-হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
তন্ত্র বলিলে কি বুঝায়, এখনও বুঝিতে পারি নাই। বৌদ্ধেরা বজ্রযান, সহজযান, কালচক্রযান– সকলকেই তন্ত্র বলে। কাশ্মীরী শৈবদের সকল গ্রন্থই তন্ত্র। নাথ-পন্থের সকল গ্রন্থই তন্ত্র। অন্যান্য শৈব সম্প্রদায়ের গ্রন্থও তন্ত্র। আবার শাক্তদের সব গ্রন্থও তন্ত্র। এখন আবার বৈষ্ণবদের পঞ্চরাত্রগুলিকেও তন্ত্র বলিতেছে। বাস্তবিকই বৈষ্ণবদের কয়েকখানি তন্ত্র আছে। এরূপ অবস্থায় তন্ত্র বলিলে হয় সব বুঝায়, নাহয় কিছুই বুঝায় না।
অনেক তন্ত্রে বলে, বেদে কিছু হয় না বলিয়াই আমাদের উৎপত্তি। আবার অনেকে বলেন, অথর্ববেদই তন্ত্রের মূল। মূলতন্ত্রগুলি হয় বুদ্ধদেবের মুখ হইতে উঠিয়াছে, নাহয় হরপার্বতীসংবাদ রূপে উঠিয়াছে। যেগুলি হরপার্বতীসংবাদ সেগুলি কেহ-না-কেই কৈলাস হইতে পৃথিবীতে ‘অবতারিত’ করিয়াছেন, না হইলে লোকে তাহ জানিবে কিরূপে ? একজন বৌদ্ধ তন্ত্রকার বলিয়াছেন,
“আমরা ব্রাহ্মণদের মত সুশব্দবাদী নহি। আমরা সোজ-কথায় লিখি। যে ভাষা সকলে বুঝিতে পরিবে আমরা এমন ভাষায় লিখি।”
মূল তন্ত্রে ব্যাকরণের বড় ধার ধারে না। কিন্তু মূল তন্ত্র বড় একটা পাওয়া যায় না, যাহা পাওয়া যায় তাহার অধিকাংশই সংগ্রহ। একজন তান্ত্রিক পণ্ডিত দুই-চারিধানি মূলতন্ত্র ও বহুসংখ্যক সংগ্রহ একত্র করিলেন, আবার তাহার উপর নিজের একখানি সংগ্রহ বাহির করিলেন। তাঁহার দলে সেই সংগ্রহ চলিতে লাগিল। এইরূপে অনেক সংগ্রহ চলিয়া গিয়াছে।
বাংলায় এই সকল সংগ্রহকর্তাদের প্রথম ও প্রধান– গৌড়ীয় শঙ্করাচার্য। তাঁহার অনেকগুলি সংগ্রহ পাওয়া গিয়াছে। তাঁহার স্তবগুলি বিশুদ্ধ সংস্কৃতে লেখা। সংস্কৃত ভাষায় তাহার যথেষ্ট অধিকার ছিল। তিনি নানা ছন্দে নানা স্তব লিখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার অনেক গ্রন্থ বড় শঙ্করাচার্যের বলিয়া চলিয়া যাইতেছে। কিন্তু বড় শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদী ছিলেন, তিনি তন্ত্র লিখিতে যাইবেন কেন ?
তন্ত্রের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া একটু নূতন। উহা ব্রাহ্মণদের কোন সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সহিত মিলে না। কিন্তু এখন বাংলার লোকে ঐরূপ সৃষ্টিপ্রক্রিয়াই জানে। সংগ্রহকারের মূলতত্ত্ব অনেক পরিষ্কার করিয়া তুলিয়াছেন। মূলতত্ত্বে অনেক প্রক্রিয়া আছে যাহা সভ্যসমাজে বাহির করা চলে না। সংগ্রহকারেরা উহা মার্জিত করিয়া লইয়াছেন, কিন্তু মার্জিত করিয়া লইলেও তাঁহাদের গুহ্য উপাসনা বড় সুবিধার নয়।
আমার বিশ্বাস তন্ত্র-সম্বন্ধে আলোচনা, যত কম হয়, ততই ভাল। কিন্তু যে সকল মহাপুরুষের এই লোকায়ত তন্ত্রশাস্ত্রকে মার্জিত করিয়া সভ্য সমাজের উপযোগী করিয়া গিয়াছেন এবং এইরূপ করায় অনেক লোক হিন্দু হইয়াছে ও হিন্দু হইয়া রহিয়াছে, তাঁহারা যে খুব দূরদর্শী ও সমাজনীতিকুশল, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
যাহা হউক শঙ্করের পর ত্রিপুরানন্দ, ব্ৰহ্মানন্দ ও পূর্ণানন্দ পূর্ববঙ্গে বৌদ্ধদিগকে হিন্দু করিয়া লইয়াছিলেন। ব্ৰহ্মানন্দদের পুস্তকে অক্ষোভ্য, বৈরোচন প্রভৃতি বুদ্ধের নাম পাওয়া যায়। অক্ষোভ্য এখানে ঋষি হইয়াছেন, বৈরোচন দেবতা হইয়াছেন। যে তারামন্ত্র সাধনের জন্য বশিষ্টদেবকে চীনে যাইয়া বুদ্ধদেবের শরণ লইতে হইয়াছিল, ব্রহ্মানন্দ সেই তারার পূজারই রহস্য লিখিয়া গিয়াছেন।
