-প্রণয় সেন
বাংলা ১২৪৮ সালের ১৩ শ্রাবণ। সোমবার। সেদিন ছিল ঝুলন পূর্ণিমার রাত। জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় প্লাবিত হয়ে গেছে নদীয়া জেলার দহকুল গ্রাম। এই গ্রামেই বিজয়কৃষ্ণের মামাবাড়ি। আর এই মামাবাড়িতেই সেই পূর্ণিমার আলোয় এক কচুবনের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক দেবশিশু। হ্যাঁ, কচুবনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিজয়কৃষ্ণ।
বিধাতার এক রহস্যময় বিধানে সেখানেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন মহান ভক্তিসাধক। পিতৃদেব প্রভুপাদ আনন্দকিশোর গোস্বামী চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ভাগবত পাঠ করতেন, নিজের গলায় সর্বক্ষণ পরম অলঙ্কার হিসেবে ঝুলিয়ে রাখতেন ‘দামোদর’ নামে শালগ্রাম শিলা।
সেদিন সেই পবিত্র ঝুলন পূর্ণিমার রাত্রে ঠিক জন্মসময়ে হঠাৎ কোনও কারণে ইংরেজের পুলিশ এসে হানা দিয়েছিল বিজয়কৃষ্ণের মামাবাড়িতে। এতে শঙ্কিত হয়ে বিজয়কৃষ্ণের মাতৃদেবী ঘর ছেড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাড়ির কাছেই এক কচুবনে। বিধাতার এক রহস্যময় বিধানে সেখানেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন মহান ভক্তিসাধক।
পিতৃদেব প্রভুপাদ আনন্দকিশোর গোস্বামী চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ভাগবত পাঠ করতেন, নিজের গলায় সর্বক্ষণ পরম অলঙ্কার হিসেবে ঝুলিয়ে রাখতেন ‘দামোদর’ নামে শালগ্রাম শিলা।
এই দুই স্ত্রী লোকান্তরিত হওয়ার দীর্ঘকাল পরে ৫০ বছর বয়সে বড় ভাই গোপীমাধব গোস্বামীর অন্তিম অনুরোধে তৃতীয়বার বিয়ে করেন স্বর্ণময়ীদেবীকে। স্বর্ণময়ীর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন দুই পুত্র- ব্রজগোপাল এবং বিজয়কৃষ্ণ।
একদিন বিজয়কৃষ্ণ এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে। শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন বিজয়কৃষ্ণ শান্তিপুরের বিখ্যাত গোঁসাই পরিবারের সন্তান। তাই কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘আমি শান্তিপুরের এক গোঁসাই-এর কথা শুনেছিলাম, তাঁর ভাগবত পাঠের সময় প্রতি লোমকূপ হতে রক্তোদগম হত, আর তিনি মাঝে মাঝে এমন হুঙ্কার দিতেন, যা বহুদূর থেকে শোনা যেত।’
সে কথা শুনে প্রভু বিজয়কৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘তিনি আমারই পিতা ছিলেন।’ সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, ‘অমন বাপ না হলে কি এমন ছেলে হয় ?’ আনন্দকিশোর পর পর দু’বার বিবাহ করেন। কিন্তু কোনও পুত্র সন্তানের মুখ দেখতে পাননি। এই দুই স্ত্রী লোকান্তরিত হওয়ার দীর্ঘকাল পরে ৫০ বছর বয়সে বড় ভাই গোপীমাধব গোস্বামীর অন্তিম অনুরোধে তৃতীয়বার বিয়ে করেন স্বর্ণময়ীদেবীকে।
স্বর্ণময়ীর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন দুই পুত্র- ব্রজগোপাল এবং বিজয়কৃষ্ণ।
একটা উলঙ্গ মহিলা একটা বাঘের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। মহিলার কী দুঃসাহস। মজার কথা, বাঘটাও চুপচুপ শুয়ে আছে, ঠিক যেন পোষা বেড়াল।’ এই আলোচনা শুনেই তাঁর মনে হল, এই কি তবে আমার মা?
