ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

স্বামী-শিষ্য সংবাদ

৩১
স্থান-বেলুড়, ভাড়াটিয়া মঠ-বাটী
কাল-(৩য় সপ্তাহ) জানুআরী, ১৮৯৯

আলমবাজার হইতে বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর বাগানে যখন মঠ উঠিয়া আসে, তাহার অল্পদিন পরে স্বামীজী তাঁহার গুরুভ্রাতৃগণের নিকট প্রস্তাব করেন যে, ঠাকুরের ভাব জনসাধারণের মধ্যে প্রচারকল্পে বাঙলা ভাষায় একখানি সংবাদ-পত্র বাহির করিতে হইবে। স্বামীজী প্রথমতঃ একখানি দৈনিক সংবাদপত্রের প্রস্তাব করেন। কিন্তু উহা বিস্তর ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় পাক্ষিক পত্র বাহির করিবার প্রস্তাবই সকলের অভিমত হইল এবং স্বামী ত্রিগুণাতীতের উপর উহার পরিচালনের ভার অর্পিত হইল। স্বামী ত্রিগুণাতীত এইরূপে কার্যভার গ্রহণ করিয়া ১৩০৫ সালের ১লা মাঘ ঐ পত্র প্রথম প্রকাশ করিলেন। স্বামীজী ঐ পত্রের ‘উদ্বোধন’ নাম মনোনীত করেন।

পত্রের প্রস্তাবনা স্বামীজী নিজে লিখিয়া দেন এবং কথা হয় যে, ঠাকুরের সন্ন্যাসী ও গৃহী ভক্তগণ এই পত্রে প্রবন্থাদি লিখিবেন। সঙ্ঘরূপে পরিণত ‘রামকৃষ্ণ মিশনের’ সভ্যগণকে স্বামীজী এই পত্রে প্রবন্ধাদি লিখিতে এবং ঠাকুরের ধর্মসম্বন্ধীয় মত পত্রসহায়ে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। পত্রের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হইলে শিষ্য একদিন মঠে উপস্থিত হইল। শিষ্য প্রণাম করিয়া উপবেশন করিলে স্বামীজী তাহার সহিত ‘উদ্বোধন’ পত্র সম্বন্ধে এইরূপ কথাবার্তা আরম্ভ করিলেনঃ

স্বামীজী॥ (পত্রের নামটি বিকৃত করিয়া পরিহাসচ্ছলে) ‘উদ্বন্ধন’ দেখেছিস?

শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ; সুন্দর হয়েছে।

স্বামীজী॥ এই পত্রের ভাব ভাষা-সব নূতন ছাঁচে গড়তে হবে।

শিষ্য॥ কিরূপ?

স্বামীজী॥ ঠাকুরের ভাব তো সব্বাইকে দিতে হবেই; অধিকন্তু বাঙলা ভাষায় নূতন ওজস্বিতা আনতে হবে। এই যেমন-কেবল ঘন ঘন verb use (ক্রিয়াপদের ব্যবহার) করলে, ভাষার দম কমে যায়। বিশেষণ দিয়ে verb (ক্রিয়াপদ)-এর ব্যবহারগুলি কমিয়ে দিতে হবে। তুই ঐরূপ প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ কর। আমায় আগে দেখিয়ে তবে উদ্বোধনে ছাপতে দিবি।

শিষ্য॥ মহাশয়, স্বামী ত্রিগুণাতীত এই পত্রের জন্য যেরূপ পরিশ্রম করিতেছেন, তাহা অন্যের পক্ষে অসম্ভব।

স্বামীজী॥ তুই বুঝি মনে করছিস, ঠাকুরের এইসব সন্ন্যাসী সন্তানেরা কেবল গাছতলায় ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকতে জন্মেছে? এদের যে যখন কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবে, তখন তার উদ্যম দেখে লোকে অবাক হবে। এদের কাছে কাজ কি করে করতে হয়, তা শেখ। এই দেখ, আমার আদেশ পালন করতে ত্রিগুণাতীত সাধনভজন ধ্যানধারণা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে কাজে নেবেছে। এ কি কম sacrifice (স্বার্থত্যাগ)-এর কথা! আমার প্রতি কতটা ভালবাসা থেকে এ কর্মপ্রবৃত্তি এসেছে বল দেখি! Success (কাজ হাসিল) করে তবে ছাড়বে!! তোদের কি এমন রোক্‌ আছে?

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, গেরুয়াপরা সন্ন্যাসীর-গৃহীদের দ্বারে দ্বারে ঐরূপে ঘোরা আমাদের চক্ষে কেমন কেমন ঠেকে!

স্বামীজী॥ কেন? পত্রের প্রচার তো গৃহীদেরই কল্যাণের জন্য। দেশে নবভাব-প্রচারের দ্বারা জনসাধারণের কল্যাণ সাধিত হবে। এই ফলাকাঙ্ক্ষারহিত কর্ম বুঝি তুই সাধন-ভজনের চেয়ে কম মনে করছিস? আমাদের উদ্দেশ্য জীবের হিতসাধন। এই পত্রের আয় দ্বারা টাকা জমাবার মতলব আমাদের নেই। আমরা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, মাগছেলে নেই যে, তাদের জন্য রেখে যেতে হবে। Success (কাজ হাসিল) হয় তো এর income (আয়টা) সমস্তই জীবসেবাকল্পে ব্যয়িত হবে। স্থানে স্থানে সঙ্ঘ-গঠন, সেবাশ্রম-স্থাপন, আরও কত কি হিতকর কাজে এর উদ্বৃত্ত অর্থের সদ্ব্যয় হতে পারবে। আমরা তো গৃহীদের মত নিজেদের রোজগারের মতলব এঁটে এ কাজ করছি না। শুধু পরহিতেই আমাদের সকল movement (কাজকর্ম)-এটা জেনে রাখবি।

শিষ্য॥ তাহা হইলেও সকলে এভাব লইতে পারিবে না।

স্বামীজী॥ নাই বা পারলে। তাতে আমাদের এল গেল কি? আমরা criticism (সমালোচনা) গণ্য করে কাজে অগ্রসর হইনি।

শিষ্য॥ মহাশয়, এই পত্র ১৫ দিন অন্তর বাহির হইবে; আমাদের ইচ্ছা সাপ্তাহিক হয়।

স্বামীজী॥ তা তো বটে, কিন্তু funds (টাকা) কোথায়? ঠাকুরের ইচ্ছায় টাকার যোগাড় হলে এটাকে পরে দৈনিকও করা যেতে পারে। রোজ লক্ষ কপি ছেপে কলিকাতার গলিতে গলিতে free distribution (বিনামূল্যে বিতরণ) করা যেতে পারে।

শিষ্য॥ আপনার এ সঙ্কল্প বড়ই উত্তম।

স্বামীজী॥ আমার ইচ্ছা হয়, কাগজটাকে পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তোকে editor (সম্পাদক) করে দেব। কোন বিষয়কে প্রথমটা পায়ে দাঁড় করাবার শক্তি তোদের এখনও হয়নি। সেটা করতে এইসব সর্বত্যাগী সাধুরাই সক্ষম। এরা কাজ করে করে মরে যাবে, তবু হটবার ছেলে নয়। তোরা একটু বাধা পেলে, একটু criticism (সমালোচনা) শুনলেই দুনিয়া আঁধার দেখিস!

শিষ্য॥ সেদিন দেখিলাম, স্বামী ত্রিগুণাতীত প্রেসে ঠাকুরের ছবি পূজা করিয়া তবে কাজ আরম্ভ করিলেন এবং কার্যের সফলতার জন্য আপনার কৃপা প্রার্থনা করিলেন।

স্বামীজী॥ আমাদের centre (কেন্দ্র) তো ঠাকুরই। আমরা এক একজন সেই জ্যোতিঃকেন্দ্রের এক একটি ray (কিরণ)। ঠাকুরের পূজা করে কাজটা আরম্ভ করেছে-বেশ করেছে। কই আমায় তো পুজোর কথা কিছু বললে না।

শিষ্য॥ মহাশয়, তিনি আপনাকে ভয় করেন। ত্রিগুণাতীত স্বামী আমায় কল্য বলিলেন, ‘তুই আগে স্বামীজীর কাছে গিয়ে জেনে আয়, পত্রের ১ম সংখ্যা বিষয়ে তিনি কি অভিমত প্রকাশ করেছেন, তারপর আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করব।’

স্বামীজী॥ তুই গিয়ে বলিস, আমি তার কাজে খুব খুশী হয়েছি। তাকে আমার স্নেহাশীর্বাদ জানাবি। আর তোরা প্রত্যেকে যতটা পারবি, তাকে সাহায্য করিস। ওতে ঠাকুরের কাজই করা হবে।

কথাগুলি বলিয়াই স্বামীজী ব্রহ্মানন্দ স্বামীকে নিকটে আহ্বান করিলেন এবং আবশ্যক হইলে ভবিষ্যতে ‘উদ্বোধনে’র জন্য ত্রিগুণাতীত স্বামীকে আরও টাকা দিতে আদেশ করিলেন। ঐ দিন রাত্রে আহারান্তে স্বামীজী পুনরায় শিষ্যের সহিত ‘উদ্বোধন’ পত্র সম্বন্ধে এরূপ আলোচনা করিয়াছিলেনঃ

স্বামীজী॥ ‘উদ্বোধনে’ সাধারণকে কেবল positive ideas (গঠনমূলক ভাব) দিতে হবে। Negative thought (নেতি-বাচক ভাব) মানুষকে weak (দুর্বল) করে দেয়। দেখছিস না, যে-সকল মা বাপ ছেলেদের দিনরাত লেখাপড়ার জন্য তাড়া দেয়, বলে, ‘এটার কিছু হবে না, বোকা, গাধা’-তাদের ছেলেগুলি অনেকস্থলে তাই হয়ে দাঁড়ায়। ছেলেদের ভাল বললে-উৎসাহ দিলে, সময়ে নিশ্চয় ভাল হয়। ছেলেদের পক্ষে যা নিয়ম, children in the region of higher thoughts (ভাবরাজ্যের উচ্চ স্তরে যারা শিশু, তাদের) সম্বন্ধেও তাই। Positive ideas (গঠনমূলক ভাব) দিতে পারলে সাধারণের মানুষ হয়ে উঠবে ও নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে। ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, কবিতা, শিল্প সকল বিষয়ে যা চিন্তা ও চেষ্টা মানুষ করছে, তাতে ভুল না দেখিয়ে ঐ-সব বিষয় কেমন করে ক্রমে ক্রমে আরও ভাল রকমে করতে পারবে, তাই বলে দিতে হবে। ভ্রমপ্রমাদ দেখালে মানুষের felling wounded (মনে আঘাত দেওয়া) হয়। ঠাকুরকে দেখেছি-যাদের আমরা হেয় মনে করতুম, তাদেরও তিনি উৎসাহ দিয়ে জীবনের মতি-গতি ফিরিয়ে দিতেন। তাঁর শিক্ষা দেওয়ার রকমটা অদ্ভুত!

কথাগুলি বলিয়া স্বামীজী একটু স্থির হইলেন। কিছুক্ষণ পরে আবার বলিতে লাগিলেনঃ

ধর্মপ্রচারটা কেবল যাতে তাতে এবং যার তার উপর নাক-সিঁটকানো ব্যাপার বলে যেন বুঝিসনি। Physical, mental, spiritual (শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক) সকল ব্যাপারেই মানুষকে positive ideas (গঠনমূলক ভাব) দিতে হবে। কিন্তু ঘেন্না করে নয়। পরস্পরকে ঘেন্না করে করেই তোদের অধঃপতন হয়েছে। এখন কেবল positive thought (গঠনমূলক ভাব) ছড়িয়ে লোককে তুলতে হবে। প্রথমে ঐরূপে সমস্ত হিঁদুজাতটাকে তুলতে হবে, তারপর জগৎটাকে তুলতে হবে। ঠাকুরের অবতীর্ণ হওয়ার কারণই এই। তিনি জগতে কারও ভাব নষ্ট করেননি। মহা-অধঃপতিত মানুষকেও তিনি অভয় দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে তুলে নিয়েছেন। আমাদেরও তাঁর পদানুসরণ করে সকলকে তুলতে হবে, জাগাতে হবে। বুঝলি?

তোদের history, literature, mythology (ইতিহাস, সাহিত্য, পুরাণ) প্রভৃতি সকল শাস্ত্রগ্রন্থ মানুষকে কেবল ভয়ই দেখাচ্ছে! মানুষকে কেবল বলছে-‘তুই নরকে যাবি, তোর আর উপায় নেই।’ তাই এত অবসন্নতা ভারতের অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করেছে। সেই জন্য বেদ-বেদান্তের উচ্চ উচ্চ ভাবগুলি সাদা কথায় মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে। সদাচার, সদ্ব্যবহার ও বিদ্যা শিক্ষা দিয়ে ব্রাহ্মণ ও চণ্ডালকে এক ভূমিতে দাঁড় করাতে হবে। ‘উদ্বোধন’ কাগজে এইসব লিখে আবালবৃদ্ধবনিতাকে তোল দেখি। তবে জানব-তোর বেদ-বেদান্ত পড়া সার্থক হয়েছে। কি বলিস-পারবি?

শিষ্য॥ আপনার আশীর্বাদ ও আদেশ হইলে সকল বিষয়েই সিদ্ধকাম হইব বলিয়া মনে হয়!

স্বামীজী॥ আর একটা কথা-শরীরটাকে খুব মজবুত করতে তোকে শিখতে হবে ও সকলকে শেখাতে হবে। দেখছিসনে এখনও রোজ আমি ডামবেল কষি। রোজ সকাল-সন্ধ্যায় বেড়াবি; শারীরিক পরিশ্রম করবি। Body and mind must run parallel (দেহ ও মন সমানভাবে চলবে)। সব বিষয়ে পরের ওপর নির্ভর করলে চলবে কেন? শরীরটা সবল করবার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারলে নিজেরাই তখন ঐ বিষয়ে যত্ন করবে। সেই প্রয়োজনীয়তা-বোধের জন্যই এখন education-এর (শিক্ষার) দরকার।

৩২
স্থান-বেলুড় মঠ
কাল-১৯০০

এখন স্বামীজী বেশ সুস্থ আছেন। শিষ্য রবিবার প্রাতে মঠে আসিয়াছে। স্বামীজীর পাদপদ্ম-দর্শনান্তে নীচে আসিয়া স্বামী নির্মলানন্দের সহিত বেদান্তশাস্ত্রের আলোচনা করিতেছে। এমন সময় স্বামীজী নীচে নামিয়া আসিলেন এবং শিষ্যকে দেখিয়া বলিলেন, ‘কিরে, তুলসীর সঙ্গে তোর কি বিচার হচ্ছিল?’

শিষ্য॥ মহাশয়, তুলসী মহারাজ বলিতেছিলেন, ‘বেদান্তের ব্রহ্মবাদ কেবল তোর স্বামীজী আর তুই বুঝিস। আমরা কিন্তু জানি-কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্।’

স্বামীজী॥ তুই কি বললি?

শিষ্য॥ আমি বলিলাম. এক আত্মাই সত্য। কৃষ্ণ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ ছিলেন মাত্র। তুলসী মহারাজ ভিতরে বেদান্তবাদী, বাহিরে কিন্তু দ্বৈতবাদীর পক্ষ লইয়া তর্ক করেন। ঈশ্বরকে ব্যক্তিবিশেষ বলিয়া কথা অবতারণা করিয়া ক্রমে বেদান্তবাদের ভিত্তি সুদৃঢ় প্রমাণিত করাই তাঁহার অভিপ্রায় বলিয়া মনে হয়। কিন্তু উনি আমায় ‘বৈষ্ণব’ বলিলেই আমি ঐ কথা ভুলিয়া যাই এবং তাঁহার সহিত তর্কে লাগিয়া যাই।

স্বামীজী॥ তুলসী তোকে ভালবাসে কিনা, তাই ঐরূপ বলে তোকে খ্যাপায়। তুই চটবি কেন? তুইও বলবি, ‘আপনি শূন্যবাদী নাস্তিক।’

শিষ্য॥ মহাশয়, উপনিষদে ঈশ্বর যে শক্তিমান্ ব্যক্তি-বিশেষ, এ কথা আছে কি? লোকে কিন্তু ঐরূপ ঈশ্বরে বিশ্বাসবান্।

স্বামীজী॥ সর্বেশ্বর কখনও ব্যক্তিবিশেষ হতে পারেন না। জীব হচ্ছে ব্যষ্টি, আর সকল জীবের সমষ্টি হচ্ছেন ঈশ্বর। জীবের অবিদ্যা প্রবল; ঈশ্বর বিদ্যা ও অবিদ্যার সমষ্টি মায়াকে বশীভূত করে রয়েছেন এবং স্বাধীনভাবে এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক জগৎটা নিজের ভেতর থেকে project (বাহির) করেছেন। ব্রহ্ম কিন্তু ঐ ব্যষ্টি-সমষ্টির অথবা জীব ও ঈশ্বরের পারে বর্তমান। ব্রহ্মের অংশাংশ-ভাগ হয় না। বোঝাবার জন্য তাঁর ত্রিপাদ, চতুষ্পাদ ইত্যাদি কল্পনা করা হয়েছে মাত্র। যে পাদে সৃষ্ট-স্থিতি-লয় অধ্যাস হচ্ছে, সেই ভাগকেই শাস্ত্র ‘ঈশ্বর’ বলে নির্দেশ করেছে। অপর ত্রিপাদি কূটস্থ, যাতে কোনরূপ দ্বৈত-কল্পনার ভান নেই, তাই ব্রহ্ম। তা বলে এরূপ যেন মনে করিসনি যে, ব্রহ্ম-জীবজগৎ থেকে একটা স্বতন্ত্র বস্তু। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীরা বলেন, ব্রহ্মই জীবজগৎরূপে পরিণত হয়েছেন। অদ্বৈতবাদীরা বলেনঃ তা নয়, ব্রহ্মে এই জীবজগৎ অধ্যস্ত হয়েছে মাত্র; কিন্তু বস্তুতঃ ওতে ব্রহ্মের কোনরূপ পরিণাম হয়নি। অদ্বৈতবাদীরা বলেন, নামরূপ নিয়েই জগৎ। যতক্ষণ নামরূপ আছে, ততক্ষণই জগৎ আছে। ধ্যান-ধারণা-বলে যখন নামরূপের বিলয় হয়ে যায়, তখন এক ব্রহ্মই থাকেন। তখন তোর, আমার বা জীব-জগতের স্বতন্ত্র সত্তার আর অনুভব হয় না। তখন বোধ হয় আমিই নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ প্রত্যক্-চৈতন্য বা ব্রহ্ম। জীবের স্বরূপই হচ্ছেন ব্রহ্ম; ধ্যান-ধারণায় নাম-রূপের আবরণটা দূর হয়ে ঐ ভাবটা প্রত্যক্ষ হয় মাত্র। এই হচ্ছে শুদ্ধাদ্বৈতবাদের সারমর্ম। বেদ-বেদান্ত শাস্ত্র-ফাস্ত্র এই কথাই নানা রকমে বারংবার বুঝিয়ে দিচ্ছে।

শিষ্য॥ তাহা হলে ঈশ্বর যে সর্বশক্তিমান্ ব্যক্তিবিশেষ-একথা আর সত্য হয় কিরূপে?

স্বামীজী॥ মন-রূপ উপাধি নিয়েই মানুষ। মন দিয়েই মানুষকে সকল বিষয় ধরতে বুঝতে হচ্ছে। কিন্তু মন যা ভাবে, তা limited (সীমাবদ্ধ) হবেই। এ-জন্য নিজের personality (ব্যক্তিত্ব) থেকে ঈশ্বরেরpersonality (ব্যক্তিত্ব) কল্পনা করা জীবের স্বতঃসিদ্ধ স্বভাব। মানুষ তার ideal (আদর্শ)-কে মানুষরূপেই ভাবতে সক্ষম। এই জরামরণসঙ্কুল জগতে এসে মানুষ দুঃখের ঠেলায় ‘হা হতোঽস্মি’ করে এবং এমন এক ব্যক্তির আশ্রয় চায়, যাঁর উপর নির্ভর করে সে চিন্তাশূন্য হতে পারে। কিন্তু আশ্রয় কোথায়? নিরাধার সর্বজ্ঞ আত্মাই একমাত্র আশ্রয়স্থল। প্রথমে মানুষ তা টের পায় না! বিবেক-বৈরাগ্য এলে ধ্যান-ধারণা করতে করতে সেটা ক্রমে টের পায়। কিন্তু যে যে-ভাবেই সাধন করুক না কেন, সকলেই অজ্ঞাতসারে নিজের ভেতরে অবস্থিত ব্রহ্মভাবকে জাগিয়ে তুলছে। তবে আলম্বন ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যার Personal God (ব্যক্তিবিশেষ ঈশ্বর)-এ বিশ্বাস আছে, তাকে ঐ ভাব ধরেই সাধনভজন করতে হয়। ঐকান্তিকতা এলে ঐ থেকেই কালে ব্রহ্ম-সিংহ তার ভেতরে জেগে ওঠেন। ব্রহ্মজ্ঞানই হচ্ছে জীবের Goal (লক্ষ্য)। তবে নানা পথ-নানা মত। জীবের পারমার্থিক স্বরূপ ব্রহ্ম হলেও মন-রূপ উপাধিতে অভিমান থাকায় সে হরেক রকম সন্দেহ-সংশয় সুখ-দুঃখ ভোগ করে। কিন্তু নিজের স্বরূপলাভে আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সকলেই গতিশীল। যতক্ষণ না ‘অহং ব্রহ্ম’ এই তত্ত্ব প্রত্যক্ষ হবে, ততক্ষণ এই জন্মমৃত্যু-গতির হাত থেকে কারুরই নিস্তার নেই। মানুষজন্ম লাভ করে মুক্তির ইচ্ছা প্রবল হলে ও মহাপুরুষের কৃপালাভ হলে-তবে মানুষের আত্মজ্ঞানস্পৃহা বলবতী হয়। নতুবা কাম-কাঞ্চন-জড়িত লোকের ওদিকে মনের গতিই হয় না। মাগ-ছেলে ধন-মান লাভ করবে বলে মনে যার সঙ্কল্প রয়েছে, তার কি করে ব্রহ্ম-বিবিদিষা হবে? যে সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত, যে সুখ-দুঃখ ভাল-মন্দের চঞ্চল প্রবাহে ধীর স্থির শান্ত সমনস্ক, সে-ই আত্মজ্ঞানলাভে যত্নপর হয়। সে-ই ‘নির্গচ্ছতি জগজ্জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী’-মহাবলে জগজ্জাল ছিন্ন করে মায়ার গণ্ডী ভেঙে সিংহের মত বেরিয়ে পড়ে।

শিষ্য॥ তবে কি মহাশয়, সন্ন্যাস ভিন্ন ব্রহ্মজ্ঞান হইতেই পারে না?

