ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-স্বামী বিবেকানন্দ

পত্রাবলী – ৩৭৫
শ্রীনগর, কাশ্মীর
১ অক্টোবর, ১৮৯৭

কল্যাণীয়া মার্গ১,

অনেকে অপরের নেতৃত্বে সবচেয়ে ভাল কাজ করতে পারে। সকলেই কিছু নেতা হয়ে জন্মায় না। কিন্তু শ্রেষ্ঠ নেতা তিনিই, যিনি শিশুর মত অন্যের উপর নেতৃত্ব করেন। শিশুকে আপাততঃ অন্যের উপর নির্ভরশীল বলে মনে হলেও, সে-ই সমগ্র বাড়ীর রাজা। অন্ততঃ আমার ধারণা এই যে, এই হল নেতৃত্বের মূল রহস্য। … অনুভব করে সত্য, কিন্তু জনকয়েকেই মাত্র প্রকাশ করতে পারে। অন্যের প্রতি অন্তরের প্রেম, প্রশংসা ও সহানুভূতি প্রকাশ করার যে ক্ষমতা, তাই একজনকে অপরের অপেক্ষা ভাব প্রচারে অধিক সাফল্য দান করে।

তোমার কাছে কাশ্মীরের বর্ণনা দেবার চেষ্টাও করব না। শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, এই ভূস্বর্গ ছাড়া অন্য কোন দেশ ছেড়ে আসতে আমার কখনও মন খারাপ হয়নি। সম্ভব হলে, রাজাকে রাজী করিয়ে এখানে একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবারও যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। এখানে অনেক কিছু করবার আছে-আর উপকরণও এত আশাপ্রদ!

বড় অসুবিধা এইঃ আমি দেখতে পাই-অনেকে তাদের প্রায় সবটুকু ভালবাসাই আমাকে অর্পণ করে; কিন্তু প্রতিদানে কোন ব্যক্তিকে আমার তো সবটুকু দেওয়া চলে না; কারণ একদিনেই তাহলে সমস্ত কাজ পণ্ড হয়ে যাবে। নিজের গণ্ডীর বাইরে দৃষ্টি প্রসারিত নয়-এমন লোকও আছে, যারা এরূপ প্রতিদানই চায়। কর্মের সাফল্যের জন্য যত বেশী সম্ভব লোকের উৎসাহপূর্ণ অনুরাগ আমার একান্ত প্রয়োজন; অথচ আমাকে সম্পূর্ণভাবে গণ্ডীর বাইরে থাকতে হবে।

নতুবা হিংসা ও কলহে সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। নেতা যিনি, তিনি থাকবেন ব্যক্তির গণ্ডীর বাইরে। আমার বিশ্বাস তুমি একথা বুঝতে পারছ। আমি একথা বলছি না যে, অপরের শ্রদ্ধাকে তিনি পশুর মত নিজের কাজে লাগাবেন, আর মনে মনে হাসবেন। আমি যা বলতে চাই তা আমার নিজের জীবনেই পরিস্ফুট;

আমার ভালবাসা একান্তই আমার আপনার জিনিষ, আবার প্রয়োজন হলে-বুদ্ধদেব যেমন বলতেন ‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়’-তেমনি আমি নিজ হস্তেই আমার হৃদয় উৎপাটিত করতে পারি। এ প্রেমে উন্মত্ততা আছে, কিন্তু কোন বন্ধন নেই। প্রেমের প্রভাবে অচেতন জড়বস্তু চেতনে পরিবর্তিত হয়।

বস্তুতঃ এই হল আমাদের বেদান্তের সার কথা। একই সদ্বস্তু অজ্ঞানীর চক্ষে ‘জড়’ এবং জ্ঞানীর চক্ষে ‘ভগবান্‌’ বলে প্রতিভাত হন এবং জড়ের মধ্যে যে চেতনের ক্রমিক পরিচয় লাভ-তাই হল সভ্যতার ইতিহাস।

অজ্ঞানীরা নিরাকারকেও সাকাররূপে দেখে, জ্ঞানী সাকারেও নিরাকার এর দর্শন পান। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-নিরানন্দের মধ্যে আমরা শুধু এই শিক্ষাই পাচ্ছি। … অতিরিক্ত ভাবপ্রবণতা কর্মের পক্ষে অনিষ্টকর। ‘বজ্রের মত দৃঢ় অথচ কুসুমের মত কোমল’-এটিই হচ্ছে সার নীতি।

চিরস্নেহশীল সত্যাবদ্ধ
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৩৭৬
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

মরী
১০ অক্টোবর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,

কাশ্মীর হইতে গত পরশু সন্ধ্যাকালে মরীতে পৌঁছিয়াছি। সকলেই বেশ আনন্দে ছিল। কেবল কেষ্টলাল ও গুপ্তের মধ্যে মধ্যে জ্বর হইয়াছিল-তাহাও সামান্য। এই Address (অভিনন্দনটি) খেতড়ির রাজার জন্য পাঠাতে হইবে-সোনালি রঙে ছাপাইয়া ইত্যাদি। রাজা ২১।২২ অক্টোবর নাগাদ বোম্বে পৌঁছিবেন। বোম্বেতে আমাদের কেহই এক্ষণে নাই। যদি কেহ থাকে, তাহাকে এক কপি পাঠাইয়া দিবে-যাহাতে সেই ব্যক্তি রাজাকে জাহাজেই ঐ Address প্রদান করে বা বোম্বে শহরেতে কোথাও।

উত্তম কপিটি খেতড়িতে পাঠাইবে। একটি মিটিং-এ (সভাতে) ঐটি পাস করিয়া লইবে। যদি কিছু বদলাইতে ইচ্ছা হয়, হানি নাই। তাহার পর সকলেই সহি করিবে; কেবল আমার নামের জায়গাটা খালি রাখিবে-আমি খেতড়ি যাইয়া সহি করিব। এ বিষয়ে কোন ত্রুটি না হয়। যোগেন কেমন আছে পত্রপাঠ লিখিবে-লালা হংসরাজ সাহানি, উকিল, রাওলপিণ্ডির ঠিকানায়। রাজা বিনয়কৃষ্ণের তরফের Address (অভিনন্দন)-টা দুদিন নয় দেরী হবে- আমাদেরটা যেন পৌঁছায়।

এইমাত্র তোমার ৫ তারিখের পত্র পাইলাম। যোগেনের সংবাদে বিশেষ আনন্দিত হইলাম এবং আমার এই চিঠি পাইবার পূর্বেই হরিপ্রসন্ন বোধ হয় আম্বালায় পৌঁছিবে। আমি তাহাদিগকে ঠিক ঠিক advice (নির্দেশ) সেখানে পাঠাইব। মা-ঠাকুরাণীর জন্য ২০০ টাকা পাঠাইলাম-প্রাপ্তিস্বীকার করিবে। … ভবনাথের স্ত্রীর সম্বন্ধে কিছুই কেন লিখ নাই। তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলে কি?

ক্যাপ্টেন সেভিয়ার বলিতেছেন যে, তিনি জায়গার জন্য অধীর হইয়া পড়িয়াছেন। মসূরীর নিকট বা অন্য কোন central (কেন্দ্রস্থানীয়) জায়গায় একটা স্থান যত শীঘ্র হয়-তাঁর ইচ্ছা। তাঁর ইচ্ছা যে, মঠ হতে দু-তিন জন এসে জায়গা select (পছন্দ) করে। তাদের মনোনীত হলেই তিনি মরী হতে গিয়ে খরিদ করে একদম বিল্ডিং শুরু করবেন। খরচ অবশ্য তিনিই পাঠাবেন। আমার selection (পছন্দ) তো এক আমাদের ইঞ্জিনিয়ার।

বাকী আর যে যে এ বিষয়ে বোঝে-পাঠাবে। ভাব এই যে, খুব ঠাণ্ডাস্থানেও কাজ নাই, আবার গরমও হয় না। দেরাদুন গরমিকালে অসহ্য-শীতকালে বেশ। মসূরী itself (খাস মসূরী) শীতকালে বোধহয় সকলের পক্ষে ঠিক নয়। তার আগিয়ে বা পেছিয়ে-অর্থাৎ ব্রিটিশ বা গাড়োয়াল রাজ্যে জায়গা পাওয়া যাবেই। অথচ সেই জায়গার বারমাস জল চাই নাইবার-খাবার জন্য। এ বিষয়ে মিঃ সেভিয়ার তোমার খরচ চেয়ে পাঠিয়ে চিঠি লিখছেন। তাঁর সঙ্গে সমস্ত ঠিকানা করবে।

আমার plan (পরিকল্পনা) এক্ষণে এই-নিরঞ্জন, লাটু, দীনু এবং কৃষ্ণলালকে জয়পুর পাঠাই; আমার সঙ্গে কেবল অচু আর গুপ্ত। মরী থেকে রাওলপিণ্ডি, তথা হতে জম্মু, সেখান হতে লাহোর, তারপর একেবারে করাচি তথা হতে। আমি এখান হইতেই মঠের জন্য collection (অর্থসংগ্রহ) আরম্ভ করিলাম। যেখান হতে তোমার নামে টাকা আসুক না, তুমি মঠের ফণ্ডে জমা করিবে ও দুরস্ত হিসাব রাখিবে।

দুটো ফণ্ড আলাদা-একটা কলিকাতার মঠের জন্য, আর একটা famine work etc. (দুর্ভিক্ষে সেবাকার্য ইত্যাদি)। আজ সারদা ও গঙ্গার দুইটি চিঠি পাইলাম। কাল তাদের চিঠি লিখব। আমার বোধহয় সারদাকে ওখানে না পাঠিয়ে Central Province (মধ্যপ্রদেশ)-এ পাঠান ভাল ছিল। সেখানে সাগরে ও নাগপুরে আমার অনেক লোক আছে-ধনী ও পয়সা-দেনেওয়ালা ইত্যাদি। যাহা হউক, আসছে নভেম্বরে সব হবে। আজ বড় তাড়া। এখানেই শেষ।

শশীবাবুকে আমার বিশেষ আশীর্বাদ ও প্রণয় দিও। মাষ্টার মহাশয় এতদিন বাদে কোমর বেঁধে নেমেছেন দেখছি। তাঁকে আমার বিশেষ প্রণয়ালিঙ্গন দিও। এইবার তিনি জেগেছেন দেখে আমার বুক দশহাত হয়ে উঠল। আমি কালই তাঁকে পত্র লিখছি। অলমিতি -ওয়া গুরুকী ফতে-To work! To work! (কাজে লেগে যাও, কাজে লেগে যাও)। তোমার সব চিঠিপত্র পেয়েছি। ইতি

বিবেকানন্দ

 


পত্রাবলী – ৩৭৭
[স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লিখিত]

মরী
১০ অক্টোবর, ১৮৯৭

কল্যাণবরেষু,

তোমার পত্রে তোমার শরীর তেমন ভাল নয় শুনিয়া দুঃখিত হইলাম। Unpopular (অপ্রিয়) লোককে যদি popular (লোকপ্রিয়) করতে পার, তবেই বলি বাহাদুর। পরে ওখানে কোন কার্য হইবার আশা নাই। তদপেক্ষা ঢাকা বা অন্য কোন স্থানে যাইতে পারিলেই ভাল হইত। যাহা হউক, নভেম্বরে যে work close (কাজ বন্ধ) হইবে, সেই মঙ্গল। শরীর যদি খারাপ বেশী হয় তো চলিয়া আসিবে।

Central Province-এ (মধ্যপ্রদেশে) অনেক field (কার্যক্ষেত্র) আছে এবং famine (দুর্ভিক্ষ) ছাড়াও আমাদের দেশে দরিদ্রের অভাব কি? যেখানে হউক একটা ভবিষ্যৎ বুঝে বসতে পারলেই কাজ হয়। যাহা হউক, দুঃখিত হইও না।

যাহা করা যায়, তাহার নাশ নাই-কখনও নহে; কে জানে ঐখানেই পরে সোনা ফলিতে পারে।

আমি শীঘ্রই দেশে কার্য আরম্ভ করিব। এখন আর পাহাড় বেড়াবার আবশ্যক নাই। শরীর সাবধানে রাখিবে। কিমধিকমিতি

বিবেকানন্দ

 


৩৭৮
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]

মরী
১০ অক্টোবর, ১৮৯৭

কল্যাণবরেষু,

তোমার পত্র পাইয়া বিশেষ আনন্দিত হইলাম। লম্বা প্ল্যানে এখনও কাজ নাই, যাহা under existing circumstances possible (বর্তমান অবস্থায় সম্ভব) হয়, তাহাই করিবে। ক্রমে ক্রমে the way will open to you (তোমার পথ খুলিয়া যাইবে)। Orphanage (অনাথাশ্রম) অতি অবশ্যই করিতে হইবে, তাহাতে আর সন্দেহ কি? মেয়েটিকেও ছাড়া হবে না।

তবে মেয়ে Orphanage-এর (অনাথাশ্রমের জন্য) মেয়ে সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট চাই, আমার বিশ্বাস ‘-’ মা এই বিষয়ে কাজ করতে বেশ পারবেন। অথবা উক্ত গ্রামের কোন বৃদ্ধা বিধবাকে এ কার্যে ব্রতী করাও, যাঁর ছেলেপুলে নাই। তবে ছেলেদের ও মেয়েদের স্বতন্ত্র স্থান হওয়া চাই। সেভিয়ার সাহেব এ কার্যের জন্য তোমায় টাকা পাঠাইতে রাজী।

তাঁহার ঠিকানা Nedon’s Hotel, লাহোর। যদি তাঁকে চিঠি লেখ, উপরে লিখিবে ‘To wait arrival’ (আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করিবে)। আমি শীঘ্রই কাল বা পরশু রাওলপিণ্ডি যাইতেছি, পরে জম্মু হইয়া লাহোর ইত্যাদি দেখিয়া করাচি প্রভৃতি হইয়া রাজপুতানায় আসিব।

আমার শরীর বেশ ভাল আছে। ইতি

বিবেকানন্দ

পুঃ-মুসলমান বালকও লইতে হইবে বৈকি এবং তাহাদের ধর্ম নষ্ট করিবে না। তাহাদের খাওয়া-দাওয়া আলগ্ করিয়া দিলেই হইল এবং যাহাতে তাহারা নীতিপরায়ণ, মনুষ্যত্বশালী এবং পরহিতরত হয়, এই প্রকার শিক্ষা দিবে। ইহারই নাম ধর্ম-জটিল দার্শনিক তত্ত্ব এখন মাথায় তুলে রাখ।
বি

আমাদের দেশে এখন আবশ্যক Manhood (মনুষ্যত্ব) এবং দয়া। ‘স ঈশঃ অনির্বচনীয় প্রেমস্বরূপঃ’-তবে ‘প্রকাশ্যতে কাপ্পি পাত্রে’২-এই স্থলে এই বলা উচিত, ‘সঃ প্রত্যক্ষ এব সর্বেষাং প্রেমরূপঃ’-তিনি প্রেমরূপে সর্বভূতে প্রকাশমান। আবার কি কাল্পনিক ঈশ্বরের পুজো হে বাপু! বেদ, কোরান, পুরাণ, পুঁথি-পাতড়া এখন কিছুদিন শান্তি লাভ করুক-প্রত্যক্ষ ভগবান্‌ দয়া-প্রেমের পুজো দেশে হোক।

ভেদবুদ্ধিই বন্ধন, অভেদবুদ্ধিই মুক্তি, সাংসারিক মদোন্মত্ত জীবের কথায় ভয় পেও না। অভীঃ, অভীঃ। লোক না পোক! হিন্দু, মুসলমান, ক্রিশ্চান ইত্যাদি সকল জাতের ছেলে লও, তবে প্রথমটা আস্তে আস্তে, অর্থাৎ তাদের খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি একটু আলগ্ হয়; আর ধর্মের যে সর্বজনীন সাধারণ ভাব, তাই শিখাইবে। ইতি

বিবেকানন্দ


 

পত্রাবলী – ৩৭৯
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

মরী
১১ অক্টোবর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,

কাশ্মীর হতে আজ দশ দিন পর্যন্ত সমস্ত কাজ যেন একটা ঝোঁকে করেছি বলে মনে হচ্ছে। সেটা শরীরের রোগ হোক বা মনেরই হোক। এক্ষণে আমার সিদ্ধান্ত এই যে, আমি আর কাজের যোগ্য নই। … তোমাদের উপর অত্যন্ত কটু ব্যবহার করেছি, বুঝতে পারছি।

তবে তুমি আমার সব সহ্য করবে আমি জানি; ও মঠে আর কেউ নেই যে সব সইবে। তোমার উপর অধিক অধিক কটু ব্যবহার করেছি; যা হবার তা হয়েছে-কর্ম! আমি অনুতাপ কি করব, ওতে বিশ্বাস নাই-কর্ম! মায়ের কাজ আমার দ্বারা যতটুকু হবার ছিল ততটুকু করিয়ে শেষ শরীর মন চুর করে ছেড়ে দিলেন ‘মা’। মায়ের ইচ্ছা!

