কর্তাভজা সত্যধর্মের আদর্শ ও উদ্দেশ্য
কর্তাভজা সত্যধর্মের আদর্শ
১. একেশ্বরবাদ:
ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবীর অর্চনা করার পরিবর্তে মালিক এক অদ্বীতিয় এবং তিনিই সর্বশক্তিমান, সর্বমঙ্গলময় এই অটল বিশ্বাসে এক-মালিকের ভজনা করাই একেশ্বরবাদ।
আমি একলা একেশ্বর দোসর তো কেউ নাই,
পার করি বে-ওজরি যে জনারে পাই,
(ভাবেরগীত নং- ২৭৬, কলি- ৩)
বেদে ব্রহ্ম এক সারবস্তু নিরাকার,
তবে পঞ্চ তত্ত্ব কি জন্যে প্রচার,
আর পাঁচ ভাবে ভাবিয়ে ভাবি, কেমনে হবে পার,
(ভাবেরগীত নং- ৪১২, কলি-৩)
২. গুরুবাদ:
বৈষম্য মূলক ৪ জাত ৩৬ বর্ণ বংশগত জাতিভেদ-বর্ণভেদ-কৌলিন্য প্রথা তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের সমাজব্যবস্থার পরিবর্তে জাত-পাত-বর্ণ-গোত্র-বিহীন গুণ ও কর্মে যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তির নেতৃত্বে-পৌরহিত্যে সমাজ ব্যবস্থা এবং ধর্ম-কর্ম অনুষ্ঠান পরিচালিত হওযার নামই গুরুবাদ।
দেখ ছত্রিশ বর্ণ চার জাতি কারু খান্ না তিনি,
বর্ণ মধ্যে কোন বর্ণ তা শুনি হন্ মানুষে নিশানি,
(ভাবেরগীত নং- ৪২১, কলি-৪)
সে পাগল বলে খাস মেওয়া জগতে বিলাব,
ডাঙ্গা-ডহর একঢল করিব সব এক বুলি বলাব,
(ভাবেরগীত নং- ৮৪, কলি-৪)
গুরুর পাদপদ্মে শশী লালের সকল ফলাফল ॥
সারকর মন গুরু করুণা সিন্ধু চরণ যুগল।
(উপাসনা তত্ত্ব – ১, কলি-৪, ২)
৩. অসাম্প্রদায়িকতা:
ধর্মীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে সকলের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সহবস্থান এবং সকলেই আমরা এক জগৎ মাতার সন্তান, এই বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব বোধই কর্তাভজা সত্যধর্মের আদর্শ, অসাম্প্রদায়িকতার নিদর্শন স্বরূপ কর্তাভজা সম্প্রদায়গণ ধর্মের ভিত্তিতে দেহে কোন চিহ্ন ধারণ করে না।
ভাইরে মগ ফিরিঙ্গি ওলন্দাজ হিন্দু মুসলমান,
এক বিধাতায় গড়েছে বস্তু তাই আছে সব দেহে সমান,
(ভাবেরগীত নং- ৪২০, কলি- ১)
আছে মানুষে মানুষে যার ভেদাভেদ জ্ঞান,
সে রাজ্যে গমনে তার মিলবে না সন্ধান,
(ভাগেরগীত নং- ৪২১, কলি-১)
৪. আধ্যাত্মিকতা:
আমি কে, কোথায় ছিলাম, কোথায় এলাম, কোথায় যাব, আমার শেষ পরিণতি কি, দুর্লভ এই মানব জনমের উদ্দেশ্য কি অর্থাৎ আত্ম দর্শন বা নিজেকে জানা। এই নিজেকে জানার নামই আধ্যাত্মিকতা।
মুখের কথা কথার কথা কোন কাজের নয়,
নিগম ঘরে বসে দুরের খবর রাখতে হয়,
(ভাবেরগীত নং- ৩২৩ কলি- ২)
যার জন্যে এসেছ এ ভব সংসারে,
