-স্বামী বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪১৫*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]
মঠ, বেলুড়
২৬ অক্টোবর, ১৮৯৮
মহামান্য মহারাজ,
আপনার স্বাস্থ্যের জন্য আমি খুবই উদ্বিগ্ন। আমার খুব ইচ্ছা ছিল নাবার পথে আপনাকে দেখে যাব, কিন্তু আমার স্বাস্থ্য এমনভাবে ভেঙে পড়ল যে, একটুও দেরী না করে আমাকে সমতলে ছুটে আসতে হল। ভয় হচ্ছে, আমার হৃদযন্ত্রে কিছু গোলযোগ হয়েছে।
যা হোক, আপনার শারীরিক অবস্থা জানবার জন্য আমি খুবই ব্যগ্র। যদি আপনি ইচ্ছা করেন—খেতড়িতে আপনাকে দেখতে যাব। আপনার কল্যাণের জন্য আমি দিবারাত্র প্রার্থনা করছি। বিপদ কিছু ঘটলে হতাশ হবেন না, ‘মা’ই আপনাকে রক্ষা করবেন। আপনার বিস্তারিত সংবাদ আমাকে লিখবেন। … কুমার সাহেব কেমন আছে?
সর্ববিধ ভালবাসা ও চিরন্তন আশীর্বাদ।
সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪১৬*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]
মঠ, বেলুড়, হওড়া
নভেম্বর (?), ১৮৯৮
মহামান্য মহারাজ,
আপনার ও কুমারের স্বাস্থ্য ভাল আছে জেনে খুব আনন্দিত হলাম। এদিকে আমার হৃদ্যন্ত্রটা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। বায়ু-পরিবর্তনে আমার আর কোন উপকার হবে বলে মনে হয় না—গত চৌদ্দ বৎসর ধরে আমি এক-নাগাড়ে কোথাও তিনমাস থেকেছি বলে মনে পড়ে না। মনে হয় যদি কোন ক্রমে বেশ কয়েক মাস ধরে এক স্থানে থাকিতে পারি, তবেই আমার পক্ষে ভাল হবে। তার জন্য আমার কোন মাথাব্যথা নেই।
যা হোক, আমি বুঝতে পারছি, এ জীবনে আমার কাজ শেষ হয়েছে। ভাল ও মন্দ, বেদনা ও আনন্দের মধ্য দিয়ে আমার জীবন-তরী বয়ে গিয়েছে। তার ফলে যে মহৎ শিক্ষাটি আমি লাভ করেছি, তা হল—জীবনটা দুঃখময়, দুঃখ বৈ আর কিছুই নেই। ‘মা’ই জানেন কোন্টি শ্রেয়।
আমরা সকলেই কর্মের অধীন; কর্ম তার নিজের পথ করে নেয়—এর কোন ব্যতিক্রম নেই। জীবনে একটিমাত্র বস্তুই আছে, যা যে-কোন উপায়ে লাভ করতে হবে, সেটি হচ্ছে ভালবাসা। বিপুল ও অনন্ত ভালবাসা, আকাশের মত উদার ও সমুদ্রের মত গভীর—সেই হল জীবনে একটি বড় লাভ। যে তা পায়, সে ধন্য।
সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪১৭*
৫৭, রামকান্ত বসু ষ্ট্রীট, কলিকাতা
১২ নভেম্বর, ১৮৯৮
স্নেহের জো,
আগামীকাল রবিবার কয়েকজন বন্ধুকে সান্ধ্যভোজে নিমন্ত্রণ করেছি। … চায়ের সময় তোমাকে আশা করছি। তখন সব কিছুই প্রস্তুত থাকবে।
শ্রীমা আজ সকালে নূতন মঠ দেখতে যাচ্ছেন। আমি সেখানে যাচ্ছি। আজ বিকাল ৬টায় নিবেদিতা সভাপতিত্ব করবে। যদি তোমার ভাল লাগে এবং বুলও যদি ইচ্ছা করেন, তা হলে চলে এস।
সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪১৮*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]
মঠ, বেলুড়
১৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৮
মহামান্য মহারাজ,
মিঃ দুলিচাঁদের নামে ৫০০-র অর্ডার সহ আপনার সহৃদয় লিপিখানি পেলাম। আজকাল আমি কিছুটা ভাল আছি। জানি না (স্বাস্থের) এই উন্নতি স্থায়ী হবে, কি না।
শুনলাম এই শীতে আপনি কলিকাতায় আসছেন। এ কথা কি সত্যি? নূতন বড়লাটাকে সম্মান জ্ঞাপন করতে অনেক রাজা আসছেন। কাগজ দেখে জানলাম শিখরের (Sikar) মহারাজা ইতোমধ্যেই এখানে এসেছেন।
আপনার ও আপনার স্বজনদের জন্য সর্বদা প্রার্থনা জানাই।
সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪১৯*
বেলুড়মঠ
১৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৮
প্রিয়—,
… ‘মা’ই আমাদের একমাত্র পথপ্রদর্শক। আর যা কিছু ঘটছে বা ঘটবে, সে-সকল তাঁরই বিধানে।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪২০*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
বৈদ্যনাথ ধাম, দেওঘর
২৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৮
প্রিয় ধীরামাতা,
আমি যে আপনার সহযাত্রী হতে পারব না, তা আপনি আগেই জেনেছেন। আপনার সঙ্গে যাবার মত শারীরিক শক্তি আমি সংগ্রহ করতে পারছি না। বুকে যে সর্দি জমেছিল তা এখনও আছে, আর তারই ফলে এখন আমি ভ্রমণে অক্ষম। মোটের উপর এখানে আমি ক্রমে সেরে উঠব বলেই আশা করি।
জানলাম, আমার ভগ্নী গত কয়েক বৎসর যাবৎ বিশেষ সংকল্প নিয়ে নিজের মানসিক উন্নতি সাধনের চেষ্টা করছে। বাঙলা সাহিত্যের ভেতর দিয়ে যা কিছু জানা সম্ভব—বিশেষ করে অধ্যাত্মবাদ সম্বন্ধে, সে-সবই সে শিখেছে, আর তার পরিমাণও বড় কম নয়।
ইতোমধ্যে সে নিজের নাম ইংরেজী ও রোমান অক্ষরে সই করতে শিখেছে। এখন তাকে অধিকতর শিক্ষাদান বিশেষ মানসিক পরিশ্রম-সাপেক্ষ; সুতরাং সে কাজ থেকে আমি বিরত হয়েছি। আমি শুধু বিনা কাজে সময় কাটাতে চেষ্টা করছি এবং জোর করেই বিশ্রাম নিচ্ছি।
কয়েকদিনের জন্য আমি দূরে চলে গিয়েছিলাম। এখন আমি মহিলাদের সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছি। তারপর যাত্রিদলটি যাচ্ছে কোন পাহাড়ের পিছনে এক বনের মধ্যে একটি শান্ত সুন্দর পরিবেশ, যেখানে কুলকুল করে ছোট নদী বয়ে চলেছে। সেখানে তারা দেবদারু গাছের নীচে বুদ্ধের মত আসন করে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে থাকবে।
এ-যাবৎ আমি আপনাকে কেবল শ্রদ্ধাই করেছি, কিন্তু এখন ঘটনা পরম্পরায় মনে হচ্ছে যে, মহামায়া আপনাকে আমার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য নিযুক্ত করেছেন; সুতরাং এখন শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রগাঢ় বিশ্বাস যুক্ত হয়েছে। এখন থেকে আমি আমার নিজের জীবন এবং কর্মপ্রণালী বিষয়ে মনে করব যে, আপনি মায়ের আজ্ঞাপ্রাপ্ত; সুতরাং সকল দায়িত্ববোধ নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে আপনার ভেতর দিয়ে মহামায়া যে নির্দেশ দেবেন, তাই মেনে চলব।
শীঘ্রই ইওরোপ কিম্বা আমেরিকায় আপনার সহিত মিলিত হতে পারব, এই আশা নিয়ে এই চিঠি শেষ করছি। ইতি
আপনার স্নেহের সন্তান
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪২১*
মঠ, বেলুড়
২ ফেব্রুআরী, ১৮৯৯
স্নেহের জো,
তুমি নিশ্চই এর মধ্যে নিউ ইয়র্ক পৌঁছেছ এবং দীর্ঘ অনুপস্থিতির পরে আবার স্বজনদের সঙ্গে মিলেছ। এবারকার যাত্রায় ভাগ্য প্রতি পদে তোমার অনুকূল হয়েছে— এমন কি সমুদ্র পর্যন্ত স্থির ও শান্ত ছিল এবং অবাঞ্ছিত সঙ্গীও জাহাজে বড় কেউ ছিল না। আমার বেলায় ঠিক এর উল্টো।
তোমার সঙ্গে যেতে না পেরে আমি নিরাশ হয়ে পড়েছি। বৈদ্যনাথে বায়ু পরিবর্তনে কোন ফল হয়নি। সেখানে আট দিন আট রাত্রি শ্বাসকষ্টে প্রাণ যায় যায়। মৃতকল্প অবস্থায় আমাকে কলিকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। এখানে এসে বেঁচে উঠবার লড়াই শুরু করেছি।
ডাঃ সরকার এখন আমার চিকিৎসা করছেন। আগের মত হতাশ ভাব আর নেই। অদৃষ্টের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। এটা আমাদের পক্ষে বড় দুর্বৎসর। যোগানন্দ, যে মায়ের বাড়ীতে থাকত, একমাস ধরে ভুগছে এবং প্রতিদিনই মৃত্যুর প্রতিক্ষা করছে। মা-ই ভাল জানেন।
আবার কাজে লেগেছি, ঠিক নিজে করছি না, ছেলেদের পাঠিয়ে দিচ্ছি সারা ভারতে আবার একটা আলোড়ন জাগাবার জন্য। সর্বোপরি তুমি তো জানই, অর্থাভাব হচ্ছে প্রধান অসুবিধা। জো, তুমি এখন আমেরিকায়, আমাদের এখানকার কাজের জন্য কিছু টাকা তুলতে চেষ্টা কর।
মার্চ নাগাদ আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছি, এপ্রিলে ইওরোপ যাত্রা। বাকী মা-ই ভাল জানেন।
সারাটা জীবন শরীর ও মনের কষ্ট সয়েছি অনেক, কিন্তু মায়ের অপার করুণা।আমার পাওনার চেয়ে অনন্তগুণ বেশী আনন্দ ও আশীর্বাদ পেয়েছি। মায়ের কাজে অবিরাম সংগ্রাম করছি, মা দেখছেন। আমি সর্বদা লড়াই করে চলেছি এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই আমি শেষনিঃশ্বাস ফেলব।
আমার অশেষ প্রীতি এবং আশীর্বাদ—তোমার জন্য চিরদিন।
সতত সত্যরূপে তোমার
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪২২*
[ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষকে লিখিত]
বেলুড় মঠ, হাওড়া
৬ মার্চ, ১৮৯৯
প্রিয় মহাশয়,
আপনার অত্যন্ত সানুগ্রহ আমন্ত্রণের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আপনার পত্রের উত্তর দিতে এত দেরী হল বলে বিশেষ দুঃখিত।
আমি সে-সময় খুব অসুস্থ ছিলাম এবং যাঁর উপর পত্রের উত্তর দেবার ভার ছিল, তিনি তা দেননি বলেই মনে হয়। আমি এইমাত্র তা জানতে পেরেছি।
আপনাদের সানুগ্রহ আহ্বানের সুযোগ গ্রহণের জন্য আমি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হইনি। এই শীতকালেই আপনাদের ঐ অঞ্চল (পূর্ববঙ্গ) দেখব বলে সঙ্কল্প করেছিলাম। কিন্তু আমার কর্মের গতি অন্যরূপ। প্রাচীন বাঙলার সভ্যতার কেন্দ্র দেখবার আনন্দ পাবার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।
আপনাদের সহৃদয়তার জন্য আবার ধন্যবাদ।
শুভার্থী
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪২৩*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
মঠ, বেলুড়, জেলা হওড়া
১৬ মার্চ, ১৮৯৯
স্নেহের মেরী,
মিসেস এডাম্স্কে ধন্যবাদ; তিনি তোমাদের—দুষ্টু মেয়েদের অবশেষে চিঠি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ‘চোখের আড়াল হলেই আর মনে থাকে না’—এ-কথা ভারতে যেমনি সত্য, আমেরিকাতেও তেমনি।
আচ্ছা, আমার শরীর এক রকম ভালই যাচ্ছে; যাতে কয়েক মাস যাবৎ মনে হচ্ছে, শরীরটা আরও কিছুকাল টিকবে।
ম্যাক্সমূলারের নূতন বই ‘রামকৃষ্ণঃ তাঁর জীবনী ও বাণী’ (Ramakrishna: His Life and Sayings) পড়েছ কি? যদি পড়ে না থাক পড়ে ফেল, এবং মাকে পড়তে দাও। মা কেমন আছেন? তাঁকে কি বুড়ো দেখাচ্ছে? ফাদার পোপ কেমন আছেন?
মার্কিন ও ইংরাজ বন্ধুদের ধন্যবাদ, তাঁদের সাহায্যেই গঙ্গার তীরে আমাদের একটি মঠ হয়েছে। মাকে মন দিয়ে দেখতে বল—‘পৌত্তলিক প্রচারক’দের দ্বারা তোমাদের ইয়াঙ্কি দেশকে প্লাবিত করতে চলেছি।
এ গ্রীষ্মে জো-র সঙ্গে আমেরিকায় যাবার খুব ইচ্ছা; কিন্তু মানুষ সংকল্প করে, এবং কে বিধান করেন?—সব সময়ে নিশ্চয়ই ভগবান্ করেন না। ভাল যা হবার তা হোক। অভয়ানন্দ (মেরী লুই) ভারতে এসেছে, বোম্বে ও মান্দ্রাজে তার খুব সম্বর্ধনা হয়েছে। আগামীকাল সে কলিকাতা আসবে, এবং আমরাও তাকে যথোচিত অভ্যর্থনা করছি।
মিস হাউ, মিসেস এডাম্স্, মাদার চার্চ ও ফাদার পোপ এবং সাত সমুদ্রের পারে অন্যান্য যে-সব বন্ধু আছে তাদের সকলকে আমার ভালবাসা জানাচ্ছি। আমরা সাত সমুদ্রে বিশ্বাস করি—দধি, দুগ্ধ, মধু, সুরা, ইক্ষুরস, লবণ, আর একটা কি—ভুলে গেছি। তোমাদের চার বোনকে মধু-সমুদ্রের উপর দিয়ে বায়ুবেগে সঞ্চালিত করছি আমার স্নেহ।
তোমাদের চিরদিনের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪২৪*
বেলুড় মঠ
১১ এপ্রিল, ১৮৯৯
প্রিয়—,
… দু-বৎসরের শারীরিক কষ্ট আমার বিশ বৎসরের আয়ু হরণ করেছে। ভাল কথা, কিন্তু এতে আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না। হয় কি? সেই আপনভোলা আত্মা একই ভাবে বিভোর হয়ে তীব্র একাগ্রতা ও আকুলতা নিয়ে ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে আছে।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪২৫
[শ্রীমতী সরলা ঘোষালকে লিখিত]
বেলুড় মঠ
১৬ এপ্রিল, ১৮৯৯
মহাশয়াসু,
আপনার পত্রে সাতিশয় আনন্দ লাভ করিলাম। যদি আমার বা আমার গুরুভ্রাতাদিগের কোন একটি বিশেষ আদরের বস্তু ত্যাগ করিলে অনেক শুদ্ধসত্ত্ব এবং যথার্থ স্বদেশহিতৈষী মহাত্মা আমাদের কার্যে সহায় হন, তাহা হইলে সে ত্যাগে আমাদের মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হইবে না বা এক ফোঁটাও চক্ষের জল পড়িবে না জানিবেন এবং কার্যকালে দেখিবেন। তবে এতদিন কাহাকেও তো দেখি নাই, সে প্রকার সহায়তায় অগ্রসর।
দু-এক জন আমাদের hobby-র (খেয়ালের) জায়গায় তাঁহাদের hobby বসাইতে চাহিয়াছেন, এই পর্যন্ত। যদি যথার্থ স্বদেশের বা মনুষ্যকুলের কল্যাণ হয়, শ্রীগুরুর পূজা ছাড়া কি কথা, কোন উৎকট পাপ করিয়া খ্রীষ্টিয়ানদের অনন্ত নরক-ভোগ করিতেও প্রস্তুত আছি, জানিবেন।
তবে মানুষ দেখিতে দেখিতে বৃদ্ধ হতে চলিলাম। এ সংসার বড়ই কঠিন স্থান। গ্রীক দার্শনিকের লণ্ঠন হাতে করিয়া অনেক দিন হইতেই বেড়াইতেছি। আমার গুরুঠাকুর সর্বদা একটি বাউলের গান গাহিতেন—সেইটি মনে পড়িলঃ
‘মনের মানুষ হয় যে জনা
নয়নে তায় যায় গো জানা,
সে দু এক জনা,
সে রসের মানুষ উজান পথে করে আনাগোনা।’
এই তো গেল আমার তরফ থেকে। এর একটিও অতিরঞ্জিত নয় জানিবেন এবং কার্যকালে দেখিবেন।
তারপর যে-সকল দেশহিতৈষী মহাত্মা গুরুপূজাটি ছাড়লেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন, তাঁদের সম্বন্ধেও আমার একটুকু খুঁত আছে। বলি, এ দেশের জন্য বুক ধড়ফড়, কলিজা ছেঁড়-ছেঁড়, প্রাণ যায়-যায়, কণ্ঠে ঘড়-ঘড় ইত্যাদি—আর একটি ঠাকুরেই সব বন্ধ করে দিলে?