এক্ষণে আমি এ সমস্ত কাজ হতে অবসর নিলাম। দু-এক দিনের মধ্যে আমি সব ছেড়ে দিয়ে একলা একলা চলে যাব; কোথাও চুপ করে বাকী জীবন কাটাব। তোমরা মাপ করতে হয় কর, যা ইচ্ছে হয় কর। মিসেস বুল বেশী টাকা দিয়েছেন। শরতের ওপর তাঁর একান্ত বিশ্বাস। শরতের পরামর্শ নিয়ে সকল মঠের কাজ কর, যা হয় কর। তবে আমি চিরকাল বীরের মত চলে এসেছি-আমার কাজ বিদ্যুতের মত শীঘ্র, আর বজ্রের মত অটল চাই।

আমি ঐ রকম মরব। সেইজন্য আমার কাজটি করে দিও-হারা-জিতার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নাই। আমি লড়ায়ে কখনও পেছপাও হইনি; এখন কি … হব? হার-জিত সকল কাজেই আছে; তবে আমার বিশ্বাষ যে কাপুরুষ মরে নিশ্চিত কৃমিকীট হয়ে জন্মায়। যুগ যুগ তপস্যা করলেও কাপুরুষের উদ্ধার নেই-আমায় কি শেষে কৃমি হয়ে জন্মাতে হবে? আমার চোখে এ সংসার খেলামাত্র-চিরকাল তাই থাকবে।

এর মান-অপমান দু-টাকা লাভ-লোকসান নিয়ে কি ছমাস ভাবতে হবে? … আমি কাজের মানুষ! খালি পরামর্শ হচ্ছে-ইনি পরামর্শ দিচ্ছেন, উনি দিচ্ছেন; ইনি ভয় দেখাচ্ছেন তো উনি ডর! আমার চোখে এ জীবনটা এমন কিছু মিষ্টি নয় যে, অত ভয়-ডর করে হুঁশিয়ার হয়ে বাঁচতে হবে।

টাকা, জীবন, বন্ধু-বান্ধব, মানুষের ভালবাসা, আমি-সব অত সিদ্ধি নিশ্চিত করে যে কাজ করতে চায়, অত ভয় যদি করতে হয়তো গুরুদেব যা বলতেন যে, ‘কাক বড় স্যায়না-’ তার তাই হয়। আর যাই হোক, এ-সব টাকা-কড়ি, মঠ-মড়ি, প্রচার-ফ্রচার কি জন্য? সমস্ত জীবনের এক উদ্দেশ্য-শিক্ষা। তাছাড়া ধন-বাড়ী স্ত্রী-পুরুষ প্রয়োজন কি?

এজন্য টাকা গেল, কি হার হল-আমি অত বুঝতে পারি না বা পারব না। লড়াই করলুম কোমর বেঁধে-এ আমি খুব বুঝি; আর যে বলে, ‘কুছ পরোয়া নেই, ওয়া বাহাদুর, আমি সঙ্গেই আছি’ … তাকে বুঝি, সে বীরকে বুঝি, সে দেবতাকে বুঝি। তেমন নরদেবের পায়ে আমার কোটি কোটি নমস্কার; তারাই জগৎপাবন, তারাই সংসারের উদ্ধারকর্তা! আর যেগুলো খালি ‘বাপ রে এগিও না, ওই ভয়’-ডিস‍্‍পেপ্‌টিকগুলো-প্রায়ই ভয়তরাসে।

তবে আমার মায়ের কৃপায় মনের এত জোর যে, ঘোর ডিস‍্‍পেপ্‌সিয়া কখনও আমায় কাপুরুষ করতে পারবে না। কাপুরুষদের আর কি বলব, কিছুই বলবার নাই। কিন্তু যত বীর এ জগতে বড় কাজ করতে নিষ্ফল হয়েছেন, যাঁরা কখনও কোন কাজ থেকে হঠেননি, যে সকল বীর ভয় আর অহঙ্কারবশে হুকুম অগ্রাহ্য করেননি, তাঁরা যেন আমায় চরণে স্থান দেন। আমি শাক্ত মায়ের ছেলে।

মিন‍্‍মিনে ভিন‍্‍ভিনে, ছেঁড়া ন্যাতা তমোগুণ, আর নরককুণ্ড আমার চক্ষে দু-ই এক। মা জগদম্বে, হে গুরুদেব! তুমি চিরকাল বলতে ,‘এ বীর!’-আমায় যেন কাপুরুষ হয়ে না মরতে হয়। এই আমার প্রার্থনা, হে ভাই! … ‘উৎপৎস্বতেঽস্মি মম কোঽপি সনামধর্ম’-এই ঠাকুরের দাসানুদাসের মধ্যে কেউ না কেউ উঠবে আমার মত, যে আমায় বুঝবে।

‘জাগো বীর ঘুচিয়ে স্বপন; শিয়রে শমন, … তাহা না ডরাক তোমা’-যা কখনও করিনি, রণে পৃষ্ঠ দিইনি, আজ কি … তাই হবে? … হারবার ভয়ে লড়াই থেকে হঠে আসব? হার তো অঙ্গের আভরণ; কিন্তু না লড়েই হারব?

‘জাগো বীর ঘুচিয়ে স্বপন; শিয়রে শমন, … তাহা না ডরাক তোমা’-যা কখনও করিনি, রণে পৃষ্ঠ দিইনি, আজ কি … তাই হবে? … হারবার ভয়ে লড়াই থেকে হঠে আসব? হার তো অঙ্গের আভরণ; কিন্তু না লড়েই হারব?

তারা! মা! … একটা তাল ধরবার মানুষ নেই; আবার মনে মনে খুব অহঙ্কার, ‘আমি সব বুঝি’। … আমি এখন চললাম; সব তোমাদের রইল। মা আবার মানুষ দেন-যাদের ছাতিতে সাহস, হাতে বল, চোখে আগুন জ্বলে, যারা জগদম্বার ছেলে-এমন একজনও যদি দেন, তবে কাজ করব, তবে আবার আসব; নইলে জানলুম মায়ের ইচ্ছা এই পর্যন্ত। … আমার এখন ‘ঘড়িকে ঘোড়া ছোটে’ আমি চাই তড়িঘড়ি কাজ, নির্ভীক হৃদয়।

সারদা বেচারীকে অনেক গাল দিয়েছি। কি করব? আমি গাল দিই; কিন্তু আমারও বলবার ঢের আছে। … আমি হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর article (প্রবন্ধ) লিখেছি। সব … ভাল নইলে বৈরাগ্য হইবে কেন? … শেষটা কি মা আর আমায় জড়িয়ে মারবেন? সকলকার কাছে আমার অনেক অপরাধ-যা হয় কর।

আমি তোমাদের সকলকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করছি-মা যেন মহাশক্তিরূপে তোমাদের মধ্যে আসেন, ‘অভয়প্রতিষ্ঠং’ অভয় যেন তোমাদের করেন। আমি জীবনে এই দেখলাম, যে সদা আত্ম-সাবধান করে, সে পদে পদে বিপদে পড়ে। যে মানের ভয়ে মরে, সে অপমানই পায়। যে সদা লোকসানের ভয় করে, সে সর্বদা খোয়ায়। … তোমাদের সব কল্যাণ হোক। অলমিতি।

বিবেকানন্দ

 


পত্রাবলী – ৩৮০*
মরী
১১ অক্টোবর, ১৮৯৭

প্রিয় জগমোহনলাল,

… আমি জয়পুরে যে তিন জন সন্ন্যাসীকে পাঠাচ্ছি, তাদের দেখাশোনা করবার জন্য-আপনি বোম্বে যাবার পূর্বে-কাউকে বলে যাবেন। তাদের খাবার ও থাকার একটি ভাল জায়গার ব্যবস্থা করবেন। আমি সেখানে না যাওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে থাকবে। তারা সরল মানুষ-পণ্ডিত নয়। তারা আমারই লোক, একজন আমার গুরুভ্রাতা। যদি তারা চায়, তাদের খেতড়িতে নিয়ে যেতে পারেন, আমি শিঘ্রই সেখানে যাব।

এখন চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই বছর বেশী বক্তৃতাও করব না। এই সমস্ত হট্টগোলে আমার আর কোন আস্থা নেই, এতে কার্যক্ষেত্রে কোন কল্যাণই সাধিত হয় না। কলিকাতায় আমার প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার জন্য আমাকে নীরবে চেষ্টা করতে হবে; আমি তাই অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রে চুপচাপ ঘুড়ে বেড়াচ্ছি।

আশীর্বাদ সহ আপনার
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৩৮১
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

মরী
১২ অক্টোবর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,

কল্যকার পত্রে সবিশেষ লিখিয়াছি। কোন কোন বিষয়ে বিশেষ বিশেষ direction (নির্দেশ) আবশ্যক বোধ করিতেছি। … (১) যে যে ব্যক্তি টাকা যোগাড় করিয়া পাঠাইবে … তাহারা acknowledgement (প্রাপ্তিস্বীকার) মঠ হইতে পাইবে। (২) Acknowledgement দুইখানা-একখানা তার, অপরখানা মঠে থাকিবে। (৩) একখানা বড় খাতায় তাদের সকলের নাম ও ঠিকানা entered (লিপিবদ্ধ) থাকিবে।

(৪) মঠের ফণ্ডে যে টাকা আসিবে, তাহার যেন কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব থাকে এবং সারদা প্রভৃতি যাহাকে যাহা দেওয়া হচ্ছে, তাদের কাছ হতে কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব লওয়া চাই। হিসাবের অভাবে … আমি যেন জোচ্চোর না বনি। ঐ হিসাব পরে publish (ছাপিয়া বাহির) করিতে হইবে। (৫) পত্রপাঠ উকিলের পরামর্শ নিয়ে এই মর্মে উইল রেজেষ্ট্রী করে নিয়ে এস যে, in case (যদি) আমি তুমি মরে যাই তো হরি এবং শরৎ আমাদের মঠের যা কিছু আছে, সব পাবে।

আন্বালা হইতে এখনও কোন সংবাদ পাই নাই-হরিপ্রসন্ন প্রভৃতি পৌঁছিয়াছে কিনা। অপরার্ধ মাষ্টার মহাশয়কে দিও। ইতি

বিবেকানন্দ

 


পত্রাবলী – ৩৮২*
[‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’কার ‘শ্রীম’কে লিখিত]

C/o লালা হংসরাজ
রাওলপিণ্ডি
১২ অক্টোবর, ১৮৯৭

প্রিয় ম-
C’estbon monami (বেশ হচ্ছে, বন্ধু)-এখন আপনি ঠিক কাজে হাত দিয়েছেন। হে বীর, আত্মপ্রকাশ করুন। জীবন কি নিদ্রাতেই অতিবাহিত হবে? সময় বয়ে যায়। সাবাস্, এই তো পথ।

আপনার পুস্তিকা প্রকাশের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ; শুধু এই পুস্তিকার আকারে খরচ পোষাবে কিনা তাই ভাবছি। … লাভ হোক বা নাই হোক গ্রাহ্য করবেন না, তা দিনের আলোতে বেরিয়ে আসুক! এজন্য আপনার উপর যেমন অজস্র আশীর্বাদ বর্ষিত হবে, তেমনি ততোধিক অভিশাপও আসবে-চিরন্তন ধারাই এই।

এই তো সময়!

ভগবদাশ্রিত
বিবেকানন্দ

 


পত্রাবলী – ৩৮৩*

জম্মু
৩ নভেম্বর, ১৮৯৭

প্রিয় মিস নোবেল্‌,

… অত্যধিক ভাবপ্রবণতা কাজের বিঘ্ন করে; ‘বজ্রাদপি কঠোরাণি মৃদুনি কুসুমাদপি’-এই হবে মূল মন্ত্র।

আমি শীঘ্রই স্টার্ডিকে লিখব। সে তোমায় ঠিকই বলেছে, বিপদে-আপদে আমি তোমার পাশে দাঁড়াব। ভারতে আমি যদি একটুকরা রুটি পাই নিশ্চয় জেন তুমি তার সবটুকুই পাবে। আমি কাল লাহোরে যাচ্ছি; সেখানে পৌঁছে স্টার্ডিকে চিঠি লিখব। কাশ্মীরের মহারাজের কাছ থেকে কিছু জমি পাবার আশায় গত পনর দিন আমি এখানে আছি। যদি এদেশে থাকি তো আগামী গ্রীষ্মে আবার কাশ্মীর যাব এবং সেখানে কিছু কাজ শুরু করব ভাবছি।

আমার অফুরন্ত স্নেহ জানবে।

তোমাদের
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৩৮৪
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

লাহোর
১১ নভেম্বর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,

লাহোরে লেকচার একরকম হইয়া গেল। দু-এক দিনের মধ্যেই দেরাদুন যাত্রা করিব। তোমাদের সকলের অমত এবং অন্যান্য অনেক বাধাবশতঃ সিন্ধুযাত্রা এখন স্থগিত রহিল। আমার দুইখানি বিলাতী চিঠি কে রাস্তায় খুলিয়াছে। অতএব আমার চিঠিপত্র এক্ষণে আর পাঠাইবে না। খেতড়ি হইতে লিখিলে পাঠাইবে। যদি উড়িষ্যায় যাও তো এমন বন্দোবস্ত করিয়া যাও যে, কোন ব্যক্তি তোমার প্রতিনিধি হইয়া সমস্ত কার্য করে-যথা হরি। বিশেষতঃ এক্ষণে আমি প্রতিদিন আমেরিকা হইতে টাকার অপেক্ষা করিতেছি।

হরি ও শরতের নামে যে উইল করিবার জন্য বলিয়াছিলাম, তাহা বোধ হয় হইয়া গিয়াছে।

এখানে সম্ভবতঃ সদানন্দ ও সুধীরকে ছাড়িয়া যাইব একটি সভা স্থাপন করিয়া। এবারে লেকচারাদি আর নয়-একেবারে হুড়মুড় রাজপুতানায় যাচ্ছি। মঠ না করে আর কথা নয়। শরীর regular exercise (নিয়মিত ব্যায়ম) না করিলে কখনও ভাল থাকে না, বকে-বকেই যত ব্যারাম ধরে, ইহাই নিশ্চিত জানিও। সকলকে আমার ভালবাসা। ইতি

বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৩৮৫
[শ্রীমতী ইন্দুমতী মিত্রকে লিখিত]

লাহোর
১৫ নভেম্বর, ১৮৯৭

কল্যাণীয়াসু,,

মা, বড় দুঃখের বিষয় যে, একান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও এ যাত্রায় সিন্ধুদেশে আসিয়া তোমাদের সহিত সাক্ষাৎ করা ঘটিল না। প্রথমতঃ ক্যাপ্টেন এবং মিসেস সেভিয়ার যাঁহারা ইংলণ্ড হইতে আসিয়া আমার সহিত প্রায় আজ নয় মাস ফিরিতেছেন, তাঁহারা দেরাদুনে জমি খরিদ করিয়া একটি অনাথালয় করিবার জন্য বিশেষ ব্যগ্র। তাঁহাদের অত্যন্ত অনুরোধ যে, আমি যাইয়া ঐ কার্য আরম্ভ করিয়া দিই, তজ্জন্য দেরাদুন না যাইলে নহে।

দ্বিতীয়তঃ আমার অসুখ হওয়ার জন্য জীবনের উপর ভরসা নাই। এক্ষণেও আমার উদ্দেশ্য যে, কলিকাতায় একটি মঠ হয়—তাহার কিছু করিতে পারিলাম না। অপিচ দেশের লোক বরং পূর্বে আমাদের মঠে যে সাহায্য করিত, তাহাও বন্ধ করিয়াছে। তাহাদের ধারণা যে আমি ইংলণ্ড হইতে অনেক অর্থ আনিয়াছি!! তাহার ওপর এবার মহোৎসব হওয়া পর্যন্ত অসম্ভব; কারণ রাসমণির বাগানের মালিক বিলাতফেরত বলিয়া আমাকে উদ্যানে যাইতে দেবেন না!!

