের রাজার ফটো পেলাম। রাজা ও মহীশূরের দেওয়ান—দুজনকেই পত্র লিখেছি। রমাবাঈয়ের দলের লোকদের সঙ্গে ডাঃ জেনসের বাদ-প্রতিবাদ থেকে বেশ বোধ হয়, মিশনরীদের পুস্তিকাখানা এখানে বহুদিন পূর্বে পৌঁছেছে। ঐ পুস্তিকাতে একটা অসত্য কথা আছে। আমি এদেশে খুব বড় হোটেলে কখনও খাইনি, আর কোনরূপ হোটেলেও খুব কমই গেছি। বাল্টিমোরে ছোট হোটেলওয়ালারা অজ্ঞ—তারা নিগ্রো ভেবে কোন কালা আদমিকে স্থান দেয় না। সেইজন্য ডাঃ ভ্রূম্যান‍্‍কে—আমি যাঁর অতিথি ছিলাম—ঐখানে একটা বড় হোটেলে নিয়ে যেতে হয়েছিল; কারণ তারা নিগ্রো ও বিদেশীদের মধ্যে প্রভেদ জানে।

আলাসিঙ্গা, তোমায় বলছি শোন, তোমাদের নিজেদেরই আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে। তোমরা কচি খোকার মত ব্যবহার করছ কেন? যদি কেউ তোমাদের ধর্মকে আক্রমণ করে, তোমরা নিজেরাই তার সমর্থন করতে এবং আক্রমণকারীকে মুখের উপর জবাব দিতে পার না কেন? আমার সম্বন্ধে বলছি, তোমাদের ভয় পাবার দরকার নেই। এখানে আমার শত্রুর চেয়ে মিত্রের সংখ্যা বেশী। আর এদেশের অধিবাসীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মাত্র খ্রীষ্টান; আর শিক্ষিতদের ভেতর খুব অল্পসংখ্যক লোকই মিশনরীদের গ্রাহ্যের মধ্যে আনে। মিশনরীরা কোন কিছুর বিরুদ্ধে লাগলে শিক্ষিতেরা আবার সে বিষয়টি পছন্দ করে। এখন মিশনরীদের শক্তি এখানে অনেক কমে গেছে এবং দিন দিন আরও কমে যাচ্ছে। তারা হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করলে যদি তোমাদের কষ্ট হয়, তবে তোমরা অভিমানী ছেলের মত ঠোঁট ফুলিয়ে আমার কাছে কাঁদুনি গাইতে কেন আস? তোমরা কি লিখতে পার না এবং তাদের ধর্মের দোষ দেখিয়ে দিতে পার না? কাপুরুষতা তো আর ধর্ম নয়!

এখানে ইতোমধ্যেই ভদ্রসমাজের ভেতর একদল লোক আমার ভাব নিয়েছে। আগামী বৎসর তাদের এমনভাবে সঙ্ঘবদ্ধ করব, যাতে তারা কার্যক্ষম হতে পারে; তখন কাজটা চলতে থাকবে। তারপর আমি ভারতে চলে গেলেও এখানে এমন অনেক বন্ধু আছে, যারা এখানকার কাজের পৃষ্ঠপোষক হবে এবং ভারতেও আমায় সাহায্য করবে। সুতরাং তোমাদের ভয় পাবার দরকার নেই। তবে তোমরা যতদিন মিশনরীদের আক্রমণে কেবল চীৎকার করবে এবং কিছু করতে না পেরে লাফিয়ে বেড়াবে, ততদিন আমি তোমাদের দিকে চেয়ে হাসব। তোমরা ছেলেদের হাতের ছোট ছোট পুতুলের মত, তা ছাড়া আর কি? ‘স্বামীজী, মিশনরীরা আমাদের কামড়াচ্ছে—উঃ জলে মলুম! উঃ-উঃ।’ স্বামীজী আর বুড়ো খোকাদের জন্য কি করতে পারে?

বৎস! আমি বুঝছি, আমাকে গিয়ে তোমাদের মানুষ তৈরী করতে হবে। আমি জানি, ভারতে কেবল নারী ও ক্লীবের বাস। সুতরাং বিরক্ত হয়ো না। ভারতে কাজ করার জন্য উপায় উদ‍্‍ভাবন আমাকেই করতে হবে। কতকগুলো মস্তিষ্কহীন ক্লীবের হাতে গিয়ে আমি পড়ছি না।

তোমাদের উদ্বিগ্ন হবার দরকার নেই, তোমরা যতটুকু পার করে যাও, তা যত অল্পই হোক না কেন, একলাই আগাগোড়া সব করে যেতে হবে। কলিকাতার লোকদের এত সঙ্কীর্ণভাব! আর তোমরা মান্দ্রাজীরা কুকুরের ডাকে মূর্ছা যাও! ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ।’—দুর্বল কখনও এই আত্মাকে লাভ করতে পারে না। আমার জন্য তোমাদের ভয় পাবার দরকার নেই, প্রভু আমার সঙ্গে রয়েছেন। তোমরা কেবল আত্মরক্ষা করে যাও; আমাকে দেখাও যে, তোমরা ঐটুকু করতে পার, তা হলেই আমি সন্তুষ্ট। কে আমার সম্বন্ধে কি বলছে, তাই নিয়ে আর আমাকে বিরক্ত করো না। আমার সম্বন্ধে কোন আহাম্মকের সমালোচনা শোনবার জন্য আমি বসে নেই। তোমরা শিশু, [জেনে রাখ] কেবল প্রভূত ধৈর্য, অসীম সাহস ও মহতী চেষ্টা দ্বারাই শ্রেষ্ঠ ফল লাভ হয়ে থাকে। আমার ভয় হচ্ছে, কিডির মন মাঝে মাঝে যেমন ডিগবাজি খায়, সেইরকম ডিগবাজি খাচ্ছে। কোণ থেকে বেরিয়ে এসে কলম ধরুক না। ‘স্বামী, স্বামী’ বলে না চেঁচিয়ে ঐ দুষ্টুদের বিরুদ্ধে কি মান্দ্রাজীরা এখন যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে না, যাতে তারা ‘ত্রাহি ত্রাহি’ চীৎকার করতে থাকে?

তোমরা ভয় পাচ্ছ কিসে? সাহসী লোকেরাই কেবল বড় বড় কাজ করতে পারে—কাপুরুষেরা পারে না। হে অবিশ্বাসিগণ, চিরকালের জন্য জেনে রাখ যে, প্রভু আমায় হাত ধরে নিয়ে চলেছেন। যতদিন আমি পবিত্র থাকব, তাঁর দাস হয়ে থাকব, ততদিন কেউ আমার একটি কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না।

তোমাদের কাগজখানা বার করে ফেল। যে-কোন রকমে হোক, আমি খুব শীঘ্র তোমাদের আরও টাকা পাঠাচ্ছি এবং মাঝে মাঝে টাকা পাঠাতে থাকব। তোমরা কাজ করে চল। দেশবাসীর জন্য কিছু কর—তাহলে তারাও তোমাদের সাহায্য করবে, সমগ্র জাতি তোমার পিছনে থাকবে। সাহসী হও, সাহসী হও! মানুষ একবারই মরে। আমার শিষ্যেরা যেন কখনও কোনমতে কাপুরুষ না হয়।

সদা প্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
…………………………….

১৯৯*
[মিঃ লেগেটকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
৭ জুলাই, ১৮৯৫

প্রিয় বন্ধু,
দেখতে পাচ্ছি—আপনি নিউ ইয়র্ক খুব উপভোগ করছেন, সুতরাং একটি চিঠির দ্বারা আপনার মধুর স্বপ্ন ভাঙবার জন্য ক্ষমা করবেন।

মিস ম্যাকলাউড এবং মিসেস স্টার্জিস-এর কাছ থেকে আমি দুটি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। তাঁরা বার্চগাছের ছালের দুটি সুন্দর খাতা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি সংস্কৃত মূল শ্লোক এবং অনুবাদে সে দুটি ভরিয়ে ফেলে আজকের ডাকে পাঠিয়ে দিলাম।

শুনছি, মিসেস ডোরা৭৫ গূঢ় রহস্যাদিতে বিশ্বাসী ‘মহাত্মা’-পদ্ধতিতে চমকপ্রদ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন।

পার্সি৭৬ ছাড়ার পর থেকে আমি লণ্ডনে যাবার জন্য অপ্রত্যাশিত অনেক জায়গা থেকে আমন্ত্রণ পাচ্ছি এবং আমি বহু আশা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি। লণ্ডনে কাজ করার এই সুযোগ হারাতে চাই না। তাই লণ্ডনের আমন্ত্রণের সঙ্গে আপনার আমন্ত্রণকে আরও কাজ করার দৈব আহ্বান বলেই মনে করি।

আমি পুরো এ মাসটা এখানেই থাকব এবং অগষ্ট মাসের কোন সময়ে কয়েকদিনের জন্য মাত্র চিকাগোয় যেতে হবে।

উদ্বিগ্ন হবেন না, ফাদার লেগেট, এই হল আশান্বিত হবার সর্বোৎকৃষ্ট সময়—যখন ভালবাসায় এত নিশ্চয়তা।

প্রভু আপনাকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন, চিরদিনের জন্য সকল শান্তি লাভ করুন, কারণ আপনি তা লাভ করার খুবই উপযুক্ত।

ভালবাসা এবং স্নেহে চিরদিন আপনার
বিবেকানন্দ
…………………………….

১৯০*
19W, 38th St., নিউ ইয়র্ক
৮ জুলাই, ১৮৯৫

স্নেহের অ্যালবার্টা,৭৭
আমি নিশ্চিত যে, তুমি এখন সম্পূর্ণভাবে তোমার সঙ্গীতশিক্ষায় নিমগ্ন। আশা করি ইতোমধ্যে তুমি স্বরগ্রামের সব কিছুই শিখে নিয়েছ। পরের বারে দেখা হলে তোমার কাছ থেকে স্বরগ্রাম সম্বন্ধে পাঠ গ্রহণ করা আমার খুব আনন্দের বিষয় হবে।

পার্সিতে মিঃ লেগেটের সঙ্গে আমাদের দিনগুলি বেশ আনন্দে কেটেছে—তিনি ঋষিকল্প নন কি?

আমি নিশ্চিত যে, হলিস্টারও (Hollister) জার্মান দেশটা খুব উপভোগ করছে এবং আশা করি তোমরা কেউই জার্মান শব্দ উচ্চারণ করার চেষ্টা করতে গিয়ে জিভ জখম করনি—বিশেষ করে সেই সকল শব্দ, যেগুলির আরম্ভ sch, tz, tsz, এবং অন্য সব মধুর জিনিষ দিয়ে।

জাহাজ থেকে লেখা তোমার চিঠিখানি তোমার মায়ের কাছে পড়েছি। আগামী সেপ্টেম্বরে আমি খুব সম্ভবতঃ ইওরোপ যাচ্ছি। আজ পর্যন্ত ইওরোপে যাইনি। মোটের উপর, সেটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব বেশী ভিন্নরকম হবে না, ইতোমধ্যেই আমি এদেশের আচার-ব্যবহার বেশ রপ্ত করে ফেলেছি।

পার্সিতে নৌকায় বেড়াবার সময় আমি দাঁড় চালানর দু-একটি বিষয় শিখে নিয়েছি। মাসীমা ‘জো জো’-কে তাঁর ‘মধুরতা’র জন্য খেসারত দিতে হয়েছে, কারণ মাছি এবং মশাগুলি মুহূর্তের জন্যও তাঁকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না। পরন্তু আমাকে তারা অনেকখানি জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল; আমার মনে হয় এর কারণ মাছিগুলি ছিল গোঁড়া; তাই একজন পৌত্তলিককে তারা স্পর্শ করেনি। আবার আমার মনে হয়, পার্সিতে আমি খুব গান গাইতাম, সেই ভয়েই তারা পালিয়ে গিয়েছে। আমাদের ভারি সুন্দর সুন্দর বার্চ (birch) বৃক্ষ ছিল। তার ছাল থেকে বই তৈরী করার চিন্তা আমার মনে উদিত হল—যেমন প্রাচীনকালে আমাদের দেশে করা হত; তোমার মা ও মাসীমার জন্য আমি কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক লিখেছি।

অ্যালবার্টা, আমি নিশ্চয়ই জানি—তুমি অচিরেই একজন বিস্ময়কর বিদুষী হতে চলেছ। তোমাদের দুজনের জন্য ভালবাসা এবং আশীর্বাদ।

সতত স্নেহবদ্ধ তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২০১*
[মিসেস স্টার্জিসকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
জুলাই, ১৮৯৫

মা,
আপনি নিশ্চয় ইতোমধ্যে নিউ ইয়র্কে এসে গিয়েছেন এবং সেখানে এখন গরম মোটেই প্রচণ্ড নয়।

এখানে আমাদের বেশ কাটছে। মেরী লুই (Marie Louise) গতকাল এসে পৌঁছেছেন। সুতরাং এখন পর্যন্ত যাঁরা এসেছেন, সবাইকে মিলিয়ে আমরা ঠিক সাতজন।

পৃথিবীর সব ঘুম যেন আমাতে নেমে এসেছে। আমি দিনে অন্ততঃ দু-ঘণ্টা ঘুমাই এবং সমস্ত রাত্রি জড়পিণ্ডের মত অসাড়ে নিদ্রা যাই। মনে হয়, নিউ ইয়র্কের অনিদ্রার এটি একটি প্রতিক্রিয়া। আমি কিছু কিছু লিখছি ও পড়ছি এবং প্রতিদিন প্রাতঃরাশের পর একটি করে ক্লাস নিচ্ছি। কঠোর নিরামিষবিধিতে আহার প্রস্তুত হচ্ছে, এবং আমি খুব উপোস করছি।

এ স্থান ত্যাগ করবার পূর্বে আমার চর্বি থেকে বেশ কয়েক পাউণ্ড উবে যাবে, এ বিষয়ে আমি দৃঢ়নিশ্চয়। এটা মেথডিষ্টদের জায়গা এবং অগষ্ট মাসে তাদের শিবির-সভা হবে। এটা অত্যন্ত সুন্দর স্থান; শুধু ভয়, জায়গাটা এই ঋতুতে অত্যন্ত জনবহুল হয়ে পড়ে।

মিস ‘জো জো’র মাছির ক্ষত নিশ্চয়ই এতদিনে সম্পূর্ণ সেরে গিয়েছে।—মা কোথায়? পরের বারে আপনি যখন তাঁকে চিঠি লিখবেন, দয়া করে তাঁকে আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানাবেন।

পার্সিতে যে-আনন্দে দিনগুলি কেটেছে, তার দিকে আমি সর্বদাই ফিরে ফিরে তাকাব এবং এই ব্যবস্থার জন্য মিঃ লেগেটকে সর্বদাই ধন্যবাদ জানাব। আমি তাঁর সঙ্গে ইওরোপে যেতে পারব। যখন তাঁর সঙ্গে পরের বারে দেখা হবে, দয়া করে তাঁকে আমার চিরন্তন ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাবেন। তাঁর মত মানুষদের ভালবাসা দ্বারাই জগৎ সর্বদা আরও ভাল হবার দিকে যাচ্ছে।

আপনি কি আপনার বন্ধু মিসেস ডোরার (লম্বা জার্মান নাম) সঙ্গে আছেন? তিনি একজন মহাপ্রাণ, খাঁটি ‘মহাত্মা’। দয়া করে তাঁকে আমার ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানাবেন।

আমি এখন একপ্রকার তন্দ্রাচ্ছন্ন—অলস, আনন্দের ভাব নিয়ে আছি, মন্দ লাগছে না।মেরী লুই নিউ ইয়র্ক থেকে তাঁর পোষা একটি কচ্ছপ নিয়ে এসেছেন। এখন এখানে এসে পোষা প্রাণীটি তার স্বাভাবিক পরিবেশ পেয়েছে। সুতরাং বিপুল অধ্যবসায়ে গড়াতে গড়াতে এবং হামাগুড়ি দিতে দিতে সে মেরী লুই-র ভালবাসা ও আদরকে পেছনে—অনেক পেছনে ফেলে চলে গিয়েছে। প্রথমটায় তিনি কিছুটা দুঃখিত হয়েছিলেন, কিন্তু আমরা এত জোরের সঙ্গে স্বাধীনতার জয়গান করতে লাগলাম যে, তাঁকে অবিলম্বে ফিরে আসতে হল।

ঈশ্বর আপনাকে এবং আপনাদের সকলকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন, এই সতত প্রার্থনা।

বিবেকানন্দ

পুনঃ—‘জো জো’ বার্চগাছের ছালের তৈরী বইটি পাঠায়নি। মিসেস বুলকে আমি যেটি পাঠিয়েছি, সেটি পেয়ে তিনি ভারি আনন্দিত।

ভারত থেকে আমি অনেকগুলি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। সেখানে সব ঠিক চলছে। সাগরপারে বিদেশে অবস্থিত শিশুদের আমাদের ভালবাসা পাঠিয়ে দেবেন।
—বি
…………………………….

২০২*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]
আমেরিকা.
৯ জুলাই, ১৮৯৫
… আমার ভারতে ফেরা সম্বন্ধে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এইঃ মহারাজ তো বেশ ভালই জানেন, আমি হচ্ছি দৃঢ় অধ্যবসায়ের মানুষ। আমি এ দেশে একটি বীজ পুঁতেছি, সেটি ইতোমধ্যেই চারা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশা করি খুব শীঘ্রই এটা বৃক্ষে পরিণত হবে। আমি কয়েকশত অনুগামী শিষ্য পেয়েছি; কতকগুলিকে সন্ন্যাসী করব, তারপর তাদের হাতে কাজের ভার দিয়ে ভারতে চলে যাব। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা আমার বিরুদ্ধে যতই লাগছে, ততই তাদের দেশে একটা স্থায়ী দাগ রেখে যাবার রোক আমার বেড়ে যাচ্ছে। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা … তাদের বিদ্যাবুদ্ধি, কলাকৌশল যতই খাটাক না কেন, প্রতিদিনই বুঝছে, আমাকে চেপে মেরে ফেলা তাদের পক্ষে একটু কঠিন কাজ। ইতোমধ্যে লণ্ডনে আমার কয়েকটি বন্ধু জুটেছে। আমি অগষ্টের শেষে সেখানে যাব মনে করেছি—দেখি, ওদিকে পাদ্রীদের কতটা ঘাঁটাতে পারা যায়। যাই হোক, আগামী শীতের কিছুটা লণ্ডনে ও কিছুটা নিউ ইয়র্কে কাটাতে হবে—তারপরই আমার ভারতে ফেরবার বাধা থাকবে না। যদি প্রভুর কৃপা হয়, তবে এই শীতের পর এখানকার কাজ চালাবার জন্য যথেষ্ট লোক পাওয়া যাবে। প্রত্যেক কাজকেই তিনটি অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়—উপহাস, বিরোধ ও পরিশেষে গ্রহণ। যে-কোন ব্যক্তি তার সময়ে প্রচলিত ভাবরাশি ছাড়িয়ে আরও উচ্চতর তত্ত্ব প্রকাশ করে, তাকে নিশ্চয়ই লোকে ভুল বুঝবে। সুতরাং বাধা ও অত্যাচার আসুক, স্বাগতম। কেবল আমাকে দৃঢ় ও পবিত্র হতে হবে এবং ভগবানে গভীর বিশ্বাস রাখতে হবে, তবেই এ-সব উড়ে যাবে। ইতি

বিবেকানন্দ
…………………………….

২০৩*
[মিসেস স্টার্জিসকে লিখিত]
Thousand Island Park
২৯ জুলাই, ১৮৯৫

মা,
আপনার গৌরবময় সময় এসেছে। আপনি নিশ্চয়ই সুস্থ আছেন।

এখানে বেশ ভালভাবে সময় কাটছে। দু-একজন মহিলা সরাসরি ডেট্রয়েট থেকে এখানে এসেছেন আমাদের সঙ্গে থাকতে। তাঁরা বেশ পবিত্র ও ভাল। আমি থাউজ্যাণ্ড আইল্যাণ্ড থেকে ডেট্রয়েটে এবং সেখান থেকে চিকাগোয় যাচ্ছি।

নিউ ইয়র্কে আমার ক্লাস চলছে। আমার অনুপস্থিতিতেও তারা বেশ সাহসের সঙ্গে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছে। ভাল কথা, ডেট্রয়েট থেকে যে দু-জন মহিলা এসেছেন, তাঁরা ক্লাসে যোগদান করেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁদের ভূতের ভয়। তাঁদের কে শিখিয়েছে, জ্বলন্ত এলকোহলের শিখায় একটু নুন দিলে কাল তলানি পড়ে, তাহলে সেটা হবে ভূতের অস্তিত্বের প্রমাণ। যা হোক, মহিলা দুটি বেশ ভূতের ভয় পেয়েছিলেন। লোকে বলে, এই রকম ভূত বিশ্বজগতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। পিতা লেগেট আপনার অনুপস্থিতিতে নিশ্চয়ই খুব নিরুৎসাহ হয়েছেন। কারণ আজ পর্যন্ত তাঁর কোন চিঠি পাইনি। বেশ, দুঃখ আসে আসুক, বিচলিত না হওয়াই শ্রেয়। কাজেই তা নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছি না।

জো জো-র সমুদ্রযাত্রা খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে থাকবে। শেষ রক্ষাই রক্ষা।

শিশুরা৭৮ জার্মানীতে বেশ আনন্দে আছে, নিশ্চয়। তাদের জাহাজ-ভর্তি ভালবাসা জানাবেন।

এখানকার সকলের ভালবাসা জানবেন। ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিকট আপনার জীবন আলোক-বর্তিকার মত হোক—এই কামনা করি।

আপনার পুত্র
তোমাদের বিবেকানন্দ
…………………………….

২০৪*
19W, 38th St., নিউ ইয়র্ক
৩০ জুলাই, ১৮৯৫

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তুমি ঠিক করেছ। নাম আর ‘মটো’ (motto)৭৯ ঠিকই হয়েছে। বাজে সমাজসংস্কার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো না, প্রথমে আধ্যাত্মিক সংস্কার না হলে সমাজসংস্কার হতে পারে না। কে তোমায় বললে, আমি সমাজসংস্কার চাই? আমি তো তা চাই না! ভগবানের নাম প্রচার কর, কুসংস্কার ও সমাজের আবর্জনার পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলো না।

‘সন্ন্যাসীর গীতি’৮০ এইটিই তোমাদের কাগজে আমার প্রথম প্রবন্ধ। নিরুৎসাহ হয়ো না—তোমার গুরুতে বিশ্বাস হারিও না—ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিও না। হে বৎস! যতদিন তোমার অন্তরে উৎসাহ এবং গুরু ও ঈশ্বরে বিশ্বাস—এই তিনটি জিনিষ থাকবে, ততদিন কিছুতেই তোমায় দমাতে পারবে না। আমি দিন দিন হৃদয়ে শক্তির বিকাশ অনুভব করছি। হে সাহসী বালকগণ, কাজ করে যাও।

সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………….

২০৫*
[মিঃ লেগেটকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
৩১ জুলাই, ১৮৯৫

প্রিয় বন্ধু,
এর পূর্বে আমি আপনাকে একখানা চিঠি লিখেছিলাম; মনে হচ্ছে, সেটি সাবধানে ডাকে দেওয়া হয়নি, তাই আর একখানা লিখছি।

১৪ তারিখের পূর্বে আমি যথাসময়ে গিয়ে পৌঁছব। ১১ তারিখের পূর্বে যে করেই হোক আমাকে নিউ ইয়র্কে যেতে হবে। সুতরাং প্রস্তুত হবার যথেষ্ট সময় হাতে পাওয়া যাবে।

আমি আপনার সঙ্গে পারি-তে যাব, সঙ্গে যাবার প্রধান উদ্দেশ্য আপনাদের বিবাহ দেখা। আপনারা যখন ভ্রমণে বাহির হবেন, তখন আমি লণ্ডন চলে যাব। ব্যস্।

আপনার এবং আপনাদের সকলের প্রতি আমার চিরস্থায়ী ভালবাসা ও আশীর্বাদের পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।

সতত আপনার পুত্র
বিবেকানন্দ
…………………………….

২০৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
19W. 38th St., নিউ ইয়র্ক
২ অগষ্ট, ১৮৯৫

সুহৃদ্বরেষু,
আপনার প্রীতিপূর্ণ পত্রখানি আজ পাইলাম। আমি জনৈক বন্ধুর সহিত প্রথমে পারি-তে যাইতেছি—১৭ অগষ্ট ইওরোপ যাত্রা করিতেছি। পারি-তে আমার বন্ধুর বিবাহ হওয়া পর্যন্ত (মাত্র এক সপ্তাহ) থাকিব, তারপর লণ্ডনে চলিয়া যাইব।

একটা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তোলা সম্বন্ধে আপনার পরামর্শটি চমৎকার, এবং আমি ঐভাবেই অগ্রসর হইতে চেষ্টা করিতেছি।

এখানে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, তাঁহাদের অধিকাংশই দরিদ্র। সুতরাং কাজও মন্থরগতিতে চলিতে বাধ্য। অধিকন্তু নিউ ইয়র্কে উল্লেখযোগ্য কিছু গড়িয়া তোলার আগে আরও কয়েক মাস খাটিতে হইবে। কাজেই এই শীতের গোড়ায় আমাকে নিউ ইয়র্কে ফিরিয়া আসিতে হইবে, এবং গ্রীষ্মে পুনরায় লণ্ডনে যাইব। এখন যতদূর মনে হইতেছে, তাহাতে এবারে সপ্তাহ-কয়েক মাত্র লণ্ডনে থাকিতে পারিব। কিন্তু ভগবানের কৃপায় হয়তো ঐ অল্প সময়েই গুরুতর বিষয়ের সূচনা হইতে পারে। কবে লণ্ডনে পৌঁছিব, তাহা আপনাকে তার করিয়া জানাইব।

থিওসফিষ্ট সম্প্রদায়ের জনকয়েক আমার নিউ ইয়র্কের ক্লাসে আসিয়াছিলেন। কিন্তু মানুষ যখনই বেদান্তের মহিমা বুঝিতে পারে, তখনই তাহাদের হিজি-বিজি ধারণাগুলি দূর হইয়া যায়।

আমার বরাবরের অভিজ্ঞতা, যখন মানুষ বেদান্তের মহান্‌ গৌরব উপলব্ধি করিতে পারে, তখন মন্ত্রতন্ত্রাদি আপনা হইতে দূর হইয়া যায়। যে মুহূর্তে মানুষ একটি উচ্চতর সত্যের আভাস পায়, সেই মুহূর্তে নিম্নতর সত্যটি স্বতই অন্তর্হিত হয়। সংখ্যাধিক্যে কিছুই যায় আসে না। বিশৃঙ্খলা জনতা শত বৎসরেও যাহা করিতে পারে না, মুষ্টিমেয় কয়েকটি সরল সঙ্ঘবদ্ধ এবং উৎসাহী যুবক এক বৎসরে তদপেক্ষা অধিক কাজ করিতে পারে। এক বস্তুর উত্তাপ নিকটবর্তী অন্যান্য বস্তুতে সঞ্চারিত হয়—ইহাই প্রকৃতির নিয়ম। সুতরাং যে পর্যন্ত আমাদের মধ্যে সেই জ্বলন্ত অনুরাগ, সত্যনিষ্ঠা, প্রেম ও সরলতা সঞ্জীবিত থাকিবে, ততক্ষণ আমাদের সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্, সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।’—এই সনাতন সত্য আমার বৈচিত্র্যময় জীবনে বহুবার পরীক্ষিত হইয়াছে। যিনি সৎস্বরূপে আপনার অন্তরে বিরাজিত, তিনিই সর্বক্ষণ আপনার অভ্রান্ত পথপ্রদর্শক হউন; অচিরে মুক্তির আলোকে আপনি স্বয়ং উদ্ভাসিত হইয়া অন্যকে মুক্ত হইতে সাহায্য করুন।

বিবেকানন্দ
…………………………….

২০৭
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
19W, 38th St., নিউ ইয়র্ক
১৮৯৫

অভিন্নহৃদয়েষু,
… মা-ঠাকুরাণীকে আমার বহুত সাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানাইবে।

শিব শিব !

এখন আমি নিউ ইয়র্ক শহরে। এ শহর গরমিকালে ঠিক কলকেতার মত গরম, অজস্র ঘাম বয়ে পড়ছে, হাওয়ার লেশ নাই। দুই মাস উত্তর দিকে গিয়েছিলাম, সেথায় বেশ ঠাণ্ডা। এ পত্রপাঠ জবাব লিখিবে। এ পত্র পৌঁছিবার পূর্বে আমি ইংলণ্ডে চলিলাম। ইতি

ঠিকানা: C/o Akshoy C. Ghosh
Muller, Juan Duff House, Regent St.,
Cambridge, England
…………………………….

২০৮*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
19W. 38th St., নিউ ইয়র্ক
৯ অগষ্ট, ১৮৯৫

সুহৃদ্বরেষু
… আমার ব্যক্তিগত মতামতের একটু আভাস দেওয়া দরকার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, মানব সমাজে ধর্মের অপূর্ব উচ্ছ্বাস মধ্যে মধ্যে উত্থিত হইয়া থাকে এবং তেমনি এক উচ্ছ্বাস বর্তমানেও শিক্ষিত সমাজের মধ্যে দেখা দিয়েছে। প্রত্যেক উচ্ছ্বাসবেগ আবার বহু ক্ষুদ্র শাখায় বিভক্ত বলিয়া বোধ হইলেও মূলতঃ তাহারা যে একই তত্ত্ব বা তত্ত্বসমষ্টি হইতে উদ্ভূত, তাহাও তাহাদের পরস্পরের সাদৃশ্য হইতে বুঝিতে পারা যায়। বর্তমান সময়ে যে ধর্মভাব দিন দিন চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রের মধ্যেই বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিতেছে, তাহার একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, যত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মতবাদ উহা হইতে উদ্ভূত হইতেছে, তাহারা সকলেই সেই এক অদ্বৈত-তত্ত্বের অনুভূতি ও অনুসন্ধানেই সচেষ্ট। জাগতিক, নৈতিক এবং আত্মিক সকল ক্ষেত্রেই এই একটি ভাব দেখা যাইতেছে যে, বিভিন্ন মতবাদসমূহ ক্রমেই উদার হইতে উদারতর হইয়া সেই শাশ্বত অদ্বৈত-তত্ত্বের অভিমুখে অগ্রসর হইতেছে। সুতরাং ধরিয়া লইতে পারা যায় যে, বর্তমান যুগের যত ভাবান্দোলন আছে, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে সেগুলি এক অপূর্ব ঐক্যমূলক দর্শন—অদ্বৈত বেদান্তের প্রতিরূপ; আর মানব আজ পর্যন্ত যত প্রকার একত্ববাদের দর্শন আবিষ্কার করিয়াছে, তন্মধ্যে ইহাই সর্বোত্তম। আবার ইহাও সর্বদা দেখা যায় যে, প্রতিযুগে এই সমস্ত বিভিন্ন মতবাদের সংঘর্ষের ফলে শেষ পর্যন্ত একটি মাত্র মতবাদই টিকিয়া যায় এবং অন্য তরঙ্গগুলি উঠে শুধু উহারই অঙ্গে মিশিয়ে গিয়া উহাকে একটি বিপুল ভাবতরঙ্গে পরিণত করিবার জন্য। তখন সেই প্রবল ভাবস্রোত সমাজের উপর দিয়া অপ্রতিহত বেগে বহিয়া যায়।

ভারতবর্ষে, আমেরিকায় ও ইংলণ্ডে অর্থাৎ যাহাদের ইতিহাস আমি অবগত আছি, সেই সব দেশে বর্তমান সময়ে এইরূপ শত শত মতবাদের সংঘর্ষ চলিতেছে। ভারতবর্ষে দ্বৈতবাদ এখন ক্রমেই ক্ষীণ হইতেছে, কেবল অদ্বৈতবাদই সর্বক্ষেত্রে প্রতাপবান। আমেরিকাতেও বহু মতবাদের মধ্যে প্রাধান্যলাভের জন্য সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছে। ইহাদের সবগুলিই অল্পবিস্তর অদ্বৈতভাবের প্রতিরূপ, আর যে ভাবপরম্পরা যত দ্রুত বিস্তার লাভ করিতেছে, সেইগুলি অদ্বৈত বেদান্তের তত বেশী অনুরূপ বলিয়া প্রতীত হইতেছে। আর আমি স্পষ্টই বুঝিতেছি যে, অন্য সবগুলিকে গ্রাস করিয়া ভবিষ্যতে একটি মতবাদ মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবেই। কিন্তু সেটি কো‍‍‍ন্‌টি? ইতিহাসের দৃষ্টিতে দেখিতে গেলে, যে অংশটি যোগ্যতম তাহাই শেষ পর্যন্ত টিকিয়া থাকে। আর নিষ্কলুষ চরিত্রের মত অন্য কোন্ শক্তি মানুষকে যথার্থ যোগ্যতা-দানে সমর্থ? অনাগত ভবিষ্যতে অদ্বৈত বেদান্তই যে চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রের ধর্ম বলিয়া বিবেচিত হইবে, তাহাতে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। আবার সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে তাহারাই জয়লাভ করিবে, যাহার জীবন চরিত্রের চরম উৎকর্ষ দেখাইতে পারিবে; সে সম্প্রদায় কোন্ সুদূর ভবিষ্যতে যে আসিবে, তাহা বিবেচ্য নহে।

আমার নিজ জীবনের একটু অভিজ্ঞতা জানাইতেছি। যখন আমার গুরুদেব দেহত্যাগ করিলেন, তখন আমরা দ্বাদশ জন অজ্ঞাত অখ্যাত কপর্দকহীন যুবক মাত্র ছিলাম। আর বহুসংখ্যক শক্তিশালী সঙ্ঘ আমাদিগকে পিষিয়া ফেলিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিল। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্যে আমরা এক অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হইয়াছি, কেবল বাক্-সর্বস্ব না হইয়া যথার্থ জীবনযাপনের জন্য একটা ঐকান্তিক ইচ্ছা ও বিরামহীন সাধনার অনুপ্রেরণা তাঁহার নিকট আমরা লাভ করিয়াছিলাম। আর আজ সমগ্র ভারতবর্ষ তাঁহাকে জানে এবং শ্রদ্ধার সহিত তাঁহার পায়ে মাথা নত করে। তৎপ্রচারিত সত্যসমূহ আজ দাবানলের মত দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়িতেছে। দশ বৎসর পূর্বে তাঁহার জন্মতিথি-উৎসবে এক শত ব্যক্তিকে একত্র করিতে পারি নাই, আর গত বৎসর পঞ্চাশ হাজার লোক তাঁহার জন্মতিথিতে সমবেত হইয়াছিল।

কেবল সংখ্যাধিক্য দ্বারাই কোন মহৎ কার্য সম্পন্ন হয় না; অর্থ, ক্ষমতা, পাণ্ডিত্য কিম্বা বাক‍্‍চাতুরী-ইহাদের কোনটিরই বিশেষ কোন মূল্য নাই। পবিত্র, খাঁটি এবং প্রত্যক্ষানুভূতিসম্পন্ন মহাপ্রাণ ব্যক্তিরাই জগতে সকল কার্য সম্পন্ন করিয়া থাকেন। যদি প্রত্যেক দেশে এইরূপ দশ-বারটি মাত্র সিংহবীর্যসম্পন্ন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন, যাঁহারা নিজেদের সমুদয় মায়াবন্ধন ছিন্ন করিয়াছেন, যাঁহারা অসীমের স্পর্শ লাভ করিয়াছেন, যাঁহাদের সমগ্র চিত্ত ব্রহ্মানুধ্যানে নিমগ্ন, অর্থ যশ ও ক্ষমতার স্পৃহামাত্রহীন—তবে এই কয়েকজন ব্যক্তিই সমগ্র জগৎ তোলপাড় করিয়া দিবার পক্ষে যথেষ্ট।

ইহাই নিগূঢ় রহস্য। যোগপ্রবর্তক পতঞ্জলি বলিয়াছেন, ‘মানুষ যখন সমুদয় অলৌকিক যোগবিভূতির লোভ ত্যাগ করিতে সক্ষম হয়, তখনই তাহার ধর্মমেঘ নামক সমাধি লাভ হয়।’৮১ সে অবস্থায়ই তাঁহার ভগবদ্দর্শন হয়, তিনি ভগবৎস্বরূপে স্থিত হন, এবং অপরকে তদ্রূপ হইতে সাহায্য করেন। শুধু এই বাণী দিকে দিকে প্রচার করিতে চাই। জগতে বহু মতবাদ প্রচারিত হইয়াছে, লক্ষ লক্ষ পুস্তকও লিখিত হইয়াছে; কিন্তু হায়, সামান্যমাত্রও যদি কেহ অনুষ্ঠান করিত!

সমাজ ও সঙ্ঘের কথা বলিতে গেলে বলিতে হয় যে, উহারা আপনা-আপনি গড়িয়া উঠিবে। যেখানে হিংসার কোন বিষয় নাই, সেখানে হিংসা থাকিবে কিরূপে? আমাদের অনিষ্ট সাধন করিতে চায়, এইরূপ অসংখ্য লোক মিলিবে। কিন্তু ইহাতেই কি প্রমাণিত হয় না যে, সত্য আমাদেরই পক্ষে? আমি জীবনে যত বাধা পাইয়াছি, ততই আমার শক্তির স্ফুরণ হইয়াছে। এক টুকরা রুটির জন্য আমি গৃহ হইতে গৃহান্তরে বিতাড়িত হইয়াছি; আবার রাজা-মহারাজগণ কর্তৃকও আমি বহুভাবে পূজিত এবং বহুবার নিমন্ত্রিত হইয়াছি। বিষয়ী লোক এবং পুরোহিতকুল সমভাবে আমার উপর নিন্দাবর্ষণ করিয়াছে। কিন্তু তাহাতে আমার কি আসে যায়? ভগবান্ তাহাদের কল্যাণ করুন, তাহারাও আমার আত্মার সহিত সম্পূর্ণ অভিন্ন। বস্তুতঃ ইহারা সকলে আমাকে স্প্রিং বোর্ডেরই (spring board) মত সাহায্য করিয়াছে—ইহাদের প্রতিঘাতে আমার শক্তি উচ্চ হইতে উচ্চতর বিকাশ লাভ করিয়াছে।

বাক‍্‍সর্বস্ব ধর্মপ্রচারক দেখিয়া যে আমার ভয় পাইবার কিছুই নাই, তাহা বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করিয়াছি। সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষগণ কখনও কাহারও শত্রুতা করিতে পারেন না। ‘বচনবাগীশ’রা বক্তৃতা করিতে থাকুক! তদপেক্ষা ভাল কিছু তাহারা জানে না। নাম, যশ ও কামিনী-কাঞ্চন লইয়া তাহারা বিভোর ও মত্ত থাকুক। আর আমরা যেন ধর্মোপলব্ধির, ব্রহ্মলাভের ও ব্রহ্ম হওয়ার জন্যই দৃঢ়ব্রত হই। আমরা যেন মৃত্যু পর্যন্ত এবং জীবনের পর জীবন ব্যাপিয়া সত্যকেই আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকি। অন্যের কথায় আমরা যেন মোটেই কর্ণপাত না করি। সমগ্র জীবনের সাধনার ফলে যদি আমাদের মধ্যে একজনও জগতের কঠিন বন্ধনপাশ ছিন্ন করিয়া মুক্ত হইতে পারে, তবেই আমাদের ব্রত উদ‍্‍যাপিত হইল। হরিঃ ওঁ।

আর একটি কথা। ভারতকে আমি সত্য-সত্যই ভালবাসি, কিন্তু প্রতিদিন আমার দৃষ্টি খুলিয়া যাইতেছে। আমাদের দৃষ্টিতে ভারতবর্ষ, ইংলণ্ড কিম্বা আমেরিকা ইত্যাদি আবার কি? ভ্রান্তিবশতঃ লোকে যাহাদিগকে ‘মানুষ’ বলিয়া অভিহিত করে, আমরা সেই ‘নারায়ণের’ই সেবক। যে ব্যক্তি বৃক্ষমূলে জলসেচন করে, সে কি প্রকারান্তরে সমস্ত বৃক্ষটিতেই জলসেচন করে না?

কি সামাজিক, কি রাজনৈতিক, কি আধ্যাত্মিক—সকল ক্ষেত্রেই যথার্থ কল্যাণের ভিত্তি একটিই আছে, সেটি—এইটুকু জানা যে, ‘আমি ও আমার ভাই এক।’ সর্বদেশে সর্বজাতির পক্ষেই এ কথা সমভাবে সত্য। আমি বলিতে চাই, প্রাচ্য অপেক্ষা পাশ্চাত্যই এ তত্ত্ব আরও শীঘ্র ধারণা করিতে পারিবে। কারণ এই চিন্তাসূত্রটির প্রণয়নে এবং মুষ্টিমেয় কয়েকজন অনুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি উৎপন্ন করিয়াই প্রাচ্যের সমুদয় ক্ষমতা প্রায় নিঃশেষিত।

আমরা যেন নাম, যশ ও প্রভুত্ব-স্পৃহা বিসর্জন দিয়া কর্মে ব্রতী হই। আমরা যেন কাম, ক্রোধ ও লোভের বন্ধন হইতে মুক্ত হই। তাহা হইলেই আমরা সত্য বস্তু লাভ করিব।

ভগবৎপদাশ্রিত
আপনার বিবেকানন্দ
…………………………….

২০৯*
[মিঃ লেগেটকে লিখিত]
Thousand Island Park, N.Y.
অগষ্ট, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
… মিঃ স্টার্ডির (যাঁর কথা সেদিন আপনাকে লিখেছি) কাছ থেকে আর একখানা পত্র পেলাম। এখানি আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। দেখুন, সমস্ত কেমন আগে থেকে তৈরী হয়ে আসছে! এখানি ও মিঃ লেগেটের নিমন্ত্রণপত্র একসঙ্গে দেখলে, আপনার কি এটি দৈব আহ্বান বলে মনে হয় না? আমি ঐরূপ মনে করি। সুতরাং ঐ আহ্বান অনুসরণ করছি। অগষ্টের শেষাশেষি মিঃ লেগেটের সঙ্গে আমি পারি যাব এবং সেখানে থেকে লণ্ডন। … হেল-পরিবারের সঙ্গে দেখা করবার জন্য চিকাগো যেতে হবে। সুতরাং গ্রীনএকার সম্মিলনীতে যোগ দিতে পারলাম না।

আমার গুরুভাইদের ও আমার কাজের জন্য আপনি যতটুকু সাহায্য করতে পারেন, কেবল সেইটুকু সাহায্যই আমি এখন চাই। আমি আমার স্বদেশবাসীর প্রতি কর্তব্য কতকটা করেছি। এখন জগতের জন্য—যার কাজ থেকে এই দেহ পেয়েছি, দেশের জন্য—যে দেশ আমাকে ভাব দিয়েছে, মনুষ্যজাতির জন্য—যাদের মধ্যে আমি নিজেকে একজন বলতে পারি, কিছু করব। যতই বয়স বাড়ছে, ততই ‘মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী’ হিন্দুদের এই মতবাদের তাৎপর্য বুঝতে পাচ্ছি। মুসলমানেরাও তাই বলেন। আল্লা দেবদূতগণকে (Angels) বলেছিলেন আদমকে প্রণাম করতে। ইবলিস্ করেনি, তাই সে শয়তান (Satan) হল। এই পৃথিবী যাবতীয় স্বর্গাপেক্ষা উচ্চ—ইহাই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষালয়। আর মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের লোকেরা নিশ্চয়ই আমাদের অপেক্ষা নিম্নশ্রেণীর—তারা যখন আমাদের সঙ্গে সংবাদ আদানপ্রদান করতে পারে না। তথাকথিত উচ্চপ্রাণিগণ পরলোকগত অপর এক দেহধারী ব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়; ঐ দেহ সূক্ষ্ম হলেও বস্তুতঃ হস্তপদাদিবিশিষ্ট মানবদেহই। তারা এই পৃথিবীতে অপর কোন লোকে বাস করে, একেবারে অদৃশ্যও নয়। তারা চিন্তা করে, আমাদের ন্যায় তাদেরও জ্ঞান ও অন্যান্য সব কিছুই আছে—সুতরাং তারাও মানুষ। দেবগণ—এঞ্জেলগণও তাই। কিন্তু কেবল মানুষই ঈশ্বর হয় এবং অন্যান্য সকলে পুনরায় মানবজন্ম গ্রহণ করে তবে ঈশ্বরত্ব লাভ করতে পারে। ম্যাক্সমূলারের শেষ প্রবন্ধটি আপনার কেমন লাগল? ইতি

বিবেকানন্দ
…………………………….

২১০*
আমেরিকা
অগষ্ট, ১৮৯৫

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এই পত্রখানি তোমার কাছে পৌঁছবার পূর্বেই আমি পারিতে উপস্থিত হব। সুতরাং কলিকাতা ও খেতড়িতে লিখে দিও যে, উপস্থিত যেন সেখান থেকে আমেরিকার ঠিকানায় চিঠি না লেখে। তবে আগামী শীতেই আবার নিউ ইয়র্কে ফিরছি। সুতরাং যদি বিশেষ কিছু প্রয়োজনীয় সংবাদ থাকে, তবে নিউ ইয়র্কে 19 W. 38th St. ঠিকানায় পাঠাবে। এ বছর আমি অনেক কাজ করেছি, আসছে বছর আরও অনেক কিছু করবার আশা রাখি। মিশনরীদের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিও না। তারা চেঁচাবে, এ স্বাভাবিক। অন্ন মারা গেলে কে না চেঁচায়? গত দুই বৎসর মিশনরী ফণ্ডে মস্ত ফাঁক পড়েছে, আর সে-ফাঁকটা বেড়েই চলেছে। যাই হোক, আমি মিশনরীদের সম্পূর্ণ সাফল্য কামনা করি। যতদিন তোমাদের ঈশ্বর ও গুরুর ওপর অনুরাগ থাকবে, আর সত্যের ওপর বিশ্বাস থাকবে, ততদিন হে বৎস, কিছুতেই তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু এর মধ্যে একটি গেলেই বিপদ। তুমি বেশ বলেছ, আমার ভাবগুলি ভারত অপেক্ষা পাশ্চাত্য দেশে বেশী পরিমাণে কার্যে পরিণত হতে চলেছে। আর প্রকৃতপক্ষে ভারত আমার জন্য যা করেছে, আমি ভারতের জন্য তার চেয়ে বেশী করেছি। এক টুকরো রুটি ও তার সঙ্গে ঝুড়িখানেক গালাগাল—এই তো সেখানে পেয়েছি। আমি সত্যে বিশ্বাসী; আমি যেখানেই যাই না কেন, প্রভু আমার জন্য দলে দলে কর্মী প্রেরণ করেন। আর তারা ভারতীয় শিষ্যদের মত নয়, তারা গুরুর জন্য জীবন ত্যাগ করতে প্রস্তুত। সত্যই আমার ঈশ্বর—সমগ্র জগৎ আমার দেশ। আমি ‘কর্তব্যে’ বিশ্বাসী নই, ‘কর্তব্য’ হচ্ছে সংসারীর পক্ষে অভিশাপ, সন্ন্যাসীর জন্য নয়। ‘কর্তব্য’ একটা বাজে কথামাত্র। আমি মুক্ত, আমার বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে—এই শরীর কোথায় যায় বা না যায়, আমি কি তা গ্রাহ্য করি? তোমরা আমাকে বরাবর ঠিক ঠিক সাহায্য করে এসেছ—প্রভু তোমাদের তার পুরস্কার দেবেন। আমি ভারত বা আমেরিকা থেকে কখনও প্রশংসা চাইনি, আর এখনও ঐরূপ ফাঁকা জিনিষ খুঁজছি না। আমি ভগবানের সন্তান, আমার কাছে একটা সত্য আছে—জগৎকে শেখাবার জন্য। আর যিনি আমাকে ঐ সত্য দিয়েছেন, তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে আমাকে সহকর্মী সব প্রেরণ করবেন। তোমরা—হিন্দুরা কয়েক বছরের ভেতরই দেখবে, প্রভু পাশ্চাত্য দেশে কি কাণ্ড করেন! তোমরা সেই প্রাচীনকালের য়াহুদী জাতির মত—জাব পাত্রে শোয়া কুকুরের মত—নিজেরাও খাবে না, অপরকেও খেতে দেবে না। তোমাদের ধর্মভাব মোটেই নেই; রান্নাঘর হচ্ছে তোমাদের ঈশ্বর, শাস্ত্র—ভাতের হাঁড়ি। আর তোমাদের শক্তির পরিচয়—রাশি রাশি সন্তান-উৎপাদনে। তোমরা কয়েকটি ছেলে খুব সাহসী, কিন্তু কখনও কখনও আমার মনে হয়, তোমরাও বিশ্বাস হারাচ্ছ। বৎসগণ, কামড়ে পড়ে থাক, আমার সন্তানগণের মধ্যে কেউ যেন কাপুরুষ না থাকে। তোমাদের মধ্যে যে সর্বাপেক্ষা সাহসী, সর্বদা তার সঙ্গ করবে। বড় বড় ব্যাপার কি কখনও সহজে নিষ্পন্ন হয়? সময়, ধৈর্য ও অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে কাজ হয়। আমি তোমাদের এখন অনেক কথা বলতে পারতাম, যাতে তোমাদের হৃদয় আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, কিন্তু তা আমি বলব না। আমি লৌহবৎ দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও হৃদয় চাই, যা কিছুতেই কম্পিত হয় না। দৃঢ়ভাবে লেগে থাক। প্রভু তোমাদের আশীর্বাদ করুন।

সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………….