এই যে প্রবল তরঙ্গশালিনী নদী, যার বেগে পাহাড়-পর্বত যেন ভেসে যায়, একটি ঠাকুরে একেবারে হিমালয়ে ফিরিয় দিলে! বলি, ও-রকম দেশ-হিতৈষিতাতে কি বড় কাজ হবে মনে করেন, বা ও-রকম সহায়তায় বড় বিশেষ উপকার হতে পারে? আপনারা জানেন, আমি তো কিছুই বুঝিতে পারি না। তৃষ্ণার্তের এত জলের বিচার, ক্ষুধায় মৃতপ্রায়ের এত অন্নবিচার, এত নাক সিটকানো? কে জানে কার কি মতিগতি! আমার যেন মনে হয়, ও-সব লোক গ্লাসকেসের ভিতর ভাল; কাজের সময় যত ওরা পিছনে থাকে, ততই কল্যাণ।
প্রীতি ন মানে জাত কুজাত।
ভুখ ন মানে বাসী ভাত।।
আমি তো জানি। তবে আমার সব ভুল হতে পারে, ঠাকুরের আঁটিটি গলায় আটকে যদি সব মারা যায় তো না হয় আঁটিটি ছাড়িয়া দেওয়া যায়। যাহা হউক, এ সম্বন্ধে আপনাদের সঙ্গে অনেক কথা কহিবার অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষা রহিল।
এ সকল কথা কহিবার জন্য রোগ, শোক, মৃত্যু সকলেই আমায় এ পর্যন্ত সময় দিয়াছেন, বিশ্বাস—এখনও দিবেন।
এই নববর্ষে আপনার সমস্ত কামনা পূর্ণ হউক।
কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪২৬*
মঠ, আলমবাজার
১৪ জুন, ১৮৯৯
প্রিয় বন্ধু,
আমি এখানে যে ভাবে আছি, মহামান্য (Highness) আপনাকেও সেইভাবে চাই, বন্ধুত্ব ও ভালবাসা আপনার এখনই সবচেয়ে প্রয়োজন।
কয়েক সপ্তাহ আগে আপনাকে একখানা চিঠি লিখেছি, কিন্তু আপনার কোন সংবাদ পাইনি। আশা করি, এখন আপনার স্বাস্থ্য খুব ভাল আছে। এ মাসের ২০ তারিখে আবার ইংলণ্ডে যাচ্ছি।
এবারকার সমুদ্রযাত্রায় কিছু উপকার হবে, আশা করছি।
ঈশ্বর আপনাকে সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করুন এবং সর্ববিধ আশীর্বাদে মণ্ডিত করুন।
সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪২৭*
পোর্ট সৈয়দ
১৪ জুলাই, ১৮৯৯
প্রিয় স্টার্ডি,
এইমাত্র তোমার চিঠিখানি ঠিক এসে গেছে। প্যারিসের মঁ নোব্লেরও (M. Nobel) একখানি এসেছে। মিস নোবল্ (Miss Nobel) আমেরিকার বহু চিঠি পেয়েছেন।
নোবল্ জানিয়েছেন যে, তাঁকে দীর্ঘকাল বাইরে থাকতে হবে; সুতরাং আমার লণ্ডন থেকে প্যারিসে তাঁর ওখানে যাবার তারিখ যেন পেছিয়ে দিই। তুমি নিশ্চয়ই জান যে, উপস্থিত লণ্ডনে আমার বন্ধুদের অনেকেই নেই; তা ছাড়া মিস ম্যাকলাউড যাবার জন্য আমায় খুবই পীড়াপীড়ি করছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইংলণ্ডে থাকা যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে না। অধিকন্তু আমার আয়ু ফুড়িয়ে এল—অন্ততঃ আমাকে এটা সত্য বলে ধরে নিয়েই চলতে হবে।
আমার বক্তব্য এই যে, আমরা যদি আমেরিকায় সত্যই কিছু করতে চাই, তবে এখনি আমাদের সমস্ত বিক্ষিপ্ত প্রভাবকে যথাবিধি নিয়ন্ত্রিত না করতে পারলেও অন্ততঃ একমুখী করতেই হবে। তারপর মাস-কয়েক পরেই আমি ইংলণ্ডে ফিরে আসার অবকাশ পাব এবং ভারতবর্ষে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত একমনে কাজ করতে পারব।
আমার মনে হয়, আমেরিকার কাজকে গুছিয়ে আনার জন্য তোমার আসা একান্ত প্রয়োজন। অতএব যদি পার তো আমার সঙ্গেই তোমার চলে আসা উচিত। তুরীয়ানন্দ আমার সঙ্গে আছে। সারদানন্দের ভাই বষ্টনে আছে। … তুমি যদি আমেরিকায় নাও আসতে পার, তবু আমার যাওয়া উচিত—কি বল?
পত্রাবলী – ৪২৮*
The Lymes
Woodsides, Wimbledon
৩ অগষ্ট, ১৮৯৯
স্নেহের জো,
অবশেষে হাজির। তুরীয়ানন্দের ও আমার সুন্দর বাসস্থান মিলেছে। সারদানন্দের ভ্রাতা মিস্ নোবল্-এর বাসস্থানে আছে, আগামী সোমবার রওনা হবে।
সমুদ্রযাত্রায় বেশ কিছু স্বাস্থ্যোন্নতি হয়েছে। তা ঘটেছে ডাম্বেল নিয়ে ব্যায়াম ও মৌসুমী ঝড়ে ঢেউয়ের উপর ষ্টীমারের ওলটপালট থেকে। অদ্ভুত, নয় কি? আশা করি এটা বজায় থাকবে। আমাদের ‘মাতা’ কোথায়—ভারতের পূজনীয়া গাভীমাতা (Worshipful Brahmini Cow)? মনে হয়, তিনি নিউ ইয়র্কে তোমার সঙ্গেই আছেন।
স্টার্ডি বাইরে গেছে, মিসেস জনসন এবং অন্য সকলেও তাই। এতে কিছু উদ্বিগ্ন। আগামী মাসের আগে সে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারছে না। ইতোমধ্যেই সমুদ্রকে ভালবেসে ফেলেছি। মৎস্যাবতার আমার উপর চড়ে পড়েছেন, আশঙ্কা হয় ভালমতেই চড়েছেন, অব্যর্থভাবে—এই বাঙালীর উপর।
এলবার্টা কেমন আছে? … বুড়োরা ও বাকী সকলে? প্রিয় মিসেস র্যাবিটের (Mrs. Brer Rabbit) কাছ থেকে একখানা সুন্দর চিঠি পেয়েছি; তিনি লণ্ডনে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি; আমাদের পৌঁছবার আগেই তিনি রওনা হয়েছেন।
এখানে এখন সুন্দর উষ্ণ আবহাওয়া; সকলে বলছে, একটু বেশীমাত্রায় উষ্ণ। কিছুদিনের জন্য আমি শূন্যবাদী হয়ে গেছি, কোন কিছুতেই বিশ্বাস করি না। কোন কিছুর পরিকল্পনা, কোন অনুশোচনা, প্রচেষ্টা—কিছুই নেই; কাজকর্মের ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ না করার নীতি অবলম্বন করেছি। আর হ্যাঁ, জো, জাহাজে আমি যখন তোমার বা ভগবতী গাভীর সমালোচনা করেছি, তখনই তোমার পক্ষ নিয়েছে।
বেচারা ছেলেমানুষ, কতটুকুই বা জানে! আসল কথা হচ্ছে, জো, লণ্ডনে কোন কাজ হবে না, কারণ তুমি এখানে নেই। তুমিই দেখছি আমার নিয়তি। এককাট্টা হয়ে লেগে যাও, কর্ম থেকে কারও নিস্তার নেই। দেখ, এবারের সমুদ্রযাত্রার ফলে আমার বয়স যেন কয়েক বছর কমে গেছে। শুধু যখন বুক ধড়ফড় করে ওঠে, তখন টের পাই বয়স হয়েছে। এটা কি অস্থিচিকিৎসার কোন ব্যাপার?
আমার রোগ সারাতে দু-একটা পাঁজর কেটে বাদ দেবে নাকি? উহুঁ, তা হচ্ছে না। আমার পাঁজরা দিয়ে … তৈরী করা-টরা চলবে না। ওটা যা-ই হোক, তার পক্ষে আমার হাড় পাওয়া কঠিন হবে। আমার হাড় গঙ্গায় প্রবাল সৃষ্টি করবে, আমার বরাতে এই লেখা আছে।
এখন আমার ফরাসী শেখার ইচ্ছা—যদি তুমি প্রতিদিন আমাকে একটি করে পাঠ দিয়ে যাও; কিন্তু ও-সব ব্যাকরণের বালাই একদম নয়—আমি কেবল পড়ে যাব, আর তুমি ইংরেজীতে ব্যাখ্যা করে যাবে। অভেদানন্দকে আমার ভালবাসা দিও, আর বল সে যেন তুরীয়ানন্দের জন্য প্রস্তত থাকে। আমি তাকে নিয়ে যাচ্ছি। শীঘ্র চিঠি দিও। সর্ববিধ ভালবাসার সঙ্গে।
সর্ববিধ ভালবাসার সঙ্গে
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪২৯*
[মিস মেরী হেলবয়েষ্টারকে লিখিত]
C/o Miss Noble
21A High Street, উইম্বলডন
অগষ্ট, ১৮৯৯
স্নেহের মেরী,
আবার লণ্ডনে হাজির। এবারে কোন ব্যস্ততা নেই, টানাহেঁচড়া নেই, চুপটি করে এক কোণে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাবার প্রথম সুযোগের অপেক্ষায় আছি। বন্ধুরা প্রায় সকলেই লণ্ডনের পল্লী অঞ্চলে কিম্বা অন্যত্র চলে গিয়েছেন আর আমার শরীর বিশেষ সবল নয়।
তাহলে কানাডাতে সরোবর, উদ্যান ও নির্জনতার মধ্যে বিশেষ আনন্দে আছ। জেনে খুশী—খুবই খুশী যে, তুমি আবার স্রোতের উপর ভেসে উঠেছ। এ অবস্থায় যেন চিরদিন থাকতে পার!
‘রাজযোগে’র অনুবাদ এখনও শেষ করতে পারনি—বেশ তো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। কাজটা হবার হলে সময় ও সুযোগ আসবেই জেন, নইলে আমাদের চেষ্টা বৃথা।
ক্ষণস্থায়ী কিন্তু প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দেশ কানাডা এখন নিশ্চয়ই সুন্দর এবং খুব স্বাস্থ্যকর। কয়েক সপ্তাহ পরেই নিউ ইয়র্কে পৌঁছব, আশা করি; তারপরের কথা জানি না। আগামী বসন্তে হয়তো আবার ইংলণ্ডে ফিরে আসব।
আমি একান্তভাবে চাই যে কাউকেই যেন কখনও দুঃখ পেতে না হয়, কিন্তু (একথা সত্যি যে) একমাত্র দুঃখই জীবনের গভীরে প্রবেশ করবার অন্তর্দৃষ্টি এনে দেয়। তাই নয় কি?
আমাদের বেদনার মুহূর্তে চিরদিনের মত বন্ধ দুয়ার আবার খুলে যায় এবং অন্তরে আলোর বন্যা প্রবেশ করে।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ে। কিন্তু হায়! এ জগতে লব্ধ জ্ঞানকে আমরা কাজে লাগাতে পারি না। যে মুহূর্তে মনে হয় কিছু শিখেছি, তখনই রঙ্গমঞ্চ থেকে তাড়াতাড়ি বিদায় নিতে হয়। এরই নাম মায়া!
এই খেলার জগৎ কোথায় থাকত, আর খেলাই বা কেমন করে চলত, যদি এই খেলার মর্ম আমাদের আগে থেকেই জানা থাকত? চোখ বেঁধে আমাদের খেলা। এই খেলায় আমাদের মধ্যে কেউ শয়তানের অভিনয় করছে, কেউ বা বীরের—কিন্তু জেন, এ-সবই নিছক খেলা। এটুকুই একমাত্র সান্ত্বনা। রঙ্গমঞ্চে সিংহ, ব্যাঘ্র, দানব এবং আরও কত জীবই না আছে, কিন্তু সকলেরই মুখে বন্ধনী আঁটা; তারা তীক্ষ্ণ শব্দ করে, কিন্তু কামড়াতে পারে না।
—জগৎ আমাদের আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। যদি তুমি চাও, শরীর বিদীর্ণ হলেও বা রক্তের ধারা বইলেও অন্তরে গভীর শান্তি অনুভব করতে পার। আর তা পাবার উপায় হল নৈরাশ্য বা সকল আশা বিসর্জন দেওয়া। তুমি কি তা জান? এটি অক্ষমের হতাশার মনোভাব নয়, বিজয়ীর বিজিত বস্তুর প্রতি যে অবহেলা, এ হল তাই—কোন কিছুকে পাবার জন্য সে যেমন লড়াই করে, পাবার পর তেমনি সেটা তার অযোগ্য মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
এই নৈরাশ্য, নির্বাসনা ও লক্ষ্যহীনতার সঙ্গে প্রকৃতির ঐক্য আছে। প্রকৃতিতে কোন সামঞ্জস্য, যুক্তিবিচার বা পারম্পর্য নেই, যেমন বিশৃঙ্খলা আগেও ছিল, এখনও তেমনি আছে।
নিকৃষ্ট মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এই মিল যে তার চিন্তা পার্থিব, শ্রেষ্ঠ মানুষের সঙ্গেও মিল তার জ্ঞানের পরিপূর্ণতায়। এরা তিনজনই ৯ লক্ষ্যশূন্য, প্রবাহ-তাড়িত, আশাহীন—তিনজনেই সুখী।
তুমি খোশগল্পভরা চিঠি চাও, তায় নয় কি? কিন্তু আমার ঝুলিতে বেশী গল্প নেই। মিঃ স্টার্ডি দুদিন আগে এসেছে। কাল ওয়েলস্-এ তার বাড়ীতে চলে যাবে। দু-এক দিনের মধ্যেই নিউ ইয়র্কের টিকিট করতে হবে।
পুরানো কোন বন্ধুর দেখা এখনও পাইনি, মিস সুটার (Miss Souter) এবং ম্যাক্স গাইসিক (Max Gysic) ছাড়া—এঁরা এখন লণ্ডনে। এঁরা যেমন বরাবর আমার প্রতি সদয় ছিলেন, এখনও তাই।
কোন খবরই তোমাকে দেবার নেই, কারণ আমি নিজেই লণ্ডনের খবর এখনও কিছু জানি না। গারট্রুড অর্চার্ড (Gertrude Orchard) কোথায় জানি না, জানলে তার কাছে চিঠি লিখতাম। মিস কেট ষ্টীলও (Miss Kate Steel) বাইরে, বৃহস্পতিবার কি শনিবার আসছে।
একজন সুশিক্ষিত ফরাসী বন্ধুর কাছ থেকে পারি-তে তাঁর অতিথি হয়ে থাকবার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, কিন্তু এবার যাওয়া হল না। অন্য কোন সময় তাঁর সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে আসব।
কয়েকজন পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবার আশা আছে, হলে শুভেচ্ছা জানাব। আমেরিকায় তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা হবে। হয় আমি বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ আটোয়া যেয়ে হাজির হব, কিম্বা তুমি আসবে নিউ ইয়র্কে।
বিদায়, ভাগ্য তোমার প্রতি প্রসন্ন হোক।
সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৩০
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
লণ্ডন
১০ অগষ্ট, ১৮৯৯
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার পত্রে অনেক সংবাদ পাইলাম। আমার শরীর জাহাজে অনেক ভাল ছিল, কিন্তু ডাঙায় আসিয়া পেটে বায়ু হওয়ায় একটু খারাপ। একজন ডাক্তার বললে, নিরামিষ খাও, আর দাল ছুঁয়ো না। ইনি এখানকার একজন মুরুব্বী ডাক্তার। এঁর মতে ইউরিক এসিড-গোলমালে যত ব্যারাম হয়। মাংস এবং দাল ইউরিক এসিড বানায়; অতএব ’ত্যাজ্যং ব্রহ্মপদং’ ইত্যাদি। যা হোক, আমি তাকে সেলাম করে চলে এলাম।
Examine (পরীক্ষা) করে বললে চিনি-ফিনি নেই—আলবুমেন আছে। যাক! নাড়ী খুব জোর, বুকটাও দুর্বল বটে। মন্দ কি, দিনকতক হবিষ্যাশী হওয়া ভাল। এখানে বড় গোলযোগ—বন্ধু-বান্ধব সব গরমির দিনে বাইরে গেছে। তার উপর শরীর তত ভাল নয়—খাওয়া-দাওয়ায়ও গোলমাল। অতএব দু-চার দিনের মধ্যেই আমেরিকায় চললুম। মিসেস বুলের জন্য একটা হিসাব পাঠাইও—কত টাকা জমি কিনতে, কত টাকা বাড়ি, খাইখরচ কত টাকা ইত্যাদি, ইত্যাদি।
সারদা বলে, কাগজ চলে না। … আমার ভ্রমণ-বৃত্তান্ত খুব advertise করে (বিজ্ঞাপন দিয়ে) ছাপাক দিকি—গড় গড় করে subscriber (গ্রাহক) হবে। খালি ভট্চায্যিগিরি তিন ভাগ দিলে কি লোকে পছন্দ করে!
যা হোক কাগজটার উপর খুব নজর রাখবে। মনে জেন যে, আমি গেছি। এই বুঝে স্বাধীনভাবে তোমরা কাজ কর। ‘টাকাকড়ি, বিদ্যাবুদ্ধি সমস্ত দাদার ভরসা’ হইলেই সর্বনাশ আর কি! কাগজটার পর্যন্ত টাকা আমি আনব, আবার লেখাও আমার সব—তোমরা কি করবে? সাহেবেরা১০ কি করছেন? আমার হয়ে গেছে! তোমরা যা করবার কর। একটা পয়সা আনবার কেউ নেই, একটা প্রচার করবার কেউ নেই, একটা বিষয় রক্ষা করবার বুদ্ধি কারু নেই।
এক লাইন লিখবার … ক্ষমতা কারুর নাই—সব খামকা মহাপুরুষ! …তোমাদের যখন এই দশা, তখন ছেলেদের হাতে ছমাস ফেলে দাও সমস্ত জিনিষ—কাগজ-পত্র, টাকা-কড়ি, প্রচার ইত্যাদি। তারাও কিছু না পারে তো সব বেচে-কিনে যাদের টাকা তাদের দিয়ে ফকির হও। মঠের খবর তো কিছুই পাই না। শরৎ কি করছে? আমি কাজ চাই। মরবার আগে দেখতে চাই যে, আজীবন কষ্ট করে যা খাড়া করেছি, তা এক-রকম চলছে।
তুমি টাকাকড়ির বিষয় কমিটির সঙ্গে প্রত্যেক বিষয়ে পরামর্শ করে কাজ করবে। কমিটির সই করে নেবে প্রত্যেক খরচের জন্য। নইলে তুমিও বদনাম নেবে আর কি! লোকে টাকা দিলেই একদিন না একদিন হিসাব চায়—এই দস্তুর। প্রতি পদে সেটি তৈয়ার না থাকা বড়ই অন্যায়।
… ঐ-রকম প্রথমে কুঁড়েমি করতে করতেই লোকে জোচ্চোর হয়। মঠে যারা আছে, তাদের নিয়ে একটি কমিটি করবে, আর প্রতি খরচ তারা সই না দিলে হবে না—একদম! … আমি কাজ চাই, vigour (উদ্যম) চাই—যে মরে সে বাঁচে; সন্ন্যাসীর আবার মরা-বাঁচা কি?