অতএব আমার প্রথম কর্তব্য এই যে, রাজপুতানা প্রভৃতি স্থানে যে দু-চারটি বন্ধুবান্ধব আছে, তাঁহাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া কলিকাতায় একটি স্থান করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করা। এই সকল কারণের জন্য আপাততঃ অত্যন্ত দুঃখের সহিত সিন্ধুদেশ যাত্রা স্থগিত রাখিলাম। রাজপুতানা ও কাথিয়াওয়াড় হইয়া আসিবার বিশেষ চেষ্টা করিব।তুমি দুঃখিত হইও না।

আমি একদিনও তোমাদের ভুলি না, তবে কর্তব্যটা প্রথমেই করা উচিত। কলিকাতায় একটি মঠ হইলে আমি নিশ্চিন্ত হই। এত যে সারা জীবন দুঃখে-কষ্টে কাজ করিলাম সেটা আমার শরীর যাওয়ার পর নির্বাণ যে হইবে না, সে ভরসা হয়। আজই দেরাদুনে চলিলাম—সেথায় দিন সাত থাকিয়া রাজপুতানায়, তথা হইতে কাথিয়াওয়াড় ইত্যাদি।

সাশীর্বাদং
বিবেকানন্দ

 


পত্রাবলী – ৩৮৬
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

লাহোর
১৫ নভেম্বর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,

বোধ হয় তোমার ও হরির শরীর এক্ষণে বেশ আছে। লাহোরে খুব ধুমধামের সহিত কার্য হইয়া গেল। এক্ষণে ডেরাদুনে চলিলাম। সিন্ধুযাত্রা স্থগিত রহিল। দীনু, লাটু ও কৃষ্ণলাল জয়পুরে পৌঁছিয়াছে কিনা, এখনও কোন সংবাদ নাই। এখান হইতে মঠের খরচের জন্য বাবু নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত মহাশয় চাঁদা আদায় করিয়া পাঠাইবেন। রীতিমত রসিদ তাহাকে দিও। মরী, রাওলপিণ্ডি ও শিয়ালকোট হইতে কিছু পাইয়াছ কিনা লিখিবে।

এ পত্রের জবাব C/o Post Master, Dehra Dun লিখিও। অন্য চিঠি আমি দেরাদুন হইতে পত্র লিখিলে পর পাঠাইবে। আমার শরীর বেশ আছে। তবে রাত্রে দু-একবার উঠিতে হয়। নিদ্রা উত্তম হইতেছে। খুব লেকচার করিলেও নিদ্রার ব্যাঘাত হয় না, আর exercise (ব্যায়াম) রোজ আছে।

ভাত তো আজ ৩ মাস রোজ খাই, কিন্তু কোন গোল নাই। এইবার উঠে-পড়ে লাগ। সেই বড় জায়গাটার উপর চুপিসাড়ে চোখ রাখ। এবার মহোৎসব৩ যাতে সেথায় হয়, তার বিধিমত চেষ্টা করা যাচ্ছে। সকলকে আমার ভালবাসা। ইতি

বিবেকানন্দ

পুঃ—মাষ্টার মহাশয় যদি আমাদের work (কাজকর্ম) সম্বন্ধে মাঝে মাঝে ‘ট্রিবিউন’-এ লেখেন তো বড়ই ভাল হয়। তা হলে লাহোরটা আর জুড়ায় না। এখন তো খুব তেতেছে। টাকা-কড়ি একটু হিসাব করে খরচ কর; তীর্থযাত্রাটা নিজের নিজের উপর, প্রচারাদি মঠের ভার।

 


পত্রাবলী – ৩৮৭
[শ্রীমতী ইন্দুমতী মিত্রকে লিখিত]

দেরাদুন
২৪ নভেম্বর, ১৮৯৭

কল্যাণীয়াসু,

মা, তোমার ও হরিপদ বাবাজীর পত্র যথাকালে পাইলাম। অবশ্যই তোমাদের দুঃখিত হইবার কারণ অনেক হইয়াছে। কি করি বল? এক্ষণে দেরাদুনে যে কার্যে আসিয়াছিলাম, তাহাও নিষ্ফল হইল—সিন্ধুদেশেও যাওয়া হইল না। প্রভুর ইচ্ছা। এক্ষণে রাজপুতানা ও কাথিয়াওয়াড় দেশ হইয়া সিন্ধুদেশের মধ্য দিয়া কলিকাতায় যাইব, ইচ্ছা আছে। পথে কিন্তু আর একটি বিঘ্ন হইবার সম্ভাবনা। তা যদি না হয়, নিশ্চিত সিন্ধুদেশে আসিতেছি।

ছুটি লইয়া হায়দ্রাবাদে বৃথা আসা ইত্যাদিতে তোমাদের নিশ্চয়ই অনেক অসুবিধা হইয়া থাকিবে—সকলই প্রভুর ইচ্ছা। কষ্ট করিলে তার সুফল আছে নিশ্চিত। আমি আগামী শুক্রবারে এ স্থান হইতে যাইব—সাহারানপুর হইয়া একেবারে রাজপুতানায় যাইবার ইচ্ছা। আমার শরীর এক্ষণে ভাল আছে। ভরসা করি, তোমরাও নীরোগ শরীরে স্বচ্ছন্দে আছ।

এস্থানে ও দেরাদুনের নিকট প্লেগ হওয়ায় অনেক হাঙ্গাম করিতেছে এবং আমাদের অনেকটা ব্যাঘাত সহ্য করিতে হইতেছে ও হইবে। মঠের ঠিকানায় পত্র লিখিলে আমি যে-স্থানেই থাকি না কেন পাইব। তুমি ও হরিপদ বাবাজী আমার বিশেষ আশীর্বাদ জানিবে। ইতি

সাশীর্বাদাং
বিবেকানন্দ

 


পত্রাবলী – ৩৮৮
[স্বামী প্রেমানন্দকে লিখিত]

দেরাদুন
২৪ নভেম্বর, ১৮৯৭

প্রিয়বরেষু,

তোমার সকল সমাচার হরিপ্রসন্ন ভায়ার মুখে শুনিলাম। রাখাল ও হরির শরীর এক্ষণে সারিয়াছে শুনিয়া বিশেষ সন্তোষ লাভ করিলাম।

এবার টিহিরীর শ্রীযুক্ত বাবু রঘুনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় ঘাড়ে একটা বেদনার জন্য অত্যন্ত ভুগিতেছেন; আমিও নিজের ঘাড়ের একটা বেদনায় অনেকদিন যাবৎ ভুগিতেছি। যদি তোমাদের সন্ধানে পুরাতন ঘৃত থাকে, তাহা হইলে কিঞ্চিৎ দেরাদুনে উক্ত বাবুকে এবং খেতড়ির ঠিকানায় কিঞ্চিৎ আমাকে পাঠাইবে। হাবু, শরৎ (উকিল)-এর নিকট নিশ্চিত পাইবে। ‘দেরাদুন—N. W. P রঘুনাথ ভট্টাচার্য’ বলিলেই উক্ত বাবু পাইবেন।

আমি পরশ্ব দিবস সাহারানপুরে চলিলাম। সেথা হইতে রাজপুতানা।

ইতি বিবেকানন্দ

পুঃ—সকলকে আমার ভালবাসা।

বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৩৮৯*

দেরাদুন
২৪ নভেম্বর, ১৮৯৭

প্রিয় ম—,

আপনার দ্বিতীয় পুস্তকখানির জন্য অশেষ ধন্যবাদ। বইটি সত্যই অপূর্ব। আপনার প্রণালী সম্পূর্ণ মৌলিক। ইতঃপূর্বে আর কোন জীবনচরিতকার কোন মহাপুরুষের জীবন ঠিক এই ভাবে নিজের কল্পনায় কিছুমাত্র অনুরঞ্জিত না করে প্রকাশ করেনি। ভাষাও অনবদ্য—যেমন সরস ও সতেজ, তেমনি সরল ও সহজ।

আমি যে বইটি কতটা উপভোগ করেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করবার নয়। ঐ সব পাঠ করবার সময় আমি যেন সত্যই অন্য জগতে চলে যাই। এ বড় আশ্চর্য, নয় কি? আমাদের গুরুদেব ছিলেন সম্পূর্ণ মৌলিক; সুতরাং আমাদের প্রত্যেককেও মৌলিক হতে হবে, নয় তো কিছুই না। এখন আমি বুঝতে পারছি যে, কেন আমাদের মধ্যে আর কেউ এর আগে তাঁর জীবনী লিখতে চেষ্টা করেনি। এই বিরাট কাজ আপনার জন্যই পড়ে ছিল। তিনি নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে আছেন।

অসীম ভালবাসা ও নমস্কার জানবেন। ইতি

বিবেকানন্দ

পুনশ্চ—সক্রেটিসের কথোপকথনগুলিতে যেন প্লেটোর কথাই সর্বদা চোখে পড়ে; আপনার এই পুস্তিকায় আপনি নিজেকে সম্পূর্ণ লুকিয়ে রেখেছেন। নাটকীয় অংশগুলি সত্যই অপূর্ব। এদেশে এবং পাশ্চাত্যে প্রত্যেকেই এই বইটি পছন্দ করছে।

 


পত্রাবলী – ৩৯০
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

দিল্লী
৩০ নভেম্বর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,

মিসেস মূলার যে টাকা দিবেন বলিয়াছেন, তাহার কতক কলিকাতায় হাজির। বাকী পরে আসিবে শীঘ্রই। আমাদেরও কিছু আছে। মিসেস মূলার তোমার ও আমার নামে গ্রিণ্ডলে কোম্পানীর ওখানে টাকা রাখবেন। তাতে তোমার power of attorney (ক্ষমতাপত্র) থাকার দরুন তুমি একাই সমস্ত draw করতে (তুলতে) পারবে। ঐটি যেমন রাখা, অমনি তুমি নিজে ও হরি পাটনায় সেই লোকটিকে ধর গিয়া—যেমন করে পার influence কর (রাজী করাও)G

আর জমিতে যদি ন্যায্য দাম হয় তো কিনে লও। নইলে অন্য জায়গার চেষ্টা দেখ। আমি এদিকেও টাকার যোগাড় দেখছি। নিজের জমিতে মহোৎসব করে তবে কাজ—তাতে বুড়ো মরে আর চেকড়াই ছেঁড়ে। এটি তোমার মনে থাকে যেন।

এই ৮/৯ মাস তুমি যে কাজ করেছ, খুব বাহাদুরী দেখিয়েছ। এইবার ধড়াধড় দেখ না—একটি মঠ ও কলিকাতায় একটি জায়গা না বানিয়ে দিয়ে তবে কাজ। কাজকর্ম, তবে খুব গোপনে। কাশীপুরের বাগানটারও তল্লাস রেখ। আমি কাল আলোয়ার হয়ে খেতড়ি যাচ্ছি। শরীর বেশ আছে … সর্দি করেছে বটে। চিঠিপত্র খেতড়িতে পাঠাবে। সকলকে ভালবাসা। ইতি

বিবেকানন্দ

পুঃ—তোমাকে যে উইল করতে বলেছিলাম শরৎ ও হরির নামে তার কি হল? অথবা তুমি জায়গা ফায়গা আমার নামে কিনবে—আমি উইল ঠিক all ready (সম্পূর্ণ তৈরী) করে রাখব। ইতি


পত্রাবলী – ৩৯১
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

খেতড়ি৫
৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,

আমরা কাল খেতড়ি যাত্রা করিব। দেখিতে দেখিতে লটবহর অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে। খেতড়ি হইয়া সকলকেই মঠে পাইবার সঙ্কল্প আছে। যে-সকল কাজ এদের দ্বারা হইবে বলে মনে করেছিলাম, তাহার কিছুই হইল না। অর্থাৎ আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকিলে কেহই যে কিছু করতে পারিবে না—তাহা নিশ্চিত। স্বাধীনভাবে না ঘুরিলে ইহাদের দ্বারা কিছুই হইবে না। অর্থাৎ আমার সঙ্গে থাকিলে কে ইহাদের পুঁছিবে—কেবল সময় নষ্ট। এইজন্য ইহাদের পাঠাইতেছি মঠে।

Famine (দুর্ভিক্ষ) ফণ্ডে যে টাকা বাঁচিয়াছে, তাহা একটা permanent work (স্থায়ী কার্যের) ফণ্ড করিয়া রাখিয়া দিবে। অন্য কোন বিষয়ে তাহা খরচ করিবে না এবং সমস্ত famine work (দুর্ভিক্ষ-কার্য)-এর হিসাব দেখাইয়া লিখিবে যে, বাকী এত আছে অন্য good work (ভাল কাজের )-এর জন্য। …

কাজ আমি চাই—don’t want any humbug (কোন প্রতারক চাই না)। যাদের কাজ করবার ইচ্ছা নেই—‘যাদু, এই বেলা পথ দেখ’ তারা। খেতড়ি পৌঁছিয়াই তোমার power of attorney (ক্ষমতাপত্র)-তে সহি করিয়া পাঠাইয়া দিব—যদি পৌঁছাইয়া থাকে। আমেরিকান বষ্টন ছাপওয়ালা চিঠিমাত্রই খুলিবে, অন্য কোন চিঠি খুলিবে না।

আমার চিঠিপত্র খেতড়িতে পাঠাইবে। টাকা আমি রাজপুতানাতেই পাইব, তাহার কোন চিন্তা নাই। তোমরা প্রাণপণে জায়গাটা ঠিক কর—এবার নিজের জমির উপর মহোৎসব করিতেই হইবে।

টাকাটা কি বেঙ্গল ব্যাঙ্কে আছে অথবা তুমি অন্য কোথাও রাখিয়া দিয়াছ? টাকাকড়ি সম্বন্ধে বিশেষ সাবধান হইবে। হিসাব তন্ন তন্ন রাখিবে ও টাকার জন্য আপনার বাপকেও বিশ্বাস নাই জানিবে। ইতি