স্বামীজী॥ তা একবার বলতে? অন্তর্বহিঃ উভয় প্রকারেই সন্ন্যাস অবলম্বন করা চাই। আচার্য শঙ্করও উপনিষদের ‘তপসো বাপ্যলিঙ্গাৎ’৫৮-এই অংশের ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে বলছেন, লিঙ্গহীন অর্থাৎ সন্ন্যাসের বাহ্য চিহ্নস্বরূপ গৈরিকবসন দণ্ড কমণ্ডলু প্রভৃতি ধারণ না করে তপস্যা করলে দুরধিগম্য ব্রহ্মতত্ত্ব প্রত্যক্ষ হয় না। বৈরাগ্য না এলে, ত্যাগ না এলে, ভোগস্পৃহা-ত্যাগ না হলে কি কিছু হবার যো আছে? সে যে ছেলের হাতে মোয়া নয় যে, ভোগা দিয়ে কেড়ে খাবে।

শিষ্য॥ কিন্তু সাধন করিতে করিতে ক্রমে তো ত্যাগ আসিতে পারে?

স্বামীজী॥ যার ক্রমে আসে, তার আসুক। তুই তা বলে বসে থাকবি কেন? এখনি খাল কেটে জল আনতে লেগে যা। ঠাকুর বলতেন, ‘হচ্ছে-হবে -ও-সব মেদাটে ভাব।’ পিপাসা পেলে কি কেউ বসে থাকতে পারে, না, জলের জন্য ছুটোছুটি করে বেড়ায়? পিপাসা পায়নি, তাই বসে আছিস। বিবিদিষা প্রবল হয়নি, তাই মাগ-ছেলে নিয়ে সংসার করছিস।

শিষ্য॥ বাস্তবিক কেন যে এখনও ঐরূপ সর্বস্ব-ত্যাগের বুদ্ধি হয় না, তাহা বুঝিতে পারি না। আপনি ইহার একটা উপায় করিয়া দিন।

স্বামীজী॥ উদ্দেশ্য ও উপায়-সবই তোর হাতে। আমি কেবল stimulate (উদ্বুদ্ধ) করে দিতে পারি। এইসব সৎশাস্ত্র পড়ছিস, এমন ব্রহ্মজ্ঞ সাধুদের সেবা ও সঙ্গ করছিস-এতেও যদি না ত্যাগের ভাব আসে, তবে জীবনই বৃথা। তবে একেবারে বৃথা হবে না, কালে এর ফল তেড়েফুঁড়ে বেরুবেই বেরুবে।

শিষ্য॥ (অধোমুখে বিষণ্ণভাবে) মহাশয়, আমি আপনার শরণাগত, আমার মুক্তিলাভের পন্থা খুলিয়া দিন, আমি যেন এই শরীরেই তত্ত্বজ্ঞ হইতে পারি।

স্বামীজী॥ (শিষ্যের অবসন্নতা দর্শন করিয়া) ভয় কি? সর্বদা বিচার করবি-এই দেহ-গেহ, জীব-জগৎ সকলই নিঃশেষ মিথ্যা, স্বপ্নের মত; সর্বদা ভাববি-এই দেহটা একটা জড় যন্ত্রমাত্র। এতে যে আত্মারাম পুরুষ রয়েছেন, তিনিই তোর যথার্থ স্বরূপ। মন-রূপ উপাধিটাই তাঁর প্রথম ও সূক্ষ্ম আবরণ, তারপর দেহটা তাঁর স্থূল আবরণ হয়ে রয়েছে। নিষ্কল নির্বিকার স্বয়ংজ্যোতিঃ সেই পুরুষ এইসব মায়িক আবরণে আচ্ছাদিত থাকায় তুই তোর স্ব-স্বরূপকে জানতে পারছিস না। এই রূপ-রসে ধাবিত মনের গতি অন্তর্দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে। মনটাকে মারতে হবে। দেহটা তো স্থূল-এটা মরে পঞ্চভূতে মিশে যায়। কিন্তু সংস্কারের পুঁটলি-মনটা শীগগীর মরে না। বীজাকারে কিছুকাল থেকে আবার বৃক্ষে পরিণত হয়; আবার স্থূল শরীর ধারণ করে জন্মমৃত্যুপথে গমনাগমন করে, এইরূপে যতক্ষণ না আত্মজ্ঞান হয়। সেজন্য বলি, ধ্যান-ধারণা ও বিচারকালে মনকে সচ্চিদানন্দ-সাগরে ডুবিয়ে দে। মনটা মরে গেলেই সব গেল-ব্রহ্মসংস্থ হলি।

শিষ্য॥ মহাশয়, এই উদ্দাম উন্মত্ত মনকে ব্রহ্মাবগাহী করা মহা কঠিন।

স্বামীজী॥ বীরের কাছে আবার কঠিন বলে কোন জিনিষ আছে? কাপুরুষেরাই ও-কথা বলে।-বীরাণামেব করতলগতা মুক্তিঃ, ন পুনঃ কাপুরুষাণাম্।৫৯ অভ্যাস ও বৈরাগ্যবলে মনকে সংযত কর। গীতা বলছেন, ‘অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।’৬০ চিত্ত হচ্ছে যেন স্বচ্ছ হ্রদ। রূপরসাদির আঘাতে তাতে যে তরঙ্গ উঠছে, তার নামই মন। এজন্যই মনের স্বরূপ সংকল্পবিকল্পাত্মক। ঐ সঙ্কল্পবিকল্প থেকেই বাসনা ওঠে। তারপর ঐ মনই ক্রিয়াশক্তিরূপে পরিণত হয়ে স্থূলদেহরূপ যন্ত্র দিয়ে কাজ করে। আবার কর্মও যেমন অনন্ত, কর্মের ফলও তেমনি অনন্ত। সুতরাং অনন্ত অযুত কর্মফলরূপ তরঙ্গে মন সর্বদা দুলছে। সেই মনকে বৃত্তিশূন্য করে দিতে হবে-পুনরায় স্বচ্ছ হ্রদে পরিণত করতে হবে, যাতে বৃত্তিরূপ তরঙ্গ আর একটিও না থাকে; তবেই ব্রহ্ম প্রকাশ হবেন। শাস্ত্রকার ঐ অবস্থারই আভাস এই ভাবে দিচ্ছেন-‘ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিঃ’৬১ইত্যাদি। বুঝলি?

শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ। কিন্তু ধ্যান তো বিষয়াবলম্বী হওয়া চাই?

স্বামীজী॥ তুই নিজেই নিজের বিষয় হবি। তুই সর্বগ আত্মা-এটিই মনন ও ধ্যান করবি। আমি দেহ নই, মন নই, বুদ্ধি নই, স্থূল নই, সূক্ষ্ম নই-এইরূপে ‘নেতি নেতি’ করে প্রত্যক্‌চৈতন্যরূপ স্ব-স্বরূপে মনকে ডুবিয়ে দিবি। এরূপে মন-শালাকে বারংবার ডুবিয়ে ডুবিয়ে মেরে ফেলবি। তবেই বোধস্বরূপের বোধ বা স্ব-স্বরূপে স্থিতি হবে। ধ্যাতা-ধ্যেয়-ধ্যান তখন এক হয়ে যাবে; জ্ঞাতা-জ্ঞেয়-জ্ঞান এক হয়ে যাবে। নিখিল অধ্যাসের নিবৃতি হবে। একেই শাস্ত্রে বলে-‘ত্রিপুটিভেদ’। ঐরূপ অবস্থায় জানাজানি থাকে না। আত্মাই যখন একমাত্র বিজ্ঞাতা, তখন তাঁকে আবার জানবি কি করে? আত্মাই জ্ঞান, আত্মাই চৈতন্য, আত্মাই সচ্চিদানন্দ। যাকে সৎ বা অসৎ কিছুই বলে নির্দেশ করা যায় না, সেই অনির্বচনীয়-মায়াশক্তি-প্রভাবেই জীবরূপী ব্রহ্মের ভেতরে জ্ঞাতা-জ্ঞেয়-জ্ঞানের ভাবটা এসেছে। এটাকেই সাধারণ মানুষ conscious state (চেতন বা জ্ঞানের অবস্থা) বলে। আর যেখানে এই দ্বৈত-সংঘাত নিরাবিল ব্রহ্মতত্ত্বে এক হয়ে যায়, তাকে শাস্ত্র superconscious state (সমাধি, সাধারণ জ্ঞানভূমি অপেক্ষা উচ্চাবস্থা) বলে এইরূপে বর্ণনা করেছেন-‘স্তিমিতসলিলরাশিপ্রখ্যমাখ্যাবিহী নম্‌।’৬২

(গভীরভাবে মগ্ন হইয়া স্বামীজী বলিতে লাগিলেনঃ)

এই জ্ঞাতা-জ্ঞেয় মগ্ন বা জানাজানি-ভাব থেকেই দর্শন-শাস্ত্র, বিজ্ঞান-সব বেরিয়েছে। কিন্তু মানব-মনের কোন ভাব বা ভাষা জানাজানির পারের বস্তুকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারছে না। দর্শন-বিজ্ঞানাদি partial truth (আংশিক সত্য)। ওরা সেজন্য পরমার্থতত্ত্বের সম্পূর্ণ expression (প্রকাশ) কখনই হতে পারে না। এইজন্য পরমার্থের দিক্‌ দিয়ে দেখলে সবই মিথ্যা বলে বোধ হয়-ধর্ম মিথ্যা, কর্ম মিথ্যা, আমি মিথ্যা, তুই মিথ্যা, জগৎ মিথ্যা। তখনই বোধ হয় যে, আমিই সব, আমিই সর্বগত আত্মা, আমার প্রমাণ আমিই। আমার অস্তিত্বের প্রমাণের জন্য আবার প্রমাণান্তরের অপেক্ষা কোথায়? শাস্ত্রে যেমন বলে, ‘নিত্যমস্মৎপ্রসিদ্ধম্’-নিত্যবস্তুরূপে ইহা স্বতঃসিদ্ধ-এইভাবেই আমি সর্বদা ইহা অনুভব করি। আমি ঐ অবস্থা সত্যসত্যই দেখেছি, অনুভূতি করেছি। তোরাও দেখ, অনুভূতি কর আর জীবকে এই ব্রহ্মতত্ত্ব শোনাগে। তবে তো শান্তি পাবি।

ঐ কথা বলিতে বলিতে স্বামীজীর মুখমণ্ডল গম্ভীর ভাব ধারণ করিল এবং তাঁহার মন যেন এক অজ্ঞাতরাজ্যে যাইয়া কিছুক্ষণের জন্য স্থির হইয়া গেল! কিছুক্ষণ পরে তিনি আবার বলিতে লাগিলেনঃ

এই সর্বমতগ্রাসিনী সর্বমতসমঞ্জসা ব্রহ্মবিদ্যা নিজে অনুভব কর, আর জগতে প্রচার কর। এতে নিজের মঙ্গল হবে, জীবেরও কল্যাণ হবে। তোকে আজ সারকথা বললাম; এর চাইতে বড় কথা আর কিছুই নেই।

শিষ্য॥ মহাশয়, আপনি এখন জ্ঞানের কথা বলিতেছেন; আবার কখনও বা ভক্তির, কখনও কর্মের এবং কখনও যোগের প্রাধান্য কীর্তন করেন। উহাতে আমাদের বুদ্ধি গুলাইয়া যায়।

স্বামীজী॥ কি জানিস-এই ব্রহ্মজ্ঞ হওয়াই চরম লক্ষ্য, পরম পুরুষার্থ। তবে মানুষ তো আর সর্বদা ব্রহ্মসংস্থ হয়ে থাকতে পারে না! ব্যুত্থান-কালে কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে। তখন এমন কর্ম করা উচিত, যাতে লোকের শ্রেয়োলাভ হয়। এইজন্য তোদের বলি, অভেদ-বুদ্ধিতে জীবসেবারূপ কর্ম কর। কিন্তু বাবা, কর্মের এমন মারপ্যাঁচ যে বড় বড় সাধুরাও এতে বদ্ধ হয়ে পড়েন। সেইজন্য ফলাকাঙ্ক্ষাহীন হয়ে কর্ম করতে হয়। গীতায় ঐ কথায় বলেছে। কিন্তু জানবি, ব্রহ্মজ্ঞানে কর্মের অনুপ্রবেশও নেই; সৎকর্ম দ্বারা বড়জোর চিত্তশুদ্ধি হয়। এ-জন্যই ভাষ্যকার৬৪ জ্ঞানকর্ম-সমুচ্চয়ের প্রতি তীব্র কটাক্ষ-এত দোষারোপ করেছেন। নিষ্কাম কর্ম থেকে কারও কারও ব্রহ্মজ্ঞান হতে পারে। এও একটা উপায় বটে, কিন্তু উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞানলাভ। এ কথাটা বেশ করে জেনে রাখ-বিচারমার্গ ও অন্য সকল প্রকার সাধনার ফল হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞতা লাভ করা।

শিষ্য॥ মহাশয়, একবার ভক্তি ও রাজযোগের উপযোগিতা বলিয়া আমার জানিবার আকাঙ্ক্ষা দূর করুন।

স্বামীজী॥ ঐ-সব পথে সাধন করতে করতেও কারও কারও ব্রহ্মজ্ঞান-লাভ হয়ে যায়। ভক্তিমার্গ-slow process (মন্থর গতি), দেরীতে ফল হয়, কিন্তু সহজসাধ্য। যোগে নানা বিঘ্ন; হয়তো বিভূতিপথে মন চলে গেল, আর স্বরূপে পৌঁছুতে পারলে না। একমাত্র জ্ঞানপথই আশুফলপ্রদ এবং সর্বমত-সংস্থাপক বলে সর্বকালে সর্বদেশে সমান আদৃত। তবে বিচারপথে চলতে চলতেও মন দুস্তর তর্কজালে বদ্ধ হয়ে যেতে পারে। এইজন্য সঙ্গে সঙ্গে ধ্যান করা চাই। বিচার ও ধ্যানবলে উদ্দেশ্য বা ব্রহ্মতত্ত্বে পৌঁছুতে হবে। এইভাবে সাধন করলে goal-এ (লক্ষ্যে) ঠিক পৌঁছান যায়। আমার মতে, এই পন্থা সহজ ও আশুফলপ্রদ।

শিষ্য॥ এইবার আমার অবতারবাদ-বিষয়ে কিছু বলুন।

স্বামীজী॥ তুই যে একদিনেই সব মেরে নিতে চাস!

শিষ্য॥ মহাশয়, মনের ধাঁধা একদিনে মিটিয়া যায় তো বারবার আর আপনাকে বিরক্ত করিতে হইবে না।

স্বামীজী॥ যে-আত্মার এত মহিমা শাস্ত্রমুখে অবগত হওয়া যায়, সেই আত্মজ্ঞান যাঁদের কৃপায় এক মুহূর্তে লাভ হয়, তাঁরাই সচল তীর্থ-অবতারপুরুষ। তাঁরা আজন্ম ব্রহ্মজ্ঞ, এবং ব্রহ্ম ও ব্রহ্মজ্ঞে কিছুমাত্র তফাত নেই-‘ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি।’ আত্মাকে তো আর জানা যায় না, কারণ এই আত্মাই বিজ্ঞাতা ও মন্তা হয়ে রয়েছেন-এ কথা পূর্বেই বলেছি। অতএব মানুষের জানাজানি ঐ অবতার পর্যন্ত-যাঁরা আত্মসংস্থ। মানব-বুদ্ধি ঈশ্বর সম্বন্ধে highest ideal (সর্বাপেক্ষা উচ্চ আদর্শ) যা গ্রহণ করতে পারে, তা ঐ পর্যন্ত। তারপর আর জানাজানি থাকে না। ঐরূপ ব্রহ্মজ্ঞ কদাচিৎ জগতে জন্মায়। অল্প লোকেই তাঁদের বুঝতে পারে। তাঁরাই শাস্ত্রোক্তির প্রমাণস্থল-ভবসমুদ্রে আলোকস্তম্ভস্বরূপ। এই অবতারগণের সঙ্গ ও কৃপাদৃষ্টিতে মুহূর্তমধ্যে হৃদয়ের অন্ধকার দূর হয়ে যায়-সহসা ব্রহ্মজ্ঞানের স্ফুরণ হয়। কেন বা কি process-এ (উপায়) হয়, তার নির্ণয় করা যায় না। তবে হয়-হতে দেখেছি। শ্রীকৃষ্ণ আত্মসংস্থ হয়ে গীতা বলেছিলেন। গীতার যে যে স্থলে ‘অহং’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে, তা ‘আত্মপর’ বলে জানবি। ‘মামেকং শরণং ব্রজ’ কিনা ‘আত্মসংস্থ হও’। এই আত্মজ্ঞানই গীতার চরম লক্ষ্য। যোগাদির উল্লেখ ঐ আত্মতত্ত্বলাভের আনুষঙ্গিক অবতারণা। এই আত্মজ্ঞান যাদের হয় না, তারাই আত্মঘাতী। ‘বিনিহন্ত্যসদ্‌গ্রহাৎ’-রূপরসাদির উদ্বন্ধনে তাদের প্রাণ যায়। তোরাও তো মানুষ-দুদিনের ছাই-ভস্ম ভোগকে উপেক্ষা করতে পারবিনি? ‘জায়স্ব ম্রিয়স্বে’র দলে যাবি? ‘শ্রেয়ঃ’কে গ্রহণ কর, ‘প্রেয়ঃ’কে পরিত্যাগ কর। এই আত্মতত্ত্ব আচণ্ডাল সবাইকে বলবি। বলতে বলতে নিজের বুদ্ধিও পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর ‘তত্ত্বমসি’, ‘সোঽহমস্মি’, ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ প্রভৃতি মহামন্ত্র সর্বদা উচ্চারণ করবি এবং হৃদয়ে সিংহের মত বল রাখবি। ভয় কি? ভয়ই মৃত্যু-ভয়ই মহাপাতক। নররূপী অর্জুনের ভয় হয়েছিল-তাই আত্মসংস্থ ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে গীতা উপদেশ দিলেন; তবু কি তাঁর ভয় যায়? পরে অর্জুন যখন বিশ্বরূপ দর্শন করে আত্মসংস্থ হলেন, তখন জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্মা হয়ে যুদ্ধ করলেন।

শিষ্য॥ মহাশয়, আত্মজ্ঞান লাভ হইলেই কি কর্ম থাকে?

স্বামীজী॥ জ্ঞানলাভের পর সাধারণের যাকে কর্ম বলে, সেরূপ কর্ম থাকে না। তখন কর্ম ‘জগদ্ধিতায়’ হয়ে দাঁড়ায়। আত্মজ্ঞানীর চলন-বলন সবই জীবের কল্যাণসাধণ করে। ঠাকুরকে দেখেছি ‘দেহস্থোঽপি ন দেহস্থঃ’৬৬ -এই ভাব! ঐরূপ পুরুষদের কর্মের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কেবল এই কথামাত্র বলা যায়-‘লোকবত্ত লীলা-কৈবল্যম্।’৬৭

৩৩
স্থান-বেলুড় মঠ
কাল-১৯০১

কলিকাতা জুবিলি আর্ট একাডেমির অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা বাবু রণদাপ্রসাদ দাশগুপ্ত মহাশয়কে সঙ্গে করিয়া শিষ্য আজ বেলুড় মঠে আসিয়াছেন। রণদাবাবু শিল্পকলানিপুণ সুপণ্ডিত ও স্বামীজীর গুণগ্রাহী। আলাপ-পরিচয়ের পর স্বামীজী রণদাবাবুর সঙ্গে শিল্প-বিদ্যা সম্বন্ধে নানা প্রসঙ্গ করিতে লাগিলেন; রণদাবাবুকে উৎসাহিত করিবার জন্য তাঁর একাডেমিতে একদিন যাইতেও ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। কিন্তু নানা অসুবিধায় স্বামীজীর তথায় যাওয়া ঘটিয়া উঠে নাই।

স্বামীজী রণদাবাবুকে বলিতে লাগিলেনঃ

পৃথিবীর প্রায় সকল সভ্য দেশের শিল্প-সৌন্দর্য দেখে এলুম, কিন্তু বৌদ্ধধর্মের প্রাদুর্ভাবকালে এদেশে শিল্পকলার যেমন বিকাশ দেখা যায়, তেমনটি আর কোথাও দেখলুম না। মোগল বাদশাদের সময়েও ঐ বিদ্যার বিশেষ বিকাশ হয়েছিল; সেই বিদ্যার কীর্তিস্তম্ভরূপে আজও তাজমহল, জুম্মা মসজিদ প্রভৃতি ভারতবর্ষের বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

মানুষ যে জিনিষটা তৈরী করে, তাতে কোন একটা idea express (মনোভাব প্রকাশ) করার নামই art (শিল্প)। যাতে idea-র expression (ভাবের প্রকাশ) নেই, রঙ-বেরঙের চাকচিক্য পরিপাটি থাকলেও তাকে প্রকৃত art (শিল্প) বলা যায় না। ঘটি, বাটি পেয়ালা প্রভৃতি নিত্যব্যবহার্য জিনিষপত্রগুলিও ঐরূপে বিশেস কোন ভাব প্রকাশ করে তৈরী করা উচিত। প্যারিস প্রদর্শনীতে পাথরের খোদাই এক অদ্ভুত মূর্তি দেখেছিলাম, মূর্তিটির পরিচায়ক এই কয়টি কথা নীচে লেখা, ‘Art unveiling nature’ অর্থাৎ শিল্প কেমন করে প্রকৃতির নিবিড় অবগুণ্ঠন স্বহস্তে মোচন করে ভেতরের রূপসৌন্দর্য দেখে। মূর্তিটি এমনভাবে তৈরী করেছে যেন প্রকৃতিদেবীর রূপচ্ছবি এখনও স্পষ্ট বেরোয়নি; যতটুকু বেরিয়েছে, ততটুকু সৌন্দর্য দেখেই শিল্পী যেন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে। যে ভাস্কর এই ভাবটি প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন, তাঁর প্রশংসা না করে থাকা যায় না। ঐ রকমের original (মৌলিক) কিছু করতে চেষ্টা করবেন।

রণদাবাবু॥ আমারও ইচ্ছা আছে-সময়মত original modeling (নূতন ভাবের মূর্তি) সব গড়তে; কিন্তু এদেশে উৎসাহ পাই না। অর্থাভাব, তার উপর আমাদের দেশে গুণগ্রাহী লোকের অভাব।

স্বামীজী॥ আপনি যদি প্রাণ দিয়ে যথার্থ একটি খাঁটি জিনিষ করতে পারেন, যদি art-এ (শিল্পে) একটি ভাবও যথাযথ express (প্রকাশ) করতে পারেন, কালে নিশ্চয় তার appreciation (সমাদর) হবে। খাঁটি জিনিষের কখনও জগতে অনাদর হয়নি। এরূপও শোনা যায়-এক এক জন artist (শিল্পী) মরবার হাজার বছর পর হয়তো তার appreciation (সমাদর) হল!

রণদাবাবু॥ তা ঠিক। কিন্তু আমরা যেরূপ অপদার্থ হয়ে পড়েছি, তাতে ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে’ সাহসে কুলোয় না। এই পাঁচ বৎসরের চেষ্টায় আমি যা হোক কিছু কৃতকার্য হয়েছি। আশীর্বাদ করুন যেন উদ্যম বিফল না হয়।

স্বামীজী॥ যদি ঠিক ঠিক কাজে লেগে যান, তবে নিশ্চয় successful (সফল) হবেন। যে যে-বিষয়ে মনপ্রাণ ঢেলে খাটে, তাতে তার success (সফলতা) তো হয়ই, তারপর চাই কি ঐ কাজের তন্ময়তা থেকে ব্রহ্মবিদ্যা পর্যন্ত লাভ হয়। যে-কোন বিষয়ে প্রাণ দিয়ে খাটলে ভগবান্‌ তার সহায় হন।

রণদাবাবু॥ ওদেশ এবং এদেশের শিল্পের ভেতর তফাত কি দেখলেন?