শরৎ যদি কলিকাতা না জাগিয়ে তুলতে পারে … তুমি যদি এ বৎসরের মধ্যে পোস্তা না গাঁথতে পার তো দেখতে পাবে তামাসা! আমি কাজ চাই—no humbug (কোন প্রতারণা নয়)! মাতাঠাকুরাণীকে আমার সাষ্টাঙ্গ, ইত্যাদি। ইতি
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৩১*
রিজলি
২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয়—,
জীবন হচ্ছে কতকগুলো ঘাত-প্রতিঘাত ও ভুল-ভাঙার সমষ্টি মাত্র। … জীবনের রহস্য হচ্ছে ভোগ নয়, পরন্তু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিক্ষালাভ। কিন্তু হায়, যখন সবেমাত্র আমাদের প্রকৃত শিক্ষা আরম্ভ হয় ঠিক তখনি ডাক আসে। এইটি অনেকের নিকট পরজন্মের অস্তিত্ব সম্বন্ধে একটা প্রবল যুক্তি বলে মনে হয়।
… সর্বত্রই কাজের উপর দিয়ে একটা ঘূর্ণিবায়ু বয়ে যাওয়া যেন ভাল বলে মনে হয়—তাতে সব পরিষ্কার করে দেয় এবং জিনিষের আসল রূপটি আমাদের সামনে তুলে ধরে। নূতন করে সে কাজ গড়ে তোলা হয়—বজ্রদৃঢ় ভিত্তির উপরে। … আমার একান্ত শুভেচ্ছা জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৩২*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
রিজলি
৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয়—,
… আমার সম্বন্ধে তো ঐ এক কথা—মা-ই সব জানেন।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৩৩*
রিজলি ম্যনর ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় স্টার্ডি,
আমি লেগেটদের বাড়ীতে শুধু বিশ্রামই উপভোগ করছি, আর কিছুই করছি না। অভেদানন্দ এখানে আছে, খুব খাটছে। দু-এক দিনের মধ্যে সে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে চলে যাবে এক মাসের জন্য। তারপর নিউ ইয়র্কে কাজ করতে আসবে।
তোমার প্রস্তাবিত ধারা অবলম্বনে আমি কিছু করবার চেষ্টায় আছি; কিন্তু হিন্দুদের সম্বন্ধে হিন্দুরই লেখা বই পাশ্চাত্য দেশে কতটা সমাদর পাবে জানি না।
মিসেস জন্সনের মতে ধার্মিক ব্যক্তির রোগ হওয়া উচিত নয়। এখন আবার তাঁর মনে হচ্ছে, আমার ধূমপানাদিও পাপ। মিস মূলারও আমায় ছেড়ে গেছেন—ঐ রোগের জন্য। হয়তো তাঁরাই ঠিক। তুমিও জান, আমিও জানি, আমি যা, আমি তাই। ভারতে অনেকে এই দোষের জন্য এবং ইওরোপীয়দের সঙ্গে আহার করার জন্য আপত্তি জানিয়েছেন, ইওরোপীয়দের সঙ্গে খাই বলে আমায় একটি পারিবারিক দেবালয় থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল।
আমার তো ইচ্ছা হয়, আমি এমন নমনীয় হই যে, প্রত্যেকের ইচ্ছানুরূপ আকারে গঠিত হতে পারি; কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এমন লোক তো আজও দেখলাম না, যে সকলকে সন্তুষ্ট করতে পারে। বিশেষতঃ যাকে বহু জায়গায় যেতে হয়, তার পক্ষে সকলকে তুষ্ট করা সম্ভব নয়।
আমি যখন প্রথম আমেরিকায় আসি, তখন প্যাণ্টালুন না থাকলে লোকে আমার প্রতি দুর্ব্যবহার করত; তারপর আমাকে শক্ত আস্তিন ও কলার পরতে বাধ্য করা হল—তা না হলে আমায় ছোঁবেই না। তারা আমাকে যা খেতে দিত, তা না খেলে আমায় অদ্ভুত মনে করত। এমনি সব!
অবশ্য সবই আমার কর্মফল, আর এতে আমি খুশীই আছি। কারণ এতে যদিও সময়ের মত যন্ত্রণা হয়, তবু এতে জীবনের আর এক অভিজ্ঞতা হয় এবং তা এ-জীবনেই হোক বা পরজীবনেই হোক, কাজে লাগবে।
আমি নিজে কিন্তু জোয়ার-ভাঁটার মধ্য দিয়েই চলেছি। আমি সর্বদা জানি এবং প্রচার করে এসেছি যে, প্রত্যেক আনন্দের পশ্চাতে আসে দুঃখ—চক্রবৃদ্ধি সুদ সমেত না হলেও আসলটা তো আসবেই। আমি জগতের কাছে প্রচুর ভালবাসা পেয়েছি, সুতরাং যথেষ্ট ঘৃণার জন্যও আমায় প্রস্তুত থাকতে হবে। আর এতে আমি খুশীই আছি—কারণ আমাকে অবলম্বন করে আমার এই মতবাদই প্রমাণিত হচ্ছে যে, প্রত্যেক উত্থানের সঙ্গে থাকে তার অনুরূপ পতন।
আমার দিক্ থেকে আমি আমার স্বভাব ও নীতিকে সর্বদা আঁকড়ে ধরে থাকি— একবার যাকে বন্ধু বলে গ্রহণ করেছি, সে সর্বদাই আমার বন্ধু। তাছাড়া ভারতীয় রীতি অনুসারে আমি বাইরের ঘটনাবলীর কারণ আবিষ্কারের জন্যই অন্তরে দৃষ্টিপাত করি; আমি জানি যে আমার উপর যত বিদ্বেষ ও ঘৃণার তরঙ্গ এসে পড়ে, তার জন্য দায়ী আমি এবং শুধু আমিই। এমনটি না হয়ে অন্য রকম হওয়া সম্ভব নয়।
তুমি ও মিসেস জন্সন যে আর একবার আমাকে অন্তর্মুখী হবার জন্য অবহিত করেছ, সেজন্য তোমাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
চিরকালের মত স্নেহ ও শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৩৪*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
রিজলি ম্যানর
সেপ্টেম্বর, ১৮৯৯
স্নেহের মেরী,
হ্যাঁ, এসে পৌঁছেছি। গ্রীনএকার থেকে ইসাবেল-এর একখানা চিঠি পেয়েছি। তার সঙ্গে এবং হ্যারিয়েটের সঙ্গে শীঘ্রই দেখা করব। হ্যারিয়েট আগের মতই নীরব। যাই হোক, আমি অপেক্ষা করব, মিঃ উলী (Mr. Woolley) ক্রোরপতি হলেই আমার টাকা দাবী করব। তোমার চিঠিতে মাদার চার্চ বা ফাদার পোপের খুঁটিনাটি খবর কিছুই নেই, কতকগুলি কাগজে আমার সম্বন্ধে কি লিখেছে না লিখেছে, কেবল তাই আছে।
কাগজের লেখার প্রতি আমার আগ্রহ অনেকদিন কেটে গিয়েছে; সেগুলি শুধু জনসাধারণের সামনে আমাদের তুলে ধরে ও তাতে আমার বইগুলি—তোমার মতে ‘যা হোক করে’ বিক্রী হয়ে যায়। এখন কি করবার চেষ্টা করছি, জান? ‘ভারত ও ভারতবাসী’ সম্বন্ধে একটি বই লিখছি—ছোট্ট সহজ খোশগল্পে-ভরা একটা কিছু। ফরাসী শিখছি আবার।
এ বছর শিখতে না পারলে আগামী বছর পারি-প্রদর্শনীর ব্যাপারটা ঠিকভাবে চালাতে পারব না। হ্যাঁ, এখানে বেশ খানিকটা ফরাসী শিখে নিতে চাই, চাকরেরা পর্যন্ত ফরাসীতে কথা বলে।
মিসেস লেগেটকে তুমি কখনও দেখনি, তাই নয় কি? মহিলাটি সত্যি চমৎকার। আগামী বছর আবার তাঁদের অতিথি হয়ে পারি যাচ্ছি, যেমন প্রথমবারে গিয়েছিলাম।
বর্তমানে দর্শন ও তুলনামূলক ধর্মশিক্ষার জন্য এবং কর্মকেন্দ্ররূপে গঙ্গাতীরে একটি মঠ হয়েছে।
সারা সময়টা কি করে কাটাচ্ছ? পড়াশুনা?—লেখা-লিখি? না, কিছুই করনি। এসময়ের মধ্যে অনেক কিছুই লিখে ফেলতে পারতে। চাই কি, যদি আমাকে ফরাসীটা শেখাতে, তাহলে এতদিনে আমি বেশ ফ্রগি (ফরাসী) হয়ে যেতাম, আর তা না করে আমাকে কিনা যত বাজে বকাচ্ছ। গ্রীনএকারে তুমি কোনদিন যাওনি; আশা করি, সেখানকার ব্যাপার প্রতি বছর বাড়ছে।
তোমার চিকিৎসা (ক্রিশ্চান সায়ান্স) দিয়ে আমাকে ভাল করতে পারলে না। তোমার রোগ-নিরাময়ের ক্ষমতা সম্বন্ধে আমার আস্থা বেশ কিছুটা কমে যাচ্ছে। স্যাম কোথায়?
আমার চুল তাড়াতাড়ি পেকে যাচ্ছিল, এখন কোনক্রমে তা বন্ধ হয়েছে। দুঃখের বিষয় এখন সবেমাত্র কয়েকটি পাকা চুল আছে; অবশ্য ভাল করে সন্ধান করলে আরও অনেক বেরিয়ে পড়বে। শুভ্র কেশ আমার বেশ পছন্দ।
মাদার চার্চ ও ফাদার পোপ ইওরোপের দেশগুলিতে বেশ আনন্দে কাটাচ্ছিলেন, দেশে যাবার পথে আমি তা একটুখানি দেখে গেছি। আর চিকাগোতে তুমি রূপকথার সিন্দারেলা হয়ে বসে আছ—তা তোমার পক্ষে ভালই। আগামী বছর তোমাকে নিয়ে পারি যাব, বুড়োবুড়ীকে রাজী করাও দেখি। সেখানে অদ্ভুত অদ্ভুত দেখবার জিনিষ আছে; সকলে বলে, ফরাসীরা ব্যবসা গুটোবার আগে শেষবারের মত একটা বড়রকম সংগ্রামে নামছে।
হ্যাঁ, সুদীর্ঘকাল তুমি আমাকে চিঠি লেখনি। এ চিঠি তোমার প্রাপ্য নয়, কিন্তু দেখছ—আমি কত ভালমানুষ, কারও সঙ্গে বিবাদ করতে চাই না—বিশেষ করে মৃত্যু যখন দ্বারে। ইসাবেল ও হ্যারিয়েটকে দেখবার জন্য আমি ব্যাকুল। মনে হয়, গ্রীনএকার ইন-এ (Greenacre Inn) তারা যথেষ্ট পরিমাণ রোগনিরাময়-শক্তির সরবরাহ পাচ্ছে এবং বর্তমান স্বাস্থ্যভঙ্গ থেকে তারা আমাকে উদ্ধার করতে পারবে।
আমার কালে কিন্তু সরাইখানাটি (Inn) আধ্যাত্মিক খাদ্যেই ভর্তি থাকত, পার্থিব দ্রব্যের পরিমাণ ছিল অনেক কম। তুমি কি অস্থিবিজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু জান? নিউ ইয়র্কে একজন এসে বাস্তবিক অবাক কাণ্ড করেছে। এক সপ্তাহ পরে তাকে দিয়ে আমার হাড়গোড় দেখান হবে।
মিস হাউ কোথায়? সত্যি তিনি মহৎপ্রাণ, একজন অকৃত্রিম বন্ধু। মেরী, কথাপ্রসঙ্গে বলছি, ভাবতে অদ্ভুত লাগে যে তোমাদের পরিবারটি—মাদার চার্চ ও তার ধর্মযাজক (Mr. Hale)—সন্ন্যাসী ও সংসারী দুই রূপেই আমার মনের উপর যে ছাপ রেখেছেন, পরিচিত আর কোন পরিবার তা পারেনি। প্রভুর আশীর্বাদ চিরদিন তোমাদের উপর বর্ষিত হোক।
আমি এখন বিশ্রাম নিচ্ছি। লেগেটরা খুব সহৃদয়। এখানে আমি খুব স্বচ্ছন্দে বাস করছি। ডিউই (Dewy) শোভাযাত্রা দেখতে নিউ ইয়র্ক যাবার ইচ্ছা। সেখানকার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়নি।
তোমার সমস্ত খবর লিখবে, তা জানবার জন্য আমার খুব আগ্রহ। তুমি অবশ্যই জোজো-কে জান। আমার অবিরত স্বাস্থ্যভঙ্গের ফলে তাদের ভারতভ্রমণ পণ্ড হয়েছে, কিন্তু তারা কতই না সহৃদয় ও ক্ষমতাপরায়ণ! কয়েক বছর ধরে সে ও মিসেস বুল স্বর্গীয় দূতের মত আমার তত্ত্বাবধান করেছে। আগামী সপ্তাহে মিসেস বুলের এখানে আসার সম্ভাবনা।
আগেই তিনি এখানে এসে হাজির হতেন, কিন্তু তাঁর মেয়ে (ওলিয়া) হঠাৎ অসুখে পড়ে। মেয়েটি খুব ভুগছে, তবে এখন বিপদ কেটে গেছে। এখানে লেগেটের একখানা কুটীর মিসেস বুল নিয়েছেন। অকালে শীত না পড়লে আরও মাসখানেক এখানে আমাদের চমৎকার কাটবে। জায়গাটি সত্যি সুন্দর—বনরাজিবেষ্টিত নিখুঁত তৃণাবৃত ময়দান।
সেদিন গল্ফ খেলার একটা প্রচেষ্টা করা গেল; খেলাটা খুব কঠিন বলে মনে হয় না—শুধু অভ্যেস চাই। তোমার গলফ্-প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে কখনও ফিলাডেলফিয়া যাওনি? তোমার মতলবটা কি? বাকী জীবনটা কি করে কাটাতে চাও বল তো? কোন কাজের পরিকল্পনা করেছ কি? একটি বড় চিঠি লিখ, লিখবে কি?
নেপলস্-এর রাজপথে চলতে চলতে তিনজন মহিলার সঙ্গে আর একজনকে যেতে দেখি—নিশ্চয়ই আমেরিকান—তোমার সঙ্গে তার এত মিল যে, আমি তো প্রায় কথা বলতে যাচ্ছিলাম; কাছে এসে তবে ভুল ভাঙল। এবারের মত বিদায়। শীঘ্র শীঘ্র লিখ।
সতত তোমার স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৩৫*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
রিজলি ম্যানর
৩ অক্টোবর, ১৮৯৯
স্নেহের মেরী,
তোমার অত্যন্ত সহৃদয় কথাগুলির জন্য ধন্যবাদ। এখন আমি অনেক ভাল আছি এবং দিন দিন আরও ভাল হচ্ছি। কাল বা পরশু মেয়েকে নিয়ে মিসেস বুলের আসার কথা। সুতরাং আবার কিছুকাল ভাল কাটবে বলে মনে হয়—তোমার অবশ্য সব সময়ই ভাল কাটছে। ফিলাডেলফিয়া যাচ্ছ জেনে খুশী হয়েছি, কিন্তু সে-বারের মত এবারে ততটা নই, সে-বার দিগন্তে ক্রোরপতি দেখা দিয়েছিল। সর্ববিধ ভালবাসা জেন।
সতত তোমার স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৩৬*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
রিজলি ম্যানর
৩০ অক্টোবর, ১৮৯৯
স্নেহের আশাবাদী ভগিনী,
তোমার চিঠি পেয়েছি। স্রোতে-ভাসা আশাবাদীকে কর্মে প্রবৃত্ত করবার মত কিছু একটা যে ঘটেছে, তার জন্য আনন্দিত। তোমার প্রশ্নগুলি দুঃখবাদের গোড়া ধরে নাড়া দিয়েছে, বলতে হবে। বর্তমান ব্রিটিশ ভারতের মাত্র একটাই ভাল দিক্ আছে, যদিও অজান্তে ঘটেছে—তা ভারতকে আর একবার জগৎমঞ্চে তুলে ধরেছে, ভারতের উপর বাইরের পৃথিবীকে চাপিয়ে দিয়েছে জোর করে।
সংশ্লিষ্ট জনগণের মঙ্গলের দিকে চোখ রেখে যদি তা করা হত—অনুকূল পরিবেশে জাপানের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে—তাহলে ফলাফল ভারতের ক্ষেত্রে আরও কত বিস্ময়কর হতে পারত। কিন্তু রক্তশোষণই যেখানে মূল উদ্দেশ্য, সেখানে মঙ্গলকর কিছু হতে পারে না। মোটের উপর, পুরানো শাসন জনগণের পক্ষে এর চেয়ে ভাল ছিল, কারণ তা তাদের সর্বস্ব লুঠ করে নেয়নি এবং সেখানে অন্ততঃ কিছু সুবিচার—কিছু স্বাধীনতা ছিল।
কয়েক-শ অর্ধশিক্ষিত, বিজাতীয় নব্যতন্ত্রী লোক নিয়ে বর্তমান ব্রিটিশ ভারতের সাজান তামাশা—আর কিছু নয়। মুসলমান ঐতিহাসিক ফেরিস্তার মতে দ্বাদশ শতাব্দীতে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৬০ কোটি, এখন ২০ কোটিরও নীচে।
ইংরেজ-বিজয়ের কালে কয়েক শতাব্দী ধরে যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলেছিল, ব্রিটিশ শাসনের অবশ্যম্ভাবী পরিণামরূপে ১৮৫৭ ও ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে যে বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং তার চেয়েও ভয়ানক যে-সকল দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে, (দেশীয় রাজ্যে কখনও দুর্ভিক্ষ হয়নি) তা লক্ষ লক্ষ লোককে গ্রাস করেছে।
তা সত্ত্বেও জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে, কিন্তু মুসলমান শাসনের আগে দেশ যখন সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল, এখনও সেই সংখ্যায় পৌঁছয়নি। বর্তমান জনসংখ্যার অন্ততঃ পাঁচগুণ লোককে সহজেই ভরণপোষণ করার মত জীবিকা ও উৎপাদনের সংস্থান ভারতে আছে—যদি সব কিছু তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া না হয়।
এই তো অবস্থা—শিক্ষাবিস্তারও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অপহৃত, (অবশ্য আমাদের নিরস্ত্র করা হয়েছে অনেক আগেই) যেটুকু স্বায়ত্তশাসন কয়েক বছরের জন্য দেওয়া হয়েছিল, অবিলম্বে তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দেখছি, আরও কী আসে! কয়েক ছত্র সমালোচনার জন্য লোককে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, বাকীরা বিনা বিচারে জেলে। কেউ জানে না, কখন কার ঘাড় থেকে মাথা উড়িয়ে দেওয়া হবে।
ভারতবর্ষে কয়েক বছর ধরে চলছে ত্রাসের রাজত্ব। ব্রিটিশ সৈন্য আমাদের পুরুষদের খুন করেছে, মেয়েদের মর্যাদা নষ্ট করেছে, বিনিময়ে আমাদেরই পয়সায় জাহাজে চড়ে দেশে ফিরেছে পেনসন ভোগ করতে। ভয়াবহ নৈরাশ্যে আমরা ডুবে আছি। কোথায় সেই ভগবান্? মেরী, তুমি আশাবাদী হতে পার, কিন্তু আমি কি পারি?
ধর, এই চিঠিখানাই যদি তুমি প্রকাশ করে দাও—ভারতের নূতন কানুনের জোরে ইংরেজ সরকার আমাকে এখান থেকে সোজা ভারতে টেনে নিয়ে যাবে এবং বিনা বিচারে আমাকে হত্যা করবে। আর আমি জানি তোমাদের সব খ্রীষ্টান শাসকসম্প্রদায় ব্যাপারটা উপভোগ করবে, কারণ আমি যে ‘হিদেন’। এর পরেও আমি নিদ্রা যাব, আর আশাবাদী থাকব? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আশাবাদীর নাম নীরো (Nero)।
হায়, সেই ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা তারা সংবাদ হিসাবেও লিখবার উপযুক্ত মনে করে না। নেহাতই যদি দরকার হয়, রয়টারের এজেণ্ট এগিয়ে এসে ‘আদেশ-মাফিক তৈরী’ ঠিক উল্টো খবরটি বাজারে ছাড়বে। হিদেন-হনন খ্রীষ্টানদের পক্ষে অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত অবসর-বিনোদন। তোমাদের মিশনারীরা ভারতে ঈশ্বরের মহিমা প্রচার করতে যায়, কিন্তু ইংরেজদের ভয়ে সেখানে একটি সত্য কথা উচ্চারণ করতে পারে না; যদি করে, পরদিন ইংরেজরা তাদের দূর করে দেবে।
পূর্বতন শাসকেরা শিক্ষার জন্য যে-সব জমি ও সম্পত্তি দান করেছিলেন, সে সকলই গ্রাস করে নেওয়া হয়েছে, এবং বর্তমান সরকার শিক্ষার জন্য রাশিয়ার চেয়েও কম খরচ করে—আর সে কী শিক্ষা! মৌলিকতার সামান্য চেষ্টাও টুঁটি টিপে মারা হয়।
মেরী, আমাদের কোন আশা নেই, যদি না সত্যি এমন কোন ভগবান্ থাকেন, যিনি সকলের পিতাস্বরূপ, যিনি বলবানের বিরুদ্ধে দুর্বলকে রক্ষা করতে ভীত নন, এবং যিনি কাঞ্চনের দাস নন। তেমন কোন ভগবান্ আছেন কি? কালেই তা প্রমাণিত হবে।
হ্যাঁ, আশা করছি—কয়েক সপ্তাহ পরে চিকাগো যেতে পারব এবং তখন সব কথা খুলে বলব।
সর্ববিধ ভালবাসা-সহ সতত তোমার ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পুনঃ—ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসাবে ‘—’ এবং অন্যান্য সম্প্রদায় কতকগুলি অর্থহীন সংমিশ্রণ; ইংরেজ প্রভুদের কাছে আমাদের বাঁচতে দেবার প্রার্থনা নিয়ে এরা গজিয়ে উঠেছে। আমরা এক নূতন ভারতের সূচনা করেছি—যথার্থ উন্নত ভারত, পরের দৃশ্যটুকু দেখবার অপেক্ষায় আছি।
নূতন মতবাদে আমরা তখনই বিশ্বাসী, যখন জাতির তা প্রয়োজন এবং যা আমাদের পক্ষে যথার্থ সত্য হবে। অন্যদের সত্যের পরীক্ষা হল ‘আমাদের প্রভুরা যা অনুমোদন করেন’; আর আমাদের হল, যা ভারতীয় জ্ঞানবিচারে বা অভিজ্ঞতায় অনুমোদিত, তাই। লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে, ‘—’ ও আমাদের মধ্যে নয়, … শুরু হয়েছে আরও কঠিন ও ভয়ঙ্কর শক্তির বিরুদ্ধে।
ইতি বি
পত্রাবলী – ৪৩৭*
C/o F. Leggett Esq.
