ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

গীতা-২

[১৯০০ খ্রীঃ ২৮ মে সান ফ্রান্সিস্কোতে প্রদত্ত বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত অনুলিপি]
গীতা সম্বন্ধে প্রথমেই কিছু ভূমিকার প্রয়োজন। দৃশ্য-কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গণ। পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষের আধিপত্য লাভের জন্য একই রাজবংশের দুইটি শাখা-কুরু ও পাণ্ডব যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত হইয়াছিল। পাণ্ডবদের ছিল রাজ্যে ন্যায়সঙ্গত অধিকার, কৌরবদের ছিল বাহুবল। পাণ্ডবদের পাঁচ ভ্রাতা এতদিন বনে বাস করিতেছিলেন; শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন তাঁহাদের সখা। কৌরবেরা পাণ্ডবদিগকে সূচ্যগ্র মেদিনী দিতেও রাজী হইল না।

গীতায় প্রথম দৃশ্যটি যুদ্ধক্ষেত্রের। উভয় দিকে আছেন আত্মীয়স্বজন ও জ্ঞাতিবন্ধুরা-এক পক্ষে কৌরব-ভ্রাতৃগণ, অপর পক্ষে পাণ্ডবেরা। একদিকে পিতামহ ভীষ্ম, অন্যদিকে পৌত্রগণ। বিপক্ষদলে তাঁহার জ্ঞাতি বন্ধু ও আত্মীয়দের দেখিয়া এবং (যুদ্ধক্ষেত্রে) তাহাদিগকে বধ করিতে হইবে-এ-কথা চিন্তা করিয়া অর্জুন বিমর্ষ হইলেন এবং অস্ত্রত্যাগ করাই স্থির করিলেন। বস্তুতঃ এইখানেই গীতার আরম্ভ।

পৃথিবীতে আমাদের সকলেরই জীবন এক বিরামহীন সংগ্রাম। অনেক সময় আমরা আমাদের দুর্বলতা ও কাপুরুষতাকে ক্ষমা ও ত্যাগ বলিয়া ব্যাখ্যা করিতে চাই। কিন্তু ভিক্ষুকের ত্যাগে কোন কৃতিত্ব নাই। আঘাত করিতে সমর্থ কোন মানুষ যদি সহিয়া যায়, তবে তাহাতে কৃতিত্ব আছে; যাহার কিছু আছে, সে যদি ত্যাগ করে, তবে তাহাতে মহত্ত্ব আছে। আমরা তো জানি আমাদের জীবনেই কতবার আমরা আলস্য ও ভীরুতার জন্য সংগ্রাম ত্যাগ করিয়াছি, আর আমরা সাহসী-এই মিথ্যা বিশ্বাসে নিজেদের মনকে সম্মোহিত করিবার চেষ্টা করিয়াছি।

‘হে ভারত (অর্জুন), উঠ, হৃদয়ের এই দুর্বলতা ত্যাগ কর, ত্যাগ কর এই নির্বীর্যতা! উঠিয়া দাঁড়াও, সংগ্রাম কর।’৩-এই তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোকটি দ্বারাই গীতার সূচনা। যুক্তিতর্ক করিতে গিয়া অর্জুন উচ্চতর নৈতিক ধারণার প্রসঙ্গ আনিলেনঃ প্রতিরোধ করা অপেক্ষা প্রতিরোধ না করা কত ভাল, ইত্যাদি। তিনি নিজেকে সমর্থন করিতে চেষ্টা করিলেন; কিন্তু তিনি কৃষ্ণকে ভুল বুঝাইতে পারিলেন না। কৃষ্ণ পরমাত্মা, স্ময়ং ভগবান্। তিনি অবিলম্বেই অর্জুনের যুক্তির আসল রূপ ধরিয়া ফেলিলেন-ইহা দুর্বলতা। অর্জুন নিজের আত্মীয়স্বজনকে দেখিয়া অস্ত্রাঘাত করিতে পারিতেছেন না।