স্বামীজী॥ প্রায় সবই সমান, originality (মৌলিকত্ব) প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় না। ঐ-সব দেশে ফটোযন্ত্রের সাহায্যে এখন নানা চিত্র তুলে ছবি আঁকছে। কিন্তু যন্ত্রের সাহায্য নিলেই originality (মৌলিকত্ব) লোপ পেয়ে যায়; নিজে idea-র expression দিতে (মনোগত ভাব প্রকাশ করতে) পারা যায় না। আগেকার ভাস্করগণ নিজেদের মাথা থেকে নূতন নূতন ভাব বের করতে বা সেইগুলি ছবিতে বিকাশ করতে চেষ্টা করতেন; এখন ফটোর অনুরূপ ছবি হওয়ায় মাথা খেলাবার শক্তি ও চেষ্টার লোপ হয়ে যাচ্ছে। তবে এক-একটা জাতের এক-একটা characteristic (বিশেষত্ব) আছে। আচারে-ব্যবহারে, আহারে-বিহারে, চিত্রে-ভাস্কর্যে সেই বিশেষ ভাবের বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরুন-ওদেশের গান-বাজনা-নাচের expression (বাহ্য বিকাশ)-গুলি সবই pointed (তীব্র, তীক্ষ্ণ); নাচছে যেন হাত পা ছুঁড়ছে! বাজনাগুলির আওয়াজে কানে যেন সঙ্গীনের খোঁচা দিচ্ছে! গানেরও ঐরূপ। এদেশের নাচ আবার যেন হেলেদুলে তরঙ্গের মত গড়িয়ে পড়ছে, গানের গমক মূর্চ্ছনাতেও ঐরূপ rounded movement (মোলায়েম গতি) দেখা যায়। বাজনাতেও তাই। অতএব art (শিল্প) সম্বন্ধে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্নরূপ বিকাশ হয়। যে জাতটা বড় materialistic (জড়বাদী), তারা nature (প্রকৃতি)-টাকেই ideal (আদর্শ) বলে ধরে এবং তদনুরূপ ভাবের expression (বিকাশ) শিল্পে দিতে চেষ্টা করে। যে জাতটা আবার প্রকৃতির অতীত একটা ভাবপ্রাপ্তিকেই ideal (আদর্শ) বলে ধরে, সেটা ঐ ভাবই nature-এর (প্রকৃতিগত) শক্তিসহায়ে শিল্পে express (প্রকাশ) করতে চেষ্টা করে। প্রথম শ্রেণীর জাতের nature (প্রকৃতি)-ই হচ্ছে primary basis of art (শিল্পের মূল ভিত্তি); আর দ্বিতীয় শ্রেণীর জাতগুলোর ideality (প্রকৃতির অতীত একটা ভাব) হচ্ছে শিল্প বিকাশের মূল কারণ। ঐরূপে দুই বিভিন্ন উদ্দেশ্য ধরে শিল্পচর্চায় অগ্রসর হলেও ফল উভয় শ্রেণীর প্রায় একই দাঁড়িয়েছে, উভয়েই নিজ নিজ ভাবে শিল্পোনতি করছে। ও-সব দেশের এক একটা ছবি দেখে আপনার সত্যকার প্রাকৃতিক দৃশ্য বলে ভ্রম হবে। এদেশের সম্বন্ধেও তেমনি-পুরাকালে স্থাপত্য-বিদ্যার যখন খুব বিকাশ হয়েছিল, তখনকার এক-একটি মূর্তি দেখলে আপনাকে এই জড় প্রাকৃতিক রাজ্য ভুলিয়ে একটা নূতন ভাবরাজ্যে নিয়ে ফেলবে। ওদেশে এখন যেমন আগেকার মত ছবি হয় না, এদেশেও তেমনি নূতন নূতন ভাববিকাশ-কল্পে ভাস্করগণের আর চেষ্টা দেখা যায় না। এই দেখুন না, আপনাদের আর্ট স্কুলের ছবিগুলোতে যেন কোন expression (ভাবের বিকাশ) নেই। আপনারা হিন্দুদের নিত্য-ধ্যেয় মূর্তিগুলিতে প্রাচীন ভাবের উদ্দীপক expression (বহিঃবিকাশ) দিয়ে আঁকবার চেষ্টা করলে ভাল হয়।

রণদাবাবু॥ আপনার কথায় হৃদয়ে মহা উৎসাহ হয়। চেষ্টা করে দেখব, আপনার কথামত কাজ করতে চেষ্টা করব।

স্বামীজী বলিতে লাগিলেনঃ

এই মনে করুন, মা কালীর ছবি। এতে যুগপৎ ক্ষেমঙ্করী ও ভয়ঙ্করী মূর্তির সমাবেশ। ঐ ছবিগুলির কোনখানিতে কিন্তু ঐ উভয় ভাবের ঠিক ঠিক expression (প্রকাশ) দেখা যায় না। তা দূরে যাক, একটাও চিত্রে ঐ উভয় ভাবের ঠিক ঠিক বিকাশ করবার চেষ্টা কারুর নেই! আমি মা-কালীর ভীমা মূর্তির কিছু idea (ভাব) ‘Kali the Mother’ (কালী দি মাদার) নামক ইংরেজী কবিতাটায় লিপিবদ্ধ করতে চেষ্টা করেছি। আপনি ঐ ভাবটা একখানা express (প্রকাশ) করতে পারেন কি?

রণদাবাবু॥ কি ভাব?

স্বামীজী শিষ্যের পানে তাকাইয়া তাঁহার ঐ কবিতাটি উপর হইতে আনিতে বলিলেন। শিষ্য লইয়া আসিলে স্বামীজী রণদাবাবুকে পড়িয়া শুনাইতে লাগিলেনঃ ‘The stars are blotted out’ &c.৬৮

স্বামীজী ঐ কবিতাটি পাঠের সময়ে শিষ্যের মনে হইতে লাগিল, যেন মহাপ্রলয়ের সংহারমূর্তি তাহার কল্পনাসমক্ষে নৃত্য করিতেছে। রণদাবাবুও কবিতাটি শুনিয়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ বাদে রণদাবাবু যেন কল্পনানয়নে ঐ চিত্রটি দেখিতে পাইয়া ‘বাপ’ বলিয়া ভীতচকিতনয়নে স্বামীজীর মুখপানে তাকাইলেন।

স্বামীজী॥ কেমন, এই idea (ভাবটা) চিত্রে বিকাশ করতে পারবেন তো?

রণদাবাবু॥ আচ্ছা, চেষ্টা করব।৬৯ কিন্তু ঐ ভাবের কল্পনা করতেই যেন মাথা ঘুরে যাচ্ছে।

স্বামীজী॥ ছবিখানি এঁকে আমাকে দেখাবেন। তারপর আমি উহা সর্বাঙ্গসম্পন্ন করতে যা যা দরকার, তা আপনাকে বলে দেব।

অতঃপর স্বামীজী রামকৃষ্ণ মিশনের সীলমোহরের জন্য বিকশিত-কমলদলযুক্ত হ্রদমধ্যে হংসবিরাজিত সর্পবেষ্টিত যে ক্ষুদ্র ছবিটি করিয়াছিলেন, তাহা আনাইয়া রণদাবাবুকে দেখাইয়া তৎসম্বন্ধে নিজ মতামত প্রকাশ করিতে বলিলেন। রণদাবাবু প্রথমে উহার মর্মগ্রহণে অসমর্থ হইয়া স্বামীজীকেই উহার অর্থ জিজ্ঞাসা করিলেন। স্বামীজী বুঝাইয়া দিলেনঃ

চিত্রস্থ তরঙ্গায়িত সলিলরাশি-কর্মের, কমলগুলি-ভক্তির এবং উদীয়মান সূর্যটি-জ্ঞানের প্রকাশক। চিত্রগত সর্পপরিবেষ্টনটি যোগ এবং জাগ্রত কুণ্ডলিনীশক্তির পরিচায়ক। আর চিত্রমধ্যস্থ হংসপ্রতিকৃতিটির অর্থ পরমাত্মা। অতএব কর্ম ভক্তি ও জ্ঞান-যোগের সহিত সম্মিলিত হইলেই পরমাত্মার সন্দর্শন লাভ হয়-চিত্রের ইহাই অর্থ।

রণদাবাবু চিত্রটির ঐরূপ অর্থ শুনিয়া নির্বাক হইয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, ‘আপনার নিকটে কিছুকাল শিল্পকলাবিদ্যা শিখতে পারলে আমার বাস্তবিক উন্নতি হতে পারত।’

অতঃপর ভবিষ্যতে শ্রীরামকৃষ্ণ-মন্দির যেভাবে নির্মাণ করিতে তাঁহার ইচ্ছা, স্বামীজী তাহারই একখানি চিত্র (Drawing) আনাইলেন। চিত্রখানি স্বামী বিজ্ঞানানন্দ স্বামীজীর পরামর্শমত আঁকিয়াছিলেন; চিত্রখানি রণদাবাবুকে দেখাইতে দেখাইতে বলিতে লাগিলেনঃ

এই ভাবী মঠমন্দিরটির নির্মাণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য যাবতীয় শিল্পকলার একত্র সমাবেশ করবার ইচ্ছা আছে আমার। পৃথিবী ঘুরে গৃহশিল্পসম্বন্ধে যত সব idea (ভাব) নিয়ে এসেছি, তার সবগুলিই এই মন্দিরনির্মাণে বিকাশ করবার চেষ্টা করব। বহুসংখ্যক জড়িত স্তম্ভের উপর একটি প্রকাণ্ড নাটমন্দির তৈরী হবে। তার দেওয়ালে শত সহস্র প্রফুল্ল কমল ফুটে থাকবে। হাজার লোক যাতে একত্র বসে ধ্যানজপ করতে পারে, নাটমন্দিরটি এমন বড় করে নির্মাণ করতে হবে। আর শ্রীরামকৃষ্ণ-মন্দির ও নাটমন্দিরটি এমন ভাবে একত্র গড়ে তুলতে হবে যে, দূর থেকে দেখলে ঠিক ‘ওঁকার’ বলে ধারণা হবে। মন্দিরমধ্যে একটি রাজহংসের উপর ঠাকুরের মূর্তি থাকবে। দোরে দুদিকে দুটি ছবি এইভাবে থাকবে-একটি সিংহ ও একটি মেষ বন্ধুভাবে উভয়ে উভয়ের গা চাটছে-অর্থাৎ মহাশক্তি ও মহানম্রতা যেন প্রেমে একত্র সম্মিলিত হয়েছে। মনে এই সব idea (ভাব) রয়েছে; এখন জীবনে কুলোয় তো কাজে পরিণত করে যাব। নতুবা ভাবী generation (বংশীয়েরা) ঐগুলি ক্রমে কাজে পরিণত করতে পারে তো করবে। আমার মনে হয়, ঠাকুর এসেছিলেন দেশের সকল প্রকার বিদ্যা ও ভাবের ভেতরেই প্রাণসঞ্চার করতে। সেজন্য ধর্ম কর্ম বিদ্যা জ্ঞান ভক্তি-সমস্তই যাতে এই মঠকেন্দ্র থেকে জগতে ছড়িয়ে পড়ে, এমনভাবে ঠাকুরের এই মঠটি গড়ে তুলতে হবে। এ বিষয়ে আপনারা আমার সহায় হউন।

রণদাবাবু এবং উপস্থিত সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারিগণ স্বামীজীর কথাগুলি শুনিয়া অবাক হইয়া বসিয়া রহিলেন। যাঁহার মহৎ উদার মন সকল বিষয়ের সকল প্রকার মহান্ ভাবরাশির অদৃষ্টপূর্ব ক্রীড়াভূমি ছিল, সেই স্বামীজীর মহত্ত্বের কথা ভাবিয়া সকলে একটা অব্যক্তভাবে পূর্ণ হইয়া স্তব্ধ হইয়া রহিলেন।

অল্পক্ষণ পরে স্বামীজী আবার বলিলেনঃ

আপনি শিল্পবিদ্যার যথার্থ আলোচনা করেন বলেই আজ ঐ সম্বন্ধে এত চর্চা হচ্ছে। শিল্পসম্বন্ধে এতকাল আলোচনা করে আপনি ঐ বিষয়ের যা কিছু সার ও সর্বোচ্চ ভাব পেয়েছেন, তাই এখন আমাকে বলুন।

রণদাবাবু॥ মহাশয়, আমি আপনাকে নূতন কথা কি শোনাব, আপনিই ঐ বিষয়ে আজ আমার চোখ ফুটিয়ে দিলেন। শিল্পসম্বন্ধে এমন জ্ঞানগর্ভ কথা এ জীবনে আর কখনও শুনিনি। আশীর্বাদ করুন, আপনার নিকট যে-সকল ভাব পেলাম, তা যেন কাজে পরিণত করতে পারি।

অতঃপর স্বামীজী আসন হইতে উঠিয়া ময়দানে ইতস্ততঃ বেড়াইতে বেড়াইতে শিষ্যকে বলিলেন, ‘ছেলেটি খুব তেজস্বী।’

শিষ্য॥ মহাশয়, আপনার কথা শুনিয়া অবাক হইয়া গিয়াছে।

স্বামীজী শিষ্যের ঐ কথার কোন উত্তর না দিয়া আপন মনে গুনগুন করিয়া ঠাকুরের একটি গান গাহিতে লাগিলেন-‘পরম ধন সে পরশমণি’ ইত্যাদি।

এইরূপে কিছুক্ষণ বেড়াইবার পর স্বামীজী মুখ ধুইয়া শিষ্যসঙ্গে উপরে নিজের ঘরে প্রবেশ করিলেন এবং ‘Encyclopedia Britannica’ পুস্তকের শিল্প-সম্বন্ধীয় অধ্যায়টি কিছুক্ষণ পাঠ করিলেন। পাঠ সাঙ্গ হইলে পূর্ববঙ্গের কথা এবং উচ্চারণের ঢঙ অনুকরণ করিয়া শিষ্যের সঙ্গে সাধারণভাবে ঠাট্টা-তামাসা করিতে লাগিলেন।

৩৪
স্থান-বেলুড় মঠ
কাল-মে (শেষ ভাগ), ১৯০১

স্বামীজী কয়েকদিন হইল পূর্ববঙ্গ ও আসাম হইতে ফিরিয়া আসিয়াছেন। শরীর অসুস্থ, পা ফুলিয়াছে। শিষ্য আসিয়া মঠের উপর তলায় স্বামীজীর কাছে গিয়া প্রণাম করিল। শারীরিক অসুস্থতাসত্ত্বেও স্বামীজীর সহাস্য বদন ও স্নেহমাখা দৃষ্টি সকল দুঃখ ভুলাইয়া সকলকে আত্মহারা করিয়া দিত।

শিষ্য॥ স্বামীজী, কেমন আছেন?

স্বামীজী॥ আর বাবা, থাকাথাকি কি? দেহ তো দিন দিন অচল হচ্ছে। বাঙলাদেশে এসে শরীর ধারণ করতে হয়েছে, শরীরে রোগ লেগেই আছে। এদেশের physique (শারীরিক গঠন) একেবারে ভাল নয়। বেশী কাজ করতে গেলেই শরীর বয় না। তবে যে-কটা দিন দেহ আছে, তোদের জন্য খাটব। খাটতে খাটতে মরব।

শিষ্য॥ আপনি এখন কিছুদিন কাজকর্ম ছাড়িয়া স্থির হইয়া থাকুন, তাহা হইলেই শরীর সারিবে। এ দেহের রক্ষায় জগতের মঙ্গল।

স্বামীজী॥ বসে থাকবার যো আছে কি বাবা! ঐ যে ঠাকুর যাকে ‘কালী, কালী’ বলে ডাকতেন, ঠাকুরের দেহ রাখবার দু-তিন দিন আগে সেইটে এই শরীরে ঢুকে গেছে; সেইটেই আমাকে এদিক ওদিক কাজ করিয়ে নিয়ে বেড়ায়, স্থির হয়ে থাকতে দেয় না, নিজের সুখের দিক্‌ দেখতে দেয় না!

শিষ্য॥ শক্তি-প্রবেশের কথাটা কি রূপকচ্ছলে বলিতেছেন?

স্বামীজী॥ না রে। ঠাকুরের দেহ যাবার তিন-চারদিন আগে তিনি আমাকে একাকী একদিন কাছে ডাকলেন। আর সামনে বসিয়ে আমার দিকে একদৃষ্ট চেয়ে সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন। আমি তখন ঠিক অনুভব করতে লাগলুম, তাঁর শরীর থেকে একটা সূক্ষ্ম তেজ electric shock (তড়িৎ-কম্পন)-এর মত এসে আমার শরীরে ঢুকছে! ক্রমে আমিও বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলুম! কতক্ষণ এরূপভাবে ছিলুম, আমার কিছু মনে পড়ে না; যখন বাহ্য চেতনা হল, দেখি ঠাকুর কাঁদছেন। জিজ্ঞাসা করায় ঠাকুর সস্নেহে বললেন, ‘আজ যথাসর্বস্ব তোকে দিয়ে ফকির হলুম! তুই এই শক্তিতে জগতের অনেক কাজ করে তবে ফিরে যাবি।’ ‘আমার বোধ হয়, ঐ শক্তিই আমাকে এ-কাজে সে-কাজে কেবল ঘুরোয়। বসে থাকবার জন্য আমার এ দেহ হয়নি।

শিষ্য অবাক হইয়া শুনিতে শুনিতে ভাবিতে লাগিল, এ-সকল কথা সাধারণ লোকে কিভাবে বুঝিবে, কে জানে! অনন্তর ভিন্ন প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া বলিল, ‘মহাশয়, আমাদের বাঙাল দেশ (পূর্ববঙ্গ) আপনার কেমন লাগিল?

স্বামীজী॥ দেশ কিছু মন্দ নয়, মাঠে দেখলুম খুব শস্য ফলেছে। আবহাওয়াও মন্দ নয়; পাহাড়ের দিকের দৃশ্য অতি মনোহর। ব্রহ্মপুত্র valley-র (উপত্যকার) শোভা অতুলনীয়। আমাদের এদিকের চেয়ে লোকগুলো কিছু মজবুত ও কর্মঠ। তার কারণ বোধ হয়, মাছ-মাংসটা খুব খায়; যা করে, খুব গোঁয়ে করে। খাওয়া-দাওয়াতে খুব তেল-চর্বি দেয়; ওটা ভাল নয়। তেল-চর্বি বেশী খেলে শরীরে মেদ জন্মে।

শিষ্য॥ ধর্মভাব কেমন দেখিলেন?

স্বামীজী॥ ধর্মভাব সম্বন্ধে দেখলুম-দেশের লোকগুলো বড় conservative (রক্ষণশীল); উদারভাবে ধর্ম করতে গিয়ে আবার অনেকে fanatic (ধর্মোন্মাদ) হয়ে পড়েছে। ঢাকার মোহিনীবাবুর বাড়ীতে একদিন একটি ছেলে একখানা কার photo (প্রতিকৃতি) এনে আমায় দেখালে এবং বললে, ‘মহাশয়, বলুন ইনি কে, অবতার কিনা?’ আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে বললুম, ‘তা বাবা, আমি কি জানি?’ তিন-চার বার বললেও সে ছেলেটি দেখলুম কিছুতেই তার জেদ ছাড়ে না। অবশেষে আমাকে বাধ্য হয়ে বলতে হল, ‘বাবা, এখন থেকে ভাল করে খেয়ো-দেয়ো, তা হলে মস্তিষ্কের বিকাশ হবে। পুষ্টিকর খাদ্যাভাবে তোমার মাথা যে শুকিয়ে গেছে।’ এ-কথা শুনে বোধ হয় ছেলেটির অসন্তোষ হয়ে থাকবে। তা কি করব বাবা, ছেলেদের এরূপ না বললে তারা যে ক্রমে পাগল হয়ে দাঁড়াবে।

শিষ্য॥ আমাদের পূর্ববাঙলায় আজকাল অনেক অবতারের অভ্যুদয় হইতেছে!

স্বামীজী॥ গুরুকে লোকে অবতার বলতে পারে, যা ইচ্ছা তাই বলে ধারণা করবার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু ভগবানের অবতার যখন তখন যেখানে সেখানে হয় না। এক ঢাকাতেই শুনলুম, তিন-চারটি অবতার দাঁড়িয়েছে!

শিষ্য॥ ওদেশের মেয়েদের কেমন দেখিলেন?

স্বামীজী॥ মেয়েরা সর্বত্রই প্রায় একরূপ। বৈষ্ণব-ভাবটা ঢাকায় বেশী দেখলুম। ‘হ-’র স্ত্রীকে খুব intelligent (বুদ্ধিমতী) বলে বোধ হল। সে খুব যত্ন করে আমায় রেঁধে খাবার পাঠিয়ে দিত।

শিষ্য॥ শুনিলাম, নাগ-মহাশয়ের বাড়ী নাকি গিয়াছিলেন?

স্বামীজী॥ হাঁ, অমন মহাপুরুষ! এতদূর গিয়ে তাঁর জন্মস্থান দেখব না? নাগ-মহাশয়ের স্ত্রী আমায় কত রেঁধে খাওয়ালেন! বাড়ীখানি কি মনোরম-যেন শান্তি-আশ্রম! ওখানে গিয়ে এক পুকুরে সাঁতার কেটে নিয়েছিলুম। তারপর, এসে এমন নিদ্রা দিলুম যে বেলা ২॥টা। আমার জীবনে যে-কয় দিন সুনিদ্রা হয়েছে, নাগ-মহাশয়ের বাড়ীর নিদ্রা তার মধ্যে একদিন। তারপর উঠে প্রচুর আহার। নাগ-মহাশয়ের স্ত্রী একখানা কাপড় দিয়েছিলেন। সেইখানি মাথায় বেঁধে ঢাকায় রওনা হলুম। নাগ-মহাশয়ের ফটো পূজা হয় দেখলুম। তাঁর সমাধিস্থানটি বেশ ভাল করে রাখা উচিত। এখনও-যেমন হওয়া উচিত, তেমনটি হয়নি।

শিষ্য॥ মহাশয়, নাগ-মহাশয়কে ও-দেশের লোকে তেমন চিনিতে পারে নাই।

স্বামীজী॥ ও-সব মহাপুরুষকে সাধারণে কি বুঝিবে? যারা তাঁর সঙ্গ পেয়েছে, তারাই ধন্য। শিষ্য॥ কামাখ্যা (আসাম) গিয়া কি দেখিলেন?

স্বামীজী॥ শিলঙ পাহাড়টি অতি সুন্দর। সেখানে চীফ কমিশনার কটন (Sir Henry Cotton) সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন-‘স্বামীজী! ইওরোপ ও আমেরিকা বেড়িয়ে এই দূর পর্বতপ্রান্তে আপনি কি দেখতে এসেছেন?’ কটন সাহেবের মত অমন সদাশয় লোক প্রায় দেখা যায় না। আমার অসুখ শুনে সরকারী ডাক্তার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দুবেলা আমার খবর নিতেন। সেখানে বেশী লেকচার-ফেকচার করতে পারিনি; শরীর বড় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। রাস্তায় নিতাই খুব সেবা করেছিল।

শিষ্য॥ সেখানকার ধর্মভাব কেমন দেখিলেন?