২১১*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ
Hotel Continental
3 Rue Castiglione, Paris
২৬ অগষ্ট, ১৮৯৫

প্রিয় বন্ধু,
গত পরশু এখানে এসে পৌঁছেছি। একজন আমেরিকান বন্ধুর অতিথি হয়ে এদেশে এসেছি; আগামী সপ্তাহে এখানে তাঁর বিবাহ হবে।

সে সময় পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমাকে এখানে থাকতে হবে তারপরে লণ্ডন যাবার কোন বাধা থাকবে না ।

আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের আনন্দের জন্য ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছি।

সদা সৎস্বরূপে আপনার
বিবেকানন্দ
…………………………….

২১২*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
C/o Miss MacLeod, Hollande
রু দ্য লা প্যায়্, পারি
৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫

সুহৃদ‍বর,
আপনার অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ অনাবশ্যক; কারণ ভাষায় তা ব্যক্ত হবার নয়।

মিস মূলারের এক প্রীতিপূর্ণ আমন্ত্রণ পেয়েছি। আর তাঁর বাসস্থানও আপনার বাড়ীর কাছে। সুতরাং প্রথমে দু-এক দিন তাঁর ওখানে উঠে তারপর আপনার বাড়ী গেলে বেশ হবে, মনে করছি।

আমার শরীর কয়েকদিন যাবৎ বিশেষ অসুস্থ থাকায় পত্র দিতে বিলম্ব হল। অচিরে মনে প্রাণে আপনার সহিত মিলিত হবার সুযোগের অপেক্ষায় আছি। প্রেম ও ঈশ্বরপ্রীতি সূত্রে আপনার সহিত চির আবদ্ধ—

বিবেকানন্দ
…………………………….

২১৩*
পারি
৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এইমাত্র তোমার ও জি.জি-র পত্র আমেরিকা ঘুরে আমার কাছে পৌঁছল।

তোমরা যে মিশনরীদের বাজে কথাগুলোর ওপর এতটা গুরত্ব আরোপ কর, তাতে আমি আশ্চর্য হচ্ছি। অবশ্য আমি সবই খাই। যদি কলিকাতার লোকেরা চায় যে, আমি হিন্দুখাদ্য ছাড়া আর কিছু না খাই, তবে তাদের বলো, তারা যেন আমায় একজন রাঁধুনী ও তাকে রাখবার উপযুক্ত খরচ পাঠিয়ে দেয়। এক কানাকড়ি সাহায্য করবার মুরদ নেই, এদিকে গায়ে পড়ে উপদেশ ঝাড়া—এতে আমার হাসিই পায়।

অপরদিকে যদি মিশনরীরা বলে, আমি সন্ন্যাসীর কামিনী-কাঞ্চন-ত্যাগ-রূপ প্রথম দুই ব্রত কখনও ভঙ্গ করেছি, তবে তাদের বলো যে, তারা মস্ত মিথ্যাবাদী। মিশনরী হিউমকে পরিষ্কাররূপে লিখে জিজ্ঞাসা করবে, তিনি যেন তোমায় লেখেন—তিনি আমার কি কি অসদাচরণ দেখেছিলেন, অথবা তিনি যাদের কাছে শুনেছেন, তাদের নাম যেন তোমায় দেন এবং জানতে চাইবে—তিনি স্বচক্ষে তা দেখেছিলেন কিনা। এইরূপ করলেই প্রশ্নের সমাধান হয়ে যাবে, আর তাদের দুষ্টামি ধরা পড়ে যাবে। ডাঃ জেন‍্‍স‍্‍‍ ঐ মিথ্যাবাদীদের এইরূপে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

আমার সম্বন্ধে এইটুকু জেনে রেখো, কারও কথায় আমি চলব না। আমার জীবনের ব্রত কি, তা আমি জানি, আর কোন জাতিবিশেষের ওপর আমার তীব্র বিদ্বেষ নেই। আমি যেমন ভারতের, তেমনি সমগ্র জগতের। এ বিষয় নিয়ে বাজে যা-তা বকলে চলবে না, আমি যতটা পারি তোমাদের সাহায্য করেছি—এখন তোমরা নিজেদের সামলাও। কোন্ দেশের আমার উপর বিশেষ দাবী আছে? আমি জাতিবিশেষের ক্রীতদাস না কি? অবিশ্বাসী নাস্তিকগণ, তোমরা আর বাজে বকো না।

আমি এখানে কঠোর পরিশ্রম করেছি—আর যা কিছু টাকা পেয়েছি, সব কলিকাতা ও মান্দ্রাজে পাঠিয়েছি। এখন এত করবার পর তাদের আহাম্মকের মত হুকুমে আমাকে চলতে হবে! তোমরা কি লজ্জিত হচ্ছ না? আমি হিন্দুদের কি ধার ধারি? আমি কি তাদের প্রশংসার এতটুকু তোয়াক্কা রাখি, না—তাদের নিন্দার ভয় করি? বৎস, আমি অসাধারণ প্রকৃতির লোক, তোমরা পর্যন্ত এখনও আমায় বুঝতে পারলে না। তোমাদের কাজ তোমরা করে যাও; তা যদি না পার তো চুপ করে থাক। আমাকে দিয়ে তোমাদের মনোমত কাজ করাবার চেষ্টা করো না। আমার পেছনে এমন একটা শক্তি দেখছি, যা মানুষ দেবতা বা শয়তানের শক্তির চেয়ে অনেকগুণ বড়। কারও সাহায্য চাই না। আমিই তো সারাজীবন অপরকে সাহায্য করে আসছি। আমাকে সাহায্য করেছে, এমন লোক তো আমি এখনও দেখতে পাইনি। বাঙালীরা—তাদের দেশে যত মানুষ জন্মেছে, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাজে সাহায্যের জন্য কটা টাকা তুলতে পারে না, এদিকে ক্রমাগত বাজে বকছে; আর যার জন্যে তারা কিছুই করেনি, বরং যে তাদের জন্য যথাসাধ্য করেছে, তারই ওপর হুকুম চালাতে চায়! জগৎ এইরূপ অকৃতজ্ঞই বটে!! তোমরা কি বলতে চাও, তোমরা যাদের শিক্ষিত হিন্দু বলে থাক, সেই জাতিভেদচক্রে নিষ্পিষ্ট, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, দয়ালেশশূন্য, কপট, নাস্তিক, কাপুরুষদের মধ্যে একজন হয়ে জীবনধারণ করবার ও মরবার জন্য আমি জন্মেছি? আমি কাপুরুষতাকে ঘৃণা করি। আমি কাপুরুষদের সঙ্গে এবং রাজনৈতিক আহাম্মকির সঙ্গে কোন সংস্রব রাখতে চাই না। আমি কোন প্রকার রাজনীতিতে (Politics) বিশ্বাসী নই। ঈশ্বর ও সত্যই জগতে একমাত্র রাজনীতি, আর সব বাজে।

কাল লণ্ডনে যাচ্ছি। উপস্থিত সেখানে আমার ঠিকানা হবেঃ
C/o ই.টি.স্টার্ডি; হাইভিউ, কেভার্শ্যাম, রিডিং, ইংলণ্ড

সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ

পুঃ—আমি ইংলণ্ড ও আমেরিকা উভয়ত্রই কাগজ বার করব, মনে করছি। সুতরাং কাগজের জন্য তোমরা সম্পূর্ণরূপে আমার ওপর নির্ভর কর, তাহলে চলবে না। তোমাদের ছাড়াও আমার অনেক জিনিষ আছে দেখবার।
বি
…………………………….

২১৪
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
হাইভিউ, কেভার্শ্যাম,
রিডিং, ইংলণ্ড ১৮৯৫

প্রেমাস্পদেষু,
ইতঃপূর্বে পত্র পাইয়া থাকিবে। এক্ষণে ইংলণ্ডে আমার যাবতীয় পত্রাদি উপরিউক্ত ঠিকানায় পাঠাইবে। মিঃ স্টার্ডি তারকদাদার পরিচিত। তিনি আমাকে এখানে আনাইয়াছেন এবং আমরা উভয়ে একত্রে ইংলণ্ডে হাঙ্গাম করিবার চেষ্টায় আছি। এবার আমি নভেম্বর মাসে পুনরায় আমেরিকা যাত্রা করিব, অতএব এখানে একজন উত্তম সংস্কৃত ও ইংরেজী, বিশেষতঃ ইংরেজী-জানা লোকের আবশ্যক—শরৎ বা তুমি বা সারদা। তাহার মধ্যে তোমার শরীর যদি একদম আরোগ্য হইয়া থাকে তো বড়ই ভাল। তুমি আসিবে, নতুবা শরৎকে পাঠাইবে। কাজ এই যে, আমি যে-সকল চেলা-পত্র এখানে রাখিয়া যাইব, তাহাদের শিক্ষা দেওয়া ও বেদান্তাদি পড়ান এবং একটু-আধটু ইংরেজীতে তর্জমা করা, মধ্যে মধ্যে লেকচার-পত্র দেওয়া। ‘কর্মণা বাধ্যতে বুদ্ধিঃ।’—র আসিবার বড়ই ইচ্ছা, কিন্তু গোড়া শক্ত করে না গাঁথিলে ফাঁস হইয়া যাইবে। এই পত্রে এক চেক পাঠাইলাম, তাহাতে কাপড়-চোপড় কিনিবে (অর্থাৎ যে আসিবে)। চেক মহেন্দ্রবাবু—মাষ্টার মহাশয়ের নামে পাঠাইলাম। গঙ্গাধরের টিবেটি চোগা মঠে আছে; ঐ ঢঙের এক চোগা গেরুয়া রঙের বানাইয়া লইবে। Collar (কলার)-টা যেন কিছু উপরে হয়, অর্থাৎ গলা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে। … সকলের আগে একটা খুব গরম ওভারকোট; শীত বড়ই প্রবল। জাহাজের উপর ওভারকোট খুব গরম …। সেকেণ্ড ক্লাসের টিকেট পাঠাইতেছি; অর্থাৎ ফার্ষ্ট ক্লাস সেকেণ্ড ক্লাসে বড় বিশেষ পার্থক্য নাই। … যদি শশীর আসা স্থির হয়, তাহা হইলে পূর্ব হইতে নিরামিষ খাওয়ার বন্দোবস্ত করিয়া লইবে।

বোম্বে যাইয়া মেসার্স কিং কিং এণ্ড কোং, ফোর্ট, বোম্বে অফিসে যাইয়া বলিবে যে, ‘আমি স্টার্ডি সাহেবের লোক’—তাহা হইলে তাহারা তোমাকে এক টিকেট দিবে ইংলণ্ড পর্যন্ত। এখান হইতে এক চিঠি উক্ত কোম্পানীর উপর যাইতেছে। খেতড়ির রাজাকে এক চিঠি লিখিতেছি যে, তাঁহার বোম্বের এজেণ্ট যেন তোমাকে দেখিয়া শুনিয়া book (বুক) করিয়া দেয়। যদি এই ১৫০ টাকায় কাপড়-চোপড় না হয়, রাখাল যেন তোমায় বাকী টাকা দেয়; আমি পরে তাহাকে পাঠাইয়া দিব। তাছাড়া ৫০ টাকা হাত খরচের জন্য রাখিবে—রাখালকে দিতে বলিবে। তারপর আমি পাঠাইয়া দিব। চুনীবাবুর জন্য যে টাকা পাঠাইয়াছি, তাহার খবর আজও পাই নাই। পত্রপাঠ চলিয়া আসিবে। মহেন্দ্রবাবুকে বলিবে, তিনি আমার কলিকাতার এজেণ্ট। তিনি যেন পত্রপাঠ মিঃ স্টার্ডিকে এক চিঠি লিখেন যে, যা কিছু কলিকাতা সম্বন্ধে লেখা পড়া business (বৈষয়িক কার্য) ইত্যাদি আমাদের করিতে হইবে, তাহা তিনি করিতে রাজী আছেন। অর্থাৎ মিঃ স্টার্ডি আমার ইংলণ্ডের সেক্রেটারী, মহেন্দ্র- বাবু কলিকাতার, আলাসিঙ্গা মান্দ্রাজের ইত্যাদি ইত্যাদি। মান্দ্রাজে এ খবর পাঠাইবে। সকলে উঠিয়া পড়িয়া না লাগিলে কি কাজ হয়? ‘উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মীঃ’ (উদ্যোগী পুরুষসিংহেরই লক্ষ্মী লাভ হয়) ইত্যাদি। পেছু দেখিতে হইবে না—forward (এগিয়ে চল)। অনন্ত বীর্য, অনন্ত উৎসাহ, অনন্ত সাহস ও অনন্ত ধৈর্য চাই, তবে মহাকার্য সাধন হইবে। দুনিয়ায় আগুন লাগাইয়ে দিতে হইবে।

আর যে দিন ষ্টীমার ঠিক হইবে, তৎক্ষণাৎ মিঃ স্টার্ডিকে এক পত্র লিখিবে যে, ‘অমুক ষ্টীমারে আমি আসিতেছি।’ নতুবা লণ্ডনে পৌঁছিয়া গোলমাল হইয়া না যাও। যে ষ্টীমার একদম লণ্ডন যায়, তাহাই লইবে; কারণ তাহাতে যদিও দু-চারি দিন অধিক লাগে, পরন্তু ভাড়া কম লাগে। এক্ষণে আমাদের অধিক পয়সা তো নাই। কালে দলে দলে চতুর্দিকে পাঠাইব। কিমধিকমিতি।

বিবেকানন্দ

পুঃ—পত্রপাঠ খেতড়ির রাজাকে লিখিবে যে, তুমি বোম্বে যাইতেছ ইত্যাদি, এবং তাঁহার লোক যেন তোমায় জাহাজে চড়াইয়া দেয়।
বি

এই ঠিকানা একটা পকেট বুকে লিখিয়া সঙ্গে রাখিবে—গোল না হয়।
…………………………….

২১৫
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
রিডিং, ইংলণ্ড
১৮৯৫

কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে সবিশেষ অবগত হইলাম। তোমার সঙ্কল্প বড়ই উত্তম। কিন্তু তোমাদের জাতির মধ্যে Organization (সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া কার্য করিবার) শক্তির একেবারেই অভাব। ঐ এক অভাবই সকল অনর্থের কারণ। পাঁচজনে মিলে একটা কাজ করিতে একেবারেই নারাজ। Organization—এর (সঙ্ঘজীবনের) প্রথম আবশ্যক এই যে, obedience (আজ্ঞাবহতা), যখন ইচ্ছা হল একটু কিছু করিলাম, তারপর ঘোড়ার ডিম—তাতে কাজ হয় না—plodding industry and perseverance (স্থির ধীর ভাবে পরিশ্রম ও অধ্যবসায়) চাই। Regular correspondence (নিয়মিত পত্রব্যবহার) অর্থাৎ কি কাজ করছ—কি ফল হল, প্রতিমাসে বা মাসে দুইবার রীতিমত লিখিয়া পাঠাইবে। একজন উত্তম ইংরেজী ও সংস্কৃত-জানা সন্ন্যাসী এখানে (ইংলণ্ডে) আবশ্যক। আমি এখান হইতে শীঘ্রই পুনরায় আমেরিকা যাইব, আমার অবর্তমানে সে এখানে কার্য করিবে। শরৎ ও শশী এই দুইজন ছাড়া আমি তো আর কাকেও দেখছি না। শরৎকে টাকা পাঠিয়েছি ও পত্রপাঠ চলে আসতে লিখেছি। রাজাজীকে৮২ লিখেছি যে, তাঁর বোম্বের agent (ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী) যেন শরৎকে দেখে শুনে জাহাজে চাপিয়ে দেয়। আমি লিখতে ভুলে গেছি, তুমি যদি মনে করে পার—শরতের সঙ্গে এক বস্তা মুগের ডাল, ছোলার ডাল, অড়র ডাল ও কিঞ্চিৎ মেথি পাঠিয়ে দিবে।৮৩ পণ্ডিত নারায়ণ দাস, শ্রীশঙ্করলাল, ওঝাজী, ডাক্তার ও সকলকে আমার প্রণয় বলিবে। গোপীর চোখের ওষুধ এখানে কি আছে? পেটেণ্ট ওষুধ সব জুয়াচুরি সর্বত্র। তাকে আমার আশীর্বাদ দেবে ও আর আর সব চেলাগুলোকে। যজ্ঞেশ্বরবাবু মীরাটে একটা কি সভা করেছেন ও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাজ করতে চান। ভাল, তাঁর একটা কি কাগজও আছে, কালীকে সেখানে পাঠিয়ে দাও, কালী যদি পারে মীরাটে একটা centre (কেন্দ্র) করুক এবং সেই কাগজটা যাতে হিন্দী ভাষাতে হয়, এমন চেষ্টা করুক—আমি কিছু কিছু টাকা পাঠিয়ে দেব। কালী মীরাট গিয়ে আমাকে যথাযথ রিপোর্ট করলে আমি টাকা পাঠিয়ে দেব। আজমীরে একটা centre (কেন্দ্র) করবার চেষ্টা কর। … সাহারানপুরে পণ্ডিত অগ্নিহোত্রী কি একটা সভা করেছেন। তাঁরা আমাকে এক চিঠি লেখেন। তাঁদের সঙ্গে correspondence (পত্রব্যবহার) রাখিবে। সকলের সঙ্গে মেলামেশা etc., work, work (কাজ কাজ)। এই রকম centre (কেন্দ্র) করতে থাক। কলিকাতায়—মান্দ্রাজে already (পূর্ব হইতেই) আছে, যদি মীরাটে ও আজমীরে পার তো বড়ই ভাল হয়। ঐপ্রকার ধীরে ধীরে জায়গায় জায়গায় centre (কেন্দ্র) করতে থাক। এখানে আমার সকল চিঠিপত্র C/o মিঃ ই. টি. স্টার্ডি, হাইভিউ, কেভার্শ্যাম, রিডিং, ইংলণ্ড। আমেরিকায় C/o মিস ফিলিপ‍্‍স্ 19 W. 38th St., নিউ ইয়র্ক। ক্রমে দুনিয়া ছাপিয়ে ফেলতে হবে। Obedience (আজ্ঞাবহতা) প্রথম দরকার। আগুনে ঝাঁপ দিতে তৈয়ার হতে হবে—তবে কাজ হয়। … ঐ-রকম রাজপুতানায় গ্রামে গ্রামে সভা কর etc. কিমধিকমিতি—

বিবেকানন্দ
…………………………….

২১৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy, রিডিং,
ইংলণ্ড
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
মিঃ স্টার্ডি এবং আমি ইংলণ্ডে সমিতি গঠন করিবার জন্য অন্ততঃ দুই-চার জন সেরা দৃঢ়চেতা ও মেধাবী লোক চাই, অতএব আমাদিগকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে হইবে। আমাদিগকে প্রথম হইতে সতর্ক হইতে হইবে—যাহাতে কতকগুলি ‘খেয়ালী’ লোকের পাল্লায় না পড়ি। আপনি বোধ হয় জানেন, আমেরিকাতেও আমার উদ্দেশ্য এইরূপ ছিল। মিঃ স্টার্ডি কিছুদিন ভারতবর্ষে আমাদের সন্ন্যাসীদের সহিত তাহাদের রীতিনীতি মানিয়া বাস করিয়াছিলেন। তিনি একজন শিক্ষিত, সংস্কৃত ভাষায় অভিজ্ঞ এবং অতীব উদ্যমশীল লোক। এ পর্যন্ত উত্তম।

পবিত্রতা, অধ্যবসায় এবং উদ্যম—এই তিনটি গুণ আমি একসঙ্গে চাই। যদি এইরূপ ছয়জন লোক এখানে পাই, আমার কাজ চলিতে থাকিবে। এইরূপ দুই-চারজন লোক পাইবার সম্ভাবনা আছে। ইতি—

বিবেকানন্দ
…………………………….

২১৭*
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy, রিডিং, ইংলণ্ড
সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় জো জো,
তোমাকে শীঘ্র চিঠি না দেওয়ার জন্য সহস্র ক্ষমা চাইছি। লণ্ডনে নির্বিঘ্নে পৌঁছেছি। বন্ধুর সন্ধান পেয়েছি, তাঁর বাড়ীতে বেশ আছি। চমৎকার পরিবার। স্ত্রীটি তাঁর বাস্তবিকই দেবীতুল্য, আর তিনি নিজে যথার্থ ভারতপ্রেমিক। সাধুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে তাঁদেরই মত খেয়ে-দেয়ে তিনি ভারতে দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। কাজেই তাঁর এখানে আমি খুব আনন্দে আছি। এর মধ্যেই ভারত থেকে ফেরা অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন উচ্চপদস্থ সৈনিককে দেখলাম; তাঁরা আমার সঙ্গে বেশ ভদ্র ব্যবহার করলেন। ‘শ্যামবর্ণ ব্যক্তিমাত্রই নিগ্রো’—আমেরিকানদের এই অদ্ভুত ধারণা এখানে মোটেই দেখা যায় না। রাস্তায় কেউ আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়েও থাকে না। ভারতের বাহিরে আর কোথাও এরূপ সুস্থির বোধ করিনি। ইংরেজরা আমাদের বোঝে, আমরাও তাদের বুঝি। এদেশের শিক্ষা, সভ্যতা বেশ উচ্চ স্তরের; সেজন্য এবং বহুদিনের শিক্ষার ফলে এতটা পার্থক্য।

টার্টল-ডাভেরা ফিরেছেন কি? তাঁদের ও তাঁদের স্বজনের উপর ভগবানের কৃপা সদা বর্ষিত হোক। ‘বেবী’রা কেমন আছে? আর এলবার্টা ও হলিস্টার? তাদের আমার অজস্র ভালবাসা জানাবে এবং তুমি নিজে জানবে।

বন্ধুটি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত। সুতরাং শঙ্কর প্রভৃতি আচার্যদের ভাষ্যপাঠে আমরা সর্বদা নিযুক্ত আছি। এখানে এখন কেবল ধর্ম ও দর্শন চলেছে, জো জো! অক্টোবর মাসে লণ্ডনে ক্লাস নেবার চেষ্টায় আছি।

চির প্রীতি-স্নেহ-শুভেচ্ছা
সহ বিবেকানন্দ
…………………………….

২১৮*
রিডিং, ইংলণ্ড
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
মিঃ স্টার্ডিকে সংস্কৃত শিখতে সাহায্য করা ছাড়া এ পর্যন্ত আমি উল্লেখযোগ্য কোন কাজই করিনি। ভারতবর্ষ থেকে আমার গুরুভ্রাতাদের মধ্যে একজন সন্ন্যাসীকে আনবার জন্য তিনি আমায় বলেছেন। আমি আমেরিকায় চলে গেলে সেই সন্ন্যাসী তাঁকে সাহায্য করতে পারেন, আমি ভারতবর্ষে লিখেছি একজনের জন্য। এ পর্যন্ত সব ভালভাবেই চলছে। এখন পরবর্তী ঢেউয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। ‘এড়িয়ে যেও না, খুঁজেও বেড়িও না; ভগবান্ যা পাঠান, তার জন্য অপেক্ষা কর’—এই আমার মূলমন্ত্র। আমি চিঠি খুব কম লিখি বটে, কিন্তু আমার হৃদয় কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ। ইতি—

বিবেকানন্দ
…………………………….

২১৯*
রিডিং, ইংলণ্ড
৪ অক্টোবর, ১৮৯৫

স্নেহের মার্গারেট,৮৪
… পবিত্রতা, ধৈর্য ও অধ্যবসায় দ্বারা সকল বিঘ্ন দূর হয়। সব বড় বড় ব্যাপার অবশ্য ধীরে ধীরে হয়ে থাকে। … আমার ভালবাসা জানবে। ইতি—

বিবেকানন্দ
…………………………….

২২০
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
রিডিং
৪ অক্টোবর, ১৮৯৫

অভিন্নহৃদয়েষু,
তুমি অবগত আছ যে, আমি এক্ষণে ইংলণ্ডে। প্রায় এক মাস যাবৎ এস্থানে থাকিয়া পুনঃ আমেরিকা যাত্রা করিব। আগামী গ্রীষ্মকালে পুনঃ ইংলণ্ডে আসিব। এক্ষণে ইংলণ্ডে বিশেষ কিছু হইবার আশা নাই, তবে প্রভু সর্বশক্তিমান্‌। ধীরে ধীরে দেখা যাউক।

ইতঃপূর্বে শরৎকে আসিবার টাকা পাঠাইয়াছি ও পত্র লিখিয়াছি। শরৎ বা শশী দুইজনের একজন যাহাতে আইসে তাহা করিবে। শশীর রোগ যদি সম্পূর্ণ আরোগ্য হইয়া থাকে, অর্থাৎ নিশ্চিহ্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে পাঠাইবে। চর্মরোগ শীতপ্রধান দেশে বড় প্রবল হইতে পারে না—উহা এই দারুণ শীতে একদম সারিয়া যাইতে পারে। নতুবা শরৎকে। … Sturdy (স্টার্ডি) সাহেবের টাকা, সে যে-প্রকার লোক চায়, সেই প্রকার আনাইতে হইবে। উক্ত মিঃ স্টার্ডি আমার নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছে এবং বড়ই উদ্যমী ও সজ্জন। থিওসফির হাঙ্গামায় পড়িয়া বৃথা সময় নষ্ট করিয়াছে বলিয়া বড়ই আপসোস।

প্রথমতঃ এরূপ লোক চাই, যাহার ইংরেজী এবং সংস্কৃতে বিশেষ বোধ। ‘—’ শীঘ্র ইংরেজী শিখিতে পারিবেন এস্থানে আসিলে, সত্য বটে, কিন্তু এদেশে শিখিতে লোক এখনও আনিতে পারি না; যাহারা শিখাইতে পারিবে, তাহাদের প্রথম চাই। দ্বিতীয় কথা এই যে, যাহারা সম্পদে বিপদে আমায় ত্যাগ করিবে না, তাহাদের আমি বিশ্বাস করি। … অত্যন্ত বিশ্বাসী লোক চাই, তারপর গোড়াপত্তন হয়ে গেলে যার ইচ্ছা গোলমাল কর, ভয় নাই।

… দাদা, না হয় রামকৃষ্ণ পরমহংস একটা মিছে বস্তুই ছিল, না হয় তাঁর আশ্রিত হওয়া একটা বড় ভুল কর্মই হয়েছে, কিন্তু এখন উপায় কি? একটা জন্ম না হয় বাজেই গেল; মরদের বাত কি ফেরে? দশ স্বামী কি হয়? তোমরা যে যার দলে যাও, আমার কোন আপত্তি নাই, কিছুমাত্রও নাই, তবে এ দুনিয়া ঘুরে দেখছি যে, তাঁর ঘর ছাড়া আর সকল ঘরেই ‘ভাবের ঘরে চুরি’। তাঁর জনের উপর আমার একান্ত ভালবাসা, একান্ত বিশ্বাস। কি করিব? একঘেয়ে বল বলবে, কিন্তু ঐটি আমার আসল কথা। যে তাঁকে আত্মসমর্পণ করেছে, তার পায়ে কাঁটা বিঁধলে আমার হাড়ে লাগে, অন্য সকলকে আমি ভালবাসি। আমার মত অসাম্প্রদায়িক জগতে বিরল, কিন্তু ঐটুকু আমার গোঁড়ামি, মাফ করবে। তাঁর দোহাই ছাড়া কার দোহাই দেব? আসছে জন্মে না হয় বড় গুরু দেখা যাবে, এ জন্ম এ শরীর সেই মূর্খ বামুন কিনে নিয়েছে।

পেটের কথা খুলে বললুম দাদা, রাগ করো না। আমি তোমাদের গোলাম, যতক্ষণ তোমরা তাঁর গোলাম—এক চুল তার বাইরে গেলে তোমরা আর আমি এক সমান। … সমাজ-ফমাজ যত দেখছ দেশ-বিদেশে, সব যে তিনি গিলে রেখেছেন দাদা—‘ময়ৈবৈত নিহতাঃ পূর্বমেব নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্।’ আজ বা কাল ও-সব তোমাদের অঙ্গে মিশিয়ে যাবে যে। হায় রে অল্প বিশ্বাস! তাঁর কৃপায় ‘ব্রহ্মাণ্ডং গোষ্পদায়তে।’ নিমকহারাম হয়ো না, ও পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই। নাম যশ সুকাজ—যজ্জুহোসি যত্তপস্যাসি যদশ্নাসি &c. (ইত্যাদি) সব তাঁর পায়ে সঁপে দাও। আমাদের আর কি চাই? তিনি শরণ দিয়েছেন, আবার কি চাই? ভক্তি নিজেই যে ফলস্বরূপা—আবার চাই কি? হে ভাই, যিনি খাইয়ে পরিয়ে বুদ্ধি বিদ্যে দিয়ে মানুষ করলেন, যিনি আত্মার চক্ষু খুলে দিলেন, যাঁকে দিনরাত দেখলে যে জীবন্ত ঈশ্বর, যাঁর পবিত্রতা আর প্রেম আর ঐশ্বর্য রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, যীশু, চৈতন্য প্রভৃতিতে এক কণা মাত্র প্রকাশ, তাঁর কাছে নিমকহারামি!!! তোর বুদ্ধ, কৃষ্ণ প্রভৃতি তিন ভাগ গল্প বৈ তো নয়, … অমন ঠাকুরের দয়া ভোল! … কেষ্ট, যীশু জন্মেছিলেন কিনা, তার কোনই প্রমাণ নাই; আর সাক্ষাৎ ঠাকুরকে দেখেও তোদের মাঝে মাঝে মতিভ্রম হয়! ধিক্ তোদের জীবনে!! আর আমি কি বলিব? দেশে দেশে নাস্তিক পাষণ্ডে তাঁর ছবি পূজা করছে, আর তোদের মতিভ্রম হয় সময়ে সময়ে!!! তোদের মত লাখ লাখ তিনি নিঃশ্বাসে তৈরী করে নেবেন। তোদের জন্ম ধন্য, কুল ধন্য, দেশ ধন্য যে, তাঁর পায়ের ধূলা পেয়েছিস। আমি কি করিব, আমাকে কাজেই গোঁড়া হতে হচ্ছে। আমি যে তাঁর জন ছাড়া আর কোথাও পবিত্রতা ও নিঃস্বার্থতা দেখতে পাই না। সকল জায়গাতেই যে ভাবের ঘরে চুরি, কেবল তাঁর ঘর ছাড়া। তিনি যে রক্ষে করছেন, দেখতে পাচ্ছি যে। ওরে পাগল, পরীর মত মেয়ে সব, লাখ লাখ টাকা—-এ সকল তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে, এ কি আমার জোরে? না, তিনি রক্ষা করছেন? তাঁর জন ছাড়া যে আমি কাউকেই একটা টাকা, একটা মেয়ে মানুষের কাছে বিশ্বাস করিনে। যার তাঁকে বিশ্বাস নাই আর মা-ঠাকুরাণীতে ভক্তি নাই, তার ঘোড়ার ডিমও হবে না, সাদা বাঙলা বললুম, মনে রেখো।

… হরমোহন দুরবস্থা জানিয়েছেন এবং শীঘ্রই স্থান-ছাড়া হতে হবে বলছেন। লেকচার চেয়েছেন—লেকচার-ফেকচার এখন কিছু নাই, তবে কিছু টাকা এখনও গাঁটে আছে—তাঁকে পাঠিয়ে দেব, ভয় নাই। পত্রপাঠ পাঠিয়ে দিতাম, কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে যে, আমার টাকা মারা গেছে—সেজন্যই পাঠাই নাই। দ্বিতীয়তঃ কোন্ ঠিকানায় পাঠাব, তা তো জানি না। মান্দ্রাজীরা দেখছি, কাগজ বার করতে পারলে না। বিষয়বুদ্ধি হিন্দুজাতির যে একেবারেই নাই। যে সময়ে যে কাজ প্রতিশ্রুত হও, ঠিক সেই সময়ে তা করা চাই, নতুবা লোকের বিশ্বাস চলে যায়। টাকাকড়ির কথা পত্রপাঠ জবাব দিতে হয়। … মাষ্টার মশায় যদি রাজী হন, তাহলে তাঁকে কলকেতার এজেণ্ট হতে বলবে, কারণ তাঁর উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস এবং তিনি এই সকল বিষয় অনেক বুঝেন, ছেলেমানুষি হুড়দঙ্গুলের কাজ নয়। একটা Centre (কেন্দ্র)—ঠিকানা তাঁকে করতে বলবে, যে ঠিকানা—ঘড়ি-ঘড়ি বদলাবে না ও যে ঠিকানায় আমি কলকেতার সমস্ত চিঠিপত্র পাঠিয়ে দেব। …

কিমধিকমিতি
নরেন্দ্র
…………………………….

২২১*
রিডিং, ইংলণ্ড
অক্টোবর, ১৮৯৫

প্রিয় জো জো,
তোমার পত্র পেয়ে বড়ই সুখী হলাম। মনে হয়েছিল, বুঝি বা আমায় ভুলে গেলে। লণ্ডনে ও লণ্ডনের কাছেপিঠে কয়েকটি বক্তৃতা দেব; ২২ তারিখে সাড়ে আটটার সময় প্রিন্সেস হলে দেব সাধারণের জন্য একটি।

এখানে চলে এসে একটা ক্লাস গড়ে ফেল না। বলতে গেলে এখানে এখনও কিছুই করে উঠতে পারিনি। কাজ ঠিকমত চালু করতে বেশ সময় লাগে। আমেরিকায় নিউ ইয়র্কে সামান্য যা হয়েছে তাতেই আমার দুই বৎসর লেগে গেল। সকলকে ভালবাসা জানাচ্ছি।

তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২২২*
রিডিং
৬ অক্টোবর, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,,
… আমি মিঃ স্টার্ডির সহিত ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে একখানি পুস্তকের অনুবাদ করিতেছি, প্রচুর টীকা সমেত উহা শীঘ্রই প্রকাশিত হইবে। এই মাসে আমাকে লণ্ডনে দুইটি এবং মেডেন-হেডে একটি বক্তৃতা দিতে হইবে। ইহাতে কতকগুলি ক্লাস খুলিবার ও পারিবারিক বক্তৃতার বন্দোবস্ত হইবার সুবিধা হইবে। কতকগুলি হইচই না করিয়া চুপচাপ কাজ করিতে চাই। … আমার শুভেচ্ছাদি জানিবেন।

আপনার
বিবেকানন্দ
…………………………….

২২৩*
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]

C/o E. T. Sturdy, Esq.
হাই ভিউ, কেভার্শ্যাম, রিডিং ইংলণ্ড
অক্টোবর, ১৮৯৫

মা,
ছেলেকে ভোলেননি তো? আপনি এখন কোথায়? মাসীমা ও শিশুরা? আপনার মন্দিরের ঋষিতুল্য পূজারীর খবর কি? ‘জো জো’ এত শীঘ্র ‘নির্বাণ’ লাভ করছে না, কিন্তু তার গভীর নীরবতা দেখে মনে হয় গভীর ‘সমাধি’।

আপনি কি ঘুরে বেড়াচ্ছেন? আমি ইংলণ্ডকে খুব উপভোগ করছি। আমার বন্ধুর সঙ্গে দর্শনশাস্ত্র আলোচনা করে কাটাচ্ছি—খাবার ও ধূমপান করার জন্য অল্প একটু সময় রেখে। দ্বৈতবাদ অদ্বৈতবাদ এবং তৎসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় ছাড়া আমাদের আর কিছু আলোচ্য নেই।

মনে হয় লম্বা ট্রাউজার পরে হলিস্টার অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন হয়েছে; এবং এলবার্টা জার্মান শিখছে।

এখানে ইংরেজরা খুবই বন্ধুভাবাপন্ন। কতিপয় এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ব্যতিরেকে কেউ কালা আদমীদের ঘৃণা করে না। এমন কি রাস্তায় আমাকে লক্ষ্য করে কেউ কোন ব্যঙ্গরব করে না। মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবি, তাহলে কি আমার মুখের রঙ সাদা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আরশিতে সত্য ধরা পড়ে; তবু এখানে সবাই খুব বন্ধুভাবাপন্ন।

আবার যে-সকল ইংরেজ পুরুষ এবং নারী ভারতবর্ষকে ভালবাসে, তারা হিন্দুদের চেয়েও বেশী ‘হিন্দু’। আপনি শুনে বিস্মিত হবেন যে, এখানে আমি নিখুঁত ভারতীয় পদ্ধতিতে প্রস্তুত প্রচুর তরিতরকারী পাচ্ছি। যখন একজন ইংরেজ একটি জিনিষ ধরে, সে তখন তার গভীরতম দেশে প্রবেশ করে। গতকাল জনৈক অধ্যাপক মিঃ ফ্রেজারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে—তিনি এখানে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। তিনি তাঁর অর্ধেক জীবন ভারতে কাটিয়েছেন; প্রাচীন চিন্তা ও জ্ঞানের মধ্যে তিনি এতখানি পুষ্ট হয়েছেন যে, ভারতের বাইরের কোন কিছুর জন্য তিনি মোটেই পরোয়া করেন না। শুনে আশ্চর্য হবেন যে, অনেক চিন্তাশীল ইংরেজ নরনারী মনে করে যে, হিন্দুদের জাতিবিভাগই সামাজিক সমস্যার একমাত্র সমাধান। আপনি হয়তো কল্পনা করতে পারবেন, সেই ধারণা মাথায় নিয়ে তারা সমাজতন্ত্রী ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রীদের কতখানি ঘৃণা করে!! আবার এখানে পুরুষেরা—অতি উচ্চশিক্ষিতেরা—ভারতীয় চিন্তাধারা সম্পর্কে গভীর আগ্রহশীল, সে তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা খুব কম। আমেরিকার চেয়ে এখানে মেয়েদের জীবনের পরিধিও সংকীর্ণতর। এ পর্যন্ত আমার সব কিছুই ভালয় ভালয় হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী ঘটনাবলী জানাব। গৃহস্বামী, রাণীমাতা, জো জো এবং শিশুদের ভালবাসা।

আপনাদের চিরদিনের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২২৪*
রিডিং, ইংলণ্ড
২০ অক্টোবর, ১৮৯৫

প্রিয় জো জো,
এই পত্রে লেগেটদিগকে লণ্ডনে স্বাগত জানাচ্ছি। এক হিসাবে এদেশ আমার মাতৃভূমি, সুতরাং পূর্বেই তোমাদিগকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। পরে আগামী মঙ্গলবার ২২ তারিখে সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় প্রিন্সেস হলে আমি তোমাদের অভ্যর্থনা গ্রহণ করব।

মঙ্গলবার পর্যন্ত আমি এত ব্যস্ত থাকব যে, এর মধ্যে কোনক্রমেই তোমার সঙ্গে দেখা করে উঠতে পারব না। তারপর যে-কোন দিন দেখা করব। চাই কি মঙ্গলবার দিনও গিয়ে পড়তে পারি।

চিরদিনের ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে।

তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২২৫*
C/o E. T. Sturdy,রিডিং, ইংলণ্ড
২৪ অক্টোবর,১৮৯৫

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
‘ব্রহ্মবাদিনের’ দুটি সংখ্যা পেলাম—বেশ হয়েছে—এইরূপ করে চল। কাগজের প্রচ্ছদপট একটু ভাল করবার চেষ্টা কর, আর সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয় মন্তব্যগুলির ভাষাটা আর একটু হালকা অথচ ভাবগুলি একটু চটকদার করবার চেষ্টা কর। গুরুগম্ভীর ভাষা ও ছাঁদ কেবল প্রধান প্রধান প্রবন্ধগুলির জন্য রেখে দাও। মিঃ স্টার্ডি কয়েকটি প্রবন্ধ লিখবেন। আমি তোমাকে কয়েকখানা কাগজও পাঠাচ্ছি—তার মধ্যে দুখানা যথাক্রমে ধর্মমহাসভা ও মিশনরীগণ সম্বন্ধে। কাগজখানা ইংলিশ চার্চের উন্নতিশীল সম্প্রদায়ের অন্যতম মুখপত্র। আমার অনুমান—সম্পাদকপত্নী আমাকে এগুলি পাঠিয়ে দিয়েছেন, কারণ তাঁর বৈঠকখানায় আমি শীঘ্র বক্তৃতা দেব। সম্পাদকের নাম মিঃ হাউইস—তিনি ইংলিশ চার্চের একজন বিখ্যাত পুরোহিত।

ইতোমধ্যেই এখানে আমার প্রথম বক্তৃতা হয়ে গেছে, আর ‘স্ট্যাণ্ডার্ড’ কাগজের মন্তব্য পড়লেই বুঝতে পারবে, লোকে তা কেমন ভালভাবে নিয়েছে। ‘স্ট্যাণ্ডার্ড’ রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের বিশেষ শক্তিশালী কাগজগুলির মধ্যে অন্যতম। আগামী মঙ্গলবার লণ্ডনে গিয়ে ৮০ ওকলি ষ্ট্রীট, (Chelsea, London, S.W.) ঠিকানায় একমাস থাকব। তারপর আমেরিকায় ফিরে গিয়ে আবার আগামী গ্রীষ্মে এখানে আসব। এ পর্যন্ত দেখছ, ইংলণ্ডে সুন্দরভাবে বীজ বপন করা হয়েছে। আমার অনুপস্থিতিতে মিঃ স্টাডি—আমার এক সন্ন্যাসী গুরুভ্রাতা, যিনি শীঘ্রই এখানে আসছেন, তাঁর সঙ্গে মিলে ক্লাসগুলি চালাবেন।

সাহস অবলম্বন কর ও কাজ করে যাও। ধৈর্য ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাও—এই একমাত্র উপায়। আমি দ্বিতীয়বার আমেরিকা থেকে তোমাদের যে টাকা পাঠিয়েছি, তা সম্ভবতঃ নিরাপদে পৌঁছেছে। ঐ টাকার প্রাপ্তিস্বীকার আমেরিকায় করবে, কারণ এই পত্র তোমাদের নিকট পৌঁছবার পূর্বেই আমি আমেরিকায় ফিরব। তোমাদের অবশ্য আমার 19W. 38th Street, নিউ ইয়র্ক, আমেরিকা—এই ঠিকানাটা মনে আছে। তোমরা অবশ্য কেভার্শ্যাম ইত্যাদি ঠিকানায় মিঃ স্টার্ডিকে পত্র লিখবে এবং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ পত্রব্যবহার করবে। মান্দ্রাজের সঙ্গে পত্রব্যবহারের প্রতিনিধি হবে তুমি, কলিকাতায় মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, আমেরিকায় মিস মেরী ফিলিপ‍্‍স্‌, নিউ ইয়র্ক—এইরূপ চলতে থাকুক। এখন কাগজটার দিকে পুরোপুরি মনোযোগ দাও। এটা যাতে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হয়, তার চেষ্টা কর। মিঃ স্টার্ডি সময়ে সময়ে লিখবেন—আমিও লিখব। এখন আমি আর টাকা পাঠাতে পারব না—ইংলণ্ডে বক্তৃতা দিয়ে পয়সা পাওয়া যায় না, সুতরাং আমাকে এখানে সব টাকা খরচ করতে হয়েছে, এক পয়সাও লাভ হয়নি। ক্রমে ক্রমে এখানে এমন বন্ধু পাব, যারা সাময়িক পত্র প্রভৃতির জন্য টাকা খরচ করবে। কাজ করে চল—ধৈর্য, পবিত্রতা, সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাও—এই ক-টি বিষয় মনে রেখো। লণ্ডনে মেননের সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছিল। এখন কাগজখানাকে দাঁড় করবার জন্য সমগ্র শক্তি প্রয়োগ কর। যতদিন পর্যন্ত তুমি সরল ও পবিত্র থাকবে, ততদিন পর্যন্ত কখনও বিফল হবে না; মা তোমায় ত্যাগ করবেন না, তোমার ওপর তাঁর সর্বপ্রকার শুভাশিস বর্ষিত হবে। ইতি

তোমার
বিবেকানন্দ
…………………………….

২২৬
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy, রিডিং,
ইংলণ্ড
১৮৯৫

প্রিয় শশী,
তোমার চিঠি, চুনীবাবুর চিঠি, সাণ্ডেলের চিঠি পূর্বে পাইয়াছি। রাখালের চিঠি আজ পাইলাম। রাখাল gravel-এ (পাথরিতে) ভুগিয়াছে শুনিয়া দুঃখিত হইলাম। বোধ হয়, বদহজমের কারণ হইয়া থাকিবে। … মঠের business (কাজকর্ম) মাষ্টার মহাশয় যদি রাজী হন, তাঁকে দিয়ে করাবে, অথবা হুটকোকে দিয়ে। সাণ্ডেলকে তার সংসার দেখতে বলবে, মঠের কাজে-টাজে বৃথা সময় সে ব্যয় না করে। হুটকোর দেনা শোধ হয়ে গেছে; এখন মাথা মুড়িয়ে নিতে বলবে। … আমি আধা জলে-স্থলে লোক চাই না।

হরমোহনকে বলবে, লেকচার-ফেকচার এখন আমার কিছুই নাই। সুরেশ দত্তের এক ‘নারদসূত্র’ তোমরা পাঠিয়েছিলে। কেন, দুনিয়ায় কি আর নারদসংহিতা ছাপা ছিল না? … হরমোহন কি-একটা Lord (লর্ড) রামকৃষ্ণ পরমহংস করেছে? Lordটা আবার কি—English Lord না Duke?