রিজলি ম্যানর
আলস্টার কাউণ্টি নিউ ইয়র্ক
প্রিয় স্টার্ডি,
ঠিকানায় অসম্পূর্ণতার জন্য তোমার শেষ চিঠিখানা কয়েক জায়গা ঘুরে আমার কাছে এসে পৌঁছেছে।
হতে পারে তোমার সমালোচনার অনেকখানি অংশ সঙ্গত ও সত্য, আবার এও সম্ভব যে, কোন একদিন তুমি দেখবে, এ-সকলই কতকগুলি লোকের প্রতি তোমার বিরাগ থেকে প্রসূত, আর আমি হয়েছি অপরের কৃত অপরাধের ফলভোগী (scapegoat)।
যা হোক, এ-সব নিয়ে তিক্ততার প্রয়োজন নেই, যেহেতু আমি যা নই, তার ভান কখনও করেছি বলে মনে পড়ে না। আর তা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ আমার ধূমপান, খারাপ মেজাজ ইত্যাদি ব্যাপার—আমার সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কাটালে যে-কেউ সহজে জানতে পারে।
‘মিলন-মাত্রেরই বিচ্ছেদ আছে’—এই হল প্রকৃতির নিয়ম। তার জন্য আমার নৈরাশ্যের ভাব আমার মধ্যে জাগে না। আশা করি, তোমার মনে কোন তিক্ততা থাকবে না। কর্মই আমাদের মিলিয়ে দেয়, আবার কর্মই আমাদের বিচ্ছিন্ন করে।
জানি তুমি কেমন লাজুকস্বভাব এবং অপরের মনোভাবে আঘাত করতে কতখানি অপছন্দ কর। আমি খুবই বুঝতে পারছি, সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শের লোকদের নিয়ে কাজ চালিয়ে যাবার জন্য যখন তোমাকে যুঝতে হচ্ছিল, তখন মাসের পর মাস তোমাকে কি-রকম মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। এমন যে হবে, তা পূর্বে অনুমান করতে পারলে তোমাকে অনেক অনাবশ্যক মানসিক অশান্তি থেকে অব্যাহতি দিতে পারতাম। এও আবার সেই ‘কর্ম’।
হিসেবপত্র পূর্বে পেশ করা হয়নি, কারণ কাজ এখনও সমাপ্ত হয়নি; সমস্ত ব্যাপারটাকে চুকে গেলে দাতার কাছে সম্পূর্ণ হিসেব দাখিল করব, ভেবেছিলাম। টাকার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার ফলে কাজ মাত্র গত বছর শুরু হতে পেরেছে এবং আমার নীতি হল, টাকার জন্য হাত না পেতে স্বেচ্ছায় দানের জন্য অপেক্ষা করা।
আমার সমস্ত কাজে এই একই নীতি মেনে চলি, কারণ আমার স্বভাব যে অনেকের কাছেই নিতান্ত অপ্রীতিকর, সে সম্বন্ধে আমি খুবই সচেতন এবং যতক্ষণ না কেউ আমাকে চায়, ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করে থাকি। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবার জন্যও প্রস্তুত থাকি।
আর এই বিচ্ছেদের ব্যাপারে আমার কখনও মন খারাপ হয় না কিম্বা সে-সম্বন্ধে বেশি কিছু চিন্তাও করি না, কারণ আমার নিত্য ভ্রাম্যমাণ জীবনে এ জিনিষ আমাকে সব সময়ই করতে হচ্ছে। তবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এর দ্বারা অন্যকে যে কষ্ট দিই, সেই আমার দুঃখ। তোমার ঠিকানায় আমার নামে কোন ডাক থাকলে দয়া করে পাঠিয়ে দেবে কি?
সকল শুভাশিস তোমাদের চিরসাথী হোক—বিবেকানন্দের নিরন্তর এই প্রার্থনা।
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৩৮*
রিজলি
১ নভেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় ,
… মনে হচ্ছে তোমার মনে যেন কি একটা বিষাদ রয়েছে। তুমি ঘাবড়িও না, কিছুই তো চিরস্থায়ী নয়। যাই কর না কেন, জীবন কিছু অনন্ত নয়! আমি তার জন্য খুবই কৃতজ্ঞ। জগতের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সাহসী, যাতনাই তাহাদের বিধিলিপি; যদিও বা এর প্রতিকার সম্ভব হয়, তবু তা না হওয়া অবধি, ভাবী বহু যুগ পর্যন্ত এ জগতে এ ব্যাপারটা অন্ততঃ একটা স্বপ্নভঙ্গের শিক্ষারূপেও গ্রহণীয়।
আমার স্বাভাবিক অবস্থায় আমি তো নিজের দুঃখ-যন্ত্রণাকে সানন্দেই বরণ করি। কাউকে না কাউকে এ জগতে দুঃখভোগ করতেই হবে; আমি খুশী যে, প্রকৃতির কাছে যারা বলিপ্রদত্ত হয়েছে, আমিও তাদের একজন।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৩৯*
নিউ ইয়র্ক
১৫ নভেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় ,
… মোটের উপর আমার শরীরের জন্য বিশেষ উদ্বেগের কোন কারণ আছে বলে মনে করি না। এ-জাতীয় স্নায়ুপ্রধান ধাতের শরীর কখনও বা মহাসঙ্গীত-সৃষ্টির উপযোগী যন্ত্রস্বরূপ হয়, আবার কখনও বা অন্ধকারে কেঁদে মরে।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৪০*
C/o E. Guernsey, M.D.
The Madrid, 180 W. 59
১৫ নভেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় মিসেস বুল,
শেষ পর্যন্ত—এখনই কেম্ব্রিজে যাওয়া স্থির করেছি। যে-সব গল্প শুরু করেছিলাম, তা শেষ করতেই হবে। প্রথমটি আমাকে ফেরত দিয়েছে বলে মনে হয় না।
আগামী পরশু আমার পোষাক তৈরী হয়ে যাবে, তারপরই যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে পারব; শুধু ভয় এই—সমস্ত শীতকালটা অবিরত পার্টি আর বক্তৃতার ফলে সেখানে বিশ্রাম হবে না, উপরন্তু স্নায়ুগুলি দুর্বল হয়ে পড়বে।
যা হোক, বোধ হয় আপনি কোথায়ও একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন, যেখানে ঐ-সব ব্যাপার থেকে গা-ঢাকা দিয়ে একান্তে থাকতে পারব।
যে ভাবেই হোক, এই সপ্তাহে পোষাক তৈরী হয়ে গেলেই আমি চলে আসছি। আমার জন্য আপনার নিউ ইয়র্কে আসবার প্রয়োজন নেই। যদি আপনার নিজের কাজ থাকে, তা হলে আলাদা কথা। মণ্টক্লেয়ারের মিসেস হুইলারের কাছ থেকে খুব সহৃদয় আমন্ত্রণ পেয়েছি। বষ্টনে রওনা হবার আগে কয়েক ঘণ্টার জন্য অন্ততঃ মণ্টক্লেয়ারে ঘুরে যেতে হবে।
অনেক ভাল বোধ করছি এবং সুস্থ আছি। দুর্ভাবনা ছাড়া আর কিছু বালাই নেই; এবারে তাও নিশ্চয়ই সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেব।
ভারতে লেখা আপনার চিঠিপত্রে পরোক্ষভাবেও আমার সম্বন্ধে যেন কোন সংবাদ না থাকে—আপনার কাছে শুধু এটিই চাই; কিন্তু পাব কিনা সে-বিষয়ে আমার আশঙ্কা আছে। কিছু সময়ের জন্য অথবা চিরদিনের মত আমি গা-ঢাকা দিতে চাই। অভিশপ্ত হোক আমার প্রসিদ্ধির দিনটি!
সর্ববিধ ভালবাসা সহ
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৪১*
C/o F. H. Leggett
21 West 34th St., New York
নভেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় স্টার্ডি,
আমার আচরণ সমর্থনের জন্য এ চিঠি নয়। যদি আমি অন্যায় কিছু করে থাকি, তবে তা কথা দিয়ে মোছা যাবে না, বা কোন বিরূপ সমালোচনা করে আমাকে সৎকাজ থেকে বিরত করা যাবে না।
বিলাসিতা, বিলাসিতা—গত কয় মাস থেকে কথাটি বড্ড বেশী শুনতে পাচ্ছি, পাশ্চাত্যবাসীরা নাকি তার উপকরণ যুগিয়েছে, আর সর্বক্ষণ ত্যাগের মহিমা কীর্তন করে ভণ্ড আমি নাকি নিজে সেই বিলাসিতা ভোগ করে আসছি। এই বিলাস-ব্যসনই নাকি আমার কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্ততঃ ইংলণ্ডে।
আমি এই বিশ্বাসের কুহকে পড়েছিলাম যে, আমার জীবনের ঊষর মরুতে অন্ততঃ ছোট্ট একটি মরুদ্যান আছে; সমগ্র জীবনের দুঃখ ও অন্ধকারের মধ্যে আলোর একটু চিহ্ন, কঠোর পরিশ্রম ও কঠোরতর অভিশাপের জীবনে এক মুহূর্তের আরাম—সেই মরুদ্যান, সেই চিহ্ন, সেই মুহূর্তটি শুধু একটু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সুখের ব্যাপার!!
আমি খুশীই ছিলাম, সেটুকু পেতে যাঁরা আমাকে সাহায্য করেছেন, তাঁদের দিনে শতবার আশীর্বাদ করেছি, কিন্তু এমন সময় আকস্মিকভাবে তোমার চিঠিখানা হাতে এল, আর আমার স্বপ্নও কোথায় মিলিয়ে গেল। তোমাদের সমালোচনায় আমার আর কোন আস্থা নেই—এ-সব বিলাসব্যসনের কথায় আর কান দিই না, স্মৃতিতে জেগে উঠেছে অন্য এক দৃশ্য সেই কথাই লিখছি। উপযুক্ত মনে করলে এ চিঠি বন্ধুদের কাছে একে একে পাঠিয়ে দিও এবং কোথাও ভুল লিখে থাকলে শুধরে দিও।
ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ারের কথা বাদ দিলে ইংলণ্ড থেকে আমি রুমালের মত একটুকরো বস্ত্র পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। অথচ অপর পক্ষে ইংলণ্ডে আমার শরীর ও মনের উপর অবিরত পরিশ্রমের চাপের ফলেই আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তোমরা— ইংরেজরা আমাকে এই তো দিয়েছ, আর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছ অমানুষিক খাটিয়ে। এখন আবার বিলাস-ব্যসন নিয়ে নিন্দা করা হচ্ছে!!
তোমাদের মধ্যে কেউ আমাকে একটি কোট দিয়েছ, বলতে পার? কেউ একটা সিগার? এক-টুকরা মাছ বা মাংস? তোমাদের মধ্যে এ-কথা বলবার দুঃসাহস কার আছে যে, তোমাদের কাছে আমি খাবার, পানীয়, সিগার, পোষাক বা টাকা চেয়েছি? জিজ্ঞেস কর, … ঈশ্বরের নামে বলছি, জিজ্ঞেস কর তোমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস কর এবং সবচেয়ে আগে জিজ্ঞেস কর তোমার নিজের ‘অন্তর্যামী ভগবানকে—যিনি কখনও ঘুমান না।’
আমার কাজের জন্য তোমরা যে টাকা দিয়েছ, তার প্রতিটি পেনি সেখানেই আছে। তোমাদের চোখের সামনে আমার ভাইকে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে, সম্ভবতঃ মৃত্যুর প্রতীক্ষায়; কিন্তু তাকে আমি একটি কানাকড়িও দিইনি, কারণ আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না।
আর অন্য দিকে ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ারের কথা মনে পড়ে—শীতের সময় তারা আমাকে বস্ত্র দিয়েছেন, আমার নিজের মার চেয়েও যত্নে আমার সেবা করেছেন, ক্লান্তি ও দুঃখের দিনে আমার সমব্যথী হয়েছেন; এবং তাঁদের কাছ থেকে আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই পাইনি। সেই মিসেস সেভিয়ার মান-মর্যাদার পরোয়া করেননি বলেই আজ হাজার হাজার লোকের পূজনীয়া।
তাঁর লোকান্তরের পর লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁকে মনে রাখবে দরিদ্র ভারতবাসীর একজন অকৃত্রিম শুভার্থিনীরূপে। তাঁরা কখনও আমাকে বিলাসিতার জন্য নিন্দা করেননি, যদিও আমার ইচ্ছা বা প্রয়োজন হলে বিলাসিতার উপকরণ যোগাতে তাঁরা প্রস্তুত।
মিসেস বুল, মিসেস ম্যাকলাউড, মিঃ ও মিসেস লেগেট সম্বন্ধে তোমাকে বলা নিষ্প্রয়োজন। আমার জন্য তাঁদের ভালবাসা ও সহৃদয়তার কথা তোমার জানা আছে; মিসেস বুল ও মিসেস ম্যাকলাউড আমাদের দেশে গিয়েছেন এবং জীবনের সাধারণ সুখ-সুবিধাগুলি ত্যাগ করে আমাদের মধ্যে এমনভাবে বসবাস ও চলাফেরা করেছেন, যা কোন বিদেশী কখনও করেনি এবং তাঁরা তো আমার বিলাসিতার মুণ্ডপাত করেন না, বরং আমাকে খাওয়াতে পারলে বা আমি চাইলে দামী সিগার খাইয়ে তাঁরা আনন্দ পান।
আর যখন আমি তোমাদের জন্য প্রাণপাত করছিলাম এবং নোংরা গর্তে অনাহারের মধ্যে রেখে যখন তোমরা আমার গায়ের মাংস তুলে নিচ্ছিলে ও সঞ্চয় করে রেখেছিলে বিলাসিতার এই অপবাদ, সেদিনও এই লেগেট ও বুলদের দেওয়া রুটিই আমি খেয়েছি, তাঁদের দেওয়া কাপড়ই আমি পরেছি, তাঁদের টাকাতেই আমি ধূমপান করেছি এবং বহুবার বাড়ীভাড়াটা পর্যন্ত মিটিয়েছেন তাঁরাই।
‘শরতের মেঘ গরজে বিপুল, নাহি ঢালে বারিধারা,
বর্ষার মেঘ স্তব্ধ নীরব ভাসায় বসুন্ধরা।’
তবেই দেখ …, যাঁরা সাহায্য করেছেন বা এখনও করছেন তাঁদের কাছ থেকে কোন বিরূপ সমালোচনা বা নিন্দা নেই; যারা কিছুই করে না এবং শুধুই নিজের সার্থসিদ্ধির পথ খোঁজে, তারাই কেবল নিন্দা ও সমালোচনা করে। এ রকম মূল্যহীন, হৃদয়হীন, স্বার্থযুক্ত ও নোংরা সমালোচনার চেয়ে বড় আশীর্বাদ আমার কাছে আর নেই। এইসব চূড়ান্ত স্বার্থান্বেষীদের কাছ থেকে বহু ক্রোশ দূরে থাকা আমার যতটা কাম্য, জীবনে আর কিছুই তেমন নয়।
বিলাসিতার কথা বলছ! এইসব সমালোচকদের এক এক করে ধর—দেখবে প্রত্যেকেরই মন পড়ে আছে দেহে, আত্মার উপলব্ধি কারও একবিন্দু নেই। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আগেই হোক, পড়েই হোক তাদের স্বরূপ বেরিয়ে পড়েছে। আর এইসব হৃদয়হীন লোকের অভিপ্রায় অনুসারে তুমি আমার আচরণ ও কর্মধারা পরিবর্তন করতে উপদেশ দিচ্ছ, আর আমি তা করছি না বলে তোমার বুদ্ধি বিভ্রান্ত!
আমার গুরুভ্রাতাদের উপর আমি যে কাজ চাপাই, তারা তাই করে। যদি তারা কখনও স্বার্থপরতা দেখিয়ে থাকে, তা আমাদের আদেশেই করেছে, নিজের খুশীমত করেনি।
লণ্ডনে আমাকে যেমন অন্ধকার গর্তটির ভেতরে রেখেছিলে এবং সর্বক্ষণ পরিশ্রম ও অনাহারের মধ্যে মেরে ফেলার উপক্রম করেছিলে, তোমার সন্তানের বেলায় তা করতে পারতে কি? মিসেস—কি তা করতে চাইবেন?