শিশুকাল থেকেই বিজয়কৃষ্ণের মধ্যে দেখা দেয় নানা ধরণের বিস্ময়। সকাল সন্ধ্যা তুলসীতলায় গড়াগড়ি দেয় ছোট্ট শিশু, কথা বলেন গৃহদেবতা শ্যামসুন্দরের সঙ্গে এবং শ্যামসুন্দরের সঙ্গে খেলা করেন। মা স্বর্ণময়ীদেবী এ সবই দেখেন। স্বর্ণময়ীও এক দিব্য স্বভাবের নারী। এক ফকিরের আশীর্বাদে তাঁর পিতা গৌরীদাস জোদ্দার এই কন্যাকে লাভ করেছিলেন।
কেউ কেউ তাঁকে পাগল বলে ভাবতেন, আবার কেউ কেউ তাঁকে সাক্ষাৎ দেবী বলে মনে করতেন। একবার হঠাৎই স্বর্ণময়ীদেবী নিখোঁজ হয়ে গেলেন। মা-কে খুঁজে বার করার জন্য বিজয়কৃষ্ণ পাগলের মতো চারিদিকে ছোটাছুটি করলেন।
কিন্তু সবাই নিষ্ফল। আগেই তিনি হারিয়েছেন (১২৫১ সনের অক্ষয় তৃতীয়ায়) পিতাকে। একদিন রাণাঘাট স্টেশনে বসে আছেন তিনি। এমন সময় কয়েকজন কাঠুরের কথাবার্তা তাঁর কানে এল। তাঁরা বলছিলেন, ‘জঙ্গলে একটা অদ্ভুত ঘনটা দেখলাম। একটা উলঙ্গ মহিলা একটা বাঘের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। মহিলার কী দুঃসাহস। মজার কথা, বাঘটাও চুপচুপ শুয়ে আছে, ঠিক যেন পোষা বেড়াল।’ এই আলোচনা শুনেই তাঁর মনে হল, এই কি তবে আমার মা?
এমন একটা প্রতিকূল পরিবেশে বিজয়কৃষ্ণ বেশিদিন তুলসীমালা বা তিলকের ওপর আস্থা রাখতে পারলেন না। তিনি হয়ে উঠলেন সংশয়বাদী, হয়ে উঠলেন বৈদান্তিক।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি কয়েকজন লোককে নিয়ে রাণাঘাটের কাছেই সেই জঙ্গলে গিয়ে হাজির হলেন। জঙ্গলে ঢুকে একটু খোঁজাখুঁজি করার পরই দেখতে পেলেন সেই বিস্ময়কর দৃশ্য। দূর থেকে দেখলেন, তাঁর মা সেই ভয়ঙ্কর বাঘের দেহে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, আর অভিমানের সুরে বলছেন, তুই তো আমার নয়, তুই দশভুজার। আমি কালী।
তুই আমার হলে আমাকে তো পিঠে করতিস। যাকগে, তুই শুয়ে থাক, আমি তোর খাবার নিয়ে আসি। এই কথা বলে তিনি যে-ই জঙ্গলের বাইরে এলেন, অমনি বিজয়কৃষ্ণ ছুটে গিয়ে মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। পুত্রকে দেখে মায়ের মনেও প্রবাহিত হল স্নেহের ফল্গুধারা। তিনি পুত্রের সঙ্গেই ফিরে এলেন ঘরে।
এই অলৌকিক খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। শান্তিপুরের ভগবান গুরুর পাঠশালায় বিজয়কৃষ্ণের প্রথম পাঠ শুরু হয়। তারপর এলেন হেজল নামের এক পাদ্রী সাহেবের পাঠশালায়। এখানে তিনি খুব মন দিয়ে বাইবেল পাঠ করেন। গোবিন্দ ভট্টাচার্যের টোল, পণ্ডিত কৃষ্ণগোপালের চতুষ্পাঠী হয়ে ইংরেজি ১৮৫৯ সালে তিনি এসে ভর্তি হলেন কলকাতার সংস্কৃত কলেজে।
সেই সময়ে কলকাতায় উদ্ধত নব্য বঙ্গের যুব শ্রেণীর প্রভাব খুব বেশি, খ্রিস্ট ভাবাশ্রিত কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাবও ক্রমবর্ধমান, খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের একটা ঝোঁক যুবকদের মধ্যে—এমন একটা প্রতিকূল পরিবেশে বিজয়কৃষ্ণ বেশিদিন তুলসীমালা বা তিলকের ওপর আস্থা রাখতে পারলেন না। তিনি হয়ে উঠলেন সংশয়বাদী, হয়ে উঠলেন বৈদান্তিক।