রাখালকে বলবে, লোকে যা হয় বলুক গে। ‘লোক না পোক’। ভাবের ঘরে তোমাদের চুরি না থাকে এবং Jesuitism-এর (কপটতার) দিক্ মাড়াবে না। Orthodox (আনুষ্ঠানিক) পৌরাণিক হিন্দু আমি কোন্ কালে, বা আচারী হিন্দু কোন্‌ কালে? I do not pose as one৮৫ বাঙালীরাই আমাকে মানুষ করলে, টাকাকড়ি দিয়ে পাঠালে, এখনও আমাকে এখানে পরিপোষণ করছে—অহ হ!!! তাদের মন জুগিয়ে কথা বলতে হবে—না? বাঙালীরা কি বলে না বলে, ওসব কি গ্রাহ্যের মধ্যে নিতে হয় নাকি? ওদের দেশে বার বছরের মেয়ের ছেলে হয়! যাঁর জন্মে ওদের দেশ পবিত্র হয়ে গেল, তাঁর একটা সিকি পয়সার কিছু করতে পারলে না, আবার লম্বা কথা! বাঙলাদেশে বুঝি যাব আর মনে করেছ? ওরা ভারতবর্ষের নাম খারাপ করেছে। … মঠ করতে হয় পশ্চিমে রাজপুতানায়, পাঞ্জাবে even (এমন কি) বোম্বায়ে। বাঙালী! … লণ্ডনে কতকগুলো কাফ্রির মত—আবার টুপি-টাপা মাথায় দিয়ে ঘুরতে দেখতে পাই। কালো হাতে খানা ছুঁলে ইংরেজরা খায় না—এই আদর! ঝি-চাকরের দলে ইয়ারকি দিয়ে দেশে গিয়ে বড়লোক হয়!! রাম! রাম! আহার গেঁড়ি গুগলি, পান প্রস্রাব-সুবাসিত পুকুরজল, ভোজনপাত্র ছেঁড়া কলাপাতা এবং ছেলের মলমূত্র-মিশ্রিত ভিজে মাটির মেজে, বিহার পেত্নী শাঁকচুন্নীর সঙ্গে, বেশ দিগম্বর কৌপীন ইত্যাদি, মুখে যত জোর! ওদের মতামতে কি আসে যায় রে ভাই? তোরা আপনার কাজ করে যা। মানুষের কি মুখ দেখিস, ভগবানের মুখ দেখ্‌।

শরৎ ভাষ্য-মাষ্যগুলো Dictionary (অভিধান) দেখে একরকম এদের পড়িয়ে দিতে পারবে তো, গীতা উপনিষদ্?—না শুধুই বৈরাগ্যি? শুধু বৈরাগ্যির কি আর কাল আছে? নিধে পেলা সকলেই কি রামকৃষ্ণ পরমহংস হয় রে ভাই! শরৎ বোধ হয় এতদিনে রওনা হয়েছে। একখানা ‘পঞ্চদশী’, একখানা ‘গীতা’ (যতগুলো পার ভাষ্য-সহিত), একখানা কাশীর ছাপা নারদ ও শাণ্ডিল্য-সূত্র (সুরেশ দত্তর ছাপা এক ছত্রে আঠারটা ভুল, মানে হয় না), পঞ্চদশীর যদি তর্জমা (ভাল, হাবাতে নয়) থাকে ও শাঙ্কর ভাষ্যের কালীবর বেদান্তবাগীশের তর্জমা ও পাণিনিসূত্রের বা কাশিকাবৃত্তি বা ফণিভাষ্যের যদি কোন বাঙলা বা ইংরেজী (এলাহাবাদের শ্রীশ বসুর) তর্জমা থাকে তো পাঠাবে।

—গুলোকে টাকাকড়ির কাজে একদম বিশ্বাস করবে না; অত কাঞ্চন ত্যাগ করতে হবে না। নিজেরা কড়িপাতির খরচ-আদায় সমস্ত করবে। মধো—যা বলি করে যা, ওস্তাদি চালাস না আর আমার ওপর। এখন তোদের বাঙালীদের বল দিকি, আমাকে একখানা ‘বাচস্পত্য’ অভিধান পাঠিয়ে দিতে—দেখি বচনবাগীশের দল! ইংরেজের দেশে ধর্মকর্মের কাজ বড়ই ধীরে ধীরে। এরা হয় গোঁড়া, না হয় নাস্তিক। গোঁড়াগুলো আবার অমনি ‘নমো নমো’ ধর্ম করে, ‘Patriotism (স্বদেশপ্রীতি) আমাদের ধর্ম,’ —এই মাত্র।

বই আমেরিকায় পাঠাবে। C/o Miss Mary Philips, 19W. 38th Street, New York U.S. America—ঐ হল আমার আমেরিকার address (ঠিকানা)। নভেম্বর মাসের শেষাশেষি আমেরিকায় যাব, অতএব বইপত্র ঐখানে পাঠাবে। শরৎ যদি পত্রপাঠ ছেড়ে থাকে তাহলেই আমার সঙ্গে দেখা হবে, নতুবা নয়। Business is business৮৬—ছেলেখেলা নয়। Sturdy (স্টার্ডি) সাহেব তাকে নিয়ে এসে ঘরে রাখবে ইত্যাদি। আমি এবার ইংলণ্ডে খালি একটু খবর নিতে এসেছি; আসছে গরমিকালে কিছু বেশী রকম হুজুগ করবার চেষ্টা করা যাবে। তারপর next winter India (পরবর্তী শীতে ভারতে)।

তোমার উপর আমার এখনও বিশ্বাস আছে। খেতড়ির রাজা যা কিছু খবর চান, তুমি নিজে লিখবে, অন্য কাউকেই জানতে পর্যন্ত দেবে না। যে সকল লোক আমাদের সহিত interested (আগ্রহান্বিত) তাদের regularly (নিয়মিতভাবে) চিঠিপত্র লিখবে। Interest (আগ্রহ) জাগিয়ে রাখবে। বাঙলাদেশময় জায়গায় জায়গায় centre (কেন্দ্র) করবার চেষ্টা কর। তোমরা তো কোন কিছু এ পর্যন্ত করে উঠতে পারলে না দেখছি; খালি বচন ঝাড়ছ! তোমারই যেন শরীর খারাপ, বাকীগুলো করছে কি? খালি আমরা লর্ড রামকৃষ্ণের শিষ্য! বলি, ও লর্ড রামকৃষ্ণ ব্যাপারটা কি হে? হরমোহনটা তো আধপাগলা বৈ নয়—ও একটা কি লর্ড রামকৃষ্ণ লেখে বল তো? লর্ড, ডিউক আবার কি হে? খেপাগুলোর জ্বালায় অস্থির! এখন এই পর্যন্ত। পরের চিঠিতে হালচাল লিখব। Sturdy (স্টার্ডি) সাহেবটি বড়ই ভাল, ভারি গোঁড়া বৈদান্তিক, সংস্কৃত একটু আধটু বোঝে। বহুৎ পরিশ্রম করলে তবে একটু আধটু কাজ হয় এ-সব দেশে—বড়ই শক্ত কাজ, আর শীতে বাদলে। তার উপর এখানে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। ইংরেজরা লেকচার-ফেকচার শুনতে একটি পয়সাও দেয় না। যদি শুনতে আসে তো তোমার ভাগ্যি, যেমন আমাদের দেশে। তার ওপর এদেশে সাধারণে আমায় জানেও না এখন। তার ওপর ভগবান্-টগবান্ বললে ওরা পালিয়ে যায়, বলে—ঐ রে পাদ্রী বুঝি! তুমি বসে বসে একটা কাজ কর—ঋগ্বেদ থেকে আরম্ভ করে সামান্য পুরাণ তন্ত্র পর্যন্ত সৃষ্টি প্রলয় সম্বন্ধে, জাতি সম্বন্ধে, স্বর্গ নরক আত্মা মন বুদ্ধি ইত্যাদি, ইন্দ্রিয় মুক্তি সংসার (পুনর্জন্ম) সম্বন্ধে কে কি বলে, একত্র করতে থাক। ছেলেখেলা করলে কি হয়? Real scholarly work (রীতিমত পাণ্ডিত্যপূর্ণ বই) চাই। Material (উপাদান) যোগাড় হচ্ছে আসল কাজ। সকলকে আমার ভালবাসা। ইতি

নরেন্দ্র
…………………………….

২২৭*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
৮০ ওকলি ষ্ট্রীট, লণ্ডন
৩১ অক্টোবর, ১৮৯৫, বৈকাল ৫টা

প্রিয় বন্ধু,
এইমাত্র দুইজন যুবক ভদ্রলোক, মিঃ সিলভারলক এবং তাঁহার বন্ধু চলে গেলেন। মিস মূলার তো আজ বিকালে এসেছিলেন এবং এঁদের আসার সঙ্গে সঙ্গে চলে যান।

এঁদের একজন ইঞ্জিনীয়র, আর একজন শস্যের ব্যবসা করেন। দর্শন ও বিজ্ঞানের অনেক গ্রন্থ এঁরা পড়েছেন এবং উভয়ে শাস্ত্রের আধুনিকতম সিদ্ধান্তগুলির সঙ্গে হিন্দুদিগের প্রাচীন চিন্তাধারার অপূর্ব মিল দেখে বিস্মিত হয়েছেন। দুজনেই চমৎকার লোক—বেশ বুদ্ধিমান ও পণ্ডিত। একজন গীর্জার সঙ্গে সম্বন্ধ ত্যাগ করেছেন, আর একজন করবেন কিনা আমায় জিজ্ঞাসা করলেন।

এঁদের সঙ্গে আলাপ হবার পর দুটি জিনিষ আমার মনে জাগছে। প্রথমতঃ ঐ বইখানি আমাদের তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। এর ভেতর দিয়ে আমরা এমন একদল লোকের সংস্পর্শে আসতে পারব, যাঁরা দার্শনিক ভিত্তিতে ধর্মকে গ্রহণ করেন এবং অলৌকিকতা একদম পছন্দ করেন না। দ্বিতীয়তঃ এঁরা দুজনেই আমার ধর্মের আনুষ্ঠানিক দিকটা জানতে চান। এতে আমার চোখ খুলেছে। জগতের সাধারণ লোক চায়—কোন প্রকার অবলম্বন। বস্তুতঃ সাধারণভাবে বলতে গেলে অনুষ্ঠানের মধ্যে যখন দর্শন (Philosophy) রূপপরিগ্রহ করে, তখনই তাকে ‘ধর্ম’ বলা হয়। তাই ধর্মমন্দির ও কিছু ক্রিয়াকলাপ থাকা নিতান্তই আবশ্যক অর্থাৎ আমাদের যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি কিছু ক্রিয়াকলাপ ঠিক করে ফেলতে হবে।

যদি আপনি শনিবার সকালে বা তার পূর্বে আসতে পারেন, তবে আমরা ‘এসিয়াটিক সোসাইটিতে’ যাব, কিম্বা আপনিই আমার জন্য ‘হেমাদ্রিকোষ’ নামক গ্রন্থখানি সংগ্রহ করতে পারেন; ঐ পুস্তকে আমরা যা চাই, তা পাব। উপনিষদ‍গুলিও নিয়ে আসবেন। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যুকালের মধ্যে আমরা একটা কিছু অপূর্ব সিদ্ধান্ত সুদৃঢ় করে ধরতে পারব; অসম্বদ্ধ দার্শনিক মতবাদ মানবজীবনের উপর কোনই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

আমরা যদি আমাদের ক্লাসগুলি শেষ হবার আগেই বইটি শেষ করে ফেলতে পারি এবং দু-একটি অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে সেটি সর্বসাধারণের মধ্যে প্রকাশ করতে পারি, তবে বইখানি চালু হয়ে যাবে। এরা চায় সঙ্ঘবদ্ধ হতে, আর চায় ক্রিয়াকলাপ। আর ঠিক এটিই একটি কারণ, যার জন্য ‘—’রা পাশ্চাত্য জনসাধারণের উপর কোনদিনই প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।

‘নৈতিক সমিতি’র প্রস্তাবে সম্মত হওয়ায় তারা আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আর একখানা পত্র লিখেছে এবং তাদের একখানা ফরমও পাঠিয়েছে। তাদের ইচ্ছা যে, আমি একখানা বই সঙ্গে নিয়ে যাই এবং তা থেকে দশ মিনিট পাঠ করি। আপনি দয়া করে গীতার অনুবাদ এবং বৌদ্ধ জাতকের অনুবাদটি নিয়ে আসবেন কি? আপনার সঙ্গে দেখা না করে আমি এ বিষয়ে কিছুই করব না। আমার ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জানবেন। ইতি

বিবেকানন্দ
…………………………….

২২৮*
৮০ ওকলি ষ্ট্রীট, লণ্ডন
৩১ অক্টোবর, ১৮৯৫

প্রিয় জো জো,
শুক্রবার সানন্দে তোমার ওখানে মধ্যাহ্নভোজন এবং এলবেমার্লে মিঃ কয়েটের সহিত আলাপ করব।

মিসেস ও মিস নেটার নামে দু-জন আমেরিকান মহিলা—মাতা ও কন্যা—গত রাত্রের ক্লাসে যোগদান করেন। তাঁরা যথার্থ অনুরক্ত বলে মনে হয়। মিস চেমিয়ার্সের ওখানে যে ক্লাস হত তা শেষ হল। আগামী শনিবার রাত্রি থেকে আমার বাসাতেই হবে। আমার ক্লাসের জন্য দু-একখানা চলনসই বড় ঘর পাব, আশা করি। মন‍্‍কিওর কন‍্‍ওয়ের নৈতিক সমিতির (Moncure Conway’s Ethical Society) নিমন্ত্রণে ১০ তারিখে তাদের ওখানে বক্তৃতা দেব। আগামী মঙ্গলবার ব্যাল‍্‍বোয়া সমিতিতে (Balboa Society) বক্তৃতা। প্রভু সাহায্য করবেন। শনিবার তোমার সঙ্গে বেরুতে পারব কিনা ঠিক নেই। তবুও শহরের বাইরে তোমার খুবই ভাল লাগবে, তা ছাড়া মিঃ ও মিসেস স্টার্ডি অতি চমৎকার লোক।

ভালবাসা, আশীর্বাদ জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ

পুনশ্চ—আমার জন্য কিছু নিরামিষ তরকারির ব্যবস্থা রেখ। ভাতের তেমন পক্ষপাতী নই, রুটি হলেও বেশ চলবে। আজকাল যা নিরামিষাশী হয়েছি, বলবার নয়।
…………………………….

২২৯
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
কেভার্শ্যাম, রিডিং, ইংলণ্ড
১৮৯৫

অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার ও সান্যালের পত্রে সবিশেষ অবগত হইলাম। তোমার চিঠি লেখার দুইটি দোষ—বিশেষ তোমার। প্রথম—যে-সকল কাজের কথা জিজ্ঞাসা করি, প্রায় তার কোনটিরই জবাব থাকে না; দ্বিতীয়—জবাব লেখায় অত্যন্ত বিলম্ব। তোমরা তো ঘরে বসে আছ ভায়া! আমাকে এ বিদেশে পেটের চেষ্টা করতে হয়, আবার দিনরাত খাটতে হয়; তার উপর লাটিমের মত ঘুরে বেড়ান। … আমি এখন বেশ বুঝতে পারছি যে, আমায় একা কাজ করতে হবে।

শশী সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত বটে; কিন্তু তোমরা খালি শশীর আসা সম্ভব কিনা তাই বিচার করছ। … এ সকল হল মহাবিলাসী বাবুর দেশ; নখের কোণে একটু ময়লা থাকলে তাকে স্পর্শ করে না। শরৎ আসতে না চায় সারদাকে পাঠাবে। অথবা মান্দ্রাজে লিখে কোন লোক পাঠাবে। প্রায় দু-মাস পূর্বে আমি এ-বিষয়ে লিখেছি। তারকদা শেষ পত্রে লিখেন যে, পর মেলে (ডাকে) এ-বিষয়ে সবিশেষ জানাবে। কিন্তু এখনও দেখছি তার কিছুই ঠিকানা হয় নাই। আশা ছিল—আমি থাকতে থাকতেই কেউ আসবে; কিন্তু এখনও তো কিছুই ঠিকানা নাই, এবং দু-বছরে এক-একটা সংবাদ আসে। Business is business—অর্থাৎ কাজকর্ম তৎপর করতে হয়, গড়িমসির কাজ নয়। আসছে সপ্তাহের শেষে আমি আমেরিকায় যাব। অতএব যে আসবে, তার সঙ্গে সাক্ষাতের কোন আশা নাই।

গিরিশবাবু আমার কাজে সহায়তা করতে পারবেন—কেমন করে? আমি চাই সংস্কৃত-জানা লোক, অর্থাৎ বই-টই তর্জমা করতে সহায়তা করে স্টার্ডিকে, আমার অনুপস্থিতিতে স্টার্ডির সঙ্গে বইপত্র তর্জমা করে—এই মাত্র। অধিক আমি আশা করি না। … কেবল এই দরকার, আমার অনুপস্থিতিকালে একটু আধটু সংস্কৃত পড়ায় বা তর্জমা করে—এই বস্, আবার কি করবে? গিরিশবাবু এদেশে বেড়িয়ে যান না, বেশ কথা। ইংলণ্ড ও আমেরিকা ঘুরে যেতে ৩০০০ টাকা মাত্র পড়বে। যত লোক এ-সব দেশে আসে, ততই ভাল। তবে ঐ টুপিপরা হতভাগাদের দেখলে গা জ্বলে। ভূত কালো—আবার সাহেব! ভদ্রলোকের মত দেশী কাপড়-চোপড় পর বাবা, তা না হয়ে ঐ জানোয়ারী রূপ!

আর কেন, হরি বল! এখানে সমস্তই ব্যয়, আয় এক পয়সাও নাই। স্টার্ডি আমার জন্য অনেক টাকা খরচ করেছে। এখানে লেকচারে আমাদের দেশের মত উল্টে ঘর থেকে খরচ করতে হয়। তবে অনেকদিন করলে ও খাতির জমে গেলে খরচটা পুষিয়ে যায়। টাকাকড়ি সেই যা প্রথম বৎসর আমেরিকায় করি (তারপর হাতে এক পয়সাও নিই না), তা প্রায় ফুরিয়ে গেল; আমেরিকায় পঁহুছিবার মত মাত্র আছে। আমার এই ঘুরে ঘুরে লেকচার করে শরীর অত্যন্ত nervous (স্নায়ুপ্রধান) হয়ে পড়েছে—প্রায় ঘুম হয় না, ইত্যাদি। তার উপর একলা। দেশের লোকের কথা কি বল? কেউ না একটা পয়সা দিয়ে এ-পর্যন্ত সহায়তা করেছে, না একজন সাহায্য করতে এগিয়েছে। এ সংসারে সকলেই সাহায্য চায়—এবং যত কর ততই চায়। তারপর যদি আর না পার তো তুমি চোর!

… যা লিখতে হয় স্টার্ডিকে লিখবে—লোক পাঠাবার মতামত—যখন আসছে যুগে তোমরা সিদ্ধান্তয় উপস্থিত হবে। … শশীকে আমি বিশ্বাস করি, ভালবাসি। He is the only faithful and true man there (ওখানে সে-ই একমাত্র বিশ্বস্ত ও খাঁটি লোক)। তার ব্যামো-ফ্যামো সব প্রভুর কৃপায় ভাল হয়ে যাবে। তার সব ভার আমার। … ইতি

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৩০*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
৮০ ওকলি ষ্ট্রীট, চেলসী
১ নভেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় বন্ধু,
ব্যালেরেন (Balleren) সোসাইটির টিকিটের সংখ্যা ৩৫। বিষয় হল—ভারতীয় দর্শন ও পাশ্চাত্য সমাজ, সভাপতির স্থান শূন্য।

আপনি সেগুলো আমাকে পাঠিয়ে দিতে বলেননি, তাই পাঠালাম না।

আপনার চিঠিগুলি ঠিকভাবেই পেয়েছি।

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৩১*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
২ নভেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় বন্ধু,
আমার মনে হয়, আপনিই ঠিক; আমরা আমাদের নিজেদের পথে কাজ করে যাব আর যা ঘটে ঘটুক।

আপনাকে বক্তৃতাটির সারাংশ পাঠাচ্ছি।

রবিবার আসব, যদি বিশেষ কিছু বাধা না ঘটে।

প্রীতির সঙ্গে আপনার
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৩২
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
লণ্ডন
১৩ নভেম্বর, ১৮৯৫

কল্যাণবরেষু—
তোমার পত্র পাইয়া সবিশেষ প্রীত হইলাম। যেরূপ কার্য করিতেছ, তাহা অতি উত্তম। রা—অতি উদার ও মুক্তহস্ত, কিন্তু তাই বলিয়া তাঁহার উপর অত্যাচার না হয়। শ্রীমান্—এর অর্থসংগ্রহ উত্তম সঙ্কল্প বটে, কিন্তু ভায়া, এ সংসার বড়ই বিচিত্র, কাম-কাঞ্চনের হাত এড়ান ব্রহ্মা বিষ্ণুরও দুষ্কর। টাকা-কড়ির সম্বন্ধ মাত্রেই গোলমালের সম্ভাবনা। অতএব মঠের নিমিত্ত অর্থ সংগ্রহ করা ইত্যাদি কাহাকেও করিতে দিবে না। রা—ছাড়া ভারতবর্ষের কোন গৃহস্থকে আমি এখনও নিঃসন্দেহে মিত্র বলিয়া জানি না। আমার বা আমাদের নামে কোন গৃহস্থকে মঠ বা কোন উপলক্ষে অর্থ সংগ্রহ করিতেছেন শুনিলেই সন্দেহ করিবে …। বিশেষ দরিদ্র গৃহস্থ লোকেরা অভাব পূরণের নিমিত্ত বহুবিধ ভান করে। অতএব যদি কখনও কোন ধনী বিশ্বাসী ভক্ত ও হৃদয়বান গৃহস্থ মঠাদি নির্মাণের জন্য উদ্যোগ করেন, অথবা সংগৃহীত অর্থ কোন ধনী এবং বিশ্বাসী গৃহস্থের নিকট জমা হয়—উত্তম কল্প, নতুবা হস্তক্ষেপ করিবে না—(জড়িত হইও না), উপরন্তু অন্যকে এ কার্যে বিরত করিবে। তুমি বালক, কাঞ্চনের মায়া বোঝ না। অবসরক্রমে মহানীতিপরায়ণ লোকও প্রতারক হয়। এই হচ্ছে সংসার। রা—কে টাকাকড়ি সম্বন্ধে কোন কথা বলিবে না।

পাঁচজন মিলে কোন কাজ করা আমাদের স্বভাব আদতেই নয়। এই জন্যই আমাদের দুর্দশা। He who knows how to obey, knows how to command. Learn obedience first. (যিনি হুকুম তামিল করতে জানেন, তিনিই হুকুম করতে জানেন। প্রথমে আজ্ঞাবহতা শিক্ষা কর।) এই সকল মহা স্বাধীনভাবপূর্ণ পাশ্চাত্য জাতিদের মধ্যে Obedience-এর (আজ্ঞাবহতার) ভাব সেই প্রকার বলবান্‌। আমরা সকলেই হম‍্‍বড়া, তাতে কখনও কাজ হয় না। মহা উদ্যম, মহাসাহস, মহাবীর্য এবং সকলের আগে মহতী আজ্ঞাবহতা—এই সকল গুণ ব্যক্তিগত ও জাতিগত উন্নতির একমাত্র উপায়। এই সকল গুণ আমাদের আদৌ নাই।

তুমি যে প্রকার কার্য করছ করে যাও—তবে পড়াশুনার উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখিবে—ইতি। য—বাবু একখানি পত্রিকা হিন্দী ভাষায়—প্রেরণ করিয়াছেন। তাহাতে আমার চিকাগো স্পীচের অনুবাদ আলোয়ারের রা— পণ্ডিত করিয়াছেন। উভয়কেই বিশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাইবে।

তোমার নিমিত্ত এক্ষণে লিখি, রাজপুতানায় একটি center (কেন্দ্র) করিবার বিশেষ যত্ন করিবে। জয়পুর বা আজমীর প্রভৃতি কোন central (মধ্যবর্তী) স্থানে হওয়া উচিত—তদনন্তর আলোয়াড়, খেতড়ি প্রভৃতি শহরে branch (শাখা) স্থাপন করিবে। সকলের সঙ্গে মিশিবে, কাহারও সহিত বিরোধ আবশ্যক নাই। পণ্ডিত না—জীকে আমার প্রেমালিঙ্গন দিবে, ঐ লোকটি খুব উদ্যমী—কালে বিশেষ কার্যক্ষম হইবে। মাঃ— সাহেব ও —জীকেও আমার যথাযোগ্য প্রেমসম্ভাষণ দিও। ঐ ‘ধর্মমণ্ডলী’ বলে কি একটা আজমীরে হয়েছে—সেটা ব্যাপার কি? বিশেষ লিখিবে।—বাবু লিখেন যে, তাঁহারা আমায় পত্রাদি লিখিয়াছেন, এ পর্যন্ত পাই নাই। … মঠ মড়ি কলকেতায় কি করবে? কাশীতে আড্ডা করিতে হইবে। সে-সকল অনেক মতলব আছে, পরন্তু অর্থসাপেক্ষ। ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে, খবরের কাগজে দেখে থাকবে যে, ইংলণ্ডে হুজ্জুক ধীরে ধীরে মাচছে। এদেশে সকল কাজ ধীরে ধীরে হয়। কিন্তু ইংরেজবাচ্ছা কোন কাজে হাত একবার দিলে আর ছাড়ে না। আমেরিকানরা চটপটে, কিন্তু অনেকটা খড়ের আগুনের মত। রামকৃষ্ণ পরমহংস অবতার ইত্যাদি সাধারণে প্রচার করিবে না। আলোয়াড়ে আমার কতকগুলো চেলাপত্র আছে, সেগুলোকে নিয়ে তদারক করবে, … মহাশক্তি তোমাতে আসবে, ভয় নাই—Be pure, have faith be obedient, (পবিত্র হও, বিশ্বাসী হও, আজ্ঞাবহ হও)।

ছেলের বে-র বিপক্ষে শিক্ষা দিবে! বালকের বে কোন শাস্ত্রে নাই। তবে ছোট ছোট মেয়ের বে-র বিপক্ষে এখন কিছু বলো না। ছেলের বে বন্ধ করতে পারলেই মেয়ের বে আপনা হতে বন্ধ হয়ে যাবে। মেয়েকে তো আর মেয়ে বে করবে না। লাহোর আর্য-সমাজের সেক্রেটারীকে লিখবে যে, অ-বলে যে একজন সন্ন্যাসী তাঁদের কাছে থাকতেন, তিনি এক্ষণে কোথায়? সে লোকটির বিশেষ সন্ধান করিবে। … ভয় কি?

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৩৩*
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]
লণ্ডন
১৮ নভেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
‘ব্রহ্মবাদিন্‌’ সম্বন্ধে আমার গোটাকতক প্রস্তাব আছে। আমি ইতোমধ্যেই খবর পেয়েছি যে, আমেরিকায় ওর অনেকগুলি গ্রাহক হয়েছে। ইংলণ্ডেও তোমায় কতকগুলি গ্রাহক যোগাড় করে দেব। ইংলণ্ডে আমার কাজ বাস্তবিক খুব চমৎকার হয়েছে; আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছি। ইংরেজরা খবরের কাগজে বেশী বকে না; কিন্তু নীরবে কাজ করে। আমেরিকা অপেক্ষা ইংলণ্ডে অনেক বেশী কাজ হবে বলেই আমার স্থির বিশ্বাস। দলে দলে লোক আসছে, কিন্তু এত লোকের জন্য তো আমার জায়গা নেই। সুতরাং বড় বড় সম্ভ্রান্ত মহিলা ও অন্যান্য সকলেই মেঝের উপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে। আমি তাদের কল্পনা করতে বলি যে, তারা যেন ভারতীয় আকাশের তলে শাখাপ্রশাখাসমন্বিত একটি বিস্তীর্ণ বটবৃক্ষের নীচে বসে আছে—তারা অবশ্য এ ভাবটা পছন্দই করে। আমাকে আগামী সপ্তাহেই এখান থেকে চলে যেতে হবে, তাই এরা ভারি দুঃখিত। কেউ কেউ ভাবছে, যদি এত শীঘ্র চলে যাই, তাহলে এখানকার কাজের ক্ষতি হবে। আমি কিন্তু তা মনে করি না। আমি কোন লোক বা জিনিষের উপর নির্ভর করি না—একমাত্র প্রভুই আমার ভরসা এবং তিনি আমার ভেতর দিয়ে কাজ করছেন।

‘ব্রহ্মবাদিনে’র প্রত্যেক সংখ্যায় ভক্তি, যোগ ও জ্ঞান সম্বন্ধে কিছু লেখা বেরুন দরকার। দ্বিতীয়তঃ লেখার ধাঁজটা ভারি কটমটে—একটু যাতে স্বচ্ছ, সরস ও ওজস্বী হয়, তার চেষ্টা কর। গত সংখ্যায় ক্ষত্রিয়দের খুব বাড়ান হয়েছে, পরের সংখ্যায় ব্রাহ্মণদের খুব প্রশংসা কর, তার পরের সংখ্যায় বৈশ্যদের। কপট ও কাপুরুষ না হয়ে সকলকে খুশী কর। দৃঢ়তা ও পবিত্রতার সহিত নিজেদের ভাবগুলি আঁকড়ে ধরে থাক; আর এখন যেরূপ বাধাই আসুক না কেন, জগৎ অবশেষে তোমাদের কথা শুনবেই শুনবে। আরও কিছু বিজ্ঞাপন যোগাড়ের চেষ্টা কর—বিজ্ঞাপনের জোরেই কাগজ চলে। আমি তোমার জন্য ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে বড় একটা কিছু লিখব; কিন্তু এটি মনে রেখো, বাঙালীদের ভাষায়—‘আমার মরবার পর্যন্ত সময় নেই’। দিবারাত্র কাজ, কাজ, কাজ। নিজের রুটির যোগাড় করতে হচ্ছে এবং আমার দেশকে সাহায্য করতে হচ্ছে—সব একলাই; আর তার দরুন শত্রুমিত্র সকলেরই কাছে কেবল গাল খাচ্ছি! যাই হোক, তোমরা তো শিশুমাত্র; আমাকে সব সহ্য করতে হবে।

কলিকাতা থেকে একজন সন্ন্যাসীকে ডেকে পাঠিয়েছি, তাকে লণ্ডনে কাজের জন্য রেখে যাব। আমেরিকার জন্য আর একজন আবশ্যক। তোমরা কি মান্দ্রাজ থেকে উপযুক্ত একজন কাউকে পাঠাতে পার না? অবশ্য তার খরচপত্র সব আমি দেব। তার ইংরেজী ও সংস্কৃত দুই-ই ভাল জানা চাই—ইংরেজীটি একটু বেশী। আবার তার খুব শক্ত লোক হওয়া দরকার—মেয়ে প্রভৃতির পাল্লায় পড়ে যেন বিগড়ে না যায়। অধিকন্তু তাকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বস্ত ও আজ্ঞাবহ হতে হবে। তোমার কি চলনসই সংস্কৃত জানা আছে? জি.জি. কিছু কিছু জানে। আমি আমার নিজের লোক চাই। গুরুভক্তিই সর্বপ্রকার আধ্যাত্মিক উন্নতির মূল। আমার আশঙ্কা, তুমি তোমার কাগজ ফেলে আসতে পারবে না। জি.জি. কি আসতে পারে? আমি দুজন লোককে এই দুই কেন্দ্রে রেখে যেতে চাই, তারপর ভারতে ফিরে গিয়ে তাদের অবসর দেবার জন্য নূতন নূতন লোক পাঠাব। বাস্তবিক আমি অবিরাম কাজ করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। যেরূপ কঠোর পরিশ্রম করেছি, আর কোন হিন্দুকে এরূপ করতে হলে সে এতদিন রক্তবমি করে মরে যেত। মেনন পূর্বের মতই বিশ্বস্ত ও অনুগত আছেন। তিনি প্রায়ই এসে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করে থাকেন। আমাকে C/o Miss Mary Philips, 19W. 38th Street, New York—ঠিকানায় পত্র লিখো। আমি আগামী সপ্তাহে (আমেরিকা) যাচ্ছি এবং আগামী গ্রীষ্মে (এখানে) আবার ফিরব। ইতোমধ্যে কাকে পাঠাবে ভাবতে থাক। আমি দীর্ঘ বিশ্রামের জন্য ভারতে যেতে চাই। কিডি, ডাক্তার, সেক্রেটারী সাহেব, বালাজী এবং বাকী সকলকে আমার ভালবাসা জানাবে। সদা আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুঃ—‘ব্রহ্মবাদিনে’ বিবিধ সংবাদের একটা স্তম্ভ থাকা উচিত। একটি ভক্ত বৈরাগী shuffled off his mortal coil—এইরূপ ভাষা লিখো না। ভক্ত বৈরাগীর মৃত্যুর সঙ্গে এইরূপ বাক্যযোজনা একটু হাস্যোদ্দীপক।
…………………………….

২৩৪*
লণ্ডন
২১ নভেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
‘ব্রিটানিয়া’ জাহাজে আগামী ২৭ বুধবার (আমেরিকা) রওনা হচ্ছি। এখানে এ পর্যন্ত আমার যতটা কাজ হয়েছে, তা বেশ সন্তোষজনক; আমার বিশ্বাস আগামী গ্রীষ্মে চমৎকার কাজ করতে পারব। … ভালবাসাদি জানবে। ইতি

তোমাদের প্রীতিবদ্ধ
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৩৫*

[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
R. M. S. ‘Britannic’৮৭

আশীর্বাদভাজন ও প্রিয়,
এ পর্যন্ত ভ্রমণ খুবই মনোরম হয়েছে। জাহাজের খাজাঞ্চী আমার প্রতি খুব সদয় এবং একখানা কেবিন আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। একমাত্র অসুবিধা হল খাদ্য—মাংস, মাংস, মাংস। আজ তারা আমাকে কিছু তরকারি দেবে বলেছে।

আমরা এখন নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছি। কুয়াশা এত ঘন যে, জাহাজ এগোতে পারছে না। তাই এই সুযোগে কয়েকটি চিঠি লিখছি।

এ এক অদ্ভুত কুয়াশা, প্রায় অভেদ্য, যদিও সূর্য উজ্জ্বলভাবে ও সহাস্য কিরণ দিচ্ছে। আমার হয়ে শিশুকে চুম্বন দেবেন এবং আপনার ও মিসেস স্টার্ডির জন্য ভালবাসা ও আশীর্বাদ।

বিবেকানন্দ

পুনঃ—দয়া করে মিসেস মূলারকে আমার ভালবাসা জানাবেন। আমি এভিনিউ রোডে রাত্রিকালীন কামিজটা (Night Shirt) ফেলে এসেছি। অতএব ট্রাঙ্কটি না আসা পর্যন্ত আমাকে বিনা কামিজেই চালাতে হবে।
…………………………….

২৩৬*
R. M. S. ‘Britannic’
বৃহস্পতিবার প্রভাত
৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় এলবার্টা,
কাল সন্ধ্যায় তোমার সুন্দর চিঠিখানা পেয়েছি। আমাকে যে মনে রেখেছ, এটা তোমার সহৃদয়তা। আমি শীঘ্রই ধর্মনিষ্ঠ দম্পতিকে দেখতে যাচ্ছি। মিঃ লেগেট একজন ঋষি, এ-কথা আমি তোমাকে আগেই বলেছি, এবং তোমার মা হলেন একজন আজন্ম সম্রাজ্ঞী, তাঁরও ভেতরে ঋষির হৃদয়।

তুমি আলপস্ পর্বত খুব উপভোগ করছ জেনে আমিও আনন্দিত। আলপস্ নিশ্চয়ই বিস্ময়কর। এরকম জায়গাতেই মানুষের আত্মা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা করে। কোন জাতি আধ্যাত্মিক দিক্ থেকে দীন হলেও বাহ্য স্বাধীনতা কামনা করে। লণ্ডনে একজন সুইস যুবকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে আমার ক্লাসে আসত। লণ্ডনে আমি খুবই কৃতকার্য হয়েছিলাম, এবং যদিও কোলাহলপূর্ণ নগরটা আমার ভাল লাগত না, আমি মানুষদের পেয়ে খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলাম। এলবার্টা, তোমাদের দেশে বৈদান্তিক চিন্তাধারা প্রথমে অজ্ঞ ‘বাতিকগ্রস্ত’ ব্যক্তিদের দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল, সেই প্রবর্তনের ফলে সৃষ্ট নানা অসুবিধার মধ্য দিয়ে কাজের পথ তৈরী করে নিতে হয়। তুমি হয়তো লক্ষ্য করেছ, আমেরিকায় আমার ক্লাসগুলিতে উচ্চশ্রেণীর নরনারী—কখনও কখনও যোগ দিয়েছেন, তাও মুষ্টিমেয়। আবার আমেরিকায় উচ্চশ্রেণীর লোকেরা ধনী হবার ফলে তাঁদের সমস্ত ঐশ্বর্য সম্ভোগ করিতে ও ইওরোপীয়দের অনুকরণ (বোকার মত?) করতে করতে কাটে। অপর পক্ষে, ইংলণ্ডে বৈদান্তিক মতবাদ দেশের সেরা জ্ঞানী ব্যক্তিদের দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছে এবং ইংলণ্ডের উচ্চশ্রেণীর মধ্যে বহু লোক আছেন, যাঁরা বিশেষ চিন্তাশীল। তুমি শুনে অবাক হবে, এখানে আমি ক্ষেত্র সম্পূর্ণ প্রস্তুত পেয়েছিলাম, এবং বিশ্বাস করি যে, আমার কাজ আমেরিকার চেয়ে ইংলণ্ডে বেশী সফল হবে। এর সঙ্গে ইংরেজ চরিত্রের প্রচণ্ড একগুঁয়েমি যোগ দাও এবং নিজেই বিচার কর। এই থেকে তুমি দেখতে পাবে যে, ইংলণ্ড সম্বন্ধে আমার মত অনেকখানি পাল্টে গিয়েছে, এবং আমি সানন্দে তা স্বীকার করি। আমি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিন্ত যে, আমরা জার্মানীতে আরও ভাল করব। পরবর্তী গ্রীষ্মে ইংলণ্ডে ফিরে আসছি। ইতোমধ্যে আমার কাজ খুবই উপযুক্ত লোকের হাতে আছে। জো জো আমেরিকায় যেমন ছিলেন, তেমনি আমার সদয় মহৎ পবিত্র বন্ধু আছেন এবং তোমাদের পরিবারের কাছে আমার ঋণ অশেষ। হলিস্টার ও তোমাকে আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ।

ষ্টমারটি কুয়াশার জন্য নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজের খাজাঞ্চী খুব সদয় হয়ে আমার একার জন্য একটা গোটা কেবিন দিয়েছে। এরা মনে করে, প্রত্যেক হিন্দুই একজন রাজা এবং খুব নম্র—অবশ্য এই মোহ ভেঙে যাবে যখন তারা জানবে যে, ‘রাজা’ কপর্দকশূন্য!! ভালবাসা ও আশীর্বাদ জেনো।

তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৩৭*
228, West 39th St. N.Y.
৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার পত্রে আমায় যে আহ্বান জানিয়েছেন, তার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। দশ দিন অতি বিরক্তিকর দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর আমি গত শুক্রবার এখানে পৌঁছেছি। সমুদ্র ভয়ানক বিক্ষুদ্ধ ছিল এবং জীবনে এই সর্বপ্রথম আমি ‘সমুদ্রপীড়ায়’ (sea-sickness) অতিশয় কষ্ট পেয়েছি। আপনি একটি পৌত্র লাভ করেছেন জেনে আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি; শিশুটির মঙ্গল হোক। দয়া করে মিসেস এ্যাডাম‍সন ও মিস থার্সবিকে আমার ঐকান্তিক ভালবাসা জানাবেন।

ইংলণ্ডে আমি জনকয়েক বিশিষ্ট বন্ধু রেখে এসেছি। আগামী গ্রীষ্মে ফিরে যাব, এই আশায় তাঁরা আমার অনুপস্থিতিকালে কাজ করবেন। এখানে আমি কি প্রণালীতে কাজ করব, তা এখনও স্থির করিনি। ইতোমধ্যে একবার ডেট্রয়েট ও চিকাগো ঘুরে আসবার ইচ্ছা আছে—তারপর নিউ ইয়র্কে ফিরব। সাধারণের কাছে প্রকাশ্যভাবে বক্তৃতা দেওয়াটা আমি একেবারে ছেড়ে দেব স্থির করেছি; কারণ আমি দেখছি, আমার পক্ষে সর্বোৎকৃষ্ট কাজ হচ্ছে—প্রকাশ্য বক্তৃতায় কিম্বা ঘরোয়া ক্লাসে একদম টাকাকড়ির সংস্রব না রাখা। পরিণামে ওতে কাজের ক্ষতি হবে এবং খারাপ দৃষ্টান্ত দেখান হবে।

বিভিন্ন স্থানে স্বতন্ত্র ও স্বাবলম্বী গোষ্ঠীর আমি পক্ষপাতী। তারা নিজেদের কাজ নিজেদের মত করুক, তারা যা খুশী করুক। নিজের সম্বন্ধে আমার এইটুকু বক্তব্য যে, আমি নিজেকে কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়াতে চাই না। আশা করি, আপনার শরীর মন ভাল আছে। ইতি

সদা প্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৩৮*
228, West 39th St., New York
৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় জো জো,
এ-যাবৎ যত সমুদ্রযাত্রা করেছি, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা মারাত্মক দশদিনব্যাপী সমুদ্রযাত্রার পরে নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছি। একাদিক্রমে দিনকয়েক বড়ই পীড়িত ছিলাম।

ইওরোপের তকতকে ঝকঝকে শহরগুলির পরে নিউ ইয়র্কটাকে বড়ই নোংরা ও হতচ্ছাড়া মনে হয়। আগামী সোমবার কাজ আরম্ভ করব। এলবার্টা যাঁদের ‘স্বর্গীয় দম্পতি’ বলে, তাঁদের কাছে তোমার বাণ্ডিলগুলি ঠিক ঠিক পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বরাবরই তাঁরা বড় সহৃদয়। মিঃ ও মিসেস স্যালমন্ ও অপরাপর বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। ঘটনাক্রমে মিসেস গার্নসির ওখানে মিসেস পিকের সঙ্গে দেখা হয়; কিন্তু এ-যাবৎ মিসেস রথিনবার্গারের কোন খবর নেই। ‘স্বর্গের পাখী’দের সঙ্গে এই বড়দিনের সময় রিজলিতে যাচ্ছি; তুমিও ওখানে থাকলে কতই না আনন্দ হত।

লেডী ইসাবেলের সঙ্গে তোমার বেশ আলাপ-পরিচয় হয়ে গেছে বোধ হয়। সকলকে আমার ভালবাসা জানাবে এবং নিজেও সাগর-প্রমাণ ভালবাসা জানবে। চিঠি ছোট হল বলে কিছু মনে করো না; আগামী বার থেকে বড় বড় সব লিখব।

সদা প্রভুপদাশ্রিত তোমাদের বিবেকানন্দ
…………………………….

২৩৯*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
228, West 39th St. নিউ ইয়র্ক
৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় বন্ধু,
দশ দিনের অত্যন্ত বিরক্তিকর এবং বিক্ষুব্ধ সমুদ্রযাত্রার পর আমি নিরাপদে নিউ ইয়র্কে এসে পৌঁছেছি। আমার বন্ধুরা ইতোমধ্যেই উপরের ঠিকানায় কয়েকটি ঘর ঠিক করে রেখেছেন। সেখানেই আমি এখন বাস করছি এবং শীঘ্র ক্লাস নেবার ইচ্ছা আছে। ইতোমধ্যে —রা অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে উঠেছে এবং আমাকে আঘাত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।

মিসেস লেগেট ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তারা বরাবরের মতই সদয় ও অনুরক্ত।

যে সন্ন্যাসীটি আসছেন, তাঁর সম্বন্ধে ভারত থেকে কোন সংবাদ পেয়েছেন কি? আমি এখানকার কাজের পূর্ণ বিবরণ পরে লিখব।

দয়া করে মিস মূলারকে, মিসেস স্টার্ডিকে এবং অন্য বন্ধুদের আমার ভালবাসা জানাবেন এবং শিশুকে আমার হয়ে চুম্বন দেবেন। ইতি

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৪০*
228, West 39th St. নিউ ইয়র্ক
১০ ডিসেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয়—,
সেক্রেটারীর পত্র পেয়েছি, তাঁর অনুরোধ মত Harvard Philosophical Club (হার্ভার্ড)-এ আনন্দের সহিত বক্তৃতা দেব। তবে অসুবিধা এই যে, আমি এখন এক মনে লিখতে আরম্ভ করেছি; কারণ আমি এমন কতকগুলি পাঠ্যপুস্তক লিখে ফেলতে চাই, যেগুলি আমি চলে গেলে আমার কাজের ভিত্তিস্বরূপ হবে। তার পূর্বে আমাকে চারখানি ছোট ছোট বই তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।

এই মাসে চারটি রবিবাসরীয় বক্তৃতার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। ফেব্রুআরীর প্রথম সপ্তাহে ব্রুকলিনে যে বক্তৃতাগুলি দিতে হবে, ডাক্তার জেন‍্‍স্ প্রভৃতি তার বন্দোবস্ত করছেন। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছাদি জানবে। ইতি

তোমাদের শুভার্থী
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৪১*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
228, West 39th St., নিউ ইয়র্ক
১৬ (?) ডিসেম্বর, ১৮৯৫

স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
তোমার সব ক-খানি চিঠি একই ডাকে আজ এসেছে, মিস মূলারও একটি লিখেছেন। তিনি ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় পড়েছেন যে, স্বামী কৃষ্ণানন্দ ইংলণ্ডে আসছেন। যদি তাই হয়, যাদের আমি পেতে পারি, তাদের মধ্যে ইনিই হবেন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী।

এখানে আমার সপ্তাহে ছ-টি করে ক্লাস হচ্ছে; তা ছাড়া প্রশ্নোত্তর ক্লাসও একটি আছে। শ্রোতার সংখ্যা ৭০ থেকে ১২০ পর্যন্ত হয়। এ ছাড়া প্রতি রবিবারে আমি সর্বসাধারণের জন্য একটি বক্তৃতা দিই। গত মাসে যে সভাগৃহে আমার বক্তৃতাগুলি হয়েছিল, তাতে ৬০০ জন বসতে পারে। কিন্তু সাধারণতঃ ৯০০ জন আসত—৩০০ জন দাঁড়িয়ে থাকত, আর ৩০০ জন জায়গা না পেয়ে ফিরে যেত। সুতরাং এ সপ্তাহে একটা বৃহত্তর হল নিয়েছি, যাতে ১২০০ জন বসতে পারবে।

এই বক্তৃতাগুলিতে যোগ দেবার জন্য কোন অর্থাদি চাওয়া হয় না; কিন্তু সভায় যে চাঁদা ওঠে, তাতে বাড়ী-ভাড়াটা পুষিয়ে যায়। এ সপ্তাহে খবরের কাগজগুলির দৃষ্টি আমার উপর পড়েছে এবং এ বৎসর আমি নিউ ইয়র্ককে অনেকটা মাতিয়ে তুলেছি। যদি এই গ্রীষ্মে এখানে থেকে একটি গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান করতে পারতাম, তবে এখানকার কাজটা সুদৃঢ় ভিত্তিতে চলতে পারত। কিন্তু মে মাসে ইংলণ্ডে যাবার সঙ্কল্প করেছি বলে এটা অসম্পূর্ণ রেখেই যেতে হবে। অবশ্য কৃষ্ণানন্দ যদি ইংলণ্ডে আসেন এবং তাঁকে তোমার সুদক্ষ ও সুযোগ্য বলে মনে হয় এবং তুমি যদি বুঝতে পার যে, এই গ্রীষ্মে আমার অনুপস্থিতিতে কাজটার ক্ষতি হবে না, তবে গ্রীষ্মটা বরং এখানেই থেকে যাব।

অধিকন্তু ভয় হচ্ছে, অবিরাম কাজের চাপে আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছে। কিছু বিশ্রাম আবশ্যক। এইসব পাশ্চাত্য রীতিতে আমরা অনভ্যস্ত—বিশেষতঃ ঘড়ি-ধরে চলাতে। ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকাখানি এখানে সুন্দর চলছে। আমি ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছি; তা ছাড়া মাসিক কাজের একটা বিবরণও তাদের পাঠাচ্ছি। মিস মূলার আমেরিকায় আসতে চান; আসবেন কিনা জানি না। এখানে জনকয়েক বন্ধু আমার রবিবারের বক্তৃতাগুলি ছাপছেন। প্রথমটির কয়েক কপি তোমায় পাঠয়েছি। আগামী ডাকে পরবর্তী দুটি বক্তৃতার কয়েক কপি পাঠাব, তোমার যদি পছন্দ হয় তবে অনেকগুলি পাঠিয়ে দেব। ইংলণ্ডে কয়েক শত কপি বিক্রীর ব্যবস্থা করতে পার কি?—তাতে ওরা পরবর্তী বক্তৃতাগুলি ছাপতে উৎসাহিত হবে।

আগামী মাসে ডেট্রয়েট যাব, তারপর বোষ্টনে ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। অতঃপর ইংলণ্ডে যাব কিছুদিন বিশ্রাম করে—যদি না তুমি মনে কর যে, আমাকে বাদ দিয়েও কৃষ্ণানন্দের সাহায্যে কাজ চলে যাবে। ইতি

সতত স্নেহাশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৪২*
228, West 39th St. নিউ ইয়র্ক
২০ ডিসেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এই সঙ্গে ‘ভক্তিযোগে’র কপি কতকটা পূর্ব থেকেই পাঠাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে ‘কর্ম’ সম্বন্ধেও একটা বক্তৃতা পাঠালাম। এরা এখন একজন সঙ্কেতলিপিকর নিযুক্ত করেছে এবং আমি ক্লাসে যা কিছু বলি, সে সেগুলি টুকে নেয়। সুতরাং এখন তুমি কাগজের জন্য যথেষ্ট মাল পাবে। এগিয়ে চল। স্টার্ডি পরে আরও লিখবে। ইংলণ্ডে এরা নিজেদের একটা কাগজ বের করবে মনে করছে, ‘ব্রহ্মবাদিনে’র জন্য তাই বেশী কিছু করতে পারিনি। কাগজটার বাইরে একটা মানানসই মলাট না দেবার মানেটা কি বল দেখি? এখন কাগজটার ওপর তোমাদের সমুদয় শক্তি প্রয়োগ কর; কাগজটা দাঁড়িয়ে যাক—আমি এটা দেখতে দৃঢ়সঙ্কল্প। ধৈর্য ধরে থাক এবং মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্ত হয়ে থাক। নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না। টাকা-কড়ির লেন-দেন বিষযে সম্পূর্ণ খাঁটি হও। তাড়াহুড়ো করে টাকা রোজগারের চেষ্টা করো না—ও-সব ক্রমে হবে। আমরা এখনও বড় বড় কাজ করব, জেনো। প্রতি সপ্তাহে এখান থেকে কাজের একটা রিপোর্ট পাঠান হবে। যতদিন তোমাদের বিশ্বাস, সাধুতা ও নিষ্ঠা থাকবে, ততদিন সব বিষয়ে উন্নতিই হবে। আগামী ডাকে কাগজটা সম্বন্ধে সব কথা আমায় লিখবে।

বৈদিক সূক্তগুলির অনুবাদের সময় ভাষ্যকারদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রেখো; প্রাচ্যতত্ত্ববিদদের কথায় এতটুকু মনোযোগ দিও না। ওরা আমাদের শাস্ত্রগুলি সম্বন্ধে কিছুই বোঝে না। নীরস ভাষাতত্ত্ববিদেরা ধর্ম বা দর্শন বুঝতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, ঋগ্বেদের ‘আনীদবাতম্‌’ শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে—‘তিনি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস না নিয়ে বাঁচতে লাগলেন।’ প্রকৃতপক্ষে এখানে মুখ্য প্রাণ সম্বন্ধেই বলা হয়েছে এবং ‘অবাতম্‌’ শব্দের প্রকৃতিগত অর্থ—অবিচলিতভাবে অর্থাৎ অস্পন্দভাবে। কল্পারম্ভের পূর্বে প্রাণ অর্থাৎ সর্বব্যাপিনী জাগতিক শক্তি যে অবস্থায় থাকে, তারই বর্ণনা দেওয়া হয়েছে (ভাষ্যকারগণ দ্রষ্টব্য)। আমাদের ঋষিদের ভাবানুযায়ী ব্যাখ্যা কর, তথাকথিত পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতানুসারে নয়। তারা কি জানে?