বাঙালী হিন্দুর মধ্যে একেবারে বৈষ্ণব অর্থাং বৈষ্ণবসম্প্রদায়ভুক্ত লোকের অপেক্ষ স্মার্ত পঞ্চোপাসকের দলই অধিক। ইঁহারা যদিও শাক্তসম্প্রদায়ভুক্ত নন, কিন্তু বাঙালীর জানে হিন্দু হইলেই হয় তাহাকে বৈষ্ণব না-হয় শাক্ত হইতে হইবে। সেইজন্য যাহারা বৈষ্ণব নহে, তাহারা সকলেই শাক্ত, শাক্তসম্প্রদায়ভুক্ত না হইলেও শাক্ত। এই দলকে বৈষ্ণবের গান অপেক্ষা শ্যামাবিষয়ক গানেই বেশী মাতাইয়া তুলে।
বৌদ্ধ মতে তারা অক্ষোভ্যেরই শক্তি। বৌদ্ধ মতে তারা, একজটা, নীলসরস্বতীর উপাসনা আছে, তারারহস্যেও তাই। বৌদ্ধরা শূন্যবাদী, তারারহস্যেও শূন্যের উপর শূন্য, তাহার উপর শূন্য, এইরূপে ষষ্ঠ শূন্য পর্যন্ত উঠিয়াছে। বৌদ্ধমতে এই সকল দেবীর ধারণী আছে, সাধন আছে; তারারহস্যে তাঁহাদের গায়ত্রী আছে। বােধ হয় ঐ অঞ্চলে অনেক বৌদ্ধ ছিল বলিয়া, এই উপায়েই ব্ৰহ্মানন্দ তাহাদিগকে হিন্দু করিয়া লইয়াছেন।
ব্রাহ্মাণদের শিষ্য পূর্ণানন্দ একজন খুব ক্ষমতাশালী পুরুষ ছিলেন। তাহার সংগ্রহগুলি আরও মার্জিত। তাহার অনেকগুলি গ্রন্থ আছে। তিনি বেশ সংস্কৃত লিখিতে পারিতেন। পূর্ববঙ্গে ও বরেন্দ্রে তাঁহার বংশধরেরাই গুরুগিরি করিয়া থাকেন, তাঁহাদের শিষ্যশাখা অসংখ্য।
রাঢ়ে আগমবাগীশের সংগ্রহ আরও মার্জিত। তাঁহার গ্রন্থে পঞ্চমকারের কথা নাই বলিলেই হয়, তাই এ দেশে তাহার বড়ই আদর। কিন্তু তাহারও গ্রন্থে মঞ্জুঘোষের উপাসনার ব্যাপার আছে। মধুঘোষ যে একজন বোধিসত্ত্ব, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।
তান্ত্রিক সংগ্রহকারেরা হতাবশিষ্ট বৌদ্ধগণকে নানা উপায়ে হিন্দু করিয়া লইয়াছেন, আপনার করিয়া লইয়াছেন। সুতরাং তাঁহারা বাংলা সমাজের যথেষ্ট উপকার করিয়া গিয়াছেন।
তান্ত্রিক মহাশয়েরা বঙ্গসমাজের অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করিয়াছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। বাংলা ভাষার সাহিত্য তাহার সাক্ষী। তাঁহাদের দলে বাংলা বই প্রচুর না হইলেও যথেষ্ট আছে এবং সেগুলি বেশ ভাল। তাঁহাদের শ্যামাবিষয়ক গানগুলি বাংলার একটি শ্লাঘার বিষয়। আজিও কেহ সংগ্রহ করে নাই, তাই তাহদের সংখ্যা করা যায় না। রামপ্রসাদের গান শুনিয়া মোহিত হয় না এমন বাঙালী কি কেহ আছে ? দেওয়ানজি মহাশয়ের ও কমলাকান্তের গান অনেক সময় হৃদয়ের নিগূঢ় তন্ত্রীগুলি বাজাইয়া দেয়।
বাঙালী হিন্দুর মধ্যে একেবারে বৈষ্ণব অর্থাং বৈষ্ণবসম্প্রদায়ভুক্ত লোকের অপেক্ষ স্মার্ত পঞ্চোপাসকের দলই অধিক। ইঁহারা যদিও শাক্তসম্প্রদায়ভুক্ত নন, কিন্তু বাঙালীর জানে হিন্দু হইলেই হয় তাহাকে বৈষ্ণব না-হয় শাক্ত হইতে হইবে। সেইজন্য যাহারা বৈষ্ণব নহে, তাহারা সকলেই শাক্ত, শাক্তসম্প্রদায়ভুক্ত না হইলেও শাক্ত। এই দলকে বৈষ্ণবের গান অপেক্ষা শ্যামাবিষয়ক গানেই বেশী মাতাইয়া তুলে।
………………….
আরও পড়ুন-
নানা ধর্মমত
বৌদ্ধ শীলভদ্র
বৌদ্ধ লেখক শান্তিদেব
নাথপন্থ
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
জগদ্দল মহাবিহার ও বিভূতিচন্দ্র
বৃহস্পতি, শ্রীকর, শ্রীনাথ ও রঘুনন্দন
ন্যায়শাস্ত্র
চৈতন্য ও তাঁহার পরিকর
তান্ত্রিকগণ
বাঙালী ব্রাহ্মণ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….