তাঁর নিজের কথায়, ‘হিন্দুশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া ঘোর বৈদান্তিক হইয়া পড়িলাম। …উপসনার আবশ্যকতা স্বীকার করিতাম না।’ সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময়েই তিনি রামচন্দ্র ভাদুড়ীর কন্যা যোগমায়াদেবীকে বিয়ে করেন। সংস্কৃত কলেজ থেকে ‘পণ্ডিত’ হয়ে তিনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন শল্যবিদ হওয়ার জন্য। তিনি স্থির করলেন, সেবা ব্রতকেই জীবনব্রত হিসেবে গ্রহণ করবেন।
সেই সময়েই ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ এবং চিকিৎসা বিদ্যার শেষ পরীক্ষায় না বসেই তিনি ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারক হয়ে পূর্ববঙ্গ সফরে বেরিয়ে পড়লেন। প্রচারকরূপে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতও পরিভ্রমণ করেন। সেই সময়েই তিনি কাশীতে তৈলঙ্গস্বামীকে দর্শন করেন।
সুস্থ হয়ে আবার শুরু হল উত্তরভারতের তীর্থপরিক্রমা। এলেন গয়াধামে। সেখানে সাক্ষাৎ হল রামাইৎ সাধু রঘুবীর দাসের সঙ্গে। তারপর ফল্গুনদীর অপর পাড়ে রামগয়ায় সাক্ষাৎলাভ হয় যোগীবর গম্ভীরনাথের সঙ্গে। এলেন আকাশগঙ্গা পাহাড়ের শীর্ষভূমিতে।
উত্তর ভারতে যখন তিনি ঘুরছিলেন; তখন হঠাৎই এক কঠিন রোগে তিনি মরণাপন্ন হয়ে পড়েন।শোনা যায়, এই দুঃসংবাদ পেয়ে ঢাকার অধিবাসী তাঁরই এক প্রিয় শিষ্য ছুটে গেলেন বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কাছে। করুণ আবেদন জানালেন, গুরুর জীবন রক্ষা করুন, তাতে আমার আয়ু নিতে হয়, নিন।
গুরুগত প্রাণ এই শিষ্যকে দেখে লোকনাথ ব্রহ্মচারী প্রীত হলেন, বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। শুভ সংবাদ পাবে।’ যথাসময়ে শুভ সংবাদ এল। পরবর্তীকালে বিজয়কৃষ্ণের একজন শিষ্য বলেন, সে এক অলৌকিক ব্যাপার। মরণাপন্ন বিজয়কৃষ্ণের শিয়রে দেখা যেত লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে। অথচ তিনি তখন ঢাকার বারদীতেই ছিলেন।
সুস্থ হয়ে আবার শুরু হল উত্তরভারতের তীর্থপরিক্রমা। এলেন গয়াধামে। সেখানে সাক্ষাৎ হল রামাইৎ সাধু রঘুবীর দাসের সঙ্গে। তারপর ফল্গুনদীর অপর পাড়ে রামগয়ায় সাক্ষাৎলাভ হয় যোগীবর গম্ভীরনাথের সঙ্গে। এলেন আকাশগঙ্গা পাহাড়ের শীর্ষভূমিতে।
তারপর গুরুর নির্দেশেই কাশীধামে এসে হরিহরানন্দ সরস্বতীর পদপ্রান্তে বসে গ্রহণ করলেন সন্ন্যাস। বিজয়কৃষ্ণের হল নতুন জন্ম, নতুন পরিচয়। সন্ন্যাস নাম হল অচ্যুতানন্দ সরস্বতী।
সেখানে অলৌকিকভাবে দেখা পেলেন এক যোগসিদ্ধ মহাপুরুষের। তিনি দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বিজয়কৃষ্ণ অনুভব করলেন সর্বদেহে এক অপূর্ব শিহরণ। অধীর হয়ে উঠলেন তিনি সেই মহাপুরুষকে আবার দর্শন করার জন্য। একদিন রামশিলা পাহাড়ের অরণ্যে আবার দর্শন পেলেন তাঁর। সেই দর্শন দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তরুণ সাধক বিজয়কৃষ্ণ হয়ে উঠলেন অস্থির।
অবশেষে এক শুভদিনে আকাশগঙ্গা পাহাড়ে এই মহাপুরুষ ব্রহ্মানন্দ স্বামী দীক্ষা দিলেন বিজয়কৃষ্ণকে। তারপর গুরুর নির্দেশেই কাশীধামে এসে হরিহরানন্দ সরস্বতীর পদপ্রান্তে বসে গ্রহণ করলেন সন্ন্যাস। বিজয়কৃষ্ণের হল নতুন জন্ম, নতুন পরিচয়। সন্ন্যাস নাম হল অচ্যুতানন্দ সরস্বতী।