‘ভক্তিযোগ’ সম্বন্ধে লেখাগুলো অনেকটা প্রণালীবদ্ধ আকারে আছে; কিন্তু ক্লাসে যে-সব বলা হয়েছে, সেগুলি অমনি এলোপাতাড়ি—সুতরাং সেগুলি একটু দেখে-শুনে ছাপাতে হবে। তবে আমার ভাবগুলির ওপর বেশী কলম চালিও না। সাহসী ও নির্ভীক হও—তা হলেই রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ‘ভক্তিযোগ’টা বহুদিন ধরে তোমাদের কাগজের খোরাক যোগাবে। তারপর ওটা গ্রন্থাকারে ছাপিও। ভারত, আমেরিকা ও ইংলণ্ডে বইটি খুব বিক্রী হবে। মনে রেখো, থিওসফিষ্টদের সঙ্গে যেন কোন প্রকার সম্বন্ধ না রাখা হয়। তোমরা যদি সকলে আমাকে ত্যাগ না কর, আমার পশ্চাতে ঠিক খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পার এবং ধৈর্য না হারাও, তবে আমি তোমাদের নিশ্চয় করে বলতে পারি, আমরা আরও খুব বড় বড় কাজ করতে পারব! হে বৎস, ইংলণ্ডে ধীরে ধীরে খুব বড় কাজ হবে। আমি বুঝতে পারছি, তুমি মাঝে মাঝে নিরুৎসাহ হয়ে পড়; মনে রেখো, ইতিহাসের এই একমাত্র সাক্ষ্য যে, গুরুভক্ত জগৎ জয় করবে। আমি জি.জি.-র চিঠি পেয়ে ভারি খুশী হয়েছি। বিশ্বাসই মানুষকে সিংহতুল্য বীর্যবান্‌ করে। তুমি সর্বদা মনে রেখো, আমাকে কত কাজ করতে হয়। কখনও কখনও দিনে দু-তিনটা বক্তৃতা দিতে হয়। এইভাবে সর্বপ্রকার প্রতিকূলতা কাটিয়ে পথ করে নিচ্ছি—কঠিন কাজ! আমার চেয়ে নরম প্রকৃতির লোক হলে এতেই মরে যেত। স্টার্ডির প্রবন্ধটা ছাপিয়েছ কি? মিঃ কৃষ্ণমেনন আমাকে বরাবর বলে এসেছে—সে লিখবে; কিন্তু আমার আশঙ্কা হচ্ছে, সে এখনও কিছু লেখেনি। ইংলণ্ডে সে দুরবস্থায় পড়েছে। আমি তাকে ৮ পাউণ্ড দিয়ে সাহায্য করেছি; এর বেশী কিছু করবার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি বুঝতে পারছি না, সে দেশে ফিরছে না কেন। তার কাছ থেকে কিছু আশা করো না। বিশ্বাস ও দৃঢ়তার সহিত লেগে থাক। সত্যনিষ্ঠ, সাধু ও পবিত্র হও, আর নিজেদের ভেতর বিবাদ করো না। ঈর্ষাই আমাদের জাতির ধ্বংসের কারণ।

ডাক চলে যাচ্ছে—তাড়াতাড়ি চিঠিখানা শেষ করতে হচ্ছে। তোমাকে ও আমাদের সকল বন্ধুবান্ধবকে ভালবাসা জানাচ্ছি। ইতি

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৪৩*
[স্বামী সারদানন্দকে লিখিত]
228, W. 39th St. নিউ ইয়র্ক
২৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় শরৎ,
তোমার পত্রপাঠে আমি অত্যন্ত দুঃখিতই হয়েছি। দেখছি, তুমি একেবারে নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছ। আমি তোমাদের সকলকে—তোমাদের ক্ষমতা ও অক্ষমতাকে জানি। তুমি কোন কাজে অপারগ হলে সেই কাজের জন্য তোমায় ডাকতুম না, তোমাকে শুধু সংস্কৃতের প্রাথমিক বিষয়গুলি শেখাতে বলতুম এবং অভিধান প্রভৃতির সাহায্যে অনুবাদ ও অধ্যাপনার কাজে স্টার্ডির সহায়তা করতে বলতুম। তোমাকে ঐ কাজের জন্য গড়ে নিতুম। বস্তুতঃ যে-কেহ ঐ কাজ চালাতে পারত—একান্ত প্রয়োজন ছিল সংস্কৃতের শুধু একটু চলনসই জ্ঞানের। যাক, যা হয় সব ভালর জন্যই। এটা যদি ঠাকুরের কাজ হয়, তবে ঠিক জায়গার জন্য ঠিক লোক যথাসময়ে এসে যাবে। তোমাদের কারও নিজেকে উত্ত্যক্ত মনে করার প্রয়োজন নাই। হাইভিউ, কেভার্শ্যাম, রিডিং, ইংলণ্ড—এই ঠিকানায় স্টার্ডির নিকট টাকা পাঠিয়ে দিও।

‘সা—’র বিষয়ে বক্তব্য এইঃ টাকা কে নিচ্ছে বা না নিচ্ছে, আমি তা গ্রাহ্য করি না, কিন্তু বাল্যবিবাহ আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি। এজন্য ভয়ানক ভুগেছি, আর এই মহাপাপে আমাদের জাতকে ভুগতে হচ্ছে। অতএব এরূপ পৈশাচিক প্রথাকে যদি আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করি, তবে নিজেই নিজের কাছে ঘৃণ্য হব। আমি তোমাকে এ বিষয়ে স্পষ্টই লিখেছিলাম; … বাল্যবিবাহরূপ এই আসুরিক প্রথার উপর আমাকে যথাশক্তি দৃঢ়ভাবে পদাঘাত করতে হবে, সেজন্য তোমার কোন দোষ হবে না। তোমার ভয় হয় তো তুমি দূর হতে নিজেকে বিপদ থেকে বাঁচাও। আমার সঙ্গে তোমার কোন সম্বন্ধ আছে—এটা অস্বীকার করলেই হল; আর আমিও তা দাবী করার জন্য অতিমাত্রায় আগ্রহান্বিত নই। আমি দুঃখিত—অতি দুঃখিত যে ছোট ছোট মেয়েদের বর যোগাড়ের ব্যাপারে আমি মোটেই নিজেকে জড়াতে পারব না; ভগবান্ আমার সহায় হোন! আমি এতে কোনদিন ছিলাম না এবং কোনদিন থাকবও না। ‘ম—’বাবুর কথা ভাবো দেখি! এর চেয়ে বেশী কাপুরুষ বা পশুপ্রকৃতির লোক কখনও দেখেছ কি? মোদ্দা কথা এই—আমার সাহায্যের জন্য এরূপ লোক চাই, যারা সাহসী, নির্ভীক ও বিপদে অপরাঙ্মুখ। আমি খোকাদের ও ভীরুদের চাই না। প্রত্যুত আমি একাই কাজ করব। একটা ব্রত আমায় উদ‍্‍যাপন করতে হবে। আমি একাই তা সম্পন্ন করব। কে আসে বা কে যায়, তাতে আমি ভ্রূক্ষেপ করি না। ‘সা—’ ইতোমধ্যেই সংসারে ডুবেছে, আর তোমাতেও দেখছি তার ছোঁয়াচ লাগছে! সাবধান! এখনও সময় আছে। তোমায় এইটুকু মাত্র উপদেশ দেওয়া আমার কর্তব্য মনে করেছিলাম। অবশ্য এখন তোমরাই মস্ত লোক—আমার কথা তোমাদের কাছে মোটেই বিকোবে না। কিন্তু আমি আশা করি—এমন সময় আসবে, যখন তোমরা আরও স্পষ্ট করে দেখতে পাবে, জানতে পারবে এবং সম্প্রতি যেরূপ ভাবছ তা থেকে অন্যরূপ ভাববে।

আমি যোগেনের জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। আমার মনে হয় না যে, কলিকাতা তার পক্ষে অনুকূল। ঠাণ্ডা আবহাওয়াতে হজমের অপূর্ব উপকার হয়।

এবার আসি। আর তোমাদের বিরক্ত করব না; তোমাদের সকলের সর্বপ্রকার কল্যাণ হোক! আমি অতি আনন্দিত যে, কখনও তোমাদের কাজে লেগেছি—অবশ্য তোমরাও যদি তাই মনে কর। অন্ততঃ গুরুমহারাজ আমার উপর যে কর্তব্য অর্পণ করেছিলেন, তা সম্পন্ন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি—এইভাবে আমি আত্মপ্রসাদ লাভ করছি; ঐ কাজ সুসম্পন্ন হোক আর নাই হোক, আমি চেষ্টা করেছি জেনেই খুশী আছি। সুতরাং তোমাদের নিকট বিদায়! তোমাদের যথেষ্ট শক্তি আছে; আর আমার পক্ষে যতটা হওয়া সম্ভব, তোমরা তার চেয়েও উঁচু; সুতরাং তোমরা নিজেদের পথে চল। ‘সা—’কে বলবে যে, আমি তার উপর মোটেই রাগ করিনি—তবে আমি দুঃখিত, খুব দুঃখিত হয়েছি। এটা টাকার জন্য নয়—টাকাতে আর কি যায় আসে! কিন্তু সে একটা নীতি লঙ্ঘন করেছে এবং আমার উপর ধাপ্পাবাজি করেছে বলেই আমি ব্যথিত হয়েছি। তার কাছে বিদায় নিচ্ছি, আর তোমাদেরও সকলের কাছে। আমার জীবনের একটা পরিচ্ছেদ শেষ হয়ে গেল। অপরেরা তাদের পালা অনুযায়ী আসুক—তারা আমায় প্রস্তুত দেখতে পাবে। তুমি আমার জন্য মোটেই ব্যস্ত হয়ো না। আমি কোন দেশের কোন মানুষের তোয়াক্কা রাখি না। সুতরাং বিদায়। ঠাকুর তোমাদিগকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন! ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৪৪*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
ডিসেম্বর, ১৮৯৫
এখানকার কাজ চমৎকার চলিতেছে। এখানে আসার পর হইতেই আমি দৈনিক দুইটি ক্লাসের জন্য অবিরাম খাটিতেছি। আগামীকাল হইতে এক সপ্তাহের অবকাশ লইয়া মিঃ লেগেটের সহিত শহরের বাহিরে যাইতেছি। আপনাদের দেশের জনৈকা প্রসিদ্ধা গায়িকা মাদাম স্টার্লিংকে আপনি জানেন কি? তিনি আমার কাজে বিশেষ আগ্রহান্বিতা।

আমি আমার কাজের বৈষয়িক দিকটা সম্পূর্ণভাবে একটি কমিটির হাতে দিয়া ঐ-সমস্ত ঝঞ্ঝাট হইতে মুক্ত হইয়াছি। বৈষয়িক ব্যবস্থাদি করিবার ক্ষমতা আমার নাই—ঐ-জাতীয় কাজ আমাকে যেন শতধা ভাঙিয়া ফেলে।

নারদসূত্রের কি হইল? আমার বিশ্বাস ঐ বইখানি এখানে প্রচুর বিক্রয় হইবে। আমি এখন ‘যোগসূত্র’ ধরিয়াছি এবং এক একটি সূত্র লইয়া উহার সহিত সকল ভাষ্যকারের মত আলোচনা করিতেছি। এই সমস্তই লিখিয়া রাখিতেছি এবং এই লেখার কাজ শেষ হইলে উহাই ইংরেজীতে পতঞ্জলির পূর্ণাঙ্গ সঠিক অনুবাদ হইবে। অবশ্য গ্রন্থখানি অনেকটা বড় হইয়া যাইবে।

আমার বোধ হয় ট্রুব‍্‍নারের দোকানে ‘কূর্মপুরাণের’ একটি সংস্করণ আছে। ভাষ্যকার বিজ্ঞানভিক্ষু পুনঃ পুনঃ ঐ গ্রন্থের বচন উদ্ধৃত করিয়াছেন। আমি গ্রন্থখানি নিজে কখনও দেখি নাই। আপনি কি একবার একটু সময় করিয়া দেখিয়া আসিতে পারেন যে, ঐ গ্রন্থে যোগ সম্বন্ধে গোটা কয়েক পরিচ্ছেদ আছে কিনা? যদি থাকে তবে দয়া করিয়া আমায় একখানি বই পাঠাইয়া দিবেন কি? ‘হঠযোগপ্রদীপিকা’, ‘শিবসংহিতা’ এবং যোগের উপর অন্য কোন গ্রন্থ থাকিলে তাহাও একখানি করিয়া চাই। অবশ্য মূল গ্রন্থগুলিই আবশ্যক। পুস্তকগুলি আসিলেই আমি আপনাকে মূল্য পাঠাইয়া দিব। জন ডেভিসের সম্পাদিত ঈশ্বরকৃষ্ণের ‘সংখ্যাকারিকা’ও একখানি পাঠাইবেন।

এইমাত্র ভারতীয় চিঠিগুলির সহিত আপনার চিঠিও পাইলাম। আসিবার জন্য যে প্রস্তুত, সে অসুস্থ। অন্যেরা বলে যে, তাহারা মুহূর্তের আহ্বানে আসিতে পারে না। এই পর্যন্ত সবই দুরদৃষ্ট মনে হয়। তাহারা না আসিতে পারায় আমি দুঃখিত। কি আর করিব? ভারতে সবই মন্থরগতি।

‘বদ্ধ আত্মায় বা জীবে তাঁহার পূর্ণত্ব অব্যক্ত বা সূক্ষ্মভাবে বিরাজিত; আর যখনই সেই পূর্ণত্বের বিকাশ সাধিত হয়, তখনই জীব মুক্ত হয়’—ইহাই রামানুজের মত। কিন্তু অদ্বৈতবাদী বলেন, ব্যক্ত বা অব্যক্ত কোনটাই প্রকৃত অবস্থা নহে, ঐরূপ প্রতীত হয় মাত্র। উভয় প্রণালীই মায়া—পরিদৃশ্যমান অবস্থা মাত্র।

প্রথমতঃ আত্মা স্বভাবতঃ জ্ঞাতা নহেন। ‘সচ্চিদানন্দ’ সংজ্ঞায় তাঁহাকে আংশিকভাবেই প্রকাশ করা হয় মাত্র, ‘নেতি নেতি’ সংজ্ঞাই তাঁহার স্বরূপ যথাযথ বর্ণনা করে। শোপেনহাওয়ার তাঁহার ‘ইচ্ছাবাদ’ বৌদ্ধদিগের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছেন। বাসনা, তৃষ্ণা বা তঞ‍্‍হা (পালি) প্রভৃতি শব্দেও ঐ ভাবটিই প্রকাশিত হইয়াছে। আমরাও ইহা স্বীকার করি যে, বাসনাই সর্ববিধ অভিব্যক্তির কারণ এবং ইহাই কার্যরূপে পরিণত হয়। কিন্তু যাহাই ‘হেতু’ বা ‘কারণ’, তাহাই সেই (সগুণ) ব্রহ্ম এবং মায়া—এই দুইয়ের সংমিশ্রণে উদ্ভূত। এমন কি ‘জ্ঞান’ও একটি যৌগিক পদার্থ বলিয়া অদ্বৈতবস্তু হইতে একটু স্বতন্ত্র। তবে জ্ঞাত বা অজ্ঞাত সর্বপ্রকার বাসনা হইতেই উহা নিঃসংশয়ে শ্রেষ্ঠ এবং অদ্বিতীয়ের নিকটতম বস্তু। সেই অদ্বৈত-তত্ত্ব প্রথমে জ্ঞান এবং তারপর ইচ্ছার সমষ্টিরূপে প্রতিভাত হন।

উদ্ভিদমাত্রই ‘অচেতন’ অথবা বড়জোর ‘চৈতন্য-বিবর্জিত ক্রিয়াশক্তি মাত্র’ বলিয়া যদি আপত্তি উত্থাপিত হয়, তবে উত্তরে বলা যাইতে পারে যে, এই অচেতন উদ্ভিদ‍শক্তিও সেই বিরাট বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিশক্তি, যাহাকে সাংখ্যকার ‘মহৎ’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন—সেই এক চেতন ইচ্ছারই অভিব্যক্তি।

বস্তু জগতের সব কিছুই সেই ‘এষণা’ বা ‘সঙ্কল্প’রূপ আদি বস্তু হইতে উদ্ভূত—বৌদ্ধদিগের এই মতবাদ অসম্পূর্ণ; কারণ প্রথমতঃ ‘ইচ্ছা’ একটি যৌগিক পদার্থ এবং দ্বিতীয়ঃ জ্ঞান বা চেতনারূপ যে প্রাথমিক যৌগিক পদার্থ, উহা ইচ্ছারও পূর্বে বিরাজ করে। জ্ঞানই ক্রিয়াতে পরিণত হয়। প্রথমে ক্রিয়া, তারপর প্রতিক্রিয়া। মন প্রথমে অনুভব করে এবং তৎপর প্রতিক্রিয়ারূপে উহাতে সঙ্কল্পের উদয় হয়। মনেই সঙ্কল্পের স্থিতি, সুতরাং সঙ্কল্পকে মূল বস্তু বলা ভুল।

ডয়সন্ ডারুইন-মতাবলম্বিগণের হাতে ক্রীড়াপুত্তলিকা মাত্র। বস্তুতঃ ক্রমবিকাশবাদকে উচ্চতর পদার্থবিজ্ঞানের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। ‘ব্যক্ত’ এবং ‘অব্যক্ত’ ভাব যে পরস্পরকে নিত্য অনুবর্তন করিয়া থাকে—এ তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানই প্রমাণ করিতে পারে। কাজেই ‘বাসনা’ বা ‘সঙ্কল্পের’ যে অভিব্যক্তি, তাহার পূর্বাবস্থায় ‘মহৎ’ বা ‘বিশ্বচেতনা’ গুপ্ত অথবা সূক্ষ্মভাবে বিরাজ করে। জ্ঞান ভিন্ন সঙ্কল্প অসম্ভব। কারণ আকাঙ্ক্ষিত বস্তু সম্বন্ধে যদি কোন জ্ঞান না থাকে, তবে আকাঙ্ক্ষার উদয় হইবে কিরূপে?

বিশ্ব-চেতনা বা মহৎ (Universal Consciousness)
|
অবচেতন
(Sub-conscious)
| |
সজ্ঞান
(Conscious)
| |
অতিচেতন
(Superconscious)
|
চৈতন্য-বিবর্জিত
সঙ্কল্প বা ক্রিয়া
(Unconsious Will) যথার্থ সজ্ঞান সঙ্কল্প
(Conscious Will Proper) অতীন্দ্রিয় জ্ঞান সঙ্কল্প
(Superconscious Will)
এ তত্ত্ব আপাতদৃষ্টিতে যতটা দুর্বোধ্য বলিয়া মনে হয়, জ্ঞানকে ‘চেতন’ ও ‘অবচেতন’ এই দুই অবস্থায় বিভক্ত করিলে ঐ দুর্বোধ্যতা অন্তর্হিত হয়। এবং তাহা না হইবার বা হেতু কি? যদি ‘সঙ্কল্প’ বস্তুটিকেই আমরা ঐরূপে বিশ্লেষণ করিয়া দেখিতে পারি, তবে উহার জনক বস্তুটিকেই বা বিশ্লেষণ করা যাইবে না কেন?

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৪৫*
[মিস ফার্মারকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
২৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় ভগিনী,
এই জগৎ—যেখানে কিছুই নষ্ট হয় না, যেখানে আমরা জীবনেই মৃত্যুর মধ্যে বাস করি, সেখানে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে, জনাকীর্ণ নগরীর পথে বা আদিম যুগের নিবিড় নিভৃত অরণ্যে, যা-কিছু চিন্তা করা হয়েছে, তা-ই থেকে যায়। তারা ক্রমাগত রূপপরিগ্রহ করবার চেষ্টা করছে, এবং যতদিন না প্রকাশ পাচ্ছে, ততদিন অভিব্যক্ত হবার জন্য চেষ্টা করবেই এবং তাদের যতই চাপবার চেষ্টা করা হোক না কেন, তারা কিছুতেই নষ্ট হবে না। কিছুরই বিনাশ নাই—যে-সকল চিন্তা অতীতে অনিষ্টসাধন করেছিল, তারাও রূপপরিগ্রহের চেষ্টা করছে, তারাও পুনঃ পুনঃ প্রকাশের দ্বারা শুদ্ধ হয়ে অবশেষে সম্পূর্ণ সৎ চিন্তায় রূপায়িত হবার চেষ্টা করছে।

সুতরাং বর্তমান কালেও এমন কতকগুলি ভাবরাশি বিদ্যমান, যেগুলি আত্মপ্রকাশে সচেষ্ট। এই অভিনব ভাবরাশি আমাদের বলছে যে, আমাদের অন্তরে যে দ্বৈতবাদের কল্পনা আছে, কোন বস্তু স্বরূপতঃ ভাল বা মন্দ এবংবিধ যে কল্পনা আছে ও তাদের দাবানর জন্য যে ততোধিক উৎকট বৃথা আশা রয়েছে—এ সমস্তকেই পরিহার করতে হবে। ঐ ভাবরাশি আমাদের শেখাচ্ছে, জগতে উন্নতির রহস্য প্রবৃত্তির উচ্ছেদ নহে, পরন্তু উচ্চতর দিকে তার মোড় ফিরিয়ে দেওয়া। ঐ ভাবরাশি শেখাচ্ছে, এই জগৎ ভাল ও মন্দ দিয়ে প্রস্তুত নয়; প্রত্যুত এর উপাদান হচ্ছে ভাল, তার চেয়ে ভাল এবং তার চেয়ে আরও ভাল। সকলে গ্রহণ না করা পর্যন্ত ঐ ভাব শান্ত হয় না। ঐ ভাব শিক্ষা দেয় যে, কোন অবস্থাতেই একেবারে হাল ছেড়ে দেবার দরকার নেই; সুতরাং যে-কোন মনোবৃত্তি, নীতি বা ধর্মকে ঐ ভাব যে-অবস্থায় পায়, সে-অবস্থাতেই সাদরে গ্রহণ করে, এবং সেগুলির উপর বিন্দুমাত্র দোষারোপ না করে বলে, ‘এ পর্যন্ত ভালই করেছ, এখন আরও ভাল করার সময় এসেছে।’ প্রাচীন- কালে চিন্তা করা হত—মন্দকে বর্জন করতে হবে, এই নতুন শিক্ষানুসারে বলা হয়, মন্দ রূপান্তরিত হবে—ভাল থেকে আরও ভাল করবার চেষ্টা করতে হবে। সর্বোপরি এই ভাব শিক্ষা দেয়, যদি পাবার আকাঙ্ক্ষা থাকে, তবে দেখবে যে, স্বর্গরাজ্য আগে থেকেই বিদ্যমান; মানুষের যদি দেখবার সাধ থাকে, তবে সে দেখবে, সে পূর্ব থেকেই পূর্ণ।

বিগত গ্রীষ্মঋতুতে গ্রীনএকারে যে সভাগুলি হয়েছিল, সেগুলি যে এত চমৎকার হয়েছে, তার একমাত্র কারণ, তুমি পূর্বোক্ত ভাবপ্রকাশের উপযুক্ত যন্ত্রস্বরূপ হয়ে অন্তরে ঐ ভাব যাতে অবাধে প্রবেশ করে, তার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত রেখেছিলে, স্বর্গরাজ্য যে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান—নতুন চিন্তাপ্রণালীর এই সর্বোচ্চ শিক্ষারূপ ভিত্তির উপর তুমি দণ্ডায়মান ছিলে।

তুমি এই ভাব জীবনে পরিণত করে দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখাবার উপযুক্ত আধাররূপে প্রভু কর্তৃক মনোনীত ও আদিষ্ট হয়েছ, এবং যে তোমাকে এই অদ্ভুত কার্যে সহায়তা করবে, সে প্রভুরই সেবা করবে।

আমাদের শাস্ত্রে আছে—‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ।’ অর্থাৎ যারা আমার ভক্তগণের ভক্ত, তারা আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত। তুমি প্রভুর সেবিকা; সুতরাং আমি যেখানেই থাকি না কেন, ভগবৎপ্রেরণায় তুমি যে মহোচ্চ ব্রতে দীক্ষিত হয়েছ, তার উদ‍্‍যাপনে যে-কোন প্রকারে সহায়তা করতে পারি, শ্রীকৃষ্ণের অনুগামী আমি তৎসাধনে নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করব ও তা সাক্ষাৎ প্রভুরই সেবা বলে মনে করব। ইতি

তোমার চিরস্নেহাবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৪৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
রিজলী ম্যানর
২৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় বন্ধু,
বক্তৃতার নকলগুলি ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই আপনার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে। আশা করি সেগুলি কোন কাজে আসতে পারে।

আমার মনে হয়, প্রথমতঃ অনেক অসুবিধা অতিক্রম করতে হবে; দ্বিতীয়তঃ তারা নিজেদের কোন কাজেরই উপযুক্ত মনে করে না—এই হল ও-দেশের জাতীয় ব্যাধি; তৃতীয়তঃ তারা এখনই শীতের সম্মুখীন হতে সাহস করছে না; তিব্বতের লোকটিকে ইংলণ্ডে কাজ করার মত খুব শক্তসমর্থ বলে তারা মনে করে না। শীঘ্রই হোক আর বিলম্বেই হোক, কেউ না কেউ আসবে।

বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমাদের বন্ধুদের আমার বড়দিনের অভিনন্দন জানাবেন—মিসেস ও মিঃ জনসন, লেডী মারগেসন (Lady Margesson), মিসেস ক্লার্ক, মিস হয়েস (Miss Hawes), মিস মূলার, মিস স্টীল (Miss Steel) এবং বাকী সকলকে।

শিশুকে আমার হয়ে চুম্বন ও আশীর্বাদ দিবেন। মিসেস স্টার্ডিকে আমার নমস্কার। আমরা কাজ করবই। ‘ওয়া গুরুজী কি ফতে।’
—বি
…………………………….

২৪৭
[মঠে সকলকে লক্ষ্য করিয়া লিখিত]
১৮৯৫

প্রিয়বরেষু,
সাণ্ডেল যে যে পুস্তক পাঠাইয়াছিল, তাহা পৌঁছিয়াছে—এ-কথা লিখিতে ভুল হয়। তাহাকে জ্ঞাত করিবে। তোমাদের জন্য লিখি—

১| পক্ষপাতই সকল অনিষ্টের মূল কারণ জানিবে। অর্থাৎ যদ্যপি তুমি কাহারও প্রতি অধিক স্নেহ অন্যাপেক্ষা দেখাও, তাহা হইলেই ভবিষ্যৎ বিবাদের মূল পত্তন হইবে।

২| কেহ তোমার নিকট অপর কোন ভাইয়ের নিন্দা করিতে আসিলে তাহা বিলকুল শুনিবে না—শুনাও মহাপাপ, ভবিষ্যৎ বিবাদের সূত্রপাত তাহাতে।

৩| অধিকন্তু সকলের দোষ সহ্য করিবে, লক্ষ অপরাধ ক্ষমা করিবে এবং সকলকে তুমি যদি নিঃস্বার্থভাবে ভালবাস, সকলেই ধীরে ধীরে পরস্পরকে ভালবাসিবে। একের স্বার্থ অন্যের উপর নির্ভর করে, এ-কথা বিশেষরূপে বুঝিতে পারিলেই সকলে ঈর্ষা একেবারে ত্যাগ করিবে; দশজনে মিলিয়া একটা কার্য করা—আমাদের জাতীয় চরিত্রের মধ্যেই নাই, এজন্য ঐ ভাব আনতে অনেক যত্ন চেষ্টা ও বিলম্ব সহ্য করিতে হইবে। আমি তোমাদের মধ্যে তো বড় ছোট দেখিতে পাই না, কাজের বেলায় সকলেই মহাশক্তি প্রকাশ করিতে পারে, আমি দেখিতে পাইতেছি। শশী কেমন স্থান জাগিয়ে বসে থাকে; তার দৃঢ়নিষ্ঠা একটা মহাভিত্তিস্বরূপ। কালী ও যোগেন টাউন-হল মিটিং কেমন উত্তমরূপে সিদ্ধ করিল—কত গুরুতর কার্য! নিরঞ্জন সিলোন (সিংহল) প্রভৃতি স্থানে অনেক কার্য করিয়াছে। সারদা কত দেশ পর্যটন করিয়া বড় বড় কার্যের বীজ বপন করিয়াছে। হরির বিচিত্র ত্যাগ, স্থিরবুদ্ধি ও তিতিক্ষা আমি যখনই মনে করি, তখনই নূতন বল পাই। তুলসী, গুপ্ত, বাবুরাম, শরৎ প্রভৃতি সকলের মধ্যেই এক এক মহাশক্তি আছে। তিনি যে জহুরী ছিলেন, তাতে এখনও যদি সন্দেহ হয়, তাহলে তোমাতে আর উন্মাদে তফাত কি? দেখ এদেশে শত শত নরনারী প্রভুকে সকল অবতারের শ্রেষ্ঠ বলিয়া পূজা করিতে আরম্ভ করিতেছে। ধীরে ধীরে—মহাকার্য ধীরে ধীরে হয়। ধীরে ধীরে বারুদের স্তর পুঁতিতে হয়; তারপর একদিন এক কণা অগ্নি—আর সমস্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে!

তিনি কাণ্ডারী; ভয় কি? তোমরা অনন্তশক্তিমান্—সামান্য ঈর্ষাবুদ্ধি ও অহংপূর্ণবুদ্ধি দমন করিতে তোমাদের ক-দিন লাগে? যখনই ঐ বুদ্ধি আসিবে, প্রভুর কাছে শরণ লও। শরীর মন তাঁর কাছে সঁপে দাও দেখি, হাঙ্গাম মিটে যাবে একদম।

যে বাড়ীতে তোমরা আপাততঃ আছ, তাহাতে স্থান পূর্ণ হইবে না, দেখিতে পাইতেছি। একটা প্রশস্ত বাটীর দরকার, অর্থাৎ সকলে গুঁতোগুঁতি করে একঘরে শোবার আবশ্যক নাই। পারতপক্ষে একঘরে দুই জনের অধিক থাকা উচিত নহে। একটা বড় হল, সেখানে পুঁথি-পাটা রাখিবে।

প্রত্যহ প্রাতঃকালে ও সন্ধ্যাকালে কালী, হরি, তুলসী, শশী প্রভৃতি অদল-বদল করে, যেন কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ শাস্ত্রপাঠ করে, ও পরে সন্ধ্যাকালে আর একবার পাঠ ও ধ্যান-ধারণা একটু ও সঙ্কীর্তনাদি হয়। একদিন যোগ, একদিন ভক্তি, একদিন জ্ঞান ইত্যাদি বিভাগ করিয়া লইলেই হইবে। এইমত একটা routine (পাঠের ক্রম) করিয়া লইলেই বড়ই মঙ্গলের বিষয়—সন্ধ্যাকালের পাঠাদির সময় সাধারণ লোকেরা যাহাতে আসিতে পারে; এবং প্রতি রবিবার দশটা হইতে নাগাত রাত্র ক্রমান্বয়ে পাঠ-কীর্তনাদি হওয়া উচিত, সেটা public-এর (সাধারণের) জন্য। এই নিয়মাদি করে কিছুদিন কষ্ট করে চালিয়ে দিলেই পরে আপনা হতে গড় গড় করে চলে যাবে। উক্ত হলে যেন তামাক খাওয়া না হয়। তামাক খাবার একটা যেন আলাহিদা জায়গা থাকে। এই ভাবটা তুমি যদি পরিশ্রম করে ধীরে ধীরে আনতে পার, তা হলে বুঝতাম অনেক কাজ এগলো। কিমধিকমিতি

নরেন্দ্র

পুনঃ—হরমোহন নাকি একটা কাগজ বার করবার যোগাড় করছিল, তার কি হল? কালী, শরৎ, হরি, মাষ্টার, G. C. Ghose (গিরিশবাবু) যোগাড় করে একটা যদি পার তো ভালই বটে।
—ন
…………………………….

২৪৮
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
১৮৯৫

অভিন্নহৃদয়েষু,
এইমাত্র তোমার পত্রে সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। ভারতবর্ষে কার্য হোক না হোক, কার্য এদেশে। কাহারও এক্ষণে আসিবার দরকার নাই। আমি দেশে গিয়ে কয়েকজনকে তৈয়ার করে তুলব, তারপর পাশ্চাত্য দেশে কোন ভয় থাকিবে না। গুণনিধির কথাই লিখিয়াছিলাম। হরি সিং প্রভৃতি সকলকে বিশেষ প্রেম আশীর্বাদ দিবে। ঝগড়াঝাঁটির মধ্যে থাকিবে না। কার সাধ্য খেতড়ির রাজাকে দাবায়? মা জগদম্বা তার শিয়রে। কালীরও চিঠি পেয়েছি—কাশ্মীরে যদি centre (কেন্দ্র) করতে পার তো বড়ই ভাল হয়। যেখানে পার একটা সেণ্টার কর। এখন এদেশে আর বিলেতে আমার গোড়া বেঁধে গেছে; কারু সাধ্যি কি তা টলায়? নিউ ইয়র্ক এবার তোলপাড়! আসছে গরমিতে লণ্ডন তোলপাড়! বড় বড় হাতী দিগ‍্‍গজ ভেসে যাবে। পুঁটি-পাঁটার কি খবর রে দাদা? তোরা কোমর বেঁধে লেগে যা দেখি, হুহুঙ্কারে দুনিয়া তোলপাড় করে দেব। এই তো সবে সন্ধ্যা রে ভাই!

দেশে কি মানুষ আছে? ও শ্মশানপুরী। যদি lower classদের education (নিম্নশ্রেণীদের শিক্ষা) দিতে পার, তা হলে উপায় হতে পারে। জ্ঞানবলের চেয়ে বল আর কি আছে—বিদ্যা শেখাতে পার? বড়-মানুষেরা কোন্ কালে কোন্ দেশে কার কি উপকার করেছে? সকল দেশেই বড় বড় কাজ গরীবরা করে। টাকা আসতে কতক্ষণ? মানুষ কই? দেশে কি মানুষ আছে? দেশের লোকগুলো বালক, ওদের সঙ্গে বালকের ন্যায় ব্যবহার করতে হবে। ওদের বুদ্ধিশুদ্ধি দশ বছরের মেয়ে বে করে করে খরচ হয়ে গেছে।

কারুর সঙ্গে ঝগড়া না করে মিলেমিশে চলে যাও—এ দুনিয়া বড়ই ভয়ানক, কাউকেই বিশ্বাস নাই। ভয় নাই, মা আমার সহায়—এমন কাজ এবার হবে যে, তোরা অবাক হয়ে যাবি।

ভয় কি? কার ভয়? ছাতি বজ্র করে লেগে যাও। কিমধিকমিতি

বিবেকানন্দ

পুনঃ—সারদা কি বাঙলা কাগজ বার করবে বলছে? সেটার বিশেষ সাহায্য করবে, সে মতলবটা মন্দ নয়। কারুর উৎসাহ ভঙ্গ করতে নাই। Criticism (বিরুদ্ধ সমালোচনা) একেবারে ত্যাগ করবে। যতদূর ভাল বোধ হয়, সকলকে সাহায্য করবে; যেখানটা ভাল না বোধ হয়, ধীরে বুঝিয়ে দিবে। পরস্পরকে criticise (বিরুদ্ধভাবে সমালোচনা) করাই সকল সর্বনাশের মূল! দল ভাঙবার ঐটি মূলমন্ত্র। ‘ও কি জানে?’ ‘সে কি জানে?’ ‘তুই আবার কি করবি?’—আর তার সঙ্গে ঐ একটু মুচকে হাসি, ঐগুলো হচ্ছে ঝগড়া-বিবাদের মূলসূত্র।
…………………………….

২৪৯
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
১৮৯৫

কল্যাণবরেষু,
তোমার এক পত্র কাল পাই, তাহাতে কতকমত সমাচার পাই। সবিশেষ কিছুই নাই, এই মাত্র। আমার শরীর এক্ষণে অনেক ভাল। এ বৎসর প্রচণ্ড শীত প্রভুর কৃপায় কিছুই লাগে না; কি দোর্দণ্ড শীত! তবে এদের বিদ্যের জোরে সব দাবিয়ে রাখে। প্রত্যেক বাটীর নীচের তলা মাটির ভেতর, তার মধ্যে বৃহৎ বয়লার—সেখানে হতে গরম হাওয়া বা ষ্টীম ঘরে ঘরে রাতদিন ছুটছে। তাইতে সব ঘর গরম, কিন্তু ইহার এক দোষ যে, ঘরের ভেতর গরমি কাল আর বাইরে জিরোর (শূন্যের) নীচে ৩০|৪০ ডিগ্রী! এদেশের বড় মানুষেরা অনেকেই শীতকালে ইওরোপ পালায়—ইওরোপ অপেক্ষাকৃত গরম দেশ।

যাক, এক্ষণে তোমাকে গোটা-দুই উপদেশ দিই। এই চিঠি তোমার জন্য লেখা হচ্ছে। তুমি এই উপদেশগুলি রোজ একবার করে পড়বে এবং সেই রকম কাজ করবে। সারদার চিঠি পাইয়াছি—সে উত্তম কার্য করিতেছে—কিন্তু এক্ষণে organization (সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া কার্য করা) চাই। তাহাকে আমার বিশেষ প্রেমালিঙ্গন, আশীর্বাদ—তারকদাদা প্রভৃতি সকলকে দিবে। তোমাকে আমার এই ক-টি উপদেশ দিবার কারণ এই যে, তোমাতে organization power (সঙ্ঘগঠন ও পরিচালন-শক্তি) আছে—এ-কথা ঠাকুর আমায় বললেন, কিন্তু এখনও ফোটে নাই। শীঘ্রই তাঁর আশীর্বাদে ফুটবে। তুমি যে কিছুতেই centre of gravity (ভারকেন্দ্র) ছাড়িতে চাও না, ইহাই তাহার নিদর্শন, তবে intensive and extensive (গভীর ও উদার) দুই হওয়া চাই।

১| এ জগতে যে ত্রিবিধ দুঃখ আছে, সর্বশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত এই যে, তাহা নৈসর্গিক (natural) নহে, অতএব অপনেয়।
২| বুদ্ধাবতারে প্রভু বলিতেছেন যে, এই আধিভৌতিক দুঃখের কারণ ‘জাতি’, অর্থাৎ জন্মগত বা গুণগত বা ধনগত সর্বপ্রকার জাতিই এই দুঃখের কারণ। আত্মাতে স্ত্রী-পুং-বর্ণাশ্রমাদি ভাব নাই এবং যে-প্রকার পঙ্ক দ্বারা পঙ্ক ধৌত হয় না, সে-প্রকার ভেদবুদ্ধি দ্বারা অভেদ সাধন হওয়া সম্ভব নহে।
৩| কৃষ্ণাবতারে বলিতেছেন যে, সর্বপ্রকার দুঃখের কারণ ‘অবিদ্যা’। নিষ্কাম কর্ম দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়; কিন্তু ‘কিং কর্ম কিমকর্মেতি’ ইত্যাদি (কোন‍্‍টি কর্ম, কোন‍্‍টি অকর্ম—এই বিষয়ে জ্ঞানীরাও মোহিত হন)।
৪| যে কর্মের দ্বারা এই আত্মভাবের বিকাশ হয়, তাহাই কর্ম। যদ্দ্বারা অনাত্মভাবের বিকাশ, তাহাই অকর্ম।
৫| অতএব ব্যক্তিগত, দেশগত ও কালগত কর্মাকর্মের সাধন।
৬| যজ্ঞাদি প্রাচীন কালে উপযুক্ত ছিল, তথা জাত্যাদি কর্ম; আধুনিক সময়ের জন্য তাহা নহে।
৭| রামকৃষ্ণাবতারের জন্মদিন হইতেই সত্যযুগোৎপত্তি হইয়াছে।
৮| রামকৃষ্ণাবতারে জ্ঞানরূপ অসি দ্বারা নাস্তিকতারূপ ম্লেচ্ছনিবহ ধ্বংস হইবে এবং ভক্তি ও প্রেমের দ্বারা সমস্ত জগৎ একীভূত হইবে। অপিচ এ অবতারের রজোগুণ অর্থাৎ নামযশাদির আকাঙ্ক্ষা একেবারেই নাই, অর্থাৎ যে তাঁহার উপদেশ গ্রহণ করে, সেই ধন্য; তাঁহাকে মানে বা নাই মানে, ক্ষতি নাই।
৯| প্রাচীন কালে বা আধুনিক কালে সাম্প্রদায়িকেরা ভুল করে নাই। They have done well, but they must do better (তাহারা ভালই করিয়াছে, তবে তাহাদিগকে আরও ভাল করিতে হইবে)। কল্যাণ—তর—তম।
১০| অতএব সকলকে—যেখানে তাহারা আছে, সেইখানেই গ্রহণ করিতে হইবে, অর্থাৎ কাহারও ভাবে ব্যাঘাত না করিয়া উচ্চতর ভাবে লইয়া যাইতে হইবে। তথা সামাজিক অবস্থামধ্যে যাহা আছে, তাহা উত্তম, কিন্তু উৎকৃষ্ট-তর-তম করিতে হইবে।
১১| জগতের কল্যাণ স্ত্রীজাতির অভ্যুদয় না হইলে সম্ভাবনা নাই, এক পক্ষে পক্ষীর উত্থান সম্ভব নহে।
১২| সেইজন্যই রামকৃষ্ণাবতারে ‘স্ত্রীগুরু’-গ্রহণ, সেইজন্যই নারীভাবসাধন, সেইজন্যই মাতৃভাব-প্রচার।
১৩| সেইজন্যই আমার স্ত্রী-মঠ স্থাপনের জন্য প্রথম উদ্যোগ। উক্ত মঠ গার্গী, মৈত্রেয়ী এবং তদপেক্ষা আরও উচ্চতরভাবাপন্না নারীকুলের আকরস্বরূপ হইবে।
১৪| চালাকি দ্বারা কোন মহৎ কার্য হয় না। প্রেম, সত্যানুরাগ ও মহাবীর্যের সহায়তায় সকল কার্য সম্পন্ন হয়। তৎ কুরু পৌরুষম্ (সুতরাং পৌরুষ প্রকাশ কর)।
১৫| কাহারও সহিত বিবাদ-বিতর্কে আবশ্যক নাই। তোমার যাহা শিখাইবার আছে শিখাও—অন্যের খবরে আবশ্যক নাই। Give your message, leave others to their own thoughts (তোমার যাহা শিখাইবার আছে শিখাও, অপরে নিজ নিজ ভাব লইয়া থাকুক)। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতং’—তদা কিং বিবাদেন? (সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার জয় কখনও হয় না; তবে বিবাদের প্রয়োজন কি?)