সকলকে ভালবাসা জানাইও। হরি কেমন আছে লিখিবে। মধ্যে দেরাদুনে উদাসী সাধু কল্যাণদেব ও আরও দু এক জনের সহিত সাক্ষাৎ। হৃষীকেশওয়ালারা আমাকে দেখিবার জন্য বড়ই উৎসুক—‘নারায়ণ হরি’র কথা পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসা ইত্যাদি।

বিবেকানন্দ

 


পত্রাবলী – ৩৯২
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

খেতড়ি
১৪ ডিসেম্বর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,

তোমার power of attorney (ক্ষমতাপত্র)-তে আজ সহি করিয়া পাঠাইলাম। … টাকাটা যত শীঘ্র্ পার draw করিবে (তুলিবে) এবং করিয়াই আমাকে তার করিবে। ছত্রপুর নামে কি একটি জায়গার বুন্দেলখণ্ডী রাজা আমাকে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। যাইবার সময় তাঁহার ওখানে হইয়া যাইব। লিমডির রাজাও ডাকিতেছেন আগ্রহ করিয়া, সেখানেও না গেলে নহে।

একবার পোঁ করে কাথিয়াওয়াড় ঘুড়িয়া চলিলাম আর কি! কলিকাতায় যেতে পারিলেই বাঁচি। বষ্টনের খবর তো এখনও নাই; তবে হয়তো শরৎ টাকাটা নিজে নিয়ে আসছে। … যাহা হউক, যেখান থেকে যা খবর আসবে, তৎক্ষণাৎ আমাকে পত্র লিখিবে। ইতি

বিবেকানন্দ

পুনশ্চ— কানাই কেমন আছে? শুনিতে পাই তাহার শরীর ভাল নহে। তাহার বিশেষ খবর লইবে এবং কাহারও ওপর হুকুম যেন না হয় দেখিবে। হরির ও তোমার সুস্থ সংবাদ লিখিবে।

 


পত্রাবলী – ৩৯৩*
[স্বামী শিবানন্দকে লিখিত]

জয়পুর
২৭ ডিসেম্বর, ১৮৯৭

প্রিয় শিবানন্দজী,

মান্দ্রাজে থাকিতেই বোম্বে গিরগাঁওয়ের যে মিঃ শেতলুরের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিল, তিনি আফ্রিকাতে যে সকল ভারতীয় বাসিন্দা রয়েছে, তাদের আধ্যাত্মিক অভাব দূরীকরণের জন্য কাহাকেও পাঠাইতে লিখিয়াছেন। অবশ্য তিনিই মনোনীত ব্যক্তিকে আফ্রিকায় পাঠাইবেন এবং আবশ্যকীয় সমস্ত ব্যয়ভার বহন করিবেন।

কাজটি আপাততঃ খুব সহজ কিম্বা নির্ঝঞ্ঝাট হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এ কাজে প্রত্যেক সৎলোকেরই এগিয়ে যাওয়া উচিত। আপনি বোধহয় জানেন, ওখানের শ্বেতকায়েরা ভারতীয়দিগকে মোটেই ভাল চোখে দেখে না। তাই সেখানকার কাজ হচ্ছে—ভারতীয়দের তত্ত্বাবধান করতে হবে, অথচ এমন ধীরভাবে, যাতে আর বিবাদের সৃষ্টি না হয়।

হাতে হাতে অবশ্য একাজের ফল পাবার আশা করা যায় না; পরিণামে দেখবেন যে, আজ পর্যন্ত ভারতের কল্যাণের জন্য যত কাজ করা হয়েছে, সে-সবের চেয়েও এতে বেশী উপকার হবে। আমার ইচ্ছা, আপনি একবার এতে আপনার ভাগ্যপরীক্ষা করে দেখুন। যদি রাজী থাকেন তবে এই পত্রের উল্লেখ করে শেতলুরকে আপনার সম্মতি জানাবেন এবং আরও খবর চেয়ে পাঠাবেন।

‘শিবা বঃ সন্ত্ত পন্থানঃ’। আমি শারীরিক খুব ভাল নই; কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই কলিকাতা যাচ্ছি, সেখানে শরীর সুস্থ হবে আশা করি। ইতি

ভগবৎপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ

 


পত্রাবলী – ৩৯৪
[শ্রীমতী মৃণালিনী বসুকে লিখিত]

ওঁ নমঃ ভগবতে রামকৃষ্ণায়

দেওঘর, বৈদ্যনাথ
৩ জানুআরী, ১৮৯৮

মা,

তোমার পত্রে কয়েকটি অতি গুরুতর প্রশ্নের সমুত্থান হইয়াছি। একখানি ক্ষুদ্র লিপিতে ঐসকল প্রশ্নের সদুত্তর সম্ভব নহে, তবে যথাসম্ভব সংক্ষেপে উত্তর লিখিতেছি।

১। ঋষি, মুনি, দেবতা কাহারও সাধ্য নাই যে, সামাজিক নিয়মের প্রবর্তন করেন। সমাজের পশ্চাতে যখন তৎকালীন আবশ্যকতার বেগ লাগে, তখন আত্মরক্ষার জন্য আপনা- আপনি কতকগুলি আচারের আশ্রয় লয়।

ঋষিরা ঐ সকল আচার লিপিবদ্ধ করিয়াছেন মাত্র। আত্মরক্ষার জন্য মনুষ্য যেমন অনেক সময় তৎকালে রক্ষা পাইবার উপযোগী অনেক আগামী-অতি-অহিতকর উপায় অবলম্বন করে, সেই প্রকার সমাজও অনেক সময় সেই সময়ের জন্য রক্ষা পান, কিন্তু যে উপায়ে বাঁচেন, তাহা পরিণামে ভয়ঙ্কর হয়।

যথা, আমাদের দেশে বিধবা-বিবাহ-প্রতিষেধ। মনে করিও না যে, ঋষি বা দুষ্ট পুরুষেরা ঐ সকল নিয়ম প্রবর্তিত করিয়াছে। পুরুষজাতির স্ত্রীকে সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীন রাখিবার ইচ্ছা থাকিলেও সমাজের সাময়িক আবশ্যকতার সহায় অবলম্বন ব্যতিরেকে কখনও সফলকাম হয় না। এই আচারের মধ্যে দুটি অঙ্গ বিশেষ দ্রষ্টব্য।

ক) ছোট জাতিদের মধ্যে বিধবার বিবাহ হয়।
খ) ভদ্র জাতিদের মধ্যে পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীর সংখ্যা অধিক।

এক্ষণে যদি প্রত্যেক কন্যাকেই বিবাহ দেওয়া নিয়ম হয়, তাহা হইলে এক-একটির এক-একটি পাত্র মিলাই কঠিন, এক-এক জনের দুই তিনটি কোথা হইতে হয়? কাজেই সমাজ একপক্ষের হানি করিয়াছে, অর্থাৎ যে একবার পতি পাইয়াছে, তাহাকে আর পতি দেয় না; দিলে একটি কুমারী পতি পাইবে না। যে সকল জাতিতে আবার স্ত্রীর সংখ্যা কম, তাহাদের পূর্বোক্ত বাধা না থাকায় বিধবার বিবাহ হয়।

ঐ প্রকার জাতিভেদ-বিষয়ে এবং অন্যান্য সামাজিক আচার সম্বন্ধেও।

পাশ্চাত্যদেশে ঐ প্রকার কুমারীদের পতি পাওয়া বড়ই সঙ্কট হইতেছে।

ঐ প্রকার যদি সামাজিক কোন আচারের পরিবর্তন ঘটাইতে হয়, তাহা হইলে ঐ আচারের মূলে কি আবশ্যকতা আছে, সেটিই প্রথম অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে এবং সেইটি পরিবর্তন করিয়া দিলেই উক্ত আচারটি আপনা হইতেই নষ্ট হইয়া যাবে। তদ্ভিন্ন নিন্দা বা স্তুতির দ্বারা কাজ হইবে না।

২। এক্ষণে কথা এইঃ সমাজ এই যে-সকল নিয়ম করে, অথবা সমাজ যে সংগঠিত হয়, তাহা কি সামাজিক সাধারণের কল্যাণের নিমিত্ত? অনেকে বলেন, হাঁ; আবার কেহ কেহ বলিতে পারেন তাহা নহে। কতকগুলি লোক অপেক্ষাকৃত শক্তিমান্‌ হইয়া ধীরে ধীরে অপর সকলকে আপনার অধীন করিয়া ফেলে এবং ছলে বলে কৌশলে স্ব-কামনা পূর্ণ করে। যদি ইহাই সত্য হয়, তাহা হইলে অজ্ঞ লোকদিগকে স্বাধীনতা দেওয়ায় ভয় আছে, এ কথার মানে কি? স্বাধীনতা মানেই বা কি?

আমার তোমার ধনাদি অপহরণের কোন বাধা না থাকার নাম কিছু স্বাধীনতা নহে, কিন্তু আমার নিজের শরীর বা বুদ্ধি বা ধন অপরের অনিষ্ট না করিয়া যে প্রকার ইচ্ছা সে প্রকার ব্যবহার করিতে পারিব, ইহা আমার স্বাভাবিক অধিকার; এবং উক্ত ধন বা বিদ্যা বা জ্ঞানার্জনের—সকল সামাজিক ব্যক্তির সমান সুবিধা যাহাতে থাকে, তাহাও হওয়া উচিত।

দ্বিতীয় কথা এই যে, যাঁহারা বলেন, অজ্ঞ বা গরীবদের স্বাধীনতা দিলে অর্থাৎ তাহাদের শরীর, ধন ইত্যাদিতে তাহাদের পূর্ণ অধিকার দিলে এবং তাহাদের সন্তানের ধনী উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সন্তানের ন্যায় জ্ঞানার্জনের এবং আপনার অবস্থার উন্নতি করিবার সমান সুবিধা হইলে তাহারা উচ্ছৃঙ্খল হইয়া যাইবে, তাঁহারা কি এ কথা সমাজের কল্যাণের জন্য বলেন অথবা স্বার্থে অন্ধ হইয়া বলেন? ইংলণ্ডেও একথা শুনিয়াছি—‘ছোটলোকেরা লেখাপড়া শিখিলে আমাদের চাকুরি কে করিবে?’

মুষ্টিমেয় ধনীদের বিলাসের জন্য লক্ষ লক্ষ নরনারী অজ্ঞতার অন্ধকারে ও অভাবের নরকে ডুবিয়া থাকুক, তাহাদের ধন হইলে বা তাহারা বিদ্যা শিখিলে সমাজ উচ্ছৃঙ্খল হইবে!!!

সমাজ কে? লক্ষ লক্ষ তাহারা? না, এই তুমি আমি দশ জন বড় জাত!!!

আর যদি তাহাই সত্য হয়, তাহা হইলেও তোমার আমার কি অহঙ্কার যে, আমরা সকলকে পথ দেখাই? আমরা কি সবজান্তা?

‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানম্‌’—আপনিই আপনার উদ্ধার কর। যে যার আপনার উদ্ধার করুক। সর্ববিষয়ে স্বাধীনতা অর্থাৎ মুক্তির দিকে অগ্রসর হওয়াই পুরুষার্থ। যাহাতে অপরে—শারীরিক, মানসিক, ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হইতে পারে, সে বিষয়ে সহায়তা করা ও নিজে সেই দিকে অগ্রসর হওয়াই পরম পুরুষার্থ।

যে সকল সামাজিক নিয়ম এই স্বাধীনতার স্ফূর্তির ব্যাঘাত করে, তাহা অকল্যাণকর এবং যাহাতে তাহার শীঘ্র নাশ হয়, তাহাই করা উচিত। যে-সকল নিয়মের দ্বারা জীবকুল স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়, তাহার সহায়তা করা উচিত।

৩। এ জন্মে যে হঠাৎ দেখিবামাত্র তাদৃগ্‌গুণাদিসম্পন্ন না হইলেও ব্যক্তি-বিশেষের উপর আমাদের আন্তরিক প্রেম আসিয়া উপস্থিত হয়, তাহা অস্মদ্দেশীয় পণ্ডিতেরা পূর্বজন্মজনিত বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন।

৪। ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধে তোমার প্রশ্নটি বড়ই সুন্দর এবং ঐটিই বুঝিবার বিষয়। সকল ধর্মের ইহাই সার—বাসনার বিনাশ; সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয় ইচ্ছারও বিনাশ হইল; কারণ বাসনা ইচ্ছাবিশেষের নামমাত্র। তবে আবার এ জগৎ কেন? এ সকল ইচ্ছার বিকাশই বা কেন? কয়েকটি ধর্ম বলেন যে, অসদিচ্ছারই নাশ হওয়া উচিত, সত্যের নহে। বাসনাত্যাগ ইহলোকে পরলোকে ভোগের দ্বারা পরিপূরিত হইবে।

এ উত্তরে অবশ্যই পণ্ডিতেরা সন্তুষ্ট নহেন। বৌদ্ধাদি অপরদিকে বলিতেছেন যে, বাসনা দুঃখের মূল, তাহার নাশই শ্রেয়ঃ, কিন্তু মশা মারিতে মানুষ মারার মত বৌদ্ধাদি মতে দুঃখ নাশ করিতে নিজেকেও নাশ করিয়া ফেলিলাম।

সিদ্ধান্ত এই যে, যাহাকে আমরা ইচ্ছা বলি, তাহা তদপেক্ষা আরও উচ্চতর অবস্থার নিম্ন পরিণাম। নিষ্কাম মানে ইচ্ছাশক্তিরূপ নিম্ন পরিণামের ত্যাগ এবং উচ্চ পরিণামের আবির্ভাব। ঐরূপ (অবস্থা) মনোবুদ্ধির অগোচর, কিন্তু যেমন মোহর দেখিতে টাকা এবং পয়সা হইতে অত্যন্ত পৃথক্‌ হইলেও নিশ্চিত জানি যে, মোহর দুয়ের অপেক্ষা বড়, সেই প্রকার ঐ উচ্চতম অবস্থা বা মুক্তি বা নির্বাণ যাহাই বল,

মনোবুদ্ধির অগোচর হইলেও ইচ্ছাদি সমস্ত শক্তি অপেক্ষা বড়, যদিও তাহা শক্তি নহে, কিন্তু শক্তি তাহার পরিণাম, এ জন্য সে বড়; যদিও সে ইচ্ছা নহে, কিন্তু ইচ্ছা তাহার নিম্ন পরিণাম, এজন্য তাহা বড়। এখন বোঝ, সকাম ও পরে নিষ্কামভাবে যথাযথ ইচ্ছাশক্তির পরিচালনার ফল এই যে, ইচ্ছাশক্তিটিই তদপেক্ষা অনেক উন্নত অবস্থা লাভ করিবে।

৫। গুরুমূর্তি প্রথমে ধ্যান করিতে হয়, পরে তাহা লয় করিয়া ইষ্টমূর্তি বসাইতে হয়। এ-স্থলে প্রীতিপাত্রই ইষ্টরূপে গ্রাহ্য।

মনুষ্যে ঈশ্বর আরোপ বড়ই মুশকিল; কিন্তু চেষ্টা করিতে করিতে নিশ্চয়ই সফল হওয়া যায়। প্রতি মনুষ্যে তিনি আছেন, সে জানুক বা না জানুক; তোমার ভক্তিতে সে ঈশ্বরত্ব-উদয় তাহার মধ্যে হইবেই হইবে।

সতত কল্যাণাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ

 


পত্রাবলী – ৩৯৫*

[শ্রী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২৫ ফেব্রুআরী, ১৮৯৮

প্রিয় শশী,

মান্দ্রাজের মহোৎসব সুসম্পন্ন হইয়াছে জানিয়া আমরা সকলেই তোমায় অভিনন্দন জানাইতেছি। আশা করি, লোকসমাগম ভালই হইয়াছিল এবং আধ্যাত্মিক খোরাকেরও যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল।

তোমার অতি প্রিয় মুদ্রাদি এবং ‘ক্লীঁফটে’র পরিবর্তে তুমি যে মান্দ্রাজের লোকদের আত্মবিদ্যা শিখাইবার জন্য অধিকতর কোমর বাধিয়া লাগিয়া গিয়াছ, তাহাতে আমরা খুব খুশী হইয়াছি। শ্রীজি৬ সম্বন্ধে তোমার বক্তৃতা সত্যই চমৎকার হইয়াছিল—যদিও আমি খাণ্ডোয়ার থাকা-কালে ‘মান্দ্রাজ মেল’ পত্রে ছাপা উহার একটা বিবরণ একটু দেখিয়াছিলাম মাত্র, এবং মঠে তো উহার কিছুই পাই নাই। তুমি আমাদিগকে একখানি কপি পাঠাইয়া দাও না?