স্বামীজী॥ তন্ত্রপ্রধান দেশ। এক ‘হঙ্কর’দেবের নাম শুনলুম, যিনি ও-অঞ্চলে অবতার বলে পূজিত হন। শুনলুম, তাঁর সম্প্রদায় খুব বিস্তৃত। ঐ ‘হঙ্কর’দেব শঙ্করাচার্যেরই নামান্তর কিনা বুঝতে পারলাম না। ওরা ত্যাগী-বোধ হয়, তান্ত্রিক সন্ন্যাসী কিম্বা শঙ্করাচার্যেরই সম্প্রদায়-বিশেষ।

অতঃপর শিষ্য বলিল, ‘মহাশয়, ও-দেশের লোকেরা বোধ হয় নাগ-মহাশয়ের মত আপনাকেও ঠিক বুঝিতে পারে নাই।’

স্বামীজী॥ আমায় বুঝুক আর নাই বুঝুক-এ অঞ্চলের লোকের চেয়ে কিন্তু তাদের রজোগুণ প্রবল; কালে সেটা আরও বিকাশ হবে। যেরূপ চাল-চলনকে ইদানীং সভ্যতা বা শিষ্টাচার বলা হয়, সেটা এখনও ও-অঞ্চলে ভালরূপে প্রবেশ করেনি। সেটা ক্রমে হবে। সকল সময়ে Capital (রাজধানী) থেকেই ক্রমে প্রদেশসকলে চাল-চলন আদব-কায়দার বিস্তার হয়। ও-দেশেও তাই হচ্ছে। যে দেশে নাগ-মহাশয়ের মত মহাপুরুষ জন্মায়, সে দেশের আবার ভাবনা? তাঁর আলোতেই পূর্ববঙ্গ উজ্জ্বল হয়ে আছে।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, সাধারণ লোক তাঁহাকে তত জানিত না; তিনি বড় গুপ্তভাবে ছিলেন। স্বামীজী॥ ও-দেশে আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বড় গোল করত। বলত-ওটা কেন খাবেন, ওর হাতে কেন খাবেন, ইত্যাদি। তাই বলতে হত-আমি তো সন্ন্যাসী-ফকির লোক, আমার আবার আচার কি? তোদের শাস্ত্রেই না বলছে, ‘চরেন্মাধুকরীং বৃত্তিমপি ম্লেচ্ছকুলাদপি।৭০ তবে অবশ্য বাইরের আচার ভেতরে ধর্মের অনুভূতির জন্য প্রথম প্রথম চাই; শাস্ত্রজ্ঞানটা নিজের জীবনে practical (কার্যকর) করে নেবার জন্য চাই। ঠাকুরের সেই পাঁজি-নেওড়ান জলের কথা৭১ শুনেছিস তো? আচার-বিচার কেবল মানুষের ভেতরের মহা-শক্তিস্ফুরণের উপায় মাত্র। যাতে ভেতরের সেই শক্তি জাগে, যাতে মানুষ তার স্বরূপ ঠিক ঠিক বুঝতে পারে, তাই হচ্ছে সর্বশাস্ত্রের উদ্দেশ্য। উপায়গুলি বিধিনিষেধাত্মক। উদ্দেশ্য হারিয়ে খালি উপায় নিয়ে ঝগড়া করলে কি হবে? যে দেশেই যাই, দেখি উপায় নিয়েই লাঠালাঠি চলেছে। উদ্দেশ্যের দিকে লোকের নজর নেই, ঠাকুর ঐটি দেখাতেই এসেছিলেন। ‘অনুভূতি’ই হচ্ছে সার কথা। হাজার বৎসর গঙ্গাস্নান কর্‌, আর হাজার বৎসর নিরামিষ খা-ওতে যদি আত্মবিকাশের সহায়তা না হয়, তবে জানবি সর্বৈব বৃথা হল। আর আচার-বর্জিত হয়ে যদি কেউ আত্মদর্শন করতে পারে, তবে সেই অনাচারই শ্রেষ্ঠ আচার। তবে আত্মদর্শন হলেও লোকসংস্থিতির জন্য আচার কিছু কিছু মানা ভাল। মোট কথা মনকে একনিষ্ঠ করা চাই। এক বিষয়ে নিষ্ঠা হলে মনের একাগ্রতা হয় অর্থাৎ মনের অন্য বৃত্তিগুলি নিবে গিয়ে এক বিষয়ে একতানতা হয়। অনেকের-বাহ্য আচার বা বিধিনিষেধের জালেই সব সময়টা কেটে যায়, আত্মচিন্তা আর করা হয় না। দিনরাত বিধিনিষেধের গণ্ডীর মধ্যে থাকলে আত্মার প্রসার হবে কি করে? যে যতটা আত্মানুভূতি করতে পেরেছে, তার বিধিনিষেধ ততই কমে যায়। আচার্য শঙ্করও বলেছেন, ‘নিস্ত্রৈগুণ্যে পথি বিচরতাং কো বিধিঃ কো নিষেধঃ?৭২ অতএব মূলকথা হচ্ছে-অনুভূতি। তাই জানবি goal (উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য); মত-পথ, রাস্তা মাত্র। কার কতটা ত্যাগ হয়েছে, এইটি জানবি উন্নতির test (পরীক্ষা), কষ্টিপাথর। কাম-কাঞ্চনের আসক্তি যার মধ্যে দেখবি কমতি, সে যে-মতের যে-পথের লোক হোক না কেন, জানবি তার শক্তি জাগ্রত হচ্ছে, জানবি তার আত্মানুভূতির দোর খুলে গেছে। আর হাজার আচার মেনে চল্‌, হাজার শ্লোক আওড়া, তবু যদি ত্যাগের ভাব না এসে থাকে তো জানবি-জীবন বৃথা। এই অনুভূতিলাভে তৎপর হ, লেগে যা। শাস্ত্র-টাস্ত্র তো ঢের পড়লি। বল দিকি, তাতে হল কি? কেউ টাকার চিন্তা করে ধনকুবের হয়েছে, তুই না হয় শাস্ত্রচিন্তা করে পণ্ডিত হয়েছিস। উভয়ই বন্ধন। পরাবিদ্যালাভে বিদ্যা-অবিদ্যার পারে চলে যা। শিষ্য॥ মহাশয়, আপনার কৃপায় সব বুঝি, কিন্তু কর্মের ফেরে ধারণা করিতে পারি না। স্বামীজী॥ কর্ম-ফর্ম ফেলে দে। তুই-ই পূর্বজন্মে কর্ম করে এই দেহ পেয়েছিস-এ-কথা যদি সত্য হয়, তবে কর্মদ্বারা কর্ম কেটে তুই আবার কেন না এ দেহেই জীবন্মুক্ত হবি? জানবি, মুক্তি বা আত্মজ্ঞান তোর নিজের হাতে রয়েছে। জ্ঞানে কর্মের লেশমাত্র নেই। তবে যারা জীবন্মুক্ত হয়েও কাজ করে, তারা জানবি-‘পরহিতায়’ কর্ম করে। তারা ভাল-মন্দ ফলের দিকে চায় না, কোন বাসনা-বীজ তাদের মনে স্থান পায় না। সংসারাশ্রমে থেকে ঐরূপ যথার্থ ‘পরহিতায়’ কর্ম করা একপ্রকার অসম্ভব-জানবি। সমগ্র হিন্দুশাস্ত্রে ঐ-বিষয়ে এক জনক রাজার নামই আছে। তোরা কিন্তু এখন বছর বছর ছেলে জন্ম দিয়ে ঘরে ঘরে ‘জনক’ হতে চাস।

শিষ্য॥ আপনি কৃপা করুন, যাহাতে আত্মানুভূতিলাভ এ শরীরেই হয়।

স্বামীজী॥ ভয় কি? মনের ঐকান্তিকতা থাকলে, আমি নিশ্চয় বলছি, এ জন্মেই হবে; তবে পুরুষকার চাই। পুরুষকার কি জানিস? আত্মজ্ঞান লাভ করবই করব, এতে যে বাধাবিপদ সামনে পড়ে, তা কাটাবই কাটাব-এইরূপ দৃঢ় সংকল্প। মা-বাবা, ভাই-বন্ধু, স্ত্রী-পুত্র মরে মরুক, এ দেহ থাকে থাক, যায় যাক, আমি কিছুতেই ফিরে চাইব না, যতক্ষণ না আমার আত্মদর্শন ঘটে-এইরূপে সকল বিষয়ে উপেক্ষা করে একমনে নিজের goal (লক্ষ্য)-এর দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টার নামই পুরুষকার। নতুবা অন্য পুরুষকার তো পশু-পক্ষীরাও করছে। মানুষ এ দেহ পেয়েছে কেবলমাত্র সেই আত্মজ্ঞান-লাভের জন্য। সংসারে সকলে যে-পথে যাচ্ছে, তুইও কি সেই স্রোতে গা ঢেলে চলে যাবি? তবে আর তোর পুরুষকার কি? সকলে তো মরতে বসেছে! তুই যে মৃত্যু জয় করতে এসেছিস। মহাবীরের মত অগ্রসর হ। কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ করবিনি। ক-দিনের জন্যই বা শরীর? ক-দিনের জন্যই বা সুখ-দুঃখ? যদি মানবদেহই পেয়েছিস, তবে ভেতরের আত্মাকে জাগা আর বল-আমি অভয়-পদ পেয়েছি। বল-আমি সেই আত্মা, যাতে আমার কাঁচা আমিত্ব ডুবে গেছে। এই ভাবে সিদ্ধ হয়ে যা; তারপর যতদিন দেহ থাকে, ততদিন অপরকে এই মহাবীর্যপ্রদ নির্ভয় বাণী শোনা-‘তত্ত্বমসি’, ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।’ এটি হলে তবে জানব যে তুই যথার্থই একগুঁয়ে বাঙাল।

৩৫
স্থান-বেলুড় মঠ
কাল-(জুন), ১৯০১

শনিবার বৈকালে শিষ্য মঠে আসিয়াছে। স্বামীজীর শরীর তত সুস্থ নহে, শিলঙ পাহাড় হইতে অসুস্থ হইয়া অল্প দিন হইল প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। তাঁহার পা ফুলিয়াছে, সমস্ত শরীরেই যেন জলসঞ্চার হইয়াছে; গুরুভ্রাতাগণ সেই জন্য বড়ই চিন্তিত। স্বামীজী কবিরাজী ঔষধ খাইতে স্বীকৃত হইয়াছেন। আগামী মঙ্গলবার হইতে নুন ও জল বন্ধ করিয়া ‘বাঁধা’ ঔষধ খাইতে হইবে। আজ রবিবার।

শিষ্য॥ মহাশয়, এই দারুণ গ্রীষ্মকাল! তাহাতে আবার আপনি ঘণ্টায় ৪।৫ বার করিয়া জল পান করেন, এ সময়ে জল বন্ধ করিয়া ঔষধ খাওয়া আপনার অসহ্য হইবে। স্বামীজী॥ তুই কি বলছিস? ঔষধ খাওয়ার দিন প্রাতে ‘আর জলপান করব না’ বলে দৃঢ় সংকল্প করব, তারপর সাধ্যি কি জল আর কণ্ঠের নীচে নাবেন! তখন একুশ দিন জল আর নীচে নাবতে পারছেন না। শরীরটা তো মনেরই খোলস। মন যা বলবে, সেইমত তো ওকে চলতে হবে, তবে আর কি? নিরঞ্জনের অনুরোধে আমাকে এটা করতে হল, ওদের (গুরুভ্রাতাদের) অনুরোধ তো আর উপেক্ষা করতে পারিনে।

বেলা প্রায় ১০টা। স্বামীজী উপরেই বসিয়া আছেন। শিষ্যের সঙ্গে প্রসন্নবদনে মেয়েদের জন্য যে ভাবী মঠ করিবেন, সে বিষয়ে বলিতেছেনঃ

মাকে কেন্দ্র করে গঙ্গার পূর্বতটে মেয়েদের জন্য একটি মঠ স্থাপন করতে হবে। এ মঠে যেমন ব্রহ্মচারী সাধু-সব তৈরী হবে, ওপারে মেয়েদের মঠেও তেমনি ব্রহ্মচারিণী সাধ্বী-সব তৈরী হবে।

শিষ্য॥ মহাশয়, ভারতবর্ষে বহু পূর্বকালে মেয়েদের জন্য তো কোন মঠের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বৌদ্ধযোগেই স্ত্রী-মঠের কথা শুনা যায়। কিন্তু উহা হইতে কালে নানা ব্যভিচার আসিয়া পড়িয়াছিল, ঘোর বামাচারে দেশ পর্যুদস্ত হইয়া গিয়াছিল। স্বামীজী॥ এদেশে পুরুষ-মেয়েতে এতটা তফাত কেন যে করেছে, তা বোঝা কঠিন। বেদান্তশাস্ত্রে তো বলেছে, একই চিৎসত্তা সর্বভূতে বিরাজ করছেন। তোরা মেয়েদের নিন্দাই করিস, কিন্তু তাদের উন্নতির জন্য কি করেছিস বল দেখি? স্মৃতি-ফৃতি লিখে, নিয়ম-নীতিতে বদ্ধ করে এদেশের পুরুষেরা মেয়েদের একেবারে manufacturing machine (উৎপাদনের যন্ত্র) করে তুলেছে! মহামায়ার সাক্ষাৎ প্রতিমা এইসব মেয়েদের এখন না তুললে বুঝি তোদের আর উপায়ান্তর আছে?

শিষ্য॥ মহাশয়, স্ত্রীজাতি সাক্ষাৎ মায়ার মূর্তি। মানুষের অধঃপতনের জন্য যেন উহাদের সৃষ্টি হইয়াছে। স্ত্রী জাতিই মায়া দ্বারা মানবের জ্ঞান-বৈরাগ্য আবরিত করিয়া দেয়। সেইজন্যই বোধ হয় শাস্ত্রকার বলিয়াছেন, উহাদের জ্ঞানভক্তি কখনও হইবে না। স্বামীজী॥ কোন্ শাস্ত্রে এমন কথা আছে যে, মেয়েরা জ্ঞান-ভক্তির অধিকারিণী হবে না? ভারতের অধঃপতন হল ভট্‌চায-বামুনরা ব্রাহ্মণেতর জাতকে যখন বেদপাঠের অনধিকারী বলে নির্দেশ করলে, সেই সময়ে মেয়েদেরও সকল অধিকার কেড়ে নিলে। নতুবা বৈদিক যুগে, উপনিষদের যুগে দেখতে পাবি মৈত্রেয়ী গার্গী প্রভৃতি প্রাতঃ স্মরণীয়া মেয়েরা ব্রহ্মবিচারে ঋষিস্থানীয়া হয়ে রয়েছেন। হাজার বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সভায় গার্গী সগর্বে যাজ্ঞবল্ক্যকে ব্রহ্মবিচারে আহ্বান করেছিলেন। এ-সব আদর্শস্থানীয়া মেয়েদের যখন অধ্যাত্মজ্ঞানে অধিকার ছিল, তখন মেয়েদের সে অধিকার এখনই বা থাকবে না কেন? একবার যা ঘটেছে, তা আবার অবশ্য ঘটতে পারে। History repeats itself (ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়)। মেয়েদের পূজা করেই সব জাত বড় হয়েছে। যে-দেশে, যে-জাতে মেয়েদের পূজা নেই, সে-দেশ-সে-জাত কখনও বড় হতে পারেনি, কস্মিন্‌ কালে পারবেও না। তোদের জাতের যে এত অধঃপতন ঘটেছে, তার প্রধান কারণ এইসব শক্তিমূর্তির অবমাননা করা। মনু বলেছেন, ‘যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ॥’৭৩ যেখানে স্ত্রীলোকের আদর নেই, স্ত্রীলোকেরা নিরানন্দে অবস্থান করে, সে সংসারের-সে দেশের কখনও উন্নতির আশা নেই। এ-জন্য এদের আগে তুলতে হবে-এদের জন্য আদর্শ মঠ স্থাপন করতে হবে।

শিষ্য॥ মহাশয়, প্রথমবার বিলাত হইতে আসিয়া আপনি ষ্টার থিয়েটারে বক্তৃতা দিবার কালে তন্ত্রকে কত গালমন্দ করিয়াছিলেন। এখন আবার তন্ত্র-সমর্থিত স্ত্রী-পূজার সমর্থন করিয়া নিজের কথা নিজেই যে বদলাইতেছেন।

স্বামীজী॥ তন্ত্রের বামাচার-মতটা পরিবর্তিত হয়ে এখন যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমি তারই নিন্দা করেছিলুম। তন্ত্রোক্ত মাতৃভাবের অথবা ঠিক ঠিক বামাচারেরও নিন্দা করিনি। ভগবতীজ্ঞানে মেয়েদের পূজা করাই তন্ত্রের অভিপ্রায়। বৌদ্ধধর্মের অধঃপতনের সময় বামাচারটা ঘোর দূষিত হয়ে উঠেছিল, সেই দূষিত ভাবটা এখনকার বামাচারে এখনও রয়েছে; এখনও ভারতের তন্ত্রশাস্ত্র ঐ ভাবের দ্বারা influenced (প্রভাবিত) হয়ে রয়েছে। ঐ সকল বীভৎস প্রথারই আমি নিন্দা করেছিলুম-এখনও তো তা করি। যে মহামায়ার রূপরসাত্মক বাহ্যবিকাশ মানুষকে উন্মাদ করে রেখেছে, তাঁরই জ্ঞান-ভক্তি-বিবেক-বৈরাগ্যাদি আন্তরবিকাশে আবার মানুষকে সর্বজ্ঞ সিদ্ধসঙ্কল্প ব্রহ্মজ্ঞ করে দিচ্ছে-সেই মাতৃরূপিণী, স্ফুরদ্বিগ্রহস্বরূপিণী মেয়েদের পূজা করতে আমি কখনই নিষেধ করিনি। ‘সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে’৭৪-এই মহামায়াকে পূজা প্রণতি দ্বারা প্রসন্না না করতে পারলে সাধ্য কি, ব্রহ্মা বিষ্ণু পর্যন্ত তাঁর হাত ছাড়িয়ে মুক্ত হন? গৃহলক্ষ্মীগণের পূজাকল্পে-তাদের মধ্যে ব্রহ্মবিদ্যাবিকাশকল্পে মেয়েদের মঠ করে যাব।

শিষ্য॥ আপনার উহা উত্তম সঙ্কল্প হইতে পারে, কিন্তু মেয়ে কোথায় পাইবেন? সমাজের কঠিন বন্ধনে কে কুলবধূদের স্ত্রী-মঠে যাইতে অনুমতি দিবে?

স্বামীজী॥ কেন রে? এখনও ঠাকুরের কত ভক্তিমতী মেয়েরা রয়েছেন। তাঁদের দিয়ে স্ত্রী-মঠ start (আরম্ভ) করে দিয়ে যাব। শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণী তাঁদের central figure (কেন্দ্রস্বরূপা) হয়ে বসবেন। আর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্তদের স্ত্রী-কন্যারা ওখানে প্রথমে বাস করবে। কারণ, তারা ঐরূপ স্ত্রী-মঠের উপকারিতা সহজেই বুঝতে পারবে। তারপর তাদের দেখাদেখি কত গেরস্ত এই মহাকার্যে সহায় হবে।

শিষ্য॥ ঠাকুরের ভক্তেরা এ কার্যে অবশ্যই যোগ দিবেন। কিন্তু সাধারণ লোকে এ কার্যে সহায় হইবে বলিয়া মনে হয় না।

স্বামীজী॥ জগতের কোন মহৎ কাজই sacrifice (ত্যাগ) ভিন্ন হয়নি। বটগাছের অঙ্কুর দেখে কে মনে করতে পারে-কালে উহা প্রকাণ্ড বটগাছ হবে? এখন তো এইভাবে মঠস্থাপন করব। পরে দেখবি, এক, আধ generation (পুরুষ) বাদে ঐ মঠের কদর দেশের লোক বুঝতে পারবে। এই যে বিদেশী মেয়েরা আমার চেলী হয়েছে, এরাই এ-কাজে জীবনপাত করে যাবে। তোরা ভয় কাপুরুষতা ছেড়ে এই মহৎ কাজে সহায় হ। আর এই উচ্চ ideal (আদর্শ) সকল লোকের সামনে ধর। দেখবি, কালে এর প্রভায় দেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। শিষ্য॥ মহাশয়, মেয়েদের জন্য কিরূপ মঠ করিতে চাহেন, তাহার সবিশেষ বিবরণ আমাকে বলুন। শুনিবার বড়ই উৎসাহ হইতেছে।

স্বামীজী॥ গঙ্গার ওপারে একটা প্রকাণ্ড জমি নেওয়া হবে। তাতে অবিবাহিতা কুমারীরা থাকবে, আর বিধবা ব্রহ্মচারিণীরা থাকবে। আর ভক্তিমতী গেরস্তের মেয়েরা মধ্যে মধ্যে এসে অবস্থান করতে পাবে। এ মঠে পুরুষদের কোনরূপ সংস্রব থাকবে না। পুরুষ-মঠের বয়োবৃদ্ধ সাধুরা দূরে থেকে স্ত্রী-মঠের কার্যভার চালাবে। স্ত্রী-মঠে মেয়েদের একটি স্কুল থাকবে; তাতে ধর্মশাস্ত্র, সাহিত্য, সংস্কৃত, ব্যাকরণ, চাই কি-অল্প-বিস্তর ইংরেজীও শিক্ষা দেওয়া হবে। সেলাইয়ের কাজ, রান্না, গৃহকর্মের যাবতীয় বিধান এবং শিশুপালনের স্থূল বিষয়গুলিও শেখান হবে। আর জপ, ধ্যান, পূজা এ-সব তো শিক্ষার অঙ্গ থাকবেই। যারা বাড়ী ছেড়ে একেবারে এখানে থাকতে পারবে, তাদের অন্নবস্ত্র এই মঠ থেকে দেওয়া হবে। যারা তা পারবে না, তারা এই মঠে দৈনিক ছাত্রী-রূপে এসে পড়াশুনা করতে পারবে। চাই কি, মঠাধ্যক্ষের অভিমতে মধ্যে মধ্যে এখানে থাকতে এবং যতদিন থাকবে খেতেও পাবে। মেয়েদের ব্রহ্মচর্যকল্পে এই মঠে বয়োবৃদ্ধা ব্রহ্মচারিণীরা ছাত্রীদের শিক্ষার ভার নেবে। এই মঠে ৫।৭ বৎসর শিক্ষার পর মেয়েদের অভিভাবকেরা তাদের বিয়ে দিতে পারবে। যোগ্যাধিকারিণী বলে বিবেচিত হলে অভিভাবকদের মত নিয়ে ছাত্রীরা এখানে চিরকুমারী-ব্রতাবলম্বনে অবস্থান করতে পারবে। যারা চিরকুমারীব্রত অবলম্বন করবে, তারাই কালে এই মঠের শিক্ষয়িত্রী ও প্রচারিকা হয়ে দাঁড়াবে এবং গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে centres (শিক্ষকেন্দ্র) খুলে মেয়েদের শিক্ষাবিস্তারে যত্ন করবে। চরিত্রবতী, ধর্মভাবাপন্না ঐরূপ প্রচারিকাদের দ্বারা দেশে যথার্থ স্ত্রী-শিক্ষার বিস্তার হবে। ধর্মপরায়ণতা, ত্যাগ ও সংযম এখানকার ছাত্রীদের অলঙ্কার হবে; আর সেবাধর্ম তাদের জীবনব্রত হবে। এইরূপ আদর্শ জীবন দেখলে কে তাদের না সম্মান করবে-কেই বা তাদের অবিশ্বাস করবে? দেশের স্ত্রীলোকদের জীবন এইভাবে গঠিত হলে তবে তো তোদের দেশে সীতা সাবিত্রী গার্গীর আবার অভ্যুত্থান হবে। দেশাচারের ঘোর বন্ধনে প্রাণহীন স্পন্দনহীন হয়ে তোদের মেয়েরা এখন কি যে হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা একবার পাশ্চাত্য দেশ দেখে এলে বুঝতে পারতিস। মেয়েদের ঐ দুর্দশার জন্য তোরাই দায়ী। আবার দেশের মেয়েদের পুনরায় জাগিয়ে তোলাও তোদের হাতে রয়েছে। তাই বলছি, কাজে লেগে যা। কি হবে ছাই শুধু কতকগুলো বেদবেদান্ত মুখস্থ করে?