কাশীধাম থেকে এলেন আবার গয়াধামের আকাশগঙ্গা পাহাড়ে। গুরু ব্রহ্মানন্দের নির্দেশে শুরু হল কঠোর যোগ সাধনা, আসন পাতলেন এক নির্জন গুহায়। লাভ করলেন যোগসিদ্ধি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশবচন্দ্র সেনের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রথম জীবনে ব্রাহ্মধর্মের একজন মহান প্রচারক রূপেই সর্বজনের কাছে ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয়। তিনি স্বীয় জীবন মাধুর্যে হয়ে উঠেছিলেন প্রেম ভক্তির প্রতীক।
অনন্তকে উপলব্ধি করার জন্যও যে একটা পর্যায় পর্যন্ত প্রতিমা বা মূর্তির পূজা প্রয়োজন, অনুভব করলেন আধ্যাত্মিক ভারতের সেই সনাতন সত্য ধারণাকে।
শিবনাথ শাস্ত্রী বলতেন, ‘গোঁসাইকে সকলের সামনে দেখিয়ে বেড়ালে, তাঁর এই ভক্তিসমৃদ্ধ মূর্তি দেখালেই ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার হবে আর কোনও প্রচেষ্টার দরকার হবে না।’ একসময় বিজয়কৃষ্ণ স্বীয় মহিমায় ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য পদ লাভ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই নিরাকারবাদী ব্রাহ্ম-আচার্যের জীবনে ঘটল আমূল রূপান্তর।
অবতার বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণ এবং কাশীর সচল শিব শ্রী তৈলঙ্গস্বামীর প্রভাবে তিনি একসময় নিরাকার ব্রহ্মের চিন্তা থেকে চলে এলেন সাকার আরাধনায়। অনন্তকে উপলব্ধি করার জন্যও যে একটা পর্যায় পর্যন্ত প্রতিমা বা মূর্তির পূজা প্রয়োজন, অনুভব করলেন আধ্যাত্মিক ভারতের সেই সনাতন সত্য ধারণাকে।
আর তরুণ দর্শনপ্রার্থী বিজয়কৃষ্ণ নদীর তীর ধরে তাঁকে অনুসরণ করে অবিরাম ছুটে চলেছেন। এই অপূর্ব দৃশ্য কল্পনা করেও গায়ে শিহরণ জাগে। একজনকে দর্শন করার জন্য, ধরার জন্য আরেকজনের কী গভীর ব্যাকুলতা।
এ জন্য ব্রাহ্ম বিজয়কৃষ্ণকে অতিক্রম করতে হয়েছে এক ভিন্নতর সাধনার পথ। সেবার তিনি তীর্থ পরিক্রমা করতে করতে শিবপুরী কাশীতে এসেছেন। তখনও তিনি নিরাকার ব্রহ্মের চিন্তায় তন্ময়, বিশ্বাস করেন না মূর্তি পূজায়। হৃদয়ে তাঁর মুক্তিলাভের এবং সত্য দর্শনের প্রবল এষণা। অন্তরের গভীরে তাই সদাই অনুভব করেন এক প্রচণ্ড অস্থিরতাকে।
কোথায় যাবেন, কার কাছে গিয়ে সঠিক পথের সন্ধান পাবেন—সেই চিন্তায় তিনি তখন উতলা। কাশীতে আসার পর তিনি দর্শন করলেন তৈলঙ্গস্বামীকে। সে-ও এক বিচিত্র দর্শন। উলঙ্গ তৈলঙ্গস্বামী সহস্রচক্ষুর সামনে গঙ্গায় ভেসে বেড়াচ্ছেন, গঙ্গার স্রোতে এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে ভেসে চলে যাচ্ছেন। আর তরুণ দর্শনপ্রার্থী বিজয়কৃষ্ণ নদীর তীর ধরে তাঁকে অনুসরণ করে অবিরাম ছুটে চলেছেন।
এই অপূর্ব দৃশ্য কল্পনা করেও গায়ে শিহরণ জাগে। একজনকে দর্শন করার জন্য, ধরার জন্য আরেকজনের কী গভীর ব্যাকুলতা।
তারপর যখন জল থেকে উঠে এসে তৈলঙ্গস্বামী এক জায়গায় স্থির হয়ে বসলেন, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়ে হাজির হলেন বিজয়কৃষ্ণ। বিজয়কৃষ্ণকে দেখেই চলমান শিব চঞ্চল হয়ে উঠতেন কিছু খাওয়াবার জন্য। তিনি সেখানে উপস্থিত ভক্তদের ইঙ্গিতে আদেশ করতেন গোঁসাইজির জন্য ভাল ভাল খাবার, মিষ্টি নিয়ে আসতে।