তারা সন্ন্যাসী, তার অর্থ এই—কোন সন্ন্যাসী অকারণে শরীর ত্যাগ বা অপ্রয়োজনে কৃচ্ছ্রতা করবে না। পাশ্চাত্যদেশে এই-সকল কঠোরতা করতে গিয়ে আমরা সন্ন্যাসের নিয়মই ভঙ্গ করেছি। তারা আমার ভাই, আমার সন্তান। আমার জন্য তারা গর্তের মধ্যে মারা যাক, এ আমি চাই না। সত্য ও মঙ্গলকর সমস্ত শক্তির বলে আমি চাই না—তারা তাদের এত কষ্টের বদলে অনাহারে বা খেটে মরুক, কিম্বা অভিশপ্ত হোক।
আরও একটি কথা। যদি তুমি দেখাতে পার—কোথা আমি দেহের উপর নির্যাতনের কথা প্রচার করেছি, তা হলে খুশী হব। শাস্ত্রের কথা তুললে আমি বলি, সন্ন্যাসী ও পরমহংসদের জীবনযাপনের যে নিয়ম সেখানে লিপিবদ্ধ আছে, তা আমরা পালন করিনি, আমাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নিয়ে দাঁড়াতে কোন (শাস্ত্রী) পণ্ডিত যদি সাহস করেন, (তাঁর সম্মুখীন হতে) আমি খুবই খুশী হব।
হ্যাঁ …, বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে আছে আমার অন্তর। এর সবই আমি বুঝি। তোমার ভেতরটা কী, তা আমি জানি, কিন্তু তুমি এমন সব লোকের কবলে পড়েছ, যারা (তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য) তোমাকে ব্যবহার করতে চায়। তোমার স্ত্রীর কথা বলছি না। তিনি সরলপ্রাণা, অনিষ্টকর কিছু তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু বৎস, তোমার গায়ে আমিষ গন্ধ আছে—সামান্য কিছু টাকা আছে, শকুনিরা তাই ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করছে। এই হল জীবন।
প্রাচীন ভারত সম্বন্ধে তুমি অনেক কথা বলেছিলে। সেই ভারত আজও বেঁচে আছে …, এখনও সে মরেনি, আজও সেই জীবন্ত ভারত নির্ভীকভাবে ধনীর অনুগ্রহের তোয়াক্কা না রেখে তার নিজস্ব বাণী প্রচার করার মনোবল রাখে; কারও মতামতের পরোয়া সে করে না, এ দেশে—যেখানে তার পায়ে শিকল আঁটা কিম্বা শিকলের প্রান্তভাগ যারা ধরে আছে, সেই শাসনকর্তাদের মুখের সামনেও করে না। সেই ভারত আজও বেঁচে আছে …,
অম্লান প্রেমের, চিরস্থায়ী বিশ্বস্ততার চিরন্তন ভারতবর্ষ—শুধু রীতিনীতিতেই নয়, প্রেমে বিশ্বাসে ও বন্ধুত্বে। সেই ভারতের একজন নগণ্য সন্তান হিসাবে আমি তোমাকে ভালবাসি ভারতীয় প্রেমে, এবং এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে তোমায় সাহায্য করার জন্য আমি সহস্রবার শরীরত্যাগে প্রস্তুত।
চিরদিন তোমার
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৪২*
1st East 39 St. নিউ ইয়র্ক
২০ নভেম্বর, ১৮৯৯
স্নেহের মেরী,
খুব সম্ভবতঃ কাল ক্যালিফোর্নিয়া যাত্রা করছি। পথে দু-এক দিনের জন্য চিকাগোয় থাকব। যাত্রা করে তোমাকে ‘তার’ করব। কাউকে ষ্টেশনে পাঠিও, কারণ পথে ‘ভিতর’ ও ‘বাহির’ (in and out) খুঁজে বার করতে আমি কোন দিনই পারি না, এখন তো আরওই।
তোমার চিরদিনের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৪৩
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
আমেরিকা
২০ নভেম্বর, ১৮৯৯
অভিন্নহৃদয়েষু ,
শরতের পত্রে খবর পেলুম। … হার-জিতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই, তোমরা এইবেলা experience (অভিজ্ঞতা) করে নাও। … আমার আর কোন রাগ নেই। আমি আবার … ঘুরতে চললুম জায়গায় জায়গায়। কুছ পরোয়া নেই, মাভৈঃ। সব উড়ে যাবে তোমাদের সামনে, খালি (অবাধ্য) হয়ো না, সব সিদ্ধি হবে। … জয় মা রণরঙ্গিণী! জয় মা, জয় মা, রণরঙ্গিণী! ওয়া গুরু, ওয়া গুরুকী ফতে!
… আসল কথা, ঐ কাপুরুষত্বের চেয়ে পাপ নেই; কাপুরুষের উদ্ধার হয় না—এ নিশ্চিত। আর সব সয়, ঐটি সয় না। ওটি যে ছাড়বে না, তার সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক চলে কি? … এক ঘা খেয়ে দশ ঘা তেড়ে মারতে হবে … তবে মানুষ। … কাপুরুষ দয়ার আধার!!১১
আমি আশীর্বাদ করছি, আজ এই মহামায়ার দিনে—এই রাত্রে মা তোমাদের হৃদয়ে নাবুন, অনন্ত শক্তি তোমাদের বাহুতে আনুন! জয় কালী, জয় কালী, জয় কালী! মা নাববেনই নাববেন—মহাবলে সর্বজয়—বিশ্ববিজয়; মা নাবছেন। ভয় কি? কাদের ভয়? জয় কালী, জয় কালী! তোমাদের এক এক জনের দাপটে ধরা কাঁপবে।
… জয় কালী, জয় কালী! আবার onward, forward (এগিয়ে চল, এগিয়ে যাও)! ওয়া গুরু, জয় মা, জয় মা; কালী, কালী, কালী! রোগ, শোক, আপদ, দুর্বলতা, সব গেছে তোমাদের! মহাবিজয়, মহালক্ষ্মী, মহাশ্রী তোমাদের! মাভৈঃ মাভৈঃ। ফাঁড়া উতরে গেছে, মাভৈঃ! জয় কালী, জয় কালী!
বিবেকানন্দ
পুঃ—আমি মায়ের দাস, তোমরা মায়ের দাস—আমাদের কি নাশ আছে, ভয় আছে? অহঙ্কার–—মনে যেন না আসে, ভালবাসা—যেন না যায় মন থেকে। তোমাদের কি নাশ আছে?—মাভৈঃ! জয় কালী, জয় কালী!
পত্রাবলী – ৪৪৪
21 West 34 St.
নিউ ইয়র্ক
২১ নভেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় ব্রহ্মানন্দ,
হিসাব ঠিক আছে। আমি সে-সব মিসেস বুলের হাতে সঁপে দিয়েছি এবং তিনি বিভিন্ন দাতাকে হিসাবের বিভিন্ন অংশ জানাবার ভার নিয়েছেন। আগেকার কঠোর চিঠিগুলিতে আমি যা লিখেছি, তাতে কিছু মনে কর না। প্রথমতঃ ওতে তোমার উপকার হবে—এর ফলে তুমি ভবিষ্যতে যথানিয়মে কেতাদুরস্ত হিসাব রাখতে শিখবে এবং গুরুভাইদেরও এটা শিখিয়ে নেবে।
দ্বিতীয়তঃ এই সব ভর্ৎসনাতেও যদি তোমরা সাহসী না হও, তাহলে তোমাদের সব আশা ছেড়ে দিতে হবে। আমি চাই তোমরা (কাজ করতে করতে) মরেও যাও, তবু তোমাদের লড়তে হবে। সৈন্যের মত আজ্ঞাপালন করে মরে যাও এবং নির্বাণ লাভ কর, কিন্তু কোন প্রকার ভীরুতা চলবে না।
কিছুদিনের মত আমার একটু গা-ঢাকা দেবার আবশ্যক হয়ে পড়েছে। সে সময় যেন আমায় কেউ পত্র না লেখে এবং খোঁজ না করে। আমার স্বাস্থ্যের জন্য এটি একান্ত আবশ্যক। আমার স্নায়ুগুলি দুর্বল হয়ে গেছে—এই মাত্র, আর কিছু নয়।
তোমাদের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হোক। আমার রূঢ়তার জন্য মন খারাপ কর না। মুখে যা-ই থাকুক—তুমি তো আমার হৃদয় জান। তোমাদের সর্বপ্রকার শুভ হোক। বিগত প্রায় এক বৎসর আমি যেন একটা ঝোঁকে চলেছি। এর কারণ কিছু জানি না। ভাগ্যে এই নরক-যন্ত্রণা ভোগ ছিল—আর তা হয়ে গেছে। আমি সত্যই এখন আগের চেয়ে অনেক ভাল। প্রভু তোমাদের সহায় হোন! আমি চিরবিশ্রামের জন্য শীঘ্রই হিমালয়ে যাচ্ছি। আমার কাজ শেষ হয়েছে। ইতি
সতত প্রভুপদাশ্রিত
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—মিসেস বুল তোমাদের তাঁর ভালবাসা জানাচ্ছেন।
পত্রাবলী – ৪৪৫*
চিকাগো
২৬ নভেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় মিসেস লেগেট,
আপনার সকল সহৃদয়তা, বিশেষ করে সহৃদয় পত্রটির জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।আগামী বৃহস্পতিবার চিকাগো থেকে রওনা হচ্ছি, সেদিনের জন্য টিকিট ও বার্থ ঠিক করা হয়েছে।
মিস নোবল্ এখানে কাজ খুব ভালই চালাচ্ছে এবং নিজের পথ সে নিজেই তৈরী করে নিচ্ছে। এলবার্টার সঙ্গে সেদিন দেখা হল। এখন অবস্থানের প্রতিটি মুহূর্তে সে উপভোগ করছে এবং সে খুব আনন্দে আছে। মিস অ্যাডাম্স্ (Jane Adams) যথাপূর্ব দেবীর মত।
যাত্রার আগে জো জো-কে ‘তার’ করব এবং সারারাত বই পড়ে কাটাব। আপনাকে ও মিঃ লেগেটকে ভালবাসা।
আপনার চিরস্নেহের
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৪৬
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]
চিকাগো
৩০ নভেম্বর, ১৮৯৯
মা,
মাদাম কাল্ভের আগমন ছাড়া নূতন কোন খবর নেই। তিনি একজন মহীয়সী মহিলা। তাঁকে যদি আরও দেখতে পেতাম! সাইক্লোনের মুখে দাঁড়িয়ে বিশাল পাইন লড়াই করে যাচ্ছে—এ একটা মহান্ দৃশ্য।১২ তাই নয় কি?
আজ রাতে এস্থান ছেড়ে যাচ্ছি। এই কয়েকটি লাইন তাড়াতাড়ি লিখছি, কারণ অ—অপেক্ষা করছিল। মিসেস অ্যাডাম্স্ যথারীতি সহৃদয়। মার্গট চমৎকার চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আরও লিখব।
ফ্রান্কিনসেন্সকে ভালবাসা।
আপনার চিরসন্তান
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৪৭*
লস এঞ্জেলেস্
৬ ডিসেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় নিবেদিতা,
তোমার ষষ্ঠ দফা এসে পৌঁছেছে, কিন্তু তাতেও আমার ভাগ্যের কোন ইতরবিশেষ ঘটেনি। স্থান-পরিবর্তনে বিশেষ কোন উপকার হবে বলে মনে কর কি? কারও কারও প্রকৃতিই এমন যে, তারা দুঃখ পেতেই ভালবাসে। বস্তুতঃ যাদের মধ্যে আমি জন্মেছি, যদি তাদের জন্য আমার হৃদয় উৎসর্গ না করতাম তো অন্যের জন্য করতেই হত—এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই হচ্ছে কারও কারও ধাত—আমি তা ক্রমে বুঝতে পারছি।
আমরা সকলেই সুখের পেছনে ছুটছি সত্য, কিন্তু কেউ কেউ যে দুঃখেরই মধ্যে আনন্দ পায়—এটা খুব আশ্চর্য নয় কি? এতে ক্ষতি কিছু নেই; শুধু ভাববার বিষয় এই যে, সুখ-দুঃখ উভয়ই সংক্রামক। ইঙ্গারসোল একবার বলেছিলেন যে, তিনি যদি ভগবান্ হতেন তবে ব্যাধিকে সংক্রামক না করে স্বাস্থ্যকেই সংক্রামক করতেন। কিন্তু স্বাস্থ্য যে ব্যাধি অপেক্ষা অধিক না হলেও অনুরূপভাবে সংক্রামক, তা তিনি একটুও ভাবেননি।
বিপদ তো ঐখানেই। আমার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখে জগতের কিছুই যায়-আসে না—শুধু অপরে যাতে সংক্রামিত না হয়, তা দেখতে হবে। কর্মকৌশল তো ঐখানেই। যখনই মহাপুরুষ মানুষের দুঃখে ব্যথিত হন, তখন তিনি নিজের মুখ ভার করেন, বুক চাপড়ান এবং সকলকে ডেকে বলেন, ‘তোমরা তেঁতুল-জল খাও, কয়লা চিবাও, গায়ে ছাই মেখে গোবরের গাদায় বসে থাক, আর শুধু চোখের জলে করুণ সুরে বিলাপ কর।’
আমি দেখছি, তাঁদের সবারই ত্রুটি ছিল—সত্যি সত্যি ছিল। যদি সত্যই জগতের বোঝা স্কন্ধে নিতে তুমি প্রস্তুত হয়ে থাক, তবে সর্বতোভাবে তা গ্রহণ কর; কিন্তু তোমার বিলাপ ও অভিশাপ যেন আমাদের শুনতে না হয়। তোমার নিজের জ্বালা-যন্ত্রণা দিয়ে আমাদিগকে এমন শঙ্কিত করে তুলো না যে, শেষে আমাদের মনে করতে হয়, তোমার কাছে না এসে আমাদের নিজের দুঃখের বোঝা নিয়ে থাকাই বরং ছিল ভাল।
যে ব্যক্তি সত্যসত্যই জগতের দায় ঘাড়ে নেয়, জগৎকে আশীর্বাদ করতে করতে আপন পথে চলতে থাকে, তাঁর মুখে একটিও নিন্দার কথা, একটিও সমালোচনার কথা থাকে না, তার কারণ এ নয় যে, জগতে পাপ নেই; তার কারণ এই যে, তিনি স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেই পাপ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। যিনি পরিত্রাতা তাঁকেই সানন্দে আপন পথে চলতে হবে; যারা পরিত্রাণ পাচ্ছে, এ কাজ তাদের নয়।
আজ প্রাতে শুধু এ তত্ত্বের আলোই আমার সামনে উদ্ঘাটিত হয়েছে। যদি এ ভাব আমার মধ্যে স্থায়িভাবে এসে থাকে এবং আমার সমগ্র জীবনকে পরিব্যাপ্ত করে, তবেই যথেষ্ট।
দুঃখভার-জর্জরিত যে যেখানে আছ, সব এস, তোমাদের সব বোঝা আমার উপর ফেলে দিয়ে আপন মনে চলতে থাক, আর তোমরা সুখী হও এবং ভুলে যাও যে, আমি একজন কোনকালে ছিলাম। অনন্ত ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমার পিতা
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৪৮*
১২ ডিসেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনি ঠিকই ধরেছেন—আমি নিষ্ঠুর, বড়ই নিষ্ঠুর। আর আমার মধ্যে কোমলতা প্রভৃতি যা কিছু আছে, তা আমার ত্রুটি। এই দুর্বলতা যদি আমার মধ্যে আরও কম—অনেক কম থাকত! হায়! কোমলভাবই হল আমার দুর্বলতা এবং এটিই আমার সব দুঃখের কারণ। ভাল কথা মিউনিসিপ্যালিটি অত্যধিক কর বসিয়ে আমাদের উচ্ছেদ করতে চায়।
সেটা আমারই দোষ, কারণ আমি ট্রাষ্ট করে সাধারণের হাতে তুলে দিইনি। আমি যে মাঝে মাঝে আমার ছেলেদের প্রতি রূঢ় বাক্য প্রয়োগ করি, সেজন্য আমি বিশেষ দুঃখিত; কিন্তু তারাও জানে যে, সংসারে সবার চাইতে আমি তাদের বেশী ভালবাসি।
দৈবের সহায়তা সত্যই হয়তো আমি পেয়েছি; কিন্তু উঃ! এতটুকু দৈব কৃপার জন্য আমাকে কি পরিমাণেই না রক্তমোক্ষণ করতে হয়েছে। ঐটি না পেলে হয়তো আমি আরও বেশী সুখী হতাম এবং মানুষ হিসাবে আরও ভাল হতাম।
বর্তমান অবস্থা অবশ্য খুবই তমসাচ্ছন্ন বলে মনে হয়; তবে আমি নিজে যোদ্ধা, যুদ্ধ করতে করতেই আমায় প্রাণ দিতে হবে—হাল ছেড়ে দেওয়া চলবে না; এইজন্যই তো ছেলেদের উপর আমি মেজাজ ঠিক রাখতে পারি না। আমি তো তাদের যুদ্ধ করতে ডাকছি না—আমি তাদের আমার যুদ্ধে বাধা না দিতে বলছি।
অদৃষ্টের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নাই। কিন্তু হায়, এখন আমি চাই যে, আমার ছেলেদের মধ্যে অন্ততঃ একজন আমার পাশে দাঁড়িয়ে সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে সংগ্রাম করুক।
আপনি কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। ভারতবর্ষে কোন কাজ করতে হলে, আমার উপস্থিতি প্রয়োজন। আমার স্বাস্থ্য এখন আগের চেয়ে অনেকটা ভাল; হয়তো সমুদ্রযাত্রায় আরও ভাল হবে। যা হোক, এবার আমেরিকায় কেবল বন্ধু-বান্ধবদের উত্ত্যক্ত করা ছাড়া আর বিশেষ কোন কাজ করিনি। আমার পাথেয় বাবদ অর্থ-সাহায্য জো-র কাছ থেকেই পাব, তাছাড়া মিঃ লেগেটের কাছেও আমার কিছু টাকা আছে। ভারতবর্ষে কিছু অর্থ-সংগ্রহের আশা এখনও আমি রাখি।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আমার যে-সব বন্ধু-বান্ধব আছেন, তাঁদের কাছে এখনও যাইনি। আশা করি, প্রয়োজনীয় পঞ্চাশ হাজার পুরোবার জন্য পনর হাজার সংগ্রহ করতে পারব এবং ট্রাষ্টের দলিল হয়ে গেলেই মিউনিসিপ্যালিটির ট্যাক্সও কমে যাবে। আর যদি এ অর্থ সংগ্রহ করতে নাও পারি, তবু আমেরিকায় নিরর্থক বসে থাকার চেয়ে চেষ্টা করতে করতে মরাও শ্রেয় মনে করি। আমার জীবনের ভুলগুলি খুবই বড় বটে; কিন্তু তাদের প্রত্যেকটির কারণ খুব বেশী ভালবাসা।
এখন ভালবাসার উপর আমার বিতৃষ্ণা হয়ে গেছে। হায়! যদি আমার একটুও ভালবাসা না থাকত! ভক্তির কথা বলছেন! হায় আমি যদি নির্বিকার ও কঠোর বৈদান্তিক হতে পারতাম! যাক এ জীবন শেষ হয়েছে; পরজন্মে চেষ্টা করে দেখব। আমার দুঃখ এই—বিশেষতঃ আজকাল—আমার বন্ধুবান্ধবগণ আমার কাছ থেকে আশীর্বাদের চেয়ে অপকারই বেশী পেয়েছে। যে শান্তি ও নির্জনতা চিরদিন খুঁজছি, তা আমার অদৃষ্টে জুটল না।
বহু বৎসর আগে আমি হিমালয়ে গিয়েছিলাম, আর ফিরব না—এই মনে করে। এদিকে আমার বোন আত্মহত্যা করল, সে-সংবাদ আমার কাছে এসে পৌঁছল, আমার সেই দুর্বল হৃদয় আমাকে শান্তির আশা থেকে বিচ্যুত করল। সে দুর্বল হৃদয়ই আবার—আমি যাদের ভালবাসি, তাদের জন্য কিছু সাহায্য ভিক্ষা করতে আমায় ভারত থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আজ তাই আমি আমেরিকায়! শান্তি আমি চেয়েছি; কিন্তু ভক্তির আধার সেই আমার হৃদয়টি আমায় তা থেকে বঞ্চিত করেছে।
সংগ্রাম ও যন্ত্রণা, যন্ত্রণা ও সংগ্রাম! যাক, তাই যখন আমার নিয়তি, তখন তাই হোক; আর যত শীঘ্র এর শেষ হয়, ততই মঙ্গল। লোকে বলে আমি ভাবপ্রবণ, কিন্তু অবস্থার কথা ভাবুন দেখি! আপনি আমাকে কতই না ভালবাসেন—আমার প্রতি কতই না সদয়! অথচ আমিই কিনা আপনার এত বেদনার কারণ হলাম! আমি এতে দুঃখিত। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে—এ তো অন্যথা হবার নয়! এখন আমি গ্রন্থি ছেদন করতে চাই, অথবা সে চেষ্টায় শরীরপাত করব।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—মহামায়ার ইচ্ছায় পূর্ণ হোক। সান ফ্রান্সিস্কো হয়ে ভারতবর্ষে যাবার খরচ আমি জো-র কাছে চাইব। যদি সে তা দেয়, তবে অবিলম্বে জাপান হয়ে ভারতের দিকে যাত্রা করব। এতে একমাস লাগবে। ভারতে কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে পারব বলে আশা রাখি—যাতে কাজ চলে যাবে বা কাজের ভিত্তি দৃঢ়তর হবে—অন্ততঃ যে বিশৃঙ্খল অবস্থায় এখন রয়েছে দেখছি, তার চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারবে না।
কাজের শেষটা যেন বড় তমসাচ্ছন্ন ও বড় বিশৃঙ্খল হয়ে আসছে—অবশ্য এমনি প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু ভগবানের দয়ায় এ কথা মনে করবেন না যে, আমি মুহূর্তের জন্যও হাল ছেড়ে দেব। কাজ করে করে অবশেষে রাস্তায় পড়ে মরবার জন্য ভগবান্ যদি আমায় তাঁর ছ্যাকড়া গাড়ীর ঘোড়া করে থাকেন, তবে তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। বর্তমানে আপনার চিঠি পেয়ে এত আনন্দে আছি যে, এমন আনন্দ বহুকাল পাইনি।
য়া গুরু কি ফতে, গুরুজীর জয় হোক! হ্যাঁ, যে অবস্থাই আসুক না কেন—সংসার আসুক, নরক আসুক, দেবতারা আসুন, মা আসুন—আমি সংগ্রাম চালিয়েই যাব, কখনও হার মানব না। স্বয়ং ভগবানের সঙ্গে সংগ্রাম করে রাবণ তিন জন্মে মুক্তিলাভ করেছিল। মহামায়ার সঙ্গে সংগ্রাম তো গৌরবের বিষয়।
আপনার ও আপনার স্বজনবর্গের সর্বপ্রকার মঙ্গল হউক। আমি যতটুকুর যোগ্য তার চাইতে অনেক, অনেক বেশী আপনি আমার জন্য করেছেন। ক্রিষ্টিন ও তুরীয়ানন্দকে আমার ভালবাসা জানাবেন।
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৪৯*
২২ ডিসেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় ধীরামাতা,
আজ কলিকাতার এক পত্রে জানলাম যে, আপনার চেকগুলি পৌঁছেছে; ঐ সঙ্গে বহু ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার বাণীও এসেছে।
লণ্ডনের মিস সুটার ছাপানো পত্রে নববর্ষের অভিবাদন জানিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, আপনি তাঁকে যে হিসাব পাঠিয়েছেন, ইতোমধ্যে তিনি তা পেয়েছেন। আপনার ঠিকানায় সারদানন্দের যে সব চিঠি এসেছে, তা দয়া করে পাঠিয়ে দেবেন।
সম্প্রতি আমার আবার শরীর খারাপ হয়েছিল, তাই চিকিৎসক রগড়ে রগড়ে আমার ইঞ্চি কয়েক চামড়া তুলে ফেলেছে। এখনও আমি তার যন্ত্রণা বোধ করছি। নিবেদিতার কাছ থেকে একখানি খুব আশাপ্রদ চিঠি পেয়েছি। আমি প্যাসাডেনায় খেটে চলেছি, এবং আশা করছি যে, এখানে আমার কাজের কিছু ফল হবে। এখানে কেউ কেউ খুব উৎসাহী। ‘রাজযোগ’ বইখানি সত্যই এই উপকূলে চমৎকার কাজ করেছে।
মনের দিক্ থেকে বস্তুতই খুব ভাল আছি; সম্প্রতি আমি যেমন শান্তিতে আছি, তেমন কখনও ছিলাম না। যেমন ধরুন, বক্তৃতার ফলে আমার ঘুমের ব্যাঘাত হয় না। নিশ্চয়ই এটা একটা লাভ! কিছু লেখার কাজও করছি। এখানকার বক্তৃতাগুলি একজন সাঙ্কেতিক লেখক টুকে নিয়েছিল; স্থানীয় লোকেরা তা ছাপতে চায়।
জো-এর কাছে লেখা স্বামী —এর পত্রে খবর পেলাম যে, মঠের সব ভাল আছে এবং ভাল কাজ করছে। বরাবর যেমন হয়ে থাকে—পরিকল্পনাগুলি ক্রমে কাজে পরিণত হচ্ছে; কিন্তু আমি যেমন বলে থাকি, ‘মা-ই সব জানেন’। তিনি যেন আমায় মুক্তি দেন এবং তাঁর কাজের জন্য অন্য লোক বেছে নেন! ভাল কথা, ফলে আসক্তি না রেখে কাজ করার যে উপদেশ গীতায় আছে, সেটি মনে মনে ঠিক ঠিক অভ্যাস করার প্রকৃত উপায় আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি।
ধ্যান, মনোযোগ ও একাগ্রতার সাধন সম্বন্ধে আমি এমন আলো পেয়েছি, যা অভ্যাস করলে আমি সর্বপ্রকার উদ্বেগ ও দুর্ভাবনার অতীত হয়ে যাব। মনটাকে ইচ্ছানুসারে এক জায়গায় ঘিরে রেখে দেওয়ার কৌশল ছাড়া এটা আর কিছু নয়। এখন আপনার নিজের অবস্থা কি—বেচারী ধীরামাতা! মা হওয়ার এই দায়, এই শাস্তি! আমরা সব শুধু নিজেদের কথাই ভাবি, মায়ের কথা কখনও ভাবি না। আপনি কেমন আছেন? আপনার কেমন চলছে? আপনার মেয়ের এবং মিসেস ব্রিগ্স্-এর খবর কি?