অর্জুনের হৃদয়ে কর্তব্য আর মায়ার দ্বন্দ্ব। আমরা যতই পক্ষিসুলভ মমতার নিকটবর্তী হই, ততই ভাবাবেগে নিমজ্জিত হই। ইহাকে আমরা ‘ভালবাসা’ বলি। আসলে ইহা আত্ম-সম্মোহন। জীবজন্তুর মত আমরাও আবেগের অধীন। বৎসের জন্য গাভী প্রাণ দিতে পারে-প্রত্যেকটি জীবই পারে। তাহাতে কি? অন্ধ পক্ষিসুলভ ভাবাবেগ পূর্ণত্বে লইয়া যাইতে পারে না। অনন্তচৈতন্যলাভই মানবের লক্ষ্য। সেখানে আবেগের স্থান নাই, ভাবালুতার স্থান নাই, ইন্দ্রিয়গত কোন কিছুর স্থান নাই, সেখানে কেবল বিশুদ্ধ বিচারের আলো, সেখানে মানুষ আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত।

অর্জুন এখন আবেগের অধীন। অর্জুনের হওয়া উচিত আরও অধিক আত্ম-সংযমী, বিচারের চিরন্তন আলোকোদ্ভাসিত পথচারী একজন জ্ঞানী ঋষি, তিনি এখন তাহা নহেন। হৃদয়ের তাড়নায় মস্তিষ্ককে বিচলিত করিয়া, নিজেকে ভ্রান্ত করিয়া, ‘মমতা’ প্রভৃতি সুন্দর আখ্যায় নিজের দুর্বলতাকে আবৃত করিবার চেষ্টা করিয়া তিনি শিশুর মত হইয়াছেন, পশুর মত হইয়াছেন। কৃষ্ণ তাহা দেখিতেছেন। অর্জুন সামান্য বিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মত কথা বলিতেছেন, বহু যুক্তির অবতারণা করিতেছেন; কিন্তু তিনি যাহা বলিতেছেন, তাহা অজ্ঞের কথা।


‘শীত ও উষ্ণ, সুখ ও দুখ-এ-সকলের অস্তিত্ব ইন্দ্রিয়স্পর্শ হইতেই অনুভূত হয়। তাহারা আসে এবং যায়।’৬এইক্ষণে মানুষ দুঃখী, আবার পরক্ষণেই সুখী। এরূপ অবস্থায় সে আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করিতে পারে না।

‘জ্ঞানী ব্যক্তি জীবিত বা মৃত কাহারও জন্যই শোক প্রকাশ করেন না।’৪ ‘তোমার মৃত্যু হইতে পারে না, আমারও না। এমন সময় কখনও ছিল না, যখন আমরা ছিলাম না। এমন সময় কখনও আসিবে না, যখন আমরা থাকিব না। ইহজীবনে মানুষ যেমন শৈশবাবস্থা হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমে যৌবন ও বার্ধক্য অতিক্রম করে, তেমনি মৃত্যুতে সে দেহান্তর গ্রহণ করে মাত্র। জ্ঞানী ব্যক্তি ইহাতে মুহ্যমান হইবে কেন?’৫ এই যে আবেগপ্রবণতা তোমায় পাইয়া বসিয়াছে, ইহার মূল কোথায়? ইন্দ্রিয়গ্রামে। ‘শীত ও উষ্ণ, সুখ ও দুখ-এ-সকলের অস্তিত্ব ইন্দ্রিয়স্পর্শ হইতেই অনুভূত হয়। তাহারা আসে এবং যায়।’৬এইক্ষণে মানুষ দুঃখী, আবার পরক্ষণেই সুখী। এরূপ অবস্থায় সে আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করিতে পারে না।

‘যাহা চিরকাল আছে (সৎ), তাহা নাই-এরূপ হইতে পারে না; আবার যাহা কখনও নাই (অসৎ), তাহা আছে-এরূপ হইতে পারে না। সুতরাং যাহা এই সমগ্র বিশ্বকে পরিব্যাপ্ত করিযা আছে, তাহা আদি-অন্তহীন ও অবিনাশী বলিয়া জানিবে। এই বিশ্বে এমন কিছুই নাই যাহা অপরিবর্তনীয় আত্মাকে পরিবর্তিত করিতে পারে। এই দেহের আদি ও অন্ত আছে, কিন্তু যিনি দেহের মধ্যে বাস করেন, তিনি অনাদি ও অবিনশ্বর।’৭