এক্ষণে তোমাকে কিঞ্চিৎ বিষয়কার্য শিখাই। প্রথমতঃ যখন আমাকে বা অন্য কাহাকেও পত্র লিখিবে, তখন পূর্বপত্র পাঠ করিয়া সকল প্রশ্নের উত্তর দিবে। বাজে খবর দিবে না। গম্ভীর ভাব রাখিতে হইবে। বাল্যগাম্ভীর্যভাব মিশ্রিত করিবে। সকলের সহিত মিশিয়া চলিবে। অহংভাব দূর করিবে, সম্প্রদায়-বুদ্ধিবিহীন হইবে, বৃথা তর্ক মহাপাপ।

ম্যাক্সমূলার তোমাদের এক পুস্তক পাঠাইয়াছেন। তাঁহাকে বিনয়পূর্ণ উত্তর দিয়াছ কিনা, এ-কথা লেখ নাই। আমি কাহাকে টাকা পাঠাইব, তাহা লেখ নাই। কেমন করিয়া পাঠাইব? … প্রায় দেড় মাসে একখানা পত্র আসে, একটা ভুল শোধরাইতে তিন মাস লাগে। এই কথা সদা মনে রাখিবে। সারদার পত্রে অবগত হইলাম N. Ghose (ঘোষ) আমাকে যীশুখ্রীষ্টাদির সহিত তুলনা করিয়াছেন। ও-সকল আমাদের দেশে ভাল বটে; কিন্তু এদেশে ছাপাইয়া পাঠাইলে আমার অবমানের সম্ভাবনা। আমি কাহারও ভাবে ব্যাঘাত করি না, আমি কি মিশনরী? যদি কালী ঐ-সকল কাগজ এতদ্দেশে না পাঠাইয়া থাকে, তাহা হইলে পাঠাইতে নিষেধ করিবে। কেবল Address (অভিনন্দন) পাঠাইলেই যথেষ্ট, proceedings-এ (কার্য বিবরণীতে) কোন আবশ্যক নাই। এক্ষণে এতদ্দেশের অনেক মান্যগণ্য নরনারী আমায় শ্রদ্ধা করেন। মিশনরী প্রভৃতিরা বহু চেষ্টা করিয়া এক্ষণে হার মানিয়া শান্তি অবলম্বন করিয়াছে। সকল কার্যই নানা বিঘ্নের মধ্যে সমাধান হয়। শান্তভাব অবলম্বন করিলেই সত্যের জয় হয়। হাড‍্‍সন (Hudson) নামক কে কি বকিয়াছে, তাহাকে আমার জবাব দিবার কোন আবশ্যক নাই। প্রথমতঃ অনাবশ্যক, দ্বিতীয়তঃ তাহা হইলে আমি হাড‍্‍সন প্রভৃতি ফেরুপুঞ্জের সমদেশবর্তী হইব। তুমি উন্মাদ নাকি? আমি এখান হইতে কে এক হাড‍্‍সনের সহিত লড়াই করিব? প্রভুর কৃপায় হাড‍্‍সন বাড‍্‍সনের গুরুর গুরুরা আমার কথা ভক্তিভাবে গ্রহণ করে। তুমি কি পাগল নাকি? খবরের কাগজ প্রভৃতি আর পাঠাইও না। ও-সকল দেশে চলুক, হানি নাই। ও-সকল কাগজে নামের প্রয়োজন ছিল, প্রভুর কার্যের জন্য। যখন তাহা সমাহিত হইয়াছে, তখন আর আবশ্যক নাই। আমার প্রত্যেক পত্রাদি গোপন করিবে, ঝট করিয়া কাগজে ছাপাইবে না। নামযশের ঐ দায়—কিছু গোপন রাখা যায় না। আমার চিঠি পূর্বের ভাবের মত হাটের মাঝে পড়িবে না। কথা কানে হাঁটে, মনে রাখিবে। মা-ঠাকুরাণীর জন্য পত্রপাঠ জায়গা অনুসন্ধান করিবে।

ঠাকুরের কাছে সকল কার্যের প্রারম্ভে প্রার্থনা করিবে। তিনি সৎ পন্থা দেখাইবেন। একটা বড় জমি প্রথমে চাই; তার পর বাড়ী ঘর সব হবে। আমাদের মঠ ধীরে ধীরে হবে, ভাবনা নাই। যখন আমাকে চিঠি লিখিবে, বিশেষ চিন্তা করে আবশ্যক সমাচার বিস্তারিতভাবে দিবে—অনাবশ্যক অর্থাৎ ঝগড়াঝাঁটি আমার শুনিবার সময় নাই।

কালী প্রভৃতি সকলেই উত্তম কার্য করিতেছে। সকলকেই আমার প্রেমালিঙ্গন দিও। মান্দ্রাজীদের সহিত মিলে মিশে কাজ করিবে এবং মধ্যে মধ্যে একজন তথায় যাইও। নামযশ কর্তৃত্বের বাসনা জন্মের মত ত্যাগ করিবে। আমি যতদিন পৃথিবীতে আছি, তিনি আমার মধ্যে কার্য করিতেছেন—ইহাতে তোমাদের যতদিন বিশ্বাস থাকিবে, ততদিন কোন অমঙ্গলের সম্ভাবনা নাই।

শাঁকচুন্নী যে ঠাকুরের পুঁথি পাঠাইয়াছে, তাহা পরম সুন্দর। কিন্তু প্রথমে শক্তির বর্ণনা নাই, এই মহাদোষ। দ্বিতীয় edition (সংস্করণ)-এ শুদ্ধ করিতে বলিবে। এই কথা মনে সদা রাখিবে যে, আমরা এক্ষণে জগতের সমক্ষে দণ্ডায়মান। আমাদের প্রত্যেক কার্য, প্রত্যেক কথা লোকে দেখিতেছে, শুনিতেছে—এই ভাব মনে রাখিয়া সকল কার্য করিবে।

যদি তুমি—কাহাকে টাকা পাঠাইব অর্থাৎ—কাহার নামে লিখিতে, তাহা হইলে আজই আমি টাকা পাঠাইতাম। টাকা পাইবামাত্রই জমি খরিদ করিবে। আপাততঃ আমার নামে খরিদ করিবে। পরে আমাদের মঠের জন্য একটা জমি দেখিতে থাক। কাছাকাছি হওয়া চাই, অর্থাৎ দুইটা জমি যাহাতে অতি নিকটে হয়, এমত চেষ্টা করিবে। কলিকাতা হইতে কিছু দূরে হয়, চিন্তা নাই; যেখানে আমরা মঠ বসাইব, সেথাই ধুম মাচিবে।

মহিম চক্রবর্তীর কথায় আমি পরম আনন্দিত হইলাম—এণ্ডিস্ পর্বতে এক্ষণে গয়াক্ষেত্র বনিয়া গেল যে! সে কোথায়? তাহাকে, বিজয় গোস্বামীকে ও আমাদের বন্ধুবর্গকে আমার বিশেষ প্রণয়-সম্ভাষণ দিবে। … পরকে মারিতে গেলে ঢাল খাঁড়া চাই, অতএব ইংরেজী ও সংস্কৃত বিশেষরূপে অধ্যয়ন করিবে। কালীর ইংরেজী দিন দিন বেশ পরিষ্কার হইতেছে। সারদার ইংরেজীর অধোগতি হইতেছে; তাহাকে flowery style (ফেনান ভাষা) পরিত্যাগ করিতে হইবে। বিজাতীয় ভাষায় flowery style লেখা বড়ই দুষ্কর। তাহাকে আমার লক্ষ ‘সাবাস্’—ওহি মরদ‍্‍কা কাম; তারকদাদাকেও grammar (ব্যাকরণ)-টা একবার উল্টে নিতে বলবে। তারকদাদার ইংরেজী ক্রমশঃ দুরস্ত হয়ে আসছে। সকলেই well done, ‘সাবাস্, বাহাদুরোঁ’। আরম্ভ অতি সুন্দর হয়েছে। ঐ ডৌলে চল। ঈর্ষা-সর্পিণী যদি না আসে তো কোন ভয় নাই, মাভৈঃ। ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’। সকলে একটু গম্ভীরভাব ধারণ করিবে।

আমি হিন্দুধর্মের উপর কোন পুস্তক এক্ষণে লিখিতেছি না। তবে আমার মনের ভাব লিপিবদ্ধ করিতেছি। Every religion is an expression, a language to express the same truth, and we must speak to each in his own language.৮৮ —সারদা এ কথা বুঝিয়াছে বেশ। হিন্দুধর্ম পরে দেখা যাইবে। হিন্দুধর্ম বললে কি এদেশের লোক আসে? সঙ্কীর্ণ বুদ্ধির নামে সকলে পালায়। আসল কথা, তাঁর ধর্ম; হিন্দুরা বলুক হিন্দুধর্ম—তদ্বৎ সর্বে (সেইরূপ সকলে)। তবে ধীরে ধীরে—শনৈঃ পন্থাঃ। নবাগন্তুক দীননাথকে আমার আশীর্বাদ দিও। লিখিবার সময় বড়ই অল্প, সর্বদাই লেকচার, লেকচার, লেকচার। Purity-patience-perseverance (পবিত্রতা, ধৈর্য, অধ্যবসায়)! মহেন্দ্র মাষ্টার প্রভৃতি সকলকে আমার প্রেমালিঙ্গন দিও। মা-ঠাকুরাণীকে আমার কোটি সাষ্টাঙ্গ। গোলাপ-মা, যোগীন-মা প্রভৃতি সকলকে আমার নমস্কার। অনেকে যে তাঁর কথা এক্ষণে শুনছে, তাদের কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ অর্থসাহায্য করিতে বলিবে; কিছু কিছু ‘পেলা’ না নিলে মঠ চলবে কি প্রকারে? এ-কথা সকলকে খুলে বলতে হবে বৈকি!

বিদেশ হতে যদি কেউ কিছু আমার নামে পাঠায়, তাদের চিঠির জবাব দিবে। ওটা একটা সাধারণ ভদ্রতা। ভবনাথ, কালীকৃষ্ণবাবু প্রভৃতিকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবে। সাণ্ডেল অর্থাভাব লিখছেন, তথাহি তারকদাদা। বলি এতগুলো লোক তাঁকে মানে, আর একটা মঠ চলে না? তোমাদের কারুর কারুর মধ্যে একটা গুজোগুজি ভাব এখনও আছে; সেটা যেদিন একেবারে অপসৃত হবে, সেদিন হতেই সকলবিধ কল্যাণ হবে।

এদেশ হতে শীঘ্র দেশে যাওয়ায় কোন লাভ নাই। বলি, প্রথমতঃ এদেশে একটু বাজলে, দেশে মহাধ্বনি হয়; তারপর এদেশের লোকেরা মহাধনী ও ছাতিওয়ালা! দেশের লোকের পয়সাও নাই এবং ছাতি একেবারেই নাই!

ক্রমশঃ প্রকাশ্য। তিনি কি শুধু ভারতের ঠাকুর? ঐ সঙ্কীর্ণ ভাবের দ্বারাই ভারতের অধঃপতন হয়েছে। তার বিনাশ না হলে কল্যাণ অসম্ভব। আমার যদি টাকা থাকিত, তোমাদের প্রত্যেককেই পৃথিবী-পর্যটনে পাঠাতাম। কোণ থেকে না বেরুলে কোন বড় ভাব আসে না। ক্রমে দেখা যাবে। প্রভুর ইচ্ছা। সকল বড় কাজ ধীরে ধীরে হয়। দুটো জমির কথা ভুলবে না এবং তোমাদের মধ্যে কে এ কার্যের ভার লইবে, তাহা লিখিবে; অপিচ গিরিশ ঘোষ ও অতুলের সহিত পরামর্শ করিবে। জমি আমার নামে খরিদ করিবে, অর্থাৎ মোট কথা এই—‘অর্থমনর্থম্’; যার হাতে থাকিলে কারুর মনে ঈর্ষা হবে না, তারই হাতে থাকা ভাল। সাণ্ডেলকে—লাটুকে গরম কাপড় (তার মনের মত) কিনে দিতে বলেছি, এবং গোপালদাদাকে টাকা পাঠাতে বলেছি এবং হুটকোকে টাকা দিতে বলেছি—তার ঋণ-পরিশোধের জন্য।

দক্ষ ও হরিশের কথা কেউ লেখ নাই কেন? তাদের তোমরা খবর নাও কিনা? সাণ্ডেল দুঃখ পাচ্ছে, তার কারণ তার মন এখনও গঙ্গাজলের মতন হয় নাই, নিষ্কাম এখনও হয় নাই, ক্রমে হবে। যদি বাঁকটুকু একদম সিধে করে তো আর কোন দুঃখ থাকিবে না। রাখালকে, হরিকে আমার বিশেষ আলিঙ্গন প্রণাম জানাইবে। তাদের বিশেষ যত্ন করিবে। তোমরা রাখালকে দিন-দুই জবরদস্ত ব্রত করিয়ে দিয়েছ নাকি? কাজটা ভাল কর নাই। যাক, চর্বি মারা যাবে। রাখাল ঠাকুরের ভালবাসার জিনিষ—এ কথা ভুলো না।

কিছুতেই ভয় খেও না। যতদিন তিনি আমার মাথায় হাত রাখছেন, ততদিন কি কারুর দাবাবার যো আছে? ভবেয়ুঃ কণ্ঠাগতাঃ প্রাণাঃ (প্রাণ কণ্ঠাগত হউক), তথাপি ডর পাবে না। সিংহ-বিক্রমের সহিত অথচ ‘কুসুমমিব’ (ফুলের মত) কোমলতার সহিত কার্য করিবে। এবারকার মহোৎসবে খুব ধুম মাতাইবে। খাওয়া দাওয়া অতি সাধারণ—মহাপ্রসাদ, সরাভোগ, দাঁড়াপ্রসাদ ইতি। পরমহংসদেবের জীবনচরিত-পাঠ। বেদ বেদান্ত পুঁথি একত্র করে আরতি করবে, এবং কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ পেলা আদায় করিবে। পুরানো ডৌলে নিমন্ত্রণ ত্যাগ করিবে। ‘আমন্ত্রয়ে ভবন্তং সাশীর্বাদং ভগবতো রামকৃষ্ণস্য বহুমানপুরঃসরঞ্চ’ ইত্যাকার একটা লাইন লিখে তারপর লিখবে যে, ঠাকুরের জন্মতিথি-মহোৎসব এবং মঠ চালাইবার খরচের জন্য আপনার সহায়তা প্রয়োজন। যদি আপনার অভিমত হয় তো অমুক স্থানে অমুকের নিকট টাকা পাঠাইবেন—ইত্যাদি। যদি মনে কর যে, আমার নামে সই করলে লোকে টাকা দেবে তো সই করে দিও অর্থাৎ ছাপিয়ে দিও। যদি না হয়, তো যেমন ordinarily (সাধারণতঃ) ‘রামকৃষ্ণসেবকাঃ সন্ন্যাসিনঃ’ অথবা ঐ প্রকার কোন রকম। আর এক পাতা ইংরেজীতে লিখিবে। ‘লর্ড (প্রভু) রামকৃষ্ণ’ শব্দের কোন অর্থ নাই; উক্ত নাম ত্যাগ করিবে, ইংরেজী অক্ষরে ‘ভগবান্’ লিখিবে। তারপর এক আধ লাইন ইংরেজী লিখিয়া দিবে।

The Anniversary of Bhagaban Sri Ramakrishna

Sir,
We have great pleasure in inviting you to join us in celebrating the —th anniversary of Bhagaban Sri Ramakrishna Paramahamsa. For the celebrating of this great occasion and for the maintenance of the Alambazer Math, funds are absolutely necessary. If you think that the cause is worthy of your sympathy, we shall be very grateful to receive your contribution to the great work.

Yours obediently
(Name)৮৯

(Place)
(Date)

যদি যথেষ্ট অর্থসংগ্রহ হয়, কিয়দংশ খরচ করে বাকী একটা ফাণ্ড করে রাখবে এবং তোমাদের খরচ তা হতে চালাবে।

ভোগের নাম করে সকলকে পিত্তি পড়িয়ে বাসি কড়কড়ে ভাত খাওয়াবে না। দুটো ফিল্টার তৈয়ার করবে। সেই জলে রান্না ও খাওয়া দুই-ই। ফিল্টার করবার পূর্বে জল ফুটিয়ে নেবে, তা হলে ম্যালেরিয়ার বাপ পলায়ন। সকলের স্বাস্থ্যের উপর প্রথম দৃষ্টি রাখিবে। মাটিতে শোওয়া ত্যাগ করিবে, পার যদি—অর্থাৎ যদি পয়সা জোটে তো বড়ই ভাল। ময়লা কাপড় ব্যারামের প্রধান কারণ। ঐ সকল টাকার কাজ। সারদা তার বন্ধুদের পত্র লিখুক, ঐ প্রকার সকলে চেষ্টা কর। আমি এখানে চেষ্টা করছি বৈকি! কিন্তু খালি আমার উপর কোন কাজে নির্ভর করিবে না। ভোগের বিষয় তোমাকে লিখি—কেবলমাত্র কিঞ্চিৎ পায়সান্ন চড়াইবে; তিনি তাহাই ভালবাসিতেন। ঠাকুরঘর অনেকের সহায়তা করে বটে, কিন্তু রাজসিক তামসিক খাওয়া-দাওয়ার কোন কাজ নাই। আঙুল-বাঁকান এবং ঘণ্টার বিকট আওয়াজ কিঞ্চিৎ কমি করে কিঞ্চিৎ গীতা-উপনিষদাদি পাঠ করিবে। অর্থাৎ Materialism (জড়োপাসনা) যত কম হয় এবং Spirituality (আধ্যাত্মিকতা) যতই বাড়ে, এই কথা আর কি। সাণ্ডেল লিখছেন যে, হাজার হাজার লোক খালি ঘণ্টানাড়া দেখতে আসে। যদি এ কথা সত্য হয় তো ও-প্রকার লোক না আসাই ভাল। ওরা মেঠাই খেতে আসে; এদিকে মঠের লোক না খেতে পেয়ে মারা যায়, তখন হাজার হাজার লোক কোথায়? আর আমরা কি সর্বত্যাগ করে সাণ্ডেলের জন্য ঘণ্টা বাজাতে এসেছি? সাণ্ডেল কাঁসারীপাড়ায় বাস করুক গে, যদি ঘণ্টানাড়া তার এতই ভাল লাগে। অর্থাৎ তিনি তাঁর ছেলেদের মুখে খাচ্ছেন—তোমার ঘণ্টানাড়ার মধ্যে নয়। তাদের একচুল কষ্ট দিয়ে তোমার ঘণ্টানাড়া সমস্তই বিফল হয়, অপিচ অমঙ্গল হয় তোমার নিজের। এ কথাটা রোজ একবার মনে রেখো। তিনি তোমার একলার জন্য বা সাণ্ডেলের জন্য এসেছিলেন, কি জগতের জন্য? যদি জগতের জন্য, তা হলে জগৎসুদ্ধ লোক যাতে তাঁকে বুঝতে পারে, এই ভাবে তাঁকে present করতে (লোকের কাছে ধরতে) হবে। সেইজন্য সুরেশ দত্তের পুঁথিতে যে আবোল-তাবোলগুলো আছে, সেগুলো দূর করে দিতে হবে—বুঝতে পেরেছ কি? ওগুলো ‘—’বাবুর বুদ্ধিতে বোধ হয় সুরেশ দত্ত লিখেছে—হরিবোল হরি! যাক্, তার উদ্দেশ্য ভাল, কেবল সেই ছোট বুদ্ধি। দক্ষিণেশ্বরের ভট‍্‍চায্যির জীবনচরিত—মাষ্টার মহাশয় জানে, সুরেশ বাবু লেখে, ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’ তারা এখনও দেখতে পায় নাই। দুনিয়া তাদের দক্ষিণেশ্বরের কুটুরি। হে প্রভু, হে প্রভু! তবে you must not identify yourself with any life of Him written by anybody, nor give your sanction to any.৯০ যতক্ষণ আমাদের নামের সঙ্গে না যায়, ততক্ষণ কোন ভয় নেই। এ সকল কথা তোমরা কাউকে বলো না—অর্থাৎ সুরেশ দত্তের উদ্দেশ্য ভাল, বইও বেশ লিখেছে—চলুক, কিছু কাজ হবে। তবে তারা তাঁকে কি ঘোড়ার ডিম বুঝেছে? সাণ্ডেল আমাকে তিন পাতা লেকচার দিয়েছে যে, মা-ঠাকুরাণীকে ভক্তি করতে হবে এবং তিনি আমায় কত দয়া করেন। সাণ্ডেলের এই মহা আবিষ্ক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ! তাঁর [বিষয়ে] একটা কিছু লিখব মনে করি; কিন্তু ভয়ে পেছিয়ে যাই। যাক্, তাঁর ইচ্ছা হয় তো কালে কালে হবে। মহেন্দ্রবাবু মঠ একপ্রকার চালাচ্ছেন; তাঁকে শত শত ধন্যবাদ; তিনি অতি মহৎ। সাণ্ডেলকে বলবে, যদি প্রভুর ইচ্ছা হয়, তার সাড়ে পাঁচ সিকের চাকরি আর তিন কড়ার বুদ্ধি শীঘ্রই ঘুচবে। তবে তার কর্ম বাজার-হাট ইত্যাদি করা; সেই কর্ম মন দিয়ে করলে—অর্থাৎ তাঁর ছেলেপুলের সেবা করলেই তার পরম কল্যাণ হবে। লেকচার-ফেকচার সে এ জন্মের মত সিকেয় তুলে রাখুক, আসছে বারে দেখা যাবে। তাকে নিজের বুদ্ধি খরচ করতে বারণ করো। যেমনটি বলি দাগা বুলিয়ে যাক্, নইলে উল্টো উৎপত্তি করে বসবে। ‘হাঁ জী হাঁ জী করতে রহিও বৈঠি আপনা ঠাম্।’

যোগেন কেমন আছে? হুটকো কি চাকরি করতে যাচ্ছে—কি করছে? হুটকোকে একটু লেখাপড়া শেখাবে—এখনও বয়স আছে। সব খবর খুলে লিখতে হয়—এ-কথা খুব মনে রেখো। গুপ্ত পড়ছে শুনছে কেমন? তুলসী, লেটোকে ঘুমুতে দিও, যা খেতে চায় দিও, তাড়া দিও না বিলকুল। বাবুরাম কি করছে; হরি, রাখাল কেমন আছে ইত্যাদি বিলকুল লিখবে। সকল কথা খোলসা করে শুনবে—আবোল-তাবোল কে কি বললে হরমোহনী ডৌলে লেখবার দরকার নাই। হরমোহনের সাংসারিক অবস্থা কেমন? তারকদাদা খুব কাজ করছে; বাঃ! বাঃ! সাবাস! ঐ-রকম চাই। এক-একটা নক্ষত্রের মত ছুটে পড় দিকি! গঙ্গা কি করছে? রাজপুতানায় কতকগুলো জমিদার তাকে মানে; তাদের কাছ থেকে ভিক্ষে করে মঠের জন্য টাকা পাঠাতে বলো …।

শাঁকচুন্নীর বই এইমাত্র পড়লাম। তাকে আমার লক্ষ-লক্ষাধিক প্রেমালিঙ্গন দিবে। তার কণ্ঠে তিনি আবির্ভাব হচ্ছেন। ধন্য শাঁকচুন্নী! শাঁকচুন্নী ঐ পুঁথি সকলকে শোনাক। মহোৎসবে শাঁকচুন্নীর পুঁথি সকলের সামনে যেন পড়ে। পুঁথি অতি বড় যদি হয় তো চুম্বক চুম্বক করে যেন পড়ে। শাঁকচুন্নী একটাও আবোল-তাবোল তো লিখে নাই। আমি তার পুঁথি পড়ে যে কি আনন্দ পেয়েছি, তা আর কি বলব! শাঁকচুন্নীর পুঁথি যাতে খুব বিক্রী হয়, সকলে পড়ে (মিলে) চেষ্টা করবে। তারপর শাঁকচুন্নীকে গাঁয়ে গাঁয়ে প্রচার করতে যেতে বলো। বাহবা, সাবাস, শাঁকচুন্নী! সে তাঁর কাজ করছে। গাঁয়ে গাঁয়ে যাক, লোককে তাঁর কথা শোনাক—এর চেয়ে তার আর কি ভাগ্য হবে? … শশী, শাঁকচুন্নীর পুঁথি and শাঁকচুন্নী himself (নিজে) must electrify the masses (জনসাধারণের শক্তিসঞ্চার করবে)। আরে মোর শাঁকচুন্নী, তোকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করছি ভাই। প্রভু তোর কণ্ঠে বসুন, দ্বারে দ্বারে তাঁর নাম শুনাও। সন্ন্যাসী হবার আবশ্যক কিছুই নাই। শশী, mass (জনসাধারণ)-এর মধ্যে সন্ন্যাসী হওয়া উচিত নয়। শাঁকচুন্নী is the future apostle for the masses of Bengal (বাঙলার জনসাধারণের নিকট ভাবী বার্তাবহ)। শাঁকচুন্নীকে খুব যত্ন করবে! তার বিশ্বাস-ভক্তির ফল ফলেছে। শাঁকচুন্নীকে এই ক-টা কথা লিখতে বলো—তার তৃতীয় খণ্ডে, প্রচার খণ্ডেঃ

‘বেদবেদান্ত, আর আর সব অবতার যা কিছু করে গেছেন, তিনি একলা নিজের জীবনে তা করে দেখিয়ে গেছেন। তাঁর জীবন না বুঝলে বেদবেদান্ত অবতার প্রভৃতি বোঝা যায় না—কেন না, He was the explanation (তিনি ব্যাখ্যাস্বরূপ ছিলেন)। তিনি যেদিন থেকে জন্মেছেন, সেদিন থেকে সত্যযুগ এসেছে। এখন সব ভেদাভেদ উঠে গেল, আচণ্ডাল প্রেম পাবে। মেয়ে-পুরুষ-ভেদ, ধনী-নির্ধনের ভেদ, পণ্ডিত-বিদ্বান-ভেদ, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-ভেদ সব তিনি দূর করে দিয়ে গেলেন। আর তিনি বিবাদভঞ্জন—হিন্দু-মুসলমান-ভেদ, ক্রিশ্চান-হিন্দু ইত্যাদি সব চলে গেল। ঐ যে ভেদাভেদে লড়াই ছিল, তা অন্য যুগের; এ সত্যযুগে তাঁর প্রেমের বন্যায় সব একাকার।’

এই ভাবগুলো তার ভাষায় বিস্তার করে লিখতে বলবে। যে তাঁর পূজা করবে, সে অতি নীচ হলেও মুহূর্তমধ্যে অতি মহান্ হবে—মেয়ে বা পুরুষ। আর এবারে মাতৃভাব—তিনি মেয়ে সেজে থাকতেন, তিনি যেন আমাদের মা—তেমনি সকল মেয়েকে মার ছায়া বলে দেখতে হবে। ভারতে দুই মহাপাপ—মেয়েদের পায়ে দলান, আর ‘জাতি জাতি’ করে গরীবগুলোকে পিষে ফেলা। He was the Saviour of women, Saviour of the masses, Saviour of all high and low.৯১আর শাঁকচুন্নী ঘরে ঘরে তাঁর পূজা করাক। ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, মেয়ে বা পুরুষ—তাঁর পূজায় সকলের অধিকার। যে ঘটস্থাপনা বা প্রতিমা করে তাঁর পূজা করবে—মন্ত্র হোক বা না হোক—যেমন করে যে-ভাষায় যার হাত দিয়ে হোক—খালি ভক্তি করে যে পূজা করবে, সেই ধন্য হয়ে যাবে।—এই ডৌলে লিখতে বলো। কুছ পরোয়া নাই; প্রভু তার সহায় হবেন। কিমধিকমিতি

নরেন্দ্র

পুঃ—ম্যাক্সমূলারকে—তিনি ভারতের পরম সহায়—এইভাবে পত্র লিখিবে। বোধ হয় লিখিয়াছ। … সে বই আমি অনেক দিন দেখেছি, তাতে আমার ভাবের আভাসও আছে।

যে অভিধানের বিজ্ঞাপন পাঠিয়ে দিয়েছিলে, তা দু-চার জন বন্ধুকে পাঠিয়েছি—কি ফল হবে, তা জানি না। তুমি একখানা নারদ-আর শাণ্ডিল্যসূত্র এবং একখানা ‘যোগবাশিষ্ঠ’—যা কলকেতায় তর্জমা হয়েছে—তা পাঠিয়ে দিতে সাণ্ডেলকে বলবে। ‘যোগবাশিষ্ঠে’র ইংরেজী তর্জমা, বাঙলা নয়। ইতি

শাঁকচুন্নী যেন আমার opinion (মত) in his book (তাঁর পুঁথিতে) না ছাপে। তাঁকে মুখে তুমি বলবে—অথবা পড়ে শুনাবে। যাকে তাকে আমার correspondence (চিঠিপত্র) পড়তে দিবে না। এ-সমস্ত private (ব্যক্তিগত)। কথা কানে হাঁটে। ইতি

নরেন্দ্র
…………………………….

২৫০*
আমেরিকা
১৮৯৫

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমাদের কোন সঙ্ঘ নেই—আমরা কোন সঙ্ঘ গড়তেও চাই না। স্ত্রী বা পুরুষ যে-কেহ যা কিছু শিক্ষা দিতে, যা কিছু প্রচার করতে চায়, সে-বিষয়ে তার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে।

যদি তোমার ভিতরে শক্তি থাকে, তবে তুমি কখনই অপর পাঁচজনকে আকর্ষণ করতে অসমর্থ হবে না। আমরা কখনই থিওসফিষ্টদের কার্যপ্রণালী অনুসরণ করতে পারি না—তার সোজা কারণ এই যে, তারা একটি সঙ্ঘবদ্ধ সম্প্রদায়, আর আমরা তা নই।

আমার মূলমন্ত্র হচ্ছে—ব্যক্তিত্বের বিকাশ। এক-একটি ব্যক্তিকে শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা ছাড়া আমার অন্য কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আমি অতি অল্পই জানি—সেই অল্পস্বল্প যা জানি, তার কিছু চেপে না রেখেই শিক্ষা দিয়ে যাই। যে বিষয়টা জানি না, স্পষ্টই স্বীকার করি যে, সেটা আমার জানা নেই। আর থিওসফিষ্ট, খ্রীষ্টান, মুসলমান বা জগতের অপর যার কাছ থেকেই হোক, লোক কিছু সাহায্য পাচ্ছে জানলে আমার এত আনন্দ হয়, তা কি বলব। আমি তো সন্ন্যাসী—সুতরাং এ জগতে আমি কারও গুরু বা প্রভু নই, আমি নিজেকে সকলের দাস মনে করি। … যদি লোকে আমায় ভালবাসে বাসুক, তাদের খুশী; ঘৃণা করে করুক—তাদের খুশী।

প্রত্যেককেই নিজের উদ্ধারসাধন নিজেকে করতে হবে—প্রক্যেককেই নিজের কাজ নিজেকে করতে হবে। আমি কোন সাহায্য খুঁজি না, পেলে তা ত্যাগও করি না; আর জগতে কোন সাহায্য দাবী করবার অধিকারও আমার নেই। কেউ যে আমায় সাহায্য করেছে বা করবে, আমার প্রতি সে তার দয়া, তাতে আমার দাবীদাওয়া কিছু নেই; এ জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।

যখন সন্ন্যাসী হই, তখন বুঝেসুঝেই এ পথ বেছে নিয়েছিলাম; বুঝেছিলাম, অনাহারে মরতে হবে। তাতে কি হয়েছে? আমি তো ভিখারী; আমার বন্ধুরা সব গরীব; গরীবদের আমি ভালবাসি; দারিদ্র্যকে সাদরে বরণ করি। কখনও কখনও যে আমায় উপবাস করে কাটাতে হয়, তাতে আমি খুশী। আমি কারও সাহায্য চাই না—তার প্রয়োজন কি? সত্য নিজের প্রচার নিজেই করবে, আমার সাহায্যের অভাবে নষ্ট হয়ে যাবে না। ‘সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ। ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব’—সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয়, সব সমান মনে করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও (গীতা)।

এইরূপ অনন্ত ভালবাসা, সর্বাবস্থায় এইরূপ অবিচলিত সাম্যভাব থাকলে এবং ঈর্ষা দ্বেষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হলে তবে কাজ হবে। তাতেই কেবল কাজ হবে, আর কিছুতেই নয়। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৫১
[স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লিখিত]
জানুআরী, ১৮৯৬

প্রিয় সারদা,
… তোর কাগজের idea (সঙ্কল্প) অতি উত্তম বটে এবং উঠে পড়ে লেগে যা, পরোয়া নেই। ৫০০ টাকা পত্রপাঠ পাঠিয়ে দেব, ভাবনা নাই টাকার জন্য। আপাতত এই চিঠি দেখিয়ে কারুর কাছে ধার করে নে। এই চিঠির জবাব—চিঠির উত্তরে আমি ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দেব। ৫০০ টাকায় কিছু আসে যায় কি? খ্রীষ্টিয়ান, মুসলমান ধর্ম প্রচারের ঢের লোক আছে, তুই আপনার দেশী ধর্মের প্রচার এখন করে ওঠ দিকি। তবে কোন আরবী জানা মুসলমান-ভায়া ধরে যদি পুরানো আরবী গ্রন্থের তর্জমা করাতে পারে, ভাল হয়। ফার্সী ভাষায় অনেক Indian History (ভারতীয় ইতিহাস) আছে। যদি সেগুলো ক্রমে ক্রমে তর্জমা করাতে পার, একটা বেশ regular item (নিয়মিত বিষয়) হবে। লেখক অনেক চাই। তার পর গ্রাহক যোগাড়ই মুশকিল। উপায়—তোরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াস, বাঙলা ভাষা যেখানে যেখানে আছে, লোক ধরে কাগজ গতিয়ে দিবি। … চালাও কাগজ, কুছ্ পরোয়া নাই। শশী, শরৎ, কালী প্রভৃতি সকলে পড়ে (মিলে) লিখতে আরম্ভ কর। ঘরে বসে ভাত খেলে কি হয়? তুই খুব বাহাদুরি করেছিস। বাহবা, সাবাস! গুঁজগুঁজেগুলো পেছু পড়ে থাকবে হাঁ করে, আর তুই লম্ফ দিয়ে সকলের মাথায় উঠে যাবি। ওরা নিজেদের উদ্ধার করছে—না হবে ওদের উদ্ধার, না হবে আর কারুর। মোচ্ছব (মহোৎসব) এমনি মাচাবি যে, দুনিয়াময় তার আওয়াজ যায়। অনেকে আছেন, যাঁরা কেবল খুঁত কাড়তে পারেন; কিন্তু কাজের বেলা তো ‘খোঁজ খবর নহি পাওয়ে।’ লেগে যা, যত পারিস। পরে আমি ইণ্ডিয়ায় (ভারত) এসে তোলপাড় করে তুলব। ভয় কি? ‘নাই নাই বললে সাপের বিষ উড়ে যায়।’—নাই নাই বলে যে নাই হয়ে যেতে হবে!

গঙ্গাধর খুব বাহাদুরি করছে। সাবাস! কালী তার সঙ্গে কাজে লেগেছে। খুব সাবাস! একজন মান্দ্রাজে যা, একজন বোম্বে যা। তোলপাড় কর—তোলপাড় কর দুনিয়া। কি বলব আপসোস—যদি আমার মত দুটা তিনটা তোদের মধ্যে থাকত—ধরা কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যেতুম। কি করি, ধীরে ধীরে যেতে হচ্ছে। তোলপাড় কর—তোলপাড় কর। একটাকে চীন দেশে পাঠিয়ে দে, একটাকে জাপান দেশে পাঠা। গৃহস্থদের কাজ নয়। … সন্ন্যাসীর দলকে হুঙ্কার দিতে হবেঃ ‘হ—র্, হ—র্, শ—ম্ভো!’ ইতি—

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৫২*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
৬ জানুআরী, ১৮৯৬

প্রিয় ভগিনী,
নববর্ষে তোমার প্রীতিসম্ভাষণের জন্য বহু ধন্যবাদ। বিশিষ্ট ভদ্রমহোদয়টির ওখানে ছয় সপ্তাহ তোমার বেশ আনন্দে কেটেছে জেনে সুখী হলাম, যদিও তারা কেবল গল‍্‍ফ‍্‍ই খেলত। ইংলণ্ডে দেখলাম—আমি যথার্থ শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত। ইংরেজরা আন্তরিক অভ্যর্থনা করেছে; এই ইংরেজ জাত সম্বন্ধে আমার ধারণাও অনেকখানি বদলেছে। প্রথমেই দেখলাম লাণ্ড্ (Lund) প্রভৃতি যারা আমার সঙ্গে বিরোধের জন্য ইংলণ্ড থেকে এখানে এসেছিল, ওখানে তাদের কোন পাত্তাই নেই। ইংরেজরা তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত উপেক্ষা করে। যারা ইংলিশ চার্চের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদের ভদ্র বলে মনে করা হয় না। ঐ চার্চভুক্ত কয়েকজন যথার্থ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠা ও পদমর্যাদায় অগ্রণীদের কেউ কেউ আমার অকৃত্রিম বন্ধু হয়েছেন। আমার ইংলণ্ডের অভিজ্ঞতা আমেরিকার তুলনায় একেবারে অন্য রকমের।

এখানে প্রেসবিটেরিয়ান প্রভৃতি গোঁড়াদের সঙ্গে হোটেলগুলিতে আমার অভিজ্ঞতার কথা শুনে ইংরেজরা তো হেসেই অস্থির। উভয় দেশের মধ্যে শিক্ষা দীক্ষা ও আচার-ব্যবহার প্রভেদ লক্ষ্য করতে দেরী হল না। বুঝলাম কেন আমেরিকার মেয়েরা দলে দলে ইওরোপীয় বিবাহ করতে যায়। সকলের কাছে সদয় ব্যবহার পেয়েছি। স্ত্রী-পুরুষ-নির্বিশেষে অনেক উদারহৃদয় বন্ধু এখন সেখানে বসন্তকালে আমার ফিরে যাওয়ার প্রতীক্ষায় আছে।

সেখানকার কাজ সম্বন্ধে বলি, বেদান্তের ভাব ইংরেজ সমাজের উচ্চ স্তরে প্রবেশ করেছে। বহু শিক্ষিত ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, যাঁদের মধ্যে ধর্মযাজকের সংখ্যাও কম নয়, আমাকে বলেন যে, এ যেন গ্রীস কর্তৃক রোম-বিজয়ের পুনরভিনয় হচ্ছে ইংলণ্ডে।

ভারতে বাস করেছে এমন ইংরেজদের মধ্যে দুটি শ্রেণীঃ এক শ্রেণীর চোখে ভারতীয় যা কিছু সবই হেয়; এরা কিন্তু অশিক্ষিত। অপর শ্রেণীর নিকট ভারত পুণ্যভূমি, ভারতের বায়ু পর্যন্ত পবিত্র; এদের হিন্দুয়ানী হিন্দুদেরও হার মানায়, এরা ঘোর নিরামিষাশী, এমন কি স্বদেশে জাতিভেদ-প্রবর্তনেও উদ্যত। ইংলণ্ডের অধিকাংশ লোকই জাতিভেদের দারুণ পক্ষপাতী। সাধারণ বক্তৃতা ছাড়া সপ্তাহে আরও আটটি করে ক্লাস নিতাম; এত লোকসমাগম হত যে, অনেকে—এমন কি অভিজাত মহিলাগণও নিঃসঙ্কোচে মেজের উপরই বসতেন। ইংলণ্ডে দৃঢ়সঙ্কল্প নরনারী দেখতে পেলাম, তারা দায়িত্ব নিয়ে তাদের জাতি-সুলভ উদ্যম ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ চালাতে থাকবে। এ বৎসর নিউ ইয়র্কে আমার কাজ চমৎকার চলেছে। মিঃ লেগেট নিউ ইয়র্কের একজন সেরা ধনী, তিনি আমার একান্ত অনুরাগী। এদেশে নিউ ইয়র্কবাসীরা অধিকতর দৃঢ়চিত্ত, এবং তাই এখানেই আমার কেন্দ্রস্থাপনের সঙ্কল্প করেছি। এখানকার মেথডিষ্ট ও প্রেসবিটেরিয়ান সম্প্রদায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ আমার উপদেশাদি অসঙ্গত মনে করেন। ইংলণ্ডের ধার্মিক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের কাছে এগুলি উচ্চতম দার্শনিক তত্ত্বরূপে পরিগণিত।

তা ছাড়া মার্কিন নারীর স্বভাবসুলভ পরচর্চা ইংলণ্ডে অজ্ঞাত। ইংরেজ মেয়েরা দেরীতে ভাব গ্রহণ করে, তবে একবার ঠিকমত গ্রহণ করতে পারলে তা আয়ত্ত করে নেবেই। ওখানে ওরা যথারীতি কাজ চালাচ্ছে ও প্রতি সপ্তাহে আমাকে কাজের বিবরণ পাঠাচ্ছে। বুঝে দেখ! আর এখানে সপ্তাহখানেকের জন্য যদি অনুপস্থিত থাকি তো কাজের দফা রফা। সকলকে আমার শুভেচ্ছা জানিও—স্যাম এবং তুমি জেনো। ভগবান্ তোমাকে চিরসুখী করুন। ইতি

তোমাদের স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৫৩*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
228, W. 39th St. নিউ ইয়র্ক
১৬ জানুআরী, ১৮৯৬

স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
বই-কয়খানির জন্য অশেষ ধন্যবাদ। ‘সাংখ্যকারিকা’ অতি সুন্দর গ্রন্থ, এবং ‘কূর্মপুরাণে’ আশানুরূপ সব না পেলেও ওতে যোগ সম্বন্ধে কয়েকটি শ্লোক আছে। আমার পূর্বের চিঠিতে ‘যোগসূত্র’ এই শব্দটি বাদ পড়েছিল। বহু প্রামাণিক গ্রন্থ থেকে পাদটীকা সংযুক্ত করে আমি ঐ গ্রন্থখানি অনুবাদ করছি। ‘কূর্মপুরাণে’র পরিচ্ছেদটি আমার টীকার মধ্যে দিতে চাই। আমি মিস ম্যাক‍লাউডের কাছ থেকে তোমার ক্লাসগুলির খুব উৎসাহপূর্ণ বিবরণ পেয়েছি। মিঃ গলস্ওয়ার্দি এখন খুব আকৃষ্ট হয়েছেন বলে মনে হয়।

এখানে আমার ক্লাসগুলি ও রবিবারের বক্তৃতাগুলি আরম্ভ করেছি। দুটি কাজই খুব উৎসাহ জাগিয়েছে। এই দুই কাজের জন্য আমি টাকা নিই না; তবে হলের খরচ চালাবার জন্য (সভাদিতে) কিছু চাঁদা ওঠাই। গত রবিবারের বক্তৃতাটি খুব প্রশংসা অর্জন করেছে, এবং সেটি খবরের কাগজে বেরিয়েছে। আগামী সপ্তাহে আমি তোমায় কয়েক সংখ্যা পাঠিয়ে দেব। ওতে আমাদের কাজের একটা সাধারণ পরিকল্পনা ছিল।

আমার বন্ধুরা একজন সাঙ্কেতিক লেখক (গুডউইনকে) নিযুক্ত করায় এই সমস্ত ক্লাসের পাঠগুলি ও বক্তৃতাগুলি লিপিবদ্ধ হচ্ছে। প্রত্যেকটির এক এক কপি তোমাকে পাঠিয়ে দেবার ইচ্ছা আছে। ঐসব থেকে তুমি হয়তো কিছু চিন্তার খোরাক পেতে পার। এখানে আমি তোমার মত এমন একজন শক্তিশালী লোক চাই—যার বুদ্ধি, কর্মে দক্ষতা ও অনুরাগ আছে। এই সর্বজনীন শিক্ষার দেশে সকলকেই যেন একটা সাধারণ মাঝারি স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে; যে কয়জন যোগ্য ব্যক্তি আছে, তারা যেন গতানুগতিক অর্থ-উপার্জনের গুরুভারে পীড়িত।

এবার পল্লী অঞ্চলে আমার একটি জমি পাবার সম্ভাবনা আছে; তাতে কয়েকটি বাড়ী, বহু গাছ ও একটি নদী আছে। গ্রীষ্মকালে ওটিকে ধ্যানের স্থানরূপে ব্যবহার করা চলবে। অবশ্য আমার অনুপস্থিতিতে ওটার দেখাশুনার জন্য এবং টাকাকড়ি লেনদেন, ছাপা ও অন্যান্য কাজের জন্য একটি কমিটির প্রয়োজন হবে।

আমি নিজেকে টাকাকড়ির ব্যাপার থেকে একেবারে আলাদা করে ফেলেছি, অথচ টাকাকড়ি না হলে কোন আন্দোলন চলতে পারে না। সুতরাং বাধ্য হয়ে কার্যপরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব একটি কমিটির হাতে দিতে হয়েছে; তারা আমার অনুপস্থিতিতে এই সব চালিয়ে যাবে। স্থিরভাবে কাজ করে যাওয়া আমেরিকানদের ধাতে নেই; তারা কেবল দলবেঁধেই কাজ করে। সুতরাং তাদের তাই করতে দিতে হবে। প্রচারের দিকটার ব্যবস্থা এই হয়েছে যে, আমার বন্ধুরা প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে এদেশের জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়াবে; এবং তারা স্বতন্ত্র দল গঠন করতে পারবে। ঐ হচ্ছে বিস্তারের সব চেয়ে সহজ উপায়। অতঃপর যখন আমরা যথেষ্ট বলশালী হব, তখন আমাদের শক্তিরাশিকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য আমরা বাৎসরিক সম্মেলন করব।

কমিটি নিছক কাজ চালানর জন্য এবং তা নিউ ইয়র্কেই সীমাবদ্ধ।

সতত স্নেহপরায়ণ ও আশীর্বাদক
তোমাদের বিবেকানন্দ
…………………………….

২৫৪
[মঠে লিখিত, শেষাংশ স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে]
228 W. 39th St., নিউ ইয়র্ক
১৭ জানুআরী, ১৮৯৬

অভিন্নহৃদয়েষু—
তোমার দুইখানি পত্র আসিয়াছে ও রামদয়ালবাবুর দুইখানি পত্র পাইয়াছি। Bill of Lading (বিল) পৌঁছিয়াছে, পরন্তু মাল আসিবার অনেক দেরী। শীঘ্র পৌঁছিবার বন্দোবস্ত না করিয়া পাঠাইলে মাল আসিতে ছয় মাস লাগিয়া যায়। হরমোহন চার মাস পূর্বে লিখেন যে, রুদ্রাক্ষ ও কুশাসন পাঠান হইয়াছে; তাহার খোঁজ-খবর এখনও পাওয়া যায় নাই। অর্থাৎ মাল ইংলণ্ডে পৌঁছিলে এখানকার Agent of the Company (কোম্পানীর এজেণ্ট) আমাকে notice (খবর) দেয়, তারপর মাসখানেক পরে মাল পৌঁছায়। তোমাদের Bill of Lading (বিল) প্রায় তিন সপ্তাহ এসেছে, এখনও notic-এর (খবরের) দেখা নাই! কেবল খেতড়ির রাজার মাল শীঘ্রই পৌঁছায়, বোধ হয় তিনি অনেক খরচ করে পাঠান। যাহা হউক, এ দুনিয়ার অপরদিকে, পাতালপুরে যে মাল নির্ঘাত পৌঁছে যায়, এই পরম ভাগ্য। মাল পৌঁছলেই তোমাদের খবর দেব। এখন তিন মাস অন্ততঃ চুপ করে থাক।

তুমি খবরের কাগজ এখন বার করতে লেগে যাও। রামদয়ালবাবুকে বলিবে যে, তিনি যে-ব্যক্তির কথা লিখিয়াছেন, তিনি উপযুক্ত হইলেও আমেরিকায় এক্ষণে কাহাকেও আনিবার আমার সাধ্য নাই। L’argent, mon ami, l’argent—টাকা, ইয়ার, টাকা কোথায়?