আশা করি, তুরীয়ানন্দ এখন সম্পূর্ণ সেরে উঠেছে এবং কাজে লেগে গেছে। বেচারার ভাগ্যে শুধু দুর্ভোগ! কিন্তু ওতে কিছু মনে করবেন না। যন্ত্রণাভোগেও একটা আনন্দ আছে, যদি তা পরের জন্য হয়। তাই নয় কি? মিসেস লেগেট ভাল আছেন, জো-ও তাই; আর তারা বলছে, আমি ভাল আছি। হয়তো তাদেরই কথা ঠিক। যাই হোক, আমি কাজ করে যাচ্ছি এবং কাজের মধ্যেই মরতে চাই—অবশ্য যদি তা মায়ের অভিপ্রেত হয়। আমি সন্তুষ্ট। ইতি
আপনার চিরসন্তান
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৫০
[স্বামী তুরীয়ানন্দকে লিখিত]
লস্ এঞ্জেলেস্
ডিসেম্বর, ১৮৯৯
হরিভাই,
… তোমার ঠ্যাঙ জোড়া লেগেছে শুনে খুশী আছি এবং বেশ কাজ করছ তাও শুনছি। … আমার শরীর ঠিক চলছে না। মোদ্দা কথা, আমার আতুপুতু করলেই রোগ হয়। রাঁধছি, যা-তা খাচ্ছি, দিনরাত খাটছি, বেশ আছি, খুব ঘুমাচ্ছি!!
আমি আসছি নিউ ইয়র্কে একমাসের ভেতর। সারদার কাগজ১৩ কি উঠে গেছে না কি? ও আর তো পাই না। Awakened (‘প্রবুদ্ধ ভারত’)—ও ঘুমিয়েছে বুঝি? আমায় তো আর পাঠায় না। যাক্, দেশে তো ‘পিলগ্ হইছন্তি’—কে আছে, কে নেই রে রাম!! ওহে, অচু-র এক চিঠি আজ এসে হাজির। সে রাজপুতানায় শিখর রাজার রামগড় শহরে লুকিয়ে ছিল। কে বলেছে যে, বিবেকানন্দ মরে গেছে। তাই এক পত্রে লিখেছে আমায়!! তাকে একখানা জবাব পাঠাচ্ছি।
আমার সকল কুশল। তোমার, তার কুশল দেবে। ইতি
দাস
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৫১*
921, West 21st Street, লস্ এঞ্জেলেস্
২৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৯
কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
সত্যি আমি চৌম্বক চিকিৎসা-প্রণালীতে (magnetic healing) ক্রমশঃ সুস্থ হয়ে উঠছি। মোট কথা, এখন আমি বেশ ভালই আছি। আমার শরীরের কোন যন্ত্র কোনকালেই বিগড়ায়নি—স্নায়বিক দৌর্বল্য ও অজীর্ণতাই আমার দেহে যা-কিছু গোল বাধিয়েছিল।
এখন আমি রোজ খাবারের আগে বা পরে যে-কোন সময়েই হোক মাইলের পর মাইল বেড়িয়ে আসি। আমি বেশ ভাল হয়ে গেছি, আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস—ভালই থাকব।
এখন চাকা ঘুরছে—মা সেই চাকা ঘোরাচ্ছেন। তাঁর কাজ যতদিন না শেষ হচ্ছে, ততদিন তিনি আমায় যেতে দিচ্ছেন না—এটিই হচ্ছে রহস্য।
দেখ, ইংলণ্ড কেমন উন্নতির দিকে এগোচ্ছে! এই রক্তারক্তির পর সেখানকার লোক এই ‘ক্রমাগত লড়াই লড়াই লড়াই’-এর চেয়ে বড় ও উঁচু জিনিষ ভাববার সময় পাবে। এই আমাদের সুযোগ। আমরা এখন একটু উদ্যমশীল হয়ে দলে দলে ওদের ধরব, প্রচুর অর্থসংগ্রহ করব এবং তারপর ভারতীয় কাজটাকেও পুরাদমে চালিয়ে দেব। চারদিকের অবস্থা বেশ আশাপ্রদ বোধ হচ্ছে, অতএব প্রস্তুত হও। চারটি ভগ্নী ও তুমি আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৫২*
921, West 21st Street, লস্ এঞ্জেলেস্
২৭ ডিসেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় ধীরামাতা,
শুভ নববর্ষ আপনার নিকট আসুক এবং বহুবার এভাবে আসতে থাকুক—এই আমার আকাঙ্ক্ষা। আমার স্বাস্থ্য পূর্বাপেক্ষা অনেক ভাল আছে এবং আবার কাজ করবার মত যথেষ্ট শক্তি পেয়েছি। ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছি এবং সারদানন্দকে কিছু টাকা (১৩০০ টাকা) পাঠিয়েছি, … দরকার হলে আরও পাঠাব। তিন সপ্তাহ যাবৎ সারদানন্দের কোন সংবাদ পাইনি; আর আজ ভোরে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। বেচারা ছেলেরা!
আমি মাঝে মাঝে তাদের প্রতি কত রূঢ় ব্যবহারই না করি! এ-সব সত্ত্বেও তারা জানে যে, আমি তাদের সকলের চেয়ে বড় বন্ধু। … আমি তিন সপ্তাহ আগে তাদের ‘তার’ করে জানিয়েছি যে, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছি। আমি যদি আরও অসুস্থ না হয়ে পড়ি, তবে যেটুকু স্বাস্থ্য এখন আছে, তাতেই চলে যাবে। আমার জন্য মোটেই ভাববেন না, আমি উঠে-পড়ে কাজে লেগে গেছি।
গল্পগুলি আর লিখতে পারিনি বলে দুঃখিত। আমি এছাড়া অন্য কিছু কিছু লিখেছি এবং প্রতিদিনই কিছু লিখিবার আশা রাখি। আমি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী শান্তিতে আছি এবং বুঝতে পেরেছি যে, এই শান্তি বজায় রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে অপরকে শেখানো। কাজই হচ্ছে আমার একমাত্র সেফ্টি ভালভ্ (অতিরিক্ত গ্যাস বের করে দিয়ে যন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার)।
আমার দরকার হচ্ছে শুধু পরিষ্কার মাথাওয়ালা জনকয়েক লোকের, যারা চেপে কাজ করে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার আনুষঙ্গিক সমস্ত ব্যাপারের দেখাশোনা করবে। আমার আশঙ্কা এই যে, ভারতে এমন লোক পেতে অনেক কাল কেটে যাবে; আর যদি তেমন কোন লোক থাকে, তাহলেও পাশ্চাত্য কারুর কাছে তার শিক্ষা নেওয়া উচিত। আবার, আমার পক্ষে কাজ করা তখনই সম্ভব হয়, যখন আমাকে সম্পূর্ণভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়।
নিঃসঙ্গ অবস্থাতেই আমার শক্তি খোলে বেশী। মা-র যেন তাই অভিপ্রায়। জো-এর বিশ্বাস এই যে, মায়ের মনে অনেক সব বড় বড় ব্যাপারের পরিকল্পনা চলছে—তাই যেন হয়! জো ও নিবেদিতা যেন সত্যি সত্যি ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা হয়ে পড়েছে দেখছি! আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, আমি জীবনে যা-কিছু ঘা খেয়েছি, যা-কিছু যন্ত্রণা ভোগ করেছি—সবই একটা সানন্দ আত্মত্যাগে পরিণত হবে, যদি মা আবার ভারতের দিকে মুখ তুলে চান।
মিস গ্রিন্সটিডেল (Miss Greenstidel) আমায় একখানি চমৎকার চিঠি লিখেছেন— তার অধিকাংশই আপনার সম্বন্ধে। তিনি তুরীয়ানন্দের সম্বন্ধেও খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। তুরীয়ানন্দকে আমার ভালবাসা জানাবেন। আমার বিশ্বাস, সে চমৎকার কাজ করবে। তার সাহস ও স্থৈর্য আছে।
আমি শীঘ্রই ক্যালিফোর্নিয়াতে কাজ করতে যাচ্ছি। ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়ে যাবার সময় আমি তুরীয়ানন্দকে ডেকে পাঠাব এবং তাকে প্রশান্ত-মহাসাগরের উপকূলে কাজে লাগাব। আমার নিশ্চিত ধারণা এখানে একটা বড় কর্মক্ষেত্র আছে। ‘রাজযোগ’ বইটা এখানে খুব পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। মিস গ্রিন্সটিডেল আপনার বাড়ীতে খুব শান্তি পেয়েছেন এবং বেশ আনন্দে আছেন। এতে আমি বেশ খুশী আছি। দিনে দিনে তাঁর সব বিষয়ে একটু সুরাহা হোক। তাঁর চমৎকার কার্যক্ষমতা ও ব্যবসাবুদ্ধি আছে।
জো একজন মহিলা চিকিৎসককে খুঁজে বের করেছে; তিনি ‘হাতঘষা’ চিকিৎসা করেন। আমরা দুজনেই তার চিকিৎসায় আছি। জো-এর ধারণা তিনি আমাকে বেশ চাঙা করে তুলেছেন। আর সে নিজে দাবী করে যে, তার নিজের উপর অলৌকিক ফল ফলেছে।
‘হাতঘষা’ চিকিৎসার ফলেই হোক, ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ওজোন’ (Ozone) বাষ্পের ফলেই হোক, অথবা বর্তমান কর্মের দশা কেটে যাবার ফলেই হোক, আমি সেরে উঠেছি। পেটভরা খাবারের পরে তিন মাইল হাঁটতে পারা একটা বিরাট ব্যাপার নিশ্চয়!
ওলিয়াকে আমার আন্তরিক ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানাবেন এবং ডাক্তার জেম্স্ ও বষ্টনের অপরাপর বন্ধুদের আমার ভালবাসা জানাবেন। ইতি
আপনার চিরসন্তান
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৫৩*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
মিসেস ব্লজেট
921, West 21st লস্ এঞ্জেলেস্
২৭ ডিসেম্বর, ১৮৯৯
প্রিয় মেরী,
আনন্দের বড়দিন, সুখের নববর্ষ, তোমার জন্মদিনের সঙ্গে জড়িত এই দিনগুলি বারে বারে ফিরে আসুক। এই শুভেচ্ছো, প্রার্থনা ও অভিনন্দন পাঠাচ্ছি এক নিঃশ্বাসে। তুমি জেনে খুশী হবে যে, আমার রোগ সেরে গিয়েছে। এটা শুধু গরহজমের ব্যাপার, হার্ট বা কিডনীর কোন রোগ নয়—চিকিৎসকরা বলছেন; না আর বেশী কিছু নয়। এখন আমি রোজ রাত্রে খাওয়ার পর তিন মাইল হাঁটছি।
আর শোন, যে আমাকে সাড়িয়ে তুলেছে, সে ধূমপান করার উপর জোর দিচ্ছে। অতএব বেশ করে পাইপ টানছি এবং তার ফল ভালই হয়েছে। সোজা কথায়, স্নায়ুদৌর্বল্য ইত্যাদি সব কিছুর কারণ হল অজীর্ণতা, তাছাড়া কিছুই না।
আমি আবার কাজেও নেবে গেছি। কাজ, কাজ—তবে কঠিন কাজ নয়; কিন্তু আমি গ্রাহ্য করি না, এবারে কিছু টাকা করতে চাই। মার্গটকে এ কথা জানিও, বিশেষ করে পাইপের ব্যাপারটা। তুমি কি জান কে আমায় সারিয়ে তুলেছে? কোন ডাক্তার নয়, ক্রিশ্চান সায়ান্সের আরোগ্যকারী’ও নয়—একজন চৌম্বক চিকিৎসক। অবাক কাণ্ড!—হাত ঘষে সে চিকিৎসা করে—ভিতরকার চিকিৎসা পর্যন্ত, তার রোগীরা আমাকে বলেছে।
রাত হয়ে যাচ্ছে। মার্গট, হ্যারিয়েট, ইসাবেল ও মাদার চার্চকে আলাদা চিঠি লেখার আশা ছাড়তে হল। ইচ্ছাই তো অর্ধেক কাজ। তারা সকলে জানে, আমি তাদের কত গভীরভাবে ভালবাসি। অতএব এখনকার মত তুমি আমার হয়ে নববর্ষের শুভবার্তা তাদের পৌঁছে দাও।
এখানে এখন ঠিক উত্তরভারতের মত শীত, কেবল মাঝে মাঝে কয়েকটা দিন একটু গরম; গোলাপ ফুলও আছে এবং চমৎকার পামগুলি। ক্ষেতে বার্লি ফলেছে, গোলাপ এবং অন্যান্য জাতের ফুল ফুটেছে আমার কুটীরের চারপাশে। গৃহস্বামিনী মিসেস ব্লজেট চিকাগোর মহিলা—স্থূলাঙ্গী, বৃদ্ধা এবং খুবই রসিক ও বাক্চতুরা। চিকাগোতে তিনি আমার বক্তৃতা শুনেছেন এবং খুব মাতৃস্বভাবা।
ইংরেজদের জন্য আমার বড় দুঃখ—তারা দক্ষিণ আফ্রিকায়১৪ শক্ত পাল্লায় পড়েছে। তাঁবুর বাইরে কর্তব্যরত এক সৈনিক চীৎকার করে একবার জানিয়েছিল যে, সে এক তাতারকে পাকড়েছে। তাঁবুর ভিতর থেকে আদেশ হল ‘তাকে ভিতরে নিয়ে এস।’ সৈন্য বললে, ‘সে আসতে চাইছে না।’ আবার কড়া আদেশ শোনা গেল, ‘তাহলে তুমি নিজে এস।’ ‘সে যে আমাকেও যেতে দিচ্ছে না’ তার থেকে ‘তাতার পাকড়ানো’১৫ প্রবচনটি এসে গেছে। তুমি কাউকে পাকড়েছ নাকি?