ইহা জানিয়া মোহ ত্যাগ কর এবং যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও, পশ্চাৎপদ হইও না-ইহাই আদর্শ। ফল যাহাই হোক, কর্ম করিয়া যাও। নক্ষত্রগণ কক্ষচ্যুত হইতে পারে, সমগ্র জগৎ আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে পারে, তাহাতে কিছু আসে যায় না। মৃত্যু তো শুধু দেহান্তরপ্রাপ্তি মাত্র! যুদ্ধ করিতে হইবে। ভীরুতা ও কাপুরুষতা দ্বারা কিছুই লাভ করা যায় না। পশ্চাদপসরণের দ্বারা কোন বিপদ দূর করা যায় না। দেবতাদের নিকট তোমরা অহরহ আকুল প্রার্থনা করিতেছ, তাহাতে কি তোমাদের দুঃখ দূর হইয়াছে? ভারতের জনসাধারণ কোটি ছয়েক দেবতার কাছে কান্নাকাটি করা সত্ত্বেও কুকুর-বিড়ালের মত দলে দলে মরিতেছে। দেবতারা কোথায়? তাঁহারা তখনই আগাইয়া আসেন, যখন তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পার। দেবতাদের কি প্রয়োজন?

কুসংস্কারের কাছে এই নতিস্বীকার করা, নিজের মনের কাছে নিজেকে বিকাইয়া দেওয়া তোমার শোভা পায় না। হে পার্থ! তুমি অনন্ত, অবিনশ্বর; তোমার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই। অনন্তশক্তিশালী আত্মা তুমি; ক্রীতদাসের মত ব্যবহার তোমায় শোভা পায় না। উঠ, জাগো, দুর্বলতা ত্যাগ করিয়া যুদ্ধ কর। যদি মৃত্যু হয় হউক। সাহায্য করিবার কেহ নাই। তুমিই তো জগৎ। কে তোমায় সাহায্য করিতে পারে? ‘জীবগণের অস্তিত্ব শরীর উৎপত্তির পূর্বে এবং মৃত্যুর পরে অব্যক্ত থাকে। শুধু মাঝখানের স্থিতিকালটুকু ব্যক্ত। কাজেই তাহাতে শোকের কারণ কিছুই নাই।’৮

‘কেহ এই আত্মাকে আশ্চর্যরূপে দেখেন, কেহ ইহাকে আশ্চর্যরূপে বর্ণনা করেন, অপর কেহ এই আত্মাকে আশ্চর্যরূপে শ্রবণ করেন, আবার অনেকে শুনিয়াও ইহাকে জানিতে পারেন না।’৯

কিন্তু এই আত্মীয়স্বজনকে বধ করা যে পাপ-এ-কথা বলার তোমার অধিকার নাই; কারণ তুমি ক্ষত্রিয় এবং বর্ণাশ্রম-অনুযায়ী যুদ্ধ করাই তোমার স্বধর্ম। … ‘সুখ-দুঃখ, জয়- পরাজয় তুল্য জ্ঞান করিয়া যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হও।’১০

এখানে গীতার অন্য একটি বিশেষ মতবাদের সূচনা করা হইতেছে-অনাসক্তির উপদেশ। অর্থাৎ আমরা কার্যে আসক্ত হই বলিয়া আমাদের কর্মফল ভোগ করিতে হয়। … ‘কেবল যোগযুক্ত হইয়া কর্তব্যের জন্য কর্তব্য করিলে কর্মবন্ধন ছিন্ন হয়।’১১সমস্ত বিপদ তুমি অতিক্রম করিতে পারিবে। ‘এই নিষ্কাম কর্মযোগের অল্পমাত্র অনুষ্ঠান করিয়া মানব জন্মমরণরূপ সংসারের ভীষণ আবর্ত হইতে পরিত্রাণ লাভ করে।’১২

‘হে অর্জুন, কেবলমাত্র নিশ্চয়াত্মিকা একনিষ্ঠ বুদ্ধি সফলকাম হয়। অস্থিরচিত্ত সকাম ব্যক্তিগণের মন সহস্র বিষয়ে নিবিষ্ট হওয়ায় শক্তির অপচয় ঘটে। অবিবেকীরা বেদোক্ত কর্মে অনুরক্ত; স্বর্গাদি ফলের জনক বেদের কর্মকাণ্ডের বাহিরে কিছু আছে, এ-কথা তাঁহারা বিশ্বাস করে না। কারণ তাঁহারা বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের সাহায্যে ভোগসুখ ও স্বর্গলাভ করিতে চান এবং সেজন্য যজ্ঞাদি করেন।’১৩ ‘এই সকল লোক যতক্ষণ না বৈষয়িক ভোগ-সুখের প্রত্যাশা ত্যাগ করেন, ততক্ষণ তাঁহাদের আধ্যাত্মিক জীবনে সাফল্য আসিতে পারে না।’