শিষ্য॥ মহাশয়, এখানে শিক্ষালাভ করিয়াও যদি মেয়েরা বিবাহ করে, তবে আর তাহাদের ভিতর আদর্শ জীবন কেমন করিয়া লোকে দেখিতে পাইবে? এমন নিয়ম হইলে ভাল হয় না কি যে, যাহারা এই মঠে শিক্ষালাভ করিবে, তাহারা আর বিবাহ করিতে পারিবে না? স্বামীজী॥ তা কি একেবারেই হয় রে? শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে। তারপর নিজেরাই ভেবে চিন্তে যা হয় করবে। বে করে সংসারী হলেও ঐরূপে শিক্ষিতা মেয়েরা নিজ নিজ পতিকে উচ্চ ভাবের প্রেরণা দেবে এবং বীর পুত্রের জননী হবে। কিন্তু স্ত্রী-মঠের ছাত্রীদের অভিভাবকেরা ১৫ বৎসরের পূর্বে তাদের বে দেবার নামগন্ধ করতে পারবে না-এ নিয়ম রাখতে হবে।

শিষ্য॥ মহাশয়, তাহা হইলে সমাজে ঐ-সকল মেয়েদের কলঙ্ক রটিবে। কেহই তাহাদের আর বিবাহ করিতে চাহিবে না।

স্বামীজী॥ কেন চাইবে না? তুই সমাজের গতি এখনও বুঝতে পারিসনি। এই সব বিদুষী ও কর্মতৎপরা মেয়েদের বরের অভাব হবে না। ‘দশমে কন্যকাপ্রাপ্তিঃ’-সে-সব বচনে এখন সমাজ চলছে না, চলবেও না। এখনি দেখতে পাচ্ছিসনে?

শিষ্য॥ যাহাই বলুন, কিন্তু প্রথম প্রথম ইহার বিরুদ্ধে একটা ঘোরতর আন্দোলন হইবে। স্বামীজী॥ তা হোক না; তাতে ভয় কি? সৎসাহসে অনুষ্ঠিত সৎকাজে বাধা পেলে অনুষ্ঠাতাদের শক্তি আরও জেগে উঠবে। যাতে বাধা নেই, প্রতিকূলতা নেই, তা মানুষকে মৃত্যুপথে নিয়ে যায়। Struggle (বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করবার চেষ্টাই) জীবনের চিহ্ন। বুঝেছিস?

শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ।

স্বামীজী॥ পরমব্রহ্মতত্ত্বে লিঙ্গভেদ নেই। আমরা ‘আমি-তুমি’র plane-এ (ভূমিতে) লিঙ্গভেদটা দেখতে পাই; আবার মন যত অন্তর্মুখ হতে থাকে, ততই ঐ ভেদজ্ঞানটা চলে যায়। শেষে মন যখন সমরস ব্রহ্মতত্ত্বে ডুবে যায়, তখন আর ‘এ স্ত্রী, ও পুরুষ’-এই জ্ঞান একেবারেই থাকে না। আমরা ঠাকুরে ঐরূপ প্রত্যক্ষ দেখেছি। তাই বলি, মেয়ে-পুরুষে বাহ্য ভেদ থাকলেও স্বরূপতঃ কোন ভেদ নেই। অতএব পুরুষ যদি ব্রহ্মজ্ঞ হতে পারে তো মেয়েরা তা হতে পারবে না কেন? তাই বলছিলুম-মেয়েদের মধ্যে একজনও যদি কালে ব্রহ্মজ্ঞ হন, তবে তাঁর প্রতিভায় হাজারও মেয়ে জেগে উঠবে এবং দেশের ও সমাজের কল্যাণ হবে। বুঝলি?

শিষ্য॥ মহাশয়, আপনার উপদেশে আজ আমার চক্ষু খুলিয়া গেল।

স্বামীজী॥ এখনি কি খুলেছে? যখন সর্বাবভাসক আত্মতত্ত্ব প্রত্যক্ষ করবি, তখন দেখবি-এই স্ত্রী-পুরুষ-ভেদজ্ঞান একেবারে লুপ্ত হবে; তখনই মেয়েদের ব্রহ্মরূপিণী বলে বোধ হবে। ঠাকুরকে দেখেছি, স্ত্রীমাত্রেই মাতৃভাব-তা যে-জাতির যেরূপ স্ত্রীলোকই হোক না কেন। দেখেছি কিনা!-তাই এত করে তোদের ঐরূপ করতে বলি এবং মেয়েদের জন্য গ্রামে পাঠশালা খুলে তাদের মানুষ করতে বলি। মেয়েরা মানুষ হলে তবে তো কালে তাদের সন্তান-সন্ততির দ্বারা দেশের মুখ উজ্জ্বল হবে-বিদ্যা, জ্ঞান, শক্তি, ভক্তি দেশে জেগে উঠবে। শিষ্য॥ আধুনিক শিক্ষায় কিন্তু মহাশয়, বিপরীত ফল ফলিতেছে বলিয়া বোধ হয়। মেয়েরা একটু-আধটু পড়িতে ও সেমিজ-গাউন পরিতেই শিখিতেছে, কিন্তু ত্যাগ-সংযম-তপস্যা-ব্রহ্মচর্যাদি ব্রহ্মবিদ্যালাভের উপযোগী বিষয়ে কতটা উন্নত যে হইতেছে, তাহা বুঝিতে পারা যাইতেছে না।

স্বামীজী॥ প্রথম প্রথম অমনটা হয়ে থাকে। দেশে নূতন idea-র (ভাবের) প্রথম প্রচারকালে কতকগুলি লোক ঐ ভাব ঠিক ঠিক গ্রহণ করতে না পেরে অমন খারাপ হয়ে যায়। তাতে বিরাট সমাজের কি আসে যায়? কিন্তু যারা অধুনা প্রচলিত যৎসামান্য স্ত্রীশিক্ষার জন্যও প্রথম উদ্যোগী হয়েছিলেন, তাঁদের মহাপ্রাণতায় কি সন্দেহ আছে? তবে কি জানিস, শিক্ষাই বলিস আর দীক্ষাই বলিস, ধর্মহীন হলে তাতে গলদ থাকবেই থাকবে। এখন ধর্মকে centre (কেন্দ্র) করে রেখে স্ত্রীশিক্ষার প্রচার করতে হবে। ধর্ম ভিন্ন অন্য শিক্ষাটা secondary (গৌণ) হবে। ধর্মশিক্ষা, চরিত্রগঠন, ব্রহ্মচর্যব্রত-উদ‍্‍যাপন-এজন্য শিক্ষার দরকার। বর্তমানকালে এ পর্যন্ত ভারতে যে স্ত্রীশিক্ষার প্রচার হয়েছে, তাতে ধর্মটাকেই secondary (গৌণ) করে রাখা হয়েছে, তাইতেই তুই যে-সব দোষের কথা বললি, সেগুলি হয়েছে। কিন্তু তাতে স্ত্রীলোকদের কি দোষ বল? সংস্কারকেরা নিজে ব্রহ্মজ্ঞ না হয়ে স্ত্রীশিক্ষা দিতে অগ্রসর হওয়াতেই তাদের অমন বে-চালে পা পড়েছে। সকল সৎকার্যের প্রবর্তকেরই অভীপ্সিত কার্যানুষ্ঠানের পূর্বে কঠোর তপস্যাসহায়ে আত্মজ্ঞ হওয়া চাই। নতুবা তার কাজে গলদ বেরোবেই। বুঝলি? শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ। দেখিতে পাওয়া যায়, অনেক শিক্ষিতা মেয়েরা কেবল নভেল-নাটক পড়িয়াই সময় কাটায়; পূর্ববঙ্গে কিন্তু মেয়েরা শিক্ষিতা হইয়াও নানা ব্রতের অনুষ্ঠান করে। এদেশে ঐরূপ করে কি?

স্বামীজী॥ ভাল-মন্দ সব দেশে সব জাতের ভেতর রয়েছে। আমাদের কাজ হচ্ছে-নিজের জীবনে ভাল কাজ করে লোকের সামনে example (দৃষ্টান্ত) ধরা। Condemn (নিন্দাবাদ) করে কোন কাজ সফল হয় না। কেবল লোক হটে যায়। যে যা বলে বলুক, কাকেও contradict (অস্বীকার) করবিনি। এই মায়ার জগতে যা করতে যাবি, তাইতেই দোষ থাকবে। ‘সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ’৭৫ -আগুন থাকলেই ধূম উঠবে। কিন্তু তাই বলে কি নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতে হবে? যতটা পারিস, ভাল কাজ করে যেতে হবে।

শিষ্য॥ ভাল কাজটা কি?

স্বামীজী॥ যাতে ব্রহ্মবিকাশের সাহায্য করে, তাই ভাল কাজ। সব কাজই প্রত্যক্ষ না হোক, পরোক্ষভাবে আত্মতত্ত্ব-বিকাশের সহায়কারী ভাবে করা যায়। তবে ঋষিপ্রচলিত পথে চললে ঐ আত্মজ্ঞান শীগগীর ফুটে বেরোয়। আর যাকে শাস্ত্রকারগণ অন্যায় বলে নির্দেশ করেছেন, সেগুলি করলে আত্মার বন্ধন ঘটে, কখনও কখনও জন্মজন্মান্তরেও সেই মোহবন্ধন ঘোচে না। কিন্তু সর্বদেশে সর্বকালেই জীবের মুক্তি অবশ্যম্ভাবী। কারণ আত্মাই জীবের প্রকৃত স্বরূপ। নিজের স্বরূপ নিজে কি ছাড়তে পারে? তোর ছায়ার সঙ্গে তুই হাজার বৎসর লড়াই করেও ছায়াকে কি তাড়াতে পারিস? সে তোর সঙ্গে থাকবেই।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, আচার্য শঙ্করের মতে কর্ম জ্ঞানের পরিপন্থী-জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়কে তিনি বহুধা খণ্ডন করিয়াছেন। অতএব কর্ম কেমন করিয়া জ্ঞানের প্রকাশক হইবে? স্বামীজী॥ আচার্য শঙ্কর ঐরূপ বলে আবার জ্ঞানবিকাশকল্পে কর্মকে আপেক্ষিক সহায়কারী এবং সত্ত্বশুদ্ধির উপায় বলে নির্দেশ করেছেন। তবে শুদ্ধ জ্ঞানে কর্মের অনুপ্রবেশ নেই-ভাষ্যকারের এ সিদ্ধান্তের আমি প্রতিবাদ করছি না। ক্রিয়া, কর্তা ও কর্ম-বোধ যতকাল মানুষের থাকবে, ততকাল সাধ্য কি-সে কাজ না করে বসে থাকে? অতএব কর্মই যখন জীবের স্বভাব হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন যে-সব কর্ম এই আত্মজ্ঞানবিকাশকল্পে সহায়ক হয়, সেগুলি কেন করে যা না? কর্মমাত্রই ভ্রমাত্মক-এ-কথা পারমার্থিকরূপে যথার্থ হলেও ব্যবহারে কর্মের বিশেষ উপযোগিতা আছে। তুই যখন আত্মতত্ত্ব প্রত্যক্ষ করবি, তখন কর্ম করা বা না করা তোর ইচ্ছাধীন হয়ে দাঁড়াবে। সেই অবস্থায় তুই যা করবি, তাই সৎ কর্ম হবে; তাতে জীবের-জগতের কল্যাণ হবে। ব্রহ্মবিকাশ হলে তোর শ্বাসপ্রশ্বাসের তরঙ্গ পর্যন্ত জীবের সহায়কারী হবে। তখন আর plan (মতলব) এঁটে কর্ম করতে হবে না। বুঝলি?

শিষ্য॥ আহা, ইহা বেদান্তের কর্ম ও জ্ঞানের সমন্বয়কারী অতি সুন্দর মীমাংসা।

অনন্তর নীচে প্রসাদ পাইবার ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল এবং স্বামীজী শিষ্যকে প্রসাদ পাইবার জন্য যাইতে বলিলেন। শিষ্যও যাইবার পূর্বে স্বামীজীর পাদপদ্মে প্রণত হইয়া করজোড়ে বলিল, ‘মহাশয়, আপনার স্নেহশীর্বাদে আমার যেন এ জন্মেই ব্রহ্মজ্ঞান অপরোক্ষ হয়।’ শিষ্যের মস্তকে হাত দিয়া স্বামীজী বলিলেনঃ ভয় কি বাবা? তোরা কি আর এ জগতের লোক-না গেরস্ত, না সন্ন্যাসী! এই এক নূতন ঢঙ।

৩৬
স্থান-বেলুড় মঠ
কাল-(জুন?), ১৯০১

স্বামীজীর শরীর অসুস্থ। আজ ৫।৭ দিন যাবৎ স্বামীজী কবিরাজী ঔষধ খাইতেছেন। এই ঔষধে জলপান একেবারে নিষিদ্ধ। দুগ্ধমাত্র পান করিয়া তৃষ্ণা নিবারণ করিতে হইতেছে। শিষ্য প্রাতেই মঠে আসিয়াছে। আসিবার কালে একটা রুই মাছ ঠাকুরের ভোগের জন্য আনিয়াছে। মাছ দেখিয়া স্বামী প্রেমানন্দ তাহাকে বলিলেন, ‘আজও মাছ আনতে হয়? একে আজ রবিবার, তার উপর স্বামীজী অসুস্থ-শুধু দুধ খেয়ে আজ ৫।৭ দিন আছেন।’ শিষ্য অপ্রস্তুত হইয়া নীচে মাছ ফেলিয়া স্বামীজীর পাদপদ্ম-দর্শনমানসে উপরে গেল। শিষ্যকে দেখিয়া স্বামীজী সস্নেহে বলিলেন, ‘এসেছিস? ভালই হয়েছে; তোর কথাই ভাবছিলুম।’

শিষ্য॥ শুনিলাম, শুধু দুধমাত্র পান করিয়া নাকি আজ পাঁচ-সাত দিন আছেন?

স্বামীজী॥ হাঁ, নিরঞ্জনের একান্ত অনুরোধে কবিরাজী ঔষধ খেতে হল। ওদের কথা তো এড়াতে পারিনে।

শিষ্য॥ আপনি তো ঘণ্টায় পাঁচ-ছয় বার জলপান করিতেন। কেমন করিয়া একেবারে উহা ত্যাগ করিলেন? স্বামীজী॥ যখন শুনলুম এই ঔষধ খেলে জল খেতে পাব না, তখনি দৃঢ় সঙ্কল্প করলুম-জল খাব না। এখন আর জলের কথা মনেও আসে না।

শিষ্য॥ ঔষধে রোগের উপশম হইতেছে তো?

স্বামীজী॥ উপকার অপকার-জানিনে। গুরুভাইদের আজ্ঞাপালন করে যাচ্ছি।

শিষ্য॥ দেশী কবিরাজী ঔষধ বোধ হয় আমাদের শরীরের পক্ষে সমধিক উপযোগী।

স্বামীজী॥ আমার মত কিন্তু একজন scientific (বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানবিশারদ) চিকিৎসকের হাতে মরাও ভাল; layman (হাতুড়ে)-যারা বর্তমান science (বিজ্ঞান)-এর কিছুই জানে না, কেবল সেকেলে পাঁজিপুঁথির দোহাই দিয়ে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছে, তারা যদি দু-চারটে রোগী আরাম করেও থাকে, তবু তাদের হাতে আরোগ্যলাভ আশা করা কিছু নয়। এইরূপ কথাবার্তা চলিয়াছে, এমন সময় স্বামী প্রেমানন্দ স্বামীজীর কাছে আসিয়া বলিলেন যে, শিষ্য ঠাকুরের ভোগের জন্য একটা বড় মাছ আনিয়াছে, কিন্তু আজ রবিবার, কি করা যাইবে। স্বামীজী বলিলেন, ‘চল, কেমন মাছ দেখব।’

অনন্তর স্বামীজী একটা গরম জামা পরিলেন এবং দীর্ঘ একগাছা যষ্টি হাতে লইয়া ধীরে ধীরে নীচের তলায় আসিলেন। মাছ দেখিয়া স্বামীজী আনন্দ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, ‘আজই ভাল করে মাছ রেঁধে ঠাকুরকে ভোগ দে।’ স্বামী প্রেমানন্দ বলিলেন, ‘রবিবারে ঠাকুরকে মাছ দেওয়া হয় না যে।’ তদুত্তরে স্বামীজী বলিলেন, ‘ভক্তের আনীত দ্রব্য শনিবার-রবিবার নেই। ভোগ দিগে যা।’ স্বামী প্রেমানন্দ আর আপত্তি না করিয়া স্বামীজীর আজ্ঞা শিরোধার্য করিলেন এবং সেদিন রবিবার সত্ত্বেও ঠাকুরকে মৎস্যভোগ দেওয়া স্থির হইল।

মাছ কাটা হইলে ঠাকুরের ভোগের জন্য অগ্রভাগ রাখিয়া দিয়া স্বামীজী ইংরেজী ধরনে রাঁধিবেন বলিয়া কতকটা মাছ নিজে চাহিয়া লইলেন এবং আগুনের তাতে পিপাসার বৃদ্ধি হইবে বলিয়া মঠের সকলে তাঁহাকে রাঁধিবার সঙ্কল্প ত্যাগ করিতে অনুরোধ করিলেও কোন কথা না শুনিয়া দুধ ভারমিসেলি দধি প্রভৃতি দিয়া চার-পাঁচ প্রকারে ঐ মাছ রাঁধিয়া ফেলিলেন। প্রসাদ পাইবার সময় স্বামীজী ঐ-সকল মাছের তরকারি আনিয়া শিষ্যকে বলিলেন, ‘বাঙাল মৎস্যপ্রিয়। দেখ দেখি কেমন রান্না হয়েছে।’ ঐ কথা বলিয়া তিনি ঐ-সকল ব্যঞ্জনের বিন্দু বিন্দু মাত্র নিজে গ্রহণ করিয়া শিষ্যকে স্বয়ং পরিবেশন করিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে স্বামীজী জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কেমন হয়েছে?’ শিষ্য বলিল, ‘এমন কখনও খাই নাই।’ তাহার প্রতি স্বামীজীর অপার দয়ার কথা স্মরণ করিয়াই তখন তাহার প্রাণ পূর্ণ! ভারমিসেলি (vermicelli) শিষ্য ইহজন্মে খায় নাই। ইহা কি পদার্থ জানিবার জন্য জিজ্ঞাসা করায় স্বামীজী বলিলেন, ‘ওগুলি বিলিতী কেঁচো। আমি লণ্ডন থেকে শুকিয়ে এনেছি।’ মঠের সন্ন্যাসিগণ সকলে হাসিয়া উঠিলেন; শিষ্য রহস্য বুঝিতে না পারিয়া অপ্রতিভ হইয়া বসিয়া রহিল।

কবিরাজী ঔষধের কঠোর নিয়ম পালন করিতে যাইয়া স্বামীজীর এখন আহার নাই এবং নিদ্রাদেবী তাঁহাকে বহুকাল হইল একরূপ ত্যাগই করিয়াছেন, কিন্তু এই অনাহার-অনিদ্রাতেও স্বামীজীর শ্রমের বিরাম নাই। কয়েক দিন হইল মঠে নূতন Encyclopaedia Britannica (এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা) ক্রয় করা হইয়াছে। নূতন ঝকঝকে বইগুলি দেখিয়া শিষ্য স্বামীজীকে বলিল, ‘এত বই এক জীবনে পড়া দুর্ঘট।’ শিষ্য তখন জানে না যে, স্বামীজী ঐ বইগুলির দশ খণ্ড ইতোমধ্যে পড়িয়া শেষ করিয়া একাদশ খণ্ডখানি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছেন।

স্বামীজী॥ কি বলছিস? এই দশখানি বই থেকে আমায় যা ইচ্ছা জিজ্ঞাসা কর-সব বলে দেব। শিষ্য॥ (অবাক হইয়া) আপনি কি এই বইগুলি সব পড়িয়াছেন?

স্বামীজী॥ না পড়লে কি বলছি?

অনন্তর স্বামীজীর আদেশ পাইয়া শিষ্য ঐ-সকল পুস্তক হইতে বাছিয়া বাছিয়া কঠিন কঠিন বিষয়সকল জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। আশ্চর্যের বিষয়, স্বামীজী ঐ বিষয়গুলির পুস্তকে নিবদ্ধ মর্ম তো বলিলেনই, তাহার উপর স্থানে স্থানে ঐ পুস্তকের ভাষা পর্যন্ত উদ্ধৃত করিয়া বলিতে লাগিলেন! শিষ্য ঐ বৃহৎ দশ খণ্ড পুস্তকের প্রত্যেকখানি হইতেই দুই-একটি বিষয় জিজ্ঞাসা করিল এবং স্বামীজীর অসাধারণ ধী ও স্মৃতিশক্তি দেখিয়া অবাক হইয়া বইগুলি তুলিয়া রাখিয়া বলিল, ‘ইহা মানুষের শক্তি নয়!’