ভক্তরা তৎক্ষণাৎ সেই আদেশ পালন করতেন। এবার তিনি পরম স্নেহে নানারকম ইঙ্গিত করে বিজয়কৃষ্ণকে সেগুলি খাওয়াতেন। গোঁসাই খেলে তিনি তৃপ্তি পেতেন, প্রসন্ন হতেন। তৈলঙ্গস্বামীর গঙ্গা বিহার নিয়ে বিজয়কৃষ্ণের নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেইসব অভিজ্ঞতার কথা তিনি পরবর্তীকালে বলেছেন। এভাবেই চলছিল দুই মহাপুরুষের স্বর্গীয় লীলা। সম্ভবত ভাবীকালের জন্য চলছিল এক অপূর্ব প্রস্তুতিপর্ব। একদিন সেই পর্বের পরিণতি হয়ে উঠল অনিবার্য।
‘শোন, একটা বিশেষ কারণে তোমাকে দীক্ষা দেব। তবে আসল দীক্ষা আমি দেব না। শরীর শুদ্ধ করার জন্য গুরুকরণ করতে হয়, তাই গুরুকরণ করা প্রয়োজন। তাই বলে আমি তোমার প্রকৃত গুরু নই।’
সেদিন আকস্মিকভাবে তৈলঙ্গস্বামী ব্রাহ্ম বিজয়কৃষ্ণকে বললেন, ‘এবার আমি তোমাকে মন্ত্রদীক্ষা দেব।’ এমন কথা যে শুনতে হবে তা গোঁসাইজি কল্পনাও করতে পারেননি। তাই তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে অন্তরঙ্গ মেলামেশার ফলে দুজনের আধ্যাত্মিক সম্পর্কও অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছিল।
স্পষ্ট করেই প্রভু বিজয়কৃষ্ণ বললেন, ‘আচ্ছা, আপনার কাছে আমি কেন দীক্ষা নেব ? আমি তো ব্রাহ্ম, আপনি আমাকে কী করে দীক্ষা দেবেন ?’ চলমান শিবের মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘শোন, একটা বিশেষ কারণে তোমাকে দীক্ষা দেব। তবে আসল দীক্ষা আমি দেব না। শরীর শুদ্ধ করার জন্য গুরুকরণ করতে হয়, তাই গুরুকরণ করা প্রয়োজন। তাই বলে আমি তোমার প্রকৃত গুরু নই।’
এরপর তিনি প্রভু বিজয়কৃষ্ণকে ত্রিবিধ মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। দীক্ষাদানের পর বললেন, ‘এবার তুমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। আমাকে ভগবান যে আদেশ দিয়েছিলেন, আমি তা পালন করলাম মাত্র।’ তারপর ? তারপর কাশীর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। প্রভু বিজয়কৃষ্ণের জীবনেও ঘটেছে আধ্যাত্মিক রূপান্তর।
তিনি গ্রহণ করেছেন সন্ন্যাস এবং যোগসাধন, হয়েছেন ভক্তিসাধক। আবার ফিরে এলেন কলকাতায়। আবার সেই ব্রাহ্মসমাজ। কিন্তু সেই সময় কেশবচন্দ্র সেনের নাবালিকা কন্যাকে কোচবিহার রাজ পরিবারে বিয়ে দেওয়া নিয়ে ব্রাহ্মসমাজে দেখা দিল চরম মতবিরোধ। কারণ, ব্রাহ্মরা ছিলেন বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে।
কেশবচন্দ্রের নবধর্মের বিরোধিতায় বিজয়কৃষ্ণ, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ গড়ে তুললেন ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’। বিজয়কৃষ্ণ ঢাকায় গেলেন সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারক হিসেবে। এই সময় কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী বিজয়কৃষ্ণের কৃপালাভ করে সিদ্ধ সাধক কুলদানন্দে রূপান্তরিত হন।
স্মরণ করতে হয়, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য রূপে তিনি যখন অবতার বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যেতে শুরু করেন, তখন ধীরে ধীরে তাঁর অন্তরলোকে সুগভীর পরিবর্তনের সূচনালগ্ন।