স্বর্গ তাহাদের নিকট পার্থিব জীবনের বিস্তারমাত্র। মানুষ ইহজীবনের অতিরিক্ত কিছু চিন্তা করিতে পারে না। এই শরীরকে কেন্দ্র করিয়া তাহাদের জীবনের সব-কিছু। ‘মুক্তিপ্রদ নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি এই শ্রেণীর মানবের নিকট একান্ত দুর্লভ।’১৪

ইহাও গীতার আর একটি মহান্ উপদেশ। বিষয়ের ভোগসুখ যতক্ষণ না পরিত্যক্ত হয়, ততক্ষণ আধ্যাত্মিক জীবন আরম্ভ হয় না। ইন্দ্রিয়-সম্ভোগে সুখ কোথায়? ইন্দ্রিয়গুলি আমাদের ভ্রম সৃষ্টি করে মাত্র। মানুষ মৃত্যুর পরে স্বর্গলোকেও একজোড়া চক্ষু ও নাসিকার কামনা করে। অনেকের কল্পনা-এ-জগতে যতগুলি ইন্দ্রিয় আছে, স্বর্গে গিয়া তদপেক্ষা বেশীসংখ্যক ইন্দ্রিয় পাওয়া যাইবে। অনন্তকাল ধরিয়া সিংহাসনে অসীম ভগবানকে-ভগবানের পার্থিব দেহকে তাঁহারা দেখিতে চান। এই সকল লোকের বাসনা-শরীরের জন্য, শরীরের ভোগসুখের জন্য, খাদ্য ও পানীয়ের জন্য। স্বর্গ তাহাদের নিকট পার্থিব জীবনের বিস্তারমাত্র। মানুষ ইহজীবনের অতিরিক্ত কিছু চিন্তা করিতে পারে না। এই শরীরকে কেন্দ্র করিয়া তাহাদের জীবনের সব-কিছু। ‘মুক্তিপ্রদ নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি এই শ্রেণীর মানবের নিকট একান্ত দুর্লভ।’১৪

‘বেদ সত্ত্ব, রজঃ ও তম-এই ত্রিগুণাত্মক বিষয়গুলি শিক্ষা দেয়।’ বেদ কেবল প্রকৃতির অন্তর্গত বিষয়গুলি শিক্ষা দেয়। পৃথিবীতে যাহা দেখা যায় না, লোকে তাহা ভাবিতে পারে না। স্বর্গ লইয়া কথা বলিতে গেলে, তাহাদের মনে জাগে-সিংহাসনে একজন রাজা বসিয়া আছেন, আর লোক তাঁহার নিকট ধূপ জ্বালাইতেছে। সবই প্রকৃতি; প্রকৃতির বাহিরে কিছুই নাই। কাজেই বেদ প্রকৃতি ভিন্ন অন্য কিছু শিক্ষা দেয় না। ‘এই প্রকৃতির পারে যাও; অস্তিত্বের এই দ্বৈত-ভাবের পারে যাও; তোমার ব্যক্তিগত চেতনার পারে যাও; কোন কিছুকে গ্রাহ্য করিও না, মঙ্গল বা অমঙ্গলের দিকে তাকাইও না।’১৫

আমরা নিজদিগকে দেহের সহিত অভিন্নভাবে দেখিতেছি। আমরা দেহমাত্র, অথবা দেহটি আমাদের, আমার দেহে চিমটি কাটিলে আমি চীৎকার করি। এ-সকলই অর্থশূন্য, কারণ আমি আত্মস্বরূপ। দেহকে আত্মার সহিত অভিন্নভাবে চিন্তা করার জন্যই এই দুঃখ-শোক কল্পনা, প্রাণী দেবতা দানব, এই বিশ্বজগৎ-প্রত্যেকটি জিনিষ আসিয়া পড়িয়াছে। আমি চৈতন্যস্বরূপ। তুমি চিমটি কাটিলে আমি কেন লাফাইয়া উঠিব? … এই দাসত্ব লক্ষ্য কর। লজ্জা হয় না তোমার? আমরা নাকি ধার্মিক! আমরা নাকি দার্শনিক! আমরা নাকি ঋষি! ভগবান্ মঙ্গল করুন-আমরা কী? জীবন্ত নরক বলিতে যাহা বুঝায়, আমরা তাহাই। পাগল বলিতে যাহা বুঝায়, আমরা তাহাই।