ঠিক এখনই আমি সুখী এবং বাকী জীবনই সুখী থাকার আশা করছি। বেশ কিছু টাকা করতে পারলে খুব খুশী হব। কিছু কিছু করছি। মার্গটকে বল, আমি বেশ কিছু টাকা করে ফেলেছি এবং জাপান, হনলুলু, চীন ও জাভার পথে দেশ ফিরব। তাড়াতাড়ি টাকা করার পক্ষে এটা চমৎকার জায়গা; এবং শুনছি, সান ফ্রান্সিস্কো এর চেয়েও ভাল। সে কি কিছু করতে পেরেছে?
কোটিপতি তুমি আর যোগাড় করতে পারলে না। তার অর্ধেক কিম্বা তার সিকির জন্য চেষ্টা কর না কেন? আরে, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। আমাদের টাকা চাই, সে মিশিগান হ্রদে ডুবে মরুক, তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। সেদিন এখানে সামান্য ভূমিকম্প হয়ে গেছে। ভূমিকম্পটি—আশা করি চিকাগোতেও হয়েছে এবং ইসাবেল কাদাজল ঘুলিয়ে উপরে তুলেছে। রাত হয়ে যাচ্ছে। হাই উঠছে, সুতরাং ইতি।
বিদায়; প্রীতি ও আশীর্বাদ।
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৫৪*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
লস্ এঞ্জেলেস্
১৭ জানুআরী, ১৯০০
প্রিয় ধীরামাতা,
সারদানন্দের জন্য প্রেরিত কাগজপত্র সহ আপনার পত্রখানি পেয়েছি; এতে কিছু সুসংবাদ আছে। সপ্তাহে আরও কিছু সুসংবাদের আশায় আছি। আপনি আপনার অভিপ্রায় সম্বন্ধে তো কিছু লিখলেন না। মিস গ্রিন্সটিডেল আমায় একখানি পত্র লিখে আপনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন—আর কেই বা না জানিয়ে পারে? ইতোমধ্যে তুরীয়ানন্দ বেশ চালিয়ে যাচ্ছে, আশা করি।
এখানে বা অন্য কোথাও বক্তৃতার দ্বারা বিশেষ কিছু হবে বলে আশা করি না। ওতে আমার খরচই পোষায় না। শুধু তাই নয়, পয়সা খরচের সম্ভাবনা ঘটলেই কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না। এদেশে বক্তৃতার ক্ষেত্রটাকে অনেক বেশী চষে ফেলা হয়েছে, আর লোকেরা বক্তৃতা শোনার মনোভাব কাটিয়ে উঠেছে।
… আমি এখানে প্রধানতঃ স্বাস্থ্যের জন্য এসেছিলাম; আর আমি তা পেয়েছি। … এখন আমার মনে হচ্ছে বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে কাজ করার পালা আমার ফুরিয়ে গেছে; ঐ জাতীয় কাজ করে আর আমার স্বাস্থ্যভঙ্গ করা নিষ্প্রয়োজন।
এখন আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আমায় মঠের সব ভাবনা ছেড়ে দিতে হবে …। আর আমার কাছে এই সর্বশ্রেষ্ঠ ত্যাগের আহ্বানও আসছে—আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নেতৃত্ব ও যশের আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিতে হবে। আমার মন প্রস্তুত হয়ে আছে এবং আমায় এ-তপস্যা করতে হবে। … আমি এখন জো ও নিবেদিতার কল্পনাবিলাসকে বাস্তবতার দৃষ্টি দিয়ে দেখতে শিখেছি।
তারা আমার হয়ে তাদের কল্পনাকে রূপদান করুক—আমার কাছে ও-সব আর নাই। আমি একটা ট্রাষ্ট দলিল করতে চাই, … শরতের কাছ থেকে কাগজপত্র পেলেই তা করে ফেলব। তারপর আমি শান্ত হব। আমি চাই বিশ্রাম, একমুষ্টি অন্ন, খানকয়েক বই এবং কিছু লেখাপড়ার কাজ। মা এখন আমাকে এই আলোক স্পষ্ট দেখাচ্ছেন। অবশ্য আপনাকেই তিনি এর প্রথম আভাস দিয়েছিলেন।
কিন্তু আমি তখন বিশ্বাস করিনি। … আমি আমার নিজের চেয়ে আপনার পরিচালনায় বেশী বিশ্বাস করি। জো ও নিবেদিতার মন অতি মহান্; কিন্তু এখন আমাকে চালিয়ে নেবার আলোক মা আপনারই হাতে তুলে দিচ্ছেন। আপনি কি আলোক পাচ্ছেন? আপনার পরামর্শ কি?
বুঝতে পারছি যে, আমি আর বক্তৃতামঞ্চ থেকে বাণী প্রচার করতে পারব না। …এতে আমি খুশী। আমি বিশ্রাম চাই। আমি যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি তা নয়; কিন্তু এর পরবর্তী অধ্যায়—কথা নয়, অলৌকিক স্পর্শ, যেমন শ্রীরামকৃষ্ণের ছিল।
আপনার চিরসন্তান
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৫৫
[ভগিনী নিবেদিতাকে লিখিত]
লস্ এঞ্জেলেস্, ক্যালিফোর্নিয়া
২৪ জানুআরী, ১৯০০
প্রিয়—,
যে শান্তি ও বিশ্রাম আমি খুঁজছি, তা আসবে বলে তো মনে হচ্ছে না। তবে মহামায়া আমাকে দিয়ে অপরের—অন্ততঃ আমার স্বদেশের—কথঞ্ছিৎ কল্যাণ করাচ্ছেন; আর এই উৎসর্গের ভাব-অবলম্বনে নিজ অদৃষ্টের সঙ্গে একটা আপস করাও অপেক্ষাকৃত সহজ। আমরা সকলেই নিজের নিজের ভাবে উৎসর্গীকৃত। মহাপূজা চলছে; একটা বিরাট বলি ভিন্ন অন্য কোন প্রকারে এর অর্থ পাওয়া যায় না।
যারা স্বেচ্ছায় মাথা পেতে দেয়, তারা অনেক যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পায়। আর যারা বাধা দেয়, তাদের জোর করে দাবানো হয়, এবং তাদের দুর্ভোগ হয় বেশী। আমি এখন স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করতে বদ্ধপরিকর। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৫৬*
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]
C/o Miss Meade
477 Douglas Building
লস্ এঞ্জেলেস্, ক্যালিফোর্নিয়া
১৫ ফেব্রুআরী ১৯০০
প্রিয় নিবেদিতা,
তোমার—তারিখের পত্র আজ প্যাসাডেনায় আমার নিকট পৌঁছিল। দেখছি, জো তোমায় চিকাগোতে ধরতে পারেনি; তবে নিউ ইয়র্ক থেকে তাদের এ-পর্যন্ত কোন খবর পাইনি। ইংলণ্ড থেকে একরাশ ইংরেজী খবরের কাগজ পেলাম—খামের উপর লেখা এক লাইনে আমার প্রতি শুভেচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে ও সই রয়েছে ‘F. H. M’। অবশ্য সেগুলির মধ্যে দরকারী বিশেষ কিছু ছিল না। আমি মিস মূলারকে একখানা চিঠি লিখতাম; কিন্তু আমি তো ঠিকানা জানি না। আবার ভয় হল, চিঠি লিখলে তিনি পাছে ভয় পান!
আমি মিসেস সেভিয়ারের কাছে খবর পেলাম যে, নিরঞ্জন কলিকাতায় সাঙ্ঘাতিক রকমের পীড়িত হয়ে পড়েছে—জানি না, তার দেহত্যাগ হয়েছে কিনা। যাই হোক নিবেদিতা, আমি এখন খুব শক্ত হয়েছি—আগের চেয়ে আমার দৃঢ়তা খুব বেড়েছে—আমার হৃদয়টা যেন লোহার পাত দিয়ে বাঁধান হয়ে গেছে। আমি এখন সন্ন্যাস-জীবনের অনেকটা কাছাকাছি যাচ্ছি।
আমি দু-সপ্তাহ যাবৎ সারদানন্দের কাছ থেকে কোন খবর পাইনি। তুমি গল্পগুলি পেয়েছ জেনে খুশী হলাম। ভাল বিবেচনা কর তো তুমি নিজে ওগুলি আবার নতুন করে লেখ। কোন প্রকাশককে যদি পাও, তাকে দিয়ে ওগুলি ছাপিয়ে প্রকাশ করে দাও; আর যদি বিক্রী করে কিছু লাভ হয়, তোমার কাজের জন্য নাও। আমার নিজের দরকার নেই। আমি এখানে কিছু অর্থ পেয়েছি। আসছে সপ্তাহে সান ফ্রান্সিস্কোয় যাচ্ছি; সেখানে সুবিধা করতে পারব—আশা করি।
ভয় কর না—তোমার বিদ্যালয়ের জন্য টাকা আসবে, আসতেই হবে। আর যদি না আসে, তাতেই বা কি আসে যায়? মা জানেন, কোন্ রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবেন। তিনি যে-দিক্ দিযে নিয়ে যান, সব রাস্তাই সমান। জানি না, আমি শীঘ্র পূর্ব অঞ্চলে১৬ যাচ্ছি কিনা। যদি যাবার সুযোগ হয়, তবে ইণ্ডিয়ানায় নিশ্চিত যাব।
এই আন্তর্জাতিক মেলামেশার মতলবটা খুব ভাল—যে রকমে পার, ওতে যোগ দাও; আর যদি তুমি মাঝ থেকে কতকগুলি ভারতীয় নারী-সমিতিকে এতে যোগ দেওয়াতে পার, তবে আরও ভাল হয়।
কুছ পরোয়া নেই, আমাদের সব সুবিধা হয়ে যাবে। এই লড়াইটা যেমন শেষ হবে, অমনি আমরা ইংলণ্ডে যাব ও সেখানে খুব চুটিয়ে কাজ করবার চেষ্টা করব—কি বল? ধীরামাতাকে লিখব কি? যদি তাঁকে লেখা ভাল মনে কর, তাঁর ঠিকানা আমায় পাঠাবে। তিনি কি তারপর তোমায় পত্রাদি লিখেছেন?
ধৈর্য্য ধরে থাক, শক্ত ও নরম—সবই ঠিক ঘুরে আসবে।
এই যে তোমার নানা রকম অভিজ্ঞতা লাভ হচ্ছে, এইটুকুই আমি চাই। আমারও শিক্ষা হচ্ছে। যে মুহূর্তে আমরা উপযুক্ত হব, তখনই আমাদের কাছে টাকা উড়ে আসবে। এখন আমার স্নায়ুপ্রধান ধাত ও তোমার ভাবুকতা মিলে সব গোল হয়ে যেতে পারে। সেই কারণে ‘মা’ আমার স্নায়ুগুলিকে একটু একটু করে নীরোগ করে দিচ্ছেন, আর তোমারও ভাবুকতা শান্ত করে আনছেন।
তারপর আমরা—যাচ্ছি আর কি। এইবার রাশি রাশি ভাল কাজ হবে, নিশ্চিত জেনো। এইবার আমরা প্রাচীন দেশ—ইওরোপের মূল ভিত্তি পর্যন্ত তোলপাড় করে ফেলব।
আমি ক্রমশঃ ধীর স্থির, শান্তপ্রকৃতি হয়ে আসছি—যাই ঘটুক না কেন, আমি প্রস্তুত।এইবার যে কাজে লাগা যাবে, প্রত্যেক আঘাতে বেশ কাজ হবে—একটিও বৃথা যাবে না— এই হচ্ছে আমার জীবনের আগামী অধ্যায়। আমার ভালবাসাদি জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পুনঃ—তোমার বর্তমান ঠিকানা লিখবে। ইতি
বি
পত্রাবলী – ৪৫৭*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
লস্ এঞ্জেলেস্
১৫ ফেব্রুআরী, ১৯০০
প্রিয় ধীরামাতা,
এই চিঠি আপনার হাতে পৌঁছবার আগেই আমি সান ফ্রান্সিস্কো যাত্রা করব। কাজটার সম্বন্ধে আপনার সবই জানা আছে। বেশী কাজ করিনি, কিন্তু দিন-দিনই আমার হৃদয়—(দেহ ও মন দু-দিক্ দিয়ে) আরও বেশী সবল হচ্ছে। কোন কোন দিন আমার বোধ হয় যে, আমি সবই সহ্য করতে পারি এবং সব দুঃখই বরণ করতে পারি। মিস মূলার যে কাগজের তাড়া পাঠিয়েছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। তাঁর ঠিকানা না জানায় আমি তাঁকে কিছুই লিখিনি। তাছাড়া ভয়ও ছিল।
আমি একা থাকলেই অধিকতর ভাল কাজ করতে পারি; এবং যখন সম্পূর্ণ নিঃসহায় থাকি, তখনই আমার দেহ মন সবচেয়ে ভাল থাকে। আমি যখন আমার গুরুভাইদের ছেড়ে আট বৎসর একাকী ছিলাম, তখন প্রায় এক দিনের জন্যও অসুস্থ হইনি। এখন আবার একা থাকার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি! অবাক কাণ্ড! কিন্তু মা যেন আমায় ঐভাবে রাখতে চান—জো যেমন চায় ‘নিঃসঙ্গ গণ্ডারে’র মত একাকী বেড়াতে।
… বেচারা তুরীয়ানন্দ কতই না ভুগেছে, অথচ আমায় কিছুই জানায়নি—সে বড় সরলচিত্ত ও ভালমানুষ! মিসেস সেভিয়ারের পত্রে জানলাম, বেচারা নিরঞ্জনানন্দ কলিকাতায় এতই সাঙ্ঘাতিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে যে, সে এখনও বেঁচে আছে কিনা জানি না। ভাল কথা! সুখ-দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলতেই ভালবাসে। এ বড় অদ্ভুত ব্যাপার! তারা যেন চক্রাকারে চলে!
আমার বোনের একখানি পত্রে জানলাম যে, তার পালিত কন্যাটি মারা গেছে। ভারতের ভাগ্যে যেন একমাত্র দুঃখই আছে। তাই হোক! সুখ-দুঃখে আমি যেন বোধশূন্য হয়ে গেছি! হালে আমি যেন লোহার মত হয়ে গেছি! তাই হোক—মায়ের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক!
গত দু-বৎসর যাবৎ যে দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে আসছি, তাতে আমি বড়ই লজ্জিত। এর সমাপ্তিতে আমি খুশী। ইতি
আপনার চিরস্নেহবদ্ধ সন্তান
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৫৮*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
প্যাসাডেনা
২০ ফেব্রুআরী, ১৯০০
প্রিয় মেরী,
মিঃ হেলের দেহত্যাগের বেদনাদায়ক সংবাদ বহন করে তোমার চিঠিখানা গতকাল পৌঁছেছে। আমি মর্মাহত হয়েছি, সন্ন্যাসের শিক্ষা সত্ত্বেও আমার হৃদয়বৃদ্ধি এখনও বেঁচে আছে। তারপর যে-সব মহাপ্রাণ মানুষ আমি দেখেছি, মিঃ হেল তাঁদের একজন।
অবশ্যই তুমি দুঃখিত ও নিতান্ত ব্যথিত; মাদার চার্চ, হ্যারিয়েট—সবারই সেই এক অবস্থা, বিশেষতঃ এই ধরনের শোক তোমাদের কাছে যখন এই প্রথম। জীবনে আমি অনেক সয়েছি, অনেককে হারিয়েছি, আর সেই বিয়োগের সবচেয়ে বিচিত্র যন্ত্রণা হল—আমার মনে হয়েছে, যে চলে গেল আমি তার যোগ্য ছিলাম না। পিতার মৃত্যুর পর মাসের পর মাস এই যাতনায় কেটেছে—আমি তাঁর কতই না অবাধ্য ছিলাম!
তুমি খুবই কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলে; যদি তোমার ঐ ধরনের কিছু মনে হয়, তাহলে জেনো সেটা শোকেরই একটি রূপ।
মেরী, মনে হয়, ঠিক এখন থেকেই তোমার যথার্থ জীবন শুরু। যতই আমরা বই পড়ি বা বক্তৃতা শুনি, বা লম্বা লম্বা কথা বলি, শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞতাই একমাত্র শিক্ষক, সেই শুধু চোখ ফোটায়। অভিজ্ঞতা যে ভাবে হয়, সেই ভাবেই তা সবচেয়ে ভাল। আমরা শিখি হাসির আলোয়, শিখি চোখের জলে। জানি না কেন এমন হয়, কিন্তু তা যে হয়, তা দেখতেই পাই। সেটাই যথেষ্ট। মাদার চার্চের জন্য অবশ্য ধর্মের সান্ত্বনা আছে। আমরা সকলে যদি স্বপ্নে ডুবে থাকতে পারতাম!
জীবনে এতদিন পর্যন্ত তুমি নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছ, আর আমাকে জ্বলতে কাঁদতে হয়েছে সারাক্ষণ। এখন ক্ষণকালের জন্য তুমি জীবনের অপর দিকটা দেখতে পেলে। এ ধরনের অবিরাম আঘাতে আঘাতে আমার জীবন তৈরী হয়েছে, এর চেয়েও শতগুণ ভয়ঙ্কর আঘাত—দারিদ্র্যের বিশ্বাসঘাতকতার আর আমার নিজের নির্বুদ্ধিতার যন্ত্রণা। এটা নৈরাশ্যবাদ? এখন তুমি বুঝবে, কেমন করে তা আসে।
ঠিক, ঠিক, তোমাকে আর কি বলব মেরী, কথা তো সবই তোমার জানা। শুধু একটি কথা বলি এবং তার মধ্যে এতটুকু ভেজাল নেই, যদি আমাদের দুঃখ বিনিময় করা সম্ভব হত, এবং তোমাকে দেবার মত আনন্দ-ভরা মন যদি আমার থাকত, তাহলে নিশ্চয় বলছি, চিরদিনের জন্য তোমার সঙ্গে তা বিনিময় করে নিতাম। সে-কথা মা-ই জানেন।
তোমার চিরবিশ্বস্ত ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৫৯*
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ
ক্যালিফোর্নিয়া
২১ ফেব্রুআরী, ১৯০০
কল্যাণবরেষু,
তোমাদর পত্রে সমস্ত সমাচার অবগত হয়ে বিশেষ আনন্দ লাভ করলুম। বিদ্যাবুদ্ধি বাড়ার ভাগ—উপরের চাকচিক্য মাত্র; সমস্ত শক্তির ভিত্তি হচ্ছে হৃদয়। ‘জ্ঞানবলক্রিয়া’শালী আত্মার অধিবাস হৃদয়ে, মস্তিষ্কে নয়। ‘শতঞ্চৈকা চ হৃদয়স্য নাড্যঃ’ (হৃদয়ে একশত এবং একটি নাড়ী আছে) ইত্যাদি। হৃদয়ের নিকট ‘সিম্প্যাথেটিক্ গ্যাংলিয়ন’ নামক যে প্রধান কেন্দ্র, সেথায় আত্মার কেল্লা।
হৃদয় যতই দেখাতে পারবে, ততই জয়। মস্তিষ্কের ভাষা কেউ কেউ বোঝে, হৃদয়ের ভাষা আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সকলে বোঝে। তবে আমাদের দেশে, মড়াকে চেতানো—দেরী হবে; কিন্তু অপার অধ্যবসায় ও ধৈর্যবল যদি থাকে তো নিশ্চিত সিদ্ধি, তার আর কি?