কুলদানন্দের বড় ভাই সারদাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিজয়কৃষ্ণের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেন। ঢাকায় সদাই নাম সংকীর্তনে বিভোর হয়ে থাকতেন বিজয়কৃষ্ণ। তাঁর এই ‘হিন্দুসুলভ’ আচরণকে ব্রাহ্ম নেতারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। অবশেষে তিনিও ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করে ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় কুটির বানিয়ে সাধন ভজনেই হলেন আত্মসমাহিত, হলেন ভক্তি সাধক বিজয়কৃষ্ণ।
বিজয়কৃষ্ণের এই রূপান্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের ঘটনাগুলিও স্মরণ করতে হয়। স্মরণ করতে হয়, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য রূপে তিনি যখন অবতার বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যেতে শুরু করেন, তখন ধীরে ধীরে তাঁর অন্তরলোকে সুগভীর পরিবর্তনের সূচনালগ্ন।
বিজয়কৃষ্ণের উচ্চ অধ্যাত্ম অবস্থা সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন বললেন, ‘বিজয় এখন সমাধিগৃহের দ্বারে করাঘাত করছে।’ বিজয়কৃষ্ণ একদিন ভাবে বিভোর হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের পা দুটি নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভগবানের অবতার।’ সেদিনের সেই অপরূপ দৃশ্য ছিল অনির্বচনীয়। শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসে বিজয়কৃষ্ণের চিন্তাজগতে দেখা দিল পরিবর্তনের স্রোত।
তিনি যেন নতুন এক অধ্যাত্ম আলোয় হলেন উদ্ভাসিত, উপলব্ধি করলেন সনাতন ধর্মের সত্যস্বরূপ এবং সাকার ঈশ্বরে হয়ে উঠলেন বিশ্বাসী। শুধুমাত্র বিজয়কৃষ্ণ নন, সেই সময়কার ব্রাহ্ম আন্দোলনের সকল নায়কই শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং এই ব্রাহ্ম সমাজের সূত্রেই সে যুগের সেরা তরুণরা পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের অপ্রতিরোধ্য প্রভাবের স্পর্শ। সেদিনই শুরু হয়েছিল এক নতুন যুগ।
আমরা এখানে শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে এক দিনের কথা স্মরণ করতে পারি।
বিজয়কৃষ্ণ শূল বেদনায় দারুণ কষ্ট পান, তাই সঙ্গে শিশিতে ওষুধ এনেছেন। ওষুধ খাওয়ার সময় হলে খাবেন। তখন তিনি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য।
সেদিনা ছিল ১৮৮২ সালের ১৪ ডিসেম্বর। বৃহস্পতিবার। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করতে এসেছেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। সঙ্গে আরও তিন-চারজন ব্রহ্মভক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণের পরম ভক্ত বলরাম বসুর সঙ্গে তাঁরা নৌকোয় কলকাতা থেকে এসেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ দুপুরে সবেমাত্র একটু বিশ্রাম করছেন।
তিনি তক্তপোষের ওপর বসে আছেন। বিজয়কৃষ্ণ এবং অন্যান্য ভক্তরা তাঁর দিকে মুখ করে মেঝেতে বসেছেন। বিজয়কৃষ্ণ শূল বেদনায় দারুণ কষ্ট পান, তাই সঙ্গে শিশিতে ওষুধ এনেছেন। ওষুধ খাওয়ার সময় হলে খাবেন। তখন তিনি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য।