তার ঠিকানা র্কতে যে জন পারে, সাবাস বলি তারে,
(ভাবেরগীত নং- ১৮৪ কলি- ৩)
কেউ ঐ জলধির অবধি চাও যদি দেখিতে,
তার ঠিকানা আর কোথাও পাবে না, দেখতে হয় আপনাতে,
(ভাবেরগীত নং- ২৭২ কলি- ৪)
৫. সহজভাব (আমিত্ব বর্জন):
দেহ-মন-বাক্য দ্বারা সর্বতোভাবে আমিত্ব বর্জন করার নাম সহজভাব। অর্থ-সম্পদ, রূপ-যৌবন, দেহবল-লোকবল, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিদ্যা-বংশ গৌরব, মান-সম্মান, নাম-যশ-খ্যাতি এ সবের মোহে মোহাচ্ছন্ন হলে দেহ-মন-বাক্যে যে ভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার নাম আমিত্ব। আমিত্ব বোধের নামান্তর অহংকার, আমিত্ব বোধ মালিক উপসনার পথে বিশেষ অন্তরায়।
প্রত্যেক মানুষের মাঝে আমি (জীবাত্মা) আছে, জীবাত্মা যতক্ষণ আছে আমি ততক্ষণ থাকবে। মালিককে উপেক্ষা করে যখন ‘আমিই করেছি আমি করবো-ই, ইত্যাদি, এ জাতীয় মনোভাব প্রকাশের নাম আমিত্ব। যখন আমির সাথে তুমি অর্থাৎ মালিক যোগ হয় তখন ‘তুমি যা বলাও তাই বলি যা করাও তাই করি ইত্যাদি এই মনোভাবের উদয় হেতু ক্রমান্বয়ে আমি তুমি’তে পরিণত হয়ে মালিকে লয় প্রাপ্ত হয়, তখন সব কিছুই তুমি হয়ে যায়, মন এই অবস্থা প্রাপ্ত হলে তার নাম সহজ ভাব বা আমিত্ব বর্জন।
আছে মানুষে মানুষে যার ভেদাভেদ জ্ঞান,
সে রাজ্যে গমনে তার মিলবে না সন্ধান,
ভাই তুমি আমি ছেড়ে ভজ তুমি,
তবে কে আমি তুমিই সর্ব্বভুতে।
(ভাবেরগীত নং- ৪২১, কলি- ১)
কর্তাভজা সত্যধর্মের উদ্দেশ্য
বর্ণবৈষম্যমূলক ব্রাহ্মণ্যবাদের কু-সংস্কার পূর্ণ সমাজব্যবস্থার বিপরীতে ধর্ম-কর্ম, জীবন-জীবিকা, সমাজব্যবস্থায় সকলের সম অধিকার তথা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করা এবং উপাসনা-প্রার্থনা, সাধন-ভজনের মাধ্যমে মায়ামুগ্ধ জীবের পারমার্থিক মুক্তির পথ সুগম করাই কর্তাভজা সর্তধর্মের মূল উদ্দেশ্যে। মানুষের মাঝে যে পরমের বাস তাকে কর্তা জ্ঞানে ভজন করা তাকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করা।
…………………………………..
সূত্র ও কৃতজ্ঞতা:
১. ভবের গীত
২. কর্তাভজা সত্যধর্ম
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………..
আরও পড়ুন-
কর্তাভজা সত্যধর্মের ৩০ ধারা
রামশরণ ও সতীমার দীক্ষাগ্রহণ
সতী মা
কর্তাভজা সত্যধর্ম
কর্তাভজার দশ আজ্ঞা
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব
ডালিম তলার মাহাত্ম্য
বাইশ ফকিরের নাম
কর্তা
দুলালচাঁদ
কর্তাভজা সত্যধর্মের পাঁচ স্তম্ভ
সাধন-ভজন ও তার রীতি নীতি
ভাবেরগীত এর মাহাত্ম্য
কর্তাভজা সত্যধর্মের আদর্শ ও উদ্দেশ্য