শুনিতে পাইলাম, আমার পত্রাদি না পাইয়া তুমি ক্ষুণ্ণ হইয়াছ; সত্য কি? প্রকৃতপক্ষে তুমি আমায় যত চিঠি লিখিয়াছ, আমি ইওরোপ ও আমেরিকা হইতে তোমায় তদপেক্ষা অধিক লিখিয়াছি। তোমার উচিত মান্দ্রাজ হইতে প্রতি সপ্তাহে যতটা সম্ভব খবর আমাদিগকে পাঠান। সর্বাপেক্ষা সহজ উপায় হইতেছে, প্রতিদিন একখানি কাগজে কয়েক পঙ‍্‍ক্তি ও কয়েকটি সংবাদ টুকিয়া রাখা।

কিছুকাল যাবৎ আমার শরীর ভাল যাইতেছিল না। সম্প্রতি অনেক ভাল। এখন কলিকাতায় অন্যান্য বৎসর অপেক্ষা একটু বেশী শীত পড়িয়াছে এবং আমেরিকা হইতে যেসব বন্ধুরা আসিয়াছেন, তাঁহারা ইহাতে খুব আনন্দেই আছেন। যে জমি কেনা হইয়াছে, আজ আমরা উহার দখল লইব এবং যদিও এখনই ঐ জমিতে মহোৎসব করা সম্ভবপর নহে, তথাপি রবিবারে উহার উপর আমি কিছু না কিছু করাইব। অন্ততঃ শ্রীজীর ভস্মাবশেষ ঐ দিনের জন্য আমাদের নিজস্ব জমিতে লইয়া গিয়া পূজা করিতেই হইবে।

গঙ্গা এখানে আছে এবং তোমায় জানাইয়া দিতে বলিতেছি, সে যদিও ‘ব্রহ্মবাদিন্’ কাগজের জনকয়েক গ্রাহক যোগাড় করিয়াছে, তথাপি কাগজ এত অনিয়মিতভাবে পৌঁছায় যে, তাহার ভয় হয়—তাহাদের সকলকে শীঘ্রই না হারাইতে হয়। তুমি জনৈক যুবকের সম্বন্ধে যে প্রশংসাপত্র দিয়াছ, উহা পাইয়াছি এবং উহার সঙ্গে আছে সেই চিরন্তন কাহিনী, ‘মহাশয় আমার জীবনধারণের কোনই উপায় নাই।’

অধিকন্তু এই কাহিনীর মান্দ্রাজী সংস্করণে এইটুকু বেশী আছে—‘আমার অনেকগুলি সন্তানও আছে।’ … আমি তাহাকে সাহায্য করিতে পারিলে খুশী হইতাম, কিন্তু সত্য বলিতে কি, আমার হাতে টাকা নাই— আমার যাহা ছিল, তাহার শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত রাজার* হাতে দিয়াছি।

… যাহা হউক আমি পত্রখানি রাখালকে পাঠাইয়াছি—সে যদি কোন প্রকারে তোমার বন্ধু যুবকটিকে সাহায্য করিতে পারে। সে লিখিয়াছে যে, সে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করিলে খ্রীষ্টানরা তাকে সাহায্য করিবে, কিন্তু সে তাহা করিবে না। তাহার হয়তো ভয় হইতেছে, পাছে তাহার ধর্মান্তর গ্রহণে হিন্দুভারত একটি উজ্জ্বলতম রত্নকে হারায়! …

নূতন মঠে নদীতীরে বাস করিতে হওয়ায় এবং যে পরিমাণ বিশুদ্ধ ও ঠাণ্ডা হাওয়া উপভোগ করিতে হইতেছে, তাহাতে অভ্যস্ত না থাকায় এখানে ছেলেরা অনেকটা হয়রান হইয়া পড়িতেছে। সারদা দিনাজপুর হইতে ম্যালেরিয়া লইয়া আসিয়াছে।

… হরিরও একটু হইয়াছিল। আমার মনে হয় ইহাতে তাহাদের অনেকটা মাংস ঝরিবে। ভাল কথা, আমরা এখানে আবার আমাদের নাচের ব্যাপার আরম্ভ করিয়াছি; হরি, সারদা ও স্বয়ং আমাকে ওয়াল‍্‍ট‍্‍জ (waltz) নৃত্য করিতে দেখিলে তুমি আনন্দে ভরপুর হইতে। আমি নিজেই অবাক হইয়া যাই যে, আমরা কিরূপে টাল সামলাইয়া রাখি।

শরৎ আসিয়াছে এবং তাহার অভ্যাসমত কঠোর পরিশ্রম করিতেছে। এখন আমাদের কিছু ভাল আসবাব হইয়াছে—ভাব দেখি সেই পুরানো মঠের চাটাই ছাড়িয়া সুন্দর টেবিল, চেয়ার ও তিনখানি খাট পাওয়া কত বড় উন্নতি! আমার পূজার কাজটাকে অনেকটা সংক্ষিপ্ত করিয়া আনিয়াছি। তোমার ‘ক্লীঁফট্’, ঝাঁজ ও ঘণ্টার যেভাবে কাটছাঁট করা হইয়াছে, তাহাতে তুমি মূর্ছা যাইবে।

জন্মতিথি পূজা শুধু দিনের বেলা হইয়াছে এবং রাত্রে সকলে আরামে ঘুমাইয়াছে। তুলসী ও খোকা কেমন আছে? তুমি তুলসীকে কাজের ভার দিয়া একবার কলিকাতায় আস না? কিন্তু উহা ভয়ানক খরচাসাপেক্ষ—আর তোমাকে তো ফিরিয়াও যাইতে হইবে; কারণ মান্দ্রাজের কাজটা পুরাপুরি গড়িয়া তোলা দরকার। আমি মাসকয়েক পরেই মিসেস বুলের সঙ্গে আবার আমেরিকায় যাইতেছি।

গুডউইনকে আমার ভালবাসা জানাইও এবং তাহাকে বলিও, আমরা অন্ততঃ জাপানে যাইবার পথে তাহার সাথে দেখা করিব। শিবানন্দ এখানে আছেন এবং আমি তাহার হিমালয়ে চিরপ্রস্থানের প্রবল আগ্রহ কতকটা দমাইয়াছি। তুলসীও তাহাই ভাবিতেছে নাকি? আমার মনে হয়, ওখানকার বড় বড় ইঁদুরের গর্তেই তাহার গুহার সাধ মিটিতে পারে—কি বল?

এখানে মঠ তো স্থাপিত হইল। আমি আরও সাহায্যের জন্য বিদেশ যাইতেছি। … শ্রীমহারাজের আশীর্বাদে ভারত বাঁচিয়া উঠিবে। আমার আন্তরিক ভালবাসা জানিবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৩৯৬*
[রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়কে লিখিত]

মঠ, বেলুড়
২৫ ফেব্রুআরী, ১৮৯৮

প্রিয় রাজাজী,

বক্তৃতার জন্য আপনার আমন্ত্রণ পেয়ে আপনাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। দিনকয়েক আগে শ্রীযুক্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গে এই বিষয়ে আমার আলাপ হয়েছিল এবং তার ফলে আপনাদের সমিতির জন্য একটু সময় ঠিক করতে আমি বিশেষ চেষ্টা করছি। আমি এও বলেছিলাম যে, রবিবারে তাদের সঠিক জানাব।

একজন বিশেষ বন্ধুর কাছে আমি অনেকটা ঋণী; তিনি সম্ভবতঃ দার্জিলিঙ নিয়ে যাবার জন্য এখানে এসেছেন। জনকয়েক আমেরিকান বন্ধুও এখানে এসেছেন এবং আমি যা কিছু সময় পাই, তার সবটাই নতুন মঠ এবং তৎসংলগ্ন প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যে নিয়োজিত হচ্ছে। তা ছাড়া আমার আশা এই যে, আগামী মাসে আমেরিকা যাত্রা করব।

আপনাকে সত্যই বলছি—আপনার এই নিমন্ত্রণের সুযোগ গ্রহণের জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি এবং ফলাফল শ্রীযুক্ত ভট্টাচার্যের মারফত রবিবারে আপনাকে জানাব।

আমার ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জানবেন। ইতি

বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৩৯৭*
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
মার্চ, ১৮৯৮

প্রিয় শশী,
আমি তোমায় দুইটি কথা লিখিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম। (১) তুলসীর উচিত গুডউইনের নিকট হইতে সাঙ্কেতিক লিখন—অন্ততঃ উহার গোড়ার জিনিষ—শিখিয়া লওয়া। (২) ভারতের বাইরে থাকা-কালে আমাকে প্রায় প্রতি ডাকে মান্দ্রাজে একখানি চিঠি লিখিতে হইত। আমি ঐ সব চিঠির নকলের জন্য লিখিয়া বিফল হইয়াছি। আমাকে ঐ সব চিঠি পাঠাইয়া দিও। আমি আমার ভ্রমণকাহিনী লিখিতে চাই। ইহাকে অন্যথা করিও না।

কাজ হইয়া গেলেই আমি ঐগুলি ফেরত পাঠাইয়া দিব! ‘ডন্’ (Dawn) কাগজখানির প্রতি সংখ্যার জন্য ৪০ টাকা খরচ হইবে এবং দুইশত গ্রাহক পাইলেই উহা নিয়মিত প্রকাশিত হইতে পারিবে—ইহা একটা মস্ত খবর।

‘প্রবুদ্ধ ভারত’ অত্যন্ত অব্যবস্থার মধ্যে রহিয়াছে বলিয়া মনে হয়; উহার সুশৃঙ্খলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা কর। বেচারা আলাসিঙ্গা! আমি তাহার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। আমি এইটুকু করিতে পারি যে, সে এক বৎসরের জন্য সকল সাংসারিক দায় হইতে মুক্ত থাকিবে, যাহাতে সে সমস্ত শক্তি দিয়া ‘ব্রহ্মবাদিন্’ কাগজের জন্য খাটিতে পারে। তাহাকে বলিও সে যেন চিন্তিত না হয়। তাহার কথা আমাদের সর্বদাই মনে আছে। তাহার ভক্তির প্রতিদান আমি কখনই দিতে পারিব না।

আমি ভাবিতেছি, মিসেস বুল ও মিস ম্যাকলাউডের সঙ্গে আবার কাশ্মীর যাইব।তাহার পর কলিকাতায় ফিরিয়া সেখান হইতে আমেরিকা যাত্রা করিব।

মিস নোব্‌লের মতে মেয়ে সত্যি দুর্লভ। আমার বিশ্বাস, বাগ্মিতায় সে শীঘ্রই মিসেস বেস্যাণ্টকে ছাড়াইয়া যাইবে।

আলাসিঙ্গার প্রতি একটু নজর রাখিও। আমার মনে হয় সে যেন কাজে ডুবিয়া গিয়া নিজের শরীরপাত করিতেছে। তাহাকে বলিও শ্রমের পর বিশ্রাম এবং বিশ্রামের পর শ্রম—এই ভাবেই সর্বাপেক্ষা ভাল কাজ হইতে পারে। তাহাকে আমার ভালবাসা জানাইও। কলিকাতায় জনসাধারণের জন্য আমাদের দুইটি বক্তৃতা হইয়াছিল—একটি মিস নোবলের এবং অপরটি আমাদের শরতের। তাহারা দুজনেই খুব চমৎকার বলিয়াছিল।

শ্রোতাদের মধ্যে প্রচুর উৎসাহ দেখা গিয়াছিল। উহাতে মনে হয়, কলিকাতার জনসাধারণ আমাদিগকে ভুলিয়া যায় নাই। মঠের কাহারও কাহারও একটু সর্দিজ্বর হইয়াছিল। তাহারা সকলেই এখন ভাল। কাজ সুন্দর চলিয়া যাইতেছে। শ্রীমা এখন আছেন। ইওরোপীয়ান ও আমেরিকান মহিলারা সেদিন তাঁহাকে দেখিতে গিয়াছিলেন। ভাবিতে পার, মা তাঁহাদের সহিত একসঙ্গে খাইয়াছিলেন!

… ইহা কি অদ্ভুত ব্যাপার নয়? প্রভু আমার উপর দৃষ্টি রাখিয়াছেন, কোন ভয় নাই—সাহস হারাইও না, স্বাস্থ্য ঠিক রাখিও এবং কোন বিষয়ে অতি ব্যস্ত হইও না। খানিকক্ষণ জোরে দাঁড় টানিয়া তার পর দম লওয়া—ইহাই চিরন্তন পন্থা। রাখাল নূতন জমি-বাড়ি লইয়া আছে। এই বৎসরের মহোৎসবে আমি সন্তুষ্ট হই নাই। …

প্রত্যেক মহোৎসব হওয়া চাই—এখানকার সকল ভাবধারার একটি অপূর্ব সমাবেশ। আমরা আগামী বৎসর এ বিষয়ে চেষ্টা করিব এবং আমি ব্যবস্থা ঠিক করিয়া দিব। তোমরা সকলে আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানিবে। ইতি

বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৩৯৮*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২ মার্চ, ১৮৯৮

স্নেহের মেরী,

মাদার চার্চের কাছে লেখা চিঠিতে আশা করি আমার খবর আগেই জানতে পেরেছ। তোমরা সকলে—সমস্ত পরিবারটিই—আমার প্রতি এত সদয় যে, মনে হয় পূর্বজন্মে আমি নিশ্চয়ই তোমাদেরই একজন ছিলাম, আমরা হিন্দুরা তো এই রকমই বলে থাকি। আমার একমাত্র আক্ষেপ যে, কোটিপতি আর জুটছে না; এই মুহূর্তে তাদের আমার খুবই প্রয়োজন; আমি সংগঠনের কাজ করতে করতে জরাজীর্ণ ও উগ্র স্বভাব হয়ে উঠছি।

হ্যারিয়েট যদিও কোটিগুণসম্পন্ন একজনকে লাভ করেছে, তার সঙ্গে কয়েক কোটি টাকার অর্থ-গুণ থাকলে নিশ্চয় মানাত ভাল; সুতরাং তুমি আবার যেন সেই ভুলটি করে বসো না।

কোন এক তরুণযুগলের স্বামী-স্ত্রী হবার পক্ষে সব কিছুই অনুকূল ছিল, কিন্তু কনের পিতার দৃঢ় সংকল্প যে, কোটিপতি ছাড়া কাউকে তিনি কন্যা সম্প্রদান করবেন না। তরুণযুগল হতাশ হয়ে পড়ল, এমন সময় এক চতুর ঘটক এসে কার্যোদ্ধার করলে। সে বরকে জিজ্ঞেস করলে, দশ লক্ষ মুদ্রার পরিবর্তে সে তার নাসিকা দিতে প্রস্তুত কিনা। সে বললে, না।

ঘটকটি তারপর কন্যার পিতার সামনে শপথ করে বললে যে, বরের বহু লক্ষ টাকা মূল্যের সম্পত্তি সঞ্চিত আছে। বিয়ে হয়ে গেল। হ্যাঁ, তোমারও কোটিপতি জুটছে না, আর আমারও তাই টাকা মিলছে না; সেজন্য আমাকে অনেক দুর্ভাবনায় পড়তে হয়েছে এবং নিষ্ফল কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে, তাই রোগে আক্রান্ত। হ্যাঁ, আসল কারণটি খুঁজে বার করা আমার মত মাথারই কাজ—নিজেকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই!