কথামৃতকার ‘শ্রীম’ বলেছেন, মহাভক্ত পূর্বপুরুষ শ্রীঅদ্বৈতের শোণিত বিজয়কৃষ্ণের ধমনীতে প্রবাহিত, শরীর মধ্যস্থিত হরিপ্রেমের বীজ এখন প্রকাশোন্মুখ—কেবল কাল প্রতীক্ষা করছে। তাই তিনি ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের দেবদুর্লভ হরিপ্রেমে ‘গরগর মাতোয়ারা’ অবস্থা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।
মন্ত্রমুগ্ধ সাপ যেমন ফণা ধরে সাপুড়ের কাছে বসে থাকে, বিজয়কৃষ্ণ পরমহংসদেবের শ্রীমুখনিঃসৃত ভাগবত শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে বসে থাকেন। আবার যখন শ্রীরামকৃষ্ণ হরিপ্রেমে বালকের মতো নাচতে থাকেন, বিজয়ও তাঁর সঙ্গে নাচতে থাকেন।
ভগবান চৈতন্যদেবের লীলাভূমি তাঁকে তখন প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে। শ্রীক্ষেত্রে এসে জগন্নাথ মন্দিরের ধ্বজা দর্শন করেই তিনি ভাবাবেশে মত্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর শ্রীক্ষেত্র লীলায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যই ছিলেন সর্বক্ষণের ধ্যান জ্ঞান। এই শ্রীক্ষেত্রেই ঘটল তাঁর অন্ত্যলীলা।
বিজয়কৃষ্ণ নানা প্রসঙ্গের পর জানতে চাইলেন, ‘ঈশ্বর দর্শন কেমন করে হয়?’ শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর দিলেন, ‘চিত্তশুদ্ধি না হলে হয় না। কামিনী-কাঞ্চনে মন মলিন হয়ে আছে, মনের কাদা ধুয়ে ফেললে তখন চুম্বক টানে। মনের ময়লা তেমনি চোখের জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা যায়। ‘হে ঈশ্বর, আর অমন কাজ করব না’ বলে যদি কেউ অনুতাপে কাঁদে, তাহলে ময়লাটা ধুয়ে যায়।
তখন ঈশ্বর রূপ চুম্বক পাথর মনরূপ সুঁচকে টেনে নেন। তখন সমাধি হয়, ঈশ্বর দর্শন হয়।’ এভাবেই দিনে দিনে দক্ষিণেশ্বরের আনন্দ সভায় বিজয়কৃষ্ণ পেলেন পরমানন্দের স্বাদ। বিজয়কৃষ্ণের রক্তে ছিল হরিনাম। প্রতিনিয়ত হরিনাম করতে করতে তাঁর দিব্যদেহ হয়ে উঠল পবিত্রতার প্রতীক। ঢাকা থেকে বেরিয়ে তীর্থ পরিক্রমা সেরে ফিরে এলেন কলকাতায়।
বাংলা ১৩০৪ সালের ফাল্গুন মাসে কলকাতার লীলা সাঙ্গ করে জলপথে তিনি যাত্রা করলেন শ্রীক্ষেত্রে। ভগবান চৈতন্যদেবের লীলাভূমি তাঁকে তখন প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে। শ্রীক্ষেত্রে এসে জগন্নাথ মন্দিরের ধ্বজা দর্শন করেই তিনি ভাবাবেশে মত্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর শ্রীক্ষেত্র লীলায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যই ছিলেন সর্বক্ষণের ধ্যান জ্ঞান। এই শ্রীক্ষেত্রেই ঘটল তাঁর অন্ত্যলীলা।
বাংলা ১৩০৬ সালের (১৮৯৯) ২২ জ্যৈষ্ঠ, রবিবার ঈর্ষাকাতর নরাধমের দেওয়া বিষ মাখানো লাড্ডু খাওয়ার দুঃসহ পরিণামে তিনি অনন্তধামে যাত্রা করেন।
…………………………
আরও পড়ুন-
শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী
লোকনাথ বাবার বাল্যসখা বেণীবাধব ব্রহ্মচারী : পর্ব এক
লোকনাথ বাবার বাল্যসখা বেণীবাধব ব্রহ্মচারী : পর্ব দুই
লোকনাথ বাবার বাল্যসখা বেণীবাধব ব্রহ্মচারী : পর্ব তিন
বিজয়কৃষ্ণ
মহাযোগী শ্রীশ্রী তৈলঙ্গস্বামী
ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কিছু কথা
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….