স্বামীজী॥ দেখলি, একমাত্র ব্রহ্মচর্যপালন ঠিক ঠিক করতে পারলে সমস্ত বিদ্যা মুহূর্তে আয়ত্ত হয়ে যায়-শ্রুতিধর, স্মৃতিধর হয়। এই ব্রহ্মচর্যের অভাবেই আমাদের দেশের সব ধ্বংস হয়ে গেল।

শিষ্য॥ আপনি যাহাই বলুন, মহাশয়, কেবল ব্রহ্মচর্যরক্ষার ফলে এরূপ অমানুষিক শক্তির স্ফুরণ কখনই সম্ভব না। আরও কিছু চাই।

উত্তরে স্বামীজী আর কিছুই বলিলেন না। অনন্তর স্বামীজী সর্বদর্শনের কঠিন বিষয়সকলের বিচার ও সিদ্ধান্তগুলি শিষ্যকে বলিতে লাগিলেন। অন্তরে অন্তরে ঐ সিদ্ধান্তগুলি প্রবেশ করাইয়া দিবার জন্যই যেন আজ তিনি ঐগুলি ঐরূপ বিশদভাবে তাহাকে বুঝাইতে লাগিলেন।

এইরূপ কথাবার্তা চলিয়াছে, এমন সময় স্বামী ব্রহ্মানন্দ স্বামীজীর ঘরে প্রবেশ করিয়া শিষ্যকে বলিলেন, ‘তুই তো বেশ! স্বামীজীর অসুস্থ শরীর-কোথায় গল্পসল্প করে স্বামীজীর মন প্রফুল্ল রাখবি, তা না তুই কিনা ঐ-সব জটিল কথা তুলে স্বামীজীকে বকাচ্ছিস!’ শিষ্য অপ্রস্তুত হইয়া আপনার ভ্রম বুঝিতে পারিল। কিন্তু স্বামীজী ব্রহ্মানন্দ মহারাজকে বলিলেন, ‘নে, রেখে দে তোদের কবিরাজী নিয়ম-ফিয়ম। এরা আমার সন্তান, এদের সদুপদেশ দিতে দিতে আমার দেহটা যায় তো বয়ে গেল।’

শিষ্য কিন্তু অতঃপর আর কোন দার্শনিক প্রশ্ন না করিয়া বাঙালদেশীয় কথা লইয়া হাসি-তামাসা করিতে লাগিল। স্বামীজীও শিষ্যের সঙ্গে রঙ্গ-রহস্যে যোগ দিলেন। কিছুকাল এইরূপে কাটিবার পর বঙ্গসাহিত্যে ভারতচন্দ্রের স্থান সম্বন্ধে প্রসঙ্গ উঠিল।

প্রথম হইতে স্বামীজী ভারতচন্দ্রকে লইয়া নানা ঠাট্টাতামাসা আরম্ভ করিলেন এবং তখনকার সামাজিক আচার-ব্যবহার বিবাহসংস্কারাদি লইয়াও নানারূপ ব্যঙ্গ করিতে লাগিলেন এবং সমাজে বাল্যবিবাহ-সমর্থনকারী ভারতচন্দ্রের কুরুচি ও অশ্লীলতাপূর্ণ কাব্যাদি বঙ্গদেশ ভিন্ন অন্য কোন দেশের সভ্য সমাজে প্রশ্রয় পায় নাই বলিয়া অভিমত প্রকাশ করিয়া বলিলেন, ‘ছেলেদের হাতে এ-সব বই যাতে না পড়ে, তাই করা উচিত।’ পরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা তুলিয়া বলিলেনঃ

ঐ একটা অদ্ভুত genius (প্রতিভা) তোদের দেশে জন্মেছিল। ‘মেঘনাদবধে’র মত দ্বিতীয় কাব্য বাঙলা ভাষাতে তো নেই-ই, সমগ্র ইওরোপেও অমন একখানা কাব্য ইদানীং পাওয়া দুর্লভ।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, মাইকেল বড়ই শব্দাড়ম্বরপ্রিয় ছিলেন বলিয়া বোধ হয়।

স্বামীজী॥ তোদের দেশে কেউ একটা কিছু নূতন করলেই তোরা তাকে তাড়া করিস। আগে ভাল করে দেখ-লোকটা কি বলছে, তা না, যাই কিছু আগেকার মত না হল, অমনি দেশের লোকে তার পিছু লাগল। এই ‘মেঘনাদবধকাব্য’-যা তোদের বাঙলা ভাষার মুকুটমণি-তাকে অপদস্থ করতে কিনা ‘ছুঁচোবধকাব্য’ লেখা হল! তা যত পারিস লেখ না, তাতে কি?সেই ‘মেঘনাদবধকাব্য’ এখনও হিমাচলের মত অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার খুঁত ধরতেই যাঁরা ব্যস্ত ছিলেন, সে-সব critic (সমালোচক)-দের মত ও লেখাগুলো কোথায় ভেসে গেছে! মাইকেল নূতন ছন্দে, ওজস্বিনী ভাষায় যে কাব্য লিখে গেছেন, তা সাধারণে কি বুঝবে? এই যে জি.সি. কেমন নূতন ছন্দে কত চমৎকার চমৎকার বই আজকাল লিখছে, তা নিয়েও তোদের অতিবুদ্ধি পণ্ডিতগণ কত criticize (সমালোচনা) করছে-দোষ ধরছে! জি.সি. কি তাতে ভ্রূক্ষেপ করে? পরে লোকে ঐসব বই appreciate (আদর) করবে।

এইরূপে মাইকেলের কথা হইতে হইতে তিনি বলিলেন, ‘যা, নীচে লাইব্রেরী থেকে মেঘনাদবধকাব্য-খানা নিয়ে আয়।’ শিষ্য মঠের লাইব্রেরী হইতে ‘মেঘনাদবধকাব্য’ লইয়া আসিলে বলিলেন, ‘পড় দিকি-কেমন পড়তে জানিস?’

শিষ্য বই খুলিয়া প্রথম সর্গের খানিকটা সাধ্যমত পড়িতে লাগিল। কিন্তু পড়া স্বামীজীর মনোমত না হওয়ায় তিনি ঐ অংশটি পড়িয়া দেখাইয়া শিষ্যকে পুনরায় উহা পড়িতে বলিলেন। শিষ্য এবার অনেকটা কৃতকার্য হইল দেখিয়া প্রসন্নমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বল দিকি-এই কাব্যের কোন অংশটি সর্বোৎকৃষ্ট?

শিষ্য কিছুই না বলিতে পারিয়া নির্বাক হইয়া রহিয়াছে দেখিয়া স্বামীজী বলিলেনঃ যেখানে ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধে নিহত হয়েছে, শোকে মূহ্যমানা মন্দোদরী রাবণকে যুদ্ধে যেতে নিষেধ করছে, কিন্তু রাবণ পুত্রশোক মন থেকে জোর করে ঠেলে ফেলে মহাবীরের ন্যায় যুদ্ধে কৃতসঙ্কল্প-প্রতিহিংসা ও ক্রোধানলে স্ত্রী-পুত্র সব ভুলে যুদ্ধের জন্য গমনোদ্যত-সেই স্থান হচ্ছে কাব্যের শ্রেষ্ঠ কল্পনা। ‘যা হবার হোক গে; আমার কর্তব্য আমি ভুলব না, এতে দুনিয়া থাক, আর যাক’-এই হচ্ছে মহাবীরের বাক্য। মাইকেল সেইভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে কাব্যের ঐ অংশ লিখেছিলেন।

এই বলিয়া স্বামীজী সে অংশ বাহির করিয়া পড়িতে লাগিলেন। স্বামীজীর সেই বীরদর্পদ্যোতক পঠনভঙ্গী আজও শিষ্যের হৃদয়ে জ্বলন্ত-জাগরূক রহিয়াছে।

৩৭
স্থান-বেলুড় মঠ
কাল-১৯০১

স্বামীজীর অসুখ এখনও একটু আছে। কবিরাজী ঔষধে অনেক উপকার হইয়াছে। মাসাধিক শুধু দুধ পান করিয়া থাকায় স্বামীজীর শরীরে আজকাল যেন চন্দ্রকান্তি ফুটিয়া বাহির হইতেছে এবং তাঁহার সুবিশাল নয়নের জ্যোতি অধিকতর বর্ধিত হইয়াছে।

আজ দুই দিন হইল শিষ্য মঠেই আছে। যথাসাধ্য স্বামীজীর সেবা করিতেছে। আজ অমাবস্যা। শিষ্য নির্ভয়ানন্দ-স্বামীর সহিত ভাগাভাগি করিয়া স্বামীজীর রাত্রিসেবার ভার লইবে, স্থির হইয়াছে। এখন সন্ধ্যা হইয়াছে।

স্বামীজীর পদসেবা করিতে করিতে শিষ্য জিজ্ঞাসা করিল, ‘মহাশয়, যে আত্মা সর্বগ, সর্বব্যাপী, অণুপরমাণুতে অনুস্যূত ও জীবের প্রাণের প্রাণ হইয়া তাহার এত নিকটে রহিয়াছেন, তাঁহার অনুভূতি হয় না কেন?’

স্বামীজী॥ তোর যে চোখ আছে, তা কি তুই জানিস? যখন কেউ চোখের কথা বলে, তখন ‘আমার চোখ আছে’ বলে কতকটা ধারণা হয়; আবার চোখে বালি পড়ে যখন চোখ করকর্ করে, তখন চোখ যে আছে, তা ঠিক ঠিক ধারণা হয়। সেইরূপ অন্তর হইতে অন্তরতম এই বিরাট আত্মার বিষয় সহজে বোধগম্য হয় না। শাস্ত্র বা গুরুমুখে শুনে খানিকটা ধারণা হয় বটে, কিন্তু যখন সংসারের তীব্র শোকদুঃখের কঠোর কশাঘাতে হৃদয় ব্যথিত হয়, যখন আত্মীয়স্বজনের বিয়োগে জীব আপনাকে অবলম্বনশূন্য জ্ঞান করে, যখন ভাবী জীবনের দুরতিক্রমণীয় দুর্ভেদ্য অন্ধকারে তার প্রাণ আকুল হয়, তখনি জীব এই আত্মার দর্শনে উন্মুখ হয়। এইজন্য দুঃখ আত্মজ্ঞানের অনুকূল। কিন্তু ধারণা থাকা চাই। দুঃখ পেতে পেতে কুকুর-বেড়ালের মত যারা মরে, তারা কি আর মানুষ? মানুষ হচ্ছে সেই, যে এই সুখদুঃখের দ্বন্দ্ব-প্রতিঘাতে অস্থির হয়েও বিচারবলে ঐ-সকলকে নশ্বর ধারণা করে আত্মরতিপর হয়। মানুষে ও অন্য জীব-জানোয়ারে এইটুকু প্রভেদ। যে জিনিষটা যত নিকটে, তার তত কম অনুভূতি হয়। আত্মা অন্তর হতে অন্তরতম, তাই অমনস্ক চঞ্চলচিত্ত জীব তাঁর সন্ধান পায় না। কিন্তু সমনস্ক, শান্ত ও জিতেন্দ্রিয় বিচারশীল জীব বহির্জগৎ উপেক্ষা করে অন্তর্জগতে প্রবেশ করতে করতে কালে এই আত্মার মহিমা উপলব্ধি করে গৌরবান্বিত হয়। তখনি সে আত্মজ্ঞান লাভ করে এবং ‘আমিই সেই আত্মা’, ‘তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো’ প্রভৃতি বেদের মহাকাব্য-সকল প্রত্যক্ষ অনুভব করে। বুঝলি?

শিষ্য॥ আজ্ঞা, হাঁ। কিন্তু মহাশয়, এ দুঃখকষ্ট-তাড়নার মধ্য দিয়া আত্মজ্ঞানলাভের ব্যবস্থা কেন? সৃষ্টি না হইলেই তো বেশ ছিল। আমরা সকলেই তো এককালে ব্রহ্মে বর্তমান ছিলাম। ব্রহ্মের এইরূপ সিসৃক্ষাই৭৬ বা কেন? আর এই দ্বন্দ্ব-ঘাত-প্রতিঘাতে সাক্ষাৎ ব্রহ্মরূপ জীবের এই জন্ম-মরণসঙ্কুল পথে গতাগতিই বা কেন?

স্বামীজী॥ লোকে মাতাল হলে কত খেয়াল দেখে। কিন্তু নেশা যখন ছুটে যায়, তখন সেগুলো মাথার ভুল বলে বুঝতে পারে। অনাদি অথচ সান্ত এই অজ্ঞান-বিলসিত সৃষ্টি-ফিষ্টি যা কিছু দেখছিস, সেটা তোর মাতাল অবস্থার কথা; নেশা ছুটে গেলে তোর ঐ-সব প্রশ্নই থাকবে না। শিষ্য॥ মহাশয়, তবে কি সৃষ্টি-স্থিতি এ-সব কিছুই নাই?

স্বামীজী॥ থাকবে না কেন রে? যতক্ষণ তুই এই দেহবুদ্ধি ধরে ‘আমি আমি’ করছিস, ততক্ষণ সবই আছে। আর যখন তুই বিদেহ আত্মরতি আত্মক্রীড়, তখন তোর পক্ষে এ-সব কিছু থাকবে না; সৃষ্টি জন্ম মৃত্যু প্রভৃতি আছে কিনা-এ প্রশ্নেরও তখন আর অবসর থাকবে না। তখন তোকে বলতে হবে-

ক্ব গতং কেন বা নীতং কুত্র লীনমিদং জগৎ।
অধুনৈব ময়া দৃষ্টং নাস্তি কিং মহদদ্ভুতম্॥৭৭

শিষ্য॥ জগতের জ্ঞান একেবারে না থাকিলে ‘কুত্র লীনমিদং জগৎ’ কথাই বা কিরূপে বলা যাইতে পারে? স্বামীজী॥ ভাষায় ঐ ভাবটা প্রকাশ করে বোঝাতে হচ্ছে, তাই ঐরূপ বলা হয়েছে। যেখানে ভাব ও ভাষার প্রবেশাধিকার নেই, সেই অবস্থাটা ভাব ও ভাষায় প্রকাশ করতে গ্রন্থকার চেষ্টা করছেন, তাই জগৎ কথাটা যে নিঃশেষে মিথ্যা, সেটা ব্যবহারিকরূপেই বলেছেন; পারমার্থিক সত্তা জগতের নেই, সে কেবলমাত্র ‘অবাঙ্ মনসোগোচরম্’ ব্রহ্মের আছে। বল, তোর আর কি বলবার আছে। আজ তোর তর্ক নিরস্ত করে দেব।

ঠাকুরঘরে আরাত্রিকের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। মঠের সকলেই ঠাকুরঘরে চলিলেন। শিষ্য স্বামীজীর ঘরেই বসিয়া রহিল দেখিয়া স্বামীজী বলিলেন, ‘ঠাকুরঘরে গেলিনি?’

শিষ্য॥ আমার এখানে থাকিতেই ভাল লাগিতেছে।

স্বামীজী॥ তবে থাক।

কিছুক্ষণ পরে শিষ্য ঘরের বাহিরে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘আজ অমাবস্যা, আঁধারে চারিদিক যেন ছাইয়া ফেলিয়াছে।-আজ কালীপূজার দিন।’ স্বামীজী শিষ্যের ঐ কথায় কিছু না বলিয়া জানালা দিয়া পূর্বাকাশের পানে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকাইয়া বলিলেন, ‘দেখছিস, অন্ধকারের কি এক অদ্ভুত গম্ভীর শোভা!’ কথা কয়টি বলিয়া সেই গভীর তিমিররাশির মধ্যে দেখিতে দেখিতে স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। এখন সকলেই নিস্তব্ধ, কেবল দূরে ঠাকুরঘরে ভক্তগণপঠিত শ্রীরামকৃষ্ণস্তব-মাত্র শিষ্যের কর্ণগোচর হইতেছে। স্বামীজীর এই অদৃষ্টপূর্ব গাম্ভীর্য ও গাঢ় তিমিরাবগুণ্ঠনে বহিঃপ্রকৃতির নিস্তব্ধ স্থির ভাব দেখিয়া শিষ্যের মন এক প্রকার অপূর্ব ভয়ে আকুল হইয়া উঠিল। কিছুক্ষণ এইরূপে গত হইবার পরে স্বামীজী আস্তে আস্তে গাহিতে লাগিলেনঃ

‘নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি।
তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরিগুহাবাসী॥’

গীত সাঙ্গ হইলে স্বামীজী ঘরে প্রবেশ করিয়া উপবিষ্ট হইলেন এবং মধ্যে মধ্যে ‘মা, মা, কালী, কালী’ বলিতে লাগিলেন। ঘরে তখন আর কেহই নাই। কেবল শিষ্য স্বামীজীর আজ্ঞাপালনের জন্য অবস্থান করিতেছে।

স্বামীজীর সে সময়ের মুখ দেখিয়া শিষ্যের বোধ হইতে লাগিল, তিনি যেন এখনও কোন এক দূরদেশে অবস্থান করিতেছেন। শিষ্য তাঁহার ঐ প্রকার ভাব দেখিয়া পীড়িত হইয়া বলিল, ‘মহাশয়, এইবার কথাবার্তা বলুন।’

স্বামীজী তাহার মনের ভাব বুঝিয়াই যেন মৃদু হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ‘যাঁর লীলা এত মধুর, সেই আত্মার সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য কত দূর বল দিকি?’

শিষ্য তখনও তাঁহার সেই দূর দূর ভাব সম্যক্ অবগত হয় নাই দেখিয়া বলিল, ‘মহাশয়, ও-সব কথার এখন আর দরকার নাই; কেনই বা আজ আপনাকে অমাবস্যা ও কালীপূজার কথা বলিলাম-সেই অবধি আপনার যেন কেমন একটা পরিবর্তন হইয়া গেল!’

স্বামীজী শিষ্যের ভাবগতিক দেখিয়া গান ধরিলেনঃ

‘কখন কি রঙ্গে থাকো মা, শ্যামা সুধা-তরঙ্গিণী,
-কালী সুধা-তরঙ্গিণী॥’
গান সমাপ্ত হইলে বলিতে লাগিলেনঃ

এই কালীই লীলারূপী ব্রহ্ম। ঠাকুরের কথা, ‘সাপ চলা, আর সাপের স্থির ভাব’-শুনিসনি?

শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ।

স্বামীজী॥ এবার ভাল হয়ে মাকে রুধির দিয়ে পুজো করব! রঘুনন্দন বলেছেন, ‘নবম্যাং পূজয়েৎ দেবীং কৃত্বা রুধির-কর্দমম্’-এবার তাই করব। মাকে বুকের রক্ত দিয়ে পুজো করতে হয়, তবে যদি তিনি প্রসন্না হন। মা-র ছেলে বীর হবে-মহাবীর হবে। নিরানন্দে, দুঃখে, প্রলয়ে, মহাপ্রলয়ে মায়ের ছেলে নির্ভীক হয়ে থাকবে।

এইরূপ কথা হইতেছে, এমন সময় নীচে প্রসাদ পাইবার ঘণ্টা বাজিল। স্বামীজী শুনিয়া বলিলেন, ‘যা, নীচে প্রসাদ পেয়ে শীগগীর আসিস।’

৩৮
স্থান-বেলুড় মঠ
কাল-১৯০১

স্বামীজী আজকাল মঠেই আছেন। শরীর তত সুস্থ নহে; তবে সকালে সন্ধ্যায় বেড়াইতে বাহির হন। শিষ্য আজ শনিবার মঠে আসিয়াছে। স্বামীজীর পাদপদ্মে প্রণত হইয়া তাঁহার শারীরিক কুশলবার্তা জিজ্ঞাসা করিয়াছে।

স্বামীজী॥ এ শরীরের তো এই অবস্থা! তোরা তো কেউই আমার কাজে সহায়তা করতে অগ্রসর হচ্ছিস না। আমি একা কি করব বল? বাঙলা দেশের মাটিতে এবার এই শরীরটা হয়েছে, এ শরীর দিয়ে কি আর বেশী কাজ-কর্ম চলতে পারে? তোরা সব এখানে আসিস-শুদ্ধ আধার, তোরা যদি আমার এইসব কাজে সহায় না হস তো আমি একা কি করব বল? শিষ্য॥ মহাশয়, এইসকল ব্রহ্মচারী ত্যাগী পুরুষেরা আপনার পশ্চাতে দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। আমার মনে হয়, আপনার কার্যে ইঁহারা প্রত্যেকে জীবন দিতে পারেন; তথাপি আপনি ঐ কথা বলিতেছেন কেন?

স্বামীজী॥ কি জানিস, আমি চাই a band of Young Bengal (একদল যুবক বাঙালী); এরাই দেশের আশা-ভরসাস্থল। চরিত্রবান্, বুদ্ধিমান্, পরার্থে সর্বত্যাগী এবং আজ্ঞানুবর্তী যুবকগণের উপরেই আমার ভবিষ্যৎ ভরসা-আমার idea (ভাব)-গুলি যারা work out (কাজে পরিণত) করে নিজেদের ও দেশের কল্যাণসাধনে জীবনপাত করতে পারবে। নতুবা দলে দলে কত ছেলে আসছে ও আসবে। তাদের মুখের ভাব ‘তমো’পূর্ণ, হৃদয় উদ্যমশূন্য, শরীর অপটু, মন সাহসশূন্য। এদের দিয়ে কি কাজ হয়? নচিকেতার মত শ্রদ্ধাবান্ দশ-বারটি ছেলে পেলে আমি দেশের চিন্তা ও চেষ্টা নূতন পথে চালনা করে দিতে পারি।

শিষ্য॥ মহাশয়, এত যুবক আপনার নিকট আসিতেছে, ইহাদের ভিতর ঐরূপ স্বভাববিশিষ্ট কাহাকেও কি দেখিতে পাইতেছেন না?

স্বামীজী॥ যাদের ভাল আধার বলে মনে হয়, তাদের মধ্যে কেউ বা বে করে ফেলেছে, কেউ বা সংসারের মান-যশ-ধন-উপার্জনের চেষ্টায় বিকিয়ে গিয়েছে; কারও বা শরীর অপটু। তারপর বাকী অধিকাংশই উচ্চ ভাব নিতে অক্ষম। তোরা আমার ভাব নিতে সক্ষম বটে, কিন্তু তোরাও তো কার্যক্ষেত্রে সে-সকল এখনও বিকাশ করতে পারছিস না। এইসব কারণে মনে সময় সময় বড়ই আক্ষেপ হয়; মনে হয়, দৈব-বিড়ম্বনে শরীরধারণ করে কোন কাজই করে যেতে পারলুম না। অবশ্য এখনও একেবারে হতাশ হইনি, কারণ ঠাকুরের ইচ্ছা হলে এইসব ছেলেদের ভেতর থেকেই কালে মহা মহা ধর্মবীর বেরুতে পারে-যারা ভবিষ্যতে আমার idea (ভাব) নিয়ে কাজ করবে।

শিষ্য॥ আমার মনে হয়, আপনার উদার ভাব সকলকেই একদিন না একদিন লইতে হইবে। ঐটি আমার দৃঢ়ধারণা। কারণ, স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি, সকল দিকে সকল বিষয়কে আশ্রয় করিয়াই আপনার চিন্তাপ্রবাহ ছুটিয়াছে। কি জীবসেবা, কি দেশকল্যাণব্রত, কি ব্রহ্মবিদ্যা-চর্চা, কি ব্রহ্মচর্য-সর্বত্রই আপনার ভাব প্রবেশ করিয়া উহাদের ভিতর একটা অভিনবত্ব আনিয়া দিয়াছে! আর দেশের লোকে কেহ বা আপনার নাম প্রকাশ্য করিয়া, আবার কেহ বা আপনার নামটি গোপন করিয়া নিজেদের নামে আপনার ঐ ভাব ও মতই সকল বিষয়ে গ্রহণ করিতেছে এবং সাধারণে উপদেশ করিতেছে।

স্বামীজী॥ আমার নাম না করলে তাতে কি আর আসে যায়? আমার idea (ভাব) নিলেই হল। কামকাঞ্চনত্যাগী হয়েও শতকরা নিরানব্বই জন সাধু নাম-যশে বদ্ধ হয়ে পড়ে। Fame, that last infirmity of noble mind৭৮ (যশের আকাঙ্ক্ষাই মহৎ ব্যক্তিদের শেষ দুর্বলতা)-পড়েছিস না? একেবারে ফলকামনাশূন্য হয়ে কাজ করে যেতে হবে। ভাল-মন্দ-লোকে দুই তো বলবেই, কিন্তু ideal (উচ্চাদর্শ) সামনে রেখে আমাদের সিঙ্গির মত কাজ করে যেতে হবে; তাতে ‘নিন্দন্তু নীতিনিপুণাঃ যদি বা স্তুবন্তু’৭৯(পণ্ডিত ব্যক্তিরা নিন্দা বা স্তুতি যাহাই করুক)।

শিষ্য॥ আমাদের পক্ষে এখন কিরূপ আদর্শ গ্রহণ করা উচিত?