লণ্ডন থেকে ফিরে এসে যখন আমি দক্ষিণ ভারতে, এবং যখন লোকেরা আমাকে উৎসবে ভোজে আপ্যায়িত করছে ও আমার কাছ থেকে ষোল আনা কাজ আদায় করে নিচ্ছে, এমন সময় একটি বংশগত পুরানো রোগ এসে দেখা দিল। রোগের প্রবণতা (সম্ভাবনা) সব সময়ই ছিল, এখন অত্যধিক মানসিক পরিশ্রমে তা আত্মপ্রকাশ করল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরে এল সম্পূর্ণ ভাঙন ও চূড়ান্ত অবসাদ। আমাকে তৎক্ষণাৎ মান্দ্রাজ ছেড়ে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা উত্তরাঞ্চলে আসতে হল;

একদিন দেরী করা মানে অন্য জাহাজ ধরবার জন্য সেই প্রচণ্ড গরমে আরও এক সপ্তাহ অপেক্ষা করা। কথায় কথায় বলছি—আমি পরে জানতে পেরেছি যে, মিঃ ব্যারোজ পরদিন মান্দ্রাজ এসে পৌঁছেছিলেন এবং তাঁর প্রত্যাশা-মত আমাকে সেখানে না পেয়ে খুবই রুষ্ট হয়েছিলেন—যদিও আমি তাঁর থাকবার জায়গার ও সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করে এসেছিলাম। বেচারী জানে না আমি তখন মরণাপন্ন।

গত গ্রীষ্মকালটা হিমালয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি; দেখলাম ঠাণ্ডা আবহাওয়ার মধ্যে আসতে না আসতেই সুস্থ বোধ করি, কিন্তু সমতলে গরমে যেতে না যেতে আবার শয্যাশায়ী হয়ে পড়ি। আজ থেকে কলিকাতায় বেজায় গরম পড়েছে, তাই আবার আমাকে পালিয়ে যেতে হবে।

এবার সুশীতল আমেরিকায়, কারণ মিসেস বুল ও মিস ম্যাকলাউড এখন এখানে। কলিকাতার কাছে গঙ্গাতীরে আমি সঙ্ঘের জন্য একখণ্ড জমি কিনেছি। এখানে একটি ছোট বাড়ীতে তাঁরা এখন বাস করছেন; খুব কাছেই যেখানে এখন মঠ স্থাপিত হয়েছে, সে বাড়ীতে আমরা রয়েছি।

প্রত্যহ তাঁদের সঙ্গে দেখা করি, এতে তাঁরাও খুব আনন্দিত। এক মাস পরে তাঁদের একবার কাশ্মীর ভ্রমণে বেরোবার ইচ্ছা; যদি তাঁরা চান, আমি তাঁদের সঙ্গে যাব— পরামর্শদাতা, বন্ধু ও সম্ভবতঃ দার্শনিক হিসাবে। তারপর আমরা সবাই সমুদ্রপথে স্বাধীনতা ও কুৎসার দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হব।

তুমি আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ো না, কারণ রোগটা আর দুই-তিন বছর আমাকে টেনে নিয়ে যাবে। বড় জোড় নির্দোষ সঙ্গীর মত থেকে যেতে পারে। আমার কোন খেদ নেই।কেবল কাজটাকে গুছিয়ে নেবার জন্য সর্বক্ষণ কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি—শুধু এইজন্য যে, আমি এখন রঙ্গমঞ্চ থেকে সরে যাব, তখনও যেন যন্ত্রটি সামনের দিকে এগিয়ে চলে।

বহুদিন আগে যেদিন জীবনকে বিসর্জন দিয়েছি, সেইদিনই আমি মৃত্যুকে জয় করেছি। আমার একমাত্র দুশ্চিন্তা হল ‘কাজ’, এমন কি তাও প্রভুকে সমর্পণ করে দিচ্ছি, তিনিই সবচেয়ে ভাল জানেন।

সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৩৯৯*
[মিস ম্যাকলাউডকে লিখিত]

দার্জিলিঙ
১৮ এপ্রিল, ১৮৯৮

প্রিয় জো জো,

আমি জ্বরে শয্যাগত ছিলাম। সম্ভবতঃ অত্যধিক পর্বতারোহণ এবং ঐ স্থানের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার জন্য এরূপ হইয়া থাকবে। আজ আমি আগের চেয়ে ভাল আছি, দু-এক দিনের মধ্যেই এখান থেকে চলে যাবার ইচ্ছা। কলিকাতায় খুব গরম হলেও সেখানে আমার বেশ ঘুম হত এবং ক্ষুধাও মন্দ হত না। এখানে দুই-ই হারিয়েছি—এই যা লাভ!

মার্গারাইটের সম্বন্ধে এখনও মিস মূলারের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে পারিনি; কিন্তু আজ তাঁকে পত্র লেখার ইচ্ছা আছে। মার্গারাইট এখানে আসবে বলে তিনি সব আয়োজন করেছেন। তাঁদের বাঙলা শেখাবার জন্য মিঃ গুপ্তকেও আমন্ত্রণ করা হয়েছে। মিস মূলার বোধ হয় এখন মার্গারাইটের জন্য কিছু করবেন; তবু আমি তাঁকে লিখব।

এ দেশে থাকাকালে মার্গারাইট যে-কোন সময়ে কাশ্মীর দেখতে যেতে পারে; কিন্তু মিস—যদি রাজী না হন, তাহলেই আবার একটা প্রকাণ্ড গোলযোগ বাধবে, আর তাতে তাঁর ও মার্গারাইট দু-জনেরই ক্ষতি হবে।

আবার আলমোড়া যাব কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই। মনে হয়, অধিক অশ্বারোহণের ফলে আবার রোগে পড়তে হবে নিশ্চিত। আমি তোমার জন্য সিমলায় অপেক্ষা করব। ইতোমধ্যে তুমি সেভিয়ারদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সেরে নাও। কাজ শুরু করে তবে এ-বিষয়ে ভেবে দেখব। মিস নোব্‌ল্‌ রামকৃষ্ণ মিশনে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন জেনে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। তোমাদের ত্রিমূর্তিকে আন্তরিক ভালবাসা জানাচ্ছি। ইতি

সতত ভগবদাশ্রিত
তোমার বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৪০০
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

দার্জিলিঙ
২৩ এপ্রিল, ১৮৯৮

অভিন্নহৃদয়েষু,

সন্দুকফু (Sandukphu, 11, 924 ft.) প্রভৃতি স্থান হইতে আসিয়া অবধি শরীর উত্তম ছিল, কিন্তু পুনর্বার দার্জিলিঙ আসিয়া অবধি প্রথম জ্বর, তাহা সারিয়া সর্দি-কাশিতে ভুগিতেছি। রোজ পালাইবার চেষ্টা করি; ইহারা আজ কাল করিয়া দেরী করিয়া দিল। যাহা হউক কাল রবিবার এ-স্থান হইতে যাত্রাপথে খর্সানেতে একদিন থাকিয়া সোমবার কলিকাতায় যাত্রা।

ছাড়িয়াই ‘তার’ পাঠাইব। রামকৃষ্ণ মিশনের একটি anniversary meeting (বাৎসরিক সভা) করা উচিত এবং মঠেরও একটি হওয়া উচিত। তাহাতে দুই জায়াগায় famine relief (দুর্ভিক্ষে সাহায্য)-এর হিসাব submit (পেশ) করিতে হইবে এবং famine relief-টা publish (প্রকাশ) করিতে হইবে। এই সমস্ত তৈয়ার রাখিবে।

নৃত্যগোপাল বলে, ইংরেজী কাগজটার খরচ অল্প; অতএব প্রথম উহা বাহির করিয়া পরে বাঙলাটা দেখা যাবে। এ-সকলও বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে। যোগেন কাগজের ভার লইতে রাজী আছে? শশী লিখছে—শরৎ যদি একবার মান্দ্রাজে যায়, তারা হইলে তারা লেকচার tour (বক্তৃতা সফর) করে।

বাবা, যে গরম এখন! শরৎকে জিজ্ঞাসা করবে—জি. সি., সারদা, শশীবাবু প্রভৃতি articles (প্রবন্ধ) তৈয়ার রেখেছেন কিনা। মিসেস বুল, ম্যাকলাউড ও নিবেদিতাকে আমার love (ভালবাসা) ও blessings (শুভেচ্ছা) দিবে। আন্তরিক ভালবাসা জানিবে।

বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৪০১*
দার্জিলিঙ
২৯ এপ্রিল, ১৮৯৮

প্রিয় জো জো,

আমার অনেক বার জ্বর হয়ে গেল—সর্বশেষ হয়েছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা। এখন তা সেরে গেছে বটে, কিন্তু ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়েছি। হাঁটবার উপযুক্ত শক্তি লাভ করলেই আমি কলিকাতায় নেমে আসছি।

রবিবারে দার্জিলিঙ ছাড়ব; পথে হয়তো দু-এক দিন কার্সিয়াং-এ কাটাব; তারপর সোজা কলিকাতায়। কলিকাতায় এখন নিশ্চয় ভয়ানক গরম। তুমি সে জন্য ভেবো না—ইনফ্লুয়েঞ্জার পক্ষে তা ভালই হবে। কলিকাতায় যদি প্লেগ শুরু হয়, তবে আমার কোথাও যাওয়া হবে না; তুমি তাহলে সদানন্দের সঙ্গে কাশ্মীর চলে যেও। বৃদ্ধ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়কে তোমার কিরূপ মনে হল?

চন্দ্রদেবতা ও সূর্যদেবতা সমেত ‘হন‍্স্ বাবা’ যেমন ফিটফাট হয়ে থাকেন, ইনি অবশ্য সেরূপ নন। অন্ধকার রাত্রে যদি অগ্নিদেবতা, সূর্যদেবতা, চন্দ্রদেবতা ও তারকাদেবীরা ঘুমিয়ে পড়েন, তখন কে তোমার অন্তর আলোকিত করে? আমি তো এইটুকু আবিষ্কার করেছি যে, ক্ষুধাই আমার চৈতন্যকে জাগিয়ে রাখে। আহা, ‘আলোকের ঐক্য’-রূপ (Correspondence of light) মহান্‌ মতবাদটি কি অপূর্ব!

ভাব দেখি, এই মতবাদের অভাবে জগৎ বহু যুগ ধরে কি অন্ধকারেই না ছিল! এ সব জ্ঞান, ভালবাসা ও কর্ম এবং যত বুদ্ধ, কৃষ্ণ, খ্রীষ্ট—সবই বৃথা। তাঁদের জীবন ও কার্য একেবারে ব্যর্থ হয়েছে; কারণ রাত্রে যখন সূর্য ও চন্দ্র তিমিরলোকে ডুবে যায়, তখন কে যে অন্তরের আলো জাগিয়া রাখে, এ তত্ত্ব তো তারা আবিষ্কার করতে পারেননি!! বড়ই মুখরোচক— কি বল?

আমি যে শহরে জন্মেছি, সেখানে যদি প্লেগ এসে পড়ে, তবে আমি তার প্রতিকারকল্পে আত্মোৎসর্গ করব বলেই স্থির করেছি; আর জগতে যত জ্যোতিষ্ক আজ পর্যন্ত আলো দিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়ার চেয়ে এ উপায়টা আমার নির্বাণলাভের প্রকৃষ্টতর উপায়!

মান্দ্রাজের সঙ্গে বহু চিঠি আদান-প্রদানের ফলে এই দাঁড়িয়েছে যে, এখনই আমাকে তাদের জন্য কোন সাহায্য পাঠাতে হবে না। প্রত্যুত আমি কলিকাতায় একখানি কাগজ চালাব। তুমি যদি ঐ কাগজ চালু করতে আমায় সাহায্য কর, তবে খুবই কৃতজ্ঞ হব। চিরকালের জন্য আমার অফুরন্ত ভালবাসা জানবে।

সদা প্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৪০২*
আলমোড়া
২০ মে, ১৮৯৮

প্রিয় মিস নোব্‌ল্

… কর্তব্যের শেষ নাই; আর জগৎ বড়ই স্বার্থপর।

তুমি দুঃখ কর না; ‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি’—(কল্যাণকারী কেহই দুর্গতি প্রাপ্ত হয় না)। ইতি

সতত তোমাদের
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৪০৩
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

আলমোড়া
২০ মে, ১৮৯৮

অভিন্নহৃদয়েষু,

তোমার পত্রে সকল সমাচার অবগত হইলাম ও তোমার ‘তারে’র জবাব পূর্বেই দিয়েছি। নিরঞ্জন গোবিন্দলাল সা কাঠগুদামে যোগীন-মার অপেক্ষা করিবে। আমি নৈনিতালে পৌঁছিলে এখান হইতে বাবুরাম ঘোড়া চড়িয়া নৈনিতালে যায় কাহারও কথা না শুনিয়া এবং আসিবার দিনও ঘোড়া চড়িয়া আমাদের সঙ্গে আসে। আমি ডাণ্ডি চড়িয়া অনেক পিছে পড়িয়াছিলাম।

রাত্রে যখন ডাকবাংলায় পৌঁছি, শুনিলাম বাবুরাম আবার পড়িয়া গিয়াছে ও হাতে চোট লাগিয়াছে—ভাঙে-চুরে নাই, এবং ধমকানি খাইবার ভয়ে দেশী ডাকবাংলায় আছে; কারণ পড়িবার দরুন মিস ম্যাকলাউড তাহাকে ডাণ্ডি দিয়া নিজে তাহার ঘোড়ায় আসিয়াছে। সে-রাত্রে আমার সহিত দেখা হয় নাই।

পরদিন ডাণ্ডির যোগাড় করিতেছি—ইতোমধ্যে শুনিলাম সে পায়ে হাঁটিয়া চলিয়া গিয়াছে। সেই অবধি তাহার আর কোন খবর নাই। দু-এক জায়গায় তার করিয়াছি; কিন্তু খবর নাই। বোধ হয় কোন গ্রামে … বসিয়া আছে।

যোগীন-মার জন্য ডাণ্ডি হইবে; কিন্তু বাকী সকলকে পায়ে হাঁটিতে হইবে।

আমার শরীর অপেক্ষাকৃত অনেক ভাল, কিন্তু ডিস্পেপসিয়া (অর্জীর্ণতা) যায় নাই এবং পুনর্বার অনিদ্রা আসিয়াছে। তুমি যদি কবিরাজী একটা ভাল ডিস্পেপসিয়ার ঔষধ শীঘ্র পাঠাও তো ভাল হয়।

ওখানে যে দুই-একটি case (রোগের আক্রমণ) এক্ষণে হইতেছে, তাহার জন্য সরকারী প্লেগ হাসপাতালে অনেক জায়গা আছে এবং ward-এ ward-এ (মহল্লায় মহল্লায়) ও হাসপাতাল হইবার কথা হইতেছে। এসকল দেখিয়া ও আবশ্যক বুঝিয়া যাহা ভাল হয় করিবে। তবে বাগবাজারের কে কি বলছে, তাহা public opinion (জনসাধারণের মত) নহে জানিবে। … আবশ্যক-কালে অভাব যেন না হয় ও অনর্থক অর্থব্যয় না হয়—এই সকল দেখিয়া কাজ করিবে।