আমরা আমাদের শরীরের ‘ধারণা’ ছাড়িতে পারি না। আমরা পৃথিবীতেই বদ্ধ আছি। এই সংস্কারগুলিই আমাদের বন্ধন। এই-জাতীয় সহস্র সংস্কারের বন্ধনে বদ্ধ অবস্থায় আমরা শরীর ছাড়িয়া যাই।

একেবারে আসক্তিশূন্য হইয়া কে কাজ করিতে পারে? ইহাই প্রকৃত প্রশ্ন। ঐরূপ (আসক্তিশূন্য) ব্যক্তির নিকট কর্মের সফলতা ও বিফলতা সমান কথা। যদি সারা জীবনের কর্ম একমুহূর্তে পুড়িয়া ছাই হইয়া যায়, তাহা হইলেও ঐ ব্যক্তির হৃৎপিণ্ডে বারেকের জন্যও বৃথা স্পন্দন জাগে না। ‘ফলের কথা চিন্তা না করিয়া যিনি কর্মের জন্য কর্ম করিয়া যান, তিনিই যোগী। এইভাবে তিনি জন্মমৃত্যুর যন্ত্রণাকে অতিক্রম করেন-এইভাবে তিনি মুক্ত হন।’১৬ তখন তিনি দেখিতে পান যে, সকল প্রকার আসক্তিই মিথ্যা মায়া। আত্মা কখনও আসক্ত হইতে পারেন না। … তারপর তিনি সকল শাস্ত্র ও দর্শনের পারে গমন করেন।

গ্রন্থ ও শাস্ত্রের দ্বারা যদি মন বিভ্রান্ত হয়-এক মহা আবর্তের মধ্যে আকৃষ্ট হয়, তাহা হইলে এইসব শাস্ত্রের সার্থকতা কি? কোন শাস্ত্র এই প্রকার বলে, অন্যটি আর এক প্রকার বলে। কোন্ গ্রন্থ অবলম্বন করিবে? একাকী দণ্ডায়মান হও। নিজের আত্মার মহিমা দেখ! তোমার কর্ম করিতে হইবে, তবেই তুমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইবে।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি কে?’ ‘যিনি সকল বাসনা ত্যাগ করিয়াছেন। কিছুই আকাঙ্ক্ষা করেন না, এমন কি এই জীবনও নয়, স্বাধীনতা নয়, দেবতা নয়, কর্ম নয়, কোন কিছুই নয়; যখন তিনি পরিতৃপ্ত, তখন আর অধিক কিছু চাহিবার তাঁহার নাই।’১৭ তিনি আত্মার মহিমা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন এবং নিজের মধ্যে সংসার দেবতা স্বর্গ-সকলই প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। তখন দেবতারা আর দেবতা থাকেন না, মৃত্যু আর মৃত্যু থাকে না, জীবন আর জীবন থাকে না। প্রত্যেকটি জিনিষই পরিবর্তিত হইয়া যায়। ‘যদি কাহারও ইচ্ছা দৃঢ় হয়, তাঁহার মন যদি দুঃখে বিচলিত না হয়, যদি তিনি কোন প্রকার সুখের আকাঙ্ক্ষা না করেন, যদি তিনি সকল প্রকার আসক্তি, সকল প্রকার ভয়, সকল প্রকার ক্রোধ হইতে মুক্ত হন, তবে তাঁহাকে স্থিতপ্রজ্ঞা বলা হয়।’১৮

‘কচ্ছপ যেমন করিয়া তাহার পাগুলিকে অভ্যন্তরে টানিয়া লয়, তাহাকে আঘাত করিলে একটি পা-ও বাহিরে আসে না, ঠিক তেমনি যোগী তাঁহার ইন্দ্রিয়গুলিকে অভ্যন্তরে টানিয়া লইতে পারেন।’১৯ কোন কিছুই ঐ (ইন্দ্রিয়)-গুলিকে জোর করিয়া বাহিরে আনিতে পারে না। কোন প্রলোভন বা কোনকিছুই তাঁহাকে টলাইতে পারে না। সারা বিশ্ব তাঁহার চতুর্দিকে চূর্ণ হইয়া যাক, উহা তাঁহার মনে একটি তরঙ্গও সৃষ্টি করিবে না।