স্বামীজী॥ মহাবীরের চরিত্রকেই তোদের এখন আদর্শ করতে হবে। দেখ না, রামের আজ্ঞায় সাগর ডিঙিয়ে চলে গেল! জীবন-মরণে দৃকপাত নেই-মহা জিতেন্দ্রিয়, মহা বুদ্ধিমান্! দাস্যভাবের ঐ মহা আদর্শে তোদের জীবন গঠন করতে হবে। ঐরূপ হলেই অন্যান্য ভাবের স্ফুরণ কালে আপনা-আপনি হয়ে যাবে। দ্বিধাশূন্য হয়ে গুরুর আজ্ঞাপালন আর ব্রহ্মচর্য- রক্ষা-এই হচ্ছে secret of success (সফল হবার একমাত্র রহস্য); ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়’ (এ ছাড়া আর দ্বিতীয় পথ নেই)। হনুমানের একদিকে যেমন সেবাভাব, অন্যদিকে তেমনি ত্রিলোকসন্ত্রাসী সিংহবিক্রম। রামের হিতার্থে জীবনপাত করতে কিছুমাত্র দ্বিধা রাখে না! রামসেবা ভিন্ন অন্য সকল বিষয়ে উপেক্ষা-ব্রহ্মত্ব-শিবত্ব-লাভে পর্যন্ত উপেক্ষা! শিশু রঘুনাথের আদেশপালনই জীবনের একমাত্র ব্রত। এরূপ একাগ্রনিষ্ঠ হওয়া চাই। খোল-করতাল বাজিয়ে লম্ফঝম্প করে দেশটা উৎসন্নে গেল। একে তো এই dyspeptic (অজীর্ণ) রোগীর দল, তাতে আবার লাফালে-ঝাঁপালে সইবে কেন? কামগন্ধহীন উচ্চ সাধনার অনুকরণ করতে গিয়ে দেশটা ঘোর তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। দেশে দেশে, গাঁয়ে গাঁয়ে যেখানে যাবি, দেখবি খোল-করতালই বাজছে! ঢাকঢোল কি দেশে তৈরী হয় না? তুরীভেরী কি ভারতে মেলে না? ঐ-সব গুরুগম্ভীর আওয়াজ ছেলেদের শোনা। ছেলেবেলা থেকে মেয়েমানষি বাজনা শুনে শুনে, কীর্তন শুনে শুনে দেশটা যে মেয়েদের দেশ হয়ে গেল। এর চেয়ে আর কি অধঃপাতে যাবে? কবিকল্পনাও এ ছবি আঁকতে হার মেনে যায়! ডমরু শিঙা বাজাতে হবে, ঢাকে ব্রহ্মরুদ্রতালের দুন্দুভিনাদ তুলতে হবে,‘মহাবীর, মহাবীর’ ধ্বনিতে এবং ‘হর হর ব্যোম্ ব্যোম’ শব্দে দিগদেশ কম্পিত করতে হবে। যে-সব music-এ (গীতবাদ্য) মানুষের soft feelings (হৃদয়ের কোমল ভাবসমূহ) উদ্দীপিত করে, সে-সব কিছুদিনের জন্য এখন বন্ধ রাখতে হবে। খেয়াল-টপ্পা বন্ধ করে ধ্রুপদ গান শুনতে লোককে অভ্যাস করাতে হবে। বৈদিক ছন্দের মেঘমন্দ্রে দেশটার প্রাণসঞ্চার করতে হবে। সকল বিষয়ে বীরত্বের কঠোর মহাপ্রাণতা আনতে হবে। এইরূপ ideal follow (আদর্শ অনুসরণ) করলে তবে এখন জীবের কল্যাণ, দেশের কল্যাণ। তুই যদি একা এ-ভাবে চরিত্র গঠন করতে পারিস, তা হলে তোর দেখাদেখি হাজার লোক ঐরূপ করতে শিখবে। কিন্তু দেখিস, ideal (আদর্শ) থেকে কখনও যেন এক পাও হটিসনি। কখনও সাহসহীন হবিনি। খেতে-শুতে-পরতে, গাইতে-বাজাতে, ভোগে-রোগে কেবলই সৎসাহসের পরিচয় দিবি। তবে তো মহাশক্তির কৃপা হবে।

শিষ্য॥ মহাশয়, এক এক সময়ে কেমন হীনসাহস হইয়া পড়ি।

স্বামীজী॥ তখন এইরূপ ভাববি-‘আমি কার সন্তান? তাঁর কাছে গিয়ে আমার এমন হীন বুদ্ধি, হীন সাহস!’ হীন বুদ্ধি, হীন সাহসের মাথায় লাথি মেরে ‘আমি বীর্যবান্, মেধাবান্, আমি ব্রহ্মবিৎ, আমি প্রজ্ঞাবান্’ বলতে বলতে দাঁড়িয়ে উঠবি। ‘আমি অমুকের চেলা, কামকাঞ্চনজিৎ ঠাকুরের সঙ্গীর সঙ্গী’-এইরূপ অভিমান খুব রাখবি। এতে কল্যাণ হবে। ঐ অভিমান যার নেই, তার ভেতরে ব্রহ্ম জাগেন না। রামপ্রসাদের গান শুনিসনি? তিনি বলতেন, ‘এ সংসারে ডরি কারে, রাজা যার মা মহেশ্বরী।’ এইরূপ অভিমান সর্বদা মনে জাগিয়ে রাখতে হবে। তা হলে আর হীন বুদ্ধি, হীন ভাব নিকটে আসবে না। কখনও মনে দুর্বলতা আসতে দিবিনি। মহাবীরকে স্মরণ করবি-মহামায়াকে স্মরণ করবি। দেখবি সব দুর্বলতা, সব কাপুরুষতা তখনই চলে যাবে।

ঐরূপ বলিতে বলিতে স্বামীজী নীচে আসিলেন। মঠের বিস্তৃত প্রাঙ্গণে যে আমগাছ আছে, তাহারই তলায় একখানা ক্যাম্পখাটে তিনি অনেক সময় বসিতেন; অদ্যও সেখানে আসিয়া পশ্চিমাস্যে উপবেশন করিলেন। তাঁহার নয়নে মহাবীরের ভাব যেন তখনও ফুটিয়ে বাহির হইতেছে! উপবিষ্ট হইয়াই উপস্থিত সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারিগণকে দেখাইয়া তিনি শিষ্যকে বলিতে লাগিলেনঃ

এই যে প্রত্যক্ষ ব্রহ্ম! একে উপেক্ষা করে যারা অন্য বিষয়ে মন দেয়, ধিক্ তাদের!করামলকবৎ এই যে ব্রহ্ম! দেখতে পাচ্ছিসনে?-এই-এই!

এমন হৃদয়স্পর্শী ভাবে স্বামীজী কথাগুলি বলিলেন যে, শুনিয়াই উপস্থিত সকলে ‘চিত্রার্পিতারম্ভ ইবাবতস্থে!’-সহসা গভীর ধ্যানে মগ্ন। কাহারও মুখে কথাটি নাই! স্বামী প্রেমানন্দ তখন গঙ্গা হইতে কমণ্ডলু করিয়া জল লইয়া ঠাকুরঘরে উঠিতেছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়াও স্বামীজী ‘এই প্রত্যক্ষ ব্রহ্ম, এই প্রত্যক্ষ ব্রহ্ম’ বলিতে লাগিলেন। ঐ কথা শুনিয়া তাঁহারও তখন হাতের কমণ্ডলু হাতে বদ্ধ হইয়া রহিল, একটা মহা নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন হইয়া তিনিও তখনি ধ্যানস্থ হইয়া পড়িলেন! এইরূপে প্রায় ১৫ মিনিট গত হইলে স্বামীজী স্বামী প্রেমানন্দকে আহ্বান করিয়া বলিলেন, ‘যা, এখন ঠাকুরপূজায় যা।’ স্বামী প্রেমানন্দের তবে চেতনা হয়! ক্রমে সকলের মনই আবার ‘আমি-আমার’ রাজ্যে নামিয়া আসিল এবং সকলে যে যাহার কার্যে গমন করিল। সেদিনের সেই দৃশ্য শিষ্য ইহজীবনে কখনও ভুলিতে পারিবে না।

কিছুক্ষণ পরে শিষ্য-সমভিব্যাহারে স্বামীজী বেড়াইতে গেলেন। যাইতে যাইতে শিষ্যকে বলিলেন, ‘দেখলি, আজ কেমন হল? সবাইকে ধ্যানস্থ হতে হল। এরা সব ঠাকুরের সন্তান কিনা, বলবামাত্র এদের তখনই তখনই অনুভূতি হয়ে গেল।’

শিষ্য॥ মহাশয়, আমাদের মত লোকের মনও যখন নির্বিষয় হইয়া গিয়াছিল, তখন ওঁদের কা কথা। আনন্দে আমার হৃদয় যেন ফাটিয়া যাইতেছিল! এখন কিন্তু ঐ ভাবের আর কিছুই মনে নাই-যেন স্বপ্নবৎ হইয়া গিয়াছে।

স্বামীজী॥ সব কালে হয়ে যাবে। এখন কাজ কর। এই মহামোহগ্রস্থ জীবসমূহের কল্যাণের জন্য কোন কাজে লেগে যা। দেখবি ও-সব আপনা-আপনি হয়ে যাবে। শিষ্য॥ মহাশয়, অত কর্মের মধ্যে যাইতে ভয় হয়-সে সামর্থ্যও নাই। শাস্ত্রেও বলে ‘গহনা কর্মণো গতিঃ।’

স্বামীজী॥ তোর কি ভাল লাগে?

শিষ্য॥ আপনার মত সর্বশাস্ত্রার্থদর্শীর সঙ্গে বাস ও তত্ত্ববিচার করিব, আর শ্রবণ মনন নিদিধ্যাসন দ্বারা এ শরীরেই ব্রহ্মতত্ত্ব প্রত্যক্ষ করিব। এ ছাড়া কোন বিষয়েই আমার উৎসাহ হয় না। বোধ হয় যেন অন্য কিছু করিবার সামর্থ্যও আমাতে নাই। স্বামীজী॥ ভাল লাগে তো তাই করে যা। আর তোর সব শাস্ত্র-সিদ্ধান্ত লোকদেরও জানিয়ে দে, তা হলেই অনেকের উপকার হবে। শরীর যতদিন আছে, ততদিন কাজ না করে তো কেউ থাকতে পারে না। সুতরাং যে কাজে পরের উপকার হয়, তাই করা উচিত। তোর নিজের অনুভূতি এবং শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্তবাক্যে অনেক বিবিদিষুর উপকার হতে পারে। ঐ-সব লিপিবদ্ধ করে যা। এতে অনেকের উপকার হতে পারে।

শিষ্য॥ অগ্রে আমারই অনুভূতি হউক, তখন লিখিব। ঠাকুর বলিতেন যে, চাপরাস না পেলে কেহ কাহারও কথা লয় না।

স্বামীজী॥ তুই যে-সব সাধনা ও বিচারের stage (অবস্থা) দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিস, জগতে এমন লোক অনেক থাকতে পারে, যারা ঐ stage (অবস্থা)-এ পড়ে আছে; ঐ অবস্থা পার হয়ে অগ্রসর হতে পারছে না। তোর experience (অনুভূতি) ও বিচার-প্রণালী লিপিবদ্ধ হলে তাদেরও তো উপকার হবে। মঠে সাধুদের সঙ্গে যে-সব চর্চা করিস, সেই বিষয়গুলি সহজ ভাষায় লিপিবদ্ধ করে রাখলে অনেকের উপকার হতে পারে।

শিষ্য॥ আপনি যখন আজ্ঞা করিতেছেন, তখন ঐ বিষয়ে চেষ্টা করিব।

স্বামীজী॥ যে সাধনভজন বা অনুভূতি দ্বারা পরের উপকার হয় না, মহামোহগ্রস্থ জীবকুলের কল্যাণ সাধিত হয় না, কামকাঞ্চনের গণ্ডী থেকে মানুষকে বের হতে সহায়তা করে না, এমন সাধন-ভজনে ফল কি? তুই বুঝি মনে করিস-একটি জীবের বন্ধন থাকতে তোর মুক্তি আছে? যত কাল তার উদ্ধার না হচ্ছে, ততকাল তোকেও জন্ম নিতে হবে তাকে সাহায্য করতে, তাকে ব্রহ্মানুভূতি করাতে। প্রতি জীব যে তোরই অঙ্গ। এইজন্যই পরার্থে কর্ম। তোর স্ত্রী-পুত্রকে আপনার জেনে তুই যেমন তাদের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলকামনা করিস, প্রতি জীবে যখন তোর ঐরূপ টান হবে, তখন বুঝব-তোর ভেতর ব্রহ্ম জাগরিত হচ্ছেন, not a moment before (তার এক মুহূর্ত আগে নয়)। জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে এই সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলকামনা জাগরিত হলে তবে বুঝব, তুই ideal-এর (আদর্শের) দিকে অগ্রসর হচ্ছিস।

শিষ্য॥ এটি তো মহাশয় ভয়ানক কথা-সকলের মুক্তি না হইলে ব্যক্তিগত মুক্তি হইবে না! কোথাও তো এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত শুনি নাই!

স্বামীজী॥ এক class (শ্রেণীর) বেদান্তবাদীদের ঐরূপ মত আছে। তাঁরা বলেন ‘ব্যষ্টিগত মুক্তি-মুক্তির যথার্থ স্বরূপ নয়, সমষ্টিগত মুক্তিই মুক্তি।’ অবশ্য ঐ মতের দোষগুণ যথেষ্ট দেখান যেতে পারে।

শিষ্য॥ বেদান্তমতে ব্যষ্টিভাবই তো বন্ধনের কারণ। সেই উপাধিগত চিৎসত্তাই কামকর্মাদিবশে বদ্ধ বলিয়া প্রতীত হন। বিচারবলে উপাধিশূন্য হইলে, নির্বিষয় হইলে প্রত্যক্ষ চিন্ময় আত্মার বন্ধন থাকিবে কিরূপে? যাহার জীবজগদাদিবোধ থাকে, তাহার মনে হইতে পারে-সকলের মুক্তি না হইলে তাহার মুক্তি নাই। কিন্তু শ্রবণাদি বলে মন নিরুপাধিক হইয়া যখন প্রত্যগ্‌ব্রহ্মময় হয়, তখন তাহার নিকট জীবই বা কোথায়, আর জগৎই বা কোথায়?-কিছুই থাকে না। তাহার মুক্তিতত্ত্বের অবরোধক কিছুই হইতে পারে না।

স্বামীজী॥ হাঁ, তুই যা বলছিস, তাই অধিকাংশ বেদান্তবাদীর সিদ্ধান্ত। উহা নির্দোষও বটে। ওতে ব্যক্তিগত মুক্তি অবরুদ্ধ হয় না। কিন্তু যে মনে করে-আমি আব্রহ্ম জগৎটাকে আমার সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে মুক্ত হব, তার মহাপ্রাণতাটা একবার ভেবে দেখ দেখি।

শিষ্য॥ মহাশয়, উহা উদারভাবের পরিচায়ক বটে, কিন্তু শাস্ত্রবিরুদ্ধ বলিয়া মনে হয়।

স্বামীজী শিষ্যের কথাগুলি শুনিতে পাইলেন না, অন্যমনে কোন বিষয় ইতঃপূর্বে ভাবিতেছিলেন বলিয়া বোধ হইল। কিছুক্ষণ পরে বলিয়া উঠিলেন, ‘ওরে, আমাদের কি কথা হচ্ছিল?’ যেন পূর্বের সকল কথা ভুলিয়া গিয়াছেন! শিষ্য ঐ বিষয় স্মরণ করাইয়া দেওয়ায় স্বামীজী বলিলেন, ‘দিনরাত ব্রহ্মবিষয়ের অনুধ্যান করবি। একান্তমনে ধ্যান করবি। আর ব্যুত্থানকালে হয় কোন লোকহিতকর বিষয়ের অনুষ্ঠান করবি, না হয় মনে মনে ভাববি-জীবের, জগতের উপকার হোক, সকলের দৃষ্টি ব্রহ্মাবগাহী হোক। ঐরূপ ধারাবাহিক চিন্তাতরঙ্গের দ্বারাই জগতের উপকার হবে। জগতের কোন সদনুষ্ঠানই নিরর্থক হয় না, তা সেটি কাজই হোক, আর চিন্তাই হোক। তোর চিন্তাতরঙ্গের প্রভাবে হয়তো আমেরিকার কোন লোকের চৈতন্য হবে।’

শিষ্য॥ মহাশয়, আমার মন যাহাতে যথার্থ নির্বিষয় হয়, সে বিষয়ে আমাকে আশীর্বাদ করুন-এই জন্মেই যেন তাহা হয়।

স্বামীজী॥ তা হবে বৈকি। ঐকান্তিকতা থাকলে নিশ্চয় হবে।

শিষ্য॥ আপনি মনকে ঐকান্তিক করিয়া দিতে পারেন-সে শক্তি আছে, আমি জানি। আমাকে ঐরূপ করিয়া দিন, ইহাই প্রার্থনা।

এইরূপ কথাবার্তা হইতে হইতে শিষ্যসহ স্বামীজী মঠে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন দশমীর জ্যোৎস্নার রজতধারায় মঠের উদ্যান যেন প্লাবিত হইতেছিল।

৩৯
স্থান-বেলুড় মঠ
কাল-১৯০১

বেলুড় মঠ স্থাপিত হইবার সময় নৈষ্ঠিক হিন্দুগণের মধ্যে অনেকে মঠের আচার-ব্যবহারের প্রতি তীব্র কটাক্ষ করিতেন। বিলাত-প্রত্যাগত স্বামীজী কর্তৃক স্থাপিত মঠে হিন্দুর আচারনিষ্ঠা সর্বথা প্রতিপালিত হয় না এবং ভক্ষ্যভোজ্যাদির বাছ-বিচার নাই-প্রধানতঃ এই বিষয় লইয়া নানা স্থানে আলোচনা চলিত এবং ঐ কথায় বিশ্বাসী হইয়া শাস্ত্রানভিজ্ঞ হিন্দুনামধারী অনেকে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসিগণের কার্যকলাপের অযথা নিন্দাবাদ করিত। নৌকায় করিয়া মঠে আসিবার কালে শিষ্য সময়ে সময়ে ঐরূপ সমালোচনা স্বকর্ণে শুনিয়াছে। তাহার মুখে স্বামীজী কখনও কখনও ঐ-সকল সমালোচনা শুনিয়া বলিতেন, ‘হাতী চলে বাজারমে, কুত্তা ভোঁকে হাজার। সাধুনকো দুর্ভাব নেহি, যব নিন্দে সংসার॥’৮০ কখনও বলিতেন, ‘দেশে কোন নূতন ভাব প্রচার হওয়ার সময় তার বিরুদ্ধে প্রাচীনপন্থীদের আন্দোলন প্রকৃতির নিয়ম। জগতের ধর্ম-সংস্থাপকমাত্রকেই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে।’ আবার কখনও বলিতেন, ‘Persecution (অন্যায় অত্যাচার) না হলে জগতের হিতকর ভাবগুলি সমাজের অন্তস্তলে সহজে প্রবেশ করতে পারে না।’ সুতরাং সমাজের তীব্র কটাক্ষ ও সমালোচনাকে স্বামীজী তাঁহার নবভাব-প্রচারের সহায় বলিয়া মনে করিতেন, কখনও উহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিতেন না বা তাঁহার আশ্রিত গৃহী ও সন্ন্যাসিগণকে প্রতিবাদ করিতে দিতেন না। সকলকে বলিতেন, ‘ফলাভিসন্ধিহীন হয়ে কাজ করে যা, একদিন ওর ফল নিশ্চয়ই ফলবে।’ স্বামীজীর শ্রীমুখে এ-কথাও সর্বদা শুনা যাইত, ‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি।’

হিন্দুসমাজের এই তীব্র সমালোচনা স্বামীজীর লীলাবসানের পূর্বে কিরূপে অন্তর্হিত হয়, আজ সেই বিষয়ে কিছু লিপিবদ্ধ হইতেছে। ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দের মে কি জুন মাসে শিষ্য একদিন মঠে আসিয়াছে। স্বামীজী শিষ্যকে দেখিয়াই বলিলেনঃ ওরে, একখানা রঘুনন্দনের ‘অষ্টাবিংশতি-তত্ত্ব’ শীগগীর আমার জন্যে নিয়ে আসবি।

শিষ্য॥ আচ্ছা মহাশয়। কিন্তু রঘুনন্দনের স্মৃতি-যাহাকে কুসংস্কারের ঝুড়ি বলিয়া বর্তমান শিক্ষিত সম্প্রদায় নির্দেশ করিয়া থাকে, তাহা লইয়া আপনি কি করিবেন?

স্বামীজী॥ কেন? রঘুনন্দন তদানীন্তন কালের একজন দিগ্‌গজ পণ্ডিত ছিলেন; প্রাচীন স্মৃতিসকল সংগ্রহ করে হিন্দুর দেশকালোপযোগী নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াকলাপ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। সমস্ত বাঙলা দেশ তো তাঁর অনুশাসনেই আজকাল চলছে। তবে তাঁর তৈরী হিন্দুজীবনের গর্ভাধান থেকে শ্মশানান্ত আচার-প্রণালীর কঠোর বন্ধনে সমাজ উৎপীড়িত হয়েছিল। শৌচ-প্রস্রাবে, খেতে-শুতে, অন্য সকল বিষয়ের তো কথাই নেই, সব্বাইকে তিনি নিয়মে বদ্ধ করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন। সময়ের পরিবর্তনে সে বন্ধন বহুকাল স্থায়ী হতে পারল না। সর্বদেশে সর্বকালে ক্রিয়াকাণ্ড, সমাজের আচার-প্রণালী সর্বদাই পরিবর্তন হয়ে যায়। একমাত্র জ্ঞানকাণ্ডই পরিবর্তিত হয় না। বৈদিক যুগেও দেখতে পাবি ক্রিয়াকাণ্ড ক্রমেই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কিন্তু উপনিষদের জ্ঞানপ্রকরণ আজ পর্যন্ত একভাবে রয়েছে। তবে তার interpreters (ব্যাখ্যাতা) অনেক হয়েছে-এইমাত্র।

শিষ্য॥ আপনি রঘুনন্দনের স্মৃতি লইয়া কি করিবেন?