… তোর টিবেটের (তিব্বতের) কি খবর? ‘মিররে’ ছাপা হলে আমাকে একখানা পাঠিয়ে দিস। … হুটোপাটিতে কি কাজ হয়? … লোহার দিল চাই, তবে লঙ্কা ডিঙ্গুবি। বজ্রবাঁটুলের মত হতে হবে, পাহাড় পর্বত ভেদ হয়ে যাতে যায়। আসছে শীতে আমি আসছি। দুনিয়ায় আগুন লাগিয়ে দেব—যে সঙ্গে আসে আসুক, তার ভাগ্যি ভাল; যে না আসবে, সে ইহকাল পরকাল পড়ে থাকবে, থাকুক। তুই কোমর বেঁধে তৈয়ার থাক। তুই শশী আর গঙ্গাধর—এই তিনজন দেখছি faithful. … তোদের মুখে হাতে বাগ‍্‍দেবী বসবেন—ছাতিতে অনন্তবীর্য ভগবান্ বসবেন—তোরা এমন কাজ করবি যে দুনিয়া তাক হয়ে দেখবে। তোর নামটা একটু ছোটখাট কর দেখি বাবা, কি নাম রে বাপ! একখানা বই হয়ে যায় এক নামের গুঁতোয়। ঐ যে বলে হরিনামের ভয়ে যম পালায়, তা ‘হরি’—এই নামে নয়। ঐ যে গম্ভীর গম্ভীর নাম ‘অঘভগনরকবিনাশন, ত্রিপুরমদভঞ্জন, অশেষ-নিঃশেষকল্যাণকর’ প্রভৃতি নামের গুঁতোয় যমের চৌদ্দপুরুষ পালায়।—নামটা একটু সরল করলে ভাল হয় নাকি? এখন বোধ হয় আর হবে না, ঢাক বেজে গেছে, কিন্তু কি জাঁহাদারি যমতাড়ানে নামই করেছ! কিমধিকমিতি—

বিবেকানন্দ

পুঃ—বাঙলাদেশটা আর ভারতবর্ষটা চেলে ফেল দেখি। জায়গায় জায়গায় Centre (কেন্দ্র) কর।

ভাগবত এসে পৌঁছেছে—Edition (সংস্করণ) বড়ই সুন্দর—কিন্তু এ-দেশের লোকের সংস্কৃত পড়বার ইচ্ছা আদৌ নাই। এজন্য বিক্রী হবার আশা বড়ই কম। ইংলণ্ডে হতে পারে, কারণ সেখানে অনেক লোকে সংস্কৃত চর্চা করে। প্রণেতাকে আমার বিশেষ ধন্যবাদ দিবে। আশা করি তাঁহার মহৎ উদ্যম সুসম্পন্ন হবে। আমরা যথাসাধ্য যত্ন করব, তাঁর বই যাতে এখানে বিক্রী হয়। তাঁর Prospectus (গ্রন্থাভাস) সমস্ত জায়গায় জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি। দয়ালবাবুকে বলবে যে, মুগের দাল, অড়র দাল প্রভৃতিতে ইংলণ্ড ও আমেরিকায় একটা খুব ব্যবসা চলিতে পারে। দাল-soup will have a go if properly introduced. (ঠিকমত শুরু করাতে পারলে দালের যূষের বেশ কদর হবে)। যদি ছোট ছোট প্যাকেট করে তার গায়ে রাঁধবার direction (প্রণালী) দিয়ে বাড়ীতে বাড়ীতে পাঠান যায়—আর একটা ডিপো করে কতকগুলো মাল পাঠান যায় তো খুব চলতে পারে। ঐ প্রকার বড়িও খুব চলবে। উদ্যম চাই—ঘরে বসে ঘোড়ার ডিম হয়। যদি কেউ একটা Company form (কোম্পানী গঠন) করে, ভারতের মালপত্র এদেশে ও ইংলণ্ডে আনে তো খুব একটা ব্যবসা হয়। নিরুদ্যম হতভাগার দল—দশবৎসরের মেয়ের গর্ভাধান করতে কেবল জানে, আর জানে কি?
…………………………….

২৫৫*
আমেরিকা
২৩ জানুআরী, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এতদিনে তুমি আমার প্রেরিত ‘ভক্তিযোগের’ কপি (ছাপাবার মত) যথেষ্ট পরিমাণে নিশ্চয় পেয়েছ। আমি ‘ব্রহ্মবাদিন্‌’ কাগজের ২১ ডিসেম্বর তারিখের শেষ সংখ্যা পেয়েছি।

‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর গত কয়েক সংখ্যা পড়ে আমার একটু সন্দেহ জাগছিল, তোমরা থিওসফিষ্টদের দলে যোগ দেবে নাকি? এবারে তোমরা ওদের হাতে একেবারে আত্মসমর্পণ করেছ। তোমাদের মন্তব্যের স্তম্ভে থিওসফিষ্টদের বক্তৃতার একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলে কেন? থিওসফিষ্টদের সঙ্গে আমার কোনরকম যোগ আছে, সন্দেহ করলে ইংলণ্ড ও আমেরিকা উভয়ত্র আমার কাজের ক্ষতি হবে, আর তা হতেই পারে। সুস্থমস্তিষ্ক ব্যক্তিরা সকলেই তাদের ভ্রান্ত মনে করে; আর তারা যে এরূপ মনে করে, তা ঠিকই। তোমরা তা ভালরূপেই জান। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তোমরা আমার উপর টেক্কা দেবার চেষ্টা করছ। তোমরা মনে করছ, থিওসফিষ্টদের নামে বিজ্ঞাপন দিলে ইংলণ্ডে অনেক গ্রাহক পাবে। তোমরাও যেমন আহাম্মক!

আমি থিওসফিষ্টদের সঙ্গে বিবাদ করতে চাই না; কিন্তু আমার ভাব হচ্ছে, তাদের একদম আমল না দেওয়া। তারা কি বিজ্ঞাপনের জন্য তোমাদের টাকা দিয়েছিল? তোমরা আগ-বাড়িয়ে বিজ্ঞাপন দিতে গেলে কেন? আমি আবার যখন ইংলণ্ডে যাব, তোমাদের জন্য যথেষ্ট গ্রাহক যোগাড় করব।

আমি বিশ্বাসঘাতক কাকেও চাই না। আমি তোমাদের স্পষ্ট বলে রাখছি, কোন ধূর্তের পাল্লায় আমি পড়ছি না। আমার সঙ্গে কপটতা চলবে না। … আমি তোমাদের খুব স্পষ্ট কথাই বলছি। একজন—মাত্র একজন যদি আমায় অনুসরণ করে, সেও ভাল, কিন্তু সে যেন মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বাসী থাকে। সফলতা বা বিফলতা আমি গ্রাহ্যই করি না। সমগ্র জগতে প্রচারকার্যের বৃথা কাজে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। যখন ইংলণ্ডে ছিলাম, তখন কি তাদের কেউ আমায় সাহায্য করতে এসেছিল? পাগল আর কি! আমি হয় আমার আন্দোলনটিকে সম্পূর্ণ খাঁটি রাখব, তা না হয় মোটেই আন্দোলন চালাব না। ইতি

তোমার চিরস্নেহাবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

আমাদের শাস্ত্রে আছে—‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ।’ অর্থাৎ যারা আমার ভক্তগণের ভক্ত, তারা আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত। তুমি প্রভুর সেবিকা; সুতরাং আমি যেখানেই থাকি না কেন, ভগবৎপ্রেরণায় তুমি যে মহোচ্চ ব্রতে দীক্ষিত হয়েছ, তার উদ‍্‍যাপনে যে-কোন প্রকারে সহায়তা করতে পারি, শ্রীকৃষ্ণের অনুগামী আমি তৎসাধনে নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করব ও তা সাক্ষাৎ প্রভুরই সেবা বলে মনে করব। ইতি

তোমার
বিবেকানন্দ

পুঃ—তোমরা কি ঠিক করলে, তা পত্রপাঠ আমায় লিখবে। আমার এ বিষয়ে মতামত একচুল নড়বার নয়। ইতি
—বি

পুঃ—‘ব্রহ্মবাদিন্’ বেদান্ত প্রচারের জন্য, থিওসফি প্রচারের জন্য নয়। তোমাদের যদি উদ্দেশ্য অন্যরূপ ছিল, তবে গোড়া থেকে আমাকে তা বলা উচিত ছিল। স্পষ্টভাবে নিজেদের অভিপ্রায় না জানিয়ে কার্যকালে অন্যরূপ করতে দেখলে আমি প্রায় ধৈর্য হারিয়ে ফেলি।

—বি

পুঃ—এই হচ্ছে জগৎ! যাদের তুমি সবচেয়ে ভালবাস এবং সবচেয়ে বেশী সাহায্য কর, তারাই তোমায় ঠকাতে চায়। ঘৃণিত সংসার!!!
—বি
…………………………….

২৫৬
[স্বামী যোগানন্দকে লিখিত]
228W. 39th St., নিউ ইয়র্ক
২৪ জানুআরী, ১৮৯৬

যোগেন ভায়া,
অড়হর দাল, মুগের দাল, আমসত্ত্ব, আমসি, আমতেল, আমের মোরব্বা, বড়ি, মসলা সমস্ত ঠিক ঠিকানায় পৌঁছিয়াছে। Bill of Lading-এতে (মাল-চালানের বিলে) নাম সহি করিবার ভুল হইয়াছিল ও invoice (চালান) ছিল না; তজ্জন্য কিঞ্চিৎ গোল হয়। পরে যাহা হউক ভালয় ভালয় সমস্ত দ্রব্য পৌঁছিয়াছে। বহু ধন্যবাদ! এক্ষণে যদি ইংলণ্ডে স্টার্ডির ঠিকানায়—High View, Caversham, Reading-এতে—ঐ প্রকার দাল ও কিঞ্চিৎ আমতেল পাঠাও তো আমি ইংলণ্ডে পৌঁছিলেই পাইব! ভাজা মুগদাল পাঠাইবার আবশ্যক নাই। ভাজা দাল কিছু অধিক দিন থাকিলে বোধ হয় খারাপ হয়ে যায়। কিঞ্চিৎ ছোলার দাল পাঠাইবে। ইংলণ্ডে duty (শুল্ক) নাই—মাল পৌঁছিবার কোন গোল নাই। স্টার্ডিকে চিঠি লিখিয়া দিলেই সে মাল লইবে।

তোমার শরীর এখনও সারে নাই, বড়ই দঃখের বিষয়। খুব ঠাণ্ডা দেশে যেতে পার, শীতকালে যেখানে বরফ বিস্তর পড়ে—যথা দার্জিলিঙ? শীতের গুঁতোয় পেটভায়া দুরস্ত হয়ে যাবে, যেমন আমার হয়েছে। আর ঘি ও মসলা খাওয়া একদম ছেড়ে দিতে পার? মাখন ঘির চেয়ে শীঘ্র হজম হয়। অভিধান পৌঁছিলেই খবর দিব। আমার বিশেষ ভালবাসা জানিবে ও সকলকে জানাইবে। নিরঞ্জনের খবর এখনও ঠিকানা করিতে পার নাই? গোলাপ-মা, যোগীন-মা, রামকৃষ্ণের মা, বাবুরামের মা, গৌর-মা প্রভৃতি সকলকে আমার প্রণামাদি জানাইবে। মহেন্দ্রবাবুর স্ত্রীকে আমার প্রণাম দিবে।

তিনমাস বাদে আমি ইংলণ্ডে আসিতেছি, পুনরায় হজুগের বিশেষ চেষ্টা দেখিবার জন্য। তারপর আসছে শীতে ভারতবর্ষে আগমন। পরে বিধাতার ইচ্ছা। সারদা যে কাগজ বার করতে চায়, তার জন্য বিশেষ যত্ন করিবে। শশীকে যত্ন করিতে বলিবে ও কালী প্রভৃতিকে। কাহারও এক্ষণে ইংলণ্ডে আসিবার আবশ্যক নাই। আমি ভারতে যাইয়া তাদের তৈয়ার করিব। তারপর যেথায় ইচ্ছা যাইবে। কিমধিকমিতি—

বিবেকানন্দ

পুঃ—নিজেরা কিছু করে না এবং অপরের কিছু করিতে গেলে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেয়—এই দোষেই আমাদের জাতের সর্বনাশ হইয়াছে। হৃদয়হীনতা, উদ্যমহীনতা সকল দঃখের কারণ। অতএব ঐ দুটি পরিত্যাগ করিবে। কার মধ্যে কি আছে, কে জানে প্রভু বিনা? সকলকে Opportunity (সুযোগ) দাও। পরে প্রভুর ইচ্ছা। সকলের উপর সমান প্রীতি বড়ই কঠিন; কিন্তু তা না হলে মুক্তি হবে না। ইতি
—বি
…………………………….

২৫৭*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
228W. 39th St., নিউ ইয়র্ক
১০ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬

প্রিয় ভগিনী,
তুমি এখন পর্যন্ত আমার চিঠি পাওনি জেনে অবাক হলাম। তোমার চিঠি পাবার ঠিক পরেই আমি চিঠি লিখেছিলাম এবং নিউ ইয়র্কে আমার তিনটি বক্তৃতাসংক্রান্ত কিছু পুস্তিকা পাঠিয়েছিলাম। এই সভায় প্রদত্ত রবিবারের বক্তৃতাগুলি আজকাল সাঙ্কেতিক লিপিতে নেওয়া হচ্ছে, পরে ছাপা হবে। তিনটি বক্তৃতা নিয়ে দুটি পুস্তিকা হয়েছে, যার অনেকগুলির অনুলিপি আমি তোমাকে পাঠিয়েছিলাম। নিউ ইয়র্কে আরও দু সপ্তাহ থাকব, তারপর ডেট্রয়েট যাব, সেখানে থেকে দু-এক সপ্তাহের জন্য আবার বোষ্টন ফিরে আসব।

নিরন্তর কার্য করার ফলে এ বৎসর আমার স্বাস্থ্য খুবই ভেঙে গেছে। স্নায়ুগুলি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই শীতে আমি একরাত্রিও ভালভাবে ঘুমাইনি। আমি নিশ্চয়ই জানি যে, আমার খাটুনি খুব বেশী হচ্ছে, এখনও ইংলণ্ডে এক বৃহৎ কার্য বাকী আছে।

আমাকে তা সম্পূর্ণ করতে হবে এবং তারপর আশা করি ভারতে ফিরে বাকী জীবনটা বিশ্রাম করে কাটাতে পারব।

এখন আমি বিশ্রামের আকাঙ্ক্ষা করছি। আশা করি, তা কিছুটা পাব এবং ভারতের লোকেরা আমাকে রেহাই দেবে। খুব ইচ্ছা হয়, কয়েক বছরের জন্য বোবা হয়ে যাই এবং একেবারে কথা না বলি!

এই সকল পার্থিব সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বের জন্য আমি জন্মাইনি। স্বভাবতঃ আমি স্বপ্নচারী এবং শান্তিপ্রিয়। আমি আজন্ম আদর্শবাদী, স্বপ্নজগতেই আমার বাস, বাস্তবের সংস্পর্শ আমার স্বপ্নের বিঘ্ন ঘটায় এবং আমাকে অসুখী করে তোলে। ঈশ্বরের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক্!

তোমাদের চার বোনের কাছে আমি চিরদিন কৃতজ্ঞ; এ দেশে আমি যা কিছু পেয়েছি তার জন্য তোমাদের কাছে ঋণী। তোমরা নিরন্তর পবিত্র ও সুখী হও। আমি যেখানেই থাকি না কেন, তোমাদের সর্বদা গভীরতম কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ভালবাসার সঙ্গে স্মরণ করব। আমার সমগ্র জীবনটাই স্বপ্নের পর স্বপ্নের সমাবেশ। সচেতন স্বপ্নচারী হওয়া আমার উচ্চাভিলাষ, বস্। সকলকে আমার ভালবাসা—ভগিনী জোসেফিনকে।

সতত তোমার স্নেহবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৫৮*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
228W.39th St., নিউ ইয়র্ক
১৩ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬

স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
ভারতবর্ষ থেকে যে সন্ন্যাসী আসবেন, তিনি তোমাকে অনুবাদের কাজে এবং অন্য কাজেও সাহায্য করবেন নিশ্চয়। অতঃপর আমি যখন (ওখানে) যাব, তখন তাঁকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেব। আজ আর একজন সন্ন্যাসীকে তালিকাভুক্ত করা হল। এবারের আগন্তুকটি একজন পুরুষ; সে খাঁটি আমেরিকান এবং ধর্মপ্রচারক হিসাবে এদেশে তার কিছু খ্যাতি আছে। তার নাম ছিল ডাঃ ষ্ট্রীট; এখন সে যোগানন্দ, কারণ যোগের দিকেই তার সব ঝোঁক।

আমি এখান য়েকে ‘ব্রহ্মবাদিন্‌’-পত্রিকায় নিয়মিতভাবে কার্যবিবরণ পাঠাচ্ছি। সে-সব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। ভারতে কিছু পৌঁছাতে কি দীর্ঘ সময়ই না লাগে! আমেরিকায় কাজ সুন্দরভাবে গড়ে উঠছে। শুরু থেকেই কোন ভোজবাজি না থাকায় আমেরিকার সমাজের সেরা লোকদের দৃষ্টি বেদান্তের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। ফরাসী অভিনেত্রী সারা বার্নহার্ড এখানে ‘ইৎশীল’ (lziel) অভিনয় করেছেন। এটি কতকটা ফরাসী ধাঁজে উপস্থাপিত বুদ্ধজীবন। এতে রাজনর্তকী ইৎশীল বোধিদ্রুম-মূলে বুদ্ধকে প্রলুব্ধ করতে সচেষ্ট; আর বুদ্ধ তাকে জগতের অসারতা উপদেশ দিচ্ছেন। সে কিন্তু সারাক্ষণ বুদ্ধের কোলেই বসে আছে। যা হোক, শেষ রক্ষাই রক্ষা—নর্তকী বিফল হল! মাদাম বার্নহার্ড ইৎশীলের ভূমিকায় অভিনয় করেন।

আমি এই বুদ্ধ-ব্যাপারটা দেখতে গিয়েছিলাম। মাদাম কিন্তু শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে আমায় দেখতে পেয়ে আলাপ করতে চাইলেন। আমার পরিচিত এক সম্ভ্রান্ত পরিবার এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। তাতে মাদাম ছাড়া বিখ্যাত গায়িকা মাদাম মোরেল এবং শ্রেষ্ঠ বৈদ্যুতিক টেস‍্‍লা ছিলেন। মাদাম (বার্নহার্ড) খুব সুশিক্ষিতা মহিলা এবং দর্শনশাস্ত্র অনেকটা পড়ে শেষ করেছেন। মোরেল ঔৎসুক্য দেখাচ্ছিলেন; কিন্তু মিঃ টেস‍্‍লা বৈদান্তিক প্রাণ ও আকাশ এবং কল্পের তত্ত্ব শুনে মুগ্ধ হলেন। তাঁর মতে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কেবল এই তত্ত্বগুলিই গ্রহণীয়। আকাশ ও প্রাণ আবার জগদ্ব্যপী মহৎ, সমষ্টি মন বা ঈশ্বর থেকে উৎপন্ন হয়। মিঃ টেস‍্‍লা মনে করেন, তিনি গণিতের সাহায্যে দেখিয়ে দিতে পারেন যে, জড় ও শক্তি উভয়কে অব্যক্ত শক্তিতে পরিণত করা যেতে পারে। আগামী সপ্তাহে এই নূতন পরীক্ষামূলক প্রমাণ দেখবার জন্য তাঁর কাছে আমার যাবার কথা আছে।

তা যদি প্রমাণিত হয়ে যায়, তবে বৈদান্তিক সৃষ্টিতত্ত্ব দৃঢ়তম ভিত্তির উপর স্থাপিত হবে। আমি এক্ষণে বেদান্তের সৃষ্টিতত্ত্ব ও পরলোকতত্ত্ব নিয়ে খুব খাটছি। আমি স্পষ্টই আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে বেদান্তের ঐ তত্ত্বগুলি সম্পূর্ণ ঐক্য দেখছি; তাদের একটা পরিষ্কার হলেই সঙ্গে সঙ্গে অপরটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। পরে প্রশ্নোত্তরাকারে এই বিষয়ে একখানা বই লিখব মনে করছি।৯২ উহার প্রথম অধ্যায়ে থাকবে সৃষ্টিতত্ত্ব—তাতে বেদান্তমতের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের সামঞ্জস্য দেখান হবে।

ব্রহ্ম
| = নিরপেক্ষ পূর্ণসত্তা
মহৎ বা ঈশ্বর = আদ্যা সৃষ্টিশক্তি
প্রাণ ও আকাশ শক্তি ও জড়
পরলোকতত্ত্ব কেবল অদ্বৈতবাদের দিক্ থেকে দেখান হবে। অর্থাৎ দ্বৈতবাদী বলেন—মৃত্যুর পর আত্মা প্রথমে আদিত্যলোকে, পরে চন্দ্রলোকে ও সেখান থেকে বিদ্যুল্লোকে যান; সেখানে একজন পুরুষ এসে তাঁকে ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায়। (অদ্বৈতবাদী বলেন, তারপর তিনি নির্বাণপ্রাপ্ত হন।)

এখন অদ্বৈতবাদীর মতে আত্মার যাওয়া-আসা নাই, আর এই যে-সব বিভিন্ন লোক বা জগতের স্তরসমূহ—এগুলি আকাশ ও প্রাণের নানাবিধ মিশ্রণে উৎপন্ন মাত্র। অর্থাৎ সর্বনিম্ন বা অতি স্থূল স্তর হচ্ছে আদিত্যলোক বা এই পরিদৃশ্যমান জগৎ—এখানে প্রাণ জড়-শক্তিরূপে ও আকাশ স্থূলভূতরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। তারপর হচ্ছে চন্দ্রলোক—তা আদিত্যলোককে ঘিরে আছে। এ আমাদের এই চন্দ্র একেবারেই নয়, এ দেবগণের আবাসভূমি—অর্থাৎ এখানে প্রাণ মনঃশক্তিরূপে এবং আকাশ তন্মাত্র বা সূক্ষ্মভূতরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। এরও ওপর বিদ্যুল্লোক—অর্থাৎ এমন এক অবস্থা, যেখানে প্রাণ আকাশের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন বললেই হয় আর তখন বলা কঠিন যে, বিদ্যুৎ জিনিষটা জড় না শক্তি। তারপর ব্রহ্মলোক—সেখানে প্রাণও নেই, আকাশও নেই; সেখানে এই উভয়ই মূল মন বা আদ্যাশক্তিতে সম্মিলিত হয়েছে। আর এখানে প্রাণ বা আকাশ না থাকায় (ব্যষ্টি) জীব সমস্ত বিশ্বকে সমষ্টিরূপে অথবা মহতের বা বুদ্ধির সংহতিরূপে কল্পনা করে। এঁকেই পুরুষ বলে বোধ হয়—ইনি সমষ্টি আত্মাস্বরূপ, কিন্তু ইনিও সেই সর্বাতীত নিরপেক্ষ সত্তা নন—কারণ এখানেও বহুত্ব রয়েছে। এইখান থেকেই জীব শেষে তার চরম লক্ষ্যস্বরূপ একত্বকে অনুভব করে। অদ্বৈতমতে জীবের আসা-যাওয়া নেই। এই দৃশ্যগুলি ক্রমাম্বয়ে জীবের সামনে আবিভূর্ত হতে থাকে; আর এই যে বর্তমান দৃশ্যজগৎ দেখা যাচ্ছে, তাও এইরূপেই সৃষ্ট হয়েছে। সৃষ্টি ও প্রলয় অবশ্য এই ক্রমেই হয়ে থাকে—তবে প্রলয় মানে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া, আর সৃষ্টি মানে বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়ে আসা।

আর যখন প্রত্যেক জীব কেবল নিজের জগৎ মাত্র দেখতে পায়, তখন ঐ জগৎ তার বন্ধন অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্ট হয়, এবং তার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়—যদিও অন্যান্য বদ্ধ জীবের পক্ষে ঐ জগৎ থেকে যায়। নাম-রূপ হচ্ছে জগতের উপাদান। সমুদ্রের একটা তরঙ্গকে ততক্ষণই তরঙ্গ বলি, যতক্ষণ তা নাম-রূপের দ্বারা সীমাবদ্ধ। তরঙ্গ শান্ত হলে তা সমুদ্রই হয়ে যায়, আর সেই নাম ও রূপ তখনই চিরকালের মত অন্তর্হিত হয়। সুতরাং যে জলটা নাম-রূপের দ্বারা তরঙ্গাকারে পরিণত হয়েছিল, সেই জল ছাড়া তরঙ্গের নাম-রূপের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, অথচ নাম-রূপকেও তরঙ্গ বলা চলে না। তরঙ্গ জলে পরিণত হলেই নাম-রূপ ধ্বংস হয়ে যায়। তবে অন্যান্য তরঙ্গগুলির অন্যান্য নাম-রূপ থাকে বটে। এই নাম-রূপকেই বলে মায়া, আর জলই ব্রহ্ম। তরঙ্গ জল ছাড়া আর কিছুই ছিল না; অথচ তরঙ্গরূপে তার নাম-রূপ ছিল। আবার এই নাম-রূপ এক মুহূর্তের জন্য তরঙ্গ থেকে পৃথক্‌ ভাবে থাকতে পারে না, যদিও জলস্বরূপে সেই তরঙ্গটি চিরকালই নাম-রূপ থেকে পৃথক্‌ থাকতে পারে। কিন্তু যেহেতু তরঙ্গ থেকে নাম-রূপকে কখনই পৃথক্‌ করা চলে না, সেইহেতু তারা যে ‘আছে’ তা বলা যেতে পারে না। কিন্তু তারা একেবারে যে শূন্য, তাও নয়—একেই বলে মায়া।

আমি এই সকল ভাবকে সাবধানে রূপ দিতে চাই; তুমি নিশ্চয় এক নিমেষেই বুঝে নেবে, আমি ঠিক পথ ধরেছি। মন চিত্ত বুদ্ধি ইত্যাদির তত্ত্ব আরও ভাল করে দেখাতে গেলে শারীর-বিজ্ঞান (Physiology) আরও বেশী করে আলোচনা করতে হবে। উচ্চতর ও নিম্নতর কেন্দ্রগুলির সম্বন্ধে আলোচনা করতে হবে। তবে আমি এখন এ বিষয়ে এমন স্পষ্ট আলোক দেখতে পাচ্ছি, যা সমস্ত ভোজবাজি থেকে মুক্ত। আমি শুষ্ক সুকঠিন যুক্তিকে প্রেমের মধুরতম রসে কোমল করে তীব্র কর্মের মসলাতে সুস্বাদু করে এবং যোগের পাকশালায় রান্না করে পরিবেশন করতে চাই, যাতে শিশুরা পর্যন্ত তা হজম করতে পারে। আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৫৯*
১৭ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এইমাত্র তোমার পত্র পেয়ে এবং তোমরা সকলে সঙ্কল্পে দৃঢ়ব্রত আছ জেনে খুব খুশী হলাম। আমার চিঠিগুলিতে খুব কড়া কথা ব্যবহার করেছি; সেজন্য তুমি কিছু মনে করো না, কারণ তুমি জানই তো মাঝে মাঝে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কাজটি ভয়ানক কঠিন, আর যতই তা বাড়ছে, ততই কঠিনতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার দীর্ঘ বিশ্রামের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অথচ এখনই আমার সম্মুখে ইংলণ্ডে বিস্তর কাজ পড়ে আছে। তোমায় অত্যন্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে জেনে আমি বড়ই দুঃখিত হলাম।

ধৈর্য ধরে থাক, বৎস! কাজ এত বাড়বে যে, তুমি ভাবতেও পার না। আমরা আশা করছি, এখানে শীঘ্রই বহু সহস্র গ্রাহক সংগ্রহ করতে পারব, আর আমি ইংলণ্ডে গেলে সেখানেও অনেক পাব। স্টার্ডি ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর জন্য তোড়জোড় করছে। সবই সুন্দর, খুব সুন্দর চলছে। তুমি পত্রিকাখানিকে একটা কমিটির হাতে দেবার যে সঙ্কল্প করেছ, আমি তা মোটেই অনুমোদন করি না। ও-রকম কিছু করো না। পত্রিকার সমস্ত পরিচালনা নিজ হাতে রাখ এবং তুমিই স্বত্বাধিকারী থাক। পরে কি করা যায় দেখা যাবে। তুমি ভয় পেও না। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি—যেমন করেই হোক, আমি ব্যয় নির্বাহ করব। কমিটি করা মানে—নানা রুচির লোক আসবে তাদের বিভিন্ন খেয়াল প্রচার করতে, আর অবশেষে সবটা পণ্ড করবে। তোমার ভগ্নীপতি পত্রিকাখানি সুন্দরভাবে সম্পাদনা করছেন, তিনি বিজ্ঞ পণ্ডিত ও অদম্য কর্মী। তাঁকে আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানাবে এবং আর সব বন্ধুকেও জানাবে। সকল কাজেই কৃতকার্য হবার পূর্বে শত শত বাধা-বিঘ্নের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। যারা লেগে থাকবে, তারা শীঘ্রই হোক আর বিলম্বেই হোক আলো দেখতে পাবে।

১| এ এই যে আমি তোমায় চিঠি লিখছি, এরই সঙ্গে সঙ্গে গত রবিবারের বক্তৃতার ফলে আমার সব কয়খানি হাড়ে ব্যথা চলেছে। আমি এক্ষণে মার্কিন সভ্যতার কেন্দ্রস্বরূপ নিউ ইয়র্ককে জাগাতে সমর্থ হয়েছি; কিন্তু এর জন্য আমাকে ভয়ানক সংগ্রাম করতে হয়েছে। গত দু-বৎসর এক পয়সাও আসেনি। হাতে যা-কিছু ছিল, তা প্রায় সবই এই নিউ ইয়র্ক ও ইংলণ্ডের কাজে ব্যয় করেছি। এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, কাজ চলে যাবে।

তারপর ভাব দেখিঃ হিন্দুভাবগুলি ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করা, আবার শুষ্ক দর্শন, জটিল পুরাণ ও অদ্ভুত মনোবিজ্ঞানের মধ্য থেকে এমন ধর্ম বের করা, যা একদিকে সহজ সরল ও সাধারণের হৃদয়গ্রাহী হবে, আবার অন্যদিকে বড় বড় মনীষিগণের উপযোগী হবে! এ যারা চেষ্টা করেছে, তারাই বলতে পারে—কি কঠিন ব্যাপার! সূক্ষ্ম অদ্বৈততত্ত্বকে প্রাত্যহিক জীবনের উপযোগী জীবন্ত ও কবিত্বময় করতে হবে; অসম্ভবরূপ জটিল পৌরাণিক তত্ত্বসকলের মধ্য থেকে জীবন্ত প্রকৃত চরিত্রের দৃষ্টান্তসকল বের করতে হবে; আর বিভ্রান্তিকর যোগশাস্ত্রের মধ্য থেকে বৈজ্ঞানিক ও কার্যে পরিণত করবার উপযোগী মনস্তত্ত্ব বের করতে হবে, আবার এগুলিকে এমন ভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে একটি শিশুও বুঝতে পারে। এই আমার জীবনব্রত। প্রভুই জানেন, আমি কত দূর কৃতকার্য হব। কর্মে আমাদের অধিকার, ফলে নয়। বড়ই কঠিন কাজ, বৎস, বড়ই কঠিন। যতদিন না অপরোক্ষানুভূতি ও পূর্ণ ত্যাগের ভাব ধারণা করবার উপযুক্ত একদল শিষ্য তৈরী হচ্ছে, ততদিন এই কামকাঞ্চনের ঘূর্ণিপাকের মধ্যে আপনাকে স্থির রেখে নিজ আদর্শ ধরে থাকা প্রকৃতই কঠিন ব্যাপার। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এরই মধ্যে অনেকটা কৃতকার্য হওয়া গেছে। আমাকে না বুঝবার জন্য আমি মিশনরীদের বা অন্যদের আর দোষ দিই না; তারা এ ছাড়া আর কি করতে পারত? তারা তো জীবনে পূর্বে কখনও এমন লোক দেখেনি, যে কামিনীকাঞ্চনের মোটেই ধার ধার না। প্রথমে যখন তারা দেখলে, তারা বিশ্বাস করতে পারলে না—পারবেই বা কিরূপে? তুমি যদি কখনও ভেবে থাক যে, ব্রহ্মচর্য ও পবিত্রতা সম্বন্ধে পাশ্চাত্যজাতিদের ধারণা ভারতীয়দেরই অনুরূপ, তাহলে তুমি নিতান্তই ভ্রান্ত। তাদের অনুরূপ শব্দ হচ্ছে বীর্য ও সাহস (virtue and courage)। তাদের সাধুত্বের আদর্শ ঐ পর্যন্ত। তাদের মতে বিবাহাদি স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম—এর অভাবে মানুষ অসাধু; আর যে ব্যক্তি সম্ভ্রান্ত মহিলাদের সম্মান না করে সে তো অসৎ। … এখন লোকেরা দলে দলে আমার কছে আসছে। এখন শত শত লোক বুঝেছে যে, এমন লোক আছে, যারা নিজেদের কামবৃত্তিকে সত্যই সংযত করতে পারে; আর সাধুতা ও সংযমের প্রতি তাদের ভক্তিশ্রদ্ধাও বাড়ছে। যারা ধৈর্য ধরে থাকে, তাদের সব কিছুই জুটে যায়। তুমি আমার অফুরন্ত আশীর্বাদ জানবে। ইতি

তোমার
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৬০*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
228W., 39th St., নিউ ইয়র্ক
২৯ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬

স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
সম্ভব হলে মে মাসের আগেই আমি যাচ্ছি। এর জন্য তোমায় উদ্বিগ্ন হতে হবে না। পুস্তকাটি সুন্দর হয়েছে। খবরের কাগজের অংশগুলি পেলে পাঠিয়ে দেব।

পুস্তক-পুস্তিকাগুলি এখানে এভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। নিউ ইয়র্কে একটি সমিতি গঠিত হয়েছে। তারাই সাঙ্কেতিক লেখার ও ছাপার যাবতীয় খরচা দিয়েছে, এই শর্তে যে বইগুলির স্বত্বাধিকার তাদের থাকবে। সুতরাং এই পুস্তিকা ও পুস্তকগুলি তাদের। একখানা বই—‘কর্মযোগ’ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে; তার চেয়ে অনেক বড় ‘রাজযোগ’ ছাপা চলছে; ‘জ্ঞানযোগ’ পরে প্রকাশিত হতে পারে। কথা-বলার ভাষা হবার ফলে বইগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করবে, পূর্বেই তা লক্ষ্য করেছ। আপত্তিকর যা কিছু ছিল—সব ছেঁটে দিয়েছি, এবং এঁরা বইগুলি বার করতে সাহায্য করেছে। বইগুলি সমিতির সম্পদ, মিসেস ওলি বুল এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক, মিসেস লেগেটও আছেন।

এখন বইগুলি যে তাঁদের হবে, এটা তো ন্যায়সঙ্গত। তাঁরাই প্রকাশক বলে অন্য প্রকাশকদের হস্তক্ষেপের কোন ভয় নেই।

যদি ভারত থেকে বই আসে, তবে সেগুলি রেখে দেবে।

সাঙ্কেতিক লেখক গুডউইন একজন ইংরেজ; সে আমার কাজে এতটা আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েছে যে, আমি তাকে ব্রহ্মচারী করে নিয়েছি, সে আমার সঙ্গে ঘুরছে, আমরা একসঙ্গে ইংলণ্ডে যাব। সে বরাবরের মত আমার খুব কাজে লাগবে।

আশীর্বাদ সহ তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৬১
বোষ্টন
(১ম সপ্তাহ) মার্চ, ১৮৯৬

Dear Sarada (প্রিয় সারদা),৯৩
তোমার পত্রে সবিশেষ অবগত হইলাম। মহোৎসব উপলক্ষে আমি এক cable (তার) পাঠাই, তাহার কোন সংবাদ তো লিখ নাই দেখিতেছি। কয়েক মাস পূর্বে শশী যে সংস্কৃত অভিধান পাঠাইয়াছিল, তাহা তো আজিও পৌঁছে নাই। … আমি শীঘ্রই ইংলণ্ড যাইতেছি। শরতের এখন আসিবার কোনই আবশ্যক নাই; কারণ আমি নিজেই ইংলণ্ড যাইতেছি। যাদের মনের ঠিকানা করতে ছ-মাস লাগে, তাদের আমার দরকার নাই। তাকে ইওরোপ বেড়াবার জন্য আমি ডাকিও নাই এবং টাকাও আমার নাই। অতএব তাকে আসতে বারণ করবে, কাউকেই আসতে হবে না।

টিবেটের (তিব্বতের) সম্বন্ধে তোমার পত্র পাঠ করে তোমার বুদ্ধির উপর হতশ্রদ্ধা হল। প্রথম—নোটোভিচ-এর বই সত্য—nonsence (বাজে কথা)! তুমি কি original (মূল গ্রন্থ) দেখেছ বা India-য় (ভারতে) এনেছ? দ্বিতীয়—Jesus এবং Samaritan Woman-এর (যীশু ও সামারিয়া-দেশীয় নারীর) ছবি কৈলাসের মঠে দেখেছ। কি করে জানলে সে যীশুর ছবি, ঘিষুর নয়? যদি তাও হয়, কি করে জানলে যে, কোন ক্রিশ্চান লোকের দ্বারা তাহা উক্ত মঠে স্থাপিত হয় নাই? টিবেটিয়ানদের (তিব্বতীদের) সম্বন্ধে তোমার মতামতও অযথার্থ। তুমি heart of Tibet (তিব্বতের ভিতরটা) তো দেখ নাই—only a fringe of the traderoute (শুধু বাণিজ্য-পথের ধারে ধারে একটুখানি দেখিয়াছ)। ঐসকল স্থানে কেবল dregs of nation (জাতের নিকৃষ্ট ভাগটাই) দেখতে পাওয়া যায়। কলকেতার চীনেবাজার আর বড়বাজার দেখে যদি কেউ বাঙালীমাত্রকে চোর বলে, তা কি যযার্থ হয়?

শশীর সঙ্গে বিশেষ পরামর্শ করে article (প্রবন্ধ) প্রভৃতি লিখবে … । ইতি

নরেন্দ্র
…………………………….

২৬২*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
১৭ মার্চ, ১৮৯৬

প্রেমাস্পদেষু—,
এইমাত্র তোমার শেষ চিঠিখানা পেলাম, খুব ভয় পেয়ে গেছি।

বক্তৃতাগুলি হয়েছিল কয়েকজন বন্ধুর উদ্যোগে, তাঁরা সাঙ্কেতিক লিপির এবং অন্য সব কিছুর খরচ দেন—এই শর্তে যে একমাত্র তাঁদেরই সেগুলি প্রকাশ করার অধিকার থাকবে। সেইমত তাঁরা ইতোমধ্যেই রবিবারের বক্তৃতাগুলি এবং রাজযোগ, কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ বিষয়ে তিনটি বই ছাপিয়েছেন। বিশেষতঃ ‘রাজযোগে’র অনেকখানি পরিবর্তন করা হয়েছে এবং পতঞ্জলির ‘যোগসূত্রে’র অনুবাদসহ ঢেলে সাজান হয়েছে। রাজযোগ লংম্যানদের হাতে। বইগুলি ইংলণ্ডে ছাপানর কথায় এখানকার বন্ধুরা খুব চটে গিয়েছেন; যেহেতু আইনতঃ আমি সেগুলি তাঁদের দিয়ে দিয়েছি। এখন কি করা যায়—বুঝতে পারছি না। পুস্তিকাগুলি প্রকাশের ব্যাপারটা গুরুতর নয়, কিন্তু পুস্তকগুলির এত পুনর্বিন্যাস ও পরিবর্তন করা হয়েছে যে, আমেরিকান সংস্করণ দেখে ইংরেজী সংস্করণ চেনাই যাবে না। এখন অনুরোধ করছি—এই বইগুলি প্রকাশ করো না, অন্যথা আমি বড় অপ্রস্তত হয়ে যাব এবং অফুরন্ত ঝগড়ার সৃষ্টি হয়ে আমার আমেরিকার কাজ পণ্ড হয়ে যাবে।

ভারতের শেষ চিঠিতে জেনেছি যে, একজন সন্ন্যাসী ভারত থেকে রওনা হয়েছেন। আমি মিস মূলারের কাছ থেকে একখানা সুন্দর চিঠি পেয়েছি, মিস ম্যাকলাউডের কাছ থেকেও একখানা; লেগেট পরিবার আমার প্রতি খুব অনুরক্ত হয়ে পড়েছে।

আমি মিঃ চ্যাটার্জি সম্পর্কে কিছুই জানি না। অন্য সূত্র থেকে শুনতে পেলাম যে, তাঁর হল অর্থকষ্ট—থিওসফিষ্টরা তাঁকে টাকা দিতে পারছে না। তাছাড়া ভারত থেকে একজন অপেক্ষাকৃত শক্তিমান্ লোক আসছে, তার তুলনায় তিনি আমাকে যেটুকু সাহায্য করতে পারবেন, তা যৎসামান্য। তাঁর সঙ্গে ঐ পর্যন্তই। আমাদের তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই।

তোমাকে আবার অনুরোধ করছি, এই পুস্তক প্রকাশের ব্যাপারটা ভেবে দেখো, এবং মিসেস বুলকে কয়েকটি চিঠি লেখো ও তাঁর মাধ্যমে আমেরিকার বেদান্তের বন্ধুদের মতামত জিজ্ঞেস কর। মনে রেখো আমাদের প্রচারিত নীতি ‘সকল প্রাণীর একত্ব’; আর জাতীয়তামূলক সমস্ত ভাবই দুষ্ট কুসংস্কার মাত্র। অধিকন্তু আমার নিশ্চিত ধারণা যে, যিনি অপরের মতে সায় দিতে প্রস্তুত, শেষে তিনি তাঁর নিজ মতেরই জয় প্রত্যক্ষ করেন। সর্বদা নতিস্বীকারই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে। আমাদের সকল বন্ধুকে ভালবাসা।

ভালবাসা ও আশীর্বাদসহ তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমি মার্চ মাসেই যত তাড়াতাড়ি পারি নিশ্চয় যাচ্ছি।
…………………………….

২৬৩*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

প্রিয় ভগিনী,
আমার ভয় হচ্ছে—তুমি ক্ষুণ্ণ হয়েছ, তাই আমার একটি চিঠিরও জাবাব দাওনি। তা এখন হাজার ক্ষমা চাইছি। সৌভাগ্যক্রমে কমলা রঙের কাপড় পেয়ে গেছি এবং যত শীঘ্র পারি একটি কোট তৈরী করে নিচ্ছি। শুনে আনন্দিত হলাম যে, মিসেস বুলের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল। তিনি সত্যি মহীয়সী নারী এবং সহৃদয় বন্ধু। একটি কথা ভগিনী, ঘরে দুটি খুব পাতলা সংস্কৃত পুস্তিকা আছে। যদি অসুবিধা না হয়, সেগুলি দয়া করে পাঠিয়ে দিও। ভারত থেকে বইগুলি নিরাপদে এসে পৌঁছেছে এবং তার জন্য আমাকে কোন শুল্ক দিতে হয়নি। কম্বলগুলি ও গালিচা এখনও এসে পৌঁছয়নি জেনে আমি অবাক হয়েছি। মাদার টেম্পলের সঙ্গে আর দেখা করতে যেতে পারিনি; সময় পাইনি। যখনই একটু সময় পাই গ্রন্থাগারে কাটাই।

তোমাদের সকলকে আমার চিরদিনের ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা।

তোমাদের সতত স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

পুঃ—মিঃ হাউ বরাবরই ক্লাসে আসছেন, এই শেষ ক-দিন আসেননি। মিস হাউকে আমার ভালবাসা জানাবে।
—বি
…………………………….