অতঃপর একটি অতিপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন আসিয়া পড়ে। অনেক সময় লোকে বহুদিন ধরিয়া উপবাস করে, কোন নিকৃষ্ট ব্যক্তি কুড়ি দিন উপবাস করিলে বেশ শান্ত হইয়া উঠে। এই উপবাস আর আত্মপীড়ন-সারা পৃথিবীর লোক করিয়া আসিতেছে। কৃষ্ণের ধারণায় এইসব অর্থশূন্য। তিনি বলেনঃ যে মানুষ নিজের উপর উৎপীড়ন করে, তাহার নিকট হইতে ইন্দ্রিয়গুলি কিছুকালের জন্য নিবৃত্ত হয়, কিন্তু বিশগুণ অধিক শক্তি লইয়া পুনঃপ্রকাশিত হয়। তখন তুমি কি করিবে? ভাবখানা এই যে, স্বাভাবিক হইতে হইবে। কৃচ্ছসাধন নহে। অগ্রসর হও, কর্ম কর, কেবল দৃষ্টি রাখিও যেন আসক্ত হইয়া না পড়। যে ব্যক্তি অনাসক্তির কৌশল জানে না বা তাহার সাধনা করে না, তাহার প্রজ্ঞা কখনও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না।

আমি বাহিরে গিয়া চোখ মেলিলাম, যদি কিছু থাকে, আমি অবশ্যই দেখিতে পাইব, না দেখিয়া পারি না। মন ইন্দ্রিয়ের পশ্চাতে ধাবিত হয়। এখন ইন্দ্রিয়গুলিকে যে-কোন প্রকার প্রকৃতি-জাত প্রতিক্রিয়া বর্জন করিতে হইবে।


এখানে অজ্ঞেরা সুপ্ত; তাহাদের বুঝিবার সময় নাই, বুদ্ধি নাই, সাধ্য নাই। সেখানে কেবল যোগীই জাগ্রত থাকেন, তাহাই তাঁহার নিকট দিবালোক।

‘যাহা সংসারের নিকট অন্ধকার রাত্রি, সংযমী পুরুষ তাহাতে জাগরিত থাকেন। ইহা তাঁহার নিকট দিবালোক। আর যে বিষয়ে সারা সংসার জাগ্রত, তাহাতে সংযমী নিদ্রিত।’২০ এই সংসার কোথায় জাগ্রত?-ইন্দ্রিয়ে। মানুষ চায় ভোজন, পান আর সন্তান; তারপর কুকুরের মত মরে। … কেবল ইন্দ্রিয়-ব্যাপারেই তাহারা সর্বদা জাগ্রত। তাহাদের ধর্মও ঐজন্যই। তাহারা আরও কামিনী, আরও কাঞ্চন, আরও সন্তান লাভের জন্য একটি ভগবান্ আবিষ্কার করিয়াছে। অধিকতর দেবত্বলাভে সাহায্য করিবার জন্য ভগবানকে চায় নাই।

‘যেখানে সারা জগৎ জাগ্রত, সেখানে যোগী নিদ্রিত, যেখানে অজ্ঞেরা নিদ্রিত, যোগী সেখানে জাগ্রত’; সেই আলোকের রাজ্যে-যেখানে মানুষ নিজেকে পাখীর মত, পশুর মত শরীর মাত্র বলিয়া দেখে না-দেখে অনন্ত মৃত্যুহীন অমর আত্মারূপে। এখানে অজ্ঞেরা সুপ্ত; তাহাদের বুঝিবার সময় নাই, বুদ্ধি নাই, সাধ্য নাই। সেখানে কেবল যোগীই জাগ্রত থাকেন, তাহাই তাঁহার নিকট দিবালোক।

‘পৃথিবীর নদীগুলি অবিরত তাহাদের জলরাশি সমুদ্রে ঢালিতেছে, কিন্তু সমুদ্রের সুন্দর গম্ভীর প্রকৃতি অবিচলিত, অপরিবর্তিতই থাকে। তেমনি ইন্দ্রিয়গুলি একযোগে প্রকৃতির সকল সংবেদন আনিলেও জ্ঞানীর হৃদয় কোনপ্রকার বিক্ষেপ বা ভয়ের কথা ভাবিতে পারে না।’২১ লক্ষ লক্ষ স্রোতে দুঃখ আসুক, শত শত স্রোতে সুখ আসুক! আমি দুঃখের অধীন নই-আমি সুখের ক্রীতদাসও নই।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!