স্বামীজী॥ এবার মঠে দুর্গোৎসব করবার ইচ্ছে হচ্ছে। যদি খরচার সঙ্কুলান হয় তো মহামায়ার পুজো করব। তাই দুর্গোৎসব-বিধি পড়বার ইচ্ছে হয়েছে। তুই আগামী রবিবার যখন আসবি, তখন ঐ পুঁথিখানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসবি।

শিষ্য॥ যে আজ্ঞা।

পরের রবিবারে শিষ্য রঘুনন্দনকৃত ‘অষ্টাবিংশতি-তত্ত্ব’ ক্রয় করিয়া স্বামীজীর জন্য মঠে লইয়া আসিল। গ্রন্থখানি আজিও মঠের লাইব্রেরীতে রহিয়াছে। স্বামীজী পুস্তকখানি পাইয়া বড়ই খুশী হইলেন এবং ঐ দিন হইতে উহা পাঠ করিতে আরম্ভ করিয়া চার পাঁচ দিনেই গ্রন্থখানি আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া ফেলিলেন। শিষ্যের সঙ্গে সপ্তাহান্তে দেখা হইবার পর বলিলেনঃ তোর দেওয়া রঘুনন্দনের স্মৃতিখানি সব পড়ে ফেলেছি। যদি পারি তো এবার মার পূজো করব। রঘুনন্দন বলেছেন, ‘নবম্যাং পূজয়েৎ দেবীং কৃত্বা রুধিরকর্দমম্’-মার ইচ্ছা হয় তো তাও করব।

**
স্বামীজী মঠে প্রথম দুর্গাপূজা করিতে ইচ্ছা করিলে শ্রীরামকৃষ্ণভক্ত-জননী শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর অনুমতিক্রমে স্থির হইল, তাঁহারই নামে সঙ্কল্প করিয়া পূজা হইবে। কলিকাতা কুমারটুলী হইতে প্রতিমা আনা হইল। ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল পূজক, স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের পিতা সাধক ঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য তন্ত্রধারক হইলেন। যে বিল্ববৃক্ষমূলে বসিয়া স্বামীজী একদিন গান গাহিয়া-ছিলেন, ‘বিল্ববৃক্ষমূলে পাতিয়ে বোধন, গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন’-সেইখানেই বোধনাধিবাসের সান্ধ্যপূজা সম্পন্ন হইল। যথাশাস্ত্র মায়ের পূজা নির্বাহিত হইল; শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর অনভিমত বলিয়া পশুবলিদান হয় নাই। গরীব-দুঃখীদিগকে নারায়ণজ্ঞানে পরিতোষপূর্বক ভোজন করান দুর্গোৎসবের অন্যতম প্রধান অঙ্গ ছিল। বেলুড় বালি ও উত্তরপাড়ার পরিচিত অপরিচিত অনেক ব্রাহ্মণপণ্ডিত নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন; তাঁহারা সানন্দে পূজায় যোগদান করেন এবং পূজা দর্শন করিয়া তাঁহাদের ধারণা জন্মে যে মঠের সন্ন্যাসীরা যথার্থ হিন্দুসন্ন্যাসী।

মহাষ্টমীর পূর্বরাত্রে স্বামীজীর জ্বর হওয়ার পরদিন পূজায় যোগদান করিতে পারেন নাই; সন্ধিক্ষণে উঠিয়া মহামায়ার চরণে তিনবার পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করেন। নবমীরাত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের গাওয়া দু-একটি গান গাহিলেন। পূজা-শেষে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর দ্বারা যজ্ঞদক্ষিণান্ত করা হইল। দুর্গাপূজার পর মঠে লক্ষ্মী ও শ্যামাপূজাও যথাশাস্ত্র নির্বাহিত হয়।

অগ্রহায়ণ মাসের শেষভাগে স্বামীজী তাঁহার গর্ভধারিণীর ইচ্ছায় বাল্যকালের এক ‘মানত’ পূজা সম্পন্ন করিতে কালীঘাটে গিয়া গঙ্গাস্নানান্তে ভিজা-কাপড়ে মায়ের মন্দিরে প্রবেশ করেন। মায়ের পাদপদ্মের সম্মুখে তিনবার গড়াগড়ি দেন, সাতবার মন্দির প্রদক্ষিণ করেন এবং নাটমন্দিরের পশ্চিমপার্শ্বে অনাবৃত চত্বরে বসিয়া নিজেই হোম করেন। এই-সকল কথা বলিবার পর স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেন, ‘কালীঘাটে এখনও কেমন উদার ভাব দেখলুম; আমাকে বিলাত-প্রত্যাগত বিবেকানন্দ বলে জেনেও মন্দিরের অধ্যক্ষগণ মন্দিরে প্রবেশ করতে কোন বাধাই দেননি; বরং পরম সমাদরে মন্দিরমধ্যে নিয়ে গিয়ে যথেচ্ছ পুজো করতে সাহায্য করেছিলেন।’

বেদান্তবাদী বা ব্রহ্মজ্ঞানী হইয়াও স্বামীজী আচার্য শঙ্করের মত পূজানুষ্ঠানাদির প্রতি শ্রদ্ধাবান্ ও অনুরাগী ছিলেন।

৪০
স্থান-বেলুড় মঠ
কাল-মার্চ, ১৯০২১

আজ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মহামহোৎসব-এই উৎসবই স্বামীজী শেষ দেখিয়া গিয়াছেন। উৎসবের কিছু পূর্ব হইতে স্বামীজীর শরীর অসুস্থ। উপর হইতে নামেন না, চলিতে পারেন না, পা ফুলিয়াছে। ডাক্তারেরা বেশী কথাবার্তা বলিতে নিষেধ করিয়াছেন।

শিষ্য শ্রীশ্রীঠাকুরের উদ্দেশে সংস্কৃত ভাষায় একটি স্তব রচনা করিয়া উহা ছাপাইয়া আনিয়াছে। আসিয়াই স্বামিপাদপদ্ম দর্শন করিতে উপরে গিয়াছে। স্বামীজী মেজেতে অর্ধ-শায়িত অবস্থায় বসিয়াছিলেন। শিষ্য আসিয়াই স্বামীজীর শ্রীপাদপদ্ম হৃদয়ে ও মস্তকে স্পর্শ করিলে এবং আস্তে আস্তে পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। স্বামীজী শিষ্য-রচিত স্তবটি পড়িতে আরম্ভ করিবার পূর্বে তাহাকে বলিলেন, ‘খুব আস্তে আস্তে পায়ে হাত বুলিয়ে দে, পা ভারি টাটিয়েছে।’ শিষ্য তদনুরূপ করিতে লাগিল।

স্তব-পাঠান্তে স্বামীজী হৃষ্টচিত্তে বলিলেন, ‘বেশ হয়েছে।’

স্বামীজীর শারীরিক অসুস্থতা এতদূর বাড়িয়াছে যে, তাঁহাকে দেখিয়া শিষ্যের বুক ফাটিয়া কান্না আসিতে লাগিল।

স্বামীজী॥ (শিষ্যের মনোভাব বুঝিতে পারিয়া) কি ভাবছিস? শরীরটা জন্মেছে, আবার মরে যাবে। তোদের ভেতরে আমার ভাবগুলির কিছু-কিছুও যদি ঢুকুতে পেরে থাকি, তাহলেই জানব দেহটা ধরা সার্থক হয়েছে।

শিষ্য॥ আমরা কি আপনার দয়ার উপযুক্ত আধার? নিজগুণে দয়া করিয়া যাহা করিয়া দিয়াছেন, তাহাতেই নিজেকে সৌভাগ্যবান্ মনে হয়।

স্বামীজী॥ সর্বদা মনে রাখিস, ত্যাগই হচ্ছে মূলমন্ত্র। এ মন্ত্রে দীক্ষিত না হলে ব্রহ্মাদিরও মুক্তির উপায় নেই।

শিষ্য॥ মহাশয়, আপনার শ্রীমুখ হইতে ঐ কথা নিত্য শুনিয়া এত দিনেও উহার ধারণা হইল না, সংসারাসক্তি গেল না-ইহা কি কম পরিতাপের কথা! আশ্রিত দীন সন্তানকে আশীর্বাদ করুন, যাহাতে শীঘ্র উহা প্রাণে প্রাণে ধারণা হয়।

স্বামীজী॥ ত্যাগ নিশ্চয় আসবে, তবে কি জানিস ‘কালেনাত্মনি বিন্দতি’-সময় না এলে হয় না। কতকগুলি প্রাগ্‌জন্ম-সংস্কার কেটে গেলেই ত্যাগ ফুটে বেরোবে।

কথাগুলি শুনিয়া শিষ্য অতি কাতরভাবে স্বামীজীর পাদপদ্ম ধারণ করিয়া বলিতে লাগিল, ‘মহাশয়, এ দীন দাসকে জন্মে জন্মে পাদপদ্মে আশ্রয় দিন-ইহাই একান্ত প্রার্থনা। আপনার সঙ্গে থাকিলে ব্রহ্মজ্ঞানলাভেও আমার ইচ্ছা হয় না।’

স্বামীজী উত্তরে কিছুই না বলিয়া অন্যমনস্ক হইয়া কি ভাবিতে লাগিলেন। শিষ্যের মনে হইল, তিনি যেন দূরদৃষ্টি-চক্রবালে তাঁহার ভাবী জীবনের ছবি দেখিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, ‘লোকের গুলতোন দেখে কী আর হবে? আজ আমার কাছে থাক। আর নিরঞ্জনকে ডেকে দোরে বসিয়ে দে, কেউ যেন আমার কাছে এসে বিরক্ত না করে।’ শিষ্য দৌড়িয়া গিয়া স্বামী নিরঞ্জনানন্দকে স্বামীজীর আদেশ জানাইল। তিনিও সকল কার্য উপেক্ষা করিয়া, মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়া, হাতে লাঠি লইয়া স্বামীজীর ঘরের দরজার সম্মুখে আসিয়া বসিলেন।

অনন্তর ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া শিষ্য পুনরায় স্বামীজীর কাছে আসিল। মনের সাধে আজ স্বামীজীর সেবা করিতে পারিবে ভাবিয়া তাহার মন আনন্দে উৎফুল্ল! স্বামীজীর পদসেবা করিতে করিতে সে বালকের ন্যায় যত মনের কথা স্বামীজীকে খুলিয়া বলিতে লাগিল, স্বামীজীও হাস্যমুখে তাহার প্রশ্নাদির উত্তর ধীরে ধীরে দিতে লাগিলেন। এইরূপে সেদিন কাটিতে লাগিল।

স্বামীজী॥ আমার মনে হয়, এভাবে এখন আর ঠাকুরের উৎসব না হয়ে অন্য-ভাবে হয় তো বেশ হয়। একদিন নয়, চার-পাঁচ দিন ধরে উৎসব হবে। ১ম দিন হয়তো শাস্ত্রাদি-পাঠ ও ব্যাখ্যা হল। ২য় দিন বেদবেদান্তাদির বিচার ও মীমাংসা হল। ৩য় দিন Question-Class (প্রশ্নোত্তর) হল। তার পরদিন চাই কি Lecture (বক্তৃতা) হল। শেষ দিনে এখন যেমন মহোৎসব হয়, তেমনি হল। দুর্গাপূজা যেমন চার দিন ধরে হয়, তেমনি। ঐরূপে উৎসব করলে শেষ দিন ছাড়া অপর কয়দিন অবশ্য ঠাকুরের ভক্তমণ্ডলী ভিন্ন আর কেউ বোধ হয় বড় একটা আসতে পারবে না। তা নাই বা এল। বহু লোকের গুলতোন হলেই যে ঠাকুরের ভাব খুব প্রচার হল, তা তো নয়।

শিষ্য॥ মহাশয়, ইহা আপনার সুন্দর কল্পনা; আগামী বারে তাহাই করা যাইবে। আপনার ইচ্ছা হইলে সব হইবে।

স্বামীজী॥ আর বাবা, ও-সব করতে মন যায় না। এখন থেকে তোরা ও-সব করিস।

শিষ্য॥ মহাশয়, এবার কীর্তনের অনেক দল আসিয়াছে।

ঐ কথা শুনিয়া স্বামীজী উহা দেখিবার জন্য ঘরের দক্ষিণদিকের মধ্যের জানালার রেলিং ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং সমাগত অগণিত ভক্তমণ্ডলীর দিকে চাহিয়া রহিলেন। অল্পক্ষণ দেখিয়াই আবার বসিলেন। দাঁড়াইয়া কষ্ট হইয়াছে বুঝিয়া শিষ্য তাঁহার মস্তকে আস্তে আস্তে ব্যজন করিতে লাগিল।

স্বামীজী॥ তোরা হচ্ছিস ঠাকুরের লীলার actors (অভিনেতা)। এর পরে আমাদের কথা তো ছেড়েই দে, লোকে তোদেরও নাম করবে। এই যে-সব স্তব লিখছিস, এর পর লোকে ভক্তিমুক্তি-লাভের জন্য এইসব স্তব পাঠ করবে। জানবি, আত্মজ্ঞানলাভই পরম সাধন। অবতারপুরুষরূপী জগদ‍্‍গুরুর প্রতি ভক্তি হলেই ঐ জ্ঞান কালে আপনিই ফুটে বেরোবে।

শিষ্য॥ (অবাক হইয়া) মহাশয়, আমার ঐ জ্ঞান লাভ হইবে তো? স্বামীজী॥ ঠাকুরের আশীর্বাদে তোর জ্ঞান-ভক্তি হবে। কিন্তু সংসারাশ্রমে তোর বিশেষ কোন সুখ হবে না।

শিষ্য॥ (বিষণ্ণ ও চিন্তিত ভাবে) আপনি যদি দয়া করিয়া মনের বন্ধনগুলি কাটিয়া দেন তবেই উপায়; নতুবা এ দাসের উপায়ান্তর নাই। আপনি শ্রীমুখের বাণী দিন, যেন এই জন্মেই মুক্ত হয়ে যাই।

স্বামীজী॥ ভয় কি? যখন এখানে এসে পড়েছিস, তখন নিশ্চয় হয়ে যাবে। শিষ্য॥ (স্বামীজীর পাদপদ্ম ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে) এবার আমায় উদ্ধার করিতে হইবেই হইবে।

স্বামীজী॥ কে কার উদ্ধার করতে পারে বল? গুরু কেবল কতকগুলি আবরণ দূর করে দিতে পারে। ঐ আবরণগুলো গেলেই আত্মা আপনার গৌরবে আপনি জোতিষ্মান্ হয়ে সূর্যের মত প্রকাশ পান।

শিষ্য॥ তবে শাস্ত্রে কৃপার কথা শুনিতে পাই কেন?

স্বামীজী॥ কৃপা মানে কি জানিস? যিনি আত্ম-সাক্ষাৎকার করেছেন, তাঁর ভেতরে একটা মহাশক্তি খেলে। তাঁকে centre (কেন্দ্র) করে কিছুদূর পর্যন্ত radius (ব্যাসার্ধ) নিয়ে যে একটা circle (বৃত্ত) হয়, সেই circle-এর (বৃত্তের) ভেতর যারা এসে পড়ে, তারা ঐ আত্মবিৎ সাধুর ভাবে অনুপ্রাণিত হয় অর্থাৎ ঐ সাধুর ভাবে তারা অভিভূত হয়ে পড়ে। সুতরাং সাধন-ভজন না করেও তারা অপূর্ব আধ্যাত্মিক ফলের অধিকারী হয়। একে যদি কৃপা বলিস তো বল।

শিষ্য॥ এ ছাড়া আর কোনরূপ কৃপা নাই কি, মহাশয়?

স্বামীজী॥ তাও আছে। যখন অবতার আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত মুমুক্ষু পুরুষেরা সব তাঁর লীলার সহায়তা করতে শরীর ধারণ করে আসেন। কোটি জন্মের অন্ধকার কেটে এক জন্মে মুক্ত করে দেওয়া কেবল মাত্র অবতারেরাই পারেন। এরই মানে কৃপা। বুঝলি? শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ। কিন্তু যাহারা তাঁহার দর্শন পাইল না, তাহাদের উপায় কি?

স্বামীজী॥ তাদের উপায় হচ্ছে-তাঁকে ডাকা। ডেকে ডেকে অনেকে তাঁর দেখা পায়, ঠিক এমনি আমাদের মত শরীর দেখতে পায় এবং তাঁর কৃপা পায়।

শিষ্য॥ মহাশয়, ঠাকুরের শরীর যাইবার পর আপনি তাঁহার দর্শন পাইয়াছেন কি?

স্বামীজী॥ ঠাকুরের শরীর যাবার পর, আমি কিছুদিন গাজীপুরে পওহারী বাবার সঙ্গ করি। পওহারী বাবার আশ্রমের অনতিদূরে একটা বাগানে ঐ সময় আমি থাকতুম। লোকে সেটাকে ভূতের বাগান বলত। কিন্তু আমার তাতে ভয় হত না; জানিস তো আমি ব্রহ্মদৈত্য, ভূত-ফুতের ভয় বড় রাখিনি। ঐ বাগানে অনেক নেবুগাছ, বিস্তর ফলত। আমার তখন অত্যন্ত পেটের অসুখ, আবার তার ওপর সেখানে রুটি ভিন্ন অন্য কিছু ভিক্ষা মিলত না। কাজেই হজমের জন্য খুব নেবু খেতুম। পওহারী বাবার কাছে যাতায়াত করে তাঁকে খুব ভাল লাগল। তিনিও আমায় খুব ভালবাসতে লাগলেন। একদিন মনে হল, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে এত কাল থেকেও এই রুগ্ন শরীরটাকে দৃঢ় করবার কোন উপায়ই তো পাইনি। পওহারী বাবা শুনেছি, হঠযোগ জানেন। এঁর কাছে হঠযোগের ক্রিয়া জেনে নিয়ে শরীরটাকে দৃঢ় করে নেবার জন্য এখন কিছুদিন সাধন করব। জানিস তো আমার বাঙালের মত রোক। যা মনে করব, তা করবই। যে দিন দীক্ষা নেব মনে করেছি, তার আগের রাত্রে একটা খাটিয়ায় শুয়ে ভাবছি, এমন সময় দেখি-ঠাকুর আমার দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে আমার পানে চেয়ে আছেন, যেন বিশেষ দুঃখিত হয়েছেন। তাঁর কাছে মাথা বিকিয়েছি, আবার অপর একজনকে গুরু করব-এই কথা মনে হওয়ায় লজ্জিত হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলুম। এইরূপে বোধহয় ২।৩ ঘণ্টা গত হল; তখন কিন্তু আমার মুখ থেকে কোন কথা বেরোল না। তারপর হঠাৎ তিনি অন্তর্হিত হলেন। ঠাকুরকে দেখে মন এক-রকম হয়ে গেল, কাজেই সে দিনের মত দীক্ষা নেবার সঙ্কল্প স্থগিত রাখতে হল। দু-এক দিন বাদে আবার পওহারী বাবার নিকট মন্ত্র নেবার সঙ্কল্প উঠল। সেদিন রাত্রেও আবার ঠাকুরের আবির্ভাব হল-ঠিক আগের দিনের মত। এইভাবে উপর্যুপরি একুশ দিন ঠাকুরের দর্শন পাবার পর, দীক্ষা নেবার সঙ্কল্প একেবারে ত্যাগ করলুম। মনে হল, যখনই মন্ত্র নেব মনে করছি, তখনই যখন এইরূপ দর্শন হচ্ছে, তখন মন্ত্র নিলে অনিষ্ট বৈ ইষ্ট হবে না।

শিষ্য॥ মহাশয়, ঠাকুরের শরীর-রক্ষার পর কখনও তাঁহার সঙ্গে আপনার কোন কথা হয়েছিল কি?

স্বামীজী সে কথার কোন উত্তর না দিয়া নির্বাক হইয়া রহিলেন। খানিক বাদে শিষ্যকে বলিলেনঃ ঠাকুরের যারা দর্শন পেয়েছে, তারা ধন্য! ‘কুলং পবিত্রং জননী কৃতার্থা।’ তোরাও তাঁর দর্শন পাবি। যখন এখানে এসে পড়েছিস, তখন তোরা এখানকার লোক। ‘রামকৃষ্ণ’ নাম ধরে কে যে এসেছিলেন, কেউ চিনলে না। এই যে তাঁর অন্তরঙ্গ, সাঙ্গোপাঙ্গ-এরাও তাঁর ঠাওর পায়নি। কেউ কেউ কিছু কিছু পেয়েছে মাত্র। পরে সকলে বুঝবে। এই যে রাখাল-টাখাল যারা তাঁর এসেছে-এদেরও ভুল হয়ে যায়। অন্যের কথা আর কি বলব!

এইরূপ কথা হইতেছে, এমন সময় স্বামী নিরঞ্জনানন্দ দ্বারে আঘাত করায় শিষ্য উঠিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কে এসেছে?’ তিনি বলিলেন, ‘ভগিনী নিবেদিতা ও অপর দু-চার জন ইংরেজ মহিলা।’ শিষ্যের মুখে ঐ কথা শুনিয়া স্বামীজী বলিলেন, ‘ঐ আলখাল্লাটা দে তো।’ শিষ্য উহা আনিয়া দিলে তিনি সর্বাঙ্গ ঢাকিয়া সভ্য-ভব্য হইয়া বসিলেন এবং শিষ্য দ্বার খুলিয়া দিল। ভগিনী নিবেদিতা ও অপর মহিলারা প্রবেশ করিয়া মেজেতেই বসিলেন এবং স্বামীজীর শারীরিক কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিয়া সামান্য কথাবার্তার পরেই চলিয়া গেলেন। স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেন, ‘দেখছিস-এরা কেমন সভ্য! বাঙালী হলে আমার অসুখ দেখেও অন্ততঃ আধ ঘণ্টা বকাত।’ শিষ্য আবার দরজা বন্ধ করিয়া স্বামীজীকে তামাক সাজিয়া দিল।

বেলা প্রায় ২॥টা; লোকের খুব ভিড় হইয়াছে। মঠের জমিতে তিল-পরিমাণ স্থান নাই। কত কীর্তন, কত প্রসাদ-বিতরণ হইতেছে-তাহার সীমা নাই! স্বামীজী শিষ্যের মন বুঝিয়া বলিলেন, ‘একবার নয় দেখে আয়, খুব শীগগীর আসবি কিন্তু।’ শিষ্যও আনন্দে বাহির হইয়া উৎসব দেখিতে গেল। স্বামী নিরঞ্জনানন্দ দ্বারে পূর্ববৎ বসিয়া রহিলেন।

আন্দাজ দশ মিনিট বাদে শিষ্য ফিরিয়া আসিয়া স্বামীজীকে উৎসবের ভিড়ের কথা বলিতে লাগিল।

স্বামীজী॥ কত লোক হবে?

শিষ্য॥ পঞ্চাশ হাজার।

শিষ্যের কথা শুনিয়া স্বামীজী উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং সেই জনসঙ্ঘ দেখিয়া বলিলেন, ‘বড়জোর তিরিশ হাজার।’

উৎসবের ভিড় ক্রমে কমিয়া আসিল। বেলা ৪॥টার সময় স্বামীজীর ঘরের দরজা জানালা সব খুলিয়া দেওয়া হইল। কিন্তু তাঁহার শরীর অসুস্থ থাকায় কাহাকেও তাঁহার নিকটে যাইতে দেওয়া হইল না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!