২৬৪*
বোষ্টন
২৩ মার্চ, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তোমার চিঠির উত্তর আগে দিতে পারিনি; আর এখন আমায় বেজায় তাড়াতাড়ি করতে হচ্ছে। সম্প্রতি যাদের আমি সন্ন্যাস দিয়েছি, তাদের মধ্যে সত্যই একজন স্ত্রীলোক, ইনি মজুরদের নেত্রী ছিলেন; বাকী সব পুরুষ। ইংলণ্ডে আমি আরও কয়েকজনকে সন্ন্যাস দেব, তারপর তাদের আমার সঙ্গে ভারতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করব। হিন্দুদের চেয়ে এইসব ‘সাদা মুখ’ সেখানে বেশী প্রভাব বিস্তার করবে; তা ছাড়া তাদের কাজ করবার শক্তিও বেশী, হিন্দুরা তো মরে গেছে। ভারতের একমাত্র ভরসার স্থল জনসাধারণ—অভিজাত সম্প্রদায় তো শারীরিক ও নৈতিক হিসাবে মরে গেছে।

হরমোহন সম্বন্ধে বক্তব্য এই যে, আমি দীর্ঘকাল পূর্বেই তাকে আমার বক্তৃতাগুলি ছাপাবার স্বাধীনতা দিয়েছিলাম, কারণ সে আমার পুরানো বন্ধু, সাচ্চা ভক্ত ও অত্যন্ত গরীব।

‘ব‍্রহ্মবাদিন্’-এ লম্বা লম্বা সংস্কৃত প্রবন্ধ থাকায় ইওরোপ ও আমেরিকায় উহা চলার সম্ভাবনা বড়ই অল্প। তুমি এটাকে সংস্কৃতে ছাপালেই তো পার? সংস্কৃত পারিভাষিক শব্দ এবং অফুরন্ত সংস্কৃত শ্লোকাদি উদ্ধৃত করলে হিন্দুদের ও সংস্কৃতজ্ঞ পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ‍হয়তো বেশ সাহায্য হতে পারে, কিন্ত সাধারণ পাশ্চাত্যবাসী তো আর তোমার হিন্দু দর্শনের ধার ধারে না! একান্ত যদি রাখতে চাও তো না হয় একটা প্রবন্ধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ কর—বাকীগুলিতে সংস্কৃত শব্দ না থাকাই উচিত এবং লেখা হালকা হওয়া উচিত। আমার যে সাফল্য হচ্ছে, তার কারণ আমার সহজ ভাষা। আচার্যের মহত্ত্ব হচ্ছে—তাঁর ভাষার সরলতা। তুমি যদি জনসাধারণের উপযুক্ত করে বেদান্ত সম্বন্ধে লিখতে পার, তবে ‘ব‍্রহ্মবাদিন্’ এখানে জনপ্রিয় হবে—নতুবা নয়। যে কয়জন গ্রাহক হয়েছে, তারা শুধু আমার প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার ফলে।

শ্রীগুরু মহারাজের জন্মতিথিতে আমি ভারতে যে তার পাঠিয়েছিলাম, সেটি তারা পেয়েছে কিনা একটু খোঁজ নিয়ে দেখো তো।

আগামী মাসে ইংলণ্ডে যাচ্ছি। আমার ভয় হয়—আমার খাটুনি অত্যধিক হয়ে পড়ছে; এই দীর্ঘ একটানা পরিশ্রমে আমার স্নায়ুমণ্ডলী যেন ছিঁড়ে গেছে। তোমাদের কাছ থেকে সহানুভূতি আমি কিছুমাত্র চাই না; শুধু এইজন্য লিখছি যে, তোমরা আমার কাছ থেকে বেশী কিছু আশা করো না। যতদূর ভালভাবে সম্ভব কাজ করে যাও। আমার দ্বারা সম্প্রতি কোন বড় কাজ হবে, এমন আশা নেই বলেই মনে হয়। যা হোক সাঙ্কেতিক প্রণালীতে আমার বক্তৃতাগুলি লিখে নেবার ফলে অনেকটা সাহিত্য গড়ে উঠেছে দেখে আমি খুশী। চারিখানি বই তৈরী হয়ে গেছে। একখানি বেরিয়ে গেছে, ‘পাতঞ্জলসূত্রে’র অনুবাদ সহ ‘রাজযোগে’র বইখানি ছাপা হচ্ছে, ‘ভক্তিযোগে’র বইটা তোমার কাছে আছে, আর ‘জ্ঞানযোগে’রটা গুছিয়ে নিয়ে ছাপার জন্য তৈরী হচ্ছে। তা ছাড়া রবিবারের বক্তৃতাগুলিও ছাপা হয়ে গেছে। স্টার্ডি বিরাট কর্মী, সে সব কাজই খুব এগিয়ে দিতে পারে। যা হোক, লোককল্যাণের জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি—এই মনে করেই আমি সন্তুষ্ট; আর কাজ থেকে অবসর নিয়ে আমি যখন গিরিগুহায় ধ্যানে মগ্ন হব, তখন এ বিষয়ে আমার বিবেক সাফ থাকবে।

সকলে আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৬৫*
আমেরিকা
মার্চ, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এই সঙ্গে পত্রিকার জন্য তোমাকে ১৬০ ডলার পাঠালাম। আমি আমার শিষ্যদের বলেছি, যাতে তারা তোমার জন্য কিছু গ্রাহক সংগ্রহ করে। জনকয়েক ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে। কাজ চালিয়ে যাও। কিন্তু তুমি মনে রেখো যে, আমাকে লণ্ডন নিউ ইয়র্ক কলিকাতা ও মান্দ্রাজে কাজ চালাতে হচ্ছে। এখন আমি লণ্ডনের কাজে যাচ্ছি। প্রভুর ইচ্ছে হলে এখানে ও ইংলণ্ডে গৈরিক-পরিহিত সন্ন্যাসীতে ছেয়ে যাবে। বত্সগণ, কাজ করে যাও।

মনে রেখো, যতদিন তোমাদের গুরুর উপর শ্রদ্ধা থাকবে, ততদিন কেউ তোমাদের বাধা দিতে পারবে না। ভাষ্য তিনখানির ঐ অনুবাদটি পাশ্চাত্যবাসীদের দৃষ্টিতে একটা মস্ত বড় কাজ হবে।

ঐ ‘সর্বজনীন ভাবের মন্দির’টি (Temple of the Universal Spirit) আমি ছেড়ে দিয়েছি—এখন একটা নূতন নাম দিয়েছি … । ইতোমধ্যেই আমার দুইজন সন্ন্যাসী শিষ্য ও কয়েক শত গৃহস্থ শিষ্য হয়েছে; কিন্তু বত্স, জনকয়েক ছাড়া তাদের অধিকাংশই গরীব; তবে জনকয়েক খুব ধনীও আছে। এ সংবাদটি এখনই প্রকাশ করে দিও না যেন। যথাসময়ে আমি জনসাধারণের সামনে আবার আত্মপ্রকাশ করব। স্থির হয়ে থাক, বত্স! স্থির হও, আর কাজ করে যাও। ধৈর্য, ধৈর্য! আগামী বত্সর আমি নিউ ইয়র্কে একটি মন্দির করবার আশা রাখি; তারপর প্রভু জানেন।

এখানে একখানি পত্রিকা চালাব; লণ্ডনে যাচ্ছি এবং যদি প্রভুর কৃপা হয়, তবে ওখানেও তাই করব। আমার ভালাবাসাদি জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৬৬*
আমেরিকা
১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
গত সপ্তাহে আমি তোমাকে ‘ব‍্রহ্মবাদিন্’ সম্বন্ধে লিখেছিলাম। তাতে ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে বক্তৃতাগুলির কথা লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম। ঐগুলি সব একসঙ্গে পুস্তিকাকারে বের করা উচিত। কয়েক শত আমেরিকায় নিউ ইয়র্কে গুডইয়ারের নামে পাঠাতে পার। আমি বিশ দিনের মধ্যে জাহাজে ইংলণ্ড রওনা হচ্ছি। কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও রাজযোগ সম্বন্ধে আমার আরও বড় বড় বই আছে। ‘কর্মযোগ’ ইতোমধ্যেই বেরিয়ে গেছে। ‘রাজযোগ’খানা খুব বড় হবে—তাও যন্ত্রস্থ হয়েছে। ‘জ্ঞানযোগ’খানা বোধ হয় ইংলণ্ড থেকে ছাপাতে হবে।

তোমরা ‘ব‍্রহ্মবাদিন্’-এ কৃ—র একখানা পত্র ছেপেছ, কাজটা ভাল হয়নি। … ‘ব‍্রহ্মবাদিন্’-এর সুরের সঙ্গে ওটি খাপ খায় না। … কোন সম্প্রদায়—ভালই হোক, আর মন্দই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ‘ব‍্রহ্মবাদিন্’-এ কিছু ছাপান যেন না হয়। অবশ্য বুজরুকদের প্রতি গায়ে পড়ে সহানুভূতি দেখাবারও কোন আবশ্যক নেই। আবার তোমাদের জানিয়ে রাখছি, কাগজটা এতই পারিভাষিক হয়ে পড়েছে যে, এখানে এর গ্রাহক বড় হবে না। সাধারণ পাশ্চাত্যদেশবাসী ঐ সব দাঁতভাঙ্গা সংস্কৃত কথা বা পরিভাষা জানেও না, জানবার বিশেষ আগ্রহও রাখে না। এইটুকু আমি দেখছি যে, কাগজটা ভারতের পক্ষে বেশ উপযোগী হয়েছে। কোন একটা মতবিশেষের ওকালতি করা হচ্ছে, এমন একটি কথাও যেন সম্পাদকীয় প্রবন্ধে না থাকে। আর সর্বদা মনে রেখো যে, তোমরা শুধু ভারত নয়, সমগ্র জগৎকে সম্বোধন করে কথা বলছ; আর তোমরা যা বলতে চাইছ, জগৎ তার সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ। প্রত্যেক অনূদিত সংস্কৃত শব্দ খুব সাবধানে ব্যবহার করো; আর ভাষা যতটা সম্ভব সহজ করবার চেষ্টা করো।

তোমরা এই পত্র পাবার আগেই আমি ইংলণ্ড পৌঁছে যাব। সুতরাং আমাকে স্টার্ডির ঠিকানায়—হাইভিউ, কেভার্শ্যাম, ইংলণ্ড—পত্র লিখবে। ইতি

তোমাদের বিবেকানন্দ
…………………………….

২৬৭*
চিকাগো
৬ এপ্রিল, ১৮৯৬

প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার হৃদ্যতাপূর্ণ পত্রখানি যথাসময়ে পেয়েছি। বন্ধুগণের সঙ্গে আমি ইতোমধ্যে অনেক সুন্দর স্থান দেখেছি এবং অনেকগুলি ক্লাস করেছি। আরও কয়েকটি ক্লাস করতে হবে, তারপর আগামী বৃহস্পতিবার রওনা হব।

মিস এডামসের অনুগ্রহে এখানকার সব ব্যবস্থাই সুন্দর হয়েছে; তিনি এত ভাল এবং দরদী! গত দুইদিন যাবৎ সামান্য একটু জ্বরে ভুগছি বলে দীর্ঘ পত্র লিখতে পারলাম না।বোষ্টনের সকলকে আমার ভালবাসা জানাবেন। ইতি

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৬৮*
125, East, 44th St, নিউ ইয়র্ক
১৪ এপ্রিল, ১৮৯৬

প্রিয়—,
… এই অনুসন্ধিৎসু ভদ্রলোকটি বোম্বে থেকে একখানি চিঠি নিয়ে এখানে আমার কাছে এসেছেন। ভদ্রলোক যন্ত্রশিল্পে দক্ষ (practical mechanic), এবং তাঁর একমাত্র ইচ্ছা এই যে, তিনি এদেশের ছুরি, কাঁচি ও অন্যান্য লৌহ নির্মিত দ্রব্যগুলির কারখানা দেখে বেড়ান। … আমি তাঁর সম্বন্ধে কিছুই জানি না; তিনি যদি মন্দ লোকও হন, তা হলেও আমার স্বদেশবাসীদের ভেতর এরকম বেপরোয়া সাহসের ভাব দেখলে উৎসাহ দিতেই ইচ্ছা করি। তাঁর নিজের খরচ চালাবার মত যথেষ্ট টাকা আছে।

লোকটি কতদূর সাচ্চা—এ সম্বন্ধে পরীক্ষা করে যদি আপনি সন্তুষ্ট হন, তা হলে তাঁকে সুবিধা দেবেন; তিনি ঐ কারখানাগুলি দেখবার একটা সুযোগ চান মাত্র। আশা করি, তিনি খাঁটি লোক, আর আপনি তাঁকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন। আমার আন্তরিক শ্রদ্ধাদি জানবেন। ইতি

ভবদীয়
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৬৯*
[ডাঃ নাঞ্জুণ্ড রাওকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
১৪ এপ্রিল, ১৮৯৬

প্রিয় ডাক্তার,
আজ সকালে আপনার চিঠি পেলাম। আগামী কাল আমি ইংলণ্ডে রওনা হচ্ছি, তাই আপনাকে দু-চারটি মাত্র আন্তরিক কথা লিখতে পারব। ছেলেদের প্রস্তাবিত কাগজের বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতিটি আছে এবং তা চালিয়ে যাবার জন্য আমি যথাসাধ্য সাহায্যও করব। আপনার উচিত, ‘ব‍্রহ্মবাদিন্’-এর ধারা অবলম্বন করে কাগজটাকে স্বাধীনমতাবলম্বী করা; কেবল ভাষা ও লেখাগুলো যাতে আরও সহজবোধ্য হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখবেন। ধরুন, আমাদের সংস্কৃত সাহিত্যে যে-সব অপূর্ব গল্প ছড়ান আছে, তা সহজবোধ্য ভাষায় আবার লেখা ও জনপ্রিয় করা দরকার; এই একটা মস্ত সুযোগ রয়েছে, যা হয়তো আপনারা স্বপ্নেও ভাবেননি। এই জিনিষটাই আপনাদের কাগজের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হবে। যেমন সময় পাব, তেমন আপনাদের জন্য আমি যত বেশী পারি—গল্প লিখব। কাগজটাকে খুব পাণ্ডিত্যপূর্ণ করবার চেষ্টা একেবারে ত্যাগ করুন, তার জন্য ‘ব‍্রহ্মবাদিন্’ রয়েছে। এভাবে চললে কাগজটা ধীরে ধীরে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে নিশ্চয়ই। ভাষাটা যতদূর সম্ভব সহজ করবেন, তা হলেই আপনারা সফল হবেন। গল্পের ভেতর দিয়ে ভাব দেওয়াই হবে প্রধান বৈশিষ্ট্য। কাগজটাকে জটিল দার্শনিক তত্ত্ববহুল মোটেই করবেন না। লেনদেনের দিকটা সম্পূর্ণরূপে নিজের হাতে রাখবেন—অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। ভারতে একটা জিনিষের বড়ই অভাব—একতা বা সংহতিশক্তি, তা লাভ করবার প্রধান রহস্য হচ্ছে আজ্ঞানুবর্তিতা।

কলিকাতায় বাঙলা ভাষায় একখানি পত্রিকা আরম্ভ করতে সাহায্য করব বলে কথা দিয়েছি। কিন্তু ব্যাপার এই—প্রথম দু-বছরই মাত্র বক্তৃতার জন্য টাকা আদায় করেছি; গত দু-বছর আমার কাজের সঙ্গে দেনা-পাওনার কোন সম্পর্ক ছিল না। এর ফলে আপনাকে বা কলিকাতার লোকদের পাঠাবার মত টাকা আমার মোটেই নেই। তথাপি আপনাকে সাহায্য করতে পারে, এমন লোক আমি শীঘ্রই জুটিয়ে দেব। বীরের মত এগিয়ে চলুন। একদিনে বা এক বছরে সফলতার আশা করবেন না। সর্বদা শ্রেষ্ঠ আদর্শকে ধরে থাকুন। দৃঢ় হউন, ঈর্ষা ও স্বার্থপরতা বিসর্জন দিন। নেতার আদেশ মেনে চলুন; আর সত্য, স্বদেশ ও সমগ্র মানবজাতির নিকট চিরবিশ্বস্ত হউন; তা হলেই আপনি জগৎ কাঁপিয়ে তুলবেন। মনে রাখবেন—ব্যক্তিগত ‘চরিত্র’ এবং ‘জীবন’ই শক্তির উৎস, অন্য কিছু নহে। এই চিঠিখানা রেখে দেবেন এবং যখনই উদ্বেগ ও ঈর্ষার ভাব মনে উঠবে, তখনই এই শেষের কটা লাইন পড়বেন। ঈর্ষাই সমস্ত দাসজাতির ধ্বংসের কারণ। এ থেকেই আমাদের জাতির সর্বনাশ। এটি সর্বদা পরিত্যাজ্য। আপনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হোক; আপনার সাফল্য কামনা করি। ইতি

আপনার স্নেহপরায়ণ
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৭০*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
6 West, 43rd St., নিউ ইয়র্ক
১৪ এপ্রিল, ১৮৯৬

স্নেহের ভগিনীগণ,
রবিবার নিরাপদে এসে পৌঁছেছি এবং অসুস্থতার জন্য আগে চিঠি দিতে পারিনি। হোয়াইট স্টার লাইনের ‘জার্মানীক’ জাহাজে আগামী কাল বেলা বারটায় যাত্রা করছি। ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা ও আশীর্বাদের চিরস্থায়ী স্মৃতির সঙ্গে—

তোমাদের চির স্নেহের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৭১
[স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
১৪ এপ্রিল, ১৮৯৬

কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে সবিশেষ অবগত হইলাম। শরৎ পৌঁছিয়াছে সংবাদ পাইলাম। তোমার প্রেরিত Indian Mirror (ইণ্ডিয়ান মিরর) ও পত্র পাইলাম। লেখা উত্তম হইতেছে, বরাবর লিখিয়া যাও। দোষ দেখা বড়ই সহজ, গুণ দেখাই মহাপুরুষের ধর্ম—এ-কথা ভুলিবে না। ‘মুগের ডাল তৈয়ার হয় নাই’ মানে কি? ভাজা মুগের ডাল পাঠাইতে আমি পূর্বেই নিষেধ করিয়াছি, ছোলার ডাল ও কাঁচা মুগের ডাল পাঠাইতে বলি। ভাজা মুগ এতদূর আসিতে খারাপ ও বিস্বাদ হইয়া যায়, সিদ্ধ হয় না। যদি এবারও ভাজা মুগ হয়, টেমসের জলে যাইবে ও তোমাদের পণ্ডশ্রম। আমার চিঠি না পড়িয়াই কাজ কেন কর? চিঠি হারাও বা কেন? যখন চিঠি লিখবে, পূর্বের পত্র সম্মুখে রাখিয়া লিখিবে। তোমাদের একটু business (কাজ-চালানর) বুদ্ধি আবশ্যক। যে-সকল কথা আমি জিজ্ঞাসা করি, তাহার উত্তর প্রায়ই পাই না—কেবল আবোল-তাবোল! … চিঠি হারায় কেন? ফাইল হয় না কেন? সকল কাজেই ছেলেমানুষি! আমার চিঠি হাটের মাঝে পড়া হয় বুঝি? আর যে আসে, সে-ই ফাইল টেনে চিঠি পড়ে বুঝি? … You need a little business faculty. … Now what you want is organization—that requires strict obedience and division of labour. I will write out everything in every particular from England, for which I start to-morrow. I am determined to make you decent workers thoroughly organized. ৯৪ …

‘Friend’ (ফ্রেণ্ড—বন্ধু) শব্দ সকলের প্রতি ব্যবহৃত হয়। ইংরেজী ভাষায় ও-সকল cringing politeness (দীনা হীনা ভদ্রতা) নাই; ঐ সকল বাঙলা শব্দের তর্জমা হাস্যাস্পদ হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংস, ঈশ্বর, ভগবান্—ও-সকল এদেশে কি চলে? M—has a tendency to put that stuff down everybody’s throat, but that will make our movement a little sect. You keep separate from such attempts. At the same time, if people worship him as God, no harm. Neither encourage, nor discourage. The masses will always have the person, the higher ones, the principle; we want both. But principles are universal, not persons. Therefore stick to the principles he taught; let people think whatever they like of this person. … Truce to all quarrels and jealousy and bigotry! These will spoil everything. ‘The first should be last and the last first’.৯৫

‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’ (আমার ভক্তগণের যাহারা ভক্ত, তাহারাই আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত)। ইতি

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৭২*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
Waveney Mansions
Fairhazel Gardens, London
এপ্রিল, ১৮৯৬, বৃহস্পতিবার অপরাহ্ণ

প্রিয় স্টার্ডি,
আমি সকালবেলা তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে, অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার চিঠিতে জানিয়েছেন—যদি আমি অক্সফোর্ডে বক্তৃতা করতে যাই, তিনি যথাসাধ্য সাহায্য করবেন।

তোমার স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুনঃ—শঙ্কর পাণ্ডুরঙ্গ কর্তৃক সম্পাদিত অথর্ববেদ-সংহিতার জন্য তুমি কি চিঠি লিখেছ?
—বি
…………………………….

২৭৩
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
হাইভিউ, কেভার্শ্যাম
রিডিং, ইংলণ্ড
সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ১৮৯৬

কল্যাণবরেষু,
শরতের মুখে সবিশেষ অবগত … হইলাম। ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল’—একথা সর্বদা মনে রাখিবে। … আমি নিজের কর্তৃত্বলাভের আশায় নয়, কিন্তু তোমাদের কল্যাণ ও প্রভুর অবতীর্ণ হইবার উদ্দেশ্য সফলের জন্য লিখিতেছি। তিনি তোমাদের ভার আমার উপর দিয়াছিলেন এবং তোমাদের দ্বারা জগতের মহাকল্যাণ হইবে, যদিও অনেকেই এক্ষণে তাহা অবগত নও; এজন্যই বিশেষ লিখিতেছি, মনে রাখিবে। তোমাদের মধ্যে দ্বেষভাব ও অহমিকা প্রবল হইলে বড়ই দুঃখের বিষয়। যারা দশজনে দশদিন প্রীতির সহিত বাস করিতে সক্ষম নহে, তাহাদের দ্বারা জগতে প্রীতিস্থাপন কি সম্ভব? নিয়মবদ্ধ হওয়া ভাল নয় বটে, কিন্তু অপক্ব অবস্থায় নিয়মের বশে চলা আবশ্যক—অর্থাৎ প্রভু যে প্রকার আদেশ করিতেন যে, কচিগাছের চারিদিকে বেড়া দিতে হয় ইত্যাদি। দ্বিতীয়তঃ অলস মনে অনেক পরচর্চা, দলাদলি প্রভৃতি ভাব সহজেই আসে। সেইজন্য নিম্নলিখিত নির্দেশগুলি লিখিতেছি। তদনুযায়ী কাজ যদি কর, পরম মঙ্গল হইবে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। না যদি কর, শীঘ্রই সমস্ত পরিশ্রম বিফল হইবার সম্ভাবনা।

প্রথমতঃ মঠ চালাইবার সম্বন্ধে লিখিঃ

১। মঠের জন্য একটা যথেষ্ট স্থান সহিত বাটী ভাড়া লইবে অথবা বাগান, যাহাতে প্রত্যেকের জন্য এক একটি ছোট ঘর হয়। একটা বড় হল পুস্তকাদি রাখিবার জন্য, এবং একটি ছোট ঘর—সেখানে লোকজনের সহিত দেখাশুনা করিবে। যদি সম্ভব হয়—আরও একটা বড় হল ঐ বাটীতে থাকার আবশ্যক, যেখানে প্রত্যহ শাস্ত্র ও ধর্মচর্চা সাধারণের জন্য হইবে।
২। কোন লোক মঠে আসিলে সে যার সহিত দেখা করিতে চায়, তারই সঙ্গে দেখা করিয়া চলিয়া যাইবে, অপরকে দিক্ না করে।
৩। এক একজন পরিবর্তন করিয়া প্রত্যহ কয়েক ঘণ্টা উক্ত হলে সর্বসাধারণের নিমিত্ত উপস্থিত থাকিবে—যাহাতে সাধারণ লোক যাহা জিজ্ঞাসা করিতে আসে, তাহার সদুত্তর পায়।
৪। যে যার আপনার ঘরে বাস করিবে—বিশেষ কার্য না পড়িলে আর একজনের ঘরে কিছুতেই যাইবে না। পুস্তকাগারে যাহার পড়িবার ইচ্ছা হইবে, যাইয়া পাঠ করিবে। কিন্তু তথায় তামাক খাওয়া বা অপরের সহিত কথাবার্তা একেবারেই নিষেধ করিবে। নিঃশব্দে পাঠ করিতে হইবে।
৫। সারাদিন সকলে পড়ে (মিলে) একটা বাজে কথা কওয়া ও বাহিরের লোক যে-সে আসছে ও সেই গোলমালে যোগ দিচ্ছে, তাহা একেবারেই নিষেধ।
৬। কেবল যাহারা ধর্মজিজ্ঞাসু, তাহারা শান্তভাবে আসিয়া সাধারণ হলে বসিয়া থাকিবে ও যাহাকে চায় তাহার সহিত দেখা করিয়া চলিয়া যাইবে। অথবা কোন সাধারণ জিজ্ঞাস্য থাকে, সেদিনকার জন্য যিনি সেই কার্যের ভার পাইয়াছেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া চলিয়া যাইবে।
৭। একজনের কথা আর একজনকে বলা বা গুজোগুজি, পরনিন্দা একেবারেই ত্যাগ করিবে।
৮। একটা ছোট ঘর অফিস হইবে। যিনি সেক্রেটারী, তিনি সেই ঘরে থাকিবেন ও সেই ঘরে কালি, কাগজ, চিঠি লিখিবার সরঞ্জাম ইত্যাদি সমস্ত থাকিবে। তিনি সমস্ত আয়ব্যয়ের হিসাব রাখিবেন ও যে-সমস্ত চিঠিপত্র ইত্যাদি আসে, তাহা তাঁহার নিকট আসিবে ও তিনি পত্রাদি না খুলিয়া যাহার যাহার নামে তাহাকে তাহাকে বাঁটিয়া দিবেন। পুস্তক ও পত্রিকাদি পুস্তকাগারে যাইবে।
৯। একটা ছোট ঘর থাকিবে তামাক খাইবার জন্য। তদ্ভিন্ন অপর কোন স্থানে তামাক খাইবার আবশ্যক নাই।
১০। যিনি গালিমন্দ বা ক্রোধাদি করিতে চান, তাঁহাকে ঐ সকল কার্য মঠের বাহিরে যাইয়া করিতে হইবে। ইহার অন্যথা তিলমাত্র না হয়।

শাসন সমিতি

১। একজন মহান্ত প্রতি বৎসর নির্বাচন করিবে অধিক লোকের মত লইয়া। দ্বিতীয় বৎসর আর একজন ইত্যাদি।
২। এ বৎসর রাখালকে মহান্ত কর, তদ্বৎ আর একজনকে সেক্রেটারী কর; তদ্বৎ আর একজন পূজাপত্র ও রান্নাবান্নার তদারক করিবার জন্য নির্বাচন কর।
৩। সেক্রেটারীর আর এক কাজ—তিনি সকলের স্বাস্থ্যের উপর নজর রাখিবেন। এই বিষয়ে তিনটি উপদেশ আছে—

১ম—প্রত্যেক ঘরে প্রত্যেক লোকের জন্য এক একটি নেয়ারের খাটিয়া ও তোষক ইত্যাদি (থাকিবে)। প্রত্যেককে আপনার আপনার ঘর পরিষ্কার করিতে হইবে।
২য়—রান্না ও খাওয়ার জন্য জল যাহাতে পরিষ্কার ও দোষহীন হয়, তাহা অবশ্যই করিবে; কারণ দুষ্ট বা অপরিষ্কৃত জলে ভোগ রাঁধিলে মহাপাপ হয়।
৩য়—শরৎকে যে প্রকার কোট করিয়া দিয়াছ, ঐ প্রকার গেরুয়া আলখাল্লা প্রত্যেককে দুটি করিয়া দিবে এবং কাপড়-চোপড় যাহাতে পরিষ্কার থাকে (তাহা দেখিবে); … বাটী অত্যন্ত পরিষ্কার যাহাতে হয়—নীচের উপরের সমস্ত ঘর—(সেদিকে নজর রাখিবে)।

৪। যে কেউ সন্ন্যাসী হতে চায়, প্রথমে তাহাকে ব্রহ্মচারী করিবে—এক বৎসর মঠে, এক বৎসর বাহিরে—তার পর সন্ন্যাসী করিয়া দিবে।
৫। ঠাকুরপূজার ভার উক্ত ব্রহ্মচারীদের মধ্যে একজনকে দিবে এবং মধ্যে মধ্যে বদলাইয়া দিবে।

বিভাগ

মঠে এই কয়েকটি বিভাগ থাকিবে, যথাঃ (১) বিদ্যা-বিভাগ, (২) প্রচার-বিভাগ, (৩) সাধন-বিভাগ।

বিদ্যা-বিভাগঃ যাহারা পড়িতে চায়, তাহাদের জন্য পুস্তকাদি ও অধ্যাপক সংগ্রহ—এই বিভাগের উদ্দেশ্য। প্রত্যহ প্রাতঃকালে এবং সায়ংকালে তাহাদের জন্য অধ্যাপক উপস্থিত থাকিবে।

প্রচার-বিভাগঃ মঠবাসী ও প্রবাসী। মঠবাসী প্রচারকেরা প্রত্যহ শাস্ত্রাদিপাঠ ও প্রশ্নোত্তরাদি দ্বারা জিজ্ঞাসুদের শিক্ষা দিবে। প্রবাসীরা গ্রামে গ্রামে প্রচার করিবে ও স্থানে স্থানে উক্তরূপ মঠ স্থাপনের চেষ্টা করিবে।

সাধন-বিভাগঃ যাঁহারা সাধন-ভজন করিতে চান, তাঁহাদের আপন আপন ঘরে সাধন-ভজনের যাহা আবশ্যক—তাহার সহায়তা করা ইত্যাদি। কিন্ত একজন সাধন করেন বলিয়া আর কাউকেও যে পড়িতে দিবেন না, অথবা প্রচার করিতে দিবেন না—এ প্রকার না হয়। যিনি উৎপাত করিবেন, তাঁহাকে অন্তর (তফাৎ) হইতে তৎক্ষণাৎ বলিবে—ইহাতে অন্যথা না হয়।

মঠবাসী প্রচারকেরা পর্যায়ক্রমে ভক্তি জ্ঞান যোগ ও কর্মসম্বন্ধে উপদেশ করিবেন, এবং তৎসম্বন্ধে দিবস ও সময় নির্দিষ্ট করিয়া উক্ত শিক্ষাগৃহের দ্বারে লটকাইয়া দিবেন—অর্থাৎ যাহাতে ভক্তিজিজ্ঞাসু জ্ঞানশিক্ষার দিনে আসিয়া আঘাত না পায় ইত্যাদি। বামাচার সাধনে উপযুক্ত তোমরা কেহই নহ; অতএব বামমার্গের নামগন্ধও মঠে যেন না হয়। যিনি এ-কথা না শুনিবেন, তাঁহার স্থান বাহিরে। ওঁ-সাধনের নাম পর্যন্ত যেন মঠে না হয়। ‘তাঁর’ ঘরে যে- দুর্বৃত্ত বিকট বামাচার ঢোকায়, তার ইহ-পরকাল উৎসন্ন হইবে।

কয়েকটি সাধারণ নির্দেশ

১। কোন স্ত্রীলোক যদি কোন সন্ন্যাসীর সহিত দেখা করিতে আইসে, তাহা হইলে সাধারণ গৃহে যাইয়া কথাবার্তা কহিবে। কোন স্ত্রীলোক অন্য কোন ঘরে প্রবেশ করিতে পাইবে না, ঠাকুরঘর ছাড়া।
২। কোন সন্ন্যাসী মেয়েদের মঠে যাইয়া বাস করিতে পাইবে না। যদি না শুনে, মঠ হইতে দূর করিবে। দুষ্ট গরু অপেক্ষা শূন্য গোয়াল (ভাল)। …
৩। দুশ্চরিত্র লোকের একেবারেই প্রবেশ নিষেধ। কোন অছিলায় তাদের ছায়া যেন আমাদের ঘরে না পড়ে। যদি তোমাদের মধ্যে কেউ দুশ্চরিত্র হয়, যে-কেহ হউক—তৎক্ষণাৎ বিদায় কর। দুষ্ট গরুর দরকার নাই। প্রভু অনেক ভাল ভাল লোক আনিবেন।
৪। শিক্ষা দিবার গৃহে ও সময়ে, এবং প্রচারের গৃহে ও সময়ে যে-কোন স্ত্রীলোক আসিতে পারেন; কিন্তু উক্ত সময় অতীত মাত্রেই চলিয়া যাইতে হইবে।
৫। কোন ক্রোধ বা ঈর্ষা প্রকাশ, বা গোপনে একজনের নিন্দা আর একজনের কাছে কদাচ করিবে না। … একজন আর একজনের দোষ দেখিতে খুব মজবুত—আপনার দোষগুলি কেউ সারাইবেন না!
৬। আহারের নির্দিষ্ট সময় যেন হয়। প্রত্যেকের বসিবার জন্য একটা আসন ও খাইবার জন্য একটা ছোট চৌকি (থাকিবে)—আসনে বসে চৌকির উপর থালা রেখে খাবে—যে প্রকার রাজপুতানায়।

কর্মচারী – সভা (office-bearers)

সমস্ত অফিসার—তোমরা করিয়া লইবে ব্যালটের দ্বারায়, যে প্রকার ‘বুদ্ধ মহারাজে’র আজ্ঞা—অর্থাৎ একজন প্রপোজ (প্রস্তাব) করিল, ‘অমুক এক বৎসরের জন্য মহান্ত হউক।’ সকলে ‘হ্যাঁ’ কি ‘না’ কাগজে লিখিয়া একটা কুম্ভে নিক্ষেপ করিবে। যদি ‘হ্যাঁ’ অধিক হয়, তিনি মহান্ত (হইবেন) ইত্যাদি।

যদিও তোমরা উক্ত প্রকারে অফিসার বাছিয়া লইবে, তথাপি আমি suggest (প্রস্তাব) করি যে, এ বৎসর রাখাল মহান্ত, তুলসী সেক্রেটারী ও ট্রেজারার, গুপ্ত লাইব্রেরিয়ান, শশী কালী হরি ও সারদা পর্যায়ক্রমে পড়াবার ও উপদেশ করবার ভার লউক—ইত্যাদি। সারদা যে কাগজ বার করতে চেয়েছে, সে উত্তম কথা বটে; কিন্তু সকলে মিলেমিশে করতে পার তো আমার সম্মতি আছে।

মতামত সম্বন্ধে এই যে, যদি কেউ পরমহংসদেবকে অবতার ইত্যাদি বলে মানে উত্তম কথা, না মানে উত্তম কথা। সার এই যে, পরমহংসদেব চরিত্রসম্বন্ধে পুরাতন ঠাকুরদের উপরে যান এবং শিক্ষাসম্বন্ধে সকলের চেয়ে উদার ও নূতন এবং Progressive (প্রগতিশীল) অর্থাৎ পুরানোরা সব একঘেয়ে—এ নূতন অবতার বা শিক্ষকের এই শিক্ষা যে, এখন যোগ ভক্তি জ্ঞান ও কর্মের উৎকৃষ্ট ভাব এক করে নূতন সমাজ তৈয়ারী করতে হবে। … পুরানোরা বেশ ছিলেন বটে, কিন্তু এ যুগের এই ধর্ম—একাধারে যোগ জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম—আচণ্ডালে জ্ঞান-ভক্তি দান—আবালবৃদ্ধবনিতা। ও-সকল কেষ্ট বিষ্টু বেশ ঠাকুর ছিলেন; কিন্তু রামকৃষ্ণে একাধারে সব ঢুকে গেছেন। সাধারণ লোকের পক্ষে এবং প্রথম উদ্যোগীর পক্ষে নিষ্ঠা বড়ই আবশ্যক—অর্থাৎ শিক্ষা দাও যে, অন্য সকল দেবকে নমস্কার, কিন্তু পূজা রামকৃষ্ণের। নিষ্ঠা ভিন্ন তেজ হয় না—তা না হলে মহাবীরের ন্যায় প্রচার হয় না। আর ও-সব পুরানো ঠাকুরদেবতা বুড়িয়ে গেছে—এখন নূতন ভারত, নূতন ঠাকুর, নূতন ধর্ম, নূতন বেদ। হে প্রভো, কবে এ পুরানোর হাত থেকে উদ্ধার পাবে আমাদের দেশ! গোঁড়ামি না হলে কল্যাণ দেখছি কই? তবে অপরের দ্বেষ ত্যাগ করতে হবে।

যদি আমার বুদ্ধিতে চলা তোমাদের উচিত বিচার হয় এবং এই সকল নিয়ম পালন কর, তাহলে আমি মঠভাড়ার এবং সমস্ত খরচ-পত্র পাঠিয়ে দেব। নতুবা তোমাদের সঙ্গত্যাগ—একদম। অপিচ গৌর-মা, যোগীন-মা প্রভৃতিকে এই চিঠি দেখিয়ে তাঁহাদের দিয়ে ঐ প্রকার একটা মেয়েদের জন্য স্থাপন করাইবে। সেখানে গৌর-মাকে এক বৎসর মহান্ত করিবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেউই সেখানে যেতে পাবে না। তারা আপনারা সমস্ত করিবে, তোমাদের হুকুমে কাউকে চলিতে হবে না। তারও সমস্ত খরচ-পত্র আমি পাঠিয়ে দেব।

প্রভু তোমাদের সৎবুদ্ধি দিন! দু-জন জগন্নাথ দেখতে গেল—একজন দেখলে ঠাকুর, আর একজন দেখলে পুঁই গাছ!!! বাপু হে, তোমরা সকলেই তাঁর সেবায় ছিলে বটে, কিন্তু যখনই মন ফুলে আমড়া গাছ হবে, তখনই মনে করো যে, থাকলে কি হয় তাঁর সঙ্গে?—দেখেছ কেবলই পুঁই গাছ! যদি তা না হত তো এত দিনে প্রকাশ হত। তিনি নিজেই বলতেন, নাচিয়ে গাহিয়ে তারা নরকে যাইবে—ঐ নরকের মূল ‘অহঙ্কার’। ‘আমিও যে, ও-ও সে’—বটে রে মধো? ‘আমাকেও তিনি ভালবাসতেন’—হায় মধুরাম, তাহলে কি তোমার এ দুর্গতি হয়? … এখনও উপায় আছে—সাবধান! মনে রেখ যে, তাঁর কৃপায় বড় বড় দেবতার মত মানুষ তৈয়ারী হয়ে যাবে, যেখানে তাঁর দয়া পড়বে। … এখনও সময় আছে, সাবধান! Obedience is the first duty (আজ্ঞাবহতাই প্রথম কর্তব্য)—যা বলি, করে ফেল দেখি! এই কটা ছোট্ট ছোট্ট কাজ প্রথমে কর দেখি—তারপর বড় বড় কাজ ক্রমে হবে। অলমিতিL

নরেন্দ্র

পুঃ—এই চিঠি সকলকে পড়াবে এবং তদনুযায়ী কাজ করা যদি উচিত বোধ হয়, আমাকে লিখবে। রাখালকে বলবে—যে সকলের দাস, সে-ই সকলের প্রভু। যার ভালবাসায় ছোট বড় আছে, সে কখনও অগ্রণী হয় না। যার প্রেমের বিরাম নাই, উচ্চ নীচ নাই, তার প্রেম জগৎ জয় করে।

নরেন্দ্র
…………………………….

২৭৪
High View, Caversham, Reading
C/o E. T. Sturdy, Esq.,
১৮৯৬

প্রিয়—,
… প্রত্যেকে পূর্ণ উদ্যম প্রকাশ না করলে কি কোন কাজ সম্পন্ন হয়? ‘উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মীঃ’—সিংহহৃদয় কাজের মানুষের কাছেই লক্ষ্মীদেবী এসে থাকেন।

পেছন ফিরে তাকানর প্রয়োজন নেই। আগে চল! আমাদের চাই অনন্ত শক্তি, অফুরন্ত উৎসাহ, সীমাহীন সাহস, অসীম ধৈর্য, তবেই আমরা বড় বড় কাজ করতে পারব। … ইতি

তোমাদের স্নেহশীল
বিবেকানন্দ
…………………………….

৭৫*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
হাই ভিউ, রিডিং
২০ এপ্রিল, ১৮৯৬

স্নেহের ভগিনীগণ,
সমুদ্রের অপর পার থেকে তোমাদের অভিনন্দন জানাই। এবার সমুদ্রযাত্রা আনন্দদায়ক হয়েছে এবং কোন পীড়া হয়নি। সমুদ্রপীড়া এড়াবার জন্য আমি নিজেই কিছু চিকিৎসা করেছিলাম। আয়ার্লণ্ডের মধ্য দিয়ে এবং ইংলণ্ডের কয়েকটি পুরানো শহর দেখে এক দৌড়ে ঘুরে এলাম, এখন আবার রিডিং-এ ‘ব্রহ্ম, মায়া, জীব, জীবাত্মা ও পরমাত্মা’ প্রভৃতি নিয়ে আছি। অপর সন্ন্যাসীটি এখানে রয়েছে; আমি যত লোক দেখেছি, তাদের মধ্যে তিনি একজন চমৎকার লোক, বেশ পণ্ডিতও। আমরা এখনও গ্রন্থগুলি সম্পাদনার কাজে ব্যস্ত। পথে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি—নিতান্তই নীরস, একটানা এবং গদ্যময়, আমার জীবনেরই মত। আমি যখন আমেরিকার বাইরে যাই, তখনই আমেরিকাকে বেশী ভালবাসি। যাই হোক, এ পর্যন্ত যা দেখছি, তার মধ্যে ওখানকার কয়েকটি বছরই সর্বোৎকৃষ্ট।

তোমরা কি ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর জন্য কিছু গ্রাহক সংগ্রহের চেষ্টা করছ? মিসেস এডামস্ (Mrs. Adams) ও মিসেস কংগারকে (Mrs. Conger) আমার ভালবাসা জানাবে। যত শীঘ্র পার তোমাদের সকলের কথা আমাকে লিখবে—আর তোমরা কি করছ, তোমাদের পান, ভোজন ও ঘুরে বেড়ানর একঘেয়েমি কি দিয়ে ভাঙছ? এখন একটু তাড়াতাড়ি, পরে এর চেয়ে বড় চিঠি লিখব; সুতরাং বিদায় এবং তোমরা সর্বদা সুখী হও।

তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমি সময় পেলেই মাদার চার্চের কাছে লিখব। স্যাম এবং ভগিনী লককে আমার ভালবাসা।
বি
…………………………….

২৭৬*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
মে, ১৮৯৬

প্রিয় ভগিনী,
আবার লণ্ডনে। এখন ইংলণ্ডের আবহাওয়া বেশ চমৎকার ও ঠাণ্ডা; ঘরে অগ্নিকুণ্ডে আগুন রাখতে হয়। তুমি জেন, আমাদের ব্যবহারের জন্য এবার একটা গোটা বাড়ী পাওয়া গেছে। বাড়ীটি ছোট হলেও বেশ সুবিধাজনক। লণ্ডনে বাড়ীভাড়া আমেরিকার মত তত বেশী নয়, তা বোধ হয় তুমি জান। এই তোমার মার কথাই ভাবছিলাম। এইমাত্র তাঁকে একখানা চিঠি লিখে C/o Monroe & Co., 7 Rue Scribe, Paris—এই ঠিকানায় পাঠিয়েছি। এখানে জনকয়েক পুরানো বন্ধুও আছেন। মিস ম্যাকলাউড সম্প্রতি ইওরোপ ভ্রমণ করে লণ্ডনে ফিরেছেন। তাঁর স্বভাবটি সোনার মত খাঁটি এবং তাঁর স্নেহপ্রবণ হৃদয়টির কোন পরির্বতন হয়নি। আমরা এই বাড়ীতে বেশ ছোটখাট একটি পরিবার হয়েছি; আর আমাদের সঙ্গে আছেন ভারতবর্ষ থেকে আগত একজন সন্ন্যাসী। ‘বেচারা হিন্দু’ বলতে যা বুঝায়, তা এঁকে দেখলেই বেশ বুঝতে পারবে। সর্বদাই যেন ধ্যানস্থ রয়েছেন, অতি নম্র ও মধুরস্বভাব। আমার যেমন একটা অদম্য সাহস এবং ঘোর কর্মতৎপরতা আছে, তাঁতে তার কিছুই নেই। ওতে চলবে না। আমি তাঁর ভেতর একটু কর্মশীলতা প্রবেশ করিয়ে দেবার চেষ্টা করব। এখনই আমার দুটি করে ক্লাসের অধিবেশন হচ্ছে। চার-পাঁচ মাস ঐরূপ চলবে—তারপর ভারতে যাচ্ছি; কিন্তু আমেরিকাতেই আমার হৃদয় পড়ে আছে—আমি ইয়াঙ্কি দেশ ভালবাসি। আমি সব নূতন দেখতে চাই। পুরাতন ধ্বংসাবশেষের চারদিকে অলসভাবে ঘুরে বেড়িয়ে সারাজীবন প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে হা-হুতাশ করে আর প্রাচীনকালের লোকদের কথা ভেবে ভেবে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে রাজী নই। আমার রক্তের যা জোর আছে, তাতে ঐরূপ করা চলে না। সকল ভাব প্রকাশের উপযুক্ত স্থান, পাত্র ও সুযোগ কেবল আমেরিকাতেই আছে। আমি আমূল পরিবর্তনের ঘোরতর পক্ষপাতী হয়ে পড়েছি। শীঘ্রই ভারতবর্ষে ফিরব, পরিবর্তনবিরোধী থসথসে জেলি মাছের মত ঐ বিরাট পিণ্ডটার কিছু করতে পারি কিনা দেখতে। তারপর প্রাচীন সংস্কারগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নূতন করে আরম্ভ করব—একেবারে সম্পূর্ণ নূতন, সরল অথচ সবল—সদ্যোজাত শিশুর মত নবীন ও সতেজ। যিনি সনাতন, অসীম, সর্বব্যাপী এবং সর্বজ্ঞ, তিনি কোন ব্যক্তিবিশেষ নন—তত্ত্বমাত্র। তুমি আমি সকলেই সেই তত্ত্বের বাহ্য প্রতিরূপ মাত্র। এই অনন্ত তত্ত্বের যত বেশী কোন ব্যক্তির ভিতর প্রকাশিত হয়েছে, তিনি তত মহৎ; শেষে সকলকেই তার পূর্ণ প্রতিমূর্তি হতে হবে; এরূপে এখনও যদিও সকলেই স্বরূপতঃ এক, তথাপি তখনই প্রকৃতপক্ষে সব এক হয়ে যাবে। ধর্ম এ ছাড়া আর কিছুই নয়; এই একত্ব অনুভব বা প্রেমই এর সাধন; সেকেলে নির্জীব অনুষ্ঠান এবং ঈশ্বরসম্বন্ধীয় ধারণাগুলি প্রাচীন কুসংস্কারমাত্র। বর্তমানেও সেগুলিকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করা কেন? পাশেই যখন জীবন ও সত্যের নদী বয়ে যাচ্ছে, তখন আর তৃষ্ণার্তদের নর্দমার জল খাওয়ান কেন? এটা মানুষের স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। পুরাতন সংস্কারগুলোকে সমর্থন করে করে আমি বিরক্ত হয়ে পড়েছি। … জীবন ক্ষণস্থায়ী, সময়ও ক্ষিপ্রগতিতে চলে যাচ্ছে। যে স্থান ও পাত্রে ভাবরাশি সহজে কার্যে পরিণত হতে পারে, সেই স্থান ও পাত্রই প্রত্যেকের বেছে নেওয়া উচিত। হায়! যদি মাত্র বার জন সাহসী, উদার, মহৎ, সরলহৃদয় লোক পেতাম!

আমি নিজে বেশ আছি এবং জীবনটাকে খুব উপভোগ করছি। আমার ভালবাসা জানবে। ইতি

তোমাদের বিবেকানন্দ
…………………………….

২৭৭*
লণ্ডন
৩০ মে, ১৮৯৬

প্রিয় মিসেস বুল,
… গত পরশু অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের সঙ্গে আমার বেশ দেখাশুনা হয়ে গেল। তিনি একজন ঋষিকল্প লোক; তাঁর বয়স ৭০ বৎসর হলেও তাঁকে যুবা দেখায়; এমন কি তাঁর মুখে একটি বার্ধক্যের রেখা নেই। হায়! ভারতবর্ষ ও বেদান্তের প্রতি তাঁর যেরূপ ভালবাসা তার অর্ধেক যদি আমার থাকত! তার উপর তিনি যোগশাস্ত্রের প্রতিও অনুকূল ভাব পোষণ করেন এবং তাতে বিশ্বাস করেন। তবে বুজরুকদের তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না।

সর্বোপরি রামকৃষ্ণ পরমহংসের উপর তাঁর শ্রদ্ধা-ভক্তি অগাধ এবং তিনি ‘নাইন্‌টিন্থ সেঞ্চুরী’তে (Nineteenth Century) তাঁর সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি তাঁকে জগতের সমক্ষে প্রচার করবার জন্য কি করছেন?’ রামকৃষ্ণ তাঁকে অনেক বৎসর যাবৎ মুগ্ধ করেছেন। এটা কি সুসংবাদ নয়?

এখানে কাজকর্ম ধীরে ধীরে—কিন্তু দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হচ্ছে। আগামী রবিবার থেকে জনসাধারণের জন্য আমার বক্তৃতা আরম্ভ হবে, ঠিক হয়েছে। ইতি—

আপনার চিরকৃতজ্ঞ ও স্নেহের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৭৮*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্‌ রোড, লণ্ডন
৩০ মে, ১৮৯৬

প্রিয় মেরী,
তোমার চিঠি এইমাত্র পেলাম। তুমি অবশ্যই ঈর্ষাপরায়ণ হওনি, কিন্তু দীন-দরিদ্র ভারতবর্ষের প্রতি সহসা যেন তোমার করুণা উথলে উঠেছিল। যা হোক, ভয় পাওয়ার কারণ নেই। … সপ্তাহ কয়েক আগে মাদার চার্চের (Mother Church) কাছে পত্র লিখেছিলাম; আজ পর্যন্ত একছত্র জবাব আদায় করতে পারিনি। ভয় হয়, তিনি দলবলসহ সন্ন্যাস গ্রহণ করে কোন ক্যাথলিক মঠে ঢুকে পড়েছেন; ঘরে চার-চারটি আইবুড়ো মেয়ে থাকলে বুড়ী মায়ের পক্ষে সন্ন্যাস না নিয়ে আর উপায় কি?

অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের সঙ্গে বেশ দেখাশুনা হয়ে গেল। তিনি ঋষিকল্প লোক—বেদান্তের ভাবে ভরপুর। তোমার কি মনে হয়? অনেক বছর যাবৎ তিনি আমার গুরুদেবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাসম্পন্ন। তিনি ‘নাইন্‌টিন্থ সেঞ্চুরী’তে গুরুদেবের সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন—তা শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। ভারতসংক্রান্ত নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হল। হায়! ভারতের প্রতি তাঁর প্রেমের অর্ধেকও যদি আমার থাকত!