রামলালের জন্য বিশেষ বুঝিয়া উপস্থিত মত জায়গা কিনিয়া দিবে রঘুবীরের নামে। তাহাতে উপস্থিত মা-ঠাকুরাণী ও তাঁহার অবর্তমানে রামলাল, শিবু তাঁহাদের উত্তরাধিকারী সেবায়েত থাকে, অথবা যেমন ভাল হয় করিবে। বাড়ী তুমি যেমন ভাল বুঝ, এখনই আরম্ভ করিয়া দিবে; কারণ নূতন বাড়িতে ২/১ মাস বাস করা ঠিক নহে, damp (স্যাঁৎসেঁতে) হয়। ‘… পরে পোস্তা হইবে। কাগজের জন্য টাকার চেষ্টা হইতেছে। যে ১২০০ টাকা তোমায় কাজের জন্য দিয়াছি, তাহা ঐ হিসাবেই যেন থাকে।

আর আর সকলে ভাল আছে। সদানন্দ কাল পা মুচড়াইয়া বলিতেছে, সন্ধ্যা নাগাদ আরাম হইবে। এবারে আলমোড়ায় জলহাওয়া অতি উত্তম। তাহাতে সেভিয়ার যে বাংলা লইয়াছে, তাহা আলমোড়ার মধ্যে উৎকৃষ্ট। ওপারে এনি বেস্যাণ্ট চক্রবর্তীর সহিত একটি ছোট বাংলায় আছে। চক্রবর্তী এখন গগনের (গাজিপুরের) জামাই। আমি একদিন দেখা করিতে গিয়াছিলাম। ‘এনি বেস্যাণ্ট আমায় অনুনয় করে বললে যে, আপনার সম্প্রদায়ের সহিত যেন আমার সম্প্রদায়ের পৃথিবীময় প্রীতি থাকে ইত্যাদি। আজও বেস্যাণ্ট চা খাইতে এখানে আসিবে। আমাদের মেয়েরা নিকটে একটি ছোট বাংলায় আছে এবং বেশ আছে। কেবল আজ মিস ম্যাকলাউড একটু অসুস্থ। হ্যারি সেভেয়ার দিন দিন সাধু বনে যাচ্ছে। … হরি ভাই-এর নমস্কার এবং সদানন্দ, অজয় ও সুরেনের প্রণাম জানিবে। আমার ভালবাসা জানিবে ও সকলকে জানাইবে। ইতি

বিবেকানন্দ

পু— সুশীলকে আমার ভালবাসা দিও এবং কানাই প্রভৃতি সকলকে। ইতি



পত্রাবলী – ৪০৪*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]

আলমোড়া
৯ জুন, ১৮৯৮

মহামান্য মহারাজ,

আপনার স্বাস্থ্য পুরোপুরি ভাল নেই জেনে খুব দুঃখিত হলাম। কয়েক দিনের মধ্যে নিশ্চয়ই সেরে উঠবেন।

আগামী শনিবার আমি কাশ্মীর রওনা হচ্ছি। রেসিডেণ্টের উদ্দেশ্যে লেখা আপনার পরিচয়-পত্রখানা পেয়েছি, কিন্তু আপনি যদি অনুগ্রহ করে রেসিডেণ্টকে এক লাইন লিখে পাঠান যে, আপনি আমাকে একটি পরিচয়-পত্র দিয়েছেন, তা হলে আরও ভাল হয়।

আপনি দয়া করে জগমোহনকে বলবেন, সে যেন কিষণগড়ের দেওয়ানকে একথা স্মরণ করিয়ে চিঠি লেখে যে, তিনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন—তাঁর পণ্ডিতদের কাছ থেকে তিনি আমাকে ব্যাস-সূত্রের নিবার্ক ভাষ্য ও অন্যান্য ভাষ্যের নকল সংগ্রহ করে দেবেন।

ভালবাসা ও আশীর্বাদ সহ
আপনার বিবেকানন্দ

পুনঃ—বেচারা গুডউইন মারা গেছে। জগমোহন তাকে ভাল করে জানে। আমার গোটা দুই ব্যাঘ্রচর্ম চাই, যদি পারি মঠে দুজন ইওরোপীয় বন্ধুকে উপহাররূপে পাঠাব। এ-রকম জিনিষ উপহার পেলে পাশ্চাত্যবাসীরা সবচেয়ে বেশী খুশী হয়।


পত্রাবলী – ৪০৫*
[নৈনিতালের মহম্মদ সর্ফরাজ হোসেনকে লিখিত]

আলমোড়া
১০ জুন, ১৮৯৮

প্রীতিভাজনেষু,

আপনার পত্রের মর্ম বিশেষভাবে উপলব্ধি করিলাম, ইহা জানিয়া যার-পর-নাই আনন্দিত হইয়াছি যে, ভগবান্‌ সকলের অগোচরে আমাদের মাতৃভূমির জন্য অপূর্ব আয়োজন করিতেছেন।

ইহাকে আমরা বেদান্তই বলি আর যাই বলি, আসল কথা এই যে, অদ্বৈতবাদ ধর্মের এবং চিন্তার শেষ কথা, এবং কেবল অদ্বৈতবাদ হইতেই মানুষ সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়কে প্রীতির চক্ষে দেখিতে পারে। আমার বিশ্বাস যে, উহাই ভাবী শিক্ষিত মানবসমাজের ধর্ম।

হিন্দুগণ অন্যান্য জাতি অপেক্ষা শীঘ্র শীঘ্র এই তত্ত্বে পৌঁছানোর কৃতিত্বটুকু পাইতে পারে, কারণ তাহারা হিব্রু কিম্বা আরব-জাতিগুলি অপেক্ষা প্রাচীনতর; কিন্তু কর্মপরিণত বেদান্ত (Practical Advaitism)—যাহা সমগ্র মানবজাতিকে নিজ আত্মা বলিয়া দেখে এবং তদনুরূপ ব্যবহার করিয়া থাকে—তাহা হিন্দুগণের মধ্যে সর্বজনীনভাবে এখনও পুষ্টিলাভ করে নাই।

পক্ষান্তরে আমাদের অভিজ্ঞতা এই যে, কখনও যদি কোন ধর্মের লোক দৈনন্দিন ব্যাবহারিক জীবনে এই সাম্যের কাছাকাছি আসিয়া থাকে, তবে একমাত্র ইসলামধর্মের লোকেরাই আসিয়াছে; এইরূপ আচরণ যে গভীর অর্থ এবং ইহার ভিত্তিস্বরূপ যে-সকল তত্ত্ব বিদ্যমান, সে সম্বন্ধে হিন্দুগণের ধারণা পরিষ্কার, এবং ইসলামপন্থিগণ সে-বিষয়ে সাধারণতঃ সচেতন নয়।

এইজন্য আমাদের দৃঢ় ধারণা যে, বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্মপরিণত ইসলাম-ধর্মের সহায়তা ব্যতীত তাহা মানব-সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমরা মানব জাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই—যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই; অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে।

মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম ‘একত্বরূপ সেই এক ধর্মে’রই বিবিধ প্রকাশ মাত্র, সুতরাং যাহার যেটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী সেটিকেই বাছিয়া লইতে পারে।

আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও মুসলমান ইসলামধর্মরূপ এই দুই মহান্ মতের সমন্বয়ই—বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ—একমাত্র আশা।

আমি মানসচক্ষে দেখিতেছি, এই বিবাদ-বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ লইয়া মহা মহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে।

ভগবান্‌ আপনাকে মানবজাতির, বিশেষ করিয়া আমাদের অতি হতভাগ্য জন্মভূমির সাহায্যের জন্য একটি মহান্ যন্ত্র-রূপে গঠিত করুন, ইহাই সতত প্রার্থনা। ইতি

ভবদীয়া স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৪০৬*
[মিঃ ই. টি. স্টার্ডিকে লিখিত]

কাশ্মীর
৩ জুলাই, ১৮৯৮

প্রিয় স্টার্ডি,

উভয় সংস্করণেই আমার সম্মতি ছিল, কারণ আমাদের মধ্যে ব্যবস্থা হয়েছিল যে, আমার বইগুলি যে-কেউ প্রকাশ করতে চাইলে আমরা আপত্তি করব না। মিসেস বুল এ সম্বন্ধে সব জানেন; তিনি তোমাকে লিখছেন।

মিস সুটার (Miss Souter)-এর কাছ থেকে সেদিন একখানা সুন্দর চিঠি পেয়েছি। তিনি আগের মতই বন্ধুভাবাপন্ন।

শিশুদের, মিসেস স্টার্ডিকে ও তোমাকে ভালবাসা।

সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৪০৭
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

শ্রীনগর
১৭ জুলাই, ১৮৯৮

অভিন্নহৃদয়েষু,

তোমার পত্রে সমস্ত অবগত হইলাম। … সারদার সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছ, তদ্বিষয়ে আমার বক্তব্য এই মাত্র যে, বাঙলা ভাষায় magazine (পত্রিকা) paying (লাভজনক) করা মুশকিল, তবে সকলে মিলিয়া দ্বারে দ্বারে ফিরিয়া subscriber (গ্রাহক) যদি যোগাড় করা যায় তো সম্ভব বটে। এ বিষয়ে তোমাদের যে প্রকার মত হয়, করিবে। সারদা বেচারা একেবারে ভগ্নমনোরথ হইয়াছে। যে লোকটা এত কাজের এবং নিঃস্বার্থ, তার জন্য এক হাজার টাকা যদি জলেও যায় তো ক্ষতি কি?

‘রাজযোগ’ ছাপা হইবার কি হইল? উপেনকেই না হয় দাও on certain shares (কিছু লাভে)। টাকাকড়ি সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছি, তাহাই শেষ। অতঃপর দেওয়া-থোওয়া সম্বন্ধে তুমি যেমন বিবেচনা করিবে, তাহাই করিবে। … আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি যে, আমার policy (কার্যধারা) ভুল, তোমারটা ঠিক—about helping others (অপরকে সাহায্য করা সম্বন্ধে), অর্থাৎ একেবারে বেশী দিলে লোকে grateful (কৃতজ্ঞ) না হইয়া উল্টা ঠাওরায় যে, একটা বোকা বেশ পাওয়া গেছে।

I always lost sight of the demoralising influence of charity on the receiver. (দানের ফলে গ্রহীতার যে নৈতিক অবনতি হয়, সেদিকে আমার দৃষ্টি থাকে না)। দ্বিতীয়তঃ ভিক্ষের পয়সা যে উদ্দেশ্যে লোকে দেয়, তাহা হইতে একটুও এদিক-ওদিক করিবার আমাদের অধিকার নাই। কাশ্মীরের প্রধান বিচারপতি ঋষিবর মুখোপাধ্যায়ের বাড়ীর ঠিকানায় দিলেই মিসেস বুল মালা পাইবেন।

মিত্র মহাশয় এবং জজ সাহেব ইহাদের অত্যন্ত যত্ন করিতেছেন। কাশ্মীরের জমি এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই, শীঘ্রই হইবার সম্ভবনা। এখানে তুমি একটা শীত কাটাইতে পারিলেই শরীর নিশ্চিত শুধরাইয়া যাইবে। যদি উত্তম ঘর হয় এবং যথেষ্ট কাঠ থাকে এবং গরম কাপড় থাকে, বরফের দেশে আনন্দ বৈ নিরানন্দ নাই। এবং পেটের রোগের পক্ষে শীতপ্রধান দেশ ব্রহ্মৌষধ। যোগেন-ভায়াকেও সঙ্গে আনিও; কারণ এদেশ পাহাড় নয়, এঁটেলমাটি বাঙলা দেশের মত।

আলমোড়ায় কাগজটা বাহির করিলে অনেক কাজ এগোয়; কারণ সেভিয়ার বেচারা একটা কাজ পায় এবং আলমোড়ার লোকেও একটা পায়। সকলকে একটা একটা মনের মত কাজ দেওয়াই বড় ওস্তাদি। কলিকাতায় নিবেদিতার বালিকা বিদ্যালয়টি যেমন করে হোক খাড়া করে দিতে হবে। মাষ্টার মহাশয়কে কাশ্মীরে আনা এখনও অনেক দূরের কথা; কারণ এখানে কলেজ হতে এখনও ঢের দেরী। তবে তিনি লিখিয়াছেন যে, তাকে প্রিন্সিপাল করে কলিকাতায় একটা কলেজ করা।

হাজার টাকা initial expense (প্রারম্ভিক ব্যয়) হলেই চলবে। সে বিষয়ে নাকি তোমাদেরও বিশেষ মত। তাহাতে যাহা ভাল বিবেচনা করিবে, তাহাই করিও। আমার শরীর বেশ আছে। রাত্রে প্রায় আর উঠিতে হয় না, অথচ দু-বেলা ভাত আলু চিনি—যা পাই তাই খাই। ওষুধটা কিছু কাজের নয়—ব্রহ্মজ্ঞানীর শরীরে ঔষধ ধরে না। ও হজম হয়ে যাবে—কিছু ভয় নাই।

মেয়েরা সকলে আছে ভাল ও তোমাদের ভালবাসা জানাইতেছে। শিবানন্দজীর দুইটি চিঠি আসিয়াছে। তাঁহার অষ্ট্রেলিয়ান শিষ্যেরও এক পত্র পাইয়াছি। কলিকাতায় শুনিতেছি নাকি প্লেগ একেবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে।

ইতি বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৪০৮
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

শ্রীনগর
১ অগষ্ট, ১৮৯৮

অভিন্নহৃদয়েষু,

তোমার বরাবর একটি বুঝিবার ভ্রম হয় এবং ‘—’ এর প্রবল বুদ্ধির দোষে বা গুণে সেটি যায় না। সেটি এই যে, যখন আমি হিসাব-কিতাবের কথা বলি, তোমার মনে হয় যে, আমি তোমাদের অবিশ্বাস করছি। … আমার কেবল ভয় এই যে, এখন তো একরকম খাড়া করা গেল। অতঃপর আমরা চলে গেলে যাতে কাজ চলে এবং বেড়ে যায়, তাহাই দিনরাত্র আমার চিন্তা। হাজারও theoretical knowledge (তাত্ত্বিক জ্ঞান) থাকুক—হাতে-হেতড়ে না করলে কোন বিষয় শেখা যায় না।

Election (নির্বাচন) এবং টাকাকড়ির হিসাব discussion (আলোচনা) এর জন্য বারংবার আমি বলি, যাতে সকলে কাজের জন্য তৈয়ার হয়ে থাকে। একজন মরে গেলে অমনি একজন (দশজন if necessary—প্রয়োজন হলে) should be ready to take it up (কাজে লাগবার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত)।

দ্বিতীয় কথা—মানুষের interest (আগ্রহ) না থাকিলে কেউ খাটে না; সকলকে দেখান উচিত যে, everyone has a share in the work and property, and a voice in the management (প্রত্যেকেরই কাজে ও সম্পত্তিতে অংশ আছে এবং কার্যধারা সম্বন্ধে মতপ্রকাশের ক্ষমতা আছে)—এই বেলা থেকে।

Alternately (পর্যায়ক্রমে) প্রত্যেককেই responsible position (দায়িত্বপূর্ণ কাজ) দেবে with an eye to watch and control (নিয়ন্ত্রণের প্রতি দৃষ্টি রেখে), তবে লোক তৈয়ার হয় for business (কাজের জন্য)। এমন machine (যন্ত্র)-টি খাড়া কর যে, আপনা- আপনি চলে যায়, যে মরে বা যে বাঁচে। আমাদের ইণ্ডিয়ার ঐটি great defect (প্রধান দোষ), we cannot make a permanent organisation (আমরা স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়তে পারি না),

and the reason is because we never like to share power with others and never think of what will come after we are gone. (আর তার কারণ এই যে, আমরা অপরের সঙ্গে কখনও ক্ষমতা ভাগ করে নিতে চাই না, এবং আমাদের পরে কি হবে, তা কখনও ভাবি না)।