ইংরেজ রাজপুরুষদের দোষ কি? যে পরিবারটির অস্বাভাবিক নির্দয়তার কথা লিখেছ, ওটা কি ভারতবর্ষের অসাধারণ, না সাধারণ? দেশসুদ্ধই ঐ রকম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আমাদের দেশী স্বার্থপরতা, নেহাত দুষ্টামি করে হয়নি, বহু শতাব্দী যাবৎ বিফলতা আর নির্যাতনের ফলস্বরূপ এই পশুবৎ স্বার্থপরতা; ও আসল স্বার্থপরতা নয়—ও হচ্ছে গভীর নৈরাশ্য। একটু সিদ্ধি দেখলেই ওটা সেরে যাবে।
ইংরেজ রাজপুরুষেরা ঐটিই দেখছে চারিদিকে, কাজেই প্রথমে বিশ্বাস করতে পারবে কেন? তবে যথার্থ কাজ দেখতে পেলে কেমন ওরা সহানুভূতি করে বল! দেশী রাজপুরুষেরা অমন করে কি?
এই ঘোর দুর্ভিক্ষ, বন্যা, রোগ-মহামারীর দিনে কংগ্রেসওয়ালারা কে কোথায় বল? খালি ‘আমাদের হাতে রাজ্যশাসনের ভার দাও’ বললে কি চলে? কে বা শুনছে ওদের কথা? মানুষ কাজ যদি করে—তাকে কি আর মুখ ফুটে বলতে হয়? তোমাদের মত যদি ২০০০ লোক জেলায় জেলায় কাজ করে—ইংরেজরা ডেকে রাজকার্যে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করবে যে!! ‘স্বকার্যমুদ্ধরেৎ প্রাজ্ঞঃ’ (প্রাজ্ঞ ব্যক্তি নিজের কার্য উদ্ধার করিবেন)।
… অ-কে Centre (কেন্দ্র) খুলতে দেননি, তার বা কি? কিষণগড় দিয়েছে তো? মুখটি বুজিয়ে সে কাজ দেখিয়ে যাক—কিছু বলা-কওয়া, ঝগড়া-ঝাঁটির দরকার নাই। মহামায়ার এ কাজে যে সহায়তা করবে, সে তাঁর দয়া পাবে, যে বাধা দেবে ‘অকারণাবিষ্কৃতবৈরদারুণঃ’ (বিনা হেতুতে দারুণ শত্রুতাবদ্ধ) নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবে।
‘শনৈঃ পন্থাঃ’ ইত্যাদি, রাই কুড়িয়ে বেল।—যখন প্রধান কাজ হয়ে, ভিত্তি-স্থাপন হয়, রাস্তা তৈরী হয়, যখন অমানুষ বলের আবশ্যক হয়—তখন নিঃশব্দে দু-একজন অসাধারণ পুরুষ নানা বিঘ্ন-বিপত্তির মধ্যে নিঃসাড়ে কাজ করে। যখন হাজার হাজার লোকের উপকার হয়, ঢাক-ঢোল বেজে ওঠে, দেশসুদ্ধ বাহবা দেয়—তখন কল চলে গেছে, তখন বালকেও কাজ করতে পারে, আহাম্মকেও কলে একটু বেগ দিতে পারে।
এইটি বোঝ—ঐ দু-একটি গাঁয়ের উপর ঐ ২০ টি অনাথ বালক সহিত অনাথাশ্রম, ঐ ১০ জন ২০ জন কার্যকরী—এই যথেষ্ট, এই বজ্রবীজ। ঐ থেকে কালে লক্ষ লক্ষ লোকের উপকার হবে; এখন ২/১০টা সিংহের প্রয়োজন—তখন শত শত শৃগালেরাও উত্তম কাজ করতে পারবে।
অনাথ মেয়ে হাতে পড়লে তাদের আগে নিতে হবে। নইলে ক্রিশ্চানরা সেগুলিকে নিয়ে যাবে। এখন বিশেষ বন্দোবস্ত নাই তার আর কি? মায়ের ইচ্ছায় বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। ঘোড়া হলেই চাবুক আপনি আসবে। এখন মেয়ে (ও) ছেলে একসঙ্গেই রাখ। একটা ঝি রেখে দাও মেয়েগুলিকে দেখবে, আলাদা কাছে নিয়ে শোবে; তারপর আপনিই বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। যা পাবে টেনে নেবে এখন বাছবিচার কর না—পরে আপনিই সিধে হয়ে যাবে। সকল কাজেই প্রথমে অনেক বাধা—পরে সোজা রাস্তা হয়ে যায়।
তোমার সাহেবকে আমার বহু ধন্যবাদ দিও। নির্ভয়ে কাজ করে যাও—ওয়াহ্ বাহাদুর!! সাবাস, সাবাস, সাবাস!!
ভাগলপুরে যে কেন্দ্র স্থাপনের কথা লিখেছ, সে কথা বেশ—স্কুলের ছেলেপুলেকে চেতানো ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের mission (কার্য) হচ্ছে অনাথ, দরিদ্র, মূর্খ, চাষাভূষোর জন্য; আগে তাদের জন্য করে যদি সময় থাকে তো ভদ্রলোকের জন্য। ঐ চাষাভূষোরা ভালবাসা দেখে ভিজবে; পরে তারই দু-এক পয়সা সংগ্রহ করে নিজেদের গ্রামে মিশন start (প্রতিষ্ঠা) করবে এবং ক্রমে ওদেরই মধ্য হতে শিক্ষক বেরুবে।
কতলগুলো চাষার ছেলেমেয়েকে একটু লিখতে-পড়তে শেখাও ও অনেকগুলো ভাব মাথায় ঢুকিয়ে দাও—তারপর গ্রামের চাষারা চাঁদা করে তাদের এক-একটাকে নিজেদের গ্রামে রাখবে। ‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং’ (নিজেই নিজেকে উদ্ধার করবে)—সকল বিষয়েই এই সত্য। We help them to help themselves (তারা যাতে নিজেই নিজেদের কাজ করতে পারে, এইজন্য আমরা তাদের সাহায্য করছি)।
ঐ যে চাষারা গাল দিচ্ছে—ঐটুকু হচ্ছে আসল কাজ। ওরা যখন বুঝতে পারবে নিজেদের অবস্থা, উপকার এবং উন্নতির আবশ্যকতা, তখনই তোমার ঠিক কাজ হচ্ছে জানবে। তাছাড়া পয়সাওয়ালারা দয়া করে গরীবের কিছু উপকার করবে—তা চিরন্তন হয় না এবং তায় আখেরে উভয় পক্ষের অপকার মাত্র। চাষাভূষো মৃতপ্রায়; এজন্য পয়সাওয়ালারা সাহায্য করে তাদের চেতিয়ে দিক্—এই মাত্র!
তারপর চাষারা আপনার কল্যাণ আপনারা বুঝুক, দেখুক এবং করুক। তবে ধনী-দরিদ্রের বিবাদ যেন বাধিয়ে বসো না। ধনীদের আদতে গাল-মন্দ দেবে না।—স্বকার্যমুদ্ধরেৎ প্রাজ্ঞঃ (প্রাজ্ঞ ব্যক্তি নিজের কার্য উদ্ধার করবে)। তাছাড়া ওরা তো মহামূর্খ, অজ্ঞ—ওরা কি করবে?
জয় গুরু জয় জগদম্বে, ভয় কি? ক্ষেত্রকর্মবিধান আপনা হতেই আসবে! ফলাফল আমার গ্রাহ্য নাই, তোমরা যদি এতটুকু কাজ কর, তা হইলেই আমি সুখী। বাক্যি-যাতনা, শাস্ত্র-ফাস্ত্র, মতামত—আমার এ বুড়ো বয়সে বিষবৎ হয়ে যাচ্ছে। যে কাজ করবে, সে আমার মাথার মণি—ইতি নিশ্চতম্। মিছে বকাবকি চেঁচামেচিতে সময় যাচ্ছে—আয়ুক্ষয় হচ্ছে, লোকহিত একপা-ও এগোচ্ছে না। মাভৈঃ, সাবাস বাহাদুর—গুরুদেব তোমার হৃদয়ে বসুন, জগদম্বা হাতে বসুন। ইতি
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৬০*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
১২৫১ পাইন ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো
২ মার্চ, ১৯০০
প্রিয় মেরী,
আমাকে চিকাগোয় যাবার নিমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছ, সেটা তোমার একান্ত সহৃদয়তা। এই মুহূর্তেই যদি আমি সেখানে চলে যেতে পারতাম! কিন্তু আমি এখন টাকা যোগাড় করতে ব্যস্ত; তবে বেশী কিছু করে উঠতে পারছি না। হ্যাঁ, যে কোন উপায়েই হোক; দেশে যাওয়ার খরচটা তোলার মত টাকা আমায় করতেই হবে। এখানে একটা নূতন ক্ষেত্র পেয়েছি—শত শত উৎসুক শ্রোতা আসছে, আমার বই পড়ে এরা আগে থেকেই প্রস্তুত ও উদ্গ্রীব ছিল।
অবশ্য টাকা যোগাড় করার ব্যাপারটা যেমন মন্থর, তেমনই বিরক্তিকর। কয়েক-শো যোগাড় করতে পারলেই আমি খুশী হব। এর মধ্যে নিশ্চই আমার আগের চিঠিখানা পেয়ে গিয়েছ। মাসখানেক কি মাস-দেড়েকর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে যাব, আশা করছি।
তোমরা সকলে কেমন আছ? মাকে আমার আন্তরিক ভালবাসা দিও। তাঁর মত মনোবল যদি আমার থাকত! খাঁটি খ্রীষ্টান তিনি। আমার স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু পূর্বের বল এখনও ফিরে পাইনি। কিন্তু এতটুকু শক্তির জন্য অনেকখানি পরিশ্রম করতে হবে। অনন্ত কয়েকটা দিনের জন্যও যদি বিশ্রাম ও শান্তি পেতাম! নিশ্চয় চিকাগোয় ভগিনীদের কাছে তা পাব। তবে মা-ই সব জানেন, আমার সেই পুরানো কথা—তিনি ভাল জানেন। গত দু-বছর বিশেষ খারাপ গেছে।
মনের দুঃখে বাস করেছি। এখন কিছুটা আবরণ সরে গেছে, এখন আমি সুদিনের—আর ভাল অবস্থার আশায় আছি। তুমি, অন্য ভগিনীরা এবং মা—সকলের উপর সর্ববিধ আশীর্বাদ। আমার ঘাত-প্রতিঘাতময় বেসুরো জীবনে মেরী, তুমি সব সময় মধুরতম সুরের মত বেজেছ। তোমার বিশেষ সুকৃতি, তুমি অনুকূল পরিবেশের মধ্যে জীবন শুরু করতে পেরেছ। আর আমি মুহূর্তের জন্যও শান্তিময় জীবন পাইনি। সব সময়ে দুর্বহ ভার মনের মধ্যে। প্রভু তোমাকে আশীর্বাদ করুন।
সতত তোমার স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৬১*
সান ফ্রান্সিস্কো
১৫০২ জোন্স্ ষ্ট্রীট
৪ মার্চ, ১৯০০
প্রিয় ধীরামাতা,
এক মাস যাবৎ আপনার কাছ থেকে কোনই খবর পাইনি। আমি সান ফ্রান্সিস্কোতে আছি। আমার লেখার ভেতর দিয়ে লোকের মন আগে থেকেই তৈরী হয়েছিল, আর তারা দলে দলে আসছে; কিন্তু টাকা খসাবার কথা যখন উঠবে, তখন এই উৎসাহের কতটা থাকে, সেইটুকু দ্রষ্টব্য!
রেভারেণ্ড বেঞ্জামিন ফে মিল্স্ আমায় ওকল্যাণ্ডে আহ্বান করেছিলেন এবং আমার বক্তব্য প্রচারের জন্য একটি শ্রোতৃমণ্ডলীর আয়োজন করেছিলেন। তিনি সস্ত্রীক আমার গ্রন্থাদি পাঠ করে থাকেন এবং বরাবরই আমার খবরাখবর রেখে আসছেন।
মিস থার্সবির দেওয়া পরিচয়পত্রখানি আমি মিসেস হার্স্টকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি তাঁর এক সঙ্গীতবাসরে আমাকে আগামী রবিবারে নিমন্ত্রণ করেছেন।
মিস থার্সবির দেওয়া পরিচয়পত্রখানি আমি মিসেস হার্স্টকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি তাঁর এক সঙ্গীতবাসরে আমাকে আগামী রবিবারে নিমন্ত্রণ করেছেন।
আমার স্বাস্থ্য প্রায় একরূপই আছে—আমি তো কোন ইতরবিশেষ দেখছি না। সম্ভবতঃ স্বাস্থ্যের উন্নতিই হচ্ছে—যদিও অজ্ঞাতসারে। আমি ৩০০০ শ্রোতাকে শোনাবার মত উঁচু গলায় বক্তৃতা দিতে পারি; ওকল্যাণ্ডে আমায় দুবার তাই করতে হয়েছিল। আর দু-ঘণ্টা বক্তৃতার পরেও আমার সুনিদ্রা হয়।
খবর পেলাম, নিবেদিতা আপনার সঙ্গে আছে। আপনি ফ্রান্সে যাচ্ছেন কবে? আমি এপ্রিলে এ জায়গা ছেড়ে পূর্বাঞ্চলে যাচ্ছি। সম্ভব হলে মে মাসে ইংলণ্ডে যাবার বিশেষ ইচ্ছা আছে। আর একবার ইংলণ্ডে চেষ্টা না করে দেশে ফেরা চলবে না কিছুতেই।
ব্রহ্মানন্দ ও সারদানন্দের কাছ থেকে সুন্দর একখানি চিঠি এসেছে। তারা সবাই ভাল আছে। তারা মিউনিসিপ্যালিটিকে বোঝাবার চেষ্টা করছে। এতে আমি খুব খুশী। এ মায়ার সংসারে হিংসা করা ঠিক নয়; কিন্তু ‘না কামড়ালেও ফোঁস করতে দোষ নেই’—এই যথেষ্ট।
সব ঠিক হয়ে আসবে নিশ্চয়—আর যদিই বা না হয়, তাও ভাল। মিসেস সুটারের কাছ থেকেও সুন্দর একখানি চিঠি পেয়েছি। তাঁরা পাহাড়ে বেশ আছেন। মিসেস—কেমন আছেন? … তুরীয়ানন্দ কেমন আছে?
আমার অসীম ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানবেন। ইতি
সতত আপনার
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৬২*
সান ফ্রান্সিস্কো
৪ মার্চ, ১৯০০
কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
আমি আর কাজ করতে চাই না—এখন বিশ্রাম ও শান্তি চাই। স্থান ও কালের তত্ত্ব আমার জানা আছে, কিন্তু আমার বিধিলিপি বা কর্মফল আমায় নিয়ে চলেছে—শুধু কাজ, কাজ! আমরা যেন গরুর পালের মত কসাইখানার দিকে চালিত হচ্ছে; কসাইখানা অভিমুখে তাড়িত গরু যেমন পথের ধারের ঘাস এক এক খাবলা খেয়ে নেয়, আমাদের অবস্থাও ঠিক সেই রকম। আর এই হচ্ছে আমাদের কর্ম বা আমাদের ভয়—ভয়ই হচ্ছে দুঃখ ব্যাধি প্রভৃতির আকর।
বিভ্রান্ত ও ভয়চকিত হয়ে আমরা অপরের ক্ষতি করি। আঘাত করতে ভয় পেয়ে আমরা আরও বেশী আঘাত করি। পাপকে এড়িয়ে চলতে একান্ত আগ্রহান্বিত হয়ে আমরা পাপেরই মুখে পড়ি।
আমাদের চারপাশে কত অকেজো আবর্জনা-স্তূপই না আমরা সৃষ্টি করি! এতে আমাদের কোন উপকারই হয় না; পরন্তু যাকে আমরা পরিহার করতে চাই তারই দিকে—সেই দুঃখেরই দিকে আমরা পরিচালিত হই।
আহা! যদি একেবারে নির্ভীক সাহসী ও বেপরোয়া হতে পারা যেত!
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৬৩*
১৫০২ জোন্স্ ষ্ট্রীট
সান ফ্রান্সিস্কো
৭ মার্চ, ১৯০০
প্রিয় জো,
মিসেস বুলের পত্রে জানলাম যে, তুমি কেম্ব্রিজে আছ। হেলেনের পত্রে আরও খবর পেলাম যে, তোমায় যে গল্পগুলি পাঠানো হয়েছিল, তা তুমি পাওনি। বড়ই আপসোসের কথা। মার্গর কাছে এর নকল আছে, সে তোমায় দিতে পারে। আমার শরীর একরকম চলে যাচ্ছে। টাকা নেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম অথচ ফল শূন্য! লস্ এঞ্জেলেসের চেয়েও খারাপ! কিছু না দিতে হলে তারা দল বেঁধে বক্তৃতা শুনতে আসে—আর কিছু খরচ করতে হলে আসে না; এই তো ব্যাপার!
দিন কয়েক যাবৎ আমার শরীর খারাপ হয়েছে এবং বড় বিশ্রী বোধ হচ্ছে। আমার বোধ হয়, রোজ রাত্রে বক্তৃতা দেবার ফলেই এ-রকম হয়েছে। আমার আশা আছে যে, ওকল্যাণ্ডের কাজের ফলে অন্ততঃ নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত ফিরে যাবার টাকা সংগ্রহ করতে পারব; আর নিউ ইয়র্কে গিয়ে ভারতে ফেরবার টাকার যোগাড় দেখব। লণ্ডনে মাস কয়েক থাকবার মত টাকা এখানে সংগ্রহ করতে পারলে লণ্ডনেও যেতে পারি। তুমি আমায় আমাদের জেনারেল-এর ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিও তো। নামও দেখছি আজকাল মনে থাকে না।
তবে আসি। প্যারিসে তোমার সঙ্গে দেখা হতেও পারে, নাও পারে। ভগবান্ তোমায় আশীর্বাদ করুন। আমি যতটা সাহায্যের যোগ্য, তুমি তার চেয়েও বেশী সাহায্য আমায় করেছ। আমার অসীম ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পত্রাবলী – ৪৬৪*
১৫০২ জোন্স ষ্ট্রীট
সান ফ্রান্সিস্কো
৭ মার্চ, ১৯০০
প্রিয় ধীরামাতা,
… আপনাকে আমি আমার জন্য আর কিছু করতে বলছি না—আমার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি যা করেছেন, তাই যথেষ্ট—আমি যতটার উপযুক্ত, তার চেয়েও ঢের বেশী করেছেন। আপনিই আমার একমাত্র বন্ধু, যিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে জীবনের ধ্রুবতারারূপে গ্রহণ করেছেন; আপনাকে আমি যে এত বিশ্বাস করি, তার রহস্য ওইখানেই। অন্যেরা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ভালবাসে। কিন্তু তাদের ধারণাও নেই যে, তারা আমাকে শ্রীরামকৃষ্ণেরই জন্য ভালবাসে।
তাঁকে বাদ দিলে আমি শুধু কতকগুলি অর্থহীন ও স্বার্থপূর্ণ ভাবুকতার বোঝা মাত্র। যাই হোক, ভবিষ্যতে কি হবে, এই দুশ্চিন্তা এবং ভবিষ্যতে কি হওয়া উচিত, এই আকাঙ্ক্ষার পীড়া বড়ই ভয়ানক। আমি সে দায়িত্বের অনুপযুক্ত—আমার অযোগ্যতা আজ ধরা পরে গেছে। আমাকে একাজ ছেড়ে দিতে হবে। এ কাজে যদি কোন নিজস্ব জীবনী শক্তি না থাকে তো মরে যাক; আর যদি থাকে, তবে আমার মত অযোগ্য কর্মীর জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হবে না।
… আমি সারা জীবন মায়ের কাজ করেছি। এখন তা হয়ে গেছে—আমি এখন তাঁর চরকায় তেল দিতে নারাজ। তিনি অন্য কর্মী বেছে নিন—আমি ইস্তফা দিলাম!
আপনার চিরসন্তান
বিবেকানন্দ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….