এখানে আমরা আর একটি ক্ষুদ্র পত্রিকা বার করব। ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর খবর কি? তার প্রচার বাড়াচ্ছ তো? যদি চার জন উৎসাহী আইবুড়ী মিলে একখানা পত্রিকা ভাল রকম চালু করতে না পার তো আমার সকল আশায় জলাঞ্জলি! তুমি মাঝে মাঝে আমার চিঠি পাবে। আমি তো ছুঁচটি নই যে, যেখানে সেখানে হারিয়ে যাব! এখন এখানে ক্লাস খুলেছি। আগামী সপ্তাহ থেকে প্রতি রবিবার বক্তৃতা আরম্ভ করব। ক্লাসগুলি খুব বড় হয়; যে বাড়ীটি সারা মরশুমের জন্য ভাড়া করেছি, সেই বাড়ীতেই ক্লাস হয়। কাল রাত্রে আমি নিজেই রান্না করেছিলাম। জাফরান, লেভেণ্ডার, জয়ত্রী, জায়ফল, কাবাবচিনি, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, মাখন, লেবুর রস, পেঁয়াজ, কিসমিস, বাদাম, গোলমরিচ এবং চাল—এগুলি মিলিয়ে এমনই সুস্বাদু খিচুড়ি বানিয়েছিলাম যে, নিজেই গলাধঃকরণ করতে পারিনি। ঘরে হিং ছিল না, নতুবা তার খানিকটা মিশালে গিলিবার পক্ষে সুবিধা হত।

কাল হালফ্যাশনের এক বিবাহে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু মিস মূলার নাম্নী জনৈকা ধনী মহিলা একটি হিন্দু ছেলেকে দত্তক গ্রহণ করেছেন এবং আমার কাজে সাহায্য করবার জন্য আমি যে বাড়ীতে আছি সেই বাড়ীতেই ঘর ভাড়া করেছেন। তিনিই বিয়ে দেখিবার জন্য আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের অনুষ্ঠান যেন আর শেষ হয় না—কি আপদ! তুমি যে বিয়েতে নারাজ, এতে আমি খুশী। এখন বিদায়। তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানিবে। আর লেখার সময় নাই; এখনি মিস ম্যাক‍লাউডের বাড়ীতে মধ্যাহ্ন-ভোজনে যাচ্ছি। ইতি

তোমাদের চির শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৭৯
ওঁ তৎ সৎ
England
মে (?) ১৮৯৬

প্রিয় শশী,
পূর্বপত্রে যদি ভুল হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই পত্রে লিখি যে, কালী যে দিবস start (যাত্রা) করিবে, সেদিন কিম্বা তাহার আগে যেন E. T. Sturdy (স্টার্ডি)-কে চিঠি লেখে, যাহাতে সে যাইয়া তাহাকে জাহাজ হইতে লইয়া আসে। এ লণ্ডন শহর মানুষের জঙ্গল—দশ পনরটা কলিকাতা একত্রে—অতএব ঐ প্রকার না করিলে গোলমাল হয়ে যাবে। আসতে দেরী যেন না হয়, পত্রপাঠ চলে আসতে বলবে। শরতের বেলার মত যেন না হয়। বাকী বুঝে-সুঝে ঠিক করে নেবে।

কালীকে যাই হোক সত্বর পাঠাবে। যদি শরতের বেলার মত দেরী হয় তো কাহাকেও আসতে হবে না; ও-রকম গড়িমসির কাজ নয়। মহা রজোগুণের কাজ, আমাদের দেশময় খালি তমস্, আমাদের দেশে রজস্ চাই—তারপর সত্ত্ব, সে ঢের দূরের কথা। ইতি

নরেন্দ্র
…………………………….

২৮০*
সেণ্ট জর্জেস্‌ রোড, লণ্ডন
৫ জুন, ১৮৯৬

প্রিয়—,
‘রাজযোগ’ বইখানার খুব কাটতি হচ্ছে। সারদানন্দ শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্রে যাবে।

আমার পিতা যদিও উকিল ছিলেন, তবু আমি ইচ্ছা করি না, আমাদের বংশের কেউ উকিল হয়। আমার গুরুদেব এর বিরুদ্ধে ছিলেন এবং আমার বিশ্বাস, যে পরিবারে কতকগুলি উকিল আছে, সে পরিবারকে নিশ্চয়ই দুর্দশায় পড়তে হবে। আমাদের দেশ উকিলে ছেয়ে গেছে—প্রত্যেক বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শত শত উকিল বার হচ্ছে। আমাদের জাতের পক্ষে এখন দরকার সাহস ও বৈজ্ঞানিক প্রতিভা। সুতরাং আমার ইচ্ছা ম—তড়িত্তত্ত্ববিৎ হয়। সফল হতে না পারলেও সে যে বড় হবার এবং দেশের যথার্থ উপকারে আসবার চেষ্টা করেছিল—এইটুকু ভেবেই আমি সন্তুষ্ট হব। শুধু আমেরিকার বাতাসেই এমন একটি গুণ আছে যে, সেখানকার প্রত্যেকের ভেতর যা কিছু ভাল সমস্তই ফুটিয়ে তোলে। আমি চাই সে অকুতোভয় ও সাহসী হোক এবং তার নিজের ও স্বজাতির জন্য একটা নূতন পথ বার করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করুক। একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়র ভারতে অনায়াসে করে খেতে পারে।

পুঃ—গুডউইন আমেরিকায় একখানি মাসিক পত্র বার করা সম্বন্ধে তোমাকে এই ডাকে একখানা চিঠি লিখেছে। আমার মনে হয়, কাজটি বজায় রাখতে হলে এই রকমের একটা কিছু দরকার। আর সে যেভাবে কাজ করবার প্রস্তাব করছে, তাকে সেইভাবে ঐ বিষয়ে সাহায্য করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। … আমার মনে হয়, সে খুব সম্ভব সারদানন্দের সঙ্গে যাবে।

তোমাদের প্রেমবদ্ধ
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৭১
[স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
১৪ এপ্রিল, ১৮৯৬

কল্যাণীয়া মিস নোব্‌ল্‌,
আমার আদর্শকে বস্তুতঃ অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করা চলে, আর তা এইঃ মানুষের কাছে তার অন্তর্নিহিত দেবত্বের বাণী প্রচার করতে হবে এবং সর্বকার্যে সেই দেবত্ব-বিকাশের পন্থা নির্ধারণ করে দিতে হবে।

কুসংস্কারের শৃঙ্খলে এই সংসার আবদ্ধ। যে উৎপীড়িত—সে নর বা নারীই হোক—তাকে আমি করুণা করি; আর যে উৎপীড়নকারী, সে আমার আরও বেশী করুণার পাত্র।

এই একটা ধারণা আমার কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সকল দুঃখের মূলে আছে অজ্ঞতা, তা ছাড়া আর কিছু না। জগৎকে আলো দেবে কে? আত্মবিসর্জনই ছিল অতীতের কর্মরহস্য; হায়! যুগ যুগ ধরে তাই চলতে থাকবে। যাঁরা জগতে সবচেয়ে সাহসী ও বরেণ্য, তাঁদের চিরদিন ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ আত্মবিসর্জন করতে হবে। অনন্ত প্রেম ও করুণা বুকে নিয়ে শত শত বুদ্ধের আবির্ভাব প্রয়োজন।

জগতের ধর্মগুলি এখন প্রাণহীন মিথ্যা অভিনয়ে পর্যবসিত। জগতের এখন একান্ত প্রয়োজন হল চরিত্র। জগৎ এখন তাঁদের চায়, যাঁদের জীবন প্রেমদীপ্ত এবং স্বার্থশূন্য। সেই প্রেম প্রতিটি কথাকে বজ্রের মত শক্তিশালী করে তুলবে।

এটা আর তোমার কাছে কুসংস্কার নয় নিশ্চিত। তোমার মধ্যে একটা জগৎ-আলোড়নকারী শক্তি রয়েছে, ধীরে ধীরে আরও অনেক শক্তি আসবে। আমরা চাই—জ্বালাময়ী বাণী এবং তার চেয়ে জ্বলন্ত কর্ম। হে মহাপ্রাণ, ওঠ, জাগ! জগৎ দুঃখে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে—তোমার কি নিদ্রা সাজে? এস, আমরা ডাকতে থাকি, যতক্ষণ না নিদ্রিত দেবতা জাগ্রত হন, যতক্ষণ না অন্তরের দেবতা বাইরের আহ্বানে সাড়া দেন। জীবনে এর চেয়ে আর বড় কি আছে? এর চেয়ে মহত্তর কোন্ কাজ আছে? আমার এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গেই আনুষঙ্গিক খুঁটিনাটি সব এসে পড়বে। আমি আটঘাট বেঁধে কোন কাজ করি না। কার্যপ্রণালী আপনি গড়ে ওঠে ও নিজের কার্য সাধন করে। আমি শুধু বলি—ওঠ জাগ।

তুমি চিরকাল অফুরন্ত আশীর্বাদ জানবে। ইতি

শুভাশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৮২
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
২৪ জুন, ১৮৯৬

প্রিয় শশী,
শ্রীজীর৯৬ সম্বন্ধে ম্যাক্সমূলারের লিখিত প্রবন্ধ আগামী মাসে প্রকাশিত হবে। তিনি তাঁর একখানি জীবনী লিখতে রাজী হয়েছেন। তিনি শ্রীজীর সমস্ত বাণী চান। সব উক্তিগুলি সাজিয়ে তাঁকে পাঠাও—অর্থাৎ কর্মসম্বন্ধে সব এক জায়গায়, বৈরাগ্য সম্বন্ধে অন্যত্র, ঐরূপ ভক্তি, জ্ঞান ইত্যাদি ইত্যাদি সম্বন্ধে। তোমাকে এ কাজ এখনই শুরু করতে হবে। শুধু যে সব কথা ইংরেজীতে অচল, সেগুলি বাদ দিও।* বুদ্ধি করে সে-সকল জায়গায় যথাসম্ভব অন্য কথা দিবে। ‘কামিনী-কাঞ্চন’কে ‘কাম-কাঞ্চন’ করবে—lust and gold etc.—অর্থাৎ তাঁর উপদেশে সর্বজনীন ভাবটা প্রকাশ করা চাই। এই চিঠি কাহাকেও দেখাবার আবশ্যক নাই। তুমি উক্ত কার্য সমাধা করে সমস্ত উক্তি ইংরেজী তর্জমা ও classify (শ্রেণীবিভাগ) করে ‘প্রফেসর ম্যাক্সমূলার, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইংলণ্ড’—ঠিকানায় পাঠাবে।

শরৎ কাল আমেরিকায় চলল। এখানকার কাজ পেকে উঠেছে। লণ্ডনে একটি centre-এর (কেন্দ্রের) জন্য টাকা already (এর আগেই) উঠে গেছে। আমি next (আগামী) মাসে Switzerland (সুইজরলণ্ড) গিয়ে এক দুই মাস থাকব। তারপর আবার লণ্ডনে। আমার শুধু দেশে গিয়ে কি হবে? এই লণ্ডন হল—দুনিয়ার centre (কেন্দ্র)। India-র heart (ভারতের হৃৎপিণ্ড) এখানে। এখানে একটা গেড়ে না বসিয়ে কি যাওয়া হয়? তোরা পাগল নাকি? সম্প্রতি কালীকে আনাব, তাকে তৈয়ার থাকতে বলো। পত্রপাঠ যেন চলে আসে। দুই চারি দিনের মধ্যে তার জন্য টাকা পাঠাব ও কাপড়-চোপড় প্রভৃতি যা যা দরকার সমস্তই লিখে দেব। সেইমত সমস্ত ঠিক করা হয় যেন।

মাতাঠাকুরাণী প্রভৃতি সকলকে আমার অসংখ্য প্রণাম দিবে। মান্দ্রাজে তারকদাদা যাচ্ছেন—উত্তম কথা।

মহাতেজ, মহাবীর্য, মহা উৎসাহ চাই। মেয়ে-নেকড়ার কি কাজ? যে রকম লিখে- ছিলাম পূর্বপত্রে, সেই রকম ঠিক চলতে চেষ্টা করবে। Organization (সঙ্ঘ) চাই।

Organization is power and the secret of that is obedience (সঙ্ঘই শক্তি, আর আজ্ঞাবহতাই হল তার গূঢ় রহস্য)। কিমধিকমিতি

নরেন্দ্র
…………………………….

২৮৩
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
কেভার্শ্যাম রিডিং,
৩ জুলাই, ১৮৯৬

প্রিয় শশী,
এই পত্রপাঠ কালীকে ইংলণ্ডে পাঠাইয়া দিবে। পূর্বের পত্রে সংবাদ পাইয়াছ। কলিকাতার মেসার্স গ্রিণ্ডলে কোম্পানীর নিকট তাহার 2nd class passage (দ্বিতীয় শ্রেণীর পাথেয় খরচ) গিয়াছে ও কাপড়-চোপড় কিনিতে যাহা কিছু লাগে তাহাও গিয়াছে। কাপড়-চোপড় অধিক কিছু আবশ্যক নাই।

কালীকে কতকগুলি বই আনতে হবে। আমার কাছে কেবল ঋগ্বেদ-সংহিতা আছে। কালী যজুর্বেদ সামবেদ অথর্ব-সংহিতা ও শতপথাদি যতগুলি ব্রাহ্মণ পাওয়া যায় এবং কতকগুলি সূত্র ও যাস্কর নিরুক্ত যদি পায়, সঙ্গে করেই যেন আনে। অর্থাৎ ঐ বইগুলি আমার চাই। … ঐ বই একটা কাঠের বাক্সয় পুরে আনলেই হবে।

গড়িমসি যেমন শরতের বেলায় হয়েছিল, তা যেন না হয়; পত্রপাঠ চলে আসবে। শরৎ আমেরিকায় চলে গেছে। আর এখানে কোন কাজ ছিল না—অর্থাৎ ছ-মাস বাদে এল, তখন আমি এখানে। সে প্রকার না হয় যেন। চিঠি হারিয়ে যেন না যায়—শরতের বেলার মত। তৎপর পাঠিয়ে দিবে। ইতি

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৮৪*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্‌ রোড, লণ্ডন
৬ জুলাই, ১৮৯৬

প্রিয় ফ্র্যাঙ্কিন‍্‍সেন্স,৯৭
… আটলাণ্টিকের এপারে এসে আমি বেশ আছি এবং আমার কাজকর্ম খুব ভালভাবেই চলছে।

আমার রবিবারের বক্তৃতাগুলি লোকের খুব হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল, ক্লাসগুলিও বেশ চলেছিল। এখন কাজের মরসুম শেষ হয়ে গেছে—আমিও সম্পূর্ণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এখন মিস মূলারের সঙ্গে সুইজরলণ্ডে বেড়াতে যাচ্ছি। গলস‍্‍ওয়ার্দিরা আমার সঙ্গে খুবই সদয় ব্যবহার করেছেন। জো বড় অদ্ভুতভাবে তাঁদের এদিকে ফিরিয়েছেন। আমি জো-র বুদ্ধিমত্তা ও নীরব কার্য-প্রণালীর প্রশংসা না করে থাকতে পারছি না। তিনি একজন মহিলা রাজনীতিবিদ্, একটা রাজ্য চালাতে পারেন। মানুষের ভেতর এমন তীক্ষ্ণ অথচ কল্যাণকর সহজ বুদ্ধি খুব অল্পই দেখেছি।

গত পরশু সন্ধ্যায় আমি মিসেস মার্টিনের বাড়ীতে একটা পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়েছিলাম। উক্ত মহিলা সম্বন্ধে তুমি নিশ্চয়ই ইতোমধ্যেই জো-র পত্রে অনেক খবর পেয়েছ।

যা হোক ইংলণ্ডে কাজ খুব আস্তে আস্তে অথচ সুনিশ্চিতভাবে বেড়ে চলেছে। এখানকার অন্ততঃ অর্ধেক নরনারী আমার সঙ্গে দেখা করে আমার কাজ সম্বন্ধে আলোচনা করেছে। এই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যতই ত্রুটি থাকুক, এটি যে চারিদিকে ভাব ছড়াবার সর্বশ্রেষ্ঠ যন্ত্র, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। আমার সংকল্প—এই যন্ত্রের কেন্দ্রস্থলে আমার ভাবরাশি প্রচার করব—তাহলেই সেগুলি সমগ্র জগতে ছড়িয়ে যাবে। অবশ্য সব বড় বড় কাজই খুব আস্তে আস্তে হয়ে থাকে। বিশেষ আমাদের হিন্দুদের—বিজিত জাতি বলে কাজের বাধাবিঘ্নও অনেক। কিন্তু এও বলি, যেহেতু আমরা বিজিত, সেইহেতু আমাদের ভাব চারিদিকে ছড়াতে বাধ্য! কারণ দেখা যায়, আধ্যাত্মিক আদর্শ চিরকালই বিজিত পদদলিত জাতির মধ্য থেকে উদ্ভূত হয়েছে। দেখ না, য়াহুদীরা তাদের আদর্শে রোম সাম্রাজ্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।

তুমি জেনে সুখী হবে যে, আমিও দিন দিন সহিষ্ণুতা ও সর্বোপরি সহানুভূতির শিক্ষা আয়ত্ত করছি। মনে হয়, প্রবল-প্রতাপশালী এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের মধ্যেও যে ভগবান্ রয়েছেন, আমি তা উপলব্ধি করতে আরম্ভ করেছি। মনে হয়, আমি ধীরে ধীরে সেই অবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যেখানে শয়তান বলে যদি কেউ থাকে, তাকে পর্যন্ত ভালবাসতে পারব।

বিশ বছর বয়সের সময় আমি এমন গোঁড়া বা একঘেয়ে ছিলাম যে, কারও প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারতাম না—আমার ভাবের বিরুদ্ধে হলে কারও সঙ্গে বনিয়ে চলতে পারতাম না, কলিকাতার যে ফুটপাতে থিয়েটার, সেই ফুটপাতের উপর দিয়ে চলতাম না পর্যন্ত। এখন এই তেত্রিশ বৎসর বয়সে বেশ্যাদের সঙ্গে অনায়াসে এক বাড়ীতে বাস করতে পারি—তাদের তিরস্কার করবার কথা একবার মনেও উঠবে না!, এ কি আমি ক্রমশঃ খারাপ হয়ে যাচ্ছি—না, আমার হৃদয় ক্রমে উদার হয়ে অনন্ত প্রেম বা সাক্ষাৎ সেই ভগবানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে? আবার লোকে বলে, শুনতে পাই, যে ব্যক্তি চারদিকে মন্দ ও অমঙ্গল দেখতে পায় না, সে ভাল কাজ করতে পারে না—এক রকম অদৃষ্টবাদী হয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে যায়! আমি তো তা দেখছি না; বরং আমার কর্মশক্তি প্রবলভাবে বেড়ে যাচ্ছে—সঙ্গে সঙ্গে কাজের সফলতাও খুব হচ্ছে। কখনও কখনও আমার এক ধরনের ভাবাবেশ হয়—মনে হয়, জগতের সবাইকে—সব জিনিষকে আশীর্বাদ করি, সব জিনিষকে ভালবাসি, আলিঙ্গন করি। তখন দেখি—যাকে মন্দ বলে, সেটা একটা ভ্রান্তিমাত্র! প্রিয় ফ্র্যান্সিস, এখন আমি সেই রকম ভাবের ঘোরে রয়েছি, আর তুমি ও মিসেস লেগেট আমায় কত ভালবাস ও আমার প্রতি তোমাদের কত দয়া, তাই ভেবে সত্যসত্যই আনন্দাশ্রু বিসর্জন করছি। আমি যেদিন জন্মগ্রহণ করেছি, সেই দিনটিকে ধন্যবাদ! আমি এখানে কত দয়া, কত ভালবাসা পেয়েছি! আর যে অনন্ত প্রেমস্বরূপ থেকে আমার আবির্ভাব, তিনি আমার ভাল মন্দ (‘মন্দ’ কথাটিতে ভয় পেও না) প্রত্যেক কাজটি লক্ষ্য করে আসছেন। কারণ আমি তাঁর হাতের একটা যন্ত্র বৈ আর কি—কোন্ কালেই বা তা ছাড়া আর কি ছিলাম? তাঁর সেবার জন্য আমি আমার সর্বস্ব ত্যাগ করেছি, আমার প্রিয়জনদের ত্যাগ করেছি, সব সুখের আশা ছেড়েছি, জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছি। তিনি আমার সদালীলাময় আদরের ধন, আমি তাঁর খেলার সাথী। এই জগতের কাণ্ডকারখানার কোনখানে কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না—সব তাঁর খেলা, সব তাঁর খেয়াল। কোন্ কারণে তিনি আবার যুক্তির দ্বারা চালিত হবেন? লীলাময় তিনি—এই জগৎ-নাট্যের সব অংশেই তিনি এই সব হাসিকান্নার অভিনয় করছেন। জো যেমন বলে—ভারি মজা, ভারি মজা!

এ তো বড় মজার জগৎ! আর সকলের চেয়ে মজার লোক তিনি—সেই অনন্ত প্রেমাস্পদ প্রভু! সব জগৎটা খুব মজা নয় কি? আমাদের পরস্পরের ভ্রাতৃভাবই বল আর খেলার সাথীর ভাবই বল, এ যেন জগতের ক্রীড়াক্ষেত্রে একদল স্কুলের ছেলেকে খেলতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, আর সকলে চেঁচামেচি করে খেলা করছে! তাই নয় কি? কাকে সুখ্যাতি করব, কাকে নিন্দা করব? এ যে সবই তাঁর খেলা। লোকে জগতের ব্যাখ্যা চায়, কিন্তু তাঁকে ব্যাখ্যা করবে কেমন করে? তাঁর তো মাথা-মুণ্ডু কিছু নেই—বিচারের কোন ধার ধারেন না। তিনি ছোটখাট মাথা ও বুদ্ধি দিয়ে আমাদের বোকা সাজিয়েছেন; কিন্তু এবার আর আমায় ঠকাতে পারছেন না, আমি এবার খুব হুঁশিয়ার ও সজাগ আছি।

আমি এতদিনে দু-একটা বিষয় শিখেছি। শিখেছি—ভাব, প্রেম, প্রেমাস্পদ সব যুক্তিবিচার বিদ্যা-বুদ্ধি ও বাক্যাড়ম্বরের বাইরে, ও-সব থেকে অনেক দূরে। ‘সাকি’,৯৮ পেয়ালা পূর্ণ কর—আমরা প্রেমমদিরা পান করে পাগল হয়ে যাই। ইতি

তোমারই
সদাপাগল বিবেকানন্দ
…………………………….

২৮৫*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
লণ্ডন
৭ জুলাই, ১৮৯৬

স্নেহের খুকীরা,
এখানকার কাজ আশ্চর্যভাবে এগিয়ে চলেছে। এখানে ভারত থেকে একজন সন্ন্যাসী এসেছিলেন। তাঁকে আমেরিকায় পাঠিয়েছি এবং ভারত থেকে আর একজনকে পাঠাতে বলেছি। এখানকার মরসুম শেষ হয়েছে; সুতরাং ক্লাস ও রবিবারের বক্তৃতাগুলি আগামী ১৬ থেকে বন্ধ হয়ে যাবে। আর সুইজরলণ্ডের পাহাড়ে শান্তি ও বিশ্রামের জন্য ১৯ তারিখে আমি যাচ্ছি—মাসখানেকের জন্য। আবার শরৎকালে লণ্ডনে ফিরে কাজ আরম্ভ করা যাবে। এখানে কাজ খুবই আশাজনক হয়েছে। এখানে আগ্রহ জাগিয়ে—আমি প্রকৃতপক্ষে ভারতে থেকে যা করতে পারতাম, তার চেয়ে বেশী ভারতের জন্যই করছি। মা (মিসেস হেল) আমাকে লিখেছেন যে, তোমরা যদি ফ্ল্যাট-বাড়ীটা ভাড়া দিতে পার, তাহলে তিনি সানন্দে তোমাদের মিশর দর্শনে নিয়ে যেতে পারেন। আমি তিনজন ইংরেজ বন্ধুর সঙ্গে সুইজরলণ্ডের পাহাড়ে যাচ্ছি। পরে শীতের শেষে কয়েকজন ইংরেজ বন্ধুকে নিয়ে ভারতে যাবার আশা করি। তাঁরাও আমার মঠে থাকতে যাচ্ছেন, মঠ হবার পরিকল্পনা চলছে মাত্র। হিমালয়ের কোথাও সেটা বাস্তবে রূপ নেবার চেষ্টা করছে।

তোমরা কোথায় আছ? এখন তো পুরাদস্তুর গরমিকাল—এমন কি লণ্ডনও খুবই তেতে উঠেছে। দয়া করে মিসেস এডামস্, মিসেস কংগার এবং চিকাগোতে অন্য বন্ধুদের আমার গভীর ভালবাসা জানিও।

তোমাদের স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৮৬*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
৮ জুলাই, ১৮৯৬

প্রিয়—,
ইংরেজ জাতটা খুব উদার। সেদিন মিনিট তিনেকের মধ্যেই আমার ক্লাস থেকে আগামী শরৎকালের কাজের নূতন বাড়ীর জন্য ১৫০ পাউণ্ড (প্রায় ২২৫০ টাকা) চাঁদা উঠেছে। এমন কি, চাইলে তারা সেই মুহূর্তেই ৫০০ পাউণ্ড দিত। কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে কাজ করতে চাই—হঠাৎ কতকগুলো খরচপত্র করতে চাই না। এখানে এই কাজটা চালাতে অনেক লোক পাওয়া যাবে, যারা ত্যাগের ভাব কতকটা বোঝে—ইংরেজ-চরিত্রের গভীরতা এখানেই (যে ভাবটা তাদের মাথার ভেতর ঢোকে, সেটা কিছুতেই ছাড়তে চায় না)। ইতি

বিবেকানন্দ
…………………………….

২৮৭*
ইংলণ্ড
১৪ জুলাই, ১৮৯৬

প্রিয় নাঞ্জুণ্ড রাও,
‘প্রবুদ্ধ ভারত’গুলি পৌঁছেছে এবং ক্লাসে বিলি করাও হয়েছে। পত্রিকা খুব সন্তোষজনক হয়েছে; ভারতে এর যথেষ্ট প্রচলন হবে নিশ্চয়। আমেরিকাতেও এর কিছু গ্রাহক হতে পারে। ইতোমধ্যেই আমি আমেরিকায় এই কাগজটার বিজ্ঞাপন দেবার ব্যবস্থা করেছি এবং গুডইয়ার ইতোমধ্যেই তা করে ফেলেছে। কিন্তু এখানে (ইংলণ্ডে) কাজ অপেক্ষাকৃত ধীরে অগ্রসর হবে। এখানে মুশকিল এই যে, এরা সকলেই নিজেদের কাগজ বের করতে চায়। আর এমনই হওয়া উচিত; কারণ সত্যি বলতে গেলে কোন বিদেশীই খাঁটি ইংরেজের মত তেমন ভাল ইংরেজী লিখতে পারে না, এবং খাঁটি ইংরেজীতে লিখলে ভাবের যা বিস্তার হবে, হিন্দু-ইংরেজীতে তা হতে পারে না। তারপর বিদেশী ভাষায় প্রবন্ধ লেখার চেয়ে গল্প লেখা আরও শক্ত।

আমি এখানে গ্রাহক-সংগ্রহের চেষ্টায় আছি; কিন্তু বিদেশী সাহায্যের উপর একদমই একেবারেই নির্ভর করবেন না। ব্যক্তির মত জাতিকেও নিজেকে নিজে সাহায্য করতে হবে। এই হচ্ছে ঠিক ঠিক স্বদেশপ্রেম। যদি কোন জাতি তা করতে না পারে, তবে বলতে হবে—তার এখনও সময় হয়নি, তাকে অপেক্ষা করতে হবে। মান্দ্রাজ থেকেই এই নূতন আলোক ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া চাই—এই উদ্দেশ্য নিয়েই আপনাকে কাজ করতে হবে। একটি বিষয়ে কিন্তু আমার একটু মন্তব্য করতে হল—মলাটটা একেবারে রুচিহীন—অতি বিশ্রী ও কদর্য। সম্ভব হলে এটাকে বদলে ফেলুন। এটাকে ভাবব্যঞ্জক অথচ সরল করুন—আর এতে মানুষের মূর্তি মোটেই রাখবেন না। বটবৃক্ষ মোটেই প্রবুদ্ধ হওয়ার চিহ্ন নয়, পাহাড়ও তা নয়, ঋষিরাও নন, ইওরোপীয় দম্পতিও নন। পদ্মফুলই হচ্ছে পুনরভ্যুত্থানের প্রতীক। চারুশিল্পে আমরা বড়ই পেছিয়ে আছি—বিশেষতঃ চিত্রশিল্পে। বনে বসন্ত জেগেছে, বৃক্ষলতায় নবকিশলয় আর মুকুল দেখা দিয়েছে—এই ভাবের একটি বনের ছবি আঁকুন দেখি। কত ভাবই তো রয়েছে—ধীরে ধীরে তা চিত্রশিল্পে ফুটিয়ে তুলুন। লণ্ডনের গ্রীনম্যান কোম্পানী যে ‘রাজযোগ’ ছেপেছে, তাতে আমার তৈরী প্রতীকটি দেখুন—আপনি বোম্বেতে তা পাবেন। আমি নিউ ইয়র্কে রাজযোগ সম্বন্ধে যে-সব বক্তৃতা দিয়েছিলাম, সেগুলি এই পুস্তকে আছে।

আমি আগামী রবিবার সুইজরলণ্ডে যাচ্ছি, এবং শরৎকালে ইংলণ্ডে ফিরে এসে আবার কাজ শুরু করব। সম্ভব হলে আমি সুইজরলণ্ড থেকে আপনাকে ধারাবাহিকভাবে কতকগুলি প্রবন্ধ পাঠাব। আপনি জানেন, আমার পক্ষে বিশ্রাম খুব দরকার হয়ে পড়েছে।

একান্ত আশীর্বাদক ও শুভানুধ্যায়ী
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৮৮*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
স্যান্স গ্রাণ্ড, সুইজরলণ্ড
২৫ জুলাই, ১৮৯৬

প্রিয়—,
আমি জগৎটাকে একেবারে ভুলে যেতে চাই, অন্ততঃ আসছে দু-মাসের জন্য; একটু কঠোর সাধনা করতে চাই। ওই আমার বিশ্রাম। … পাহাড় এবং বরফ দেখলে আমার মনে এক অপূর্ব শান্তির ভাব আসে। এখন আমার যেমন সুনিদ্রা হচ্ছে, এমন অনেক দিন হয়নি।

বন্ধুদের আমার ভালবাসা জানাবেন।

আপনাদের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৮৯*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ

গ্র্যাণ্ড হোটেল, ভ্যালে
সুইজরলণ্ড
আমি অল্পস্বল্প পড়াশুনা করছি—উপোস করছি অনেক এবং সাধনা করছি তার চেয়েও বেশী। বনে বনে বেরিয়ে বেড়ানটা অতি আরামপ্রদ। আমাদের বাসস্থানটি তিনটি বিরাট তুষার-প্রবাহের নীচে এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম।

ভাল কথা, সুইজরলণ্ডের হ্রদে আর্যদের আদি বাসভূমি সম্বন্ধে আমার মনে যা-ও একটু সন্দেহের ভাব ছিল, তা একেবারে চলে গেছে; তাতারদের মাথা থেকে লম্বা টিকিটা সরিয়ে দিলে যা দাঁড়ায়, সুইজরলণ্ডের অধিবাসীরা হচ্ছে তাই।

স্নেহাশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৯০*
[লালা বদ্রী শাহকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
রিডিং, লণ্ডন৯৯
৫অগষ্ট, ১৮৯৬
আপনার সহৃদয় অভিনন্দনের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আপনার কাছে একটি বিষয় জানবার আছে। দয়া করে সংবাদটি জানালে বিশেষ বাধিত হব। আমি একটা মঠ স্থাপন করতে চাই—আলমোড়ায় বা আলমোড়ার কাছে হলেই ভাল। আমি শুনেছি, মিঃ র‍্যা‍মজে নামে জনৈক ভদ্রলোক আলমোড়ার কাছে একটি বাংলোতে বাস করতেন, ঐ বাংলোর চারিদিকে একটি বাগান আছে। ঐ বাংলোটি কেনা সম্ভব হবে কি? দাম কত? যদি কেনা সম্ভব না হয়, তবে ভাড়া পাওয়া যাবে কি?

আলমোড়ার কাছে কোন সুবিধামত জায়গা আপনার জানা আছে কি, যেখানে বাগবাগিচা সহ আমাদের মঠ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? সঙ্গে বাগান প্রভৃতি অবশ্যই থাকা চাই। একটা গোটা ছোট পাহাড় হলেই ঠিক আমার মনোমত হয়।

আশা করি, শীঘ্র আপনার উত্তর পাব। আপনি এবং আলমোড়ার অন্যান্য সব বন্ধুরা আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা জানবেন। ইতি

আপনাদের
বিবেকানন্দ
…………………………….

২৯১*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
সুইজরলণ্ড
৫ অগষ্ট, ১৮৯৬
আজ সকালে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের একখানি পত্র এসেছে; তাতে খবর পেলাম যে, শ্রীরামকৃষ্ণ-সম্বন্ধীয় প্রবন্ধটি ‘নাইন্‌টিন্থ সেঞ্চুরী’ পত্রিকার অগষ্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।তুমি কি তা পড়েছ? তিনি ঐ বিষয়ে আমার মত চেয়েছেন। এখনও তা দেখিনি বলে তাঁকে কিছু লিখতে পারছি না। তুমি যদি তা পেয়ে থাক তো দয়া করে আমায় পাঠিয়ে দিও। ‘ব‍্রহ্মবাদিনে’র কোন সংখ্যা এসে থাকলে তাও পাঠিও। ম্যাক্সমূলার আমাদের কার্যধারা জানতে চান, … এবং মাসিক পত্রিকা সম্বন্ধেও খবর চান। তিনি যথেষ্ট সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সম্বন্ধে একখানি গ্রন্থ লিখতে প্রস্তুত আছেন।

আমার মনে হয়, পত্রিকাদি সম্বন্ধে তাঁর সঙ্গে তোমার সরাসরি পত্রালাপ করাই উচিত। ‘নাইন্‌টিন্থ সেঞ্চুরী’ পড়ার পরে তাঁর পত্রের উত্তর দিতে যখন আমি তোমাকে তাঁর চিঠিখানি পাঠিয়ে দেব, তখন তুমি দেখতে পাবে যে, আমাদের প্রচেষ্টায় তিনি কত খুশী হয়েছেন এবং যথাসাধ্য সাহায্য করতে রাজী আছেন।

পুনশ্চ—আশা করি, বড় পত্রিকাখানি সম্বন্ধে ভাল করে ভেবে দেখবে। আমেরিকায় কিছু টাকা তুলতে পারা যাবে এবং কাগজখানি নিজেদের হাতেই রাখা যাবে। তুমি ও ম্যাক্সমূলার কি প্রকার কার্যধারা ঠিক কর, তা জেনে আমি আমেরিকায় পত্র লিখব ভেবেছি।

যে গাছের ফল ও ছায়া আছে, তারই আশ্রয় নিতে হয়; ফল যদি নাই বা পাওয়া যায়, ছায়া থেকে তো কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না?১০০ সুতরাং শিক্ষণীয় এই যে, বড় বড় কাজ এভাবেই করা উচিত।
…………………………….

২৯২*
সুইজরলণ্ড
৬ অগষ্ট, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
‘ব‍্রহ্মবাদিন্’ কতটা আর্থিক দুরবস্থায় পড়েছে, তা তোমার পত্রে জানলাম। লণ্ডনে যখন ফিরে যাব, তখন তোমায় সাহায্য করতে চেষ্টা করব। তুমি সুর নামিও না যেন—কাগজখানি চালিয়ে যাও; অতি শীঘ্রই তোমায় এমন সাহায্য করতে পারব যে, বাজে শিক্ষকতার কাজ থেকে তুমি অব্যাহতি পাবে। ভয় পেও না; বড় বড় সব কাজ হবে, বৎস! সাহস অবলম্বন কর। ‘ব‍্রহ্মবাদিন্’ একটি রত্নবিশেষ, একে নষ্ট হতে দেওয়া হবে না। অবশ্য এ-জাতীয় পত্রিকাকে সর্বদাই ব্যক্তিগত বদান্যতার দ্বারা বাঁচিয়ে রাখতে হয়, আর আমরা তাই করব। আরও মাস-কয়েক আঁকড়ে পড়ে থাক।

ম্যাক্সমূলারের শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় প্রবন্ধটি ‘নাইন্‌টিন্থ সেঞ্চুরীতে’ বেরিয়েছে। সেটি পেলেই আমি তোমায় পাঠিয়ে দেব। তিনি আমাকে চমৎকার সব চিঠি লেখেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের একখানি বড় জীবনী লেখবার উপাদান চান।

কলিকাতায় লিখে দাও, যেন তারা যতটা সম্ভব উপাদান যোগাড় করে তাঁকে পাঠায়।

আমেরিকার কাগজে প্রেরিত সংবাদটি আমি আগেই পেয়েছি। ওটি ভারতবর্ষে প্রকাশ করবে না। সংবাদপত্রে এই সব হইচই ঢের হয়ে গেছে; আমার অন্ততঃ এ সবে বিরক্তি এসে গেছে। মূর্খেরা যাই বলুক না কেন, আমরা আমাদের কাজ করে যাব। সত্যকে কেউ চেপে রাখতে পারবে না।

Organization is power and the secret of that is obedience দেখতেই পাচ্ছ, আমি এখন সুইজরলণ্ডে রয়েছি, আর ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছি। পড়া বা কোন লেখার কাজ আমি করতে পারছি না—করাও উচিত নয়। লণ্ডনে আমার এক মস্ত কাজ পড়ে আছে, আগামী মাস থেকে তা শুরু করতে হবে। আগামী শীতে আমি ভারতে ফিরব এবং সেখানকার কাজটাকে দাঁড় করাব।

সকলে আমার ভালবাসা জানবে। সাহসে বুক বেঁধে কাজ করে যাও, পিছু হটো না—‘না’ বলো না। কাজ কর—প্রভু পেছনে আছেন। মহাশক্তি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছেন। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ

পুনশ্চ—ভয় পেও না; টাকা ও আর সব শীঘ্রই আসবে।
…………………………….

২৯৩*
[পাশ্চাত্য শিষ্য স্বামী কৃপানন্দকে লিখিত]
সুইজরলণ্ড
অগষ্ট, ১৮৯৬
পবিত্র হও ও সর্বোপরি অকপট হও; মুহূর্তের জন্যও ভগবানে বিশ্বাস হারিও না—তাহলেই আলো দেখতে পাবে। যা কিছু সত্য, তাই চিরস্থায়ী; কিন্তু যা সত্য নয়, তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। বর্তমান ক্ষিপ্র অনুসন্ধিৎসার যুগে জন্মগ্রহণ করে আমরা অনেকটা সুবিধা পেয়েছি। অন্যে যাই ভাবুক আর করুক, তুমি কখনও তোমার পবিত্রতা, নীতি ও ভগবৎপ্রেমের উচ্চ আদর্শ খর্ব করো না। সর্বোপরি সব রকম গুপ্ত সমিতির বিষয়ে সতর্ক থেক। ভগবৎ-প্রেমিকের পক্ষে চালাকিতে ভীত হবার কিছুই নেই। স্বর্গে ও মর্ত্যে পবিত্রতাই সবচেয়ে মহৎ ও দিব্য শক্তি। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম, সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।’—সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার নয়; সত্যের মধ্য দিয়েই দেবযান মার্গ চলেছে। কে তোমার সহগামী হল বা না হল, তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামিও না; শুধু প্রভুর হাত ধরে থাকতে যেন কখনও ভুল না হয়; তাহলেই যথেষ্ট।

গতকাল আমি ‘মণ্টি রোজা’র তুষারপ্রবাহের ধারে গিয়েছিলাম এবং সেই চিরতুষারের প্রায় মাঝখানে জাত কয়েকটি শক্ত পাপড়িবিশিষ্ট ফুল তুলে এনেছিলাম। তারই একটি চিঠির মধ্যে তোমাকে পাঠাচ্ছি—আশা করি, জাগতিক জীবনের সর্বপ্রকার বাধা-বিপর্যয়রূপ হিমরাশি ও তুষারপাতের মধ্যে তুমিও ঐ রকম আধ্যাত্মিক দৃঢ়তা লাভ করবে।

তোমার স্বপ্নটি খুবই সুন্দর। স্বপ্নে আমরা আমাদের মনের এমন একটা স্তরের পরিচয় পাই, যা জাগ্রত অবস্থায় কখনও পাই না, এবং কল্পনা যতই অবাস্তব হোক না কেন, অজ্ঞাত আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ তার পশ্চাতেই অবস্থান করে। সাহস অবলম্বন কর। মানবজাতির কল্যাণের জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব—বাকী সব প্রভুই জানেন।

অধীর হয়ো না, তাড়াহুড়ো করো না। ধীর, একনিষ্ঠ এবং নীরব কর্মই সফল হয়। প্রভু অতি মহান্। বৎস, আমরা সফল হবই—সফল হতেই হবে। তাঁর নাম ধন্য হোক।

এখানে … কোন আশ্রম নেই। একটি থাকলে কী সুন্দরই না হত! আমি তাতে কতই না আনন্দিত হতাম এবং তাতে এদেশের কতই না কল্যাণ হত!
…………………………….

২৯৪*
সুইজরলণ্ড
৮ অগষ্ট, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
কয়েকদিন পূর্বে তোমায় একখানি পত্র লিখেছি। সম্প্রতি আমার পক্ষে তোমায় জানান সম্ভবপর হয়েছে, ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর জন্য আমি এইটুকু করতে পারবঃ তোমায় দু-এক বছরের জন্য মাসিক ১০০ টাকা হিসাবে অর্থাৎ বছরে ৬০ বা ৭০ পাউণ্ড হিসাবে, যাতে মাসে ১০০ পুরা হয়; এমন সাহায্য করতে পারব, তাতে তুমি নিজে স্বাধীন হয়ে ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর কাজ করতে পারবে ও সেটিকে ভাল করে দাঁড় করাতে পারবে। মণি আয়ার এবং অন্য কয়েকটি বন্ধু কিছু টাকা তুলে পত্রিকার মুদ্রণ প্রভৃতির ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন। গ্রাহকদের চাঁদা থেকে কত আয় হয়? তা খরচ করে ভাল ভাল লেখকদের কাছ থেকে ভাল ভাল প্রবন্ধ সংগ্রহ করা চলে না কি? ‘ব্রহ্মবাদিনে’ যা কিছু বেরুবে, তার সবটাই যে সকলকে বুঝতে হবে, তার কোন মানে নাই; কিন্তু দেশপ্রেম-প্রণোদিত হয়ে ও পুণ্যসঞ্চয়ের জন্য সকলের এ-পত্রিকার গ্রাহক হওয়া উচিত—অবশ্য আমি হিন্দুদের লক্ষ্য করেই এ কথা বলছি।

[তোমাদের] কয়েকটি গুণ থাকা প্রয়োজনঃ

প্রথমতঃ হিসাবপত্র সম্বন্ধে বিশেষ সততা অবলম্বনীয়। এই কথা বলতে গিয়ে আমি এমন কোন আভাস দিচ্ছি না যে, তোমাদের মধ্যে কারও পদস্খলন হবে, পরন্তু কাজকর্মে হিন্দুদের একটা অদ্ভুত অগোছালো ভাব আছে—হিসাবপত্র রাখার বিষয়ে তাদের তেমন সুশৃঙ্খলা বা আঁট নাই; হয়তো কোন বিশেষ ফণ্ডের টাকা নিজের কাজে লাগিয়ে ফেলে এবং ভাবে শীঘ্রই তা ফিরিয়ে দেব—ইত্যাদি।

দ্বিতীয়তঃ ‘ব্রহ্মবাদিন্‌’টিকে ভালভাবে পরিচালনা করার উপর তোমার মুক্তি নির্ভর করে, এই ভাব নিয়ে উদ্দেশ্য-সিদ্ধি বিষয়ে পূর্ণ নিষ্ঠা প্রয়োজন। এই পত্রিকাই তোমার ইষ্টদেবতাস্বরূপ হোক; তাহলেই দেখবে সাফল্য কেমন করে আসে। এর আগেই অভেদানন্দকে ভারতবর্ষ থেকে ডেকে পাঠিয়েছি। আশা করি, পূর্বের ‘স্বামী’ (সন্ন্যাসী)-কে পাঠাবার সময় যেমন দেরী হয়েছিল, এবারে তেমন হবে না। এই চিঠি পেয়ে তুমি আমায় ‘ব‍্রহ্মবাদিন্’-এর সমস্ত আয়ব্যয়ের একটা পরিষ্কার হিসাব পাঠিও—যাতে আমি বুঝতে পারি, কি করা উচিত। মনে রেখো—অখণ্ড পবিত্রতা ও গুরুর প্রতি স্বার্থশূন্য একান্ত আজ্ঞাবহতাই সকল সিদ্ধির মূল।

দু-বৎসরের মধ্যে আমরা ‘ব্রহ্মবাদিন্‌’কে এরূপ দাঁড় করাব যে, পত্রিকার আয় থেকে শুধু যে খরচ চলে যাবে তা নয়, স্বতন্ত্র একটু আয়ও হবে। বিদেশে ধর্ম-পত্রিকার বেশী কাটতি হওয়া অসম্ভব; সুতরাং হিন্দুদের মধ্যে যদি এখনও কিছুমাত্র ধর্মজ্ঞান বা কৃতজ্ঞতা অবশিষ্ট থাকে, তবে এ পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা তাদেরই করতে হবে।

ভাল কথা, এনি বেসাণ্ট (Annie Besant) একদিন আমাকে তাঁদের সমিতিতে ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে বক্তৃতা করবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমি এক সন্ধায় বক্তৃতা দিই—কর্ণেল অল‍্কট্ (Col. Olcott)-ও উপস্থিত ছিলেন। সকল সম্প্রদায়ের প্রতিই আমার সহানুভূতি আছে, এটি দেখাবার জন্যই আমি এরূপ করেছিলাম; কিন্তু আমি কোন আজগুবিতে যোগ দেব না। আমাদের দেশের আহাম্মকদের বলো, আধ্যাত্মিক বিষয়ে আমরাই জগতে শিক্ষক—বিদেশীরা নয়। ইহলোকের বিষয়ে অবশ্য তাদের কাছ থেকে আমাদের শিখতে হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে ম্যাক্সমূলারের প্রবন্ধ পড়েছি। ছয় মাস আগে যখন তিনি ওটি লেখেন, তখন তাঁর কাছে প্রতাপ মজুমদারের ক্ষুদ্র পুস্তিকা ছাড়া লেখবার আর কোন উপাদান ছিল না; সুতরাং সে হিসাবে তাঁর প্রবন্ধটি ভালই হয়েছে, বলতে হবে। সম্প্রতি তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে একখানি বড় বই লেখবার সঙ্কল্প প্রকাশ করে আমাকে একখানি সুন্দর সুদীর্ঘ পত্র লিখেছেন। আমি এর মধ্যেই তাঁকে অনেক উপাদান দিয়েছি; ভারত থেকে আরও উপাদান পাঠাতে হবে। কাজ করে যাও। লেগে থাক, সাহসী হও, ভরসা করে সব বিষয়ে লাগ। ব্রহ্মচর্যের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখবে; তোমার তো ছেলেপুলে যথেষ্ট হয়েছে—আর কেন? এই সংসারটা কেবল দুঃখময়। কি বল? আমার স্নেহাশীর্বাদ জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!