প্লেগ সম্বন্ধে সব লিখেছি। মিসেস বুল ও মূলার প্রভৃতির মত যে, যখন পাড়ায় পাড়ায় হাসপাতাল হয়ে গেল, তখন মিছে কতকগুলো টাকা খরচ কেন? We will lend our services as nurses etc. Those that pay the piper must command the tune (আমরা শুধু সেবক হিসাবে কাজ করব। যারা টাকা দেয় তাদের কথা শুনতে হয়)।

কাশ্মীরের রাজা জমি দিতে রাজী। জমি দেখেও এসেছি। এখন দু-চার দিনের মধ্যে হয়ে যাবে—প্রভুর যদি ইচ্ছা হয়। এখানে একটি ছোট বাড়ি করে যাব এইবারেই। যাবার সময় leave it in the charge of Justice Mukherjee (বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে রেখে যাব)। আর তুমি না হয় এসে এখানে শীত কাটিয়ে যাও with somebody else (অপর কাকেও সঙ্গে নিয়ে); শরীরও সেরে যাবে এবং কাজও হবে। যে টাকা press (ছাপাখানা)-এর (জন্য) রেখে এসেছি,

তা হলেই হবে।—তুমি যেমন বিবেচনা কর। এবার N. W. P (উত্তর-পশ্চিমপ্রদেশ), রাজপুতানা প্রভৃতিতে কতকগুলি টাকা পাব—নিশ্চিত। ভাল কথা কয়েকজনকে … এই ভাবে টাকা দিও। এই টাকা আমি মঠ থেকে কর্জ নিচ্ছি এবং পরিশোধ করব to you with interest (তোমার কাছে সুদ সমেত)। …

আমার শরীর এক রকম ভালই আছে। বাড়ী-ঘর আরম্ভ হয়েছে—বেশ কথা। সকলকে আমার ভালবাসা দিও। ইতি

বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৪০৯*

কাশ্মীর
২৫ অগষ্ট, ১৮৯৮

প্রিয় মার্গট,

গত দু-মাস যাবৎ আমি অলসের মত দিন কাটাচ্ছি। ভগবানের দুনিয়ার জমকালো সৌন্দর্যের যা পরাকাষ্ঠা হতে পারে, তারই মধ্য দিয়ে প্রকৃতির এই নৈসর্গিক উদ্যানে মনোরম ঝিলামের বুকে নৌকায় ভেসে বেড়াচ্ছি, এখানে পৃথিবী বায়ু ভূমি তৃণ গুল্মরাজি পাদপশ্রেণী পর্বতমালা তুষার-রাশি ও মানবদেহ—সবকিছুর অন্ততঃ বাহিরের দিকটায় ভগবানেরই সৌন্দর্য বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

নৌকাটিই আমার ঘরবাড়ী; আর আমি প্রায় সম্পূর্ণ রিক্ত— এমন কি দোয়াত-কলমও নেই বলা চলে; যখন যেমন জুটছে, খেয়ে নিচ্ছি—ঠিক যেন একটি রিপ ভ্যান উইঙ্কল্-এর ছাঁচে ঢালা তন্দ্রাচ্ছন্ন জীবন!

কাজের চাপে নিজেকে মেরে ফেলো না যেন। ওতে কোন লাভ নেই; সর্বদা মনে রাখবে, ‘কর্তব্য হচ্ছে যেন মধ্যাহ্ন-সূর্যের মত—তার তীব্র রশ্মি মানুষের জীবনীশক্তি ক্ষয় করে।’ সাধনার দিক্‌ দিয়ে ওর সাময়িক মূল্য আছে বটে, তার বেশী করতে গেলে ওটা একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র। আমরা জগতের কাজে অংশগ্রহণ করি আর নাই করি, জগৎ নিজের ভাবে চলে যাবেই। মোহের ঘোরে আমরা নিজেকে ধ্বংস করে ফেলি মাত্র।

এক-জাতীয় ভ্রান্ত ধারণা আছে, যা চরম নিঃস্বার্থতার মুখোস পরে দেখা দেয়; কিন্তু সবরকম অন্যায়ের কাছে যা মাথা নোয়ায়, সে চরমে অপরের অনিষ্টই করে। নিজেদের নিঃস্বার্থপরতা দিয়ে অপরকে স্বার্থপর করে তোলার কোন অধিকার আমাদের নেই। আছে কি?

তোমাদের
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৪১০*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

শ্রীনগর, কাশ্মীর
২৮ অগষ্ট, ১৮৯৮

স্নেহের মেরী,

তোমাকে চিঠি লেখার কোন সুযোগ ইতোমধ্যে করে উঠতে পারিনি, আর তোমারও চিঠি পাবার কোন তাগিদ ছিল না; তাই বাজে অজুহাত দেখাব না। শুনলাম মিসেস লেগেটকে লেখা মিস ম্যাকলাউডের চিঠি থেকে তুমি কাশ্মীর ও আমাদের সম্বন্ধে সমস্ত সংবাদ জানতে পারছ, সুতরাং এ সম্বন্ধে আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।

কাশ্মীরে হাইন‍্‍সহোল্ড (Heinsholdt)-এর ‘মাহাত্মা’-সন্ধান সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে; প্রথমেই প্রতিপন্ন করতে হবে যে, সমগ্র ব্যাপারটা একটি বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে আসছে, প্রচেষ্টা খুব তাড়াতাড়ি আরম্ভ করা হয়েছে। মাদার চার্চ ও ফাদার পোপ কেমন আছেন? তোমরা কেমন আছ? একজন দল থেকে সরে পড়াতে৭ পুরানো খেলা আরও উৎসাহ সহকারে চলছে কি? ফ্লোরেন্সের কোন প্রতিমূর্তির মত যার চেহারা, সে কেমন আছে (নামটা ভুলে গিয়েছি)?

কয়েকদিনের জন্য আমি দূরে চলে গিয়েছিলাম। এখন আমি মহিলাদের সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছি। তারপর যাত্রিদলটি যাচ্ছে কোন পাহাড়ের পিছনে এক বনের মধ্যে একটি শান্ত সুন্দর পরিবেশ, যেখানে কুলকুল করে ছোট নদী বয়ে চলেছে। সেখানে তারা দেবদারু গাছের নীচে বুদ্ধের মত আসন করে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে থাকবে।

এ-রকম প্রায় মাসখানেক চলবে; তারপর যখন আমাদের সৎকর্মের ফলভোগ শেষ হবে, তখন আবার স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পতন হবে। তারপর কয়েক মাস কর্মফল সঞ্চয় করব ও দুষ্কর্মের জন্য আবার নরকে যেতে হবে—চীনে, এবং আমাদের কুকর্ম ক্যাণ্টন ও অন্যান্য নগরের দুর্গন্ধের মধ্যে আমাদের নিমজ্জিত করবে। তারপর জাপানের নরকে। তারপর আবার যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্গলোকে।

কত না সুন্দর সুন্দর জিনিষ তোমাকে পাঠাতে আমার ইচ্ছা, কিন্তু হায়! শুল্ক-তালিকার কথা ভাবলে আমার আকাঙ্ক্ষা ‘মেয়েদের যৌবন ও ভিখারীদের স্বপ্নের মত’ মিলিয়ে যায়।

কথাপ্রসঙ্গে বলছি, আমি খুশী যে, দিনদিন আমার চুল পাকছে। তোমার সঙ্গে পরবর্তী সাক্ষাতের পূর্বেই আমার মাথাটি পূর্ণ-বিকশিত একটি শ্বেত পদ্মের মত হবে।

আহা! মেরী যদি তুমি কাশ্মীর দেখতে—শুধুই কাশ্মীর! পদ্ম ও হাঁসে ভরা চমৎকার হ্রদগুলি (হাঁস নেই, রাজহংসী আছে—এটুকু কবির স্বাধীনতা) এবং বায়ু সঞ্চালিত সেই পদ্মগুলিতে বড় বড় কালো কালো ভ্রমর বসবার চেষ্টা করছে (আমি বলতে চাই যে পদ্মগুলি মাথা নেড়ে আপত্তি জানাচ্ছে—ইতি কবিতা)—এই দৃশ্য যদি তুমি দেখতে, তা হলে মৃত্যু শয্যাতেও তোমার পুরোপুরি জ্ঞান থাকত।

যেহেতু এটা ভূস্বর্গ এবং যেহেতু তর্কশাস্ত্র বলে—হাতের একটি পাখী বনের দুটির সমান, অতএব এই (ভূস্বর্গের) ক্ষণিক দর্শনও লাভজনক, কিন্তু অর্থনীতির দিক্‌ থেকে অপরটি (অর্থাৎ না-দেখাই) শ্রেয়। কোন কষ্ট নেই, পরিশ্রম নেই, কোন খরচপত্র নেই, ছেলেমানুষি ভাবপূর্ণ অতি সহজ জীবন এবং তারপর সেইটুকুই সব।

আমার চিঠিটা তোমার কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে … সুতরাং এখানে শেষ করছি (এ হল নিছক আলস্য)। বিদায়।

সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ

আমার স্থায়ী ঠিকানাঃ
মঠ, বেলুড়
হাওড়া জেলা, বাঙলা, ভারতবর্ষ


পত্রাবলী – ৪১১
[শ্রীযুক্ত হরিপদ মিত্রকে লিখিত]

শ্রীনগর, কাশ্মীর
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৮

কল্যাণবরেষু,

তোমার পত্র ও তার পাইয়া সমস্ত অবগত হইলাম। প্রভুর নিকট প্রার্থনা করি যে, নির্বিঘ্নে সিন্ধি-ভাষা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হও।

মধ্যে আমার শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হইয়া পড়ায় কিঞ্চিৎ দেরী হইয়া পড়িল, নতুবা এই সপ্তাহের মধ্যেই পঞ্জাবে যাইবার কল্পনা ছিল। এক্ষণে দেশে অতিশয় গ্রীষ্ম বলিয়া ডাক্তার যাইতে নিষেধ করিতেছেন। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ নাগাদ বোধ হয় করাচি পৌঁছিব। এক্ষণে এক-রকম ভাল আছি। আমার সঙ্গে এবার কেহ নাই। দুজন আমেরিকান লেডি ফ্রেণ্ড মাত্র আছেন। তাঁহাদের সঙ্গ বোধ হয় লাহোরে ছাড়িব। তাঁহারা কলিকাতায় বা রাজপুতানায় আমার অপেক্ষা করিবেন।

আমি সম্ভবতঃ কচ্ছভুজ, জুনাগড়, ভাটনগর, লিমডি ও বরোদা হইয়া কলিকাতায় যাইব। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে চীন ও জাপান হইয়া আমেরিকায় যাইব—এই তো বাসনা। পরে শ্রীপ্রভুর হাত। আমার এখনকার সমস্ত খরচ উক্ত আমেরিকান বন্ধুরা দেন এবং করাচি পর্যন্ত ভাড়া প্রভৃতি তাঁহাদের নিকট হইতেই লইব।

তবে যদি তোমার সুবিধা হয়, ৫০ টাকা টেলিগ্রাম করিয়া C/o ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, চিফ জজ, কাশ্মীর স্টেট, শ্রীনগর—এঁর নামে পাঠাইলে অনেক উপকার হইবে। কারণ সম্প্রতি ব্যারামে পড়িয়া বাজে খরচ কিছু হইয়াছে, এবং সর্বদা বিদেশী শিষ্যদের নিকট টাকা ভিক্ষা করিতে লজ্জা করে।

সদা শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৪১২*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]

C/o ঋষিবর মুখার্জি
প্রধান বিচারপতি, কাশ্মীর
১৭ সেপ্টেম্বর,১৮৯৮

মহামান্য মহারাজ,

এখানে আমি দু-সপ্তাহ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এখন সুস্থ হয়ে উঠেছি। আমার কিছু টাকার টান পড়েছে। যদিও আমেরিকান বন্ধুরা আমাকে সাহায্যের জন্য তাঁদের সাধ্যমত সব কিছুই করেছেন, কিন্তু সবসময়ই তাঁদের কাছে হাত পাততে সঙ্কোচ হয়, বিশেষতঃ অসুখ করলে খরচের বহর অনেক বেড়ে যায়। এই জগতে শুধু একজনের কাছেই আমার কিছু চাইতে লজ্জা হয় না এবং তিনি হলেন আপনি।

আপনি দিলেন কি না দিলেন—আমার কাছে দুই সমান। যদি সম্ভব হয়, অনুগ্রহ করে কিছু টাকা পাঠাবেন। আপনি কেমন আছেন? অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি আমি (এখান থেকে) নাবছি।

জগমোহনের চিঠিতে কুমার (যুবরাজ) সাহেব সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে জেনে সবিশেষ আনন্দিত হলাম। আমার সব খবর ভাল, আশা করি আপনার সব কুশল।

সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ


পত্রাবলী – ৪১৩*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]

লাহোর
১৬ অক্টোবর, ১৮৯৮

মহামান্য মহারাজ,

আমার ‘তারে’র পরে যে চিঠিখানা গিয়েছে, তাতে আপনার অভিপ্রেত সংবাদ ছিল; সেজন্য আপনার ‘তারে’র উত্তরে আমার স্বাস্থ্যের সংবাদ দিয়ে আর কোন ‘তার’ করিনি।

এ বৎসর কাশ্মীরে অনেক রোগভোগের পর এখন আরোগ্যলাভ করেছি এবং আজ সোজাসুজি কলিকাতায় যাচ্ছি। গত দশ বছর বাঙলাদেশে দুর্গাপূজা দেখিনি, দুর্গাপূজা সেখানকার একটি ধুমধাম ব্যাপার। আশা করি, এ বছর পূজা দেখব।

পাশ্চাত্যদেশীয় বন্ধুগণ দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই জয়পুর দেখতে যাবেন। জগমোহন যদি সেখানে থাকে, তা হলে তাকে দয়া করে নির্দেশ দেবেন, সে যেন তাঁদের একটু দেখাশোনা করে এবং শহরটি ও প্রাচীন শিল্পকীর্তিগুলি ঘুরে দেখিয়ে দেয়।

আমার গুরুভ্রাতা সারদানন্দকে নির্দেশ দিচ্ছি, জয়পুর রওনা হবার পূর্বে মুন্সীজীকে যেন লিখে জানায়।

আপনি ও যুবরাজ কেমন আছেন? যথারীতি আপনার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করছি।

আপনার প্রীতিবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমার ভবিষ্যৎ ঠিকানাঃ
মঠ, বেলুড়, হাওড়া জেলা, বাঙলা।


পত্রাবলী – ৪১৪
[শ্রীযুক্ত হরিপদ মিত্রকে লিখিত]

লাহোর
১৬ অক্টোবর, ১৮৯৮

কল্যাণবরেষু,

কাশ্মীরে স্বাস্থ্য একেবারে ভাঙিয়া গিয়াছে এবং ৯ বৎসর যাবৎ দুর্গাপূজা দেখি নাই—এ বিধায় কলিকাতা চলিলাম। আমেরিকা যাইবার সঙ্কল্প এখন পরিত্যাগ করিয়াছি এবং শীতকালের মধ্যে করাচি আসিবার অনেক সময় হইবে।

৫০ টাকা আমার গুরুভ্রাতা সারদানন্দ লাহোর হইতে করাচি পাঠাইবেন। দুঃখিত হইও না—সকলই প্রভুর হাত। আমি এ বৎসর তোমাদের সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া কোথাও যাইব না নিশ্চিত। সকলকে আমার আশীর্বাদ।

সদা শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!